সেই অদ্ভুত লোকটা

সেই অদ্ভুত লোকটা

এক একটা মানুষের কিছুতেই বয়েসটা ঠিক বোঝা যায় না৷ চল্লিশও হতে পারে, পঁয়ষট্টিও হতে পারে৷ ঠিক এই রকমই একটা লোক বসে থাকে পার্ক সার্কাস ময়দানে৷ প্রত্যেক শনিবার৷ লোকটি পরে থাকে একটা সরু পা-জামা আর একটা রং- চঙে জোব্বা৷ মুখে কাঁচা-পাকা দাড়ি৷ চোখে চশমা, মাথায় একটা চ্যাপ্টা টুপি৷

গনগনে রোদের মধ্যেও লোকটি পার্কের বেঞ্চে দুপুরবেলা বসে থাকে৷ একদৃষ্টে চেয়ে থাকে ঘাসের দিকে৷

স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় দীপু মাঝে মাঝে পার্ক সার্কাস ময়দানের ভেতর দিয়ে শর্টকাট করে৷ লোকটিকে দেখে দীপুর কেমন যেন অদ্ভুত লাগে৷ একই রকম পোশাক, প্রত্যেক শনিবার ঠিক একই জায়গায় বসে কেন এই মানুষটা? সব সময় ও একলা থাকে, কেউ ওর পাশে বসে না৷

একদিন ছুটির পর বৃষ্টির মধ্যে স্কুল থেকে বেরিয়েছে দীপু৷ পার্কের রেলিং টপকে দৌড় লাগাতে গিয়েই আছাড় খেয়ে পড়ল৷ তাড়াতাড়ি উঠে ছড়িয়ে পড়া বইপত্রগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে, এমন সময় দেখল, একটু দূরের বেঞ্চে সেই দাড়িওয়ালা, কালো চশমা পরা লোকটা তাকিয়ে আছে তার দিকে৷

দীপুর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই লোকটা হাতছানি দিয়ে তাকে কাছে ডাকল৷

দীপুর এখন মোটেই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে লোকটার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে নেই৷ কিন্তু এই লোকটাই বা শুধু শুধু এখানে বসে বৃষ্টিতে ভিজছে কেন?

দীপুর কৌতূহল হল৷ সে এগিয়ে গেল লোকটার কাছে৷

লোকটি বলল, ‘ইসটুম, কিসটুম; দ্রুখ দ্রুখ?’

এ আবার কী রকম ভাষা? এই লোকটা কি কাবুলিওয়ালা নাকি? চেহারা দেখে তো তা মনে হয় না৷ লোকটির রোগাপাতলা চেহারা৷ দীপু কখনো রোগা কাবুলিওয়ালা দেখেনি৷

দীপু বলল, ‘কেয়া? হাম নেহি জানতা!’

লোকটা এবারে দুটো আঙুল তুলে জিজ্ঞেস করল, ‘হিন্দি? বাংলা?’

দীপু বলল, ‘বাংলা৷’

এবারে লোকটা ভাঙাভাঙা উচ্চারণে বলল, ‘বেশ কথা! হামি বাংলা জানে৷ এই লিজিয়ে খোঁকাবাবু, চকলেট খাও!

লোকটা তার জোব্বার পকেট থেকে একটা আধভাঙা চকলেটের টুকরো বার করে দীপুর দিকে এগিয়ে দিল৷

দীপুর হাসি পেল৷ লোকটা কি তাকে ক্লাস সিক্স-সেভেনের ছেলেদের মতন বাচ্চা পেয়েছে? ভুলিয়ে-ভালিয়ে ঘুমের ওষুধ মেশানো চকলেট খাইয়ে তারপর চুরি করে নিয়ে যাবে? দীপু এখন ক্লাস নাইনে পড়ে! সে ইচ্ছে করলে এই রোগা লোকটাকে ল্যাং মেরে ফেলে দিতে পারে৷

দীপু বলল, ‘আমি চকলেট খাবো না৷ আপনি আমায় ডাকলেন কেন?’

লোকটি চকলেট নিজের মুখে ভরে বলল, ‘তুমহার নাম তো দীপক মিত্রা আছে, তাই না?’

দীপু একটু অবাক হল৷ লোকটা নাম জানল কী করে? লোকটা তার সঙ্গে ভাব জমাতেই বা চাইছে কেন?

তবু সে বলল, ‘মিত্রা নয়, মিত্র৷ আমি আর বৃষ্টিতে ভিজতে পারছি না৷ কী বলতে চান চটপট বলুন!’

লোকটা হঠাৎ সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে ফেলল৷ তারপর বলল, ‘তুমহাকে আমার খুব ভালো লাগল৷ তুমি হামার বাড়িতে যাবে? বেশি দেরি হবে না৷ স্রেফ আধা ঘণ্টা থাকবে?’

দীপুর মনে হল, এ লোকটা তো তাহলে সত্যিই ছেলেধরা৷ স্কুলের কাছে বসে থাকে, ভুলিয়ে-ভালিয়ে ছেলেদের নিয়ে যেতে চায়৷

দীপুদের স্কুলের ক্লাস এইটের ছেলে অর্ণব সরকার গতমাসে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে৷ তাকে কি এই লোকটা ধরে নিয়ে গেছে নাকি?

দীপুর কিন্তু একটুও ভয় হল না৷ সে বলল, ‘আমাকে আপনার বাড়ি নিয়ে যাবেন? কেন? আমি মাছ খাই না, শুধু মাংস খাই৷ আলু সেদ্ধ আর ডিম সেদ্ধ একসঙ্গে মেখে খাই৷ দুধ আর কোকো মিশিয়ে খাই৷ এসব খাওয়াতে পারবেন?’

লোকটা হা হা করে হেসে উঠে বলল, ‘বেশ তো আমি তুমাকে মুরগমশল্লাম খাওয়াব৷ ঠান্ডা লস্যি খাওয়াব৷ যদি তুমি একঠো কাম করতে পারো!’

‘ধ্যাৎ!’ বলে দীপু আবার চলতে শুরু করল৷ লোকটা তখনও হাসতে লাগল জোরে জোরে৷

দীপু আর পেছন ফিরে তাকাল না৷

একটুখানি যেতে না যেতেই কোথা থেকে একটা মস্তবড় কুকুর তেড়ে এল দীপুর দিকে৷ গলায় বেল্ট বাঁধা একটা অ্যালসেশিয়ান, কারুর বাড়ির পোষা কুকুর, হঠাৎ বেরিয়ে এসেছে৷

দীপু এমনিতে কুকুর দেখে ভয় পায় না৷ কিন্তু এই কুকুরটা তেড়ে আসছে তার দিকেই৷ পার্কে আর কোনো লোকজন নেই৷ কুকুরের সঙ্গে ছুটেও পারা যায় না৷ দীপু তাড়াতাড়ি আর একটা বেঞ্চের ওপর উঠে দাঁড়াল৷

কুকুরটাও সেখানে এসে যেই দীপুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাবে, অমনি একটা লাল রঙের দড়ির ফাঁস এসে পড়ল কুকুরটার গলায়৷

দীপু দেখল সেই কালো চশমা পরা লোকটাই দড়ি ছুড়ে কুকুরটাকে বেঁধে ফেলেছে৷ তারপর কুকুরটাকে টানতে টানতে নিজের কাছে নিয়ে গেলে লোকটা তার গলা থেকে ফাঁস খুলে দিল তারপর কুকুরটার মাথায় একটা চাপড় মেরে বলল, ‘যা, ভাগ!’

অতবড় কুকুরটা এখন দারুণ ভয় পেয়ে লেজ গুটিয়ে প্রাণপণে দৌড়ে পালিয়ে গেল৷

লোকটা আবার দীপুর দিকে হাতছানি দিয়ে বলল, ‘ইধারে এসো, দীপকবাবু৷’

দীপু বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ! আমার বাড়ি ফেরার দেরি হয়ে যাচ্ছে৷’

লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ভয় নেই দীপকবাবু৷ এক মিনিট ঠারো! একটা কথা বলি৷ তোমাকে একঠো চিজ দিতে চাই৷ বহুৎ দামি চিজ৷’

‘দামি চিজ, মানে দামি জিনিস? সেটা আমাকে দেবেন কেন?’

‘দেবো, তুমাকে আমার পছন্দ হয়েছে সেই জন্য৷ তার বদলে তুমাকেও একটা কাজ করতে হোবে৷ যাবে, আমার বাড়িতে?’

‘না৷ স্কুল থেকে ঠিক সময়ে বাড়ি না ফিরলে আমার মা চিন্তা করবেন৷ তা ছাড়া আমি বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছি৷ সামনেই আমার পরিক্ষা—’

‘ঠিক আছে, বৃষ্টি হামি থামিয়ে দিচ্ছি৷ এই দেখো—এক, দো, তিন—৷

হাতের সেই লাল রঙের দড়িটা শূন্যে ছুড়ে দিয়ে লোকটা পাঁচ পর্যন্ত গুনে বলল, এই দেখো, বৃষ্টিকে বেঁধে ফেলেছি হামি, এবারে রোদ উঠবে৷

বৃষ্টি সত্যিই থেমে গেল৷ যদিও আগে থেকেই একটু কমে আসছিল৷

দীপু হেসে বলল, আপনি বুঝি কুকুরের মতন বৃষ্টির গলাতেও দড়ি বাঁধতে পারেন? হে-হে-হে৷ আপনি আপনিই বৃষ্টি কমে গেছে৷

লোকটি বলল, তুমাকে আমি আর একঠো চিজ দেখাচ্ছি৷ তুমি এই দড়িটাতে হাত দও!

দীপু সাবধান হয়ে গিয়ে বলল, ‘না, আমি দড়িতে হাত দেবো না!’

‘ঠিক আছে৷ ওই গাছটায় হাত দাও!’

‘কেন? তাতে কী হবে?’

‘দিয়ে দেখো না৷’

লোকটা তার হাতের দড়িটা দিয়ে গাছটার গায়ে একবার মারল৷ তারপর দীপু সেই গাছটায় হাত ছোঁয়াতেই দারুণ চমকে উঠল৷ দীপুর সারা শরীরটা ঝনঝন করে উঠেছে! ঠিক কারেন্ট লাগলে যেমন হয়৷

গাছের গায়ে তো কখনো কারেন্ট থাকতে পারে না৷ এই লোকটা তাহলে ম্যাজিক দেখাচ্ছে দীপুকে!

ঠিক দীপুর মনের কথাটা বুঝতে পেরেই লোকটা বলল, ‘এ সব ম্যাজিক নেহি! আসল জিনিস আছে৷ আর একটা দেখবে? ওই দেখো; আশমান দিয়ে একঠো এরোপ্লেন যাচ্ছে৷ যাচ্ছে তো?’

দীপু ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখল, প্রায় তাদের মাথার ওপর দিয়েই একটা প্লেন উড়ে যাচ্ছে৷

সেই লোকটা লাল দড়িটা ছুড়ে দিল শূন্যের দিকে, তারপর বলল, ‘যা!’

প্লেনটা অমনি অদৃশ্য হয়ে গেল৷

এবারে গা ছমছম করে উঠল দীপুর৷ এ কার পাল্লায় পড়ল সে৷ এই সময় পার্কটা এত ফাঁকাই বা কেন? লোকটা যদি দীপুকেও ওই দড়িতে বেঁধে ফেলে?

দীপু শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কী হল প্লেনটার? ধ্বংস হয়ে গেল?’

‘না, না, ধ্বংস হবে কেন? তা হলে তো ভেতরের আদমিগুলোও মরে যাবে৷ আমি তো কোনো মানুষ মারি না৷ আমি শুধু তোমার আঁখ থেকে মুছে দিলাম এরোপ্লেনটাকে৷ শোনো দীপকবাবু আমি তুমাকে যে চিজ দেবো বলেছিলাম, তা কোনো আনসান চিজ নয়৷ তোমাকে দেবো আসলি চিজ, তা হল জ্ঞান৷ তুমি আমার কাছ থেকে এই জ্ঞান যদি নাও, তবে তুমি আন্ধারেও দেখতে পাবে, আগুন লাগলে হাত পুড়বে না, তিনদিন কিছু না খেলেও ভুখা লাগবে না, আরও অনেক কিছু পারবে৷’

‘ঠিক আছে শিখিয়ে দিন৷’

‘আভি তো হবে না৷ দু’এক ঘণ্টা টাইম লেগে যাবে৷ তার আগে যে তুমাকে একঠো কাম করতে হবে৷’

‘কী কাজ বলুন?’

‘তুমি আমাকে একটা দাওয়াই খাওয়াবে৷’

‘দাওয়াই, মানে ওষুধ?’

‘হাঁ হাঁ৷ আমার বাড়িতে সেই ওষুধ আছে৷ খুব দামি হেকিমি ওষুধ৷ পাঁচ ফোঁটা তাজা রক্ত মিশিয়ে সেই ওষুধ তৈয়ারি করতে হয়৷ চৌদ্দো-পনেরো বছরের ছেলের বুকের রক্ত৷ তুমি সেইটুকু রক্ত আমাকে দেবে?’

‘রক্ত?’

‘হাঁ, মাত্র পাঁচ ফোঁটা! আসলে হয়েছে কি জানো, আমি তো শুধু রোদ্দুর খাই৷ রোদ্দুর না থাকলে আমি দুবলা হয়ে যাই৷ তখন ওই দাওয়াই খেতে হয়৷’

‘আপনি রোদ্দুর খান?’

‘হাঁ, দীপকবাবু! আমি কিছু খাবার খাই না৷ রোদ্দুর খেলেই আমার শরীর খুব তাজা থাকে৷ মুস্কিল হয় এই বর্ষাকালে৷ এক একদিন রোদ্দুরই থাকে না, শুধু মেঘ, শুধু বৃষ্টি! তখন আমি দুবলা হয়ে যাই৷’

‘আপনি তো ইচ্ছে করলেই বৃষ্টি থামিয়ে দিতে পারেন৷ বৃষ্টি বন্ধ করে দিয়ে রোদ খাবেন!’

‘আরে বাপ রে বাপ! সে কি কখনো হয়! বর্ষাকালে যদি বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যায়, তবে কত ক্ষতি হবে৷ চাষ-বাস হবে না৷ ধান-গম হবে না৷ কত লোক না খেয়ে মরবে৷ আমার একেলার সুখের জন্য কি আমি বৃষ্টি বন্ধ করতে পারি? তুমি আমায় একটু দাওয়াই খাইয়ে দাও? স্রেফ পাঁচ ফোঁটা রক্ত!’

দীপু খানিকক্ষণ হাঁ করে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল৷ তারপর আস্তে আস্তে বলল, এখন অপনার বাড়ি যাব, অনেক দেরি হয়ে যাবে, আমার মা খুব চিন্তা করবেন! আমি কাল যদি আপনার বাড়ি যাই? কাল মাকে বলে আসব যে একটু দেরি হবে৷’

‘কাল? ঠিক আসবে?’

‘হ্যাঁ, আসব! আপনি ভাববেন না যে আমি পাঁচ ফোঁটা রক্ত দিতে ভয় পাই! আজকে এখন বাড়ি যাব৷’

‘তা হলে এসো কালকে!’

দীপু বারবার পেছনে তাকাতে তাকাতে চলে গেল পার্কটা পেরিয়ে৷ লোকটা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে৷ বৃষ্টি নেমে গেল আবার৷

দীপু অবশ্য এই ঘটনাটা বাড়িতে কারুকে বলল না৷ কিন্তু লোকটা তাকে দারুণ দারুণ ম্যাজিক শিখিয়ে দেবে ভেবে সে খুব উত্তেজিত হয়ে রইল৷ পাঁচ ফোঁটা রক্ত তো অতি সামান্য ব্যাপার৷

সেদিন বিকেল থেকে সারারাত বৃষ্টি হল৷ পরের দিনও সেই রকম বৃষ্টি৷ সেদিন দীপুর ইস্কুল বন্ধ৷ তবু বিকেলের দিকে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার নাম করে সে চলে এল সেই পার্কে৷ সেই লোকটা নেই৷ এত বৃষ্টির মধ্যে কেউই পার্কে আসেনি৷ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে চলে এল দীপু৷

এরপর পরপর কয়েকদিন চলল খুব বৃষ্টি৷ আকাশে রোদই ওঠে না৷ দীপুর খালি মনে হয়, সেই লোকটা কিছু না খেয়ে আছে৷ আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে৷ ওষুধ খাবে কি করে! অন্য কোনো ছেলে কি পাঁচ ফোঁটা রক্ত দেবে?

বৃষ্টির জন্য ইস্কুল বন্ধ রইল দু-দিন৷ তার পরের শনিবার দীপু ছুটির পরেই দৌড়ে এল পার্কে৷ লোকটা আজও বসে নেই তার সেই নিজের জায়গাটায়৷ কিন্তু সেই বেঞ্চটার ওপরে একটা লাল রঙের দড়ি পড়ে আছে৷

এটা কি সেই ম্যাজিকের দড়ি? লোকটা দীপুর জন্যই রেখে গেছে? কিন্তু দীপু সেই দড়িটা ছুঁয়ে কিছুই বুঝতে পারল না৷ লোকটা তো তাকে তার, সেই-জ্ঞান কিংবা ম্যাজিক শিখিয়ে যায়নি৷

লোকটিকে আর কোনোদিন দেখতে পায়নি দীপু৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *