সূর্য বিনোদিনী – ৭

দিনেরবেলায় সুবল, বিশু মহারানার সঙ্গে বিভিন্ন শিবিরে গিয়ে-গিয়ে অন্য শিল্পীদের সাহায্য করে, আর রাতে সে নিজের শিবিরে আপন মনে পাষাণ কোঁদে। প্রতি রাত্রির অন্ধকারে শিল্পা সুবলের প্রতিরূপ হয়ে আসে। সুবল মহারানা পাথরের বুকে অপ্সরার রূপ আঁকে। শিল্পাকে সামনে রেখে সে পাথরের পুঁথির প্রত্যেক পাতায় জীবনের বিবিধ কথা লেখে। নারীর বিভিন্ন রূপ, বেশবাস, কেশ-বিন্যাস, প্রসাধন, বেণীবন্ধন, রান্নাশালায় রাঁধা-বাড়া, দাম্পত্য, স্বামীর হাতে হাত রেখে জীবন-সংঘর্ষের পথে চলা নারী, শিশুকে স্তন্যদান, জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি জীবনের অনেক কিছুই চিত্রিত হল শিল্পীর ছেনিতে, শিল্পার সাহায্যে। কিন্তু আজ সুবল মহারানার মন বড় উদাস হয়ে আছে। তার মুখে হাসি নেই। সুবলের হাতের ছেনি আজ স্থির, মূক।

‘শিল্পী!’

‘বলো শিল্পা।’

‘আজ তোমার ছেনি স্তব্ধ কেন? কতক্ষণ ধরে একই মুদ্রায় বসে রয়েছি আমি! এবার কি অন্য কোনো ভঙ্গিমায় বসব? নাকি আজ আর তক্ষণের কাজ করবে না?’

‘আমার মন ভালো নেই শিল্পা। আজ অপরাহ্নে শিল্পী নীলকমল মহারানা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। তার হাতের অসমাপ্ত একটি মূর্তির দায়িত্ব এবার আমারই।’

‘কিন্তু এটাই যে জীবনের বিধান, শিল্পী। কারো জন্য কোনো কাজ থেমে থাকে না। কেউ–না–কেউ তাকে পূর্ণ করেই। কোণার্কও কারো জন্য থেমে থাকবে না, কেউ হারিয়ে গেলে অন্য কেউ এসে তার স্থান পূরণ করে দেবে।’

‘হ্যাঁ, কোণার্ক অবশ্যই পূর্ণ হবে! নীলকমল মহারানার কাজ সম্পূর্ণ করবে সুবল মহারানা, সুবল মহারানার কাজ অন্য কেউ সম্পূর্ণ করে দেবে। কোণার্ক পূর্ণ হবেই! অসম্পূর্ণ রয়ে গেলে কেবল নীলকমল মহারানার স্বপ্ন, তার কামনা, মনোবাঞ্ছা, আশা-আকাঙ্ক্ষা। আজ যদি নীলকমল মহারানার অকালমৃত্যু না-হতো, তবে সে ফিরে গিয়ে বিয়ে-থা করে সংসারী হতো। তার বাগদত্তার কাছে এখনও সংবাদ পৌঁছায়নি। সে হয়তো আজকের সন্ধ্যাপ্রদীপটিও ও নীলকমল মহারানার নাম করেই জ্বেলেছে।’

‘শুনেছি, তাঁর রাজরোগ হয়েছিল। রোগের লক্ষণ ফুটে উঠতেও বিলম্ব হয়েছে। এমনও হতে পারে যে, নীলকমল মহারানা নিজের রোগের কথা জেনেও তা কাউকে বলেননি। হয়তো বা লুকিয়ে রেখেছিলেন। চিকিৎসা সময়মতো হয়নি। রাজবৈদ্য আপ্রাণ চেষ্টা করেও তাকে সারিয়ে তুলতে পারেননি বলে দুঃখ প্রকাশ করছিলেন।’

‘জানো শিল্পা, এই যক্ষ্মা রোগটা যেন আমাদের, মানে শিল্পীদের কেনা-রোগ। পাথর কাটতে-কাটতে আমরা যখন শ্বাস নিই, তখন প্রচুর পরিমাণে ধুলো আমাদের বুক ভরিয়ে দেয়, নষ্ট করে দেয়। নীলকমল মহারানা সম্ভবত ভয়েই তার রোগের কথা পাঁচকান করেনি। সে ভেবেছিল, একবার তার যক্ষ্মার কথা কারো কানে গেলেই তাকে এখান থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কোণার্ক-মন্দিরের কাজ সম্পূর্ণ না-হওয়া অবধি সে ফিরতে চায়নি।’

‘ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, ওঁর আত্মার সদ্‌গতি হোক!’

‘অকালে নিহত কোনো মানুষের অতৃপ্ত আত্মার সদ্‌গতি হয় না, শিল্পা। নীলকমল মহারানার আত্মা, তার অতৃপ্ত কামনার বশীভূত হয়ে মোক্ষ পাবে না। অনন্তকাল ধরে তার অশরীরী আত্মা ঘুরে মরবে। আজ নীলকমল মহারানার ক্ষেত্রে হচ্ছে, কাল অন্য কারো, পরদিন আবার অন্য কেউ। আমরা কেউ জানি না যে, আজ থেকে বারো বছর পরে কতজন শিল্পী আদতে নিজের ঘরে ফিরতে পারবে? এমনও হতে পারে আমারও ওই একই দশা হল—তখন তুমি আমার আত্মার সদ্‌গতির জন্যেও একটু প্রার্থনা করে দিও, কেমন?’

‘এমন কথা বলতে নেই শিল্পী। নীলকমল মহারানা একজন দক্ষ শিল্পী ছিলেন। তোমার হাতে পূর্ণ কোণার্ক দেখলে ওঁর আত্মার শান্তি হবে।’

‘না শিল্পা, শান্তি নয়, কষ্ট হবে। কষ্ট!’

‘এ কেমন কথা? নীলকমল মহারানাও তো কোণার্ককে পূর্ণ অবস্থায় দেখতে চেয়েছিলেন, সেই কৃতিত্বের সহভাগী হতে চেয়েছিলেন। তার আত্মা কষ্ট কেন পাবে?’

‘কারণ নীলকমল মহারানার বাসনা কেবল কোণার্ক সম্পূর্ণ হওয়া অবধি সীমিত ছিল না। সে বারো বছর ধরে ব্রহ্মচর্য পালনের ব্রত রেখেছিল ঠিকই, কিন্তু সে তো কোনো সন্ন্যাসী ছিল না। তার কামনা-বাসনাগুলো দমিত হয়ে ছিল মাত্র। সে নিজের এই অতৃপ্তির কারণ কাকে মানবে জানো? এই কোণার্ককে…। তার অতৃপ্ত আত্মা কোণার্ককে যে দৃষ্টিতে দেখবে তা কোণার্কের পক্ষে অশুভই হবে।

নীলকমল এবং তার মতো এমন অনেক অমোক্ষ আত্মাদের অশুভ দৃষ্টির ফলে কোণার্ক ধ্বংস হয়ে যাবে একদিন। এই অতৃপ্ত আত্মারা কোণার্ক নির্মাণের দেবার্চনা এবং ধর্মকার্যে পদে–পদে বাধা উৎপন্ন করবে। এইসব অতৃপ্ত আত্মাদের পরিতোষ করা আমাদেরই দায়িত্ব। এ কোণার্ক-শিল্পীর কর্তব্য। আজ অবধি শুধু তোমাকেই শিল্প-শাস্ত্রসম্মত প্রত্যেক নৃত্য-মুদ্রার প্রতিরূপ করে মূর্তি গড়েছি আমি, কিন্তু এবার অতৃপ্ত আত্মাদের অশুভ দৃষ্টি থেকে কোণার্ককে রক্ষা করতে আরও কিছু ভাস্কর্য কোণার্কের দেহে উৎকীর্ণ করতে হবে আমাকে।’

‘আমি সেই কাজে কীভাবে সাহায্য করতে পারি? বলো শিল্পী, কোন ভঙ্গিমায়, কোন মুদ্রায় দেখতে চাও আমাকে? আদেশ দাও, আমি প্রস্তুত!’

‘না শিল্পা!’ সুবলের স্বর কুণ্ঠিত মনে হল। ‘সেইসব ভাস্কর্যের জন্য আমি তোমাকে কোনো নির্দেশ দিতে পারব না। প্রত্যেক চিত্র এবং প্রতিটি মূর্তির প্রতিরূপ পাওয়া যায় না। কিছু ছবি শিল্পী নিজের কল্পনার চোখে দেখেই আঁকে। তবে তোমাকে একটাই অনুরোধ, এই ভাস্কর্য নির্মাণের সময়েও তুমি আমার চোখের সামনেই থেকো। আমার প্রেরণা হয়ে যদি তুমি আমার সামনেই থাকো, তাহলে আমার কল্পনা আধার পাবে। তোমার চোখ, ঠোঁট, মুখ, সুগঠিত দেহ, এবং তোমার রূপ-লাবণ্য আমার কল্পনার নায়িকার দেহেও ঢেলে দিতে চাই।’

‘কিন্তু চিত্রগুলো কী নিয়ে আঁকবে সে কথা তো বললে না?’

শিল্পীর কণ্ঠ বিভোর হয়ে উঠল, ‘নর ও নারীর মধুর মিলনের যথার্থ চিত্র। যেসব মিথুনমূর্তি দেখে ভূত-প্রেত-পিশাচেরা আনন্দ পাবে। শিল্পীদের অতৃপ্ত আত্মারা মৈথুনদৃশ্য দেখে তৃপ্ত হবে। নীলকমল মহারানার অতৃপ্ত আত্মাও সন্তুষ্ট হবে।’

‘কিন্তু শিল্পী, এই ধরনের দৃশ্য মন্দিরের ভাস্কর্যে অঙ্কিত হলে কলিঙ্গের শিল্পীদের যে বড় মানহানি হবে! অপমান হবে মহারাজেরও। ভবিষ্যতের দর্শক ভাববে, কলিঙ্গের শিল্পীরা পাষাণের বুকে নিজেদের কামনার ছবি খোদাই করে গিয়েছে। আবার তারা এটাও ভাবতে পারে যে, বিকৃত কাম প্রবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ করার জন্যই কোণার্কের নির্মাণ করা হয়েছিল। আর এই ভাবনাটাও খুব ভুল কিছু হবে কি? কোণার্ক নির্মিত হয়ে যাওয়ার পরে তা কিন্তু একা কলিঙ্গের সম্পত্তি নয়, সারা বিশ্বের সম্পদ হয়ে উঠবে কোণার্ক। এই ধরনের ভাস্কর্য কোণার্কের নামে, কোণার্ক-শিল্পীদের নামে, কোণার্ক-নির্মাতার নামে কলঙ্ক হয়ে দাঁড়াবে।’

সুবল অকুণ্ঠ ভাবেই বলে চলল, ‘যে উৎকলভূমির এক কিশোরী কোণার্ক এবং কোণার্ক-শিল্পীকে অমর করে তুলতে, নিন্দা ও অপবাদের চিন্তাকে বিসর্জন দিয়ে, নিজের পিতার অজ্ঞাতসারে, নির্জন-গহন রাতে সুবল মহারানার সামনে শিল্পের প্রতিরূপ হতে রাজি হয়, সেই উৎকলভূমির শিল্প কখনোই কলঙ্কিত হতে পারে না। মন্দিরের ভিত্তিতে এবং অন্য উচিত স্থানে কামকলারত মূর্তির স্থান দেওয়া একেবারে শাস্ত্রসম্মত কাজ।

শিল্পশাস্ত্রের মতে—দেবতা মন্দিরে দেবার্চন, ধ্যান এবং ধর্মচর্চার দৃশ্য দেখে হর্ষিত হন; গন্ধর্ব নৃত্য তথা বাদ্যের চিত্র দেখে প্রসন্ন বোধ করেন; কিন্নরগণ নর-পশু, অর্ধনর ও অর্ধেক পশু-পক্ষীর মূর্তি এবং চিত্র দেখে সুখ লাভ করেন; অসুরেরা ভয়ংকর মূর্তি দেখে আনন্দ পায়; যক্ষ খুশি হয় নিজের প্রতিরূপ দেখে; মানুষ নিজের বিগত ইতিহাসের সুন্দর, সমৃদ্ধ সময়ের দৃশ্য দেখে প্রসন্ন হয়ে ওঠে; অশ্ব এবং হস্তী আনন্দ পায় অশ্ববন্ধ, গজবন্ধের চিত্রে এবং পাখির পুলক জাগে পক্ষীবন্ধের দৃশ্যে; কিন্তু ভূত-প্রেত-পিশাচ মৈথুন দৃশ্য, কামমূর্তি দেখে তৃপ্ত হয়। ভূত-প্রেত-পিশাচ মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না বলে তাদের সন্তুষ্টির জন্য মন্দিরের বাইরের অংশে কামকেলিরত মূর্তি তথা মৈথুনদৃশ্য অঙ্কনের বিধান রয়েছে।

ভূত-প্রেত-পিশাচদের সন্তুষ্ট করতে না-পারলে মন্দিরে অতৃপ্ত আত্মাদের অশুভ দৃষ্টি পড়বে। তাই মন্দিরের বাহ্য-ভিত্তিতে এমন কিছু মূর্তি স্থাপিত করতে হবে যাতে সমস্ত জীবধারীদের পাশাপাশি ভূত-প্রেত-পিশাচরাও সন্তুষ্ট হয়। বৃহৎ সংহিতাতেও বলা আছে যে, সবৎসা গাভী, নকুল, পাখি, শ্রীবৃক্ষ, স্বস্তিক, পূর্ণকুম্ভ, পত্রাবলী, মীন-যুগল, শঙ্খ এবং মিথুন-দৃশ্য এই সবই মঙ্গলসূচক। সৌন্দর্যের তৃষ্ণা প্রত্যেক আত্মার মধ্যেই থাকে, শিল্পা। আর কোণার্ক তো স্বর্গ–মর্ত্য–পাতালের সৌন্দর্য আর আনন্দের সর্বশ্রেষ্ঠ পীঠস্থল হয়ে উঠতে চলেছে।’

‘শিল্পী, মন্দির নির্মাণের গূঢ় তত্ত্ব বা তথ্য কোনওটাই আমার জানা নেই। কিন্তু এটুকু জানি যে, মন্দির হল সাধনার কেন্দ্র। সাধনার স্থলে এমন দৃশ্যাবলী সাধকের মনকে চঞ্চল করে তুলবে।’

‘মন্দির সাধনার নয়, ভক্তির কেন্দ্রস্থল, শিল্পা। দুর্গম গিরি-কন্দর থেকে আরম্ভ করে নির্জন শ্মশানে…যেকোনো স্থানেই মগ্ন সাধক নিজের সাধনা করতে পারে। তার মগ্ন ভাবের জন্য কোনো অশরীরী আত্মা তার মনকে বিচলিত করতে পারে না, তাকে কষ্টও দিতে পারে না। আর সাধনার একটি ভাগে ত্রিপুরসুন্দরীর কামকলার আরাধনাও পড়ে। মন্দিরের ভিত্তিতে, প্রাচীরে যৌনমূর্তি এবং কামদৃশ্যগুলি আসলে এই কামকলা বিদ্যারই উৎকীর্ণ রূপ। মন্দিরে কামকলার পূজা-বিধানও রয়েছে।’

‘কিন্তু সে তো তান্ত্রিক-উপাসনার অঙ্গ?’

‘তন্ত্র বিনা কোনো ধরনের উপাসনাই সফল হতে পারে না, শিল্পা। তন্ত্র কী? তন্ত্র আসলে একটি পদ্ধতির নাম, এবং অতি অবশ্যই প্রত্যেক উপাসনারই নিজস্ব একটি তন্ত্র বা পদ্ধতি বিদ্যমান। এবং কামকলার উপাসনা প্রত্যেক তন্ত্রের একটি অত্যাবশ্যকীয় ভাগ। তাছাড়াও এসবের পাশাপাশি মন্দিরের বাইরের দিকে এই ধরনের যৌন-দৃশ্য উপাসকদের পরীক্ষার বস্তুও বটে। তাঁদের ভক্তি, নিষ্ঠা, মনোভাব, ইন্দ্রিয় সংযম এসবই কামকেলির দৃশ্যের মাধ্যমে অতিসূক্ষ্মতার সঙ্গে বিচার করা যায়। ওইসব দৃশ্য দেখে যারই মনে সামান্যতম বিকার জন্মাবে, সে দেবতার কাছেই পৌঁছাতে পারবে না। যদিও বা পৌঁছায়, তাহলে পৌঁছাবে শুধুই তার স্থূল দেহ; তার মন তখনও কামনার অরণ্যে পথ হারিয়ে ফেলবে। আর যে উপাসক এই সব কিছু দেখেও অবিচলিত থাকবে, সে এগিয়ে যাবে ভক্তির পথে, মুক্তির মার্গে।’

‘আমার এত জ্ঞান নেই শিল্পী। তবে আমি চাই, তুমি যা কিছু গড়বে, তার মধ্যে আমার ছায়া থাকুক। আমি তোমার প্রত্যেক শিল্পরূপে নিজেকে দেখতে চাই। তোমার শিল্পের জন্য প্রতিরূপ হয়ে উঠতে আমি উন্মুখ হয়ে আছি।’

‘না শিল্পা, আমি আগেও বলেছি এবং এখনও বলছি, আমার এই কাজের জন্য কোনো ধরনের প্রতিরূপের প্রয়োজন নেই। এই ধরনের দৃশ্যের প্রতিরূপ শিল্পীর মনেই থাককে।’ কথা বলতে বলতেই সুবলের চোখের সামনে একটি অস্পষ্ট মুখের ছবি ফুটে উঠল। তার স্ত্রী বিনোদিনীর পদ্ম-মুখ। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আজ বিনোদিনীর চাঁদমুখখানি বার বার মনে পড়ছে তার। বড় ব্যাকুল লাগছে। বারংবার তার মন একটাই প্রশ্ন করছে আজ, ‘এই জন্মে কি আর বিনোদিনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা সম্ভব হবে? যদি এখানে থাকতে থাকতেই নীলকমল মহারানার মতো আমারও মৃত্যু হয়? তাহলে তো আমার আর বিনোদিনীর, দুজনের অতৃপ্ত আত্মাই চন্দ্রভাগার তটে, কোণার্কের আকাশে কেঁদে কেঁদে ফিরবে। অশরীরী অবস্থায় কি মিলন সম্ভব?’

সুবল অন্যমনস্ক হয়ে উঠেছে। আর অন্যমনস্ক অবস্থায় কোনো শিল্পীর পক্ষেই কাজ করা সম্ভব নয়। সে নিজেকে সংযত করল। ছেনি হাতুড়িকে তাদের কাজে ব্যস্ত করে তুলল সুবল। পাষাণখণ্ডে মূর্তির অবয়ব ফুটিয়ে তুলতে লাগল। শিলাখণ্ডে সূক্ষ্ম অলঙ্কার এবং পরিধানে সজ্জিত নিজের প্রিয়তমার দেহ উৎকীর্ণ করতে করতে সুবল ডুবে গেল অনন্ত ঊর্মিল কল্পনার সাগরে। বয়ে চলল তার লহরে। তার শিল্প হয়ে উঠল একমাত্র সত্য, শিব এবং সুন্দর!

এখন শিল্পা প্রতিদিন আসে। সুবলের সামনে বসে। তবে প্রতিরূপ রূপে নয়। এমনিই। আর কোণার্কের চক্রে সুবল নিজের সূক্ষতম কারিগরি বিদ্যা দিয়ে জীবন-চক্র, কাল-চক্র, সৃষ্টি-চক্রের অদ্ভুত দৃশ্য আঁকতে থাকে।

রথের আকারে নির্মিত মুখশালার পীঠে দক্ষিণ এবং উত্তর দিকে রথ-চক্র তৈরি করার কথা ছিল। বড় দেউল বা প্রধান মন্দিরের দক্ষিণ ও উত্তরে চারটি করে, পূর্বে সিঁড়িতে ডানে-বামে দুটি-দুটি করে চক্র—যার ফলে শিল্পখচিত মন্দিরকে বিশাল রথের মতোই দেখায়। এবং সাতটি অশ্ব এই রথকে টেনে নিয়ে যাওয়ার মুদ্রায় ব্যস্ত থাকবে।

সূর্য-রথের বারোটি চক্র, বছরের বারোটা মাসের প্রতীক। প্রত্যেক চক্রে আটটি করে কাঠি অষ্ট প্রহরের প্রতীক এবং সপ্তাশ্ব সপ্তাহের সাত দিনের প্রতীক। মন্দিরটিকে আসলে জীবন, কাল এবং সৃষ্টি-চক্রের অনন্তকাল অবধি প্রবাহমান হওয়ার প্রতীক হতে হবে।

সুবল ঠিক করল, দক্ষিণ দিকের চক্র শুক্লপক্ষের সংকেতবাহী হবে এবং সেখানে আধ্যাত্মিক জীবনের দৃশ্য উৎকীর্ণ করবে। বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতার, গজলক্ষ্মী, অন্যান্য দেবী-দেবতা, গজারোহী এবং অশ্বারোহী, দেব-উপাসনার চিত্র দক্ষিণ পার্শ্বের চক্রের উপরে চিত্রিত হবে। উত্তর দিশার চক্রে রাত্রির স্পর্শ থাকবে। অন্ধকারে চলা জীবন-ব্যাপার সেই চক্রে উৎকীর্ণ করা হবে। দিন আর রাতের আলো-আঁধারের খেলাই তো জীবন। এটাই যে এই পৃথিবীর মূল রহস্য। তাই উত্তরের পার্শ্ব-চক্রে থাকবে অলস নর্তকী, নারীর কেশবিন্যাস, রমণীর প্রসাধনী এবং নারীর বিবিধ রূপ। এবং সবশেষে থাকবে সৃষ্টির রহস্য—ভোগশয্যা। নারী ও পুরুষের মিলনের দৃশ্য।

সূর্য আলোর উৎস। সূর্যই শক্তি তথা পৌরুষের আধার। সূর্যরশ্মি সত্যের উদ্ঘাটন করে। কোণার্ক-শিল্পীরাও সূর্যমন্দিরকে জীবনের পরম সত্য হিসেবে প্রতিপন্ন করতে দৃঢ়সংকল্প হয়ে কাজে নেমে পড়ল। শিলাগুলির প্রতি কণায় বসন্তের রোমাঞ্চ জেগে উঠল। মহাভারতে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, ‘পাষাণের হৃদয় থাকে না।’ তিনি ভুল বলেছিলেন। কোণার্কে পাষাণের বুকেও হৃদয় স্পন্দিত হয়ে উঠল। হৃদয়ের স্পন্দন যদি না-থেকে থাকে, তাহলে তা ছিল দুজনের—এক, শিল্পীর শিল্পার এবং দুই, সমকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পী সুবল মহারানার।

সুবলের মুখমণ্ডল একটি স্বর্গীয় উজ্জ্বল আভায় প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে। নিজের শিল্পকে উৎকীর্ণ করার কাজে মগ্ন হয়ে আছে সে। শিল্পা স্থিরচিত্রের মতো বসে কিংবা দাঁড়িয়ে থেকে সুবলকে দেখে চলেছে, ‘কী অদ্ভুত! এই তরুণ শিল্পী এভাবে জীবনের চরম এবং পরম সত্যকে উৎকীর্ণ করার সময়েও কতটা নির্বিকার, কতখানি অবিচল এবং কত একনিষ্ঠ! নিজের শিল্পসাধনায় নিমগ্ন এই শিল্পী জিতেন্দ্রিয়। মহান!’

হঠাৎই একটি নীল দীপশিখা হাতে নিয়ে এক রমণী শিবিরে প্রবেশ করলেন। ‘ধন্য তুমি শিল্পী! ধন্য তোমার একনিষ্ঠ সাধনা! যদি তুমি বিরহকাতর ভাব নিয়ে বিকারগ্রস্ত মনে নিজের অবদমিত বাসনাকে ফুটিয়ে তুলতে, তাহলে মূর্তিগুলোর মধ্যে তোমার শিল্পের পরাকাষ্ঠা এভাবে উদ্ভাসিত হতে পারত না। তোমার ছেনি-হাতুড়ি তাহলে হয় বাচাল হয়ে উঠত, নয়তো মূক হয়ে যেত। জিতেন্দ্রিয় পীঠে তুমি চরমতম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছ। কামনা–বাসনার আগুনে ঝলসে মৈথুন-মূর্তি গড়লে কোনও শিল্পীই তার মধ্যে এমন দিব্য ভাব আনতে পারবে না। মানব জীবনে যে নবরসের অস্তিত্বের কথা আছে, তাদের মধ্যে আদিরস প্রণয়কে উপেক্ষা করলে জীবন-চক্রেরই অবহেলা করা হয়, শিল্পী। প্রত্যেকটি রসকে দিব্য ভাবে ফুটিয়ে তুলে তুমি কোণার্ক-শিল্পী রূপে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিয়েছ।’

কথা শুরু হতেই শিল্পীর দৃষ্টি গিয়ে পড়েছিল বক্তার ওপরে। সুবলের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন বীর পরমার্দি দেবের বিধবা পত্নী চন্দ্রাদেবী। তাঁর হাতে ধরা আছে একটি প্রজ্জ্বলিত দীপ। ওই প্রদীপের আলোক নিয়েই চন্দ্রাদেবী যেন শিল্পীকে তার আগামী পথ দেখাতে এসেছেন। যে মাতৃভূমির হিতার্থে চন্দ্রাদেবীর স্বামী নিজেকে যুদ্ধভূমিতে উৎসর্গ করে দিয়েছেন, সেই মাতৃভূমির গৌরব নির্মীয়মাণ কোণার্ককে সম্পূর্ণ হতে দেখাই এখন তাঁর জীবনের একমাত্র আকাঙ্ক্ষা। এমন নারী বরেণ্য।

সুবল মহারানা চন্দ্রাদেবীকে ভক্তিভরে প্রণাম জানাল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা কথা মনে পড়তে চমকে উঠল সে, ‘কী সর্বনাশ! এখন যে এখানে শিল্পাও উপস্থিত রয়েছে! চন্দ্রাদেবী ওকে দেখে ফেললে কী হবে? শিল্পার নামে তখন কুৎসা রটবে। আচ্ছা, চন্দ্রাদেবীর মতো একজন মহীয়সী নারী কি এসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাবেন?’

শিল্পার দিকে তাকাল সুবল। কিন্তু কোথায় শিল্পা? তার বসার স্থান তো শূন্য! স্বপ্ন ভেঙে গেলে যেভাবে মানুষ স্বপ্ন আর সত্যির অন্তর বুঝতে চেষ্টা করে, সেভাবেই নিজেকে বোঝানোর প্রয়াস করতে লাগল সুবল মহারানা। তবে কি শিল্পা সত্য নয়? কুহেলিকা? কল্পনামাত্র? নাহলে কোনো মানুষ কি এত দ্রুত চোখের সামনে থেকে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে? তাহলে কি সুবল যাকে শিল্পা বলে মনে করছিল, সে আসলে তার শিল্পীমনের ঘোর, যা সাকার হয়ে উঠে এসে তার কাজের প্রতিরূপ হতে চাইছিল? তবে কি তার কল্পনাশক্তি এত প্রবল, এত প্রগাঢ় যে, তা এইভাবে সাকার রূপ ধারণ করতে পারে? নাহ্, একথা সুবল কখনো ভাবতেও পারেনি। সুবল মনে মনে বলতে থাকে, ‘ওহ্, তাহলে শিল্পা সত্য নয়! কিন্তু তার কথাগুলো? সেগুলোও কি কল্পনা? নিজেরই নিজেকে বলা? না, না! এ হতে পারে না। শিল্পা শুধু কল্পনার ফসল হতেই পারে না! সে নৃত্যাচার্য সৌম্য শ্রীদত্ত দীক্ষিতের কন্যা। সে আছে! সে অবশ্যই আছে!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *