সেই কুয়াশা ২.৫

পাঁচ

লাশের শরীর সার্চ করল কুয়াশা আর নাতালিয়া কিন্তু উল্লেখযোগ্য কিছুই পাওয়া গেল না। টাকাভর্তি ওয়ালেট আছে, ভুয়া আই.ডি. আছে, পিস্তলের বাড়তি অ্যামিউনিশনও আছে—কিন্তু এসব থেকে তার আসল পরিচয় বের করা সম্ভব নয়। একটা মোবাইল ফোনও বেরিয়েছে পকেট থেকে, তবে সেটার মেমোরি সম্পূর্ণ খালি। ফোনবুক বা কললিস্টে একটা নাম্বারও নেই। বিরক্ত হয়ে মেঝে থেকে উঠে পড়ল নাতালিয়া, মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল খেদোক্তি।

‘কিছু একটা মিস করে যাচ্ছি আমরা,’ চিন্তিত গলায় বলল কুয়াশা। ‘একেবারে কিছুই জানতে পারব না, তা কী করে হয়?’ নাতালিয়ার দিকে মুখ ফেরাল। কী কথা হয়েছে ওর সঙ্গে, তা প্রথম থেকে খুলে বলো আমাকে।’

‘বলতে গেলে কিছুই না,’ নাতালিয়া জানাল। ‘গল্প করবার মুডে ছিল না ও।

‘তারপরেও সব শুনতে চাই আমি। ওর কথা থেকে তুমি হয়তো কিছু আঁচ করতে পারোনি, কিন্তু আমি পারব।

ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ নীরব রইল নাতালিয়া। তারপর শান্ত গলায় বলল, ‘কী লুকাচ্ছ তুমি আমার কাছে, কুয়াশা? সত্যি করে বলো তো, কেন এই লোক খুঁজছিল তোমাকে?

‘ক’দিন আগে আমার নামে নতুন একটা হুলিয়া জারি হয়েছে, জানো নিশ্চয়ই?’ বলল কুয়াশা। ‘অনেকেই খুঁজছে আমাকে।’

‘হেঁয়ালি করছ তুমি!’ অভিযোগের সুরে বলল নাতালিয়া। ‘এ-লোক আইনের কেউ নয়… তার ওপর বিদেশি। মুখে যেভাবে সায়ানাইড পিল লুকিয়ে রেখেছিল, তাতে তো মনে হয় চরমপন্থী, কিংবা ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটির সঙ্গে জড়িত! পুলিশ-টুলিশ ছাড়িয়ে আজকাল কি ওদের সঙ্গেও শত্রুতা বাধিয়েছ নাকি?’

‘আমি কিছুই করিনি, যা করবার ওরাই করছে। ড. ইভানোভিচকে খুন করেছে, আমাকে দিয়েছে ফাঁসিয়ে। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবার জন্য লড়ছি আমি।’

‘বলতে চাইছ, আমার দেশের একজন বিজ্ঞানীকে খুন করবার পিছনে ব্রিটিশদের হাত আছে?’

উঁহু। এই খুনিদের নির্দিষ্ট কোনও দেশ নেই, দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে রিক্রুট করা হয়েছে এদেরকে। খুবই ভয়ানক এক সংগঠন… পরে সব খুলে বলব তোমাকে। আগে এই লোকটার ব্যাপারে শিয়োর হয়ে নেয়া দরকার।’

‘কী শিয়োর হবে?’

‘অস্পষ্ট ব্যাপারগুলো…

‘কোনোটা স্পষ্ট মনে হচ্ছে নাকি তোমার কাছে?’ বাধা দিয়ে জানতে চাইল নাতালিয়া।

‘অবশ্যই!’ মাথা ঝাঁকাল কুয়াশা। কয়েকটা বিষয় তো এমনিতেই পরিষ্কার—-আমার জন্য এসেছিল ও, কিন্তু ব্যর্থ হলে জ্যান্ত ধরা পড়তে চায়নি। নিশ্চয়ই এমন কিছু জানত, যা আমাকে জানানো চলে না। ব্যাটার কোনও সঙ্গীও নেই আশপাশে, থাকলে এখনও আমরা বেঁচে থাকতাম না।’

‘কিন্তু তুমি যে আমার কাছে আসবে, সেটা জেনেছে কীভাবে? আমি নিজেই তো জানতাম না!’

‘ওটা সম্ভবত অনুমান… সেজন্যেই মাত্র একজনকে পাঠানো হয়েছে এখানে।’

‘অনুমান!’

‘রাশান ইন্টেলিজেন্সের ফাইলে নিশ্চয়ই এ-দেশে আমার সমস্ত কন্ট্যাক্টের রেকর্ড আছে… সেটাই ফলো করছে ওরা। যাদের কাছে সাহায্য চাইতে পারি, বিশেষ করে লেনিনগ্রাদে, তাদের পিছনে লোক লাগানো হয়েছে।

‘লেনিনগ্রাদ কেন?’

‘কারণ এখানেই আমি একজনকে খুঁজতে এসেছি। সে-কাজে যারা আমাকে সাহায্য করতে পারে, তাদের সবাই এখন আমার শত্রুদের টার্গেট।’

‘আমি ছাড়া আর ক’জন আছে অমন?’

‘খুব বেশি না, দু-তিনজন। লেনিনগ্রাদ ভার্সিটির একজন প্রফেসর আছেন, আরেকজন আছে দানভ এ… জনৈক পলিটিক্যাল অ্যাকটিভিস্ট। আর হ্যাঁ, লোকাল ক্রিমিনালদের মধ্যেও একজন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

‘সতর্ক করে দেবে ওদেরকে?’

‘দরকার নেই। যত খুশি লোক লাগাক, ওদের কারও কাছেই আমি যাচ্ছি না। তবে এর বাইরে আরেকজনকে চিনি আমি, তার সঙ্গে দেখা করা জরুরি। সেজন্যেই আমাদের এই ইংরেজ বন্ধুর ব্যাপারে শিয়োর হওয়া দরকার। কতখানি জানে ওরা … যার সঙ্গে দেখা করব বলে ভাবছি, তার পিছনেও লোক লাগিয়েছে কি না…’

‘সম্ভাবনা কতটুকু?’

‘নির্ভর করছে কতখানি রিসার্চ করেছে ওরা, তার ওপর! ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে গত এক যুগ দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি আমার। ব্যাপারটা সিরিয়াস, নাতালিয়া। ভাল করে ভাবো, কী বলেছিল লোকটা তোমাকে?’

‘বললাম তো, কিছুই না। তবে হ্যাঁ, একবার ফোন এসেছিল ওর মোবাইলে। অন্যপাশের লোকটার সঙ্গে নদীর ধার নিয়ে কথা বলছিল… মাছি মারা ছাড়া নাকি আর কিছু করবার নেই ওখানে। কথা শেষ করেই কললিস্ট থেকে নাম্বারটা মুছে দিতে দেখেছি ওকে।’

‘নদীর ধার?’ ভ্রূকুটি করল কুয়াশা। একটু পরেই মাথা ঝাঁকাল। ‘অভ কোর্স! দ্য হার্মিটেজ। ম্যালাচিট, হল! নদীর ধারে, হ্যাঁ… ওখানকার এক মহিলাকে চিনি আমি। ব্যাটারা দেখি কিছুই মিস করেনি, আমি নিজেও তো ভুলে গিয়েছিলাম ওখানকার কথা!

‘কোন মহিলা সেটা?’ গম্ভীর হয়ে প্রশ্ন করল নাতালিয়া। ‘তোমার বান্ধবী?’

‘হ্যাঁ… সিনিয়র বান্ধবী,’ হাসল কুয়াশা। ‘বয়স সত্তরের কাছাকাছি, হার্মিটেজ মিউজিয়ামের অ্যাসিসটেন্ট কিউরেটর। এককালে প্রায়ই চা খেতে যেতাম তাঁর ওখানে। ইতিহাস নিয়ে জ্ঞানগর্ভ তর্ক-বিতর্ক চলত আমাদের। একেবারে সাদাসিধে মানুষ, ভাবতেও পারিনি আমার ফাইলে বেচারির নাম উঠে যাবে।’

‘এতেই অবাক হচ্ছ? ওঁর ছেলেমেয়ে আর নাতিপুতির নামও উঠে আছে কি না দেখো গিয়ে। এসব ব্যাপারে আমাদের ইন্টেলিজেন্স অত্যন্ত সিরিয়াস।

‘এনিওয়ে,’ হাত নাড়ল কুয়াশা, ‘আর কী কথা হয়েছে ওদের

মধ্যে?

‘ওটুকুই।’ একটু ভাবল নাতালিয়া। ও হ্যাঁ… আমি যখন কাপড় বদলাচ্ছিলাম, ব্যাটা মশকরা করছিল আমার সঙ্গে।’

‘কী ধরনের মশকরা?’

‘বাজে কিছু না। বলছিল- কিউরেটর, অ্যাকাডেমিকস্ আর লাইব্রেরিয়ানদের তুলনায় গণিতবিদের শরীর যে অনেক সুন্দর হবে, তা ওর আগেই বোঝা উচিত ছিল। আমরা ফিগার নিয়ে গবেষণা করি কিনা…’

পিঠ খাড়া হয়ে গেল কুয়াশার। ‘শিট!’ গাল দিয়ে উঠল ও। ‘তারমানে ভদ্রলোকের খোঁজ পেয়ে গেছে ওরা!’

‘কার কথা বলছ?’ বিস্মিত হলো নাতালিয়া।

ঠাট্টা করতে গিয়ে আসল খবর ফাঁস করে দিয়েছে লোকটা।’ ব্যাখ্যা করল কুয়াশা, ‘কিউরেটর মানে ওই বৃদ্ধা মহিলা, অ্যাকাডেমিকস্ হলো আমার প্রফেসর বন্ধু, আর লাইব্রেরিয়ান হচ্ছেন সল্টিকভ-শেদ্রিন লাইব্রেরির আরেক বৃদ্ধ… তাঁর কাছেই যেতে চাইছিলাম আমি।’

‘কে এই বৃদ্ধ?’

‘মিউজিয়ামের ওই বৃদ্ধার মত আরেক জ্ঞানতাপস। বই সংগ্রহের জন্য লাইব্রেরিতে নিয়মিত আসা-যাওয়া করতাম আমি, সেই সূত্রে ঘনিষ্ঠতা গর্ভে উঠেছিল। ভদ্রলোক দুনিয়ার অসংখ্য ব্যাপারে আমার চোখ খুলে দিয়েছেন।’

‘কেন দেখা করতে চাইছ ওঁর সঙ্গে?’

‘ভদ্ৰলোককে চলন্ত বিশ্বকোষ বললে ভুল হয় না। বিশেষ করে রাশা আর লেনিনগ্রাদের বিষয়ে তাঁর মত গভীর জ্ঞান আর কারও মধ্যে নেই। এমন সব তথ্য জানেন, যা বইয়ের পাতায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেজন্যেই তারাকিন নামে একটা প্রভাবশালী পরিবারের খোঁজ নেবার জন্য তাঁর কাছে যাব ভেবেছিলাম।’

‘প্রভাবশালী পরিবার? এই লেনিনগ্রাদে?’

‘হুঁ।’

মুখ বাঁকাল নাতালিয়া। ‘এত সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে এত দুশ্চিন্তা! তুমি না… অ্যাই, আমি কী কাজ করি, তা ভুলে গেছ? রাশান ইন্টেলিজেন্সের ডেটাবেজ থেকে কম্পিউটারের মাধ্যমে ওই তথ্য তো আমিই তোমাকে বের করে দিতে পারি!’

‘উঁহুঁ, ওটা করবার সঙ্গে সঙ্গে তোমার নামে মৃত্যু-পরোয়ানা জারি হয়ে যাবে।’ মেঝেতে পড়ে থাকা লাশের দিকে ইশারা করল কুয়াশা। ‘এই লোকের ‘সঙ্গী-সাথীরা ছড়িয়ে আছে সবখানে। পায়চারি শুরু করল ও। তা ছাড়া… কম্পিউটারে কিছু পাওয়া যাবে বলেও মনে হয় না। যা খুঁজছি, তা বহু বছর আগের কথা। মাঝে অনেক কিছু ঘটেছে, বহুবার সরকার বদলেছে… বদলেছে প্রযুক্তিও। রেকর্ডে কোনোকালে যদি ভারাকিনদের নাম থেকেও থাকে, এখন আর আছে কি না সন্দেহ। আমার তো ধারণা, সরকারি সব ধরনের ডেটাবেজ থেকে নামধাম মুছে ফেলা হয়েছে ওদের।’

‘প্রভাবশালী কোনও পরিবারের নাম এত সহজে রেকর্ড থেকে মুছে ফেলা যায় না, কুয়াশা,’ প্রতিবাদ করল নাতালিয়া।

‘নাম মোছা না গেলেও সংশ্লিষ্টতার তথ্য মোছা যায়।’

‘কীসের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা?’

জবাব না দিয়ে মৃত লোকটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসল কুয়াশা, খুলে ফেলল তার শার্টের বোতাম, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করল উন্মুক্ত বুকটা। যা খুঁজছিল তা পেয়ে গেল একটু পরেই–বুকের মাঝখানে একটা বৃত্তাকার উল্কি… ফেনিসের চিহ্ন। নাতালিয়াকে কাছে ডেকে দেখাল ওটা।

‘কী এটা?’ বিভ্রান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল নাতালিয়া। ‘জন্মদাগ?’

মাথা নাড়াল কুয়াশা। নিচু গলায় বলল, ‘পার নস্ত্রো সার্কোলো… জন্মের সময় এ-জিনিস ছিল না আমাদের ইংরেজ বন্ধুর শরীরে। চিহ্নটা অর্জন করে নিতে হয়েছে ওকে।

‘তোমার কথাবার্তার কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।’

‘এখুনি বুঝবে। সবকিছু খুলে বলছি। নিজের নিরাপত্তার জন্যই এ-সব জানা দরকার তোমার। ফেনিস নামে একটা গুপ্তসংঘ …’

আস্তে আস্তে নাতালিয়াকে সবকিছু বলল কুয়াশা— ফেনিসের কথা, এখন পর্যন্ত যা যা ঘটেছে… স-অ-ব। ওর কথা শেষ হবার পর অনেকক্ষণ চুপ করে রইল মেয়েটা, সময় নিল এতসব তথ্য হজম করবার জন্য। একটু পর হেঁটে জানালার সামনে গেল, বাইরে দৃষ্টি ফেলে বলল, ‘তোমাকে আমি অবিশ্বাস করি না, কুয়াশা। বুঝতে পারছি, যা বলেছ তার মধ্যে মিথ্যে নেই একবিন্দুও। সেজন্যেই জানতে চাইছি, এত ভয়ানক একটা সংগঠনের সঙ্গে সংঘাতে নামা কি উচিত হয়েছে তোমার? এরা তোমার পুরনো শত্রুদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী…’

‘জানি,’ বলল কুয়াশা। ‘সেজন্যেই রানার সাহায্য নিচ্ছি। এ-ধরনের সংগঠনের ব্যাপারে অভিজ্ঞতা আছে ওর।’

‘ওকে এর ভিতরে টেনে আনাও ঠিক হয়েছে বলে মনে হয় না। আর যা-ই হোক, রানা, তোমার বন্ধু নয়। স্রেফ পরিস্থিতির চাপে পড়ে হাত মিলিয়েছে তোমার সঙ্গে, কিন্তু কাজ শেষ হওয়ামাত্র… মানে যদি আদৌ শেষ করতে পারো আর কী… তোমাকে অ্যারেস্ট করবে ও।

‘তা হলে কী করা উচিত ছিল আমার?’

‘ব্যাপারটা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারতে। গা-ঢাকা দেবার বিষয়ে তুমি একটা প্রতিভা। যদি না চাইতে, তা হলে ফেনিসের পক্ষে কোনোদিন সম্ভব হতো না তোমাকে খুঁজে পাওয়া।’

‘ওটা কাপুরুষের কাজ হতো। আমার বাবার মত একজন পরমাত্মীয়কে খুন করেছে ওরা, তারপর আবার সেটার জন্য ফাঁসিয়ে দিয়েছে আমাকেই! না, এ থেকে কিছুতেই পিছু হটা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।’

কুয়াশার কণ্ঠে উত্তেজনা লক্ষ করে উল্টো ঘুরল নাতালিয়া। বলল, ‘কিন্তু তোমরা অসহায়! যদ্দূর বুঝতে পারছি, তোমাদেরকে কোণঠাসাও করে ফেলেছে ফেনিস। কী করতে পারবে তোমরা এ-অবস্থায়?’

‘ভুল ভাবছ,’ কুয়াশা বলল। ‘এরই মধ্যে অনেকটা এগিয়ে গেছি আমরা। লিস্টের প্রথম নাম- বিয়াঞ্চির ব্যাপারটা ভেরিফাই করা হয়েছে। আর এই যে… এখানে পড়ে থাকা ইংরেজকে দেখে বোঝা যাচ্ছে, ঠিক পথেই এগোচ্ছি। লেনিনগ্রাদে ভারাকিন পরিবারকে যেন ট্রেস করতে না পারি আমরা, সে-চেষ্টা চালাচ্ছে ওরা। তোমার এখানে একজন এসেছে, আরও দু’জন নজর রাখছে হার্মিটেজ মিউজিয়াম আর শেট্রিন লাইব্রেরিতে। মরিয়া হয়ে উঠছে ওরা। এটা আমার জন্য সুসংবাদ।

‘নাহয় বের করলে ফেনিসের পিছনে কারা আছে… কিন্তু সে-খবর কার কাছে নিয়ে যাবে তোমরা? কে সাহায্য করবে তোমাদেরকে?’

‘সময় এলে সেটা জানা যাবে। দুনিয়ার সবাই তো আর ফেনিসের সঙ্গে জড়িত নয়। এমন লোকজন নিশ্চয়ই আছে, যারা ওদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারবে। আমাদেরকে শুধু তার জন্য তথ্য-প্রমাণ একাট্টা করে দিতে হবে। তুমি সাহায্য করবে আমাদেরকে? আমাকে?’

‘ঝামেলায় জড়াতে চাইছ আমাকে?’

‘দুঃখিত। এ-ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই আমার হাতে। বৃদ্ধ ওই লাইব্রেরিয়ানের কাছে সরাসরি যেতে পারব না আমি। যখন বন্ধুত্ব ছিল, তখন আমার আসল পরিচয় জানা ছিল না তাঁর। পরে পুলিশের হাতে যথেষ্ট নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে বেচারাকে এ-কারণে। আমাকে খবর পাঠিয়েছিলেন, আর কোনোদিন যেন দেখা করবার চেষ্টা না করি তাঁর সঙ্গে, আমাকে ধরিয়ে দেবেন সেক্ষেত্রে। তাঁর ইচ্ছেকে সম্মান দেখিয়েছি এতদিন, কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। তাঁকে বোঝানো দরকার, কেন দেখা করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে… সেজন্য তৃতীয় কাউকে দরকার।’

হালকা হাসি ফুটল নাতালিয়ার ঠোঁটে। সামনে এগিয়ে এল। বলল, ‘থাক, অত কৈফিয়ত দিতে হবে না। অবশ্যই সাহায্য করব আমি তোমাকে। তুমি না থাকলে এতদিনে নামহীন কোনও কবরে পচে যেত আমার লাশ।’

ওর হাত ধরল কুয়াশা। ‘আমি চাই না শুধু কৃতজ্ঞতার বশে তুমি সাহায্য করো আমাকে।’

‘তা করছি না। যা শুনেছি তোমার মুখে, তাতে ভয় লাগছে আমার। ফেনিসকে ঠেকাতে হবে… আর তা এ-মুহূর্তে তোমাদের পক্ষেই সম্ভব।’

.

সিমনিকে নাতালিয়ার পরিচয় জানতে দেয়া যাবে না। তাই ঘর থেকে বেরুনোর আগে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল কুয়াশা, নীচে তাকাল লোকটা কী করছে দেখার জন্য। এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে, গাড়ি থেকে নেমে তাকে পেভমেন্টের উপর পায়চারি করতে দেখল।

‘ও শিয়োর না, কোন্ বিল্ডিঙে ঢুকেছি আমি—এটা, না পাশেরটায়,’ বলল কুয়াশা। ঘাড় ফিরিয়ে নাতালিয়ার দিকে তাকাল। ‘নীচের সেলারগুলোর মধ্যে কি এখনও কানেকশন আছে?’

‘হ্যাঁ।’ জবাব এল।

‘আমি তা হলে যাই। পাশের আরেকটা বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে ওকে বিভ্রান্ত করে দেব। একঘণ্টার কথা বলে এসেছি, এখন যদি না ফিরি, নার্ভাস হয়ে উল্টোপাল্টা কিছু ঘটিয়ে বসতে পারে।’

‘আবার আসবে এখানে? কী করতে হবে আমাকে, তার কিছুই তো বলোনি এখনও

‘আসব তো বটেই। সিমকিনের কাছ থেকে আরও আধঘন্টা সময় নিয়ে আসি। তারপর তোমাকে সব শিখিয়ে পড়িয়ে দেব!’

‘ওটার কী হবে?’ ইশারায় ইংরেজ লোকটার লাশ দেখাল নাতালিয়া। ‘এভাবে সামনের কামরায় ফেলে রাখা নিরাপদ নয়।’

‘আপাতত থাকুক ওখানে। ফিরে আসার পর ভেবে দেখব লাশটা কোথায় সরানো যায়।’

ফ্লাট থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি ধরে নেমে গেল ও নীচের সেলারে। নাতালিয়ার কথাই ঠিক, পুরনো বিল্ডিংগুলোর কিছুই বদলায়নি প্রতিটা সেলার-ই পাশেরটার সঙ্গে অন্ধকার প্যাসেজওয়ের মাধ্যমে সংযুক্ত। পুরো ব্লকজুড়ে জালের মত বিছিয়ে আছে এসব প্যাসেজ। একের পর এক সেলার পেরুল কুয়াশা, চারটে বিল্ডিং পেরিয়ে উঠে এল মূল সড়কে। ওদিক থেকে ওকে আশা করেনি সিমকিন, পিঠ ফিরিয়ে রেখেছিল, পিছনে গিয়ে কাঁধে টোকা দিল ও।

চমকে উঠে কুয়াশার দিকে তাকাল পুলিশ অফিসার। বিস্মিত কণ্ঠে বলল, ‘আরে… কোত্থেকে এলে? আমার তো মনে হচ্ছিল সামনের ওই বিল্ডিঙে ঢুকেছ তুমি!’ হাত তুলে নাতালিয়ার বিল্ডিংটা দেখাল।

‘বড্ড নার্ভাস হয়ে আছ তুমি, বন্ধু, মুখে হাসি এনে বলল কুয়াশা। ‘চোখে ভুলভাল দেখছ। এনিওয়ে, বলতে এলাম যে আমার আরেকটু সময় লাগবে। গাড়িতে গিয়ে বসো তুমি, বাইরে বেশ ঠাণ্ডা। তা ছাড়া… হাঁটাহাঁটি করে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছ অযথা!’

‘তোমার কি বেশি দেরি হবে?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইল সিমকিন।

‘বড়জোর আধঘণ্টা। কেন, আমাকে ফেলে কোথাও চলে যাবার কথা ভাবছ নাকি?’

‘না, না,’ তাড়াতাড়ি বলল সিমকিন। ‘আমার আসলে বাথরুমে যাওয়া দরকার।’

‘ব্ল্যাডারকে কন্ট্রোল করতে শেখো,’ কড়া গলায় বলল কুয়াশা। ‘নিতান্তই যদি না পারো, ড্রেনের কাছে গিয়ে ছেড়ে দাও কল।

সিমর্কিনকে আর কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে সরে গেল ও।

পরের বিশ মিনিট ধরে নাতালিয়ার সঙ্গে আলোচনা করল কুয়াশা—ঠিক করে নিল, কীভাবে মাইয়োরভ প্রসপেক্টের সল্টিকভ-শেদিন লাইব্রেরির বৃদ্ধ লাইব্রেরিয়ানের কাছে ওর সাক্ষাতের খবর পৌঁছে দেয়া হবে। বাইরের একটা ফোনবুদ থেকে ভদ্রলোকের কাছে ফোন করছে নাতালিয়া জানাবে, তাঁর এক পুরনো অনুরাগীর প্রতিনিধি ও। আভাসে-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেবে, মানুষটা কুয়াশা। ব্যাপারটা পরিষ্কার হবার পর এ-ও বলবে, কুয়াশা বিপদে পড়েছে, গোপনে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চায়।

এ-খবর পাবার পর বৃদ্ধের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা সহজেই অনুমেয়। চমকে যাবেন তিনি, ঘাবড়েও যাবেন। গোপন সাক্ষাতের জন্য যে-সব নির্দেশনা দেয়া হবে, তা একজন সাধাসিধে মানুষকে বিচলিত করবার জন্য যথেষ্ট। সন্ধ্যা ছ’টা বাজার দশ মিনিট আগে বৃদ্ধকে লাইব্রেরি কমপ্লেক্স থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম একজিট দিয়ে বেরিয়ে আসতে বলবে নাতালিয়া। ওদিককার রাস্তাঘাট তখন অন্ধকার থাকবে, লোক চলাচলও থাকবে না খুব বেশি। নির্দিষ্ট একটা দূরত্ব পর্যন্ত একদিকে হাঁটতে হবে তাঁকে, তারপর কয়েক দফা দিক বদলে যেতে হবে আরও কিছুদূর। এর মাঝে কুয়াশা যদি দেখা না করে, তা হলে লাইব্রেরিতে ফিরে গিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। সুযোগ বুঝে ওখানেই পরে হাজির হবে কুয়াশা। বলা বাহুল্য, এসব কথায় এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হবে তাঁর মধ্যে। চালচলনে ছাপ পড়বে সেটার, কাজেকর্মেও। যে-ই তাঁর উপর নজর রাখুক, ভদ্রলোকের অস্বাভাবিক আচরণ দেখতে পাবে নিঃসন্দেহে। এর কারণ জানার চেষ্টা করতে হবে তাকে, ফলে কাভার মেইনটেন করতে পারবে না। লোকটাকে চিনতে পারামাত্র আঘাত হানবে কুয়াশা, সরিয়ে দেবে দৃশ্যপট থেকে। লাইব্রেরিয়ানের সঙ্গে এরপর ও দেখা করতে পারবে নিশ্চিন্তে।

‘ওঁর সঙ্গে কথা বলবার পর কী করবে?’ জানতে চাইল নাতালিয়া।

‘সেটা নির্ভর করছে ভদ্রলোক আমাকে কী বলেন, আর ওঁর পিছনে লাগা ফেউয়ের কাছ থেকে কী জানতে পারি… তার ওপর, কাঁধ ঝাঁকাল কুয়াশা। ‘দেখা যাক কী হয়

‘রাতে থাকবে কোথায় তুমি? আমার এখানে আসবে?’

‘না এলেই তোমার জন্য মঙ্গল।’

‘ঝুঁকি নিতে আপত্তি নেই আমার।’

‘আমার আপত্তি আছে। তা ছাড়া রাতের শিফটে কাজ করো তুমি, সকাল পর্যন্ত তো বাসাতেই থাকো না।’

‘আজকের রুটিন বদলে নিতে পারি। বিকেলের শিফটে যদি ডিউটি সেরে আসি, মাঝরাতে ফিরতে পারব।’

‘শিফট বদলাবার কারণ জানতে চাইবে লোকে। ‘

‘বলব আমার এক আত্মীয় এসেছে মস্কো থেকে। ‘আইডিয়াটা পছন্দ হচ্ছে না আমার।’

কিন্তু এখানে থাকলে নিরাপদ থাকবে তুমি। রাত-বিরেতে কোথায় ঘুরে বেড়াবে? অন্তত আমার সিকিউরিটির জন্যও কাছে থাকা প্রয়োজন তোমার।’

অনিচ্ছাসত্ত্বেও মাথা ঝাঁকাল কুয়াশী। ‘বেশ, আমি ভেবে দেখব। কিন্তু কোনও কথা দিচ্ছি না।’ উঠে দাঁড়াল কুয়াশা। ‘আমাকে যেতে হয় এবার। তুমিও ফোন করবার জন্য একটু পর বেরিয়ে পোড়ো।

‘লাশটা?’

‘সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। দূরের কোনও সেলারে ফেলে দেব। তোমার কাছে ভদকা আছে?’

‘কেন, ড্রিঙ্ক করতে চাও?’

উঁহুঁ, ইংরেজ ব্যাটার গায়ে ঢালব। তারপর কেটে দেব দু’হাতের রগ। মনে হবে মাতাল হয়ে আত্মহত্যা করেছে। একটা ব্লেডও দাও আমাকে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *