সৃষ্টির দিশা

সৃষ্টির দিশা

আমাদের একাধিক এক সহস্র সমস্যার কেন্দ্রগত সমস্যা তো এই। আমাদের যৌবন-প্রবাহ এত মন্থর যে প্রায় বন্ধ। সেইজন্যে যেটুকু আবিলতা ভরা গঙ্গাকে বৈচিত্র্য দেয় সেটুকু আবিলতা গঙ্গাজলের বোতলটাকে দূষিত করছে। অতি প্রাচীন সাহিত্যে যখন সীতা-সাবিত্রীর সঙ্গে অহল্যা-দ্রৌপদীও ঠাঁই পেয়েছিলেন সে সাহিত্যে তখন আদর্শবৈচিত্র্য কেন, আদর্শবিরোধও ছিল। সত্যিকার আর্ট সম্বন্ধে নীতি-দুর্নীতির প্রশ্নই ওঠে না, সে-সম্বন্ধে একমাত্র প্রশ্ন সে আর্ট কি না। গঙ্গানদীতে পাঁক আছে না পদ্ম আছে এ প্রশ্ন অবান্তর, আসল কথা ওটা নদী কি না। ওটা যদি distilled water-এর কাচে ঘেরা চৌবাচ্চা হয় তবে ওতে স্নান করে শুচি হওয়াও চলবে না, ওতে সাঁতার দিয়ে ওর বেগ সর্বাঙ্গে অনুভব করাও চলবে না, ওর স্বাদ নিয়ে তৃপ্ত হওয়াটাও অসম্ভব হবে। কেবল ওর চারদিকে পাহারা দিয়ে ফেরা ছাড়া অন্য কোনো চরিতার্থতা থাকবে না। বলা বাহুল্য, কোটালের চরিতার্থতা কোটালের পক্ষে যতই উপাদেয় হোক, তস্করবহুল রাজ্যেও এমন লক্ষ লক্ষ লোক আছে যারা লক্ষবিধ চরিতার্থতা চায়, তাদের ঘরে পাছে কেউ আগুন লাগায় এই ভয়ে তারা ঘরে বসে থাকবে না, বাইরে তাদের বড়ো দরকার।

যে সমুদ্রে অমৃত থাকে সেই সমুদ্রে গরলও থাকে। সেজন্যে দেবতারা একটুও চিন্তিত হয় না; তাদের মধ্যে এমন প্রাণবান পুরুষের অভাব হয় না যিনি গরলটাকে কন্ঠে ধারণ করতে প্রস্তুত। তেমন পুরুষ না থাকলে ভাবনার কারণ ঘটত সন্দেহ নেই। তখন গরলের ভয় অমৃতের আকাঙ্ক্ষাকে দাবিয়ে রাখত। নিরাপদপন্থীরা পরামর্শ দিতেন, ‘অমৃতে কাজ কী বাপু? যেমন আছ তেমনি থাকা শ্রেয়।’ কিন্তু তেমন থাকাটা যে ভয়ে ভয়ে থাকা, ভয় যে মরণেরও অধিক, ‘কিমহং তেন কুর্যাম?’

জরাগ্রস্ত অস্তিত্বের মহৎ ভয় থেকে আমাদের ত্রাণ করতে পারে একমাত্র যৌবন-ধর্ম। সে ধর্ম যদি স্বল্পমাত্রও হয় তবু সে অমৃত, সে অজর করে। তার আস্বাদ যদি পাই তো ঔষধ-পথ্য মুখে রুচবে না, মাদুলি কবচ ছুড়ে ফেলে দেব, ডাক্তার কবিরাজকে দূর থেকে নমস্কার জানাব। ভিতর থেকে আমরা এত আনন্দ পাব যে সেই আনন্দে আমাদের ব্যাধি তো যাবে সেরে, আমরা আনন্দ বিচ্ছুরিত করব, জগৎকে আনন্দময় করব। আমরা কৃপণের মতো আপনাতে নিবদ্ধ থাকব না, আমরা বিশ্বসংসারের সঙ্গে যোগ দিয়ে সকলের ভার ভাগ করে নেব। কঠোরতম তপস্যাকেই তো আমরা ভালোবাসি, সহজকে আমাদের একটুও ভালো লাগে না, সমস্ত জীবনটাই যদি একটা অসাধ্যসাধন না হয় তবে জীবনকে আমাদের কীসের দরকার? সুলভ সিদ্ধিকে ধিক থাক, দুর্লভ সিদ্ধিকেও আমরা চাইনে, সুসাধ্য নয় দুঃসাধ্য নয় অসাধ্যেরই উপরে আমাদের লোভ, সিদ্ধিমাত্রেই আমাদের অলভ্য। যে পথের শেষ আছে সে-পথ আমাদের নয়, আমরা তো লক্ষ্য মানিনে, আমরা মানি অক্লান্ত চলার আনন্দ। আমরা যুবা, যতক্ষণ আমরা দুঃখের আগুন নিয়ে খেলা করি ততক্ষণ আমরা সুখে থাকি, আরাম আমাদের উষ্ণ রক্তকে শীতল করে দেয়। যতক্ষণ জ্যোতি ততক্ষণ জ্যোতিষ্ক, জ্বালা নিবে গেলে গ্রহ। তখন তার মাথায় দেখা দেয় পাকাচুলের মতো সাদা বরফ, সে-বরফ তার একার নয়, সমগ্র সৌরজগতের আতঙ্ক। সে তো আভান্বিত করে না, কম্পান্বিত করে; নিজে তো জরেই, সকলকে জরায়।

নিজেদের যৌবনের ওপরে যদি অটল বিশ্বাস রাখি তো যৌবনই আমাদের পথ দেখাবে, সে আমাদের যে পথে নিয়ে যাবে সেই আমাদের পথ, ‘স এব পন্থাঃ’। আমাদের পথ আমাদের চলবার আগে তৈরি হয়ে রয়নি যে পথনির্মাতার সাহায্য না নিলে পথ হারাব, যা তৈরি হয়ে রয়েছে তা পূর্বপুরুষের পথ, সে-পথ হারানোটাই ভাগ্য। সত্যের কোনো বাঁধা পথ নেই, যে পথ আমরা চলতে চলতে বাঁধি সেই আমাদের সত্যের পথ, পূর্বযাত্রীদের পথের সঙ্গে তার কোথাও যোগ কোথাও বিয়োগ; যোগ দুজন স্বনিষ্ঠ পুরুষের হাত ধরাধরি, বিয়োগ দুজন স্বনিষ্ঠ পুরুষের হাত ছাড়াছাড়ি। পূর্বপুরুষ উত্তরপুরুষকে দেয় আপন সত্যের স্মৃতি, উত্তরপুরুষ পূর্বপুরুষকে দেয় আপন সত্যের আভাস, কিন্তু সত্যকে কেউ কারুকে দিতে পারে না, সত্যকে আপনি উপলব্ধি করতে হয়। Self-education ছাড়া education নেই, education-এর নামে যা চলছে তা আমাদের ভাবতে দেওয়া নয়, আমাদের জন্যে ভেবে রাখা, আমাদের চলতে দেওয়া নয়, আমাদের চালানো। তার দ্বারা আমাদের উপকার হতে পারে, স্বপ্রকাশ হয় না। ইউরোপের আধুনিকতম স্কুলেরও উদ্দেশ্য শিশুকে গড়ে তোলা, মানুষ করা, তাকে একটা বিশেষ প্রভাবের মধ্যে বাড়তে দেওয়া। কিন্তু প্রতিভা যে আগুনের মতো, উৎকৃষ্টতম স্কুলও তার পক্ষে কাচের ঝাড়ের মতো কৃত্রিম, সে যখন দিব্য তেজে জ্বলে তখন কাচকে ফাটিয়ে খানখান করে। যে মানুষ হয় সে আপনি মানুষ হয়, সে নিজেই নিজেকে গড়ে, সে সব প্রভাব অতিক্রম করে। যাকে মানুষ করা হয়, গড়ে তোলা হয়, স্পষ্ট প্রভাবিত করা হয় সে একটি পোষা বাঘের মতো স্বভাবভ্রষ্ট, সে একটি breeding farm-এর ফসল, তাকে দিয়ে সমাজের শান্তিরক্ষা হয় কিন্তু সৃষ্টিরক্ষা হয় না, সৃষ্টি যে কেবলই আঘাত খেয়ে কেবলই চেতনালাভ, কেবলই অপ্রত্যাশিতের সাক্ষাৎ, কেবলই প্রত্যাশিতের গাফিলি। যারা বলে ভাবী বংশধরদের আমরা উন্নত করব তাদের শুভাকাঙ্ক্ষার তারিফ করতে হয়, কিন্তু তাদের সত্যিকার কর্তব্য নিজেদেরই উন্নত করা। ভাবী বংশধরেরা নিজেদের ভার নিজেরা নিতে পারবে এটুকু শ্রদ্ধা তাদের উপরে থাক। সত্যকে পথের শেষে পাবার নয় যে বয়েসের যারা শেষ অবধি গেছে তারাই পেয়েছে। পথের শেষ নেই, বয়সের শেষ নেই, সত্যকে পদে পদে পাবার, দিনে দিনে পাবার। শিশুর কাছে শিশুর অভিজ্ঞতাই সত্য, যতদিন-না সে বৃদ্ধ হয়েছে ততদিন তার পক্ষে বৃদ্ধের অভিজ্ঞতা হচ্ছে অকালবৃদ্ধতা।

