সূর্য বিনোদিনী – ৪

সামনে বিছানো আছে নির্মাণের মানচিত্রের প্রতিলিপি। সুবল একমনে দেখে চলেছে মানচিত্রের প্রতিটি রেখা। মূল মানচিত্রটি মন্ত্রী সদাশিব সামন্তরায় মহাপাত্রের কাছে সুরক্ষিত রয়েছে। এক-এক করে সম্পূর্ণ ভাস্কর্যের রূপরেখা তার মানসচক্ষে ভেসে উঠতে লাগল—‘বিশালাকার সূর্য-রথ রূপে নির্মিত হবে মন্দির। রথের বারো জোড়া চাকা, বারো মাসের চব্বিশটি পক্ষের প্রতীক। গায়ত্র, ভ্রাতি, উষ্ণীক, জগতি, ত্রিস্তপ, অনুস্তপ এবং পঙক্তি সূর্যদেবের রথে জুতে থাকা এই সাতটি অশ্ব বা সপ্তাশ্ব সম্মিলিত রূপে সপ্তাহের প্রতীক।

পশ্চিমে আয়তাকার পীঠে সর্বমুখী মহাপ্রশস্ত গর্ভস্থল, পূর্বে প্রশস্ত মুখশালা, বিমানের দক্ষিণে, পশ্চিমে এবং উত্তরে ভিত্তি সংলগ্ন মিত্র, পূষণ এবং হরিদশ্ব নামক তিন পার্শ্ব-দেবতার মন্দির। মুখশালার পূর্বে, উত্তরে এবং দক্ষিণে তিনটি দ্বার। প্রত্যেক দ্বারের শেষে সোপান শ্রেণী, প্রত্যেক সোপান শ্রেণীর দুইধারে শিল্পখচিত স্তম্ভ।

পূর্ব দিকের সোপান শ্রেণীর স্তম্ভদ্বয়ের উপরে বিরাট সজীব গজসিংহের মূর্তি। দক্ষিণ সোপানের প্রান্ত ভাগে স্তম্ভের উপরে আরোহণ করে থাকবে দুটি সমরাশ্ব, উত্তর দিকে স্তম্ভের উপরে রণহস্তী।

পূর্ব দিকের সোপান শ্রেণী এবং নাট্য-মণ্ডপের পিছনের সোপান শ্রেণীর মধ্যে পঞ্চাশ হাত উঁচু অরুণ স্তম্ভ। মুখশালা থেকে দেউলের অভিমুখে যেতে শিল্পসজ্জিত দ্বার। গর্ভগৃহে পঞ্চরথের আকৃতির সিংহাসন, তাতে রত্নখচিত রত্নবেদী। রতনবেদীতে দেবপ্রতিমা, কুট্টিম থেকে সিংহাসন অবধি কলাখচিত সিঁড়ির শ্রেণী, সিংহাসনের নীচে হস্তী, তার পায়ের কাছে লতা এবং মধ্যে–মধ্যে অন্য পশুদের চিত্র। সিংহাসনের মধ্যে উপাসনার চিত্রে পূর্ণ বেশে নতজানু হয়ে মহারাজ নৃসিংহ দেব এবং সীতা দেবী। রাজ-দম্পতির সামনে–পিছনে পাঁচজন মন্ত্রী, ফুল দেওয়ার জন্য ঝুঁকে পড়েছে একজন সেবক।

সিংহাসনের সামনে দুইদিকে পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে উলট-সিংহ, পিছনের দুটি কোনায় একটি করে হাতি এবং তাদের উপরে উলট-সিংহ। নৈঋত কোণে ছায়া দেবীর এবং তারও নৈঋতে মায়া দেবীর মন্দির।’

মানচিত্র দেখতে দেখতে সুবল মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছিল। মানচিত্রটা গুটিয়ে হাত নিয়ে এবার সুবল নিজের শিবিরের বাইরে এসে দাঁড়াল। এখন পদ্মতোলা গণ্ডের ভূভাগটা সম্পূর্ণরূপে ওর চোখের সামনে ফুটে উঠছে। কিন্তু কী যেন চিন্তা করেই শিহরিত হল সে। চমকে উঠল সুবল, ‘না না, এ কিছুতেই হতে পারে না! এই নির্দিষ্ট ভূমিতে নির্ধারিত পরিকল্পনার মধ্যে যে অনেক বাস্তুদোষ আছে!’

