১২
আষাঢ় মাসের শুক্ল দ্বিতীয়া। প্রভু জগন্নাথ দেবের বিশ্ববিখ্যাত ‘ঘোষ-যাত্রা’ অর্থাৎ রথযাত্রার দিন। তিন দেবতাই বাইশ বেহারার পিঠে চেপে নাচতে-নাচতে চলেছেন সিংহদ্বারে। সিংহদ্বার থেকে বলগণ্ডি অবধি ভ্রাতা ভগিনী সহ প্রভুকে আসীন করে নিয়ে যাওয়ার জন্য ষোল চাকা, চোদ্দ চাকা আর বারো চাকার তিনটি রথ ইন্দ্রদ্যুম্ন পাটনায় অপেক্ষা করছে। মালিনী নদীর উত্তরে জগন্নাথ দেবের মাসিমা গুণ্ডিচা দেবীর নিবাসস্থল—আড় মণ্ডপ। বলগণ্ডিতে রথ পৌঁছালে পরে তিন ঠাকুরই দোলচাপ-এ চেপে নদীর ওপারে যাবেন, ওপারে দাঁড়িয়ে থাকবে চারচাকার পাটনা রথ। সেই রথে উঠে সোজা গুণ্ডিচা দেবীর মন্দির প্রাঙ্গণে পৌঁছাবেন তাঁরা।
রথযাত্রায় সবার আগে থাকে তালধ্বজ নামক রথ। চোদ্দটা চাকা। তালধ্বজে চড়েন শ্রী বলরাম। তার ঠিক পিছনে বারো চাকার পদ্মধ্বজ রথে থাকেন দেবী সুভদ্রা ও সুদর্শন চক্র, এবং সবার শেষে ষোল চাকার নন্দীঘোষ নামক রথে শ্রী জগন্নাথ দেব বিরাজ করেন। সন্ধে নামার আগেই এই তিন দেবতা গুণ্ডিচা দেবীর মন্দিরে গিয়ে উপস্থিত হন। পরদিন রথ থেকে নেমে ভগবান মন্দিরে প্রবেশ করেন। এবং আগামী সাতদিন সেখানেই বিরাজ করেন।
বড়দাণ্ডে আজ বিপুল জন সমাগম হয়েছে। নীলাদ্রি-বিহারী গোলোকনাথকে একটি বার স্বচক্ষে দেখার জন্য ভক্তিবিহ্বল মানুষের ঢল ছলছল চোখে প্রতীক্ষা করছে। আজ নীলাদ্রিনাথের এই রথযাত্রা মহারাজ নৃসিংহ দেবের সঙ্গে সমগ্র উৎকল জাতির বিজয়যাত্রাতে পরিণত হয়েছে। যখন সম্পূর্ণ ভারতবর্ষ ম্লেচ্ছদের পায়ে দলিত, মথিত, রক্তরঞ্জিত হয়ে উঠছে, তখনও স্বাধীন হিন্দু রাজ্য রূপে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার গর্ব বহন করে চলেছে উৎকল। আর এই গর্বের স্বামী শ্রী জগন্নাথ মহাপ্রভু।
যুদ্ধজয়ের উল্লাস, নৃসিংহ দেবের পুনর্জীবন প্রাপ্তি, কোণার্ক মন্দির গড়ে ওঠার অন্তিম পর্বের পুলক, আজকের এই রথযাত্রার উল্লাস মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। সীঙ্গি, পটহ, তূর্য, ডমরু, ঘণ্টা, শঙ্খ, ঘড়িয়াল, করতাল, ঝাঁঝর, বীণার সম্মিলিত ঝঙ্কারে গুঞ্জরিত হতে থাকা বেদবাণী, ভক্তদের কীর্তন আর জগন্নাথ স্বামীর নামে দেওয়া জয়ধ্বনির উদঘোষ এক মহাঘোষে পরিণত হয়ে আকাশ–বাতাস কাঁপিয়ে তুলছে। সুখ–দুঃখ, মিলন–বিরহ, জয়–পরাজয়, প্রাপ্তি–অপ্রাপ্তি, আশা–নিরাশা এই সবকিছু ভুলে বিমুগ্ধ ভক্তদের আত্মা দারুব্রহ্মের পুরুষোত্তম বিগ্রহ দর্শনের জন্য আকুল প্রতীক্ষা করে চলেছে।
প্রলয় প্রয়োধি সংসার-পারাবারের অগাধ জলরাশিতে আমস্তক নিমজ্জিত আত্মারা নিজেদের করুণপ্রবণ আরাধ্যকে দর্শনের জন্য আতুর। কামনা, বাসনা, ভোগ, লালসা সবই এখন বিস্মৃত। জ্ঞান, গরিমা, স্বাভিমান, অহংকার সব ত্যাগ করে চরম উন্মাদনা নিয়ে সকল ভক্ত এখন পরমপদকমলে লীন হতে ব্যাকুল। উৎকলের গর্ব, গৌরব, ত্রাতা, ওই রহস্যময় পুরুষোত্তমের পতিত পাবন বেশ দেখার জন্য জনসমুদ্র আজ ভাবতরঙ্গে উদ্বেলিত। ভক্তমানসে একটাই বাক্য গুঞ্জন তুলছে—‘রথেতু বামনম্ দৃষ্টবা পুনর্জন্মম্ ন বিদ্যতে!’
চোড়গঙ্গ দেবের আমল থেকে অমরাবতী-কটক থেকে কাঠ এনে রথ বানানো হতো। কিন্তু মহারাজ নৃসিংহ দেব এবারে সুন্দরবন থেকে কাঠ আনয়ন করিয়েছেন। নায়ক দামোদর মহাপাত্র রাজার আজ্ঞা অনুসারে নদীপথে বড় ভেলায় চাপিয়ে ভাসিয়ে এনেছেন সেই কাঠ। রথকে যে চিত্রকাররা চিত্রকারী দিয়ে সাজায়, তাদের জন্য চিত্রকারসাহী এবং যারা ফুল দিয়ে রথসজ্জা করে, সেইসব মালাকারদের জন্য মালাকারসাহী নৃসিংহ দেবই বসিয়েছেন হরবংশপুর গ্রামে।
কাশ্মীর রাজ্যে দূত পাঠিয়ে সীতাদেবীর পিতৃগৃহ থেকে সুরুবুলী শালের চাঁদোয়া আনিয়ে সাজানো হয়ছে রথ। দখিনা বাতাসে পতপত করে উড়ছে রথের পতাকা। আজ নৃসিংহ দেব স্বয়ং রথের পথ ঝাঁট দেবেন। তারপর রজ্জু স্পর্শ করবেন।
জগন্নাথ দেবের মন্দিরে এক ধরনের বিশেষ সেবক সম্প্রদায় আছে, যারা রথ টানে। তাদের বলা হয় ভগতগণ। এই ভগতগণই তারপর বত্রিশ হাত টেনে নিয়ে যাবে রথকে। সেখান থেকে ছয়টি শ্বেত হস্তী রথকে টেনে নিয়ে যাবে বলগণ্ডি। আর তারপর দোলচাপে চড়ে ভগবান নদী পার করে যাবেন মাসির বাড়ি।
রথের অভীষব ধরে টান দিলেন মহারাজ নৃসিংহ দেব। হরিবোল, হুলধ্বনি আর বাদ্যযন্ত্রের নিনাদে রথদাণ্ড কেঁপে উঠল, মেদিনী দুলে উঠল, থরথর করে উঠল দশদিক, বায়ুতে উঠল গুঞ্জন। মন–প্রাণ–হৃদয় স্পন্দিত হল। নন্দীঘোষের চাকার ঘর্ঘর শব্দে মুখর হয়ে উঠল পরিসর। উল্লসিত হয়ে উঠল স্বর্গ–মর্ত্য–পাতাল। কোটি কোটি মানুষ যেন এক প্রাণ নিয়ে বলে উঠল—হে অচল মহামেরু, তুমি যদি স্বেচ্ছায় না-চলো, তবে কার সাধ্য আছে যে তোমাকে চলমান করে তুলবে? আর সেই তুমিই আজ ভক্তদের ইচ্ছানুসারে এগিয়ে চলেছ। কত কামনা নিয়ে ভক্তরা আজ তোমার দ্বারে এসেছিল, কিন্তু সেইসব কামনা এখন বিস্মৃত, স্মৃতি লুপ্ত এখন। আজ সবাই শোক–দুঃখ ভুলে গিয়েছে। মৃত্যুও এখানে অমৃতময়।
এই রহস্যময় দারুব্রহ্মের এ কেমন সম্মোহন? আচার্য শঙ্কর লিখে গিয়েছিলেন, আমি রাজ্য কামনা করি না। স্বর্গ কিংবা মণিমাণিক্যের প্রয়োজন আমার নেই। সর্বজন বাঞ্ছিত মনোহারিণী কামিনীর অভিলাষীও আমি নই। প্রমথপতি মহেশ্বর যুগ যুগ ধরে নিরন্তর যার চরিত্র বন্দনা করেন, সেই প্রভু জগন্নাথ আমার নয়নপথগামী হোন।
ন বৈ প্রার্থ্যং রাজ্যং ন চ মাণিক্য বিভবং,
ন য়চেহং রম্যং নিখিলজনকাম্যাং বরবধূং।
সদা কালে কালে প্রমথপতিনা গীতচরিতো,
জগন্নাথঃ স্বামী নয়নপথগামী ভবতুমে।।
আষাঢ়ের মেঘ আকাশ ঘিরে ফেলেছে। দেবলোক থেকে ঝরে পড়ছে আশিসের মধুবারি। নৃসিংহ দেবের চোখ দিয়েও অঝোরে বয়ে চলেছে আনন্দাশ্রু। মনে এখন একটাই প্রার্থনা, ‘এই জীবনে একটি বার, কেবল একটি বার ওই যুবতী নারীর দর্শন করিয়ে দাও প্রভু, যে মৃত্যুর কোলে শুয়ে থাকা নৃসিংহ দেবের মুখে তোমার প্রসাদ তুলে দিয়েছিল। তুমি না-চাইলে আমি কীভাবে তাকে খুঁজে বের করব বলো তো? তার স্বামীর কঠোর পরিশ্রমেই কোণার্ক গড়ে উঠছে। প্রায় পূর্ণ হতে চলেছে আমার স্বপ্নের মন্দির। সেই শিল্পী যখন ঘরে ফিরে যাবে, তখন সেখানে তার স্ত্রীকে দেখতে না-পেলে তার কী হবে প্রভু? হে দীনবন্ধু, একটি বার তার সাক্ষাৎ করিয়ে দাও, একটি বার…!’
হঠাৎই নৃসিংহ দেবের দৃষ্টি একজন রমণীর উপরে পড়ল। চোখ নিবদ্ধ হয়ে গেল সেখানেই। ভাবসমুদ্রে ডুবে সেই নারী বিশাল জনসমুদ্রকে দেখে চলেছিল, এবং তার চোখাচুখি হয়ে গেল মহারাজের সঙ্গে। ‘ওই তো! ও-ই তো!’ ধড়ফড় করে এগিয়ে গেলেন মহারাজ, কিন্তু কোথায় কী? এই মহাজনপারাবারে কি আর একটি জলকণাকে আলাদা করে ধরতে পারা সম্ভব? সে ততক্ষণে ভিড়ে বিলীন হয়ে গিয়েছে।
নৃসিংহ দেবের মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এল, ‘এ কেমন লীলা তোমার? সব শুনলে, তবু প্রার্থনা স্বীকার করলে না? তুমি তো মন পড়ে ফেল? এ কেমন বর দিলে? অবশ্য যা করেছ বুঝেই করেছ, প্রভু। ওই নারী তোমার শরণাগত, এই দীন হীন নৃসিংহ দেবের আশ্রয়ের কি আর কোনো প্রয়োজন আছে ওঁর? তোমার মনে কী আছে তুমিই জানবে। শুধু প্রার্থনা করি, ওই নারী এবং ওঁর স্বামীর একটিবারের জন্য সাক্ষাৎ করিয়ে দিও প্রভু।’
ওদিকে বিনোদিনী দেখে ফেলেছিল মহারাজ রথের পথে ঝাঁট দিচ্ছেন। মনে আবেগের সাগর তোলপাড় হয়ে চলেছিল, ‘তাহলে যে পুরোহিত আমাকে কুয়োতে পড়ে যাওয়ার সময় রক্ষা করেছিল, যে মহাদণ্ডপাশ আমাকে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার সময়ে আটকে দিয়ে নতুন জীবন দিয়েছিল, এবং যে আহত সৈনিককে আমি নিজের কুটিরে আশ্রয় দিয়েছিলাম, সে আর কেউ নয়, স্বয়ং মহারাজ নৃসিংহ দেব? ছিঃ ছিঃ! আমি ওঁর সামনেই ওঁকে কত ভর্ৎসনা করে গিয়েছি, কিন্তু উনি একটি কথাও অন্যথা নেননি। প্রত্যেক বার আমি ওঁর কৃপা পায়ে ঠেলে পালিয়ে বেড়িয়েছি, আর নিয়তি বার বার আমাকে ওঁরই সামনে এনে ফেলেছে। কিন্তু আজ কীভাবে পালাব?
আজ মহারাজ আমাকে দেখলেই ধরে নিয়ে যাবেন কোণার্কে। আমি সমাজ থেকে বহিষ্কৃতা, স্বামী আমার এই অবস্থা দেখলে মনোকষ্টেই মরে যাবে। তখন শাশুড়ি মা বলতেন, তুই কুলটা, অলক্ষুণে। তুই মরলেই একটা পয়মন্ত মেয়েকে বউ করে আনব। নিশ্চয়ই বাড়ি ছেড়ে আসার পর আমার স্বামীর কাছে আমার সংবাদ গিয়েছে, আমার নামে অপবাদ গিয়েছে। এখন আর তাঁকে কীভাবে এই মুখ দেখাব? তাঁর জন্য আমি যে এখন মৃত। বরং তিনি কোণার্ক থেকে বাড়ি ফিরলে দ্বিতীয় বিয়ে করবেন। নতুন সংসার পাতবেন। আমি সেই পথে বাধা দিতে চাই না। না, না রাজার দৃষ্টি থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে হবে।’
নিজের মনে জন্ম নিতে থাকা চোরা স্রোতে ডুবে বিনোদিনী নিজেকে ভিড়ের মধ্যে লুকোতে চেষ্টা করল। তখনই তার চোখে পড়ল রাজপথের পাশের একটি সংকীর্ণ গলিপথ। সেখানেও অবশ্য মানুষ কম নেই। বিনোদিনী গলির দিকে এগোল। কিছুটা দূর অবধি হেঁটে চলার পরে সে বুঝল গলির অন্য মাথাটা আসলে বন্ধ। অসহায় ভাবে সে নিজের চারিপাশে তাকাল। হঠাৎই তার কানে এল এক অমৃত স্বরলহরী। মনে হল নতুন প্রাণের সঞ্চার হল আবহে।
গলির একটা দিকে, একখানা ছোট্ট বাড়ি। বাড়ির সামনে আঙিনা। সেখানে তুলসীর মণ্ডপ। আঙিনার একটি কোণে, ছায়ায় বসে এক তরুণী করুণ স্বরে তন্ময় হয়ে গীতগোবিন্দ পাঠ করে চলেছে।
নিভৃতনিকুঞ্জগৃহম্ গতয়া নিশি রহসি নিলীয় বসন্তম্।
চকিতবিলোকিতসকলদিশা রতিরভসরসেন হসন্তম্।।
সখী হে কেশিমথনমুদারম্!
সখী হে কেশিমথনমুদারম্
রময় ময়া সহ মদনমনোরথভাবিতয়া সবিকারম্।।
সখী হে কেশিমথনমুদারম্!
সখী হে কেশিমথনমুদারম্!
প্রথমসমাগমলজ্জিতয়া পটুচাটুশতৈরনুকূলম্।
মৃদুমধুরস্মিতভাষিতয়া শিথিলীকৃতজঘনদুকূলম্।।
সখী হে কেশিমথনমুদারম্!
সখী হে কেশিমথনমুদারম্!
কিশলয়শয়ন নিবেশিতয়া চিরমুরসী মমৈব শয়ানম্।
কৃত পরিরম্ভণ-চুম্বনয়া পরিরভ্য কৃতাধরপানম্।।
সখী হে কেশিমথনমুদারম্!
সখী হে কেশিমথনমুদারম্!
অলসনিমীলিতলোচনয়া পুলকাবলিললিতকপোলম্।
শ্রমজলসকলকলেবরয়া বরমদনমদাদতিলোলম্।।
সখী হে কেশিমথনমুদারম্!
সখী হে কেশিমথনমুদারম্!
কোকিলকলরবকূজিতয়া জিতমনসিজ-তন্ত্রবিচারম্।
শ্লথকুসুমাকুলকুন্তলয়া নখলিখিতঘনস্তনভারম্।।
সখী হে কেশিমথনমুদারম্!
সখী হে কেশিমথনমুদারম্!
চরণরণিতমণিনূপুরয়া পরিপূরিতসুরতবিতানম্।
মুখরবিশৃঙ্খলমেখলয়া সকচগ্রহচুম্বনদানম্।।
সখী হে কেশিমথনমুদারম্!
সখী হে কেশিমথনমুদারম্!
রতিসুখসময়-রসালসয়া দরমুকুলিতনয়নসরোজম্।
নিঃসহনিপতিততনুলতয়া মধুসূদনমুদিতমনোজম্।।
সখী হে কেশিমথনমুদারম্!
সখী হে কেশিমথনমুদারম্!
মালব রাগে গাওয়া গীতগোবিন্দ-এর এই পদাবলী একতারার তন্ত্রী-নিনাদের সঙ্গে জুড়ে গিয়ে অপূর্ব মধুক্ষরণ করে চলেছে। তৃষ্ণায় বিনোদিনীর কণ্ঠ শুকিয়ে আসছিল, কিন্তু এই পদাবলী শোনার পর যেন তিরোহিত হয়েছে সেই তেষ্টা। মনে কিছুটা সঙ্কোচ রেখেই বাঁশের জাল-দরজা খুলে সেই বাড়ির আঙিনায় ঢুকে পড়ল বিনোদিনী।
ভিতরে পা-রাখতেই অনির্বচনীয় এক আহ্লাদে তার দেহ পুলকিত হয়ে উঠল। একটা বিরাট তুলসী মঞ্চে তুলসীর একাধিক চারা রোপিত হয়েছে। প্রতিটা চারাগাছের ফাঁকে ফাঁকে একটি করে দমনকের গুল্মলতা। মঞ্চের চারটি কোণে, মাটিতে পোঁতা আছে বৈজয়ন্তী লতাগাছ। ফুলও ফুটে রয়েছে। বাঁশের জাল-দরজা থেকে বাড়ির মূল অংশে প্রবেশের মধ্যেকার পথটা আট হাত চওড়া। সেই পথের দুধারের মাটিতে লকলক করছে অপরাজিতার লতা। বাঁশ দিয়ে ভরদণ্ড তৈরি করা আছে তাদের বেড়ে ওঠার জন্য। বছরের এই সময়টাতেই অপরাজিতার ফুল ফোটে, চারিদিকে নীল আর সাদা অপরাজিতার এত ফুল দেখে মণিমাণিক্যের ছড়াছড়ি বলে ভ্রম হয়।
বিনোদিনী কোনো রকমের শব্দ করতে চায়নি। কিন্তু না-জানি কেন সেই যুবতী নিজের গান থামিয়ে দিল। শান্ত হয়ে গেল একতারার ঝঙ্কার। চোখ মেলতেই সেই যুবতী দেখল এক নারী তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মুখেচোখে অসহায় একটা ভাব। গীতগোবিন্দের এই পদাবলী গাইতে গাইতে যুবতীর চোখ আনন্দাশ্রুতে ভরে গিয়েছিল। জল পুঁছতে পুঁছতেই সে উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, ‘সখী, কে তুমি? কী চাই?’
‘আমি এক অভাগী, বোন। অসহায়। আশ্রয়হীন। এই জগতে মাথাটুকু গোঁজার মতো জায়গাও আমার কাছে নেই। তেষ্টায় বুক ফেটে যাচ্ছে। খিদেতে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। একটু জল হবে?’
‘কী বলছ, সখী? এটা শ্রীক্ষেত্র! এখানে কেউ নিরাশ্রয় হয় না। সবার নাথ শ্রী জগন্নাথ স্বামী। এসো, দাওয়াতে উঠে এসো। কুশ-তল্পিতে এসে বোসো। আমি এখুনি আসছি।’ কথা শেষ করেই যুবতী গৃহের ভিতরে চলে গেল। যখন সে ফিরে এল, তখন তার হাতে কাঁসার থালায় চাল আর গুড় দিয়ে তৈরি অন্নরসা, আর একটা মাটির কটোরায় জল।
‘নাও সখী। জগন্নাথ দেবের প্রসাদ মনে করে খেয়ে নাও দেখি।’
প্রসাদ পেয়ে বিনোদিনী একটু তৃপ্ত হলে পরে যুবতী জিজ্ঞাসা করল, ‘তা যাবে কোথায়? আজ যে পথে বিষম ভিড়?’
‘কোথায় আর যাব? জগন্নাথ মহাপ্রভুই আমার রক্ষক, তিনিই আমার পথ-প্রদর্শক। তিনি যেদিকে নিয়ে যাবেন, চলে যাব। তোমার মুখে গীতগোবিন্দের অমৃতময় পদাবলী শুনে ধন্য হয়ে গেলাম। মনে হচ্ছিল রোজ এমন পদাবলী শুনেই বাকি জীবনটা কেটে যাক।’
‘সত্যিই তোমার কেউ নেই? তাহলে তুমি আমার কাছেই থেকে যাও। আমি প্রভু জগন্নাথের দেবদাসী। আমার নাম পেখম। আমার সহচরী রূপে যে দাসীটি ছিল, সে বিয়ের পর নিজের স্বামীর গৃহে চলে গিয়েছে। একা একা সবদিক সামাল দেওয়া এবং একইসঙ্গে প্রতিদিন নৃত্যগীতের অভ্যাস করা আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তুমি এখানে থেকে গেলে আমারও সুবিধা হবে, আবার তোমারও আশ্রয় মিলবে। কি, থাকবে আমার সঙ্গে?’
অন্ধ আর কী চায়? শুধু দুটি চোখ।
‘যদি প্রভু জগন্নাথ আমার নিয়তিতে এই কথাই লিখে থাকেন, তাহলে তাকে খণ্ডন করার সাধ্য আমার নেই। আমার মন চিনে নিয়ে তিনিই আমাকে এখানে, তোমার এই নির্ভয় আশ্রয়ে এনেছেন।’
‘সত্যিই তা-ই। জগন্নাথ দেবের মহিমা অপার!’
‘কিন্তু তুমি আমাকে তাহলে সখী বলে ডেকো না। আমি তোমার দাসী হয়েই থাকব। সখীর বাড়িতে কি আর দীর্ঘদিন থাকা যায় নাকি?’
‘আমি তোমায় সখী বলেই ডাকব। তুমি আমার সখী, আমি তোমার স্বামীনি। সম্পর্ক আসলে মনের বন্ধনে তৈরি হয়। এসো, ভিতরে এসো।’
এই নিরাপদ আশ্রয়েই জগন্নাথ মহাপ্রভুর সেবা অর্চনা করে বিনোদিনীর দিন কাটতে লাগল। মাঝেমধ্যেই সে ভাবে, তার জীবন কী ছিল, আর কী হল। পতিতপাবন জগন্নাথ দেবের রথারূঢ় বিগ্রহ দেখে নেওয়ার পর এই দুঃখ–বেদনা আর হাহাকারে ভরা জগৎ সংসারে আর জন্ম নিতে হয় না। কিন্তু রথের উপরে অধিষ্ঠিত দেবতার মুখ দর্শন হল কই? তার আগেই তো দেখা হয়ে গেল মহারাজ নৃসিংহ দেবের সঙ্গে। পালিয়ে আসতে হল। জগন্নাথ স্বামীর ইচ্ছা না-থাকলে তাঁর মুখ দেখার সাধ্যি কারো নেই।
জীবনভর যে পুরুষটি তার মনের নদীতে শক্তি, সম্ভ্রম, মমতা এবং মাধুর্যের ধারা শুকোতে দিল না, সে আসলে পরম পুরুষ, জগন্নাথ স্বামীর সেবক, উৎকলের অপরাজেয় নরপতি। স্বামী কোণার্কের শিল্পী, স্থপতি। আর এত সৌভাগ্যের পরেও সে একজন ভাগ্যহীনা, পরিত্যক্তা, স্বামী-স্নেহ বঞ্চিতা এক নিরাশ্রিতা নারী, যার নিয়তিতে সবার থেকে মুখ লুকিয়ে রাখা, পরিচয় গোপন রাখাই লেখা রয়েছে। ‘হে জগন্নাথ, এ কেমন বিড়ম্বনা? এই কষ্টের শেষ কোথায়? চলার পথে আর কত কাঁটা বাকি রয়েছে, তুমিই বলো, প্রভু?’
নৃসিংহ দেবের শিল্পানুরাগের সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন, কোণার্কের সূর্য মন্দির সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। রাজত্বের বারো বছরের সকল রাজস্ব ব্যয় করে, বারোশো শিল্পীর অকল্পনীয় পরিশ্রমের ফলে এই শিল্পসাধনা সম্পন্ন হতে পেরেছে। মহারাজ নৃসিংহ দেবের সবচেয়ে কঠিন ব্রতটিকে উদ্যাপনের তিথি ক্রমশ এগিয়ে আসছে। নৃসিংহ দেবের হাতে বার বার পরাজিত গৌড়ের মুসলিম শাসক ইখতিয়ারউদ্দিন বেগের মৃত্যু হয়েছে। বারোশো ছেচল্লিশ সন থেকে মুসলমানদের সঙ্গে চলে আসা সংঘর্ষের অবসান ঘটেছে এখন। উৎকল এবার নিষ্কণ্টক। এবং কোণার্ক এখন সম্পূর্ণ। যবন শাসনে আক্রান্ত ভারতভূমির একমাত্র স্বাধীন রাজ্য উৎকলের প্রত্যেক ঘরে এখন প্রতিদিনই উৎসব পালিত হয়। বীর, লড়াকু পাইকেরা মুসলমান শাসকের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। এখন আর ম্লেচ্ছদের পক্ষ থেকে প্রতি-আক্রমণের কোনো প্রশ্নই নেই। স্বাধীনতার সূর্য উৎকলকে আলোকিত করে চলেছে অবিরত।
সন ১২৫৮। মাঘ শুক্ল সপ্তমী। বিক্রম সম্বতের হিসাবে সম্বৎ ১৩১৪। রবিবার। সাধ্য যোগ। মেষ রাশি, অশ্বিনী নক্ষত্র, রাশি অধিপতি মঙ্গল, নক্ষত্র অধিপতি কেতু, মকর লগ্ন। শুক্র ধনুতে, তুলায় বৃহস্পতি অর্থাৎ শুক্র আর বৃহস্পতি পরস্পর রাশি বিনিময় করেছে, স্থাপত্য এবং নির্মাণের কারক স্বগৃহী শনি কুম্ভে এবং তুলা রাশিতে মঙ্গল আর বৃহস্পতির চন্দ্রের উপর তথা মেষ রাশিস্থ চন্দ্র মঙ্গল তথা বৃহস্পতির উপর পরস্পর পূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করছে অর্থাৎ গজকেশরী যোগ। সঙ্গে রবিবার তথা অশ্বিনী নক্ষত্রের যোগের ফলস্বরূপ সমস্ত কাজে সিদ্ধিদায়ক সর্বার্থসিদ্ধি যোগের শুভ মুহূর্ত।
মাঘমাসের শুক্ল পক্ষের সপ্তমী তিথিতে অচলা সপ্তমী পর্ব পালিত হয়। এছাড়াও এর অনেক নাম—সূর্য সপ্তমী, রথ আরোগ্য সপ্তমী, সূর্যরথ সপ্তমী, পুত্র সপ্তমী। শাস্ত্রের মতে, সূর্যদেবতা এই দিনেই সমগ্র জগৎকে নিজের আলোয় আলোকিত করেছিলেন, তাই এই মাঘ শুক্ল সপ্তমী তিথিকেই সূর্য-জয়ন্তী রূপে পালন করা হয়। যদি কখনো এই সপ্তমী রবিবারে পড়ে, তখন তাকে ভানু সপ্তমীও বলা হয়। পরম বৈষ্ণব নৃসিংহ দেবের শাসনকালে এই মহাযোগ এবারেই প্রথম এসেছিল। তা-ও আবার এক অদ্ভুত সময়ে—যখন কোণার্কের সূর্যমন্দিরের কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। রাজগুরু ভাব সদাশিবের কথা অনুসারে অর্কক্ষেত্রে সূর্যদেবের জন্মদিনের এই মহামুহূর্তে বিশ্ববাসীর হাতে বিশ্ববিখ্যাত সূর্যমন্দির তুলে দিতে পারলে তার থেকে বড় কোনো উপহার আর হতেই পারবে না। অতএব, কোণার্কের সূর্য মন্দিরের প্রতিষ্ঠাদিবস নিশ্চিত হয়ে গেল।
কোণার্ক ক্ষেত্রে এখন আনন্দ আর উল্লাসের আবহ। মহেন্দ্রগিরি স্থিত গোকর্ণেশ্বর মন্দির, মুখলিঙ্গম, শ্রীকূর্ম এবং সিংহাচলের বিষ্ণু মন্দিরগুলিতে অখণ্ডদীপ জ্বলে উঠেছে। জাজপুরের গঙ্গেশ্বর তথা বয়ালিশবাটির গঙ্গেশ্বরী মন্দিরে, বেগুনিয়ার প্রাচীন দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে, রেমুণার গোপীনাথ মন্দিরে এবং পুরী জগন্নাথ দেবের মন্দিরে কোণার্কের সফল প্রাণ প্রতিষ্ঠার জন্য পূজা-অর্চনা করা হচ্ছে। কপিলাশ্ব পর্বতের শিখরেশ্বর মন্দিরে বারো লক্ষ বিল্বপত্র এবং বারো লক্ষ চাঁপাফুল দিয়ে করা হয়েছে অখণ্ড রুদ্রাভিষেক।
কোণার্কের প্রতিষ্ঠার উৎসবে সম্মিলিতে হওয়ার জন্য সাগরপথে অনেক দ্বীপের রাজা, ধর্মবেত্তা, বিদ্বান, জ্যোতিষী, পণ্ডিত, কবি, সঙ্গীতজ্ঞ তথা গুণীজনেরা অতিথি হয়ে এসেছেন। পুরী, কৃত্তিবাস, রেমুণা, বারাণসী, নারায়ণপুর, দেবকূট, দ্বারকাপুরী, প্রভাস, পাটন, শূর্পারক ক্ষেত্র, কোথা থেকে আসেনি মানুষ? দেশের প্রত্যেক কোণ থেকে আসা জনতা ভিড় করেছে কোণার্কে। কোণার্কের প্রসিদ্ধি শুনেই এসেছেন, ‘চলো, একবার দেখে আসি—কী আছে কোণার্কে?’
কোণার্কের প্রতিষ্ঠার আগেই মহারাজ নৃসিংহ দেব সকল কোণার্ক–শিল্পীকে সর্বোত্তম পারিতোষিক দিয়েছেন। প্রত্যেক শিল্পীর জন্য আজীবন বৃত্তির ব্যবস্থা স্বীকৃত হয়েছে। সুবল মহারানাকে নিজের হাতে রত্ন পদক পরিয়ে দিয়ে শিল্পী–শিরোমণির উপাধি দিয়েছেন রাজা নৃসিংহ দেব। তিনি নিজের ভূমি রাজস্ব মন্ত্রীকে এই নির্দেশ দিয়েছেন যে, সুবলের ইচ্ছা ও পছন্দ অনুসারে রাজ্যের যে কোনো অঞ্চলে তাকে ভূমি দানের ব্যবস্থা করা হোক।
প্রতিষ্ঠা–সমারোহে প্রত্যেক শিল্পীর পরিবারকে বিশেষ ভাবে আমন্ত্রণ করা হয়েছে। সুবলের বাড়ি থেকে এসেছে তার মা আর ভাই ধবল মহারানা। তাদের দেখে সুবল আনন্দে আপ্লুত হয়ে পড়ল, কিন্তু তার চোখ খুঁজতে লাগল তার মনোনিধি বিনোদিনীকে। ‘তবে কি মা ওকে বাড়িতেই রেখে চলে এসেছে? ও যদি এখানে আসত, তাহলে আমাকে সম্মান প্রদান দেখে ওর মনের বিরহ ব্যথা হয়তো কিছুটা কমত। গর্ব করে বলতে পারত, আমার স্বামী শুধু একজন কোণার্ক-শিল্পী নয়, সে শিল্পী-শিরোমণি।’
সুবলের মায়ের অভিজ্ঞ চোখ। তিনি পুত্রের মনোভাব বুঝতে পেরেছেন। তিনি বললেন, ‘আর কী করা যাবে, সুবল? সব তাঁরই ইচ্ছা। বিনোদিনী একবার জেদ ধরল, বাপের বাড়ি যাব। আমিও ভাবলাম, ঠিক আছে যাক। মন ভালো থাকবে। তুই নেই, একা একা কি আর ওর ভালো লাগে? তারপর ওখানে না-জানি কী ঘটল? সব শেষ হয়ে গেল। আমরা তোকে আর কোনো খবর পাঠাইনি। তাহলে এখানে কাজে মন বসাতে পারতিস না, বাবা। আমার সংসারটা শূন্য করে দিয়ে চলে গেছে সে।’
সুবল মহারানা স্তম্ভিত হয়ে গেল। পাশেই কোলাহল চলছে। কিন্তু সুবলের কানে এসে কিছুই প্রবেশ করছে না। শুধুই প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে দুটি শব্দ—‘সব শেষ’, ‘সব শেষ’, ‘সব শেষ’!
‘এতদিন ধরে যে পদ্মগন্ধা কিশোরীর প্রতীক্ষা-মূর্তি মনের মধ্যে স্থাপন করে কোণার্কের পাষাণে সে ফুল ফুটিয়ে চলেছিলাম, সে তাহলে কবেই মিলন-বিরহ, সুখ-দুঃখের ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছে। ভালোই হয়েছে যে আমি এই সংবাদ পাইনি। পারতাম কি বিশু মহারানার মতো পাথর হয়ে থাকতে? কোণার্কের প্রত্যেক শিল্পীর বাড়ি থেকেই যদি সংবাদ আসত, তাহলে কি আর কোণার্কের কাজ সম্পূর্ণ হতো? কিন্তু তাই বলে এভাবে সব শেষ হয়ে যাবে? এত সহজে সবকিছু শেষ করে চলে যাওয়া কি মানায়?’
সুবলের মা ছেলের মনের ব্যথাটা টের পেয়েছেন, ‘সুবল, সংসার বড় অনিত্য। ভাঙা গড়া লেগেই থাকে। তুই বেঁচে থাক, তোর আবার বিয়ে দেব, সংসার করবি। ওর থেকেও সুন্দরী বউ পাবি। আর এখন তুই উৎকলের শিল্পী-শিরোমণি। তোর আবার চিন্তা কীসের? ধবলের জন্য মেয়ে দেখছিলাম। তোর জন্যেও একটি মেয়ে দেখেছি। বছর দশেক বয়স। তুই বাড়ি ফিরলেই এক মণ্ডপে দুই ভাইয়ের বিয়ে দিয়ে দেব। আবার আমার সংসার ভরে উঠবে। যে চলে গেছে, তার জন্য কেঁদে আর কী হবে!’
সুবল কোনো উত্তর দিল না। বারো বছরের একাগ্র সাধনায় সে সুখ–দুঃখের অনেক উপরে উঠে গিয়েছে। কায়া-মন-প্রাণে সে আজ একজন বিবাগী। প্রিয়া পরিণীতার সঙ্গে মিলনের কামনায় সে বিভোর হয়েছে বটে, কিন্তু অধীর কখনো হয়নি। সে স্বর্গীয় প্রেমের ভাবনা মনে নিয়ে পাথরের বুকে ছবি এঁকে গিয়েছে, শিব-জগন্নাথের ভক্তিগাথা লিখেছে, নবগ্রহ–পাটে কুঁদেছে নিজের ভক্তির প্রমাণ।
আজও সে অধীর হল না। ভাবল, ‘সবই জগন্নাথ দেবের ইচ্ছা। এটাই হয়তো তাঁর সঙ্কেত যে কোণার্ক ছেড়ে যেও না।’ গিয়ে করবেই বা কী? ঘর আর ঘরণীর মোহেই তো কোণার্ক থেকে ঘরে ফেরার তাগিদ ছিল। পার্থিব সুখের জন্য অপার্থিব কামনা থেকে বিমুখ হতো। এখন আর কোনো বন্ধন নেই, সে মুক্ত বিহঙ্গ। ‘মায়ের জন্য ধবল তো রয়েইছে। শিল্পা আমাকে বেঁধেছিল, নিজেই মুক্তি দিয়ে গিয়েছে। ধর্মপদ আমাকে বেঁধেছিল। সেও বন্ধনমুক্তি ঘটিয়ে চলে গিয়েছে। আর সবথেকে বড় বাঁধন ছিল বিনোদিনী। সে যে কবে সেই বাঁধন ছিন্ন করে চলে গিয়েছে তা আমি জানতেই পারিনি। আমি নিজেই নিজের পায়ের বেড়ি হয়ে ফিরছিলাম, আর নয়, আর নয়…।’
সুবল এবার শিবেই সান্তারার সঙ্গে দেখা করল। তিনি ভয়ানক ব্যস্ত ছিলেন, কিন্তু সুবলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য সময় দিলেন। সুবল স্পষ্ট জানাল যে সে কোণার্ক ছেড়ে ফিরে যেতে ইচ্ছুক নয়। কোণার্কের পাশেই কোথাও তাকে ভূমি দান করা হলে মহারাজের দ্বারা প্রদত্ত আজীবন বৃত্তির সাহায্যে সে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চায়।
শিবেই সান্তারা বললেন, ‘তোমার জন্য উপযুক্ত ভূমির সন্ধান করা হবে, সুবল।’
‘আমার নিজস্ব একটি পরিকল্পনা আছে। অভয় দিলে বলি।’
‘বলো, সুবল…’
‘কুশভদ্রার তীরে বেগুনিয়া গ্রাম। সেখানে পাতাল ফুঁড়ে উঠে এসেছে একটি শ্বেতবর্ণের শিবলিঙ্গ। মহারাজ সেই শিবলিঙ্গটির জন্য দক্ষিণেশ্বর মহাদেবের মন্দির নির্মাণের ঘোষণা করেছেন। দক্ষিণেশ্বর মহাদেবের সেই মন্দিরের নির্মাণস্থলের পাশেই রয়েছে একটি কেতকী বন। আমাকে সেই বনের ধারেই একটি কুটির বানিয়ে থাকার মতো ভূমি প্রদান করে দিন, মন্ত্রী মশাই।
বহুবার ওই শিবলিঙ্গকে দর্শন করার জন্য গিয়েছি। এবং প্রতিবারই কেয়া বনের সৌন্দর্য আমাকে আকৃষ্ট করেছে। জানেন মন্ত্রী মশাই, আমি আমার স্ত্রী’কে শেষবার একটি পুকুরে স্নানরত অবস্থায় দেখেছিলাম। আমার খুব ইচ্ছে করত কোণার্কের কাজ মিটলে আমি আর আমার স্ত্রী বিনোদিনী দুজনে মিলে ওই বনের ধারে বাসা বেঁধে থাকব। মা আর ভাই সমারোহ অনুষ্ঠানে এসেছিল, তারা জানাল আমার স্ত্রী আর জীবিত নেই, তাই এখন আমি একাই ওখানে কুটির বানিয়ে থাকতে চাই। যদি মহারাজের অনুমতি থাকে, তবে আমি দক্ষিণেশ্বর মহাদেবের মন্দিরের ভাস্কর্যে নিজের সেবাও দিতে পারব। যখন কোনো কাজকর্ম থাকবে না, তখন কুশভদ্রায় স্নান করে প্রতিদিন ধূসর দিগন্তের চিত্রপটে কোণার্ককে দেখব। কেয়া ফুল দিয়ে বিরিঞ্চিনারায়ণের পূজা করতে পারব। এটুকুই। এর থেকে বেশি আর কোনো কামনা আমার নেই। আমার এই প্রার্থনা কি স্বীকার করা সম্ভব?’
যখন নৃসিংহ দেব কোণার্ক মন্দিরের প্রতিষ্ঠার জন্য সীতাদেবীর সঙ্গে রথে উঠতে যাবেন, তখন শিবেই সান্তারা তাঁর কাছে সুবলের প্রার্থনার অবিকল রূপটিকে তুলে ধরলেন। মহারাজ কিছু বলার আগেই রানিমা বলে উঠলেন, ‘সান্তারা মশাই, সুবল মহারানার ইচ্ছা পূরণ করার আমাদের কর্তব্য। এতে মহারাজের কোনো আপত্তি থাকতেই পারে না।’
মহারাজ বললেন, ‘মহারানির ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা। কিন্তু একটা ব্যাপার ভেবে বড় অবাক হচ্ছি, কেতকী বনের ধারে অমন নির্জন একটা স্থান বেছে নেওয়ার কারণ কী থাকতে পারে?’
‘সুবল ওর স্ত্রীকে শেষ বার একটি পুকুরে স্নানরত অবস্থায় দেখেছিল। সে ঠিক করেছিল দুজনে মিলে একসঙ্গে ওই বনের ধারে সংসার বাঁধবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তাঁর স্ত্রী এখন আর জীবিত নেই। তাই এখন সে একাই ওখানে বাস করতে চায়।’
‘পুকুরে স্নানরত অবস্থায় দেখেছিল…? তাহলে কি?’ কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন মহারাজ। পুরোনো কিছু কথা তাঁর স্মৃতির ঝাঁপিটাকে নাড়া দিয়ে গেল। বহু দিন আগে যখন তিনি ওই অনামিকা নারীকে পুকুরের জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করা থেকে বাঁচিয়েছিলেন, তখন সে-ও বলেছিল যে, তার স্বামী নাকি তাকে ওই পদ্মপুকুরেই স্নানরত অবস্থায় শেষবার দেখেছিল। তাই পুকুরটা তার কাছে খুব প্রিয়। ‘তাহলে কি…তাহলে ওই নারীই ছিল সুবল মহারানার স্ত্রী! কিন্তু তাকে যে কিছুদিন আগেও আমি জগন্নাথ দেবের ঘোষযাত্রায় দেখেছি? কবে মৃত্যু হল তার? কীভাবে? সত্যিই, জীবন বড় অনিত্য! কবে যে কী হয়ে যায় তার নেই ঠিক। যাক, যা হয়ে গিয়েছে তা নিয়ে আক্ষেপ করে কী লাভ? যে চলে গিয়েছে, তাকে ফেরানো সম্ভব নয়। সুবলের ইচ্ছার কথা মেনে নিলে বরং তার আবেগটাকে সম্মান দেওয়া হবে।’
মহারাজ শিবেই সান্তারাকে স্পষ্ট আদেশ দিলেন, ‘সুবল মহারানাকে তার ইচ্ছামতো ভূমির অধিকারপত্র কাল সন্ধ্যার মধ্যেই দিয়ে দেওয়া হোক।’
সুবলকে জানিয়ে দেওয়া হল যে তার প্রার্থনা স্বীকার করেছেন মহারাজ। সুবল ফিরে গিয়ে তার মা’কে বলল, ‘মা, প্রভু জগন্নাথ যা করেন, তার পিছনে অবশ্যই কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য থাকে। তুমি ধবলের বিয়ে দিয়ে দাও। আজ কোণার্কের জন্য সংসার ত্যাগ করে এখানে না-এলে আমার নিজেরই প্রায় দশ বছরের একটি সন্তান থাকত। তাই যে মেয়েটিকে আমার বিয়ের জন্য পছন্দ করেছিলে, সে আমার কন্যাসমা। আমার আর বিয়ে করা ঠিক হবে না। এখন আমি সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছি। তোমার বউমা আমাকে মুক্ত করে দিয়ে গিয়েছে, এবার তুমিও আমাকে মায়ার বাঁধন থেকে মুক্তি দাও।’ নিজের কথা শেষ করে সুবল মাকে প্রণাম করে কোণার্ক মন্দিরের শিখরের দিকে তাকিয়ে দুই হাত জোড়া করে নমস্কার জানাল।
মন্দিরের নবগ্রহ-পাটের সামনে দাঁড়িয়ে একশত এক বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের কণ্ঠে বিভিন্ন গ্রহ এবং সূর্যদেবতার প্রাণপ্রতিষ্ঠার মন্ত্র মন্দিরের প্রস্তর-ভিত্তিতে ধাক্কা খেয়ে গুঞ্জরিত হয়ে ভুবন-ভাস্করের উদ্দেশে যাত্রা করছে—ওম্ আং হৃং ক্রৌং যং রং লং বং শং ষং সং হং সঃ সোৎহম্ প্রাণা ইহ প্রাণাঃ। ওম্ আং হৃং ক্রৌং যং রং লং বং শং ষং সং হং সঃ জীব ইহ জীব স্থিতঃ। ওম্ আং হৃং ক্রৌং যং রং লং বং শং ষং সং হং সঃ সর্বেন্দ্রিয়াণী ইহ সর্বেন্দ্রিয়াণী। বাঙমনস্ত্বক্ চক্ষুঃ শ্রোত্র জিহ্বা ঘ্রাণ বাকপ্রাণ পাদ্-পায়ুপস্থানি ইহৈবাগত্য সুখং চিরং তিষ্ঠন্তু স্বাহা…।
মন্দিরে ঘণ্টা, ঘড়িয়াল, পটহ, তূর্য, মুরুজ, শঙ্খ ইত্যাদি বিবিধ শুভ-বাদ্য সহযোগে বেদপাঠী পণ্ডিতেরা পুরাণোক্ত সূর্যস্তোত্র গাইতে শুরু করতেই শোক-ক্লেশ রহিত সুবলও নিজের শিবিরে দাঁড়িয়ে দুই কর জোড়া করে তাঁদের কণ্ঠস্বরে নিজের কণ্ঠ মেলাতে লাগল—
ওম্ বিকর্তনো বিবস্বাংশ্চ মার্তণ্ডো ভাস্করো রবিঃ।
লোকপ্রকাশকঃ শ্রীমান্ লোকচক্ষুর্গ্রহেশ্বরঃ।।
লোকসাক্ষী ত্রিলোকেশঃ কর্তা হর্তা তমিস্রহা।
তপনতাপনশ্চৈব শুচিঃ সপ্তাশ্ববাহনঃ।।
গভস্তিহস্তো ব্রহ্মা চ সর্বদেবনমস্কৃতঃ।
একবিংশতিরিত্যেষ স্তব ইস্টঃ সদা রবেঃ।।
অর্থাৎ, বিকর্তন, বিবস্বান, মার্তণ্ড, ভাস্কর, রবি, লোকপ্রকাশক, শ্রীমান্, লোকচক্ষু, গ্রহেশ্বর, লোকসাক্ষী, ত্রিলোকেশ, কর্তা, হর্তা, তমিস্রহা, তপন, তাপন, শুচি, সপ্তাশ্ববাহন, গহস্তিহস্ত, ব্রহ্মা তথা সর্বদেবনমস্কৃত, এই একুশটি নাম দিয়ে করা স্তব সূর্যদেবের সদা প্রিয়।
কোণার্ক-মন্দিরের প্রতিষ্ঠা সমারোহের একটি অনুষ্ঠান হিসাবে রাতে মহাভোগ দানের শেষে দেবদাসীদের নৃত্য পরিবেশনও রাখা হয়েছে। সেই উদ্দেশে জগন্নাথ মহাপ্রভুর মন্দির থেকে দেবদাসীদের পদ্মক্ষেত্র কোণার্কে যাওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছিল। চয়ন করা দেবদাসীদের মধ্যে পেখমও একজন। কোণার্ক চলে গেলে তার সখী একাকী কীভাবে থাকবে তা ভেবে পেখম বিনোদিনীকেও নিজের সঙ্গে করে এনেছে।
আসার পথে বিনোদিনীর মন অতীতকে ছুঁয়ে ফেলছিল বার বার, ‘কোণার্কে সেই যেতেই হচ্ছে? এটাই কি তবে জগন্নাথ স্বামীর ইচ্ছা? কিন্তু কী পাব ওখানে গিয়ে? স্বামীর কাছে আমি এখন মৃত। কোণার্ক দর্শনটা হবে? হ্যাঁ, তা অবশ্য হবে। আমার স্বামীর হাতেই গড়ে উঠেছে কোণার্ক-মন্দির। সেটাই নাহয় দেখে আসি। এমনও তো হতেই পারে যে দূর, থেকে আমার স্বামীকেই দেখতে পেয়ে গেলাম? চন্দ্রভাগা তীর্থে স্নান করলে জন্ম জন্মান্তরের পাপ অবশ্য ধুয়ে মুছে যাবে। সবটাই লীলা–পুরুষোত্তমের ইচ্ছা!’
পেখমের সঙ্গে বিনোদিনীও কোণার্কে এসেছে। চন্দ্রভাগা মুক্তিতীর্থে স্নান সেরে সে পুণ্যলাভ করেছে।
ওদিকে ভানু-সপ্তমীর দিনে বেদপুরের বিদ্বান ব্রাহ্মণেরা প্রাণপ্রতিষ্ঠা করার পরদিন সকালে দেবতার নিদ্রাভঙ্গ হতেই প্রথমে বালারুণকে পঞ্চামৃতে স্নান করানো হল। তার পরে হল শুদ্ধোদক স্নান। এবং সব শেষে বাল-ভোগ। অপরাহ্নে বিশ্রামের আগে অবকাশ-ভোগ এবং তার পরে প্রৌঢ়-বিশ্রাম। সন্ধ্যার সময়ে সান্ধ্য-আরতি, লঘুভোগ ও তারপরে সান্ধ্যভোগ। রাত্রে মহৎ-শৃঙ্গারের মাধ্যমে সূর্যদেবকে অষ্ট অলংকারে সজ্জিত করে রাজ-ভোগ। এসব মিটলে দেবতার পূজার অঙ্গ রূপেই দেবদাসীদের নৃত্য এবং সবশেষে শয়ান।
এই সবকিছুই হয়ে চলেছে দর্শনার্থীদের চোখের সামনে। তারা মহা উল্লাসে সমস্ত আয়োজন দেখে চলেছে। কিন্তু বিনোদিনীর চোখ এসব দেখতে আগ্রহী নয়, সে খুঁজে চলেছে একজনের মুখ। সূর্যদেবতা তার কাছে গৌণ, আর মুখ্য হল তার হৃদ্কমলের সূর্য সুবল মহারানা।
যখন তার এবং সুবলের বিয়ে হয়, তখন সে একেবারেই অবোধ বালিকা ছিল। তার পর ওই এক পলকের একটু দেখা। মাঝে কেটে গেছে বারো বছর। আর দেখা হয়নি। কবে হবে সাক্ষাৎ? কীভাবে হবে? সে মনে মনে ভাবে, ‘দেখা হলেও চিনব কীভাবে?’
রাত্রে দেবতার শয়ানের পর সকলেই ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু দুজনের আঁখিপাতে নিঁদ নেই। একজন সুবল মহারানা। এবং দ্বিতীয় ব্যক্তির নাম সৌম্য শ্রীদত্ত। আচার্য সৌম্য শ্রীদত্ত নাট্যমণ্ডপে শিল্পার স্নানরতা মূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত কাতর ভাবে সেই মূর্তিটিকে স্পর্শ করে কেঁদে চলেছেন, ‘তোর সাগর-স্নান কি এখনও শেষ হল না, মা? তুই কি আর সত্যিই ফিরে আসবি না? আমি সাগরদেবতাকে এমন কথা তো বলিনি যে তিনি তোর প্রাণটাই নিয়ে নেবেন? দ্যাখ মা, দ্যাখ…আজ কোণার্ক সম্পূর্ণ হয়েছে। তোর সমর্পণ সার্থক, কিন্তু তুই এসবের কিছুই দেখতে পেলি না। যুগ–যুগ জীয়ে সুবল মহারানা! সুবল তোর এই প্রতিমাখানা বানিয়ে না-রাখলে তোকে আর কোথায় খুঁজে পেতাম আমি? এখন এটাই আমার সম্বল। এটুকুই সান্ত্বনা। আমার বড় ভুল হয়ে গেল রে মা! আমাকে ক্ষমা করে দিস!’
নাট্যমণ্ডপের উত্তরে অম্লান চন্দ্রালোকে একটি ছায়ামূর্তি নিশ্চল ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে রয়েছে সেই প্রতীক্ষারত নারীমূর্তিখানি। নিশ্চল মানুষটা আসলে সুবল মহারানা। সে নিজের হাতে সৃষ্টি করা রচনার মধ্যে নিজের জন্য নতুন কিছু খুঁজে চলেছে। সুবল মহারানার প্রেমের নদীর দুই কূল। এক পাড়ে বিনোদিনী, অন্য তীরে শিল্পা। প্রতিক্ষারত নারী অর্থাৎ বিনোদিনীর মূর্তির কাছে নিজের চোখের জল ফেলে সে হাঁটা দিল নদীর অপর কূলে—শিল্পার স্নানরতা মূর্তির কাছে। আর তখনই আচমকা অম্লান জ্যোৎস্নায় মুখোমুখি হয়ে গেলেন নৃত্যগুরু আচার্য সৌম্য শ্রীদত্ত দীক্ষিত এবং শিল্পী-শিরোমণি সুবল মহারানা।
দুজনে একে অপরকে দেখলেন। দুজনেই বর্তমানে থেকেও ডুব দিলেন নিজের নিজের অতীতে। যেন কোনো কিছুর অনুসন্ধান চলছে। কিন্তু সেই অন্বেষণের অন্ত নেই। আর সকলের মতোই সৌম্য শ্রীদত্তও সুবল মহারানার স্ত্রীর মৃত্যুর সংবাদ পেয়েছেন। হঠাৎই তাঁর মনে হল, স্নানরতা মূর্তির শিল্পা যেমন তাঁর কন্যা, তেমনই প্রতীক্ষারতা মূর্তির বিনোদিনীও তাঁরই মেয়ে। স্নেহের একই স্রোত আছড়ে পড়ছে দুই তটে। কী অদ্ভুত! জীবিত প্রিয়জনের অভাবে আজ পাষাণ প্রতিমাদের বুকে স্পন্দন এবং নিজের হৃদয়ের অবলম্বন খুঁজে বেড়াচ্ছে মানুষ।
সৌম্য শ্রীদত্ত কোনো কথা না-বলেই সুবলকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। জমে হিমখণ্ড হয়ে যাওয়া দুটি হৃদয় একে অন্যের সান্নিধ্যে এসে গলে জল হয়ে গেল। সুবল মহারানা আর সৌম্য শ্রীদত্তর চোখের জলে একাকার হয়ে গেল বিনোদিনী আর শিল্পা—এক পতির হৃদয় আর এক পিতার হৃদয়ে কোনো তফাত রইল না। দুজনে একে অপরকে একটি কথাও বলতে পারলেন না, তাঁদের অশ্রু কথা বলে চলল। আজ শব্দের কোনো প্রয়োজন নেই, অর্থ নেই। নীরবতাই আজ বাঙ্ময়।
কোণার্ক প্রতিষ্ঠার পর দ্বিতীয় দিন। এখনও পূর্ব দিগন্তে সূর্যদেবতার দেখা মেলেনি। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। দেশ-দেশান্তর থেকে আসা যাত্রীরা আরও একবার চন্দ্রভাগার জলে স্নান করে সূর্যমন্দির দর্শন করার জন্য রাতটা কোণার্ক চত্বরেই কাটিয়ে দিয়েছেন। এমন পুণ্যলাভের সৌভাগ্য আবার কবে পাওয়া যাবে কে জানে? বাড়ি ফেরার আগে আর একটি বার দেব বিগ্রহের দর্শন পেতে তাদের মন ব্যাকুল। গতকাল প্রতিষ্ঠার আয়োজনের মহা সমারোহে ভাস্কর্যগুলোকে দেখার মতো সুযোগ হয়নি, আজ সেই সাধ পূরণ হবে। আবার কখনো আসা হয়তো সম্ভবই হবে না।
সুবল মহারানাও ভাবছে, ‘আর শুধু আজকের দিনটা। মহারাজ ভূমির অধিকারপত্র আজই দিয়ে দেবেন। আগামীকাল গিয়ে কেয়াবনের ধারে নিজের মতো করে কুটিরটা বানিয়ে ফেলব। কুটিরেরই বা কী দরকার? একটা বড় মাচার মতো বানিয়ে নিতে পারলেই তো হল। নিজের হাতে খোদাই করে সৃষ্টি করা দেবতার বিগ্রহকে আজ দর্শন করে আসব। কাল পর্যন্ত ওটা ছিল পাথরের মূর্তি মাত্র, কিন্তু এখন তা প্রাণ-প্রতিষ্ঠিত দেবতা। আগামীকাল থেকে কুশভদ্রার তীরে কেতকী-বনের ধারে শুরু হবে আমার নতুন জীবন।’ এসব ভাবতে ভাবতেই সুবল স্নান করার জন্য চন্দ্রভাগার তটের দিকে এগিয়ে চলল।
নদীর তীরে গিয়ে থমকে দাঁড়াল সুবল। চন্দ্রভাগার প্রশস্ত নীল জলরাশি দেখে সে মুগ্ধ হয়ে গেল, ‘এই জলরাশি ঠিক যেন আমার বিনোদিনীর বুকে ফেলা নীল শাড়ির মতোই।’ বারো বছর ধরে তাকে নিজ আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নিজ-অবগাহন করাতে থাকা এই নদীই তার প্রিয়া। সুবলের কানে হঠাৎ গুনগুন করে ভেসে এল কারো মন্ত্রোচ্চারণ, ‘এহি সূর্য সহস্ত্রাংশো তেজোরাশে জগত্পতে। অনুকম্পয় মাং দেব গৃহাণার্ঘ্যং দিবাকর।।’
কেউ একজন সূর্যদেবতাকে অর্ঘ্য দিচ্ছেন। পুরুষের নয়, নারীর কণ্ঠ! কোমর অবধি জলে নিমগ্ন এক ধ্যানস্থ রমণী নিজের পদ্ম-কোরকের মতো অঞ্জলিতে নদীর জল নিয়ে মন্ত্রপাঠ করতে করতে অর্ঘ্য দিয়ে চলেছে ভুবন ভাস্করকে। অপরূপা নারীর কমল-মুখের উপর দুটি চোখ যেন দুই ভ্রমর। মন্ত্রোচ্চারণের ফলে স্পন্দিত হচ্ছে বকফুলের মতো অধরোষ্ঠ। ওই ধ্যানমগ্ন সজীব প্রতিমায় চোখ পড়তেই সুবলের চেতনা এক অদ্ভুত মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। জেগে উঠল তার শিল্পীসত্তা। দৃষ্টি ওই নারীর উপরেই নিবদ্ধ হয়ে গেল, ‘কে এই পদ্মগন্ধা? এই অদ্ভুত সৌম্য, সুন্দরী সন্ন্যাসিনীর রূপ যে ধরা গেল না কোণার্কের পাষাণবক্ষে? মুখে পবিত্রতার এক অদ্ভুত লালিমার স্পর্শ, যার দর্শনে সমস্ত কামনা, বাসনা, লালসা যেন হোমাগ্নিতে পূর্ণাহুতির ফলে ঊর্দ্ধগামী ভস্মের মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
কে এই নারী? একে দেখে কেন জানি না মনে হচ্ছে যে, এর সঙ্গে আমার জন্মজন্মান্তরের বন্ধন রয়েছে। আজ আমার মনে সত্য, শুভ আর সুন্দরের একত্রিত এক বিগ্রহ সজীব হয়ে উঠছে যেন। দেবী, আপনি যে-ই হোন না কেন, এই সুবল মহারানার হৃদয়ের স্পন্দন হয়ে আপনি জীবিত থাকবেন।’
ওই নারী অর্ঘ্যদান পর্ব সমাপ্ত করে চোখ মেলল। জলে ছলছল করুণ দুই নেত্র। সম্ভ্রম, শঙ্কার দোলাচলে কেঁপে উঠল সুবলের মন, ‘এমন বরনারীর কীসের অভাব? সিঁথিতে সিঁদুর বলছে, ইনি সধবা। ঘন, কুঞ্চিত কেশ ঘোষণা করছে যে ইনি অখণ্ড সৌভাগ্যবতী। তাহলে কীসের অভাব? কী সেই কারণ, যার জন্য দুচোখের দৃষ্টিতে অমন অপার শূন্যতা?’
হঠাৎ মেঘের ঘোর কাটিয়ে সূর্যদেবতা উঁকি দিলেন। যেন এ জগতের শ্রেষ্ঠতম নারীরত্নের দর্শন করার লোভ সংবরণ করতে পারেননি ভগবান দিবাকর। সূর্যের আলোতে ওই নারীর শোভা সহস্রগুণ বেড়ে গেল। কিন্তু মাত্র এক মুহূর্তের জন্যই…সূর্যদেব আবার অন্তর্হিত হলেন নীল-শ্যাম মেঘের অন্তরালে। ‘তবে কি এই নারীর দেওয়া জলের অর্ঘ্য স্বীকার করার জন্যই তিনি একটিবার দেখা দিলেন?’ মনে মনে ভাবল সুবল।
ঈশ্বর নারীদের এক অদ্ভুত, অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা দিয়েছেন—যদি কেউ কোনো নারীকে একদৃষ্টে দেখতে থাকে, তাহলে সেই দৃষ্টিকে নারী অনুভব করতে পারে। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। ওই নারী বুঝতে পারল যে কেউ তাকে এক নাগাড়ে দেখে চলেছে। অনুমানে ভিত্তি করেই সেই নারী সেদিকে তাকাল এবং তার দৃষ্টিপথে ধরা দিল এক সুদর্শন পুরুষ, যার নাম সুবল মহারানা। পিতলের মূর্তির মতো প্রাণবন্ত, পুরুষালী, সুন্দর, নিশ্চল। ঘন কুঞ্চিত কেশ, কানে কুণ্ডল, লোমশ বক্ষে দোদুল্যমান রত্নপদক, শিল্পীসুলভ গভীর মর্মস্পর্শী দৃষ্টি। চার চোখ এক হল। নারী বুঝতে পারল, ‘এ কোনো সাধারণ পুরুষ হতেই পারে না! কিছু বিশেষত্ব আছেই।’
ওই নারীর পা যেন আর সরে না। কিছুতেই জল থেকে উঠে তটে আসতে পারে না সে। এক লজ্জা, এক ভয়, এক সঙ্কোচ তাকে মুড়ে ফেলেছে। নিজের চোখ নামিয়ে নিয়ে ওই নারী জলের গভীরতায় নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে চাইল। চোখের সামনে এই দৃশ্য দেখে সুবলের মনে পড়ে গেল বিনোদিনীর লজ্জা পেয়ে পদ্মপুকুরের জলে ডুব দেওয়ার সেই দৃশ্য। ‘একি, এই নারী যে আমাকে দেখে লজ্জা পেয়ে আরও গভীর জলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে! হে ভগবান! ডুবে মরবে নাকি?’ সে নিজের চোখ সরিয়ে নিল। আর তখনই কেউ সুবলকে চিনতে পেরে বলে উঠল, ‘আরে, আপনিই সুবল মহারানা না? উৎকলের শিল্পী-শিরোমণি? ধন্য আপনি, ধন্য আপনার শিল্প!’
এই কথা যখনই ওই নারীর কানে প্রবেশ করল, মনে হল যেন এক বিদ্যুল্লতা তার সমস্ত শরীরটাকে ঝনঝন করে কাঁপিয়ে দিয়ে গেল। সে আবার চোখ তুলল। সুবলের দিকে তাকিয়ে বিনোদিনী মনে মনে ভাবল, ‘তাহলে উনিই? উনিই তো? কত পুণ্য করেছিলাম আমি! নাকি চন্দ্রভাগায় স্নানের পর আমার সব পাপ ধুয়ে গেল? একটি বার দুচোখ ভরে ওঁকে দেখতে চাই। জানি না আর দেখতে পাব কিনা, জানি না আর আমাদের দেখা হবে কিনা?’
ভালো করে সুবলকে দেখবে কি, এমন সময় এক বৃদ্ধা স্নান করার জন্য তীরে এসে পৌঁছাল। আর তাকে দেখেই চমকে উঠল বিনোদিনী। বৃদ্ধা আর কেউ নয়, স্বয়ং সুবল মহারানার মা। বৃদ্ধাও তাকে দেখতে পেল। দেখেই চমকে উঠল। দেখামাত্রই সুবলের মা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘ওরে কুলটা মাগী, আবার আমার ছেলের জীবনে বিষ ঢালতে চলে এসেছিস? দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে…দূর হ আমাদের জীবন থেকে! আমার ছেলের জীবনের সুখের পথে এখন একমাত্র বাধা তুই-ই…। ছিঃ-ই ছিঃ-ছিঃ-ছিঃ-ছিঃ! অলক্ষুণে মেয়েছেলের মরণও হয়নি!’
বৃদ্ধার দৃষ্টিতে থাকা ঘৃণা, স্বরে থাকা ভর্ৎসনা, ভঙ্গিমায় থাকা অসহিষ্ণুতা দেখে বিনোদিনীর সারা দেহ যেন অবশ হয়ে এল। বীভৎস যে দৃষ্টি সে দেখে চলেছিল, তার তুলনায় বৃদ্ধার মুখের ভাষা অনেক শালীন মনে হচ্ছিল। চোখের ভাষায় পরম প্রেম এই জীবনে দেখার সুযোগ বিনোদিনী কখনো পায়নি, কিন্তু নেত্রের ভাষায় চরম ঘৃণা আজ তাঁর দেখা হয়ে গেল।
বিনোদিনী নদীর অপর পারে দূর দিগন্তে দৃষ্টি স্থির করে দাঁড়িয়ে রইল। বিরহী নেত্র থেকে জল গড়িয়ে চন্দ্রভাগার জলে মিশে যেতে লাগল। ওই অশ্রুবিন্দুর তাপে ভয় পেয়েই সম্ভবত সূর্যদেব মেঘের আচ্ছাদনে নিজেকে আরও বেশি করে মুড়ে ফেললেন। বিনোদিনী নদীর মধ্যভাগের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। এগোতেই থাকল। এখন আকাশে শুধু মেঘ আর মেঘ। এত সকালেই চরাচরে আঁধার নেমে এসেছে।
সুবল মহারানা নদীর তীর থেকে ফিরে আসছে বটে, কিন্তু তার চেতনে–অবচেতনে এখনও অনামিকা ওই নারীর রূপ ধরা রয়েছে। বাস্তবে বিনোদিনীর অপার পবিত্র সৌন্দর্যের সামনে সুবল মহারানার শিল্পী মন পরাজিত হয়েছে। নিজের ইচ্ছাটাকে কোনো ভাবেই সংবরণ করতে না-পেরে সে আরও একবার ফিরে তাকাল। কিন্তু বিনোদিনীকে দেখতে পাওয়ার আগেই তার বৃদ্ধা মা হন্তদন্ত হয়ে এসে তার পাশে দাঁড়াল, ‘সুবল রে, তাড়াতাড়ি চল বাবা! আকাশ ঘিরে মেঘ করে এসেছে। মনে হচ্ছে প্রবল জোরে ঝড় আসবে। ঘোর অমঙ্গলের লক্ষণ। আমার কথা শোন, এখুনি আমার সঙ্গে বাড়ি ফিরে চল। কোণার্কে থাকা আমাদের জন্য আর শুভ হবে না।’ আসলে বৃদ্ধা আকাশ দেখে এসব বলেনি, বলছিল বিনোদিনীকে দেখতে পেয়েই। তার মনে ভয় ছিল যদি সুবল আর বিনোদিনীর সাক্ষাৎ হয়ে যায়, তবে মহা বিপদ হবে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে সুবলকে বিনোদিনীর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছিল।
‘মা, কিছু ভাঙলে নতুন কিছু গড়েও ওঠে; আর যখন কিছু গড়ে ওঠে, তখনও কিছু–না–কিছু ভাঙেই। এত বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।’
‘আর যাই ভাঙুক বা গড়ে উঠুক, আমার ছেলের যেন কোনো সমস্যা না-হয়। চল, চল। এখান থেকে চল, এখানে আর এক মুহূর্তও দাঁড়ানো যাবে না।’
‘তুমি যাও, মা। সুবল মহারানা কোণার্ক ছেড়ে যাবে না। এই পাষাণ-শিল্পী এবার পাষাণ-হৃদয় নিয়ে সবকিছু সহ্য করবে।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই কোণার্কের আকাশ চক্রবাত-ঝঞ্ঝায় ভরে উঠল। ঊনপঞ্চাশ বায়ু একযোগে নিজের সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে ঝাউ আর কেতকীর বনকে, নগরের ছোট-বড় ঘরবাড়িকে, ক্ষুদ্র এবং বৃহৎ বৃক্ষকে নাড়া দিতে লাগল। বিনোদিনীর চোখ থেকে ঝরে পড়া অশ্রুকে নিজের সহানুভূতি দেওয়ার জন্য বৃষ্টি প্রবল থেকে প্রচণ্ড হয়ে উঠল। নদীর জলে এক অসহায় নারীকে এভাবে অপমানিত হতে দেখেই মনে হয় বিচলিত ইন্দ্রের বজ্র নিরন্তর অশনিপাত করতে আরম্ভ করে দিল।
সাগরে অসময়ে জোয়ার উঠল, দুকূল ছাপিয়ে যেতে লাগল নদীজল। ধরিত্রী, অম্বর, সাগর, পবন সবাই আজ এক সাক্ষাৎ প্রেমের বিগ্রহস্বরূপ নারী বিনোদিনীর চোখে অপমানের অশ্রু দেখে ব্যথিত, রুষ্ট হয়ে উঠেছে। বিনোদিনী নাম্নী নারী নিজের ইতি খুঁজে নিয়েছে চন্দ্রভাগা নামক নদীর বুকে। নদী নারীকে নিজের মধ্যে সমাহিত করে নিয়েছে। এখন দুজনে মিলেমিশে একাকার।
রুষ্ট প্রকৃতির এই রুদ্র রূপকে শান্ত করার জন্য কোণার্কের মন্দিরে সমবেত স্বরে শান্তিপাঠ শুরু হল—ওম্। গ্রহাঃ শান্তিঃ। অন্তরীক্ষ শান্তিঃ। পৃথিবী শান্তিঃ। আপঃ শান্তিঃ। ওষধেয়ঃ শান্তিঃ। বনস্পতয়ঃ শান্তিঃ। বিশ্বেদেবাঃ শান্তিঃ। কামঃ শান্তিঃ। ক্রোধঃ শান্তিঃ। ব্রহ্মঃ শান্তিঃ। সর্বঃ শান্তিঃ। শান্তিরেব শান্তিঃ। সামঃ শান্তিরেভিঃ। যতো যতসমিহসে ততো নং অভয়ং কুরু। সন্নঃ কুরু প্রজাভ্যোৎভয়ং নঃ পশুভ্যঃ।। ওম্ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।।
একটি পূর্ণ দিনের শেষে যখন শান্তিপাঠ শেষ হল, তখন কোণার্ক নগরী ধ্বস্ত হয়ে গিয়েছে। অনেক বিশালকায় সব ভবন ধরাশায়ী। আকারে ছোট ঘরগুলি তো একেবারে ধুয়ে মুছে গিয়েছে, যেন সেখানে কিছু ছিলই না। পথে, বাগানে, বনে যত্র তত্র সর্বত্র বিশাল বিশাল সব বৃক্ষ সমূলে উৎপাটিত হয়ে পড়ে রয়েছে। নগরে যেদিকেই চোখ যায়, সেদিকেই ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে অগুণতি নর-নারীর মৃতদেহ। এক মূক সত্যদ্রষ্টার মতো অবিচল, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল শুধু কোণার্কের বিশ্ব বিশ্রুত মন্দির।
পরিচয়হীন অনেক যাত্রী, শ্রমিক, গ্রাম-নগরের অনেক নাগরিক যত্র তত্র মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন। নৃসিংহ দেব সকল শবদেহের অন্তিম সংস্কারের ব্যবস্থা করালেন। রাজ কর্মচারীদের পর্যবেক্ষণে বেশ কয়েকটি গণচিতায় স্তূপের আকারে শব রেখে ব্রাহ্মণদের দিয়ে অন্তিম সৎকারের ব্যবস্থা করানো হল। মৃত্যু এখানে জাতি, ধর্ম এবং অর্থের ভেদাভেদকে শেষ করে দিল। মৃতদেহের খোঁজ করে তাদের অন্তিম সংস্কারের এই প্রক্রিয়া পরদিন পর্যন্ত চলল।
সুবলের মা আর ভাই ধবলের কিছু হয়নি। পারিপার্শ্বিক অবস্থা সামান্য স্বাভাবিক হলে সুবল তার মা এবং ভাইকে বুঝিয়ে গ্রামে পাঠিয়ে দিল। সুবল রয়ে গেল কোণার্কেই। তার জীবনে আর কোনো বন্ধন রইল না। কিন্তু বাস্তবেই কি সে বন্ধনমুক্ত হল? কিছু বন্ধন যে কিছুতেই খোলে না।