সেই আমি, সেই আমি
They all must fall
In the round I call .
ভি, তোমার স্বামীর জন্য লজ্জার কিছু নেই। ও ওর যথাসাধ্য লড়েছে। লক্ষ্মী বোন ভি, কেঁদো, আমি ওকে তেমন জোরে মারিনি। আমি তো জানতুম ওর সুন্দরী স্ত্রী আছে, যে ওকে। ভালোবাসে, আর আছে দুটি কিশোর–কিশোরী ছেলেমেয়ে, যারা ওকে পুজো করে। স্বামীকে লড়াই করতে দেখছে স্ত্রী, বাপকে লড়তে দেখছে ছেলেমেয়ে, তাদের সামনে আমি কি ওকে খুব বেশি লজ্জা দিতে পারি? দিইনি যে তা তুমি দেখেছ। নইলে প্রথম রাউন্ডেই ওর পড়ে যাওয়া উচিত ছিল। তবু আমি ওকে ফেলিনি। রিংয়ের খুব কাছেই তুমি ছিলে, তোমার দুপাশে ছিল তোমার দুই ছেলেমেয়ে। তোমাদের ভীত মুখ আমি দেখেছিলুম। তোমরা সাক্ষী আছ, আমি ওকে খুব বেশি মারিনি। এ কথা ঠিক যে আমি লড়াইয়ের সময় ওর গায়ে থুথু ছিটিয়েছি, মুখ ভাঙিয়ে ঠাট্টা করেছি, চেঁচিয়ে বলেছি, তোর মরণ আমার হাতে অবিমৃষ্যকারী বেল্লিক, আমার হাতে তুই মরবি, এবং এ কথাও ঠিক প্রথম রাউন্ডেই ওর পড়ে যাওয়া উচিত ছিল। তবু ওকে আমি লড়াই করতে দিয়েছি, নাচতে–নাচতে সরে গেছি ওর নাগালের বাইরে, যেন ওকে আমি কত ভয় করি! ইচ্ছে করে অসতর্ক হওয়ার ভান করে আমি ওর অনেকগুলো আঘাত নিয়েছি শরীরে। সেটা শুধু তোমাদের জন্যেই। তোমরা দেখে খুশি হও। পাঁচ রাউন্ড পর্যন্ত ও লড়ে গিয়েছিল। পড়ল ছয়। রাউন্ডেই। ভি . লক্ষ্মী বোন আমার, কেঁদো না। ছয় রাউন্ড! পৃথিবীর লোকের কাছে আমার এই রকমই কথা দেওয়া ছিল। ছয় রাউন্ড–তার বেশি না। কী করব বলো! তোমাকে বলছি, ওর খুব বেশি লাগেনি। লক্ষ্মী বোন আমার, তুমি ওকে বাড়ি নিয়ে যাও, ক্যামেরার আলো আর সংবাদদাতার পেন্সিলের ডগা থেকে ওকে দূরে নিয়ে যাও। আড়ালে, ওকে এই লজ্জা থেকে বাঁচাও। ওকে বোলো, এতে লজ্জার কিছু নেই, যার কাছে ও হেরেছে তার কাছে একদিন না একদিন পৃথিবীর সব সেরা লড়িয়েই হেরে যাবে। খুব শিগগিরই ও আবার দিনের আলোয় লোকসমাজে মাথা উঁচু করে চলাফেরা করতে পারবে। ওকে বোলো, আমি নিজেকে যত বড় বলি আমি তত বড়–ই। বরং তার চেয়েও কিছু বেশি। ভি, আমি দুঃখিত। সেটা শুধু তোমাদের কথা ভেবেই। কিন্তু আমি যদি তুমি হতুম তাহলে আজ আমি আমার স্বামীকে নিয়ে একটু অহংকারও করতুম। কারণ আজ তোমার স্বামী পৃথিবীর সবার সেরা লড়িয়ের কাছে হেরেছে। এটা কিছু কম গৌরবের? তুমি শুনেছ, যারা লড়াই দেখছিল তারা চেঁচিয়ে আমাকে গালাগালি দিচ্ছিল। বলছিল, আমি ভন্ড, জালিয়াত খুনি, আমি লড়াই সাজিয়ে নিই, আমি লড়াইয়ের আগে প্রতিপক্ষকে সন্মোহিত করে নিই। তারা তোমার স্বামীকে বলছিল, ওকে খুন করো, ওকে দড়ির ধারে ঠেলে নিয়ে যাও, ওকে মারো, ভয় নেই, তোমার ফাঁসি হবে না। আমরা গির্জায় মোমবাতি জ্বেলে দেব, আমরা তোমার স্বাস্থ্য পান করব, দোহাই ওকে জিতে যেতে দিয়ো না। কিন্তু আমি জানি, ওরা যতই চিৎকার করুক, ওদের সকলের ভিতরেই একটি শুদ্ধ বিচারক আছেন। ওদের সকলেরই অন্তরের সেই শুদ্ধ বিচারক আমার লড়াই দেখে উঠে দাঁড়িয়ে মাথার টুপি খুলে ফেলেছিল। ওরা মুখে তা কোনওদিন স্বীকার করবে না। হাতের নাগালে পেলে ওরা একদিন আমাকে লিঞ্চ করবে। লক্ষ্মী ভি, বোন আমার, দ্যাখো রিংয়ের বাইরে কি আমাকে খুব বেশি ভয়ংকর বলে মনে। হয়? দ্যাখো, এখন আমি একতাল কাদামাটির মতো মানুষ দ্যাখো, আমার স্নায়ু এত দুর্বল যে আমার হাত-পা কাঁপছে। সাজঘরের আয়নায় আমার ভয়–পাওয়া নেংটি ইঁদুরের মতো মুখচোখ আমি দেখতে পাচ্ছি। তোমার চোখের জল দেখে মনে ক্ষোভ হচ্ছে যে কেন আমি তোমার স্বামীর কাছে হেরে গেলাম না। তোমার ওই অবোধ কিশোরী মেয়েটির সামনে আমার হাঁটু গেড়ে বসতে ইচ্ছে করছে; হায়, ওর বাবাকে যখন মেরেছিলুম তখন ওর মুখে কী দুর্বোধ্য যন্ত্রণা ফুটে উঠেছিল। তোমার ওই কিশোর ছেলেটিকে আমার কাছে নিয়ে এসো, ও চোখের জল চেপে রাগি মুখে দাঁড়িয়ে আছে, কাল ওর স্কুলের বন্ধুরা হয়তো ওর দিকে আড়চোখে চেয়ে মুচকি হাসবে। ভি, ঠিক এতটাই দুর্বল, রিংয়ের বাইরে আমি একতাল কাদা–মাটির মানুষ। তোমার সঙ্গে এখন আমার কাঁদতে ইচ্ছে করছে। দ্যাখো, এখন গ্লাভস খোলা আমার দুটি নগ্ন হাত কী ভদ্র ও সুন্দর! দ্যাখো, লড়াইয়ের খাটো প্যান্ট ছেড়ে এখন আমি গায়ে পরেছি সাদা একটা জোব্বা। এখন কি আমাকে একজন ধর্মপ্রচারকের মতো বিশুদ্ধ দেখাচ্ছে না? দ্যাখো, আমার চোখে চিকচিক করছে সামান্য একটু জল। সন্দেহ কোরো না, আজ রাতে তোমাদের খাওয়ার টেবিলে আমাকে মনে। করে একটা চেয়ার খালি রেখে দিয়ো, ইচ্ছে হলে টেবিলের ওপর ফেলে রেখে এক টুকরো রুটি। আজ থেকে আমাকে তোমাদের পরিবারের একজন বলে ভেবো।
ওরা সব সাজ–বদল করা মানুষ। ওরা আমাকে টেলিফোনে ডেকে বলছে, এল, অভিনন্দন! চমৎকার লড়েছ, চমৎকার! ওরা আমাকে বেনামা চিঠিতে লিখছে, এল, রাস্তার কুকুর, বেজন্মা, তোর জন্য দূরবিন লাগানো চমৎকার একটা রাইফেল কিনেছি, যে রাইফেলে ‘কে’ মারা পড়েছিল সেই একই মেকারের। এরপর যদি তুই কখনও লড়াইতে নামিস, তবে গ্যালারি থেকে আমর নিশানা ঠিক থাকবে। ওরা সব সাজ–বদল করা মানুষ। দেখো, বিকিনি পরা মেয়েটি মায়াময়ী সমুদ্রতীরে উপুড় হয়ে পড়ে বালিতে গর্ত খুঁড়ে গোপনে বলে রাখছে, এল, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তারপর বালি দিয়ে গর্তের মুখ বুজিয়ে দিচ্ছে লজ্জায়। আবার দ্যাখো,
আধবুড়ো লোকটা টেলিভিশনের কাছ থেকে হতাশ হয়ে সরে যেতে নিজেকেই নিজে বলছে, ওই বদমাশ গুন্ডা লোচ্চা এলটাকে কেন দ্বীপান্তরে পাঠানো হচ্ছে না! কেউ কি নেই যে ওকে খুন করে শহীদ হতে পারে! ওরা আমার পক্ষে কিংবা বিপক্ষে বাজি ধরে জিতছে, কিংবা হেরে যাচ্ছে। ওরা এই সময়ে, রাগে, হতাশায় চেয়ে দেখছে আমি উড়োজাহাজ থেকে নামতে–নামতে দু-হাত তুলে ওদের দেখাচ্ছি ছটা আঙুল। ছয় রাউন্ড–তার বেশি না। এবার এই লড়াইতে আমার প্রতিপক্ষের আয়ু ছয় রাউন্ড মাত্র। ওরা জানে, আমি কথা রাখব। ওরা চেঁচিয়ে বলে, নরকে যা, বেজন্মা! ওরা সব সাজ–বদল করা মানুষ। শূন্য ঘরে আমার ছবির দিকে তাক করে ওরা গুলি ছুড়ছে। রাস্তার মোড়ে–মোড়ে দাঁড়িয়ে বিক্রি করছে আমারই ছবি। ওরা আমাকে ভয় করে, ঘেন্না। করে, ভালোবাসে। ওরা সব সাজ বদল করা মানুষ। জানে না যে, যে এল–কে ওরা খুঁজে বেড়াচ্ছে আমি সে নই। সে নই।
আসলে আমি সেই শহরতলির রাস্তার ছোট্ট এল, যে পাথর কুড়িয়ে বেড়ায়, নিশানা ঠিক করে গাছে বা ল্যাম্পপোস্টে ছুঁড়ে মারে। কোন রাস্তায় যে সে যাবে তার কোনও ঠিক–ঠিকনাই নেই! একদিন গ্রীষ্মের এক সুন্দর সকালে যে এল পাথর কুড়িয়ে অভ্যাস মতো ছুড়বার আগে নিশানা ঠিক করে নিতে গিয়ে টের পেয়েছিল তার কোনও নিশানা, নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু বলতে কিছু নেই! রাস্তার একধারে তাদের কালো মানুষদের বস্তি, অদূরে বিশাল হাইওয়ের ওপর দিয়ে তীব্র গতিতে গাড়ি চলে যাচ্ছে, আর এক পাশে–এল দেখেছিল–মিশনারি স্কুলের উঠোনে নীল ইউনিফর্ম পরা কালো মেয়েরা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে বেদির মতো উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন মাদার–তাঁর সাদা পোশাক, মাথা ঢাকা আলগা ঘোমটার মতো কালো কাপড় তাঁর কাঁধ আর পিঠের ওপর পড়ে আছে, তাঁকে তাই পেঙ্গুইন পাখির মতো দেখায়। সাদা সুন্দর সেই পেঙ্গুইন পাখির মতো নান আর তাঁর সামনে প্রার্থনারত নীল পোশাক পরা কালো মেয়েদের সারি, একধারে হাইওয়ে আর অন্যদিকে তাদের নোংরা বস্তি–এইসব কিছুর ওপর সুন্দর সকালের আধ–ফোঁটা রোদ পড়ে আছে। কোনদিকে, কোথায় যে হাতের পাথরখানা ছুঁড়ে মারবে এল, ছোট্ট এল তো ভেবেও পেল না। তার কুড়ানো পাথর হাতে রয়ে গেল অনেকক্ষণ। সেই প্রথম সে বুঝতে পেরেছিল, তার সত্য কোনও লক্ষ্যবস্তুও নেই, কোনও ল্যাম্পপোস্ট, কোনও গাছই তার শত্রু নয়, তার হৃদয় ওই সকালের মতোই পবিত্র ও সুন্দর। তাই সে হাতের পাথরখানা আবার গড়িয়ে দিল রাস্তায়। না, কোনও কিছুকেই সে আর আঘাত করতে চাইল না। আমি এল, আমি সেই ছোট্ট এল, পাথর কুড়িয়ে নিয়েও যে আবার সে পাথর রাস্তায় গড়িয়ে দিয়েছিল একদিন।
এল, তুমি যখন হাঁটছ, তখন তোমার পায়ের অত শব্দ হয় কেন? চোরের মতো হাঁটতে শেখো, এল। নইলে একদিন ওই পায়ের শব্দই তোমার মৃত্যু ডেকে আনবে। এই কথা একদিন আমাকে বলেছিল সেই লোকটা যে ছিল একজন হাটুরে পটুয়া, যার কোনও ছবিরই দাম পঞ্চাশ সেন্টের বেশি ছিল না। যার ব্যাবসা ছিল ছবি নকল করে বিক্রি করা, যে লোকটা বিখ্যাত সব ছবি স্কেচ আর কপি করতে-করতে মাঝে-মাঝে ছুঁড়ে ফেলে দিত তার রঙের ব্রাশ আর তুলি, কখনও খেপে গিয়ে পাগলের মতো দেয়ালের গায়ে আবোল-তাবোল রং মাখাত, গভীর রাতে মদ খেয়ে বাড়ি ফেরার সময়ে যে আবেগ–ভরে গাইত নিগ্রো লোক–সংগীত! এই লোকটা ছিল আমার বাবা। হাতের রং ঝাড়নে মুছতে-মুছতে যে সবজান্তার মতো হেসে বলত, এল, চোরের মতো হাঁটতে শেখো, ঠিক চোরের মতো। সবসময়ে এই কথা ভেবে যে রাস্তার প্রতি মোড়ে, প্রতিটি দেয়ালের আড়ালে তোমার জন্য শান্তভাবে অপেক্ষা করছে বন্দুকের ব্যারেল, রিভলবারের নল, আঙুলের মধ্যে লুকোনো ধারালো ব্লেড, বুটের তলায় লাগানো লোহার নাল। অত অহংকার করে হেটোনা, অপরাধবোধ নিয়ে হাঁটতে শেখো, চোরেরা যেভাবে হাঁটে। ছায়ার মতো চলাফেরা করো, ভেবে নাও তোমার শরীর নেই, তুমি ছায়া মাত্র! ভাবতে-ভাবতে ক্রমে ক্রমে ছায়া হয়ে যেয়ো। পালাতে শেখো, খুব জোরে দৌড়োতে শেখো। দেখো, যেন পায়ের শব্দ না হয়, গলার শব্দ না হয়, তোমার হৃৎপিন্ড যেন খুব জোরে শব্দ না করে। জীবন–মরণ এল, এর ওপর তোমার জীবন–মরণ। বলতে-বলতে টপ করে হঠাৎ লাফিয়ে উঠত সেই পাগল পটুয়া, এল, পায়ের পাতার ওপর তুমি হাঁটতে পারো না? খুব গম্ভীর মুখে নিজেই সে হেঁটে দেখাত আমাকে, এইভাবে…ঠিক এইভাবে পায়ের শব্দ গোপন করা যায়। পায়ের পাতার ওপর ভর দিয়ে হাঁটতে শেখো। তখন দেখবে তুমি দ্রুত হাঁটতে পারছ, শরীরকে ইচ্ছে মতো হালকা করে নিতে পারছ। আবার কখনও কখনও লোকটা চোখ পিটপিট করে আমার দিকে চেয়ে থেকে খুব হতাশ হয়ে বলত, হায় এল, তুমি এত লম্বা–চওড়া কেন? ভিড়ের ভিতরে তোমাকেই যে সকলের আগে চোখে পড়ে যাবে! হায়, তুমি আরও ছোট খাটো হলে না কেন, আরও রোগা, আরও বিষণ্ণ হলে না কেন, এল?
কখনও আমি সাদা ছোঁকরাদের টিটকিরি শুনে ঘুষি তুলেছি, অমনি এক পথ–চলতি নিগ্রো বুড়ি আমার হাত চেপে ধরে কানের কাছে ফিসফিস করে বলেছে বাছা, ভয় পেতে শেখো, ভয় পেতে শেখো। এখনও আমাদের জোট বাঁধতে অনেক দেরি। হ্যাঁ, আমি সেই এল, যে ভয় পেতে শিখেছিল। রাতে ঘরের চালের ওপর দিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে বেড়াল, সেই শব্দে ঘুম ভেঙে সে ভয়ে আঁকড়ে ধরত বালিশ। হেমন্তে শুকনো পাতা ঝরে পড়ছে, সেই শব্দে সে তড়িৎগতিতে বড় রাস্তা ছেড়ে দৌড়ে নেমে যেত গলিতে। বর্ষার জল–জমা গর্তের মধ্যে লাফিয়ে পড়েছে ব্যাঙ সেই শব্দে তার হৃৎপিন্ড লাফিয়ে উঠত গলায়। সে বাতাসের মধ্যে শুনতে পেত ফিসফিশ শব্দ, ট্রিজন! হত্যা! লুট। দূর সমুদ্রের শব্দের মধ্যে সে শুনতে পেত সেই গান, পায়ে-পায়ে লাথি মারতে মারতে নিয়ে চলো ওই নিগ্রোটাকে। টেক দি নিগার বাই দি টো। বাতাসের ভিতরে লুকোনো আছে বিস্ফোরক, সূর্যের আলোয় মেশানো আছে গন্ধক, প্রতিটি গাছের চিক্কণতায় লুকোনো আছে বিশ্বাসঘাতকতা। সে কেবল এই বীজ–মন্ত্র শিখেছিল, বিশ্বাস কোরো না, এল, বিশ্বাস। কোরো না।
প্রতিপক্ষের নাগাল থেকে আমি ছায়ার মতো পালিয়ে যেতে শিখেছিলুম আমি জোরে দৌড়তে শিখেছিলুম, আমি পায়ের পাতার ওপর ভর দিয়ে হাঁটতে শিখেছিলুম, আমি চোখ বুজে ভাবতে শিখেছিলুম যে আমি আমার ছায়া। এখন লড়াইয়ের পর রিংয়ের মধ্যে লাফিয়ে উঠে আসে মানুষ, রিংয়ের দড়ির ওপার থেকে ঝুঁকে চিৎকার করে বলে, এ লড়াই নয়, কালো–শিল্প, সম্মোহনবিদ্যা, অ্যালকেমি। কুকুর, তুই কেবল চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যেতে শিখেছিস। আমার আহত প্রতিপক্ষ হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে সংবাদদাতাদের কাছে গম্ভীর মুখে বিবৃতি দেয়, লড়াইয়ের সময় রিংয়ের মধ্যে ও এত দ্রুত সরে যাচ্ছিল যে আমি ওকে ভালো করে দেখতেই পাচ্ছিলুম না। ও যেন ঠিক ছায়ার মতো পড়ছিল আমি ওকে ছুতেই পারিনি। আমার পরবর্তী প্রতিপক্ষ বুক ঠুকে চেঁচিয়ে বলে, তোমাকে দেখে নেব এল, এবার তোমাকে আমি দেখে নেব। আমি মৃদু হেসে পৃথিবীর লোকের সামনে আবার আমার দুই হাত তুলে ধরি! আঙুল দেখাই। সাত রাউন্ড! তার বেশি না। এবার আমার প্রতিপক্ষের আয়ু মাত্র সাত রাউন্ড। বিস্ময়ে, ক্ষোভে, হতাশায় ওরা চিৎকার করে বলে, নরকে যা, নরকে যা, বেজন্মা। কেননা ওরা জানে যে আমি আমার কথা রাখব। কেননা, আমি প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াই, মৌমাছির মতো হুল ফুটিয়ে দিই। আমি আমার প্রতিদ্বন্দ্বীকে ডেকে বলি, গোঙাও, বাছা গোঙাও। আমাকে ছুঁতে পারোনি বলে দুঃখ কোরো না। কে কবে ছুঁতে পেরেছে আমাকে! আমি যে সেই ভয় পাওয়া নেংটি ইঁদুরের মতো ছোট্ট এল, যে ভয়ঙ্করভাবে পালিয়ে যেতে শিখেছিল। যে সূর্যের আলো থেকে বাতাস থেকে, সমুদ্রের শব্দের কাছ থেকে কেবল পালিয়ে গেছে, যে নিজেকে ভাবতে শিখেছিল ছায়া। তুমি তো দেখেছ কেমন দ্রুত চলে আমার পা, রুহমবা নাচের হালকা শরীর নর্তকের মতো আমি কেমন আমার প্রকাণ্ড শরীরকে দূরে-দূরে সরিয়ে নিয়ে যাই, কেমন করে আমি হয়ে যাই ছায়ার মতো অবাস্তব, হয়ে যাই মায়াবী জাদুকর!
ভি, তোমাকে জিগ্যেস করি, দ্যাখো তো আমি কি দেখতে সুন্দর নই! আমাকে কি যথেষ্ট ভদ্রলোকের মতো দেখতে নয়? দ্যাখো, আমার প্রকাণ্ড শরীর এমন সুষম ও স্বাভাবিকভাবে গড়ে ওঠা যে আমাকে একটুও বিকট দেখায় না, দেখো আমার থুতনির কাছে ছোট্ট একটু আঁচিল, ঘন। জ, মাথায় কালো চুল, আমার চোখ দ্যাখো, এর ভিতরে কি কোনও ঘেন্নার আগুন আছে, কিংবা প্রতিশোধস্পৃহা? বরং শিশুর মতোই নিষ্পাপ ও কৌতূহলী আমার চোখ। তুমি যদি কখনও দ্বিধা। ত্যাগ করে আমাকে তোমার ওই কিশোর ছেলেটি ভেবে বুকে জড়িয়ে ধরো তবে নিশ্চিত জেনো, তোমার এই টোল খাওয়া শরীর নরম বুক যুবতী–মুখের ডোল এইসব ভুলে গিয়ে আমি তোমাকে আমার মা ভেবে কাঙাল ছেলের মতো চোখ বুজে চুপ করে থাকব। কিন্তু দ্যাখো, খুব বেশিক্ষণ আমাকে এই ভাবে রেখো না। খুব বেশিক্ষণ আমি কারও কিছু হয়ে থাকতে পারি না। আমার নিজেরই এক অদৃশ্য হাত আমাকে সবকিছু থেকে ইচ্ছা, লোভ এবং বিশ্বাস থেকে ছিঁড়ে আনে। দুবার আমার বিয়ে ভেঙে গেছে। না, আমি পত্নীপরায়ণ স্বামী নই, যেমন আমি নই মা বাবার আদুরে বাধ্য ছেলে, নই ভাই-বোনের প্রিয় সহোদর, আমি নই বন্ধুদের বিশ্বাসভাজন। আমি অত হতে পারি না। আমি এক প্রকাণ্ড শিশুর মতোই নতুন খেলনা পেতে ভালোবাসি, আবার ভেঙে দুমড়ে সেই খেলনা ফেলে দেওয়াও আমার কাছে সমান প্রিয়। শিশুর মতো নিষ্ঠুর ও
উদাসীন আর কে আছে? আবার শিশুর মতো ভীতুই বা আর কে? দ্যাখো রিংয়ের বাইরে আমি এখন একতাল কাদামাটির মতো মানুষ, পাতা ঝড়ে পড়ার শব্দে আমি চমকে উঠি, বেড়ালের পায়ের শব্দ হলে রাতে আমার ঘুম হয় না, আমার আমিই সেই এল যে আঙুল তুলে এক দুই তিন রাউন্ড দেখাই। ভি, কিছুক্ষণের জন্য এ সব কিছুই সত্য। দ্যাখো, গ্লাভস পরা সেই দুটি ভয়ংকর হাতকে এখন দ্যাখো, আমি এখন খুব সূক্ষ্ম ছুঁচে সুতো পরাতে পারি, আমি এই হাতে আঁকতে পারি পাখি, রমণী ও প্রজাপতির ছবি, বেহালায় বাজাতে পারি প্রেমের গান। ভি, বোন আমার, পৃথিবীতে কিছুক্ষণের জন্য এই সব কিছুই সত্য। যেমন একথাও সত্য যে, একদিন ছেলেবেলায় আমাকে শ্রান্ত ও পিপাসার্ত দেখে বুড়ো এক সাহেব ডেকে বলেছিল, এসো এল, এক কাপ কফি খেয়ে যাও। আবার এ কথাও সত্য, সাদা মানুষের হাতে একদিন বেধড়ক মার খেয়ে একটি অশিক্ষিত নিগ্রো ছেলে রক্তমাখা মুখে উদভ্রান্তের মতো ম্যানহাটনের পথে–পথে ঘুরে বেড়িয়েছিল। পথচারীদের ধরে-ধরে করুণ গলায় জিগ্যেস করেছিল, মশাই, বলতে পারেন আফ্রিকাটা কোন দিকে? আমি আফ্রিকায় যেতে চাই। আমি আফ্রিকায় চলে যেতে চাই।
কিছুক্ষণের জন্য এই পৃথিবীতে সব কিছুই বড় সত্য।
একদিন আমি সমুদ্রের তীরে এক জাহাজঘাটায় চারজন প্রার্থনারত লোককে দেখেছিলুম। আরব বেদুইনদের মতো অদ্ভুত তাদের ঢিলাপোশাক, মাথায় সাদা ফেজ টুপি। তারা মক্কার দিকে মুখ করে নানা বিচিত্র ভঙ্গিতে তাদের প্রার্থনা সেরে নিচ্ছিল। দেখলুম তারা কখনও উবু হচ্ছে, উঠে দাঁড়াচ্ছে, বসছে কানে হাত দিচ্ছে। আমি দু-পা ফাঁক করে, প্যান্টের পকেটে দুই মুষ্টিবদ্ধ হাত নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলুম। আমার সামনে সমুদ্রের গভীর সবুজ রং মাথার ওপরে লালফিরোজায় মাখামাখি আকাশ, দুইয়ের মাঝখানে নিঃসঙ্গ এক জাহাজের দীর্ঘ মাস্তুল, আর তারা চারজন। তখন আমি শহরতলির বাচ্চা–বখাটে এল চোর, ছিনতাইবাজ; পাছাভারী বুক–উঁচু মেয়েদের দেখে প্রকাশ্যে শিস দিই, মাঝে-মাঝে হিসেব করে দেখার চেষ্টা করি আমাদের মধ্যে কার কটা বে-আইনি ছেলে–পুলে আছে। অথচ আমার সামনে সেদিন সেই তুচ্ছ, অতি তুচ্ছ সাধারণ সেই দৃশ্যটি যেন রুখে দাঁড়াল। আমি নড়তে পারলুম না। উদাসীন একটি মেঘ আমার মনের ওপর একটুক্ষণের জন্য তার ছায়া ফেলে গেল। প্রার্থনার শেষে তারা চারজন বুড়োসুড়ো লোক সামনে আমার দু-পকেটে মুষ্টিবদ্ধ হাত এবং দু-পা ফাঁক করে দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখে ভয়ে জড়সড়ো হয়ে দ্রুত গুটিয়ে নিল তাদের কাপড়ের টুকরোগুলি যার ওপর দাঁড়িয়ে তারা প্রার্থনা করছিল, তারপর তারা তাড়াতাড়ি সরে পড়বার চেষ্টায় ছিল। আমি তাদের সঙ্গ ধরে জিগ্যেস করলুম, তোমরা কারা? তারা প্রথমে সন্দেহের চোখে আমাকে দেখল, একটু ইতস্তত করল, তারপর হেসে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিল। আমরা বালির ওপর বসলুম। তারা সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বলল , আমরা তীর্থযাত্রী। আমাদের গোত্র–পরিচয় এখন আর নেই, সে সব আমরা পিছনে ফেলে এসেছি। আমি হেসে ঠাট্টা করে বললুম, বাহবা! চমৎকার! কিন্তু যে কাপড়ের টুকরোগুলো মাটিতে পেতে তোমার প্রার্থনা করছিল সেগুলো কিন্তু তোমরা গুটিয়ে নিয়েছ, ফেলে যাওনি। শুনে সবচেয়ে বুড়ো লোকটা, যার পাকা জ্ব, নিরীহ মুখ, সে বলল , বাছা কোনও কিছুকেই ফেলে যে আমরা যাচ্ছি না একথা সত্যি। তবে তীর্থযাত্রীকে ওরকমই ভাবতে হয়। নইলে কোনও কিছুকেই কি ফেলে যাওয়া যায়? দেখো ওই আকাশ, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, এই আমাদের পৃথিবী–এরা সবাই চলেছে, কেউ কাউকে ফেলে রেখে যাচ্ছে কি? এখন তুমি যদি অনুমতি দাও তবে আমরা এই প্রার্থনা করার কাপড়ের টুকরোগুলো সঙ্গে নেব; আর যদি তোমার ইচ্ছে হয়তো বলল আমরা এগুলো সমুদ্রে ফেলে দিয়ে যাই। কেন না কে জানে, তুমিই ঈশ্বরের প্রেরিত পুরুষ কি না, তীর্থযাত্রার মুখে হয়তো আমাদের পরীক্ষা করতে এসেছ।
ভি, ওরা ছিল অশিক্ষিত সামান্য মানুষ, ওদের ধর্মজ্ঞান ওরকমই যুক্তিহীন ও আবেগপূর্ণ। তবু সমুদ্রের ধারে বালির ওপর বসে চারজন বুড়োসুড়ো লোকের মুখোমুখি, পিছনে জাহাজ, আকাশ ও সমুদ্রের মায়া, ঢেউয়ের আর এলোমেলো বাতাসের শব্দের মধ্যে ওই কথা আমার অদ্ভুত লেগেছিল–আমি ঈশ্বরের প্রেরিত পুরুষ কি না? আমি মনে-মনে নত হয়ে আমার বিদ্রূপ সামলে নিলুম। তারা আমার মঙ্গল প্রার্থনা করল, তারপর খুশি হয়ে ঢালু বালিয়াড়ি ভেঙে ধীরে-ধীরে সুবজ জলের কাছে নেমে গেল।
এখন আমার চারধারে সবসময়ে ঘিরে থাকে ঘুষি মারবার থলি, ওজন তুলবার যন্ত্র, মেসিন বল, দৌড়োবার জুতো, আমার সারাদিনের সঙ্গী সেইসব দৈত্যকায় মানুষেরা যাদের সঙ্গে আমি লড়াই অভ্যাস করি। আমি এল, যে নাম শুনলে আমারই বুকের ভিতর দপ করে জ্বলে ওঠে অহংকার। আমি মূল্যবান। আমার নামে বাজি ধরা হয়। লড়াইয়ের আগে ওজন নেওয়ার সময়ে। প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে দেখা হয়, আমি ফুঁসে উঠে বলি, বুড়ো শুয়োর, হোঁতকা ভালুক, আমি গান গাইতে-গাইতে তোকে মেরে ফেলতে পারি। আমি রাস্তার লোককে জড়ো করে বলি, আমি সর্বশ্রেষ্ঠ; আমিই সর্বকালের একমাত্র সেরা লড়িয়ে। আমি অজেয়, ভয়ঙ্কর দ্যাখো এল–তোমরা আমার জয়ধ্বনি দাও। দেখো ভি, তবু রিংয়ের বাইরে আমি একতাল কাদামাটির মানুষ; মনের ভিতরে খুব গভীরে আমি এখনও এক বিমনা এল, যে নদীর ওপর ঝোলানো পোলে দাঁড়িয়ে রাতের কুয়াশার দিকে চেয়ে থাকে, যে একা-একা ঘুরে বেড়ায় শহরতলির রাস্তায় রাস্তায়, জাহাজঘাটায় যে পথে চলতে দেখা বুড়ি ফলওয়ালির ঝুড়ি থেকে মজা করবার জন্য টপ করে তুলে নেয় ফল, যে সদ্য–হাঁটতে–শেখা নিগ্রো শিশুর দিকে দু-হাত বাড়িয়ে বলে, এসো, এসো আর একটু…আর একটু…শাবাশ! আমি সেই এল, যে একদিন সমুদ্রের ধারে চারজন বুড়োর। মুখোমুখি ভাবতে বসেছিল, সে ঈশ্বর প্রেরিত পুরুষ কি না। যে একদিন হাতের কুড়োনো পাথর রাস্তায় গড়িয়ে দিয়ে ভেবেছিল, পৃথিবীর কোনও গাছ, কোনও ল্যাম্পপোস্টই তার শত্রু নয়। মাঝে-মাঝে তাই উজ্জ্বল আলোর নীচে, রিংয়ের ভিতরে দুটি গ্লাভসবদ্ধ হাত শূন্যে তুলে পৃথিবীর মানুষকে ডেকে আমার এই কথা বলতে ইচ্ছে করে, দ্যাখো, চেয়ে দ্যাখো তোমরা আমাকে কোথায় নির্বাসিত করেছ!