সূর্য দেবী, পর্মল দেবী
ঐতিহাসিক বলছেন : ইসলাম ধর্মের উদয় হচ্ছে ইতিহাসের অন্যতম বিস্ময়কর ব্যাপার!
৬২২ খ্রিস্টাব্দে হজরত মহম্মদ সহায়-সম্পদহীন অবস্থায় প্রাণ রক্ষার জন্যে পালিয়ে যান মক্কা থেকে মদিনায়।
তারই কিছু-বেশি এক শতাব্দীকাল পরেই দেখা গেল, হজরত মহম্মদের অনুবর্তীরা যে সাম্রাজ্য স্থাপন করেছেন, তার বিস্তার আটলান্টিক সাগর থেকে সিন্ধুনদ এবং কাস্পিয়ান সাগর থেকে নীলনদ পর্যন্ত!
এই বিশাল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল ইউরোপের স্পেন, পোর্তুগাল ও দক্ষিণ ফ্রান্সের কতকাংশ; আফ্রিকার সমুদ্র-তীরবর্তী উত্তর অংশ, মিশর, আরব, সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া, আর্মেনিয়া, পারস্য, আফগানিস্তান, বেলুচিস্তান ও ট্রানসঅক্সিয়ানা।
তারপরও হজরত মহম্মদের উত্তরাধিকারী ও অনুবর্তীগণ খ্রিস্টর্ধমাবলম্বীদেরও একসঙ্গে পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে বারংবার আক্রমণ করতে ছাড়েননি—এক কনস্তান্তিনোপল নগরকেই তাঁরা অবরোধ করেছিলেন উপরি উপরি তিনবার।
কিন্তু ৭১৬ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় থিয়োডোসিয়াসের এবং ৭৩২ খ্রিস্টাব্দে চার্লস দি হ্যামারের কাছে যদি তাঁরা শোচনীয়রূপে পরাজিত না হতেন, তাহলে আজ হয়তো ইউরোপীয়দের হাতে হাতে থাকত বাইবেলের পরিবর্তে কোরান!
ওই দুই স্মরণীয় পরাজয়ের কিছু আগেই ইসলাম ধর্মের বিপুল বন্যা এসে উপস্থিত হয়েছিল পশ্চিম আর্যাবর্তের সীমান্ত পর্যন্ত।
তখন খলিফা ওয়ালিদের সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন হাজাজ! এই পূর্বাঞ্চলের সীমান্তের পরেই আরম্ভ হয়েছে ভারতবর্ষের সিন্ধুদেশ এবং সেখানে রাজত্ব করতেন ব্রাহ্মণবংশীয় রাজা দাহির।
ভারতবর্ষ তখন মুসলমান আরব-সন্তানদের নাম শুনেছিল অবশ্যই, কিন্তু আরবদের মনে যে ভারত আক্রমণের বাসনা জেগেছে, এমন কোনও সম্ভাবনার ইঙ্গিত তখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
তার বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, তন্ত্র-মন্ত্র, মন্দির-মঠ ও তেত্রিশ কোটি দেবতা এবং হাজার রকম সু আর কু সংস্কার প্রভৃতি নিয়ে আর্য ভারতবর্ষ তখন নিশ্চিন্ত হয়ে দেখত কেবল অতীত গৌরবের স্বপ্ন!
সারা ভারতবর্ষ ছোট ছোট রাজ্যের দ্বারা বিভক্ত। চন্দ্রগুপ্ত, অশোক, কনিষ্ক, সমুদ্রগুপ্ত বা হর্ষবর্ধনের মতো সাম্রাজ্য স্থাপন করতে পারেন, ভারতে তখন এমন প্রবল শক্তির অধিকারী ছিলেন না কেউ। ওরই মধ্যে যাঁরা অপেক্ষাকৃত বলবান রাজা, বৈচিত্র্য সন্ধানের জন্যে তাঁরা করতেন পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধ-বিবাদ!
বীরত্বের অভাব তাঁদের ছিল না, কিন্তু অভাব ছিল একতার। সকলে মিলে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে কোনও বহিঃশত্রুকে বাধা দেবার ক্ষমতা বা বিচারবুদ্ধি তাঁদের ছিল না। বহিঃশত্রুর আবির্ভাব হলে প্রত্যেকেই স্বতন্ত্রভাবে কেবল আপন রাজ্য সামলাবার জন্যেই ব্যস্ত হয়ে থাকতেন।
এইভাবেই দিন যাচ্ছিল। হয়তো আরও কিছু কাল কেটে যেত এইভাবেই।
আরবদের দৃষ্টি তখন ইউরোপের দিকে আকৃষ্ট, একতার অভাবে অন্তঃসারশূন্য হলেও ভারতবর্ষ তখন পর্যন্ত ছিল তাদের চোখের আড়ালে।
কিন্তু ভগবান বোধহয় চাইলেন নির্বোধ ভারতকে কঠিন দণ্ড দিতে। দৈবের লীলায় ঘটল এমন এক অভাবিত ঘটনা, আর্যাবর্ত করলে আরবের দৃষ্টি আকর্ষণ।
সুদূর সিংহলে ছিল কয়েকজন আরব সওদাগর। তাদের মৃত্যুর পর তাদের কন্যারা হল অনাথা। সিংহলের রাজা দয়াপরবশ হয়ে সেই অনাথা মেয়েগুলিকে জলপথে খলিফার পূর্বাঞ্চলের শাসনকর্তা হাজাজের নিকটে পাঠিয়ে দিলেন।
কিন্তু তাঁর এই দয়ার ফলেই হল ভারতবর্ষের সর্বনাশের সূত্রপাত! সব সময়েই ভালোর ফলে ভালো হয় না।
জলপথে খলিফার রাজ্যে যেতে গেলে পথিমধ্যে পড়ে সিন্ধুদেশের সাগরতট। সেইখানে একদল বোম্বটে খলিফার উদ্দেশে প্রেরিত জাহাজগুলিকে আক্রমণ ও লুণ্ঠন করে অদৃশ্য হয়।
সেই সংবাদ শুনে শাসনকর্তা হাজাজ রাজা দাহিরকে এক পত্র পাঠিয়ে জানালেন, অবিলম্বে দুষ্ট বোম্বেটেদের দমন এবং তাঁর ক্ষতিপূরণ করতে হবে।
রাজা দাহির উত্তর দিলেন, ‘বোম্বেটেরা আমার অধীন নয়। তাদের দমন করবার শক্তি আমার নেই।’
হাজাজ এই উত্তর সন্তোষজনক বলে মনে করলেন না। তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে খলিফার কাছ থেকে হুকুম আনিয়ে সেনাপতি উবেদুল্লাকে সসৈন্যে পাঠিয়ে দিলেন সিদ্ধুদেশ আক্রমণ করতে।
সিন্ধুদেশের প্রধান বন্দর দেবুলের নিকটে হল আরবের সঙ্গে ভারতের সর্বপ্রথম শক্তিপরীক্ষা। হিন্দুরা হল জয়ী। আরব সৈন্যদের কতক মারা পড়ল, কতক পালিয়ে বাঁচল। সেনাপতি উবেদুল্লাও দেহরক্ষা করলেন যুদ্ধক্ষেত্রে।
হাজাজ আরও বেশি সৈন্যের সঙ্গে আবার সেনাপতি বুদেলকে পাঠালেন দাহিরের বিরুদ্ধে।
ফল অন্যরকম হল না। এবারেও ভারতের ত্রিশূলের আঘাতে বিশ্বজয়ী আরবের অর্ধচন্দ্রাঙ্কিত পতাকা ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেল এবং নিহত হলেন সেনাপতি বুদেল।
রাগে ও দুঃখে হাজাজ পাগলের মতো হয়ে উঠলেন—খলিফার কাছে মান বুঝি আর থাকে না! তিনি বিপুল আয়োজন করতে লাগলেন তৃতীয় অভিযানের জন্যে।
এবারে সেনাপতি হলেন হাজাজের ভাইয়ের ছেলে ও জামাই ইমাদ-উদ-দিন মহম্মদ। তাঁর অধীনে ছিল খলিফার সর্বশ্রেষ্ঠ সৈন্যদল—উষ্ট্রারোহী ও অশ্বারোহী। সেই বিপুল বাহিনী নিয়ে মহম্মদ দেবুল দুর্গ অবরোধ করলেন (৭১১ খ্রিস্টাব্দ)। দুর্গের ভিতর ছিল মাত্র চার হাজার রাজপুত সৈন্য। তারা বেশিদিন দলে ভারী আরবদের বাধা দিতে পারলে না। দুর্গের পতন হল।
দেবুলের বাসিন্দাদের বলা হল, হয় মুসলমান হও, নয় মরো। হিন্দুরা ধর্ম ছাড়তে রাজি হল না। তখন নারী ও শিশুদের বন্দি করে প্রত্যেক পুরুষকে নিক্ষেপ করা হল তরবারির মুখে।
দেবুলের পতনের জন্যে দাহির কিছুমাত্র বিচলিত হলেন না। বললেন, ‘দেবুল তো নগণ্য জায়গা, আসল যুদ্ধ হবে এইবারে আমার সঙ্গে।’ তিনিও তোড়জোড় আরম্ভ করলেন।
দাহির ভুল বুঝেছিলেন। কোথায় বিশ্বজয়ী সম্রাট ওয়ালিদ—সাম্রাজ্য যাঁর তিনটি মহাদেশে বিস্তৃত, আর কোথায় দাহির—ভারতে একটি ক্ষুদ্র প্রদেশের রাজা! ধনবলে ও লোকবলে দুজনের মধ্যে তুলনাই চলে না! তবু যে দুই-দুইবার তিনি আরব অভিযানকে ব্যর্থ করতে পেরেছিলেন, এইখানেই দাহিরের বাহাদুরি।
ঠিক সেই সময়ে ভারতে দাহিরের চেয়ে ঢের বেশি শক্তিশালী রাজা ছিলেন। দাক্ষিণাত্যের প্রতাপশালী চালুক্য, পল্লভ ও রাষ্ট্রকূট নৃপতিরা যদি তখন দাহিরকে সাহায্য করতে আসতেন, তাহলে আরবদের ভারতে প্রবেশ করবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা হয়তো অঙ্কুরেই হত বিলুপ্ত।
কিন্তু আপন আপন প্রাধান্য বিস্তারের জন্যে তখন তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে গৃহযুদ্ধে নিযুক্ত, ভারত-সীমান্তে কালবৈশাখীর উদয় দেখবার সময় তাঁদের হয়নি।
বিশেষ করে রাষ্ট্রকূট নৃপতিরা এমন প্রবল পরাক্রান্ত ছিলেন যে, পরে আরব শাসনকর্তারা পর্যন্ত তাঁদের সঙ্গে বন্ধুত্ব-বন্ধন অটুট রাখবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টার ত্রুটি করতেন না।
দাহিদের সঙ্গে আরবদের সঙ্ঘর্ষের মাত্র চৌষট্টি বৎসর আগে উত্তরভারতের একচ্ছত্র সম্রাট হর্ষবর্ধন দেহত্যাগ করেছিলেন। তাঁর বলিষ্ঠ বাহু যতদিন অস্ত্রধারণে সক্ষম ছিল, ততদিন কোনও বিদেশি শত্রু ভারতে প্রবেশ করতে সাহসী হয়নি।
মহম্মদ সদলবলে অগ্রসর হতে লাগলেন, এবং জয়ী হলেন একাধিক ছোট ছোট যুদ্ধেও। কিন্তু তখনও রাজা দাহিরের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি।
দাহির বামনাবাদ থেকে রাওয়ারে এসে হাজির হলেন—সঙ্গে তাঁর পঞ্চাশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য।
আরবরাও সেইখানে এসে হাজির। দুই পক্ষই প্রস্তুত, কিন্তু সহসা কোনও পক্ষই আক্রমণ করতে অগ্রসর হল না।
এইভাবে গেল কয়েকদিন। দুই পক্ষই পরস্পরের গতিবিধি লক্ষ করে, এখানে-ওখানে মাঝে মাঝে দু-একটা হাঙ্গামা হয়—ব্যস, এই পর্যন্ত!
শেষটা দাহির আর স্থির থাকতে পারলেন না। ৭১২ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন তারিখে রণহস্তীর উপর আরোহণ করে তিনি উচ্চকণ্ঠে বললেন, ‘সৈন্যগণ, আরবদের আক্রমণ করো!’
আরম্ভ হল যুদ্ধ।
কেউ হটতে রাজি নয়—দুই পক্ষেরই সমান জিদ! কার শক্তি বেশি, তাও বোঝা অসম্ভব! ঝন ঝন বাজতে লাগল তরবারি, শন শন ছুটতে লাগল শূল ও বাণ, ঝক-মক জ্বলতে লাগল হাজার হাজার বিদ্যুৎ-শিখা! বর্মে-বর্মে ঠোকাঠুকির শব্দ, যোদ্ধাদের ভৈরব-গর্জন, মত্ত হস্তীদের বৃংহিত ধ্বনি, অশ্বদের হ্রেষারব, আহতদের চিৎকার—পৃথিবীর কান যেন ফেটে যায়!
যুদ্ধের পরিণাম যখন সম্পূর্ণ অনিশ্চিত, হঠাৎ ঘটল এক অঘটন।
আরব তিরন্দাজরা জ্বলন্ত তুলা-জড়ানো তির নিক্ষেপ করছিল। আচম্বিতে সেই রকম একটি তির এসে লাগল দাহিরের হাতির গায়ে। তিরের শাণিত ফলার সঙ্গে সঙ্গে জ্বলন্ত আগুনের বিষম স্পর্শ পেয়ে হাতি দাহিরকে নিয়ে পাগলের মতো পাশের নদীর ভিতরে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। নেতা ও রাজার সেই দশা দেখে হিন্দু সৈন্যরা যুদ্ধ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল স্তম্ভিত, চিত্রার্পিতের মতো।
নদীর মাঝখানে গিয়ে মাহুত অনেক কষ্টে হাতিকে শান্ত করলে। দাহির আবার তীরে এসে উঠলেন। আবার আরম্ভ হল যুদ্ধ।
ঐতিহাসিকদের বর্ণনায় জানা যায়, দাহির আরবদের মধ্যে গিয়ে পড়ে বিপুল বিক্রমে যখন শত্রুর পর শত্রু সংহার করছিলেন, তখন হঠাৎ এক তিরের আঘাতে আহত হয়ে হস্তীপৃষ্ঠ থেকে ঠিকরে পড়ে গেলেন মাটির উপরে।
কিন্তু তবু তিনি নিরস্ত হলেন না, সেই আহত অবস্থাতেই উঠে দাঁড়িয়ে আবার তিনি ঘোড়ার উপরে চড়তে যাচ্ছেন, ঠিক সেই সময়ে কোথা থেকে একজন আরব সৈনিক ছুটে এসে তরবারি চালিয়ে তাঁকে কেটে ফেললে।
সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ সাঙ্গ। নায়কের মৃত্যুতে হতাশ হয়ে হিন্দু সৈন্যরা রণক্ষেত্র ছেড়ে পলায়ন করলে। আকাশ-বাতাস পরিপূর্ণ হয়ে উঠল আরবদের জয়নাদে।
বারংবার এই একই দৃশ্যের অভিনয় হয়েছে ভারতবর্ষে। প্রধান নায়কের পতন হলে এদেশি সৈন্যরা আর রণক্ষেত্রে দাঁড়াতে চায় না। কিন্তু ইউরোপের বহু রণক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, প্রধান নায়কের মৃত্যুর পরেও তাঁর স্থান গ্রহণ করে দ্বিতীয় নায়ক সৈন্যদের চালনা করে নিয়ে গেছেন জয়ের পথে।
দাহির তো রণক্ষেত্রে বরণ করে নিলেন বীরের মৃত্যু এবং ভারতের মাটিতে সেইদিনই প্রথম কায়েমি হয়ে উড়তে লাগল অর্ধচন্দ্র-চিহ্নিত পতাকা, কিন্তু তারপর?
তারপর সিন্ধুদেশের রাজধানীতে যখন সেই খবর গিয়ে পৌঁছোল, দাহিরের প্রধানা রানি রানিবাই তাঁর সখীদের সঙ্গে আত্মহত্যা করে শত্রুদের কবল থেকে করলেন উদ্ধারলাভ।
তারপর? চরম যুদ্ধের পরেও হিন্দুরা মরিয়া হয়ে বামনাবাদে গিয়ে আর একবার ফিরে দাঁড়ালে। কিন্তু তারা আর ফেরাতে পারলে না ভারতবর্ষের দুর্ভাগ্যের স্রোত। যুদ্ধক্ষেত্রে আত্মবলি দিলে ছাব্বিশ হাজার হিন্দু। আরবরা দখল করলে বামনাবাদ। তারপর আর মাথা তুলতে পারেনি সিন্ধুদেশবাসী হিন্দুরা। মুসলমানদের ভারত-বিজয়ের অধ্যায় সম্পূর্ণ হল।
তারপর? বামনাবাদে ছিলেন রাজা দাহিরের দুই কুমারী কন্যা—সূর্য দেবী ও পর্মল (পরিমল) দেবী। তাঁদের রূপ দেখে চমৎকৃত হলেন বিজয়ী মহম্মদ। তিনি তাঁদের পাঠিয়ে দিলেন খলিফার হারেমের শোভাবৃদ্ধির জন্যে।
তারপর? হ্যাঁ, তারপরেও আরও কিছু বাকি আছে। অপূর্ব এই পরিশিষ্ট! এ হচ্ছে এক ঐতিহাসিক রূপকথা!
সূর্য দেবী, পর্মল দেবী! যেন স্বর্গীয় পারিজাতের দুটি হালকা পাপড়ি! রূপকাহিনির রাজকন্যারা যেন মূর্তিগ্রহণ করেছে তাঁদের মোহনীয় তনুলতার মধ্যে!
পবিত্র আর্যাবর্তের দুই রাজকুমারী, বন্দিনী হয়ে তাঁরা চলেছেন কোন অজানা সুদূরে, বিধর্মী আরব খলিফার ভয়াবহ হারেমে! এমন সম্ভাবনা তখনকার দিনে কল্পনা করাও অসম্ভব!
তাঁরা কাঁদছেন, কাঁদছেন আর কাঁদছেন; এবং কাঁদতে কাঁদতে মাঝে মাঝে তাঁরা গম্ভীর ও মূর্তির মতো স্থির হয়ে যাচ্ছেন; এবং তারপর মাঝে মাঝে গঙ্গাজলে-ধোয়া নির্মল ফুলের মতো অশ্রু-ভেজা মুখ দুখানি তুলে পরস্পরের সঙ্গে চুপিচুপি কী কথা বলছেন—যেন কী পরামর্শ করছেন! কিন্তু চুপিচুপি কথা বলবার দরকার ছিলনা। ভারতের ভাষা বোঝে না আরবরা।
সূর্য দেবী, পর্মল দেবী! খলিফার হারেমে হাজির হলেন তাঁরা যথাসময়ে।
দুই ভারতীয় রাজকুমারীর রূপের ছটা দেখে খলিফা ওয়ালিদের চক্ষু স্থির! শুষ্ক, দগ্ধ মরুর সন্তানের সুমুখে ভারতের স্নিগ্ধ সরস শ্যামল শ্রী মূর্তিমতী। চক্ষুস্থির হবার কথাই তো!
জ্যেষ্ঠ রাজকুমারীর কাছে এগিয়ে গিয়ে খলিফা বললেন, ‘আমি তোমাকে বিবাহ করব।’
সূর্য দেবী দুই হাত জোড় করে বললেন, ‘মহিমময় সম্রাট, আমাদের কারুর সঙ্গেই তো আপনার বিবাহ হতে পারে না!’
খলিফা সবিস্ময়ে বললেন, ‘কেন?’
সূর্য দেবী বললেন, ‘সম্রাটের সেনাপতি মহম্মদ আগেই আমাদের গ্রহণ করেছেন!’
খলিফা ভ্রূ সঙ্কুচিত করে বললেন, ‘তোমার কথার অর্থ আমি বুঝতে পারছি না।’
সূর্য দেবী বললেন, ‘সেনাপতি মহম্মদ গোপনে আমাদের বিবাহ করেছেন। আমরা সম্রাটের যোগ্য নই।’
খলিফা ওয়ালিদ বজ্র-কণ্ঠে গর্জন করে বললেন, ‘কী! আমার ভৃত্য মহম্মদের এতবড় স্পর্ধা! উত্তম, আমি এখনই তার পাপের শাস্তি বিধান করব!’
খলিফা ওয়ালিদ তখনই রাগে কাঁপতে কাঁপতে এক আদেশপত্র রচনা করলেন স্বহস্তে। তার মর্ম হচ্ছে এই : মহাপাপী মহম্মদ যেখানেই থাক, আমার এই আদেশপত্র পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন তাকে বন্দি করা হয়। তারপর কাঁচা গোচর্মের মধ্যে তাকে পুরে, চামড়া সেলাই করে আমার কাছে যেন পাঠিয়ে দেওয়া হয়—এই আমার হুকুম।
খলিফা জানতেন, কাঁচা চামড়ার মধ্যে মহম্মদের দেহ সুদূর ভারত থেকে তাঁর রাজধানীতে আসতে লাগবে অনেকদিন। এর মধ্যে কাঁচা চামড়া যাবে শুকিয়ে, সঙ্কুচিত হয়ে এবং তা মহম্মদের দেহের চারপাশে চেপে বসে করবে তার প্রাণসংহার! এ-রকম শাস্তি দেবার পদ্ধতি বোধহয় আরবদের দেশে বহুকাল থেকেই প্রচলিত ছিল।
রাজধানীতে যথাসময়েই এল চামড়ার থলির মধ্যে মহম্মদের মৃতদেহ।
খলিফা সেইদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে সূর্য দেবীকে সগর্বে বললেন, ‘দ্যাখো, আমার ভৃত্যরা কীভাবে আমার হুকুম তামিল করে!’
সূর্য দেবী বললেন, ‘সম্রাট, হুকুম দেওয়া খুবই সহজ! কিন্তু তার আগে সম্রাটের উচিত ছিল না, আমার অভিযোগ সত্য কি না সে-সম্বন্ধে খবর নেওয়া?’
খলিফা বিপুল বিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কী বলতে চাও?’
—’আমি মিথ্যাকথা বলেছি।’
—’মিথ্যাকথা বলেছ?’
—’হ্যাঁ সম্রাট, হ্যাঁ! মহম্মদ আমাদের বিবাহ করেননি।’
—’মহম্মদ তোমাদের বিবাহ করেনি!’
—’না।’
—’এমন মিথ্যাকথা বলার কারণ?’
সূর্য দেবীর দুই চোখে ফুটল আগুনের ফিনকি। তীব্র স্বরে বললেন, ‘কারণ নেই সম্রাট? আপনি কি এরই মধ্যে ভুল গিয়েছেন যে, মহম্মদ আমাদের জন্মভূমি কেড়ে নিয়েছে, আমাদের পিতাকে হত্যা করেছে? তাই আমরা নিলুম প্রতিশোধ!’
খলিফা ওয়ালিদ চিৎকার করে বললেন, ‘শয়তানি! তোদের জন্যে আমি আমার বিশ্বস্ত বিজয়ী সেনাপতিকে হারালুম। মৃত্যুদণ্ড! তোদের উপরেও আমি মৃত্যুদণ্ড দিলুম! এমন ভীষণ যন্ত্রণা দিয়ে তোদের হত্যা করা হবে যা তোরা কল্পনাও করতে পারবি না!’
সূর্য দেবী কী উত্তর দিয়েছিলেন, মুসলমান ঐতিহাসিকরা তা লিপিবদ্ধ করেননি। কিন্তু সূর্য দেবী ও পর্মল দেবী ছিলেন সেকালকার আর্যাবর্তের কন্যা। তখনকার হিন্দু মেয়েরা যে কেমন হাসিমুখে অনায়াসে প্রাণ বিসর্জন দিতে পারত, ইতিহাসে আছে তার অগুনতি প্রমাণ।
সুতরাং আমরা এটুকু অনুমান করলে অন্যায় হবে না যে, খলিফার কথার উত্তরে সূর্য দেবী হয়তো বলেছিলেন, ‘কী ভয় দেখাও সম্রাট? বিধর্মীর কবলে পড়লে ভারতের মেয়ে মৃত্যুকে দেখে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো! জন্মভূমির শত্রুকে আমরা ইহলোক থেকে বিদায় করেছি—আমরা পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিয়েছি! আর আমাদের বাঁচবার ইচ্ছা নেই—যা খুশি করতে পারো!’
এই গল্পটি বলেছেন মুসলমান ঐতিহাসিকরাই এবং ইউরোপীয় ঐতিহাসিকরাও এই গল্পটিকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকরা কাহিনিটিকে সত্য বলে মানতে রাজি নন!
গল্পটি রূপকথা কি না জানি না, কিন্তু সিন্ধু-বিজয়ের অল্পদিন পরেই মহম্মদকে যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়, তার ঐতিহাসিক প্রমাণের অভাব নেই।