কিন্তু শিশু যখন নিজের পায়ে চলতে গিয়ে পড়ে তখন সেই পতন কি তার পক্ষে ভয়াবহ নয়? নিশ্চয়। কিন্তু ততোধিক ভয়াবহ হিতৈষীর কাঁধ। নিধনে আর কিছু না বাঁচুক স্বধর্ম তো বাঁচে। ভ্রান্তি থেকে আর কিছু না পাওয়া যাক সত্যকে তো পাওয়া যায়। মানুষের ছ-টা রিপু ছাড়া আর একটা রিপু আছে, সপ্তম রিপু, সে-রিপুর নাম ভয়। আশ্চর্য এই যে, ছয় রিপুর বিরুদ্ধে আমাদের দেশে অনুশাসনের অন্ত নেই, কোন আদিকাল থেকে আমরা এদেরই সঙ্গে বজ্র আঁটুনি এঁটে আসছি, অথচ এদের প্রত্যেকের মধ্যে প্রচ্ছন্ন ও সকলকে জড়িয়ে বিরাট যে ভয়রিপু তাকে আমরা ধর্তব্যের মধ্যে আনিনি।

আমরা ভীরু নই, আমরা প্রেমিক, আমাদের যৌবনধর্ম আমাদের অন্তরের ধন, আমাদের প্রাণের চেয়ে প্রিয়। মুক্তি যদি ভয়ের থেকে মুক্তি না হয় তবে মুক্তি আমরা চাইনে, আমাদের একমাত্র মুক্তি জন্ম থেকে মুক্তি নয়, মৃত্যু থেকে মুক্তি নয়, ভয় থেকে মুক্তি—জরা থেকে মুক্তি। কামক্রোধাদি রিপু এর তুলনায় নগণ্য; ভয়কে যদি জয় করতে পারি তো তাদের পায়ে দলতে পারব। ভয়ই তো শয়তান, স্রষ্টার শত্রু, সৃষ্টির পতনকামী, পাপের মন্ত্রদাতা। আমরা যৌবনের প্রতি একনিষ্ঠ থেকে ভয়ঞ্জয় হব, আমরা দিগন্তগ্রাসী তামসিকতার মাঝখানে আলোকনিষ্ঠ প্রদীপের মতো জ্বলব। অপরিমেয় শূন্যের মাঝখানে সূর্য যেমন যুগযুগান্তকাল জ্যোতি বিকিরণ করছে, সে জ্যোতি কত সামান্য দূর পৌঁছোয় মনেও আনছে না, চির সমস্যাময় দেশে আমরাও তেমনি চিরজীবনকাল আভা বিকিরণ করব, সে আভায় কোন সমস্যা কতটুকু ঘুচল হিসাব করব না। সমস্যা প্রতি দেশে ও প্রতি যুগে আছে এবং সমস্যা সর্বত্র ও সর্বক্ষণ এক সহস্র এক। সুদূরতম ভবিষ্যতেও এর অন্যথা হবার নয়। লক্ষ বর্ষ পরেও এ পৃথিবী (যদি থাকে তো) এমনই সমস্যাময় থাকবে, সেকালের মানুষের সেকেলে মন একে এমনই অমনোমতো ভাববে, সেকালের আদর্শবাদীদের কাছে এর অপূর্ণতা এমনই অসহনীয় বোধ হবে। সমস্যা দূর করবার জন্যে মানুষ নয়, সমস্যাকে ছাড়িয়ে ওঠবার জন্যেই মানুষ। সমস্যা সত্ত্বেও কী করে উঠতে পারি, কী হয়ে উঠতে পারি এই আমাদের ভাবনা। সমুদ্রকে সেচে ফেলার চেষ্টা বৃথা, সমুদ্রের উপরে ভেসে চলতে পারি কি না দেখতে হবে।

সমস্যা আছে বলেই ভাবিনে। ভাবি সমস্যার দ্বারা যাতে অভিভূত না হই। দুঃখ আছে বলে দুঃখ নেই। দুঃখ, পাছে শেষ পর্যন্ত খাড়া না রই। বাইরের প্রতিকূলতাকে ভয় করিনে, ভয় করি আপন অন্তরের ভীরুতাকে। ভূতের ভয়ে মানুষ ভগবানকে ভক্তি করে, আপনার ভয়ে আমরা আপনাকেই ভক্তি করব। আত্ম-অবিশ্বাস মানে আত্মঘাত। যৌবনের পদে পদে বিপদ, সারাটা পথ অনিশ্চিত। প্রতিদিন পরীক্ষা, চিরকাল হতাশা। অপরিসীম কষ্টস্বীকার, অপরিসীম ধৈর্যধারণ, অপরিসীম উৎসাহরক্ষা। অবিশ্রাম গতিবেগ, অবিরাম পরিবর্তন, অনাসক্ত ত্যাগভোগ। যৌবন যে সৃষ্টিকাল, সৃষ্টি যে চির প্রসববেদনা, সেই বেদনায় যাকে টানল তার কেন শান্তি-স্বস্তির প্রত্যাশা? সেই বেদনাই তার সৌভাগ্য।

তারজন্যে দুঃখের শেষে সুখ নেই, কেননা দুঃখের শেষ নেই। মর্তের শেষে স্বর্গ নেই, কেননা মর্তের শেষ নেই। তপস্যার শেষে বর নেই, কেন না তপস্যার শেষ নেই। চলতে চলতে যখন যা আসে তা-ই তার সুখ, কাঁটায় কাদায় ধুলোয় ভরা চলার পথই তাঁর স্বর্গ আর চলতে পারাটাই তার বর। যৌবনকে যে অন্তরে ধারণ করলে সে-ই তো ব্রহ্মচারী, তার ব্রহ্ম যৌবনময় ব্রহ্ম। তার সন্ন্যাস বড়ো কঠিন সন্ন্যাস, কেননা মোক্ষ তার নেই। যে বেদনায় সূর্য তারাকে অবিশ্রান্ত ঘোরাচ্ছে, সেই বেদনা তাকে অবিশ্রান্ত পথে চলায়, জীবন থেকে জীবনে নিয়ে চলে, অস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে। নির্বাণ? জ্যোতির্লোকের কি নির্বাণ আছে? নিজেকে নির্বাপিত করে সে-লোক থেকে যে দূরে সরে গেল সেই বিগতজ্যোতি চন্দ্রকেও ঘুরে মরতে হচ্ছে। সেই নির্বাণ কি কারুর কাম্য? মুক্তি? যতদিন না জগতের কণামাত্র বস্তু সৃষ্টিচক্র থেকে মুক্তি পায় ততদিন মহামানবেরও মুক্তি নেই, যে বাঁধনে পরমাণুকে বেঁধেছে সেই বাঁধনে তিনিও বদ্ধ। শেষ দিন কোনোদিন আসবার নয়, সৃষ্টির শেষ নেই। নিজেরও শেষ খুঁজে পাবার নয়, শেষ পেয়েছি ভাবলেও পাওয়াটা সত্য নয়, ভাবনাটাই মিথ্যা। আত্মঘাতী যখন জীবনকে শেষ করেছি ভাবে তখনও সে বেঁচে। মরণ কেবল এক জীবন থেকে মুক্তি, আরেক জীবনে বাঁধাপড়া। বিশ্বসংসার থেকে পালাবার পথ যখন নেই তখন মানবসংসার থেকে পালাবার প্রয়াস কেন? এ সংসারে যদি আনন্দ না থাকে তো কোন সংসারেই-বা আছে?

নির্বাণের তপস্যা আত্মহত্যার তপস্যা, মুক্তির তপস্যা পলায়নের। আমাদের তপস্যা সৃষ্টির তপস্যা, আমরা বিশ্বস্রষ্টার সহস্রষ্টা, তাঁর সঙ্গে আমাদের সাদৃশ্য সাহচর্য। আমাদের পদে পদে মোহভঙ্গ, তবু আমরা চিরপদাতিক। আমাদের চোখে নিদ্রা থাকবে না, তবু আমরা খোলা চোখের স্বপ্ন দেখব। আমাদের বাহু নেতিয়ে পড়বে, তবু আমরা আনন্দলোক সৃষ্টি করতে থাকব। ভারতবর্ষের তরুণ তাপসের কত দায়িত্ব। যে সৃষ্টি তার জন্যে অপেক্ষা করছে সে কি সামান্য সৃষ্টি! সে কী এত তুচ্ছ যে একটু-আধটু জোড়াতালির সাপেক্ষ! দু-দশটা সংস্কার বিপ্লবের ব্যাপার! কঠিনতম বলেই তো তার দ্বারা পৌরুষের আত্মপরীক্ষা, প্রতিভার নব নবোন্মেষ, প্রেমের দেশব্যাপী প্লাবন। লক্ষ বর্ষ পরেও সাধের ভারতবর্ষ সৃষ্টি হতে থাকবে, সৃষ্ট হয়ে উঠবে না, উত্তরোত্তর পুরুষের পৌরুষকে প্রতিভাকে প্রেমকে এমনই সৃষ্টিতৎপর রাখবে, ছুটি দিয়ে বন্ধ্যা করবে না। আমাদের কয়েক সহস্র বর্ষের ইতিহাস তো ইতিহাসের ভূমিকা, এখনও আমাদের সকল হওয়াই বাকি, আমাদের হয়ে-ওঠা অনন্তকাল চলবে। ভারতবর্ষের তরুণ তাপসকে প্রতিমুহূর্ত সতর্ক থাকতে হবে, পাছে কখন মার এসে বলে, ‘আমি ভানুমতীর ম্যাজিক জানি, চোখের সামনে ফল ফলিয়ে দেব, আমাদের scheme সদ্যফলপ্রদ।’ যা-কিছু তপস্যাকে সরল সংক্ষিপ্ত করে দেয় তাই তপস্বীর প্রলোভন। তপস্যার অন্তক তপস্বীরও অন্তক। সফলতা যার কাম্য নয় তাকে ফলের লোভ যে দেখায় সে-ই তো কাম, তাকে ভস্ম করতে হবে। ফল আপন সময়ে আপনি আসে, তার জন্যে উদগ্রীব আগ্রহে ফুল-ফোটানো ফেলে রাখব না, ফুলের ঋতুতে ফুটে উঠে ফলের ঋতুতে ফলব। একটি ঋতুকে বাদ দিলে কোনোটিরই স্বাদ পাইনে। দশ মাস গর্ভে না ধরে যাকে পাওয়া যায় তাকে পাওয়ার চেয়ে মৃতবৎসা হওয়া বরং আনন্দের। জীবনের কোনো অনুভূতিকেই পরবর্তী অনুভূতির খাতিরে লাফ দিয়ে অতিক্রম করা চলে না, পরিপূর্ণ দাম্পত্যের পরে পরিপূর্ণ বাৎসল্য।

সংস্কার ও বিপ্লব বাইরের জিনিস, সুস্থ সমাজে ও দুটো আপনা-আপনি হতে থাকে, সুস্থ দেহে যেমন ত্বক বদলায়। ওদের চেয়ে বড়োকথা সমাজের স্বাস্থ্যবিধান, রক্তের জোর অটুট রাখা, হৃৎপিন্ডের ক্রিয়া অবিকল রাখা। এরজন্যে চাই অন্তরের উদ্বোধন, অন্তরের দিক থেকে বাইরে সৃজন। এ ক্রিয়া যখন পূর্ণ তেজে চলে তখন ভাত কাপড়ের ভার নিতে একটুও বাজে না, বরং সে-ভার বইবার আনন্দ হয় স্বতঃস্ফূর্ত। অন্তর যখন প্রাণোচ্ছল হয় তখন দেহধারণের অসীম আনন্দ মানুষকে জরা-ব্যাধি-মৃত্যুর সীমা ভুলিয়ে দেয়, মানুষ কঠিন কিছু করতে পেলে বেঁচে যায়, সাধ্যসাধনা তাকে পীড়িত করে, হাতে হাতে ফললাভ তার পক্ষে demoralisation—চরিত্রভ্রংশ। সেইজন্যে তরুণ ভারতকে নিতে হবে অন্তরের দিক থেকে সৃষ্টি করবার ব্রত। বাইরের দিক থেকে বদলে যাওয়া তা হলে আপনা-আপনি হতে থাকবে, দম দিলে ঘড়ির কাঁটা আপনা-আপনি চলে, সারাক্ষণ হাতে ধরে চালিয়ে দিতে হয় না। আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকারি অন্তরের মধ্যে যৌবনকে অনুভব করা। দেহ-মনের স্তর ভেদ করে আত্মা থেকে যৌবনরস উৎসারিত করতে হবে, যেমন মাটি-পাথরের স্তর ভেদ করে artesian well থেকে জল উদ্ধার করা হয়। এই খননকার্যে শ্রান্তি নেই, ক্ষান্তি নেই, শেষ নেই। সেইজন্যে এই কার্যই তরুণ ভারতের আত্মসম্মানের উপযুক্ত। এরচেয়ে সহজ কাজ তার পক্ষে অপমানকর। সে তো ফাঁকি দিতে চায় না, সে কাজই দিতে চায়। কিন্তু সে-কাজ যদি কঠিনতম না হয় তবে তার পৌরুষ লজ্জা পায়, তার অন্তর সায় দেয় না, সে বেগার খাটতে খুঁতখুঁত করে ও প্রেরণার অভাবে বেকার বসে রয়। স্বতঃস্ফূর্তির কাজ তো কেবল কাজ নয়, সে খেলা। খেলার আনন্দ যখন কাজের আনন্দের সঙ্গে মিতালি পাতায় তখন বেদনার থেকে ভার চলে যায়, দুঃখের থেকে হুল চলে যায়, কাজও হয় অকাজের বহুগুণ। তখন একে একে দেশের সবই হয় এবং যা সকলের কল্পনারও অতীত তাও কেমন করে হয়ে উঠে আশ্চর্য করে দেয়।

ঘর ছেড়ে যদি বাহির হই তো আমরা সুলভ অভিসারে বাহির হব না, আমরা তারই অভিসারে বাহির হব যাকে সর্বস্ব দিয়েও কেউ কোনোদিন পায়নি ও পাবে না, আমরা চাই পূর্ণ পূর্ণতম অমৃতঘন চির কৈশোরকে। Rolland-এর এই মন্ত্রটি যেন আমাদের মন্ত্রণা দেয়—‘Always to seek, always to strlve, NEVER to find, never to yield’.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *