সূর্য বিনোদিনী – ১৩

১৩

এই আকস্মিক প্রাকৃতিক বিপর্যয় এসে পড়ায় নিজের ইচ্ছামতো ভূমিটির অধিকারপত্র পেতে সুবল মহারানার সামান্য দেরি হল। অবশ্য তার আগেই সে ওই ভূমিতে কুটির বানানোর জন্য মৌখিক সম্মতি পেয়ে গিয়েছিল। তবুও ওই বিষম পরিস্থিতির পরেই কুটির নির্মাণ সম্ভব ছিল না। কোণার্ক-শিল্পীরা একে একে ঘরে ফিরে গেলে, তাদের বাস করার জন্য নির্মিত শিবিরগুলিকে সরিয়ে দেওয়া হল। বাকি নগরীকে মুছে দেওয়ার দায়িত্ব একা ওই প্রলয়ঙ্কর চক্রবাতই নিয়ে রেখেছিল।

চতুর্দিকে এত হাহাকারের মাঝে সুবলের মনের সমস্ত ব্যথা-বেদনা বোধ ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল। সে দিন রাত এক করে রাজ্যের কর্মচারী এবং স্বয়ংসেবকদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে বিপদগ্রস্ত মানুষদের সাহায্য করছিল। গতকালের প্রাকৃতিক উপদ্রবের পরে আজ তৃতীয় প্রহর কেটে গিয়েছে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত সুবল বিশ্রাম নেওয়ার সময় পায়নি।

মাঘ শুক্ল নবমীর সূর্য এবার ধীরে ধীরে নিজের আভাজাল গুটিয়ে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল।

রাজ্যের পক্ষ থেকেই করা হয়েছিল দুর্যোগ কবলিত মানুষের জন্য অস্থায়ী আবাস এবং ভোজনের ব্যবস্থা। উৎকল ধীরে ধীরে নিজের বিষাদে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ আনতে পেরেছিল। নিজের ব্যস্ততার শেষে ক্লান্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য হাত-পা ধুয়ে একটু বিশ্রাম নেবে বলে সুবল নদীর দিকেই যাচ্ছিল। এমন সময় বেগুনিয়া গ্রামের গ্রামণীর পাঠানো এক প্রতিনিধির সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেল। সারা দুপুর ধরে ওই ব্যক্তি সুবলকে খুঁজে চলেছিলেন। আসলে শিবেই সান্তারা মহাশয়ের নির্দেশে সুবলের আবাসের ব্যবস্থা বেগুনিয়া গ্রামের দক্ষিণেশ্বর শ্বেতলিঙ্গ মহাদেবের নির্মীয়মাণ মন্দিরের কাছেই একটি কুটিরে করা হয়েছিল এবং রাজ্যের পক্ষ থেকে ওই কুটিরের নির্মাণের জন্য যাবতীয় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বেগুনিয়া গ্রামের গ্রাম-প্রধান বা গ্রামণীকেই।

এই সংবাদ শোনা মাত্রই সুবল ওই ব্যক্তির সঙ্গে বেগুনিয়া গ্রামের উদ্দেশে রওনা দিল। কারণ এই পরিবেশে সে কোণার্কে রাত্রিযাপন করতে ভয়ানক অস্বস্তি বোধ করছিল। ওই অবস্থায় রাজকীয় অতিথিশালায় সকল কক্ষে লোক গমগম করছিল, ধর্মশালায় মাথা গোঁজার জায়গা ছিল না, অস্থায়ী শিবিরে বিপদগ্রস্ত মানুষের ভিড়ে তিল ধারণের স্থানটুকুও অমিল ছিল এবং এই আপদকালে কোণার্ক নগরে কাউকে নিজের জন্য বলে ব্যবস্থা করার জন্য ব্যতিব্যস্ত করে তোলা সুবলের নিজের কাছেই অত্যন্ত অপমানজনক।

দক্ষিণেশ্বর শ্বেতলিঙ্গ মহাদেবের নির্মীয়মাণ মন্দির একেবারে কেতকীবনকে আলিঙ্গন করেই দাঁড়িয়ে ছিল। এমনকী সম্পূর্ণ বেগুনিয়া গ্রামটি কেতকীবনের কোলে অবস্থিত। চন্দ্রভাগার ফেলে যাওয়া গতিপথে একটি অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ। এই হ্রদ আজও ওই মন্দিরের সামনে পদ্মপুকুরে পরিণত হয়ে টিকে রয়েছে। হ্রদের নাম ছাড়ন ঝিল। নদী গতিপথ বদলেছে বটে, কিন্তু তার সঙ্গে ঝিলের সম্পর্ক পুরোপুরি শেষ হয়নি।

ঝিলের শান্ত জলে পদ্ম ফুটে ছিল, আর বনের মধ্যে কেতকী। সুবল মহারানার হৃদয়ে এই দুই ধরনের ফুলের জন্যই একটা আলাদা আবেদন ছিল। পদ্মফুল তার মনে বিনোদিনীর স্মৃতিকে সজীব করে তুলত, আর কেতকীর গন্ধে তার প্রিয় শিল্পার স্মৃতি মানসপটে এঁকে যেত যাবতীয় বিভঙ্গের ছবি। সুবলের হৃদয়ে এই দুই নারীর মূর্তি আসলে দুটি ফুলের মতোই গেঁথে বসেছিল।

সন্ধ্যা নামছে। চন্দ্রভাগার ছাড়ন ঝিলের ধার দিয়ে হেঁটে চলেছে সুবল মহারানা। সারাদিনের ক্লান্তি ধুয়ে ফেলার জন্য সুবল ঝিলের পাড়ে গিয়ে দাঁড়াল। দুই হাতে জল তুলে মুখে দেবে মাথাটা নীচু করেছে এমন সময় তার দৃষ্টি একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে গিয়ে থমকে গেল। হাত থেকে গড়িয়ে পড়ল সবটুকু জল। সে যে স্থানে দাঁড়িয়ে ছিল, তার থেকে সামান্য দূরত্বেই ঝিলের জলে এক নারীর শবদেহ ভাসছে। যেখানে শবদেহটা ভাসছে, সেই জায়গাটা একটা বাঁকের মুখ, নদীর সঙ্গে ঝিলের সংযোগের স্থল।

সুবল সামান্য এগিয়ে গেল। কাছে গিয়ে উপুড় হয়ে থাকা শবদেহটাকে চিত করে দিতেই সে চমকে উঠল। মাত্র একদিন আগেই যে সৌম্য, সুন্দরী, সন্ন্যাসীনিকে সে চন্দ্রভাগার বুকে সূর্যদেবতাকে জলার্ঘ্য দিতে দেখেছিল, এ যে সেই নারী! এলোমেলো বাতাসে খানিক কেতকীর ফুল এসে অপরিচিতার মুখে, বুকে পড়ল, কিছু ফুল পড়ল আশেপাশের জলের উপরে।

‘এই অদ্ভুত ফুলশয্যায় কেমন শান্তিতে শুয়ে আছে এই নারী!’ হাওয়ার গতি আরও বেড়ে গেল। আরও অনেক ফুল উড়ে এসে পড়তে লাগল। মনে হল চক্রবাত পৃথিবীবাসীর পাপ ধুয়েমুছে দিয়ে কমনীয় ফুলেদের বৃন্তচ্যুত করে নদীর ধারায় তাদের ভাসিয়ে দক্ষিণেশ্বর মহাদেবের চরণ অবধি পৌঁছে দিয়েছে।

হঠাৎ সুবলের মনে হল তার পায়ে যেন বিন্দুমাত্র শক্তিও অবশিষ্ট নেই। পাশেই মাটির টিলার উপর ধপ করে বসে পড়ল সে।

গ্রামণীর পাঠানো ওই ব্যক্তি, যে তার সঙ্গেই পথ চলছিল, সে দৌড়ে এল তার কাছে। সে ভেবেছে, হয়তো সুবলের মাথা ঘুরে গিয়েছে। কাছে এসে সে-ও দেখল, এক নারীর শবদেহ নদী বাঁকের কাছে চিত হয়ে পড়ে আছে। তার পা নদীর জলধারাকে স্পর্শ করে আছে, আর মাথার দিকটা ঝিলের শান্ত জলশয্যায়। নিষ্ঠুর ঝঞ্ঝা নিজের নির্লজ্জ হাতে মৃতার পরিধেয় বস্ত্রটাকে অবধি হরণ করে নিয়েছে। কিন্তু কী আশ্চর্য, তার অনাবৃত দেহের উপরে এসে পড়ছে অসংখ্য কেতকীর পাপড়ি। সৃষ্টি হয়েছে এক অপার্থিব আস্তরণ। প্রকৃতি নিজেই তার লজ্জা নিবারণের সমস্ত ব্যবস্থা করেছে। এই জগতে একজন নারীর সম্মান কীভাবে অক্ষুণ্ণ রাখা যায়, সে কথা প্রকৃতি জানে, খুব ভালো ভাবেই জানে।

সুবল সঙ্গে থাকা ব্যক্তিটিকে বেগুনিয়া গ্রামের গ্রামণীর কাছে খবর দেওয়ার জন্য পাঠিয়ে দিল। কারণ এই অঞ্চল স্পষ্ট ভাবেই বেগুনিয়া গ্রামের সীমান্তে অবস্থিত। তাই এর পরবর্তী যাবতীয় দায়দায়িত্ব বেগুনিয়া গ্রামের গ্রামণীকেই পালন করতে হবে। আবার শবটিকে অরক্ষিত অবস্থায় ছেড়ে যাওয়া মানবিক হবে না। আবার রাজ্যের কর্মচারীদের অনুপস্থিতিতে এই শবদেহকে জল থেকে তুলে আনাটাও উচিত হবে না। সুবল তাই ওই ব্যক্তিকে পাঠিয়ে শবদেহ আগলে বসে রইল।

গ্রামণী এলেন। সঙ্গে এলেন গ্রামভট্টও। সব কিছু দেখে শুনে নিয়ে তাঁরা দুজনে নিকটস্থ দণ্ডপাণি–চতুষ্কীতে সংবাদ দিতে চলে গেলেন। ঠায় বসেই রইল সুবল।

স্তব্ধ হয়ে বসে সুবল ওই নারীর শবখানিকে দেখতে লাগল। মাত্র এক হাত দূরে পড়ে আছে একটি নিথর দেহ। রমণীর ঘন কেশের উন্মুক্ত অগ্রভাগ জলে ভাসছে। যেন শৈবালদাম। হাতে উল্কিতে আঁকা রয়েছে রাধাকৃষ্ণের ছবি। সুবল ভাবে, ‘এমন নরম হাতে সুচ ফুটিয়ে ফুটিয়ে উল্কি আঁকতে পারল কেউ? কীভাবে করল কে জানে? তার কষ্ট হল না? এই নারীই কাল পর্যন্ত জীবনের স্পন্দনে পরিপূর্ণ ছিল, আর আজ পূতিঃগন্ধময়। হয়তো এর পরিজনেরা একে কোণার্ক-মন্দিরের আশেপাশে খুঁজে বেড়াচ্ছে, আর সে এখানে এসে পড়েছে।

যদি তার পরিজনেরা তাকে খুঁজে না-পেয়ে নিরাশ হয়ে ফিরে চলে যায়, তখন তার দেহ সৎকারের সব দায়িত্ব রাজ্যের হবে। তাহলে তো এই নারীর শবটিকে অজ্ঞাত পরিচয় মনে করে দাহ করা হবে, কিন্তু এর অপর কোনো পরিচিত থাকুক বা না-থাকুক আমার সঙ্গে যে একদিন আগেই পরিচয় ঘটে গিয়েছে। যদি এর কোনো স্বজন দেহ দাবি করার জন্য উপস্থিত না-হয়, তাহলে আমিই এই নারীর দেহের অন্তিম সৎকার করব! প্রয়োজন পড়লে মহারাজের কাছে গিয়ে আবেদন জানাব। অধিকার চাইব।

গতকাল যখন একে প্রথমবারের জন্য দেখলাম, তখনও মনে হয়েছিল যেন ওঁর সঙ্গে আমার জন্মজন্মান্তরের একটা সম্পর্ক রয়েছে। শুধু চোখে চোখে দেখা ছিল না, শিল্পীর আত্মার সঙ্গে সৌন্দর্যের স্বামীনির আত্মার সম্পর্ক ছিল। তাহলে, এই মুহূর্তে আমিই এখন এর একান্ত আপন।’

নিয়তিও যেন চাইছিল, সুবলই বিনোদিনীর দেহের সৎকার করুক। নাহলে কোণার্ক থেকে দূরে চলে আসার পরেও তার কাছেই বা কেন তার শব ভেসে এল? কেনই বা তাকে দেখে সুবলের মনে প্রথমে মমতা এবং কর্তব্য বোধ জাগবে? সুবল ঠিক করেই ফেলল যে, যদি ওই শব অনাথ বলে ঘোষিত হয়, তবে তার অন্তিম সংস্কার সে-ই করবে।

দণ্ডপাশি এসে উপস্থিত হল। মহাদণ্ডপাশকেও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ সমেত সূচনা দেওয়া হয়েছিল। জানা গেল যে, ওই নারী আসলে দেবদাসী পেখমের দাসী ছিল। পেখম তার অতীত বা আত্মীয়পরিজন সম্পর্কে কিছুই জানে না। তাই সবদিক দেখে শবদেহটিকে অনাথ বলেই ঘোষণা করা হল। যেহেতু শবটিকে অজ্ঞাত পরিচয় বলে মেনে নেওয়া হল, তাই রাতে সেটার সুরক্ষার দায়িত্ব বেগুনিয়া গ্রামের গ্রামভট্টকে দিয়ে এবং পরদিন সকালে দাহকার্যের আদেশ গ্রামণীকে দান করে দণ্ডপাশি বিদায় নিলেন।

সুবল ওই রাতেই পথ চলে আবার কোণার্কে ফিরে এসে শিবেই সান্তারার সঙ্গে দেখা করল। সবটা খুলে বলতেই শিবেই সান্তারা মহাশয় সুবলকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন মহারাজ নৃসিংহ দেবের কাছে। মহারাজ শবের বিবরণ শুনেই চমকে উঠলেন, ‘কুঞ্চিত, ঘন কালো কেশ! ডান হাতে রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি আঁকা রয়েছে? পায়ে আঁকা আছে পদ্মফুলের উল্কি? বহুদিন আগে ভাঙা মন্দিরপ্রাঙ্গণে যে নারীকে দেখেছিলেন, সে নয় তো? কিন্তু পরশুই তো শুনলাম সে আর জীবিত নেই? তাহলে…?

যদি ওই নারী সত্যি সত্যিই সুবল মহারানার স্ত্রী হয়ে থাকেন, তবে তাঁর দেহ সৎকার সংক্রান্ত সমস্ত ক্রিয়াকর্ম করার অধিকার সুবলেরই রয়েছে। এবং যদি তা না-ও হয়, তাহলেও সুবলের আবেগকে সম্মান জানিয়ে সেই অধিকার তাকে দেওয়া উচিত। সুবল এখন আর কোনো সাধারণ শিল্পী নয়, সে রাজকীয় মর্যাদা প্রাপ্ত শিল্পী–শিরোমণি। আর সে কোনো পার্থিব সম্পত্তি দাবি করছে না, শুধু নিজের আবেগের কথাটুকু নিবেদন করছে। এটুকু শুনতেই হবে।’

নৃসিংহ দেব মুখে কিছু বললেন না, ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন যে সুবলের প্রার্থনা স্বীকৃত হয়েছে।

তৎক্ষণাৎ এক বিশেষ দূতকে এই সংক্রান্ত আদেশ দিয়ে বেগুনিয়া গ্রামে গ্রামণীর কাছে পাঠানো হল। সুবলের আবেগকে সম্মান দেওয়ার জন্য মহারাজ এই কথাও লিখে পাঠালেন যে মৃতার মুখাগ্নি করার সময়ে তিনি নিজেও সুবলের পাশে উপস্থিত থাকতে চান। আসলে তিনি নিজের চোখেই দেখতে চাইছিলেন, ‘এই মৃতা সেই নারীই কিনা?’

ব্যক্তি এক ভাবে ভাবে, আর নিয়তির ছকটা থাকে অন্যরকম। মাঘের হিমশীতল রাতে ঝিলের পাড়ে বসে গ্রামভট্ট ওই শবদেহটিকে রক্ষা করবে—এমন নির্দেশই ছিল। সে কাঠ জড়ো করে আগুন জ্বালল, মদ নিয়ে জেঁকে বসল তাপ পোয়াতে। রাত এক প্রহর এভাবে মৌতাতে কাটল। নেশা কাটতেই হঠাৎই তার ভয় করতে আরম্ভ করল। সে ভাবল, ‘এখানে কেউ আমাকে দেখতে আসছে না, আর মড়াও তো আর পায়ে হেঁটে উঠে চলে যাবে না। আশেপাশে বন্য পশু থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই যে মৃতদেহটাকে ছিঁড়ে খাবে। যদি এখন চুপি চুপি বাড়ি চলে যাই, আর ভোরের আলো ফোটার আগেই ফিরে আসি, তাহলে কেমন হয়?’

সে এবার একটা জ্বলন্ত কাঠের টুকরো নিয়ে উঠে ঝিলের মোহানার দিকে এগোল। জল এনে জ্বালিয়ে রাখা আগুনটা নেভাতে হবে যে।

জ্বলন্ত কাঠ নেভানোর মুহূর্তে শবদেহটার হাতে থাকা একটা অলঙ্কার চকচক করে উঠল। মৃতদেহটার দিকে এগিয়ে গেল গ্রামভট্ট। শবের হাতের আঙুলে থাকা একটি সোনার আঙটির লোভে পড়ে গেল সে। সে আংটিটাকে খুলে আনার চেষ্টা করল, কিন্তু মরদেহটা জলে ভিজে স্ফিত হয়ে যাওয়ায় মুদ্রিকাটাকে সহজে খোলা গেল না। বেশ বলপ্রয়োগ করতে হল। এই জোর প্রয়োগ করা, ধাক্কাধাক্কির ফলে শবদেহটা জলের দিকে খানিকটা নেমে গেল। গ্রামভট্ট অবশ্য বেশ কসরত করে আঙটিটাকে বাগিয়ে ফেলল।

অপরদিকে চন্দ্রভাগার ধারা ঝিলের জলে প্রবেশের ফলে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিতে পড়ে গেল মৃতার শরীর। এবার জলের ধারায় বয়ে বিনোদিনীর শরীর সাগরের দিকে এগোতে লাগল। গ্রামভট্টের নেশা ততক্ষণে কেটে গিয়েছে। সে কপাল চাপড়ে হায় হায় করে উঠল। এবার কর্তব্যে গাফিলতির দায়ে তার প্রাণদণ্ড অবধারিত জেনে সে পালিয়ে যাওয়া স্থির করল। আবার পরক্ষণেই তার মনে হল, ‘যদি পালিয়ে যাই, তাহলে আমার অপরাধ আরও প্রবলভাবে প্রমাণিত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। ঠান্ডা মাথায় অন্য কোনো উপায় বের করতে হবে।’ সে বাড়ি চলে গেল। এবং মুদ্রিকাটাকে যত্ন করে নিজের অধীনে লুকিয়ে রাখল।

ওদিকে ভোর হতে-না-হতেই বেগুনিয়া গ্রামের গ্রামণী শ্মশানে চিতা সাজিয়ে ফেললেন। সুবল মহারানার সঙ্গে এসে উপস্থিত হয়েছে স্বয়ং উৎকল-নরেশ নৃসিংহ দেব। তাঁদের পিছনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে শাসক বিভাগের গণ্যমান্য কর্মচারীরা। সূর্যোদয় হতেই শবদেহটিকে এনে চিতায় শোয়ানোর আদেশ দেওয়া হল। কিন্তু শব কোথায়? থরথর করে কাঁপতে–কাঁপতে হাতজোড় করে গ্রামভট্ট এসে উপস্থিত হল, ‘মহারাজ, শব তো নেই!’

‘নেই মানে?’

‘লুপ্ত হয়ে গিয়েছে।’

‘কী বলছ তুমি? কীভাবে? তুমি তখন কী করছিলে?’

‘আমি তখন সামনেই ছিলাম, মহারাজ। নিজের চোখে সবটাই দেখেছি। সে এক আশ্চর্য ব্যাপার! মধ্যরাতে শবদেহটা ধীরে-ধীরে জীবন্ত হয়ে উঠল। আমি দেখেই ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিলাম। স্পষ্ট দেখলাম, ওই নারীর দুটো হাত ক্রমশ দুটো ডানায় পরিণত হল। জল থেকে উঠে ওই রমণী হেঁটে এল ঝিলের পাড় ধরে। আমি ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিলাম, দেবীর মতো সুন্দরী ওই নারী আমাকে বলল—ভয় পেও না। তুমি এতক্ষণ আমাকে সযত্নে সুরক্ষিত রেখেছিলে। আমি তোমার উপরে যথেষ্ট প্রসন্ন হয়েছি…। তারপর সে বরাভয় দিয়ে আমাকে কাছে ডাকল।’

সবাই স্তব্ধ হয়ে শুনছে। গ্রামভট্ট বলে চলল, ‘আমি ভয়ে-ভয়ে একটু এগিয়ে গেলাম।’

মহারাজই বললেন, ‘তারপর?’

‘তারপর পরির মতো ওই নারী নিজের হাতের আঙুল থেকে একটি সোনার আঙটি খুলে আমার হাতে দিয়ে বলল, এটা তোমাকে উপহার দিলাম। তারপর পলক ফেলতেই ডানা মেলে আকাশে উড়ে গেল। দেখলাম, আকাশের বুকে শূন্য থেকেই জন্ম নিল একটা সোনার রথ। ওই রথে চেপেই শূন্যে মিলিয়ে গেল ওই দেবী। মহারাজ, ওই নারী কোনো সাধারণ মানবী ছিল না। নিশ্চয়ই কোনো অপ্সরা বা দেবকন্যা ছিল। হয়তো কোনো অভিশাপের ফলে মর্ত্যে জন্ম নিতে বাধ্য হয়েছিল। সব দেখেশুনে আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম মহারাজ। এইসব কিছু ঘটে যাওয়ার পরেই আমি গ্রামণী মশায়ের বাড়িতে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, কিন্তু উনি ততক্ষণে শুয়ে পড়েছিলেন; তাই আর জ্বালাতন করিনি।’

নৃসিংহ দেব একেবারে অবাক হয়ে গিয়েছেন। তিনি বললেন, ‘কই সেই আঙটি? দেখাও দেখি।’

গ্রামভট্ট সযত্নে সেই মুদ্রিকাটাকে বের করে অঞ্জলিতে রেখে সাদরে মহারাজের সামনে প্রস্তুত করল। আঙটিটাকে হাতে তুলে নিয়ে ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন মহারাজ। সোনার পদ্মের সাতটি পাপড়ির কেন্দ্রে ঘন নীল রঙের পুষ্পরাগ মণি বসানো একটি অঙ্গুরীয়। প্রতিটি পদ্ম-পাপড়িতে খোদাই করা আছে একটি করে অক্ষর—‘সু’ ‘ব’ ‘ল’ ‘ম’ ‘হা’ ‘রা’ ‘না’।

মহারাজের হাত থেকে মুদ্রিকাটা খসে পড়ল। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল সুবল। সে হাতে তুলে আংটিটাকে। মুদ্রিকাখানা দেখামাত্রই এত বছরের জমাট বাঁধা আবেগ বেরিয়ে এল চোখের জল হয়ে। পাষাণ তরল হয়ে গেল। কপাল চাপড়াতে লাগল সে, ‘হায় রে, আমি কেমন অভাগা, যাকে গত পরশু নদীতে অর্ঘ্য অর্পণ করতে দেখে আমার মনে হয়েছিল যে এর সঙ্গে জন্মজন্মান্তরের সম্পর্ক আছে, তার পরিচয় জানার জন্য সামান্য চেষ্টাও করলাম না? কতক্ষণ তার সামনে বসে রইলাম, তবুও বিনোদিনীকে চিনতে পারলাম না? কেন? কেন? কেন?’

সুবল বিশ্বাস–অবিশ্বাসের দোলাচলে ভুগে নিজেই নিজের সব প্রশ্নের জন্য উত্তর তৈরি করতে লাগল, ‘ওর অনাবৃত দেহটাকে চিতা অবধি তুলে আনার জন্য অনেকেই ওকে স্পর্শ করত। বিনোদিনী কখনোই তা মেনে নিতে পারত না। তাই এমন অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে সে চলে গিয়েছে। সে কারো অনুগ্রহ চায়নি—না জীবিত অবস্থায়, না মরার পরে। যা হয়েছে, ভালোই হয়েছে।’

কান্নায় ভেঙে পড়েছে সুবল। তার এই অবস্থা দেখে এবার নৃসিংহ দেবের চোখও জলে ভরে উঠল। এই নারীর কাছেই তিনি বারংবার পরাজিত হয়েছেন, একথা তিনি ছাড়া আর কেউ যে জানেই না। আজও সেই নারী শবদেহ রূপে নৃসিংহ দেবের অন্তিম অনুগ্রহ অস্বীকার করে চলে গিয়েছে।

ওদিকে মাটিতে পড়ে পড়ে নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন করে চলা সুবলকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো সাহস কারো হল না। শ্মশানে উপস্থিত প্রত্যেক ব্যক্তির চোখেই এখন জল।

চিতা যখন একবার সাজানো হয়েই গিয়েছে, তখন তার কাঠ সরানো যাবে না। সুবল ওই মুদ্রিকাখানা গ্রামভট্টকে ফিরিয়ে দিল। বিরহী প্রেমিকের মতোই সে আবার সেই স্থানে চলে গেল, যেখানে বিনোদিনীর শবটিকে শেষবারের জন্য দেখেছিল। সে ঝিল থেকে তুলে নিয়ে এল কয়েকটি পদ্মফুল। কেতকীবন থেকে আনল কিছু কেতকীর পুষ্প। ফুল তুলে আনতে গিয়ে কেতকীর পাতায় হাত কেটে গিয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হল। কিন্তু সেদিকে যে তার হুঁশ নেই। এবার হাতে কেতকী আর পদ্মের ফুল নিয়ে সে চিতার কাছে ফিরে এল। চিতায় সাজিয়ে দিল পুষ্পরাজি। তারপর ডোমের হাত থেকে অগ্নি-শলাকা নিয়ে চিতায় অগ্নি সংযোগ করল সুবল।

সৌম্য শ্রীদত্ত সব দেখলেন। এবং তিনি ছাড়া তৃতীয় কোনো ব্যক্তিই জানল না যে, সুবল মহারানা একই চিতায় বিনোদিনী আর শিল্পা দুজনেরই সাংকেতিক অন্তিম সৎকার করল। এই দুজনেই একসঙ্গে তার হৃদয়ে বাস করত। দুজনের মৃত্যুই হয়েছিল জলসমাধিতে, এবং দুজনেই চিতাগ্নি পায়নি।

শ্মশান থেকে ফিরে এসে রাজা নৃসিংহ দেব স্থির করলেন, বিনোদিনীর বলার ফলেই যেহেতু এই ব্রত আরম্ভ করেছিলেন, তাই আমৃত্যু এই ব্রত পালন করে যাবেন।

সারা উৎকল জুড়ে লোকের মুখে-মুখে দাবানলের মতো একটাই খবর ছড়িয়ে পড়ল—সুবল মহারানার স্ত্রী বিনোদিনী একজন দেবকন্যা ছিলেন। মৃত্যুর পর তিনি স্বর্গরথে করে অন্তর্হিত হয়ে যান। ক্রমশ এই কথা সুবলের ভাই ধবল এবং তার বন্ধু রজতের কানেও গিয়ে পৌঁছাল।

খোঁজখবর নিয়ে তারা সুবলের সঙ্গে দেখা করতে এসে উপস্থিত হল বেগুনিয়া গ্রামে। রজত সঙ্গে করে নিজের স্ত্রীকেও এনেছিল। রজতের স্ত্রী, বিনোদিনীর প্রতি সুবলের মায়ের প্রত্যেক অন্যায় আচরণের কথা, তার প্রতি ধবলের অনুকম্পা তথা সহানুভূতির কথা, গ্রামে ছড়িয়ে পড়া মিথ্যা অপবাদের কথা, বিনোদিনীকে বিতাড়িত করার কথা, তার অন্তর্ধানের ঘটনা এই সবই সুবলকে জানাল। সবশেষে সে বলল, ‘ভাই সুবল, তোমার সঙ্গে বিনোদিনীর বিয়ের ফলে সবথেকে বেশি খুশি আমি হয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল ভগবান শ্রীরামচন্দ্র এবং মাতা সীতার মতোই তোমাদের ভারি সুন্দর জুটি হবে। কিন্তু নিয়তির খেলা, বিনোদিনীর কপালে মা সীতার মতোই সুখ জুটল না। তুমি নিজের হাতে করে কোণার্ক-মন্দির গড়েছ। কোণার্ক হয়তো অমর হয়ে যাবে, কিন্তু ওই মন্দির তৈরিতে আমাদের বিনোদিনীর অবদানের কথা কেউ জানবে কি? কোণার্কের নির্মাণের সঙ্গে উচ্চারিত হবে রাজা নৃসিংহ দেব, মন্ত্রী শিবেই সান্তারা, প্রধান শিল্পী বিশু মহারানার নাম। খুব বেশি হলে শিল্পী-শিরোমণি সুবল মহারানা বা বারোশো জিতেন্দ্রিয় শিল্পীর কথাও হয়তো বলা হবে, কিন্তু বিনোদিনী ওই মন্দিরের জন্য কী পেয়েছে আর কী ত্যাগ করেছে, সেই কথা কি ইতিহাস মনে রাখবে?’

সুবলের কাছে কোনো উত্তর রইল না। ধবল মুখ নীচু করে নিল। তার চোখের জল বাঁধ মানছে না।

সুবল মহারানা নির্বিকার ভাবে দূরে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ সে বলল, ‘কোণার্কের মন্দিরে প্রতীক্ষারত নারীর মূর্তির মধ্যে দিয়ে আমার বিনোদিনী অমর হয়ে গিয়েছে। নৃসিংহ দেব একদিন এই পৃথিবী থেকে চলে যাবেন, মন্ত্রী শিবেই সান্তারাও দেহ রাখবেন একসময়ে, প্রধান শিল্পী বিশু মহারানার মৃত্যু ঘটবে, শিল্পী–শিরোমণি সুবল মহারানা কিংবা মন্দিরের জন্য প্রাণপাত করে কাজ করা বারোশো জিতেন্দ্রিয় শিল্পীও সময়ের প্রকোপে একদিন মুছে যাবে, কিন্তু সুবল মহারানার ছেনি-হাতুড়ি যে অমরত্ব বিনোদিনীকে দিয়েছে তা কেউ পাবে না। ছেনির কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। এবার সুবল নিজের বিনোদিনীর কথা লিখে যাবে।’

সুবল কী বলল, তা অন্যরা কেউই কিছু বুঝে উঠতে পারল না। সুবল তাদের বিদায় জানাল।

শৈলে শৈলে ন মাণিক্যং, মৌক্তিকং ন গজে-গজে—প্রত্যেক পাথর মানিক হতে পারে না এবং প্রত্যেক হাতির মাথায় গজমুক্তা থাকে না। সর্বসুলভ মুক্তা হল শুক্তি-মুক্তা। এবং এই শুক্তির মুক্তার আবির্ভাব শুক্তি বা ঝিনুকের পক্ষে কিন্তু বেশ বেদনাদায়ক। যদি কোনও কারণে শুক্তির আবরণের মধ্যে কোনো কঠিন বস্তু, বালুকণা ঢুকে যায় তা প্রাণীটির পক্ষে ভীষণ কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। তখন শুক্তি সেই বস্তুকণাকে কেন্দ্র করে একধরনের রস নিঃসরণ করে সেটিকে মসৃণ মোড়কে মুড়ে ফেলে। এই প্রক্রিয়া বেশ পীড়াদায়ক। শুক্তি সমানে এক আভাময় আবরণে মুড়ে ফেলতে থাকে অবাঞ্ছিত বস্তুকণাটাকে। মুড়তেই থাকে…মুড়তেই থাকে।

একটা কষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আরেকটা কষ্ট অল্প থেকে অধিক, অধিক থেকে অধিকতর হতেই থাকে ক্রমশ। একমাত্র যখন কেউ সেই শুক্তির কবচ ভেঙে ভিতর থেকে ওই বস্তুকণাকে ঘিরে থাকা মনমোহন আচ্ছাদনটিকে বাইরে বের করে আনে, তখনই তার কষ্ট থেকে সে মুক্তি পায়। অর্থাৎ, একমাত্র শুক্তির মৃত্যুর মাধ্যমেই এই কষ্ট থেকে নিবৃত্তি পাওয়া সম্ভব হয়। সুবল মহারানা যেন শুক্তির মতোই কষ্ট ভোগ করে চলেছিল।

সুবল কখনও রাতের পর রাত জেগে কেতকী-বনে খোলা আকাশের নীচে শুয়ে নিজের হারানো চাঁদের সন্ধান করতে লাগল। কখনও সকাল-সন্ধ্যায় সে ঝিলের বুকে বৃন্তচ্যুত পদ্মফুল খুঁজে বেড়াত। আবার কখনও দিনের বেলায় বনে কুড়িয়ে ফিরত কেতকীর ফুল। সুবল আসলে বিনোদিনীর স্মৃতি সন্ধান করত, শিল্পার কথা স্মরণ করত, যদিও সে জানতে যে, কেউ কোত্থাও নেই। হতাশ সুবল একসময়ে নিজের বাসায় ফিরে তালপাতা খুলে লিখতে বসত। একান্তে নিজেরই লেখা বারংবার উচ্চস্বরে পড়ত। সেই পাঠ শুনত শুধু শুক, পিক, তোতা, প্রজাপতি আর ভ্রমরের দল।

কিন্তু কিছুতেই সুবল ঠিক শান্তি পেত না। তার শান্তি যে ছেনি হাতুড়িতেই ছিল। কুশভদ্রার তীর থেকে সে কুড়িয়ে নিয়ে এল একখানা বেলেপাথর। সেই পাষাণের বুকে খোদাই করতে লাগল বিনোদিনীর মূর্তি। প্রস্ফুটিত পদ্মের উপর উপবিষ্ট বিনোদিনী। দেবীর মতো। কারণ উৎকলের মানুষজন বিনোদিনীকে দেবকন্যা ভাবতে শুরু করেছিল।

সুবল আরও একটি বার জনগণের চিন্তাভাবনাকে পাষাণের বুকে স্থান করে দিতে চেয়েছিল। এভাবেই সে দিনে পাথর কুঁদত, আর রাতে লিখত তার জীবনের কথা। আটমাস সময় লাগল। দুটো কাজই একইসঙ্গে সম্পূর্ণ হল। তার লেখা জীবনগাথাকে সম্মান প্রদান করার মতো মানুষ একজনই ছিলেন—মহারাজ নৃসিংহ দেব।

কেতকীর শুকনো পাতাকে পিষে সুতো বানিয়ে সুবল একটার পর একটা তালপাতাকে বিঁধে পুঁথির আকার দিয়েছিল। সুবল যখন ওই পুঁথি মহারাজকে নিয়ে গিয়ে দেখাল, তখন তিনি করুণায় অভিভূত হয়ে গেলেন। নিজের হাতে নিয়ে মহারাজ পুঁথিটিকে উলটে পালটে দেখতে থাকলেন। কিন্তু আচমকাই তাঁর একটা কথা মনে পড়ে গেল—যখন তিনি সুবলকে ভাস্কর্যের নীচে শিল্পীর নাম খোদাই করার কথা বলেছিলেন, তখন সে বলেছিল, কোণার্কের কোনো ভাস্কর্যের নীচেই কোনো শিল্পীর নাম খোদিত থাকবে না।

নৃসিংহ দেব হাতের পুঁথি মুড়ে রাখলেন।

তিনি বললেন, ‘শিল্পী-শিরোমণি সুবল মহারানা, তোমার এই জীবনকথার মতো অনন্য আর কিছুই নেই। কিন্তু মনে পড়ে কি, তুমি নিজেই বলেছিলে এধরনের উল্লেখ তোমার কুলের গৌরবের পৃষ্ঠাকে কলঙ্কিত করে তুলবে? তুমিই বলেছিলে যে, কোণার্কের ইতিহাসে কোনো শিল্পীর নামোল্লেখ করা থাকবে না! যদি তুমি বিনোদিনীর কথা মেলে ধরতে চাও, তাহলে যে শিল্পী সুবল মহারানার ইতিহাসও এসে পড়বে। তার ছবি আঁকা হয়ে যাবে সময়ের পটে। আমি এই জীবনগাথাকে সম্মান এবং স্বীকৃতি দিলে তোমারই গৌরব আহত হবে। এবার বলো, এরপরেও তুমি কি সেটাই চাও?’

গত আটমাস যাবৎ সুবল ভাবের উথালপাতাল সাগরে সাঁতরে বেড়িয়েছে। এবার যেন সেই ঢেউই তাকে সৈকতে এনে আছড়ে ফেলল। নৃসিংহ দেবের কথা তার ভিতরের সেই কঠোর শিল্পীসত্তাকে আবার জাগিয়ে তুলল, যা বারো বছরের জন্য তার হৃদয়কে পাষাণ বানিয়ে দিয়েছিল।

হাতজোড় করে সে বলল, ‘না মহারাজ, আর আমি তা চাই না। আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি ভুল করে ফেলেছি। দিন মহারাজ, দয়া করে পুঁথিটা আমাকে ফিরিয়ে দিন।’

‘সুবল, কী করবে এই পুঁথি ফিরিয়ে নিয়ে? এটা বরং রাজকীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত থাক। তোমার লেখা শব্দেরা বিখ্যাত নাহলেও অক্ষয় তো হোক।’

‘এই পুঁথিতে লেখা ব্যথা-বেদনার কথা একান্তই আমার। বিশ্ববাসীকে এসবের সাক্ষী করার কোনো প্রয়োজন নেই। জীবনের লালসা দুর্দম্য। জীবন নিজেও জানে যে সে ভঙ্গুর, তবুও সে অক্ষয় হতে চায়, অমরত্বের দাবি করে। সেই খেয়ালেই লিখে বসেছিলাম এইসব কথা। এখন আমার একটাই ইচ্ছা, মহারাজ—আমার শব্দেরা আমারই সঙ্গে যেন চিতাগামী হয়। আর কোনো দাবিদাওয়া নেই।’

মহারাজ পুঁথিখানা সুবলকে হস্তান্তরিত করলেন। সুবল পুঁথি নিয়ে, মহারাজকে প্রণাম জানিয়ে বিদায় নিল।

সন্ধ্যা নাম্নী বালিকা এখন রজনীর কৈশোর লাভ করেছে। তার উন্মুক্ত কেশের কালিমা অন্ধকার হয়ে ঢাকা দিয়েছে চরাচরকে। সামনে সুন্দরীর শাড়ির মতো পড়ে রয়েছে ভাদ্র মাসের চন্দ্রভাগা। নদীর বুকে একটা মাছধরা ডোঙা দেখা যাচ্ছে।

ডোঙায় করে নিজের কুটিরে ফিরছে সুবল মহারানা। সে নিজেই নৌকা বাইছে। আচমকা জলে একটা আলোড়ন হল। ঝপ করে শব্দ। সুবল ভাবল, ‘কোনো বড় মাছ বোধ হয়!’ সে ঝুঁকে দেখতে যেতেই হাত থেকে বৈঠাখানা জলে পড়ে গেল। আর সেটাকে ধরতে গেল সুবল। টাল সামলাতে পারল না, অমনি হালকা ডোঙাটাও জলে উলটে গেল।

মহারাজের কাছ থেকে পুঁথি ফিরিয়ে নিয়ে ফিরছিল সুবল। বৈঠা, সুবল আর নৌকার সঙ্গে সেই পুঁথিও গিয়ে পড়ল চন্দ্রভাগার জলে।

সুবল মহারানা নিজের লেখা পুঁথিটাকে বাঁচানোর জন্য জল তোলপাড় করতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ তার অনুসন্ধান চলল, কিন্তু ফল হল না। পুঁথির দেখা মিলল না। ওভাবে নদীর জলে সাঁতরে আর কতক্ষণ টিকে থাকা যায়? দম শেষ হয়ে আসছে দেখে হাল ছেড়ে দিয়ে সুবল উলটে যাওয়া ডোঙাটাকে জাপটে ধরতে চেষ্টা করল, কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হতেই ডিঙিনৌকার একটা মাথায় সুবলের মাথাটা প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা খেল। সঙ্গে সঙ্গে সংজ্ঞা হারাল সুবল।

অজ্ঞান অবস্থায় তার দেহটা ধীরে ধীরে জলের চাদর ভেদ করে নীচে নামতে শুরু করল। তার প্রাণপ্রিয়া বিনোদিনীর মতোই চন্দ্রভাগার বুকে সমাহিত হয়ে গেল তার শরীর। নদীর কিন্তু তাতেও কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সে আপন বেগে পাগলপারা বয়ে চলল।

বেশ কয়েকদিন পর যখন রাজকীয় কোষাধিকারীর দূত সুবল মহারানাকে মাসিক বৃত্তি দেওয়ার জন্য তার কুটিরে গিয়ে উপস্থিত হলেন, তখন জানতে পারলেন যে সুবল মহারানা বেশ কিছুদিন ধরে ঘরেই ফেরেনি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সুবলের কোনো সন্ধান মিলল না। কেউ খেয়ালও করল না যে, কুশভদ্রার তীরে বেলেপাথরকে খোদাই করে গড়া বিনোদিনীর মূর্তিটাও সুবলের জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে।

কত ঋতু কাটল! কেটে গেল কত বছর! নদীতে জল বাড়ল-কমল, বন্যা এল। মূর্তি চাপা পড়ে গেল বালুরাশির নীচে। এভাবেই চাপা পড়া অবস্থায় থেকে গেল বছরের পর বছর। একসময় নদীও নিজের গতিপথ বদল করতে শুরু করল। তার চলার ভঙ্গি তো এমনই।

বালির নীচে চাপা পড়া ওই মূর্তি অষ্টাদশ শতকে প্রথমবার লোকসমক্ষে আসে। কয়েকটি বাচ্চা ছেলে বালির চর খুঁড়ে জল বের করার চেষ্টা করছিল। সেই সময়ে তারা এই মূর্তি দেখতে পায়। দেবীমূর্তি ভেবে তার চরণের কাছে দু-চারটে ফুল সাজিয়ে আর কপালে সিঁদুর লেপে দিয়ে তারা প্রতিমার সৎকার করে। প্রতিমার নীচে লেখা ছিল—‘বিনোদিনী, যার মুখশোভা অনন্য।’ কেউ জানতেও পারল না যে, বিনোদিনী নাম্নী কোনো রক্তমাংসের তরুণী ছিল, এবং তাকে মাথায় রেখেই এই মূর্তি গড়া হয়েছিল। দেবদ্বিজে ভক্তি রাখা ভারতবর্ষে কোনো দেবদেবীসুলভ প্রতিমা দেখলে কেউই ভাবতে পারে না যে তার পিছনে কোনো মানুষের কাহিনিও থাকতে পারে।

শোনা যায়, সুবল মহারানার নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার বেশ কয়েক বছর পরে কোণার্কের মন্দিরের কাছে এক বিশালদেহী পুরুষ কুষ্ঠরোগীকে দেখা গিয়েছিল। খসে খসে পড়ে যাচ্ছিল তার অঙ্গ। সারা গায়ে মাছি ভনভন করত। কেউ জানতে পারেনি যে ওই কুষ্ঠরোগী আসলে একসময়ের মল্লবীর কুকা। তার জঘন্য অপরাধের জন্য প্রকৃতিই তাকে শাস্তি দিয়েছিল। যদিও কুকা কারো কাছে কখনওই নিজের অপরাধের কথা স্বীকার করেনি, কিন্তু মনে মনে সে জানত তার কোন পাপের ফল তাকে ভোগ করতে হচ্ছে। সবসময়েই তার মনে হত যেন ধর্মপদ তাকে দেখে হাততালি দিচ্ছে, হাসছে।

কোণার্কের মন্দির উদ্বোধনের পরেই পরিত্যক্ত হয়ে যায়। কিন্তু সেখানে দলে দলে পর্যটক আসতে আরম্ভ করে। তারা কুষ্ঠরোগীদের ভিক্ষাও দিত। কুকা, একসময়ের বিখ্যাত মল্লবীর সেই ভিক্ষুকদের পঙক্তিতে দাঁড়িয়ে রোজ হাত পাতত। এভাবে দীর্ঘ রোগদশা ভোগ করার পর তার মৃত্যু হয়।

এই কাহিনির তিন প্রধান পাত্র—বিনোদিনী, শিল্পা এবং সুবল মহারানা, তিনজনেরই অপঘাতে মৃত্যু ঘটেছিল। সলিল সমাধি। তিনজনের দেহই চিতার আগুন পায়নি। এই তিনজনের অতৃপ্ত, অশরীরী আত্মা আজও কোণার্ক চত্বরে ঘোরাফেরা করে। বছরে একটি বার, মাঘ শুক্ল সপ্তমীতে, সূর্যদেবতার জন্মদিনে শিল্পা নিজেকে দেবদাসী রূপে সজ্জিত এবং সমর্পণ করে কোণার্ক পরিসরের বাইরে নৃত্য পরিবেশন করে।

সেই নাচ কিন্তু সকলে দেখতে পায় না, কিংবা সবাই তার নূপুরের ধ্বনি শুনতে পায় না। আজই সেই রাত—মাঘ শুক্ল সপ্তমীর রাত। সূর্য সপ্তমীর রাত। যে নূপুরের শব্দ শুনে আপনি আকৃষ্ট হয়ে এগিয়ে চলে যাচ্ছিলেন, তা আসলে শিল্পার নূপুরের ধ্বনি। আমি প্রথমে এই কথা ভেবে অবাক হচ্ছিলাম যে, যা সকলে শুনতে পায় না, তা আপনি কীভাবে শুনলেন? কিন্তু আপনার সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, আপনিও সাধারণ মানুষ নন, একজন লেখক। এবং আপনার মধ্যে কিছু বিশেষত্ব আছে।

‘যেমন?’ আমিও আশ্চর্যের সুরে জিজ্ঞেস করলাম।

যেমন আপনি অশরীরী আত্মাদের দেখতে বা শুনতে পান। তবে তাদের খুব কাছাকাছি চলে গেলে আপনার অনিষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই আমি আপনাকে ওদিকে এগোতে নিষেধ করলাম। সুবল মহারানার আত্মাও এই রাতে এখানে আসে। কোণার্ক মন্দিরকে দু-চোখ ভরে দেখে, শিল্পার নূপুরের সুরলহরায় মুগ্ধ হয়। এই তিনটি আত্মা কীসের জন্য অপেক্ষা করছে জানেন? তারা চায়, বিশ্ব তাদের কথা জানুক। এটাই তাদের বাসনা। যতদিন তাদের এই কামনার পূর্তি হবে না, ততদিন তাদের সদ্‌গতি হওয়া অসম্ভব।

তবে এখন আমার মনে হচ্ছে, আপনি নিজের কলমের মাধ্যমে তাদের কথা সকলের সামনে মেলে ধরবেন। তাহলেই তাদের আত্মার মুক্তি ঘটবে। সত্যিই এই কাহিনিটা লিখবেন তো?

আচমকাই অদূরে কোথাও বনমোরগের কর্কশ ডাকে সূর্যোদয়ের ঘোষণা হল। আমি টের পেলাম সহসাই থেমে গেল সম্মোহনী নূপুরের ধ্বনি। আশপাশটা কেমন কুয়াশাঘন হতে থাকল। সুন্দরী বন্ধুটি আমাকে আবার প্রশ্ন করল, ‘আপনি ইতিহাসের গল্প খুঁজছিলেন, তাই না? আমি যে কাহিনিটা বললাম, সেটা লিখবেন তো বন্ধু?’

এবার আমার তরফ থেকে প্রশ্ন ধেয়ে গেল, ‘কিন্তু এতসব কথা আপনি জানলেন কী করে? আপনি যা কিছু বলেছেন তা অদ্ভুত, কিছুটা অলৌকিকও। কিন্তু এগুলো যে সত্যি, তারই বা প্রমাণ কী? আমি সত্যিকারের কাহিনি লিখতে চাইছি। যদি এধরনের গল্প বুনি, তাহলে সেই তো মিথ্যে কাহিনি লেখার সুবাদে হয়তো পুরষ্কার পাব, কিন্তু নিজের মনকে সান্ত্বনা দেব কীভাবে? পারলে এই কাহিনির সত্যতার প্রমাণ দিন।’

‘তাহলে আপনাকে একটা কথা দিতে হবে যে?’

‘যদি প্রমাণ দেবেন বলেন, তাহলে আমিও কথা দিতে রাজি।’

‘আমি এই কাহিনির সত্যতার প্রমাণ।’

‘কী বলছেন ঠিক বুঝলাম না। আমি মানছি যে গল্পটা আপনিই আমাকে বলেছেন, কিন্তু তাই বলে কয়েকশো বছর আগের কাহিনির প্রমাণ আপনি কী করে হবেন?’

‘কাঠ জ্বলে আংরা হয়,

আংরা জ্বলে ছাই।

আমি জ্বলি বিরহজ্বালায়

কেউ বোঝে না তা-ই।।

আপনি সম্ভবত এখনও আমাকে চিনতে পারেননি। আচ্ছা, ঠিক আছে। আমিই নিজের পরিচয় দিই। আমিই বিনোদিনী, সুবল মহারানার সেই অভাগী স্ত্রী।’

নিজের কথা শেষ করেই ওই সুন্দরী নিজের ডান হাতখানা আমার সামনে মেলে ধরলেন। দেখলাম দুধসাদা হাতের উপরে রাধাকৃষ্ণের যুগলচিত্রের উল্কি আঁকা আছে। আমার মাথাটা ঘুরে গেল, সারা শরীর দুলে উঠল। আগের বারের থেকে আরও বেশি জোরে শোনা গেল বনমোরগের উদ্‌ঘোষ। পাশে বসে থাকা অপরূপার দেহ ঘিরে কুয়াশা আবর্তিত হতে থাকল। আমি নীল এক অন্ধকারে হারিয়ে গেলাম।

বিঁপ…বিঁপ…বুং…বিঁপ…বিঁপ…বুং…

ছুম ছনন ছম ছুম ছনন ছম ছুম…

বিঁপ…বিঁপ…বুং…বিঁপ…বিঁপ…বুং…

ছুম ছনন ছম ছুম ছনন ছম ছুম…

‘শাম্ব, তুমি মাতৃসমা গোপিনীদের সঙ্গে প্রণয়লীলা করছ, লজ্জা করছে না? যদি তুমি আমার পুত্র না-হতে, তবে আমার সুদর্শন চক্রে এতক্ষণে তোমার মুণ্ডচ্ছেদ হয়ে যেত।’

‘জাস্ট প্রিপেয়ার দ্য ইঞ্জেকশন! ফাস্টার!’ কথাগুলো কানে আসছিল। মনে হল কোমরে কেউ কিছু ফোটাল।

বিঁপ…বিঁপ…বুং…বিঁপ…বিঁপ…বুং…

‘তাই আমি চাইছি, আমার এই মূর্তির স্থাপনা কৃষ্ণ-পুত্রের হাতে হোক। এবং এর নামকরণ হোক আমার পুত্র কর্ণের নামে—কর্ণার্ক। আমার এই মূর্তি কর্ণার্ক নামেই বিখ্যাত হবে।’

বিঁপ…বিঁপ…বুং…বিঁপ…বিঁপ…বুং…

‘দেবী, বস্তুস্থিতি এখন আপনার সামনেও স্পষ্ট হয়ে গেছে। নতুন করে বলার মতো কিছু নেই। আমার কাছে রাজধর্ম সবথেকে বড়। এবং আপনি জানেনই যে, তা পালন করা কত কঠিন কাজ। মাতৃভূমির সম্মান অপ্রতিহত রাখা ব্যক্তির কর্তব্য। সেই ব্যক্তি রাজা হোক বা রাজকুমার কিংবা সাধারণ নাগরিক।’

বিঁপ…বিঁপ…বুং…বিঁপ…বিঁপ…বুং…

‘ভাইটি আমার, মেয়েদের চোখ কখনো ভুল বস্তুর সন্ধান দেয় না।’

বিঁপ…বিঁপ…বুং…বিঁপ…বিঁপ…বুং…

‘অক্সিজেন! ড্রিপ! হেড পোর্শনটা তোলো। ফাস্টার!’

বিঁপ…বিঁপ…বুং…বিঁপ…বিঁপ…বুং…

‘এ তো রাজার আদেশ নয়, আহ্বান! রাজা হলেন জগন্নাথ মহাপ্রভুর রাউত, তিনি সেবক মাত্র। এই নির্দেশ আসলে মহাপ্রভু জগন্নাথ স্বামীর। শিল্পীকে দেওয়া এই নির্দেশ আসলে পরমশিল্পী বিধাতার নির্দেশ।’

বিঁপ…বিঁপ…বুং…বিঁপ…বিঁপ…বুং…

‘পাল্স্?’

‘হেভি!’

‘বি পি?’

‘ভেরি লো। সিক্সটি!’

‘নার্স, ইঞ্জেকশন!’

বিঁপ…বিঁপ…বুং…বিঁপ…বিঁপ…বুং…

‘গ্রহীতা যদি দাতাকে স্মরণ করে, তবেই গ্রহীতা এবং দাতা উভয়ের মাহাত্ম্য থাকে, কিন্তু দান করে তা ভুলে গেলেই দাতার মাহাত্ম্য প্রকাশ পায়।’

বিঁপ…বিঁপ…বুং…বিঁপ…বিঁপ…বুং…

‘যে সাগরে শয্যা বেঁধে এসেছে, সে কি আর শিশিরে ভয় পায়? আমি মরতে বেরিয়েছিলাম। এখনও জীবিত আছি এ আমার বিধিলিপি।’

বিঁপ…বিঁপ…বুং…বিঁপ…বিঁপ…বুং…

‘তুমি শিল্পী…আর আমি শিল্পা!’

বিঁপ…বিঁপ…বুং…বিঁপ…বিঁপ…বুং…

বিঁপ…বিঁপ…বুং…বিঁপ…বিঁপ…বুং…

‘রেয়ার কেস! পেশেন্টের অজ্ঞানও নয় বা ঘুমিয়েও নেই অথচ চোখ মেলছে না। বাট হিজ ব্রেইন ইজ ওয়ার্কিং সো ফাস্ট। হয়তো কোনো ট্রমায় আছে। ট্রাংকুইলাইজার! একে ঘুম পাড়াও।’

আধো-আচ্ছন্ন অবস্থা থেকে কখন যে ঘুমের মধ্যে হারিয়ে গেলাম বুঝতে পারলাম না। জ্ঞান ফিরতে দেখি আমার বউ মন্দিরা বেডের পাশেই বসে আছে। আমার ছোট ছেলেটা কাঁদতে কাদতেই ওঁর কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে মনে হয়। বড় ছেলে মায়ের পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার দুচোখ ভরা জল। মন্দিরা তাকে সমানে বুঝিয়ে চলেছে, ‘কাঁদিস না বাবু, তোদের বাবা ঠিক হয়ে যাবে।’

‘দুদিন হয়ে গেছে মা, বাবা ঘুমিয়েই রয়েছে। বাবাকে বলো, আমি আর দুষ্টুমি করব না। ভাইকেও করতে মানা করব। বাবা যখন গল্প লিখবে, তখন লেখার ঘরে ঢুকে লাফালাফি করব না। বায়নাও করব না আমরা। প্লিস মা, বাবাকে এবার উঠে বসতে বলো। বাবা কি এখনো রাগ করেই থাকবে?’

একজন নার্স ধমক দিল, ‘কথা বলবেন না! বাইরে যান! বাইরে গিয়ে বসুন।’

ওরা আমার চোখ মেলাটাকে খেয়াল করেনি। আমি আস্তে-আস্তে ডান হাতটা তুললাম। হাতে অজস্র চ্যানেল গাঁথা আছে। ব্যথা লাগল। মন্দিরা আমার নড়াচড়া দেখেই চেঁচিয়ে উঠল, ‘ডক্টর, ওর সেন্স ফিরেছে।’ ও এসে আমার হাতে হাত রাখল। আমি সর্বশক্তি দিয়ে ওর হাতটাকে আঁকড়ে ধরলাম।

ডাক্তার বলে উঠলেন, ‘আরেকটা ইনজেকশন!’

‘অলসনিমীলিতলোচনয়া পুলকাবলিললিতকপোলম্।
শ্রমজলসকলকলেবরয়া বরমদনমদাদতিলোলম্।।
সখী হে কেশিমথনমুদারম্!
সখী হে কেশিমথনমুদারম্!’

‘চেক দ্য বি পি আগেইন!’

‘নর্মাল, স্যার।’

‘পালস্?’

‘এখন স্টেবল।’

‘ওকে। চোখের তারাও এখন স্থির হয়েছে। ইটস্ গেটিং বেটার।’

‘ওম্ আং হৃং ক্রৌং যং রং লং বং শং ষং সং হং সঃ সোৎহম্ প্রাণা ইহ প্রাণাঃ। ওম্ আং হৃং ক্রৌং যং রং লং বং শং ষং সং হং সঃ জীব ইহ জীব স্থিতঃ। ওম্ আং হৃং ক্রৌং যং রং লং বং শং ষং সং হং সঃ সর্বেন্দ্রিয়াণী ইহ সর্বেন্দ্রিয়াণী। বাঙমনস্ত্বক্ চক্ষুঃ শ্রোত্র জিহ্বা ঘ্রাণ বাকপ্রাণ পাদ্-পায়ুপস্থানি ইহৈবাগত্য সুখং চিরং তিষ্ঠন্তু স্বাহা।’

‘পেশেন্ট ইজ আউট অব ডেঞ্জার নাউ। ইউ আর টু লাকি ম্যাম। ইট ইজ ভেরি রেয়ার। ইয়োর হাজব্যান্ড হ্যাজ রিটার্নড ব্যাক। এখন আর ভয় নেই। তবে আমরা আরও দু-তিনদিন অবজার্ভেশনে রাখব। আপনি এখন বাচ্চাদের নিয়ে বাড়ি ফিরে যান। ওদের-ও তো কষ্ট হচ্ছে এখানে। বরং কাল সকালে আসুন। ডাক্তার বা স্টাফেরা সব সামলে নেবে। চিন্তার কোনো কারণ নেই।’

‘প্লিস ডক্টর! প্লিস অ্যালাও আস টু স্টে হেয়ার। প্লিস!’

‘ওকে। বাট ওঁকে কথা বলাবার চেষ্টা করবেন না। এই সময়ে কোনো ধরনের এক্সাইটমেন্টই ওঁর পক্ষে ভালো নয়। নো নয়েজ প্লিস!’

‘ওহ ইয়েস ডক্টর। থ্যাঙ্কস! থ্যাঙ্কস আ লট!’

‘সিস্টার, পেশেন্টের ড্রিপ আর অক্সিজেন সারা রাত ধরে চলবে। বি পি আর পালস রেট নোট রেগুলার ইন্টারভ্যালে মনিটরিং আর নোট করবেন। সবকিছু নর্মাল থাকলে ভোর পাঁচটায় ড্রিপ বন্ধ করে দেবেন।’

‘এই পুঁথিতে লেখা ব্যথা-বেদনার কথা একান্তই আমার। বিশ্ববাসীকে এসবের সাক্ষী করার কোনো প্রয়োজন নেই। জীবনের লালসা দুর্দম্য। জীবন নিজেও জানে যে সে ভঙ্গুর, তবুও সে অক্ষয় হতে চায়, অমরত্বের দাবি করে। সেই খেয়ালেই লিখে বসেছিলাম এইসব কথা। এখন আমার একটাই ইচ্ছা মহারাজ, আমার শব্দেরা আমারই সঙ্গে যেন চিতাগামী হয়। আর কোনো দাবিদাওয়া নেই…’

আমার চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। নিস্তব্ধতা। শান্তি! শান্তি!

ওম্। গ্রহাঃ শান্তিঃ। অন্তরীক্ষ শান্তিঃ। পৃথিবী শান্তিঃ। আপঃ শান্তিঃ। ওষধেয়ঃ শান্তিঃ। বনস্পতয়ঃ শান্তিঃ। বিশ্বেদেবাঃ শান্তিঃ। কামঃ শান্তিঃ। ক্রোধঃ শান্তিঃ। ব্রহ্মঃ শান্তিঃ। সর্বঃ শান্তিঃ। শান্তিরেব শান্তিঃ। সামঃ শান্তিরেভিঃ। যতো যতসমিহসে ততো নং অভয়ং কুরু। সন্নঃ কুরু প্রজাভ্যোৎভয়ং নঃ পশুভ্যঃ।। ওম্ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।।

চারদিন পরে অবশেষে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরতে পারি। তবে জীবনে প্রথমবারের জন্য আমি খুব লজ্জিত বোধ করেছিলাম। নিজের বোকামির জন্য নিজের সংসারটাকেই ভাসিয়ে দিতে বসেছিলাম আমি। গল্প খোঁজার নেশায় নিজের প্রাণটাকেই হারিয়ে ফেলতাম। কিন্তু বিনোদিনী, শিল্পা আর সুবল মহারানার এই কাহিনি আপনাদের কাছে পৌঁছে দেওয়াটাও আমার কর্তব্য। আমি যে বিনোদিনীর অতৃপ্ত আত্মাকে কথা দিয়েছিলাম!

কোণার্ক ভগ্ন হয়েও অমর, এবং অমরই রয়ে যাবে। কোণার্ক প্রমাণ করে দিয়েছে যে, পাষাণের বুকেও প্রাণ থাকে। কোণার্ক কোনো সাধারণ মন্দির নয়, একটি স্পন্দন। এক গহন উচ্ছ্বাস। সেখানকার প্রতিটি পাষাণখণ্ড সুবল মহারানার স্পর্শের সঞ্জীবনীতে অমর হয়ে গিয়েছে। কোণার্কের প্রত্যেক মূর্তিই জাগ্রত। পাষাণের বুকে খোদিত হাতি, ঘোড়া, পশু-পাখি, লতাপাতা, গাছপালা, দেবী-দেবতা, নর-নারী সব, সবই রক্ত-মাংসের কায়া নিয়ে জেগে ওঠে। তারা কথা বলে, ডাক দেয়, নাচে, গায়, মন্ত্রের উচ্চারণে আরাধনা সম্পূর্ণ করে। নর্তকীদের নূপুর–নিক্কণে মন হরণ করে কোণার্ক। পাথরের বুকে আঁকা ফুলও একসময়ে সজীব হয়ে উঠলে নাসাপুটে প্রবেশ করে তাদের সৌরভ।

আজ আপনিও যদি বিনোদিনীর এই কাহিনি শোনার পর কোণার্ককে দেখতে যান, তাহলে হয়তো মনে হবে, কোণার্ক শতাব্দীর নিদ্রা কাটিয়ে আড়মোড়া ভাঙছে। সে যেন এখুনি তার গল্প শোনাতে বসবে। সময়কে কোনো এক মায়াবলে থমকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে সে নিজের সুখদুঃখের ঝাঁপি খুলে বসবে আপনার আমনে। বলবে, এসো দুটো কথা বলি। আপনার মনে শুধু সেই কথাকে শোনার ধৈর্য আর বোঝার ক্ষমতা থাকা চাই।

তবে এই কাহিনি লেখার সময় আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, যখন আপনি এই শেষ ক’টা লাইন পড়বেন, ততক্ষণে সুবল মহারানা, শিল্পা কিংবা বিনোদিনীর অতৃপ্ত আত্মার মুক্তি ঘটে যাবে। তাদের আত্মার মোক্ষলাভের বিনীত প্রার্থনা নিয়ে ভগ্ন শব্দ কোণার্কের কথা আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম। এই কাহিনিতে আপনি নারীবাদ খুঁজলে খুঁজুন, সর্বহারার ব্যথা খুঁজুন, নিজের দেশের বিগত ইতিহাসের গরিমা খুঁজুন, প্রেম খুঁজুন, ত্যাগ আর বলিদানের কথা খুঁজুন, গল্পবাজের গল্প খুঁজুন, শব্দের খেলা খুঁজুন অথবা না-বলা কথার সঙ্কেত খুঁজুন…আমার কোনো শর্ত নেই। কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবেন, তা আপনার ওপরে নির্ভর করছে।

কিছু কাহিনি কখনোই শেষ হয় না বা বলা ভালো যে, আমরা বলে তাদের শেষ করতে পারি না। আসলে ওই কাহিনিগুলোকে ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব।

তাই না?  

সমাপ্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *