সূর্য বিনোদিনী – ৬

আমার অপরূপা বান্ধবী গল্প বলতে বলতে এবার একটু বিরাম নিলেন। তাঁর কথা থেমে যেতে আমিও যেন এক অদেখা কালখণ্ড থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম। কাহিনির অর্কক্ষেত্রে বিচরণ করতে করতে মনে হচ্ছিল আমিও যেন ওই পর্বের এক চরিত্র।

এই গল্পটা আমার মুখে শুনতে আপনাদের কেমন লাগছে তা জানি না, কিন্তু আমি কথকঠাকুরণের কথার গুণে বিভোর হয়েই শুনছিলাম। কথার মাধুরীতে স্তম্ভিত এক পাষাণের মতোই। ইশ, যদি সুবল মহারানার হাতে পড়ে আমিও কোণার্কের ভিতেই কোথাও মিশে থাকতে পারতাম!

‘কী হল শুরু করুন এবার!’

আমার বন্ধুনীটি স্মিত হেসে আবার বলতে আরম্ভ করলেন…

‘দেখেছেন কিনা জানি না, নাটমন্দিরের পীঠে পূর্ব দিকের দ্বারের সিঁড়িতে একটি মূর্তি আছে। সেই মূর্তির পায়ের কাছে শিলালেখতে খোদাই করা আছে–সো মাহ চৈ। অন্য কোনো মূর্তির নীচে কিন্তু এই ধরনের কোনো শিলালেখ কিছু লেখা মেলে না। ওটা আসলে সৌম্য শ্রীদত্তর মূর্তি। সুবল মহারানা মনপ্রাণ উজাড় করে ওই মূর্তিটা গড়েছিল।

সোয়া হাত উঁচু আর আধ হাত চওড়া একটি আসনের উপরে দণ্ডায়মান মূর্তিকে ঘিরে নৃত্যভঙ্গিমায় উৎকীর্ণ নর্তক–নর্তকীর দল। নৃত্য-গুরুর পরিধেয় বস্ত্রটিও কোমর থেকে পা অবধি খোদাই করে সৃষ্টি। মাথায় পাগড়ি, কানে মকরাকৃতি কুণ্ডল, বুকে পদক খচিত রত্নহার। হাতে গিনি বাজিয়ে তিনি নৃত্যের নির্দেশনা করছেন। বাঁ হাতে ধরা গিনি বুকের নীচে অবস্থান করছে। ডান হাতেও একটা গিনি আছে। কপিত্থ মুদ্রায় বাম হাতের গিনিতে ঠাপ দেওয়ার জন্য উদ্যত ডান হাতে গিনি ধরা।

এখন সময়ের গ্রাসে ধূলিস্মাৎ হয়েছে নাটমন্দিরের ছাদ। নাটমন্দিরের শীর্ষে নির্মিত গর্ভমুদ্রাও রোদে–জলের আঘাত সহ্য করে মুক্ত আকাশের নীচে পড়ে রয়েছে। এই গর্ভমুদ্রা সুবল মহারানার স্পর্শধন্য। দুটি স্তরের পাপড়ি সম্পন্ন পূর্ণ বিকশিত পুণ্ডরীক। এক মহান শিল্পীর শিল্প নৈপুণ্যের নিদর্শন।’

‘আচ্ছা, গর্ভমুদ্রা কী?’ শিল্পকলা সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না বলে প্রশ্নটা করতে বাধ্য হলাম।

‘মন্দিরের ছাদের ভিতরের দিকে কেন্দ্রে একটা অধোমুখ পুষ্পের আকৃতি খোদাই করা হয় দেখেছেন? বাস্তুশিল্পের প্রতিমান প্রত্যেক মন্দিরে এটা দেখা যায়। আজকাল যেসব মন্দির তৈরি হয় সেখানে এধরনের কাজ করাই হয় না, আর এখনকার দর্শনার্থীরা প্রাচীন মন্দিরে শুধু বিনোদনমূলক ভ্রমণের জন্য যান। মন্দিরে, ধর্মে বা মন্দিরের শিল্পে তাঁদের আগ্রহ না-থাকায় গর্ভগৃহে প্রবেশ করেন না। তাই গর্ভমুদ্রার ব্যাপারে জানতেও পারেন না। কিন্তু যারা প্রবেশ করেন, তাঁরা দেখতে পান।

আকাশে সূর্য থাক বা না-থাক, এই শিলাপদ্ম অনন্ত প্রতীক্ষা নিয়ে গর্ভগৃহে প্রবেশ করা দর্শনার্থীদের দিকে তাকিয়ে থাকে। সূর্যদেব নিজে কখনো পৃথিবীর বুকে নেমে আসেন না। তিনি নিজের দুই পত্নী সংজ্ঞা এবং ছায়ার সঙ্গে বিশ্ব-পরিক্রমা করেন। কিন্তু তাঁদের নৈসর্গিক প্রেমের প্রতীক এই শিলাপদ্ম। ভারতীয় নারী পদ্মের এই নিষ্ঠা রাখেন নিজের স্বামীর জন্য, এই নিষ্ঠা নিয়েই একজন ভারতীয় রমণী নিজের স্বামীর অনুপস্থিতিতে তাঁর জন্য অপেক্ষা করেন। সেই স্বামী দেবতা হোক বা রাক্ষস, স্ত্রী’র কিছুই যায় আসে না। সেই নারী এই একনিষ্ঠ প্রেম নিয়েই বাঁচে, এবং এই একনিষ্ঠ প্রেমকে আলিঙ্গন করেই তার মৃত্যু হয়।

এই গর্ভমুদ্রা আসলে কোণার্ক মন্দিরের ওই বারোশো শিল্পীদের প্রিয়তমাদের একনিষ্ঠ প্রেমের পাষাণ প্রতিরূপ, যার মহিমায় বশীভূত হয়েই কোণার্ক-শিল্পীদের ঘরণীরা বারো বছর ধরে নিজ নিজ স্বামীর পথ চেয়ে নির্নিমেষ ভাবে কাটিয়ে দিয়েছিলেন।’

‘আপনার কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছে এই ভগ্ন কোণার্ক, সুবল মহারানার ত্যাগ এবং বেদনার অবিকল প্রতিরূপ। সুবল, তাঁর স্ত্রী, এবং কোণার্ক-মন্দিরের নির্মাণের কাজে লিপ্ত ওই বারোশো শিল্পী ও তাঁদের প্রিয়তমাদের কথা ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।’

‘এইটুকুতেই মনখারাপ হয়ে গেল? এখনও তো আমি কাহিনির অর্ধেকটাও বলিনি। শুনুন শুনুন, আগে একটু ধৈর্য ধরে ঘটনাটা শুনুন…

সূর্যদেবতা তখনও সাগর-স্নান সেরে ওঠেননি। সুবল মহারানা একটা বিশাল বেলেপাথরের সামনে দাঁড়িয়ে কী যেন ভেবে চলেছে। সম্ভবত নাটমন্দিরের জন্য একটি নৃত্যমূর্তি খোদাই করার আগে আগে সে নিজের কল্পনাশক্তিকে ধার দিয়ে নিচ্ছে। কীভাবে গড়ব? সুডৌল দেহযষ্টি, কমনীয় দেহবল্লরী, অথবা অলংকার জড়ানো? কীভাবে গড়া ঠিক হবে? সুগঠিত দেহের ওপর অলংকরণের উৎকর্ষতা সম্পন্ন এক অপূর্ব লাস্যময়ীর ভঙ্গিমায় চিরন্তন শিল্পও বিস্ময়কর হয়ে উঠবে। হয়ে উঠবে অপার আনন্দের খনি। স্থাপত্য আর ভাস্কর্য একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠবে তখন।

দেহে অলংকরণের একটা কাল্পনিক চিত্র সুবলের মনে এসে গিয়েছে, কিন্তু নৃত্যমূর্তির অঙ্গসৌষ্ঠবের নিখুঁত বিবরণী এখনও কল্পনার সঙ্গে লুকোচুরি খেলে চলেছে। এমন সময় শব্দ ভেসে এল ছম…ছম…! ছম…ছম…! ছম…ছম…! দূর থেকে ক্রমশ কাছে আসতে থাকা ধ্বনি শুনে সুবল অবাক হল। একটি সুন্দর লয়-তাল আবর্তিত হচ্ছে। সেই ধ্বনি উত্তরোত্তর তীব্র হচ্ছে, আরও তীব্র।

কে? কোনো দেবদাসী বুঝি? তবে কি আচার্য শ্রীদত্ত সুবলের জন্য কোনো প্রতিরূপের ব্যবস্থা করেছেন? নাহলে কী-ই বা হবে, কে-ই বা হতে পারে? কে জানে তাকে কেমন দেখতে? তার ভাবে, মুদ্রায় কি স্বর্গীয় আভা বিচ্ছুরিত হবে? বাস্তবের লালিত্য কি কল্পনার মাধুর্যকে পরাজিত করতে পারবে? আচার্য শ্রীদত্ত কি তবে সুবল মহারানার কল্পনায় আস্থা রাখতে পারলেন না? কল্পনার অসীম বৈভবের সামনে বাস্তব সদা দরিদ্র—একথা কি আচার্য বোঝেন না?

মনে মনে এসব চিন্তায় মগ্ন থাকলেও আগত ধ্বনির উদ্দেশে কান খাড়া করে, দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বসে ছিল সুবল। এমন সময় যেন একটি নৃত্যমূর্তিই সশরীরে বায়ুতে ভেসে তার সামনে এসে দাঁড়াল।

সুবল মহারানা হতবাক হয়ে গেল। মনে তার একটাই প্রশ্ন, তবে কি আমার কল্পনা স্বয়ং সাকার হয়ে উঠল? কল্পনা কি এভাবে প্রাণ পেয়ে জীবন্ত হয়ে ওঠে? কে এই দেবকন্যা? অন্য কোনো শিল্পীর প্রতিরূপ হতে আসা কোনো দেবদাসী নয় তো? না, তা-ও নয়। সুবল তাদের প্রত্যেককেই দেখেছে। খুব ভালো করে নিরীক্ষণ না-করলেও তাদের মুখ ভুলে যাওয়ার কথা কিন্তু নয়।

তবে কি এই অপ্সরা আজ সুবল মহারানার শিল্পকর্মের প্রতিরূপ হতে উপস্থিত হয়েছে? এ জগতে কি কোনো নারীর এমন রূপ থাকাও সম্ভব? যা দেখছে, তা স্বপ্ন নাকি সত্য যাচাই করতে নিজের হাতের ছেনির ছুঁচলো মুখটা নিজের আঙুলে বিঁধে দেখল সুবল। রক্তের একটি ফোঁটা আঙুলের মাথায় বিনবিন করে উঠল। নাহ্, এ তো স্বপ্ন নয়! সত্যিই এক অপ্সরা দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে।

সুবল সর্বপ্রথম তার দুই নূপুরধারী পায়ের দিকে তাকাল। পা-জোড়া তো নয়, আধফোটা দুটি পদ্ম-প্রসূন যেন! পদ্ম কোরকের সাহায্যে উদিত সূর্যের আভায় দুটি লঘু আলতারেখা। সুবলের সঙ্কুচিত দৃষ্টি ক্রমশ উপরে উঠতে লাগল এবং ওই অপ্সরার সুঠাম দেহকে স্পর্শ করতে করতে তার মুখের উপর গিয়ে নিবদ্ধ হল। দৃষ্টি স্থির হল বটে, কিন্তু অন্তরের নিঃসঙ্গতা যেন কোনো এক তীব্র আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। এত রূপ, এত রূপ, বুকের মাঝে কোলাহল পড়ে গেল! এত লাবণ্য! এমন স্বর্গীয় ভাবমুদ্রা! সুবলের মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল, এ কি আমার জন্য প্রতিরূপ হবে? আমার হাতে কি এমন সামর্থ্য আছে যে এই রূপকে আমি পাষাণের বুকে জীবন্ত করে তুলতে পারব?

সুবল নিজেই পাষাণে পরিণত হয়ে গেল—স্তম্ভিত, হতবাক। তার চোখের পলক পড়া বন্ধ হয়ে গেল। ওই অপলক দৃষ্টি নিয়ে সে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল সজীব মূর্তিটির পানে।

ব্যাপারটা কঠিন হলেও নিজের মনের উদ্দাম দোলনকে দ্রুত বশে এনে ফেলল সুবল। সে এখন তপস্বী। সূর্যপীঠে আগামী বারো বছর অখণ্ড ব্রহ্মচর্য পালনে ব্রতী এক সন্ন্যাসী। এখন যদি সে তপভ্রষ্ট হয়, ইন্দ্রিয় নিগ্রহে অসফল হয়, বিচলিত হয়, উদ্বেলিত হয়, শিল্পের উৎকর্ষ সাধনার পথে স্খলিত হয়, তাহলে তার শিল্পী-ধর্ম আহত হবে। আর ওদিকে, তার প্রাণপ্রিয়ার গহন বিশ্বাস, অকল্পনীয় বিরহ এবং অখণ্ড সতীত্ব…তার কী হবে? তাই এই বিচলন অনুচিত। সুবল মহারানা নিজেকে সংযত করে ফেলল।

তবে কি সে মানা করে দেবে? না, না! তা হয় না। এই ব্রহ্মচর্যের দাবদাহে স্পর্শ করতে না-পারি, প্রতিরূপকে দেখার সুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবে কেন?’ ভয়ানক দোলাচলে ভুগতে থাকা সুবলের মনে একের পর এক প্রশ্ন জাগতে থাকে, ‘কে এই কিশোরী? এই কোমল ফুলের মতো মেয়েটিকে পাথরের দেবতার কাছে অর্পণ করে কোন পাষণ্ড একে দেবদাসী হতে বাধ্য করেছে?’

কিশোরী মৌন হয়েই দাঁড়িয়েছিল। তবে কি মেয়েটি মূক ও বধির? নাকি মৌন ব্রত ধারণ করেছে সে? হায় রে দেবদাসীর জীবন! পাষাণের দেবতাকে অর্পিত প্রাণ! যৌবনের উদ্দাম আকাঙ্ক্ষা, কামনা, বাসনা, প্রণয়, পরিণয়, মাতৃত্ব সব কিছু বর্জিত। স-ব কিছু নিষিদ্ধ! দেবতাদের মনোরঞ্জনের জন্য যাদের জীবন উৎসর্গীকৃত, তাদের কি মন বলে কিছু থাকতে পারে না? তাদের হৃদয়ের ভাবনার কি কোনো মূল্য নেই? মানুষ হয়েও আর পাঁচটা মানুষের মতো চাহিদা রাখাটা কি পাপ? কিন্তু কেন?

অনেক অনেক প্রশ্ন আছে, কিন্তু একটার উত্তরও সুবলের জানা নেই। মানুষ নিজের আরাধ্য দেবতাকে সবসময়েই পবিত্রতম, স্নিগ্ধতম এবং অন্যতমটুকুই সমর্পণ করার কামনা রাখে, তবুও সুবল এটা মেনে নিতে পারে না যে, দেবদাসী দেবার্পণীয়।

মহারাজা চোড়গঙ্গ দেবের শাসনকাল থেকেই জগন্নাথ দেবের মন্দিরে দেবতাদের সমক্ষে নৃত্য–গীত পরিবেশনের জন্য দেবদাসী নিয়োজিত হয়ে এসেছে। মন্দিরের পক্ষ থেকে দেবদাসীদের আবাসস্থল, ভূমি এবং সমস্ত আবশ্যকীয় বস্তুর বন্দোবস্ত করা হয়ে থাকে। অন্যান্য সম্পত্তিও যথেষ্ট দান করা হয় তাদের। দাস-দাসীর অভাব থাকে না তাদের। কিন্তু এটুকুই কি পর্যাপ্ত? আর এই দেবদাসীরা কারা? কোথা থেকে নিয়ে আসা হয় এদের? আচার্য শ্রীদত্ত একে কোন রহস্য-মঞ্জুষা থেকে বের করে এনেছেন ভগবান জানে? কিন্তু এই কিশোরী এমন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে কেন? মনে মনে ভাবল সুবল। সুবলের বড় কৌতূহল হল। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘ওহে, কিছু বলছ না কেন? কে তুমি?’

হাওয়ার পরশে যেভাবে ফুলের পাপড়ি তিরতির করে কাঁপতে থাকে সেভাবেই কেঁপে উঠল সুন্দরীর অধর, ‘আপনি কে? প্রথমে আপনার পরিচয় দিন।’

সুবল আশ্চর্য হয়ে ভাবে, ‘অদ্ভুত! আমারই শিবিরে এসে আমাকেই আমার পরিচয় জানতে চাইছে? কে এই বালিকা?’ মুখে সে বলে, ‘আমি মন্দির নির্মাণের কাজ নিয়োজিত একজন সামান্য শিল্পী। আমার নাম সুবল মহারানা।’

এক বিরল বিলাসময় লাস্যের ভঙ্গিমা মুখে এনে কিশোরী বলল, ‘তাহলে আমি শিল্পা, শিল্পী। শিল্পীর শিল্পা।’

অজানা এক আবেগে সুবলের সারা দেহে শিহরন খেলে গেল। কিশোরীর উত্তরে লুকিয়ে রয়েছে এক গূঢ় ব্যঞ্জনা। মন থেকে ভাবনার জাল ছিন্ন করে সুবল বলল, ‘বাহ, ভারি অপরূপ কথা বললে তো! শিল্পের প্রতিরূপ হলে তাকে শিল্পা-ই বলা হবে বইকি। কিন্তু তোমার আসল নাম কী? কী পরিচয়? কোন মন্দিরের দেবদাসী তুমি?’

কিশোরী মুখ খুলতেই যেন বেজে উঠল বীণার মধুর স্বরলহরী, ‘আমার নাম সত্যিই শিল্পা। আমি নৃত্যগুরু আচার্য সৌম্য শ্রীদত্তের কন্যা। এবং সূর্যদেবের চরণে স্বেচ্ছায় সমর্পিতা।’

সুবলের তরুণ হৃদয়ের মৃদুল তরঙ্গ স্তম্ভিত হয়ে গেল। আচার্য শ্রীদত্তর দুহিতা হবে কিনা সুবল মহারানার শিল্পের প্রতিরূপ? মন এক অদ্ভুত সম্ভ্রমে ভরে উঠল। এই ফুলের মতো কোমল কন্যা কি শিল্পের প্রতিরূপ হওয়ার মতো কষ্টসাধ্য কাজ করতে পারবে?

‘শিল্পের প্রতিরূপ হয়ে ওঠার কাজ কিন্তু খুব কঠিন, কিশোরী। ধৈর্য, নিষ্ঠা, একাগ্রতা এবং গভীর অনুরাগ নিয়ে দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই স্থানে, একই ভঙ্গিমায় স্থিরভাবে বসে থাকতে হবে। পারবে তুমি?’

কিশোরী মৃদু হাসল। মনে হল, কোনও এক কোমল পুষ্প অতি সন্তর্পণে তার পাপড়িগুলো মেলে ধরল। তারপর বলল, ‘তা পারব না কেন? অবশ্যই পারব।’

‘কিন্তু প্রতিরূপ হিসেবে আচার্য তোমাকেই কেন পাঠালেন? এই কাজ তোমার যোগ্য নয়, কিশোরী।’

‘আমি এখানে স্বেচ্ছায় এসেছি। আমার পিতা এই সম্বন্ধে কিছুই জানেন না।’

‘অন্যায় করেছ। আচার্যকে না-জানিয়ে অন্যায় করেছ তুমি, কিশোরী।’

‘কিশোরী! এ আবার কেমন সম্বোধন? শিল্পা! শিল্পী, আমার নাম শিল্পা! সম্ভবত নিয়তি কোনো বিশিষ্ট প্রয়োজনেই আমার নাম শিল্পা স্থির করেছে।’

‘আমার নামও শিল্পী নয়। সুবল…সুবল মহারানা!’

‘না…তুমি শিল্পী…আর আমি শিল্পা!’

সুবলের মনে হল যেন বঙ্গোপসাগর থেকে পূবের হাওয়া উড়ে এল চন্দ্রভাগার তটে। কেতকী বনের সুরভীতে ম’ম’ করে উঠল চারিপাশ—তুমি শিল্পী…আর আমি শিল্পা!

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। কিন্তু তোমার পিতার অজ্ঞাতে এইভাবে তোমার প্রতিরূপ হতে চাওয়া অনুচিত। আগে আচার্যের অনুমতি নিতে হবে।’

‘আমি মনে মনে নিজেকে একজন দেবদাসী রূপে সূর্যদেবতার চরণে অর্পণ করেছি। আমার পিতা বলেন যে, তোমার ছেনিতে পাষাণে শিল্প ফোটে, তোমার হাতে কোণার্কের পাষাণ-বাগিচায় উৎকলের শিল্প অমর হতে চলেছে। শিল্পী, আমিও অমর হতে চাই। তোমার শিল্পের প্রতিরূপ হয়ে আমিও এই পাথরের বুকে উৎকীর্ণ হতে চাই। কোণার্কের এইসব শিলাখণ্ডে সমাহিত হয়ে যুগের পর যুগ বেঁচে থাকতে চাই আমি! আমার পিতা আমার ইচ্ছার কথা শুনলে আমাকে অনুমতি দেবেন না। আমি নিজের সমস্ত কামনা, সকল বাসনা, সব ভাবনা স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে দিয়েছি, কারণ তাদের কেন্দ্র হয়ে ওঠার যোগ্য ব্যক্তি আমার পরিধির বাইরে ছিল। এখনকার এই জীবনে তোমার শিল্পের প্রতিরূপ হয়ে অমর হয়ে যাওয়াই আমার এক এবং একমাত্র কামনা, শিল্পী। আমার এই কামনাকে পূর্ণ করার ক্ষমতা কেবল তোমারই আছে। এই অনুপম নির্মাণে যদি আমার যৎকিঞ্চিত অবদানও থাকে, তবে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব। তোমার শিল্পের প্রতিরূপ হয়ে ওঠার জন্য আমার পিতার আজ্ঞা নয়, তোমার অনুমতি এবং সহমত প্রয়োজন। বলো না শিল্পী, আমাকে অমর করে দেবে তো?’

‘শাস্ত্রীয় নৃত্যের জ্ঞান আছে তোমার?’

‘বিধিবত কোনো শিক্ষা আমার নেই, কিন্তু আমি নাট্যাচার্য সৌম্য শ্রীদত্ত দীক্ষিতের কন্যা। আমার পিতা নিজের শিষ্যদের যা শেখাতেন, আমি তা-ই অভ্যাস করে গিয়েছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, আমি আমার পিতার পরিকল্পিত নাট্যমন্দিরের যোগ্য নৃত্যমূর্তির জন্য উপযুক্ত প্রতিরূপ হয়ে উঠতে পারব। এছাড়াও তুমি তো আছই। তাই না? কোথাও কোনো ভুল-ত্রুটি হলে তুমিই বুঝিয়ে দেবে। পিতা বলেন যে, তুমি নাকি নৃত্যশাস্ত্রেও সমান প্রাজ্ঞ।’

‘কিন্তু তোমার এই পদক্ষেপে যদি আচার্যের আপত্তি থাকে? যদি তিনি ক্ষুণ্ণ হন?’

‘আমি আমার পিতা, নৃত্যগুরু সৌম্য শ্রীদত্ত দীক্ষিতের কাছে সাকার নৃত্যকলা। আমাকে না-দেখতে পেলে তিনি তাঁর নৃত্যের বিদ্যাই ভুলে যাবেন। আমার মুখ, আমার চোখ, আমার চলার ছন্দ দেখেই তাঁর মনে সঙ্গীত ফোটে। তিনি বলেন, যেদিন নাকি আমি তাঁর থেকে দূরে চলে যাব, সেইদিন তাঁর শিল্পশক্তি লোপ পাবে। পিতা আমাকে দূরে সরিয়ে রাখতেই পারবেন না। আমি স্বেচ্ছায় নিজেকে সূর্যদেবতার পায়ে অর্পণ করে দিয়েছি। এই সূর্যমন্দিরের কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গেলে এখানেই দেবদাসী রূপে থেকে যাব। পিতা জানেন আমি সূর্যদেবের কাছে সমর্পিতা, তাই আমাকে ফেরানোর চেষ্টা তিনি করবেন না। এমতাবস্থায় তিনি আজীবন আমারই সঙ্গে থেকে যাবেন। আমার শুধু তোমার অনুমতি চাই, শিল্পী। শুধু তোমার…’

সুবলের মন এখন ভিন্ন এক দোলাচলে বিচলিত, ‘এই আবেগপ্রবণ কিশোরী এখনও নিজের পিতার স্নেহজালে আবিষ্ট হয়ে আছে। কাল যদি যৌবনের ঢেউ এসে ওর হৃদয়কে আলোড়িত করে তোলে, তখন কী হবে? যখন ওর মনের শ্রাবণ-মেঘ কোনো সাগরের বুকে বৃষ্টি হয়ে ঝরার জন্য আতুর হয়ে উঠবে, তখন? ও নিতান্তই কিশোরী, তাই আবেগে বশে এমন কঠিন পণ করে বসেছে। ওকে বোঝাতে হবে, বোঝাতেই হবে!’

‘শিল্পা, তোমায় কিছু কথা বলি। জীবনের বহু রূপ, অনেক স্তর। কতটুকুই বা দেখেছ তুমি? জীবনের সঙ্গীতের কতটাই বা শুনেছ তুমি? যেদিন সেই সঙ্গীত তোমার কানে প্রবেশ করবে, তোমার হৃদয়কে স্পর্শ করবে, সেইদিনই জেগে উঠবে তোমার প্রাণ। তোমার করা প্রতিজ্ঞা সেইদিন চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে। জীবনকে না-জেনে, না-বুঝে এ ধরনের কোনো প্রতিজ্ঞা করে ফেলা মুর্খামির কাজ। ফিরে যাও। আমার কোনো প্রতিরূপের প্রয়োজন নেই। আমার প্রতিরূপ আমার মনে মণিকোঠায় সাজানো রয়েছে।’

পুবের রক্তিম আভায় নীল আকাশ যেভাবে ধীরে ধীরে আলোকরঞ্জিত হয়ে ওঠে, ঠিক সেভাবেই শিল্পার লাজুক হাসিতে ভরে উঠল তার মুখ। ফুটে উঠল এক অনির্বচনীয় মাধুর্য।

‘আমি জানি শিল্পী, তুমি একজন বিবাহিত পুরুষ। তাই তো আগেই বলেছি, আমার কামনার কেন্দ্র আমার পরিধির বাইরে…। কিন্তু আমাকে একটা কথা বলো, তুমি বা তোমার মতো এই বারোশো শিল্পীর মধ্যে অনেকেই তাদের পরিণীতা, প্রিয়তমাদের ছেড়ে এখানে কেন এসেছে? তাছাড়া, যারা অবিবাহিত, তাদের কামনার ফুল কি শুকিয়ে গিয়েছে? এই বারোশো শিল্পী যখন নিজের নিজের স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে, তখন ওদের দেহ থেকে অনঙ্গ, আর মন থেকে বসন্ত বিদায় নেবে। তোমার কিংবা ওদের এই ত্যাগে আর উৎসর্গে কি আমার মতো একজন কলিঙ্গ-কন্যার এইটুকু ভাগ থাকতে পারে না? একজন মেয়ে বলেই কি আমার কোনো কর্তব্য নেই? কোনো অধিকার নেই?’

সুবল আত্মবিস্মৃত হয়ে গেল। ভুলে গেল তার নিজের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ, কর্তব্য, পণ-প্রতিজ্ঞা সবকিছু। চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হতে লাগল সমগ্র চরাচর। চতুর্দিকে ফুটে উঠতে লাগল শুধু শিল্পারই মুখ। শিল্পা…শিল্পা…শিল্পা…শিল্পা…। বিভিন্ন নৃত্য-মুদ্রায় ও ভঙ্গিমায় শুধুই শিল্পা।

‘শিল্পা, তোমাকে জন্ম দিয়ে এই উৎকল ধন্য হয়েছে। তোমার রূপ, গুণ এবং মহান চিন্তাধারার কথা সাধারণ বাক্যে প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই। যদি সুবল মহারানার হাতের ছেনি তোমার এই রূপের এক কণাও পাথরের বুকে খোদাই করতে পারে, তাহলে জানবে সুবল মহারানা নিজেই ধন্য হবে। তোমার এই সুন্দর দেহের ললিত ভঙ্গিমা, কোমল ভাবমুদ্রা যদি তুমি নিজে দেখতে পেতে, তাহলে হয়তো তুমি অনুভব করতে পারতে যে তুমি কী বা তুমি কে? আমি আমার মানসী বিনোদিনীর পাশাপাশি প্রত্যক্ষ শিল্পাকেও এই পাষাণে ঢেলে দিতে চেষ্টা করব।’

এরপর থেকে সুবল মহারানার কল্পনা মনে বিনোদিনী আর চোখে শিল্পাকে রেখে পাষাণকে নিত্য নতুন রূপ দিতে লাগল। তার মনের অনুরাগ এবং প্রেম তার হাতের ছেনি দিয়ে জীবন্ত করে তুলতে লাগল পাষাণকে। পাথরের বুকে ছেনির আঘাতে সঙ্গীত জন্ম নিতে লাগল ছন…ছন…ছন…ছন…ছন…ছন…।

মহারাজ নৃসিংহ দেবের শাসনে শুধু নৃত্য-গীতই নয়, সাহিত্যও চরম উৎকর্ষতা লাভ করেছিল। কাব্য, ব্যাকরণ, দর্শন, বিজ্ঞান, অলঙ্কার-কোষ, জ্যোতিষ শাস্ত্র, স্মৃতি, আয়ুর্বেদ এবং যুদ্ধবিদ্যা ইত্যাদি নানান বিষয়ের উৎকৃষ্ট সব গ্রন্থে ভরে উঠেছিল উৎকল-সাহিত্যের ভাণ্ডার।

নির্মাণপর্বেই কোণার্কের খ্যাতি দূর দেশে পৌঁছে গেল। দেশ-বিদেশের ব্যবসায়ীরা উৎকলের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন। শুধু শিল্প এবং সাহিত্যেই নয়, কৃষি ও বাণিজ্যেও নিরন্তর প্রগতি হয়ে চলেছিল। লোকমুখে তখন একটাই কথা—উৎকলের মাটি স্বর্ণগর্ভা; যেখানেই খুঁড়বে, সেখানেই পাবে হিরে, নীলা, মণি-মাণিক্য। আর সত্যি বলতে কী, এ শুধু কথার কথা ছিল না। হিরের ব্যবসায় উৎকলের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল দূর-দূরান্তে। সম্বলপুরের খনি থেকে এত হিরে উঠত যে, হয়তো এক-একবারেই তাতে গাঁথা হয়ে যেত তিন-সাড়েতিন ভরির হার। বহু স্থানে লৌহ আকরিকের খনির সন্ধান মিলল। ভুবনেশ্বরে আরম্ভ হল লৌহ-ধাতুকর্ম। পাটবস্ত্র, সৈন্ধব লবণ, কার্পাস, এলাচ–লবঙ্গ ইত্যাদি মশলাদ্রব্য, সুপারি, পিতলের তৈজসপত্র এবং উৎকলীয় হস্তির চাহিদা দেশ-বিদেশে বেড়েই চলেছিল। সমুদ্রপথে উৎকলের হাতি বিদেশে পাঠানো হতো। সিংহল, স্বর্ণদ্বীপ, জাভা, ব্রহ্মদেশ, চিন থেকে ব্যবসায়ীরা উৎকলে এসে ব্যবসা করতে শুরু করল।

উৎকলের শিল্প এবং ভাস্কর্যের আদরও দিনে দিনে বাড়ছিল। বিদেশিরা সোনার দামে উৎকলের শিল্পীদের শিল্পকর্ম কিনছিল। বিদেশি অতিথিরা উৎকলে এলে আতিথেয়তা দেখে মুগ্ধ হয়ে যেতেন। রাজনৈতিক সম্বন্ধকে সুদৃঢ় করে তোলার জন্য উপহারের আদান-প্রদান ক্রমশ বেড়ে চলেছিল উৎকলে। নৃসিংহ দেব নিজেই বেশ কয়েকজন রাজাকে শ্বেত হস্তী উপহার দিয়েছিলেন। আর ওদিকে সুবলের সাহায্যে বিশ্বমৈত্রীকে শিলাবক্ষে অমর করে তুলছিলেন বিশু মহারানা। তিনি সুবলকে নির্দেশ দিয়েছিলেন—যেন কিছু চিত্রে বিদেশি অতিথিদের দ্বারা উৎকলের উপহার প্রাপ্তির ঘটনাও দর্শিত হয়। বেশ কয়েকটি পটে রাজার উপহার-প্রাপ্তির ঘটনাও চিত্রিত হল।

কিন্তু বিশু মহারানা ওইসব চিত্রে উৎকলের রাজার দ্বারা বিদেশিদের শ্বেত-হস্তী উপহার দানের দৃশ্য চিত্রিত করালেন না। ব্যাপারটা শিবেই সান্তারার দৃষ্টি এড়াল না। তিনি মহারাজের সামনেই বিশু মহারানাকে এই নিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘বিশু মহারানা, আপনি উত্তর দিচ্ছেন না কেন? মহারাজ দ্বারা প্রদত্ত উপহারের দৃশ্য কেন চিত্রিত করা হল না?’

বিশু মহারানা গম্ভীরভাবে বললেন, ‘ক্ষমা করবেন, মন্ত্রীমশাই। এটা করা উচিত হবে না।’

‘কিন্তু কেন? কী এর কারণ?’ শিবেই সান্তারার কণ্ঠে ক্ষোভ স্পষ্ট। তাঁর মনে হল, বিশু মহারানা যেন তাঁর কথা শুনতেই পাচ্ছেন না।

‘ব্যক্তি কার থেকে কী উপহার পাচ্ছে, তা হৃদয়ে গাঁথা থাকার কথা, আঁকা থাকার কথা, শিলায় খোদিত হওয়ার যোগ্য। কিন্তু সে কাকে, কী দান করছে, তা বিজ্ঞাপনের বিষয় হতে পারে না, মাননীয়। গ্রহীতা যদি দাতাকে স্মরণ করে, তবেই গ্রহীতা এবং দাতা উভয়ের মাহাত্ম্য থাকে, কিন্তু দান করে তা ভুলে গেলেই দাতার মাহাত্ম্য প্রকাশ পায়। উৎকল-নরেশ কর্তৃক উপহার রূপে শ্বেত হস্তী প্রদান কোণার্কের বুকে চিত্রিত করলে তা হবে উৎকলের অতিথিপরায়ণতার অপমান। সবিনয় নিবেদন করছি, এই কাজ উৎকলের কোনো শিল্পীকে করতে বাধ্য করবেন না,’ এবারে উত্তরটা দিল সুবল মহারানা।

এই উত্তর শুনে নৃসিংহ দেব অভিভূত হয়ে গেলেন, ‘ধন্য তুমি শিল্পী, ধন্য! তোমার যথাযোগ্য সম্মান করতে পারিনি আমি।’

‘মহারাজের স্নেহই আমার সম্মান,’ সুবল মহারানার কণ্ঠে বিনয় প্রকাশ পেল।

‘এ তোমার মনের ঔদার্য, শিল্পী। শিল্পীর মন আকাশের মতো বিরাট না-হলে কোণার্কের দৃশ্য মহাকালের আঁচড় সহ্য করে যুগ-যুগান্ত ধরে কীভাবে তার অস্তিত্ব বজায় রাখবে? কিন্তু আমার মনে অন্য একটা প্রশ্ন আছে—।’

‘কী প্রশ্ন, মহারাজ?’

‘কোনো চিত্রেই শিল্প উৎকীর্ণকারী শিল্পীকে দেখতে পাচ্ছি না। ইতিহাস কোণার্ক-নির্মাতা রূপে নৃসিংহ দেবকে স্মরণে রাখবে, কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তো শিল্পীর নাম থাকাটাও দরকার? এবং সেই পাতার ছবিটাও কিন্তু শিল্পীই আঁকবে। একদিন–না–একদিন এই পৃথিবীর বুক থেকে বারোশো শিল্পীর নাম মুছে যাবে। আমি জানি, অতজনের নাম ও ছবি এঁকে বা লিখে যাওয়াও সম্ভব নয়। তাই বলছি, তোমার এবং বিশু মহারানার কীর্তির ছাপ এখানে রেখে যাও। এ কোনো রাজ-আজ্ঞা নয়। এ হল উৎকলের ইচ্ছা। এ নৃসিংহ দেবের ব্যক্তিগত অনুরোধ!’

‘রাজার অনুরোধও তাঁর আজ্ঞাই হয়, মহারাজ। কিন্তু এই আদেশ পালন করা অসম্ভব। এ ধরনের কাজের অর্থ উৎকলের সংস্কৃতির অপমান,’ রাজাকে দেওয়া প্রত্যুত্তরে এবারে সুবলের স্বর যথেষ্ট দৃঢ়।

‘সংস্কৃতির অপমান? তা কীভাবে সম্ভব? এ তো শিল্পীর সম্মান! গুণীকে উচিত সম্মান দেওয়া সংস্কৃতির অপমান হতে পারে না।’

‘শিল্পীর কুলগৌরব এ ধরনের প্রথাকে আজ্ঞা দেয় না, মহারাজ। জগন্নাথ মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা ইন্দ্রদুম্ন্য মহারানা মহাপ্রভুর কাছে বর চেয়ে বলেছিলেন—হে প্রভু, আমার বংশ যেন আমার সঙ্গেই সমাপ্ত হয়ে যায়, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এই দাবি না-করতে পারে, আমার পিতা-পিতামহ-প্রপিতামহ এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। সেই একই যুক্তিতে কোনো কোণার্ক-শিল্পীই চাইবে না যে, শিলাখণ্ডের কোথাও তার নাম অঙ্কিত হোক। কেউ চাইবে না যে, ভবিষ্যতে কেউ এই দাবি করুক যে তার পিতা–পিতামহ কিংবা পূর্বপুরুষের কেউ এই মন্দিরের নির্মাণকল্পে নিজের শিল্পশ্রম দান করেছিলেন।

এ হল উৎকলের শিল্পীর শিল্প, তাদের গৌরব। নাম উৎকীর্ণ হলে এই গৌরব বংশ-গরিমায় আবদ্ধ থেকে যাবে। কিন্তু তা যদি নামহীন হয়, সেই গৌরব হয়ে উঠবে সমগ্র জাতির গৌরব। জাতি, রাজ্য সবার উপরে। তার নাম অখণ্ড থাকাই বাঞ্ছনীয়। তাই কোণার্কের ভাস্কর্যে কোথাও, কোনো শিল্পীর নামোল্লেখ করা হবে না, মহারাজ। কোণার্ক-শিল্পী আপনার এই আদেশ পালনে অক্ষম। অপারগ। আমাকে ক্ষমা করুন!’ কথা শেষ করে একপায়ে নতজানু হয়ে নমস্কার জানাল সুবল।

বিমুগ্ধ মহারাজ নৃসিংহ দেব, শিবেই সান্তারা এবং বিশু মহারানা সুবলকে দেখেই চললেন। ভাবে বিহ্বল মহারাজ আবেগ ভরা কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘আমি এখনও সঙ্কুচিত মনোবৃত্তি নিয়েই জীবনধারণ করছি। তাই তোমার, আমার করে চলেছিলাম। কিন্তু তুমি ঠিক বলেছ, শিল্পী। উৎকলের জাতীয় গৌরবের ক্ষেত্রে কোনো সঙ্কুচিত মনোভাবের স্থান নেই। এই স্থাপত্য সমগ্র উৎকলের সমস্ত শিল্পীর পরিচয় বহন করবে এবং শিল্পের উৎকর্ষে মানুষের চোখে যখন অপার বিস্ময় জাগবে, তখন তা-ই হবে শিল্পীদের সোনালি স্বাক্ষর। ইতিহাসের পাতায় নৃসিংহ দেবের নাম হয়তো থাকবে, কিন্তু জনতার হৃদয়ে থেকে যাবে উৎকলের শিল্পীদের কীর্তি। তুমি ধন্য, শিল্পী। এবং ধন্য এই উৎকলের মাটি, যে তোমায় জন্ম দিয়েছে!’

শিবেই সান্তারা ভাবছিলেন, ‘এত অল্প বয়সে কী উচ্চ এবং পরিপক্ক চিন্তাধারার অধিকারী এই শিল্পী।’ আর বিশু মহারানার মাথায় তখন একটাই প্রশ্ন ঘুরছিল, ‘এ-ই কি সেই সুবল মহারানা যে বাস্তুশাস্ত্র অনুসারে এই মন্দিরের চিরস্থায়ীত্বের প্রশ্ন তুলে মন্দির নির্মাণে অস্বীকার করেছিল? আর আজ দেখো, যেদিকে তাকাবে, সেদিকেই সুবলের হাতের ছোঁওয়া। কোণার্কের প্রত্যেক ভাস্কর্যে, প্রতিটি মূর্তিতে, প্রতি চিত্রে সুবল মহারানার চমৎকার। সুবল সেইদিন সত্যই বলেছিল—এই বিশ্ব সুবল মহারানার ছেনির চমৎকার অবশ্যই দেখবে, মাননীয়। অবশ্যই দেখবে!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *