২
আমি অবাক হয়ে তার বলা প্রত্যেকটা বাক্য শুনে চলেছি। অপশ্রুতির অগুনতি জাল ছিন্ন হয়ে চলেছে পরের পর। শরীরে-মনে শিহরন জেগে উঠছে। না, ঠান্ডায় নয়, কথার উষ্মায় শীত তো কখন বিদায় নিয়েছে। এই শিহরনের কারণ সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু ঠিক কী কারণে, তা-ও আমি বলে বোঝাতে পারব না।
আমার বন্ধুনীটি একই ভঙ্গিতে দীর্ঘক্ষণ বসে ছিলেন। মাঝে মাথা থেকে আঁচলটা একবার খসেও পড়েছিল। দেখলাম সঙ্গে সঙ্গে তিনি আঁচল দিয়ে মাথা ঢেকে নিলেন।
আমি বললাম, কই, বলতে শুরু করুন—।
মুখে স্মিত হাসি টেনে তিনি শুরু করলেন, আমার কাহিনিতে কিন্তু উড়িষ্যা বা উৎকল রাজ্যের ইতিহাস এসে পড়বে। আপনি কল্পনাপ্রবণ মানুষ, তাই আশা করি, কথায়-কল্পনায় মিলেমিশে যাওয়া এই কাহিনির মধ্যে যে পৌরাণিক আখ্যান, ঐতিহাসিক তথ্য, মানুষের হাসি-কান্নার মতো বিষয়গুলো আছে, সবকিছুকেই সমান গুরুত্ব দেবেন। নইলে কিন্তু ঠিকঠাক স্বাদ পাবেন না।
প্রাচীনকাল থেকে মধ্যযুগ হয়ে এখনকার এই উড়িষ্যাকে কলিঙ্গ, উৎকল, উৎ্করাত, ওড্র, ওদ্র, ওড্রদেশ, ওড, ওড্ররাষ্ট্র, ত্রিকলিঙ্গ, দক্ষিণ কোশল, কঙ্গোদ, তোষালি, চেদি, মৎস ইত্যাদি বহু নামে ডাকা হয়েছে। কিন্তু এগুলোর মধ্যে কোনো নামই সম্পূর্ণ উড়িষ্যাকে ইঙ্গিত করে না। প্রতিটা নামই বিভিন্ন সময়ে উড়িষ্যা রাজ্যের খানিকটা করে অংশের প্রতিনিধিত্ব করেছে।
সংস্কৃত শব্দ ‘ওড্র’ থেকে উড়িষ্যা শব্দটি এসেছে। ওড্র রাজ্যের স্থাপনা করেছিলেন ভগীরথের বংশজাত রাজা ওড্র। সময়-সারণীর দিকে তাকালেই আমরা দেখতে পাব যে, খ্রিস্ট-পূর্ব তৃতীয় শতক থেকে ওড্র রাজ্যে মহামেঘবাহন বংশ, মাঠর বংশ, নল বংশ, বিগ্রহ এবং মুদ্গল বংশ, শৈলদ্ধোব বংশ, ভৌমকর বংশ, নন্দোদ্ধব বংশ, সোম বংশ, গঙ্গ বংশ এবং সূর্য বংশের রাজাদের রাজত্ব ছিল।
প্রাচীনকালে উৎকলের অধিকাংশটাই কলিঙ্গ নামে পরিচিত ছিল, কারণ সেইসময়ে কলিঙ্গই ছিল উৎকল রাজ্যের রাজধানী। ২৬১ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে সম্রাট অশোক কলিঙ্গ জয় করলেন। ইতিহাস বলছে, ভয়ানক যুদ্ধের শেষে চতুর্দিকে হতাহত মানুষের সংখ্যা দেখে অশোকের মনে বিরাট পরিবর্তন আসে। তারপর তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। পরবর্তী জীবনে একজন প্রজাবৎসল সম্রাট রূপে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার-প্রসারেই তাঁর জীবন কাটে।
অশোক নানা স্থানে শিলালেখ উৎকীর্ণ করালেন। ধৌলি কিংবা জগৌদার মতো জায়গায় নিজের ধর্মীয় সিদ্ধান্ত খোদাই করালেন অভিলেখগুলোতে। শিল্পের মাধ্যমে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারে গতি আসতে পারে, এটা বুঝেই সম্রাট অশোক ললিতগিরি, রত্নগিরি, উদয়গিরি এবং লগুন্ডীর মতো স্থানে বোধিসত্ত্ব আর অবলোকিতেশ্বরের অনেক মূর্তি নির্মাণ করালেন। ২৩২ খ্রিস্ট-পূর্বে সম্রাট অশোকের মৃত্যু ঘটে। এরপরেও অবশ্য কিছু সময় জুড়ে কলিঙ্গে মৌর্য সাম্রাজ্যের আধিপত্য ছিল, কিন্তু ১৮৪ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দ থেকে এখানে চেদি বংশের শাসন আরম্ভ হয়ে যায়। মহামেঘবাহন প্রথম চেদি রাজা রূপে কলিঙ্গের শাসক হন।
৪৯ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে কলিঙ্গের শাসনভার হাতে তুলে নিলেন চেদিরাজ খারবেল। তাঁর হাত ধরে কলিঙ্গের সেনাবাহিনীর গতিবিধি অতিরিক্ত মাত্রাতেই বৃদ্ধি পেল। তাঁরই ক্ষমতাবলে চেদি শাসন ভারতের পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিস্তার লাভ করল। উত্তরে মথুরা থেকে দক্ষিণের পাণ্ড্য বংশের কোনো রাজাই খারবেলের তরবারির সামনে দাঁড়াতে পারেননি। খারবেলের রাজত্বে জৈন ধর্ম প্রতিপত্তি লাভ করল। খারবেল বিভিন্ন মাধ্যমের দ্বারা জৈন ধর্মের প্রসার ঘটিয়েছিলেন, তারই প্রমাণ উদয়গিরি এবং খণ্ডগিরির গুহা।
১৭৪ খ্রিস্টাব্দে গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী কলিঙ্গ অধিকার করলেন। এরপর এই বংশ ২০২ খ্রিস্টাব্দ অবধি শাসন বজায় রাখল। এই বংশের অন্তিম রাজার নাম যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণী।
এই পর্যন্ত ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণীর মৃত্যুর পরে কলিঙ্গের রাজনীতির আকাশে অন্ধকার ঘনিয়ে এল। বারংবার সংঘাত চলল। উত্তর ভারতের কয়েকটি ছোট ছোট রাজবংশ—কুষাণ, মুরুণ্ড, নাগ এই মাটিতে শাসন করতে এল এবং অল্প সময়ের মধ্যে চলেও গেল। তখনও অবশ্য সমুদ্রগুপ্তের দক্ষিণ ভারত অভিযান আরম্ভ হয়নি।
সমুদ্রগুপ্তের পর পরই নতুন একটি শক্তি উঠে এল—মাঠর বংশ। তাঁদের শাসন চলল ৪৯৮ খ্রিস্টাব্দ অবধি। কলিঙ্গ এই সময়টাতে নানাক্ষেত্রেই বিরাট সমৃদ্ধ হয়েছিল।
মাঠরদের পর ৫০০ খ্রিস্টাব্দে নল বংশের শাসন আরম্ভ হল। এই রাজবংশের শাসনের সময়ে ভগবান বিষ্ণুর পুজো প্রচলিত ছিল। নল বংশের বিষ্ণুভক্ত রাজা স্কন্দবর্মণ পোডাগোড়াতে একটি বিষ্ণুমঠ নির্মাণ করেছিলেন। নলদের পর এল বিগ্রহ এবং মুদ্গল বংশ, শৈলোদ্ধব বংশ এবং তারও পরে ভৌমকর বংশ কলিঙ্গ বিজয় করল। ষষ্ঠ এবং সপ্তম শতকে উড়িষ্যার তটে শৈলোদ্ধব বংশ শাসন করছিল। উত্তরের মহানদী থেকে আরম্ভ করে দক্ষিণে মহেন্দ্রগিরি অবধি তাঁদের রাজত্ব ছড়িয়ে পড়েছিল। এই সময়পর্বেই দেশবিদেশের সঙ্গে উৎকলের বাণিজ্য বৃদ্ধি পেল। সুবর্ণদ্বীপের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হল। সুবর্ণদ্বীপ বুঝলেন তো? আজকের ব্রহ্মদেশ। ষষ্ঠ–সপ্তম শতকে কলিঙ্গ রাজ্যের শিল্পকলায় উন্নতির জোয়ার এল। সর্বোৎকৃষ্ট! এই সময়েই জন্ম নিয়েছে স্বর্ণজলেশ্বর, রামেশ্বর, লক্ষ্মণেশ্বর, ভরতেশ্বর, শত্রুঘ্নেশ্বর কিংবা পরশুরামেশ্বরের মতো মন্দির।
ভৌমকর বংশের সম্রাট দ্বিতীয় শিবাকর দেবের রানি মোহিনীদেবী ভুবনেশ্বরে মোহিনী মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন। এই দ্বিতীয় শিবাকর দেবের ভাই প্রথম শান্তিকর দেবের শাসনকালে উদয়গিরি-খণ্ডগিরির পাহাড়ে অবস্থিত গণেশ গুহা আবার তৈরি হয়েছিল। ধৌলগিরির পাহাড়ে একটি বৌদ্ধমঠও এই সময়েই নির্মিত হয়। রাজা প্রথম শান্তিকর দেবের রানি হিরা মহাদেবী হিরাপুরে চৌষট্টি যোগিনী মন্দিরের নির্মাণ করান।
৬২১ খ্রিস্টাব্দে উত্তর-ভারতের স্থানেশ্বরের রাজা হর্ষবর্ধন উৎকল আক্রমণ করে বসলেন। চিলকা হ্রদ অবধি অধিকারও করে ফেললেন হর্ষ। ৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে হর্ষের মৃত্যুর পরে উন্মত্ত সিংহ শৈলোদ্ধব রাজ্য আক্রমণ করলেন। উন্মত্তের আরেক নাম ছিল শিবাকর দেব। যাই হোক, এর পর থেকে উৎকল ভূমিতে ভুয়াম কাল শুরু হল। ভুয়ামরা বৌদ্ধদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। এই রাজত্বের সময়ে বেশ কিছু স্বাধীন রাজ্যক্ষেত্রের উদ্ভব হয়েছিল। সেগুলোকে মণ্ডল বলা হতো।
মধ্যযুগের একেবারে শুরুতেই কলিঙ্গে আরম্ভ হয়ে গেল সোমবংশী রাজাদের শাসন। রাজা দ্বিতীয় মহাশিবগুপ্ত যযাতি ৯৩১ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসেই কলিঙ্গের ইতিহাসকে গৌরবময়ী করে তোলার জন্য ভগবান জগন্নাথের মুক্তেশ্বর, সিদ্ধেশ্বর, বরুণেশ্বর, কেদারেশ্বর, বেতাল, সিসরেশ্বর, মার্কণ্ডেশ্বর, বরাহ এবং খিচ্চাকেশ্বরী সমেত মোট আটত্রিশটি মন্দিরের নির্মাণ করালেন। সত্যি বলতে কী, ওই সময়টা উড়িষ্যার ইতিহাসের সবথেকে বেশি উজ্জ্বল পর্ব। সোমবংশীদের সময়েই মন্দির স্থাপত্য কলার উৎকর্ষের পরম শিখর স্পর্শ করে। এবং এর কেন্দ্রে ছিল ভুবনেশ্বর। বলা হয়, রাজা দ্বিতীয় মহাশিবগুপ্ত যযাতি ভুবনেশ্বরে মহাপ্রভু জগন্নাথ দেবের এই আটত্রিশটি মন্দির নির্মাণ করার পাশাপাশি বিখ্যাত লিঙ্গরাজ মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
১০৩৮ খ্রিস্টাব্দ। তখন গঙ্গ বংশের ক্ষীণশক্তির পুনরুত্থান ঘটল পঞ্চম বজ্রহস্তের হাত ধরে। সোমবংশের রাজা কামদেবকে হারিয়ে তাঁরা কলিঙ্গ পুনর্দখল করলেন। তবে তখনও অবশ্য সম্পূর্ণ উৎকলে আধিপত্য লাভ করতে পারেননি। অবশেষে ১১১২ খ্রিস্টাব্দে চোডগঙ্গ দেব সম্পূর্ণ উৎকল দখল করলেন। রাজা চোডগঙ্গ দেব আবার ছিলেন পরম বৈষ্ণব। তিনি পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের নির্মাণ করালেন এবং লিঙ্গরাজ মন্দির তাঁর হাত ধরেই পূর্ণতা পেল। তিনি রাজরানি মন্দির নির্মাণ করালেন। নির্মিত হল লোকনাথ এবং গুণ্ডিচা মন্দিরও। গুণ্ডিচা মন্দিরেই পুরীর জগন্নাথ দেবের বিশ্ববিখ্যাত রথযাত্রা বিরতি নেয়। মাসির বাড়ি বলে সকলে। গঙ্গ বংশ তিন শতাব্দী ধরে উৎকল প্রদেশ শাসন করল। দ্বাদশ এবং ত্রয়োদশ শতকে ভাস্করেশ্বর, মেঘেশ্বর, যমেশ্বর, কোটিতীর্থেশ্বর, সারিদেউল, অনন্তবাসুদেব, চিত্রকর্ণী, নিয়ালি মাধব, শভনেশ্বর, দক্ষ-প্রজাপতি, সোমনাথ, জগন্নাথ, সূর্য–কাষ্ঠ মন্দির এবং বিরজা মন্দির নির্মাণের কৃতিত্ব কিন্তু এঁদেরই।
চোডগঙ্গ দেবের মৃত্যুর পরে তাঁর বংশের মোট পনেরোজন শাসক উৎকলে নিজের কীর্তি বৃদ্ধি করেছেন। ওই বংশের সপ্তম নৃপতি তৃতীয় অনঙ্গভীম দেব ১২১১ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের নির্মাণকার্য উনিই সম্পন্ন করান। ওঁর আমলেই মহানদী এবং কাঠজোড়ির সঙ্গমে কেশরী বংশের রাজাদের সময়ে কটাসিন নামক একটি সৈনিক স্কন্ধাবারের নামে কটক নগরীর পত্তন হয়। ১১৩৫ সনে কলিঙ্গের বদলে কটকই হয়ে উঠল উৎকল রাজ্যের রাজধানী। কটককে অভিনব-বারাণসীও বলা হতো। তৃতীয় অনঙ্গভীম দেবের আবার দুই রানি ছিলেন। সোমল দেবী ও কস্তুরী দেবী। সোমল দেবীর কন্যা ছিলেন কুমারী চন্দ্রা, এবং কস্তুরী দেবীর পুত্রের নাম ছিল নৃসিংহ দেব। কুমারী চন্দ্রার বিয়ে হয়েছিল হৈহয় বংশের পরমার্দি দেবের সঙ্গে। এই পরমার্দি দেব কিন্তু চান্দেলা রাজা পরমার্দি দেব নন। তিনি আলাদা মানুষ। নিজের প্রবল পরাক্রমী রাজা পরমার্দি দেবকে তৃতীয় অনঙ্গভীম দেব নিজের প্রধান সেনাপতির পদে ভূষিত করেছিলেন।
তৃতীয় অনঙ্গভীম দেবের পরে উৎকলের শাসন-সূত্র হাতে তুলে নিলেন তাঁর পুত্র নৃসিংহ দেব। ১২৩৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২৬৪ খ্রিস্টাব্দ অবধি চলেছিল অরিন্দম নৃসিংহ দেবের শাসনকাল তথা উৎকল ভূমির চরম উৎকর্ষের যুগ। সেই সময়ে অবশিষ্ট প্রায় সম্পূর্ণ ভারতই যবন আক্রমণে বিধ্বস্ত। মরুভূমিতে মরুদ্যানের মতো কেবল উৎকল আর কাশ্মীর ওই কঠিন সময়েও হিন্দু রাজ্য হিসেবে নিজেদের রক্ষা করে চলেছিল।
উৎকলকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলছিল ম্লেচ্ছ শত্রুর দল। অনঙ্গভীম দেব যখন রোগশয্যায়, শাসনের অঘোষিত ভার গিয়ে পড়েছিল নৃসিংহ দেবের হাতে। কাশ্মীরের মালব নরপতির কন্যা, কুমারী সীতা দেবীর জন্য তৎকালীন ভূ-ভারতে নৃসিংহ দেবের মতো উপযুক্ত পাত্র আর কই? ওই সময়ে বংশ গরিমা, কান্তি, বীরত্ব, পাণ্ডিত্য, মহানুভবতা, এবং মানবিকতার মতো শ্রেষ্ঠ পুরুষোচিত গুণের অধিকারী হিসেবে নৃসিংহ দেবের নাম সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল। সত্যি বলতে কী, জীবিত কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। বলা হয়, ভারতের নানা রাজ্যের রাজকুমারীরা তাঁকে নিজেদের স্বপ্নের পুরুষ রূপে কামনা করতেন, তাঁর গলায় বরমালা দেওয়ার জন্য নাকি শত শত হাত উন্মুখ হয়ে থাকত। কিন্তু একমাত্র সীতা দেবীর ঐকান্তিক কামনা এবং নিষ্ঠাপূর্ণ ভাবনার ফলেই তিনি আশুতোষ শিবের আশীর্বাদ স্বরূপ নৃসিংহ দেবকে স্বামী রূপে পেলেন। আমি যেটুকু বললাম, তা ভূমিকা মাত্র। অধৈর্য হয়ে পড়লেন কিনা জানি না, কিন্তু নৃসিংহ দেব আমার এই কাহিনির এমন এক চরিত্র যে এই কথাগুলো বলে না-নিলে কাহিনি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব ছিল।
শব্দগুলো আমার, কিন্তু কথাগুলো আসলে আমার অপরূপা বান্ধবীটির। আমার বারবার মনে হচ্ছে, এই কাহিনির মধ্যে একজন পাত্র হিসেবে ঢুকে পড়ে আমি অপরাধ করছি। আমি তো আর এই কাহিনির লেখক নই, একজন লিপিকার মাত্র। আর তাই, নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে এই কাহিনিতে চরিত্র রূপে আমার নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া উচিত। আগামীতে তা-ই করব। কিন্তু কাহিনিটাও এত অদ্ভুত যে এর মধ্যে নিজেকে চরিত্র রূপে দেখতে লোভ হয়।
যাই হোক, কাহিনিতে ফেরা যাক—
সেই রাতে নৃসিংহ দেব এবং সীতাদেবীর ফুলশয্যা ছিল। রাজমহলের কোনায়–কোনায় জ্বলছিল গন্ধতেলে ভরা অগুনতি প্রদীপ। সুগন্ধী তেলের সুবাসে ভরে উঠেছিল প্রাসাদের আবহ। দ্বারে, গবাক্ষে, স্তম্ভে এবং ভিত্তিতে শেকলের মতো করে সাজানো হয়েছিল মনোহারী পুষ্পহার। একাধিক স্থানে তালপাতা, অশোক পাতা, আমের পল্লব এবং কদলী-স্তম্ভ দিয়ে স্বাগত-দ্বার বানানো হয়েছিল। সেজে উঠেছিল প্রজাদের ঘর-গেরস্থালি। নিজেদের যুবরাজ তথা ভাবী রাজার জীবনের এমন মাঙ্গলিক ক্ষণে প্রসন্ন চিত্তে তারা অকাল দীপাবলি পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
অন্তঃপুরে চন্দ্রাদেবী নিজের নবাগন্তুকা ভ্রাতৃজায়া সীতাদেবীর সামনে বসেছিলেন। বিশেষ রাত্রির জন্য তখন যুবরাজ্ঞীর শৃঙ্গার চলছে। ননদিনীর রঙ্গকৌতুকে অধরের হাসি ধরে রাখতে পারছেন না সীতাদেবী। নবপরিণীত যুগলের জন্য চন্দ্রাদেবী নিজের হাতে শয্যা সাজিয়েছিলেন। পর্যঙ্কে রজনীগন্ধা ফুলের চন্দ্রবিতানটিও তাঁর নিজের হাতে বোনা।
ওই শুভ মুহূর্তে কেন্দ্রীয় সভাকক্ষে উৎসব–মণ্ডপে নৃসিংহ দেব নিজের সমবয়েসি, শাসনে সহায়ক এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের মধ্যে বসে অভিনন্দন এবং উপহার গ্রহণ করছিলেন। হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি গিয়ে পড়ল কক্ষের দ্বারে সদ্য উপস্থিত হওয়া এক প্রহরীর ওপরে। দ্বিধাগ্রস্ত মুখ, সঙ্কুচিত মন নিয়ে সে যেন কিছু বলব-বলব করেও বলে উঠতে পারছিল না। হয়তো যুবরাজের জীবনের এমন শুভক্ষণে কোনো গুরুতর সংবাদ দেওয়া সঠিক হবে কিনা সেই চিন্তায় ভুগছিল। তার কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা দেখে নৃসিংহ দেব নিজের হাতের মুদ্রায় তাকে ভেতরে আসার সঙ্কেত দিলেন।
কক্ষে প্রবেশ করেই প্রহরী উপস্থিত সকলকে মূক অভিবাদন জানাল। তারপর নিজের কোমরবন্ধ থেকে একটা পাতলা বাঁশের নল বের করে সেটাকে দু-হাতে ধরে নিঃশব্দে সামনের দিকে এগিয়ে দিল। নৃসিংহ দেবের আবুত্ত অর্থাৎ চন্দ্রাদেবীর স্বামী তথা রাজ্যের প্রধান সেনাপতি পরমার্দি দেব বেশ চিন্তা আর সন্দেহ নিয়েই সেই বাঁশের নলটিকে নিজের হাতে নিলেন।
নৃসিংহ দেবের চোখে তখন একরাশ প্রশ্ন। দৃষ্টি সশঙ্ক। তিনি পরমার্দি দেবকে চোখে চোখে ওই বাঁশের নলটি খোলার নির্দেশ দিলেন। নলটির দুই মুখই লাক্ষার মুদ্রা দিয়ে বন্ধ করা। পরমার্দি দেব ক্ষিপ্র হাতে নলের একটি মুখের মুদ্রা ভঙ্গ করে ভেতরে রাখা পত্রটিকে বের করে এনে দ্রুত পড়তে শুরু করে দিলেন। তাঁর মুখ ক্রমশ গম্ভীর, রক্তিম ও থমথমে হয়ে উঠল। প্রধান সেনাপতি হাত নেড়ে প্রহরীকে বিদায় দিলেন। প্রহরী আবার উপস্থিত সকলকে মূক অভিবাদন নিবেদন করে বিদায় নিল।
এতক্ষণে নৃসিংহ দেব প্রশ্ন করলেন, ‘পত্রে কী লেখা আছে? কোনো অশুভ সংবাদ?’
‘অশুভ বলা চলে না, কিন্তু চিন্তার কারণ তো বটেই,’ পরমার্দি দেব উত্তর দিলেন।
‘বলুন, কী লেখা আছে।’
‘আমি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। আপনি চিন্তিত হবেন না। কুমার, এ ব্যাপারে আগামীকাল আপনার সঙ্গে কথা হবে।’
‘না! এখনই বলুন। কী ব্যাপার?’
