৯
আজকাল নৃসিংহ দেব যেন কোনো এক অজ্ঞাত দুঃখে মনমরা হয়ে থাকেন। কেউ জানে না এই মনোব্যথার কারণ কী। বিশাল দুর্গের প্রাচীর ভেদ করে দুঃখ কীভাবে প্রবেশ করল সেই সংবাদ কারো জানা নেই।
বারাবাটি দুর্গের উত্তরে মহানদী তথা বিরূপার মাঝে চৌবেদারের অভেদ্য দুর্গ, পশ্চিমে মহানদী এবং কাঠজোড়ির প্রাকৃতিক সুরক্ষা এবং বিডানাসির দুর্গ, দক্ষিণে কাঠজোড়ির অপর পারে সারঙ্গগড়ের অত্যুচ্চ দুর্গ, স্বয়ং বারাবাটি দুর্গের বহির্ভাগে বৃহৎ পরিখা আর পাথর দিয়ে তৈরি অভেদ্য উঁচু প্রাচীর, বাহ্য প্রাচীরের ভিতরেও আরেকটি সুরক্ষা-ভিত্তি। দুর্গের দ্বারে ঢাল-তরবারি, ভল্ল নিয়ে সতর্ক পাইকের দল সুরক্ষায় নিযুক্ত রয়েছে অষ্টপ্রহর। অন্ধকারে সামান্য আলো পড়লেই ঝিকিয়ে উঠছে তাদের হাতের খোলা তলোয়ার। ঢালের উপরে থাকা কালো লৌহ-কীলক কালো মেঘের মতোই রাত্রির আঁধারকে আরও গহন করে তুলছে। দুর্গের বাসিন্দারা তাই নিশ্চিন্ত।
তবে এত পাইক, এত সুরক্ষার আয়োজন, তবুও বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছেন নৃসিংহ দেব। মহারানির চোখেও ঘুম নেই। কত বছর ধরে চলবে এই তপস্যা, এই ব্রহ্মচর্য? কোণার্ককে উৎসর্গ করা রাজার এই দেহের সঙ্গে কি তাঁর মনটাও পাথরে পরিণত হয়েছে? ভগবান আদিত্যের কৃপায় পুত্র ভানুদেব নিজের পিতার অবিকল প্রতিকৃতি হয়ে উঠছে। সে পিতার বৈভবের যোগ্য উত্তরাধিকারী হতে চলেছে। ধীরে ধীরে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে কোণার্ক-মন্দির। দক্ষিণ-পশ্চিমে গুলবর্গা ও বিদর নৃসিংহ দেবের আয়ত্তে এসে গিয়েছে। তাহলে? এখনও মহারাজ এমন বিচলিত কেন? গঙ্গ-বংশের স্বর্ণযুগ চলছে, তবুও কীসের চিন্তায় মগ্ন মহারাজ?
কোণার্কের নির্মাণকাজে বিরাম নেই। বৈশাখের বেলা-দ্বিপ্রহর। সূর্যের তেজ দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনো খ্যাপা ষাঁড় রুদ্র হুঙ্কার দিয়ে চলেছে। সুবল মহারানা এইমাত্র নাট্যশালার দক্ষিণ পাশে এক প্রতীক্ষারত যুবতীর মূর্তি স্থাপন করেছে। এখন শেষ পর্বের কাজ চলছে। একাগ্র চিত্তে, ব্যস্ত ভাবে মূর্তির গায়ে ছেনির আলতো ঘায়ে পাথর কাটছে তার হাত। প্রখর রোদের তাপে সুবলের বলিষ্ঠ শরীর থেকে কোণার্কের অভ্যর্থনায় ঝরে পড়ছে মুক্তোর মতো ঘামের বিন্দু।
নৃসিংহ দেব আজ নৃত্যগুরু সৌম্য শ্রীদত্তের সঙ্গে মন্দির প্রাঙ্গণ নিরীক্ষণে বেরিয়েছেন। নির্মাণকাজ দেখতে দেখতে তাঁরা দুজনেই সুবলের পাশে এসে দাঁড়ালেন। এই প্রখর রৌদ্রতাপে সুবল একাগ্রচিত্তে কাজ করে চলেছে দেখে মহারাজ নিজের সেবককে চোখের ইঙ্গিতে কিছু নির্দেশ দিলেন। সে সঙ্গে সঙ্গেই মহারাজের মাথার উপরে মেলে ধরে থাকা ছাতা সুবলের মাথার উপরে মেলে ধরল।
অবশ্য এসবে সুবলের হুঁশ নেই। এক মনে সে একজন প্রতীক্ষারত নারীর শিলাবয়বকে শিল্পের পূর্ণতা দিতে ব্যস্ত। অর্ধউন্মুক্ত দ্বারের চৌকাঠে নিজের হাত রেখে প্রতীক্ষারত এক নারীর মনমোহিনী মূর্তি। অবগুণ্ঠন মাথা থেকে সামান্য সরে গিয়েছে। পানপাতার মতো ত্রিকোণ মুখ। চিবুক অবধি ঘোমটায় ঢাকা। আধখোলা দরজার মুখে নিজের প্রিয়তমের জন্য আকুল প্রতীক্ষার একটি সজীব চিত্রণ।
পাথরের মন নিয়ে শিল্পী নিজের পরিণীতাকেও পাথরের মূর্তি বানিয়ে দিয়েছে। পাষাণ মূর্তির অধরে যেন স্পন্দন জেগে উঠল। সুবল স্পর্শ করে দেখল সেই কোমল অধর। ‘বিনোদিনী, এত দূর থেকে কি তুমি আমার স্পর্শ অনুভব করতে পারছ? আমার মনে হয় পারছ। কারণ এই একই ভাবে তোমার প্রতীক্ষার দীর্ঘশ্বাস প্রতিদিন, প্রতি প্রহরে বয়ে নিয়ে আসে চন্দ্রভাগার বাতাস। তা আমাকে ছুঁয়ে যায়। আমি জানি, আমার জন্য তুমি অনন্তকাল ধরে প্রতীক্ষা করে যেতে পারো। আর তাই আমি তোমার প্রতীক্ষার ছবি এঁকে দিলাম কোণার্কের বুকে। বিশ্ববাসী কখনো–না–কখনো এই মূর্তির মাধ্যমে ঠিক তোমাকে চিনে নেবে। সুখী হও। প্রতীক্ষার দিন একটা–একটা করে কমে আসছে। আমাদের দেখা হবেই।’
নৃসিংহ দেব বেশ কিছুক্ষণ ধরে মূর্তিটিকে দেখার পর স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। এ কার মূর্তি? কার অপেক্ষার ছবি তুলে ধরেছে সুবল মহারানা? তিনি ভাবতে লাগলেন, ‘রাজা নাকি শিল্পী, কে বড়? রাজা একমাত্র তখনই রাজা, যখন তাঁর কাছে সিংহাসন থাকবে। আর শিল্পী নিজের ভাবনার সাম্রাজ্যের সার্বভৌম সম্রাট। শিল্পীর সামনে সমগ্র জগৎ মাথা নত করতে বাধ্য।’
মূর্তিতে শিল্পের অন্তিম স্পর্শ দিয়ে সুবল সোজা হয়ে দাঁড়াল। এবার সে খেয়াল করল তার মাথার উপরে রাজছত্র ধরা আছে। অভিভূত হয়ে সে বলে উঠল, ‘অপরাধ ক্ষমা করবেন মহারাজ! আমি আপনার উপস্থিতির কথা বুঝতেই পারিনি। আর এ কী! এই তুচ্ছ সেবকের মাথার উপরে রাজছত্র ধরার আদেশ কেন দিয়েছেন, প্রভু?’
‘শিল্পী, মহাপ্রভু জগন্নাথের ছায়ায় সকলেই তাঁর সেবক। কেউ ছোট, কেউ বড়।’
‘মহারাজ, আপনার ঔদার্যের কোনো তুলনা হয় না।’
‘আচ্ছা শিল্পী, এই প্রতীক্ষারত মূর্তির নারী চরিত্রটিকে কিছু প্রশ্ন করতে পারি?’
‘প্রশ্ন নয়, আদেশ করুন মহারাজ। কোনো ত্রুটি?’
‘কলিঙ্গের কোনো শিল্পীর শিল্পকর্মে ত্রুটি খুঁজে বের করার ক্ষমতা এই বিশ্বে কারো নেই। আজ উৎকলের শিল্পীদের হাতের কাজ স্বর্ণদ্বীপ, জাভা, সুমাত্রা, বালি, মলয়দ্বীপ এবং সিংহল দেশে পূজিত হচ্ছে। ত্রুটি মনে হলে তা আমার দৃষ্টির বিভ্রম হলেও হতে পারে, কিন্তু শিল্পীর শিল্পে ত্রুটি থাকতে পারে না। শুধু কিছু জানার আগ্রহ ছিল। কে এই প্রতীক্ষারত নারী? কারো চরিত্রকে মাথায় রেখেই কি কাজ এগিয়েছ? নাকি এ কেবল শিল্পীর কল্পনা?’
‘মহারাজ, এর কিছুটা সত্য, বাকিটা কল্পনা।’
‘তাহলে বলো, এই শিল্পের সত্য অংশটুকু কতখানি?’
‘এই অধমের স্ত্রী। তার নাম বিনোদিনী।’
কেন কে জানে, নৃসিংহ দেবের মন ছুটে ফিরে গেল সেই নির্জন বনপ্রান্তের ভগ্ন মন্দিরের আশেপাশে, ‘সে-ও তো কারো ঘরণী ছিল? যখন তার স্বামী ঘরে ফিরে গিয়ে তাকে আর দেখতে পাবে না, তখন কি সে অভিশাপ দেবে? তার হারিয়ে যাওয়া স্ত্রীকে? আমাকে? এই কোণার্ককে?’ স্মৃতির জুঁই বাগিচায় একটি ফুল গন্ধমান হয়ে উঠল। রাজার চিন্তার জাল ছিন্ন হল। নিজের মনকে মিথ্যা আশ্বাস জোগানোর জন্য খুব অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করে বসলেন তিনি, ‘শিল্পী, এই ধরনের প্রতীক্ষায় কি তুমি বিশ্বাস করো?’
‘এই বিশ্বাসই প্রত্যেক কোণার্ক-শিল্পীর মনের নিধি, প্রাণের সুধা। এই আস্থাই আমাদের শক্তি। যদি এই বিশ্বাস ভঙ্গ হয়, তাহলে শিল্পীও ভেঙে পড়বে।’ বলতে বলতে সুবল মাথা নীচু করে নিল। চোখে আসা জল আলতো হাতে মুছে সে বলল, ‘ক্ষমা করবেন মহারাজ, দিনরাত পাথরের কাজ করে চলেছি। চারদিকে পাষাণরেণু-ধূলিকণা উড়ছে। চোখে এসে পড়েছিল।’
‘তোমার এই বিশ্বাস অটল থাক শিল্পী। তবেই তুমি বা তোমরা সকলে মিলে কোণার্কের কপালে মাহাত্ম্যের, তপস্যার এবং ত্যাগের কথা উৎকীর্ণ করতে পারবে।’
কথা শেষ করে নৃসিংহ দেব অন্যান্য শিল্পীদের কাজ নিরীক্ষণের উদ্দেশে এগিয়ে চললেন।
সুবল মহারানা নাট্যমন্দিরের দক্ষিণ পার্শ্বে একটি অপূর্ব দৃশ্য চিত্রিত করেছে। স্নানরতা এক নারীর মূর্তি। লম্বা বেণী সুপক্ক জোড়া বেলফলের মতো বুকের উপত্যকা বেয়ে সর্পিল ছন্দে জলধারার মতো একদিক থেকে অন্যদিকে নেমে গিয়েছে। জলসিক্ত বেণী থেকে ঝরে পড়ছে জলের কণা, আর একটি তৃষ্ণার্ত মরাল নিজের চঞ্চু বাড়িয়ে দিয়ে বেণী থেকে ঝরে পড়া জল পান করছে। অপূর্ব কল্পনা! শিল্পী চায়নি রূপসীর বেণী থেকে ঝরে পড়া দেহগন্ধ সুবাসিত জলের বিন্দুগুলি মাটিতে পড়ুক। সুন্দরীর কোমল চরণে যাতে মাটি না-লাগে, তার জন্য শিল্পী তার পায়ে তুলে দিয়েছে কাষ্ঠপাদুকা। এসবই পাষাণে তক্ষণ করা। কিন্তু কে এই নারী? প্রতীক্ষারত নারীর মূর্তি এবং স্নানরত নারীর এই মূর্তির মধ্যে অন্তর আছে। এ কোনো যুবতী নয়, কোনো কিশোরী কন্যার বিলাসপূর্ণ স্নান।
নৃসিংহ দেব এবং সৌম্য শ্রীদত্ত দুজনেই সশরীর প্রশ্ন হয়ে মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। মূর্তি দেখে সৌম্য শ্রীদত্ত চমকে উঠেছেন, ‘কে এই কিশোরী কন্যা, যাকে শিল্পী নিজের ছেনির স্পর্শে পাষাণের বুকে এঁকেছে? সে প্রতিরূপ হয়ে এই অবস্থায় শিল্পীর সামনে দাঁড়ালই বা কীভাবে? এ কোনো দেবদাসীর মুখ নয়। কারণ এখানে তো এত অল্পবয়েসি কোনো দেবদাসীই নেই। এর আকার-প্রকার, মুখ, নাক, চোখ সবকিছু আমার শিল্পার সঙ্গে বড় মিলে যাচ্ছে। তাহলে কি শিল্পাই সুবল মহারানার সামনে প্রতিরূপ হয়ে দাঁড়ায়? আর সেই কারণেই কি সুবল অন্য কোনো দেবদাসীকে প্রতিরূপ হিসেবে নিতে চায় না? কিন্তু শিল্পাই বা প্রতিরূপ হবে কী করে? কবেই বা প্রতিরূপ সেজে সে সুবলের সামনে এসে দাঁড়াল? কবে? কীভাবে?’
নৃসিংহ দেব এগিয়ে গেলেন। তাঁকে অনুসরণ করলেন সৌম্য শ্রীদত্ত। কিন্তু এ কী? যত এগোচ্ছেন, ততই চোখে পড়ছে ভিন্ন-ভিন্ন মুদ্রা-ভঙ্গিমার মূর্তি, আর প্রতিটা মূর্তির মুখ অবিকল শিল্পার মুখেরই মতো। শিল্পাই ভিন্ন রূপে, ভিন্ন ছন্দে সর্বত্র দাঁড়িয়ে রয়েছে। শিল্পী কি তবে নিজের কল্পনায় শিল্পাকে দেখে মূর্তির মুখের আদলকে শিল্পার মুখের ছাঁচে ঢেলে দিয়েছে? তা-ই হয়েছে, মনে মনে আশ্বস্ত হলেন শ্রীদত্ত।
সৌম্য শ্রীদত্তের মুখ থেকে অস্ফুটে উচ্চারিত হল কয়েকটি বাক্য, ‘অদ্ভুত! সুবল মহারানা, তোমার কল্পনা অদ্ভুত! শিল্পী তুমি যশস্বী হও! তোমার শিল্প যশস্বী হোক! কোণার্ক যশস্বী হোক!’ তিনি মুখে এই কথাগুলো উচ্চারণ করলেন বটে, কিন্তু মনের কোনো একটা কোণ থেকে ধোঁয়া উঠতে লাগল, ‘এতগুলো মূর্তির একই মুখ? বিনা প্রতিরূপে এই কাজ করা কি সম্ভব? তবে কি শিল্পাই প্রতিরূপ হিসেবে সুবলের কাছে দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থেকেছে!’ আবার পরক্ষণেই আচার্যের মন বলে উঠল, ‘না, না! এ যে অসম্ভব!’
নৃসিংহ দেব এবার অন্য একটি মূর্তির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। এই শিল্পকর্মটি একটু বিচিত্র। মহারাজ প্রশ্ন করলেন, ‘এ কেমন কল্পনা, নৃত্যগুরু?’
‘এই মূর্তি শিল্পীর অদ্ভুত কল্পনা আর শিল্পগৌরবের প্রতিভূ, মহারাজ। একজন দক্ষ শিল্পী নিজের কল্পনার মাধ্যমে দূর কোনো স্থানে থেকেও নিজের স্ত্রীর মনের কথা পড়ে ফেলতে পারে। বিরহিণী সেই নারীর মনে মাতৃত্বের বাসনা জাগবেই, কিন্তু উপায় নেই। দাম্পত্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। কাজের সূত্রে স্বামী ভিনদেশে। সন্তানাদি নেই। তাই বাড়িতে, খাঁচায় পোষা শুকপাখিটাকেই সন্তানের মতো পালন করেছে সেই নারী। তাকেই স্তন্যপান করায়। এই ছবি অপূর্ণ এবং অপূর্ব সুন্দর মাতৃত্বের ইচ্ছা পূরণের। এর মাধ্যমে সুবল মহারানা নিজের কল্পনাশীলতা এবং কলাবৈভবের চরম উৎকর্ষ স্থাপন করেছে। দেখুন মহারাজ, ওই দেখুন, শিল্পী কিন্তু শুধু নিজের প্রিয়তমার ধ্যানেই মগ্ন হয়ে থাকেনি, ব্যবসা-বাণিজ্যের, শিকারের, যুদ্ধের, নাগরিক জীবনের বহু চিত্র এঁকে গিয়েছে পাথরের বুকে। পাষাণের পৃষ্ঠায় অঙ্কিত হতে থাকা কোণার্ক যেন সমগ্র উৎকলের দৈনন্দিনী হয়ে উঠেছে।’
আরেকটু এগোতেই নৃসিংহ দেবের চোখে পড়ল, একটি দৃশ্যে একজন ব্যক্তি অপর এক ব্যক্তির কেশ সমূলে কেটে দিচ্ছে। মহারাজ আর নিজের কৌতূহল চাপতে না-পেরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচার্য, এই দৃশ্যটা? এটা কীসের?’
‘এই দৃশ্য আসলে উৎকলের বর্তমান এবং তার ভবিষ্যতের প্রতি প্রকাশিত আশঙ্কার চিত্র, মহারাজ। এখন উৎকলের যুবকেরা শিল্পের জন্য, বাণিজ্যের জন্য, যুদ্ধের জন্য নিজেদের ঘরবাড়ি ত্যাগ করে বিভূমে কাজ করে চলেছে। প্রত্যেকের ঘরে রয়ে গিয়েছে একাকী, বিরহিণী যুবতী বধূ। এমন অবস্থার সুযোগ নিয়ে যদি কোনো পাপী তাদের কারো প্রিয়তমার শীলহরণ করে, অপবিত্র করে? বিদেশ থেকে ঘরে ফিরে স্বামী নিজের স্ত্রীর সঙ্গে হওয়া অপরাধের দণ্ড সেই পাপীকে দিচ্ছে। এখানে সেই গল্পই বলা আছে।’
পশ্চিম দিকে এগোতে লাগলেন নৃসিংহ দেব। আবার থমকে দাঁড়ালেন। এই ছবি? এই ছবির সাক্ষী যে তিনি নিজেই! এক নারী অপর নারীর কানে-কানে কোনো কথা বলছে। পাশেই এক বৃদ্ধা চণ্ডীর মতো রণংদেহী রূপ নিয়ে নিজের পুত্রবধূকে গালিগালাজ করে চলেছে। যুবতী সেই বধূর মুখ অবসাদে মলিন। রাজা মনে মনে ভাবতে লাগলেন, এভাবেই সেই যুবতীর অপবাদও এক মুখ থেকে অন্য মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। এভাবেই সমাজ তার বিরুদ্ধে হয়ে গিয়েছে। এভাবেই সে নিজের শাশুড়ির কাছে প্রতারিত হয়েছে। আর এইসব কিছু একসময়ে সহ্যের সীমা ছাড়াতেই সে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আচ্ছা, সুবল কি নিজের কল্পনার মাধ্যমে প্রত্যেক শিল্পীর মনের কথা, ঘরের মানচিত্র জেনে ফেলেছে? এত দূর স্থানে থেকেও সে কীভাবে ওই যুবতীর ব্যথার কথা উৎকীর্ণ করে ফেলল?
মহারাজ কোনো প্রশ্ন না-করলেও সৌম্য শ্রীদত্ত নিজেই এই চিত্রের বিবরণ দিয়ে চললেন, ‘এখানে এক নারী নিজের সখীর কানে গ্রামের অন্য এক নারীর সম্পর্কে রটা কুৎসার কথা বলছে, যার স্বামী বিদেশে চলে গিয়েছে…’
‘থাক আচার্য। আর বলার প্রয়োজন নেই। এই ছবিটিকে দেখেই আমি বুঝতে পেরেছি। চলুন। আজ আর ভালো লাগছে না।’ রাজার মন আবার বিচলিত হয়ে উঠেছে। কিন্তু সুবল মহারানার প্রতি তাঁর সম্মান বেড়ে গিয়েছে। কী অদ্ভুত প্রতিভা এই তরুণ শিল্পীর! কী মহান এঁর কাজ! কত দক্ষতা! কল্পনা হলেও তা কত বাস্তববাদী!
ফেরার পথে নৃসিংহ দেব একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না। তাঁর মনের ভিতরে একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খেতে লাগল, ‘ওই যুবতী এখন কেমন আছে, কোথায় আছে কে জানে? আদৌ জীবিত আছে কিনা তাও জানা নেই। কোনো-না-কোনো শিল্পীর স্ত্রী সে। যখন সেই শিল্পী গৃহে ফিরে যাবে, তখন কী হবে?’
নৃসিংহ দেবের বাহ্যিক আচরণে একথা স্পষ্ট যে, কোনো ব্যথা তাঁকে নাগাড়ে মন্থন করে চলেছে। শিবেই সান্তারার সঙ্গে পথিমধ্যে সাক্ষাৎ হয়ে গেল। রাজার রণক্লান্ত, চিন্তাক্লিষ্ট, মলিন মুখের ছবি তাঁকে ভাবিয়ে তুলল। তিনি মনে মনে স্থির করলেন, মহারাজের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করা উচিত, ‘কিন্তু দিনমানে কী উপায়? নৃত্য তো রাত্রির অবসরে মনোরম লাগে। তাহলে কী করা যায়?’
নৃসিংহ দেব সর্বজনবিদিত সাহিত্যরসিক। যুদ্ধ এবং সাহিত্য, নৃত্য এবং শিল্প, কলা এবং কাব্য, সবকিছুই তাঁকে স্পর্শ করে। শিবেই সান্তারা তৎপর হয়ে কবি সম্মেলনের আয়োজন করলেন। বর্ধমান মহাপাত্র, কবিরাজ রঘুবীর, গোবিন্দ ভুজ, রঘুনাথ পারিছা এবং রাজকবি বিদ্যাধরকে আহ্বান করা হল। কাব্যপ্রতিভায় ধনী এই পঞ্চরত্নকে শিবেই সান্তারা বললেন, ‘রাজা কোনো কারণে উদ্বিগ্ন, অন্যমনস্ক থাকছেন, তাঁকে উৎফুল্ল করে তুলতে হবে।’
প্রথম চারজন কবি নিজের কাব্যসম্ভার মেলে ধরলেন। পাঠ হলে একে-একে। শেষে এলেন রাজকবি বিদ্যাধর। তিনি নৃসিংহ দেবকে কেন্দ্র করে লেখা ‘একাবলী’ কাব্য পাঠ করতে আরম্ভ করলেন। একাবলী কাব্য রাজকবি বিদ্যাধর বিরচিত নৃসিংহ দেবের প্রশস্তিমূলক কাব্য। তিনশো চোদ্দটি শ্লোকে গাঁথা এই কাব্যের ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠল রাজবন্দনা। কিন্তু নৃসিংহ দেব আজ এত প্রশস্তি শুনেও শান্তি পাচ্ছেন না। তাঁর শুধুই মনে হচ্ছে, শ্লোকগুলিতে শুধুই চাটুক্তি লেখা হয়েছে, ‘শ্লোকে বর্ণিত সেই শৌর্য, বীর্য, পরাক্রম, ওজঃ, কর্তব্যপরায়ণতা আজ কোথায়? এক সাধারণ গ্রামবধূ যুক্তির খড়্গে আমার মিথ্যা পৌরুষকে খণ্ডিত করে দিল! তাকে কী দিতে পেরেছি আমি? ন্যায়, বাঁচার অধিকার, সুরক্ষা? রাজার ন্যূনতম দায়িত্ব পালনেও আজ আমি ব্যর্থ হয়েছি। এই প্রশস্তি সর্বৈব মিথ্যা। এই যশোগান যেন আমাকে উপহাস করছে।’
ওই যুবতী শুধু মহারাজা নৃসিংহ দেবের ভোগবিলাসেই নয়, তাঁর সমস্ত সুখ, অহংকার, আত্মবিশ্বাসের উপর প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছে। বিদ্যাধরের কাব্যপাঠ কে শুনছে? আর যেই শুনুক-না-কেন, মহারাজ নৃসিংহ দেব তো নিশ্চিত ভাবেই শুনছেন না। তাঁর মন এখন সেই ভগ্ন দেবদেউলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে, যেখানে সেই রূপসী যুবতী অট্টহাসি করে তাঁকে বলেছিল, ‘রাজার আবার দুঃখ?’
রাজা পাঠ শোনেননি একথা সত্য, কিন্তু রাজকবির মনোবল নষ্ট করার অভিপ্রায় তাঁর নেই। তিনি আদেশ দিলেন ‘একাবলী’র কাব্য রাজকবির কাছ থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে বহেড়ার আঠা, কদলী রস, জলৌকা ভস্ম এবং লাজবর্ত রত্নের চূর্ণ থেকে প্রস্তুত মসির দ্বারা অভিলিখিত করে রাজ্যের গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত করা হোক। রাজা এত কথা বললেন বটে, কিন্তু তাঁর মন যে অস্থির সেকথা বুঝতে কারো সমস্যা হল না।
দিনমানের মনোরঞ্জনের অবসান হল। রাজার অন্যমনস্কতা কাটিয়ে তাঁকে উৎফুল্ল করার অভিপ্রায়ে রাতের জন্য পৃথক ব্যবস্থা করা হল। শিবেই সান্তারার নির্দেশে রাত্রে ‘গোপীবল্লভ’ নাটিকা মঞ্চস্থ হল।
নাটিকার দর্শকাসনে উপস্থিত হল কোণার্ক-শিল্পীরাও।
রঙ্গমঞ্চ খোলা আকাশের নীচে। মঞ্চের একপাশে বসে আছেন মহারাজ নৃসিংহ দেব, রানি সীতা দেবী, রাজভগিনী চন্দ্রাদেবী। মঞ্চের সামনে বিদেশ থেকে আগত অতিথিবৃন্দ এবং শিল্পী সম্প্রদায়। রঙ্গমঞ্চের আরেক পাশে নৃত্যাচার্য সৌম্য শ্রীদত্তের কন্যা শিল্পা এবং শিবেই সান্তারার পুত্রী কলাবতী সহ অন্যান্য সখীরা। সেখানেই আসন গ্রহণ করেছেন নাট্যাচার্য নিজেও। বাদ্যকারদের বসার ব্যবস্থাও সেখানেই করা হয়েছে।
রাধা এবং কৃষ্ণের প্রেমলীলার অদ্বিতীয় কাব্য মঞ্চস্থ হচ্ছে। উপস্থিত সকলে যখন নাটিকার কলাকুশলীদের অভিনয়ে মগ্ন, সুবল মহারানার মন তখন অন্য কোথাও। এক সরসীই এখানে তার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। তার দৃষ্টি শিল্পার উপরে নিবদ্ধ। শিল্পার মুখের আভা যেন সুন্দর, কোমল পদ্মের পাপড়ি হয়ে প্রাতঃকালীন সূর্যের অরুণিমাকেও হার মানায়। সুবলের প্রিয়তমা বিনোদিনীর মুখ তার কাছে অঙ্কিত চিত্রের মতো, অস্পষ্ট। কিন্তু শিল্পা? সে বাস্তব। স্পষ্ট। লীলায়িত দেহ নিয়ে বর্তমান। এক সুন্দর, সুকুমারী মুখ। এই কিশোরীই প্রতি রাতে সুবলের কল্পনায় সমাহিত হয়ে সে যে রূপে চাইত সেই রূপেই এসে দাঁড়াত। আর সুবল একের পর এক মূর্তি গড়ে চলত। একদিনের একটি ঘটনার কথা সুবলের মনে পড়ে গেল।
সুবলকে নাট্যাচার্য একটি চিত্রপট পাঠিয়েছিলেন। তা নিয়ে বিশেষ কিছু আলোচনার প্রয়োজন ছিল। ভোর হওয়া মাত্রই সুবল তাঁর আবাসে গিয়ে পৌঁছাল। সৌম্য শ্রীদত্ত অন্যান্য দিনের মতোই ব্রাহ্মমুহূর্তে নৃত্যাভ্যাস করতে ব্যস্ত ছিলেন। তাঁর বাড়ির আঙিনায় প্রবেশ করা মাত্রই স্তম্ভিত হয়ে গেল সুবল। চতুর্দিক কেতকী-জলের সুবাসে ম’ম’ করছিল। আঙিনার এক কোণে দাঁড়িয়েছিল সদ্যস্নাতা কিশোরী শিল্পা। এক অপূর্ব লীলায়িত ভঙ্গিমায় নিজের চিকুর-জালকে হাতে ধরে জল নিংড়ে ফেলছিল সে। তার পোষ্য মরাল তার কেশরাশি থেকে ঝরে পড়া জলবিন্দু শূন্য থেকেই ঠোঁটে করে লুফে নিচ্ছিল। শিল্পার অলক্তক-রঞ্জিত পায়ে কাঠের পাদুকা। আচমকাই শিল্পা চোখ তুলে তাকাল। সে দেখল এক সুন্দর তরুণ তার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রয়েছে। দ্রুতপদে সে কক্ষের দিকে রওনা দিল। কিন্তু সেই সুন্দর মুহূর্তের রেশ সুবলের মনে রয়ে গেল, আঁকা হয়ে গেল তার হৃদয়ের পাতায়।
এরপর সুবলের সঙ্গে আচার্য সৌম্য শ্রীদত্তর সাক্ষাৎ হয় এবং কাজ বুঝে নিয়ে সে ফিরে আসে। সেইদিন শিবিরে ফিরেই সে গড়তে আরম্ভ করে এক সদ্যস্নাতা কিশোরীর মূর্তি। আর তারপর থেকেই তার প্রত্যেক শিল্পকর্মে, প্রতিদিন একটাই মুখ ফিরে-ফিরে আসতে থাকে, শিল্পা…শিল্পা…শিল্পা! শিল্পার রূপ তার অবচেতনকে গ্রাস করে ফেলে। বিবিধ বেশভূষায়, ভাবভঙ্গিমায় এবং মুদ্রাতে শিলার বুকে সুবল শিল্পাকেই উৎকীর্ণ করতে থাকে। শিল্পার রূপ সুবলকে এমন ভাবে আচ্ছাদিত করে ফেলেছিল যে, সে হাতে ছেনি আর হাতুড়ি তুলে নিলেই তার কল্পনালোক থেকে সাকার হয়ে উঠত শিল্পার আকৃতি। সুবল তার কল্পসুন্দরীর সঙ্গে কথা বলত, তার মূর্তি গড়ত, তাকে সত্য বলে মনে করত। কিন্তু সবটাই কি তার কপোল-কল্পনা ছিল?
না। তা ছিল না। শিল্পা প্রতি রাতে সবার অগোচরে সুবলের শিবিরে যেত, কিন্তু সুবল বাস্তবের শিল্পাকে দেখেও তার কল্পনার শিল্পার থেকে আলাদা করতে পারত না। মায়া আর কায়ার মধ্যে পার্থক্য করার মতো বোধই থাকত না শিল্পসাধক সুবলের। শিল্পা নীরবে তার শিবিরে যেত, সুবল তার ভঙ্গিমা দেখে মূর্তি গড়ত। কাজ সমাপ্ত হলে শিল্পা আবার ফিরে আসত তার আবাসে।
কখনো–কখনো সুবল মহারানা নিজের কল্পনার শিল্পাকে প্রশ্ন করত, কথা বলত তার সঙ্গে, আর বাস্তবের শিল্পা সুবলের প্রত্যেক প্রশ্নের উত্তর দিত, প্রতিপ্রশ্ন করত তাকে। কতটা বাস্তব, কতখানি মিথ্যা সব বোধ হারিয়ে গিয়েছিল সুবলের। সব একাকার। নিজের প্রগাঢ় কল্পনাকে সাক্ষাৎ উপলব্ধি করতে পেরে সুবল নিজেকে ধন্য মনে করত, আর সুবলের কল্পনার সাম্রাজ্যের রাজ্ঞী হয়ে নিজেকে ধন্য মনে করত কিশোরী শিল্পা। এই অদ্ভুত, অবুঝ রহস্য অন্য কারো পক্ষেই বোঝা সম্ভব ছিল না। সুবল এবং শিল্পা পরস্পর, একে অপরের সঙ্গে যতটা নিবিড় ভাবে পরিচিত ছিল, ঠিক ততটাই ছিল অপরিচিত, অজ্ঞাত।
মঞ্চে অভিনয় চলছে। সুবল শিল্পার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে মনে মনে বলে চলেছে, ‘আমি তোমার কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব, শিল্পা। তোমার অবদান না-থাকলে নাট্যমন্দিরের কাজ শেষ করতে পারতাম না। তোমার জন্যই প্রতিটা মূর্তি এত প্রাণবন্ত, এত লাস্যময়ী হয়ে উঠতে পেরেছে। তোমারই জন্য নৃত্যগুরুর কল্পনাকে বাস্তবায়িত করতে পেরেছি। সুবল মহারানা চিরকাল তোমার কাছে ঋণী থাকবে। এবার বিদায় জানাই। এখন থেকে আমার কল্পনার পিঞ্জর থেকে তোমাকে আমি মুক্ত করে দিলাম। তোমার রূপের নেশা থেকে এবার আমিও মুক্তি চাই। শিল্পীকে মুক্ত আকাশের মতোই উন্মুক্ত এবং উদার হতে হয়, নাহলে সে নিজের শিল্পের ঔদার্য হারিয়ে ফেলে। বিদায় আমার কল্পনা! কোণার্ক তোমাকে নিজের বুকে স্থান দিয়ে অমর করে রাখবে। আমার স্বপ্নে তুমিও এটাই চেয়েছিলে।’
ওদিকে শিল্পাও কিন্তু শিল্পী সুবল মহারানাকেই দেখে চলেছে। সে ভাবছে, ‘প্রভু শ্রীরামচন্দ্রের চরণ স্পর্শ করে পাষাণ পর্যন্ত জীবন্ত নারীতে পরিণত হয়েছিল। যদি আজ তোমার চরণ স্পর্শ করে আমার এই নারীদেহ তোমারই কোনো শিল্পকর্মের উপযুক্ত পাষাণখণ্ড হয়ে যেতে পারত! তাহলে তোমার হাতের ছেনিতে কেটে–কুঁদে আমার প্রত্যেক শিরা-ধমনীর যন্ত্রণাকে সমাহিত করে তুমি আমাকে তোমার শিল্পকর্মে পরিণত করতে। কী দুর্লভ হতো সেই মুহূর্ত! আমি শুধু এটাই চাই।’
আর এই দুজনের নয়নাভিসার সকলের অলক্ষ্যে একজন দেখে চলেছেন। নৃত্যাচার্য সৌম্য শ্রীদত্ত দীক্ষিত। তিনি মনে মনে নিশ্চিত, ‘অতি অবশ্যই এই দুজনের মধ্যে কোনো গোপন সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। অবশ্যই হয়েছে। শিল্পাই সুবলের সামনে দিনের পর দিন প্রতিরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই কোণার্ক অখণ্ড ব্রহ্মচর্য এবং সন্ন্যাসের পীঠস্থান। সেই মাটিতে দাঁড়িয়ে আমার কন্যা শিল্পা মহারাজের প্রিয় শিল্পী সুবল মহারানার স্থির হৃদয়ে বিচলনের তরঙ্গ সৃষ্টি করছে। শিল্পার এই কাজ, এই আচরণ সাধনা এবং পবিত্রতার এই পীঠকে কলঙ্কিত করার পথে নিয়ে চলেছে। যখন রাজা স্বয়ং এই কথা জানবেন, তখন কী হবে? এবং শিল্পা নিজেও বাগদত্তা। সেক্ষেত্রে পরপুরুষের কল্পনাও যদি তাকে স্পর্শ করে, তাহলে তার কৌমার্য এবং নারীত্ব কলঙ্কিত হবে। হবে কী? এতদিনে তা হয়ে গিয়েছে।’
আবাসে ফেরামাত্রই শ্রীদত্ত শিল্পার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করলেন, ‘পাপিষ্ঠা, কী করে এই কাজ করলি? কেন করলি? নিজের কপালে কলঙ্ক লাগালি, আমার মুখ পোড়ালি, কোণার্ককে অপবিত্র করলি! তুই কেন সুবলের শিল্পের প্রতিরূপ হয়েছিস দিনের পর দিন? কেন? সম্পূর্ণ নাট্যমন্দির আর কোণার্কের ভিত্তি তোর বিলাসময় প্রতিকৃতিতে ভরে গিয়েছে। কেন করলি এমন কাজ? কেন করলি?’
শিল্পার মনে প্রথম প্রতিক্রিয়া এল, ‘শিল্পী তোমাকে ধন্যবাদ। তাহলে কি সত্যিই আমাকে একটি বার স্নানরত অবস্থায় দেখে তুমি নিজের হৃদয়ে স্থান দিয়েছিলে? তাহলে কি সত্যিই কোণার্কের নাটমন্দিরের প্রত্যেক মূর্তির মুখ আমারই মুখের আদলে গড়া হয়েছে? তাহলে কি সত্যিই শিল্পী আমার রূপ, যৌবন, জীবনকে ধন্য করে দিল? আমার অমরত্বের কামনা কি তাহলে সফল হয়েছে? নাহলে বাবা মূর্তিতে আমার মুখের আদল দেখে চিনলেনই বা কীভাবে? আহা শিল্পী, যদি তোমার চরণ দুটি পেতাম, এই বুকে ধরে লুটিয়ে পড়তাম আমি! কিন্তু তুমি আমার জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হয়েও জীবন-পরিধির বাইরে থাকো।’
সৌম্য শ্রীদত্ত বলেই চলেছেন, ‘তুই প্রতি রাতে সুবলের শিবিরে গিয়ে তার সামনে প্রতিরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছিস। এতে যেমন আমার সম্মান আহত হয়েছে, তেমনই নিজেকে কলঙ্কিত করেছিস তুই। আঘাত দিয়েছিস সুবলের নিষ্ঠায়, একাগ্রতায়, শুচিতায়, তার ব্রহ্মচর্যে, সন্ন্যাসে। সবকিছু জানার পরে মহারাজ তোকে এবং আমাকে কঠোর সাজা দেবেন। আর সব কথা জানাজানি হলে তোর বিবাহ দেওয়াও আমার পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।’
‘কিন্তু বাবা, এই কথা কে বলল যে আমি শিল্পীর শিল্পের জন্য প্রতিরূপ হতাম?’
‘সুবল নাট্যমন্দিরে যে কটা মূর্তি গড়েছে তার প্রত্যেকটার নাক, চোখ, মুখের আদল, অঙ্গ সৌষ্ঠব অবিকল তোরই দেহ বিবরণের সঙ্গে মিলে যায়। বিনা প্রতিরূপে এধরনের কাজ করা অসম্ভব!’
‘তাহলে কি ওই মূর্তিগুলোকে গড়ার ফলে কোণার্কের শিল্প কলঙ্কিত হয়েছে?’
‘কোণার্কের শিল্প নয় মূর্খ, তুই কলঙ্কিত হয়েছিস! তুই…তুই…তুই…! সুবলের শিল্প মহান। পাপ তাকে স্পর্শ করতে পারেনি।’
‘যদি আমার প্রতিরূপ দেখে সৃষ্ট শিল্প মহান হয়, যদি আমার প্রতিরূপ হওয়াতে কোণার্কের শিল্পের উৎকর্ষ বৃদ্ধি পায়, তাহলে তা আমার জন্যও গর্বের বিষয়, কলঙ্কের হতে যাবে কেন?’
‘কারো বাগদত্তা হয়েও তুই এই কাজ কীভাবে করলি?’
‘আমার হৃদয়ে কেবল একজন দেবতাই বাস করেন। সেখানে অন্য কারো স্থান পাওয়া অসম্ভব। শিল্পীর পূজা করে এই শিল্পা ধন্য হয়ে গিয়েছে।’
‘তুই কোণার্ক-শিল্পীর শিল্পকে কলঙ্কিত করছিস। কোণার্ককে কলঙ্কিত করছিস তুই। সুবল বিবাহিত পুরুষ। তুই কারো বাগদত্তা। তোদের দুজনের এভাবে একান্তে মেলামেশা করা মহাপাপ। সুবল মহারাজের প্রিয় পাত্র, কিন্তু ন্যায়ের সামনে ব্যক্তিগত ভাবনার কোনো মূল্য নেই। একথা কোনোভাবে রাজার কানে উঠলে তোর আর আমার সঙ্গে সুবলেরও শিরচ্ছেদ হবে। লোকে কোণার্কের নাম শুনলে ছিঃ ছিঃ করবে। মূর্খ, কেন বুঝতে পারছিস না যে কোণার্ক পীঠের ব্রহ্মচর্য আর একাগ্রতা ভঙ্গ করা অক্ষম্য অপরাধ?’
‘শিল্পীর একাগ্রতা যদি ভঙ্গই হয়ে থাকে, তাহলে সে এমন সুন্দর শিল্প গড়ল কীভাবে? বিচলিত মন আর অস্থির হৃদয় নিয়ে কি এধরনের শিল্পকর্মের জন্ম দেওয়া সম্ভব? কোণার্কের অমর্যাদা যদি কেউ করে থাকে, তাহলে সে আমি। শিল্পী নির্দোষ! আমি ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি, সে জানতই না যে আমি তার কাছে যেতাম। নিজের শিল্পের জগতে সে লীন হয়ে থাকত। কল্পনার চরিত্রদের সঙ্গে কথা বলত। যখন মনে হতো ওর কোনো প্রশ্নের উত্তর আমার দেওয়া উচিত, তখনই আমি উত্তর দিতাম। কিন্তু ভাবে বিভোর শিল্পী বুঝতেই পারত না যে রক্ত-মাংসের শিল্পাই তাকে উত্তর দিচ্ছে। সে ওই উত্তরগুলোকেও কল্পনার জগৎ থেকেই পাওয়া বলে ধরে নিয়ে নিজের কাজে বিলীন হয়ে যেত। শিল্পীর অসাধারণ প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হয়েই আমি ওর প্রেমে পড়েছি। কিন্তু সেই কথাও ওকে জানাইনি। দোষ আমার। শিল্পীর কোনো ভুল নেই। সে নিষ্পাপ।’
নৃত্যগুরু নিজের স্পষ্টবাদী কন্যাকে দেখে এবং তার কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন, ‘এত স্পষ্টবাদীতা?’ কোণার্কের নির্মাণ এখন অর্ধেকেরও বেশি এগিয়ে গিয়েছে। এত বছরেও সুবলের স্বভাবে, আচরণে, ব্যক্তিত্বে কোনো বিচলন তিনি দেখেননি। সৌম্য শ্রীদত্ত অনুধাবন করলেন যে, সুবলের প্রতি শিল্পার এই প্রেম আসলে একপক্ষীয়। মনে জাগা ব্যথার পাশাপাশি একটু শান্তিও জন্ম নিল—কোণার্কের শিল্পী নিজের ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়নি। নিজেই নিজের মনকে প্রবোধ দিলেন নাট্যগুরু। মুখে বললেন, ‘শিল্পা, তুই স্পষ্টবাদী। সত্যি কথা বলেছিস। তাই অতি অবশ্যই তোর দণ্ড কিছুটা হলেও লাঘব হওয়া উচিত। নাহলে সুবল বিবাহিত জেনেও তার প্রতি আসক্ত হয়ে তুই তার স্ত্রীর প্রতিও অন্যায় করেছিস, এই যুক্তির ভিত্তিতে আমিই মহারাজের কাছে তোর মৃত্যুদণ্ড দাবি করতাম।’
‘বাবা, মৃত্যুর ভয় আমার নেই। কোণার্কের শিল্পের সঙ্গে শিল্পী এই শিল্পাকে অমর করে দিয়েছে। আজই আমার মৃত্যু হোক বা কয়েক বছর পরে, এখন আর কী আসে যায়? আমি, আপনি, রাজা নৃসিংহ দেব, স্বয়ং শিল্পী সবাই কালের করাল গ্রাসের সামনে অসহায়। আজ নাহয় কাল মৃত্যু আমাদের প্রত্যেককে আলিঙ্গন করবে। কিন্তু কোণার্কের শিল্পের সঙ্গে অমর হওয়ার সৌভাগ্য সবার নেই। আমারই কি ছিল? রাজা নৃসিংহ দেব নাহয় কোণার্ক-নির্মাতা রূপে অমর হয়ে থাকবেন। আপনি অমর হয়ে থাকবেন নাটমন্দিরের মূর্তি-যোজনার জন্য, শিল্পী অমর হয়ে থাকবে তার অদ্বিতীয় ভাস্কর্যের কারণে। কিন্তু আমি? আমার জন্য কোনো কারণ, কোনো আয়োজন ছিল না। সবটাই নিয়তি। এই অকিঞ্চন শিল্পা অমর হয়ে গেল কেবলমাত্র শিল্পীর কল্পনায় স্থান পাওয়ার কারণে। এক্ষেত্রে আমার কোনো গুণ নেই। সবটাই রূপের ফল। সেই রূপ বিধাতার দেওয়া। তাতে আমার কোনো ভূমিকা নেই।
নৃত্য আপনি আমাকে শেখাননি। বিশ্ববাসী একসময়ে শুনে অবাক হবে যে, যেটুকু নৃত্য আমি শিখেছি, তা নিজের পিতাকে অভ্যাসরত অবস্থায় লুকিয়ে দেখার ফলেই শিখেছি—একলব্যের মতো। আর শিল্পীর কল্পনায় আমার স্থান পাওয়ার কারণ কী জানেন? শিল্পীর প্রতি আমার একান্ত অনুরাগ, যা স্বয়ং শিল্পীও জানে না। যদি আমার মৃত্যুতে শিল্পীর শিল্প-সাধনার পথ সুগম হয়, আপনার সম্মান ফিরে আসে, কোণার্ক-পীঠের পবিত্রতা অক্ষুণ্ণ থাকে তবে আমি হাসিমুখে মৃত্যুবরণ করব।
লোকে বলে, হৃদয়ের স্পন্দনেরও নাকি এক ধরনের অনুনাদ থাকে, যা সেই হৃদয়ের অনুরণনে পরিণত হয়, যার নাম করে হৃদয় স্পন্দিত হয়েছে। আমার হৃদয়-স্পন্দনের অনুনাদ শিল্পীর হৃদয়ের অনুরণনে পরিণত হলে তা কি আমার অপরাধ? তবুও আমি মহারাজ নৃসিংহ দেবের দণ্ডের প্রতীক্ষায় নিজেকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করে ফেলেছি, বাবা। তিনি রাজা হিসেবে আর যা-ই করুন না কেন, ওই মূর্তিগুলোকে নষ্ট করতে পারবেন না।
এই নিয়তি। এই বিধির বিধান। এটাই আমার ললাটের লিখন। আমার অমরত্ব এতেই। কোনো যোগ্যতা না-থাকা সত্ত্বেও আমি শিল্পীর হাতে অমর হয়ে গেলাম। আর আমার কোনো মৃত্যুভয় নেই। আর মানসিক পাপকে এই জগতের কোনো শাস্ত্রে পাপ হিসেবে মানা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। চিন্তা করলে কারও শাস্তি হতে পারে না, তবুও মহারাজ যদি আমাকে শাস্তি দিতে চান—দেবেন, আমার কোনো আপত্তি নেই। যেটুকু জীবন যাপন করার ছিল, তা আমি করে নিয়েছি। আমার প্রাপ্য আমি বুঝে নিয়েছি। আপনি নৃসিংহ দেবকে সংবাদ দিন, বলুন, শিল্পা রাজ-বধীকদের হাতে মৃত্যুদণ্ড ভোগ করার জন্য সর্বতোভাবে প্রস্তুত।’
‘এই জন্যই, এই জন্যই তোকে প্রাণদণ্ড দেওয়া যাবে না। যে শাস্তি ভোগ করার সময় অপরাধীর দেহে, মনে কোনো কষ্ট অনুভূত হয় না, সেই শাস্তি তার জন্য যথেষ্ট নয়। আর তোকে মৃত্যুদণ্ড দিলে কোণার্ক অভিশপ্ত হয়ে যাবে। আর এই কথা মহারাজকে জানিয়ে বিচলিত করার কোনো অর্থ হয় না। যে মাতৃহারা কন্যাকে আমি পিতা আর মাতা দুইয়ের ভূমিকা পালন করেই বড় করে তুলেছি, সেই মেয়ে আজ আমার গর্বে আঘাত করেছে। তাই তার অপরাধ নির্ণয় করে দণ্ড বিধানের অধিকার আমারই। তোকে আমি নির্বাসন দিলাম!
কাল মধ্যরাত পেরিয়ে কোণার্ক বন্দর থেকে সিংহল দ্বীপের উদ্দেশে একটি বহিত্র যাত্রা করবে। তুই নিজেকে নির্বাসিত জেনে ওই জলযানে চড়ে সিংহল দ্বীপে চলে যা! সিংহল দ্বীপ, বালি দ্বীপ, যবদ্বীপ, মলয়দ্বীপে কলিঙ্গবাসীরা ক্লিঙ্গ নাম ধারণ করে বসবাস করে। সিংহল দ্বীপে তাদেরই একজন হয়ে তুই বাস করবি, আর বাকি জীবনটা সুবল মহারানার মানসিক অভ্যর্থনা করে করেই কাটাবি। উৎকলীয় শিল্পীরা সাগরপথে বিভিন্ন দ্বীপে আসা যাওয়া করে। তোর কাকা প্রদত্ত এখন কয়েকজন নর্তক–নর্তকীদের সঙ্গে সিংহল দ্বীপে অবস্থান করছে। সিংহল দ্বীপের শাসক নৃত্যশিক্ষার একটি প্রয়োগশালার আয়োজনে প্রদত্তকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেই সূত্রেই সেখানে কয়েকজন প্রস্তর-শিল্পী এবং তাদের পরিবারও রয়েছে। তাই সিংহলে বাস করতে তোর কোনো সমস্যা হবে না। যেহেতু তোর হবু স্বামীর প্রতি আর তোর কোনো আকর্ষণ নেই, তাই জোরে করে বিবাহের আয়োজন করলে তা দুজনের জন্যই নরক যন্ত্রণার সমান হয়ে দাঁড়াবে। তাই তোর ভাবী শ্বশুরবাড়িতে আমি জানিয়ে দেব যে, সাপের দংশনে তোর মৃত্যু হয়েছে। কেউ কোনোদিন জানতে পারবে না যে, শ্রীদত্ত দীক্ষিতের কন্যা মানসিক অভিসার করেছিল, নিজের হবু স্বামীর প্রতি নিষ্ঠাচ্যুত হয়েছিল এবং নিজেকে ও নিজের বংশকে কলঙ্কিত করেছিল।’
‘আমার জন্য আপনি ওদের মিথ্যে কথা বলবেন?’
‘বংশকে কলঙ্কিত হতে দেওয়ার থেকে মিথ্যা বলা ভালো নয় কি? শিল্পা, তোর জন্য আজ আমার কুলপুরুষের সম্মান, কীর্তি, মর্যাদা মাটিতে মিশে যেতে চলেছে। সেইসব কিছুকে রক্ষা করার জন্য যদি আজ মিথ্যে বলে আমাকে পাপী হতেও হয়, তবুও তা-ই শ্রেয়। অবশ্য আমি এসব কথা বলছিই বা কেন? আমার মনে যে ঝড় উঠেছে, তার মুখোমুখি হওয়া সহজ কাজ নয়। যে সৌম্য শ্রীদত্ত সকালে নিজের মেয়ের মুখ না-দেখে জলস্পর্শ করত না, সে-ই আজ তার মেয়েকে নির্বাসন দিচ্ছে—এই কথাটা একটু ভেবে দেখিস তুই। এই শাস্তি যে একা তুই ভোগ করবি তা নয় কিন্তু, এই দণ্ডের সমান ফলভোগ আমাকেও করতে হবে। তোর এই বৃদ্ধ পিতার বেঁচে থাকার জন্য তোর বেঁচে থাকাটা খুব দরকার।
আবার কোণার্কের প্রতিষ্ঠার জন্য তোর দেশত্যাগও সমান ভাবে প্রয়োজনীয়। এখন সুবলের চোখে শুধু স্ফুলিঙ্গ দেখা দিয়েছে, কিন্তু সেই আগুনকে নিয়ন্ত্রণে না-আনলে পরে তা-ই হয়ে উঠবে আগ্নেয়গিরি এবং একসময়ে লেলিহান অগ্নিশিখা কোণার্ককে পুড়িয়ে ছাই করে দেবে। আমার কাছে তোর এই নির্বাসন তোর মৃত্যুর থেকেও বেশি নিদারুণ, কিন্তু কোণার্কের জন্য এই শাস্তি তোকে ভোগ করতেই হবে।’
‘যখন আপনার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আমি শিল্পকে ভালোবাসতে শিখেছিলাম, তখন নিপাট বালিকাই ছিলাম, বাবা। আর সেই আমিই আজ একই আদর্শ থেকে একজন শিল্পীকে ভালোবেসে ফেলেছি। কিন্তু আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে, আমি শিল্পা নাম্নী কোনো স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব নই, আমি নাট্যাচার্য সৌম্য শ্রীদত্তর কন্যা মাত্র। ভালোবেসে আমি ভুলই করেছি বাবা। আমাকে ক্ষমা করে দেবেন! আমি আপনার দেওয়া শাস্তি স্বীকার করলাম। আমার পিতার গর্ব অক্ষুণ্ণ থাক! শিল্পীর গৌরব অক্ষুণ্ণ থাক! কোণার্কের প্রতিষ্ঠা অক্ষুণ্ণ থাক!’
‘সাগর-যাত্রার জন্য প্রস্তুত থেকো। এবং এই কথা যেন পাঁচকান না হয়!’ সৌম্য শ্রীদত্তর কণ্ঠস্বর মৃত্যুর মতো শীতল মনে হল।
‘অবশ্যই। আমি প্রস্তুত থাকব। একটাই অনুরোধ—আমি কি একবার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে পারি? অন্তিম বার। আর হয়তো দেখা হবে না।’ শিল্পার স্বর করুণার্দ্র হয়ে উঠল।
জন্ম দিতেই যে সন্তানের মা পৃথিবীর মোহমায়া ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল, সেই সন্তান যদি মায়ের কথা বলে তাহলে কি কেউ না করতে পারে? কিন্তু কে শিল্পার মা?
বয়ালিশবাটিতে গঙ্গেশ্বরী দেবীর শিখরহীন মন্দির। কোণার্ক নির্মাণের কয়েক বছর আগের কথা—তখন দেবী অমোক্ষ, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত এবং অপূজিত অবস্থায় বিরাজ করতেন। গাভীদের বাঁটে মুখ দিয়ে তিনি নাকি তাদের সব দুধ শুষে পান করতেন। রাখালরা ধরতে পারত না যে ঠিক কী ঘটছে। একদিন এক রাখাল ঠিক করলে, ‘আমার গোরুর দুধ কে চুরি করে খায় আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব।’ গোরুগুলোকে বনে ছেড়ে দিয়ে সে অল্প দূরেই একটা অশ্বত্থ গাছের পিছনে লুকিয়ে দেখতে লাগল। সে দেখল এক অপূর্ব সুন্দরী নারী গাভীর স্তনে মুখ দিয়ে বাছুরের মতো দুধ পান করছে। আগুপিছু ভাবনাচিন্তা না-করেই রাখাল সেই সুন্দরী নারীর মাথায় নিজের হাতের লাঠি দিয়ে এক ঘা মারল। ফেটে গেল সেই নারীর মাথা। সেই রাতেই ওই গোপালকের একমাত্র পুত্র আচমকাই ধড়ফড়িয়ে মারা গেল। না কোনো রোগ, না কোনো অপঘাত।
পুত্রের পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম সম্পন্ন করার পর রাখাল ভাবতে বসল যে, সে এমন কী কাজ করল যার পাপের ফল পেল! কোনো ভুল করেছে কি? তখন তার মনে পড়ে গেল সেই সুন্দরী নারীর কথা, তার মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করার ঘটনা। সে সেই স্থানে ফিরে গেল যেখানে ওই নারীর দর্শন পেয়েছিল। গিয়ে দেখে মাথা থেকে পড়া রক্তের বিন্দু জমাট বেঁধে স্থানে স্থানে পড়ে আছে এবং সেই রক্তের দাগ একটি নির্দিষ্ট দিকে এগিয়েছে। এভাবেই চিহ্ন ধরে এগিয়ে গিয়ে সে দেবীর সন্ধান পেল। দেবীর ধড় তখন লুপ্ত হয়েই গিয়েছিল। শিরটুকু অবশিষ্ট ছিল। মাথা থেকে রক্তের তিনটি ধারা নেমে শুকিয়ে দাগ সৃষ্টি হয়েছিল। রাখাল শ্রদ্ধাভরে সেই মস্তকটাকেই তুলে এনে একটি কুটিরে স্থাপন করল, দেবী রূপে। তার পর থেকেই দেবীর পূজা আরম্ভ হয়।
দেবী গঙ্গেশ্বরীর ভগিনী দেবী যজ্ঞেশ্বরী। তিনি অনঙ্গভীম দেবকে স্বপ্নাদেশ দিলেন, ‘এক রাতের মধ্যে দেবী গঙ্গেশ্বরীর মন্দির নির্মাণ করতে হবে’। ভয়ে হোক বা ভক্তিতে অনঙ্গভীম দেব ব্যবস্থা করলেন। এক রাতের মধ্যেই তৈরি হয়ে গেল মন্দির, কিন্তু ওই অল্প সময়ের মধ্যে মন্দিরের শিখর বা চূড়া স্থাপন করা সম্ভব হল না। দেবীর মন্দির তখন থেকেই শিখরবিহীন অবস্থায় রয়েছে। দেবী গঙ্গেশ্বরী অবশ্য এখনও কুটিরেই পূজিত হন।
শিল্পার মা এই দেবী গঙ্গেশ্বরীকেই নিজের ইষ্ট জ্ঞান করতেন। শিল্পার জন্মের সময় তাঁর মৃত্যু হয়। শিল্পা ছোটবেলায় যখন তার মায়ের জন্য কান্নাকাটি করত তখন তার বাবা শ্রীদত্ত একবার তাকে বলেছিলেন, ‘দেবী গঙ্গেশ্বরীই তোর মা!’
ছোট্ট শিল্পা একবার জেদ ধরে বসল, ‘আমি মা’কে দেখতে চাই।’
নিরুপায় নৃত্যগুরু তখন শিল্পাকে দেবী গঙ্গেশ্বরীর মন্দিরে এনে বললেন, ‘যা, ভিতরে গিয়ে দেখ, তোর মা বসে আছেন। তোর মা ডাকলে দেখা দেয় না, কিন্তু না-চাইতেই সব দেয়। মানুষের ইচ্ছার কোনো মূল্য নেই। তোর মায়ের ইচ্ছাই সব। তিনি চাইলে সব সম্ভব। যা, ভেতরে যা!’
শিল্পা মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করার পর রুদ্ধ কণ্ঠে শ্রীদত্ত প্রার্থনা করেছিলেন, ‘মা, তুমি জগন্মাতা! এই শিশুর কোনো দোষ নেই। মা-হারা সন্তানের কান্না সহ্য করতে না-পেরে আমিই বলেছি তুমি ওর মা। সবই তোমার ইচ্ছা মা। এই শিশুকে তুমিই সামলিও মা।’
শিল্পা যখন মন্দির থেকে বেরিয়ে এল, তখন তার ঠোঁটে দুধের বিন্দু লেগে ছিল। সে বেরিয়ে এসেই শ্রীদত্তকে বলেছিল, ‘আমার মা খুব ভালো। মায়ের মতো ভালো কেউ হতে পারবে না।’ এরপর থেকে শিল্পা আর কখনো নিজের মায়ের জন্য জেদ করেনি। যখনই মায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য তার মনখারাপ করত, তখনই সে দেবী গঙ্গেশ্বরীর মন্দিরে চলে যেত। মায়ের উষ্ণ আশিস দেবী গঙ্গেশ্বরীর আশীর্বাদ হয়ে তার সঙ্গেই থাকে সদাসর্বদা। সেই মা গঙ্গেশ্বরীর সঙ্গে তার কন্যা শিল্পার সাক্ষাৎ কে আটকাবে?
মেয়ের মুখে মা গঙ্গেশ্বরীর দর্শনের কথা শুনে শ্রীদত্ত বললেন, ‘কাল ভোরে চলে যাস। কিন্তু মনে রাখবি, শুধু তোর মায়ের সঙ্গেই দেখা করার অনুমতি দিলাম। অন্য কারো সঙ্গে নয়। শুধু মায়ের সঙ্গে…।’
এই গঙ্গেশ্বরী এবং যজ্ঞেশ্বরী দেবী শিল্পী-সম্প্রদায়েরও আরাধ্যা। প্রত্যেক শিল্পী প্রতিদিন স্নান সেরে গঙ্গেশ্বরী ও যজ্ঞেশ্বরী দেবীর দর্শন করে তবেই হাতে ছেনি-হাতুড়ি তুলে নেয়।
সূর্যোদয়ের অনেক আগেই শিল্পা গঙ্গেশ্বরী দেবীর মন্দিরে গিয়ে উপস্থিত হল। কেউ তাকে দেখে ফেলার আগেই তাকে সরে পড়তে হবে। দেবীর দর্শন করতে-করতে শিল্পা মনে মনে ভাবতে লাগল, ‘জন্মদাত্রী মা জন্মের পরেই আমাকে ছেড়ে চলে গেল। আজ তুমিও ত্যাগ করে দিলে মা? তুমিও দূরে ঠেলে দিলে? সঙ্গী-সাথীদের থেকে দূরে চলে যাচ্ছি, চন্দ্রভাগার তট হারিয়ে যাচ্ছে আমার বুক থেকে। কিন্তু কেন? সাগরপাড়ের একটি অপরিচিত দ্বীপে আমাকে কেন নির্বাসন দিলে, মা?’
দেবীর বিগ্রহের সামনে নিষ্কম্প দীপশিখার মতো বসে মৃদু, মধুর স্বরে সে মন্ত্রপাঠ করে চলেছে। তার মন্ত্রোচ্চারণে তারই হৃদয় সজল হয়ে উঠছে এক পবিত্র আনন্দে, ব্যথার বারিধারায়। মনের অশান্ত সাগরকে উদ্বেলিত করতে থাকা প্রশ্নরা উত্তরের কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে। ছোটবেলায় রাজজ্যোতিষী তার জন্মছক দেখে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, ‘দীক্ষিত মশাই, এই কন্যা দেবীর অংশ। জগৎ সংসারে এর আগমন কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই হয়েছে। যতদিন এই ধরায় থাকবে, ততদিন হাসি-আনন্দে কাটাবে। নিজের উদ্দেশ্য পূর্ণ হলেই নিজের ধামে ফিরে যাবে দেবী। এই মেয়েকে নিয়ে বিশেষ চিন্তা করবেন না।’
শিল্পা ভাবতে থাকে, ‘তবে কি আমি যে দেবীর অংশ, সেই দেবীর নিবাস সিংহল দ্বীপেই? তবে কি তিনিই আমাকে সেখানে ডাকছেন? তাহলে কি এটাই ঠিক মা? তুমি সেখানেও আমার মা হয়ে আমাকে আগলাবে তো? আসি, মা। সিংহল দ্বীপে আবার দেখা হবে।’
শিল্পা মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে নিজের আরাধ্যাকে প্রণাম জানাল। মাথা তুলতেই মনে একটা কামনাও জাগল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তা মন থেকে ছুড়ে ফেলে দিল শিল্পা, ‘না, আর কোনো কামনা নয়, আর কোনো চাহিদা নেয়।’ দেবীর দিকে মুখ করে উলটো পায়ে পিছু হাঁটতে আরম্ভ করল সে। তার চোখ দেবীর বিগ্রহের উপরে স্থির। এভাবে পিছু হঠতে গিয়েই কারো সঙ্গে তার ধাক্কা লেগে গেল।
কেউ একজন বলে উঠল, ‘ক্ষমা করবেন দেবী, আমি বুঝতে পারিনি। আমার কোনো দোষ নেই।’ গলা শুনেই পিছনে ফিরে তাকাল শিল্পা। বলিষ্ঠ দেহ, আয়ত নেত্র, সৌম্য বপুর যুবক স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। মন্দিরদ্বারে তার সঙ্গে সুবল মহারানার ধাক্কা লেগেছে। সুবল মহারানা…শিল্পার শিল্পী। যার প্রতিমার পূজারিণী হওয়ার অপরাধেই আজ সে নির্বাসনের দণ্ড ভোগ করতে বাধ্য হয়েছে, সেই সুবল মহারানা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ‘মা গো, যা চাওয়া হয় না, তুমি তাও মন পড়ে দিয়ে দাও!’ মনে মনে বলল শিল্পা।
সুবল বলল, ‘দয়া করে আমার পথ ছেড়ে দিন, দেবী। নাহলে এখান থেকে ফিরে কাজ আরম্ভ করতে বিলম্ব হবে। আকাশে মেঘ করে এসেছে। বৃষ্টি শুরু হলে ফেরা কঠিন হবে।’
শিল্পা মুখে কিছু না-বললেও মনে মনে ভাবল, ‘শিল্পী, আমার জন্য কি তোমার দুদণ্ড সময়ও নেই? অবশ্য তোমার কাছে কোণার্ক ছাড়া আর কোনো কিছুর জন্যই সময় নেই। শিল্পা, তুই নিজে সেই পথ ছেড়ে এসেছিস। এবার এই পথও ছেড়ে শিল্পীকে যেতে দে।’
শিল্পা শিল্পীর পথ ছেড়ে দাঁড়াল। সুবল এগোতেই শিল্পা মাটিতে বসে পড়ে তার দাঁড়ানো জায়গাটাতেই মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে নিল। শিল্পীর তা চোখ এড়াল না। অবগুণ্ঠনের আড়ালে থাকা মুখটাকে চেনার চেষ্টা করল সুবল। তার চোখমুখের অভিব্যক্তি দেখে শিল্পার সারা দেহ, মন, আত্মা শিহরিত হয়ে উঠল, ‘তাহলে শিল্পী আমাকে চেনার চেষ্টা করছে। হয়তো বা চিনেও ফেলেছে। ও কি জানে আমার বিদায়ের সময় উপস্থিত? বিদায়বেলায় আলিঙ্গনই তো রীতি।’
শিল্পা অনুভব করল—শিল্পী তাকে বুকে জড়িয়ে আলিঙ্গন করছে। না, এ ভ্রম মাত্র। তা ভাঙতেও বিলম্ব হল না। আর সঙ্গে সঙ্গেই শিল্পার ঠোঁট থেকে অস্ফুট ধ্বনি বেরিয়ে এল, ‘বিদায় শিল্পী!’
প্রকৃতিও যেন তার এই শেষ উচ্চারিত কথাটা সহ্য করতে পারল না। ঝমঝম করে একরাশ অভিমান নিয়ে ঝরে পড়ল ধরার বুকে। সেই শব্দে ঢাকা পড়ে গেল শিল্পার কণ্ঠ।
তুমুল বর্ষা মাথায় নিয়েই শিল্পা নিজের পথ ধরল। একবার পিছনে ফিরে তাকাল, মনে হল যেন শিল্পীও তাকে অনুসরণ করছে। কিন্তু এসবই ভ্রম। আগের বারের মতোই।
শিল্পার নিঃশব্দ ক্রন্দন বর্ষার ধারাপাতে মিশে গেল। জলধারা আরও তীব্র হল।
নির্ধারিত সময়েই বহিত্র বন্দর থেকে রওনা দিল। নির্বাসিত কলিঙ্গ-কন্যা সহ অন্যান্য যাত্রীদের নিয়ে সেই জলযান বিদায় জানাতে আসা স্বজনদের দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। শ্রীদত্তের এই নিষ্ঠুর ত্যাগ, শিল্পার এই নিদারুণ নির্বাসনের কথা কেউ জানতেও পারল না। সুবল মহারানা বুঝতেও পারল না যে তার প্রেরণা, তার প্রতিরূপ, তার শিল্পা চিরদিনের জন্য উৎকল ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হল।
শ্রীদত্ত মহাশয়ও বন্দরে এসেছিলেন শেষবারের মতো কন্যাকে বিদায় জানাতে। বন্দর থেকে ফেরার আগে তিনি জোড়করে সাগরকে প্রণাম করে বললেন, ‘হে মহোদধি, আমি আমার কন্যাকে জনক-দুহিতার থেকেও কঠিন শাস্তি দিলাম। তুমি সাক্ষী থাকলে। আমি নিজের সকল শিল্প, সমস্ত প্রেরণার উৎস, নিজের পুত্রী শিল্পাকে তোমায় অর্পণ করলাম, রত্নাকর!’
সৌম্য শ্রীদত্ত সাগরতট থেকে ফিরে এলেন বটে, কিন্তু নিজের কন্যাকে চিরদিনের জন্য নির্বাসিত করা পিতার মন ওই সাগরের পাড়েই কোথাও রয়ে গেল।