বাংলাদেশে ঈদ হচ্ছে। দেশটা খুব দূরের দেশ এখন। চাইলেও যেতে পারবো না দেশটায়। হাত বাড়ালেও দেশটাকে ছুঁতে পারবো না। দেশটা থেকেও নেই। কুড়ি বছর হলো দেশে নেই আমি। কুড়ি বছর হলো, ঈদের কোনও উৎসব দেখিনি। অনেক সময় ঈদ চলে গেলে শুনেছি ঈদ এসেছিল।নির্বাসিত জীবনের ঝুটঝামেলা মেটাতেই বছর গড়িয়েছে। দেশের আনন্দ-উৎসবের খবরের চেয়ে বেশি পাই দেশের দুঃখ-দুর্দশার খবর।
বেশ ক’দিন যাবৎ বাঙালি বন্ধুদের ফেসবুকে গরুর ছবি দেখছি। গরুগুলো দেখতে ডেনমার্ক বা অস্ট্রেলিয়ার গরুর মতো। দেশে থাকাকালীন এত মাংসল গরু দেখিনি। শুনেছি এদের নাকি হরমোন খাইয়ে বড় করা হচ্ছে, দেখতে যেন নাদুস নুদুস হয়। অতিরিক্ত হরমোন শরীরে যায় বলে মেয়েরা বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছে যাচ্ছে দ্রুত। শৈশব বলে কিছু আর থাকছে না মেয়েদের। এ এক সমস্যা বটে। আমার ছোটবেলায় গরুরা অনেক শীর্ণ ছিল। গরু কিনে বাড়ির উঠোনে বেঁধে রাখা হতো। খড় আর লবণ পানি খেতে দিতেন বাবা। গরু যখন লেজ নেড়ে নেড়ে খেতো, দেখতে খুব ভালো লাগতো আমার।
শীতের সময় মা গরুর পিঠে কম্বল দিয়ে দিতেন। গরুর যত্ন যদিও বাবা মা দু’জনই করতেন, তারপরও কখনও আমার মনে হতো না সেই যত্ন যথেষ্ট। সারারাত আমার ঘুম আসতো না, আমরা দিব্যি মশারির নিচে, আর ওদিকে বেচারা গরু কিনা পড়ে আছে উঠোনে, ওকে যে মশা কামড়াচ্ছে, তার কী হবে! গরুকে একবার একটা মশারি দেবার প্রস্তাব করেছিলাম, মা মশারি দেননি, কিন্তু উঠোনে ধুপ জ্বালিয়ে মশা দূর করার ব্যবস্থা করেছিলেন। ভোরবেলা ছুটে যেতাম গরুকে দেখতে। দেখতাম বড় বড় কাজলকালো চোখদুটোয় জল।গরুর গলায়,পেটে, পিঠে আদর করে দিতাম। যেন নতুন অতিথি এসেছে বাড়িতে। এখন থেকে অতিথিকে আর কোনও কষ্ট সইতে হবে না, মশার কামড় থেকে বাঁচতে নতুন মশারিও মিলবে, এমন প্রতিশ্রুতি দিতাম।
একসময় সেই সময়টা আসতো, যখন উঠোন থেকে গরুকে সরিয়ে মাঠে নিয়ে যাওয়া হতো। কেউ না কেউ আমাকে টেনে নিয়ে যেতই গরুর জবাই হওয়া দেখতে। আমার খুব ইচ্ছে হতো গরু তার সবটুকু শক্তি খাটিয়ে ছুরি আর বাঁশ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোকে উল্টে ফেলে দিয়ে দৌড়ে গেইটের বাইরে চলে যাক। অদৃশ্য হয়ে যাক কোথাও। গরুর জবাই হওয়াটা সত্যিই এক বীভৎস দৃশ্য।প্রতি বারই এক গাদা লোক এসে গরুর পা’গুলোকে দড়ি দিয়ে বেঁধে, বাঁশ দিয়ে বেকায়দায় আটকে শুইয়ে ফেলতো আর নিরীহ নিদোর্ষ গরুর গলা ধারালো ছুরি দিয়ে কাটতো। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোতো। গরু চিৎকার করে কাঁদতো। ছটফট করতো, সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়াতে চাইতো, কিন্তু পারতো না। ওই দৃশ্য দেখার পর আমার গা অবশ অবশ লাগতো। কান্না পেতো খুব। দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে খানিকটা কেঁদে তবে বেরোতাম। একটা জলজ্যান্ত গরুকে অমন নিষ্ঠুরভাবে মেরে ফেলার কষ্টটা বুকের মধ্য থেকে কিছুতেই যেতো না। কষ্ট খানিকটা কমতো যখন দেখতাম বিকেলে গেইটের কাছে শত শত ভিখিরি জমা হয়েছে এক টুকরো মাংসের আশায় আর বালতি ভরে ভরে মাংস নিয়ে ওদের বিলোনো হচ্ছে। মাংস আমিও বিলোতাম। আমাকে বলে দেওয়া হতো একজনের হাতে দুটোর বেশি টুকরো না দিতে,দুটোর বদলে চিরকালই আমি কিন্তু চারটে টুকরো দিয়েছি। জানিনা সেই আমার ছোটবেলার মতো এখনও ভিখিরির ভিড় হয় কি না বাড়িতে বাড়িতে। শুনেছি দেশটা নাকি অনেক পাল্টে গেছে। ঠিক কতটা পাল্টেছে, কেমন পাল্টেছে, খুব দেখতে ইচ্ছে করে।
আমি নাস্তিক মানুষ। সত্যি বলতে কী, আমার কোনও ঈদ বড়দিন নেই, পুজো হানুকা নেই, বুদ্ধ পূর্ণিমা বা গুরু নানকের জন্মদিন নেই। আমি বিশ্বাস করি পয়লা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারির উৎসবে। আমি উৎসব করি ডারউইনের জন্মবার্ষিকীতে, মানবাধিকার দিবসে। কিন্তু ঈদ এলে বড় মনে পড়ে শৈশবের সেই দিনগুলো।মনে পড়ে বাবার সেই কাক ডাকা ভোরে উঠে স্নান করে নেওয়া। আর ছেলেমেয়েদের সবাইকে ঘুম থেকে উঠিয়ে, সে শীত হোক, গ্রীস্ম হোক, স্নান করতে পাঠানো। আমরা মহা আনন্দে কসকো সাবান দিয়ে স্নান করতাম। কসকো সাবানটা বাবা ঈদের দিনের স্নানের জন্যই কিনতেন। কেন কসকোটা কিনতেন, কেন অন্য সাবান নয়, আজও জানি না। আমি এখনও কোথাও কোনও দোকানে কসকো সাবানের মতো কোনও সাবান দেখলে কিনে ফেলি। আসলে সাবান নয়, শৈশবের সেই দিনগুলো কিনি, হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো।
ঈদের আগে আমাকে আর আমার বোনকে নিয়ে বাবা গৌরহরী বস্ত্রালয়ে যেতেন, আমাদের জামার কাপড় কিনে দিতেন, সেই কাপড় দরজির দোকানে দিয়ে আসতেন। বাটার দোকান থেকে কিনে দিতেন জুতো। বাবা চুড়ি মালা লিপস্টিক এসব কিনে দেবার আবদার কখনো শুনতেন না। সাজগোজ করা তিনি একেবারেই পছন্দ করতেন না। মুখে কখনও রং লাগালে ঘাড় ধরে কলতলায় নিয়ে সব রং ধুয়ে দিতেন। বাবার বক্তব্য, ‘পড়ালেখা করো, বড় হও, ছাত্রানাম অধ্যায়নং তপঃ’।
ঈদের ভোরে স্নান শেষ করে নতুন জামা কাপড় পরা তখনও শেষ হয়নি, মা টেবিলে সাজিয়ে রাখতেন ছ’সাত রকমের শেমাই, জর্দা। আমি আজও বুঝিনা অত ভোরে মা কী করে অতগুলো শেমাই বানিয়ে ফেলতেন। মা বোধহয় জাদু জানতেন। বাবা আমাদের ভাই বোন সবাইকে সঙ্গে নিয়ে শেমাই খেতেন। মা খেতেন না। মা রান্নাঘরে ব্যস্ত। মা’র তখন পোলাও রান্না শেষ, মুরগির কোরমা আর খাসির রেজালা শেষ হয় হয়। সকাল দশটাতেই আমাদের পোস্ট-নাস্তা বা প্রি-লাঞ্চ খেতে হতো। বিস্তর পোলাও মাংস। বাবার সঙ্গে ডাইনিং টেবিলে বসে আমরা ভাই বোনরা অতি সুস্বাদু সেসব খাবার খেতাম। মা খেতেন না। মা রান্নাঘরের দৌড়োদৌড়িতে। মা কী করে যে অত ভালো রাঁধতেন! মাটির চুলোয় ফুঁকনি ফুঁকে কী করে যে রান্নাই বা করতেন মা, জানি না। মা বোধহয় জাদু জানতেন। মা জাদুই জানতেন।
মা’র সারাদিনে সময় হতো না ঈদের শাড়ি পরার। সব ঈদে মা শাড়ি পেতেন না। যে ঈদে পেতেন, সেই ঈদে শাড়ি পরতে পরতে মা’র সন্ধে হতো। বাড়ির সবাইকে খাইয়ে, অতিথিদের খাইয়ে, তারপর। মা’র ওই নতুন শাড়ি কিছুক্ষণ পর আবার খুলে রাখতে হতো, কারণ মা’কে আবার ঘরের-শাড়ি পরে যেতে হতো রান্নাঘরে সবার জন্য রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতে। রাতের খাবারও বাবার সঙ্গে বসে আমরা খেতাম। মা কখন খেতেন, কী খেতেন, কোথায় বসে খেতেন, জানতাম না। জানতে কি চাইতাম কোনোদিন?
কোরবানির ঈদের দিন শাড়ি পরার কোনও সুযোগ হতো না মা’র। সেই শেষরাত থেকে শুরু হতো পেঁয়াজ রসুন বাটা। মা সারাদিন রান্নাঘরে। সকালে গরু জবাই হতো মাঠে। মাংস কাটা হতো বারান্দায়। বড় বড় গামলায় মাংস চলে যেতো রান্নাঘরে। মা সারাদিন রান্না করতেন। যা কিছুই রান্না করতেন, দৌড়ে দৌড়ে ডাইনিং টেবিলে দিয়ে যেতেন আমাদের জন্য। কোনওদিন রান্নাঘরে উঁকি দিয়েও দেখিনি মা কী করে রান্না করছেন, মা’কে একটু সাহায্য করার কথা কোনওদিন ভাবিনি।
আজ মা নেই। মা যখন ছিলেন, বুঝিনি ছিলেন। মা’র চলে যাওয়াটা আজও আমি মেনে নিতে পারিনি। বাবার চলে যাওয়াটাও। নির্বাসন জীবন একদিন শেষ হবে, একদিন তাঁদের কাছে ফিরবো আবার, এই স্বপ্ন দেখতাম। স্বপ্নগুলো কবে মরে কঙ্কাল হয়ে রয়েছে!
ঈদ এলেই মা’কে খুব মনে পড়ে। যদি শৈশবকে ফিরে পেতাম আবার কোনও জাদুবলে, তবে মা’কে একা একা ওভাবে কষ্ট পেতে দিতাম না আর। যে দিন গেছে, সে দিন আর ফিরবে না জানি। জেনেও ইচ্ছে করি ফিরে পেতে। মা’র সঙ্গে কোথাও কোনওদিন আর দেখা হবে না আমার জানি। জেনেও বড় ইচ্ছে হয় হঠাৎ কোথাও দেখা হোক। বেহেস্ত বলে কিছু নেই জানি, জেনেও ইচ্ছে হয় বেহেস্ত বলে কিছু থাকুক কোথাও। আর সেই বেহেস্তে আমার মা অনন্তকালের জন্য বাস করুক। পৃথিবীতে মা শুধু দাসীর মতো খেটে গেছেন। পড়ালেখা করে বড় হতে চেয়েছিলেন মা, স্বনির্ভর হতে চেয়েছিলেন মা, মা’কে কিছুই হতে দেওয়া হয়নি। মেয়ে বলেই দেওয়া হয়নি।
মা’র কষ্টগুলো আমি ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করবো সারাদিন। এভাবেই আমি কাটাবো আমার এবারের ঈদ।
অক্টোবর ৬, ২০১৪