চৌদ্দ
শুধুমাত্র চমৎকার একটা কিচেনের জন্য নয়, লণ্ডনের বিখ্যাত কনোট হোটেল আত্মগোপনের জায়গা হিসেবেও একেবারে আদর্শ। শুধু লবি থেকে দূরে থাকতে হবে, এবং খাওয়াদাওয়া সারতে হবে রুম সার্ভিসের মাধ্যমে। সম্ভবত এই বিশেষ দুটো বৈশিষ্ট্যের কারণেই ওখানে কামরা পাওয়া অত্যন্ত দুঃসাধ্য। অন্তত দু’তিন সপ্তাহ আগে থেকে বুকিং দিয়ে না রাখলে সেটা একেবারেই অসম্ভব। কার্লোস প্লেসের এই অভিজাত হোটেল রাজকীয় শাসনামলের শেষ চিহ্ন। উঁচুতলার লোকজনের শেষ আশ্রয়স্থল, যেখানে তারা প্রয়োজনের মুহূর্তে গা-ঢাকা দিতে পারে। বলা বাহুল্য, এখানে কেউ কাউকে বিরক্ত করে না।
বহুদিন থেকে এ-কারণে কনৌট হোটেলকে নিজের কাজে ব্যবহার করছে রানা। স্বল্প সময়ের নোটিশে স্বাভাবিক নিয়মে কামরা পাওয়া অসম্ভব, তাই বিকল্প পন্থা অবলম্বন করেছে ও-ম্যানেজিং বোর্ডের একজন ডিরেক্টরকে বিভিন্ন বিপদ-আপদে সাহায্য করে কৃতজ্ঞ বানিয়ে রেখেছে। প্রতিটা থিয়েটারে হাউস-সিট থাকে, বড় বড় রেস্তোরাঁতেও থাকে রিজার্ভড় টেবিল… তাদের নামিদামি পৃষ্ঠপোষকদের জন্য . একই নিয়মে কনৌট হোটেল ও রাখছে কিছু খালি কামরা। ডিরেক্টরের কল্যাণে সেগুলোর যে-কোনোটা যখন-তখন পেতে পারে রানা। আজও তার ব্যত্যয় হয়নি।
‘ছয়শ’ ছাব্বিশ নম্বর স্যুইট,’ রানার ফোন পেয়েই জানিয়েছেন ভদ্রলোক। লবিতে দাঁড়াবার প্রয়োজন নেই। লিফট ধরে সোজা চলে যাবেন ওখানে। ম্যানেজারকে ফোন করলে আপনার রেজিস্ট্রেশন ফর্ম পাঠিয়ে দেবে কামরায়।’
তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে হোটেলে চলে এসেছে রানা। তার আগে সেরে নিয়েছে জরুরি আরেকটা কাজ রুমিং হাউসে ফেরা সম্ভব নয়, কিন্তু জামাকাপড় সব রয়ে গেছে ওখানে। কপাল ভাল, পাসপোর্ট আর টাকাপয়সা নিয়ে বেরিয়েছিল, তবে গায়ের কাপড় ছাড়া আর কোনও পরিধেয় ছিল না ওর কাছে। পোশাক-আশাকের গুরুত্ব কম নয়। ওর পেশায় ওগুলো স্রেফ লজ্জা-নিবারণ বা ফ্যাশনের বস্তু নয়, কাজ করবার হাতিয়ারও বটে। পোশাকের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা করা যায় নিত্যনতুন পরিচয় বা স্ট্যাটাস। তাই বেশকিছু নতুন কাপড় কিনে নিতে হয়েছে :
মাঝরাতের সামান্য পরে কনৌট হোটেল থেকে বেরিয়ে এল রানা। গাঢ় একটা রেইনকোট পরেছে, মাথায় সরু ব্রিমের হ্যাট। সার্ভিস এলিভেটর ধরে বেজমেন্টে নামল, ওখান থেকে এমপ্লয়িদের এন্ট্রান্স ধরে পিছনের ব্যস্ত রাস্তায়। একটা ট্যাক্সি নিয়ে রওনা হলো ওয়াটারলু ব্রিজের উদ্দেশে। বিকেলে পরিকল্পনামাফিক ফোন করেছিল মারভিন লংফেলোর কাছে। অফিসে ছিলেন না বিএসএস চিফ, তাঁর সেক্রেটারিকে জানিয়ে দিয়েছে কনৌট হোটেলের রুম নম্বর-৬৪৮। ওটা থেকে বাইশ বিয়োগ করলে আসল নম্বরটা পেয়ে যাবেন তিনি।
একে একে ট্রাফালগার স্কয়্যার, স্ট্র্যাণ্ড আর স্যাভয় কোর্ট পেরিয়ে এল ট্যাক্সিং এগোল ওয়াটারলু ব্রিজের এন্ট্রান্সের দিকে। আর সামনে যাবার মানে হয় না, টেমস্ আর ভিক্টোরিয়া এমব্যাঙ্কমেন্টের সাইড স্ট্রিট ধরে হেঁটে চলে যাওয়া যাবে বাকি পথ। তাই ট্যাক্সি ড্রাইভারের কাঁধ স্পর্শ করে ও বলল, ‘ব্যস, এখানেই নামব আমি।’ ভাড়া আর বখশিশ বাবদ চকচকে দুটো নোট গুঁজে দিল লোকটার হাতে।
