গত কুড়ি বছর আমি ঈদের কোনও উৎসব দেখিনি। অনেক সময় ঈদ চলে গেলে শুনেছি ঈদ এসেছিল। আমি নাস্তিক মানুষ। আমার কোনও ঈদ বড়দিন নেই, পুজো হানুকা নেই, বুদ্ধ পূর্ণিমা বা গুরু নানকের জন্মদিন নেই। আমি বিশ্বাস করি পয়লা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারির উৎসবে। আমি উৎসব করি ডারউইনের জন্মবার্ষিকীতে, মানবাধিকার দিবসে। কিন্তু ঈদ এলে বড় মনে পড়ে শৈশবের সেই দিনগুলো। মনে পড়ে বাবার সেই সাত কাক ডাকা ভোরে উঠে স্নান করে নেওয়া। আর ছেলেমেয়েদের সবাইকে ঘুম থেকে উঠিয়ে, সে শীত হোক, গ্রীস্ম হোক, স্নান করতে পাঠানো। আমরা মহা আনন্দে কসকো সাবান দিয়ে স্নান করতাম। কসকো সাবানটা বাবা ঈদের দিনের স্নানের জন্যই কিনতেন। কেন কসকোটা কিনতেন, কেন অন্য সাবান নয়, আজও জানি না। আমি এখনও কোথাও কোনও দোকানে কসকো সাবানের মতো কোনও সাবান দেখলে কিনে ফেলি। আসলে সাবান নয়, শৈশবের সেই দিনগুলো কিনি, হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো।
ঈদের আগে বাবা আমাকে আর আমার বোনকে গৌরহরী বস্ত্রালয়ে নিয়ে গিয়ে জামা পায়জামার কাপড় কিনে দিতেন। সেই কাপড় দরজির দোকানে দিয়ে আসতেন । বাটার দোকান থেকে কিনে দিতেন জুতো। বাবা চুড়ি মালা লিপস্টিক এসব কিনে দেবার আবদার কখনো শুনতেন না। সাজগোজ করা তিনি একেবারেই পছন্দ করতেন না। মুখে কখনও রং লাগালে ঘাড় ধরে কলতলায় নিয়ে সব রং ধুয়ে দিতেন। বাবার বক্তব্য, ‘পড়ালেখা করো, বড় হও, ছাত্রানাম অধ্যায়নং তপঃ’।
ঈদের ভোরে স্নান শেষ করে নতুন জামা কাপড় পরা তখনও শেষ হয়নি, মা টেবিলে সাজিয়ে রাখতেন ছ’সাত রকমের শেমাই, জর্দা। আমি আজও বুঝিনা অত ভোরে মা কী করে অতগুলো শেমাই বানিয়ে ফেলতেন। মা বোধহয় জাদু জানতেন। বাবা আমাদের ভাই বোন সবাইকে সঙ্গে নিয়ে শেমাই খেতেন। মা খেতেন না। মা রান্নাঘরে ব্যস্ত। মা’র তখন পোলাও রান্না শেষ, মুরগির কোরমা আর খাসির রেজালা শেষ হয় হয়। সকাল দশটাতেই আমাদের পোস্ট-নাস্তা আর প্রি-লাঞ্চ খেতে হতো। বিস্তর পোলাও মাংস। বাবার সঙ্গে ডাইনিং টেবিলে বসে আমরা ভাই বোনরা অতি সুস্বাদু সেসব খাবার খেতাম। মা খেতেন না। মা রান্নাঘরের দৌড়োদৌড়িতে। মা কী করে যে অত ভালো রাঁধতেন, মাটির চুলোয় ফুঁকনি ফুঁকে কী করে যে রান্নাই বা করতেন মা, আমি আজও জানি না। মা বোধহয় জাদু জানতেন। মা জাদুই জানতেন।
মা’র সারাদিনে সময় হতো না ঈদের শাড়ি পরার। সব ঈদে মা শাড়ি পেতেন না। যে ঈদে মা শাড়ি পেতেন, সেই শাড়ি পরতে পরতে মা’র সন্ধে হতো। বাড়ির সবাইকে খাইয়ে, অতিথিদের খাইয়ে, তারপর। মা’র ওই শাড়ি কিছুক্ষণ পর আবার খুলে রাখতে হতো, কারণ মা’কে আবার ঘরের শাড়ি পরে যেতে হতো রান্নাঘরে সবার জন্য রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতে। রাতের খাবারও বাবার সঙ্গে বসে আমরা খেতাম। মা কখন খেতো, কী খেতো, কোথায় বসে খেতো, জানতাম না। জানতে কি চাইতাম কোনোদিন?
কোরবানির ঈদের দিন শাড়ি পরার কোনও সুযোগ হতো না মা’র। সেই শেষরাত থেকে শুরু হতো পেঁয়াজ রসুন বাটা। মা সারাদিন রান্নাঘরে। সকালে গরু জবাই হতো মাঠে। মাংস কাটা হতো বারান্দায়। বড় বড় গামলায় মাংস চলে যেতো রান্নাঘরে, মা যেন রান্না করেন সব। মা সারাদিন রান্না করতেন। যা কিছুই রান্না করতেন, দৌড়ে দৌড়ে ডাইনিং টেবিলে দিয়ে যেতেন আমাদের জন্য। কোনওদিন রান্নাঘরে উঁকি দিয়েও দেখিনি মা কী করে রান্না করছেন, মা’কে একটু সাহায্য করার কথা কোনওদিন ভাবিনি।
আজ মা নেই। মা যখন ছিলেন, বুঝিনি ছিলেন। মা’র চলে যাওয়াটা আজও আমি মেনে নিতে পারিনি। বাবার চলে যাওয়াটাও। নির্বাসন জীবন একদিন শেষ হবে, একদিন তাঁদের কাছে ফিরবো আবার, এই স্বপ্ন দেখতাম। স্বপ্নগুলো কবে মরে কঙ্কাল হয়ে রয়েছে!
ঈদ এলেই মা’কে খুব মনে পড়ে। যদি শৈশবকে ফিরে পেতাম আবার কোনও জাদুবলে, তবে মা’কে একা একা ওভাবে কষ্ট পেতে দিতাম না কোনওদিন। যে দিন গেছে, সে দিন আর ফিরবে না জানি। জেনেও ইচ্ছে করি ফিরে পেতে। মা’র সঙ্গে কোথাও কোনওদিন আর দেখা হবে না আমার জানি। জেনেও বড় ইচ্ছে হয় হঠাৎ কোথাও দেখা হোক। বেহেস্ত বলে কিছু নেই জানি, জেনেও ইচ্ছে হয় বেহেস্ত বলে কিছু থাকুক কোথাও। আর সেই বেহেস্তে আমার মা অনন্তকালের জন্য বাস করুক। পৃথিবীতে মা শুধু দাসীর মতো খেটে গেছেন। পড়ালেখা করে বড় হতে চেয়েছিলেন মা, স্বনির্ভর হতে চেয়েছিলেন মা, মা’কে কিছুই হতে দেওয়া হয়নি। মেয়ে বলেই দেওয়া হয়নি।
মা’র কষ্টগুলো আমি ছুয়েঁ দেখার চেষ্টা করবো দিনভর। এভাবেই আমি কাটাবো আমার এবারের ঈদ।