ঠাকুরদার আশীর্বাদে, জ্ঞান ও গরিমার বলে সুবল মহারানা উৎকল ভূমির অদ্বিতীয় বাস্তুবিশারদ। ধারার রাজা ভোজ একাদশ শতাব্দীর পূর্বাব্দে বাস্তু শাস্ত্রের আকর গ্রন্থ ‘সমরাঙ্গনসূত্রধা’র রচনা করেছিলেন। সেই মহাগ্রন্থের তিরাশিটি অধ্যায়ের সবক’টাই সুবলের কণ্ঠস্থ। সে বিচলিত হয়ে উঠল। সময় নষ্ট না-করে সে তখনই মন্দিরের ভাস্কর্য–নিয়ন্তা বিশু মহারানার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলল, ‘ক্ষমা করবেন বরেণ্য, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই মহামন্দিরের নির্মাণের পরিকল্পনায় কিন্তু অনেক বাস্তুদোষ আছে। মন্ত্রীবর শিবেই সান্তারা মহাশয়কে বার্তা পাঠান।’

‘বাস্তুদোষ? কেমন বাস্তুদোষ, সুবল?’ বিশু মহারানার চোখে কৌতূহল খেলে গেল।

‘একটা নয়, একাধিক আছে।’

‘সে কী?’

‘প্রথমটা আস্থা এবং পরম্পরাজনিত। সূর্যদেবের গতির দিশা কী? পূর্ব থেকে পশ্চিমে। কিন্তু এই মন্দিরে সূর্যদেবের রথের অভিমুখ দেখুন। পূর্ব দিকে মুখ করে রয়েছে। বরেণ্য, আপনিই বলুন, সূর্য কবে পূর্ব দিকে যান?’

‘বুঝলাম। আর?’

‘মন্দিরের নির্মাণ রথের আকৃতির হওয়ার ফলে পূর্ব, অগ্নি এবং ঈশান কোণ খণ্ডিত হয়ে যাচ্ছে।’

‘আর?’

‘মন্দিরের পিণ্ড ঈশান ও অগ্নি কোণে কাটা এবং বায়ু ও নৈঋত কোণে এগিয়ে রয়েছে। প্রধান মন্দিরের পূর্ব-দ্বারের মুখে নৃত্যশালা। তার ফলে পূর্ব-দ্বারটি অবরুদ্ধ হয়ে যাবে। এ তো দ্বারবেধ! নৈঋত কোণে ছায়া দেবীর মন্দিরের ভিত প্রধান দেবায়তনের তুলনায় নীচে অবস্থান করছে। এবং তারও নৈঋতে মায়া দেবীর মন্দিরের ভিত্তি আরও নীচুতে থাকবে। অথচ বাস্তুশাস্ত্র বলছে, যে কোনো ধরনের নির্মাণের ক্ষেত্রে নৈঋত ভাগই সর্বাধিক উঁচু হওয়া উচিত। অগ্নি কোণে একটি গভীর কূপ থাকার কথা। বাস্তুবিদ্যার অনুসারে এই কুয়োর অবস্থান কেবল দোষই নয়, মহাদোষ। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণের ক্ষেত্রে অগ্নি কোণে জলস্রোত কীভাবে থাকতে পারে, মাননীয়?’

‘শুনছি আমি। আর কিছু?’

‘হ্যাঁ শ্রীমান, আরও আছে বইকি। দক্ষিণ এবং পূর্ব দিকে বিশাল দ্বার থাকবে। এর ফলে মন্দিরের খ্যাতি অম্লান থাকলেও বৈভব কিন্তু শীঘ্রই ক্ষীণ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। আমার মনে হয়, এই সমস্ত বাস্তুদোষ দূর করতে না-পারলে এই মন্দির সেই উদ্দেশ্য কখনোই সফল করতে পারবে না, যার জন্য এর নির্মাণ সংঘটিত হতে চলেছে।’

‘সূর্য-রথটির মুখ পূর্ব দিকে কেন থাকবে—তোমার এই শঙ্কার উত্তর হল এই যে, উদীয়মান সূর্যের রশ্মি মন্দিরে স্থাপিত সূর্যদেবের অভিষেক করবে বলেই এই মন্দিরকে পূর্বমুখী রূপে নির্মাণ করা হচ্ছে। এবং মন্দিরের সকল দ্বার বছরের বিভিন্ন ঋতুতে তথা দিনের বিভিন্ন সময়ে সূর্যের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করবে—এই উদ্দেশ্যেই পরিকল্পনা করা হয়েছে। সূর্যের গতির সাপেক্ষে প্রতিদিন সূর্যের প্রথম রশ্মি নাটমন্দিরের দ্বার হয়ে রত্নবেদী এবং সিংহাসনে আসীন দেববিগ্রহকে স্পর্শ করুক, এটাই উদ্দেশ্য। এই পরিকল্পনা অনুসারে দিনের বিভিন্ন সময়ে সূর্যরশ্মি মুক্ত ভাবে নাটমন্দিরে প্রবেশ করতে পারবে।’

‘কিন্তু স্বয়ং সূর্যদেব, মর্ত্যের মানুষের দ্বারা স্থাপিত নিজের বিগ্রহকে নিজেরই কিরণে অভিষিক্ত করবেন—এর ঔচিত্য নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন আছে, মহাশয়!’

‘জানি না! উচিত এবং অনুচিতের নির্ণয় না আমি করব, না তুমি। এবং বাকি সমস্ত বাস্তুদোষের ক্ষেত্রেও একটাই কথা তোমাকে বলতে পারি, এই ভূমিটাই মন্দিরের জন্য পাওয়া গিয়েছে। তোমার হাতে যে মানচিত্র আছে, আমাকেও তা-ই দেওয়া হয়েছে। এমতাবস্থায় না এই ভূমিটিকে পরিবর্তন করা সম্ভব, না এই মানচিত্র!’

‘কিন্তু আমরা শিবেই সান্তারা মহাশয়কে জানাতে তো পারিই? মন্দিরের মুখ্যদ্বার পশ্চিমমুখী হয়ে গেলেই কিন্তু অনেক দোষ আপনা আপনিই কেটে যাবে।’

‘শোনো সুবল, মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনা হয়ে গিয়েছে। যদি তা না-ও হয়ে থাকত, তাহলেও এই পরিবর্তন করা অসম্ভবই হতো। হয়তো বাস্তুশাস্ত্রে আমি তোমার মতো পারদর্শী নই, কিন্তু রাজসেবায় তোমার থেকে আমার অভিজ্ঞতা অনেক অনেক বেশি। আমার এবং তোমার কাজ মানচিত্রের অভিকল্পনাকে শিল্পের মাধ্যমে জীবন্ত করে তোলা, তাতে ত্রুটি সন্ধান করা নয়। অভিকল্পনের দায়িত্ব মন্ত্রী সদাশিব সামন্তরায় মহাপাত্র মহাশয়ের। বিশ্বনাথ মহারানা এবং সুবল মহারানার দায়িত্ব তাকে বাস্তবায়িত করা। এবং তাই আমি তোমাকে তোমার উপরে অর্পিত দায়িত্বটুকু পালন করার আদেশই দেব।’

‘কিন্তু…’

‘কোনো কিন্তু বা পরন্তুর স্থান নেই, সুবল। একটা কথা মন দিয়ে শোনো, যা যা বলেছ, তা তোমার আর আমার মধ্যেই থাকবে। ভুলেও অন্য কাউকে এই কথাগুলো বলতে যেও না। এখন যাও, মন দিয়ে নিজের কাজ করো।’

সুবল হতাশ হয়ে পড়ল। তাহলে কি বিশু মহারানা সমেত এই বারোশো শিল্পী বারো বছর যাবৎ যে ব্রহ্মচর্য পালন করবে তা শুধুমাত্র বাস্তুদোষের কারণে ধূলি-ধূসরিত হয়ে যাবে? সহায়ক ভাস্কর্যের পদে আসীন সুবলও নিজের সমস্ত কামনা-বাসনার গলা টিপে ষোল বছর ধরে ছেনির মৃদু আঘাতে পাথরের বুক কেটে যে কালজয়ী শিল্পের জন্ম দেবে, তা কালের কলেবরে বিলীন হয়ে যাবে। কারণ, তা আগে থেকেই অভিশপ্ত।

তাহলে কি ফিরে যাবে সুবল?

ফিরবে না-ই বা কেন?

যদি তার জ্ঞানের সদ্ব্যবহারই না হয়, তাহলে সে কেন তার শ্রম ব্যর্থ করবে? কেন? কেন?

বিদ্যার অহংকার তার নেই, কিন্তু গর্ব সে অবশ্যই করে। রাজকার্য যদি পূর্বনির্ধারিত যন্ত্রচালনা হয়ে থাকে, তাহলে সুবল সেই যন্ত্রের এক মূক দন্তুর-চক্র হয়ে বেঁচে থাকতে অপারগ।

সারা দিন ধরে সুবল ওই চিন্তাতেই ডুবে রইল। বার বার সে মানচিত্র খুলে খুলে দেখতে থাকল। ইশ, যদি আর কিছুদিন আগে আসতে পারত! যদি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনার আগেই তার হাতে এসে পড়ত এই মানচিত্রখানি, তাহলে হয়তো সে বিশু মহারানা এবং শিবেই সান্তারা মহাশয়কে বুঝিয়ে ঠিক সম্মত করিয়ে ফেলতে পারত। কিন্তু বিশু মহারানা বললেন, আর কিছু করার নেই। তাহলে? তাহলে এই নির্মাণের কাজে সহকারী হওয়ার প্রশ্নও ওঠে না। সে ফিরে যাবে! ফিরে যাবে সে! ফিরে যাবে!

চন্দ্রভাগার তটে অস্তাচলগামী সূর্যদেব সন্ধ্যার আলোককে যেন সিঁদুর রঙের কাপড় পরিয়ে দিয়েছেন। ক্ষুব্ধ সুবল মানচিত্র হাতে তুলে নিয়ে হাঁটা দিল বিশু মহারানার শিবিরের দিকে। শিবিরে প্রবেশ করতেই তার চোখে পড়ল যে বিশু মহারানা নিজেও শ্যেনদৃষ্টিতে মানচিত্রটাকেই দেখে চলেছেন। সুবলের পায়ের শব্দে তাঁর হুঁশ ফিরল। স্নেহভরা কণ্ঠস্বরে তিনি সুবলকে প্রশ্ন করলেন, ‘ব্যাপার কী, সুবল? আবার নতুন কোনো সমস্যা?’

‘না মহাশয়। এখন আর কোনো সমস্যা নেই। আর আগের সব সমস্যার একটা সহজ সমাধান আমি বের করে ফেলেছি। আমি এই নির্মাণকার্যের সঙ্গে কোনো ভাবেই যুক্ত থাকতে চাই না। আমি নিজের গ্রামে ফিরে যেতে চাই।’

মুহূর্তের জন্য যেন স্তম্ভিত হয়ে গেলেন বিশু মহারানা। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সুবল, কী বলছ তুমি?’

‘দেখুন, মহারাজা নৃসিংহ দেব যে মনকামনা নিয়ে মন্দির নির্মাণ করাতে চাইছেন, তা সিদ্ধ হবে না। এই স্থাপত্য চিরস্থায়ী হবে না, মাননীয়। যদি আমার জ্ঞানের ব্যবহারই না করতে পারলাম, তবে আমার শিল্প এবং শ্রমকে পণ্ড করে কী হবে? আমাকে ফিরতেই হবে।’

‘আচ্ছা, এখন বোসো! এ নিয়ে আমার যা বলার, তা পরে বলব। আগে আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দাও।’

‘প্রশ্ন? করুন। জানা থাকলে অবশ্যই উত্তর দেব।’

‘বলো তো দেখি, বিধাতা এই সংসারে সৃষ্টির দায়িত্বভার কাকে দিয়েছেন?’

‘নারীকে।’

‘একা নারী কি সৃজন করতে সক্ষম?’

‘না। সৃজনে পুরুষ এবং প্রকৃতি এই দুইয়ের সমাহার প্রয়োজন। সৃষ্টি করতে হলে নারীকে নরের সাহায্য নিতেই হবে।’

‘তাহলে কি একাকী সৃজন বা সৃষ্টি করা সম্ভব নয়?’

‘সম্ভব। শুধুমাত্র একজন শিল্পী একাকী সৃষ্টি করতে পারেন।’

‘বাহ্! এবার বলো, এমন কী আছে, যার বিস্তৃতি সাগরের থেকেও বেশি?’

‘মানুষের মন। মানবমনের বিস্তার সাগরের থেকেও বেশি।’

‘এত বড়, বিস্তীর্ণ মনকে, মনের ভাবকে, কয়েকটি শব্দে, কিছু রেখায়, কিছু পাথরের বুকে কে বাঁধতে পারে, সুবল?’

‘একজন শিল্পী। সে নিজের শব্দে, নিজস্ব রেখায়, কিছু পাথরের বুকে মানুষের মনকে, মনের ভাবকে, অনুভূতিকে বেঁধে ফেলে, সমাহিত করে।’

‘সুন্দর! অতি সুন্দর! আচ্ছা, এবার বলো, মানুষের এমন কী আছে, যাকে আগুন পোড়াতে পারে না?’

‘মানুষের ধর্মকে। মানুষের ধর্ম তার চিতার আগুনেও পুড়ে ছাই হয় না।’

‘তাহলে সুবল, একজন শিল্পীর ধর্ম কী?’

‘তার শিল্প, তার কলার মাধ্যমে সত্য, শুভ এবং সুন্দরের নিরূপণ করা।’

‘সা-ধু! সা-ধু! এবার শেষ প্রশ্ন, সর্বভুক, সর্বগ্রাসী কাল বা সময়ও কাকে গিলে খেতে পারে না, সুবল?’

‘মাননীয়, অপরাধ ক্ষমা করবেন, কিন্তু আমি আপনার এসব প্রশ্নের অভিপ্রায় বুঝতে পারছি না।’

‘তাতে কোনো সমস্যা নেই। এখন বুঝতে না-পারলেও পরে ঠিকই বুঝে যাবে। যে প্রশ্নটা করলাম, তার উত্তর দাও। সময়ও কাকে গিলে খেতে পারে না? যদি উত্তর দিতে না-পারো সেটাও বলো, আমিই উত্তরটা দিয়ে দেব।’

‘কীর্তি! কীর্তিকে সর্বগ্রাসী কালও গিলে খেতে পারে না।’

‘তাহলে যদি এই জগৎ সংসারে একমাত্র কীর্তিই কালের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত হয়ে থাকে, তুমি এত উদ্বিগ্ন হচ্ছ কেন? আটশো আর আট হাজার বছরের মধ্যে কী তফাত? এই দিন, সপ্তাহ, মাস কিংবা বছর, এগুলো সব সময়ের হিসেব করার জন্য মানুষের দেওয়া সংজ্ঞা। কাল অনাদি, কাল অনন্ত! তার চেয়েও আদি ও অনন্ত হল শিল্পের সম্ভাবনা। যদি এই নির্মাণ প্রলয়কাল অবধি টিকে থাকে, এবং প্রলয়কালে নষ্ট হয়, তাহলেও জানবে কীর্তি অক্ষয় অমর হয়ে রয়ে যাবে। উৎকলের কীর্তি! উৎকলের শিল্পের কীর্তি!

উৎকলের শিল্পীদের কীর্তি! আর উৎকলের শিল্পীদের এই কীর্তি নির্মাণের দায়িত্ব ছেড়ে তুমি ফিরে যেতে চাইছ, সুবল? কিন্তু যেতে পারবে কি? এই যে তুমি এখানে এসেছ, এ কি রাজার আদেশে? না, সুবল! তুমি এখানে এসেছ অদৃষ্টের আদেশে। তোমার নিয়তি তোমাকে এখানে টেনে এনেছে। আর নিয়তি অটল!

সুবল, তুমি উৎকলের শিল্পের আশা, ভবিষ্যৎ। তুমি নাহয় এখান থেকে চলেই গেলে, কিন্তু গিয়েও কি শান্তি পাবে? তোমার আত্মার কশাঘাতে অহরহ আহত হবে তুমি। এই রাজ্য, এই সমাজ এবং তোমার অন্তরাত্মা তোমাকে প্রতিদিন অগুনতি প্রশ্ন করবে। তোমাকে তোমার বিবেক জিজ্ঞাসা করবে যে, যখন এই উৎকলের শিল্পীরা কঠিন পাষাণকে নিজেদের ঘামে কোমল করে তারই বুকে কুঁদে কুঁদে কলাকৃতি নির্মাণ করছে, তখন তুমি কী করছ?

ব্যক্তি বলো, বস্তু বলো বা বাস্তুই বলো, দীর্ঘকালীন অস্তিত্বে কারো কোনো গুরুত্ব নেই। গুরুত্বপূর্ণ শুধু তার কীর্তি। এই ভাস্কর্যের কীর্তিও এর দীর্ঘ অস্তিত্বের দ্বারা নয়, এর অদ্বিতীয় শিল্পসৌকর্য দ্বারা অর্জিত হবে। আর সেই কীর্তির আলেখ্য এক এবং একমাত্র তোমারই ছেনিতে উৎকীর্ণ করা সম্ভব, সুবল মহারানা। যে মহান পুরুষ শাম্বের জন্য এই পদ্মক্ষেত্র অর্কক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল, সেই শাম্বের পিতা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রণভূমিতে দাঁড়িয়ে এই রাষ্ট্রকে এক অমূল্য মন্ত্র শিখিয়ে গিয়েছিলেন—কর্ম করো, ফলের চিন্তা কোরো না। পরিণামের চিন্তা কেন করছ, সুবল?

কর্মণ্যেবাধিকারাস্তে—ভুলে গেছ, সুবল? তাহলে আবার স্মরণ করো! তুমি কেবল কর্ম করার অধিকারী। ফল তোমার হাতে নেই। ফলের আশায় আসক্ত হোয়ো না। নিরন্তর কর্মরত থাকো। শুধুই কর্ম করো। তোমার ছেনিই এই পাষাণের বুকে পদ্মের পাপড়ি ফুটিয়ে তোলার অদ্বিতীয় সামর্থ্য রাখে, সুবল। সেই ক্ষমতার সঙ্গে ন্যায় করা তোমার ধর্ম। নিজের সৃজনীশক্তির সবটা ব্যবহার করতে পারাই তোমার ধর্ম। সাগর যাকে বাঁধতে পারে না, সেই মানবমনকে নিজের শিল্পের রেখায় বেঁধে অমর করে দেওয়াই তোমার ধর্ম। তোমার পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে উত্তরাধিকারে পাওয়া উৎকলীয় শিল্পের দ্বারা তোমার এবং তোমার পিতৃপুরুষদের কীর্তি শিলালেখে উৎকীর্ণ করাই তোমার ধর্ম।

যদি এর পরেও তুমি চলে যেতে চাও, তো যেও। কোণার্কের সূর্যমন্দির তারপরেও তৈরি হবেই! হ্যাঁ, হয়তো তোমার শিল্পের অভাবে সেই মন্দির অদ্বিতীয় হবে না, কিন্তু তোমার পিতার বয়েসি আমি, এই বিশু মহারানা, নিজের অন্তিম শ্বাস পর্যন্ত এই মন্দিরকে অদ্বিতীয় করে তোলার সবরকম চেষ্টা চালিয়ে যাব!’

সুবল স্তম্ভিত হয়ে গেল। তার মস্তিষ্ক শূন্য, জিহ্বা অসাড়। দুই শিল্পীর মধ্যে শুধুই নিবিড় মৌনতা। সুবলের কানে গুঞ্জরিত হতে লাগল বিশু মহারানার উক্তি, ‘তুমি কেবল কর্ম করার অধিকারী। ফল তোমার হাতে নেই। ফলের আশায় আসক্ত হোয়ো না। নিরন্তর কর্মরত থাকো। শুধুই কর্ম করো।’

মৌন ভঙ্গ হল না। সুবল অধোমুখ হয়ে বসে রইল। তার চিন্তারা এবার পথ পরিবর্তন করে ফেলেছিল। সত্যিই তো, যদি সে ফিরে যায়, তাহলে সারা উৎকল কী বলবে? বলবে, সুবল প্রেমের সঙ্গে পবিত্রতা, ত্যাগ এবং উৎসর্গের পরীক্ষায় অসফল হয়ে গেছে। কী ভাববে তার বুড়ি মা? কী-ই বা ভাববে তার থেকে আট বছরের ছোট ভাই ধবল? উৎকলের জাতীয় গৌরবের নাম শোনামাত্র তার কল্পে নিজের সমস্ত সাধ, কামনা, বাসনা, অভিলাষার বলিদানকে সৌভাগ্য মনে করে যে বিনোদিনী, সে-ই বা কী ভাববে? যখন বিনোদিনীকে বাইরের কেউ এই নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবে; বলবে যে, সুবল ফিরে এল কেন; তখন কী হবে?

স্বামীর অক্ষয় কীর্তির কামনায় সে শূন্য শয্যায় নিজের মধুযামিনী কাটিয়েছে। স্বামীর কোণার্ক-শিল্পী হয়ে ওঠার যূপকাষ্ঠে এই যে তার ত্যাগ, পতির কল্যাণ-কামনায় প্রতিদিন নীরবে তুলসীমণ্ডপে তার জলসিঞ্চন, সান্ধ্যপ্রদীপ প্রজ্জ্বলন, গৃহের সমস্ত অন্ধকারকে নিজের মনের কোণে লুকিয়ে রেখে স্বামীর গৌরবময় প্রত্যাবর্তনের জন্য অপেক্ষা করা—সেই অক্ষয় কীর্তি, সেই গৌরব, সেই শিল্পীসত্তাকে এভাবে হত্যা করে সুবল গৃহে ফিরলে কেমন লাগবে তার?

বিশু মহারানাই ঠিক বলছিলেন। নিয়তিই তাকে নিয়ে এসেছিল। তার ফেরার পথ ছিল না। সে ফিরতে পারবে না। সুবল মনে মনে বলতে থাকে, ‘আমি ফিরব না, বিনোদিনী। তোমার স্বামী একজন কোণার্ক-শিল্পী, এই গৌরব থেকে তোমাকে বঞ্চিত করার অধিকার আমার নেই। বারো বছর পরে আমি ঠিক ফিরে আসব। ষোল বছর লাগে লাগুক! কিংবা হয়তো ফিরবই না। আমি জানি না। হয়তো তখন আর আমাদের প্রেমের প্রতিমায় চক্ষুদান করার মতো প্রাণশক্তি না তোমার থাকবে, না আমার। প্রেমের পরিণতি তো জরা, ব্যাধি এবং মৃত্যুতেও মেলে। আমি তোমাকে জীবন আর মৃত্যুর ঊর্ধ্বে নিয়ে যাব, বিনোদিনী। তোমাকে আমি অনন্ত-যৌবনা করে দেব। অমর করে দেব তোমাকে। তোমাকে আমি পাথরের মতো কঠোর করে দেব। আমিও পাথর হয়ে উঠব। পাষাণের মতো মন নিয়ে পাথরের বুকে তোমায় আমি উৎকীর্ণ করব। এই কোণার্কের শিলায় শিলায় তোমার মুখই পদ্ম হয়ে ফুটে উঠবে। সুবল মহারানা ফিরবে না। সে কোণার্কের পাষাণে পদ্ম ফোটাবে।’

চিন্তার জালে আবদ্ধ সুবলের মনের কথা কখন যে মুখে ফুটে উঠেছে সে খেয়ালই করেনি। কিন্তু তার এই কথাতেই বিশু মহারানা আশ্বস্ত হলেন। স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল তাঁর। তিনি উঠে সুবলের দুই কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘ওঠো, সুবল। স্বাভাবিক হও। নিজের জ্ঞানগৌরবের বাস্তব বোধ তোমার এতক্ষণে হয়েছে দেখছি। কোন জ্ঞানের ব্যবহার কখন আর কোথায় করবে সেটা জানাও প্রয়োজন। বাস্তুশাস্ত্রজ্ঞ সুবল মহারানাকে নয়, শিল্পী সুবল মহারানাকেই আজ উৎকলের প্রয়োজন। তোমার ছেনির আঘাতে এই ভাস্কর্যকে এমন শিল্প দিয়ে যাও, যার কথা একদা সারা বিশ্ব বলবে।

ওঠো, হে কোণার্ক-শিল্পী। আজ রাতে অথবা কাল ভোরে এই রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যাচার্য সৌম্য শ্রীদত্ত তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। এখনও পর্যন্ত তুমি যত মূর্তি, যত প্রতিমা গড়েছ, তাদের দেখে তিনি উচ্ছ্বসিত। কোণার্ক মন্দিরের গায়ে প্রতিমা ও মূর্তি নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনি তোমাকে কিছু নির্দেশ দেবেন।

মূর্তি সংক্রান্ত যোজনার দেখাশোনা করছেন নাট্যাচার্য। এবং তাই ওঁর পরিকল্পনা অনুসারেই মূর্তি নির্মাণ এবং স্থাপনা করা হবে। আনন্দের কথা হল, তোমার কাজ দেখে মূর্তির নৃত্য ভঙ্গিমা এবং ধ্বনির আকার দেওয়ার জন্য তিনি তোমাকেই চয়ন করেছেন। তোমার উপরে আমার অনেক আশা, সুবল। মনে আর কোনো ক্ষোভ, কোনো রোষ রেখো না। যে কোনো ধরনের মানসিক অসন্তোষ কিন্তু তোমার শিল্পনৈপুণ্যের প্রতিকূলে যাবে। সমস্ত গ্লানিকে মন থেকে দূর করে কাজে লেগে পড়ো।’

‘মাননীয়, আমার মনে আর কোনো ক্ষোভ নেই, কোনো গ্লানি নেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, আপনার আশানুযায়ী আমি নিজেকে শিল্পের মাধ্যমে স্বয়ংসিদ্ধ করতে পারব। আমার হেতু আপনাকে যে মানসিক উদ্বেগ সহ্য করতে হল, তার জন্য আমি আপনার ক্ষমাপ্রার্থী। যুদ্ধক্ষেত্রে আগামী শোকে কাতর সব্যসাচী অর্জুনকে উদ্বোধিত করেছিলেন যোগীরাজ শ্রীকৃষ্ণ। আজ ভাবে কাতর সুবল মহারানাকে মানসিক ঝঞ্ঝাবাত থেকে উদ্ধারের কাজে আপনি স্বয়ং মাধবের রূপ ধরে এসেছেন আমার কাছে। আমি আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব। বিশ্ববাসী সুবল মহারানার ছেনির চমৎকার যুগ-যুগান্তর ধরে দেখবে। অবশ্যই দেখবে! আমি আপনাকে কথা দিলাম!’

বিশু মহারানার শিবির থেকে সুবল বেরিয়ে এসেছে তা প্রায় অনেকক্ষণ হল। চন্দ্রভাগার পাড়ে দূরে ঝাউবনের দিকে মুখ করে আপন মনে কি যেন ভেবে চলেছে সুবল। হঠাৎ মনে হল যেন মুক্ত আকাশ হতে তারার দল পুষ্পবৃষ্টির মতো নেমে আসছে ঝাউয়ের বনে ওপর। অচিরেই ভুল ভাঙল সুবলের। আসলে অসংখ্য জোনাকির জ্বলা-নেভা দেখে আকাশের তারা বলে ভ্রম হয়েছিল।

জোনাকিদের নরম আলোর খেলা দেখতে দেখতে একটা সময় পদ্মপুকুরে স্নানরতা বিনোদিনীর মুখটা ভেসে উঠল সুবলের মানসপটে। সুবলের মন প্রিয়া-পরিণীতার স্মরণে কেঁদে উঠল। আর তার শিল্পী মন অস্ফুটে বলে উঠল, ‘আমি পাষাণে পদ্ম ফোটাব, বিনোদিনী!’

প্রেয়সী বিনোদিনীর স্মরণে উচ্চারিত এই কথাগুলো নদী চন্দ্রভাগার কলকল ধ্বনিতে বয়ে চলল তার গতিপথ ধরে। বহু দূরে বিনোদিনী তখন স্বামীবিহীন গৃহের এক কোণে স্থাপিত জগন্নাথ স্বামীর প্রতীক-মূর্তির সামনে প্রদীপ জ্বালিয়ে, জোড়হাতে আঁচলের খুঁট ধরে, চোখ বন্ধ করে কোণার্ক-শিল্পীর জন্য মঙ্গলকামনা করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *