সূর্য বিনোদিনী – ১

ছুম ছনন ছম ছুম ছনন ছম ছুম ছনন ছম ছুম…
ছনননন ছনননন ছনননন ছনননন ছুম ছনন ছম ছুম…
ছম…ছম…ছম…ছম…ছুম…ছনন ছম…ছুম…

রাত্রির নিবিড় স্তব্ধতাকে ছিন্নভিন্ন করে বেজে চলেছে এক অদৃশ্য ঘুঙুরের ধ্বনি। সেই ধাতব স্বর-লহরা ধীরে ধীরে আমাকে যেন তার মায়াপাশে বেঁধে ফেলছে। নিজের অজান্তেই বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছি আমি। এক-পা দু-পা করে সেই শব্দের উৎস লক্ষ করে এগিয়ে চলেছি, এমন সময় এক নারীকণ্ঠ বাধা দিল আমায়, ‘দাঁড়ান, ওদিকে যাবেন না!’

আমি পিছনে ফিরে তাকালাম। দেখলাম, এক অপরূপা হাতের ইশারায় আমাকে থামতে বলছেন। কিন্তু তখনও আমার কানে বেজে চলেছে সেই ঘুঙুরের মধুর ছন্দ। সে এক অমোঘ আকর্ষণ। নেশার মতো। আবারও আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললাম। নিষেধ না-মেনে পা-বাড়াতেই কখন যেন সেই নারী আমার বাঁ হাতটাকে শক্ত ভাবে চেপে ধরলেন।

‘বললাম না, ওদিকে যাবেন না!’

মুহূর্তের জন্য মনে হল, আমার হাতটা যেন কোনো হিমশীতল লতা আঁকড়ে ধরেছে। আমি এক ঝটকায় হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে বললাম, ‘কেন?’

‘কারণ তাতেই আপনার মঙ্গল। ওই যে ঘুঙুরের শব্দ শুনছেন, ওটা দেবদাসী-নৃত্য। দেবতা ছাড়া আর কেউ দেবদাসীর লাস্য দেখার অধিকারী নন। তাছাড়া আপনি ওখানে গিয়ে কিছুই দেখতে পাবেন না। আপনি বরং এখানেই থাকুন। কানে যেটুকু শব্দ আসছে আসুক। ওটুকুই প্রাপ্তি বলে ধরে নিন। কেমন?’

‘কিন্তু…’

‘কোনো কিন্তু নয়। আপনি এটাকে অনুরোধ ভাবলে অনুরোধ, আদেশ ভাবলে আদেশ। দেখুন, আপনার সঙ্গে আমার কোনও শত্রুতা নেই। আপনি আমাকে চেনেন না, আমিও আপনাকে চিনি না। আপনার ভালোর জন্যই বলছি, ওদিকে যাওয়া ঠিক হবে না। আসুন, আমরা ওই শিমুল গাছটার নীচে গিয়ে বসি। আসুন না!’

ওই ঘুঙুরের ধ্বনি, ওই নিক্কন আমাকে যেন সম্মোহিত করে ফেলেছিল। তাই সেই অপরিচিতার আহ্বানে সাড়া দিতে আমার ঠিক মন চাইছিল না। ওই কিঙ্কিণীর শব্দই এখন আমার মনের বিলাস, প্রাণের আরাম। আমাকে আরও একবার অবাক করে দিয়ে ওই রূপসী নিঃসঙ্কোচে আমার হাতটা আঁকড়ে ধরলেন। আমি আবারও সেই কনকনে স্পর্শে শিউরে উঠলাম। তার হাতের বজ্রমুঠি থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, চলুন।’

মাঘ মাস। শুক্ল সপ্তমীর চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। শীতল চন্দ্রাতপ। অবিরত হিমেল হাওয়া বয়ে চলেছে। আশেপাশে কুয়াশা এসে জমাট বেঁধেছে। তারই মধ্যে চাঁদের আলো পড়ে এক মোহময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। মোহিনী রূপবতী ওই রমণীকে নীল শাড়িতে মানিয়েছে বেশ। সে যেন নীল-সরোবরের মাঝে ফোটা শ্বেতপদ্ম। আশ্চর্য! এতক্ষণে খেয়াল হল যে, এই শীতের রাতেও ওই রূপসীর গায়ে কোনো গরম পোশাক নেই। পায়ে নেই জুতো জোড়াও! তাকে যত দেখছি, আমার শীত-শীত অনুভূতিটা যেন ততই বাড়ছে। আমি না-পেরে তাকে জিজ্ঞেস করে বসলাম, ‘আজ বেশ ঠান্ডা পড়েছে। আপনার শীত করছে না? আমার তো এই জ্যাকেট চাপিয়েও শীত করছে!’

‘ও আমার অভ্যেস আছে। সমুদ্রের কাছাকাছি এলাকায় কখনো তেমন ভয়ানক শীত পড়ে না। আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। আচ্ছা, এবার আমি কি একটা প্রশ্ন করতে পারি?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, করুন না! প্রশ্ন-উত্তরের হাত ধরেই তো অচেনা মানুষ চেনা হয়ে যায়।’ আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, এই অল্প সময়েই তার প্রতি আমার একটা আকর্ষণ বোধ তৈরি হয়েছে। আমি চাইছিলাম, আমাদের মধ্যে অনেক কথা হোক।

‘এত রাতে আপনি এখানে কী করছেন? সবাই যখন ঘুমোতে ব্যস্ত, তখন এই ভাঙা দেউলে কী খুঁজে বেড়াচ্ছেন শুনি?’

‘হ্যাঁ, খুঁজতেই তো এসেছি। অতীত খুঁজে বেড়াচ্ছি। এটা আমার নেশা। আচ্ছা, আপনার করা এই প্রশ্নটাই যদি আমি আপনাকে করি?’

‘হ্যাঁ, সে আপনি করতেই পারেন। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এই ঘুরে বেড়ানোটা নেশা নয়, নিয়তি। আগে বলুন, অতীতে আপনি কী খুঁজে বেড়ান?’

‘কী খুঁজি, তা নিজেও জানি না। একটা ব্যাকুল মন বর্তমানের সংঘর্ষ আর ভবিষ্যতের স্বপ্নের থেকেও বেশি ব্যস্ত করে তুলে আমাকে বলে, ইতিহাসেই তুই সব খুঁজে পাবি। ওখানেই সবকিছুর উত্তর আছে। আর তাই বোধহয় আমার মনটা এমন অতীতমুখী হয়ে গেছে।’

‘তবুও…কোনো একটা আকর্ষণের বিষয় তো নিশ্চয়ই আছে। তা বলা যাবে না বুঝি?’

‘আকর্ষণের কারণ যে একেবারে নেই, তা বলব না। আমি ইতিহাসের গল্প খুঁজি। পাষাণে নিঃশ্বাস খুঁজি, স্পন্দন খুঁজি, প্রেম সন্ধান করি। বলতে পারেন, আমি একজন কল্পনাজীবি। ইতিহাসের কাহিনি লিখি।’

‘বেশ বেশ। আপনার মতো অনেক মানুষই এখানে ছুটে আসেন লেখালিখি করার টানে। তা পেলেন কোনো কাহিনি? নতুন কিছু?’

‘না, এখনও কিছু পাইনি। আর প্রতিবার খুঁজতে বেরিয়ে যে পেতেই হবে এমন তো কোনও কথা নেই! তবে একটা কথা বলি, ওই লিখে ফেলা হাজার-হাজার গল্পের পরেও এমন অনেক গল্প থেকে যায়, যা শুধু মানুষের মুখে-মুখে ফেরে। আমি সেই গল্পগুলোই খুঁজি।’

‘সত্যিই আপনি কল্পনাজীবি! এই নিশুতি রাতে, প্রাচী নদীর তটে কেমন গল্পের টুকরো কুড়োতে বেরিয়েছেন! কুড়োনো হয়ে গেলে আবার ঘরে ফিরে যাবেন…।’

‘তা কেন হবে? গল্প কি আর ওভাবে মেলে? তবে ওই ঘুঙুরের শব্দ…আমার মন বলছে ওর পেছনে কিছু-না-কিছু কাহিনি তো আছেই। কিন্তু আপনি যে আবার ওইদিকে আমাকে যেতেই দিচ্ছেন না!’

‘বেশ বুঝতে পারছি, এই এলাকায় আপনি নতুন। আপনার গল্প সন্ধানে আমি বাধা দিয়ে ক্ষতি করেছি বটে, কিন্তু জানবেন যা করেছি আপনার ভালোর জন্যেই করেছি। তবে…’

‘তবে?’

‘আপনি চাইলে আমি কিন্তু আপনার লোকসানের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে পারি।’

‘ক্ষতিপূরণ? কিন্তু কীভাবে?’

‘একটা গল্প বলে…যে গল্পটা আগে কেউ বলেনি, কেউ শোনেনি।’

‘অ-পূ-র্ব! তবে ওটা ক্ষতিপূরণ নয়, আপনার অনুগ্রহ।’

‘বেশ, তা-ই। তবে আপনার কথা শুনে আপনার সম্পর্কে আমার মনে যে ধারণা তৈরি হয়েছে তাতে আপনি এই কাহিনির একজন উপযুক্ত দাবিদার। আসলে এখানে যারা আসে, তারা কেউ এভাবে গল্প খোঁজে না। তারা সাদা চোখে ইতিহাস খোঁজে। কিন্তু আপনাকেই প্রথম দেখলাম, আপনি পাষাণে শ্বাস, স্পন্দন আর প্রেম খুঁজছেন। আমার এই কাহিনিতে আপনি এসবের চেয়েও অনেক বেশি কিছু খুঁজে পাবেন। আমারও লাভ বইকি। কতদিন হয়ে গেল কারো সঙ্গে মন খুলে গল্প করিনি। আপনাকে এই কাহিনি শোনাতে পারলে আমিও শান্তি পাব।’

‘সবই তো বুঝলাম। কিন্তু এই কাহিনি শোনাতে নিশ্চয়ই অনেক সময় লাগবে। এমন নির্জন জায়গায় একজন অপরিচিত পুরুষের সঙ্গে এভাবে গল্প করতে আপনার ভয় করবে না? যদি আপনাকে খুঁজতে কেউ এসে পড়ে? আমাদের দেখে তারা কিছু বলবে না? আমাকে মাফ করবেন। আমার নিজেকে নিয়ে চিন্তা নেই। এখানে আমি পর্যটক। কিন্তু দেখবেন, আমার জন্যে আপনাকে অপবাদের পাত্র না হতে হয়। এত কথা বলছি কারণ, এটা আপনার পরিচিত এলাকা।’

‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। কোনো সমস্যা হবে না। প্রথম কথা হল, এদিকে কেউ আসবেই না, আর কেউ দেখলেও আমার তাতে কিচ্ছু যায়-আসে না। আমার কোনো পরিবার নেই। একটা সময়ে অবশ্য ছিল। স্বামী, শাশুড়ি-মা, দেওর…সবাই মারা গেছেন।

‘আপনার কথায় আর আপনার বাহ্যিক রূপে তো বিস্তর ফারাক দেখছি। কপালে সিঁদুর পরে আছেন, আর বলছেন আপনার স্বামী মারা গেছেন। স্বামী মারা যাওয়ার পরে কি কোনো ভারতীয় বিধবা নারী সিঁদুর পরেন?’

‘আমি মনে করি, আমার স্বামী তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে বেঁচে আছেন। এই সৌভাগ্য-সিঁদুর তাই আজও আমার সিঁথি আলো করে থাকে।’

‘আর সমাজ? সমাজকে ভয় করেন না?’

‘আপনার সমাজ আর আমার সমাজের মানসিকতায় কয়েক শতাব্দীর পার্থক্য, বন্ধু। আপনার সমাজ আমার মানসিকতাকে স্পর্শ করতে পারবে না। আমি আপনার সমাজের মানসিকতা নিয়ে চিন্তিতও নই। আসুন না, বসি। দুটো গল্প করি।’

একটা মিষ্টি গন্ধে মন মাতাল হয়ে উঠছে বারবার। ঝরনা ধারায় চাঁদের আলো ঝরে পড়ছে। চারিদিক থেকে ভেসে আসছে অদ্ভুত তালে লয়ে বেজে চলা সুমধুর শব্দ…

ছুম ছনন ছম ছুম ছনন ছম ছুম ছনন ছম ছুম…

ছনননন ছনননন ছনননন ছনননন ছুম ছনন ছম ছুম…

শিমুল গাছটার নীচে দুজনে বেশ ঘনভাবেই বসলাম। এতটাই কাছাকাছি যে তার শাড়ির আঁচল আমাকে অবিরত স্পর্শ করে চলেছে। না, এর মধ্যে কোনো কামনা নেই। যেন ভাইয়ের সঙ্গে বহু বছর পরে দিদির দেখা। এই ভালোবাসা অনন্য। সম্ভবত এটাই বন্ধুত্ব। অপরিচিত দুটি মানুষ সহসা জড়িয়ে পড়েছে একটা না-বলা কাহিনির রজ্জুতে। বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই বসে থাকার পর আমিই বললাম, ‘এবার শুরু করুন তাহলে শুনি!’

‘সেটাই তো ভাবছি, কোথা থেকে যে শুরুটা করি।’

‘একেবারে গোড়া থেকে—’

অপরূপা অদ্ভুত সুন্দরভাবে হাসলেন। মনে হল, এক নিমেষে চাঁদ নেমে এসেছে মাটিতে।

আমার চোখে চোখ রেখে তিনি বললেন, ‘আপনি লেখক মানুষ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনার লেখনীতে আমার এই কাহিনি জীবন্ত হয়ে উঠবে। কাহিনিটা কিন্তু দ্বাপর যুগের…। সেই যুগ তো আর আমি দেখিনি, কেবল তার গল্প শুনেছি।’

দ্বাপর যুগ! আমার গায়ে শিহরন খেলে গেল। যাক, আমি নিশ্চিন্ত, আমার সুন্দরী বন্ধুনীটি তাহলে গল্প-বলার প্রথম বিন্দু পেয়ে গেছেন।

‘এতদিনে কোনার্ক মন্দির নিশ্চয়ই ঘুরে দেখে ফেলেছেন? পাশেই একটা আশ্রম আছে। জনশ্রুতি আছে, এই আশ্রম দ্বাপর যুগের। কৃষ্ণের পুত্র শাম্ব এই আশ্রম তৈরি করেছিলেন। কৃষ্ণের আট পাটরানি ছিলেন—রুক্মিণী, জাম্ববন্তী, সত্যভামা, কালিন্দী, মিত্রবিন্দা, নগ্নজিতি, ভদ্রা এবং লক্ষ্মণা। এঁদের মধ্যে জাম্ববন্তীর গর্ভজাত সন্তান শাম্বকে নাকি অবিকল কৃষ্ণের মতোই দেখতে ছিল। একবার নাকি রুক্মিণীর পুত্র প্রদ্যুম্ন অপহৃত হয়েছিলেন বলে এই আটজন মা জাম্ববন্তীর পুত্রসন্তানটিকে কখনো নিজেদের চোখের আড়াল করতেন না। এবং এই কারণেই কৃষ্ণ মজা করে শিশুটির নাম রাখলেন সাম্ব। স-অম্ব; অম্বা বা অম্ব মানে মা। অর্থাৎ সাম্ব মানে যে সর্বদা মায়ের কাছে থাকে। সেই নামটাই লোকের মুখে–মুখে হয়ে গেল শাম্ব।

‘কৃষ্ণ নিজের জীবদ্দশাতেই একজন কিংবদন্তী যুগপুরুষে পরিণত হয়েছিলেন। তবে কৃষ্ণ বলুন বা আজকের রথী-মহারথী রাজনেতা, যুগপুরুষদের জীবনের সবথেকে বড় বিড়ম্বনা হল সাধারণ মানুষের সামনে তাঁদের মহিমা যত প্রবল হয়, ততই তাঁদের জীবনে আত্মীয়-কুটুমের প্রভাব ক্ষীণ হতে থাকে।

‘কৃষ্ণ তখন আর্যাবর্তের রাজনীতি নিয়ে ভয়ানক ব্যস্ত। স্ত্রী-পুত্রদের জন্য সময় নেই হাতে। আট মায়ের অতিরিক্ত স্নেহপ্রশ্রয়ে শাম্ব কিছুটা উদ্ধত হয়ে উঠেছিল। আগেই বললাম, শাম্ব আর কৃষ্ণকে আলাদা করে চেনা যেত না। শোনা যায়, সে নাকি কৃষ্ণের থেকেও বেশি সুদর্শন হয়ে উঠেছিল। আর কৃষ্ণপুত্র হওয়ায় গর্বে সে ছেলের মাটিতে নাকি পা পড়ত না। কিন্তু শাম্ব ছিল অবোধ শিশুর মতোই সরল।

মহর্ষি নারদ একদিন দ্বারকায় গেলেন। উদ্ধত শাম্ব তাঁকে যথোচিত সম্মান দিল না। নারদ ভারি অপমানিত বোধ করলেন।

পৌরাণিক কাহিনিতে আমরা নারদের ভূমিকা দেখেছি। তিনি কুচক্রী, তাল লাগাতে পারলে আর কিছু চান না। নারদ এই অপমানের প্রতিশোধ নিলেন অত্যন্ত ক্রূরভাবে। তিনি কৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাতে এক মোক্ষম চাল চাললেন, ‘দ্বারকাধীশ, আপনার পুত্র শাম্ব অজাচার করছে।’

কৃষ্ণ বললেন, ‘তাই নাকি? প্রমাণ দাও।’

নারদ এবার তাঁর প্রিয় খেলাটা খেললেন। তিনি শাম্বকে বললেন, ‘তোমার পিতা কৃষ্ণ রৈবতক পর্বতে তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন।’

শাম্ব তৎক্ষণাৎ রওনা হল সেখানে। রৈবতক পর্বতে পৌঁছে সে দেখল, সেখানে এক জলাশয়ে গোপিনীরা জলকেলি করছে। শাম্ব কিন্তু গোপিনীদের মাতৃজ্ঞানেই শ্রদ্ধা করত। কিন্তু সমস্যা বাধল অন্য জায়গায়। প্রেমভাবে মূহ্যমান গোপিনীরা শাম্বকে দেখে ভুল করে কৃষ্ণ ভেবে বসল। তারা শাম্বকে টেনে জলে নামিয়ে আলিঙ্গনে-চুম্বনে ভরিয়ে তুলল। শাম্ব কিন্তু গোপিনীদের আচরণকে মাতৃস্নেহ বলেই ভেবেছিল। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই তার দিক থেকে কোনো প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ আসেনি।

গোপিনীদের মাতৃপ্রেমে শাম্ব ডুবে গেল। সেই অবস্থাতেই কৃষ্ণকে রৈবতকে এনে নারদ সব দেখালেন, পুরো ঘটনাটাকেই নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করলেন। যুগপুরুষ কৃষ্ণের গর্জনে সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেল। ক্রুদ্ধ কৃষ্ণ নিজের ডান হাতের তর্জনী তুলে শাম্বকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘শাম্ব, তুমি মাতৃসমা গোপিনীদের সঙ্গে প্রণয়লীলা করছ, লজ্জা করছে না? যদি তুমি আমার পুত্র না-হতে, তবে আমার সুদর্শন চক্রে এতক্ষণে তোমার মুণ্ডচ্ছেদ হয়ে যেত। পুত্রমোহ আছে বলেই আজ তা সম্ভব হল না।

‘আমি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি শাম্ব, তোমার যে রূপ তোমার ঔদ্ধত্যের কারণ, সেই রূপই তোমার বিদ্রুপের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তোমার এমন অবস্থা হবে যে, তুমি লজ্জায় কারো সামনে দাঁড়াতেই পারবে না। তোমার এই রূপ, এই সৌন্দর্য থাকবে না, শাম্ব। যতদিন বাঁচবে, ততদিন নিজের অহংকারের স্মৃতি নিয়ে বাঁচবে। যদি জীবনের প্রতি মুহূর্তে আমি রাধাকে সত্যিই স্মরণ করে থাকি, যদি আজীবন আমি মাতা দেবকী এবং মা যশোদার মধ্যে কোনো বিভেদ না-করে থাকি, যদি রমণের কোনো মুহূর্তে আমার আট স্ত্রী’র মধ্যে কোনও ভেদাভেদ না–করে থাকি, এবং সর্বোপরি, আজকের আগে যদি কখনো কোনো অনৈতিক কাজ না-করে থাকি, তবে আজই, এই মুহূর্তে, তোমার শ্বেত কুষ্ঠ হোক! শাম্ব, যুগন্ধর কৃষ্ণ তোমাকে এই অভিশাপ দিল…’।

কৃষ্ণের এই অভিশাপের ফলস্বরূপ তৎক্ষণাৎ শাম্বের শ্বেত কুষ্ঠ দেখা দিল।

কৃষ্ণের হুঙ্কারে বাতাস স্তম্ভিত হল। দশ দিক কেঁপে উঠল। নারদ মুনি গ্লানিতে জড়ভরত হয়ে গেলেন। গোপিনীরা হায় হায় করে উঠল, ‘ক্ষমা…ক্ষমা করো কৃষ্ণ! ক্ষমা নন্দলাল! ক্ষমা করো শাম্বকে। পুত্রবৎ শাম্ব নির্দোষ, নিরপরাধ! হে মাধব, তুমি জীবনে কখনো কোনো অনুচিত কাজ না-করলেও তোমার আজকের এই অভিশাপে অন্যায় হল। তোমার ভুল ভাঙো, দামোদর। ওরে, কেউ রাধিকাকে ডেকে আন। হে মধুসূদন, ব্রজবালাদের আমরণ বিরহজ্বালায় জ্বালিয়েও কি তোমার শান্তি হয়নি যে, গোপিনীদের জুড়ে এই কলঙ্কের কথা সময়ের কপালে লিখে দিলে? যদি শাম্ব অপরাধী হয়ে থাকে, তাহলে গোপিনীরাই বা অপরাধ-মুক্ত থাকে কীভাবে? যদুকুলশিরোমণি, তোমার এই অভিশাপ ফিরিয়ে নাও। এই ভুলের মার্জনা করো, রাধাবল্লভ। আমরা শপথ করে বলছি, তোমার নামে শপথ করে বলছি, শাম্ব নির্দোষ।’

কৃষ্ণ বুঝে গেলেন যে, তিনি মস্ত বড় ভুল করে বসেছেন। তিনি পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করলেন, ‘আমি নিজের অভিসম্পাত ফিরিয়ে নিতে পারব না। তবে শাম্বকে এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ বলে দিচ্ছি। শাম্ব, সময় নষ্ট না-করে তুমি এখনই মৈত্রেয়বনে চলে যাও। সেখানে গিয়ে উপবাসে থাকো, জিতেন্দ্রিয় হও, অখণ্ড ব্রহ্মচর্য পালনের মাধ্যমে সূর্যদেবের উপাসনা করো। যদি সূর্যদেব কৃপা করেন, তাহলে অচিরেই তুমি সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করবে।’

‘ব্রহ্মচর্য? জিতেন্দ্রিয়? হা কৃষ্ণ, তুমি কি রুক্মিণীর আঁচলে নিজের মন, মতি, বুদ্ধি বেঁধে রেখে এসেছ? কুষ্ঠ-বিগলিত এই দেহ দেখে কে-ই বা শাম্বকে প্রলুব্ধ করতে আসবে? কোন রমণী শাম্বকে এই অবস্থায় দেখে লালায়িত হবে যে ওর ইন্দ্রিয়–নিগ্রহে বাধা আসতে পারে? জীবাত্মা এবং ব্রহ্মের মতো, পদ্ম এবং সূর্য বা অর্কের মতো, প্রাণবায়ু এবং জীবনের মতো আমাদের কাছে কৃষ্ণই স-ব। কৃষ্ণ ভিন্ন অপর কোনো পুরুষ আছে বলেও আমরা বিশ্বাস করি না। শাম্বকে অভিশাপ দেওয়া মানে আমাদের সেই বিশ্বাসকে অপমান করা, কৃষ্ণ। যদি শাম্বকে দেওয়া অভিশাপ ফিরিয়ে নিতে না-পারো, তাহলে আমরা, গোপিনীরাও, তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি যে, যে রাধার নামকে প্রতি মুহূর্তে স্মরণ করার শক্তিতে তুমি অভিশাপ দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করেছ, সেই রাধার নামও তুমি ততদিন পর্যন্ত মনে করতে পারবে না, যতদিন অবধি না শাম্ব সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে।

‘যাও কৃষ্ণ, আমরা তোমাকে ভুলব না, কিন্তু তুমি একমাত্র তখনই আমাদের মুখ দেখার অধিকার পাবে, যখন তোমার পুত্র শাম্ব নীরোগ হয়ে ফিরে আসবে। হতে পারো তুমি যুগন্ধর, হতে পারো তুমি এই জগতের পুরুষোত্তম, কিন্তু যদি তুমি ব্রজভূমির একবিন্দু দুধ-মাখনের প্রতিও ঋণী থেকে থাকো, তবে পুত্র শাম্বর রোগমুক্তির জন্য চেষ্টা করো।

‘আর, দেবর্ষি নারদ, আপনি…এখানে আপনার উপস্থিতি এবং আপনার গ্লানিভরা মুখ একথাই প্রমাণ করছে যে, এই কুচক্রের মূল পাণ্ডা আপনিই। যদি কৃষ্ণের প্রতি আমরা একনিষ্ঠ হয়ে থাকি, তবে আমরা আপনাকে অভিশাপ দিচ্ছি, দেবর্ষি, মহর্ষি ইত্যাদি শত অভিধায় ভূষিত হলেও আপনি কখনো ঋষি রূপে পূজিত হবেন না।

‘পুত্র শাম্ব, তুমি যাও। রুক্মিণী সমেত আট মাতা এবং রাধা সমেত তোমার এই সকল গোপিনী মায়েদের আশীর্বাদ তোমার সঙ্গে থাকবে। তোমার তপশ্চর্যা সফল হবে। রোগমুক্ত হয়ে ফিরে এসো। আমরা সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করব, পুত্র। তোমার রোগ-মুক্তির মাধ্যমেই আমাদের কলঙ্ক-মুক্তি ঘটবে।’

সবথেকে বড় বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুটাকে মন দিয়ে লক্ষ করলে তারও একটা কেন্দ্র পাওয়া যায়। জগতের কেন্দ্র যদি কৃষ্ণ হয়ে থাকেন, তবে তাঁর কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন রাধা। রাধা কিন্তু শুধু কোনো নাম নয়। রাধা একটি মন্ত্র। ‘রা’-এর অর্থ—‘প্রাপ্ত হোক’ এবং ‘ধা’ মানে ‘মুক্তি’। এই বিশেষ মন্ত্রই কৃষ্ণের প্রত্যেক শ্বাসপ্রশ্বাসে অজপা জপ হয়ে উচ্চারিত হতো। কিন্তু গোপিনীদের অভিশাপের ফলে সেই মন্ত্রই ভুলে গেলেন কৃষ্ণ। পিতা-পুত্র উভয়েই একইসঙ্গে অভিশপ্ত হয়ে গেলেন।

ব্যাধিগ্রস্ত, অনুতপ্ত, ব্যথিত শাম্ব রৈবতক পর্বত থেকে মৈত্রেয়বনের উদ্দেশে যাত্রা করল। চন্দ্রভাগা নদীর তটে আরম্ভ করল জিতেন্দ্রিয়, উপবাসী, ব্রহ্মচারী জীবনের তপস্যা। আজকের চন্দ্রভাগাই প্রাচীনকালের চিত্রোৎপলা এবং প্রাচী নামে পরিচিত ছিল। অঙ্গদেশের সিহাবা পর্বতশ্রেণী থেকে জন্ম নিয়ে সাগরে মোহানা অবধি নিজের অববাহিকাকে চন্দ্রভাগা সমৃদ্ধ করে তুলেছিল। আজ নাহয় নদীর জলের স্রোত কম। একটা সময়ে এই ধারাই চিরস্রোতা ছিল। গতিপথের স্থানভেদে ভিন্ন-ভিন্ন নামে পরিচিত এই নদী। গতিপথের শেষে এই নদীই চন্দ্রভাগা নাম ধারণ করে কটকের কাছে বঙ্গোপসাগরে মিশে গিয়েছে।

ওদিকে কিন্তু কৃষ্ণ নিজেও শাম্বর রোগ-মুক্তির জন্যে চিন্তাভাবনা করতে শুরু করেছিলেন। সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় ছিল ইন্দ্রের সাহায্য চাওয়া, কারণ অতীতে ইন্দ্রের সহায়তাতেই অপালা এই কুষ্ঠরোগ থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে আবার কৃষ্ণই ইন্দ্রের ক্ষমতা খর্ব করেছিলেন। গোবর্ধন পূজার মাধ্যমে ইন্দ্রের দেবত্ব হরণ এবং কৃষ্ণের দেবত্ব লাভ হয়েছিল। আপনি অনেক পড়াশোনা করেন, তাই একথা নিশ্চয়ই আপনাকে বুঝিয়ে বলতে হবে না, বন্ধু। আর এই রাজনৈতিক বিরোধের কারণেই কৃষ্ণের পক্ষে ইন্দ্রের কাছে সাহায্য চাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। অনেক ভেবেচিন্তে কৃষ্ণ অবশ্য একটা উপায় বের করলেন।

নিজের গুরু সান্দীপনি মুনির পুত্র পুনর্দত্তকে উদ্ধার করার সময়ে কিছু মগদেশীয় ব্রাহ্মণের সঙ্গে কৃষ্ণের পরিচয় হয়েছিল। এই মগ ব্রাহ্মণেরা আবার ছিল তন্ত্র-মন্ত্র এবং ওষধি-বিদ্যায় পারদর্শী। কৃষ্ণ মগদেশ থেকে সতেরোজন ব্রাহ্মণকে আহ্বান করলেন। উদ্দেশ্য একটাই—পুত্র শাম্বর রোগমুক্তি। এভাবে শাম্বর তপশ্চর্যার পাশাপাশি সতেরোজন মগ ব্রাহ্মণের চিকিৎসাও আরম্ভ হয়ে গেল।

এক-এক করে পল, ক্ষণ, প্রহর, দিন, পক্ষ, মাস, বছর গুনে গুনে চিকিৎসা ও তপস্যা চলল। দেখতে দেখতে বারো বছর কেটে গেল। একদিন চন্দ্রভাগাতে স্নান করার সময়ে শাম্ব নদীর জলে সূর্যদেবতার একটি মূর্তি কুড়িয়ে পেল। পাথরের মূর্তি। সে মূর্তিটা নিয়ে নদী থেকে উঠে এল সে।

সেই রাতেই সূর্যদেবের স্বপ্নাদেশ পেল কৃষ্ণ-তনয়, ‘নিজের সতেরো চিকিৎসক ব্রাহ্মণ দিয়ে নদী থেকে প্রাপ্ত মূর্তিটিকে প্রতিষ্ঠা করাও, শাম্ব। এই মূর্তির নির্মাণ স্বয়ং দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা করেছেন। আমার প্রিয় অস্ত্র তেজোপ্রভ নির্মাণ করার পরে অবশিষ্ট পাথরের খণ্ড থেকে এই মূর্তি সৃষ্টি করেছেন দেবশিল্পী। এই মূর্তিটির স্থাপনা এবং প্রতিষ্ঠা আমার পুত্র কর্ণের করার কথা ছিল, কিন্তু তোমার পিতা কৃষ্ণের ছলনাতেই কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে তার মৃত্যু ঘটে। যুগ যুগ ধরে সূর্য-পুত্রের বিরুদ্ধে এবং ইন্দ্র-পুত্রের পক্ষে বিষ্ণুর অবতারের ছলনা চলে আসছে। ত্রেতা যুগে আমার পুত্র বালির বিরুদ্ধে ইন্দ্র-পুত্র সুগ্রীবের হয়ে শ্রীরামচন্দ্র ছলনার আশ্রয় নিয়েছিলেন। দ্বাপরে সূর্য-পুত্র কর্ণের বিরুদ্ধে এবং ইন্দ্র-পুত্র অর্জুনের পক্ষে কৃষ্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। তাই আমি চাই, আমার এই মূর্তির স্থাপনা কৃষ্ণ-পুত্রের হাতে হোক। এবং এর নামকরণ হোক আমার পুত্র কর্ণের নামে—কর্ণার্ক। আমার এই মূর্তি কর্ণার্ক নামেই বিখ্যাত হবে। আমারই আদেশে চিত্রোৎপলা নিজের জলধারার মাধ্যমে এই মূর্তিটিকে অঙ্গ থেকে কলিঙ্গে বয়ে নিয়ে এসেছে। এই কর্ণার্ক মূর্তির স্থাপনা হলেই তুমি নীরোগ হয়ে যাবে। আমি সূর্যদেব, এই বর দিলাম যে, আজকের পর থেকে এই মর্ত্যলোকে যে ব্যক্তিই আমার নামে মন্দির নির্মাণ করে আমার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করবে, সে-ই তিরোধানের পরে সনাতনলোকের অধিবাসী হবে।’

যে স্থানে শাম্ব তপস্যা করেছিল, ঠিক সেখানেই সে একটা ছোট মন্দির বানিয়ে সূর্যদেবতার ইচ্ছানুসারে তাঁর মূর্তি স্থাপনা করল। মন্দিরটার নাম দিল কর্ণার্ক মঠ। আজও ওই মঠে নিরাকার–ওঙ্কার ব্রহ্মের প্রতীক রূপে কালো, মসৃণ পাথরে নির্মিত সূর্যদেবতার মূর্তির পুজো করা হয়। মঠের পিছনদিকে অবস্থিত একটি পর্ণকুটিরে আজও অখণ্ড ধুনি জাজ্বল্যমান। শাম্ব নিজের হাতে ওই ধুনিতে বৈষ্ণবাগ্নি জ্বালিয়েছিলেন। মঠের প্রাঙ্গণে সতেরোটি সমাধি-মন্দির রয়েছে—সেই সতেরোজন মগ ব্রাহ্মণের সমাধিস্থল।

দ্বাপর যুগে এই জায়গাটারই নাম ছিল মৈত্রেয়বন। সূর্যমন্দির নির্মাণের পরে কর্ণার্ক মঠের অনুসরণে এরই নাম হয়ে গেল কর্ণার্ক ক্ষেত্র। কিন্তু কর্ণ নিজেই একটি অভিশপ্ত চরিত্র ছিলেন। তাঁর ভাগ্যে অপযশ ছাড়া আর কখনো কিছুই জোটেনি। তাই তাঁর নাম থেকে এই স্থানের নামকরণ হলেও মানুষ ভুলে গেল কর্ণ থেকেই কর্ণার্ক শব্দটি এসেছে। এমনিতেই বাংলা ‘কথা’কে উড়িষ্যায় বলে ‘কোথা’। সবকিছুই একটু টেনে-টেনে উচ্চারণ করা হয় এদিকটায়। স্থান, কাল আর পাত্রের ভেদে এভাবেই ‘কর্ণার্ক’ হয়ে গেল ‘কোর্ণার্ক’। পরে মূর্ধন্য-ণ-এর মাথায় বসা রেফটুকুও জিভের সুখে উঠে গেল। পড়ে রইল কোণার্ক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *