৫
‘নাট্যাচার্য সৌম্য শ্রীদত্তকে সুবল মহারানার সাদর প্রণাম!’ করজোড়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করল সুবল।
নাট্যাচার্য সৌম্য শ্রীদত্ত। বয়স আনুমানিক ষাট–বাষট্টি বছর। দীর্ঘ, ধপধপে সাদা কেশরাশি দুই কাঁধে ছড়ানো। নিয়মিত ক্ষৌরকর্মের ফলে মুখের দাড়িগোঁফের চিহ্নমাত্র নেই। উন্নত নাসিকাখানি শুকপাখির ঠোঁটের মতো ঈষৎ বাঁকা। আয়ত চক্ষু দুটি টানা। ঈশ্বর এমন চোখ সাধারণত পুরুষদের দেন না।
সৌম্য শ্রীদত্তের চলা, বলা এমনকী হাতের মুদ্রা তথা সঙ্কেতেও একটা অদ্ভুত ছন্দ আছে। লালিত্যের অবিকল প্রতিকৃতি সৌম্য শ্রীদত্তর ব্যক্তিত্বে এক সূক্ষ্ম কমনীয় আভার দেখা মেলে। সম্ভবত এইসব কারণেই রাজা অনঙ্গভীম দেব তাকে ‘সৌম্য’ উপাধি প্রদান করেছিলেন। বাস্তবে তাঁর নাম শ্রীদত্ত দীক্ষিত। নৃত্যকলা এবং নাট্যের জগতে উৎকল তো বটেই, সমগ্র ভূভারতে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী অমিল। বলা হয়, ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্র সৌম্য শ্রীদত্ত দীক্ষিতের দেহ ধারণ করে ভারত-ভূমিতে অবতীর্ণ হয়েছে।
সৌম্য শ্রীদত্ত এই কয়েকদিনেই সুবল মহারানার শিল্পচাতুর্যে মুগ্ধ হয়েছেন। বারোশো শিল্পীর ছেনি যখনই, যেখানে অবরোধে ভোগে, তখনই সেখানে সুবল মহারানার হাতের ছেনি গিয়ে সেই অবরোধকে মুক্ত করে। এই কথা সৌম্য শ্রীদত্ত খুব ভালো করেই বুঝে গিয়েছেন।
সুবলকে দেখেই সৌম্য শ্রীদত্ত পুলকিত কণ্ঠে বললেন, ‘দীর্ঘায়ু ভবঃ! যশস্বী ভবঃ! তুমি উৎকলের গৌরব, শিল্পী। আমি আশা করছি, কোণার্কের প্রতিটা পাষাণ খণ্ড তোমার শিল্পের স্পর্শ পেয়ে নৃত্য-বাদ্য-সঙ্গীতে বিশারদ হয়ে উঠবে। এদের দেখেই নীরব চন্দ্রভাগার তট নূপুরের ধ্বনি শুনবে। তোমার গড়া মূর্তির মধ্যে আমি সঙ্গীতের গুঞ্জন শুনেছি। আমি নিশ্চিত, তোমার তৈরি সমস্ত মূর্তি, সকল প্রতিমার সঙ্গীতের মূর্ছনায় একদিন মুখর হয়ে উঠবে এই অর্কক্ষেত্র। তুমি মহান শিল্পী! আমি তোমাকে আশীর্বাদ করছি, একসময়ে সমগ্র বিশ্বে তোমার শিল্পকর্মের বন্দনা হবে!’
‘এই শিল্প-মাধুরীর জনক তো আপনি, আচার্য। আপনি উৎকলের শিল্পীদের কাছে যা আশা করছেন, তার সবটাই আপনার অবদান। আপনার নির্দেশমতোই কাজ করছে সকলে। আপনি যে অদ্ভুত চিত্রপট আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন, তার ভিত্তিতে কাজ করে গেলে যে কোনো অনভিজ্ঞ ব্যক্তিও শিল্পীর গৌরব লাভ করবে। উৎকলের প্রত্যেক শিল্পী শুধুমাত্র আপনার নির্দেশের অনুপালন করে তাকে সাকার করে তুলছে, আর এতেই তারা ধন্য। আপনার নির্দেশ বিনা এই মহাযজ্ঞ সম্পাদন করা অসম্ভব,’ বিনয়ের সঙ্গে সুবল উত্তর দিল।
সুবলের কথার মাধুর্যে অভিভূত হয়ে উঠলেন সৌম্য শ্রীদত্ত। মনের প্রসন্ন ভাব হাসি হয়ে ফুটে উঠল মুখে। দীর্ঘ পদক্ষেপে তিনি নতুন মূর্তিগুলিকে নিরীক্ষণ করতে আরম্ভ করলেন।
এক-একজন দক্ষ শিল্পীর অধীনে অনেক অর্বাচীন শিল্পী কাজে নিমগ্ন। তাদের একনিষ্ঠ, একাগ্রচিত্ত শিল্পকর্মের তপ অনবরত পাষাণের বুকে উৎকীর্ণ করছে অবিরাম সঙ্গীত। মন্দিরের জগমোহনের উপরিভাগে ভৈরবের ছ’টি জীবন্ত মূর্তি স্থাপনার কথা আছে। তাদের তক্ষণ-কার্যও শেষ হয়ে গিয়েছে। ভৈরব-মূর্তিগুলির হাতে ডমরু, কুঠার, ত্রিশূল এবং বিষপাত্র; কণ্ঠে রুদ্রাক্ষমালা এবং মুণ্ডমালিকা। তেজদীপ্ত রূপ। নাট্যশাস্ত্রের মতে নৃত্যের সূচীপাদ ভঙ্গিমায় এই সমস্ত মূর্তি হবে চতুর্ভুজ এবং খপ্পরধারী।
যুগ-যুগান্ত ধরে কোণার্কের শিল্পকে কালের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য জগমোহনের পূর্ব, উত্তর এবং দক্ষিণ দিকে দুটি-দুটি করে ভৈরব মূর্তিকে রক্ষক রূপে স্থাপনা করার কথা। ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন শিবিরে গড়া হলেও মূর্তিগুলিকে দেখলে একে অপরের অবিকল প্রতিকৃতিই মনে হচ্ছিল। সব এ-ক! কোথাও কোনো পার্থক্য ছিল না।
জগমোহনের উপরের দুটি স্তরে মাদল, মঞ্জীর, ঝাঁঝর, বীণা, বেণু এবং তূর্য বাদনে মগ্ন জীবন্ত নারী-মূর্তি স্থাপিত হবে, যাদের নির্মাণের কাজ এখনও আরম্ভ হয়নি।
নাট্যাচার্যের চিন্তা তাঁর মুখের কথায় ফুটে উঠল, ‘সুবল, কঠোর পাষাণের বুকে ননীর মতো কোমল নারীমূর্তি গড়তে হবে। কোমলাঙ্গীদের দেহে সজ্জিত বস্ত্র আর অলংকারকে দেখে যেন আসল বলে ভ্রম হয়। তাদের কেশবিন্যাস হবে অন্যতম শ্রেষ্ঠ। তাদের যৌবনদীপ্ত সুগঠিত অবয়ব এবং লম্বিত মুদ্রাকে উৎকলের শিল্পী আপন নৈপুণ্যে অমর করে দেবে—এটুকুই আমার অভিলাষা। সম্ভব হবে তো, শিল্পী?’
‘আপনার আশীর্বাদ সঙ্গে থাকলে অবশ্যই সম্ভব হবে, আচার্য।’
‘শোনো সুবল, দক্ষিণের নৃসিংহনাথ মন্দিরের সেবার নিমিত্তে মহারাজ একশোজন নৃত্য-নিপুণ দেবদাসীকে নিযুক্ত করেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই কোণার্কের জন্য এই নিযুক্তি আরও বাড়বে। মহারাজের ইচ্ছা, নাট্য-মণ্ডপে নৃত্যরতা ওই সকল দেবদাসীও যেন উৎকল–শিল্পীদের খোদাই করা মূর্তিগুলির বিভঙ্গের সামনে পরাজিত অনুভব করে। এবং জানবে, এটা আমারও সাধ! কোথাও যেন কোনো ত্রুটি না-থাকে, বৎস।’
‘আচার্য, কোণার্ক-মন্দিরের নির্মাণে রত প্রত্যেক শিল্পীই উৎকলের নৃত্যকলার সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিত। চিত্রশিল্প এবং মূর্তিকলার প্রারম্ভিক জ্ঞানই নৃত্যকলা পাঠের সঙ্গে আরম্ভ হয়। নৃত্যকলার জ্ঞান ব্যতীত নৃত্যরত মূর্তি গড়ার সাহস কোন শিল্পী করবে? মহারাজের ইচ্ছা এবং আপনার সাধ—এই দুই-ই পূরণ করতে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’
‘আচ্ছা সুবল, মূর্তিকলা অনুযায়ী নৃত্য-ভঙ্গিমার সংজ্ঞা কী? বলো তো দেখি…’
‘আচার্য, আমার সীমিত জ্ঞানে আমি যেটুকু বুঝেছি, নৃত্যের মৌলিক বিলাসপূর্ণ ললিত মুদ্রাই হল ভঙ্গিমা। ভঙ্গিমার রচনা একমাত্র সমস্ত অবয়বের সাহায্যেই প্রকাশ করা সম্ভব। এবং নৃত্যে রূপ তথা সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে ভঙ্গিমা অত্যাবশ্যকীয়। নৃত্য-ভঙ্গিমায় একটি পাশের নিতম্ব সামান্য উন্নত এবং মাথা সামান্য ঢলে থাকে। এই সময়ে পা ছন্দাকৃতি স্থিতিতে অবস্থান করে।’
‘উত্তম! অতি উত্তম! তাহলে এবার বলো, উৎকলীয় নৃত্যশৈলীতে কোন–কোন বিশেষ ভঙ্গিমা আছে?’
‘উৎকলীয় নৃত্যের বিশেষ ভঙ্গিমা হল অলসা, দর্পণ, পার্শ্ব-মর্দলা, মর্দলা, অর্ললা, বিরাজ, প্রণমা, মানিনী, ত্রিভঙ্গি এবং চৌভঙ্গি। নাট্য-মণ্ডপের মূর্তিগুলিতে এই সমস্ত ভঙ্গিমার ব্যবহার করা হবে, আচার্য।’
হাতে মিঠে গুড় পেলে ছ-সাত বছরের বালক যেভাবে আনন্দে নেচে ওঠে, ঠিক সেভাবেই উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন নাট্যাচার্য। তাঁর মুখ থেকে নিঃসৃত হল—‘তা থৈ, তত্ থৈ, থৈ থৈ তত্ থৈ…’
নিজের উৎফুল্লতা দমন করে আবার গুরুভঙ্গিতে ফিরলেন আচার্য সৌম্য শ্রীদত্ত, ‘নৃত্যের আনুষঙ্গিক বাদ্য কী কী থাকবে?’
‘উৎকলীয়-নৃত্যে ব্যবহৃত সমস্ত বাদ্যযন্ত্রই থাকবে, আচার্য। বীণা, করতাল, ঝাঁঝর, মাদল, মঞ্জীর, বেণু, পটহ, তূর্য, মৃদঙ্গ এবং মহুঅর।’
‘মহুঅর-ও থাকবে? সাধু, সুবল…সাধু! আর মুদ্রা?’
‘মূর্তির মুদ্রা না-থাকলে ভঙ্গিমা কীভাবে খেলবে, আচার্য? ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্রে বর্ণিত পতাকা, অর্ধ-পতাকা, অরাল, পঞ্জলি, কপিত্থ, পুষ্পপুট ইত্যাদি মুদ্রার বিন্যাসে প্রতিটা মূর্তিকে প্রাণবন্ত করে তোলার ইচ্ছা আছে।’
‘তোমার উপরে আমার পূর্ণ আস্থা আছে, সুবল। শুধু তোমার কথা বললে অবশ্য পাপ হয়, এখানে উপস্থিত বারোশো শিল্পীর উপরেই আমি সমান ভাবে বিশ্বাস করি। তবুও নাট্যমন্দিরের নৃত্য–মূর্তিগুলির নির্মাণের দায়িত্ব আমি তোমাকেই অর্পণ করতে চাই। আমি জানি যে, উৎকলের নৃত্যকলা সম্পর্কে তোমার সম্যক ধারণা আছে। তাই আমি চাই, এই মূর্তিগুলি তোমার উপস্থিতিতে এবং সর্বাঙ্গীণ নির্দেশনায় তৈরি হোক।’
‘আচার্য, এখানে উপস্থিত বারোশো শিল্পীর প্রত্যেকেই এক-একজন সুবল মহারানা। তবুও আপনার আদেশ এবং সম্মান রক্ষা করা আমার কর্তব্য। আপনার কথামতোই আমার নির্দেশনায় এই কাজ সম্পন্ন হবে।’
‘হ্যাঁ বৎস সুবল, তাই করো। নাট্যমন্দিরে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় অবস্থিত নৃত্যরত-মূর্তিগুলি এবং বাদ্যযন্ত্রধারী নর-নারীর মূর্তিগুলি উৎকলীয় নৃত্য-সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন হয়ে উঠবে। আমি, নাট্যাচার্য সৌম্য শ্রীদত্ত দীক্ষিত এবং আমার শিষ্যরা কালের প্রভাবে একদিন এই পৃথিবী থেকে ধুয়েমুছে গেলেও উৎকলের নৃত্য-গীতের এই পরম্পরা সুবল মহারানার ছেনির স্পর্শ পেয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে উৎকল রাজ্যের গৌরবগাথা শোনাবে এবং এরই মাধ্যমে অমর হয়ে যাবে সকল কোণার্ক-শিল্পী। কোণার্ক কেবল কোনো দেবমন্দির রূপে নয়, শিল্পের অধিষ্ঠান এক কলামন্দির রূপে যুগ-যুগান্তর ধরে সম্মানিত হবে। একইসঙ্গে চিত্রকলা, সঙ্গীত, নৃত্যকলা এবং শিল্পকলার এই অদ্বিতীয় সম্মেলন আগামী যুগের কাছে শিক্ষকের ভূমিকা গ্রহণ করবে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এর সম্মোহনে বাঁধা পড়বে। শুধু একটাই দিক অচ্ছুৎ রয়ে গেল, সুবল।’
‘কোন দিকের কথা বলছেন, আচার্য?’
‘উৎকলের লোকনৃত্য। তার পাশাপাশি একধার ধরে উৎকলের পাইক বাহিনীকেও হাতে ঢাল-তরোয়াল দিয়ে নৃত্যরত অবস্থায় চিত্রিত করতে হবে। উৎকলের সৈনিকদের কিন্তু তাদের গৌরবের ভাগ থেকে বঞ্চিত করলে চলবে না, সুবল। কী, পারবে তো?’
‘আপনার নির্দেশনা পেলে আমরা সব করতে পারব, আচার্য! তবে এই সকল মূর্তি নির্মাণ করার আগে আমাকে আরেকটি মূর্তি উৎকীর্ণ করার আদেশ দিন। আপনার মূর্তি! নাট্যমণ্ডপের ঊর্দ্ধভাগে অবস্থিত পাষাণ প্রতিমাদের মাঝে খচিত নর্তক–নর্তকীদের নির্দেশ প্রদানকারী নাট্যাচার্যের মূর্তি! উৎকলের নাট্যাচার্য সৌম্য শ্রীদত্তর মূর্তি বিনা নাট্যমণ্ডপ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, কোণার্ক অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, আমার শিল্পসাধনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। মহারাজের পৃষ্ঠপোষকতায় আপনি উৎকলের নৃত্য-পরম্পরাকে উৎকীর্ণ করার ক্ষেত্রে যে তৎপরতা এবং সংলগ্নতা দেখিয়েছেন, তার উচিত সম্মানের জন্য গুণগ্রাহী মহারাজ আপনার মূর্তি নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছেন। এবং বিশু মহারানা এই উত্তরদায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন, আচার্য,’ কথা শেষ করে সুবল নিজের দুই হাত জোড়বদ্ধ অবস্থায় সৌম্য শ্রীদত্তের সামনে মাথা নত করল।
‘তাই নাকি? তাহলে বলতে হয়, এ হল মহারাজের বদান্যতা, কিন্তু…’
‘কোণার্ক নির্মাণে কাজে কোনো কিন্তুর গুরুত্ব নেই, আচার্য। আপনি উৎকলের শিল্পীদের উপরে আস্থা রাখুন।’
‘ভরসা আমার আছে সুবল। কিন্তু এই নাট্য-মণ্ডপের শিল্পে যেন অশ্লীলতার লেশমাত্র চিহ্ন না-থাকে। ওখানে দেবার্চনার জন্য দেবদাসীদের নৃত্য হবে। জীবিত নর্তকী হোক বা পাষাণ-খচিত, তার মুদ্রা-বিন্যাসে এবং ভাব প্রকাশে নৈসর্গিক মানবের নিষ্কলুষ আনন্দের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে হবে। নর্তকীর রূপ-লাবণ্য যেন ভক্তি-ভাবনার সূর্যরশ্মি হয়ে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। নারী মূর্তির তক্ষণের জন্য শিল্পীদের প্রতিরূপ লাগবে। প্রতিরূপ না-পেলে নৃত্যের ভঙ্গিমার ও মুদ্রার অবিকল উৎকীর্ণন সম্ভব হবে না। এখন সমস্যা হল তোমার জন্য প্রতিরূপ রূপে কোন দেবদাসীকে নিয়োগ করা হবে? কিন্তু তোমার মতো রূপবান, সুদর্শন যুবকের সামনে নৃত্য-প্রতিরূপ হয়ে কোনো নারী কি নিজেকে সংযমিত করে রাখতে পারবে? এই যে কিন্তুর কথা বললাম, এই কিন্তু কোনো ক্ষুদ্র কিন্তু নয়, সুবল।’
‘কিন্তু এই কিন্তুর কোনো অস্তিত্বই নেই, আচার্য। প্রতিরূপকে জ্ঞানচক্ষু ছাড়া অন্য কোনো চোখে দেখাই হবে না—এটা কেবল আমার নয়, এই কোণার্ক পরিসরে কর্মরত বারোশো শিল্পীরও মূলমন্ত্র। আগামী বারো বছরের জন্য নিজেদের প্রত্যেক আবেগদ্বারের কপাট আমরা রুদ্ধ করে এসেছি। প্রত্যেক কোণার্ক-শিল্পীর হয়ে আমি কথা দিচ্ছি—আমাদের মধ্যে কেউ, হ্যাঁ কেউই ব্রহ্মচর্যের পথ থেকে বিচ্যুত হব না! নারী আর পুরুষের মধ্যে কিন্তু নৈসর্গিক প্রেমও হওয়া সম্ভব এবং সূর্যের সঙ্গে পদ্মের প্রেম এই সত্যেরই প্রতীক। এই অঞ্চল একাধারে যেমন পদ্ম-ক্ষেত্র, অন্যদিকে এটা অর্ক-ক্ষেত্রও বটে। এই মাটিতে দাঁড়িয়ে আমাদের আদর্শ কোনো ভাবেই খণ্ডিত হতে পারে না।
আপনাকে সবিনয়ে জানাই, ব্যক্তিগত রূপে আমার কোনো প্রতিরূপের প্রয়োজনই নেই। সুবল মহারানার হৃদয়ে স্বয়ং কোণার্ক-সুন্দরী প্রতিষ্ঠিত। তার প্রেরণাতেই আমি পাষাণের রাগসঙ্গীত আর কাব্যছন্দের জন্ম দিই। আমি যখনই নিজের চোখ বন্ধ করি, তখনই তাকে দেখতে পাই। যে রূপে দেখতে চাই, সেই রূপেই দেখি। এই প্রণয়ী শিল্পীর মানসপ্রিয়া সে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন আচার্য—আমি কোনো ধরনের প্রতিরূপ ছাড়াই নিজের শিল্পকে মূর্ত রূপ দিতে প্রস্তুত।’
সৌম্য শ্রীদত্ত সুবল মহারানার প্রতিটি কথায় বিশ্বাস রাখলেও তার আবেগের প্রতি আস্থা রাখতে পারলেন না। প্রতিরূপ ছাড়াই শিল্প? এও কি সম্ভব?
‘তুমি নিজের বক্তব্যে ঠিক হতে পারো, কিন্তু প্রতিরূপ অবশ্যই প্রয়োজন বৎস। আচ্ছা ঠিক আছে, আমি কোনও–না-কোনও পথ ঠিক বের করব। সুবল মহারানা, তোমার জয় হোক! তোমার মনের জোর দেখে আমিও মনোবল পেলাম।’
আচার্য সৌম্য শ্রীদত্ত নাট্যশাস্ত্রে পারদর্শী হলেও এই ভাবুক, প্রণয়ীর কল্পনাশক্তির সঙ্গে তিনি পরিচিত নন। বিধাতার সৃজনীশক্তির অদ্ভুত প্রতিরূপ বিনোদিনী সুবল মহারানার মানসিক প্রতিরূপ এবং নিজের ছেনির ঘায়ে সে তার মানসিক প্রতিরূপকেই পাষাণের বুকে খোদাই করে চলে। সুবল বিধাতার এই প্রতিরূপের কাছে জিততেও চায়, আবার হারতেও চায়। এক অনির্বচনীয় নেশায় মত্ত হয়ে সে পাষাণ খণ্ডে আঘাত করে চলে। সৌম্য শ্রীদত্ত এই কথা জানেন না। জানার কথাও নয়। এই জগতে কে-ই বা কবে প্রেমিকের মন পড়তে পেরেছে?
গৌড়ের শাসক ইখতিয়ার বেগের সঙ্গে নৃসিংহ দেবের সংঘর্ষের বিরাম নেই। উৎকলের উত্তর সীমান্তে অমর্দন দুর্গ দখল করে নিয়েছিল যবন সৈন্যের দল। দেশপ্রাণ উৎকলীয় সেনার সাহায্যে নৃসিংহ দেব তাদের উচিত শিক্ষা দিয়ে রাজধানীতে ফিরে এসেছেন। এদিকে সূর্যমন্দিরের নির্মাণকাজও সমান তালে চলছে।
দিনমানে মন্দিরের নির্মাণ সংক্রান্ত কাজ দেখাশোনার পরে মহলে ফিরে এসেছেন মহারাজ। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। আজ বেশ কয়েকদিন পরে নৃসিংহ দেব আমজনতার ছদ্মবেশ ধারণ করে ভ্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। রাজ্যের শান্তিকালে এটাই তাঁর প্রিয় কাজ। কখনো দণ্ডপাণি, কখনো গ্রামভট্ট, কখনো সাধারণ সৈনিক, কখনো পুরোহিত, আবার কখনো বা পথ হারিয়ে ফেলা পথিক সেজে তিনি প্রজাদের মধ্যে বিচরণ করেন। তাদের সমস্যা, তাদের সুখদুঃখের কথা শোনেন। পরে সেইমতো সাহায্যও করেন।
চাঁদনী রাত। ধবল জ্যোৎস্নায় ফুল, ফল, পাতা, লতা প্রতিটি জিনিস আলাদা করে চিনে ফেলা যাচ্ছে দূর থেকেই। মহারাজ আজ এক পুরোহিতের বেশ ধারণ করেছেন। নিজের প্রিয় অশ্বের বদলে বাহন হিসেবে সঙ্গে নিয়েছেন একটা বুড়ো ঘোড়া। লক্ষ্য নিশ্চিত নয়। ঘোড়া নিজের ইচ্ছামতো প্রধান পথ ছেড়ে পাকদণ্ডী ধরে নেমে চলল গ্রামের দিকে। কে জানে, অদৃষ্টের কোন সঙ্কেত পেয়ে সে এগোচ্ছে?
সামনে এক নাম না-জানা গ্রাম। গ্রামের সীমানায় একটা ছোট আমবাগান। রাত্রির দ্বিপ্রহর শেষ হতে চলেছে। গ্রামের মাঝখানে একটি দেবালয়ের শিখরে লাগানো ধবল পতাকাখানি গ্রামের বাইরে থেকেও স্পষ্ট দৃশ্যমান। বাগানের একটা গাছেই নৃসিংহ দেব নিজের ঘোড়াটাকে বেঁধে দিলেন। ভয়ের কিছু নেই। নৃসিংহ দেবের শাসন মানে রামরাজত্ব। এই রাজত্বে চুরি হয় না। তার উপরে এই বুড়ো ঘোড়া, কে নিতে যাবে?
কোন এক অদৃশ্য আকর্ষণে রাজা নৃসিংহ দেব মন্দিরটির দিকে এগিয়ে চললেন। দেবালয়ের দ্বারে দাঁড়িয়ে অধিষ্ঠিত অজ্ঞাত, অনাম দেবতার উদ্দেশে প্রণাম জানালেন উৎকল-রাজ। হঠাৎই তাঁর চোখে পড়ল এক কিশোরী ঘোমটা টেনে, কাঁখে ভারী কলস নিয়ে দেবালয়ের দিকেই আসছে।
মন্দির প্রাঙ্গণে ভালো ভাবে দৃষ্টি ফেরাতেই একটা কুয়ো চোখে পড়ল মহারাজের। কিন্তু যে শূন্য কলসিই এত কষ্ট করে বয়ে নিয়ে আসছে, ভরা কলস নিয়ে সে ফিরবে কেমন ভাবে? ছদ্মবেশী নৃসিংহ দেব একটি বকুলগাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালেন।
কিশোরী ওই পথটুকু কোনোক্রমে এসেই কাঁখের ভারী কলসখানা কুয়োর পাড়ে তুলে দিল। তারপর মন্দিরের চাতালটাকে লতার মতো আঁকড়ে ধরে বুকভরে বেশ কয়েকটা টানা শ্বাস নিল। কিছুক্ষণের চেষ্টায় ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতেই চাতালের ওপরে বসে পড়ল সে।
‘কী আশ্চর্য, সময় বয়ে যাচ্ছে অথচ সে যে কাজে এসেছে সেটাই করছে না! তবে কি সে এখানে অন্য কোনও কাজে এসেছে? যদি তাই না হবে, এত গভীর রাতে কি কেউ জল ভরতে আসে? সে নিশ্চিত অভিসারে বেরিয়েছে। কিন্তু ঘোমটা? তবে তো সে বিবাহিত! হে জগন্নাথ স্বামী, এ আমি নিজের রাজ্যেই কোন অনাচার দেখছি? ভুল ভেবে পাপ করছি না তো?’ নৃসিংহ দেব মনে মনে ভয়ঙ্কর দ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন।
কিশোরী সেই থেকে একটি নির্দিষ্ট দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে। হঠাৎ কিশোরী বধূটি তার মাথার ঘোমটা সরিয়ে দিল। ঘোমটার আড়াল সরে যেতেই ললাটে চাঁদের আলো এসে পড়ল তার। কপাল তো নয়, যেন আধফালি চাঁদ। না-ফোটা বকফুলের মতো স্ফুরিত অধর। কিন্তু কে এই অভিসারিকা? কার প্রেয়সী? কোন হৃদয়হীনের মিথ্যা আশ্বাসে নিন্দা আর অপবাদের ভয় তুচ্ছ করে এই কিশোরী বধূ এত রাতে ঘর ছেড়ে পথে নেমেছে?
সাতপাঁচ ভাবছিলেন মহারাজ নৃসিংহ দেব, এমন সময় কারও পায়ের শব্দ শোনা গেল। রাজা সতর্ক হয়ে উঠলেন। কিশোরীর মুখেচোখে উৎকণ্ঠা দেখা দিল। এবার কি ছদ্মবেশী নৃসিংহ দেব সেই গোপন অভিসারের সাক্ষী হতে চলেছেন? তিনি কি দণ্ড বিধান দেবেন? কাকে দেবেন? প্রেয়সীকে নাকি তার প্রীতমকে? প্রেমজালে আবদ্ধ এই নিষ্পাপ কিশোরীকে ছেড়ে দেবেন নাকি এই কিশোরীকে প্রণয়পাশে আবদ্ধকারী সেই প্রণয়ীকে? নাকি দুজনকেই? কী করবেন তিনি?
পায়ের শব্দ ক্রমশ ঘন হয়ে এল। চোখের পলকে ওই কিশোরী যেন মানিনী নায়িকাতে রূপান্তরিত হয়ে গেল। সম্ভবত প্রেমিকের আগমনে বিলম্ব হওয়াতে রুষ্ট হওয়ার অভিনয় করতে চাইছে কিশোরী। কোমরে আঁচল বেঁধে নিয়ে দ্রুত হাতে কলসের কণ্ঠে রশির ফাঁস পরিয়ে কলসটাকে কুয়োর ভিতরে নামিয়ে দিল সে।
কিশোরীর এ কেমন ছলনা! একটু আগেই শূন্য কলস বয়ে আনতে যার কষ্ট হচ্ছিল, ভরা কলসি কুয়ো থেকে টেনে তুলবে কেমন করে সে? জলের ভারে কুয়োতেই না পড়ে যায়! বধূটি কি তবে আত্মহত্যা করতে উদ্যত? না, না। হয়তো প্রেমিক এসে ক্ষিপ্র হাতে তাকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই কুয়ো থেকে টেনে তুলবে জলভরা কলস। প্রেমিকার এই অসহায় দশা তার মনকে বিচলিত করে তুলবে। তারপর শুরু হবে মানভঞ্জন পর্ব। কিন্তু যদি তার এই কুয়ো অবধি পৌঁছাতে বিলম্ব হয়? তখন? তখন তো এই কিশোরী নির্ঘাত কুয়োর মধ্যেই গিয়ে পড়বে!
এতটা তফাতে দাঁড়িয়েও মহারাজ নৃসিংহ দেব স্পষ্ট বুঝতে পারছেন, কলস ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছে। কিশোরী নিজের সর্বশক্তি দিয়ে সেটাকে টেনে রেখেছে। জলে ডুবে থাকা কলসের ভার কিছুটা কম হয় বলে সম্ভবত সে এখনও নিজেকে আটকে রাখতে পেরেছে। কিন্তু কোথায় গেল তার কামনার পুরুষ?
কিশোরীর বঙ্কিম গ্রীবা, তার চোখ আর কান সেই পদশব্দের পথ চেয়ে ছিল, কিন্তু সম্ভবত তার গণনায় কোনো ভুল হয়ে গিয়েছে। পায়ের শব্দ ক্রমশ ক্ষীণ হতে হতে দূরে সরে গেছে। হয়তো বা কোনো পথিক নিজের পথ ধরে চলে গিয়েছে। এবার কী করবে কিশোরী?
বধূ এতক্ষণে বেশ বুঝে গেছে তার গণনায় কোথাও ভুল হয়েছে। এখন কলসিটাকে জলভরা অবস্থায় তুলে আনা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু সেই পথও সহজ নয়। ক্ষীণ দেহ নিয়ে অমন ভার বহন করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। জল আর কলসের সম্মিলিত ভারে আর রশির টানে সে এবার কুয়োর দিকে ঝুঁকে পড়তে লাগল।
কিশোরীর প্রাণ-সংকটাপন্ন। চোখের সামনে এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটতে চলেছে দেখে নৃসিংহ দেব আর নিজেকে আড়াল করে রাখতে পারলেন না। বকুল বৃক্ষের আড়াল থেকে দ্রুত ছুটে তিনি কূপের কাছে এসে দাঁড়ালেন। তারপর বাম হাতে কলসে বাঁধা রশিখানি ধরে ডান হাতে কিশোরীকে পিছন দিকে টেনে আনলেন। অপ্রত্যাশিত এই ঘটনায় বিহ্বল হয়ে কিশোরী মূর্ছিত হয়ে পড়ল। তবে ভয়ের আর কোনো কারণ নেই, নৃসিংহ দেবের বলিষ্ঠ ভুজার আশ্রয় ঈশ্বরের বরাভয়েরই সমান। ডান হাতে কিশোরীকে ধরে রেখে বাম হাত দিয়ে খুব সহজেই মহারাজ কলসিটিকে টেনে তুলে এনে মাটিতে নামিয়ে রাখলেন।
এতক্ষণে কিশোরীর মুখের দিকে ভালো করে চেয়ে দেখলেন ছদ্মবেশী পুরোহিত। যেন আকাশের ওই চাঁদ নেমে এসে তাঁর বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। কিশোরীর ছলছল চোখ কোনো এক অজানা গ্লানিতে ভরে উঠতে দেখলেন মহারাজ। সেই জল কপোল বেয়ে গড়াতেই ভিজে উঠল চাঁদমুখখানি। লজ্জা ভয় দুঃখে তার দেহলতা কম্পিত হয়ে উঠল। নাকের ডগায় তিলফুলের মতো নাকছাবিতে ক্ষুদ্র কাচের খণ্ডটি নক্ষত্রের মতো কাঁপতে লাগল। আলুলায়িত চিকুরের গোছা ঢেউ তুলে নৃসিংহ দেবের বুকে ছড়িয়ে পড়ল।
কিশোরীর চোখ থেকে দুফোঁটা জল এসে পড়ল নৃসিংহ দেবের হাতের উপর। শিশির বিন্দুর মতো ওই দুফোঁটা জলের উষ্ণতা যে এতখানি তা মহারাজের জানা ছিল না। এক অবুঝ অনুভূতির প্রবাহে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন তিনি। কিন্তু তাঁর বিবেক তাঁকে সজাগ করে তুলল, ‘তুমি রাজা! তুমি প্রজাপালক! তুমিই রক্ষক! মাতৃজাতির রক্ষা করা তোমার কর্তব্য। নৃসিংহ দেব, মাতৃতত্ত্বের তিন চরম মাত্রা হল নারী, সংস্কৃতি আর মাতৃভূমি। তাদের রক্ষা এবং সম্মান করা প্রত্যেক পুরুষের পরম দায়িত্ব।’
উদার স্বরে মহারাজ এবার কিশোরীকে অভয় দিলেন, ‘ভয় পেয়ো না। বিপদ কেটে গিয়েছে। নির্ভয়ে থাকো।’
মহারাজের অভয় বাণী শুনে কিশোরী কিছুটা সংযত হল। কোমর থেকে আঁচল খুলে এনে ঘোমটা দিল মাথায়। মাটিতে নেমে আসা চাঁদের মুখ আবরণে ঢাকা পড়তেই ধরার বুকে যেন আঁধার নেমে এল। মহারাজ আকাশের দিকে চোখ তুলে চাইলেন। চাঁদ আছে যথাস্থানেই, তবে? হয়তো কিশোরীর এই রূপ, এই সৌন্দর্য দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েছে চাঁদও।
নৃসিংহ দেব শুধোলেন, ‘কে তুমি, কিশোরী? কার কন্যা? কার প্রিয়া?’
সম্বিৎ ফিরে পেয়েছে কিশোরী বধূ। ঝরে গিয়েছে তার ভাবমূর্ছনা। সে উত্তর দিল, ‘এই প্রশ্ন করে আপনি আমাকে অপমান করলেন মাননীয়! আমি কিশোরী নই, প্রেমিকা নই, কারো বিবাহিত স্ত্রী। কারো কূলের বধূ আমি।’
এমন নির্ভীক উত্তর শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন নৃসিংহ দেব। যে মেয়ে এমন নির্ভীকভাবে সত্যি কথা বলতে পারে, তার তো কোনো গোপন অভিসারে লিপ্ত থাকার কথা নয়। ছদ্মবেশী এবার অনুতাপের স্বরে বললেন, ‘ক্ষমা করুন, দেবী! অজ্ঞজন দয়ার পাত্র। কে আপনি? কার কূলের বধূ? এই চাঁদনি রাতে মন্দিরের চাতালে দাঁড়িয়ে আপনি কার জন্য অপেক্ষা করছেন?’
‘আপনি তো দেখছি বার বার আমায় অপমান করছেন, ব্রাহ্মণ। একজন বিবাহিতা নারী কেবল তার স্বামী ছাড়া আর কার অপেক্ষায় থাকবে? সেই অপেক্ষায় জন্ম–জন্মান্তর বয়ে গেলে যাক, প্রতীক্ষা বিফল হোক, তবু আমার কাছে তা গৌরবের বিষয়।’ ঘোমটার ভিতর থেকে আসা উত্তরের সুর এবার আরও দৃঢ় এবং স্পষ্টভাবে শোনা গেল।
মুগ্ধ হয়ে গেলেন নৃসিংহ দেব। উল্লসিত ভাব চেপে রেখেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘স্বামীর জন্য অপেক্ষা বুঝি এমন গভীর রাতে, নির্জন মন্দির প্রাঙ্গণে করতে হয়? তার জন্য তো ঘর রয়েছে আপনার। এত রাতে কুয়ো থেকেই বা কেন জল তুলতে এসেছেন? আপনার কথায় মনে সন্দেহ জাগছে, দেবী। সম্ভব হলে আমার সন্দেহের নিরসন করুন।’
কিশোরী দুই আঙুলে ঘোমটা টেনে একটু চওড়া করে নিল, ‘আচ্ছা, আপনি কে বলুন তো মশাই? জগন্নাথ স্বামীর পাঠানো দূতের মতোই আজ আপনি আমাকে মৃত্যুর হাতে থেকে রক্ষা করেছেন, এই উপকার আমি মানতে বাধ্য। সেক্ষেত্রেও একটি কথা জেনে রাখুন, আপনি একজন সামর্থ্যবান পুরুষের ধর্ম পালন করেছেন। কিন্তু তাই বলে আমার নাড়ীনক্ষত্র, মনের ভেদ আর ঘরের ছেদ আপনার মতো অপরিচিত মানুষকে কেন বলব? প্রথমত, দয়া করে নিজের পরিচয় দিয়ে আমাকে উপকৃত করুন। যদি তার পরে আপনাকে আমার কথা বলা উচিত মনে হয়, আমি বলব। অবশ্যই বলব! এমনিতেও আপনার স্পর্শে আমার শরীর কলঙ্কিত হয়েছে। দুর্ঘটনাবশত যদি কুয়োর ভিতরে পড়ে যেতাম, তাহলে নাহয় আলাদা কথা ছিল। কিন্তু এবার দেখছি অন্যত্র কোনো কুয়ো খুঁজে তার মধ্যেই ঝাঁপ দিয়ে মরতে হবে। এই কূপ এই দেবদেউলের, তাই এতে ডুবে মরে এর জল অপবিত্র করতে পারি না। তাহলে নরকেও ঠাঁই হবে না আমার। মরে যখন যাবই, তখন আর আমার মনের ভেদ বাইরের লোকে জানুক, না-জানুক আমি দেখতে আসব না। আপনার দেওয়া এই জীবনদান আমার কাছে মৃত্যুর নামান্তর বলেই জানবেন।’
নৃসিংহ দেব কেঁপে উঠলেন, ‘কী বলছেন দেবী? আমি, জগন্নাথ স্বামীর এক সেবক, একজন সামান্য পুরোহিত, তাঁর চরণের এক রাউত। দেবী, আপনাকে স্পর্শ করা আপদধর্ম ছিল। জগন্নাথ স্বামীর আদেশ। আমার স্পর্শ কোনো পরপুরুষের স্পর্শ নয়, এই স্পর্শ পিতার, এই স্পর্শ ভ্রাতার। আপনি এভাবে ভাববেন না। আমার বাড়ি দূরের এক গ্রামে। এক বন্ধুর গৃহে যাচ্ছিলাম। আপনাকে বিপদগ্রস্ত দেখেই আমি এগিয়ে এলাম। এ জগন্নাথ স্বামীরই নির্দেশ। তাঁর কৃপা! আমি আপনাকে রক্ষা করিনি, তিনিই করেছেন। আমি তো নিমিত্ত মাত্র।’
ঘোমটার আড়ালে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল, ‘আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। বিপত্তি কেটে গেল। আপনার রূপ ধরে জগন্নাথস্বামীই আমাকে উদ্ধার করেছেন।’
‘হ্যাঁ দেবী, এটাই সত্য! যেকোনো শুভ কাজ সম্ভব করার জন্য জগন্নাথ মহাপ্রভুর ইচ্ছা এবং কৃপার প্রয়োজন। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আপনি নিষ্কলঙ্কই আছেন। কিন্তু আপনি এখনও আমার উৎকণ্ঠা আর সন্দেহের নিরসন করতে পারেননি। এই গভীর রাতে, এমন নির্জন স্থানে আপনি কার জন্য অপেক্ষা করছিলেন? এমন সময়ে জল নিতে আসার কারণই বা কী? ভোরের আলো ফুটলে এলেই তো হতো?’
অবগুণ্ঠনবতীর গ্রীবা নত হয়ে গেল, ‘শাশুড়ি মায়ের আদেশ, প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগেই যেন ঘর নিকোনো হয়ে যায়। তার জন্যই জল নিয়ে যেতে হয়।’
‘কুয়োর জল দিয়ে ঘর লেপা হবে? আশ্চর্য! আবার সেই কাজের জন্য এই এ-ত বড় কলসি? আপনার ওজনের দ্বিগুণ ওজন হবে নিশ্চয়ই কলসিটার। প্রতিদিন কী করে বয়ে নিয়ে যান? আপনি এই কলসিতে জল ভরার পরে দু-পা চলতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে। অহেতুক মিথ্যে কেন বলছেন আমাকে?’
‘আপনি না-জেনে আমাকে সমানে অপমান করে চলেছেন। আমি জল নিতে আসি একথা ঠিকই, কিন্তু জল নিজে ভরিও না, এবং বাড়ি অবধি নিয়েও যাই না। এই কাজে আমার ভ্রাতৃসম দেওর আমাকে সাহায্য করে। আমি কলসখানা নিয়ে আসি। পিছনেই আমার দেওর আসে। ওর আসার আগে আমি কলসিটা কুয়োতে নামিয়ে দিই। সময় বাঁচে। সে জল ভরে বাড়ির পিছনদিকের পথ ধরে। আমি ঘর নিকোই। এ সবই হয় শাশুড়ি মার অগোচরে। আজও তা-ই করেছিলাম, কিন্তু ওর না-আসাতেই বিপত্তি বাঁধল। আপনি ঠিক সময়ে এসে উপস্থিত না-হলে আজ কলসি আর আমি দুজনেই কুয়োর মধ্যে গিয়ে পড়তাম। একদিকে অবশ্য ভালোই হতো—এই যন্ত্রণার জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে যেতাম।’
‘আচ্ছা, সব বুঝলাম, কিন্তু আপনি কলসিটাকে ছেড়ে দিলেন না কেন? আপনার প্রাণের থেকেও কি কলসিটা বেশি দামি?’
‘হ্যাঁ, আমার শাশুড়ি মায়ের চোখে আমার জীবনের থেকে কলসিটার দামই বেশি।’
‘আপনাকে দিয়ে এভাবে কাজ করানো তো এক ধরনের প্রতারণা। কোন অপরাধের শাস্তি দিচ্ছেন আপনার শাশুড়ি মা?’
‘উনি আমাকে এভাবে কষ্ট দিয়ে বড় আনন্দ পান। তবে এই প্রতারণার মূলে আমার শাশুড়ি নন, আছেন অন্য আরেকজন।’
‘কে সেই নরাধম? আপনার স্বামী?’
‘আপনি নিজেই প্রশ্ন করেন, নিজেই তার উত্তর বলে দেন। উলটোদিকের মানুষটার উত্তরের অপেক্ষা অবধি করেন না। আমার স্বামী কেন এমন কাজ করবেন?’
‘তাহলে কে সেই দুষ্ট? বলুন দেবী, সে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করে চলেছে।’
‘নাহয় বললাম তাঁর নাম, কিন্তু আপনি তাঁর কিচ্ছুটি করতে পারবেন না।’
‘উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা অবশ্যই করব।’
‘আপনার সাধ থাকলেও সাধ্যে কুলোবে না, মহাশয়,’ ঘোমটার ভিতর থেকে তির্যক উত্তর এল।
‘আমার হয়তো নেই, কিন্তু আমি জগন্নাথ স্বামীর সেবক, পুরোহিত। আমি মহাপ্রভু জগন্নাথ স্বামীর কাছে সেই নরাধমের জন্য দণ্ড প্রার্থনা করব এবং মহারাজা নৃসিংহ দেবকে দিয়ে সেই দণ্ড দেওয়াব।’
‘তাঁকে না তো জগন্নাথ স্বামী দণ্ড দিতে পারবেন, না আপনার মহারাজা নৃসিংহ দেব।’
‘কী বলছেন আপনি?’
‘কারণ স্বয়ং মহারাজা নৃসিংহ দেবই আমার অপরাধী। এই রাজ্যের ভাগ্যবিধাতাই আমার দুর্ভাগ্যের বিধিলিপি লিখেছেন। তিনি মহাপ্রভু জগন্নাথের কাছের মানুষ, আপনি তাঁর কী শাস্তি বিধান করবেন?’
ভারি আশ্চর্য হয়ে কিশোরীর দিকে তাকালেন মহারাজ, ‘বলে কী এই ননীর পুতুলের মতো মেয়ে? আমি এর কষ্টের কারণ? কেন? কীভাবে?’ নৃসিংহ দেব কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না। আবার প্রশ্ন করাই তিনি সঙ্গত মনে করলেন, ‘কিন্তু তা কী করে সম্ভব? মহারাজ নিজের প্রজার কষ্ট নিবারণ করার জন্য সবসময়েই যত্নবান, দেবী। আপনার কথার মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো রহস্য আছে। খুলে বলুন।’
‘কোনো রহস্য নেই। উনি কেবল আমার একার নন, আমার মতো বারোশো শিল্পীবধূর দুঃখের এক এবং একমাত্র কারণ। আমার স্বামী একজন কোণার্ক-শিল্পী। দ্বিরাগমনের মাত্র কয়েকদিন আগে তাঁকে কোণার্ক-নির্মাণের জন্য রাজাদেশ দিয়ে ডেকে নেওয়া হয়। আজ তিনি পাষাণের বুকে প্রাণ সঞ্চার করতে ব্যস্ত। আমার শাশুড়ি মায়ের চোখে আমি অলক্ষ্মী। সংসারে আমার পা পড়ার আগেই সংসার থেকে তাঁর পুত্রকে বিদায় নিতে হয়েছে। বৃদ্ধা হয়তো এ জীবনে আর নিজের নাতি নাতনির মুখও দেখতে পাবেন না। তাঁর বড় ছেলে হয়তো তাঁর চিতায় আগুনটুকুও দিতে পারবে না। মনের দিক থেকে বড় অসহায় হয়ে পড়েছেন তিনি। আমাকে গালমন্দ, ভর্ৎসনা করে একটু শান্তি পান। তাঁর কোনও দোষ নেই, দোষ আমার ভাগ্যের, আর দোষ আপনার মহারাজ নৃসিংহ দেবের।’
‘কিন্তু দেবী, আপনার স্বামী একজন কোণার্ক-শিল্পী, এই কথায় আপনার বা আপনার শাশুড়িমায়ের গর্ব হয় না?’
‘হয়। খুব গর্ব হয়! কিন্তু আমার বুকের জ্বালা তাতে জুড়োয় না। শাশুড়ি মায়ের মানসিক বেদনা যত তীব্র হয়ে উঠছে, ততই আমার উপরে অত্যাচার বেড়ে চলেছে। আর সহ্য করতে পারি না।’
‘যদি আপনার স্বামী কোণার্ক-নির্মাণ ছেড়ে আবার গৃহে ফিরে আসেন? আমি জগন্নাথ মহাপ্রভুর কাছে আপনার এই প্রার্থনা নিবেদন করব। তিনি আপনার প্রার্থনা স্বীকার করবেন বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।’
‘না মহাশয়। এ আমি কখনোই চাইব না। আজ যদি বারোশো শিল্পীর স্ত্রী এই একই কামনা করে, তবে মন্দির কীভাবে তৈরি হবে? আর যদি মন্দির নির্মাণে বাধা পড়ে, তাহলে উৎকলের শিল্পকলার বিজয়গাথা রচিত হবে কী করে? না, না। আমি কখনো তা চাই না। আমি চাই, আমার স্বামীর কীর্তি কোণার্কের পাষাণখণ্ডে অমর হয়ে থাক। যুগ-যুগান্ত ধরে ওঁর হাতের শিল্প উৎকলের অভিমান হয়ে বিশ্ববাসীর কাছে জীবিত হয়ে থাকবে। প্রত্যেক স্ত্রী-ই চায় তার স্বামী অক্ষয় হোক, অমর হোক। আমিও তাদের মতোই। একমাত্র কোণার্কই পারবে আমার স্বামীকে অমর করে দিতে।’
‘সাধু, সাধু! মহান আপনার চিন্তা, মহৎ আপনার ভাবনা দেবী! কিন্তু অমন ভাবলে আপনার দুঃখ থেকে যে নিস্তার পাবেন না?’
‘আমার স্বামীও দুঃখেই দিন কাটাচ্ছেন। পতি দুঃখে থাকলে, সতীর জীবনে সুখ কি শোভা পায়?’
নৃসিংহ দেব স্তম্ভিত হয়ে পড়লেন। তাঁর মনে একটাই ভাবনা ঘুরপাক খেতে লাগল, ‘এই সরলা কিশোরী বারবার আমাকে ধিক্কার জানিয়ে চলেছে। একজন উৎকৃষ্ট শাসক রূপে আমার যে গর্ব ছিল, তাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে চলেছে এই বধূ। আজ অবধি আমি পরাজয়ের স্বাদ পাইনি, কিন্তু আজ এই মেয়ে বারংবার আমাকে পরাস্ত করে চলেছে।’
মনের কথা মনেই চেপে রেখে মহারাজ মুখে বললেন, ‘কিন্তু আপনি কীভাবে জানলেন যে আপনার স্বামী কষ্টে আছেন, দুঃখে আছেন? বারোশো শিল্পী এবং সংলগ্ন শ্রমিকদের আহার, আবাস, বস্ত্র, স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষার নিখুঁত ব্যবস্থা করেছেন মহারাজ নৃসিংহ দেব। কোনো কিছুরই অভাব নেই।
বলাই নায়ককে ব্যয় সংক্রান্ত বিষয়ের এবং আল্লু নায়ককে ভাণ্ডারের অধীক্ষক করা হয়েছে। গঙ্গা নায়ক ওখানকার লেখাকার। বয়ালিস বাটীর শ্রী ভ্রমরবর হরিচন্দন আয়-ব্যয়-রক্ষক। রূপাশগড়ের দলবেহরা শিল্পীদের প্রত্যেক প্রয়োজনীয় বিষয়ের খেয়াল রাখছেন। যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে অবকাশ পেলেই মহারাজ নিজে শিল্পীদের দেখাশোনা করতে যাচ্ছেন। স্বয়ং মহারানি সীতা দেবী নির্মাণস্থলে গিয়ে শিল্পী, শ্রমিকদের সুখ–দুঃখের দিকে সজাগ দৃষ্টি রেখেছেন। সন্তানের খিদের ধরন যেমন মা চিনে নেয়, ঠিক তেমন ভাবেই মহারানি প্রতিদিন প্রখর নিরীক্ষণ করে চলেছেন।’
‘কিন্তু আপনি এত কথা জানলেন কীভাবে? আপনি তো বললেন যে, আপনি দূর গ্রামের বাসিন্দা?’
‘যে গ্রামেরই বাসিন্দা হই না কেন, সে তো এই রাজ্যেরই অংশ। পুরোহিত মানুষ আমি। অসংখ্য যজমান। সংবাদ হেঁটে এসে কানে পৌঁছে যায়।’
‘হেঁটে-আসা সংবাদের মধ্যে কোণার্ক শিল্পী, শ্রমিকদের বার্তাও থাকে বুঝি?’
‘থাকে, দেবী। এত বড় নির্মাণকাজ চলছে! তার সংবাদ চাপা থাকে নাকি?’
‘তাহলে শুনুন পুরোহিত মশাই, আপনার কাছে শুধু তাদের সুখের কথাই এসে পৌঁছেছে। দুঃখের কথাগুলো কেউ বলেনি। তাদের কষ্টের কথাগুলো কেউ শুনতেও চায়নি। সে দুঃখ সে কষ্ট সে ব্যথা শরীরের নয়, মনের। তাদের মনের খবর আপনার রাজাও জানেন না, রানিও জানেন না, আর আপনিও জানেন না।’
‘রাজার কাছে কারো কোনো কথা চাপা থাকে না। শুনেছি, তিনি নাকি ছদ্মবেশে রাজ্যের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়ান।’
‘সে হয়তো ঘোরেন, কিন্তু এই দুঃখের কথা কখনোই জানতে পারবেন না তিনি। তিনি হয়তো যুদ্ধের সৈনিক কিংবা কোণার্কের শিল্পী-কারিগরদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অভাবের কথা জিজ্ঞাসা করেন এবং তাদের অভাব পূরণ করেন। কিন্তু জানেন কি সেইসব সৈনিক বা শিল্পীর বধূর কথা? জানেন তাঁদের অন্তরের হাহাকার, মনের কষ্ট? কেউ বলে নাকি এইসব কথা আপনার রাজাকে? বলুন না, বলে কেউ?’
‘কী তাঁদের মনের বেদনা? কীসের হাহাকার?’
‘আপনি ব্রাহ্মণ মানুষ। জ্ঞানে, অভিজ্ঞতায় আমার থেকে অনেক বেশি পরিপক্ক। আপনাকে আর আলাদা করে কী বলি বলুন তো? এই অসময়ে, একান্তে, একজন পরপুরুষের সামনে নিজের মনকষ্টের ব্যাখ্যা দিতে আমি অপারগ। আপনি জগন্নাথ দেবের সেবক জেনে এটুকু যে বলতে পেরেছি এটাই অনেক।’
‘ভয় পেও না, মা! সঙ্কোচ কোরো না! এতে তোমার মনের বোঝা কমবে। তোমার দুঃখের কাহিনি জগন্নাথ স্বামীর সেবকের কাছে বলছ মানে এটুকু জেন স্বয়ং জগন্নাথ মহাপ্রভুই তা শুনছেন। হতেও তো পারে যে আমি তোমার কোনো উপকারে লাগলাম?’
‘পুরোহিত মশাই, খাদ্য, বস্ত্র, পরিবারকে ভূমিদান, কিছু মাসিক দ্রব্য, এইটুকুতেই কি এই পরিবারগুলোর সমস্ত কষ্ট দূর হয়? বারো বছরের বিরহ বেদনার উপশমের জন্য মহারাজ নৃসিংহ দেব কী দেবেন? তার কোনো মূল্য হয় কি? এই দারুণ বিরহের একটি মুহূর্তের মূল্য দেওয়ার ক্ষমতাও আপনার মহারাজার নেই।’
নৃসিংহ দেবের মুখ দিয়ে একটি কথাও সরল না। কিন্তু অন্তরে ঝড় উঠেছে যে, তাই নিরুত্তরও থাকতে পারলেন না। নির্বিকার ভাবেই বললেন, ‘দেবী, জাতির বৃহত্তর লক্ষ্য স্পর্শের খাতিরে ব্যক্তির নিজস্ব সুখ ত্যাগ বাঞ্ছনীয়। এই জগতের অনেক অমর কীর্তিকথার নেপথ্যে অসংখ্য ব্যক্তি জীবনের পবিত্র ত্যাগের কথা জড়িয়ে আছে।
আপনি সম্ভবত জানেন না যে, কোণার্ক বাস্তবে একটি সন্ন্যাস-পীঠ। জিতেন্দ্রিয়তার পীঠ। ত্যাগের পীঠ। উৎসর্গের পীঠ। পদ্মক্ষেত্র কোণার্কে সূর্য এবং পদ্মের নিষ্কাম প্রেমকে আদর্শ মেনে অখণ্ড ব্রহ্মচর্য পালনের মাধ্যমে যদি শিল্পীরা নিজেদের শিল্পের প্রতি চরম পরাকাষ্ঠা দেখাতে পারেন, তবেই কোণার্ক মন্দির নির্মাণ সম্ভব হবে। উৎকলের ভবিষ্যৎ আজ উৎকলের শিল্পীদের সংযম ও জিতেন্দ্রিয়তা এবং শিল্পী-বধূদের নিষ্ঠার উপর নির্ভর করছে। আশা করি, মহারাজের এইটুকু কামনা অনুচিত বলে আপনি গণ্য করবেন না।’
‘অবশ্যই…অবশ্যই উৎকলের ভবিষ্যৎ উৎকলের শিল্পী এবং তাঁদের প্রিয়তমাদের কাছে এই আশা করতেই পারে। অধিকার আছে বইকি। কিন্তু প্রজার আদর্শ হলেন রাজা। উৎকলের ভবিষ্যতের জন্য সব বলিদানই কি প্রজাদের দিতে হবে? এক্ষেত্রে কি রাজার কোনো ভূমিকা থাকবে না?’
‘ঠিক বুঝতে পারলাম না।’
‘জানি বুঝবেন না।’
‘আপনি যদি বোঝান, ঠিক বুঝব।’
‘বারো বছর ধরে একজন কোণার্ক-শিল্পী তাঁর সাধনার চরম পরাকাষ্ঠা নিয়ে, অখণ্ড ব্রহ্মচর্য পালন করে, নিজের কামনা-বাসনাকে উৎসর্গ করবেন। বারো বছর ধরে নিজের আশ-উচ্ছ্বাসের গলা টিপে তাঁদের বধূরা নিজেদের সমস্ত যৌবন, নিজেদের ঋতুক্ষমতাকে সময়ের আগুনে নিবেদন করবেন। কিন্তু স্বয়ং মহারাজ কি এই বারোটা বছরের মন্দির নির্মাণের পর্বে সংযম, ব্রহ্মচর্য আর নিষ্ঠার পালনে নিজের কামনা, বাসনা, ভোগের সমস্ত আবেগকে কোণার্কের ধুলোয় অর্পণ করতে পারবেন? আছে আপনার মহারাজের এত সাহস?
আর যদি তা না-ই থাকে, তবে তিনি কীভাবে শিল্পীদের কাছে, তাঁদের পরিবারের কাছে এত কিছু আশা করেন? যা একজন রাজার পক্ষে সম্ভব নয়, তা প্রজারা করবে কীভাবে? কেনই বা করবে? রাজার শরীরেই একমাত্র রক্ত-অস্থি-মজ্জা-বীর্য আছে, আর পাষাণের বুকে খোদাই করে করে শিল্পীর শরীর পাষাণের হয়ে গেছে বুঝি? শিল্পীদের কামনা-বাসনারাও কি পাথর হয়ে গেছে? আপনি একজন বিচক্ষণ মানুষ। একটি বার আমার কথাগুলো বিবেচনা করে দেখুন,’ গভীর উদ্বেগে কিশোরীর তনু তখন থরথর করে কাঁপছে।
কিশোরীর সামনে দাঁড়িয়ে প্রবল পরাক্রমী নৃসিংহ দেব চকিত, মর্মাহত। সত্যিই তো, তিনি এর আগে এই কথাগুলো কখনো ভেবেই দেখেননি, বিচার করেননি। তাঁর কাছে এতদিন একজন শিল্পী শুধুই স্রষ্টা হিসেবে পরিগণিত হয়েছেন। সে-ও যে একজন মানুষ, তারও কামনা-বাসনা-দেহ ভোগের লিপ্সা থাকতে পারে, তা তিনি আগে কখনো উপলব্ধিই করেননি। এই বালিকাবধূ বয়সে ছোট হলেও তার কথায় বিন্দুমাত্র মিথ্যে নেই।
নৃসিংহ দেব তার সামনে নতজানু হয়ে বললেন, ‘আমার প্রণাম স্বীকার করুন, দেবী! আমি আপনার থেকে বয়সে অনেক বড়, আপনি কিশোরী, কিন্তু আপনি অনেক বেশি বিবেচক ও বিচক্ষণ। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি—আপনার মনের সব ক্ষোভ আমি জগন্নাথ স্বামীর কাছে পৌঁছে দেব। তারপর তিনি যা নির্দেশ দেবেন, রাজাও সেইমতো চলবেন।’
‘ক্ষমা করুন, পুরোহিত মশাই। রাজার প্রতি কিন্তু আমার কোনো অভিযোগ নেই। আপনাকে অত্যন্ত সহৃদয় ব্যক্তি বলে মনে হয়েছে আমার, তাই এতগুলো কথা বলে ফেললাম। যা বলেছি, তা এখনই ভুলে যান। মহাপ্রভু জগন্নাথ স্বামীর কাছে আপনি মহারাজের মঙ্গল কামনা করবেন। প্রার্থনা করবেন যেন কোণার্ক-মন্দিরের নির্মাণ শীঘ্রই সম্পন্ন হয়।’
‘অবশ্যই মা। আর আমি আপনার স্বামীর মঙ্গল কামনাও করব। কী নাম তাঁর?’
‘নিজের স্বামীর নাম এই মুখে কী করে আনব পুরোহিত মশাই? তাছাড়া শুধুমাত্র আমার স্বামীর নাম জেনেই বা কী হবে? এই ব্যথা, এই বেদনা তো আমার একার নয়, বারোশো শিল্পীর আর তাদের প্রিয়ার।’
‘আপনি ধন্য, দেবী! আপনাকে একটাই কথা বলতে পারি, এই কঠিন সময়ে পাষাণের মতো ধৈর্য ধরুন। সুখী হোন। জগন্নাথ স্বামী আপনার কল্যাণ করুন!’
যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে স্বামী ফিরে এসেছেন। সীতাদেবী শয়নকক্ষে অভিসারিকার সাজে অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু স্বামীর মুখেচোখে হতাশার ছায়া দেখে চিন্তায় পড়ে গেলেন মহারানি, ‘এ কী দশা আপনার? মহারাজ, সব কুশল তো?’
‘হ্যাঁ রানি, জগন্নাথ দেবের কৃপায় এখনও অবধি সব ঠিকই আছে।’
‘কিন্তু আপনাকে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন? কী হয়েছে মহারাজ?’
‘কিছুই হয়নি, দেবী। আপনাকে আমার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল তাই না? বিলম্বের জন্য ক্ষমা চাইছি।’
‘আপনার প্রতীক্ষায় এই জীবন শেষ হয়ে গেলেও আমার মনে কোনো দুঃখ, কোনো গ্লানি থাকবে না। আপনাকে পেয়ে আমি পূর্ণতা লাভ করেছি।’
‘কিন্তু কোণার্ক এখনও অসম্পূর্ণ রানি। আর যতক্ষণ না অবধি কোণার্ক সম্পূর্ণ হচ্ছে, ততক্ষণ আমিও অপূর্ণ থেকে যাব।’
‘কোণার্কও পূর্ণ হবে মহারাজ। আমি নিজে কোণার্কের কাজ সম্পূর্ণ হতে যা যা প্রয়োজন, সব করব।’
‘আমি জানি মহারানি, আমি জানি। আপনি স্বয়ং রোদ–জল–বৃষ্টি মাথায় নিয়ে নির্মাণস্থলে গিয়ে শিল্পীদের সুখ-সুবিধার খেয়াল রাখছেন। আমি সব জানি। কিন্তু কোণার্ক অন্য কিছু চায়।’
‘কী চায় কোণার্ক? বলুন মহারাজ। আপনি আদেশ করুন।’
‘আমি একটা স্বপ্নাদেশ পেয়েছি মহারানি। কোণার্কের কাজ নিষ্ঠাভরে পূর্ণ করার জন্য আমাদের দুজনকেই একটি ব্রত পালন করতে হবে।’
‘ব্রত? কী ব্রত? বলুন মহারাজ, আগামীকালই পুরোহিত ডেকে ব্রত পালনের সমস্ত ব্যবস্থা করা হবে।’
‘আমার কথা সম্ভবত আপনি বুঝতে পারেননি মহারানি। শ্রীকৃষ্ণ–পুত্র শাম্ব বারো বছর ধরে ব্রহ্মচর্য পালন করে সূর্যদেবের উপাসনা করেছিলেন। তখন থেকেই অর্কক্ষেত্র জিতেন্দ্রিয় পীঠ। কোণার্কের শিল্পীরা বারো বছর ধরে ব্রহ্মচর্যের ব্রত নিয়ে মন্দিরের নির্মাণকাজ করবেন। সেইসঙ্গে তাঁদের পত্নীরা আগামী এক যুগ ধরে এই ভাগ্যলিখন মানতে বাধ্য হবেন। আমি রাজা, আমার উচিত তাঁদের সমুখে আদর্শ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা। মহারানি, আমাদের দাম্পত্যে আমি আপনার কাছে আগামী বারো বছরব্যাপী সন্ন্যাস চাইছি। এর অন্যথা হলে কোণার্ক পূর্ণ হয়েও অপূর্ণ থেকে যাবে।’
‘কোণার্ক পূর্ণ হবে মহারাজ। সর্বতোভাবেই পূর্ণ হবে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।’
সীতাদেবী এক এক করে নিজের অভিসারিকা বেশ খুলে ফেললেন। কিছুক্ষণের মধ্যে এক সন্ন্যাসিনীর বেশে এসে দাঁড়ালেন নৃসিংহ দেবের সমক্ষে। মহারাজা নিজের দুই হাত জোড় করে তাঁকে বললেন, ‘আপনার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই দেবী। আপনার এই ত্যাগ শিল্পীদের জীবনের প্রেরণা হবে। প্রভুরও তা-ই ইচ্ছা।’
মহারাজ মন্থর গতিতে অন্তঃপুর থেকে বেরিয়ে এলেন।
দূরে সৈন্যশিবিরের বাইরে একটি কম্পমান দীপশিখা প্রাসাদের দিকে এগিয়ে আসছিল। মহারাজ দেখলেন বৈধব্যের শ্বেত চিহ্ন গায়ে নিয়ে তাঁর ভগিনী চন্দ্রাদেবী দ্রুতপায়ে মহলের দিকেই আসছেন। চন্দ্রাদেবীর পিছনে বারো খড়্গধারী পাইক। তারা তাঁকে মহল পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আসছে। চন্দ্রাদেবী যুদ্ধ থেকে ফিরে আসা সৈনিকদের কুশল সংবাদ নিতে শিবিরে গিয়েছিলেন।
মনে মনে স্বস্তি পেলেন নৃসিংহ দেব। উৎকলের বীরত্ব এবং উৎকলের শিল্পকলা দুই-ই, চন্দ্রাদেবী ও সীতাদেবীর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। উৎকল অবিজিতই থাকবে। কোণার্ক পূর্ণ হবে। উৎকলের সন্তানেরা নিজেদের কীর্তির কথা অমল অক্ষরে লিখে রেখে যাবে ভবিষ্যতের জন্য। কোণার্ক যেমন একধারে হবে সূর্যের শক্তির নিবাসস্থল, ভাস্কর আরাধনার মন্দির তেমনি অন্যদিকে হবে পরমার্দি দেবের নৈপুণ্য, শৌর্য, বীরত্ব এবং বিজয়ের স্মৃতির সৌধও।