ষোলো
চারদিন আগে যে-ভাবে ফ্রান্স উপকূল ত্যাগ করেছিল রানা, ফিরল ওভাবেই–মোটরবোটে চড়ে। প্যারিসে পৌঁছুতে বেশ সময় লেগে গেল, ওর পুরনো কন্ট্যাক্ট পিঠ ফিরিয়ে নিয়েছে। লণ্ডনের ঘটনায় ইন্টারপোলের মাধ্যমে পুরো ইয়োরোপে হুলিয়া জারি করা হয়েছে রানার নামে, এ-অবস্থায় ওর সঙ্গে আর নিজেকে জড়াতে চাইছে না লোকটা।
কী আর করা, আল্লাহ-খোদার নাম করে ট্যাক্সি ভাড়া করল রানা, রওনা হলো প্যারিসের পথে। একটানা গেল না; নিরাপত্তার খাতিরে পথে কয়েকবার বদলাল ট্যাক্সি, একইসঙ্গে বদলাল ছদ্মবেশ, শেষ পর্যন্ত সকাল নটা নাগাদ পৌঁছুল রাজধানীতে। ভুয়া পাসপোর্ট ছিল সঙ্গে, এয়ারপোর্টে গিয়ে এয়ার-কানাডার মন্ট্রিয়ল-গামী ফ্লাইটের টিকেট কিনে নিতে অসুবিধে হলো না। দুপুর একটায় টেকঅফ করল বিমান।
বিজনেস ক্লাসের আরামদায়ক সিটে বসেও ছটফট করতে লাগল রানা। সোনিয়া আর কুয়াশাকে টোপ বানিয়ে ফাঁদ পাতা হয়েছে ওর জন্য—একজনের প্রতি অনুভব করে ও দায়িত্ব, অন্যজনের প্রতি শ্রদ্ধা। জানা কথা, ওকে বাগে পাবার পর প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে ওদের, খুন করা হবে দু’জনকেই। বাস্তবতাকে মেনে নিতে হচ্ছে রানার—বুঝতে পারছে ওদেরকে বাঁচাবার আসলে কোনও উপায় নেই। আর এই উপলব্ধি মাথায় আগুন জ্বেলে দিয়েছে ওর, সেই আগুনের আঁচে সবার আগে পুড়েছে স্মিথ আর তার সঙ্গী… এরপর আসবে শত্রুপক্ষের বাকিদের পালা। রানার মাথায় এখন শুধু প্রতিশোধের চিন্তা। ক’দিন আগের মাসুদ রানার সঙ্গে এখনকার মানুষটার আর মিল পাওয়া যাবে না। না, ফেনিসকে আর কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চায় না, চায় ধ্বংস করতে… নিজের হাতে। অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন আর মারভিন লংফেলোর মত পিতৃসম দু’জন মানুষ জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন ফেনিসের কারণে; ওদের হাতে মারা গেছে অসংখ্য নিরীহ-অসহায় মানুষ… এখন আবার হত্যা করতে চলেছে সোনিয়া আর কুয়াশাকে! না, এই পিশাচদের প্রতি বিন্দুমাত্র অনুকম্পা দেখাবে না। ও। প্রতিশোধ নেবে… ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ!
একটাই সূত্র আছে এখন রানার হাতে—ম্যাসাচুসেটসের সিনেটর ডেভিড ম্যাহোনি দ্য থার্ড। সত্যিই কি তিনি জড়িত ফেনিসের সঙ্গে? বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বলছে, আগামী বছরের নির্বাচনে নিশ্চিতভাবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে চলেছেন ম্যাহোনি। জন্মের পর থেকে সম্ভবত এই একটা লক্ষ্য নিয়েই গড়ে তোলা হয়েছে তাঁকে। ম্যাহোনি পরিবারের অগাধ ধন-সম্পদ, পারিবারিক প্রভাব আর ফেনিসের মদদকে মাথায় রাখলে এমন পরিকল্পনা একেবারে অবাস্তব বলে মনে হয় না। সিনেটরের বিষয়ে এরই মধ্যে ছোটখাট একটা গবেষণা করে ফেলেছে ও, যেসব তথ্য পেয়েছে, তাতে বিশ্বাস করা মুশকিল, এত বছর থেকে মানুষটা ধোঁকা দিয়ে বেড়াচ্ছে গোটা দুনিয়াকে। অবস্থাদৃষ্টে যা-ই দেখাক না কেন।
খটকা যে নেই রানার মনে, তা নয় উপসাগরীয় যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন ম্যাহোনি, মার্কিন ওঅর রেকর্ড বলে: সেখানে তাঁর বীরত্ব তুলনাহীন। সাহসিকতার জন্য পাঁচ-পাঁচটা পদক পেয়েছেন। বহুবার নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ে ব্যর্থ করে দিয়েছেন প্রতিপক্ষের হামলা,
হামলা, কয়েকবার উদ্ধার করেছেন আহত সহযোদ্ধাদেরকে। নিজেও জখম হয়েছেন বেশ কয়েকবার। মার্কিন সেনাবাহিনীতে এ-কারণে কিংবদন্তি-তুল্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন।
যুদ্ধের পর দেশে ফিরে এসেও আরেকবার মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁকে। ম্যাসাচুসেটস্ টার্নপাইকে ভয়াবহ এক সড়ক দুর্ঘটনায় পড়েন ম্যাহোনি। একটা পণ্যবাহী ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে তাঁর গাড়ির। মারাত্মকভাবে আহত হন তিনি। হাসপাতালে নেবার পর ডাক্তাররা ধরেই নিয়েছিলেন কোনও আশা নেই, পত্রিকাগুলো বের করেছিল বিশেষ সংখ্যা–ম্যাহোনির মত বীর আমেরিকানের আস্ত-মৃত্যুর কথা ভেবে। হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিল হাসপাতালের সামনে, সমবেতভাবে প্রার্থনা শুরু করে দিয়েছিল তাঁর সুস্থতার জন্য। সংবাদপত্রের ভাষায়… মানুষের এই ভালবাসাই নাকি মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে এনেছে তাঁকে।
এই ঘটনাগুলোই খটকার জন্ম দিয়েছে রানার মনে। ফেনিসের এমন গুরুত্বপূর্ণ একজন অ্যাসেট, যাকে ছোটবেলা থেকে গড়ে তোলা হচ্ছে দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাশালী পদে বসানোর জন্য, সে কেন বার বার মৃত্যুর মুখে ঝাঁপ দেবে? এতবড় ঝুঁকি কেন নেবে সংগঠনটা? ম্যাহোনি মারা গেলে তো তাদেরই সবচেয়ে বড় ক্ষতি! কিন্তু এ-ও ঠিক, দুঃসাহসিক ওসব কার্যকলাপের মাধ্যমেই পাদপ্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছেন সিনেটর, জয় করেছেন জনসাধারণের ভালবাসা ও আস্থা। প্রাণ বিলিয়ে দেবার নিঃস্বার্থ মনোভাবই তাঁকে বিজয়ী করতে চলেছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। তবে কি ক্যালকুলেটেড রিস্ক নিয়েছিল ফেনিস? ম্যাহোনিকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য ফেলেছে মৃত্যুর মুখে?
প্যারিস এয়ারপোর্ট থেকে হেরাল্ড ট্রিবিউনের একটা কপি কিনেছে রানা। ওতে সংক্ষিপ্তভাবে জানানো হয়েছে নাইজেল উইটিংহ্যামের মৃত্যুসংবাদ। সন্ত্রাসী হামলার কথা আছে, তবে রানার নাম নেই। রহস্য ভেদ করবার আগ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার সম্ভবত বিস্তারিত জানাতে চাইছে না মিডিয়াকে। তবে এ-খবর রানার দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি, করেছে ট্রান্সকম আর ভরগেন ইণ্ডাস্ট্রিজ সম্পর্কিত একটা ফলো-আপ নিউজ। ওতে বস্টনের কোম্পানিটার বোর্ড অভ ডিরেক্টরদের একটা আংশিক তালিকা প্রকাশিত হয়েছে, তাতে তৃতীয় নামটাই ম্যাসাচুসেটসের সিনেটরের। ফেনিসের সঙ্গে তাঁর কানেকশনের ব্যাপারে এখন আর সন্দেহের অবকাশ নেই। ডেভিড ম্যাহোনি দ্য থার্ড শুধু ভিলা বারেমির অভ্যাগত একজন অতিথির বংশধর নন, ফেনিসের সত্যিকার উত্তরসূরিও বটে।
স্পিকারে পাইলটের ঘোষণা শুনে ধ্যান ভাঙল রানার। চ্যানেল আইল্যাণ্ড অতিক্রম করছে বিমান, ছ’ঘণ্টা পর অতিক্রম করবে নোভা স্কোশিয়া-র উপকূল: মন্ট্রিয়লে ল্যাও করবে তারও এক ঘণ্টা পরে। আন্দাজ করল রানা, এয়ারপোর্ট থেকে আরও চার ঘণ্টা লাগবে কানাডা-যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তে পৌঁছুতে। রিশেলিউ নদী হয়ে লেক চ্যাম্পলেইন দিয়ে আমেরিকায় ঢোকার প্ল্যান করেছে ও। অভিযানের চূড়ান্ত অংশের শুরুটা হবে তখনই। বাঁচবে কিংবা মরবে রানা, কিন্তু কিছুতেই হার মানবে না। উত্তেজনা অনুভব করল বুকের ভিতর।
বস্টন।
ওখানে কেউ দেখা করতে চায় ওর সঙ্গে।
কে? কেন?
কুয়াশার ধারণা, ওকে ফেনিসের দলে ভেড়াতে।
কিন্তু না, পিশাচদের সঙ্গে কোনোদিনই ও হাত মেলাবে না, এটা কি জানে না ওরা? যদি অকালমৃত্যুকে বরণ করে নিতে হয়, তা-ও রানা মাথা নোয়াবে না ওদের কাছে। একটা ব্যাপার নিশ্চিত, মরার আগে ফেনিসকে উপযুক্ত একটা শিক্ষা দিয়ে যাবে ও বুঝিয়ে দেবে, ওকে কতখানি আণ্ডার-এস্টিমেট করেছিল ওরা।
জোর করে চোখ মুদল রানা, একটু ঘুমিয়ে নেয়া প্রয়োজন। আগামী কয়েকটা দিন নির্ঘুম কাটবে ওর।
.
আটলান্টিকের দিক থেকে ছুটে আসছে দামাল হাওয়া, বৃষ্টির ছাঁটে বার বার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে উইণ্ডশিল্ড, ওয়াইপার-দুটো তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যুঝছে অবিরাম। কোস্টাল হাইওয়ে ধরে এরই মাঝ দিয়ে ছুটছে রানার গাড়ি পোর্টল্যাণ্ড থেকে সাদামাটা চেহারার একটা সুবারু সেডান ভাড়া করেছে ও, এগিয়ে চলেছে বস্টনের পথে। তবে ওখানে গিয়েই শত্রুপক্ষের সামনে নিজের উপস্থিতি জাহির করবে না, অপেক্ষা করবে না ফেনিসের পরবর্তী চালের জন্য। ওদের জালে পা দিলেই সব শেষ—সমাপ্তি ঘটবে আশা-ভরসার। তা হতে দেবে না রানা, নিজস্ব ছকে এগোবে বলে ঠিক করেছে। সোনিয়া-কুয়াশাকে নিয়ে এখুনি অস্থির হচ্ছে না; জানে, ওকে বাগে না পাওয়া পর্যন্ত ওদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে বাধ্য হবে শত্রুরা। দুই জিম্মিকে মেরে ফেললে রানার উপরে চাপ সৃষ্টির মত আর কোনও অস্ত্র থাকবে না তাদের হাতে।
হ্যাঁ, বস্টনে যাচ্ছে ও… কিন্তু প্রতিপক্ষকে তা জানিয়ে নয়। গোপনে মন্ট্রিয়লের রানা এজেন্সির মাধ্যমে ব্যবস্থা করে এসেছে—একদিনের ব্যবধানে রিটজ কার্লটন হোটেল দুটো টেলিগ্রাম পাবে। প্রথমটায় বলা হবে, আগামীকাল পৌঁছুবেন সোমনাথ চ্যাটার্জি, তার জন্য একটা স্যুইট যেন রিজার্ভ রাখা হয়। পরদিন বিকেলে আসবে দ্বিতীয় টেলিগ্রাম – তাতে জানানো হবে, ফ্লাইট নিয়ে গোলমাল হওয়ায় দু’দিন দেরি হবে মি. চ্যাটার্জির; ওই হিসেবে যেন রিজার্ভেশনের তারিখ পরিবর্তন করে নেয়া হয়।
এই দুটো টেলিগ্রাম ছাড়া রানার ব্যাপারে আর কিছুই জানতে পারবে না ফেনিস। আসল উদ্দেশ্য ফাঁস হবে না রানার, আবার শত্রুকে একটু নিশ্চয়তাও দেয়া হবে—বটনে আসার নির্দেশটা ও পালন করতে চলেছে। সোনিয়া, কুয়াশা বা মারভিন লংফেলোর ব্যাপারে চরম সিদ্ধান্ত নেবার বিষয় ইতস্তত করতে হবে ওদেরকে। ভুলে যেতে হবে আটচল্লিশ ঘণ্টার ডেডলাইন!
তিনদিন সময় রানার হাতে। এর মাঝে ট্রান্স-কমিউনিকেশন ইন্টারন্যাশনাল সম্পর্কে যতকিছু সম্ভব জেনে নিতে হবে ওকে; খুঁজে বের করতে হবে এমন কোনও গলদ, যেটাকে অস্ত্র বানিয়ে পৌঁছুনো যায় সিনেটর ম্যাহোনির কাছে। হাতে সময় কম, কিন্তু কাজ অনেক। বস্টনে রানা এজেন্সির শাখা আছে, কিন্তু ওখানে যাওয়া যাবে না। অন্য কারও সাহায্য নিতে হবে ওকে। কার কাছে যাওয়া যায়, তা নিয়ে ভাবতে শুরু করল।
একটা রোড-সাইন পেরিয়ে এল রানা মার্কেলহেড নামে একটা শহরের নাম লেখা আছে ওতে। তারমানে বস্টন আর ত্রিশ মিনিটের দূরত্ব। গন্তব্য এসে পড়েছে, গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল ও।
.
বিকেল সাড়ে পাঁচটায় বস্টনে ঢুকল রানা। বিরূপ আবহাওয়া আর অফিস ছুটির সময় মিলিয়ে পুরো শহরে তখন বিশৃঙ্খল অবস্থা। বয়েলস্টোন স্ট্রিটের ব্যস্ত শপিং ডিস্ট্রিক্টে যখন পৌঁছল, চারপাশে শুনতে পেল শত শত গাড়ির অবিরাম হর্ন… কান ঝালাপালা হবার দশা। প্রুডেনশিয়ালের আণ্ডারগ্রাউণ্ড লটে ভাড়া করা গাড়িটা পার্ক করল ও। রওনা হলো রেস্টুরেন্টের খোঁজে। খুব খিদে পেয়েছে, কিছু পেটে না দিলেই নয়। বৃষ্টিভেজা সাইডওঅক ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মনে পড়ল এক বৃদ্ধের নাম। কর্পোরেট ল-র উপর হার্ভার্ডের স্কুল অভ বিজনেসে পঁচিশ বছর শিক্ষকতা করবার পর বছরদুই আগে রিটায়ার করেছেন ভদ্রলোক। ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে চেনে না রানা, তবে আমেরিকার কর্পোরেট ব্যবসাজগতের বিষয়ে প্রফেসর অ্যান্থনি স্যাণ্ডার্স নামের এই বৃদ্ধের জ্ঞান বিশ্বকোষতুল্য। অতীতে রানা এজেন্সি বেশ কয়েকবার সাহায্য নিয়েছে তাঁর।
রেস্টুরেন্টে ঢুকেই পে-ফোন ব্যবহার করল রানা, অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিল প্রফেসর স্যান্ডার্সের। তারপর দ্রুত খাওয়াদাওয়া সেরে একটা ট্যাক্সিতে চাপল, হাজির হয়ে গেল বৃদ্ধের ব্র্যাটল স্ট্রিটের বাড়িতে।
বেল চাপলে এক বৃদ্ধা দরজা খুললেন। মায়াময় চেহারা, দু’চোখে কৌতূহল।
‘মিসেস স্যান্ডার্স?’
‘ইয়েস?’
‘আধঘণ্টা আগে ফোন করেছিলাম আমি….’
‘তুমি মাসুদ কায়সার?’
‘জী। একটা রিসার্চের ব্যপারে কথা বলতে চাই আপনার স্বামীর সঙ্গে….’
‘এসো, এসো, ভিতরে এসো!’ তাড়াতাড়ি বললেন বৃদ্ধা। বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থেকো না, অসুখ করবে। কী যে শুরু হলো দু’দিন ধরে… বন্যা দেখা দেয় কি না, ঈশ্বর জানেন!’ প্রায় জোর করেই রানার কাছ থেকে কোট আর টুপি নিলেন তিনি। ‘বাই দ্য ওয়ে, আমি এলিজাবেথ স্যাণ্ডার্স।’ হাত বাড়িয়ে দিলেন করমর্দনের জন্য।
‘নাইস টু মিট ইউ, মিসেস স্যান্ডার্স, ‘ পাল্টা হাসি দিয়ে হাত মেলাল রানা। ‘প্রফেসর স্যাণ্ডার্স আছেন?’
‘যাবে কোথায়? এখন ওর ইভনিং ড্রিঙ্কের সময় না? তুমি এসেছ ভাল হয়েছে। এখন একজন পার্টনার পাবে। এসো।‘
বৃদ্ধার পিছু পিছু বিশাল এক লিভিংরুমে ঢুকল ওরা। ঘরের চারদিকের দেয়ালজুড়ে তৈরি করা হয়েছে শো’কেস আর শেলফ তাতে শোভা পাচ্ছে নানা রকম রেলিক আর বই, সংখ্যায় অগণিত। দুটো জিনিসেরই সংগ্রহের বাতিক আছে সম্ভবত এই ঘরের মালিকের। ঘরের একপ্রান্তে গদিমোড়া একটা বড় সোফায় ‘বসে আছেন ভদ্রলোক, পা তুলে রেখেছেন সামনে রাখা টিপয়ের উপর, কোলের উপরে কম্বল বিছানো, তার উপর একটা বই, হাতে ধরে রেখেছেন ড্রিঙ্কের গ্লাস। মগ্ন হয়ে আছেন তিনি।
‘অ্যান্থনি, তোমার গেস্ট এসেছে,’ ঘোষণা করলেন মিসেস স্যান্ডার্স।
চোখ তুললেন প্রফেসর স্যাণ্ডার্স।
‘মাসুদ কায়সার, স্যর,’ নাম বলল রানা। পকেটে কয়েকটা ভুয়া পরিচয়পত্র নিয়ে সবসময় ঘোরে ও, সেখান থেকে নয়া দিল্লির একটা পত্রিকার আই.ডি কার্ড বাড়িয়ে ধরল। ভারত থেকে এসেছি, সাংবাদিক। আমেরিকার কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের উপর একটা প্রবন্ধ লিখছি। ফোনে বলেছিলাম আপনাকে।’
‘হ্যাঁ… হ্যাঁ… মনে আছে,’ হাসলেন প্রফেসর স্যাণ্ডার্স 1 ‘বোসো। তুমি করে বলছি, কোনও অসুবিধে নেই তো?
‘না, না। আপনি বয়সে ও জ্ঞানে আমার অনেক বড়। বৃদ্ধের মুখোমুখি আরেকটা সোফায় বসল রানা।
‘কী খাবে?’
‘কিছু না। ধন্যবাদ।‘
‘একটু উইস্কি নাও। ভিজে-টিজে এসেছ, হুইস্কি খেলে গাঁ গরম হবে।’
‘বেশ,আপনি বলছেন যখন…’ মাথা ঝোঁকাল রানা।
‘আমি দিচ্ছি।’ বলে গ্লাস আনতে চলে গেলেন মিসেস স্যান্ডার্স। ফিরে এলেন একটু পরে। উইস্কি পরিবেশন করলেন।
‘হ্যাঁ, বলো কী করতে পারি তোমার জন্য।’ বললেন স্যাণ্ডার্স।
নোটবুক আর কলম বের করল রানা। ‘বস্টন সম্পর্কে এ-মুহূর্তে গবেষণা করছি আমি। যদ্দূর জেনেছি, এখানকার সবচেয়ে বড় কর্পোরেট এনটিটি হলো ট্রান্স-কমিউনিকেশন ইন্টারন্যাশনাল। ওদের সম্পর্কে কিছু বলতে পারেন আমাকে?’
‘পারব না কেন?’ কাঁধ ঝাঁকালেন স্যান্ডার্স। কে না চেনে অ্যালাবাস্টার ব্রাইড অভ বস্টন-কে? কংগ্রেস স্ট্রিটের রানি বলি আমরা ওটাকে।
‘অ্যালাবাস্টার ব্রাইড?’ ভুরু কোঁচকাল রানা।
‘কংগ্রেস স্ট্রিটের ট্রান্সকম্ টাওয়ার,’ পাশ থেকে ব্যাখ্যা করলেন মিসেস স্যাণ্ডার্স। ‘সাদা পাথরের বিশাল এক বিল্ডিং-চল্লিশ তলা উঁচু। প্রতিটা ফ্লোরে সারি সারি গোল জানালা। এমন বিল্ডিং আর একটাও নেই গোটা শহরে।
দূর থেকে মনে হয়, শত শত চোখ নজর রাখছে বস্টনের উপর,’ যোগ করলেন প্রফেসর স্যান্ডার্স। সূর্যের আলোর কারসাজিতে কোনও চোখকে মনে হয় খোলা, কোনোটা বন্ধ… আবার কোনও কোনোটা যেন চোখ টিপছে!’
‘অদ্ভুত তো!’ মন্তব্য করল রানা। বৃত্তাকার জানালা… পার নস্ত্রো সার্কোলো… আমাদের চক্রের জন্য! কাকতালীয়, নাকি সত্যিই কোনও মেসেজ দেয়া হচ্ছে?
অদ্ভুত… একই সঙ্গে মনে প্রভাব ফেলবার মত!’ বললেন স্যাণ্ডার্স। ‘একটু বিসদৃশ ঠেকে চোখে, তবে ইচ্ছে করেই সম্ভবত করা হয়েছে সেটা। এক ধরনের শুদ্ধতার প্রতীক… ফিনানশিয়াল ডিস্ট্রিক্টের অন্ধকার কংক্রিট জঙ্গলের মাঝে আলোর একটা স্তম্ভের মত অবয়ব ওটার।
‘ইন্টারেস্টিং!’ বৃদ্ধের কথায় উপমা খুঁজে পেল রানা-সাদা দালানটা আলো, আর জঙ্গলটা হচ্ছে বিশৃঙ্খল পৃথিবী
‘যথেষ্ট হয়েছে অ্যালাব্যাস্টার ব্রাইডের কথা,’ বললেন স্যাণ্ডার্স। ট্রান্সকম সম্পর্কে কী জানতে চাও?’
‘আপনি যা জানেন, সব।’ রানা জবাব দিল।
একটু অবাক হলেন স্যাণ্ডার্স। ‘সব? খুব বেশি কিছু তো বলতে পারব না। আসলে… ওরা একটা ক্লাসিক মাল্টিন্যাশনাল কংগ্লোম্যারেট। ডাইভার্সিকেশনের দিক থেকে তুলনাহীন, ম্যানেজমেন্টও ব্রিলিয়ান্ট।’
‘পেপারে পড়েছি, ভরগেন ইণ্ডাস্ট্রিজে ওদের হোল্ডিঙের পরিমাণ জেনে বিস্মিত হয়েছে লোকে।‘
‘হ্যাঁ,’ মাথা ঝাঁকালেন স্যাণ্ডার্স। ‘অনেকেই অবাক হয়েছে, তবে আমি হইনি। ভরগেনের মালিকানার একটা বড় অংশ যে ট্রান্সকমের দখলে, সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এমন আরও চার-পাঁচটা দেশের কথা বলতে পারি, যেখানে একই ধরনের হোল্ডিংস রয়েছে ওদের।’ উইস্কিতে চুমুক দেয়ার জন্য একটু বিরতি নিলেন তিনি। ‘আসলে… যে-কোনও কংগ্লোম্যারেটের ফিলোসফিই হলো যতটা সম্ভব সম্পদ আর মার্কেট বাড়ানো! ইকোনমিক্সের মালথুসিয়ান ল-কে প্রয়োজনে ব্যবহার, কিংবা অবজ্ঞা করে ওরা। নিজস্ব র্যাঙ্কের ভিতরে সৃষ্টি করে আগ্রাসী প্রতিযোগিতা, আবার ছেঁটে ফেলে বাইরের প্রতিযোগীদেরকে! এ-থিয়োরির বাস্তব প্রয়োগের কারণে ট্রান্সকম এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সফল মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর একটা।
বৃদ্ধ প্রফেসরের মুখভঙ্গি যাচাই করল রানা। আগ্রহোদ্দীপক বিষয় পেয়ে উৎসাহী হয়ে উঠেছেন। ও বলল, ‘বুঝলাম আপনার কথা। কিন্তু একটা ব্যাপার পরিষ্কার হলো না- আরও চার-পাঁচটা দেশের নাম বলতে পারবেন বলছেন। কীভাবে সম্ভব সেটা?’
‘যে-কেউই পারবে। একটু শুধু পড়াশোনা করতে হবে, সঙ্গে দরকার হবে কল্পনাশক্তি। তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন স্যান্ডার্স। ‘আইন, কায়সার, আইন! হোস্ট কান্ট্রির আইন। ওটাই সবকিছুর চাবিকাঠি!’
‘আইন?’
‘ওটাই একমাত্র জিনিস, যেটাকে অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। যে-দেশেই ব্যবসা করতে চাও তুমি, সে-দেশের আইনকে মানতেই হবে। হ্যাঁ… আইনের ফাঁকফোকর খুঁজে বের করবে তুমি, বিভিন্ন দুর্বলতার সুযোগ নেবে… তারপরও একেবারে এড়িয়ে যেতে পারবে না। কিন্তু কীভাবে ডিল করবে আইন-আদালতের সঙ্গে? সরাসরি তো আর রিপ্রেজেন্ট করতে পারবে না নিজেকে, লইয়ার আর ল-ফার্মের সহায়তা নিতেই হবে তোমাকে… এবং সেটা হতে হবে স্থানীয়। কারণ, বস্টনের একজন অ্যাটর্নি হংকং বা এসেনে কাজে আসবে না তোমার।’
ঠিক কী বলতে চাইছেন আপনি?’ দ্বিধান্বিত গলায় প্রশ্ন করল রানা।
‘বিভিন্ন দেশের ল-ফার্ম নিয়ে স্টাডি করতে হবে তোমাকে,’ সামনে ঝুঁকলেন স্যাণ্ডার্স। ‘যে-প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে খোঁজ নিচ্ছে, তারা বিদেশি কোনও ল-ফার্মকে টাকা দিচ্ছে কি না, সেটা বের করো। তারপর মিলিয়ে দেখো, ওই ফার্মের ক্লায়েন্টদের মধ্যে কার কর্মকাণ্ড আমাদের ওই প্রতিষ্ঠানের স্বার্থরক্ষা করছে। ব্যস, তা হলেই পেয়ে গেলে, গোপনে কোন্ কোন্ জায়গায় পুঁজি খাটাচ্ছে ওরা।’ বক্তৃতা দিতে মজা পাচ্ছেন বৃদ্ধ আইনবিদ, হাসি হাসি হয়ে উঠল মুখ। ‘খুব মজার একটা খেলা বলতে পারো এটা, বিভিন্ন সেমিনারে বহু কর্পোরেট প্রতিনিধিকে চমকে দিয়েছি ওদের গোমর বলে দিয়ে। ওসবের একটা ইনডেক্সও রেখেছি আমি।’
ট্রান্সকমের ব্যাপারে কখনও গবেষণা করেছেন আপনি?’ জানতে চাইল রানা।
‘অবশ্যই! সেজন্যেই তো চার-পাঁচটা দেশের কথা বললাম।’
‘কোথায় কোথায় রয়েছে ওদের ইনভেস্টমেন্ট, আমাকে বলতে পারেন?’
চোখ বন্ধ করে স্মরণ করার প্রয়াস চালালেন স্যাণ্ডার্স। ‘দাঁড়াও, ভেবে দেখি। হুমম… ভরগেন ইণ্ডাস্ট্রিজের ব্যাপারটা তো জেনেছ। ট্রান্সকমের ওভারসিজ রিপোর্টে এসেনের মাইনহফ-স্যালেঙ্গার ফার্মে বড় অঙ্কের পেমেন্টের রেকর্ড আছে। ভরগেনের সঙ্গে রয়েছে মাইনহফের সরাসরি লিগাল কানেকশন। ফার্মটা ছোটখাট ক্লায়েন্ট বা ট্রানজ্যাকশনে আগ্রহী নয়। এ-কারণে বহু আগেই ভরগেনে ট্রান্সকমের শেয়ারের ব্যাপারে নিশ্চিত হই আমি।’
‘আর?’
‘আর… কিয়োটা, জাপান। ওখানকার আর্কিওয়া না কী যেন নামের একটা ফার্মকে ব্যবহার করে ওরা। তার মানে দাঁড়ায়… ইয়াকাণ্ডবি ইলেকট্রনিক্স।’
‘ইয়োরোপে?’
‘ভরগেন তো আছেই… এরপর আসে আমস্টারড্যাম। ওখানকার ল-ফার্ম হলো হাইনট অ্যাণ্ড সান্স। তাই আমার ধারণা, নেদারল্যাণ্ড টেক্সটাইলসে বড় ধরনের মালিকানা আছে ট্রান্সকমের; ওটা আবার স্ক্যান্ডিনেভিয়া থেকে লিসবান পর্যন্ত বিরাট এক অঞ্চলজুড়ে ব্যবসা করছে।‘
‘আর আছে?’
‘হ্যাঁ। তারপরেরটা সম্ভবত ফ্রান্সের লিজঁ-তে…’ বলতে বলতে থেমে গেলেন স্যাণ্ডার্স। মাথা নাড়লেন। ‘না, বোধহয় ভুল করছি। লিঅঁ-র চাইতে ইটালির তুরিন হবার সম্ভাবনা বেশি।‘
‘তুরিনের কোন্ কোম্পানি?’
‘ফার্মটার নাম প্যালাদিনো না তোনা… ওরা পুরো ইটালিতে একটামাত্র কোম্পানিকে রিপ্রেজেন্ট করে–বিয়াঞ্চি-পাভোরোনি।’
‘ওরে বাবা!’ নিখাদ বিস্ময় প্রকাশ পেল রানার গলায়। ‘এ তো, রীতিমত বিশাল এক কার্টেল।’
‘তা তো বটেই,’ একমত হলেন বৃদ্ধ আইনবিদ। ‘এককভাবেই বিয়াঞ্চি-পাভোরোনির অর্থনৈতিক ক্ষমতা কম নয়; তার সঙ্গে যদি ভরগেন, নেদারল্যাণ্ড টেক্সটাইলস্ আর ইয়াকাশুবি-সহ ইংল্যাণ্ড, স্পেন আর সাউথ আফ্রিকার আরও ক’টা জায়ান্ট যুক্ত হয়… গুগুলোর কথা বলিনি আমি তোমাকে… তা হলে নিঃসন্দেহে ট্রান্সকম একটা ইণ্ডাস্ট্রিয়াল সুপারপাওয়ারে পরিণত হয়েছে।’
মনে হচ্ছে আপনি ব্যাপারটা পছন্দ করেন না।’
‘ঠিকই ধরেছ,’ স্বীকার করলেন স্যান্ডার্স। ‘ ইকোনোমিক পাওয়ারের এমন সেন্ট্রালাইযেশন ভাল নয়। মালথুসিয়ান ল-র বিপরীত, প্রতিযোগিতা বলতে কিছু অবশিষ্ট থাকে না। তবে এ-ধরনের সাফল্যের পিছনে যে-প্রতিভা আছে, তার কদর করি আমি। বলতে গেলে অসম্ভব একটা লক্ষ্য অর্জন করেছে সে জিয়োভান্নি গুইদেরোনি-র কথা বলছি… ট্রান্সকমের প্রতিষ্ঠাতা।’
‘নাম শুনেছি ভদ্রলোকের, রানা মাথা ঝাঁকাল। ‘আধুনিক যুগের রকফেলার বলা হয় তাঁকে, তাই না?’
‘কমই সেটা। নিজেকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন গুইদেরোনি, সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিলুপ্তপ্রায় বিজনেস জায়ান্টদের শেষ সদস্য… ব্যবসা ও অর্থনীতির অলিখিত সম্রাট। পশ্চিমের বেশিরভাগ সরকার-ই সম্মান করে তাঁকে, এমনকী ইস্টার্ন ব্লকেও তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি কম নয়… বিশেষ করে রাশায়।‘
‘রাশা!’
‘হ্যাঁ।’ স্ত্রী-র দিকে তাকিয়ে আবার উইস্কি পরিবেশনের ইশারা দিলেন স্যাণ্ডার্স। ‘পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যকার ব্যবসা-বাণিজ্যে সাফল্যের হিসাব করলে গুইদেরোনির ধারেকাছে পাওয়া যাবে না কাউকে। অবশ্য একই কথা পুরো দুনিয়াব্যাপী ব্যবসার বেলাতেও খাটে। এখন বুড়ো হয়ে গেছেন, বয়স পঁচাশি-র উপরে… কিন্তু শুনেছি, বহু বছর আগে বস্টন ল্যাটিনে বড় হবার সময় যে-তেজ ছিল তাঁর, তা আজও কমেনি একবিন্দু।
‘উনি বস্টনের মানুষ? নাম শুনে তো মনে হয় না!’
‘ঠিকই আন্দাজ করেছ। বস্টনে বড় হলেও গুইদেরোনি আসলে ইয়োরোপিয়ান। সে-ও এক ইন্টারেস্টিং কাহিনি। জাহাজে চড়ে অশিক্ষিত বাপের সঙ্গে দশ-এগারো বছর বয়সে ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে আমেরিকায় আসেন তিনি। সেখান থেকে আজকের এই অবস্থানে পৌঁছেছেন… দ্য গ্রেট অ্যামেরিকান ড্রিমের সফল উদাহরণ বোধহয় একেই বলে!’
নিজের অজান্তেই সোফার হাতল খামচে ধরল রানা উত্তেজনায় নিঃশ্বাস আটকে আসছে। ‘কোত্থেকে এসেছিল ওই জাহাজ?’ রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করল ও।
‘ইটালি,’ উইস্কিতে চুমুক দিলেন স্যাণ্ডার্স। ‘দেশের দক্ষিণাংশ সম্ভবত। বোধহয় সিসিলি বা আর কোনও দ্বীপ থেকে।’
পরের প্রশ্নটা করতে রীতিমত নার্ভাস বোধ করছে রানা। ‘আপনার কি জানা আছে, জিয়োভানি শুইদেরোনির সঙ্গে ম্যাহোনি পরিবারের কারও পরিচয় ছিল কি না?’
মদের গ্লাসের উপর দিয়ে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকালেন বৃদ্ধ আইনবিদ। ‘অবশ্যই জানি। আমি কেন, ম্যাসাচুসেটসের সবাই জানে—ম্যাহোনি পরিবারে কাজ করত জিয়োভানির বাবা… আমাদের সিনেটরের দাদার আমলে, ম্যাহোনি হলে। বুড়ো ম্যাহোনি-ই প্রথম জিয়োভানির মধ্যে প্রতিভার ঝলক দেখতে পান, তাই ওকে ভর্তি করে দেন স্কুলে, সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন। সে-আমলের বিচারে যথেষ্ট উদার একটা কাজ। কারণ গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইমিগ্র্যান্টদের কুকুর-বেড়ালের মত ট্রিট করত আমেরিকার লোকজন; তাদের কাউকে স্কুল-কলেজে পড়তে দেবার মত মহত্ত্ব ছিল না ওদের। বুড়ো ম্যাহোনিকে নিঃসন্দেহে এর জন্য অনেক সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে।’
‘আপনি নিশ্চয়ই ডেভিড ম্যাহোনি দ্য ফার্স্টের কথা বলছেন?’ ফিসফিসিয়ে বলল রানা। এই লোকই কাউন্ট বারেমির ভিলায় আতিথ্য গ্রহণ করেছিল।
‘হ্যাঁ।’
‘এতকিছু করেছেন তিনি একটা অচেনা ছেলের জন্য?’
‘অসাধারণ, তাই না? অথচ সে-সময়ে ঝুটঝামেলার অন্ত ছিল না ম্যাহোনি পরিবারে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সর্বস্ব হারাতে বসেছিল, মান-সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকাই কষ্টকর হয়ে উঠেছিল ওদের। এর-ই মাঝে জিয়োভান্নির জন্য উঠেপড়ে লেগে গিয়েছিল বুড়ো ম্যাহোনি। যেন দেয়ালের লিখন পড়তে পারছিল সে।’
‘মানে?’
‘এক হাতে ম্যাহোনি পরিবারের দুর্দশার ইতি ঘটিয়েছেন জিয়োভান্নি গুইদেরোনি। শুধু তাই নয়, ওদের ধন-সম্পদ বাড়িয়ে দিয়েছেন কয়েকশ’ গুণ। মরার আগে নিজের কোম্পানিকে সবার উপরে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেখেছে বুড়ো ম্যাঙ্গোনি… দেখেছে টাকার বন্যা বইতে। সবই ঘটেছে সামন্য এক চাকরের ছেলেকে দয়া দেখানোর ফলে… যেন জেনেশুনেই ওকে প্রতিষ্ঠিত করবার সংগ্রামে নেমেছিল লোকটা। বললাম না, খুবই ইন্টারেস্টিং কাহিনি!’
একটু ভাবল রানা। বলল, ‘যদি ভুল না করে থাকি, গুইদেরোনি শব্দটা এসেছে ইটালিয়ান গুইদা থেকে.
. মানে, গাইড।’
‘অথবা রাখাল,’ বলে উঠলেন স্যাণ্ডার্স।
ঝট করে তাঁর দিকে তাকাল রানা। ‘কী বললেন?’
‘আমি না, গুইদেরোনি-ই বলেছেন কথটা … সাত-আট মাস আগে, জাতিসংঘে।’
‘জাতিসংঘ?’
‘হুঁ। সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেবার জন্য আমন্ত্রণ দেয়া হয় তাঁকে, সে-আমন্ত্রণ তিনি গ্রহণও করেছিলেন। শোনোনি ওই ভাষণ? সারা দুনিয়ায় প্রচার করা হয়েছে ওটা—রেডিও, টিভি, স্যাটেলাইট… সবখানে।’
‘দুঃখিত, শোনার সৌভাগ্য হয়নি। কী বলেছিলেন উনি?’
‘তুমি একটু আগে যা বললে, সে-কথাগুলোই। বিনীত স্বরে জানিয়েছিলেন, তাঁর নামের উৎস লুকিয়ে আছে গুইদা বা গাইড শব্দের ভিতরে। সে-দৃষ্টিতেই নিজেকে দেখেন তিনি—সামান্য এক রাখাল হিসেবে, অন্যকে সঠিক পথে নিয়ে যাওয়া যার কর্তব্য। দুনিয়াজোড়া ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে উদাত্ত আহ্বানও জানিয়েছেন– অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে সরে এসে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মানুষের উপকারে কাজ করবার জন্য। খুবই হৃদয়গ্রাহী ভাষণ ছিল ওটা, জাতিসংঘ থেকে তো প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ইকোনোমিক কাউন্সিলের মেম্বার হবার জন্য তাঁকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এখনও অবশ্য সাড়া দেননি গুইদেরোনি।
‘আপনি নিজ কানে শুনেছেন ওই ভাষণ।’
‘অবশ্যই! বস্টনবাসীদের জন্য তো প্রায় বাধ্যতামূলক হয়ে উঠেছিল ওটা। যতক্ষণ ভাষণ দিয়েছেন ভদ্রলোক, ততক্ষণ টিভি-রেডিওতে আর কোনও অনুষ্ঠান প্রচার হয়নি।’
‘ওঁর গলাটা কেমন ছিল?’
কাঁধ ঝাঁকালেন স্যাণ্ডার্স। ‘ব্যাখ্যা করা মুশকিল। বুড়ো হয়ে গেছেন গুইদেরোনি—কথা বলেন তেজোদ্দীপ্ত কণ্ঠে, কিন্তু বয়সের ছাপ ঠিকই পড়েছে তাতে।’ স্ত্রী-র দিকে তাকালেন। ‘তোমার কী মনে হয়?’
‘ঠিক বলেছ,’ সায় দিলেন মিসেস স্যান্ডার্স। ‘তবে একটা জিনিস খেয়াল করেছি, বয়সের তুলনায় অনেক পরিষ্কার মি. গুইদেরোনির গলা—কথা একদম জড়ায় না। এক নিঃশ্বাসে অনেক কথা বলে ফেলেন, শোনার সময় মনে হয় যেন শোঁ শোঁ বাতাস বইছে কানের পাশে। বড়ই অদ্ভুত এক অনুভূতি ওটা।’
পোর্তো ভেচিয়োর খামারবাড়িতে শোনা মারিয়া মাযোলার কথাগুলো মনে পড়ল রানার। রেডিওতে পঁচাত্তর বছরের পুরনো একটা কণ্ঠ শুনেছিলেন তিনি… যে-কণ্ঠ ঝোড়ো বাতাসের চেয়ে ভয়ঙ্কর!
আর কোনও সন্দেহ নেই: রাখাল বালকের খোঁজ পেয়ে গেছে ও।