‘তেমন গুরুতর কিছু নয়।’
‘আপনি অযথা সময় ব্যয় করছেন। দিন দেখি, পত্রখানা আমার হাতে দিন!’ কথা শেষ করেই নৃসিংহ দেব নিজের হাত বাড়িয়ে দিলেন। অগত্যা বাধ্য হয়েই পরমার্দি দেব চিঠিটা তুলে দিলেন তাঁর হাতে।
“মহারাজ অনঙ্গভীম দেবের প্রতি,
সবিনয় নিবেদন সহকারে জানানো যাচ্ছে যে, কটাসিনের কাছাকাছি যবন সৈনিকদের সৈন্য–গতিবিধি হঠাৎই তীব্র হয়ে উঠেছে। যবনদের বাহিনী সংখ্যায় বিশাল। সম্ভবত উৎকল আক্রমণই তাদের পরবর্তী লক্ষ্য। কটাসিনের সুরক্ষা শিবিরে এত সৈন্য নেই, যাদের মাধ্যমে দীর্ঘকালীন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। অতএব, প্রতিরক্ষার জন্য এখানে অতিশীঘ্র যুদ্ধে পারদর্শী সৈন্যের ভীষণ প্রয়োজন। আমি কথা দিলাম—যদি এর মধ্যে যবন শিবিরের পক্ষ থেকে আক্রমণ করা হয়, তাহলেও উৎকল–বাহিনীর প্রত্যেক পাইক নিজের দেহে রক্তের শেষ বিন্দু পর্যন্ত শত্রুর সৎকার খড়্গ দিয়েই করবে। পরিস্থিতি বিচার করার জন্য এই সংবাদ আপনার নিকটে প্রেরিত হল।
সাদর,
গুল্ম-নায়ক, কটাসিন সুরক্ষা শিবির।”
‘প্রধান সেনাপতি, যত শীঘ্র হোক, সৈন্যদের যুদ্ধযাত্রার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দিন। আজকের উৎসব-অবকাশ এই মুহূর্তে নিরস্ত করা হল। এই উৎসবের জন্য যে খাদ্য তৈরি করা হয়েছে, তা এখনই পরিবেশিত হোক। এখন থেকে ঠিক চার ঘণ্টা পরে সৈন্যরা যেন কটাসিনের উদ্দেশে যাত্রা আরম্ভ করে। প্রাথমিক সৈন্যদলটি শুধুমাত্র অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রওনা দিলেই চলবে।
মন্ত্রী শিবেই সান্তারা, একটি সৈন্যদল যেন খাদ্যদ্রব্য নিয়ে আগামীকাল ভোরেই যুদ্ধস্থলের দিকে যাত্রা করে। তবে আমার দেওয়া কোনো আদেশই যেন আজ রাত্রে প্রজাদের মধ্যে ছড়িয়ে না-পড়ে সেটাও দেখবেন। আমার হস্তীপালকে নির্দেশ দিন—সে যেন গজরাজ নিঃশঙ্ককে পেট ভরে ঘি-মাখানো ভাত খাইয়ে সৈন্য শিবিরে প্রস্তুত করে রাখে। আমার দুই প্রিয় ঘোড়া চঞ্চল ও চপলকেও রণসাজে সজ্জিত করার আদেশ দিয়ে রাখুন। কটাসিনের গুল্ম-নায়ককে আমি হতাশ করব না,’ এই বলে নৃসিংহ দেব নিজের আসন ত্যাগ করে উঠে গেলেন।
‘কিন্তু আপনি কেন যাবেন? আজ যে আপনার মধুযামিনী, কুমার! সৈন্যরা আমার সঙ্গে চলুক, আমি এই রাজ্যের প্রধান সেনাপতি। আজই আপনার ওখানে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। যদি একান্তই প্রয়োজন পড়ে আপনি আগামীকাল যুদ্ধভূমিতে অবতীর্ণ হয়ে উৎকলকে গৌরবাণ্বিত করুন,’ পরমার্দি দেবের কণ্ঠে প্রবল প্রতিরোধ প্রকাশ পেল।
‘না, আপনি কেবল উৎকল রাজ্যের প্রধান সেনাপতিই নন, আপনি আমার আবুত্ত, আমার ভগিনীর স্বামী। আমার ভগিনীপতি যুদ্ধযাত্রা করবেন, আর আমি মধুযামিনী করব, এ তো হতে পারে না। আমি এখনি একবার অন্তঃপুর থেকে ঘুরে আসছি। আপনিও ভগিনী চন্দ্রার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করে নিন। আমরা দুজনে মিলে যুদ্ধস্থলের উদ্দেশে যাত্রা করব। যত শীঘ্র সম্ভব…! ভাস্করের প্রথম রশ্মির অভ্যর্থনা আমি কটাসিনের গুল্ম-নায়কের সঙ্গেই করতে চাই। ঈশ্বরের কাছে কেবল একটাই প্রার্থনা—যবন সৈন্যরা যেন আজ রাতেই না আক্রমণ করে বসে!’
‘ধন্য…ধন্য, কুমার নৃসিংহ দেব, ধন্য!’ সভায় উপস্থিত রাজপুরুষেরা নৃসিংহ দেবের জয় জয়কার করতে লাগল, কিন্তু সাধুবাদ শোনার ইচ্ছা বা অবকাশ কোনোটাই কুমারের নেই। দীর্ঘ পদক্ষেপে ব্যক্তিগত শস্ত্রাগারের দিকে চললেন তিনি।
উৎসবের দিন। স্বাভাবিক ভাবেই কুমার নৃসিংহ দেবের ব্যক্তিগত শস্ত্রাগারের কপাট রুদ্ধ। শস্ত্রাগারের প্রহরী বসে বসে রাজকীয় পাকশালার এক মুখরা দাসীর সঙ্গে মস্করা করছে, ‘আজকের এই শুভদিনে কী কী রাঁধছিস, সুন্দরী?’
‘আ ম’লো যা! নোলা একেবারে সক সক করছে। কত্ত কী খাবার হয়েছে—লাড্ডু, রসগোল্লা, রসমালাই, ছানাপোড়া, ক্ষীরমোহন, রাজভোগ, রাবড়ি, চিঞ্জাহিলি, রসবালি; সুষ্কুলি, পুরি, মুকুন্দি, ভাত, শাক এমন অনেক খাদ্যখাবার; নারকেলের টক চাটনি, পেস্তার মিষ্টি চাটনি, পকোড়ায় থালা ভরে গেছে। রাঁধুনি বড়ঠাকুর গোলা ক্ষীর বানিয়েছেন। তবে এখনও আশকে পিঠেটা হয়ে ওঠেনি। এবার তুই বলবি, এট্টুখানি খেতে দে। ছাড় মুখপোড়া, আমার রাস্তা ছাড়! ভাঁড়ার থেকে খেজুরের গুড় বের করতে হবে আমায়।’
‘হায় হায় সুন্দরী, এত মণ্ডামিঠাইয়ের মাঝে শুধু একটু ঝালের অভাব ছিল, সেটাও তুই নিজের কথা দিয়ে পূরণ করে দিলি! দিনরাত আমি তোর রূপের প্রশংসা করি, আর আসার সময় খানকয়েক রসগোল্লা নিয়ে আসতে পারলি না?’
‘আমি ঠিক জানতাম, এসব খাবারের নাম শুনলে তোর মুখ থেকে লালঝোল পড়ে যাবে। যা, গিয়ে দাঁত মেজে আয়। মুখ ধো ভালো করে! প্রভু জগন্নাথের ভোগ লাগেনি এখনও, আর ইনি রসগোল্লা খাবেন! ওলাউঠো হয়ে মর! ছাড় রাস্তা ছাড়!’
‘খাওয়ার জন্য সকাল থেকে কুড়ি বার দাঁতন করেছি। মালাকার আমাকে কেতকীর পাপড়ি মেশানো জল দিয়েছিল, তাতেই কুলকুচি করেছি, সুন্দরী। দেখ না, মুখটা শুঁকে দেখ—।’
‘ঘরে আয়না না-থাকলে কোনো পুকুরে গিয়ে জলে নিজের ছবি দেখে নে। আমাকে বলে কিনা মুখ শুঁকতে! সাহস তো মন্দ নয়, তুই নিজেকে কী ভাবিস বলতো?’
‘শুঁকবি শুঁকবি! সেই দিন আসছে। তোর ভাইকে আমার বাবার সঙ্গে দেখা করতে বলিস। নইলে তোর এই যৌবন চলে যাবে, কুমারীই থেকে যাবি। মেয়েপক্ষের দিক থেকে আগে প্রস্তাবটা আসুক, তারপর বাবাকে সামলানোর দায়িত্বটা আমার।’
‘দেখ, জ্বালাস না! আমার ভাল্লাগছে না। রাস্তা ছাড়! দেরি হয়ে যাচ্ছে। আজ আমি ভয়ানক ব্যস্ত।’
‘কে আটকে রেখেছে তোর পথ? আমার সঙ্গে পীরিতের কথা বলতে তোর ভালোই লাগে, আমি বুঝি? তুই যা না! আমি আজ রাতেই বাবাকে বলব, কুমার নৃসিংহ দেবের তো বিয়ে হয়েই গেল, এবার আমার বিয়েটাও ঠিক করে ফেলুক। ছোটবেলায় নাকি কোন এক গ্রামভট্টের মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ের জন্য কথা বলে রেখেছিল। ওখানেই কথা পাকা করতে বলব।’
‘আরে যা! আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে নিজের বউ করবি এই স্বপ্ন দেখছিস তো, হাতে নারকেল ছাপানোর ছাঁচ ধরা আছে, নাকে মারলে এক ঘায়ে অক্কা পাবি। এখন আসি, দেরি হলে রাঁধুনি বড়ঠাকুর খেপে যাবেন।’
‘দেখ কেমন লাগে? গা-জ্বলল তো? রসগোল্লা না হয় না-ই দিলি, তোর রসাল ঠোঁটের একটা চুমু তো দিতে পারিস। সকাল-সকাল যে কোনো মিষ্টি হলেই হল। আর এখন এদিকে কেউ আসবে না, ধরা পড়ার ভয়ও নেই।’
‘নিতান্তই ছ্যাঁচড়া তুই। আচ্ছা ঠিক আছে, বাড়ি ফেরার সময় আমার সঙ্গে ফিরিস। আজ কুমারের ফুলশয্যে। আজকের দিনে কাউকে ফিরিয়ে দিয়ে মনে কষ্ট দেব না। কিছু–না–কিছু উপহার দেবই। তবে হ্যাঁ, একলা পেয়ে কিন্তু অসভ্যতা করবি না। আগে থেকে বলে দিলুম!’
‘এর থেকে ভালো ছিল সরাসরি না বলে দিতে পারতিস। তুই কি জানিস না যে আমি এই জায়গা ছেড়ে দিন বা রাত কখনোই নড়তে পারব না?’
‘তুই গোবর-গণেশ হয়ে থাক! আজ আমাদের রাজকুমার কামদেবের দেওয়া অস্ত্র-শস্ত্র ব্যবহার করবেন। আজকের খড়্গ, বাণ, বল্লম এসবই অন্যদিনের থেকে আলাদা হবে।’
‘আচ্ছা, এখন বিদায় নে। এখন তো দেরি হচ্ছে না তোর? আর বাড়ি ফেরার সময় সভার ওই বামন ভাঁড়টাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাস। ওকেই চুমু দিস। তোর চুমুর লোভে আমি নিজের কর্তব্যে অবহেলা করতে পারব না।’
এই ব্যঙ্গোক্তি প্রণয়িনীকে সরাসরি আঘাত করল। প্রেমিকের প্রতি তার মনে করুণা জন্মাল। ডাঁয়ে–বাঁয়ে দেখে যেই না সে এগিয়ে এল, অমনি শোনা গেল কারো ভারী পায়ের শব্দ। সাবধান হয়ে একে অন্যের থেকে দূরে সরে গেল দুজনেই। মনের কথা মনেই রয়ে গেল, অধরের চুম্বন রয়ে গেল অধরাই। কুমার নৃসিংহ দেবের কণ্ঠের আদেশ ভেসে এল, ‘প্রহরী, শস্ত্রাগার খোলো! আমাকে রণ-সাজে সজ্জিত হতে সাহায্য করো।’
বিন্দুমাত্র সময় ব্যয় না-করেই অজ্ঞাত এক আশঙ্কা মনে নিয়ে শস্ত্রাগারের রক্ষী দরজার আগল খুলে দিল। নৃসিংহ দেব শস্ত্রাগারের ভিতরে প্রবেশ করলেন। কুমারের পিছনেই একটি প্রমাণ মাপের উল্কাদণ্ড নিয়ে প্রবেশ করল প্রহরীও। সুবিশাল কক্ষ। সেখানে নির্দিষ্ট ক্রম মেনে যত্ন সহকারে রক্ষিত রয়েছে অস্ত্রের বিপুল সম্ভার। বিশাল কুন্ত, ভল্ল, কৃপাণ, অসি, বড়–ছোট নানা মাপের ধনুক, সূচীমুখ, চন্দ্রমুখ, ভল্লমুখ, এবং নারাচের মতো বাণ-পুরিত অনেক নিষঙ্গ, লোহা আর তামার কবচ–শিরস্ত্রাণ, লৌহ তন্তু দিয়ে বোনা তথা মৎস্য–শল্কের আকৃতি সম্পন্ন লঘু লৌহ–কুর্তক এবং ভুজা–বাহু রক্ষক, সামুদ্রিক কচ্ছপের পিঠের আবরণ থেকে নির্মিত ঢাল, যার উপরে কালায়স নির্মিত অর্ধ–কন্দুক জড়িত রয়েছে। বিবিধ শস্ত্রাস্ত্র অস্ত্রাগারের ভিত্তির আশ্রয় নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কোনোটা আবার টাঙানো। কোনোটার জন্য নির্দিষ্ট করা রয়েছে কাঠের আসবাব।
নৃসিংহ দেব অত্যন্ত দ্রুত নিজের শরীর থেকে রাজবস্ত্র খুলে একপাশে রাখলেন। প্রহরী তাঁকে একটি কার্পাস নির্মিত কুর্তক দিয়ে নিজের হাতে করে একটি লৌহ–কুর্তকের বাঁধন খুলতে লাগল। নৃসিংহ দেব কার্পাস–কুর্তকটির উপরে লৌহ–কুর্তক ধারণ করে নিলেন। তার উপরে পরিধান করলেন চারটি ভাগে নির্মিত একটি লৌহ কবচ। প্রহরী নীরবে তাঁর ভুজায় ভুজা-রক্ষক এবং বাহুতে বাহু-রক্ষক বাঁধল। সাদরে কুমারের শিরস্ত্রাণ হাতে নিয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। নৃসিংহ দেব বীরাসনে বসে নিজের গ্রীবা প্রহরীর সামনে নত করে দিলেন। প্রহরী উদঘোষ করল, ‘মাতৃভূমির হিতার্থে…’
কুমার বললেন, ‘…তুমি উৎসর্গীকৃত!’
শিরস্ত্রাণ মাথায় পরাতে গেলে যুবরাজের মস্তক স্পর্শ করতে হবে। তাই রক্ষী এবার বলল, ‘অপরাধ ক্ষমা করুন, কুমার!’
নৃসিংহ দেব বললেন, ‘যুদ্ধকালের জন্য সবকিছুই ক্ষমার্হ।’
প্রহরী এগিয়ে গিয়ে তাঁর মাথায় সসম্মানে শিরস্ত্রাণটিকে পরিয়ে দিল। শিরস্ত্রাণের নিম্নভাগ থেকে ঝুলতে থাকা লৌহ-শৃঙ্খলগুলি কুমারের দুই কাঁধে ছড়িয়ে গেল। তিরে ভরা একটি তূণীর নিয়ে প্রহরী নৃসিংহ দেবের পিঠে কষে বেঁধে দিল। এরপর সপ্রশ্ন চোখে সে কুমারের চোখের দিকে তাকাল, ‘কুমার, এবার?’
নৃসিংহ দেব বললেন, ‘কটিনক!’ প্রহরী তখনই দেওয়ালে টাঙানো একটা ধনুক নামিয়ে আনল। প্রায় একমানুষ উচ্চতা সেটার। দেহ বাঁশের, তামার তন্তু লেপটে রয়েছে শরীর জুড়ে। বাঁশের গাঁটগুলো ধরার জায়গাতে স্পষ্ট। শূকরের অন্ত্র দিয়ে ধনুকটির ছিলা নির্মিত হয়েছে। কুমার ধনুকটিকে নিজের বাম কাঁধে ঝুলিয়ে দিলেন।
কুমার এবার বললেন, ‘রুদ্রহাস!’
শস্ত্রাগারের প্রহরী এবারে ভিত্তি থেকে ঝুলিয়ে রাখা রত্নজড়িত, রক্তবর্ণ কৌশেয় কোষ যুক্ত, সাত আঙুল চওড়া, বাহান্ন অঙ্গুলি লম্বা, দুই ধার বিশিষ্ট রুদ্রহাস হাতে তুলে নিল। সাম্ভর হরিণের চামড়া দিয়ে তৈরি কটিবন্ধনীর সাহায্যে নৃসিংহ দেবের কোমরের বাম দিকে ঝুলিয়ে দিল রুদ্রহাস।
এবার নৃসিংহ দেব জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মেয়েটি কে ছিল?’
‘ক্ষমা করুন, কার কথা বলছেন, প্রভু?’ থতমত খেয়ে বলল প্রহরী।
‘মেয়েটি কে ছিল?’ আবার একই সুরে প্রশ্ন করলেন কুমার।
‘অপরাধ মার্জনা করুন, কুমার! ও পাকশালার প্রধান দাসীদের মধ্যে একজন। ছোটবেলাতেই ওর পিতা মারা গিয়েছেন। আমার বাগদত্তা। কিন্তু ওর ভাইটা খুব একগুঁয়ে। এদিকে ঘরে খাবার জোটে না, আর ওদিকে বোনের বিয়ে ধুমধাম করে দেবে বলে বিয়ের দিন পিছিয়েই চলেছে। আজ উৎসবের আবহে আমি একটু কৌতুক করছিলাম। তবে বিশ্বাস করুন, নিজের কর্তব্যে কোনো অবহেলা করিনি। আপনি এসে পড়বেন কে তা জানত? আমি স্বপ্নেও কল্পনা করিনি যে, যার মধুযামিনী যাপনের জন্য সমগ্র উৎকল আজ আমোদে মগ্ন হয়ে রয়েছে, তিনি রণবেশ ধারণ করার জন্য শস্ত্রাগারে আসবেন।’
‘কটাসিনের গুল্ম–নায়ক বার্তা পাঠিয়েছেন—যুদ্ধ আসন্ন। মাতৃভূমি উৎকল-বীরদের কাছে রক্ত দাবি করছেন। তুমি, আমি—আমরাই যে উৎকলের সন্তান। আমাদের সামনে এখন কঠিন লড়াই। যদি আমরা যুদ্ধ শেষে সকুশল ফিরে আসতে পারি, তবে তোমার বাগদত্তার সঙ্গে তোমার শুভ পরিণয়ে আমিই অভিভাবক হব, প্রহরী। কথা দিলাম—তোমার শ্যালকের ইচ্ছামতোই ধুমধাম করে হবে তোমাদের বিবাহ।
এবার কর্তব্যের কথায় ফিরে আসি। সেনাপতির পাঠানো শকট এখুনি এসে উপস্থিত হবে। তোমাকে দায়িত্ব দিলাম—অন্যান্য অস্ত্র এবং শস্ত্র সেই শকটে বোঝাই করে, নিজেও রণসাজে সজ্জিত হয়ে শিবিরে উপস্থিত হবে তুমি। কিছু খেয়েছ?’
‘না, কুমার।’
‘আচ্ছা। ভোজন নিয়ে চিন্তা কোরো না, তবে তোমার আজকের ভোজন পথে নৃসিংহ দেবের সঙ্গে ঘোড়ার পিঠে বসে হবে।’ নিজের কথা শেষ করেই কুমার ক্ষিপ্র পদক্ষেপে শস্ত্রাগার থেকে বেরিয়ে এলেন। তাঁর প্রত্যেক পদক্ষেপণে তাঁর দেহের কবচের সঙ্গে শিরস্ত্রাণ থেকে দোদুল্যমান লৌহ-শৃঙ্খলগুলি ধাক্কা খেয়ে ঝঙ্কার তুলছে। ঝঙ্কার তো নয়, যেন সিংহের গর্জন!
ওদিকে রক্ষীটির প্রেমিকা যখন কুমার নৃসিংহ দেবকে শস্ত্রাগারে প্রবেশ করতে দেখেছিল, তখন সে নিজের কৌতূহল সংবরণ করতে পারেনি। যা হওয়ার তা-ই হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই এক মুখ থেকে আরেক মুখে, সেখান থেকে আবার আরেকজনের মুখে এই আশঙ্কা মহল-পরিসরে ছড়িয়ে পড়ল যে, কুমার রণসাজে সজ্জিত হয়ে যুদ্ধযাত্রা করতে চলেছেন। এই সংবাদ গিয়ে পৌঁছাল অন্তঃপুরেও। সকলের মুখে যখন একই গুঞ্জন, তখনই দেখা গেল—রণসজ্জায় সজ্জিত কুমার নৃসিংহ দেব মধুযামিনী-কক্ষের দিকে হেঁটে আসছেন।
চন্দ্রাদেবী আর সীতাদেবী একসঙ্গে কুমারকে স্বাগত জানালেন। নৃসিংহ দেব চন্দ্রাদেবীকে সম্বোধন করে বললেন, ‘উৎকলের মাটি আমাকে আহ্বান করেছে, প্রিয় ভগিনী। আবুত্তও তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন, তাই এই মুহূর্তে তোমার নিজের কক্ষে উপস্থিত থাকা উচিত।’
‘অবশ্যই ভ্রাতা, কিন্তু আপনার প্রতি আমার একটি আবেদন আছে। আমি ফিরে না-আসা অবধি আপনি এই কক্ষ ত্যাগ করবেন না। আমি শীঘ্রই ফিরে আসছি,’ এই কথা বলে চন্দ্রাদেবী প্রস্থান করলেন।
নৃসিংহ দেব নিজের সদ্যপরিণীতা স্ত্রীকে বললেন, ‘দেবী, বস্তুস্থিতি এখন আপনার সামনেও স্পষ্ট হয়ে গেছে। নতুন করে বলার মতো কিছু নেই। আমার কাছে রাজধর্ম সবথেকে বড়। এবং আপনি জানেনই যে, তা পালন করা কত কঠিন কাজ। মাতৃভূমির সম্মান অপ্রতিহত রাখা ব্যক্তির কর্তব্য। সেই ব্যক্তি রাজা হোক বা রাজকুমার কিংবা সাধারণ নাগরিক। রাজ্যের সীমান্তে যবন আক্রমণের সম্ভাবনা এই মুহূর্তে প্রবল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই উৎকলের সেনা সীমাপ্রান্তের উদ্দেশে রওনা দেবে। দুই মাতার কাছে আজ্ঞা নিয়েই এসেছি। এবার আপনার অনুমতিরও প্রয়োজন। জন্মসূত্রে আপনি একটি স্বাধীন হিন্দু রাজ্যের রাজকুমারী এবং বিবাহসূত্রে এক স্বাধীন হিন্দু রাজকুলের বধূ তথা ভাবী রানি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার এই যুদ্ধযাত্রায় আপনি আমাকে সহর্ষে অনুমতি দেবেন।’
সীতাদেবী চোখের সামনে নিজের সৌম্য, সুদর্শন স্বামীকে রণবেশে দেখে মনের কোণে ফুটতে থাকা কোমল চিন্তার ফুলগুলিকে দলন করে স্থির কণ্ঠে বললেন, ‘কুমার, সৌভাগ্যই বলতে পারেন যে কিছুক্ষণ আগেই প্রধান পুরোহিত দুর্গের আরাধ্যা চণ্ডিকাদেবীর পূজা শেষে নিবেদিত ভোগ এবং সিঁদুর পাঠিয়েছেন। মধুযামিনীতে আপনাকে বরণের জন্য। ওই যে ওখানে আরতির থালায় রাখা রয়েছে সেই ভোগ ও সিঁদুর। আসুন, ওই সিঁদুর দিয়েই আপনার যুদ্ধযাত্রার মঙ্গল তিলক এঁকে দিই।’
নৃসিংহ দেবের বুক গর্বে ফুলে উঠল। সেই ভাব লুকিয়ে তিনি কৃত্রিম অভিমানের সুরে বললেন, ‘আজ আমাদের দাম্পত্য জীবনের প্রথম রাত্রি। যুদ্ধক্ষেত্রে অনেক কিছুই ঘটতে পারে। আমাকে বিদায় জানানোর মধ্যে আপনার কোনো কুণ্ঠা বা গ্লানি নেই তো?’
‘কুমার, উৎকল আমার জন্মভূমি নাহলেও এখন থেকে কিন্তু এটাই আমার কর্মভূমি। তাকে রক্ষার জন্য আমি নিজের সর্বস্ব আহুতি দিতে পারি। আর এখন যে আমার সর্বস্ব শুধুই আপনি। এই যে মা চণ্ডিকার প্রসাদ আর সিঁদুর আপনার তিলকের মুহূর্তে এসে উপস্থিত হয়েছে, এও যে দেবী মায়ের আশীর্বাদ। তিনি বিজয়ের বরই দিয়েছেন। আমার মনে কোনো কুণ্ঠা, গ্লানি বা শঙ্কা নেই।
আশুতোষ শিবের বরে আমি আপনার মতো স্বামী লাভ করেছি, কুমার। জগন্নাথ স্বামীর সেবক নৃসিংহ দেবের অহিত করতে পারে এমন কোনো শত্রু এখনও জন্মায়নি। আমি এই কক্ষেই আপনার বিজয়-বরণের জন্য অপেক্ষা করব!’
মানীর ললাটে তিলক এঁকে দিলেন মানিনী। পঞ্চপ্রদীপে সাজানো আরাত্রিক-থালিকা দিয়ে আরতি করলেন। এরই মধ্যে চন্দ্রাদেবী নিজের স্বামী পরমার্দি দেবকে নিয়ে কক্ষে এসে উপস্থিত হলেন। রণবেশে সজ্জিত পরমার্দি দেবের কপালেও বালার্ক সমান বিজয় তিলক শোভা পাচ্ছিল। চন্দ্রাদেবী নিজের ভ্রাতার আরতি করলেন। সীতাদেবী নিজের হাতে করে কুমার নৃসিংহ দেব এবং পরমার্দি দেবের হাতে তুলে দিলেন প্রসাদ-সিঁদুর লিপ্ত একটি করে জবাকুসুম পুষ্প। দুই বীর ফুল হাতে নিয়ে নিজের নিজের কপালে ঠেকালেন। আর তখনই সৈন্য-অভিযানের আনুষ্ঠানিক প্রতীক রূপে বেজে উঠল রণতূর্য–‘তূ…তূতূ…তূতূ…তূ…তূ…’। বীরদর্পে স্নাত কুমার নৃসিংহ দেব ও পরমার্দি দেব শিবিরের দিকে হেঁটে চললেন। দূর থেকে তাঁদের দেখে মনে হচ্ছিল গিরি-কন্দর থেকে বেরিয়ে সিংহদ্বয় ময়দানে নামছে।
নৃসিংহ দেব এবং পরমার্দি দেবের নেতৃত্বে উৎকলের পাইক বীরেরা কটাসিনের প্রান্তরে যবন সৈন্যদের অভিমান চূর্ণ–বিচূর্ণ করে দিল। কিন্তু প্রত্যেক বারের মতো এবারে আর বিজয়ী উৎকল সেনারা রাজ্যে ফিরে এল না। নৃসিংহ দেব নিজের সৈনিকদের বিজয়োন্মাদনাকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে গেলেন বঙ্গের দিকে। বাংলার লখনৌতি আক্রমণ করলেন। অবশ্য এই আক্রমণ একেবারে অকারণ ছিল না।
বাংলার তৎকালীন শাসক তুঘা খাঁ উৎকল আক্রমণের সুযোগ সন্ধান করে চলেছিল। কটাসিনে যবন সৈন্যদের পরাজয়ের পরেই তুঘা খাঁ সেই সুযোগ পেয়েও গিয়েছিল, কিন্তু নৃসিংহ দেব বুঝে গিয়েছিলেন যে, তুঘা খাঁয়ের আক্রমণের জন্য অপেক্ষা না-করে স্বয়ং আক্রমণাত্মক নীতি নিলে ফল ভালো হবে। লখনৌতি সহজেই অধিকার করলেন নৃসিংহ দেব। লখনৌতি বিজয়ের পরে বঙ্গভূমির বেশ কয়েকটি অঞ্চল তাঁর অধীনে চলে আসে।
উৎকলের এই বিজয়ী বাহিনী এবার এগিয়ে চলল রাঢ়ভূমির দিকে। পাইক বীরদের পরাক্রমের সামনে তুঘা খাঁয়ের সেনাবল হাতির পায়ে পিঁপড়ের মতোই দলিত মথিত হয়ে শেষ হয়ে গেল। তুঘা খাঁয়ের সেনাপতি করিমুদ্দিন লাঘরি, যাকে নিয়ে তুঘা খাঁয়ের বিশেষ গর্ব ছিল, পরমার্দি দেবের ভল্লের ঘায়ে যুদ্ধক্ষেত্রেই নিহত হল।
তুঘা খাঁ দেহলির কাছে সাহায্য চেয়ে বসল। তখন দেহলির বুকে শাসন করছিল ইলতুৎমিশের ছোট ছেলে নাসিরুদ্দিন। অবশ্য শাসনের সূত্রধর হয়ে আঙুল নাড়াচ্ছিলেন অন্য একজন—তাঁর নাম গিয়াসুদ্দিন বলবন। দেহলি থেকে সাহায্য আসার আগেই রাঢ়ভূমি দখল করে ফেলল নৃসিংহ দেবের বাহিনী। উৎকল বাহিনীর এই রাঢ়-বিজয় বেশ কয়েকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
তুঘা খাঁয়ের পরাজয়ের পর দেলহির সুলতান নাসিরুদ্দিন মালিক ইখতিয়ারুদ্দিন উজবেগকে বাংলার শাসক রূপে নিযুক্ত করে পাঠাল। এই ইখতিয়ারুদ্দিন উজবেগ ইলতুৎমিশের সময়ে তাঁর প্রিয় পাত্র ছিল। গৌড় পুনঃঅধিকারের উদ্দেশে দেলহি থেকে আসা যবন সৈন্যরা নৃসিংহ দেব–পরমার্দি দেব যুগলের নেতৃত্বে পাইক বীরদের তরবারির প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ল। ভয়ভীত হয়ে পলায়ন করল দেলহির বাহিনী। এই যুদ্ধে নৃসিংহ দেবের বিজয় লাভের পরে বাঁকুড়া, বীরভূমি এবং হুগলী-ক্ষেত্র উৎকল রাজ্যের অংশে পরিণত হল।
১২৪৩ সালে কটক থেকে বেরোনো উৎকল-বাহিনী ১২৪৬ সালে বিজয় দুন্দুভি বাজিয়ে আবার যখন নিজের রাজধানীতে পা-রাখল, তখন বর্ষাকাল আরম্ভ হয়ে গেছে। নৃসিংহ দেব সহ সমগ্র বাহিনীকে আদ্য-আষাঢ়ের প্রথম বর্ষা আকাশের অর্ঘ্যপালে বিদ্যুৎ-রশ্মির প্রদীপ জ্বালিয়ে অভ্যর্থনা জানাল। বৃষ্টি-বিন্দু যেমন মাটিকে সিক্ত করে তুলছিল, তেমনি আনন্দাশ্রুতে ভিজে উঠল সীতাদেবীর দুই নয়ন।
বিজয়ী পাইক বীরদের সম্মানে সমগ্র উৎকল অকাল–দীপাবলি পালন করল। প্রত্যাবর্তনের দিনেই সন্ধ্যায় নৃসিংহ দেব নিজের শস্ত্রাগারের রক্ষীর সঙ্গে তার বাগদত্তার বিবাহ সম্পাদনা করলেন। পরিণয়ের তিন বছর পরে, সেই রাতে, চন্দ্রা দেবী সোল্লাসে নৃসিংহ দেব ও সীতা দেবীর মধুযামিনী যাপনের শয্যা আবার সাজালেন। সকলে ভাবল, প্রণয় আর বিলাসের বাগানে তিন বছর ধরে বিরহের যে কাঁটা বিঁধে ছিল, তা বেছে তুলে নিলেন বিধাতাপুরুষ।
উৎকল–ভূমিতে পরদিনের সকালটা ছিল আলস্যে ভরা, কিন্তু দ্বিপ্রহর ছিল স্ফূর্ত। অনঙ্গভীম দেবের আদেশে নৃসিংহ দেবের রাজ্যাভিষেক ঘোষিত হল। গঙ্গ-বংশের সূর্য ইতিহাসের আকাশে আরও প্রখর হয়ে উঠল। মনে হল, কেটে গেছে আষাঢ়ের মেঘ।
গৌড় এবং রাঢ় বিজয়ের পর নৃসিংহ দেব এখন উৎকলের অধিপতি। সমগ্র উৎকল উৎকর্ষে উন্মুখ। প্রজারা সদাই সন্তুষ্ট। কিন্তু নৃসিংহ দেবের মন বিচলিতই রয়ে গেল। কোনো একটি বিষয় তাঁকে উদ্বিগ্নই করে চলেছিল। কিন্তু কী? সম্ভবত উনি নিজেও বুঝতে পারছিলেন না এই মানসিক অস্থিরতার কারণ।
সন্ধ্যা নেমেছে। আকাশে শুধুই মেঘ। বায়ু নিস্তব্ধ, চতুর্দিক অদ্ভুত স্থবির। এক অবুঝ উদ্বিগ্নতা গ্রাস করেছে সমগ্র চরাচরকে। শয়নকক্ষে সীতাদেবীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে আছেন নৃসিংহ দেব, কিন্তু মন অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে। একজন নারী কিন্তু উষ্মার পরশেই পুরুষের মন পড়ে ফেলতে পারেন। সীতাদেবী অনুভব করলেন যে, তাঁর দক্ষিণ পার্শ্বে শায়িত প্রণয়ী পতিদেবের শরীর শয্যায় থাকলেও মন অন্যত্র পড়ে রয়েছে। নৃসিংহ দেবের সিংহবক্ষে হাত বোলাতে বোলাতে তিনি বললেন, ‘মহারাজ, আপনার মন এখানে নেই। আমি আপনার অর্ধাঙ্গিনী, আপনার এই চিন্তার কারণ জানার অধিকার কি আমার নেই?’
‘অবশ্যই দেবী, অধিকার অবশ্যই আছে! আমি নিজেই আমার এই উদ্বিগ্নতার কথা আপনাকে বলার জন্য সুযোগের সন্ধান করছিলাম। যুদ্ধ এবং বিজয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য আবশ্যকীয় বিষয়, কিন্তু এটুকুতে আমার মনে শান্তি আসছে না। যুদ্ধের দ্বারা স্বাধীনতা রক্ষা করা গেলেও জাতিগৌরবকে কালজয়ী করে তুলতে গেলে পরম্পরা, সংস্কৃতি, শিল্পকলা এবং সঙ্গীতের সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। এটাও যে রাজধর্ম। হাজার হাজার বছর পরে গঙ্গ-বংশের গরিমা কীভাবে অপ্রতিহত থাকবে তার কোনো উপায় ভেবে পাচ্ছি না, প্রিয়ে। তাই আমার মন এমন উচাটন হয়ে আছে। যবনদের বিরুদ্ধে বার-বার যুদ্ধ করে রক্তপাত দেখে দেখে মন গ্লানিতে ভরে গেছে। কবে হবে সেই গ্লানির মোচন? আমি মুক্তির পথ খুঁজে চলেছি। মন ব্যথিত হয়ে আছে। প্রিয়তমা, আপনার নৃসিংহ দেবের নাম কি তার চিতায় ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই লুপ্ত হয়ে যাবে?’
‘শান্তং পাপং! আপনি এসব কেন ভাবছেন? আমি আপনার স্ত্রী। আপনি আপনার মনের এই কথাগুলো আমাকে আগে কেন বলেননি, মহারাজ? কেশরী বংশের রাজা পুরন্দর কেশরী দ্বারা পূজিত, কৃষ্ণ–তনয় শাম্ব দ্বারা নির্মিত সূর্যমন্দিরে আপনার পূর্বপুরুষেরা পূজা করে এসেছেন। রাজমাতা কস্তুরীদেবীও অনেক বছর নিঃসন্তান থাকার পর ওই মন্দিরে সূর্যদেবতার উপাসনা করেছিলেন এবং সূর্যদেব তাঁকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেছিলেন যে, ওই মন্দিরে অধিষ্ঠিত মহাবীরের আরাধনা করলে তাঁর পুত্রপ্রাপ্তি ঘটবে। শ্রাবণ মাস অবধি প্রতিদিন সওয়া মণ সিঁদুর অর্পণ করে রাজমাতা মহাবীর হনুমানকে প্রসন্ন করে আপনাকে পুত্র রূপে পান।
আপনার অন্নপ্রাশনের সময় রাজমাতা পণ করেছিলেন যে, তিনি একটি বিশাল সূর্যমন্দিরের নির্মাণ করাবেন এবং সেখানে সূর্যদেবতার মূর্তি স্থাপনা করবেন। রাজমাতার এই সাধ আজও অপূর্ণ রয়ে গেছে, মহারাজ। আপনি একটি এমন সূর্যমন্দিরের নির্মাণ করতেই পারেন, যা হবে অপ্রতিম, অদ্বিতীয় তথা স্থাপত্যের দিক থেকে উৎকলের গৌরবের প্রতিমান। তাহলে রাজমাতার ইচ্ছাকে সম্মান দেওয়া হবে, তাঁর প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হবে এবং আপনার নিজের গ্লানির ভারও কমবে। আমার মতে…’
সীতাদেবীর মুখের বাক্য সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই শয়নকক্ষ প্রচণ্ড উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল। পুষ্করাবর্তক মেঘের প্রিয়া সৌদামিনী কোন এক অজানা অভিলাষে শব্দ তুলল, ‘গড়ড়…ড়…ড়…ড়…!’ মনে হল কাছেই ঝাউয়ের বনে বজ্রপাত হল। ভয়ে কেঁপে উঠে সীতাদেবী স্বামীর বুকে নিজের মুখ লুকিয়ে ফেললেন। বুকের মধ্যে সুন্দরী রানিকে পেয়ে যেন চুম্বনের বর্ষাই করে দিলেন মহারাজ নৃসিংহ দেব। শয্যার পাশেই কাঁসার একটি বড় জলপূর্ণ পাত্রে ক্ষুদ্র নৌকার মতো ভাসমান সুবর্ণ-প্রদীপ যেন এই দৃশ্য দেখে হেসে উঠল।
টিমটিম করে জ্বলতে থাকা কম্পমান দীপশিখার দিকে তাকালেন অসহায় সীতাদেবী। তাঁর দৃষ্টি দেখে সবকিছু বুঝেও নৃসিংহ দেব যেন না-বোঝার অভিনয় করলেন। গবাক্ষ দিয়ে ঘূর্ণি বাতাস ঢুকে নির্লজ্জ ভাবে হরণ করে নিয়ে গেল প্রদীপের শিখার শীল, সরিয়ে দিয়ে গেল সীতা দেবীর বুকের কাপড়। বাইরে টপটপ ধ্বনিতে মুখর হয়ে মেঘ থেকে বৃষ্টি ঝরে পড়ল।
কক্ষের বাইরে পুরুষ আর প্রকৃতির অভিসার শুরু হয়ে গিয়েছিল। দিগন্ত ভরে উঠছিল পুলকে। ওদিকে কক্ষের বাইরে ধরিত্রী নিজের সমস্ত রন্ধ্র অনাবৃত করে অনন্তের ধারাপ্রেমকে সর্বাত্মক ভাবে গ্রহণ করছিল, আর এদিকে সীতাদেবীর শয্যায় নৃসিংহ দেবের শরীরে যেন প্রথমবারের জন্য অবতীর্ণ হলেন স্বয়ং মদন। কক্ষ মৃদু প্রহরণ, অস্ফুট শ্বাসধ্বনি, দমিত শীৎকারে ভরে উঠল। বাইরে প্রকৃতি যেন নিজের নেত্র বন্ধ করে অস্ফুট স্বরে কালিদাস বিরচিত কুমারসম্ভবম-এর পঞ্চম সর্গ পাঠ করে চলল।