সেইখানে

সেইখানে

আমার মেজোদাদামশাই কখনো কখনো ডেকে বলতেন, ও রে, টুনু মিনু নেগো ধেলো ইলু বিলু মন্টু, শোন। পরিদের দেশে গেছিস কখনো?

শুনে আমরা হেসেই খুন। পরিদের দেশ আবার হয় নাকি? ও তো ঠাকুমাদের বানানো গল্প!

মেজোদাদামশাই বিরক্ত হয়ে বলতেন, তবে কি আমার ঠাকুরদার বাড়ির চিলেকোঠার মস্ত সিন্দুকটাও ঠাকুমাদের বানানো গল্প বলতে চাস? যাঃ, তোদের আর কোনো কথাই বলব না।

আমরা অমনি তাকে ঘিরে ধরলাম, না মেজোদাদামশাই, না। বলোনা, তোমার ঠাকুরদার বাড়ির চিলেকোঠার সিন্দুকের গল্প।

 মেজোদাদামশাইও তো সেই চান। বলতে লাগলেন, শোন তবে ঠাকুরদার বাড়ির চিলেকোঠায় ছিল কার হাতে কবেকার তৈরি একটা কাঠের সিন্দুক। এক মানুষ উঁচু, আলমারির মতো দাঁড় করানো, কাঁঠাল কাঠের তৈরি সেটা। পাল্লার ওপর তেল-সিঁদুর দিয়ে লাল রঙের লক্ষ্মীঠাকুরুনের পাচা আঁকা। তার রং এখন স্কুলে গিয়েছে, তারই নীচে সোনালি রঙের একটা দরজা আঁকা। তারই মাঝখানে আবার ছোট্ট একটা চাবির ছাদাও আঁকা রয়েছে।

 যখন তোদের মতো ছোটো ছিলাম, রোজ সেটাকে চেয়ে চেয়ে দেখতাম, আর অবাক হয়ে ভাবতাম, আঁকা ছ্যাদা, তার চারদিকে চাবি ঘোরানোর দাগ কেমন করে হয়!

সত্যিকার চাবির ছ্যাঁদাও ছিল একটা, কিন্তু তাতেও কেউ চাবি ঢুকিয়ে সে সিন্দুক খুলত না, তবে আবার আঁকা ছ্যাঁদার চাবির দাগ পড়ে কী করে? ঠাকুরমাকে জিগেস করলে বলতেন, ষাট ষাট; চুপ, ওকথা মুখেও আনিস নে। তোর ঠাকুরদার ঠাকুরদার বাবার মানতকরা ওই সিন্দুক, ওতে কি চাবি লাগাতে আছে? মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম কর এক্ষুনি।

আমি করতামও তাই, আর আড়চোখে তাকিয়ে দেখতাম আঁকা ছ্যাদার চারদিকে চাবি ঘোরানোর স্পষ্ট দাগ। দেখতাম, আর মনে হত তেল-সিঁদুরের প্যাঁচা বুঝি আমারই দিকে চেয়ে রয়েছে।

রোজ সন্ধ্যে না পড়তেই বাড়ির পণ্ডিতমশাই সংস্কৃত পড়াতে আসতেন। তেলের আলোতে বসে অং-বং পড়া যে কী কষ্ট, সে আর তোরা কী বুঝবি! যেদিন শব্দরূপ মুখস্থ হত না, সেদিন সে কী কান-প্যাঁচানোর ধুম পড়ে যেত!

প্রায়ই এটা-ওটা ভুলে যাই, একদিন সংস্কৃত পড়া তৈরি করে রাখতেই গেছি ভুলে।সন্ধ্যে বেলায় যেই-না দূর থেকে সদরের উঠোনে পণ্ডিতমশাইয়ের খড়ম পায়ের শব্দ শুনেছি, অমনি একদৌড়ে সিঁড়ি ডিঙিয়ে একেবারে চিলেকোঠায়।

ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজায় খিল দিয়ে, ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে খুব হাঁপাচ্ছি। চারদিক থমথম করছে, নিঝুম চুপচাপ, শুধু নিজের বুকের ধুকপুক শুনতে পাচ্ছি, আর দূরে কোথায় একটা খোঁজ খোঁজ ধর ধর শব্দ। ভয়ে মরি, শেষটা যদি এখানে এসে দরজায় ধাক্কাধাক্কি করে? তবেই তো পুরোনো খিল খসে পড়বে। এদিক-ওদিক পালাবার পথ খুঁজছি, হঠাৎ চোখে পড়ল, কাঠের সিন্দুকের আঁকা দরজায় ছোট্ট একটা সোনালি চাবি লাগানো।

আমি তো অবাক! ছ্যাঁদায় আবার কে চাবি আঁকল! এ ঘরে তো আমি ছাড়া আর কেউ বড়ো-একটা আসে না। আস্তে আস্তে গিয়ে চাবির গায়ে হাত দিতেই চমকে উঠলাম। ওমা, আঁকা তো নয়, সত্যিকার চাবি! চাবিটাকে ঘোরাব কি না ভাবছি, এমন সময় সিঁড়িতে শুনি পায়ের শব্দ।

অমনি সাহস এল, দিলাম চাবি ঘুরিয়ে। ঘোরাতেই খুট করে সোনালি দরজাটা গেল খুলে! আমরা তো মুচ্ছো যাবার জোগাড়।

তারই মধ্যে কানে এল ঘরের বাইরে, দোরের হাতলে টানাটানি। আর কথাটি না বলে, চাবি ধরে টেনে,দরজাটা আবার খুলে ভেতরে সেঁদিয়ে গেলাম। তারপর সোনালি চাবিটা দিয়ে আবার ভেতর থেকে এঁটে দিলাম। দেখি সেখানে ফুট ফুট করছে আলো।

 সেই আলোতে চেয়ে দেখি হাতের চাবিটাকে কেমন যেন চেনা-চেনা লাগছে। আরে, এই তো আমার মা-র মিনেকরা বাক্সের হারানো চাবি! ওটাকে একেবার কোথায় যে রেখেছিলাম আর মনে করতে পারিনি। আর এখানে আঁকা দরজায় দিব্যি লাগানো ছিল!

চারদিকে তাকিয়ে দেখি, আর তো আমি একা নই। কোথা থেকে দলে দলে ছেলেমেয়েরা এসে হাজির। প্রথমে ভাবলাম এরা সব অচেনা, কাছে আসতে দেখি তা তো নয়। কোন কালে কার সঙ্গে খেলা করেছি, কার সঙ্গে পড়েছি, তাদের নাম পর্যন্ত ভুলে গেছি, তারাই সব এখন আমাকে দেখে দৌড়ে এল, খুশিতে সবাই ডগমগ! খালি হাতে এল না কেউ, সঙ্গে করে নিয়ে এল কত ছাতা, টর্চ, রুমাল, বই, পেনসিল কাটা কল, মায় একটা ইস্কুলের ব্যাগ পর্যন্ত। সব তারা আমার হাতে গুঁজে দিয়ে যায়। আমি তো লজ্জায় মরি। এত জিনিস কারো কাছ থেকে নেওয়া যায় কখনো?

তারা বলে কী, না, এসব তোমারই জিনিস, তুমি নিজের হাতে এ সমস্ত হারিয়েছ। এখানে-ওখানে ফেলে এসেছ, এর বাড়িতে, ওর বাড়িতে, ট্রামগাড়িতে, মেলায়, ইস্কুলে, খেলার মাঠে। দেখে দিকিনি চিনতে পার কি না, এই তোমার নাম লেখা।

তখন আরেক বার চারিদিকে চেয়ে দেখি, আরে, এ জায়গাটাও যে আমার কত চেনা, কত দিন মনে পড়েনি এখানকার কথা! এই তো এখানকার আম গাছের তলায় ছোটোবেলায় কত খেলাই করেছি! এই দেখো, আমাদের গুলি খেলার গাব্বটা অবধি তেমনি রয়েছে! ওই তো গাছের গায়ের ছোট্ট কোটর থেকে আমার চেনা সেই সাদা কাঠবিড়ালটা মুখ বাড়াচ্ছে, আমাকে দেখে কত খুশি। আহা, আমিই ভুলে গিয়েছিলাম, ও দেখছি আমাকে ঠিক মনে করে রেখেছে।

কোথায় এলাম, এ তো আর নতুন জায়গা নয়, এ যে সবই চেনা, এ সবই যে একসময় আমার ছিল। এদের যে ভুলে গেছি তা পর্যন্ত মনে ছিল না। কানের কাছে কে যেন বললে, ও ছেলে আবার পালাচ্ছে, চেরতা খেতে ভুললে তো চলবে না! এই নাও, হাঁ করো।

চেয়ে দেখি সেই আমার কবেকার ধাইমা। আরে, ধাইমার মুখটা পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিলাম। ওরই কোলে চেপে কত ঘুরেছি, চুল টেনেছি, চিমটি কেটেছি, ওর গায়ে দুধ ছিটিয়েছি, ওর হাতে ভাত খেয়েছি, ওর পাশে ঘুমিয়েছি। আহা, কেমন করে ভুলে গিয়েছিলাম।

ধাইমার পায়ে পায়ে আমার ছোটোবেলাকার কত আদরের মেনি বেড়ালটাও এসে উপস্থিত। আবার ঠিক তেমনি করে পিঠ বেঁকিয়ে ম্যাও ম্যাও করতে করতে ছুটে এসে আমার পা জাপটে ধরেছে।

বেড়ালটাকে সরিয়ে দিয়ে রাঙা মাস্টারমশাই এগিয়ে এলেন, দুই বগলে তাল তাল বই, হেসে বললেন, কত পড়া ভুলেছ বলো দিকিনি? কত নামতা, বানান, রাজধানী, কী উৎপন্ন হয়, কত সাল তারিখ, রাজার নাম, কত যুদ্ধ, কত জয়-পরাজয়– তার হিসেব রাখো? আজও শব্দরূপ মুখস্থ করতে ভুলেছ?

এই দেশেই তবে যত রাজ্যের ভুলে-যাওয়া জিনিসের হদিশ পাওয়া যায়! আহা, ওই তো আমার হারানো মার্বেলের ঢিবি, আম গাছের তলায় ছোটো একটা পাহাড়ের মতো হয়ে রয়েছে। ওই যে আমার ঘোড়ার-ছবি-দেওয়া টিফিন খাবার বাক্স। ক-বছর আগে চড়িভাতি করতে গিয়ে কাঁদের বাগানে ফেলে এসেছিলাম। যেমন ছিল ঠিক তেমনি আছে, এতটুকু মরচে পড়েনি।

 এই কি তবে পরিদের দেশ? কী ভালো এই দেশটি। আর যে ওসব জিনিস কখনো দেখতে পাব, তা ভাবিনি।

ওই তো আমার বুড়ি দিদিমারা তিনজনেই এখানে! যখন পড়তে শিখিনি, কত পরির গল্পই-না বলেছেন আমাকে। আহা, এমন মানুষদেরও ভুলে যেতে আছে? এরা যে ডানাওয়ালা পরিদের চেয়েও অনেক, অনেক ভালো! দু-হাত বাড়িয়ে সবাইকে একসঙ্গে বুকে জড়িয়ে ধরবার চেষ্টা করতে লাগলাম।

গল্প থামিয়ে মেজোদাদামশাই উঠে পড়েন, আহা, অমন দেশ ছেড়েও লোকে আবার ফিরে আসে! ওরে, ও টুনু মিনু নেগো ধেলো ইলু বিলু মন্টু, তোরা তো নিত্য সব ভুলে যাস, চল চল আমার সঙ্গে পরির দেশে চল। সেখানে যে তোদের জন্যে আলাদিনের ভাড়ার ঘর খোলা রয়েছে, যাবি তো চল।

আর দ্যাখ, আর কিছু নেবার দরকার নেই, খালি একটু টিফিন নিয়ে চল। ওখানে সবই আছে, শুধু খাবারের কোনো ব্যবস্থাই দেখলাম না, খাবার খেতে বুঝি কেউ আর ভোলে না?

তবে আমার ছোটোবেলাকার ওই আম গাছেতে আমের গুটি দেখেছিলাম, আহা, ওই টক আম কী যে মিষ্টি লাগত সে ভুলেই গিয়েছিলাম!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *