সেই ছবি – সিজার বাগচী
বাজ পড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় অর্কর। অনেকক্ষণ ধরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এবার জোরে—জোরে বাজ পড়ছে।
ঘুম ভাঙার পর অন্ধকারে চোখ মেলে দু—এক মুহূর্ত অর্ক বুঝতে পারে না ও কোথায় শুয়ে। তারপর ওর খেয়াল হল, দিনদুয়েক আগে বাবার অফিস কোয়ার্টার ছেড়ে ওরা নতুন বাড়িতে উঠে এসেছে। এই বাড়িতে এসে অর্ক আলাদা ঘর পেয়েছে। কোয়ার্টারে দাদা আর ও একটাই ঘর ভাগাভাগি করে থাকত। যেহেতু তিন বছরের বড়ো, তাই ঘর সাজানোর ব্যাপারে ও খবরদারি করত। নিজের ইচ্ছেমতো দেওয়ালে পোস্টার সাঁটত। সাউন্ড সিস্টেমে নিজের পছন্দের গান বাজাত। সারা ঘর নিজের জামাকাপড়, বইখাতা ছড়িয়ে রাখত। অর্ক একেবারে পাত্তা পেত না।
নতুন বাড়িতে অর্কর বড়ো ঘর হয়েছে। ঘরের পাশেই বাগান। জানলা খুললেই বাগানের পেয়ারা গাছ, নারকেল গাছ দেখা যায়। দিনের বেলা প্রচুর পাখি আসে বাগানে। এখানে আসার আগে এত পাখি দেখেনি অর্ক। সেই পাখিদের কিচিরমিচিরে ওর ঘরটাও যেন ঝলমল করতে থাকে।
কিন্তু এখন এই রাতে এতবড়ো ঘরে একা জেগে উঠে অল্প—অল্প ভয়ই করে অর্কর। ছেলেবেলা থেকে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত ও কোনোদিন একা ঘরে থাকেনি। এই প্রথম। অর্কর খুব ইচ্ছে করছিল, ছুটে বাবা—মায়ের ঘরে চলে যায়। পাছে কাল সকালে দাদা এই নিয়ে হাসাহাসি করে, তাই নিজের ভয়কেই সামলানোর চেষ্টা করে ও।
ধীরে ধীরে অর্ক বিছানায় উঠে বসে। কাচের জানালায় মাঝে মাঝেই আলো এসে পড়ছে। তারপর গুমগুম করে বাজ পড়ার আওয়াজ। অর্ক একবার জানলা দিয়ে তাকায়। আর তখনই ওর চোখ পড়ে জানলার পাশে টাঙানো বড়ো ছবিটায়। নতুন বাড়ি কেনার পরই এ ঘরে ঢুকে ওরা ছবিটা দেখেছিল। বাড়ির আগের মালিক নিজের সব জিনিসপত্র নিয়ে গেলেও, ছবিটা নেয়নি। ছবিটা এই ঘরেরই দৃশ্য। অর্ক যেরকম খাটে শুয়েছে, প্রায় ওইরকম খাট রয়েছে ছবিতে। তবে অর্কর জামাকাপড়ের আলমারি, লেখাপড়ার টেবিল অবশ্য ছবিতে নেই। ছবিতে খাট ছাড়া আছে একটা ছেলে। কিন্তু ছেলেটির চেহারা এমনভাবে আঁকা যে, মুখ দেখা যাচ্ছে না।
ঘর গোছানোর সময় মা জানতে চেয়েছিলেন, ‘এই ছবি নিয়ে কী করব?’
বাবা আলগোছে একবার ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘থাক না। কেউ এঁকেছে—টেকেছে। খারাপ কী?’
অর্কও ছবিটা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। অথচ এখন ছবিটার দিকে তাকিয়ে ওর মাথার ভিতরেও বিদ্যুৎ চমকাল। ছবিটা আর নিছক ছবি নেই। ওটা যেন এই ঘরেরই মতো একটা ঘর। আর সেই ঘর থেকে ছেলেটি ওর দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছে।
অর্ক বিছানা আঁকড়ে ধরে। একটা শিরশিরে অনুভূতি কেন্নোর মতো ওর সারা শরীরে হেঁটে বেড়ায়।
ছেলেটি এবার বলে, ‘আরে ভয় পেয়ে গেলে যে! আমি তো তোমায় ডাকতে এসেছি।’
‘ডা—ডাকতে?’ অর্ক কোনোমতে বলে।
‘হুম। আমার এই ঘরে।’
অর্ক ভয়ে—ভয়ে বলে, ‘ওটা তোমার ঘর মানে? ওটা তো ছবি!’
‘তোমার কাছে ছবি। আমার কাছে ঘর। এই যেমন ধর আয়না। তুমি তো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াও। কিন্তু জান কি যেটা প্রতিবিম্ব ভাবছ, তা আসলে অন্য এক জগৎ?’
‘জগৎ?’ অর্ক থতমত খেয়ে বলে।
‘হ্যাঁ। এক—এক বিশেষ দিনে সেই জগতের দরজা খোলে। এই যেমন আজ আমি তোমার সঙ্গে কথা বলছি। কাল সকাল হলে কি আর তা সম্ভব হবে? তখন তো আবার আমি ছবি হয়ে যাব। তুমি আসবে আমার ঘরে?’
অর্ক ফ্যালফ্যাল করে ছেলেটির দিকে তাকায়। এমন অদ্ভুত কাণ্ড ও কখনো দেখেনি। এটা কি স্বপ্ন? কিন্তু ছেলেটার জ্বলজ্বলে চাউনি, হাসি, সবই ওর সামনে ঘটছে। বাইরের ঝড়—বৃষ্টির শব্দও দিব্যি শুনতে পাচ্ছে ও।
বাবা—মাকে ডাকার কথা অর্কর মাথায় এল। সেই সঙ্গে দাদার মুখও মনে পড়ল। অর্ক ঠিক করল, আগে ও নিজে ব্যাপারটা বুঝবে। এরপর দরকার হলে বাবা—মাকে ডাকবে। সেইমতো ও বিছানা ছেড়ে নামল। এমন সময় কাছেই কোথাও জোরে বাজ পড়ল। সেই আওয়াজে কাঁপুনি লাগে অর্কর মনে। ও একবার জানলার দিকে দেখে আর একবার ছবিটার দিকে। ছেলেটি হাসতে হাসতে ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে। সেই ডাকে এমন কিছু ছিল যে, অর্ক তা এড়াতে পারে না।
অর্ক পায়ে—পায়ে এগিয়ে যায় ছবিটার কাছে। ছেলেটি ছবির ভিতর থেকে হাত বের করে। বলে, ‘এসো।’
অর্ক ছবির ফ্রেমে এক পা দিয়ে ছেলেটির হাত ধরে। আর তারপরই ও আবার চমকায়। ছেলেটির হাত কনকনে ঠান্ডা। তবে অর্ক হাত ধরতেই ছেলেটি এক টানে ওকে ছবির ভিতর ঢুকিয়ে নেয়।
ছবির ভিতর পা দিয়ে অর্কর ভারি শীত—শীত করতে লাগল। জায়গাটা খুব ঠান্ডা। আর এক আশ্চর্য রকমের নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে আছে এখানে। ঘরের দেওয়াল, আসবাব সব যেন ভাসছে। ছেলেটির মুখের দিকে অর্ক ভালোভাবে তাকায়। এবার ছেলেটিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ফরসা, কোঁকড়ানো চুল। ছেলেটি বোধ হয় ওরই বয়সি। শুধু ছেলেটির চোখ আর হাসিটা ভারি ছমছমে।
অর্ক জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার নাম কী?’
‘আমার নাম?’ ছেলেটি হি হি করে হাসে। বলে, ‘আমার নাম ছবি।’
‘তুমি ছবিতে কতদিন আছ?’
‘তা প্রায় সাত—আট বছর।’
অর্ক জানতে চায়, ‘তার আগে?’
‘এই বাড়িতে থাকতাম। তুমি শোনোনি, এই বাড়িতে আগে যাঁরা থাকতেন, তাঁদের ছেলেটি কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। তাঁরা থানা—পুলিশ করেছিলেন, সব জায়গায় তন্ন—তন্ন করে খুঁজেছিলেন, শুধু ছবিটা দেখেননি।’
‘তুমি—তুমি ছবিতে ঢুকে পড়েছিলে?’ অর্ক প্রায় চিৎকার করে ওঠে।
ছেলেটি মাথা নাড়ে। বলে, ‘হ্যাঁ। এই যেভাবে তুমি ঢুকে পড়লে।’
অর্ককে পরদিন সকাল থেকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওর বাবা—মা খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেওয়া থেকে পুলিশে রিপোর্ট করা, সবই করেছেন। কিন্তু অর্কর হদিশ মেলেনি। তবে দাদার একবার সন্দেহ হয়েছিল ছবিটা নিয়ে। ছবিটা দেখিয়ে ও একবার বাবাকে বলেছিল, ‘আচ্ছা, আমরা যখন এলাম তখন এই ছবিতে একটা ছেলে ছিল না? এখন দেখছি দুটো…’
বাবা কোনো জবাব দেওয়ার আগে মা ধমকে ওঠেন, ‘বোকার মতো কথা বলিস না।’
তবু দাদার সন্দেহ যায় না। ছবির সামনে ও দাঁড়িয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। দুটো ছেলের কোনোটারই মুখ দেখার উপায় নেই। তবু একটা ছেলেকে পিছন থেকে অর্কর মতো লাগে।
দাদা নিজের ঘর বদল করে অর্কর ঘরে আসে। ছবিটার উপর নজর রাখা দরকার…।