স্যাভয় হোটেলের পাশের ঢালু লেইন ধরে হাঁটতে শুরু করল রানা, নেমে এল পাহাড়ের নীচে। কৃত্রিম আলোয় আলোকিত, চওড়া বুলেভার্ডের ওপাশে দেখা যাচ্ছে কংক্রিটের ওয়াকওয়ে আর ইঁটের উঁচু দেয়াল-টেমস্ নদীর সীমানা ঘিরে রেখেছে। নদীতীরের কাছে স্থায়ীভাবে মুরিং করে রাখা হয়েছে ক্যালেডোনিয়া নামে এক বিশাল বার্জ—ওটাকে পরিণত করা হয়েছে মদ্যশালায়। এখন অবশ্য বন্ধ। রাত এগারোটার পরে আর খোলা থাকে না ওটা। জানালার কাঁচের ওপাশে ম্লান আলো দেখে বোঝা গেল, ভিতরের কর্মচারীরা দিনশেষের সাফ-সুতরোয় ব্যস্ত।
গাছের সারিতে ঢাকা এমব্যাঙ্কমেন্ট ধরে সিকি মাইল দক্ষিণে গেলে দেখা পাওয়া যাবে ছোটখাট এক ফ্লিটের-বড়সড়, চওড়া, আরামদায়ক অনেকগুলো রিভারবোটের সমষ্টি, দিনভর পর্যটক আনানেয়া করে টাওয়ার অভ লণ্ডন, ল্যামবেথ ব্রিজ আর ক্লিওপেট্রা’স নিডলে। বহু বছর আগে এই বোটগুলো টাওয়ার সেন্ট্রাল বলে পরিচিত ছিল… আর এখানেই কুয়াশাকে আসতে বলেছে রানা।
স্যাভয় হোটেলের পিছনের বাগানের ভিতর দিয়ে এগোল 3, উপর থেকে ভেসে আসছে বলরুমের সঙ্গীতের আবছা আওয়াজ। গার্ডেন পার্টির জন্য তৈরি করা একটা অ্যাম্ফিথিয়েটারে পৌঁছল, বেঞ্চের সারির মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে কয়েক জোড়া কপোত-কপোতী। নিঃসঙ্গ কেউ আছে কি না, দেখার জন্য চোখ বোলাল রানা, কিন্তু পেল না কাউকে। অ্যাম্ফিথিয়েটার থেকে বেরিয়ে এল তাই, পেভমেন্ট ধরে হাঁটতে শুরু করল বুলেভার্ডের পাশ ধরে!
কোথায় কুয়াশা? এতক্ষণে তো পৌঁছে যাবার কথা। গাড়ি নিয়ে এসেছে? রাস্তার ধারে পার্ক করা গাড়ির খোঁজে নজর বোলাল রানা, কিন্তু এবারও হতাশ হতে হলো। গভীর রাতে খাঁ খাঁ করছে রাস্তা… একটা যানবাহনও নেই; উদ্দেশ্যহীনভাবে কিছু মানুষ হাঁটাহাঁটি করছে নদীতীরের দেয়াল ঘেঁষে, ওদের মাঝেও নেই লোকটা!
হঠাৎ একটা লাইটার জ্বলে উঠল। রাস্তার ওপারে, রিভারবোটে উঠবার পিয়ারের প্রবেশপথে। একবার নিভল, আবার জ্বলল। ওদিকে চোখ ফেরাতেই সাদাচুলো একজন পুরুষকে দেখতে পেল রানা, কোমরের কাছে জড়িয়ে ধরে রেখেছে স্বর্ণকেশী এক মেয়েকে। দাঁড়িয়ে গেল ও. চোখ পিট পিট করে বোঝার চেষ্টা করল, ওটা সঙ্কেত কি না।
তৃতীয়বারের মত জ্বলল লাইটার, এবার একটু বেশি সময়ের জন্য। কাঁপা কাঁপা আলোয় কুয়াশার রুক্ষ চেহারা চিনতে পারল রানা… কিন্তু সঙ্গের মেয়েটি কে? ডিকয়? লোকটা পাগল হয়ে গেল নাকি? গোপন সাক্ষাতের জায়গায় অপরিচিত একজনকে নিয়ে এসেছে কেন? এত বড় ভুল তো করার কথা নয় ওর। নাকি…
চমকে উঠল রানা। বুকের ভিতর বেজে উঠল অমঙ্গলের ডঙ্কা। রাস্তা পেরুতে শুরু করল ঘোরগ্রস্তের মত। হঠাৎ একটা গাড়ির হর্নে সংবিৎ ফিরে পেল। তাড়াতাড়ি পিছিয়ে এল দু’পা। পরমুহূর্তে সগর্জনে একটা ভ্যান পেরিয়ে গেল ওর সামনে দিয়ে। আরেকটু হলে চাপা পড়ত ওটার তলায়। বিড়বিড় করে নিজেকে অভিসম্পাত দিল ও। তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে ধীরে ধীরে পেরুল রাস্তা। কাছাকাছি হতেই বুঝতে পারল, জড়িয়ে ধরা মেয়েটি ডিকয় নয়। তাকে আদর করার ভঙ্গিতে ধরেনি কুয়াশা, বরং ধরে রেখেছে যাতে পড়ে না যায়।
ফিসফিস করে মেয়েটির কানে কী যেন বলল কুয়াশা, তা শুনে মুখ ঘোরাতে শুরু করল সে। বুকের রক্ত ছলকে উঠল রানার, সোনালি পরচুলার নীচে ওটা সোনিয়ার মুখ। মড়ার মত ফ্যাকাসে হয়ে আছে… জীবনের কোনও চিহ্ন যেন নেই এতে।
দ্রুত পা চালিয়ে ওদের পাশে পৌঁছুল রানা। মুখ খোলার আগেই কুয়াশা বলল, ‘ওকে ড্রাগ দেয়া হয়েছে।’
‘হায় খোদা!’ ফিসফিসাল রানা। আপনি ওকে এখানে নিয়ে এসেছেন কেন? ফ্রান্সে হাজারটা জায়গা আছে, যেখানে লুকিয়ে রাখতে পারতেন… চিকিৎসাও দেয়া যেত ওকে!’
‘যদি নিশ্চিত হতে পারতাম, তা হলে তা-ই করতাম,’ কুয়াশার কণ্ঠ আশ্চর্য রকমের শান্ত। ‘প্লিজ, খোঁচাখুঁচি কোরো না। সমস্ত বিকল্প খতিয়ে দেখেছি আমি।’
বুঝতে পেরে মাথা ঝাঁকাল রানা। নীরব দৃষ্টিতে কৃতজ্ঞতা। প্যারিস থেকে সরিয়ে না আনলে হয়তো মারা পড়ত মেয়েটা। জিজ্ঞেস করল, ‘ডাক্তার দেখিয়েছেন?’
‘হুঁ। তবে না দেখালেও চলত।’
‘কী ধরনের কেমিক্যাল দেয়া হয়েছে ওকে?’
‘স্কোপোলামিন।’
‘গতকাল সকালে। আঠারো ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে।’
‘আঠারো!’ চমকে উঠল রানা। তবে এ-মুহূর্তে বিস্তারিত জানবার সময় নেই। ‘গাড়ি আছে আপনার সঙ্গে?
‘না। চার্টার প্লেনের পাইলট একটা গাড়িতে করে আমাদেরকে পৌঁছে দিয়েছে এখানে। ওকে বিদায় করে দিয়েছি।’
‘গিয়ে কাউকে বলে দেবে না তো? কতখানি বিশ্বাস করা যায় ওকে?’
‘এক ফোঁটাও না। তাই কৌশল খাটিয়েছি। পথে একটা গ্যাস স্টেশনে থেমেছিল ও বাথরুম সারার জন্য। তখন ফুয়েল লাইন ফুটো করে দিয়েছি। ফিরতি পথে ফুরিয়ে যাবে তেল… নির্জন এলাকায়। সেলফোন নেই ওর সঙ্গে। সাহায্য চাইতে পারবে না, খবরও দিতে পারবে না কাউকে। কেটে পড়ার জন্য সময় পাব আমরা!’
‘ভাল করেছেন,’ বলে উল্টো ঘুরল রানা। ‘একটু দাঁড়ান, আমি ট্যাক্সি নিয়ে আসছি।’
‘তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে, রানা।’
‘পরে,’ সংক্ষেপে বলল রানা।
.
প্রায়-অচেতন অবস্থা সোনিয়ার, হোটেলে ফিরে বিছানায় শোয়ানোর পরেও চোখ খুলল না। তবে শ্বাস নিচ্ছে স্বাভাবিক লয়ে, সেটা স্বস্তির বিষয়। জ্ঞান ফেরার পর বমি বমি ভাব অনুভব করবে, তবে সেটা কেটে যাবে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে। তুলনামূলকভাবে অনেক কম ক্ষতিকর ড্রাগ এই স্কোপোলামিন। মেয়েটার শরীর চাদর দিয়ে ঢেকে দিল রানা, কপালে আলতো চুমো খেলো, তারপর বেরিয়ে এল কামরা থেকে। দরজা পুরোপুরি বন্ধ করল না, ঘুমের মধ্যে অস্থির হয়ে উঠতে পারে সোনিয়া-ড্রাগের একটা পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া ওটা।
হোটেল স্যুইটের সিটিং রুমে গা এলিয়ে পড়ে রয়েছে কুয়াশা একটা সোফার উপরে। ক্লান্তির চরমে পৌঁছে গেছে বেচারা। তার হাতে এক কাপ গরম কফি তুলে দিল রানা, নিজেও নিল, তারপর একটা চেয়ার টেনে বসল মুখোমুখি।
‘কী ঘটেছিল?’ জানতে চাইল ও।
জবাব দিল না কুয়াশা। কফিতে চুমুক দিল। তারপর ছুঁড়ল পাল্টা প্রশ্ন। ‘তুমি মারা গেছ বলে গুজব রটেছে… জানো সেটা?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু তার সঙ্গে সোনিয়ার সম্পর্ক কোথায়?’
‘ওর সম্পর্ক নেই, কিন্তু ওকে উদ্ধারের সম্পর্ক আছে।’ কফির কাপের উপর দিয়ে রানার দিকে চাইল কুয়াশা। ‘ওই গুজবটার জন্যই উদ্ধার করতে পেরেছি ওকে। কপাল ভাল, তোমার সম্পর্কে অনেক কিছু জানি আমি।’
‘মানে?’
‘মাসুদ রানা সেজেছিলাম… পরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্য বেসিক কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছে। তারপর ওর মুক্তির বিনিময়ে নিজে ধরা দেবার প্রস্তাব দিলাম। ওরা রাজি হলো।’
‘খোলাসা করুন ব্যাপারটা!’
‘পারলে তো করতাম-ই,’ সোজা হয়ে বসল কুয়াশা। বড় বড় কয়েক চুমুকে শেষ করল কফি, খালি কাপ নামিয়ে রাখল সাইডটেবিলের উপর। ‘অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ফেনিসের ভিতরের কেউ তোমাকে জ্যান্ত রাখতে চাইছে। সে-কারণেই বাকিদের কাছে প্রচার করা হয়েছে তোমার মৃত্যু-সংবাদ। ফিল্ডের লোকজন শুধু আমাকে খুঁজছে… তোমাকে নয়!’
‘কিন্তু সোনিয়া…’
‘ওকে কীভাবে খুঁজে পেল, তা জানি না। হেলসিঙ্কি বা রোম…. যে-কোনও জায়গা থেকে সূত্র পেতে পারে। সে যা-ই হোক, গতকাল সকালে অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে বাইরে গিয়েছিল ও… বেশি দূরে না, রাস্তার শেষ মাথায় একটা বেকারি আছে, ওখান থেকে রুটি আনতে গিয়েছিল। এক ঘণ্টা পরও ফিরে এল না। ঝামেলার গন্ধ পেলাম। দুটো পথ ছিল আমার সামনে—ওর খোঁজে বেরুতে পারি, অথবা অপেক্ষা করতে পারি অ্যাপার্টমেন্টেই। খোঁজাখুঁজিতে যেতে ইচ্ছে হলো না। কোথায় খুঁজব তার কিছুই জানি না। তাই বসে রইলাম অ্যাপার্টমেন্টে… আগে হোক বা পরে, যারা-ই ওকে আটক করে থাকুক, ওখানে আসতেই হবে তাদেরকে। বেশ ক’বার ফোন বাজল, কিন্তু একবারও ধরলাম না। জানতাম, ফোনের জবাব না পেলে সশরীরে হাজির হবে ওরা…’
বাধা দিল রানা। ‘আপনি তো আমার ফোন ধরেছিলেন!’
‘ওটা অনেক পরে। ততক্ষণে ব্যাটাদের সঙ্গে বোঝাপড়া হয়ে গেছে।’
‘হুম। তারপর?’
‘শেষ পর্যন্ত দু’জন লোক হাজির হলো দোরগোড়ায়। ওদেরকে বন্দি করলাম আমি। শার্ট খুলে একজনের বুকে গোল উল্কি দেখলাম। কী আর বলব, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছি বহু কষ্টে…. ইচ্ছে করছিল তখুনি ব্যাটাকে খুন করে ফেলি। পাগল-পাগল লাগছিল নিজেকে।’
‘কেন?’
‘লেনিনগ্রাদ আর এসেনে আমার তিনজন বন্ধুকে খুন করেছে এই উল্কিঅলারা… খুবই কাছের বন্ধু। ওসব পরে বলছি। আগে গতকালের ঘটনা শোনাই।’
‘বলে যান।’
‘সংক্ষেপে বলছি পরের অংশ… শূন্যস্থানগুলো পূরণ করে নিয়ো তুমি। ফেনিসের ওই খুনি আর তার দোস্ত… স্থানীয় এক গুণ্ডা সে… ওদেরকে ঘণ্টাখানেক বন্দি করে রাখলাম আমি। এরপর এল একটা ফোন। ওটা তুলে কথা বললাম আমি, অপরপক্ষে চমকে দেবার জন্যই পরিচয় দিলাম তোমার নাম বলে। ব্যাটার তো তখন প্যান্ট খারাপ হয়ে যাবার দশা। খসখসে গলায় জানাল, লণ্ডনে খোঁজ পাওয়া গেছে তোমার… প্যারিসে থাকি কী করে! জোর দিয়ে তখন জানালাম, লণ্ডনে যাকে দেখা গেছে, সে আমার ডিকয়… আমিই আসল মাসুদ রানা। নিশ্চিত হবার জন্য কয়েকটা প্রশ্ন করল লোকটা, ঠিক ঠিক জবাব দিয়ে দূর করলাম তার সন্দেহ। তারপর বললাম, ধরা দিতে চাই এভাবে ছোটাছুটি করে পোষাচ্ছে না আমার। ওরা যদি সোনিয়াকে ছেড়ে দেয়, তা হলে বন্দি খুনিকে নিয়ে আত্মসমর্পণ করব আমি।’
‘এক মিনিট, আবার বাধা দিল রানা। ‘আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, ফোনের ওই লোক জানত, আমি বেঁচে আছি। যদি গুজব শোনা পার্টির কেউ হতো, তা হলে আপনার কথা বিশ্বাসই করত না।’
‘এর মানেটা বুঝতে পারছ?’ ভুরু নাচাল কুয়াশা।
‘হ্যাঁ। ফেনিসের ভিতরে শ্রেণী বিভাজন রয়েছে।
‘একজ্যাক্টলি। সবাইকে সব কিছু জানানো হয় না… কিংবা জানানো হয় মিথ্যে তথ্য!
‘কেন?’
সিম্পল,’ পায়ের উপর পা তুলল কুয়াশা। ‘বড় বড় সমস্ত প্রতিষ্ঠান আর সংগঠনে নানা রকম খুঁত থাকে… ফেনিসও তার ব্যতিক্রম নয়। তা ছাড়া ওরা কাজ করছে উচ্ছৃঙ্খল, খুনে, ম্যানিয়াকদেরকে নিয়ে। তাদের সবাই যে সেন্ট্রাল কমাণ্ডের অর্ডার মেনে নেবে, এমনটা ভাবা ভুল। তোমাকে জ্যান্ত রাখা দরকার… অথচ মুখের কথায় সেটা সম্ভব নয়। মাথা গরম সৈনিকরা তোমাকে দেখামাত্র খুন করে ফেলতে পারে। তাই চমৎকার একটা গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে—তুমি মারা গেছ। মরা মানুষকে কেউ শিকার করে না, তা-ই না?’
‘একটা প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেল, গম্ভীর গলায় বলল রানা। কিন্তু দ্বিতীয়টা? আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছে কেন ওরা?’
‘আমি বলব, ফেনিস তোমাকে দলে ভিড়াতে চাইছে।’
‘হোয়াট!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল রানা।
কুয়াশা নির্বিকার। বলল, ‘ভাল করে ভেবে দেখো। তোমার স্ট্যাটাস… তোমার কানেকশন… তোমার দক্ষতা… এসব কত কাজে লাগতে পারে ফেনিসের! আর্ট-দশটা আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য তুমি, দুনিয়াব্যাপী রয়েছে তোমার নিজস্ব ইনভেস্টিশন এজেন্সির নেটওঅর্ক, নামীদামি বহু মানুষ তোমার বুদ্ধি-পরামর্শের উপর নির্ভরশীল। এমন যোগ্যতা ওদের পুরো অর্গানাইজেশনে আর কারও আছে কি না সন্দেহ!’
‘আপনার ব্যাপারে ভিন্ন অ্যাপ্রোচ কেন?’
‘কাম অন!’ হাসল কুয়াশা। ‘পলাতক এক বিজ্ঞানী আমি, এমনিতেই সারা দুনিয়ার পুলিশ খুঁজছে আমাকে। এ-অবস্থায় আমাকে দলে ভিড়ানো, আর খাল কেটে কুমির ডেকে আনা একই কথা।’
‘এই দলে ভেড়ানোর আইডিয়া আপনার মাথায় এল কেন?’
‘খুন হবার আগে আমাকে একটা প্রস্তাব দিয়েছিল ব্রুনা ভরগেন—ওদের সঙ্গে যোগ দিতে বলেছিল। ওই প্রস্তাব দেবার অধিকার ছিল না ওর, তবে কথাবার্তায় এটা বুঝেছি-যোগ্য প্রতিপক্ষ পেলে তাকে দলে টানার নজির আছে ফেনিসে। আমাকে হয়তো চায় না ওরা… কিন্তু তোমার ব্যাপার আলাদা। যদি রাজি করাতে না পারে, তা হলে নিঃসন্দেহে খুন করবে… কিন্তু এ-মুহূর্তে একটা বিকল্প দেয়া হচ্ছে তোমাকে।’
রেস্টুরেন্টের ফোনে শোনা সেই অচেনা লোকটার কথা মনে পড়ল রানার।
একসঙ্গে বসে নিজেদের বিভেদ মিটিয়ে নেয়া ভাল না? কথা বললে বুঝতে পারবেন, আমাদের বিভেদ যতটা বড় ভাবছেন, ততটা আসলে নয়…।
কে জানে, কুয়াশার ধারণাই হয়তো সত্যি।
‘প্যারিসের ঘটনা শেষ করুন,’ বলল রানা। ‘সোনিয়াকে উদ্ধার করলেন কীভাবে?’
‘ওটা তেমন কঠিন হয়নি। তোমার নাম করে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দিয়েছিলাম না? ব্যাটা রাজি হয়ে গেল। কথাবার্তা বলে ডি ল্য কনকর্ডের রাস্তায় ঠিক দুপুর বারোটায় দেখা করবার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো- গাড়ি নিয়ে যাব দু’পক্ষই; একটায় থাকবে সোনিয়া-সহ ওদের ড্রাইভার, অন্যটায় নিজস্ব একজন ড্রাইভার-সহ আমি আর ওদের বন্দি খুনি। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে শুধু ড্রাইভার অদল-বদল হবে। আমার ড্রাইভার সোনিয়াকে নিয়ে চলে যাবে, আর ওদের ড্রাইভার দায়িত্ব নেবে আমাদের। চালাকিটা খাটালাম ওখানেই। উল্কিঅলার সঙ্গের লোকটার ব্যাপারে কিছুই বলা হয়নি, তাই ওকে বেহুঁশ করে মাসুদ রানা বানালাম… আমি নিজে সাজলাম ড্রাইভার। বারোটার সময় যখন অদল-বদল হলো, গাড়ি-সহ সোনিয়াকে পেয়ে গেলাম আমি… ওদের হাতে ধরা না দিয়েই!’
‘ওরা টের পায়নি?’ অবাক হলো রানা।
‘পাবে না কেন? দু’মিনিটের মধ্যেই পেয়েছে। ধাওয়াও করেছিল। গাড়ি নিয়ে একটু খেল দেখাতে হয়েছে, তবে শেষ পর্যন্ত ফাঁকি দিয়েছি ওদেরকে।’
কপাল ভাল আপনি প্যারিসে গিয়েছিলেন!’ বলল রানা। নইলে সোনিয়াকে বাঁচাবার কোনও উপায় ছিল না।’ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল, ‘ধন্যবাদ।’
‘বাদ দাও তো ওসব!’ মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে হাত নাড়ল কুয়াশা। ‘আজকের পেপার দেখেছ?
‘হ্যাঁ। আমেরিকার ট্রান্স-কমিউনিকেশন
ট্রান্স-কমিউনিকেশন ইন্টারন্যাশনালের বিশাল শেয়ার আছে ভরগেন ইণ্ডাস্ট্রিজে ‘
‘কীসের শেয়ার? আমার তো মনে হয় ওরাই মালিক। খেয়াল করেছ নিশ্চয়ই, ওদের হেডকোয়ার্টার বস্টনে।
মাথা ঝাঁকাল রানা। ‘সিনেটর ডেভিড ম্যাহোনি দ্য ফোর্থ-এর শহর, যাঁর পিতামহ কাউন্ট বারেমির ভিলায় অতিথি হয়েছিলেন। লোকটার সঙ্গে ট্রান্সকমের সম্পর্ক আছে কি না, সেটাই এখন দেখতে হবে আমাদেরকে।
‘দেখাদেখির কী আছে? নেই বলে ভাবছ নাকি?
‘এই মুহূর্তে কোনও ব্যাপারেই নিশ্চিত নই আমি,’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল রানা। ‘আসুন, দু’জনে কী কী জেনেছি, সেসব আলোচনা করলে একটা আইডিয়া পাওয়া যাবে।’
একমত হলো কুয়াশা ‘রোম দিয়ে শুরু করো। বিয়াঞ্চির ব্যাপারে সব জানতে চাই আমি
ইটালিতে ঘটে যাওয়া সবকিছুর বিস্তারিত বর্ণনা দিল রানা। একটু সময় নিল রেড ব্রিগেডের সঙ্গে সোনিয়ার কানেকশনের অংশটা ব্যাখ্যা করতে।
‘তা হলে ও-জন্যেই কর্সিকায় লুকিয়ে ছিল সোনিয়া?’ জিজ্ঞেস করল কুয়াশা। ব্রিগেডের হাত থেকে বাঁচার জন্য?’
‘হ্যাঁ। ব্রিগেডের ফাইনান্সিঙের ব্যাপারে যা শুনেছি ওর কাছে, সম্ভবত ওই পদ্ধতিতেই বাকি সব টেরোরিস্ট অর্গানাইজেশনকে টাকা দিচ্ছে ফেনিস।’
‘আর পাভোরোনির ব্যাপারটা?’
‘বিয়াঞ্চির হাত থেকে ফেনিসের মশাল এখন চলে গেছে পাভোরোনির হাতে। মানেটা পরিষ্কার—বংশ-পরিচয় নয়, কাউন্সিলের সদস্য হবার জন্য ভিন্ন যোগ্যতা প্রয়োজন।’
ব্রুনা ভরগেনও একই কথা বলেছিল,’ কুয়াশা বলল। ‘ওদেরকে নাকি বাছাই করা হয়েছে।’
‘লেনিনগ্রাদ থেকে জার্মানি পর্যন্ত কী ঘটল শোনা যাক এবার,’ বলল রানা,
শান্ত কষ্টে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করল কুয়াশা। চেষ্টা করল স্বাভাবিক থাকতে; কিন্তু নাতালিয়া, শেভচেঙ্কো আর হাইনরিখ বোহ্লের কথা বলার সময় গলা কেঁপে গেল ওর। কারণটা বুঝতে পেরে সহানুভূতির দৃষ্টি ফুটল রানার চোখে।
‘অ্যানসেল ভরগেনে পরিণত হয়েছিল প্রিন্স আন্দ্রেই ভারাকিন,’ উপসংহারে বলল কুয়াশা। ‘ভরগেন ইণ্ডাস্ট্রিজের প্রতিষ্ঠাতা… ক্রুপদের পরেই জার্মানির সবচেয়ে বড় অস্ত্র-নির্মাতা ওরা। পুরো ইয়োরোপ জুড়ে ওদের ব্যবসা। ব্রুনাকে বানানো হয়েছিল তার দাদুর উত্তরসূরি।’
‘ওয়ালথার ভরগেন বাদ পড়ে গেছে মাঝখানে,’ মন্তব্য করল রানা। ঠিক যেমন বাদ পড়েছিল মার্সেলো বিয়াঞ্চি। আপনার ধারণাই ঠিক–বাছাই করে কাউন্সিল সদস্য নেয় ফেনিস।’
‘এদের কেউই সংগঠনের জন্য অপরিহার্য ছিল বলে মনে হয় না,’ যোগ করল কুয়াশা। ‘পরিচয় ফাঁস হবার সঙ্গে সঙ্গে যেভাবে খুন করে ফেলল… ইমপ্রট্যান্ট হলে ওভাবে মারতে পারত না!’
‘তা হলে ধরে নিতে পারি, স্বার্থসিদ্ধির জন্য এদেরকে দলে রেখেছিল ফেনিস… অন্যদের চোখে গুরুত্বপূর্ণ দেখিয়েছিল। ওদের কাজ শেষ; পরিচয় ফাঁস হয়ে যেতেই আর বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজন মনে করেনি।’
‘কিন্তু কী সেই কাজ?’ অধৈর্য গলায় বলল কুয়াশা। ‘কর্পোরেট স্ট্রাকচারের সাহায্য নিয়ে খুন আর সন্ত্রাসকে ফাইনান্স করছে ওরা, পুরো দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিচ্ছে অস্থিরতা আর আতঙ্ক কেন? কোনও মাথামুণ্ডু পাচ্ছি না এর।’
বেডরুমের দিক থেকে গোঙানির আওয়াজ আসায় উঠে দাঁড়াল রানা। দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। না, জাগেনি সোনিয়া। ঘুমের ঘোরে গুঙিয়ে উঠেছে। একটু নড়াচড়া করে স্থির হলো। নিয়মিত তালে ওঠানামা করছে বুক। সিটিংরুমে ফিরে এল রানা।
‘কোনও সমস্যা?’ জানতে চাইল কুয়াশা।
‘না। ঘুমের মধ্যে নড়ে উঠেছে,’ বলল রানা।
মাথা ঝাঁকিয়ে আলোচনার সেই ধরল কুয়াশা, ‘যদ্দূর বুঝতে পারছি, এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনও অগ্রগতি হয়নি আমাদের। চারটে নাম আছে আমাদের হাতে, তার মধ্যে দুজন মারা গেছে, বাকি দুজনের ব্যাপারে খোঁজ নিতে গেলেও একই ঘটনা ঘটবে কি না, বলা যাচ্ছে না। ফেনিসের কুকীর্তির খবর পেয়েছি—বিয়াঞ্চি-পাভোরোনি টাকা ঢালছে রেড ব্রিগেডে, ভরগেন নিঃসন্দেহে বাদের-মেইনহফে, ট্রান্সকম কাদেরকে দিচ্ছে খোদাই জানে। কিন্তু এসব অভিযোগ প্রমাণ করতে পারব না আমরা! মোটিভও জানতে পারিনি। সোজা কথায় বলা যেতে পারে—ফেনিসকে খুঁজে পেয়েছি আমরা, কিন্তু অদৃশ্য অবস্থায়! ধরাছোঁয়ার বাইরে।’
‘বড় একটা সমস্যাই বটে,’ স্বীকার করল রানা।
‘কিন্তু যদি ধরাছোঁয়ার ব্যবস্থা করা যায়?’ বলে উঠল কুয়াশা।
‘কী বলতে চান?’ ভুরু কোঁচকাল রানা।
‘ওদের একজনকে আটক করতে হবে আমাদের, রানা… বড়-সড় কাউকে, এবং জ্যান্ত অবস্থায়।’
‘হোস্টেজ?’
‘দ্যাট’স রাইট।’
‘পাগলের মত কথা বলছেন!’ বিরক্তি ফুটল রানার গলায়। যাকে আটকাবেন, তাকে খুঁজে বের করবার জন্য ফেনিসের পাশাপাশি লোকাল ল-এনফোর্সমেন্টও আদাজল খেয়ে পিছনে লেগে যাবে আমাদের। বেশি সময় টেকা যাবে না।’
‘ভুল’ মাথা নাড়ল কুয়াশা। ইটালির প্রাক্তন প্রাইম মিনিস্টার অল্ডো মোরো-কে পঞ্চান দিন আটকে রেখেছিল রেড ব্রিগেড—রোমের পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে মাত্র আট ব্লক দূরে! পুলিশ তার টিকিটিও খুঁজে বের করতে পারেনি।
‘প্রাইম মিনিস্টারের উদাহরণ দিচ্ছেন কেন?’ জিজ্ঞেস করল রানা। ‘কাকে উঠিয়ে আনতে চান আপনি?’
সরাসরি জবাব দিল না কুয়াশা : অর্থপূর্ণ কণ্ঠে জানতে চাইল, ‘নাইজেল উইটিংহ্যামের ব্যাপারে কী প্ল্যান করেছ?’
‘আজ রাত আটটায় এখানেই আসবার কথা উইটিংহ্যামের বিএসএস চিফ মারভিন লংফেলোকে কনভিন্স করেছি। উনিই নিয়ে আসবেন ফরেন সেক্রেটারিকে। বিয়াঞ্চিকে যে-ভাবে চাপ দিয়ে ইনফরমেশন’ আদায় করেছিলাম, সে-ভাবে ওঁকেও ব্ল্যাকমেইল করব বলে ভাবছি।
‘ওসবের দরকার নেই। লোকটা এখানে আসছে যখন, তাকে কবজা করার একটা সুবর্ণ সুযোগ দেখতে পাচ্ছি।’
‘উঁহুঁ,’ মাথা নাড়ল রানা। ‘মি. লংফেলো আসছেন উইটিংহ্যামের সঙ্গে। আর যা-ই করুন, আমাদের হাতে তাঁর দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে কিছুতেই তুলে দেবেন না।’
‘মি. লংফেলোকে আমাদের আসল প্ল্যান না জানালেই হয়।’
‘ভেবেছেন ফরেন সেক্রেটারিকে বন্দি করতে গেলে উনি চুপচাপ বসে থাকবেন? তা ছাড়া… আমরা অমন কিছু করতে গেলে মহাবিপদে পড়ে যাবেন মি. লংফেলো। তাঁর কাস্টডি থেকে গায়েব হয়ে যাবেন উইটিংহ্যাম, এর জন্য ভয়ানক শাস্তি হয়ে যেতে পারে। না, না… জেনেশুনে ওঁকে এত বড় বিপদে ফেলতে পারব না আমি। তা হয় না!’ রানার কণ্ঠে তীব্র আপত্তি।
দুনিয়াদারি সম্পর্কে এখনও তোমার অনেক কিছু শেখার আছে, বন্ধু,’ উপহাসের সুর ফুটল কুয়াশার কথায়। ‘এখনও বুঝতে পারছ না, কীসের মধ্যে পড়েছি আমরা। .কোণঠাসা অবস্থা আমাদের, চরম পদক্ষেপ নিতে না পারলে ধ্বংস হয়ে যাব। কী ভেবেছ তুমি, উইটিংহ্যামকে ব্ল্যাকমেইল করলেই হড়বড় করে সব বলে দেবে? বিএসএস চিফের সঙ্গে থাকরে ও. কাজেই মনে মনে এক ধরনের নিরাপত্তা অনুভব করবে। জানবে, লংফেলো কিছুতেই . ক্ষতি হতে দেবেন না তার। মুখ খোলাবার জন্য এই নিরাপত্তাই সরিয়ে নিতে হবে আমাদেরকে, ওকে কে ফেলে দিতে হবে অনিশ্চয়তার মধ্যে। যখন জানবে তার কোনও আশা নেই, কেউ তাকে উদ্ধার করতে পারবে না… শুধুমাত্র তখনই কথা বলার তাগিদ অনুভব করবে মনের ভিতর।
‘আপনার যুক্তি আমি অগ্রাহ্য করছি না’ রানা বলল। কিন্তু মি. লংফেলোকে বিপদে ফেলবার মত কোনও কাজ করতে আমি রাজি নই।’
‘তা হলে এসো, ওঁকে বিপদমুক্ত করবার ব্যবস্থা নিই,’ বলল কুয়াশা। ‘কখন আসছেন ওঁরা, কোন্ রাস্তায় আসবেন- সেগুলো জানা আছে আমাদের। হোটেলে পৌঁছুনোর আগেই ওঁদেরকে রাস্তায় অ্যামবুশ করি না কেন? ছিনিয়ে নেব ফরেন সেক্রেটারিকে।
‘মি. লংফেলো?’
‘ওই দিকটা কাভার দেবার জন্যই তো অ্যামবুশ করব! নইলে হোটেলের এই কামরাতেই ফাঁদ পাততাম। মিডিয়ার কাছে কোনও একটা সন্ত্রাসী দলের নামে ভুয়া মেসেজও পাঠাব আমরা, সঙ্গে থাকবে মুক্তিপণের দাবি। এর পরে কেউ আর দোষারোপ করতে পারবে না মি. লংফেলোকে।’
প্ল্যানটা নেড়ে চেড়ে দেখল রানা। ছোটখাট খুঁত আছে, কিন্তু একদিক থেকে মন্দ নয়। গ্রেট ব্রিটেনের ফরেন সেক্রেটারি যেন-তেন মানুষ নন। তাঁর মুখ দিয়ে যদি দুনিয়ার সামনে ফেনিসের অস্তিত্ব আর লক্ষ্য নিয়ে কথা বেরোয়, তা অগ্রাহ্য করতে পারবে না কেউ। তবু কেন যেন মন মানতে চাইছে না। মনে হচ্ছে যেন মি. লংফেলোর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে সেটা।
‘কী ভাবছ?’ ওর নীরবতা লক্ষ করে জিজ্ঞেস করল কুয়াশা। ‘আমার প্রস্তাব পছন্দ হচ্ছে না?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। ‘আপনি যা করতে চাইছেন, সেটা অপরাধীদের পথ। আপনার জন্য মানানসই, কিন্তু আমি এভাবে কাজ করি না।’
‘ন্যায়ের পথে থেকে এখন পর্যন্ত কী-ই বা করতে পেরেছ?’ রূঢ় গলায় বলল কুয়াশা। ‘মেনে নাও, রানা, ফেনিসকে পরাস্ত করতে গেলে ন্যায়-নীতি, আবেগ, দয়া… এসবকে প্রশ্রয় দেয়া চলবে না। ওদের মত নিষ্ঠুর হতে হবে আমাদেরকেও।’
‘তাই বলে বন্ধু আর মিত্রদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করব?’
‘প্রয়োজনবোধে… হ্যাঁ,’ চেহারা কঠিন হয়ে উঠল কুয়াশার। উইটিংহ্যামকে বাগে পাবার জন্য এরচেয়ে ভাল কোনও বুদ্ধি থাকলে বলতে পারো। আমি শুনছি।’
কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে হার মানল রানা। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, আপনার প্ল্যান মোতাবেকই এগোব আমরা। দেখা যাক, উইটিংহ্যামকে আটক করে কিছু উদ্ধার করা যায় কি না। ভুল বলেননি, কোণঠাসা অবস্থা আমাদের… এখন দু’চারটে কিডন্যাপিঙের অভিযোগ যুক্ত হলে কিছু যায় আসে না। তবে একটাই শর্ত আমার- অ্যামবুশের সময় মি. লংফেলোর কোনও ক্ষতি করা যাবে না। আমি চাই না তাঁর গায়ে একটা আঁচড়ও লাগুক।’
‘তেমন ইচ্ছে আমারও নেই…’
কুয়াশার কথা শেষ হবার আগেই বেডরুম থেকে আবার শোনা গেল গোঙানি। এবার আগের চেয়ে জোরে। তার পিছু পিছু ভেসে এল ব্যথাতুর একটা চিৎকার, বিছানায় শরীর তড়পানোর আওয়াজ। উঠে দাঁড়াল রানা, চলে গেল সোনিয়ার পাশে। ছটফট করছে মেয়েটা, ঘামে ভিজে গেছে সর্বাঙ্গ… কিন্তু চেতনা ফেরেনি এখনও। মাথার কাছে বসে চুলে হাত বোলাতে শুরু করল। একটু পরে শান্ত হয়ে এল মেয়েটা।
রানার পিছু পিছু কামরার দরজা পর্যন্ত এসেছে কুয়াশা। ওখান থেকে বলল, উইড্রোয়াল সিনড্রোম। সকাল পর্যন্ত চলবে। শরীর থেকে বেরুতে শুরু করেছে ড্রাগ… ব্যথাটা সাইড-এফেক্ট। কিছু করার নেই তোমার, শুধু ধরে রাখো ওক।‘
‘জানি। থাকছি আমি ওর কাছে’ মৃদু গলায় বলল রানা।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল কুয়াশা। তারপর বলল, ‘আমি এখন চলি। সকালে আবার যোগাযোগ করব তোমার সঙ্গে। রাতের প্ল্যান-প্রোগ্রাম তখন ফাইনাল করে নেয়া যাবে।‘
‘চাইলে এখানেই থাকতে পারেন রাতটা,’ প্রস্তাব দিল রানা।
‘দু’জনের এক জায়গায় থাকা ঠিক হবে না,’ কুয়াশা বলল। ‘লণ্ডনে আমার মাথা গোঁজার অনেক জায়গা আছে। কিচ্ছু ভেবো না। সকালে ফিরে আসব।
‘ঠিক আছে,’ মাথা ঝাঁকাল রানা!
‘বিদায়,’ হাত নাড়ল কুয়াশা। ‘খেয়াল রেখো মেয়েটার দিকে।’
‘রাখব,’ বলল রানা। ‘কুয়াশা?’
চলে যাবার জন্য উল্টো ঘুরেছিল কুয়াশা, রানার ডাক শুনে ঘাড় ফেরাল। ‘কী?’
‘আপনার বন্ধুদের জন্য আমি দুঃখিত। কথা দিচ্ছি, ওদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না।‘
‘থ্যাঙ্ক ইউ, রানা।‘
দরজার সামনে থেকে সরে গেল কুয়াশা।