১০
নিয়তি যেমন নিজের ছন্দে চলে, সেভাবেই চলছিল। মনে বিঁধে থাকা কাঁটা কাকে, কখন, কোথায় এবং কতখানি ব্যথা দেয় তার আভাস অন্য কেউ পায় না। কারও থাকায় বা না-থাকায়, কারও চলে যাওয়ায় বা থেকে যাওয়ায় জাগতিক প্রপঞ্চে কোনো বাধা পড়ে না।
দিনে–প্রতিদিনে কোণার্ক সম্পূর্ণ হওয়ার পথে এক পা–এক পা করে এগিয়ে চলেছিল। ওদিকে বাইরে থেকে আপাত শান্ত সমাহিত সাগরের ভিতরে হিল্লোল জাগছিল। ইখতিয়ার বেগ আবার উৎকল আক্রমণ করে বসল এবং এবারে রাজা নৃসিংহ দেব ইখতিয়ার বেগ নামক কাঁটাগুল্মটিকে সমূলে উৎপাটন করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
সেনাপতি তুলসী, সেনাপতি রাজগোবিন্দ, সেনাপতি সুরু এবং সেনাপতি বিষ্ণুদেবকে সঙ্গে নিয়ে প্রধান সেনাপতি রূপে স্বয়ং রাজা নৃসিংহ দেব উৎকল-বীরদের বাহিনী সহ রণক্ষেত্রে যবন সৈন্যদের কালান্তক রূপে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। প্রলয় আরম্ভ হল।
ইখতিয়ার বেগ কোনোভাবে আজকের দিনটা উতরে হওয়ার অপেক্ষা করছেন, আর নৃসিংহ দেব ভাবছেন আজকেই এই যুদ্ধ শেষ করে দেবেন, ‘আর একটা সাংঘাতিক আঘাত দিলেই ইখতিয়ার বেগ যুদ্ধে টিকতে পারবে না।’
নিজের প্রিয় হস্তী নিঃশঙ্ক’র পিঠে চেপে মহারাজ নিজেই যুদ্ধ সঞ্চালনা করছেন। প্রতিপক্ষও কম যায় না। আজকের ভীষণ সংগ্রামে নিঃশঙ্ক’র পিঠের হাওদাখানা ভেঙে তছনছ হয়ে গিয়েছে।
সূর্য অস্ত যাচ্ছে, সন্ধ্যা নামবে। নৃসিংহ দেব তখন ভীষণ যুদ্ধে ব্যস্ত, এমন অবস্থায় হাওদা বদলানো অসম্ভব। ওদিকে ভাঙা হাওদার মধ্যে থেকে অস্ত্রচালনা করতেও সমস্যা দেখা দিচ্ছে। পক্ষ-বিপক্ষ সকলেই ভাবছে এখন হয়তো রাজা রক্ষণাত্মক ভাবে লড়াই চালিয়ে যাবেন। কিন্তু সকলের সমস্ত ভাবনায় জল ঢেলে মহারাজ নিজের দলের সমস্ত সুরক্ষিত সৈন্যদের যুদ্ধে নামিয়ে দিলেন। ‘জগন্নাথ স্বামীর জয়!’ বলে শত শত পাইক বীর শত্রুদলের সেনার উপরে সমুদ্রের উন্মত্ত ঢেউয়ের মতোই আছড়ে পড়ল। ইখতিয়ার বেগ এমন অবস্থার কথা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি।
এক যবন সেনাপতি নিজের ঘোড়ার পিঠে চড়ে নৃসিংহ দেবের হাতির সামনে এসে দাঁড়াল। নৃসিংহ দেব যতক্ষণে নিজের ভল্ল নিয়ে তাকে তাক করে ছুড়ে মারবেন, ততক্ষণে নিঃশঙ্ক নিজের শুঁড় দিয়ে যবন সেনাপতির গলা ধরে তাকে শূন্যে ছুড়ে দিল। পূর্বানুমান মতো অভীষ্ট লক্ষ্যের উদ্দেশে ততক্ষণে ছুটে গিয়েছে নৃসিংহ দেবের হাতের বল্লম। অস্ত্র গিয়ে আঘাত করল যবন সেনাপতির ঘোড়াকে। আহত ঘোড়া লাফিয়ে উঠে নিজের সামনের দুই পা-দিয়ে নিঃশঙ্কের মাথায় প্রচণ্ড জোরে আঘাত করে বসল। হাতি কেঁপে উঠল। মহারাজের ভারসাম্য বিঘ্নিত হল এর ফলে। হস্তীপাল মাটিতে পড়ে গেল। হাওদা না-থাকায় নৃসিংহ দেবও নিজেকে সামলাতে পারলেন না। তিনি মাটিতে পড়ে সঙ্গে সঙ্গেই জ্ঞান হারালেন।
মহারাজকে পড়ে যেতে দেখেই নিঃশঙ্ক তাঁকে নিজের চার পায়ের আড়ালে সুরক্ষিত করে ফেলল। উৎকলের চার সেনাপতির সঙ্গে তাঁদের প্রধান সেনাপতির সমস্ত সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। বন্ধ হয়ে গেল নির্দেশ পাওয়া। অবস্থা ভালো নয় দেখে সেনাপতি রাজগোবিন্দ যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য সঙ্কেত দিতে বললেন। বেজে উঠল তূর্য।
কেউ রাজাকে খুঁজেই পাচ্ছে না। নিঃশঙ্ককে চেনাও এখন দুষ্কর। কারণ তার গা থেকে রাজকীয় বেশ খুলে গিয়েছে যুদ্ধের আঘাতে। হাওদা অবশিষ্ট নেই। উড়ে গিয়েছে রাজকীয় পতাকা। উৎকলের ভাগ্যাকাশকে ঢেকে দিল দুর্ভাগ্যের মেঘ। বিশেষ দূত রাজধানীতে সংবাদ নিয়ে গেল, ‘শত্রু-বিমর্দক মহারাজ নৃসিংহ দেব যুদ্ধে বীরের মৃত্যু বরণ করেছেন। তাঁর শব এখনও মেলেনি। সন্ধান চলছে। নিঃশঙ্ককেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’
রাজশোক পালনের উদ্দেশে উৎকলের রাজকীয় ধ্বজা নামিয়ে দেওয়া হল। রাজপ্রাসাদে এই নিদারুণ সংবাদ পৌঁছানো মাত্রই সীতাদেবী মূর্ছিত হয়ে পড়লেন। চন্দ্রাদেবী বিষাদে পাষাণ হয়ে গেলেন। কোণার্ক-শিল্পীদের ছেনি আর হাতুড়ির শব্দ থেমে গেল। প্রজারা অবসন্ন। মন্ত্রী শিব সামন্তরায় হতপ্রভ, ‘এবার উৎকলের কী হবে? কোণার্কের কী হবে? উৎকল পরাধীন হয়ে যাবে! যুবরাজ কুমার ভানুদেব এখনও নিতান্তই বালক, যবন শত্রুর সম্মুখীন হতে পারা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। রাজপরিবারের গরিমার কী হবে? তবুও রাজার অন্ত্যেষ্টির আগে যুবরাজের রাজ্যাভিষেক করাই বাঞ্ছনীয়। উৎকলের সিংহাসন শূন্য থাকতে পারে না। সীতাদেবীর অভিভাবকত্বে এবং কুশল মন্ত্রীদের সহযোগিতায় শাসনকাজ সামলাবেন ভানুদেব। যবনদের প্রতিরোধ করতে না-পারলে ওই বর্বরের দল উৎকলের বুকে মরণ-নাচন শুরু করবে, পাপ নাচবে আমাদের অঙ্গনে। সূর্যমন্দিরের প্রতিষ্ঠা হবে না। কোণার্কের শিল্পকলা ধুলোয় মিশে যাবে।’
বিশু মহারানা ভাবছিলেন, ‘তাহলে কি সুবলের ভবিষ্যৎবাণীই সত্য হতে চলেছে? বাস্তুদোষের জন্যই কি এই প্রতিকূল অবস্থার মুখে পড়তে চলেছে কোণার্ক তথা সমগ্র উৎকলের ভবিষ্যৎ? কোণার্ক কি আর সম্পূর্ণ হবে না?’
সুবল সব শুনেও নির্লিপ্ত। তার মনে এখন বিশু মহারানার বলা কথাগুলো ভেসে উঠছে, ‘তুমি কেবল কর্ম করার অধিকারী। ফল তোমার হাতে নেই। ফলের আশায় আসক্ত হয়ো না। নিরন্তর কর্মরত থাকো। শুধুই কর্ম করো।’ তার হাতের ছেনি একবার কেঁপে উঠল। কিন্তু ওই একবারই। আর নয়। মন স্থির করে সে আবার নিজের কাজে লেগে পড়ল, ‘মহারাজ দেশের জন্য নিজের প্রাণ দিয়েছেন। তাঁর আশা পরিপূর্ণ না-হওয়া পর্যন্ত সুবল মহারানার হাত কাজ থামাবে না। ইখতিয়ার বেগ আমার হাত কেটে নেবে? নিক! প্রাণে মেরে ফেলবে? মেরে দিক! কিন্তু কোণার্কের কাজ আমি থামাব না। মন্দিরের চূড়া স্থাপিত হবে না? না-ই হোক! অনেক দেবতাই চূড়াবিহীন মন্দিরে বিরাজ করেন। এই তো স্বয়ং মা গঙ্গেশ্বরী দেবীর মন্দিরেরই শিখর নেই। উৎকলের আকাশ থেকে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার আগে কোণার্কের রত্নবেদীতে সূর্যদেবকে প্রতিষ্ঠা করবই করব। মহারাজ নৃসিংহ দেবের আত্মার শান্তির জন্য সূর্যদেবতার বিগ্রহ শীঘ্রাতিশীঘ্র প্রতিষ্ঠা করা অনিবার্য। সুবল মহারানার থামা মানা। সে থামবে না। তার হাতের ছেনি বিরতি দেবে না। শোকে জড়বৎ হয়ে যাওয়া কোনো শিল্পীর ধর্ম নয়। জিতেন্দ্রিয় হয়ে ওঠার অর্থ শুধু বাসনাকে অর্গলবদ্ধ করা নয়। লোভ, ক্রোধ, মোহ, শোক, মদ, মাৎসর্য এদের কোনোটারই এই জিতেন্দ্রিয় পীঠে কোনো স্থান নেই।’
এক-এক করে সব শিল্পীরা সুবলের কাছে এল। প্রত্যেকে দেখে গেল সুবলের হাত চলছে। ছেনি কথা বলছে পাথরের সঙ্গে। সুবল মুখ তুলে তাকিয়ে তাদের দেখল। বিশু মহারানা অনর্গল কেঁদে চলেছেন। কাঁদছে প্রত্যেক শিল্পীই। নিঃশব্দে। সুবল চোখ নামিয়ে নিল। মুখ ফিরিয়ে নিল কাজের দিকে। রাতের নৈঃশব্দ্যে সুবলের ছেনি পাথরের বুকে নয়, প্রত্যেক কোণার্ক-শিল্পীর হৃদয়ে অনুপম ভাস্কর্য খোদাই করে চলল।
নিঃশঙ্ক একটি বিশালকায় রণহস্তী। অগুণতি যুদ্ধে সে নৃসিংহ দেবের সঙ্গী থেকেছে। তাকে কোনো কথা বোঝানোর জন্য নৃসিংহ দেবকে সঙ্কেত দিতে হয় না, মহারাজের মনের কথাই সে বুঝতে পারে। নিজের শুঁড় প্রভুর দেহে বুলিয়ে বুলিয়ে সে এতক্ষণে বুঝে ফেলেছে যে আঘাত সাংঘাতিক। হয়তো রাজা আর জীবিত নেই। তার ছোট ছোট চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে লাগল। নিজের প্রভুকে যুদ্ধভূমিতে ছেড়ে সে পালিয়ে আসতে পারে না। সে অপেক্ষা করছে। কেউ তো আসবে রাজার শব নিতে।
অসংখ্য তারায় ভরে উঠেছে আকাশ। উৎকলের পুণ্যাত্মাদের আত্মারা অনন্তের বুকে নক্ষত্র হয়ে জ্বলজ্বল করছে। এমন সময় আকাশ মেঘে ঢেকে গেল। বৃষ্টি আরম্ভ হল আচমকাই। অসময়ের এই বর্ষণ কি তবে নৃসিংহ দেবের বলিদানে আকাশের করুণ অভিষেক কিংবা মূক রোদন? নৃসিংহ দেবের রক্তাক্ত শরীর রণভূমিতে, ধরিত্রীর উদার আলিঙ্গনে নিশ্চল হয়ে পড়ে রয়েছে। অগুনতি বীর মাতৃভূমির হিতার্থে নিজেদের প্রাণের বলিদান দিয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত। মৃত্যুর শীতল ঔদার্যে শত্রু, মিত্র দুপক্ষের রক্তই মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে।
এই অন্ধকারে এখন আর কে আসবে? কী করবে নিঃশঙ্ক? অনবরত কেঁদে চলেছে অবলা জীবটা। সে ভাবছে, রাজার শবদেহটাকে যুদ্ধভূমির বাইরে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু কীভাবে? দেহটাকে শুঁড়ে ধরে তুলে নিয়ে যদি নিজের পিঠের উপরে রাখে, তাহলেও চলাফেরার ছন্দে তা মাটিতে পড়ে যাবে। কী করবে এবার নিঃশঙ্ক? আশেপাশে পড়ে থাকা অন্যান্য সৈনিকদের শবদেহগুলোকে শুঁড়ে করে সরিয়ে সরিয়ে নিঃশঙ্ক কিছুটা জায়গা বের করল। তারপর নিজে একটা দিকে সরে গিয়ে শুঁড়ে করে রাজার দেহের উপর মোলায়েম পরশ দিল সে। বৃষ্টি ঝরে চলেছে।
স্নেহস্পর্শ আর জলের ধারায় চেতনা ফিরে এল রাজার দেহে। তিনি সামান্য কেঁপে উঠলেন। আস্তে আস্তে লুপ্ত জ্ঞান ফিরে পাচ্ছেন রাজা। তাঁর মনে হচ্ছে—যেন কোনো বালক তাঁর গায়ে হাত বুলিয়ে চলেছে। চোখ মেলে তাকালেন তিনি। তার অনুমান সত্যি। মনে হল পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে আরও এক জন। সে এক গৌরাঙ্গ কিশোর। তারা দুজনে মিলে ধরে তাঁকে ওঠানোর চেষ্টা করছে। তবে কি জগন্নাথ স্বামী নিজে তাঁর ভ্রাতা বলরামকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধভূমিতে এসেছেন? আর কীসের চিন্তা? স্বয়ং জগন্নাথ মহাপ্রভু নিজের ভাইকে নিয়ে নৃসিংহ দেবকে নিয়ে যেতে এসেছেন।
নিঃশঙ্কও দেখল—এক বালক আর একটি কিশোর। সে বুঝতে পারল যে, তারা দুজনে রাজার কোনো অনিষ্ট করবে না। অবশ্য এখন আর রাজার কোন ভয়টাই বাকি আছে? বালক নিঃশঙ্কর গা চাপড়ে আদর করতেই সে সামনের দুই পা ভাঁজ করে মাটিতে উবু হয়ে বসল। হাতির শুঁড় ধরে বালক উঠে গিয়ে বসল তার পিঠের উপর। এরপর হাতিটা উঠে দাঁড়াল। মন্ত্রাবিষ্টের মতো সে অত্যন্ত সাবধানে রাজাকে পিঠের উপরে তুলে নিল। বালক নৃসিংহ দেবকে ধরে রাখল। নীচে দাঁড়িয়ে থাকা কিশোরটি হাঁটা দিল। তাকে লক্ষ্য করে এগোতে শুরু করল নিঃশঙ্ক।
কিছুটা পথ এভাবে চলার পরে কিশোরের কোমর শুঁড়ে করে জড়িয়ে ধরে তাঁকে নিজের মাথায় বসাল নিঃশঙ্ক। নিঃশঙ্কর পিঠে এই প্রথমবার নৃসিংহ দেব এবং তার হস্তীপাল ছাড়া অন্য কেউ বসেছে। অবশ্য তা নিয়ে গজরাজের কোনো আপত্তি নেই। নৃসিংহ দেব এখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। এত নিবিড় ঘুম তিনি বহু বছর পরে ঘুমোলেন।
নৃসিংহ দেবের ঘুম ভেঙেছে। সামান্য নড়াচড়া করতেই তিনি অনুভব করলেন—সাগরতটের বালুকারাশির উপরে শুয়ে আছেন তিনি। দৃষ্টি স্বচ্ছ হতে মাথা তুলে এদিক ওদিকে দেখতেই নজরে পড়ল একটি পর্ণকুটির। প্রদীপের ক্ষীণ আলো দেখা যাচ্ছে।
‘আমি এখন কোথায় আছি? যুদ্ধস্থল থেকে কত দূরে?’ মনে মনে ভাবলেন মহারাজ। খিদেও পেয়েছে। তীব্র খিদে! পাশেই বসে রয়েছে তাঁর প্রিয় গজরাজ। ‘আহা রে, নিঃশঙ্করও হয়তো খুব খিদে পেয়েছে,’ প্রিয় হাতিটার কথা ভাবতেই ব্যথায় মুচড়ে উঠল মহারাজের বুক। তিনি আরেকবার পাতার কুটিরের দিকে তাকালেন, ‘কে থাকে ওখানে? সে কি কোনো ভাবে আমাকে সাহায্য করতে পারবে?’
দুই হাতে ভর দিয়ে কোনো ক্রমে উঠে দাঁড়ালেন নৃসিংহ দেব। পর্ণকুটিরের দ্বারে পৌঁছে দেখলেন, বায়ুর বেগে যাতে প্রদীপখানা নিভে না-যায়, তার জন্য একটু আড়াল করে সেটাকে বসানো হয়েছে। কিন্তু টিমটিম করে জ্বলতে থাকা ওই প্রদীপশিখার আলোতেই আলোকিত হয়ে উঠেছে কুটিরের ভিতর ও বাহির।
‘কেউ আছেন?’ নৃসিংহ দেব যেন দশ দিকের উদ্দেশে এই প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন।
ঘোমটায় মাথা ঢাকা এক নারী পর্ণকুটিরের দ্বারে এসে দাঁড়াল, ‘আপনি কে? কী চাই আপনার?’
‘আমি একজন আহত সৈনিক। আমাদের উৎকলের বাহিনী যবন সেনার বিরুদ্ধে লড়াই করছিল। সেখানেই আমি ভীষণ আহত হই, কোনোক্রমে নিজের প্রাণটুকু রক্ষা করতে পেরে যুদ্ধভূমি থেকে ফিরেছি। ক্ষুধায় তৃষ্ণায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। কিছু খেতে না-পেলে আমাদের দুজনেরই প্রাণ যাবে,’ কথার মধ্যেই হাত তুলে নিঃশঙ্ককে দেখালেন তিনি, ‘কোনো ব্যবস্থা করা কি সম্ভব?’
‘আপনি যুদ্ধ ছেড়ে পালিয়ে এসেছেন? আমাদের মহারাজ নৃসিংহ দেব যুদ্ধভূমিতে বীরের মতো মৃত্যুবরণ করেছেন, আর আপনি প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে এসেছেন? উৎকলের কোনো সৈনিক এইভাবে যুদ্ধের আঙিনা থেকে পালিয়ে আসে না। আমি জানি না, মহারাজ জীবিত থাকলে আপনাকে ক্ষমা করতেন কিনা, তবে আমি আপনাকে ক্ষমা করতে পারলাম না।’
‘যদি রণভূমিতে আমার মৃত্যু ঘটত, তাহলে আমার থেকে সুখী কেউ হতো না, দেবী। যুদ্ধ করতে করতে আহত হয়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। ওই যে হাতিটাকে দেখছেন, ও মহারাজের প্রিয় হাতি—নিঃশঙ্ক। ও-ই আমাকে তুলে এখানে নিয়ে এসেছে। আমি সজ্ঞানে যুদ্ধ ছেড়ে পালিয়ে আসিনি। তবে আপনাকে কথা দিচ্ছি, যদি আজ প্রাণরক্ষা করতে পারি, তবে উৎকলের রণভূমিতে যবনের দল আমার তাণ্ডব দেখবে। যবন সৈন্যরা এখন মহারাজের মৃত্যুর আনন্দে উৎসব পালন করছে নিশ্চয়ই। তাদের এই আনন্দই শেষ আনন্দ হবে—আমি আপনাকে কথা দিলাম। কিন্তু তার জন্য আগে কাল সুস্থ অবস্থায় আমার যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হওয়া প্রয়োজন। আমাকে এবং রাজহস্তী নিঃশঙ্ককে জীবিত থাকতেই হবে। আপনি নিজে কোনো ভাবে আমাদের সাহায্য করতে পারলে করুন দেবী। নাহলে উপায় বলুন। আমরা চেষ্টা করব। আমাদের সাহায্য করলে সমগ্র উৎকল আপনার কাছে চিরঋণী থাকবে।’
‘ক্ষমা চাইছি। অজ্ঞাতে কটুকথা বলে ফেললাম। আসলে মহারাজের মৃত্যুর সংবাদ শুনে থেকে বড় অস্থির হয়ে পড়েছি। মহারাজের হাতি আমার কুটিরে এসেছে, এ তো আমার পরম সৌভাগ্য! আপনি কাল ভোরেই যুদ্ধক্ষেত্রের উদ্দেশে যাত্রা করবেন, তাই তো?’
‘হ্যাঁ দেবী, বিশ্বাস করুন, যদি আজ রাতটা জীবিত থাকতে পারি, কাল উৎকলে বিজয়-পর্ব হবে!’
‘আপনি আমার অতিথি হলেন। এই অভাগীর কুটির পবিত্র হল। আমি ধন্য হলাম। আসুন, আসুন।’
নৃসিংহ দেব কুটিরে প্রবেশ করলেন। মাটিতে পাতা ছেঁড়াখোড়া আস্তরণে বসে তিনি নিজের শিরস্ত্রাণ নামিয়ে রাখলেন। এই ক্ষীণ আলোতেও তাঁকে দেখে ওই নারী চমকে উঠল, ‘আরে, এ তো সেই পুরুষ, যে আমাকে পদ্মপুকুরে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করার সময় রক্ষা করেছিল! তখন বলেছিলেন যে, ইনিই নাকি উৎকলের মহাদণ্ডপাশ। না, না, এঁর কাছে আগেকার সেইসব ঘটনার উল্লেখ করা চলবে না। করলে বিপদ। জিজ্ঞাসা করবেন, সেইদিন কেন পালিয়েছিলাম। শাস্তিই যে দেবেন না তা-ই বা কে জানে? এ কী বিপত্তিতে ফেললে প্রভু?
এখন কী করি? আজ মহাদণ্ডপাশ বিপন্ন অবস্থায় আমার অতিথি হয়েছেন। ইনি একসময়ে আমার জীবন রক্ষা করেছিলেন। নিয়তি সম্ভবত এঁর জীবন রক্ষা করে আজ সেই ঋণ শোধ করার একটা সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু তা-ই বা করবে কীভাবে? সারা দেহেই দেখছি ক্ষতচিহ্ন। ইনি ভয়ানক খিদেতে কাতর হয়ে আছেন। বাইরে মহারাজের হাতি ক্ষুধার্ত হয়ে বসে আছে। উৎকলের কন্যা কি আজ যথাযথ ভাবে অতিথি সৎকারটুকুও সারতে পারবে না?
সাধ থাকলেও সাধ্য নেই। মাটির হাঁড়িতে অল্প কিছুটা ভাত বসিয়েছিলাম। জলকলমির শাক রেঁধেছি। কিন্তু তা আমার নিজের জন্যই যথেষ্ট নয় তো এই মহাদণ্ডপাশকে অতিথি হিসেবে কীভাবে দেব? আচ্ছা, সে নাহয় শাক-ভাতটাই খাওয়ালাম, কিন্তু রাজার হাতিকে? সে-ও যে অতিথি! কীভাবে ভরাব তার পেট? হে জগন্নাথ স্বামী, পথ দেখাও! উপায় বলো। এই শ্রীক্ষেত্রে জগন্নাথ মহাপ্রভুর কৃপায় কেউ কোনোদিন অভুক্ত শোয় না। আজ যদি তিনজনের মধ্যে একজনও না-খেয়ে থাকে, তবে শ্রীক্ষেত্রের মর্যাদা ভঙ্গ হবে।
এ কেমন পরীক্ষা নিচ্ছ প্রভু? আমার মতো নির্ধন, অভাগী তোমার এই পরীক্ষায় কীভাবে উত্তীর্ণ হবে? এই মাটিতেই তো কত ধনী-মানী-মহাজনের নিবাস, কতই না মঠ আর আশ্রম, স্বয়ং তোমার শ্রী-মন্দিরও এখানেই, আর তুমি এই যুবককে মহারাজার হাতি সমেত আমার মতো দরিদ্রের কুটিরে পাঠিয়ে দিলে? কেন?
শ্রীক্ষেত্রে শ্রীক্ষেত্রেরই একমুঠো মাটির আশ্রয় নিয়ে মাটির প্রদীপ তৈরি করে দিন-কাটানো এক দুঃখিনীর মান কী আর অপমানই বা কীসে? যদি এই অভাগী অভুক্ত থাকে, তবে তা আপনার অপমান। এই যুবক আর রাজার হাতি আমার নয়, আপনার অতিথি, হে নাথ। কৃপা করো! দ্রৌপদীর অক্ষয় পাত্র থেকে শাক খেয়ে দুর্বাসা এবং তাঁর শিষ্যদের ক্ষুধার নিবৃত্তি তুমিই করিয়েছিলে, আমার এই অতিথিদের ক্ষুধা মিটিয়ে তুমিই পথ দেখাও।’
নৃসিংহ দেব আস্তরণের উপরেই অবসন্ন অবস্থায় পড়ে আছেন। কুটিরের ভিতরের দুর্দশা দেখে তিনি স্পষ্ট বুঝেছেন যে এখানে দারিদ্রের সাম্রাজ্য। মনে মনে লজ্জাই পেলেন তিনি। তাঁর রাজ্যে মানুষ এভাবে দুর্দশায় জীবন কাটাচ্ছে, আর তিনি মনে করেন যে তিনি এক গর্বিত প্রজাপালক। অন্ন এখানে দুর্লভ। তাঁর ভুল ভেঙেছে। আর লজ্জা কীসের? গর্ব এমনিও বিলীনই হবে। প্রাণ চলে গেলে আর কীসের গর্ব?
ভারতবর্ষ অলৌকিকতায় ভরা। এখানে কবে, কোথায়, কার সঙ্গে এবং কীভাবে চমৎকার ঘটবে, তা কেউ জানে না। ওই বালক এবং কিশোর নিঃশঙ্ককে সঙ্গে নিয়ে শ্রীক্ষেত্রে এসে উপস্থিত হয়েছিল। জগন্নাথ স্বামীর শ্রীমন্দিরের এক অদ্ভুত মাহাত্ম্য—এই মন্দিরে যত ভক্তই এসে উপস্থিত হোক না কেন, মন্দিরের ভাণ্ডারে প্রসাদ কখনো কমও পড়ে না, আবার বেশি হয়ে নষ্টও হয় না। আজ মন্দিরের প্রসাদের বিতরণ পর্ব সমাপ্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কী আশ্চর্য! আজ প্রায় সব প্রসাদটুকুই রয়ে গিয়েছে অবিতরিত।
কী বিপদ! শ্রী-প্রসাদ ফেলাও চলবে না। পূজারিরা আজকের এহেন ঘটনা দেখে একটু অবাকই হয়েছেন। দেবতাকে শয়ান করিয়ে প্রধান পূজারি যখন নিজের কক্ষে শয়নে গেলেন, তখনও তাঁর মনে চিন্তা চলছে, ‘হে জগন্নাথ স্বামী, আজ যে শ্রী-প্রসাদের মর্যাদা রক্ষা হল না’ এইসব ভাবতে ভাবতেই তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। স্বপ্ন দেখলেন! জগন্নাথ মহাপ্রভু বলছেন, ‘যত প্রসাদ বেঁচে গিয়েছে, তার সবটাই ছাঁদা বেঁধে একটি গোশকটে চাপিয়ে নগরীর বাইরে রেখে এসো। এই কাজে যেন বিলম্ব না হয়।’
পূজারি তৎক্ষণাৎ জগন্নাথ দেবের আদেশ পালন করলেন। জগন্নাথ মহাপ্রভুর আদেশের কারণ দেখার জন্য তিনি খাদ্যে বোঝাই ওই গোশকটের পিছু-পিছু চললেন। গোশকটে জোতা বলদগুলো স্বেচ্ছায় একটি পর্ণকুটিরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বলদ জোড়া আর এগোয়ও না, পিছোয়ও না। এবার কী হবে? পূজারি দেখলেন, পাশেই একটি পর্ণকুটির। তিনি কুটিরে গিয়ে সেখানে ওই নারীকে দেখে নিবেদন করলেন, ‘দেবী, এখানে শ্রী-প্রসাদ আছে। কোনোভাবেই এর যেন অপমান না-হয়। আজ রাতে এই শ্রী-প্রসাদকে আপনার কুটিরেই স্থান দিতে হবে। যদি কাল সকাল অবধি এই প্রসাদ কেউ না-খায়, তবে সাগরের জলে বিসর্জন দেওয়া হবে। সেই ব্যবস্থা আমরাই করব।’
বিনোদিনী বলল, ‘হে প্রভু, তোমার মতো দয়াময় আর কে আছে? শ্রীমন্দিরে বসে-বসেই তুমি জগৎ সংসারের দুঃখ–দুর্দশার কথা শুনে ফেল। এই অভাগীর কথাও রাখলে তুমি, ধন্য প্রভু! তোমার লীলার কথা কে-ই বা কবে বুঝতে পেরেছে?
পূজারি মশায়, শ্রী-প্রসাদের অপমান স্বয়ং জগন্নাথ মহাপ্রভুই হতে দেবেন না। আপনাকে তিনিই পাঠিয়েছেন। কোণার্কের মহাদণ্ডপাশ এই মুহূর্তে রাজা নৃসিংহ দেবের হাতিকে সঙ্গে নিয়ে আমার শরণাপন্ন হয়েছে। তাঁরা দুজনেই ক্ষুধার্ত। এই প্রসাদের যথাযোগ্য সৎকার হবে। আপনি চিন্তা করবেন না। এই প্রসাদ স্বয়ং জগন্নাথ স্বামী আপনার হাত দিয়ে তাঁর ভক্তদের জন্য পাঠিয়েছেন।’
পুরো প্রসাদটাকেই সেখানে নামিয়ে রেখে মনে মনে জগন্নাথ স্বামীর জয় জয়কার করে পূজারি ফিরে গেলেন। এখন বিনোদিনীর সামনে রাখা আছে মহাপ্রসাদে ভরা কুড়ুয়া আর হাণ্ডি। রাজাকে বেড়ে দেওয়া হল জগন্নাথ প্রভুর ভুক্তাভুক্ত—মিষ্টি ভাত, পাঁচমেশালি ডাল, বেসনের বড়া, সর্ষে মেশানো তরকারি-বেসর, চাটনি, ক্ষীর, বড় গোলকের মতো নাড়ু। তার পর নৃসিংহ দেব আর বিনোদিনী দুজনে মিলে নিঃশঙ্কর মুখের সামনে সাজিয়ে দিলেন প্রসাদে ভরা হাঁড়িকুঁড়ি। গজরাজ মহাপ্রসাদ পেয়ে চেটেপুটে খেল। একটা বড় মাটির কলসে ভরা ছিল ঘোল। জলের অভাব পূরণ হয়ে গেল।
বিনোদিনী বলল, ‘এই যুবক সত্যিই জগন্নাথ দেবের বরপুত্র। নাহলে কি এভাবে না-চাইতেই কেউ মহাপ্রভুর মহাপ্রসাদ পেয়ে যায়?’
খেয়েদেয়ে তৃপ্ত হয়ে নিঃশঙ্ক বিনোদিনীর মাথায় নিজের শুঁড় বুলিয়ে দিল। স্নেহের পরশ পেয়ে সে-ও অভিভূত হয়ে উঠল। ঘুম পেয়ে যেতেই নিঃশঙ্ক দেহ ছড়িয়ে দিল মাটির উপর।
নৃসিংহ দেব এবার বিনোদিনীকে বললেন, ‘দেবী, এবার আপনি কুটিরের মধ্যে বিশ্রাম করুন। নিঃশঙ্ক ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছে। ওর বিশ্রাম প্রয়োজন, নাহলে আগামীকাল যুদ্ধে লড়তে পারবে না। এখানে কিছুক্ষণ বিরাম নিয়ে আমরা যুদ্ধভূমির উদ্দেশে রওনা দেব। এবং যাওয়ার আগে যদি আপনার কোনো আপত্তি না-থাকে, আমি আপনার পরিচয় জানতে চাইব। আপনাকে একটি গোপন সংবাদ দিচ্ছি, মহারাজ নৃসিংহ দেব জীবিত আছেন। আমি চাই, আপনি এই সংবাদ রাজধানীতে পৌঁছে দিন। আপনার মঙ্গলকামনা নৃসিংহ দেবের জন্য বরদায়ী হবে এবং আপনার রাজভক্তি, উৎকলের প্রতি প্রেম তথা অতিথিপরায়ণতার উচিত সম্মান করে রাজা নিজেও গৌরবান্বিত অনুভব করবেন।’
মৌন হয়ে গেল বিনোদিনী। পাষাণের মতো নীরব। স্থবির। তাঁর মনে প্রশ্ন চলছে, ‘কীভাবে বলি এঁকে? আমি রাজধানী যাব কীভাবে? মহারাজ জীবিত আছেন, এর থেকে আনন্দের কথা আর কিছু হতেই পারে না। কিন্তু আমার পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। এক মুখ থেকে অন্য মুখ, সেখান থেকে আরেক মুখ হয়ে আমার পরিচয় আমার স্বামীর কাছে গিয়ে পৌঁছাবে। সমাজ আমাকে কুলটা, অলক্ষ্মী মনে করে। সেসব শুনে আমার স্বামী অপমান আর গ্লানিতে ভয়ানক আহত হবেন। সে যতই নিষ্পাপ হোক না কেন একজন গৃহত্যাগী নারীকে সমাজ মেনে নিতে পারে না। এই সমাজ তাকে কুলবধূর সম্মান কখনোই দেবে না। কিছু করার নেই আমার। আমি কোথাও যেতে পারব না।’
তার কাছ থেকে কোনও উত্তর না পেয়ে নৃসিংহ দেব বেশ আহত অনুভব করছেন, ‘দেবী, আমি বুঝতে পারছি যে আপনার হয়তো আমার কথায় বিশ্বাস করতে শঙ্কা হচ্ছে। আচ্ছা সেসব কথা ছাড়ুন, আমি কি আপনার শুভনাম জানতে পারি?’
বিনোদিনী নিজের দুই হাত জোড় করে বলল, ‘ভদ্র, অভাগীর কোনো নাম হয় না। নেইও।’
নৃসিংহ দেব স্পষ্ট দেখলেন—তার ডান হাতে রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তির উল্কি আঁকা রয়েছে। ছবির নীচে লেখা আছে ‘রাধাকৃষ্ণ’। ‘আরে, এ তো সে-ই, যাকে একবার কুয়োর ভিতরে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছিলাম, আরেকবার পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করা থেকে রক্ষা করেছিলাম।’
তিনি মুখে বললেন, ‘ঠিক আছে, দেবী। সম্ভবত আমি আপনার কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারিনি। এ আমার দুর্ভাগ্য! আপনি এখন বিশ্রাম করুন। আর কিছুক্ষণ পরে নিঃশঙ্ক একটু সুস্থ অনুভব করলেই আমরা দুজনে যুদ্ধভূমির উদ্দেশে যাত্রা করতে চাই। উৎকলের এক কন্যা তথা উৎকলের এক বধূ যদি আমাকে বিজয়-প্রদীপ দেখিয়ে বিদায় জানান, তাহলে আমি ধন্য বোধ করব।’ কথা শেষ করে নৃসিংহ দেব নিঃশঙ্কর পাশেই মাটিতে শুয়ে পড়লেন। সাগরের বুকে চিরে আসা শীতল বাতাসে কখন যে তাঁর চোখে ঘুম নেমে এল, তা তিনি জানতেও পারলেন না।
অর্ধরাত্রির পর চার ঘটিকা অতিক্রান্ত। নিঃশঙ্ক এবার উঠে দাঁড়াল। শুঁড় দিয়ে আলতো ছোঁয়ায় সে নৃসিংহ দেবের ঘুমও ভাঙাল। বিদায়ের মুহূর্ত উপস্থিত হয়েছে। তিনি পর্ণকুটিরের সামনে এসে গলাখাঁকারি দিলেন। কোনো সাড়া মিলল না। এবার একটু কিন্তু কিন্তু ভাব নিয়েই কুটিরের মধ্যে প্রবেশ করে দেখলেন বিধবার সিঁথির মতোই শূন্য পড়ে আছে কুটির। কোথায় সেই নারী? শুধু কুটিরের ঠিক মাঝখানে একটি মাটির থালায় রাখা আছে একটি প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ। কুটিরের স্বামীনির কোনো চিহ্ন নেই।
এখন আর ওই নারীকে খোঁজার মতো সময় নৃসিংহ দেবের হাতে নেই। উৎকলের স্বাধীনতা মহারাজ নৃসিংহ দেবকে ডাকছে। তিনি স্বয়ং প্রদীপের পবিত্র উষ্মা নিয়ে নিঃশঙ্কর পিঠে চড়ে যুদ্ধভূমির উদ্দেশে রওনা দিলেন।
ভোরের সূর্য এবার আলো ছড়াতে আরম্ভ করেছে। চারজন সেনাপতি—সেনাপতি তুলসী, সেনাপতি রাজগোবিন্দ, সেনাপতি সুরু এবং সেনাপতি বিষ্ণুদেব শিবিরে বসে শলাপরামর্শ করছিলেন। হঠাৎই নিঃশঙ্কর বৃংহিত শুনে তাঁরা চমকে উঠলেন। চারজনেই খুব ভালো করে নিঃশঙ্কর ডাক চেনেন। তাঁরা একসঙ্গে শিবির থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন। নিঃশঙ্কর পিঠে আরূঢ় রাজা নৃসিংহ দেবকে দেখে একসঙ্গে জয়-নিনাদ করলেন তাঁরা, ‘জগন্নাথ স্বামীর জয়! মহারাজ নৃসিংহ দেবের জয়!’
জয়জয়কার শুনে উৎকলের সেনা সজাগ হয়ে উঠল। উৎকলের পাইকেরা দলে দলে নিজেদের শিবির থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল। গগনভেদী উল্লাসে তূর্য বেজে উঠল, ‘তূ..তূ..তূ..তূ..তূ..তূ..!’ ওদিকে বিপক্ষ শিবিরে বিশ্রামরত যবন বাহিনী তূর্যের এই উল্লাসধ্বনি শুনে চঞ্চল হয়ে উঠল, ‘এখন আবার বাজনা কীসের? কী হল?’
নৃসিংহ দেব আদেশ দিলেন, ‘এখুনি সৈন্য সজ্জা করো! ইখতিয়ার বেগকে তার বাহিনীর প্রস্তুত হয়ে ওঠার আগেই ঘিরে ফেলো। কাল দুপুরের আগেই প্রত্যেক যবন সৈন্যের দ্বিখণ্ডিত দেহ যেন এই মাটিতে পড়ে থাকে। তরবারির কোনো আঘাতই যেন ব্যর্থ না-হয়। সৈনিক নয় তো তার ঘোড়াকেই, ঘোড়া না-পেলে তাঁদের হাতিকেই মারো। কিন্তু মারো। মারতে থাকো। মারো অথবা মরো! আজ আর কোনো যুদ্ধবিরাম হবে না, কাল আর কোনো যুদ্ধ হবে না। মা গঙ্গেশ্বরীর নামে শপথ করে বলছি, আজ এই যুদ্ধের শেষ দেখে ছাড়ব। সন্ধ্যা নামার আগেই যুদ্ধ শেষ হওয়া চাই। আজ এই যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি নৃসিংহ দেব নয়, স্বয়ং জগন্নাথ স্বামী!’
‘জগন্নাথ স্বামীর জয়! মা গঙ্গেশ্বরীর জয়! নৃসিংহ দেবের জয়!’ পাইক সৈন্যদের জয়জয়কারে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠল। তাদের প্রস্তুত হয়ে ওঠার জন্য আধঘণ্টা সময়ই যথেষ্ট ছিল। আসলে নৃসিংহ দেবের মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পরে হতাশ হয়ে পড়া সৈনিকদের কাছে তাঁকে সাক্ষাৎ দেখার ব্যাপারটা রণোন্মাদনাকে বহু মাত্রায় বাড়িয়ে দিল।
অর্ধ ঘটিকার মধ্যেই উৎকলের সেনাবাহিনী নিজেদের শিবির থেকে বেরিয়ে এল। এরই মধ্যে ইখতিয়ার বেগের বাহিনীও যুদ্ধভূমিতে এসে দাঁড়াল। সূর্যোদয় হওয়ার আগেই শুরু হয়ে গেল মহাসমর।
যুদ্ধকে আর যুদ্ধ বলে মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে নৃশংস এক শিকার। রণভূমি তো নয়, যেন এক বধ্যভূমি। ফলমূলের মতোই কাটা পড়তে থাকল যবন সৈন্যদের মাথা। ইখতিয়ার বেগ উন্মাদের মতো আচরণ করতে লাগল। করবে না-ই বা কেন? তার শত্রু যে মৃত্যুঞ্জয় হয়ে ফিরে এসেছে!
আজ নিঃশঙ্কও যেন বিচিত্র রণরঙ্গে মত্ত হয়ে উঠেছে। কোনো শত্রু সৈনিককে শুঁড়ে করে পাকড়ে ধরে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে, কাউকে ধরে সামনের পা-দিয়ে একটা পা চেপে ধরে তার অন্য পা’টাকে শুঁড়ে করে টেনে দেহটাকেই চিরে ফেলছে, কারো মাথাটাকে তরমুজ ফাটানোর মতোই ফাটিয়ে বের করে দিচ্ছে রক্ত আর ঘিলু। গজরাজের দুই পাশে চপল আর চঞ্চলও রণসাজে সজ্জিত হয়ে সমান তালে নিজেদের সামনের দুই পা দিয়ে শত্রুদের আঘাত করে আহত করে চলেছে।
ইখতিয়ার বেগ দেখল, তার সেনা পর্যুদস্ত হয়ে চলেছে। পিছু হটা ছাড়া তার সামনে এখন আর কোনো পথ খোলা নেই। কিন্তু এবারে নৃসিংহ দেবের রণনীতি একটু ভিন্ন। যুদ্ধের শুরু হওয়ার আগেই সেনাপতি রাজগোবিন্দ এবং সেনাপতি বিষ্ণুদেব ইখতিয়ার বেগকে পিছন দিকে থেকে ঘিরে ফেলেছেন। এবার তাঁরা একযোগে আক্রমণ করলেন। জাঁতার ভিতরে গম পেষাই হওয়ার মতো অবস্থা হয়ে দাঁড়াল যবন সেনার।
ইখতিয়ার বেগ নিজের জীবন রক্ষার্থে পালাচ্ছিল, কিন্তু সেনাপতি সুরুর দৃষ্টি এড়াতে পারল না। তিনি ইখতিয়ার বেগের ঘোড়ার পিছু নিলেন। মুহূর্তের মধ্যে তার নাগালে পৌঁছে গেলেন সেনাপতি সুরু, ইচ্ছে করলেই তরবারির এক আঘাতে নামিয়ে দিতেন পারেন বেগের মাথা। এমন সময় কোনো কিছুতে ঠোক্কর খেয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ল ইখতিয়ারের ঘোড়া। নিজের অশ্বের গতি রুদ্ধ করলেন সেনাপতি সুরু। ভূপতিত ইখতিয়ার এবার উঠে দাঁড়াল। তার ঘোড়ার সামনের পা দুটো ভেঙে গিয়েছে। পালানোর পথ নেই।
সেনাপতি সুরু নিজের ঘোড়ার গা থেকে খুলে নিলেন লাগামখানা। তার একটা প্রান্ত ইখতিয়ার বেগের পায়ে জড়িয়ে দিলেন। এবার লাগাম ছাড়াই তিরবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে সুরু ইখতিয়ার বেগকে মাটিতে ঘষটাতে ঘষটাতে নিয়ে চললেন নৃসিংহ দেবের কাছে। রাজার পায়ের কাছে উৎকলের শত্রুকে সুরু আছড়ে ফেললেন। নৃসিংহ দেব প্রশ্নবাচক দৃষ্টি নিয়ে সুরুর দিকে একবার তাকাতেই তিনি বললেন, ‘ইখতিয়ার বেগ!’
গর্জন করে উঠলেন উৎকল-সিংহ, ‘আমি তোমাকে যুদ্ধাপরাধী বলে ঘোষণা করছি! আর সেনাপতি সুরু, আপনি থামলেন কেন? আমার আদেশ ছিল, মারো অথবা মরো! থামলেন কেন? আমার আদেশের সম্পূর্ণ পালন কিন্তু এখনও হয়নি।’
‘তাহলে একেই আগে শেষ করি, মহারাজ!’ বলেই নিজের হাতের তলোয়ার দিয়ে সুরু ইখতিয়ারকে আঘাত করতে উদ্যত হলেন।
‘না সেনাপতি, ইখতিয়ার বেগ এখন একজন ঘোষিত যুদ্ধবন্দি। এবং যুদ্ধবন্দিকে হত্যা করা পাপ। অধর্মও। একে চোরের মতোই বেঁধে যুদ্ধভূমির একটা কোণে ফেলে রাখুন। যদি অশ্বের খুরে পিষ্ট হয়ে মরা থেকে বেঁচে যায়, তাহলে নাহয় একে নিয়ে বিচার করার ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা করব। আপনি প্রতিপক্ষের বাহিনীর ওপরে আক্রমণের মাত্রা আরও তীব্র করে তুলুন।’
যুদ্ধে যখন প্রতিপক্ষের সর্বোচ্চ পদাসীন ব্যক্তি বন্দি হয়ে যান, তখনও যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া আসলে আনুষ্ঠানিকতার নামান্তর। যবন বাহিনীকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে কচুকাটা করল পাইক বীরের দল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রণভূমিতে কমতে কমতে একসময় শূন্য হয়ে গেল তাদের সংখ্যা। যুদ্ধ শেষ হল। রাজা নৃসিংহ দেব নিজের হাতে ইখতিয়ার বেগের বাঁধন খুলে দিয়ে বললেন, ‘যাও ইখতিয়ার বেগ, উৎকলের বন্দিগৃহ শত্রুদের ভোজন করানোর কোনো ব্যবস্থা রাখে না। উৎকলের মর্যাদায় আবার আঘাত করার দুঃসাহস কোরো না!’
সেই রাতেই সংজ্ঞাহীন অবস্থাতেই সীতাদেবী স্বপ্নে দেখলেন যে, মা গঙ্গেশ্বরী নিজের হাতে করে তাঁর সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিচ্ছেন। তাঁর সম্বিৎ ফিরল। উঠে বসেই তিনি শিবেই সান্তারাকে ডেকে পাঠালেন। তাঁকে বললেন, ‘মা গঙ্গেশ্বরীর স্বপ্নাদেশ পেয়েছি। মহারাজ সকুশল রয়েছেন। রাজধ্বজাকে আবার যথাযোগ্য মর্যাদায় উত্তোলিত করে দিন। এখনই!’
শিবেই সান্তারা ভাবলেন, ‘শোকে রানি অসংলগ্ন আচরণ করছেন। অবশ্য এমন বিক্ষিপ্ত ভাব অস্বাভাবিক কিছুও নয়।’ কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ না-করেই তিনি উৎকলের ধ্বজা উত্তোলনের ব্যবস্থা করলেন। আশার দুর্নিবার শক্তিতে ভর করে সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বলে উঠল। কোনো নতুন সংবাদ আসেনি, উদাস মনকেই শক্ত করতে চাইল প্রত্যেকে। রাজধানী এক অবুঝ মানসিকতার টানাপোড়েনে জেরবার।
অর্ধরাত্রির সামান্য আগে এক পাইক ঘোড়া ছুটিয়ে বারাবটি দুর্গের সামনে এসে দাঁড়াল। সে সজোরে চিৎকার করে দুর্গপালকে বলল, ‘দুর্গের দ্বার খুলে দিন, দুর্গপাল! আনন্দ সংবাদ! দুন্দুভি বাজাতে বলুন। মহারাজ জীবিত আছেন। সুস্থ আছেন। উৎকলের বিজয় হয়েছে। বিজয়ী সেনা রাজধানীতে ফিরে আসছে।’
দাবানলের মতোই এই খবর ছড়িয়ে পড়ল। শাঁখ, কাঁসর, ঘণ্টা, কাড়ানাকাড়া বেজে উঠল। সীতাদেবী আর চন্দ্রাদেবী একে অপরকে আলিঙ্গন করে কাঁদতে লাগলেন। আসলে এর আগে এঁরা একে অপরকে সাহস দিয়ে আড়ালে গিয়ে চোখের জল ফেলছিলেন। তবে তা ছিল বিলাপ, আর আজকের এই কান্না তা থেকে একেবারে ভিন্ন। আনন্দাশ্রু আবেগের বানে ভাসিয়ে নিয়ে গেল দুই রাজ-রমণীকে। উৎকলের জন্য যা কিছু অশুভ, তা বয়ে গেল। সমগ্র উৎকলের মুখে এখন হাসি, আনন্দ আর চোখে জল।
এই সংবাদ সুবলের কানেও গেল, ‘রাজা জীবিত আছেন। বিজয়ী হয়েছেন। ফিরে আসছেন।’ তার মুখে কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না। নির্বিকার ভাব নিয়ে সাতশো বিয়াল্লিশ মণ ওজনের শ্যামল শিলার বুকে নবগ্রহ মূর্তি খোদাই করতে থাকল।
সাগরের অতল জলরাশিতে দুলতে দুলতে বহিত্র নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছিল। মধ্যরাত্রি। অগণিত নক্ষত্র সাগরের জলে নিজেদের প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করেছে। আকাশ আর জল জুড়ে যেন টানা হয়েছে এক ঝিলমিলে চাদর। শিল্পা নিজের বিগত অতীত এবং আগামী ভবিষ্যতের মাঝে এক নিস্তব্ধ বর্তমানে দাঁড়িয়ে নিজেকে বড় একাকী অনুভব করছে। আর সবথেকে বড় পরিচালক—নিয়তি? সে নিজের নাটকের পরবর্তী দৃশ্য মঞ্চনের পরিকল্পনায় অত্যন্ত ব্যস্ত।
যাত্রা আরম্ভ করার পরই বহিত্রের প্রধান নাবিক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। দুপুর থেকেই তিনি উদরশূলের ভয়ানক বেদনায় অস্থির হয়ে ওঠেন। সমুদ্রযাত্রা চলাকালীন যতখানি চিকিৎসা হওয়া সম্ভব, তা করাও হয়। বৈদ্য বলেছিলেন, প্রধান নাবিকের উণ্ডুক পুচ্ছ ফুলে উঠেছে। সেটাই বেদনার উৎস। নয় ঘণ্টা অসহ্য উদরপীড়া সহ্য করার পর অবশেষে প্রধান নাবিকের মৃত্যু ঘটে। এখন এই বহিত্র সাধারণ নাবিকদের ভরসায় ভেসে চলেছে।
দ্বিতীয় দিন থেকে হাওয়ার দিক বদল হয়েছে। পালগুলোকে বহিত্রের লক্ষ্যস্থল এবং বায়ুর দিশার অনুরূপে সমন্বিত করে তোলার যোগ্যতা সাধারণ নাবিকদের নেই। বহিত্র এখন পথ হারিয়েছে। সাগরদেবতার কৃপায় এবং পবনদেবের আনুকূল্যে মহাজলধির বুকে ভাসতে-ভাসতে জলযানটি চলেছে কোনো এক অজ্ঞাত লক্ষ্যের উদ্দেশে। যাত্রীদের মনে এখন একটাই প্রার্থনা—কোনোভাবে পাড় পাওয়া গেলেই হল, স্থলভাগের দেখা মিললে কোনো একটি বন্দরে বহিত্র গিয়ে থামুক। আগে প্রাণ বাঁচুক। তার পর নাহয় যাত্রা, লক্ষ্য এবং যাত্রাপথ নিয়ে মাথা ঘামানো যাবে।
বিপদ কখনো একলা আসে না। আচমকাই সাগরের জল ফুঁসতে আরম্ভ করেছে। উঁচু উঁচু ঢেউ দেখলে বুক শুকিয়ে যায়। পশ্চিমের আকাশ রক্তিম হয়ে উঠেছে। আগামী ভয়ানক এক ঝড়ের সম্ভাবনায় ভয়ভীত হয়ে উঠেছে প্রত্যেক যাত্রী। সাগরের জলের একেবারে উপরিস্তরে দেখা যাচ্ছে তিমি, তিমিঙ্গিল, মহামৎস্য, অষ্টপদ এবং বিশাল-বিশাল আকারের মকর। একটি বিশালকায় তিমিঙ্গিল ভয়াবহ ভাবে হাঁ-করে এসে বহিত্রের পেটে ধাক্কা মারল। কেঁপে উঠল জলযান।
সব যাত্রী নিজের নিজের ইষ্ট স্মরণ করতে লাগল। তাঁরা বুঝতে পারছেন সঙ্কট ঘনিয়ে আসছে।
সাগর ক্রমশ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। প্রতি মুহূর্তে আগের থেকে বেশি। সাগরের ঢেউ এখন বহিত্রের পাটাতনের উচ্চতারও উপর দিয়ে যাচ্ছে। ঝঞ্ঝা বেগমান হয়ে চলেছে। আর তারই সঙ্গে থেকে–থেকে বহিত্রের পেটে ধাক্কা মেরে যাচ্ছে তিমিঙ্গিল। হয়তো প্রকৃতি সহায় হলে ঝড় থেমে যাবে। কিন্তু তিমিঙ্গিল? সে তো থামবে না। ঝড়ে কোনো বিপদ হওয়ার আগেই না তিমিঙ্গিলের ধাক্কায় বহিত্রখানা ডুবে যায়—এই হাহাকারে যাত্রীরা সরব হয়ে উঠল।
বহিত্রের জলসমাধি এখন প্রায় নিশ্চিত। কলিঙ্গ থেকে যাত্রা আরম্ভ করা, দুচোখে সুখস্বপ্ন নিয়ে ভেসে চলা উৎকলের শিল্পী, নর্তক, বাদ্যকার, বণিকরাই কলিঙ্গের শিল্প, সংস্কৃতি এবং পরম্পরার মেরুদণ্ড। আজ কি ওদের সলিল সমাধি হবে? শিল্পা কিন্তু নির্বিকার। প্রত্যেকে যখন আসন্ন মৃত্যুর ভয়ে ব্যাকুল, তখন শিল্পার মনে কোনো ভয় নেই। সে একদৃষ্টে তিমিঙ্গিলটিকে দেখে চলেছে।
সবাই ভাবছে, ঈশ্বরই একমাত্র ভরসা। প্রত্যেকে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, যেন অপর ব্যক্তির হাতেই রয়েছে জীবনরক্ষার চাবিকাঠি। শেষমেশ কেউ একজন প্রশ্ন করল, ‘এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার কি কোনো উপায় নেই? এখন কি তবে শুধু নিশ্চিত মৃত্যুর জন্যই অপেক্ষা করতে হবে? আমরা কেউই কি শেষ কোনো চেষ্টা করে দেখতে পারি না?’
এক মধ্যবয়স্ক বণিক বললেন, ‘উপায় একটা আছে বটে, কিন্তু ভীষণ কঠিন। অত্যন্ত নিষ্ঠুর। কষ্টদায়ক।’
‘এই আসন্ন মৃত্যুর থেকে বেশি নিষ্ঠুর বা কঠিন কিংবা কষ্টদায়ক আর কিছু হতে পারে কি? আপনি সবকিছু জেনেও এতক্ষণ কিছুই বলেননি কেন? বলুন, এখুনি বলুন। মরার আগে একবার শেষ চেষ্টা করে দেখা যাক,’ কেউ একজন চেঁচিয়ে বলল কথাটা।
‘প্রকৃতিকে তো কোনো ভাবেই বশে আনা সম্ভব নয়, তাই এই সামুদ্রিক ঝঞ্ঝার কোনো প্রতিকারও নেই। দৈব সহায় থাকলে হয়তো ঝড় থামবে কিংবা বায়ু নিজের গতির অভিমুখ পরিবর্তন করলে আর আমাদের বহিত্র ডুববে না, কিন্তু তিমিঙ্গিলের হাত থেকে বাঁচার উপায় আগে করা দরকার। এই সর্বভুকটির হাত থেকে বাঁচলে তবেই আমরা ঝড় থেকে বাঁচার কথা ভাবব।’
‘আরে মশায়, আপনি উপায় বলুন। এটা উপদেশ দেওয়ার সময় নয়। কিছু করা গেলে বলুন, আমরা চেষ্টা করি।’
‘তাহলে শোনো, কাজের কথাটা বলি—এই সাগর বলিদান চায়। কোনো পবিত্র, নিষ্পাপ, কুমারীর বলি। যদি কোনো এমন বালিকা বা কিশোরীকে সাগরজলে উৎসর্গ করা যায়, তবে সাগর বলি পেয়ে শান্ত হয়ে যাবে। তিমিঙ্গিল তাকে আহার হিসেবে গ্রহণ করে আর বহিত্রকে আক্রমণ না-করে গভীর জলে ফিরে যাবে। তখন বহিত্রের পাল নামিয়ে নিয়ে তাকে ঢেউ আর নিয়তির ভরসায় ভাসতে দিলে সে-ও আমাদের কোনো না কোনো তটে নিয়ে গিয়েই তুলবে। এটাই বাঁচার একমাত্র উপায়। কিন্তু প্রশ্ন হল এমন আত্মবলিদান দেবে কে?’ বণিক উপায় বললেন বটে, কিন্তু কথাগুলো সকলের বুকে যেন হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করল।
এই নিদানের সত্য-মিথ্যা, উচিত-অনুচিত, ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদির বাছবিচার করার মতো ক্ষমতা, ধৈর্য, মানসিকতা বা সময় কোনোটাই যাত্রীদের মধ্যে নেই। সবাই মরার থেকে একজনের বলিদান অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান। সকলেই বলতে শুরু করল, ‘আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার যদি এটাই একমাত্র উপায় হয় তবে এখুনি এটাই করা উচিত।’
কিন্তু কে আত্মবলিদান দেবে? কার বলি দেওয়া হবে?
প্রত্যেক মা নিজ নিজ কন্যাকে বুকে জড়িয়ে ধরল, ‘না, না। আমি মরলে মরব, কিন্তু আমার মেয়ের জীবন অমূল্য। মরলে সবাই একসঙ্গে মরুক, তখন আমি, আমার মেয়ে সকলেই একসঙ্গে চলে যাব। সেটা তবু মানা যায়। কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে আমার মেয়েকে মরতে দিতে পারি না।’
মরুভূমিতে জন্ম নেওয়া একাকী পানলতার মতো শিল্পাকে নিজের বুকে টেনে নেওয়ার জন্য কোনো মা নেই। নিজের কোলে টেনে নিয়ে সুরক্ষা দেবে এমন পিতাই তাকে নিজের থেকে অনেক–অনেক দূরে নির্বাসন দিয়েছেন। একে একে সবার দৃষ্টি শিল্পার উপরে গিয়ে পড়ল। প্রত্যেকের চোখে অসহায় ভাব। প্রতিটা দৃষ্টিই কাতর, অনুনয়-বিনয়ে ভরা। এই প্রথম শিল্পার মনে হল, এই মুহূর্তে তার থেকেও অসহায় কেউ আছে। আসন্ন মৃত্যু থেকে তাদের অব্যাহতি দিতে একজনই পারবে—শিল্পা।
শিল্পার মন এখন ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে। নির্ভয় হয়ে সে বিশাল, ভয়ঙ্কর তিমিঙ্গিলটাকে দেখতে থাকে। মনে মনে মা গঙ্গেশ্বরীকেও স্মরণ করে। তার চোখ বুজে এল। সে নিজের দুই বাহু মেলে দিল যেন দেবী তাকে নিজের কোলে তুলে নিচ্ছেন। নিজের ওড়নাটাকে ঝোড়ো হাওয়ার মুখে আর সামলাতে চেষ্টা করল না শিল্পা। সেটা উড়ে গেল আপন খেয়ালে। বহিত্রের পাটাতনের একদম ধারে দাঁড়িয়ে শিল্পা নিজেকে সাগরজলে বিসর্জন দিয়ে দিল। সফেন জলরাশির মধ্যে মুহূর্তে তার দেহটা হারিয়ে গেল। তিমিঙ্গিল কখন যে তাকে নিজের মুখে নিয়ে অন্তর্হিত হল, পালিত পশুর যেভাবে খাদ্য পেয়ে ফিরে যায়, সেভাবে কখন যে তিমিঙ্গিল ফিরে গেল, কখন যে শিল্পার রক্তে জল লাল হয়ে উঠল, কখন যে সেই লালিমা মুছে গিয়ে আবার ফিরে এল সফেন ভাব, তা কেউ টেরও পেল না।
বহিত্রে উপস্থিত সকল নর-নারী এই বলিদানে অভিভূত হয়ে পড়ল, আর তার কিছুক্ষণ পরেই নিজেদের জীবন রক্ষার আনন্দে উৎফুল্লও। হায় রে মানুষ! হায় রে তার স্বার্থপরতা!
নিয়তি যেন শিল্পাকে সাগরে বিলীন করার জন্যই এত আয়োজন করেছিল। মুহূর্তের মধ্যে শান্ত হয়ে গেল সাগরের জল, যেন কিছুক্ষণ আগে কিছুই ছিল না, কিছুই ঘটেনি।
সাগরের ঢেউ আর নিয়তির ভরসায় ভাসতে ভাসতে পাল-নামানো বহিত্রটি একসময় কামাম্বুজ দেশের একটি বাণিজ্যতরীর প্রধান নাবিকের দৃষ্টিতে আসে। সেই জলযান থেকে যথাসাধ্য সাহায্য করার পর অবশেষে সাতান্ন দিন পরে কলিঙ্গ থেকে যাত্রা করা বহিত্র সিংহল দ্বীপে গিয়ে ভেড়ে। সিংহল দ্বীপের বন্দরে যখন যাত্রীরা নামল, তখন সেখানে শিল্পা রইল না বটে, কিন্তু প্রত্যেক যাত্রীর জীবন হয়ে সে বেঁচে রইল। প্রত্যেকের অন্তঃকরণে শিল্পাই থেকে গেল। সিংহলের শাসক দ্বারা নিয়োজিত বিশেষ নাবিক দলের অধীনে যখন ওই বহিত্র উৎকলে ফিরে গেল, তখন আচার্য সৌম্য শ্রীদত্ত নিজের কন্যার বলিদানের কথা জানতে পারলেন। আর কাউকে কোনো মিথ্যাভাষণের প্রয়োজন পড়ল না।
সৌম্য শ্রীদত্ত নিজের পুত্রীকে সাগরদেবতার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সাগরদেবতাও সেই দান সর্বাত্মক ভাবে গ্রহণ করেছিলেন। শিল্পার শোকে সাগর তটে দাঁড়িয়ে শ্রীদত্ত দীক্ষিতের চোখ ভিজে উঠেছিল। প্রতিটি অশ্রুকণা সাগরদেবতা নিজের বুকে সেভাবেই স্বীকার করে নিচ্ছিলেন, যেভাবে তিনি শিল্পাকে স্বীকার করেছিলেন। হয়তো এক পিতার চোখের জলে সাগরের জল আরেকটু বেশি লবণাক্ত হল। হয়তো বা কিছুই হল না। অমন কত চোখের জলই সে পান করেছে এবং আগামী দিনেও করবে।