সেই বাড়িটা
রামানুজদের বাড়িটা সমুদ্র থেকে দূরে নয়, বাড়ি থেকেই সমুদ্রের নীল জল, বড়ো বড়ো ঢেউ, এসব দেখা যায়। বাড়ি বলতে একটা গোটা বাংলো। ওপরটা পুরু, দামি, লাল টালিতে ছাওয়া। খাঁজকাটা লাল ইটের দেওয়াল। শ্বেতপাথরের মেঝে। বড়ো বড়ো চারটে ঘর, খাবার ঘর, রান্নাঘর, দুটো চানের ঘর, সেখানে আধুনিক সুব্যবস্থা সব আছে। পোশাক বদলাবারও একটা ঘর আছে, ইংরেজরা যাকে বলে ড্রেসিং রুম।
রামানুজের বাবা একটা নামি কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর হয়ে নতুন এখানে এসেছেন। আগে এটা ছিল বিলিতি কোম্পানি। সাহেব ছাড়া কেউ ওই পদে যোগ্য বলে বিবেচিত হতেন না। এখন যুগের হাওয়া বদলেছে, সাহেবরাও বিদায় নিয়েছে অনেকদিন। এই বাংলোটা বড়োসাহেবের জন্যেই নির্দিষ্ট।
রামানুজের একটাই অসুবিধা। আশেপাশে বাড়ি থাকলেও কম, সেখানে ওর বয়সি কোনো ছেলে নেই যার সঙ্গে খেলবে। তাই একা একাই ও একটা ফুটবল নিয়ে বাড়ির সামনে খেলা করে। ওর মা-বাবা পইপই করে বলে দিয়েছেন ও যেন একা একা কখনো সমুদ্রের ধারে না যায়। বড়ো বড়ো ঢেউ অনেক সময় বেলাভূমিতে আছড়ে পড়ে ফিরে যাবার সময় সামনে যা পায় টেনে নিয়ে যায়। মানুষকেও রেহাই দেয় না। এখানকার সমুদ্র খুব রাফ, চোরা ঢেউ বিপজ্জনক। দক্ষ সাঁতারু আর ওই ঢেউয়ের মতিগতি যাদের বিলক্ষণ জানা, তারাই শুধু নিরাপদ।
ওদের বাংলো থেকে একটু দূরে, বাঁ-দিকে, একটা পুরোনো দোতলা বাড়ি রামানুজের চোখে পড়েছে। দোতলা বাড়ি, কিন্তু মনে হয় অনেকদিনের পুরোনো। বালি, সুরকি, সিমেন্ট সব খসে পড়ে শুধু ইটগুলোই অবশিষ্ট আছে, সমুদ্রের হাওয়ায় তাতেও নোনা ধরেছে। একটা পুরোনো গেট কোনোরকমে দাঁড়িয়ে আছে, জানলার কাঠামোই আছে, বেশিরভাগেরই কাচ নেই। এ অঞ্চলে বাড়িটা কেমন যেন বেমানান, কেউ থাকে বলেও মনে হয় না। বাড়িটার ধারেকাছে আর কোনো বাড়ি নেই।
জায়গাটা বেশ ফাঁকা আর নির্জন তাই রামানুজ খেলার জন্যে এ জায়গাটাই বেছে নিয়েছে। খেলা মানে বল নিয়ে ছুটোছুটি আর একা একা ড্রিবলিং করা। ফুটবল ওর প্রিয় খেলা।
ইস্কুল থেকে ফিরে জলখাবার খেয়েই ও বল নিয়ে এখানে চলে আসে। এখানে সাতটার আগে সূর্য অস্ত যায় না, তাই খেলার সময়টাও বেশি। ওর বয়স তেরো।
সেদিন বল নিয়ে অনেকক্ষণ কসরত করার পর ও হাঁপিয়ে উঠেছিল, শরীর ঘেমে গেছে। বলটা পায়ের কাছে রেখে মাটিতে বসে ও জিরোচ্ছিল। তখনও সূর্য অস্ত যেতে বেশ কিছু সময় আছে।
হঠাৎ ও চমকে উঠল। পুরোনো বাড়িটার গেটের ওপর দু-হাত রেখে ওর বয়সি একটি ছেলে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। গেটটা ছোটো, তাই অমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে, চিবুক দু-হাতের ওপর। ছেলেটার গায়ের রং একটু তামাটে, কালো কোঁকড়া চুল আর ডাগর ডাগর দুটো চোখ। ও তাকাতেই ছেলেটির মুখে ফুটে উঠল মিষ্টি এক টুকরো হাসি।
রামানুজেরও বেশ কৌতূহল হল। কয়েকদিন ধরেই বাড়িটা ও দেখছে। সদর দরজা সবসময় বন্ধই থাকে, দোতলার বেশিরভাগ কাচহীন জানলাও বন্ধ, বাড়িতে কেউ থাকে বলে ওর মনে হয়নি। হঠাৎ এই ছেলেটা এল কোথা থেকে!
ও উঠে দাঁড়িয়ে গুটিগুটি এগিয়ে গেল, তারপর ছেলেটির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, তুমি এ বাড়িতে থাক?
ছেলেটি ঘাড় দোলাল।
আমার নাম রামানুজ…রামানুজম পিল্লাই, তোমার নাম?
র্যামন ডিসুজা, ছেলেটি মৃদু হাসল, সবাই আমাকে রাম বলে।
র্যামন থেকে রাম! রামানুজও হাসল, আমাকেও আমার মা-বাবা রামু বলে ডাকেন। তুমি খেলবে আমার সঙ্গে?
হ্যাঁ, রাম ঘাড় কাত করল।
ওরা পরস্পরের থেকে অনেকটা তফাতে মুখোমুখি দাঁড়াল, তারপর দু-জনে দু-জনের দিকে বলে শট মারতে লাগল। একজন মারে অন্যজনে ফেরায়।
এভাবে কিছুক্ষণ খেলার পর সূর্য অস্ত গেল, তবে অন্ধকার নামতে তখনও কিছু সময় বাকি আছে।
রামানুজ বলল, এবার আমাকে বাড়ি যেতে হবে রাম, মা-র কড়া হুকুম সন্ধের আগেই ফিরতে হবে।
আমার মা-রও কড়া হুকুম সন্ধের পর বাইরে থাকা চলবে না, রাম বলল, কাল তুমি আসবে তো রামু?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, কাল অনেকক্ষণ খেলব।
রামানুজ বাড়ির পথ ধরল। ওর মন আজ বেশ খুশি, একজন খেলার সঙ্গী পাওয়া গেছে। একা একা কতদিন খেলা যায়!
রাত্তিরে খেতে বসে মাকে রামের কথা বলল ও। র্যামন থেকে রাম, বলেই ও হাসতে লাগল। ওর মা-ও হেসে ফেললেন, তারপর বললেন, ভালো ছেলে তো? আজেবাজে ছেলে হলে মিশবে না।
না, ও খুব ভালো ছেলে, রামানুজ মাকে আশ্বস্ত করল।
রামকে কেমন যেন দুঃখী দুঃখী মনে হয়েছিল ওর। সেকথা কিন্তু ও মাকে বলল না।
পরদিন বিকেলে রামদের বাড়ির সামনে গিয়ে ওকে দেখতে পেল না রামানুজ। সদর দরজা যেমন বন্ধ থাকে তেমন বন্ধই আছে। ও আশা করেছিল রাম ওর জন্যে বাইরে অপেক্ষা করবে। একটু হতাশই হল ও।
কী আর করা যাবে! ও একাই বল পেটাতে লাগল। একবার উঁচু করে বল মেরে ও ছুটে যাচ্ছিল বলটার কাছে, কে যেন বলে উঠল, লিভ ইট।
রামানুজ চমকে থমকে দাঁড়াল। তারপরই দেখল রামু বুক দিয়ে বলটা মাটিতে নামাচ্ছে।
আরে তুমি কখন এলে! ও অবাক হয়ে বলল, তোমাকে আসতে দেখিনি তো!
তুমি ওপরে বলের দিকে তাকিয়ে ছিলে তাই দেখনি, রাম হাসি হাসি মুখে বলল।
হবেও-বা, রামানুজ মনে মনে ভাবল, কিন্তু ওর মনটা কেমন খুঁতখুঁত করতে লাগল।
দু-জনে অনেকক্ষণ খেলল। পরে মাটিতে পাশাপাশি বসে জিরোতে জিরোতে রামানুজ বলল, তোমাদের বাড়িটা ভীষণ পুরোনো, কত জায়গায় ভেঙে গেছে, সারাও না কেন!
রামের মুখে একটা ম্লান ছায়া পড়ল, ও বলল, আমার বাবার ব্যাবসা এখন ভালো যাচ্ছে না, অনেক ধার-দেনা হয়েছে, তাই বাড়ির দিকে নজর দিতে পারছেন না।
রামানুজের মনে হল, একথাটা বলা ওর উচিত হয়নি, ওর বন্ধু বোধ হয় মনে দুঃখ পেয়েছে। প্রসঙ্গটা বদলাবার জন্য ও বলল, আমি ভেবেছিলাম এ বাড়িতে কেউ নেই, সবসময় বন্ধ থাকে।
রাম কোনো জবাব দিল না।
তোমার মা-র কথা কিছু বললে না তো! রামানুজ আবার বলল।
আমার মা খুব রাগী, আমি মাকে খুব ভয় করি, রাম জবাব দিল। একটু থেমে ও বলল, আমার মা কিন্তু আমাকে র্যামন ছাড়া অন্য নামে ডাকেন না।
এভাবেই দিনগুলো কাটছিল।
রামানুজ লক্ষ করেছিল, ও কখনো রামকে আগে থেকে ওর জন্য অপেক্ষা করতে দেখেনি, সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ আগে ছাড়া ওর দেখা পাওয়া যেত না। তাও যখন আসত, ওকে চমকে দিয়েই যেন আবির্ভাব ঘটত ওর। যেন মাটি ফুঁড়ে হাজির হয়েছে।
ব্যাপারটা যাচাই করার জন্য একদিন ও বাড়িটার সামনে মাটিতে বসে ছিল, চোখ ছিল সদর দরজার দিকে। কখন রাম আসে সেটা ও নিজের চোখে দেখবে।
নিবিষ্ট মনে ও অপেক্ষা করছিল, তারপরই রামের গলা শুনে ও থ বনে গেল। রোজ যেখানে ও দাঁড়ায়, সেখানে দাঁড়িয়ে ও বলল, কী হল, বসে আছ যে! খেলবে না?
তোমাকে তো বাড়ি থেকে বেরুতে দেখলাম না, রামানুজ ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি কোথা থেকে এলে!
আমি বেরিয়েছিলাম, বাড়ি থেকে তো আসিনি, ওর মুখের হাসিটা লেগেই ছিল।
রামানুজ এর পর আর এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন করেনি।
একদিন শুধু বলেছিল, তোমাদের বাড়িতে আমাকে নিয়ে যাবে না?
যাবে! রামের দু-চোখে একটা যেন সংশয়ের ছায়া পড়েছিল, ঠিক আছে, কাল নিয়ে যাব।
পরদিন রামানুজকে ও বাড়ির ভেতর নিয়ে গিয়েছিল। তখনও দিনের আলো ছিল তবু ভেতরটা অন্ধকার অন্ধকার। তার মধ্যেও রামানুজের মনে হয়েছিল ঘরগুলো ধুলো-মলিন। চারদিকে যেন একটা বিশৃঙ্খলা।
তোমাদের ঘরে এত ধুলো কেন! ও নাক চেপে বলেছিল, মনে হয় অনেকদিন ঝাঁট পড়েনি। জানলাগুলো সব খুলে দিলে আলো-বাতাস আসে।
তুমি ঠিকই বলেছ, রাম অপরাধীর মতো বলেছিল, আসলে বাড়িঘরের দিকে তাকাবার মতো আমার বাবার মনের অবস্থা নেই।
তোমার মা তো এদিকে নজর দিতে পারেন, রামানুজ বলেছিল, ঘরদোর পরিষ্কারের ব্যাপারে আমার মা-ই তো সব দেখাশোনা করেন, আমার বাবা নাকই গলান না।
আমার মা তেমন নন, রামের মুখ যেন ম্লান হল, বাবার জন্য আমার খুব কষ্ট হয়।
রামানুজ সেদিন ভারাক্রান্ত মনে বাড়ি ফিরেছিল।
দু-দিন পরে রাম নিজে থেকেই রামানুজকে বাড়ির ভেতর নিয়ে গিয়েছিল। সেদিন কিন্তু ঘরগুলো পরিষ্কার লেগেছিল, সব জানলাও খোলা, আলো আসছিল ভেতরে।
রামানুজ খুশি হয়ে বলেছিল, কে পরিষ্কার করল এমন!
আমি করেছি, গর্বের সঙ্গে জবাব দিয়েছিল রাম।
তুমি! রামানুজ অবাক হয়েছিল। ওর বয়সি একটি ছেলের পক্ষে এমন কাজ করা সহজ ব্যাপার নয় তা বুঝতে ওর কষ্ট হয়নি।
তোমার মা-বাবাকে তো একদিনও দেখলাম না, রামানুজ বলেছিল।
সামনেই দু-ধাপ সিঁড়ি দোতলায় চলে গেছে, সেদিকে তাকিয়ে রাম একটু যেন ভয়ে ভয়েই বলল, ওঁরা ঘুমুচ্ছেন।
এই অবেলায়! রামানুজ অবাক কণ্ঠে বলেছিল।
রাত্তিরে ওঁদের ভালো ঘুম হয় না, তাই দিনে ঘুমোন।
তা বলে এই অবেলায়! রামানুজ মনে মনে ভাবল, এমন ঘুমোলে কাজকর্ম করেন কখন! সাধে কি আর ব্যাবসা ভালো চলছে না রামের বাবার!
একথা অবিশ্যি ও রামকে বলল না।
কিন্তু আশ্চর্য, রাম বোধ হয় ওর মনের কথা বুঝতে পারল, বলল, ব্যাবসায় আর কিছু করার নেই বাবার। আমাদের আরও একটা বাড়ি আর জমিজমা ছিল, ধার-দেনা মেটাতে সব বিক্রি হয়ে গেছে, শুধু এই বাড়িটাই আছে। দুশ্চিন্তায় বাবার রাত্তিরে ঘুম হয় না।
রামানুজ অবাক না হয়ে পারল না। ওর মনে যে প্রশ্নটা জেগেছিল তার জবাব ও পেয়ে গেল। কিন্তু ওর মনে যে এই প্রশ্নটাই এসেছিল তা রাম বুঝতে পারল কেমন করে।
আরও একটা ব্যাপার লক্ষ করেছে রামানুজ। বাবার কথা বলতে যেমন আবেগজড়িত হয়ে পড়ে রাম, মা-র বেলায় তেমন নয়।
আরও কয়েকদিন কেটে গেল, এর মধ্যেই ওই বাড়িতে আর যায়নি রামানুজ।
সেদিন রাম বলল, আজ তোমাকে একটা জিনিস দেখাব।
ওকে ও বাড়ির ভেতর একটা ঘরে নিয়ে গেল। এ ঘরে আগে কখনো আসেনি রামানুজ। একটা সিঙ্গল খাট, একটা টেবিল আর দুটো চেয়ার ছাড়া ঘরে আর কোনো আসবাব ছিল না। টেবিলের ওপর বই-খাতা গোছানো রয়েছে।
এটা আমার ঘর, রাম বলল।
এখানেই বুঝি তুমি পড়াশোনা কর?
হ্যাঁ। তারপর একটা লম্বা খাতা বের করে রামানুজের হাতে দিয়ে বলল, পড়ে দেখো।
রামানুজ উলটেপালটে দেখল, ইংরেজিতে লেখা কয়েকটা গল্প।
তুমি লিখেছ! রামানুজ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
রাম সলজ্জভাবে ঘাড় দোলাল।
রামানুজ পড়তে লাগল। এক কিশোরের উচ্চাকাঙ্ক্ষার কাহিনি, নানান বিপর্যয়ের মধ্যেও সে মাথা উঁচু করে চলতে চায়। পড়তে পড়তে রামানুজের মনে হল এ যেন রামের নিজের জীবন কাহিনি।
ও তন্ময় হয়ে পড়ছিল। এদিকে সূর্য অস্ত গেছে কিছুক্ষণ, একটু একটু করে অন্ধকার নেমে আসছে।
আলো জ্বালিয়ে দাও, রামানুজ বলল, পড়তে অসুবিধে হচ্ছে।
ইলেকট্রিক কোম্পানি লাইন কেটে দিয়েছে, কুণ্ঠিতভাবে বলল রাম, দাঁড়াও, আমি একটা মোমবাতি জ্বালি।
তারপরই যেন ভীষণ চমকে উঠে দাঁড়াল ও। রামানুজ ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখল ঘরে আরেকজন মানুষের উপস্থিতি ঘটেছে। একজন ভদ্রমহিলা। ছোটো করে চুল ছাঁটা, গায়ে একটা সিল্কের গাউন মতো পোশাক, তবে বিবর্ণ হয়ে গেছে। দু-চোখে কেমন যেন একটা খর দৃষ্টি।
রামের দিকে তাকিয়ে দেখল ও যেন ভয়ে কুঁকড়ে গেছে। ইনিই তবে ওর মা! দেখেই মনে হয় খুব রাগী মহিলা। র্যামন, হু ইজ হি? খ্যাসখ্যাসে গলায় তিনি জিজ্ঞেস করলেন।
আমার বন্ধু, মিনমিনে গলায় জবাব দিল রাম।
তুমি জান না, তোমার বন্ধুদের এ বাড়িতে আসা আমি পছন্দ করি না।
রাম মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে রইল।
যাও, বাইরে নিয়ে যাও ওকে।
রামানুজের খুব অপমান বোধ হল। ও রামের অপেক্ষা না করেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। রামও পেছন পেছন এল কিন্তু রামানুজ ফিরেও তাকাল না। গট গট করে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল।
ওর দু-কান ঝাঁ ঝাঁ করছিল। কেমন মানুষ রামের মা, এতটুকু ভদ্রতা বোধ পর্যন্ত নেই! এই জন্যেই বোধ হয় যে কয়বার ও ওই বাড়িতে গেছে, অন্ধকার হবার আগেই রাম ওকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছে যাতে ওর মা-র সঙ্গে দেখা না হয়। আজ রামের গল্পটা পড়তে পড়তে সময়ের ব্যাপারটা খেয়াল ছিল না আর তার ফলেই ঘটল এমন বিচ্ছিরি কাণ্ডটা।
ও আর এখানে আসবে না, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল।
দিন দশেক কেটে গেছে। রামানুজ এ ক-দিন ও বাড়িমুখো হয়নি।
তারপরই ওর মন গলতে শুরু করল। রামের কী দোষ! ও তো সরল মনেই ওকে বাড়ির ভেতর নিয়ে গিয়েছিল। ওর মায়ের ব্যবহারের জন্য ও দায়ী হবে কেন!
বলটা নিয়ে সেদিন বিকেলেই আবার ও ওই বাড়িটার পথ ধরল। অনেকক্ষণ একা একাই বল নিয়ে ও ছুটোছুটি করল কিন্তু রাম এল না। হয়তো ওর অভিমান হয়েছে কিংবা মা-র ভয়ে বেরুচ্ছে না।
সূর্য অস্ত গেল। আশাহত হয়ে বসে পড়ল রামানুজ। রাম কি টের পায়নি ও এসেছে, কিংবা হয়তো বাড়ি নেই ওর বন্ধু।
আস্তে আস্তে নেমে আসছে অন্ধকার। নির্জন ওই জায়গায় পুরোনো রংচটা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন গা ছমছম করছিল রামানুজের। তারপরই ও চমকে উঠল। একজন মানুষ ওর সামনে দাঁড়িয়ে। মনে হয় না বয়স খুব বেশি, কিন্তু চুল সব পেকে গেছে। পোশাকে পারিপাট্য নেই কিন্তু চোখে-মুখে একটা স্নিগ্ধ ভাব। দিনের আলো ক্রমেই কমে আসছে।
ভদ্রলোক ওর পাশে বসে পড়লেন, বললেন, একা একা এখানে বসে আছ কেন?
আমি আমার বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছি, রামানুজ জবাব দিল।
তোমার বন্ধু! ভদ্রলোক একটু কৌতূহলী হয়ে বললেন, কোথায় থাকে? কী নাম তার?
ওই সামনের বাড়িতে থাকে, রামানুজ বলল, আমার নতুন বন্ধু, নাম র্যামন ডিসুজা, সবাই ওকে রাম বলে ডাকে।
ভদ্রলোক একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লেন, বললেন, তোমার বোধ হয় মস্ত একটা ভুল হয়েছে।
ভুল! কীসের ভুল! রামানুজ একটু অবাকই হল।
ও বাড়িতে কেউ থাকে না, ভদ্রলোক আস্তে আস্তে বললেন, কুড়ি বছর আগে সব শেষ হয়ে গেছে।
কী বলছেন আপনি! রামানুজ এবার অধৈর্য কণ্ঠে বলল, আপনার কথা আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
তবে শোনো, ভদ্রলোক বললেন, সে এক দুঃখের কাহিনি। এই বাড়িতে মি ডিসুজা তাঁর স্ত্রী আর ছেলে র্যামনকে নিয়ে বাস করতেন। র্যামন একটা মিশনারি স্কুলে ক্লাস এইট-এ পড়ত। ক্লাসের ও ছিল ফার্স্ট বয়, খেলাধুলাতেও ভালো ছিল আর স্বভাব ছিল আখের রসের মতো মিষ্টি। মি ডিসুজা ছিলেন ক্লথ মার্চেন্ট, কাপড়ের ব্যবসায়ী। ব্যাবসা ভালোই চলছিল, অভাব ছিল না। সংসারে একটাই ছিল কাঁটা। র্যামনের মা, মিসেস ডিসুজা ছিলেন ভীষণ মেজাজি আর অবুঝ। সবসময় সেরা জিনিসের ওপর ছিল তাঁর নজর। যতক্ষণ না মনের মতো জিনিসটা হাতে এসেছে তিনি শান্ত হতেন না। ছেলেকে তিনি বড্ড বেশি শাসন করতেন, বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে দিতেন না। বাড়িতে কোনো বন্ধুকে নিয়ে আসার অনুমতি ছিল না। একমাত্র বাবার কাছেই ও পেত স্নেহ ও সান্ত্বনার আশ্রয়।
ছেলেটা মায়ের ভয়ে জুজু হয়ে থাকত। অথচ ওর অনেক গুণ ছিল। ভালো গল্প লিখত। ওর গল্প ওদের ইস্কুলের ম্যাগাজিনে এমনকী এখানকার ইংরেজি খবর কাগজে ছোটোদের বিভাগে ছাপা হয়েছিল। ওর খুব শখ ছিল বড়ো হয়ে একজন সাহিত্যিক হবে।
এদিকে মি ডিসুজা একটা বড়ো লেনদেন-এর ব্যাপারে খুব ক্ষতিগ্রস্ত হলেন। তাঁর এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ই তাঁর সঙ্গে প্রবঞ্চনা করল। মি ডিসুজা মুষড়ে পড়লেও সামলে ওঠার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু মিসেস ডিসুজার দাবি মেটাতে গিয়ে তিনি সামলে উঠতে পারলেন না। ধারদেনায় যখন তিনি দিশেহারা তখনও মিসেস ডিসুজা অবুঝের মতো দামি জিনিসের জন্য বায়না করে চলেছেন। যখন-তখন মোটা টাকার দাবিতে অশান্তি করছেন।
এ নিয়ে একদিন চরম অশান্তি হল। মিসেস ডিসুজার সেদিনের কথাগুলো মি ডিসুজার বুকে ভীষণ আঘাত করল। তিনি মনস্থির করে ফেললেন। পরদিন রাতের খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে র্যামন আর মিসেস ডিসুজাকে চিরকালের জন্য তিনি ঘুম পাড়িয়ে দিলেন তারপর নিজে গলায় দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়লেন। এ হল কুড়ি বছর আগের ঘটনা। তারপর থেকে এ বাড়িতে কেউ বাস করে না।
আপনার গল্প আমি বিশ্বাস করি না, রামানুজ প্রতিবাদ করে বলল, রাম আর ওর বাবার মধ্যে চমৎকার একটা সম্পর্ক ছিল, ওর কথাবার্তা থেকেই আমার তা মনে হয়েছিল। সেই ছেলেকে মি ডিসুজা কখনোই বিষ দিতে পারেন না।
সাধে কি আর দিয়েছিলেন! ভদ্রলোক ফোঁস করে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন, তাঁর অবর্তমানে ছেলে ভেসে যাবে, পথের ভিখিরির মতো ভিক্ষে করে জীবন কাটাবে, এটা তিনি হতে দিতে চাননি।
আপনি কে? কোথায় থাকেন? বেশ উত্তেজিতভাবেই বলে উঠল রামানুজ, এসব কথা আপনি জানলেনই-বা কেমন করে?
ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন, রামানুজও তাই করল।
অন্ধকারে এখন আর ভদ্রলোকের মুখ দেখা যাচ্ছে না, শুধু তাঁর উপস্থিতি টের পাচ্ছে রামানুজ।
আমি…, ভদ্রলোক একটু থামলেন, তারপর মৃদু কণ্ঠে বললেন, আমি এখানেই থাকি। আর আমার চাইতে এই ঘটনা বেশি কেউ জানবে কেমন করে! আমিই যে র্যামনের বাবা, মি ডিসুজা।
তারপরই তিনি মিলিয়ে গেলেন অন্ধকারে।
রামানুজ হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। ওর সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে গেছে। তারপরই ও দৌড় মারল। ভীষণ ভয় পেয়ে প্রাণের তাগিদে মানুষ যেমন দৌড়োয়, তেমন দৌড়। দরদর করে ও ঘামছে।
ওর বলটা পড়ে রইল ওই বাড়ির সামনে। ওটাই যেন ঘটনার একমাত্র সাক্ষী।