সূর্য বিনোদিনী – ১১

১১

উৎকলের পাইক বীরেরা নিজেদের বিজয়ী মহারাজকে নিয়ে বিজয়দুন্দুভি বাজাতে–বাজাতে রাজধানীতে ফিরল। আগেও অনেক যুদ্ধ হয়েছে, যুদ্ধজয়ও হয়েছে, কিন্তু এমন বিজয়ের উল্লাস একেবারে অনন্য। রাজ্যে উৎসবের আয়োজন শুরু হয়ে গিয়েছে। নৃসিংহ দেবের জীবনে অবশ্য বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই। তিনি যথাশীঘ্র সম্ভব মন্দির নির্মাণের কাজ দেখাশোনা করার জন্য পৌঁছে গেলেন প্রাঙ্গণে।

বিশু মহারানা এখন মহারাজের রণবেশে সজ্জিত একটি মূর্তি তক্ষণ করতে ব্যস্ত। পাশে দাঁড়িয়ে সুবল মহারানা একটি শিলাখণ্ডকে মনোযোগ দিয়ে দেখেই চলেছে। এই প্রস্তরখণ্ডটিকে কোন মূর্তি নির্মাণের কাজে ব্যবহার করা যাবে, তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে ভালো করে দেখে-বুঝে নেওয়া দরকার। সুবলের ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি বালক। এগারো বছর বয়স তার। নাম ধর্মপদ মহারানা।

ধর্মপদ মহারানা হল বিশু মহারানার একমাত্র পৌত্র। কয়েক দিন আগেই বিশু মহারানার গ্রামে বিসূচিকা রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছিল। মড়ক লেগে যায়। মাত্র কয়েক ঘণ্টার তফাতে বিশু মহারানার পুত্র এবং পুত্রবধূ দুজনেরই মৃত্যু ঘটে। গ্রামে বিশু মহারানার জ্ঞাতিগুষ্ঠির লোকেরা তাদের পারলৌকিক কাজ সারে। নাতি ধর্মপদকে তারা কোণার্কে বিশু মহারানার কাছে পৌঁছে দিয়ে যায়। এই ক’দিনের মধ্যেই সুবল মহারানা আর ধর্মপদের মধ্যে ভারি ভাব হয়ে গিয়েছে। স্নেহের একটা বন্ধন গড়ে উঠেছে দুজনের মধ্যে। দিনের বেশিরভাগ সময়টাই ধর্মপদ সুবলের কাছে কাটায়। সুবলও এমন এক সহচর পেয়ে খুশি, এতটুকু বিরক্তি নেই। সুবল নিজের স্নেহের পাত্র ধর্মপদকে খোদাইকর্মের প্রাথমিক শিক্ষাটুকু দিতে আরম্ভ করেছে। আর এই সবকিছু দেখে বিশু মহারানাও অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছেন। ধর্মপদ যদি সুবলের মতো কাউকে গুরু হিসাবে পায় তাহলে তার চেয়ে ভালো আর কিছু হতেই পারে না।

নিজের মূর্তি গড়তে দেখে মহারাজ নৃসিংহ দেব গম্ভীর স্বরে বিশু মহারানাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘বিশু মহারানা মহাশয়, এই জয় আসলে নিঃশঙ্কের বিজয়। আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন যে যুদ্ধভূমিতে ভয়ানক ভাবে আহত হয়ে আমি মৃত্যুর অপেক্ষা করছিলাম। আমার এই নতুন জীবন আসলে নিঃশঙ্কের অবদান। ও কিন্তু আমার থেকেও অনেক বড় যোদ্ধা। কোণার্কে আমার মূর্তির আগে ওর মূর্তি স্থাপন করা উচিত। নিঃশঙ্ক না-থাকলে আমার এই পুনর্জন্ম সম্ভব হতো না। আর একটা কথা, আমি চাই নিঃশঙ্কর মূর্তির পাশাপাশি এই যুদ্ধে নিহত হাতি ও ঘোড়াদের স্মরণে কোণার্কে গজবন্ধ এবং অশ্ববন্ধ স্থাপিত হোক।’

মহারাজের আদেশ মতো বিশু মহারানা এবার নিজের অধস্তন শিল্পীদের নির্দেশিত করে বিদায় নিলেন। নিঃশঙ্কের মূর্তি নির্মাণের কাজটা বিশু মহারানা মহারাজের ব্যক্তিগত ইচ্ছানুসারে সুবল মহারানাকেই অর্পণ করলেন।

মুখশালার উত্তর দ্বারে সিঁড়ির দুই দিকে নিঃশঙ্কর স্মরণে দুটি বিশালকায় গজ-মূর্তি স্থাপিত হল। যুদ্ধের আভরণে সজ্জিত মূর্তি দুটির পেটের নীচের দিকে খোদাই করে পাথর দিয়ে তৈরি শিকল এমনভাবে বানানো হল, যাদের দেখলে সত্যিকারের লৌহশৃঙ্খল বলে ভ্রম হয়। দুটি হস্তিমূর্তিই নিজের-নিজের শুঁড়ে শত্রুপক্ষের সেনাকে পাকড়ে ধরে আছে। এবং তাদের পায়ের নীচে পিষ্ট হচ্ছে বিপক্ষের অন্যান্য সৈনিক।

নিঃশঙ্কর মূর্তি দেখে মহারাজ মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তাঁর মুখ থেকে অনায়াসে বেরিয়ে এল, ‘নিঃশঙ্ক নিঃসন্দেহে যুদ্ধে এভাবেই বীরের মতো লড়েছিল। কিন্তু সুবল, ওর শিকল তো খুলে দাও! আমার প্রিয় গজরাজ কখনো অবিশ্বস্ত, স্বেচ্ছাচারী হয়নি। শৃঙ্খলার প্রয়োজন পড়েনি। প্রত্যেক যুদ্ধে ও আমার বিশ্বস্ত অনুচর, সহায়ক হিসাবেই কাজ করেছে। ওকে এভাবে লৌহশৃঙ্খলে আবদ্ধ দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।’

‘ক্ষমা করবেন মহারাজ! পাথর দিয়ে তৈরি এই শেকলের খোদাই কিন্তু নিঃশঙ্কর মূর্তির সঙ্গেই করা হয়ে গিয়েছিল। এখন যদি এই শৃঙ্খলকে খোলার বা ভাঙার চেষ্টা করি, তাহলে আপনার প্রিয় গজরাজের মূর্তি একেবারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে।’ নতজানু হয়ে থাকা সুবল মহারানার এই কথাগুলো শুনে মহারাজ নৃসিংহ দেব একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলেন, ‘আরে না না! ক্ষমাপ্রার্থী হওয়ার মতো কিছু হয়নি। তবে থাক, শিল্পী। নিঃশঙ্কর এই মূর্তি দুটো ক্ষতবিক্ষত হলে আমার মনও ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে। তোমার বলার পর আমি আবার ভালো ভাবে দেখলাম। ভাস্কর্যের এই চরম উৎকর্ষতার নিদর্শনের মধ্যে এই শিকলে কোনো সমস্যা নেই। বরং সুন্দর লাগছে।’

ধর্মপদ নিতান্তই বালক। শিষ্টাচারে অনভিজ্ঞ। রাজার সঙ্গে সুবলের কথোপকথন সে কৌতূহল নিয়ে শুনছিল। যখন নৃসিংহ দেব তার উপস্থিতি খেয়াল করলেন, তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘শিল্পী, এই বালকটি কে? এই পাষাণপুরীতে কোথা থেকে এল এইটুকু ছেলেটা? যদি কোনো বিপদ-আপদ ঘটে যায়?’

‘মহারাজ, এই বালক কলিঙ্গের শিল্পকলার ভবিষ্যৎ। এর নাম ধর্মপদ মহারানা। মহান শিল্পী বিশু মহারানার পৌত্র।’

‘কিন্তু এ এখন এখানে কী করছে? এখন ওর লেখাপড়া, খেলাধূলা করার বয়স।’

‘পৈতৃক শিল্পটাকে একেবারে বালক বয়স থেকেই আত্মসাৎ করা হয়, মহারাজ। আর ওর খেলাধূলো করার দিন আর নেই। কয়েকদিন আগেই বিসূচিকা রোগে ওর পিতা-মাতা গত হয়েছেন। গ্রামবাসীরা ওকে এখানে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছে। ও কিন্তু নিজের ঠাকুরদার সঙ্গে থাকার তুলনায় আমার সঙ্গেই দিনের বেশিরভাগ সময়টা কাটায়। মহারাজ, দয়া করে ওকে এখান থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার মতো কোনো আদেশ দেবেন না। আমার এই অনুরোধটুকু রক্ষা করলে আমি আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব।’ সুবল অতি সংক্ষেপে নৃসিংহ দেবকে সম্পূর্ণ বস্তুস্থিতি সম্পর্কে অবগত করিয়ে দিল।

আর নৃসিংহ দেব? তাঁর কী অবস্থা? তাঁর কানে যেন কেউ গরম সীসে ঢেলে দিল! এ কী শুনলেন তিনি? বিশু মহারানার পুত্র আর পুত্রবধূ বিসূচিকা রোগে মারা গিয়েছে? তাঁর পৌত্র ধর্মপদ অনাথ হয়ে গিয়েছে? আর বিশু মহারানা শোক-তাপ রহিত হয়ে আমার মূর্তি খোদাই করে চলেছেন। ধন্য কোণার্ক! ধন্য কোণার্কের প্রত্যেক শিল্পী! কর্তব্যে কেউ বিন্দুমাত্র অবহেলা করছেন না।

নৃসিংহ দেব স্নেহভরে ধর্মপদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, ‘দীর্ঘজীবী হও! উৎকলের শিল্পকলা তোমার হাত ধরে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠুক। আমি মন্ত্রী শিবেই সান্তারাকে বলে দিচ্ছি, আজ থেকে ধর্মপদ মহারানাকেও কোণার্ক-শিল্পীদের সমান পারিশ্রমিক এবং সমস্ত প্রকার সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে।’

কোণার্কে এখন সাতশো বিয়াল্লিশ মণের ঘন কালো বর্ণের শিলায় উৎকীর্ণ নবগ্রহ মূর্তির স্থাপনা করার কাজ চলছে। তিন–তিনবার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু কোনোবারেই পাট-শিলাটিকে তার আধারে সঠিক ভাবে স্থাপন করা সম্ভবপর হয়নি। তৃতীয় বারের প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হওয়ার পর বিশু মহারানা এবং সুবল মহারানার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। এত ভারী পাথরের খণ্ডে উৎকীর্ণ নবগ্রহ-পাটকে বার বার তোলা আর নামানো ভয়ঙ্কর রকমের শ্রমসাধ্য ব্যাপার। আবার একটা চেষ্টা করা হল। কিন্তু সম্ভবত নবগ্রহ শিলায় উৎকীর্ণ সকল গ্রহই বারোশো কোণার্ক-শিল্পীর উপরে অসন্তুষ্ট হয়ে আছে—কোনো লাভ হল না।

ধর্মপদ দূর থেকে পুরো ব্যাপারটা লক্ষ্য করছিল।

অনেক সময়েই খুব কাছ থেকে দেখলে সত্যিটাকে দেখা যায় না, কিন্তু দূর থেকে দেখলে তা স্পষ্ট ধরা পড়ে। যে বিষয়টা বিশু মহারানা আর সুবল মহারানারা কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না, সেটাই দূর থেকে দেখে ধর্মপদ মহারানা ধরে ফেলল। নবগ্রহ-শিলাটিকে তোলার জন্য তৈরি করা উত্তোলক যন্ত্রের কিছু অংশের গঠনের কৌণিক বিন্যাসে সমস্যা হচ্ছিল এবং খুব কাছ থেকে দেখে তা ধরা দুরূহ ছিল।

ধর্মপদ সোজা সুবল মহারানার কাছে চলে এল।

‘ধর্ম, এদিকে কেন এলে? কোনোভাবে চোট লেগে গেলে একেবারে সাংঘাতিক কাণ্ড হয়ে যাবে!’

‘সুবল কাকা, তুমি আমার সঙ্গে এসো। আমি তোমাকে আর ঠাকুরদাকে কিছু দেখাতে চাই।’

‘এখন? কী দেখাবে? এখানেই বলো। আর না-হলে একটু অপেক্ষা করো। দেখছ তো আমরা কত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজে ব্যস্ত!’

‘কাকা, আমার সঙ্গে একটিবার এসো। আমি জানি তোমাদের সমস্যা হচ্ছে। আর আমি যা দেখাতে চাইছি, সেটা দেখলে হয়তো তোমাদের সমস্যার সমাধানও হয়ে যাবে।’

সুবল অবাক হয়ে ধর্মপদের দিকে তাকাল, ‘বলে কী এই বালক? বড়–বড় স্থপতি যেখানে মাথা ঘামিয়ে একটা সমাধান বের করতে পারছে না, সেখানে এই ছেলে পথ খুঁজে বের করেছে? তবে গুণ অবশ্য বয়স দেখে আশ্রয় নেয় না। কী বলতে চাইছে, তা দেখা উচিত। যদি কোনো সফল উপায় নাও বেরোয়, তাহলেও ক্ষতি তো আর বাড়বে না। কিন্তু যদি সত্যিই সফল হওয়া যায়, তাহলে শুধুই লাভ।’

সুবল বিশু মহারানাকে সঙ্গে নিয়ে ধর্মপদের পিছনে হাঁটা দিল। ধর্মপদ আবার সেই স্থানেই ফিরে এল, যেখানে সে কিছুক্ষণ আগে অবধি দাঁড়িয়ে ছিল। সে সুবল আর বিশু মহারানাকে বলল, ‘আমার ঠিক পিছনে তোমরা দাঁড়াও।’ একেবারে সঠিক অবস্থানে তাদের দুজনকে দাঁড় করিয়ে সে নিজের তর্জনী তুলে বিশালকায় উত্তোলকটির উদ্দেশে দেখাল। প্রথম কয়েক মুহূর্ত দুজনেই কিছু বুঝতে পারলেন না, কিন্তু যখন বুঝতে পারলেন যে ধর্মপদ ঠিক কী দেখাতে চাইছে, তখন সুবল আনন্দে তাকে কোলে তুলে নিল।

‘ধর্ম, তোর কত বুদ্ধি রে! আহা, কী আনন্দ! মহারাজের দেওয়া পারিশ্রমিক আর সুযোগ–সুবিধার মর্যাদা রক্ষা করলি তুই,’ বলতে বলতে সুবল তাকে নিয়ে গোল-গোল ঘুরে-ঘুরে নাচতে লাগল।

‘কাকা ছাড়ো! নামাও আমাকে! এভাবে কোলে নিয়ে ঘোরাতে থাকলে নীচে তাকালে আমার মাথা ঘোরে, ভয় করে। নামাও আমাকে।’

‘হাহাহাহা হাহাহাহা হা হা হা হা! আরে ধর্ম, তুই-ই আমার মাথা আজ ঘুরিয়ে ছাড়লি।’ কুম্ভকার ঘুরন্ত চাক থেকে কাঁচা মাটির তৈরি পাত্রকে ঠিক যেমন ভাবে নামিয়ে রাখে, সুবল ধর্মপদকে তার কোল থেকে ঠিক সেভাবেই মাটিতে নামিয়ে রাখল।

উত্তোলক যন্ত্রের নির্দিষ্ট অংশের কৌণিক অবস্থান ঠিক করে ফেলার পর নবগ্রহ-পাটটিকে পুনঃস্থাপনার চেষ্টা করা হল। এবং এবারে তা আধারশিলার উপরে অনায়াসে স্থাপিত হল। প্রত্যেক শিল্পী ধর্মপদের কাছে এসে-এসে তাকে সাধুবাদ জানাল। ধর্মপদ মহারানাকে কোণার্ক-শিল্পীরা ‘ছোট মহারানা’ বলে ডাকতে আরম্ভ করে দিল।

মদ্র দেশের এক মল্লবীর কুকা। তার বিশাল বপু। কুকা ভারতভূমির অনেক মল্লবীরের গর্ব দলিত করে উৎকলে এসে পৌঁছেছে। এখন উৎকলের রাজকীয় মল্লকে মল্লযুদ্ধে পরাস্ত করে নিজের মুকুটে আরেকটি পালক গোঁজাই তার লক্ষ্য। কিন্তু উৎকলের দুই পরম বীর রাজকীয় মল্লদ্বয় বিষ্ণু সান্তারা ও দীনবন্ধু বেহরা শেষ যুদ্ধেই বীরের মতো মৃত্যুবরণ করেছেন। তার পর থেকে এখনও পর্যন্ত কোনো নতুন রাজমল্লের নিযুক্তি হয়নি।

নৃসিংহ দেব কুকাকে বললেন, ‘এই মুহূর্তে উৎকলে কোনো রাজমল্লই নেই। তুমি আমার আমন্ত্রণ স্বীকার করে উৎকলের রাজমল্ল হয়ে যাও।’

কুকা রাজি হল না। সে দিগ্বিজয় অভিযানের নেশায় প্রমত্ত। কুকা স্পষ্ট বলল, ‘আমি কারো বশ্যতা স্বীকার করার জন্য জন্মাইনি। উৎকলের মল্লবিদ্যা লোপ পেয়েছে—আপনি নিজের মুখে একবার এই কথা বলুন, তাহলে এটাকেই আমি আমার জয় বলে ধরে নিয়ে ফিরে যাব।’

কুকার কথা শুনে মহারাজ নৃসিংহ দেব ভয়ানক আহত হলেন। কিন্তু তাঁর কাছে দেওয়ার মতো কোনো উত্তরও নেই। সেনাপতি বিষ্ণুদেব এই মানহানি দেখে আর সহ্য করতে না-পেরে মহারাজকে বিনম্র ভাবেই বললেন, ‘মহারাজ, উৎকলের এ ধরনের অপমান আমরা সহ্য করতে পারব না। মহান মল্লবীর কুকা মহাশয়কে রাজ অতিথির মর্যাদা দিয়ে অতিথিশালায় থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক। এরপর আপনার অনুমতিক্রমে রাজত্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মল্লযোদ্ধাদের আহ্বান করা হবে। যেসব মল্লবীরেরা আসবেন, তাঁদের সঙ্গে কুকার মল্ল প্রতিযোগিতার আয়োজন থাকবে। কুকা জয়লাভ করলে একথা প্রমাণিত হবে যে উৎকলের মল্লবিদ্যা লুপ্ত হয়েছে। আর যদি আগত মল্লযোদ্ধাদের মধ্যে কেউ জিতে যান, তাহলে তাঁকেই উৎকলের রাজমল্ল রূপে আমরা বরণ করে নেব।’

মহারাজ শুনে বললেন, ‘বাহ, উত্তম প্রস্তাব! মহাশয় কুকা, আপনাকে উৎকলের রাজঅতিথির আমন্ত্রণ রক্ষা করার অনুরোধ জানাচ্ছি। আপনার যোগ্য প্রতিস্পর্ধীকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব আমাদের। এতেই উভয় পক্ষের সম্ভ্রম রক্ষা হবে।’

কুড়ি দিন সময় লাগল। মাতৃভূমির গরিমা রক্ষার জন্য অবশেষে দুজন মল্লবীরকে খুঁজে বের করলেন সেনাপতি বিষ্ণুদেব। পুরো রাজ্যেই এই আগামী মল্লযুদ্ধ নিয়ে চর্চা হচ্ছিল। কুকার আতঙ্ক তার প্রসিদ্ধি রূপেই উৎকলে এসে গিয়েছিল। প্রত্যেক রাজ্যবাসী এই প্রতিযোগিতা নিয়ে উৎসুক হয়ে উঠছিল। দিন নির্ধারিত হল।

প্রতিযোগিতার দিনে অপরাহ্নে মল্লযুদ্ধ নিশ্চিত করাই ছিল। কোণার্ক-শিল্পীদের দর্শক হিসেবে আমন্ত্রণ করা হয়েছে। তারা অর্ধদিবসের অবকাশ পেয়েছেন। সুবলও মল্লযুদ্ধ দেখতে এসেছে। ছোটবেলা থেকেই মল্লবিদ্যা ব্যাপারটাকে দারুণ ভাবে রপ্ত করেছে সে। অত্যন্ত প্রিয় বিষয়। সুবলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা দেখতে এসেছে ছোট মহারানা।

বিশাল বর্গক্ষেত্রের মতো ভূভাগ। তার কেন্দ্রে অক্ষবাট বানিয়ে চতুর্দিকে দর্শনার্থীদের বসার জন্য সিঁড়িযুক্ত দর্শকদীর্ঘা তৈরি করা হয়েছে। সেখানে তিল ধারণের জায়গা নেই। কুকা অক্ষবাটে তাল ঠুকতে-ঠুকতে ঘুরছে। সে যে সদ্য ব্যায়াম করে এসেছে, তা তার স্ফীত মাংশপেশি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। শরীরের চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে আসতে চাইছে শিরা-উপশিরাগুলি। উৎকলের দুই মল্লই তাকে দেখে বেশ ভয় পেয়েছে।

প্রতিযোগিতা আরম্ভ হল। কুকা নিজের প্রতিপক্ষের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল, কিন্তু প্রতিপক্ষ কোনো রকম সুযোগ না-দিয়ে ঘুরে গিয়ে দাঁড়াল কুকার ঠিক পিছনে। কুকা কখন যে তাকে নিজের ডান হাত দিয়ে ধরে, বাঁ কাঁধের উপরে টেনে তুলে শূন্যে একটা পাক খাইয়ে মাটিতে চিৎ করে ফেলে দিল তা কেউ বুঝতেই পারল না। ধোপা যেভাবে কাপড়কে আছাড় দেয়, সেভাবে আছাড় মারতে–মারতে কুকা নিজের প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে দিল।

দর্শকেরা নির্বাক হয়ে দেখল, প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বীর বুকে পা-রেখে কুকা নিজের বিজয় ঘোষণা করছে। দর্শকরা বেশ গম্ভীর হয়ে গেল।

দ্বিতীয় প্রতিদ্বন্দ্বী অবশ্য কিছুক্ষণ ধরে কুকাকে প্রতিরোধ করতে সফল হল। কিছুক্ষণ মানে কিছুক্ষণই। পাকা খেলোয়াড় কুকার মারাত্মক প্যাঁচে পড়ে সেও অবশেষে হার মানল। এবার নিজের বিজয়গৌরব প্রদর্শন করার সময়ে কুকা সমস্ত মর্যাদা অতিক্রম করে ফেলল। নিজের ডান হাত দিয়ে ডান জঙ্ঘায় তাল ঠুকে বলল, ‘আছে আর কেউ? আছে কি? আছে কেউ কুকার মোকাবিলা করার মতো…?’

কুকার প্যাঁচপয়জার দেখতে সুবলের এতক্ষণ বেশ ভালোই লাগছিল। কিন্তু তার এই অহংকার সুবলকে ভীষণ আহত করল। এ তো অপমান! সে নরম ভাবেই বলল, ‘কুকা, আপনি মল্লশ্রেষ্ঠ। কিন্তু এমন উন্মাদের মতো আচরণ আর প্রদর্শন কেন করছেন? ক্রীড়ায় আজ আপনি বিজয়ী হয়েছেন, কাল আপনার পরাজয় হতে পারে। এত অহংকার করবেন না। আপনাকে মানাচ্ছে না।’

‘হা হা হা হা…। এটা অহংকার নয়, গর্ব। তুমি বুঝবে না।’

‘আমি সবই বুঝছি। আপনার মল্লবিদ্যাও আমি দেখলাম। আপনি আমার মাতৃভূমির মল্লবীরদের হারিয়েছেন, তবুও আমি আপনার প্রশংসা করছি। কিন্তু আপনার এই আচরণ অত্যন্ত নিন্দনীয়। অশোভনীয়। অহংকারের চূড়ামণি আপনি। আপনার এই অহংকার আমি সহ্য করতে পারব না।’

‘সহ্য করতে পারবে না? তাহলে কী করবে শুনি? আমার সঙ্গে মল্লযুদ্ধ লড়বে? আমাকে হারাবে?’

‘তা আমি বলিনি। কিন্তু একটা কথা জেনে রাখুন, আমার সামনে অহংকার দেখালে সে কোনোভাবেই পার পাবে না।’

কুকা অট্টহাসি দিল, ‘ভাষণ তো ভালোই দাও দেখছি। তোমাকে আমি স্পর্ধা দেখালাম। এসে আমার সঙ্গে লড়ে দেখাও। আমাকে হারাও। নিজে না-পারলে অন্য কাউকে নিয়ে এসো।’

‘স্পর্ধা কীসের? কোনো স্পর্ধা প্রতিস্পর্ধার ব্যাপারই নেই। আপনি শ্রেষ্ঠ। বিজয়ী। শুধু অহংকারটুকু না-দেখালেই হল।’ সুবল মহারানার স্বর এখনও শান্ত, স্বাভাবিক।

‘তুমিই এগিয়ে এসো। এসো…এসো, এসো। আমার হাত ধরো। এসো? এসো না! আসবে না? কী হল?’ এবার কুকা সুবল মহারানাকে উপহাস করতে লাগল।

এবার সুবল আপনি থেকে তুমিতে নেমে এল, ‘শোনো কুকা, অহংকার জগন্নাথ স্বামীর ভোজন। আর তোমার অহংকার তাঁর ভূমিতেই ভঙ্গ হবে। বিধির বিধান।’ সুবলের কণ্ঠস্বর এবার আগের থেকে একটু ভিন্ন মনে হল। শান্ত অথচ দৃঢ়। কোমল অথচ কঠোর। সুবলের গলা শুনে কুকা একটু অবাকই হল। সে সুবলের দিকে ভালো করে দেখল। কোনো কোণ থেকেই সুবলকে দেখে মল্লযোদ্ধা মনে হয় না। সে মনে মনে ভাবল, ‘এর পাঁজরের দু-চারটে হাড় ভেঙে দেওয়া খুব দরকার।’ লাল–লাল চোখ নিয়ে সে ডান হাত বাড়িয়ে সুবলকে মল্লযুদ্ধের জন্য আহ্বান জানাল। দর্শকেরা নিস্তব্ধ ভাবে সবটাই দেখতে লাগল।

মহারাজ নৃসিংহ দেব হস্তক্ষেপ করলেন, ‘না সুবল, তুমি মল্লযোদ্ধা নও। তুমি শিল্পী। মল্ল-শিরোমণি কুকা যখন উৎকলের মল্লবীরদের পরাস্ত করেছেন, তখন তাঁর আনন্দ করার অধিকার আছে বইকি।’

‘ক্ষমা করবেন মহারাজ। আনন্দ করার অধিকার আছে বইকি, কিন্তু অহংকারে অন্ধ হওয়ার অধিকার নেই। পরিণাম যাই হোক না কেন, উৎকল কোনো স্পর্ধার সামনে চুপ থাকতে পারবে না। শক্তিপরীক্ষা হয়ে যাক, দেখেই নিই না উনি কত বড় মল্লবীর! আপনি আদেশ দিন। মা গঙ্গেশ্বরী, আমার বাল্যকালের মল্লগুরু তথা আমার স্বর্গত পিতার নামে শপথ করে বলছি, জয়-পরাজয়ের গুরুত্ব আমার কাছে কিছুই নেই, এবং পিতার মৃত্যুর পর থেকে আমি আখড়া স্পর্শও করিনি, কিন্তু একজন মহান মল্ল হয়েও কুকা আজ যে অহংকার দেখিয়েছে, তা আমাকে আখড়ার মাটিতে নামতে বাধ্য করছে। দয়া করে আজ্ঞা দিন, মহারাজ।’

নৃসিংহ দেব আর কোনো উত্তরই দিতে পারলেন না। একদিকে রাজ্যের সম্মান, অন্যদিকে প্রিয় শিল্পীর জীবনের প্রশ্ন। তিনি মৌন হয়ে গেলেন। আর মৌনং স্বীকৃতি লক্ষণম্ ধরে নিয়ে নিজের পোশাক খুলে ধর্মপদের হাতে দিয়ে সুবল আখড়ার উদ্দেশে এগিয়ে গেল। পরনের ধুতিটাকে সাপটে সে কাছার মতো করে বেঁধে নিল। অক্ষবাটের মাটি স্পর্শ করে প্রথমে সে প্রণাম করল। তারপর গিয়ে দাঁড়াল কুকার সামনে। কুকা এখনও ডান হাত বাড়িয়ে আমন্ত্রণের ভঙ্গিতেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার বিশাল দেহের সামনে সুবল মহারানাকে নিতান্তই এক বালক বলে মনে হচ্ছে। জরাসন্ধের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করার জন্য এক সুকুমার বালক যেন আখড়ায় নেমে এসেছে।

মূর্তি গড়ার সময়ে ছেনিকে ধরার একটা বিশেষ নিয়ম আছে, যাতে হাতুড়ির আঘাতে তা পিছলে না-যায়। এত বছর ধরে পাথর কাটতে–কাটতে খোদাই করতে–করতে এবং লোহার ছেনি হাতে ধরে–ধরে সুবল মহারানার হাতগুলোও পাথরের মতোই কঠোর হয়ে গিয়েছে। যবে থেকে সুবল কোণার্কে এসেছে, তবে থেকে সে একটি দিনও বিশ্রাম নেয়নি। নিয়মিত ছেনি, হাতুড়ি আর পাথরের ঘষা খেতে–খেতে তার হাতের পাঞ্জাটা গোসাপের থাবার মতোই খরখরে, রুক্ষ্ম, কঠিন হয়ে গিয়েছে।

সুবল কুকার ডান হাতের কাছে নিজের ডান হাত বাড়িয়ে দিল। কুকা সুবলকে ধরবে কী, সুবলই কুকার হাত এমনও ভাবে পাকড়ে ধরল যেন সে নিজের হাতে পাথর-কাটার মোটা ছেনি ধরেছে, এখুনি হাতুড়ি দিয়ে সজোরে আঘাত করবে। কুকা নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করল, কিন্তু সফল হল না। তার মনে হল যেন কোনো সাঁড়াশির মুখে হাতটা আটকা পড়েছে। সে অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। তার অসহজ অবস্থার সুযোগে সুবল তার ডান হাতের পাঞ্জাটাকে ধরে উলটে দিল। কুকা সর্ব শক্তি প্রয়োগ করল। অবস্থার সামান্য উন্নতি হল। সুবলের হাত থেকে কুকার পাঞ্জাটা আলগা হয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল। কুকার আঙুলগুলো এখনও সুবলের মুঠোর মধ্যে ধরা আছে। আর একটু এদিক-ওদিক হলেই কুকার হাতটা সুবলের হাতের মুঠো থেকে বেরিয়ে আসবে। তখন পাশার দান উলটো পড়বে, সুবলের জন্য বিপদ বাড়বে।

আপ্রাণ চেষ্টা চালানোর পাশাপাশি কুকা প্রচণ্ড খেপে উঠেছে। ছেনির উপরে হাতুড়ির প্রচণ্ড আঘাত পড়লে যেমন ছেনিটা ঘুরে যায়, তেমন ভাবেই সুবল কুকার আঙুলগুলোকে উলটোদিকে ঘুরিয়ে দিল। তারপর সামান্য একটা হ্যাঁচকা টান দিল সুবল। আঙুলগুলো ভেঙে গেল। কুকাকে ঠেলে মাটিতে ফেলে দিল সুবল মহারানা।

‘কুকা, অহংকারে মত্ত মল্লবীরেরা আমার হাত ধরতে এলে, তাদের পাঁজরগুলো আমি ঠিক এভাবেই ভেঙে দিই। তোমার শুধু আঙুল ক’টা ভাঙলাম। আমি জানি, তুমি স্বপ্নেও কল্পনা করোনি যে উৎকলকে অপমান করার মূল্য তোমাকে এভাবে নিজের মল্লজীবনের সমাপ্তি দিয়ে চোকাতে হবে। আজকের পর থেকে আর কোনো আখড়ার মাটিতে দাঁড়িয়ে, তুমি কোনো মল্লযোদ্ধার সঙ্গে লড়তে পারবে না। সেই ক্ষমতা তুমি হারিয়ে ফেলেছ। উৎকল অন্যের গর্বকে সম্মান করে, আর অহংকারকে…আমি আর কী বলব, নিজেই তো দেখে নিলে আজ।’ সুবলের কণ্ঠস্বরে এখন বনকেশরীর গর্জন শোনা যাচ্ছে।

কুকার এই দুর্দশা দেখে দর্শকদের পাশাপাশি মহারাজ নৃসিংহ দেবও প্রসন্ন হলেন। সবথেকে বেশি আনন্দ পেল ধর্মপদ মহারানা। সে লাফাতে–লাফাতে হাততালি দিতে লাগল।

নৃসিংহ দেব রাজবৈদ্যকে ডেকে কুকার চিকিৎসা করার আদেশ দিলেন। তিনি বললেন, ‘সম্পূর্ণ সুস্থ না-হয়ে ওঠা পর্যন্ত কুকাকে উৎকল-রাজার অতিথিশালায় বাস করার অনুমতি দেওয়া হল।’

দর্শকেরা নিজের নিজের ঘরে ফিরে গেল। সুবল মহারানাও ধর্মপদকে সঙ্গে নিয়ে অন্যান্য শিল্পীদের সঙ্গে ফিরে গেল মন্দির প্রাঙ্গণের শিবিরে। তারা কেউ লক্ষ্য করল না যে একজনের আগুন ঝরানো দৃষ্টি এগারো বছরের ধর্মপদকে প্রায় ভস্ম করে ফেলছে। কুকার দুই চোখ ধর্মপদকে গিলে খাচ্ছিল। তার দুর্দশার সময়ে ধর্মপদ মহারানা আনন্দে লাফাতে-লাফাতে করতালি দিচ্ছিল এই দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠলেই কুকার মনটা গোখরোর বিষের মতো নীল হয়ে যাচ্ছিল।

মাঝে তিনটি সপ্তাহ অতিবাহিত হয়েছে। কুকার ভাঙা আঙুলগুলো এখন প্রায় ঠিকঠাক। শারীরিক ব্যথা-বেদনা প্রশমিত হয়ে গেলেও মনের একটা ব্যথা যে এখনও মেলায়নি। এখনও ধর্মপদের করতালির শব্দ কুকার কানে বাজছে। আজকাল মল্লবীর কুকা কোণার্ক মন্দিরের ভাস্কর্য দেখার অছিলায় প্রতিদিন গিয়ে ধর্মপদের সঙ্গে দেখা করে। সুবল প্রথম দিকে ব্যাপারটা জানত না। যখন জানল, তখন ধর্মপদকে সাবধান করে বলল, ‘ধর্ম, আহত ষাঁড়ের আশেপাশে ঘোরাফেরা করা কিন্তু বুদ্ধিমানের পরিচয় নয়। কুকার থেকে তোর দূরে থাকাই ভালো।’

ধর্মপদের বালক-বুদ্ধি। সোজা সরল মনোভাব। জগতের ষড়রিপু কিংবা নীতি-নিয়ম সম্পর্কে সে অনভিজ্ঞ। কুকা ক্রমশ তার কৃত্রিম স্নেহপাশে ধর্মপদকে আবদ্ধ করে ফেলছিল। একদিন সে ধর্মপদকে বলল, ‘কতবার কোণার্ক-মন্দিরটাকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করি, কিন্তু অসুবিধা হয়। দিনেরবেলায় এত শিল্পী এখানে কাজ করে, ঠকাঠক শব্দ। বড় কোলাহল। ধর্মপদ, আজ রাতে আমি মন্দির প্রাঙ্গণটাকে ভালো ভাবে ঘুরে দেখতে চাই, তুমি আমাকে ঘুরিয়ে দেখাবে?’

‘কেন দেখাব না? নিশ্চয়ই দেখাব।’ কুকার এক কথাতেই ধর্মপদ রাজি হয়ে গেল।

রাত্রি দুই প্রহর অতিক্রান্ত। সুবল মহারানা ভাবছে যে ধর্মপদ এখন বিশু মহারানার শিবিরে ঘুমোচ্ছে, আর বিশু মহারানা ভাবছেন যে তাঁর নাতি এখন সুবল মহারানার শিবিরে গল্প করছে। আর ধর্মপদ? সে এখন নির্মীয়মাণ কোণার্ক-মন্দিরের জগমোহনে কুকার জন্য অপেক্ষা করছে।

কুকা কাছেই লুকিয়ে বসে আছে। সে অনুকূল সময়ের অপেক্ষ করছে। সুবল মহারানার শিবির ব্যতিরেকে অন্যান্য সব শিবিরেরই প্রদীপ নিভে গিয়েছে এখন। নিঃশঙ্কর মূর্তির পিছন থেকে কুকা আস্তে আস্তে বেরিয়ে এল। সে ধর্মপদের কাঁধে এসে হাত রাখল। বালকসুলভ হাসি খেলে গেল ধর্মপদের মুখে। এবার ধর্মপদ আর কুকা দুজনে মিলে এক-একটা মূর্তির সামনে গিয়ে গিয়ে কোণার্কের সৌন্দর্য দেখতে আরম্ভ করল। দুজনেই দেখতে লাগল বটে, কিন্তু কুকার মনোযোগ কোণার্কের ভাস্কর্যের দিকে নেই।

অরুণ স্তম্ভের কাছে পৌঁছে কুকা একবার চারিদিকে তাকিয়ে দেখে নিল। চরাচর নিস্তব্ধ। শুধু সুবল মহারানার শিবির থেকে পাথরের বুকে ছেনি ঠোকার শব্দ ভেসে আসছে—ছন্ন্…ছন্ন্…ছন্ন্…।

ধর্মপদ অরুণ স্তম্ভ সম্পর্কে সুবল মহারানার কাছে যা যা শুনেছিল, সেই সব কথা কুকাকে নাগাড়ে বলে চলেছে। কিন্তু সেসবে কুকার মন নেই। আচমকাই সে নিজের বাঁ-হাত দিয়ে ধর্মপদের একটা পা ধরে নিজের ডান হাতে ধর্মকে কষে পাকড়ে নিজের মাথার উপরে তুলে নিল। ধর্মপদ এতটাই হকচকিয়ে গেছে যে কী ঘটছে বুঝে উঠতে পারছে না। এবার কুকা পাশেরই একটা পাথরে ধর্মকে এমন সজোরে আছাড় মারল যে এক আঘাতেই তার মাথাটা ফেটে চৌচির হয়ে গেল। চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল মাথার ঘিলু, রক্ত। মুহূর্তের মধ্যে নিথর হয়ে গেল ছোট মহারানার দেহ। কোণার্ক নির্মাণে অমূল্য যোগদানকারী, সকলের প্রিয় ধর্মপদ মহারানার জীবনাবসান হল। অহংকার আর অসূয়াতে ভরা কুকা এক নিরীহ বালকের প্রাণ কেড়ে নিল।

কুকা সেই রাতেই উৎকল ছেড়ে পালিয়ে গেল।

পরদিন পৌত্রের শবদেহ দেখে বিশু মহারানা শোকে মূর্ছিত হয়ে পড়লেন।

চন্দ্রভাগার তটে ধর্মপদের চিতা সাজানো হয়েছে, কিন্তু বিশু মহারানা কিছুতেই ধর্মর মুখাগ্নি করতে রাজি হচ্ছেন না। নৃসিংহ দেব এবার বললেন, ‘পৌত্রর মুখাগ্নি করুন, বিশু মহারানা। যা হওয়ার, তাকে কে আটকাবে? এখন নিজের ধর্ম পালন করুন। কোণার্কের সর্বকনিষ্ঠ তথা মহান শিল্পীর অন্তিম সংস্কার যে করতেই হবে।’

‘কীভাবে এই কাজ করব মহারাজ? ওই ছেলের মুখে একসময় দুধ তুলে দিয়েছি, আর আপনি আজ বলছেন ওই মুখেই আগুন দিতে?’

এবারে রাজা নৃসিংহ দেব সুবলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শিল্পী, তাহলে তুমিই এই কাজ সম্পন্ন করো।’

‘আমাকে এই অনুরোধ করবেন না। আমার কর্তব্য যে আরও বড়…’ সুবলের স্বর এতটুকু কাঁপল না, কিন্তু অশ্রু ঠিকরে বেরিয়ে এল তার চোখ থেকে।

‘আরও বড় কর্তব্য? কী বলছ তুমি?’

‘মুখাগ্নি করলে আমার অশৌচ আরম্ভ হবে। তারপর ষোলো দিনের জন্য কোণার্কের ভাস্কর্যে ত্যাজ্য হয়ে যাব। ছেনি অবধি স্পর্শ করতে পারব না। আমাকে মুখাগ্নি করতে বলবেন না। আমি পারব না! আমি পারব না!’ প্রত্যাখ্যান নয় বেদনাই তার কথার গোপন কারণ।

‘আমি ধর্মপদের মুখাগ্নি করব!’

এই কণ্ঠস্বর শুনে সকলে চমকে তাকাল। ‘আমি রক্তের সম্পর্কে ধর্মপদ মহারানার কেউ নই, কিন্তু ব্রাহ্মণ হওয়ার কারণে এই অধিকার আমার আছে। আমিই ওকে মুখাগ্নি দেব! ওর সকল পারলৌকিক ক্রিয়ার সমস্ত দায়দায়িত্বও আমিই নিলাম।’ বক্তা আর কেউ নন স্বয়ং আচার্য সৌম্য শ্রীদত্ত দীক্ষিত মহাশয়। নিজের কন্যা শিল্পার অন্তিম সংস্কার, শ্রাদ্ধাদি করতে না-পারা শ্রীদত্ত ধর্মপদের শব সৎকার করার মধ্যে দিয়ে মনের সান্ত্বনা খুঁজে চলেছেন।

লেলিহান চিতার অগ্নিরথে শায়িত ধর্মপদ ইহলোক ত্যাগ করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *