সেই দিন সেই রাত
কোনো এক সময় বাড়িটার রং ছিল হলদে। কার্নিসে টানা ছিল লালের বর্ডার। বছরের পর বছর জলে ভিজে, রোদে পুড়ে এখন যে কী রং দাঁড়িয়েছে, সাধারণ মানুষ বলতে পারবেন না। ফুটো নল বেয়ে দেওয়ালের গা দিয়ে যেদিকটায় অনবরত বর্ষার জল পড়ে, সেদিকটায় ছোপ ছোপ কালো। যে দিকটায় রোদ বা জল কম লাগে, সেদিকটা জনডিসের চোখের মতো হলদেটে। সবচেয়ে বাহারি হল সামনের বা সদরের দিকটা। ওই দিকটা দক্ষিণ। হাওয়ার দিক। বাতাসের লেজের ঝাপটায় এখানে-ওখানে পলেস্তারা খসে ইট বেরিয়ে পড়েছে। যেন দাঁত বের করে হাসছে। দোতলায় খড়খড়ি জানালা। বহুকাল রঙ না পেয়ে শুকনো ঝনঝনে। চারটে মাঝারি আকৃতির থামের ওপর তিনতলার ছাদ। থামওলা বাড়ি মানেই পুরোনো বাড়ি। হ্যাঁ পুরোনো বাড়িই। ঐতিহাসিক বাড়ি বলতেও আপত্তি নেই। যতীশবাবুর বাবার বাবা কোম্পানির আমলে এ বাড়ি কিনেছিলেন। বাড়ির নাম ছিল ‘ডাচকুঠি’। এই জায়গাটা ইতিহাসের কোন এক সময়ে দিনেমারদের দখলে ছিল; সেই সময় এই বাড়ি তৈরি হয়েছিল ডেনিশ শাসকদের কর্মচারীদের জন্যে। দিনেমাররা নেই। ইংরেজ বিতাড়িত। যতীশবাবুর ঊর্ধ্বতন তিনপুরুষ শেষ। ‘ডাচকুঠি’-র মালিক এখন যতীশবাবু এবং তাঁর নিজের কেরামতি বৃহৎ এক পরিবার।
দক্ষিণের বড়ো রাস্তার পশ্চিম মাথাটা সোজা গঙ্গায় গিয়ে পড়েছে। পুব মাথাটা চলে গেছে বাস রাস্তার দিকে। বাসে খাস কলকাতা ঘণ্টা-খানেকের পথ। লাট ভবন থেকে যতীশবাবুর ঐতিহাসিক বাড়ি বারো কি চোদ্দো মাইল। একটানা তিরিশ বছর সরকারি সেরেস্তায় চাকরি করে যতীশবাবু সবে অবসর নিয়েছেন। সামান্য পেনসন, সামনে সারি সারি মুখ। যতীশবাবু যে সময় সংসারী হয়েছিলেন যে সময় ছোটো পরিবারের কথা কানে ফানেল দিয়ে এখনকার মত ঢেলে দেবার প্রথা চালু হয়নি। সস্তাগন্ডার বাজার। পৈতৃকবাড়ি, সরকারি চাকরি। বেড়ে যাও, বাড়িয়ে যাও মনের আনন্দে। প্রথমে এল বড়ো ছেলে সমীর, তারপরই এল মেজো তিমির, সেজো মিহির, মেয়ে অলকা। এখানেই পূর্ণচ্ছেদ হলে মন্দ হত না। কিন্তু জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ মানুষের হাতে নেই। প্রায় বৃদ্ধ বয়সে যতীশ সর্বশেষেরটিকে পেলেন, শিশির। স্ত্রী মনোরমার শরীর তখন প্রায় ভেঙে এসেছে। শিশিরের গুঁতোয় তিনি একেবারেই গুঁড়িয়ে গেলেন। অ্যানিমিয়া, অ্যালার্জি, অম্বল, বদহজম, হাঁপানি। অসুখের সাঁড়াশি আক্রমণ। যতীশবাবু অবশ্য শক্তই আছেন। চুল পেকেছে। দাঁত গেছে। রাতে অনিদ্রা। তাহলেও সাবেক আমলের ঘি-দুধ খাওয়া শরীর শক্ত ভিতের বাড়ির মতো খাড়া আছে। বেশ বোঝাই যায় ভাঙবেন তবু মচকাবেন না।
দোতলার দক্ষিণের ঘরের লাল মেঝে জায়গায় জায়গায় চটে গেলেও ঘরটি বেশ বড়ো। অনেকটা হলঘরের মতো। একটু লম্বাটে। বাড়ির দক্ষিণে এক চিলতে খেলার মাঠ। ফলে দক্ষিণটা ফাঁকাই বলা চলে। জানলা খুলে রাখলে সারি সারি নারকেল গাছ, গোটা কতক ঢেঙা বাড়ি, একটা টেলিভিশান অ্যান্টেনা চোখে পড়ে। রাতে ঘুম না এলে জানলার দিকে চেয়ার টেনে এনে আকাশ দেখেন, ঝাপসা গাছ দেখেন, তারা দেখেন আর স্ত্রীর শাসকষ্ট শোনেন। যৌবনের কথা ভাবেন। মাঝে মাঝে মনে হয় যতীশ যেন বলির পাঁঠাটি। চান করে, সিঁদুর মেখে বসে আছেন। হাড়িকাঠ চোখে পড়ছে। মৃত্যুর আনাগোনা টের পাচ্ছেন। ঘাড়ের কাছে-কোপটা পড়লেই হয়।
পশ্চিমের জানলা ঘেঁষে সাবেক আমলের বাঘ থাবা পেল্লায় খাট। এক পাশে বালিশের থাক, চাদর-ঢাকা। মাথার ওপর গোটানো মশারি। একটা প্রান্ত একটু বেসামাল হয়ে ঝুলে আছে। শীত এলো বলে। চামড়া খসখসে হতে শুরু করেছে। পায়ের নীচের দিকটা মাঝে মাঝে চুলকে ওঠে। চুলকোলেই খড়ি ফোটে। মনোরমার হাঁপানি বেড়েছে। শীতের মুখটায় বাড়ে। আর একবার বাড়ে যাবার সময়। মনোরমা ছোটো একটা ফুলঝাড়ু দিয়ে বসে বসে ঘর ঝাঁট দিচ্ছেন। মাঝে মাঝে থেমে পড়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন। যতীশবাবু জামা পরতে পরতে বললেন, ‘কেন ধূলো নাকে নিচ্ছে বল দিকিনি। রাখো না। বাজার থেকে এসে আমি দিয়ে দেবো। বললে শোনো না কেন?’
মনোরমা হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘একটু এগিয়ে রাখি। তোমার তো আবার কোমরে বাত।’
—বাত আর হাঁপানিতে অনেক তফাত। ধুলো হল তোমার যম। যা বলি শোনো। সারা জীবনেই তো অবাধ্যতা করে এলে। শেষ কালটা একটু কথা শোনো না। শুনেই দেখো না!
—তুমিও তো ভারি বাধ্য ছিলে। চিরটাকাল ডাইনে যেতে বললে বাইনে যাও, বাইনে বললে ডাইনে। হাঁপানি বললে তো সংসার ছেড়ে দেবে না। বাত বলে কী তুমি বাজার করা থেকে নিষ্কৃতি পাবে?
—না, তা বোলো না। ছেলেদের বললেই করে দেবে। তবে কী জান, ঠিক পছন্দ হয় না।
—তবে শুনবে! তোমার ঝাঁটও আমার ঠিক পছন্দ হয় না। তুমি ধুলো ঠিক টানতে পারো না। তোমার অবশ্য দোষ নেই। চোখে কম দেখো।
যতীশবাবুর জামা পরা হয়ে গেছে। কথা বলতে বলতেই পুবের দেওয়ালে ঝোলানো সেকেলে আয়নায় মাথার চুল ঠিক করে নিয়েছেন। উত্তরের টেবিলে রাখা একটা বড়ো কৌটো খুলে একগুলি চ্যবনপ্রাশ নিয়ে স্ত্রীর দিকে এগিয়ে গেলেন।
—না মরলে হাত থেকে যখন ঝাঁটা আর ন্যাতা খসবে না তখন হাঁ করে গুলিটা মুখে ফেলেদি।
মনোরমা বাধ্য মেয়ের মতো হাঁ করলেন। পরনে লালপাড় শাড়ি। পাকা চুলের সিঁথিতে মোটা সিঁদুর। মুখখানি শীর্ণ হলেও ভারী উজ্জ্বল। টিকোলো নাকে ছোট্ট একটি মুক্তোর নাকছাবি।
—কত তাড়াতাড়ি তুমি বুড়ি হয়ে গেলে, আমি কিন্তু দেখো এখানে জোয়ান আছি। গুলি দেখেছো! যতীশ হাত ভাঁজ করে ওপর বাহুর গুলি দেখালেন। মনোরমা মেঝেতে থেবড়ে বসে স্বামীর কেরামতি দেখলেন হাসি হাসি মুখ করে। ঝাড়ুটা হাতে তুলে নিতে নিতে বললেন, ‘হ্যাঁ এখনো নবকাত্তিকটি হয়ে আছ, চুলে একটু কলপ লাগিয়ে পিঁড়েতে আর একবার বসিয়ে দিলেই হয়। রাজি থাক তো বল, পাত্রীর সন্ধান করি।
মানিব্যাক থেকে টাকা বের করতে করতে যতীশবাবু বললেন, ‘কুলীন প্রথাটা কে তুলে দিলে বল তো? ওই সর্বনাশটা না করলে তোমার কয়েকটা অ্যাসিসট্যান্ট এনে দিতুম। তুমি বড়ো বউ হয়ে সিংহাসনে বসে বসে হুকুম করতে।’
মনোরমা শব্দ করে একটু হাসলেন তারপর হঠাৎ একটা কবিতার লাইন আবৃত্তি করে ফেললেন, ‘বুঝিবে সে কীসে প্রভু আশীবিষে দংশেনি যারে। বুঝলে, সব কিছুর ভাগ দেওয়া যায় স্বামীর ভাগ মেয়েরা সহজে দিতে চায় না।’
—তা যা বলেছ। সব স্বামীই স্ত্রীদের পাঁঠা। ন্যাজেই কাটো কি মুড়োর দিকে কাটো কারুর কোনো বলার এক্তিয়ার নেই, এজমালি সম্পত্তি। এখন বলো আজকের বাজার কী হবে! পাঁঠা হবে? অনেক দিন তো হয়নি।
—তোমার রেস্তো বুঝে বাজার করবে। চককোবত্তিরা তো খেয়েই ফতুর। তোমরা খাবে তো নিয়ে এসো, আমার হাঁপানি বেড়েছে, ওসব চলবে না।
—তুমি না খেলে আনব কেন, এক যাত্রায় পৃথক ফল! মাছই হোক। মাছের ঝোল আর ভাত।
চেয়ারের ওপর থেকে পাট করা ব্যাগ তুলে নিয়ে যতীশ বেরিয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার ওষুধ আছে?’
২
অলোকা, অলোকা, অলোকা। ছাদ থেকে সেজো, মিহির চিৎকার করছে। অলোকার সাড়া নেই। মিহির ছাড়বার পাত্র নয়। অলোকার সাড়া না পেয়ে, মা মা বলে চিৎকার করতে শুরু করল। মেজো তিমির নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দার রেলিঙে হাতের ভর রেখে ছাদের দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠল, ‘ষাঁড়ের মতো চেল্লাচ্ছিস কেন? তোর একটা কমনসেন্স নেই। আমার সুর চটকে যাচ্ছে। অলোকা নেই। সকাল থেকে অলোকা মিসিং।’
জিনের হাফপ্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে মিহির ছাদে ব্যায়াম করছে। সেজো হাতের গুলি মাসাজ করতে করতে ছাদের আলসের ওপর কনুইয়ের ভর রেখে বললে, ‘ম্যালা কমন সেনস কমন সেনস করে কপচো না, গলা দিয়ে যার আট রকমের সুর বেরোয় তার সুর আপনিই চটকে আছে, বুঝেছো গোলাম আলি। অষ্ট ধাতুর সঙ্গীতসাধনা। মা-ও কী মিসিং!’
—শাট আপ ননসেনস। বছরের পর বছর ডন বঠকি মেরে ওই তো মর্কটের মত চেহারা। তুই গানের কি বুঝিস রে রাসকেল!
—মেজদা লিমিট ছাড়িয়ে যাচ্ছ কিন্তু, এখনও আমার পঞ্চাশটা ডন বাকি, তা না হলে আমি নীচে নেমে গিয়ে তোমাকে আর তোমার যন্ত্র দুটোকেই ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসতুম।
—আয় নেমে আয় দেখি তোর হিম্মত কত? বাপের ব্যাটা হোস তো নেমে আসবি।
—দু-ছেলের ঝগড়া শুনে মনোরমা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলেন। জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে মেজো ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে ছাদের দিকে তাকালেন।
‘এই যে মা।’ মিহির চিৎকার করে উঠল, ‘কোথায় ছিলে তুমি। আমি জানতে চাই, আমাকে ইনসাল্ট করার অধিকার ওকে কে দিলে? মা আছে, তাই মা, মা বলে ডাকি, এতে ফয়েজ খাঁর অসুবিধে হয় কানে তুলো গুঁজে থাকো।’
—তোমার ওই ছেলেটা মা আনসিভিলাইজড, ব্রুট, দুঃশাসন। চেহারা নেই মাস্তানি আছে। যত ট্যাঁ ফোঁ করে বাড়িতে। যা না যা সাহস থাকে বাড়ির বাইরে গিয়ে হিমমত দেখা। দেখা রাসকেল।
মনোরমা বিব্রত মুখে মেজো ছেলের দিকে তাকালেন। তারপর হাতের ইসারায় দু-জনকে থামতে বলে সেজোকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মা, মা করে চেঁচাচ্ছিস কেন? যা বলার নেমে এসে, কাছে এসে বল না?’
—ও তুমিও দেখছি মেজোর দলে। গান যেন কেউ শেখে না, গান যেন কেউ গায় না! তোমার মেজো ছেলেই একা গাইয়ে। ওরকম গাইয়ে নয়াপয়সায় গন্ডা গন্ডা মেলে। বুঝেছো মাদার।
—শুনছ, শুনছ? এরপর আমি কিন্তু সিরিয়াস অ্যাকসান নেব। জিওগ্রাফি চেঞ্জ করে দেব।
—দাও না দেখি। ক্ষমতা কত। বাবরি চুল রেখে, চিকনের পাঞ্জাবি প’রে মেয়েছেলে ধরার তাল। বুঝি না ভাব তোমার টেকনিক। দেব হাটে হাঁড়ি ভেঙে।
—মিহির, মুখ সামলে। আই সে হোল্ড ইওর টাং।
মনোরমা দু-হাত দিয়ে দু-কান চেপে ধরে রোদ-ঝলসানো আকাশের দিকে মুখ তুলে বললেন, ‘ওঃ ভগবান কবে নেবে আমাকে, আর যে পারি না। ওরে তোরা থাম। সেই জন্মে থেকে তোদের দক্ষযজ্ঞ শুরু হয়েছে। আমি তোদের পায়ে পড়ছি।’
‘কী হল মাসিমা! কার পায়ে পড়ছেন!’ গলা শুনে মনোরমা ফিরে তাকালেন। সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে অনুপ। ভারী সুন্দর চেহারা ছেলেটির। একটু বেঁটে। অদ্ভুত ভালো স্বাস্থ্য। প্রভাতের আকাশের মতো উজ্জ্বল মুখ। দেখলে মনে হয় পৃথিবীটা এদের জন্যেই যেন সুন্দর! অনুপ এই বাড়ির উপকারী বন্ধু। হৃদয়টা যেন সোনা বাঁধানো। সময়ে অসময়ে অনুপ সকলের পাশে, সকলের কাজে। সোস্যাল ওয়ার্কার। পাড়ায় একটা স্টাডি সার্কেল করে সন্ধ্যে থেকে রাত পর্যন্ত বস্তির ছেলে-মেয়েদের বিনা পয়সায় পড়ায়। গুঁড়ো দুধ, পুষ্টিকর খাবার বিলি করে। একটা দাতব্য চিকিৎসালয় খুলেছে। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ নিয়ে সারাদিন চাঁদা তুলে বেড়ায়। এর মাঝে ছোট্ট একটা চাকরিও আছে। পেশায় আর্টিস্ট। নেশা, কবিতা ও গান লেখা।
ছেলে আর মার মাঝখানে একটু জায়গা করে নিয়ে অনুপ ছাদের দিকে তাকালো। ছাদের আলসেতে মিহিরের স্যান্ডো গেঞ্জি পরা শরীরের ওপর অংশ হাফ বাস্ট ছবির মতো মেঘ ভাসা নীল আকাশে লেপ্টে আছে। অনুপ হাসি হাসি মুখ করে জিজ্ঞেস করল—
—কি ব্যায়ামবীর! শরীর চর্চার সঙ্গে মনের চর্চাও করতে হয় মিহির। কথায় কথায় অত চটে গেলে শরীর ভালো হয় না। পাকিয়ে পাকতেড়ে হয়ে যায়।
—তোমার ওই উপদেশটা তোমার পাশের মালটিকে বলো।
—ছি ছি মিহির দাদাকে কেউ মাল বলে?
—বলে বলে, অনুপ। পয়মালরা ওই ভাষাই ব্যবহার করে। বস্তির ছেলেদের তুমি মানুষ করতে পারবে, পারবে না ভদ্রলোকের ছেলেদের। অনুপ মনোরমার হাত ধরে বললে, মাসিমা ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে আপনি ঘরে যান। আমি রাম-লক্ষ্মণকে মিলিয়ে দিচ্ছি। একজন সুর আর একজন অসুর। সুরাসুরের লড়াই সেই পুরাণের কাল থেকেই চলে আসছে। এ আর নতুন কী!
মনোরমা চলে যাচ্ছিলেন। মিহির ছাদ থেকে ষাঁড়ের মতো চিৎকার করে উঠল—আমার ছোলা! ছোলা ভিজিয়েছ! সকাল থেকে তোমার আদরের মেয়ের টিকি দেখছি না। তিনি সাতসকালে কোথায় চরতে বেরোলেন।
অনুপ ছাদের দিকে মুখ তুলে বললে—তিনি যথাস্থানেই আছেন। তোমার ছোলাও আছে, আদাও আছে। সব ঠিক আছে। খালি নিজে বেঠিক হয়ে যেও না।
মিহির আলসের কাছ থেকে সরে গেল। মাথাটা কেবল তালে তালে লাফাতে লাগল, একটা গোল দড়ি লাফিয়ে উঠছে আবার নেমে যাচ্ছে। মিহিরের স্কিপিং শুরু হয়েছে। দুপদাপ শব্দ।
তিমির করুণ মুখে অনুপকে জিজ্ঞেস করল—কী করা যায় বল তো? একে পুরোনো বাড়ি। প্রতিদিন আধঘণ্টা ধরে ওই দামড়া যদি লাফাতে থাকে, এই ছাদ থাকবে? তুমিই বল এই শব্দে কোনো ভদ্রলোক গান করতে পারে। কতদিন সহ্য করা যায়। কতদিন সহ্য করা যায় এই বাঁদরামি?
অনুপ হাসি-হাসি মুখে তিমিরের হাত ধরে বললে, ‘মেজদা, ওকে এখন কিছু বলা যাবে না। বললেই ব্যাপারটা আরও গোলমেলে হয়ে যাবে। ছেলেটা খারাপ নয়। একটু একগুঁয়ে। আমি শিগগির একটা জিমনাসিয়াম খুলছি। ওকে সেই জিমনাসিয়ামের পান্ডা করে দেব। যা করার ওইখানেই তখন করবে।’
—তাই করো। মাঠের জিনিস মাঠেই হোক, সংগীত তো আর মাঠে করা যায় না। সংগীতের জন্যে একটা নিভৃত ঘরের দরকার হয়। তবে পারবে না তুমি, আমার সাধনায় বাঁশ দেবার জন্যে ও মুখিয়ে আছে।
—তা ভাবছেন কেন তিমিরদা। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই ভালো আছে, সেই ভালোটাকে বের করার জন্যে সাধনা করতে হবে। বাইরে ও তো আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
—তাই না কি! তিমির অবাক হয়ে অনুপের মুখের দিকে তাকাল।
—হ্যাঁ তাই। একটু পরেই ওই ওকেই দেখবেন পাড়ার চায়ের দোকানে বসে আপনাকে আর মান্না দেকে পাশাপাশি রাখছে।
—বলো কী!
—এই! এই হল জগৎ। জগৎ বড়ো আশ্চর্য জায়গা। মানুষে মানুষে সম্পর্ক বড়োই বিচিত্র। চলুন, একটু হবে নাকি? মুড আছে?
—নতুন কিছু বানিয়েছ?
—কাল রাতে অনেকদিন পরে হঠাৎ আটটা লাইন এসে গেল। দু-জনে কথা বলতে বলতে তিমিরের ঘরে। পরিচ্ছন্ন ছোটো একটা ঘর। একপাশে দেয়ালে ঠেসানো ছোটো একটা খাট। খাটে গেরুয়া রঙের পরিপাটি বেডকভার। বিছানার ওপর ঝকঝরে একটা হারমোনিয়াম। সামনে স্বরলিপি লেখা গানের খাতা। কোণে দড়ির ফাঁসে লটকানো তানপুরা। দেয়ালে কয়েকজন বিখ্যাত শিল্পীর ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। একটা বন্ধ জানালার প্যারাপেটে পাথরের ধূপদানিতে ধূপ জ্বলছে। তিমির হারমোনিয়ামে বসল। অনুপ ঝোলা সামলে উলটো দিকে পা ঝুলিয়ে বসল। ঝোলার ভেতর থেকে বেরোলো গানের খাতা—কালো মলাটের মোটা মাঝারি সাইজের ডায়েরি।
—দেখি দাও। তিমির হাত বাড়াল। অনুপ পাতা উলটে ডায়েরিটা তিমিরের হাতে দিল।
—পড়ে দেব, আমার দেবাক্ষর পড়তে পারবেন!
—খুব পারব। তিমির খাতাটা সামনে রেখে ঝুঁকে পড়ল। মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল—কী সুর। ভেবেছ কিছু!
—ভোরের সুর চলবে না মনে হয়। তা না হলে বলতুম আহির ভৈরোঁ, কিংবা ভৈরবী। গানটায় যে কী রস, করুণ কি রুদ্র আপনিই ভালো বুঝবেন। দেশটা একবার ট্রাই করে দেখতে পারেন।
তিমির চোখ বুজিয়ে হারমোনিয়ামের বেলো টিপল। একটু একটু করে সারা বাড়ি সুরে ভরে গেল,
সেই দিন সেই রাত
আছে সেই রজনীগন্ধা
শুধু হারিয়ে গিয়েছে তার
গন্ধটুকু আজ
স্মৃতি যার মরুময় বন্ধ্যা
স্বপনের খেলাঘর ভাঙে স্বপনে
রাখে না অবুঝ মন কভু স্মরণে
পারের খেয়া সে তো থামবে ঘাটে
যখন নামবে সন্ধ্যা।।
ধূপের ধোঁয়া পাকিয়ে পাকিয়ে ওপর দিকে উঠছে। টেবিলের ওপর ফুলদানিতে একগোছা রজনীগন্ধা। একটা দুটো ফুল ডাঁটি থেকে খসে তলায় পড়ে আছে। বাইরে প্রথম শীতের ঝলমলে কমলালেবু রঙের রোদ। তিমির সত্যি বড়ো ভালো গায়। মিষ্টি সুরেলা গলা।
যতীশবাবু বাজার করে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে গান শুনে একটু যেন খুশি হলেন। বাজারের ব্যাগটা চোখের সামনে তুলে ধরে একটু মুচকি হাসলেন। তাঁর এই আপন মনে হাসিটা মনোরমার কাছে ধরা পড়ে গেল। মনোরমা ওপর থেকে নীচে নেমে আসতে আসতে হাসি দেখে জিজ্ঞেস করলেন—হল কী! আপন মনেই হাসছ। বুঝেছি ব্যাগটা ময়লা হয়েছে। শরীরের জন্যে কাচতে পারছি না।
—ধূস, বাজারের ব্যাগ এর চেয়ে কবে ভালো হয়। সে জন্যে হাসিনি গো, হাসছি কেন জান! হঠাৎ দার্শনিক হয়ে গেলুম।
—তার মানে! ছিলে রিটায়ার্ড কেরানি, হঠাৎ হয়ে গেলে দার্শনিক!
—বাজারে গিয়ে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে মাথা গরম হয়ে গেল দাম দেখে। দুটো মুলো, এক কিলো আলু, একফালি লাউ, একটা পুঁচকে কপি, গোটাচারেক করলা, এক আঁটি ধনেপাতা, দুটো পাতিলেবু, ব্যাস বাজেট শেষ, মাছের দিকে আর জল মাড়াতে হল না। ভাবতে ভাবতে আসছি, এভাবে বাঁচা যায় না। ওরে যতীশ, এভাবে বাঁচা যায় না। হঠাৎ তোমার ছেলে আমাকে নবাব বানিয়ে দিলে।
—বুঝলুম না।
—মোটা মাথায় ওসব ঢুকবে না? গানটা শুনছ?
মনোরমা ঘাড় নাড়লেন।
—শুনে কী তোমার মনে হচ্ছে না, ঐশ্বর্য মানিব্যাগে নেই, বাজারের ব্যাগে নেই, ব্যাঙ্কের লকারে নেই, তোমার গলার নেকলেসে নেই, আছে মানুষের মনে, মানুষের প্রতিভায়। এই মুহূর্তে আমি সাজাহাঁ, তুমি আমার মমতাজ।
মনোরমা চোখ বড়ো করে স্বামীর হাত থেকে ব্যাগটা নিলেন, নিতে নিতে বললেন, মিনিট কুড়ি আগে সাজাহান মহলে ঢুকলে দেখতেন তাঁর পোড়ো কেল্লার ছাদে দাঁড়িয়ে স্বয়ং ঔরঙ্গজেব দারার ছিন্ন মুন্ড নিয়ে এইরকম, এইরকম করে নাচাচ্ছে। মনোরমা হাতেধরা ব্যাগটা যতীশের মুখের সামনে বারকতক নাচালেন।
—তার মানে?
—সেজোর ছাদে একসারসাইজ, মেজোর ছাদের তলায় গান। এ বলে আর দেখি, ও বলে আয় দেখি। খুনোখুনি হয় আর কী! শেষে অনুপ এসে তার জাদুদন্ড ঘুরিয়ে চুলোচুলি বন্ধ করে বাড়ির আবহাওয়াটাই পালটে দিলে।
—ও অনুপ, সেই মিরাকল ম্যান! তার কাজ! তার কাজ!
যতীশ সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এলেন। আর হাত খানেক এগোলেই তিমিরের ঘর। পাশেই বাঁক নিয়ে উঠে গেছে ছাদের সিঁড়ি। যতীশ সুরে মশগুল হয়ে এগিয়ে চলেছেন। মিহির প্রায় দমকলের বেগে ছাদের সিঁড়ির শেষ দুটো ধাপ না মাড়িয়েই একলাফে যতীশবাবুর ঘাড়ে পড়তে পড়তে কোনোরকমে সামলে নিল। বুকে অল্প অল্প ঘাম। কাঁধে তোয়ালে। হাফ প্যান্ট। বড়ো বড়ো লোমওয়ালা পা। যতীশবাবু চমকে গিয়েছিলেন—কি রে বাঘে তাড়া করেছে নাকি?
মিহির কাঁচুমাচু মুখে বললে—আজ্ঞে না, ছোলা।
—ছোলা তাড়া করেছে!
—আজ্ঞে না, ছোলা খেতে হবে, ছোলা, তাই একটু তাড়াতাড়ি।
—ছোলা পালাচ্ছে নাকি!
—না পালায়নি, মানে, মা আবার যদি পাখিকে খাইয়ে দেয়!
—একটা আধমরা টিয়া কত ছোলা খাবে!
—ও আপনি জানেন না। আধমরা হলে কী হবে, সারাদিনে আধ সের মেরে দিতে পারে। সব তো ঠুকরে ঠুকরে ফেলে দেবে।
—যা যা, তাহলে দৌড়ে যা।
মিহির আগের মতো বেগে না হলেও প্রায় দৌড়েই নেমে গেল।
যতীশবাবু তিমিরের ঘরের সামনে দাঁড়ালেন। প্রথম অনুপই তাঁকে দেখল, তিমির গানে বিভোর। অনুপ তাড়াতাড়ি খাট থেকে উঠে দরজার কাছে এগিয়ে এল—
—জ্যাঠামশাই, আসুন না, ভেতরে আসুন।
তিমিরও ততক্ষণে গান ছেড়ে উঠে এসেছে। উঠে এসে অনুপের পেছনে দাঁড়িয়েছে। যতীশ একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘আসব! আমি বোধহয় তোমাদের গান ভন্ডুল করে দিলুম।’
তিমির তাড়াতাড়ি বলল, ‘না, না, তা কেন? ভেতরে আসুন না বাবা! আপনি তো আমার ঘরে আসেনই না।’
যতীশ চটি খুলে ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। সাবেক আমলের বাড়ি, উঁচু চৌকাঠ। চৌকাঠ ডিঙোবার জন্যে পা উঁচু করে একটু পড়ে যাবার মতো হলেন। অনুপ তাড়াতাড়ি ধরে ফেলল। তিমির একপাশে সরে দাঁড়ালো। যতীশ ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, ‘থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ। বাঁ-পায়ে চটিটা, বুঝলে অনুপ, জড়িয়ে ধরেছিল। আজকাল তো আর পায়ে ধরার যুগ চলে গেছে। ওই চপ্পলই যা মাঝে-মাঝে জড়িয়ে ধরে। যা: বেটা তোকে ক্ষমা করে দিলুম!’
তিনজন একসঙ্গে হেসে উঠল।
যতীশ সারা ঘরে একবার চোখ বুলিয়ে খুশি খুশি মুখে বললেন, ‘বা: তোমার রুচির প্রশংসা করতে হয়। বেশ পবিত্র করেছ হে। তুমি আজ আমাকে খুব আনন্দ দিয়েছো তিমির। তোমার গান শুনে আমার পুরোনো কালের সব কথা মনে পড়ছিল। গলাটা তোমার বেশ হয়েছে হে। যদি রাখতে পার।
অনুপ বললে, ‘বসুন না জ্যাঠামশাই।’
তিমির একটা চেয়ার এগিয়ে দিল।
যতীশ বসতে বসতে বললেন, যদি রাখতে পার বড়ো অ্যাসেট। তবে দেখো সুর-এ আ যোগ কোরো না। তিমির বুঝতে না পেরে হাসি হাসি মুখে যতীশের দিকে তাকিয়ে রইল।
—বুঝতে পারলে না? যতীশ হেসে ফেললেন—বোসো না দাঁড়িয়ে রইলে কেন।
তিমির, অনুপ বসল যে যার জায়গায়।
—সুরের পেছনে পেছনে আসে সুরা। ওইটাই ভয়।
অনুপ বললে—সে ভয় নেই জ্যাঠামশাই। তিমিরদার কোনো নেশাই নেই। ধূমপান পর্যন্ত করে না।
যতীশ প্রসঙ্গ পালটে বললেন—আমার মধ্যে সামান্য সুর ছিল। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ওর মামার বাড়ির ধারা। বুঝলে অনুপ, রক্তের ধারা বড়ো ভীষণ জিনিস। মানুষ সব নিয়ে আসে। তারপর অনুশীলনে সাধনায় তা স্পষ্টই হয়ে ওঠে।
—আপনি আর বাজান না কেন জ্যাঠামশাই?
—আর বল কেন? অনেকদিন ছেড়েছুড়ে দিয়েছি। হাতের কড়া নষ্ট হয়ে গেছে। তার-ফার ছিঁড়ে সেতারটা পড়ে আছে। সংসার সংসার করে সব নষ্ট হয়ে গেল। বুঝলে অনুপ, দারিদ্র্য দোষ গুণরাশি-নাশি। এ জিনিস হয় আমিরের না হয় ফকিরের। মধ্যবিত্তদের জীবন ন্যাজে গোবরে হয়েই কেটে যায়। নাও ধরো।
তিমির হারমোনিয়ামটা টেনে নিয়ে আবার গান শুরু করল। যতীশ হাঁটুতে তাল দিতে থাকলে চোখ বুঁজিয়ে।
৩
অলোকা বাথরুমে ঢুকেছে। স্বভাবে একটু পিটপিটে। বাথরুমের আগাপাশতলা পরিষ্কার না করে পা রাখতে ঘেন্না করে। খচর খচর করে ঝ্যাঁটা চালাচ্ছে আর গুনগুন করে গান গাইছে। দুটো শব্দই মিলেমিশে বাইরে আসছে। বালতিতে জল পড়ার শব্দও যোগ হয়েছে।
বড়ো ভাই সমীর সবে অ্যাডভোকেট হয়ে হাইকোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করেছে। বরাতক্রমে একজন ভালো সিনিয়ার জুটে গেছে। আশা করা যায় খাটতে পারলে তিন-চার বছরেই দাঁড়িয়ে যাবে। দু-ভাঁজ কাপড় লুঙির মতো করে সমীর ঘর থেকে বেরিয়ে এল। মুখে সিগারেট। হন্তদন্ত হয়ে বাথরুমের দিকে চলেছে।
মিহির ছোলা চিবোতে চিবোতে উঠোনে পায়চারি করছিল। দাদার ব্যস্ততা দেখে মুচকি হেসে বললে—চললে কোথায়?
—বাথরুমে। কেন তুই যাবি!
—কাউকেই যেতে হবে না। যিনি ঢুকেছেন তিনি ঘণ্টাখানেকের আগে বেরোবেন না।
—সে কি রে! অলোকা ঢুকেছে বুঝি!
—শুনতে পাচ্ছ না।
সমীর থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
—ছোলা খাবে?
—ছোলা? খাব কি রে! নাম শুনলেই পেট খারাপ হয়।
—হায় পেট! তুমি একটু করে ব্যায়াম করো বড়দা। তোমার ওই আইনের প্যাঁচে পড়ে শরীরটা কষে যাবে। শেষ বয়সে উকিলদের কেমন চেহারা হয়ে যায় দেখেছ তো! এই এতখানি টাক। তিন থাক গলা। বিশাল ভুঁড়ি। চোখে চশমা। কিংবা রোগা পাকানো খেঁকুরে মার্কা। মুখে বিরক্তি। শ্বাসকষ্ট, কাশি, ডিসপেপসিয়া, তিরিক্ষি মেজাজ। ভাঙা তোবড়ানো গাল। কিছু বললেই খ্যাঁক করে ওঠেন—‘ক্যা বললে’। সাবধান বড়দা। এর মধ্যেই তোমার যা পেট হয়েছে স্বচ্ছন্দে পোয়েট বলা চলে।
—ছোলা খাচ্ছিস ছোলা খা। ইচ্ছে হয় পাখির মতো শিস দে। অত বাজে বকিস কেন? একেই তো বলে, বেশি শরীরচর্চা করলে বুদ্ধি কমে বুদ্ধু হয়ে যায়।
—আমাকে পরীক্ষা করে একবার দেখো না। বুদ্ধি কম না বেশি।
—বেশ, অলকাকে বাথরুম থেকে বের কর দেখি। মনে হচ্ছে আমি আর দাঁড়াতে পারব না।
—এই কথা?
উঠোনের পশ্চিম দিকে কলঘর, বাথরুম। জায়গাটা অন্ধকার অন্ধকার। দিনের বেলাতেও কম পাওয়ারের একটা আলো জ্বলে। মিহির বাথরুমের দরজায় জোরে জোরে বার কয়েক টোকা মারল। ভেতর থেকে অলোকা বলল—কে?
—এই তুই একটু বেরিয়ে আয়। বাবা একবার বাথরুমে যাবে।
—এক মিনিট।
অলোকার গান থেমে গেল। মিহির ইসারায় দাদাকে ডেকে ফিসফিস করে বলল—বেরোলেই স্যাট করে ঢুকে পড়বে।
ভাইয়ের পরামর্শে সমীর বাথরুমের একপাশে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে রইল। অলোকা কোনোরকমে ভিজে শাড়ি শরীরে জড়িয়ে বেরিয়ে এল। ভিজে চুল। ফর্সা গাল বেয়ে মুক্ত বিন্দুর মতো জল নেমেছে। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলে,
—বাবা কোথায়?
মিহির বললে—যাও বাবা ঢুকে পড়ো।
সমীর সাঁ করে বাথরুমে ঢুকেই ধড়াস করে দরজা বন্ধ করে দিল। অলোকা চমকে উঠেছে। এক ঝলক দাদাকে দেখে ফেলেছে।
—এই যে বললি বাবা! মিথ্যাবাদী। এরকম কায়দা করার কী দরকার ছিল? সত্যি কথা বলতে পারিস না?
—বাড়ির বড়ো ছেলে পিতৃতুল্য। মিথ্যে তো কিছু বলিনি ম্যাডাম। তার ওপর নিম্নচাপ, দাঁড়াতে পারছিল না। তাই একটু ছলনা করতে হল। ক্ষমা প্রার্থনীয়।
ভাইয়ের দিকে কটমট করে তাকিয়ে ভিজে পায়ের ছাপ ফেলে ফেলে অলোকা ঘরের দিকে চলে গেল। মিহির একটা একটা করে ছোলা ছুড়ে ছুড়ে মুখে ফেলতে ফেলতে উঠোনে পায়চারি করতে লাগল।
৪
শিশির সকালে পড়তে যায়। ছেলেটি ভালো। বেশ ভালো। যতীশবাবুর সব ছেলের চেয়ে বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ। কথা কম বলে। বাড়িতে থাকলে বোঝাই যায় না যে বাড়িতে আছে। ছেলেটি সামান্য খেয়ালী মতো। নাওয়া-খাওয়া বা ঘুমোনোর কোনো ঠিক নেই। কোনো দিন পড়ছে তো পড়ছেই সারা রাত কেটে গেল। আবার ঘুমোচ্ছে তো ঘুমোচ্ছেই, বেলা বারোটা বেজে গেল।
শিশির তার অধ্যাপকের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আপন মনে হাঁটছে। ধীরে রাস্তা হাঁটাই তার স্বভাব। কেউ কখনো জোরে জোরে হাঁটতে বললে শিশির তাকে স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের একটা কাহিনি শুনিয়ে দেয়। দক্ষিণ ভারতে স্বামীজি গেছেন। এক ভক্তের সঙ্গে পথ হাঁটছেন। বাস ধরে কোথাও যেতে হবে। দু-জনে হাঁটছেন স্টপেজের দিকে। এমন সময় বাস এসে গেল। ভক্ত বলছেন, স্বামীজি, পা চালিয়ে আসুন, দৌড়োন, দৌড়োন। বাসটা ধরতে হবে। স্বামীজি মুচকি হেসে বললেন, দেখো, আমি একমাত্র ঈশ্বরের জন্যে দৌড়োতে প্রস্তুত, সামান্য একটা বাসের জন্যে দৌড়োতে রাজি নই।
শিশিরের সব ব্যাপারেই অন্যরকম। বয়েস অল্প হলেও তার একটা জীবনদর্শন গড়ে উঠেছে। দাদাকে মনে হয় নকল হিরো। সব সময় উত্তমকুমার হবার চেষ্টা। মেজদাকে মনে হয় ব্যর্থ প্রেমিক। সব সময় এমন একটা ভাব করে থাকে, যেন কালিদাসের বিরহী। সেজদাকে ভালো লাগে। ওর মধ্যে কোনো লুকোচুরি নেই। ধুম-ধাড়াক্কা। এই রাগছে, এই হাসছে। এই রেগে কথা বন্ধ, এই আবার ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি। মানুষের এইরকমই হওয়া উচিত। সহজ, সরল। শিশির সবচেয়ে ভালোবাসে দিদিকে। দিদির কোনো তুলনা হয় না। দিদির রাগ নেই। দিদির দুঃখ নেই। দিদি সারাদিন হাসিমুখে কাজ করে যেতে পারে।
শিশির ধীরে ধীরে এপাশে-ওপাশে তাকাতে তাকাতে দেখতে দেখতে হাঁটছে। হঠাৎ আচমকা তার পাশ দিয়ে একটা গাড়ি চলে গেল। প্রায় ঝড়ের বেগে। আর একটু হলেই চাপা দিত। শিশির ঘাড় ঘুরিয়ে নম্বরটা দেখে রাখল। এর বেশি সে আর কিছু মনে রাখতে চাইল না। রাস্তায় বেরোলে এ রকম হতেই পারে। গাড়িটা আর একটু চেপে এলেই তার বিপদ হতে পারত। বোধহয় নতুন চালাতে শিখেছে।
শিশির দুপা এগোতে না এগোতেই দেখল আর একটা গাড়ি ঠিক ওইভাবেই হু-হু করে ছুটে আসছে। ভেতরে একদল ছেলে চিৎকার করছে, ধরো ধরো, পাকড়ো পাকড়ো।
শিশির থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। এইসব ঘটনা আজকাল এত ঘটছে যে মনে কোনো দাগ কাটে না। মানুষ মানুষকে মারবে এইটাই হল কালের ফ্যাশান! কিছু একটা হয়েছে, যা অনবরতই হচ্ছে। আজ রামের হচ্ছে, কাল শ্যামের হবে। শিশির ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাল না। শরৎ এসেছে। সোনালি রোদের ভিয়েনে জাফরানী প্রকৃতি।
কিছু দূর এগোতেই দেখল রাস্তার পাশে অনেক মানুষের জটলা। কেউ বলছে মরে গেছে, কেউ বলছে, এখনও মনে হয় বেঁচে আছে। শিশিরের কী কৌতূহল হল। উঁকি মেরেই তার মাথাটা ঘুরে গেল। রাস্তার একপাশে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে অনুপদা। কাঁধের সেই বিখ্যাত ঝোলা ব্যাগটা ছিটকে চলে গেছে এক পাশে। অনেকখানি জায়গা রক্তে থকথক করছে। শিশির হতবাক। তার কী করা উচিত বুঝতে পারল না। একটা কিছু করা উচিত। দূর রাস্তার দিকে দেখল, একটা সাদা অ্যামবাসাডার আসছে।
শিশির একজনকে বলল, একটা গাড়ি আসছে, কথাটায় মন্ত্রের মতো কাজ হল। ‘এই একটা গাড়ি আসছে’ গাড়ি আসছে। রাস্তার পাশ থেকে ভিড়ের কিছুটা সরে এল রাস্তার মাঝখানে! গাড়িটা থামতে বাধ্য হল। পেছনের আসনে ফিনফিনে ধুতি পাঞ্জাবি পরা ফুলোফুলো চেহারার একজন আরোহী। শিশির ভদ্রলোককে চেনে না। আরোহী ড্রাইভারকে বলছেন, ‘আহা, থামছ কেন? চলো চলো।’
ভিড়ের একজন রুক্ষ গলায় বললে, ‘চলবে কী? নেমে আসুন। গাড়িটা আমাদের চাই।’
‘তার মানে? গাড়িফাড়ি হবে না।’
ভিড়ের আর একজন বললে, ‘হবে না মানে! দেখছেন না একজন গুলি খেয়েছে। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।’
ভদ্রলোক মেজাজের গলায় বললেন, ‘এটা অ্যাম্বুলেন্স নয়।’
এই একটা কথায় আগুন জ্বলে গেল। একজন ঝপ করে একপাশের দরজাটা খুলে ফেললে। ভদ্রলোক সঙ্গেসঙ্গে দরজাটা বন্ধ করতে যাচ্ছিলেন। সবাই হইহই করে উঠল। কে একজন বললে, ‘নাম শালা। দু নম্বরী পয়সায় রোয়াব! নেমে আয়।’
ভদ্রলোকের হাত চেপে ধরে একজন টানছে। আর একজন ওপাশ থেকে হাত বাড়িয়ে গোটাকতক ঘুঁসি চালিয়ে দিয়েছে। আর একটা হাত চুল খামচে ধরার চেষ্টা করছে।
ভদ্রলোক কোনোরকমে নেমে এলেন। মুখটা ভয়ে কেমন হয়ে গেছে। শরীর কাঁপছে। গলগল করে ঘামছেন। কে একজন বললে, ‘শালা জামাই সেজেছে। মেরে থোবনা ঘুরিয়ে দে।’
আর একজন বললে, ‘পাংচার করে হাওয়া বের করে দে।’
শিশিরের হঠাৎ মনে হল ভদ্রলোককে সে চেনে। বিখ্যাত যাত্রা অভিনেতা। নায়ক, বিজনকুমার। গন্ধরাজ অপেরার প্রাণপুরুষ। ‘বিমাতার কোলে সতীনকন্যা’র রমরমা বিজনকুমার আর বিজনকুমারীর অভিনয়ের গুণে। শিশিরদের পাড়াতেই ভদ্রলোক থাকেন।
শিশির বললে, ‘আরে, ইনি তো সেই বিজনকুমার।’
‘বিজনকুমার, বিমাতার কোলে সতীনকন্যা! তাহলে সেই হাসিটা একবার দাও গুরু, একতলা থেকে সাততলা। বিজনকুমারীকে রেপ করার পর যে হাসিটা তুমি হাস।’
শিশির বিজনকুমারের হাত ধরে সুবোধ ময়রার বেঞ্চে বসিয়ে দিল।
অনুপকে ধরাধরি করে দু-তিনজন গাড়িতে তোলার চেষ্টা করছিল। কে একজন বললে, ‘পুলিস কেসে পড়ে যাবে। পুলিসে ছুঁলে আঠারো ঘা।’ যারা তুলছিল তারা বললে, ‘বাড়িতে গিয়ে বউয়ের আঁচলের তলায় ঢুকে থাকুন।’
তুলতে তুলতে একজন বললে, ‘এখনও মনে হয় বেঁচে আছে মাইরি।’
অনুপকে নিয়ে চারটে ছেলে হাসপাতালের দিকে চলে গেল। বিজনকুমার পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, ‘ছেলেটাকে আমি চিনি, অনুপ না?’
‘শিশির বললে, ‘অনুপদা।’
‘হ্যাঁ, ছেলেটাকে আমি চিনি। আমার কাছে কয়েকবার গেছে। ভালো গান লেখে। ইস ছেলেটাকে মেরে দিলে! বাঁচবে তো!’
বিজনকুমার ঘষে ঘষে মুখ মুছলেন।
শিশির বললে, ‘কী জানি। কতটা রক্ত বেরিয়েছে দেখেছেন!’
বিজনকুমার রাস্তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘অ্যাঁ রক্ত! মানুষের রক্ত!’ বলেই কেমন যেন অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
শিশির বললে, ‘আপনি জল খাবেন?’
ইশারায় জানালেন, ‘না খাব না।’ তারপর অতি কষ্টে বললেন, ‘তুমি ভাই আমাকে একটা ট্যাক্সি ধরে দেবে।’
দোকানের ভেতর থেকে সুবোধ বললে, ‘আমি কিন্তু দোকান বন্ধ করব। এখুনি ঝামেলা শুরু হবে। যে মরে মরুক। আমার শোকেসের একটা কাচ ভাঙা মানে হাজার টাকা।’
সুবোধের কথা শুনে শিশির অবাক, মানুষের জীবনের চেয়ে কাচের দাম বেশি!
শিশির বিজনকুমারকে বললে, ‘ট্যাক্সি তো সহজে আসবে না এদিকে। আপনার বাড়ি তো বেশি দূরে নয়। হেঁটে যেতে পারবেন না?’
বিজনকুমার অসহায়ের মতো বললেন, ‘আমার হাঁটার অভ্যাসটা নষ্ট হয়ে গেছে। খুব কষ্ট হয়।’
সুবোধ দোকান বন্ধ করার জন্যে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রাস্তার দু-পাশের দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গেছে। চারপাশ থমথম করছে। রাস্তা খালি। একপাশে থলথল করছে জমাট রক্ত। একটা বাঁধানো একসারসাইজ বুক আর ঝকঝকে একটা লাইটার পড়ে আছে। অনুপদার গানের খাতা, আর লাইটার।
শিশিরের খুব ইচ্ছে করছিল, জিনিস দুটো তুলে নেয়। শিশির জানে দিদি অনুপদাকে ভীষণ ভালোবাসে। জিনিস দুটো পেলে সারাজীবন স্মৃতি হিসেবে রেখে দিত। অনুপদা মারা গেলে এই নয় যে, দিদি সারাজীবন অবিবাহিতা থাকবে। সবই হবে। তবু মাঝে মাঝে গানের খাতাটা উলটেপালটে দেখতে পারত, নির্জন দুপুরে লাইটারটাকে শাড়ির আঁচলে মুছে মুছে চকচকে করত।
এটা তো ঠিক, অনুপদার মতো ছেলে লাখে একটা জন্মায় কি না সন্দেহ।
শিশির ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করল। বিজনকুমার বললেন, ‘আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছ ভাই?’
‘আপনিও হাঁটুন। বেশি দূর তো নয়!’
ভদ্রলোককে ঘাড় থেকে নামাতে পারলে বাঁচে শিশির। গলগল করে ঘামছেন। বাহারি রুমালে মুখ মুখছেন আর বছরে বছরে জীবনসঙ্গিনী পাল্টাচ্ছেন। যত সব বিদঘুটে বইয়ের লম্পট নায়ক। বোতলের কল্যাণে শরীরের ওজন বোধহয় এক টন। অভিনয়-প্রতিভা বলতে, হা: হা: করে হাসার প্রতিভা। মুর্খে দেশ বলেই ভোগে আছেন। লোকসংস্কৃতির নামে ব্যভিচারে কাতলা মাছের মতো ওলটপালট খাচ্ছেন।
মানুষ আজকাল কী সাংঘাতিক ভীতু হয়ে গেছে। একটা নিরীহ ছেলে, একটা সুন্দর ছেলে খুন হয়ে গেল, আর সব লোক পথ ছেড়ে, দোকানপাঠ বন্ধ করে খুপরিতে গিয়ে ঢুকল! দুপুর হয়ে আসছে। পোস্ত ভাত, ডাঁটা চচ্চড়ি ভাত, চুনো মাছের ঝাল আর ভাত খেয়ে, খবরের কাগজ খুলে শুয়ে পড়বে। একটা দিবানিদ্রা দিয়ে উঠে চা খাবে এক কাপ, তারপর উঁকি মেরে দেখবে, সব নর্মাল হল কি না। মানুষের কত কাজ! সামান্য একটা মৃত্যু জীবনের কেনাবেচা কী বন্ধ করতে পারে।
পাড়ার মুখে ঢোকার সময়, জলদবাবুর স্ত্রী জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে শিশিরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে বল তো! সবাই বলছে আজ না কী সিনেমা হল বন্ধ থাকবে। আমার যে টিকিট কাটা আছে।’
শিশির উজ্জ্বল চোখে ভদ্রমহিলার দিকে তাকাল। জলদবাবুর বড়ো মজার ব্যবসা। অবশ্য শোনা কথা। হাসপাতাল থেকে চোরাই ওষুধ কিনে ওষুধের দোকানে বিক্রি করা। কাঁচা পয়সা একেবারে পাঁকের মতো চারপাশে ভ্যাড়ভ্যাড় করছে। আদরে আদরে বউটার মাথা খেয়েছেন। শিশির কোনো উত্তর দিল না। যেমন হাঁটছিল, সেই ভাবেই বাড়ির দিকে এগোলো। শুধু চোখে কিছুক্ষণ লেগে রইল মেয়েটির চেহারা। ফর্সা। বোকা বোকা, অহঙ্কারী চেহারা। ঠোঁটের ওপর একটা আঁচিল। জানলায় প্রায়ই দাঁড়িয়ে থাকেন মহিলা, খাঁচার প্রাণীর মতো।
বাড়ি যত এগিয়ে আসছে, অনুপের চিন্তাটা তত প্রবল হচ্ছে। শিশির ভাবছে, দিদিকে বলবে কী বলবে না। শিশির জানে, দিদির জীবনে কোনো দুঃখ নেই। অনুপকে ঘিরে নতুন এক ধরনের আনন্দ তৈরি হচ্ছিল। নতুন স্বপ্ন। শিশির ভাবত, অনুপকে জামাইবাবু বলতে তার কোনো লজ্জা হবে না। ছেলে অনেক আছে। অনেক ভালোই হয়তো জগতের বিচারে। অনুপ অতুলনীয়।
একটা ফাঁকা মন নিয়ে শিশির বাড়িতে ঢুকল। উঠোনের মাথার ওপর চার চৌকো আকাশে শরৎ লেগে আছে। এ আকাশ দেখলেই মনে হয় পুজো আসছে। এই উঠোনটাই তাদের বাড়ির মস্ত সম্পদ। আলোর ঝরনাধারা নেমে আসে ফিকে নীল একটা শাড়ি প্রায় শুকনো বাতাসে দুলছে। মা মনে হয় ধূপ জ্বেলেছেন পুজোর ঘরে। অপূর্ব সুবাস। শান্ত নিস্তব্ধ সব। শিশির চুপচাপ উঠোনের পাশে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। এত সাংঘাতিক একটা ঘটনা না বলে থাকে কী করে। কী হল অনুপের, সেটাও তো জানা দরকার। সে কি বাঁচবে! যদি না বাঁচে! শিশির জানে, মা আর বাবা দু-জনেই অনুপের সঙ্গে দিদির বিয়ের কথা ভাবছিল। বাবা প্রায় নিশ্চিন্তই ছিল। আশার কাচ দিয়ে তৈরি সুন্দর একটা বাক্স, চুরমার হয়ে যায় বুঝি।
শিশির আবার রাস্তায় বেরিয়ে এল। এ কথা বলার চেয়ে পালিয়ে থাকাই ভালো। অন্যভাবে জানে জানুক। বেরিয়ে আসতে আসতে সে শুনতে পেল, দিদি গান গাইছে রান্নাঘরে।
শিশির আবার হাঁটতে লাগল। কোথায় যাবে সে নিজেই জানে না। পৃথিবীর এই সব মোটা দাগের ঘটনা তাকে এমন করে দেয়, তখন নিজেকে মনে হয়, বোধবুদ্ধিশূন্য এক নিরেট মানুষ। এখনও তার সেই অবস্থা। নিশ্চিন্ত গরুর মতো হেঁটেই চলেছে, হেঁটেই চলেছে।
প্রথমে মনে হল যেকোনো রুটের একটা বাসে উঠে পড়বে। শেষ স্টপেজে গিয়ে নেমে পড়বে। শিশির ধরা পড়ে গেল। অনুপের মা আর ছোটো বোন ইলা হন্তদন্ত হয়ে আসছে। শিশিরকে দেখে অনুপের মা কেঁদে ফেললেন।
‘শুনেছ? তুমি শুনেছ?’
ইলা শিশিরের হাত ধরে বললে, ‘কী হবে শিশিরদা! তুমি শুনেছ, দাদাকে মেরে ফেলেছে।’
শিশিরের মনে হল, একটা পরিচিত ঘটনাকে এরা দু-জনে বড়ো বেশি কচলাচ্ছে। বাঙালি নতুন রঙের স্বাদ পেয়েছে। হাতে ছোরাছুরি এসেছে। বোমা এসেছে। শাসন আলগা হয়েছে। দু-চারটে খুনজখম তো হবেই। থানার আগের ওসি একজনকে বলেছিলেন, ‘খুন খুন করে অত লাফাবার কী হয়েছে। মানুষ হয় ক্যানসারে মরবে না হয় মরবে বোমা-ছুরিতে। কোনটা ভালো!’
শিশির শান্তভাবে বললে, ‘অত উতলা হচ্ছে কেন?’ মরেই গেছে এমন তো বলা যায় না।’
‘কী করে বুঝলে তুমি।’
‘আমার সামনেই তো ঘটল ঘটনাটা।’
‘তোমার সামনে? তুমি কিছু করলে না। তুমি কোথায় যাচ্ছ!’
অনুপের মা বললেন, ‘তুমি কি দেখলে? সে কি বেঁচে আছে!’
শিশির ঠাণ্ডা গলায় বললে, ‘তা তো জানি না। আমি দেখলুম, সে পড়ে আছে উপুড় হয়ে।’
‘তুমি কিছু করলে না?’
‘আমি ওদের বললুম, একটা গাড়ি আসছে।’
‘তারপর?’
ইলা বললে, ‘ওরা? ওরা কারা?’
‘ওই যে, কোনো কিছু হলেই, যারা মজা দেখার জন্যে ভিড় করে আসে। ওরা গাড়িটা থামাল, তারপর অনুপদাকে ধরাধরি করে গাড়িতে তুলে নিয়ে গেল।’
‘কোথায় নিলে গেল?’
‘কোনও একটা হাসপাতালে। ওরাই বলছিল, মনে হয় বেঁচে আছে। আবার কেউ বলছিল মনে হয় বেঁচে নেই।’
ইলা বললে, ‘শিশিরদা, তুমি দাদার সঙ্গে গেলে না!’
‘সকলে একসঙ্গে গিয়ে কী হবে? ওরা তো গেছে।’
‘তুমি আমাদের সঙ্গে যাবে না?’
‘না, তোমরা যাও, আমি পরে যাব।’
শিশির ইলার দিকে তাকাল। ইলার মুখ থমথমে, চোখে জল। অন্যদিনের চেয়ে ইলাকে আজ আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। শিশির অনেক সময় ভেবেছে, চাকরিবাকরি পেলে ইলাকে বিয়ে করবে। আজ সেই ইচ্ছেটা আবার হল।
শিশির বললে, ‘তোমরা যাও, আমি একজনের সঙ্গে দেখা করে এখুনি আসছি।’
অনুপের মা অসহায়ের মতো বললে, ‘আমরা কোথায় যাব বাবা।’
শিশির বললে, ‘অনুপদার ক্লাবের ছেলেদের নিয়ে প্রথমে থানায় যান।’ শিশির আর দাঁড়াল না। বেশ কিছুদূর আসার পর শিশির নিজেকে প্রশ্ন করল, সে কি স্বার্থপর?
সঠিক কোনো উত্তর নেই। প্রথমে যে নাড়াটা খেয়েছিল, সেটা থিতিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে ঘটনাটা বহুকাল আগে তার জীবনের বাইরে ঘটে গেছে। সে যেন গল্প শুনছে।
৫
মিহির তখন হাফ প্যান্ট পরে তেল মাখছিল। রোজ আধঘণ্টা ধরে ঘসে ঘসে সে তেল মাখে। ব্যায়ামগুরুর নির্দেশ। তেল না মাখলে পেশী শক্ত হয়ে যাবে। চেহারা পাকতেড়ে মেরে যাবে।
মিহির তেল ঘষছে। অলোকা রান্নাঘরে কড়ার তেলে ট্যাংরা মাছ ছাড়বে কী ছাড়বে না ভাবছে। ইতস্তত করছে। ট্যাংরা ভীষণ সাংঘাতিক মাছ। গরম তেল ছিটকোবেই। যতবার ভাজতে গেছে ততবারই ফোস্কা পড়েছে।
যতীশবাবু বাথরুমে। মনোরমা পুজোয় বসেছেন। সমীর বেরিয়ে গেছে। তিমির জুতোর পেরেক ঠুকছে। এমন সময় অনুপের মা আর ইলা ঢুকলেন। সামনের উঠোনেই মিহির।
মিহিরকে দেখেই অনুপের মা ডুকরে কেঁদে উঠলেন, ‘বাবা, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে।’
মিহির সঙ্গেসঙ্গে বললে, ‘আমি জানতুম আপনার সর্বনাশ হবে। ওইরকম কুম্ভকর্ণের মতো যাদের ঘুম তাদের সর্বস্ব একদিন চুরি হবেই, হবেই, হবেই। কী কী গেছে?’
অনুপের মা কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছ বাবা। আমার সর্বস্ব গেছে। অনুপকে খুন করেছে।’
‘স্বপ্ন দেখছেন না কী! দুঃস্বপ্ন! এই তো অনুপদা মেজদার কাছে এসেছিল। একটা নতুন গান লিখেছে। মেজদা সুর করে শুনিয়ে দিলে।’
ইলা বললে, ‘আপনি জানেন না। একটু আগে বাজারের কাছে দাদাকে মেরেছে।’
ইলা চোখে আঁচল চাপা দিল। অলোকা কড়া ফেলে ছুটে এসেছে। তিমিরের জুতোয় পেরেক ঠোকা হয়নি। যতীশবাবু ভিজে কাপড় ছাড়ার সময় পাননি। মনোরমা মাঝপথে পুজো ফেলে এসেছেন।
তিমির বললে, ‘কি বলছেন আপনি, অনুপ তো সকালে এসেছিল। এই কিছুক্ষণ আগে সে এখান থেকে বেরিয়েছে।’
মনোরমা বললেন, ‘সেই কোন সকালে শিশিরটা বেরিয়েছে এখনও ফিরল না।’
ইলা বললে, ‘আমাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। ওই দিকে ফলসা বাগানের দিকে চলে গেল।’
মিহির বললে, ‘ওদিকে আবার কে আছে?’
যতীশবাবু বললেন, ‘তোমরা শিশিরের কথা পরে ভেব, আগে অনুপের খোঁজ খবরটা নাও।’
তিমির বললে, ‘মিহির তুই যা।’
মিহির বললে, ‘আমার এখনও ঘণ্টাখানেক লাগবে রেডি হতে। তুমি যাও।’
‘এটা আমার কাজ! এসব কাজে একটু চেহারা দরকার।’
যতীশবাবু বললেন, ‘কেন, তোমরা কী মারামারি করতে যাবে। তোমরা তো খবর নিতে যাবে।’
তিমির বললে, থানাপুলিশের ব্যাপার আছে তো। থানাপুলিশটা ও ভালো বোঝে।’
ইলা এতক্ষণ চুপটি করে দাঁড়িয়েছিল একপাশে। হঠাৎ তার মনে হল, চোখের সামনে মধ্যবিত্ত বাঙালির চেহারাটা বড়ো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দাদাকে সে বহুবার বলত, তুই কার জন্যে এইসব করছিস, টেক্রটবুক লাইব্রেরি, জিমনাসিয়াম, ফ্রি কোচিং, সেমিনার, পত্র-পত্রিকা প্রকাশ। কার জন্যে করছিস দাদা! তোর বিপদে কেউ কী এগিয়ে আসবে! দাদা বলেছিল, একটা জিনিস জেনে রাখ, তাহলে তোর আর কোনো অভিযোগ থাকবে না। বাঙালি কখনো এগোয় না সব সময় পেছোয়।’
ইলা বললে, ‘মা এখানে আর সময় নষ্ট কোরো না। চলো যা পারি আমরা নিজেরাই করি।’
অলোকা বললে, ‘দাঁড়াও। আমি তোমাদের সঙ্গে যাব।’
যতীশবাবু বললেন, ‘আমি এখনও মরিনি। পুরোনো বাঙালি এক আধজন এখনও বেঁচে আছে। একটু দাঁড়াও। কাপড়টা প’রে আসি।’
যতীশবাবু ঘরে গেলেন। তিমির মিহিরকে বলল, ‘গুড ফর নাথিং। শুধু কুঁদো একটা চেহারাই আছে। মানুষের কাজে লাগে না।’
মিহির বলল, ‘তোমার ওই কোকিলকন্ঠই সার। সারা দিন খাঁচায় বসে কুহু কুহু, একটি রজনীগন্ধা, একটি মাধবী সন্ধ্যা। ইলা তুই পাঁচ মিনিট দাঁড়া, আজ সব শালাকে মায়ের ভোগে পাঠাব। আজ আমি পাড়া ঝেঁটাব। অনুপদাকে কারা ঝেড়েছে আমি জানি। আমিও পালটা ঝাড় দেব! সব ব্যাটা তখন দোয়ানি খুঁজবে। হারামজাদারা একটা মিনিট শান্তিতে থাকতে দেবে না।’
মনোরমা মিহিরকে ভালোই চেনেন। কোনোরকমে একবার ক্ষেপে গেলে আর রক্ষে নেই। সেবার বারোয়ারি পুজোর মারমারিতে একাই সাতটা ছেলের মাথা ফাটিয়েছিল। মিহিরের এই চেহারাকে তিনি ভীষণ ভয় পান।
তিমির বলল, ‘এই তোর দোষ। ধরে আনতে বললে বেঁধে আনিস।’
‘চুপ করো তুমি। কোয়েলিয়া গান থামা এবার, তোর ওই কুহু-কুহু-কুহু তান ভাল লাগে না আর।’
ইলার দিকে তিমিরেরও হাত বাড়াবার ইচ্ছে আছে। তিমিরের মনে হল কাছাকাছি আসার এই সুবর্ণ সুযোগ হাত ছাড়া করা উচিত হবে না। এতকাল অনুপের গানে সুর বসিয়ে এসেছে, এইবার ইলার মনে রং ধরাতে হবে। একটু ঝক্কি ঝামেলার ব্যাপার ঠিকই, তবে সেই বলে না, রাজদ্বারে আর শ্মশানে, য তিষ্ঠতি স বান্ধব।
তিমির বললে, ‘চলো ইলা আমি তোমাদের সঙ্গেসঙ্গে যাচ্ছি। ওই রগচটা, দামড়াটা কখন কী করে বসে তার ঠিক নেই।’
যতীশ ধুতি পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে এসে দেখলেন, তিন জনে বেরিয়ে যাচ্ছে। মনোরমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হল! শিল্পী চলল কোথায়!’
‘তিমির যাচ্ছে। তোমাকে আর যেতে হবে না।’
হঠাৎ চোখ চলে গেল মিহিরের দিকে। মিহিরের বোধহয় মনে হয়েছে, এই সব আজেবাজে উত্তেজনায়, কাফ আর থাইয়ের মাসলস একটু ঢিলে হয়ে গেল। তাই রান্নাঘরের দরজার পাল্লা ধরে হোঁত হোঁত করে বৈঠক মেরে চলেছে।
যতীশবাবু বললেন, ‘আহা ব্যায়ামবীর! শোনো যে শরীর মানুষের কোনো কাজে লাগে না, সে শরীর তুমি ফেলে দাও।’
মিহিরের দৃকপাত নেই। গত বছর তিনেক সে ইঞ্চির জগতে আছে। আটচল্লিশ, ছাপ্পান্ন, ছত্রিশ, ছাব্বিশ।
অলোকা রান্নাঘরে ফিরে গেলেও রান্নায় আর মন নেই। গরম তেলে একের পর এক মাছ ছেড়ে যাচ্ছে। তেল ছোটোকাবে, কী ফোস্কা পড়বে সে খেয়াল আর নেই। অল্প বয়সে বাবা মারা যাওয়ায় অনুপ লেখাপড়ায় তেমন এগোতে না পারলেও মনুষ্যত্বের পথে অনেক দূর এগিয়েছিল। বেঁচে থাকলে আরও এগোবে। ইদানীং নেতারা তাকে দল টানতে চেয়েছিল। এ-দল বলে তুমি আমার দিকে এসো, ও-দল বলে আমার দিকে। একটা বড়ো দল অনুপকে নির্বাচনে দাঁড় করাতে চায়। অনুপ অলোকাকে বলেছিল, আমি যা আছি, যেমন আছি, বেশ আছি। আমার ক্ষমতার লোভ নেই। সাত-শো টাকা মাইনে পাই। ভাত, ডাল, রুটি খাই। বোনটার বিয়ে দিতে পারলে, ব্যস, আমায় আর পায় কে!
অলোকা ইয়ারকি করে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আপনি বিয়ে করবেন না?’
‘সাত-শো টাকার বিয়ে? একটা ভালো শাড়ির দাম সাত-শো।’
‘টাকাপয়সা, শাড়ি-ফাড়ি ছাড়ুন, মনের ইচ্ছেটা কি?’
‘আমার কোনো ইচ্ছে নেই।’
‘প্রেম নেই?’
‘প্রেম মানে কী শুধু নারীপ্রেম! আমার গাছ আছে, আকাশ আছে, নদী আছে। আমার গান আছে। সবার ওপরে আছে মানুষ।’
‘মেয়েরা বুঝি মানুষের মধ্যে পড়ে না!’
‘মানুষের মধ্যে অবশ্যই পড়ে, তবে স্ত্রীর মধ্যে নেই। সংসার আমার অসহ্য লাগে।’
অনুপ আসে যায়। তিমিরের বন্ধু। দেখতে দেখতে সকলের বন্ধু। অলোকার প্রেমের ন্যাকামি নেই, কিন্তু অনুপের অভিভাবক হতে ইচ্ছে করে। সময়ে খায় না। সেলসম্যানের চাকরি। সারাদিন টোটো করে ঘুরছে। সকলের জেন্য ভূতের বেগার খেটে মরছে। ছেলেটাকে যেভাবেই হোক, একটু স্বার্থপর করতে হবে। অলোকা মাঝে মাঝে এটা ওটা স্পেশাল রাঁধতো শুধু মনে মনে অনুপকে ভেবে। অলোকার মনে হত তার জীবনে মৃদুমন্থর পায়ে কেউ একজন আসছে। যে আর পাঁচটা ন্যাকা ন্যাকা ছেলের মতো নয়। একেবারে অন্যরকম।
যতীশবাবু মনোরমাকে বললেন, ‘যতক্ষণ অনুপের কোনও খবর না আসছে, ততক্ষণ আমরা চর্বচোষ্য করে না-ই বা খেলুম। মনের এই অবস্থায় খাওয়াটা ঠিক হবে না।’
মনোরমা বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলছ, তবে কী জান, তোমার বয়েস হয়ে যাচ্ছে। চান করেছ। কিছু না খেলে পিত্তি পড়বে।’
‘ভুল বললে, বৃদ্ধের শরীর ঠিক রাখবার উপায় মাঝেমধ্যে উপবাস।
অলোকা রান্নাঘরে সব চাপাচুপি দিয়ে দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়াল। মিহির চান সেরে এসেছে। অলোকার কাছে ফিসফিস করে বললে, ‘বিশ্বাস কর দিদি, আমার খুব দুঃখ হচ্ছে, বাথরুমে আমি খুব কেঁদেছি; কিন্তু মানুষের পেটটা তো মন থেকে অনেক দূরে, পেটের তো আর দুঃখ হয় না। সকালে অত ডন বৈঠক মেরেছি, বারবেল, ডাম্বেল।’
অলোকা বললে, ‘বুঝেছি, বুঝেছি, ভীষণ ক্ষিধে পেয়েছে, এই তো!’
‘বুদ্ধিমান মেয়ে। ধরেছিস ঠিক। পেটে একেবারে ছুঁচো ডিগবাজি মারছে। আমার শোকটা কীরকম জানিস দিদি, বাইরে কোনো প্রকাশ নেই। ভেতরটা একেবারে ফেটে যায়। গুমরে গুমরে ওঠে।’
‘অত ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। খাবে চলো।’
অলকা মিহিরকে খেতে বসিয়েছে। খাওয়া তখন মাঝপথে। মিহির একটু বেশি খায়। দু’বার ভাত নেওয়া হয়ে গেছে, আর একবার নিয়েছে। করুণ মুখে বললে, ‘দিদি, আজ তো কেউ আর খাবে না। ট্যাংরা মাছের ঝালটা দুর্দান্ত রেঁধেছিস, আমাকে আর একটু দে না ভাই।’
মুখে ভাত পুরে মিহির বললে, ‘জীবনের কোনো দাম নেই। এই আছে, এই নেই।’
‘তুই তাড়াতাড়ি খেয়ে নে তো। জীবনদর্শন পরে হবে। ওটা তোর সাবজেক্ট নয়।’
‘তোদের একটা দোষ কী জানিস দিদি! তোরা মানুষকে ওপরটা দেখে বিচার করিস। ফলে কোনো সময়ই আসল মানুষটাকে চিনতে পারিস না। যেমন তোরা বলিস শিশিরটা স্বার্থপর। আসলে শিশিরটা হল উদাসীন। দেখবি ও কোনো দিন সন্ন্যাসী হয়ে যাবে। আমাকে তোরা ভাবিস একটা ষাঁড়। সারাজীবন গুলিগালা ফুলিয়ে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়াব।’
‘তুই ইলার সঙ্গে গেলি না কেন?’
‘মেয়েটা ভালো নয়। ওর কটা ছেলে বন্ধু আছে জানিস?’
‘তাতে তোর কী? বিপদে পড়ে এসেছে। মানুষ বিপদে পড়লে তাকে সাহায্য করবি না! মেয়েটা মোটেই খারাপ নয়। অনুপদার মতোই সরল। একটু আগে জ্ঞান দিলি, ওপর দেখে মানুষকে বিচার করিসনি। তুই নিজেই তাই করছিস।’
মিহির বিশাল একটা ঢেঁকুর তুলে খাওয়া শেষ করল। দিদির দিকে তাকিয়ে বললে, ‘খুব লজ্জা করছে জানিস। সবাই উপোস করে আছে আর আমি ভরপেট খেয়ে ঢেঁকুর তুলছি। কী করব বল, আমি ক্ষিধে সহ্য করতে পারি না।’
‘তুই এখন ওঠ।। পারিস তো একবার খবর নে।’
‘হ্যাঁ এখন তুই আমাকে যা বলবি তাই করব। আমি ফুল ফিট। ইঞ্জিনে কয়লা পড়ে গেছে, আর ভাবনা নেই।
৬
তিমির জীবনে কখনো হাসপাতালে আসেনি। এলেই তার শরীর খারাপ লাগে! ভয় হয়। মনে হয় এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটাই একটা ভাগ্য। অনুপকে নিয়ে ডাক্তারবাবুদের যমে মানুষে টানাটানি চলছে। অনুপ এখনও বেঁচে আছে। তবে আর কতক্ষণ থাকবে বলা কঠিন।
তিমিরের মনে হচ্ছে, সে যেন ইঁদুরকলে পড়ে গেছে। ইলার আকর্ষণে ইলার পেছন পেছন আরও ছ-টা ছেলে এসে গেছে। অনুপ তাদের কাছে একটা উপলক্ষ মাত্র। সেই ছেলে ছ-টার উপদ্রবে হাসপাতালের কর্মীরা প্রায় অতিষ্ঠ। তিমির একপাশে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আছে। চলেও আসতে পারছে না। একবার ইলাকে বলেছিল, আমি তাহলে এখন একবার আসি। ইলা তার হাত দুটো চেপে ধরেছিল! তার হাত কাঁপছিল। দু চোখে টলটলে জল। ফিসফিস করে বলেছিল, না না, আপনি থাকুন। ইলাও বুঝেছিল তিমির ছাড়া আর যারা রয়েছে, তারা খুব নির্ভরযোগ্য নয়। ইলা বেশ জানে, তার দাদার চারপাশে যারা ঘুরত, তারা সবাই আদর্শবান নয়। সকলেরই একটা না একটা ধান্দা ছিল। বেশ বড়ো একটা অংশের উদ্দেশ্য ছিল, ইলার সঙ্গে প্রেম করা।
হঠাৎ হেড সিস্টার এসে বললেন, ‘আরও রক্ত চাই। প্রায় সব রক্তটাই বেরিয়ে চলে গেছে। তিমিরের সঙ্গে টাকাপয়সা কিছুই নেই। ইলা আর ইলার মায়ের কাছে যা ছিল একটু আগেই গোটা তিনেক দামী ওষুধ বাইরে থেকে কিনে আনতে সব শেষ হয়ে গেছে। রক্ত দিতে হবে। ছটা ছেলে আর তিমিরে রক্তের স্যাম্পল নিয়ে গেল টেস্ট করার জন্যে। গ্রূপ মিললেই টেনে নেবে বোতল খানেক।’
এরই মাঝে দুই নেতা এসে গেলেন। বড়ো দলের নেতা। এ নেতা বলেন এই জঘন্য কাজ আপনার দলের। ও দলের নেতা বলেন, প্রমাণ করতে পারবেন? আমরা ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করি না। পুলিস বললে, সমাজবিরোধী। প্রথম নেতা বললেন, ওই এক শিখে রেখেছেন আপনারা, সমাজবিরোধী। কারা এই সমাজবিরোধী!
তিমির কিছু না বলে, হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এল। রাত নেমেছে শহরে। শরতের শেষ। হিম হিম বাতাস বইছে। মাথার ওপর আকাশ। পশ্চিমে বিশাল একখন্ড সাদা মেঘ উঠেছে। ভাল্লুকের মতো রাস্তায় পড়ে তিমিরের মনে হল, সে পালাচ্ছে। মনে হল, ইলা আর ইলার মায়ের কী অবস্থা। ওই ভাবেই ওদের থাকতে হবে যতক্ষণ না একটা কিছু হচ্ছে।
দু-পা গিয়েই তিমিরের মনে হল, যে জিনিসের এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হল অর্থ। প্রচুর টাকা চাই। তিমির আবার ফিরে এল। হাসপাতালের বাইরে দুই নেতা দুদিকে মুখ করে একজন চুরুট আর একজন সিগারেট খাচ্ছেন।
তিমির ছাঁদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দুজনেরই বেশ জবরদস্ত চেহারা। পাঞ্জাবির তলা থেকে ভুঁড়িটা ঠেলে উঠেছে ওলটনো ধামার মতো। মুখটুখগুলো সাধারণ মাপের চেয়ে বড়ো। একটা আয়নার পুরোটাই ভরে যাবে। বেশ তেল চকচকে চেহারা। দেখলে মনেই হয় না দেশে অভাব, অভিযোগ, দারিদ্র্য, খুনখারাপি, এইসব আছে।
তিমির প্রথমে চুরুটটির সামনে দাঁড়িয়ে বললে, ‘অনুপের জন্যে কিছু টাকার ব্যবস্থা করুন না। প্রচুর ওষুধ বাইরে থেকে আনাতে হচ্ছে। বোতল বোতল রক্ত।’
‘রক্ত! রক্ত তো তোমরা নিজেরাই দিতে পার। এত সব জোয়ান ছেলে রয়েছ।’
‘আমার রক্ত! সুগার ভরা। দেশের জন্যে আমরা এক সময়ে প্রচুর রক্ত ঝরিয়েছি ভাই। এখন তোমরা ঝরাবে। অনাচারের বিরুদ্ধে লড়বে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে, অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।’
‘তাহলে টাকা?’
‘ওই যে শুভবাবুকে বলো। এ তো ওঁদেরই গুন্ডাদের কাজ।’
সিগারেট ধরা ফেরানো মুখ বললে, ‘এটা আপনাদের একটা রেওয়াজ হয়ে গেছে, খুনজখম হলেই, আমার পার্টি করছে। জনগণ মূর্খ নয়। তাদেরও মগজ আছে। অনুপ এমন কিছু পলিটিক্যাল হিরো নয় যে তাকে মেরে আমরা কোনো ফায়দা ওঠাব। একটা ফালতু ছেলে। সমাজবিরোধীও বলা যায়।’
চুরুট বললেন, ‘সমাজবিরোধী ব্যাখ্যাটা এবার স্পষ্ট হওয়া দরকার হয়েছে। অনুপ যদি সমাজবিরোধী হয় তাহলে আমরাও সমাজবিরোধী।’
সিগারেট: সমাজ জীবনের শান্তি যারা নষ্ট করে তারাই সমাজবিরোধী।
চুরুট: অনুপ কি শান্তি নষ্ট করেছে? অমন একটা উপকারী ছেলে?
সিগারেট: ও আর ওর দলবল পাড়ার এক বিধবাকে পথে বসিয়েছে! তার এক টুকরো জমি খোলা পড়েছিল, সেই জমিটা জবরদস্তি দখল করে রাতারাতি একটা আটচালা তুলে, পাঠচক্র সাইনবোর্ড মেরে শেষ করে দিয়েছে। এর পেছনে অবশ্য আপনাদেরও মদত আছে। প্রকারান্তরে আপনারই সমাজবিরোধী। যত অপকর্মেও মাথা।
চুরুট: তা অবশ্য ঠিক। একটা পোড়ো ডিসপিউটেড জমিকে ওরা কাজে লাগিয়েছে। সেখানে ছেলে-মেয়েরা বিনা পয়সায় লেখাপড়া করছে, বিনা পয়সার রুগির চিকিৎসা হচ্ছে। এর চেয়ে পাপ কাজ আর কী হতে পারে! খুব অসুবিধে হয়ে গেছে আপনাদের ছেলেদের। ওই পোড়ো ভিটেয় বসে সাট্টা খেলতে পারছে না। চুল্লু খেতে পারছে না। এর তার বাড়ির মেয়েকে ধরে এনে সেবা করতে পারছে না।
তিমির বললে, ‘আপনাদের এই কবির লড়াই অনুপকে কোনও সাহায্য করছে না। কিছু টাকার খুব প্রয়োজন।’
‘টাকার প্রয়োজন তো সকলেরই; কিন্তু আসে কোথা থেকে! পার্টিফাণ্ড তো ভাঙা যায় না।’
‘তাহলে আপনারা আসুন।’
চুরুট বললেন, ‘ছোকরার তো ভারি ট্যাঁকট্যাঁকে কথা।’
সিগারেট বললেন, ‘কোন বাড়ির ছেলে। আগে তো চোখে পড়েনি!’
তিমির বললে, ‘যাক দু-জনের তাহলে মিলন হল!’
চুরুট বললেন, ‘শোনো ছোকরা বাঁচতে যদি চাও, যেকোনো একটা দলে ভিড়ে যাও। দল হল আমব্রেলা। তা না হলে ওই অনুপের অবস্থা হবে।’
তিমির বললে, ‘ভেবে দেখি।’
তিমির কোনোদিন সাহস করে এত কথা বলেনি। নিজেই অবাক হচ্ছিল। নিজের বাকপটুতায়। বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। রাতের দুর্বলতা চারপাশে, আনাচে-কানাচে, ঘুপচি-ঘাপটিতে জমে উঠছে। ওই বিশাল বাড়ির একটি ঘরে জীবন-মৃত্যুর লড়াই চলেছে। আজকের সকাল অন্য সব সকালের চেয়ে কত ভিন্ন। তিমির বেঁচে আছে অক্ষত। বেলা দশটা পর্যন্ত অনুপও তাই ছিল। এই মুহূর্তে সে ফুটো ফুটো।
তিমির হাসপাতালের ভেতর ঢুকতে যাচ্ছে। ইলা বেরিয়ে এলো চোখে আঁচল চাপা দিয়ে। পেছন পেছন আসছে, সেই তিনটে লটপটে ছেলে। তিমির বললে, ‘কি হল ইলা!’
একটা ছেলে বললে, ‘খেল খতম।’
তিমিরের মনে হল সে পাথর হয়ে যাচ্ছে। কত সহজে, কত হালকা করে ছেলেটা বলতে পারল, খেত খতম। ইলা তিমিরের বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ওষুধের গন্ধ। হলদে আলো। সাদা পোশাক-পরা নার্স। ঠেলা স্ট্রেচারে আপাদমস্তক ঢাকা একটা দেহ করিডর ধরে এগিয়ে চলেছে।
তিমির একটা হাত ইলার পিঠে রাখল, আর একটা হাত ইলার মাথার পেছনে, চুলের খোঁপার পাশে। তিমিরের মনে তখন মরণ, দু হাতের মাঝে জীবন। তিমির ধরাধরা গলায় বলতে পারল, ‘ইলা কাঁদে না। লক্ষ্মীটি কাঁদে না।’
দু হাত দূরে থমকে দাঁড়িয়ে আছে হায়নার মতো তিনটে ছেলে। বিশ্রী রাতের গায়ে যেন কালো কালো লোম বেরোচ্ছে। অনুপের লেখা একটা গানের লাইন মনে পড়ছে, একটি রজনীগন্ধা একটি মাধবীসন্ধ্যা! অনুপের সব লেখার মধ্যেই একটা কথা থাকত, ফুল ফোটার আগেই ফুল ঝরে যাওয়া।
তিমির আর শক্ত থাকতে পারল না। হু-হু করে কেঁদে ফেলল। বাইরে দুটো ভীষণ আকৃতির মানুষ যমদূতের মতো খাড়া! একজনের মুখে চুরুট। আর একজনের মুখে সিগারেট। অনুপকে যেন নিতে এসেছে। ছ’টা ছেলে যেন ভূত-প্রেত, নন্দী-ভৃঙ্গী।
একটা ছেলে বললে, ‘আমি জানি এ কার কাজ। চখার দল করেছে। অনুপদা সাতদিন আগে চখাকে বাড়ির সামনে ধরেছিল। বলেছিল, ‘এ পাড়ায় আর কোনোদিন নোংরামি করতে এলে যা ব্যবস্থা করার করব। অনুপদা জানত না, কোথায় খাপ খুলতে গেছে!’
৭
অনুপ চলে গেল। পড়ে রইল তার শান্তিনিকেতনী ঝোলা ব্যাগ। গোটা বারো গান লেখা ডায়েরি আর খাতা। একটা সিগারেট লাইটার, একটা পুরোনো সাইকেল। একটা কম দামি পেন।
অনুপকে যারা সরিয়েছে তারা কম করিতকর্মা নয়। এখনও পর্যন্ত পুলিস কাউকে গ্রেফতার করে উঠতে পারেনি। আজকাল একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়। বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে। ব্যাপারটার পেছনে আরও অনেক চক্রান্ত আছে। অনুপ যে বিধবার জমির ওপর গ্রন্থাগার আর ক্লাব করেছিল, সেই বিধবা মহিলাটি তার পড়তি যৌবনের শেষ ছটায় এক বিকৃত-প্রেমী নেতাকে জড়িয়ে ফেলেছে। তিনি এখন ওই এলানো ফুলে প্রবীণ ভ্রমরের মতো হুল ছাড়া আটকে ভোঁ ভোঁ করছেন। শোনা যায়, তিনি বিপ্লবী কায়দায় তাঁর সংসারকে তালাক দিয়ে এই অবৈধ প্রেমটিকে ব্যভিচারের গাড্ডা থেকে তুলে ধর্মের বেদিতে অক্ষয় প্রেমের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করবেন। রাজনীতির কল্যাণে, তাঁর এখন অর্থের অভাব নেই। তাঁরই, কয়েকজন বশম্বদ চেলার বড়ো ইচ্ছে, ইলাকে একদিন সবাই মিলে রেপ করে। খুবই সদিচ্ছা। এদেশের যৌবন আর কোন ঢালে বইবে? ড্রাগস, চুল্লু, সাট্টা, সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক, বাজার দোকানে রোজ পেলা তোলা, সপ্তাহে নিদেন একটা লাশ ফেলা। আর সিনেমার অনুপ্রেরণায় গণধর্ষণ। ওরা জানে, পাড়ায় গিজগিজ করছে মানুষ। সংখ্যায় অনেক, কিন্তু ওরা মানুষ নয় পোকা। এই তো সেদিন পল্লব সিনেমার রাতের শো ভাঙার পর দত্ত জুয়েলারি স্টোর্সের মেজো ছেলে নতুন বউকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। বউটার খুব যৌবন। বড়ো দত্তর খুব দেমাক। টাকা পয়সা চাইতে গেলে খুব রেলা নিত। সেই রেলা এখন রোড রোলারে ফেলে ফ্ল্যাট। মেজো ছেলেটার থোবনায় তিনটে ঘুসি। ব্যাটা নর্দমায় দোআনি খুঁজছে আর সাউথ ক্যালকাটার আদুরিকে বিবস্ত্র করে, যাও সুন্দরী এইবার হেঁটে হেঁটে বাড়ি যাও, কেমন লাগছে মধুমতী, যখন এই পুণ্য কর্মটি হচ্ছে, তখন অন্য সব বাঙালির বাচ্চারা পালিয়ে আয় পালিয়ে আয় বলে পালাচ্ছে। ওই বীরেরা গালাগালটাকে এখন শুধরে নিয়েছে। শুয়োরের বাচ্চা আর বলে না, বলে বাঙালির বাচ্চা। অনুপ চলে গেছে। রুখে দাঁড়াবে কে। বরং এ বেশ ভালো, এক একটা গরমাগরগম ঘটনা ঘটে যায়, আর ঘরে ঘরে রসাল আলোচনা। ছেলে, বুড়ো, মেয়ে, মদ্দ। যে ত্রিসীমানায় ছিল না, তার মুখেও প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ। শাড়ি, শায়া, ব্লাউজ, ভেতরের জামা সব খুলে, বললে, যা:। আর সে আসছে, ওই চেহারা। সঙ্গেসঙ্গে শ্রোতার মন্তব্য, বেশ করেছে, আজকালকার মেয়েদের সাজ নয় তো লোভ দেখানো! আমি বলব, বেশ করেছে।
সেদিন সকালে ইলার মা এলেন যতীশবাবুর বাড়িতে। মহিলা একমাত্র ছেলের মৃত্যুতে একেবারে দুমড়ে-মুচড়ে গেছেন। ফর্সা রং পোড়া পোড়া হয়ে গেছে। অলোকা বললে, ‘আসুন মাসীমা। চা করছি, খাবেন তো?’
মহিলা ভয়ে ভয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাত বললেন, ‘মা কোথায়?’ গলা শুনেই মনোরমা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
ইলার মা বললেন, ‘আর তো ওপাড়ায় টেঁকা যাচ্ছে না দিদি। ভয় আমার নয়, ভয় ইলার। গোটা সাতেক ছেলের একটা দল প্রায় অতিষ্ঠ করে মারলে।’ সমীর এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। জিজ্ঞেস করলে ছেলে সাতটার নাম জানেন?’
‘ওরাই নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে। সেই শুনি। অদ্ভুত অদ্ভুত নাম সব। ছেনো, লকা, লম্বু, জগা। কে যে কোনটা তা বাবা বলতে পারব না।’
‘আপনি প্রথমেই লোক্যাল থানায় একটা পিটিশান করুন। আইনে আগে কী করে দেখা যাক।’
মিহিরও এসে গেছে। মিহির বললে, ‘তুমি দাদা ছেলেমানুষের মতো কথা বোলো না। থানায় জানালে, থানাই ওদের প্রথমে জানাবে, মাসীমার বারোটার জায়গায় আঠারোটা বাজিয়ে দেবে। তুমি নতুন ওকালতি ধরেছ তো, সবেতেই আইন দেখাচ্ছ।’
সমীর বললে, ‘তাহলে রাস্তাটা কি? মানুষ পাড়া ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে?
‘না খুনকা বদলা খুন।’
‘তোর মুন্ডু। ওই করতে গিয়ে আজ আমাদের এই হাল হয়েছে।’
‘তাহলে একটা শান্তি কমিটি করো।’
‘শান্তি কমিটি। এ কি হিন্দু-মুসলমানে রায়াট। তুই যা, ছাদে যাচ্ছিস ছাদে যা।’
শিশির একবার তাকিয়ে চলে গেল। অনুপ যেদিন চলে গেল, সেই রাত থেকে শিশিরের মাথায় ইলা ঢুকেছে। আগে ইলার কথা সে এত ভাবত না। মাঝেমধ্যে দেখা হলে, তার মনে হত, মেয়েটার খুব রূপ। শাড়ি ফেলে স্কার্ট পরলে কে বলবে ভারতীয়। ওই পর্যন্তই। শিশির মনের ব্যথ্যা মনেই রাখে। এমনিই তার এই জগৎটাকে মনে হয় রং তামাশা। বন্ধুবান্ধব নেই। বাড়ির সঙ্গেও বেশি মেলামেশা নেই। একা থাকতে ভালোবাসে। আর একা থাকে বলেই নানা-রকম উদ্ভট চিন্তা আসে মনে। ইলা সেদিন প্রথমে তাকেই বলেছিল ওদের সঙ্গে হাসাপাতালে যেতে। শিশির যেতে পারত, কেন গেল না সে নিজেই জানে না। এখন মনে হয় তার প্রায়শ্চিত্ত করা উচিত। সে যদি ছাত্র না হত, সে যদি বড়দার মতো একটা কিছু করত, তাহলে আজই সে ইলাকে বিয়ে করে সব সমস্যার সমাধান করে দিত। শিশির এই পাড়ার সমস্ত ছেলের চালচলন জানে। এই পাড়া কেন, কলেজের সহপাঠীদের তো দেখছে। মেয়ে মানেই ভোগের সামগ্রী। কড়া কড়া হিন্দি ছবি দেখছে। ভিডিয়ো দেখছে। যা-তা বই পড়ছে। যা-তা নেশা করছে, আর চারদিক একেবারে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। শিশির ওই সাতটাকে চেনে। একজনের বাপ কনট্রাক্টর, একজনের বাপ দোকানদার, একটা ছেলে ওই যাত্রানায়ক বিজনকুমারের ভাই। সব কটা সমান। ওদের দিকে তাকাবার সময় ওদের বাড়ির লোকদের নেই। তারা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। ওই দলের একটাকে কুপিয়ে খুন করতে পারলে তবেই সমস্যার সমাধান। একটা নয়, পারলে সাতটাকেই। ওদের বাঁচার অধিকার নেই। এই সাতটা খুন তাকেই করতে হবে। ভদ্রলোক হয়ে মায়ের আঁচলের তলায় বসে, বাবার উপদেশ শুনলে, সে মধ্যবিত্ত কেরানি হবে। কালে তার একটা বউ হবে। রোজ সকালে ডাল ভাত, চুনোমাছের ঝাল খেয়ে অফিসে যাবে। রোজ রাতে বউকে নিয়ে বিছানায়। রোজই সেই এক খেলা। ধীরে ধীরে নগ্ন। পাঁচ মিনিট চটকাচটকি, দু মিনিট সঙ্গম, দশ মিনিটের মধ্যে অতৃপ্তির নিদ্রা। একটি সন্তান। দীর্ঘ ব্যবধানে আর একটি। ইনসিয়োরেন্স, সেভিংস, পরিকল্পিত হিসেবী জীবন। রাবিশ। হেল উইথ দিস টাইপ অফ লাইফ। পৃথিবীতে এইভাবে বাঁচার দিন ফুরিয়ে গেছে। সে আদর্শকে পড়ে থাকতে দেখছে পথের পাশে চাপচাপ রক্তে। তার নাম ছিল অনুপ। সে এ যুগের ছেলে ছিল। তার মনটা ছিল সে যুগের। নাইট স্কুল, ব্যায়ামাগার, ফ্রি হোমিয়োপ্যাথিক ওষুধ, প্রেমের গান। ডাইনোসর, টেরড্যাকটিকল মরেছিল, অন্য সব ক্ষিপ্র, হিংস্র প্রাণীর উদ্ভবে। মানুষও পশু, তবে এক জাতির মধ্যেই অনেক ধরনের। বাঘ, সিংহ, ভেড়া, ছাগল, হায়না, শেয়াল। কে বাঁচে, কে মরে। শৃগাল জেতে কী শের!
শিশির ভীষণ ভাবনায় পড়েছে। সে রফা করে বাঁচবে না। সে মিহিরের মতো লোক দেখানো শরীর চায় না। সে সমীরের মতো শামলাধারী, যে আইন প্রায় তামাশা, সেই আইনের আইনজীবী হতে চায় না। হতে চায় না তিমির। যে গান কেউ শুনবে না, যে গান গেয়ে ভিক্ষে করতে গেলেও পয়সা মিলবে না, সেই গানের গাইয়ে হয়ে, মিহি পাঞ্জাবি পরে বাড়ি বাড়ি দশবিশ টাকার টিউশানি শিশির করতে চায় না। একে শিল্পী বলে না। কারু আর চারু এ যুগের নয়। এ যুগ হল বারুদের যুগ। একটা কিছু করতে হবে। এবং করতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। শিশির সোজা রাস্তায় গিয়ে পড়ল। আজকাল তার হাঁটাচলা অনেক দ্রুত হয়েছে। সমস্ত জগৎ, সমস্ত ব্যবস্থার ওপর তার অসম্ভব ক্রোধ। সব মানুষকেই তার মনে হয় ভন্ড। সবাই প্রচ্ছন্ন পাপী। অনেকটা পথ উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটলে সে কিছুটা শান্ত হয়।
যতীশবাবু এতক্ষণ পুজোয় ব্যস্ত ছিলেন। তিনি এইবার এলেন অনুপের মায়ের খবর নিতে। অলোকা চা এনেছে। ভদ্রমহিলা যতীশবাবুর সামনে বসে চা খেতে লজ্জা পাচ্ছেন। যতীশবাবু বললেন, ‘আমাদের দু-জনেরই যথেষ্ট বয়েস হয়েছে। আর লজ্জাটজ্জা এখন বিসর্জন দেওয়াই ভালো। নিন চা খান। অনুপ আমাকে বেশ কিছুটা কাবু করে দিয়ে গেছে। আমার চার ছেলে। আমি বেশ কয়েক বছর এই ভাবায় অভ্যস্ত হয়েছিলুম, আমার পাঁচ ছেলে কিছুতে সামলে উঠতে পারছি না।’
মনোরমা বললেন, ‘দিদি বেশ বিপদে পড়েছেন। পাড়াটাতো খুবই খারাপ। আর ওই মেয়ে। বড়ো সমস্যা। বেশ ভয়ে ভয়ে দিন কাটছে।’
যতীশবাবু বললেন, ‘দ্যাখো মনোরমা, আমি মনে মনে একটা জিনিস ভেবেছি। তোমাকে আমি বলিনি, আজ দিদির সামনেই বলে ফেলি, মনে হয় তোমার আপত্তি হবে না। আমি সমীরের বিয়ে দোব। দোব ইলার সঙ্গে। দিদি আপনার কোনো আপত্তি নেই তো!’
ইলার মা মাথা নীচু করে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। আঁচলে চোখ মুছছেন।
যতীশবাবু বললেন, ‘মৌনং সম্মতি: লক্ষণম। মনোরমা তোমার কোনো আপত্তি নেই তো?’
‘সারাজীবন তোমার কোনো কথায় আপত্তি করেছি?’
‘সেইতেই তো আমার ভয়। দেখো বিয়ে মানুষ একবারই করে। সমীরকে আমি জানি। সে আমার সিদ্ধান্তের ওপর না বলবে না। যুগ পালটেছে। ইলার আপত্তি হবে না তো!’
ইলার মা মুখ তুললেন। বহুদিন পরে মহিলা হাসলেন। চোখে জল, মুখে হাসি। মাথা দুলিয়ে বললেন, ‘না দাদা আপত্তি হবে না। মেয়ের চালচলন একালের মত হলেও, মনটা সেকালের।’
‘সেইটাই তো দরকার। তাহলে পাকা কথা হয়ে গেল। শুভস্য শীঘ্রম। আমি পুরোহিত মশাইয়ের সঙ্গে কথা বলে দিন-ক্ষণ পাকা করে ফেলছি।’
যতীশবাবুর বাড়িতে বিয়ের বাতাস লেগে গেল। মনোরমা একবার শুধু স্বামীকে বলেছিলেন মেয়েটাকে আগে পার করতে পারলে বেশ হত। এই বিয়ের ব্যাপারে সকলেই খুব খুশি। শুধু তিমির অসম্ভব গম্ভীর। সেই হাসপাতালের সাঙ্ঘাতিক রাতের পর তিমির ইলাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছে। এখনও ইলার স্পর্শ তার বুকে লেগে আছে। অনুপের মৃত্যুর পর ইলাদের বাড়িতে তার যাওয়া-আসা বেড়ে গিয়েছিল। ইলাকে গান শেখাতে শুরু করেছিল। ইলার মা একদিন বাড়ি ছিলেন না, সেদিন তিমির নিজেকে রুখতে পারেনি। বড়ো বেশি কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। দু-জনের কেউই মনে করেনি পাপ করছি। অনুপ তিমিরেরই বন্ধু ছিল। ইলা অনুপের বোন। ইলার ওপর কার অধিকার বেশি। তিমিরের স্থায়ী কোনো উপার্জন নেই। সেই কারণে তার বিয়ের কথা উঠল না। আজ নেই। কাল তো হতে পারে। গান তো সে ভালোই গায়। ক্ল্যাসিক্যাল গুরু ধরেই শিখেছে। আধুনিক ফেরি করতে হয়। উপায় কী! উচ্চাঙ্গের যে বাজার নেই। ইলা যদি দাদার বউ হয়, একবাড়িতে সে কি করে থাকবে। অসম্ভব। ইলার দিকে তো তাকাতেই পারবে না। তাকালেই দু-জনেরই মনে পড়বে, সেই দিন, সেই রাতের কথা।
যতীশবাবুর বাড়িতে দুটি ছেলেকে প্রায়ই দেখা যায় না। দেখা যায় না শিশিরকে, দেখা যায় না তিমিরকে। শিশির ইলাকে মন থেকে ফেলে দিয়েছে। ফেলতে পারেনি ওই সাতটা ছেলেকে, যারা সমস্ত যুবশক্তিকে কলুষিত করছে। শিশির কখনো ভাবে টেররিস্ট হবে। কখনো ভাবে গেরিলা। ভয়ঙ্কর একটা কিছু হতে না পারলে, এই পুরোনো পাপ ধ্বংস করা যাবে না। মন্দিরে পূজারি ঘণ্টা নেড়ে যাবেন, ক্লাসে শিক্ষক লেকচার দেবেন, মঞ্চে নেতা চিৎকার করে যাবেন, ঘরে ঘরে নবজাতকের ক্রন্দন শোনা যাবে, সানাই বাজবে, প্রজাপতি উড়বে, ক্ষমতার জিপগাড়ি রাস্তা কাঁপিয়ে ছুটবে, নিশুতি রাতে বোমার শব্দ, পারিজাত সিনেমার পাশে, অর্ধসমাপ্ত ফ্ল্যাটে গণধর্ষণ, এই সব ‘চলছে চলবে’র গলায় পা তুলে দিতে হবে। সোজা রাস্তা ধরে শিশির গোঁ গোঁ করে বুনো মোষের মতো হাঁটতে থাকে, হাঁটতেই থাকে।
দু-পাশে সেই একই লোকালয়, বাজার, দোকানপাট। দু-ধরনের মুখ, বোকা-বোকা, বদমাইশ- বদমাইশ, ধান্দাবাজ, চোর-চোর, পাপী-পাপী। সর্বত্র মানুষ পোকার কিলিরবিলির। পথ কোনো সময়েই দিগন্তে গিয়ে ঠেকে না। আগুন জ্বালা দিগন্ত। যার সামনে মানুষ থমকে দাঁড়াতে পারে। উদ্ভাসিত হতে পারে। শিশির একজন গুরু খুঁজছে, যিনি শেখাতে পারেন, মানুষ কীভাবে মারতে হয়, কীভাবে একের পর এক ক্লিন্ন জনপদ নি:শেষে নিশ্চিহ্ন করতে হয়। গড়া নয়, সেই গুরু চাই যিনি ভাঙতে শেখাবেন, শেখাবেন চুরমার করতে। সুর নয়, অসুর হতে হবে। দেবীর মৃত্যু হয়েছে। দানব না জাগলে দেবীর আবির্ভাব অসম্ভব। শিশিরকে সবাই পাগলাটে খেয়ালী ভাবে, তাই রক্ষে। না হলে তার এই বিভ্রান্ত, উদাস, অথচ ক্রোধী ভাব সকলের উদ্বেগ জাগাত।
তিমির একদিন ইলাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এই যে তুমি একটা সহজ সরল বিশ্বাসী লোককে ঠেকাতে চলেছ, তোমার বিবেকে লাগছে না।’
ইলা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, ‘এমন কোনো মেয়ে নেই যাকে কিছু না কিছু গোপন করতে হয়! এ নিয়ে কোনো মেয়েও মাথা ঘামায় না, কোনো ছেলেও মাথা ঘামায় না। বিয়ের পর সব মুছে গিয়ে নতুন জীবন শুরু হয়।’
‘আমার কথা তুমি একবারও ভেবেছ।’
‘ভেবেছি, ভাবছি, ভাবব।’
‘কীভাবে!’
‘তোমার কত কাছে থাকব। বউ না হলে কী ভালোবাসা যায় না, সেবা করা যায় না! তখন দেখবে নতুন সম্পর্কটাই কত মধুর লাগছে!’
তিমির বাইরে এসে প্রাণ খুলে খানিক হেসে নিল। এই হল জগৎ!
শিশির ভাবছে এই হল জগৎ, তিমিরও ভাবছে এই হল জগৎ!
তিমির একটা মেস দেখে এল। কম খরচে, কোনোরকমে আপাতত থাকা যাবে। বিয়ে চুকলে নি:শব্দে সরে পড়বে। পরিকল্পনাটা সে কাউকেই জানাল না।
দেখতে দেখতে যতীশবাবুর বাড়ি সেজে উঠল। ফাল্গুনের বাতাস ছুটেছে। চাঁদও উঠেছে। যতীশবাবু বাড়ি রং করিয়েছেন। আলোর মালা ঝুলিয়েছেন। এই তাঁর প্রথম কাজ, আর এই হয়তো শেষ কাজ। মনোরমা বললেন, ‘ধুমধাড়াক্কা এত যে খরচ করছ শেষে খাবে কী?’
উৎসবের মেজাজে ছিলেন যতীশ। বললেন, ‘আমার চার চারটে ছেলে আবার জামাই আসবে, আমার আবার ভয় কী! যাকে রাখ সেই রাখে।’
‘আর ছেলেরা যদি দূর করে দেয়!’
‘তখন মাথার ওপর আকাশ, ভগবান ভরসা।’
‘বিয়ের দিন এসে গেল। সমীরের সিনিয়ার সাতখানা গাড়ি যোগাড় করে দিয়েছেন। শেষ অবধি এলাহি ব্যাপারই হয়ে গেল। মাত্র জনা কুড়ি বরযাত্রী। প্রথমে সমীরের গাড়ি ইলাদের পাড়ায় ঢুকেছে। সমীরের গাড়িতে মিহির, তিমির, শিশির, পুরোহিত। পরের গাড়িতে যতীশবাবু, অলোকা, শিশিরের আদালতের কয়েকজন। পরপর সাতটা গাড়ি। যতীশবাবুর জীবনে যেন যৌবন ফিরে এসেছে আজ। বুক চিতিয়ে বসে আছেন গাড়িতে। মুখে একটা তৃপ্তির হাসি। পুত্রবধূ হিসেবে যাকে নির্বাচন করেছেন, সে পরমাসুন্দরী। লোককে ডেকে ডেকে দেখাবার মতো। সমীরও সুন্দর। বৃদ্ধের কত স্বপ্ন। ফুলের মতো ফুটে উঠবে নাতি, নাতনি।
সমীরের গাড়িটা ইলাদের বাড়ির ঢোকার রাস্তার বাঁ-দিকে বাঁক নিয়েছে সবে। গতি খুবই কম। সেই সাতটা ছেলে। পর পর সামনে। মুখে ক্রুর হাসি। শিশির বসেছিল সামনে। শিশিরের শরীরটা টান টান হল। সে যখন বেরচ্ছিল, তখন যতীশবাবু বলেছিলেন, ‘এঃ আজকের দিনে তোর একটা ধুতি পাঞ্জাবি জুটল না!’ মনোরমা বলেছিলেন, ‘জুটবে না কেন! ও পরতে পারব না। পরতে জানেই না।’
শিশিরের ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলেছিল, আজ রাতে একটা কিছু হবে।
সমীর বললে, ‘এ আবার কী? এরা কারা?’
শিশির মনে মনে বললে, ‘সুখী রাজপুত্র রাজকন্যাকে দৈত্যপুরী থেকে উদ্ধার কি বিনা যুদ্ধে হয়।’
শিশির ঘাড় না ঘুরিয়ে চাপা গলায় বললে, ‘মেজদা, সেজদা, তৈরি, অ্যাকশান।’
শিশির বসে বসেই কোমরের বেল্টটা খুলে হাতে নিল। ছেলে সাতটা পাশাপাশি ধীর পায়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। চিউইংগাম চিবোচ্ছে।
শিশির ঝট করে দরজাটা খুলেই বাঘের মতো লাফিয়ে পড়ল। হাতের বেল্ট বাতাসে ঘুরে সাঁই করে একটা শব্দ তুলল। একবার, দুবার, বারবার। সাতটা ছেলে একেবারে হতচকিত। ভাবতেই পারেনি, তাদের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াবার সাহস কেউ রাখে।
মিহির ওপাশ থেকে লাফিয়ে নেমেছে। নেমে এসেছে তিমির। পেছনের গাড়িতে বসে যতীশবাবু বলছেন, ‘কী হচ্ছে কী, মারামারি!’
যতীশও নেমে এলেন। চিৎকার করে বললেন, ‘ফাইট ফাইট।’ রক্ত ফুটছে। শুভ রাত্রি। শুভ কাজ দিয়ে শুরু হোক। মরতে একদিন হবেই। আজ হোক আর কাল হোক। কাউকে না কাউকে একদিন না একদিন শুরু করতে হতই। আজ সেই দিন।
সাতটা ছেলের পকেটে সাতখানা বিলিতি ক্ষুর, অকেজো। মিহির অবাক। শিশির একাই সাতটার মহড়া নিচ্ছে। যতীশবাবু এগিয়ে যেতে যেতে বলছেন, ‘ভয় নেই, আমি আছি। ফাইট।’
মিহির তেল মাখা চকচকে শরীরের কথা ভুলে গেল। ভুলে গেল সে ভারতশ্রী হতে পারে। নিরীহ বরযাত্রীরা নেমে এসেছে। সাতটা ছেলে ক্ষতবিক্ষত। মিহির আজ প্রমাণ পেল, তার ডাম্বেল, বারবেল, আদাছোলার তেজ কতটা। সাতটা ছেলে কুকুরের মতো কেঁউ কেঁউ করছে।
সমীর কোনোদিন ভুলতে পারে না, সেই দিন, সেই রাতের কথা। ভাবতেই পারবে না, সংসারে ফাটল ধরিয়ে সরে যাবার কথা। শিশির বেধড়ক মারতে মারতে এগোচ্ছে। যে দিগন্ত সে দেখতে চেয়েছিল আজ সেই রক্তাক্ত দিগন্ত তার সামনে খুলে গেছে। রাত যতই অন্ধকার হোক, ভোর একদিন হবেই।