৩
খণ্ডগিরির কাছেই একটি গ্রামের শিল্পীদের কুল-গৌরব হল সুবল মহারানা। বিশ–বাইশ বছরের হৃষ্টপুষ্ট, সুশোভন এক যুবক। সুঠাম দেহ, গোধূম বর্ণ, উন্নত নাসিকা, সৌম্য মুখমণ্ডল, ঘন শ্যাম-কুঞ্চিত কেশ। গ্রামের বধূদের প্রিয় দেবর। খুব ছোটবেলাতেই কাছের একটি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের এক সুন্দরী কন্যার সঙ্গে তার বিয়েও হয়ে গিয়েছে। এই অঘ্রাণেই দ্বিরাগমন। গ্রাম-বধূরা এই নিয়ে তার সঙ্গে মশকরা করে, এবং সে লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে।
সুবলের বধূর দ্বিরাগমনের তিথি এগিয়ে আসছে। সুবল মাঝে মাঝে বউয়ের কথা ভাবে। ভাবে সে বুঝি শিল্পীর চোখে লালিত স্বপ্নের মতো সুন্দর। নিজের স্ত্রীর কথা মনে পড়লেই সুবলের চোখের স্বপ্ন শরৎ ঋতুর নীলাভ আকাশের থেকেও বেশি সুন্দর আর সাগরের থেকেও বেশি গভীর হয়ে যায়। তার স্ত্রীর নাম বিনোদিনী। বিধাতার হাতে গড়া শ্বেতপাথরের সেই প্রতিমাকে কোন ছোটবেলায় সে দেখেছে। এখন না-জানি সেই রূপ কীরূপে বিকশিত হয়েছে!
আজ হয়তো বিনোদিনীকে দেখলে চিনতেও পারবে না সুবল। তার সৌন্দর্য নিষ্কলুষ ফুলের সুগন্ধ হয়ে গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে চলে আসে সুবলের কাছে। সুবলের শিল্পীমন তাকে দেখার জন্য উৎকণ্ঠিত। সে ভাবে, বিনোদিনীকে দেখার পর, তাকে স্পর্শ করার পর সে আরও…আরও বেশি সুন্দর মূর্তি গড়তে পারদর্শী হয়ে উঠবে। তার রূপ-কল্পনার সময় সুবলের চোখে আধফোটা পদ্মের অনুরাগ-রঞ্জিত এক লজ্জাবতীর ছবি জন্ম নেয়।
সুবলের মা নববধূর জন্য গেরস্থালি সাজায় আর বলে, ছেলের সুখ, সৌভাগ্য, যশ, কীর্তি, স্বাস্থ্য, সন্তোষ আর দীর্ঘ আয়ুর বর নিয়ে লক্ষ্মী প্রতিমা বধূ বিনোদিনী এই ঘরে পা রাখবে। বধূর চরণই শ্রীদেবীর চরণ। শুভাগমনের তিথি, বার, নক্ষত্র এবং লগ্ন ইতিমধ্যে সবই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে।
সুবলের বন্ধু রজত সুবলের মনের খবর রাখে। তার পরিণীতা স্ত্রী বিনোদিনীদের পাশের গ্রামের মেয়ে। সে এখন বাপের বাড়িতেই রয়েছে। কয়েক মাস আগে সে একটি পুত্রসন্তানের জননী হয়েছে। রজতকে তাই নিজের স্ত্রী-পুত্রকে গ্রামে ফেরানোর জন্য শ্বশুরগৃহে যেতে হবে। রজত সুবলকে জিজ্ঞাসা করে, ‘যাবে, সুবল? আমার বউ তোমাকে দেখলে খুব আনন্দ পাবে।’
‘বলছ, ভাই? আচ্ছা, দাঁড়াও। আমি মায়ের সঙ্গে একটু কথা বলে নিই।’
সুবলের মা গোড়াতেই ‘না’ করলেন না, তবে একটু মিষ্টি ভাবে ঘুরিয়ে বললেন, ‘দিনকাল যা পড়েছে! এত ইয়ে বাপু আমাদের সময় দেখিনি। এ বাড়িতে বউমার আসতে মাত্র আর বারোদিন বাকি আছে। দ্বিরাগমনের আগে এভাবে শ্বশুরবাড়ি যাওয়া কি মানায়?’
‘মা, আমি শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কথা বলিনি। রজত নিজের বউ-ছেলেকে আনতে ওর শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। সেটা অন্য গ্রামে, বিনোদিনীদের পাশের গ্রাম। তুমি তো জানোই, রজতের প্রথম সন্তান হয়েছে। আমি সঙ্গে থাকলে হয়তো পথে সুবিধা হবে বলেই আমাকে যেতে বলছে।’
‘কিন্তু পথে যে তোর শ্বশুরবাড়ির গ্রামটা পড়বে? আমি কি ঘাসে মুখ দিয়ে চলি? আমার চুলগুলো রোদে পাকেনি! যাক গে, রজতের বউটা বাপু খুব মিষ্টি। ওরকম বউ ঘরে ঘরে আসুক। অমন লক্ষ্মীমন্ত বউ আর বাচ্চাটাকে ঘরে আনতে যাচ্ছে, সেই কাজে বাধা দিয়ে তো আর পাপ বাড়াতে পারি না। যাবি যখন বলছিস, যা। কিন্তু মনে থাকে যেন সুবল, তোর শ্বশুরবাড়ির গ্রামের উত্তরদিক দিয়ে যে পথটা আছে, সেটা ধরে ফিরবি। ওই গ্রামে যেন দ্বিরাগমনের আগে তোর পা না-পড়ে, সুবল! এসব রীতি একটু মেনে চলতে হয় বাবা।’
রজতের স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে সুবলরা যখন তার শ্বশুরবাড়ির গ্রামের উত্তরদিকের পথটা ধরল, তখনই রজতের স্ত্রী চঞ্চলা বলল, ‘শোনো না, সামনেই একটা পদ্মপুকুর পড়বে। তার পাশেই বিরাট আমবাগান। ওখানে ছায়ায় একটু বিশ্রাম নেব। ছেলেকে দুধ খাওয়াতে হবে।’ নিজের কথা শেষ করেই চঞ্চলা রজতের দিকে তাকিয়ে অল্প হেসে চোখ টিপল।
শেষ দুপুরের পড়ন্ত নরম রোদে প্রতিটা গাছ, প্রতিটা গুল্ম কমলা হয়ে উঠেছে। দুটো গ্রামের মাঝামাঝি পদ্মে ভরা পুকুরটা নিজের আর আশপাশের শোভাবর্ধন করছে। দুই গ্রামেরই মেয়ে-বউরা এসে এখানেই স্নানপর্ব সারে। এই অসময়েও কয়েকজন কিশোরী পদ্মপুকুরে নাইতে নেমেছে। সুবল তেরছা চোখে ওই জলে কাউকে খুঁজে চলেছে। কোনো সরসীর অন্বেষণে সে ব্যাকুল।
চঞ্চলা সুবলের উদ্দেশে বলে উঠল, ‘যদি মিষ্টি খাওয়াবে কথা দাও, তবে একজনের সন্ধান দিতে পারি।’
‘আগে সন্ধান দাও, তারপর মিষ্টিমুখ করাব।’
‘ভাইটি আমার, মেয়েদের চোখ কখনো ভুল বস্তুর সন্ধান দেয় না।’
‘ভুল বা ঠিক তো বলিনি। সন্ধান দিলেই মিষ্টি বাঁধা।’
‘তাহলে অমন বাঁকা চোখে না-তাকিয়ে একটু সোজাসুজি দেখো দেখি। ওই যে, পরনে লাল শাড়ি, ওটাই তোমার হৃদয়েশ্বরী বিনোদিনী।’
সুবল এবার দুচোখ মেলে দেখল, গায়ে লাল শাড়ি জড়িয়ে উদ্ভিন্নরূপা এক কিশোরী পদ্মপুকুরে কোমর-জলে দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় আঁচল চাপা। দূর থেকে দেখলে পদ্মপুষ্পের বনে তাকেও পদ্ম বলেই ভ্রম হয়। রক্তিম শাড়ির পাপড়িতে আবৃত একটি পদ্মকেশরী মুখ। কাজল কাজল দুটি চোখ সত্যিই যেন ভ্রমরের মতো পদ্ম-কেশরে বসে মধুপান করছে।
তখনই পুকুরে স্নানরতাদের মধ্যে কেউ বলে উঠল, ‘ও রে ও সখী, ওই দ্যাখ—যাকে দিনরাত স্বপ্নে দেখিস, মনে সাজাস আর সোহাগ করিস, দ্বিরাগমনের দিন গুনিস, সেই সুবল মহারানা নিজেই চলে এসেছেন। দ্যাখ লো মুখপুড়ি! ওই যে…মাথায় জগন্নাথি প্রসাদবস্ত্রের পাগড়িতে ওটাই সুবল মহারানা। আমি চিনি। চান সেরে উঠে প্রণাম কর!’
বিনোদিনীর সখীরা সবাই একসঙ্গে খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসি তো নয়, পুকুরের জলে যেন জলতরঙ্গ উঠল। সুবল কাঁপা-কাঁপা হৃদয়ে নিজের সদ্যস্নাতা বালিকাবধূর মুখচ্ছবি দুচোখে ধরার চেষ্টা করছিল এমন সময়ে, লাল শাড়ি পরিহিতা ছপাক করে পুকুরের জলে ডুব দিল। কিশোরীর স্থানে জলে শুধু ঘূর্ণি দেখা গেল।
বিনোদিনীর সখীদের ওপরে বেশ রেগে গেল সুবল। হতাশ সুবল একদৃষ্টে জলের দিকে তাকিয়ে রইল, তার লাবণ্যবতী কখন উঠবে, জলের তলায় শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে না তো?
‘আজ নাহয় লজ্জা পেয়ে জলে ডুব দিয়ে দিল, বারোদিন পরে এ-ই তোমার গলার মালা হবে গো,’ চঞ্চলা সুবলকে উদ্দেশ্য করে বলল কথাটা। সুবল একবার কপট রাগের দৃষ্টি নিয়ে চঞ্চলার দিকে তাকাল। চঞ্চলা আবার বলল, ‘যাক গে, যেটুকু দেখা গেছে তাতে করে কি মিষ্টিমুখ করানো চলে?’
‘মিষ্টিমুখ তো হবেই, আজ আমার বন্ধু রজত তোমায় মিষ্টিমুখ করাবে। ওর মুখেও তো মিষ্টির স্বাদ লাগা চাই। আমাকে এই পথে ও-ই এনেছে, ওর দিকটাও আমার দেখা দরকার।’
‘নির্লজ্জ কোথাকার!’ চঞ্চলার এই ছদ্ম রাগ দেখে রজত আর সুবল জোরে–জোরে হাসতে লাগল।
ওরা আবার পথচলা আরম্ভ করল। কিছুটা দূরে গিয়ে কোনো এক অদম্য আকর্ষণের বশে সুবল পিছনে ফিরে তাকাল। বিনোদিনী জল থেকে মাথা তুলে সিক্ত লাল বস্ত্রে তাকে একদৃষ্টে দেখে চলেছিল। সুবল সেদিকে তাকাতেই সে আবার জলে ডুব দিল। পিছনে সখীদের কথার স্রোত আর কলকল হাসির রব উঠল।
চঞ্চলা ভ্রূ নাচিয়ে হাসি হাসি মুখে মৌন প্রশ্ন ছুড়ে দিল, ‘কেমন দেখলে?’
‘চলো চলো, আমরা এবার এগোই। নইলে আমার বিনোদিনী শুধু ডুবই দিতে থাকবে,’ সলজ্জভাবে সুবল উত্তর দিল।
পদ্মপুকুরের অন্যান্য পদ্মপ্রসূনের মধ্যে একটি সজীব পদ্মফুলের মনমোহন ছবি মনে গেঁথে নিয়ে সুবল ঘরে ফিরে এল।
মহারাজা নৃসিংহ দেবের মনে এখন একটাই চিন্তা—একটি বিশাল সূর্য মন্দিরের নির্মাণ করাতে হবে। তিনি নিজের মনের কথা মন্ত্রী সদাশিব সামন্ত রায় মহাপাত্রকে বললেন। এবং মন্ত্রী সদাশিব সামন্ত রায় মহাপাত্র ওরফে শিবেই সান্তারা মনপ্রাণ ঢেলে উদ্যোগী হয়ে পড়লেন।
শিবেই সান্তারা নির্মাণ বিভাগের মন্ত্রী তথা সমকালের একজন দক্ষ অভিযন্তা এবং স্থপতি। যোজনাটিকে বাস্তবায়িত করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিনি নিজের কল্পনাশীল মেধা এবং প্রযুক্তিগত বিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে সূর্য মন্দিরের মানচিত্র তথা প্রাক-কলন তৈরি করলেন। নৃসিংহ দেবের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পরে কার্যপদ্ধতি নির্ধারিত হয়ে গেল। অনুমান করা হল যে, এই নির্মাণে উৎকল রাজ্যের বারো বছরের সকল রাজস্ব লেগে যাবে। বারোশো কুশল শিল্পীদের সহায়তায় এই মন্দিরের মূল সংরচনার নির্মাণে বারো বছর সময় লাগার সম্ভাবনার কথাও অনুমান করা হল। সহায়ক স্থাপত্যের জন্য আরও চারটি বছর।
বয়ালিসবাটির ভ্রমরবর হরিচন্দন আয়–ব্যয়ের নিরীক্ষক রূপে নিযুক্ত হলেন। রূপাশগড়ের দলবেহরাকে দক্ষ শিল্পী আনয়নের ব্যবস্থার দায়িত্ব দেওয়া হল। কুশল শিল্পীর অভাব অবশ্য উৎকলে কোনোদিনই ছিল না। আগে থেকেই ভুবনেশ্বরের শত শত মন্দির, পুরীধামের বিশ্ববিখ্যাত জগন্নাথ মন্দির এবং রাজ্যের অন্য বিভিন্ন অঞ্চলের অনেক ছোট-বড় মন্দির উৎকলের শিল্পীদের দক্ষ স্থাপত্য-শিল্পের উদাহরণ তৈরি করেছিল। পদ্মতোলা গণ্ড নামক পুষ্করিণী বুজিয়ে সেখানেই মন্দির নির্মাণ করা হবে—এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের সঙ্গে-সঙ্গেই স্থাপত্যের জন্য ভূমির সমস্যার নিদানও পাওয়া গেল।
ওদিকে যখন থেকে মালিক ইখতিয়ারুদ্দিন উজবেগ বাংলার শাসক বনেছিল, তখন থেকেই সে গৌড় তথা রাঢ়ভূমিকে আবার নিজের অধীনস্থ করার জন্য উৎকল রাজ্যকে বার বার আঘাত হানছিল। প্রতিটা ছোটখাটো যুদ্ধে উৎকল এখনও বিজয়ীই হচ্ছিল। বিবশ, পরাজিত উজবেগ এবার দেহলি থেকে বড় ধরনের সৈন্য-সাহায্য চাইল, এবং বলবন উজবেগকে সাহায্য করার জন্য সত্যি সত্যিই বিরাট সৈন্যসাহায্য পাঠিয়ে দিল।
এবারে পরিস্থিতি অন্যরকম দাঁড়াল। নৃসিংহ দেব এক বিশাল সূর্য মন্দিরের নির্মাণে ব্যস্ত, একই সময়ে তাঁর মাতৃভূমির শিয়রে শমন।
রাজ্যের প্রত্যেক গ্রামেগঞ্জে ঢেঁড়া পিটিয়ে ঘোষণা করা হতে লাগল—
‘শোনো…শোনো…শোনো…মহারাজ নৃসিংহ দেবের আদেশ…মহারানি সীতা দেবীর ইচ্ছা…রাজমাতা কস্তুরি দেবীর মনোকামনা! পদ্মক্ষেত্রে পদ্মতোলা গণ্ডে একটি অদ্বিতীয় সূর্য মন্দিরের নির্মাণ করা হবে। এই মন্দির উৎকলীয়-শিল্পের পরাকাষ্ঠার চরম নিদর্শন হওয়া চাই। উৎকল নিজের সবথেকে কুশল শিল্পীদের আবাহন করছে…এই ঐশ্বরিক ইচ্ছার পূরণে অংশীদার হও। এই মন্দিরের নির্মাণকালে শিল্পীদের পরিবারের সম্পূর্ণ উত্তরদায়িত্ব স্বয়ং মহারাজ নৃসিংহ দেব বহন করবেন বলে কথা দিয়েছেন।
শোনো…শোনো…শোনো…উৎকলের বলিদানী বীরেরা শোনো…মাতৃভূমির উপরে সংকট আসন্ন। যবনদের অহংকারকে যথাযথ উত্তর দেওয়ার জন্য মাতৃভূমির উৎকলীয় বীরদের রক্ত প্রয়োজন। উৎকল সেনাদলে সম্মিলিত হওয়ার জন্য যুবকদের আহ্বান জানাচ্ছে—মাতৃভূমির ঋণ শোধ করার এই তো সুযোগ! শোনো…শোনো…শোনো…’
একদিকে মাতৃভূমির সুরক্ষার জন্য যবনদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষ আসন্ন ছিল, অন্যদিকে শিল্পকলা এবং স্থাপত্যের অক্ষয় কীর্তি স্থাপনার প্রস্তুতি-পর্ব।
যুদ্ধ এবং নির্মাণের এই দুই মহাপর্ব সমান্তরাল ভাবে চলতে পারা বিস্ময়কর হলেও নৃসিংহ দেবের পক্ষে তা অসম্ভব কিছু ছিল না। কারণ উৎকলের প্রজারা নৃসিংহ দেবকে ঈশ্বরের মতোই বিশ্বাস করত। অখণ্ড আস্থার কেন্দ্র ছিলেন তিনি। নৃসিংহ দেব যোদ্ধা পুরুষ, বীর, কিন্তু যুদ্ধোন্মাদ ছিলেন না। তাঁর মনেপ্রাণে বসত করত সাহিত্য, শিল্পকলা, সঙ্গীত এবং ভাস্কর্য। তরবারির ঝংকার আর নূপুরের নিক্কন সমানভাবে প্রিয় ছিল তাঁর। তিনি পরমশিল্পী বিধাতা পুরুষের এমন এক অদ্ভুত সৃষ্টি ছিলেন যে, তাঁর মধ্যে অদ্ভুত সুন্দর সব পরস্পর বিরোধী গুণের সমাহার ছিল। অপূর্ব এক সমন্বয়! তাঁর উদার শাসননীতি এমনিতেই তাঁকে জনপ্রিয় শাসক করে তুলেছিল।
একদিকে যুদ্ধের জন্য যুবকদের আবাহন, অন্যদিকে শিল্পের জন্য শিল্পীদের আমন্ত্রণ। প্রতিটি গ্রাম, প্রত্যেক নগর থেকে যুবকেরা দলে দলে নিজেদের ঘরসংসার ত্যাগ করে নৃসিংহ দেবের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার সংকল্পে তৎপর হয়ে উঠল। কেউ যবনদের সঙ্গে শক্তির পরীক্ষায় নিজের তরবারিতে, আবার কেউ পাষাণের বুকে শিল্প সৃষ্টির তাগিদে ছেনিতে ধার দিতে শুরু করল। কারো মনে কোনো গ্লানি নেই। যুদ্ধ এবং মন্দির-নির্মাণ দুটোই উৎকলবাসীদের কাছে সমান রুচিকর। জীবনের আদর্শ। রাজা এবং জাতি, উভয়ের গৌরবই উৎকলীয়দের আত্মার অঙ্গ, কারণ উৎকলের রাজা নিজের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের বলে শুধুমাত্র রাজ্যে নয়, উৎকলের প্রত্যেক প্রজার হৃদয়ে শাসন করেন।
পরমার্দিদেব সামন্তরায় যবনদের বিরুদ্ধে অনেক বার নিজের ক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছিলেন, কিন্তু এবারে যুদ্ধের বিভীষিকায় নিহত হলেন তিনি।
আবুত্তের এই বীরগতি প্রাপ্তির সংবাদ শুনে নৃসিংহ দেবের মাথায় যেন বাজ পড়ল! এবারের যুদ্ধে বাংলার বিজিত ক্ষেত্রের অধিকাংশটাই যবনদের অধিকারে চলে গেল। সিংহের গুহামুখে যবনদের এই পদনিক্ষেপ রণ-কেশরীকেও বিচলিত করে তুলল। কিন্তু নৃসিংহ দেব যুদ্ধ থেকে মুখ ফেরালেন না। আহত পশুরাজের মতোই উৎকলের সেনাদল যবন বাহিনীর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। রাঢ় তথা বারেন্দ্র ভূমির যবন রমণীদের ক্রন্দনে তাঁদের চোখের কাজল বয়ে গিয়ে ঘোর কালো করে তুলল গঙ্গার জলকেও। নৃসিংহ দেবের পরাক্রমে দশ দিক স্তম্ভিত হয়ে গেল। শেষ অবধি যবন সেনাদের আর উৎকলের মাটিতে পা-রাখার সাহস হল না।
লক্ষ্মণাবতীর যুদ্ধে বাংলার শাসক তথা দেহলির সংযুক্ত সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণ রূপে পরাজিত করে নৃসিংহ দেব হাম্মির মানমর্দক এবং দেহলি-বিভঞ্জকের মতো দু-দুটি গর্ব-গৌরব উপাধিতে অলংকৃত হলেন। অনেকানেক তাম্রপত্রে তাঁর কীর্তি খোদিত হল। কবি বিদ্যাধর একাবলী নামক কাব্যে, এবং কবি ডিণ্ডম দেব আচার্য ভক্ত ভাগবত মহাকাব্যম্-এ রাজা নৃসিংহ দেবের শৌর্যের কথা লিপিবদ্ধ করলেন।
উৎকল রাজ্যের এই ঐতিহাসিক মহাবিজয় উপলক্ষ্যে চন্দ্রভাগার মোহানায় বিশ্বের সর্বোচ্চ, আপাদমস্তক শিল্পখচিত, বিশ্ববিশ্রুত সূর্য মন্দির কোণার্কের ভিত্তি স্থাপনও সুনিশ্চিত হয়ে গেল।
বারোশো শিল্পী। প্রত্যেককে বারো বছর ধরে ব্রহ্মচারী থেকে, একাগ্রচিত্তে, নিজের গৃহ, পরিবার, পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি, প্রেম-প্রীতি, রাগ-বিরাগ, সুযোগ–সুবিধা, মোহ, লোভ, লালসা এবং কামনা—এই সব কিছুকে বিস্মৃত করে, নিজেকে ভুলে অবিরাম কাজ করে যেতে হবে। কোণার্ক মন্দিরের কলস স্থাপনার আগে ঘরে ফেরার কোনো সম্ভাবনাই নেই।
বারো বছর ধরে অখণ্ড ব্রহ্মচর্য পালনের প্রতিজ্ঞা করার পরে উৎকলের বারোশো শিল্পী এই অভূতপূর্ব স্থাপত্যের নির্মাণের জন্য একত্রিত হল। তাঁদের সোনালি সংসার, পুত্র-কন্যাদের ক্রন্দন, প্রিয়া-পরিণীতাদের বিরহ বেদনা, পরিবারের বৃদ্ধজনদের দীর্ঘ উচ্ছ্বাস, সব পিছনে পড়ে রইল। একযুগ সময়ব্যাপী পিতা নিজের পুত্রের, স্ত্রী নিজের স্বামীর মুখ দেখতে পারবে না। পুত্র নিজের মাতা-পিতার অন্তিম সময়ে মুখে জলটুকুও দিতে পারবে কি? মুখাগ্নি করতে পারবে? এমন শত শত অনুচ্চারিত প্রশ্ন গৌণ রয়ে গেল।
শিল্পীদের জন্য আশীর্বাদের রূপ ধরে এল আদেশ, ‘যাও, এই কাজে পিছু হটবে না। শিল্প-সাধনার পথে কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ-মাৎসর্যের কোনো ভূমিকা নেই। কোণার্ক কালজয়ী হোক! উৎকলের শিল্প, উৎকলের শিল্পী অমর হোক! উৎকলের খ্যাতি দিগন্তে প্রসারিত করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে রওনা দাও।’
অখণ্ড ব্রহ্মচর্য পালন না-করলে পদ্মক্ষেত্রে সূর্য মন্দিরের নির্মাণ সম্ভবই ছিল না। পদ্ম আর সূর্যের প্রেমই ছিল এই নির্মাণের আদর্শ। বারো বছর ধরে প্রত্যেক রাগ-অনুরাগ এবং শরীরী আকর্ষণের তিলাঞ্জলি দিয়েই এই প্রক্রিয়াকে সম্পন্ন করা সম্ভব ছিল। এই নির্মাণ আসলে নিজের গহনে এক নিষ্কলুষ প্রেমের মন্দির, একাগ্র সাধনার পূণ্যপীঠ, এবং উৎসর্গ তথা পবিত্রতার স্মৃতি সৌধ হয়ে ওঠার কথা ছিল।
রূপাশগড়ের দলবেহরা নির্মাণ সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করছিলেন। এই মহানির্মাণের কাজে নিজের কুলাগত জ্ঞান-গরিমা নিয়ে যোগ দিল সুবল মহারানা। নিজের প্রিয়া-পরিণীতার দ্বিরাগমনের অপেক্ষা না-করে সুবল বারো বছর অখণ্ড ব্রহ্মচর্য পালনের মহাব্রত নিয়ে নিজের দ্বিরাগমনের তিথির সাতদিন আগেই বাপ–পিতামহর ছেনি, হাতুড়ি সম্বল করে উৎকলের পদ্মক্ষেত্রে গিয়ে উপস্থিত হল।
দলবেহরা মহাশয় যখন তাকে সঙ্গে নিয়ে পদ্মক্ষেত্রের উদ্দেশে রওনা দিলেন, তখন সে মুখ ফুটে এটুকুও বলতে পারল না যে, বিশ্ববিখ্যাত সূর্য মন্দির নির্মাণের জন্য পাষাণের বুকে ফুল ফোটানোর আগে একটি বার নিজের বিনোদিনীর পদ্মমুখখানি দেখে নিতে দিন। বলবেই বা কীভাবে? সে তো আর একলা নয়। তার মতো আরও বারোশো জন শিল্পী ছিল। কেউ নিজের মধুযামিনী ছেড়ে এসেছিল, কেউ উঠে এসেছিল বিবাহ-বেদী থেকে, কেউ নিজের অজাত শিশুর মুখ দেখার ইচ্ছে দমন করে আসতে বাধ্য হয়েছিল, কেউ বা মৃত্যুশয্যায় নিজের মা’কে ফেলে রেখে এসেছিল।
সত্যিই তো, সুবল মহারানা বলবেই বা কীভাবে? যদি যুদ্ধের ডাক শুনে একজনও সৈনিক অকুণ্ঠ ভাবে সবকিছু ত্যাগ করে দিয়ে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করে দেওয়ার জন্য তৎপর হয়ে উঠতে পারে, তাহলে উৎকলের কীর্তি-কথা লেখার জন্য তার মতো একজন শিল্পীই বা কেন এই সামান্য আত্মত্যাগ করতে পারবে না?
সবার মনে একটাই কথা ছিল, ‘এ তো রাজার আদেশ নয়, আহ্বান! রাজা হলেন জগন্নাথ মহাপ্রভুর রাউত, তিনি সেবক মাত্র। এই নির্দেশ আসলে মহাপ্রভু জগন্নাথ স্বামীর। শিল্পীকে দেওয়া এই নির্দেশ আসলে পরমশিল্পী বিধাতার নির্দেশ।’
দলবেহরার সঙ্গে আসার পথে ওই পদ্মপুকুরখানা আবার পড়ল। সুবল আরও একবার বড় সাধ নিয়ে পুকুরের দিকে তাকাল। জলে একটিও পদ্ম ফুটে নেই। যেন তার পরিণীতার অভিমানের প্রতীক হয়ে সব পদ্মপুষ্পই নিজেদের ঠোঁট বন্ধ করে নিয়েছে—কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু পদ্মপাতায় অশ্রুবিন্দুর মতো জমে থাকা শিশিরকণারা যেন বলছিল, ‘প্রিয়, ক্ষত দেখা যাচ্ছে না বলে ভেবো না যে ক্ষত নেই। ক্ষত আছে, ব্যথাও আছে।’
সুবল আর দ্বিরাগমনের তিথি পিছোনোর কথা তোলেনি। এ তো কয়েকদিনের গল্প নয়। তাই দ্বিরাগমন যথাসময়ে হল। সুবল অবশ্য উপস্থিত রইল না। তার ভাই ধবল মহারানা ভ্রাতৃবধূকে নিয়ে এল। সুবল অবশ্য নিজের ভাইয়ের হাত দিয়ে একটি স্মৃতিচিহ্ন পাঠিয়েছিল—সোনার পদ্মে সাতটি পাপড়ির কেন্দ্রস্থলে গাঢ় পীতাভ বর্ণের পুষ্পরাগ মণি জড়িত একটি আংটি, যার সুবল-পাপড়ির প্রত্যেকটিতে একটি করে অক্ষর খোদিত ছিল—‘সু’ ‘ব’ ‘ল’ ‘ম’ ‘হা’ ‘রা’ ‘ণা’।
উপহার, উপহার! শুধু কি এটুকুই? সুবলের পক্ষ থেকে বিনোদিনী উপহার হিসেবে পেল এক নয়, দুই নয়, বারোটি বছরের অপেক্ষা! একজন শিল্পী নিজের প্রাণপ্রিয়াকে আর কী-ই বা দিতে পারে?
সুবল মহারানার কুল উৎকলের বিখ্যাত শিল্পীদের কুল ছিল। সুবলের ঠাকুরদা সুবলকে তক্ষণ শিল্প, বাস্তু শাস্ত্র, নৃত্যকলা, স্থাপত্যবিদ্যা এবং বিবিধ পাষাণের গুণধর্ম খুব ভালোভাবেই শিখিয়েছিলেন। শিবেই সান্তারা নিজের সমকালের অপ্রতিম শিল্পী বিশ্বনাথ মহারানা বা বিশু মহারানাকে কোণার্ক মন্দিরের ভাস্কর্য নিয়ন্তা রূপে নিযুক্ত করলেন। সুবলের গুণ এবং শিল্পজ্ঞান দেখে বিশু মহারানা তাকেই নিয়োগ করলেন নিজের সহায়ক রূপে। সুবল মহারানা এবার হয়ে উঠল কোণার্ক ভাস্কর্যের সহ-নিয়ন্তা। বাইশ বছরের যুবক সুবলের অধীনে এবার বারোশো শিল্পীর নিজ নিজ শিল্পকে প্রতিষ্ঠা করার পালা।
দূর–দূরান্তের বিভিন্ন পাহাড় থেকে নানা ধরনের পাষাণ খণ্ড আনানো হল। কী বিচিত্র তাদের নাম—চিত্রঙ্কুদা, করান্দিমাল্যা, মাঙ্কড়া, রেগড়া ইত্যাদি। বিচিত্র তাদের বর্ণ—সাদা, কালো, নীলাভ। নবগ্রহের নির্মাণ করার জন্য আনা হল ছ’শো বিয়াল্লিশ মণ ওজনের একটি শিলাখণ্ড। মন্দিরের উপরে কলস স্থাপনা করার জন্য ছাপ্পান্ন হাজার মণ ওজনের একটি বিশাল পাথর হাজার যোজন দূরত্বের জলপথ অতিক্রম করে আনা হচ্ছিল।
বেদপুরের বিদ্বান বেদপাঠী ব্রাহ্মণদের দ্বারা ভূমিপূজা এবং ভূমিশুদ্ধির পরে মঙ্গল-ধ্বজা রোপণ করা হল। ভিত্তি স্থাপনা হয়ে গেল। শিবেই সান্তারার আঁকা মানচিত্রকে মূল মেনে প্রত্যেক শিল্পীকে তার উপযুক্ত কাজ ভাগ করে দেওয়া হল। নির্দিষ্ট সময়ে কার্য সম্পূর্ণ করতেই হবে, দেওয়া হল এই আদেশ। পরিকল্পনা করা হল যে, বারোশো শিল্পীর দ্বারা নির্মিত পৃথক পৃথক অংশগুলিকে একসঙ্গে জুড়ে, তাদের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে এক অদ্বিতীয় ভাস্কর্যকে দাঁড় করাতে হবে।
এই কাজ সহজ ছিল না। আত্মার সঙ্গে আত্মার সামঞ্জস্য বিধানের মতোই কঠিন। আজকের পৃথিবী, মন আর হৃদয়ের দিক থেকে ক্ষুদ্র, সীমিত, কুণ্ঠিত। আজকের অহংকার, অসহিষ্ণুতা, উপেক্ষা এবং অবিশ্বাস করতে শেখায়। কিন্তু রাজা নৃসিংহ দেবের শাসনকালে সম্পূর্ণ উৎকল এক নব-চেতনায় প্রমত্ত ছিল। রাজা, পারিষদ, সামন্ত, প্রজা, শিল্পী, ভাস্কর, কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, বাস্তুকার, ভূগোলবেত্তা, জ্যোতিষী প্রত্যেকে একে অন্যের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। একটি সমন্বিত, শুভ, সুন্দর দিব্যদৃষ্টি নিয়ে, উদ্যম এবং সাধনার বলে কালজয়ী সৃষ্টির পথে অগ্রসর হচ্ছিল উৎকল।
মূর্তি, প্রতিমা গড়ার কাজ আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। ছেনির মৃদু আঘাতে পাষাণ সজীব হয়ে উঠছিল। কোণার্কের পরিকল্পনা ক্রমশ শ্বাস নিতে শুরু করেছিল।