সূর্যর দেশে

সূর্যর দেশে

রানি মাসিমারা সল্টলেকে বাড়ি করেছেন৷ মেসোমশায় রিটায়ার করার পর দিল্লির পাট চুকিয়ে এখন এদিকেই৷ এসে অবধি, যদিও পস্তাচ্ছেন৷ দিল্লির তুলনায় কলকাতাকে এখন সত্যিই গ্রাম বলে মনে হয়৷ কিন্তু এ জীবনের মতো দান দেওয়া হয়ে গেছে৷ এখন আর ফেরার উপায় নেই৷

এক ছেলে এক মেয়ে ওঁদের৷ মেয়ের বিয়ে হয়নি৷ বলে, বিয়ে করবেও না৷ এখন হায়দারাবাদে আছে৷ ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট ঝিনি৷ ছেলে ছোট৷ সে এই পোড়া দেশ সম্বন্ধে বীতশ্রদ্ধ হয়ে সোনার দেশ ইউ. এস. এ-তে চলে গেছে৷ সোনা খুঁজতে৷ অতএব মায়ের আজ্ঞায় আমার উপর ভার পড়েছে প্রতি রবিবার মাসিমা-মেসোমশায়ের খোঁজ করার৷ টালিগঞ্জ থেকে তাইই সল্টলেকে আসা৷

সেকটর ওয়ান-এ বাড়ি৷ অনেক সুন্দর সুন্দর ডিজাইনের বাড়ি হয়েছে এদিকে৷ ফাঁকা৷ চওড়া চওড়া পরিষ্কার রাস্তাঘাট৷ মনেই হয় না কলকাতায় আছি৷ বাস থেকে নেমে এক খিলি পান মুখে দিয়ে রাস্তাটা পেরুতে যাব ঠিক সেই সময় একটা মস্ত গাড়ি আমাকে প্রায় চাপা দিতে দিতে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল৷

খুবই রাগ হল৷ আমিও অন্যদেরই মতো৷ আমার নিজের গাড়ি নেই এবং গাড়ি কোনোদিনও হবার সম্ভাবনাও নেই বলে গাড়িওলাদের উপর আমার খুবই রাগ৷ আজকাল গাড়ি আর কার না আছে? আলতু-ফালতু সব লোকই গাড়ির মালিক! দেখলে গা রিরি করে৷

গাড়িটা থামতেই বেশ জুৎসই একটা কিছু বলব ভাবলাম ড্রাইভারকে৷ পানের পিক-এর সঙ্গে ঘেন্না মিশিয়ে ছুড়ে দেব ভাবলাম পিচের মসৃণ রাস্তার উপর৷ কিন্তু কিছু বলার আগেই, ড্রাইভিং সিটের দিকের দরজা খুলে ড্রাইভার নামলেন৷ পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা মোটা-সোটা এক ছোটখাটো ভদ্রলোক৷ চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা৷ নেমেই, আমার দিকে চেয়ে বললেন, এক্সকিউজ মি! আপনার নাম কি তপেন? তপেন রায়? আপনি কি মিত্র ইনস্টিট্যুশানে…

হ্যাঁ৷

আমি অবাক হয়ে বললাম৷

ভদ্রলোক আমার পিঠে একটা চড় মেরে বললেন, কী রে! তপু! আমাকে চিনতে পারলি না? আমি সূর্য৷

সূর্য৷ সূর্য! সূর্য?

আমি বোকার মতো চেয়ে রইলাম৷ চিনতে পারলাম না৷

আরে৷ আমি সূর্য রে! কাঁসারিপাড়ার৷

হঠাৎ মাথার মধ্যে স্মৃতি দৌড়ে এল নর্দমা থেকে ইঁদুরের মতো৷

ও ও ও৷ সূর্য! তাইই বল৷

চিনেছিস? যাঃ বাব্বা! তা তুই কোথায় যাচ্ছিস এখন? এদিকেই থাকিস নাকি? কী করিস এখন? বাড়ি করেছিস?

আমি হাসলাম৷ ভাবলাম সূর্যটা আজও সেরকমই বোকা আছে৷ বাড়ি-করা লোকদের চেহারা দেখেই বোঝা যায়৷ অথবা ব্যবহারে৷ আমি করব বাড়ি?

মুখে বললাম, টালিগঞ্জেই থাকি৷

সেই যেখানের আমবাগানের নীচে আমরা ফুটবল খেলতাম?

সূর্য শুধোল৷

হ্যাঁ৷ তোর মনে আছে দেখছি৷ তবে এখন দেখলে আর চিনতে পারবি না৷ ঝলমল করছে সব নতুন নতুন বাড়ি চারদিকে৷ মধ্যে কেবল আমাদের বাড়িটাই পড়ে আছে৷ হংসমধ্যে বক যথা৷ গলিটা একেবারে সরু হয়ে গেছে৷

চললি কোথায়?

মেসোর বাড়ি৷

নাম কী? এখানেই থাকেন?

মৃগেন বোস৷ সেকটর ওয়ান-এ৷

মৃগেন বোস মানে? ব্রিগেডিয়ার? গ্যারিসন এঞ্জিনিয়ার ছিলেন?

হ্যাঁ৷

বলিস কী রে? এতদিন তোর সঙ্গে দেখা হল না আমার? কী কড়া লোক মাইরি! উনি না থাকলে আমি এতদিনে কয়েক ক্রোড় বানিয়ে নিতাম৷ হান্ড্রেড পার্সেন্ট অনেস্ট৷ এই যুগে একেবারেই অচল৷ তোর মেসোমশাই হতে পারেন, কিন্তু মহা ঝঞ্ঝাটিয়া লোক৷ তবে এখনও সকলে খুব রেসপেক্ট করে৷

ও৷ তাইই বুঝি! টাকা আর রেসপেক্ট একই সঙ্গে সবসময় থাকে না অবশ্য৷

তা চল তোকে নামিয়ে দি৷ বাড়িটাও দেখা হয়ে যাবে৷

থাক, আমি হাঁটতে ভালোই বাসি৷ আর কতটুকুই বা দূর!

তাতে কী? চল৷ নামিয়ে দি৷ তোর কতক্ষণ লাগবে এখানে?

কী করে বলব? ওঁরা একা থাকেন৷ যা দরকার-টরকার তা কেনাকাটাও করে দিয়ে যাই৷ কাজের লোক তো এখানে ভালো পাওয়া যাচ্ছে না৷ একটি মেয়ে আছে৷ সে মাসিমার আয়ার কাজও করে আর টুকটাক কাজ৷

তা, কখন ফ্রি হবি তুই?

কেন বল তো?

তোকে আমার বাড়িতে নিয়ে যেতাম৷ ছোটবেলার বন্ধু বলে কতা৷ আজকে আমার বাড়ি খেয়েই যা না, গরিবের বাড়ি দুপুরবেলা, দুটি ডালভাত!

বললাম, দেখি কখন ছাড়া পাই ওখান থেকে৷

ওসব হবে না৷ তোকে ঠিক সাড়ে এগারোটায় গাড়ি পাঠাব৷ ড্রাইভার এসে নিয়ে যাবে৷

দেখি৷

আবার দেখি কি?

সূর্য আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেল মেসোর বাড়ি৷ ওর বিরাট সাদা গাড়িটা চলে গেল৷ কী গাড়ি, কে জানে? মনে হল, ইম্পোর্টেড৷ যাদের গাড়ি নেই তাদের গাড়ি সম্বন্ধে ভালো ধারণা থাকে না৷ আমারও কোনো ঔৎসুক্য নেই৷

মেসো বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসেছিলেন৷ রানি মাসি রান্নাঘরে কী করছিলেন৷

মেসো বললেন, কার সঙ্গে এলে?

আমার বন্ধু সূর্য৷ মিলিটারি কনট্রাক্টর৷ চেনেন নাকি?

সূর্য সেন? এ কোন সেকটারে কাজ করত তা বললে বুঝতে পারতাম৷ তবে আমি একজনের নাম শুনেছি সূর্য সেন বলে, সে এক নম্বরের চোর, প্রচুর পয়সা করেছে৷ সে তোমার বন্ধু হতেই পারে না৷ তোমার মতো বয়সে এত পয়সা করা সূর্য সেনের পক্ষেও সম্ভব নয়৷ এ নিশ্চয়ই অন্য কেউ৷ মার্সিডিজ গাড়ি! ভাবা যায় না৷

বাঙালিরা তো কিছুই ভাবতে পারে না৷ সবটাতেই আমরা উঃ! উঃ! করি৷ আর অন্য সকলেই মার্সিডিস না কি বললেন তা চড়ে বেড়ায়৷ একজন বাঙালি চড়লেই আমরা সকলে মিলে তার পেছনে লেগে যাই৷

সেটা কথা নয়, কথাটা হচ্ছে…

কী রে? কখন এলি তপু? চা খাবি তো?

রানি মাসিমা বললেন৷ ছোটো তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে এসে৷

তারপর বললেন, আজ মল্লিকে বাজারে পাঠিয়েছিলাম৷ ভালো পার্শে মাছ পেয়েছি৷ ধনেপাতা কালোজিরে কাঁচালংকা দিয়ে রাঁধছি তোর জন্যে৷ খাবি তো? খেয়ে যাবি না?

না রানি মাসি৷ হঠাৎই আমার স্কুলের এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল৷ সেও কাছাকাছিই কোথাও বাড়ি করেছে৷ সে পেড়াপেড়ি করছে, তার ওখানে খাওয়ার জন্যে৷

তোর বন্ধু? বাঃ ভালোই তো হল! তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলে সেও তো দেখাশোনা করতে পারবে আমাদের৷

সে যদি সেই সূর্য সেন হয় তপু তাহলে কিন্তু আমি তার সঙ্গে কোনোই যোগাযোগ রাখব না৷

সেই সূর্য সেন মানে?

রানি মাসিমা বললেন৷

আরে সে ছিল এক নম্বরের চোর৷ আমার সেকটরে থাকলে ব্ল্যাকলিসটেড করে দিতাম৷ ভয়ে কখনও আমার সামনে আসেনি৷

আপনাদের আর্মিতেও করাপশন আছে নাকি মেসো?

আমি অবাক হয়ে শুধোলাম৷

মেসো বললেন, অ্যাটমসফিয়ারে অক্সিজেনেরই মতো, হাওয়ার মধ্যে সূক্ষ্ম ধূলিকণার মতো এই ভারতবর্ষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে করাপশন ঢুকে গেছে৷ দেখি, রাজীব গান্ধী যদি এখন কিছু করতে পারেন৷ একটু চুপ করে থেকে বললেন, চিরদিনই অনেস্ট থাকলাম৷ আমি চালিয়াতি করি না৷ তবে আমার মোটা কাপড় মোটা ভাত তো জোটে৷ করাপটেড লোকেদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই৷

রানি মাসি ঝাঁঝালো গলায় বললেন, তোমার যত বাড়াবাড়ি৷ পৃথিবীর অন্য সকলেই করাপটেড আর তুমি একা ধোওয়া তুলসী পাতা৷ তোমার আক্ষেপ করা দেখে আমার তো মনে হয় তুমিই সবচেয়ে বেশি করাপটেড৷ মনের করাপশনও করাপশন বইকি৷

চুপ করো৷ যা বোঝো না, তা নিয়ে বেশি কথা বোলো না৷





ঠিক সাড়ে এগারোটার সময় মেসোর বাড়ির বাইরে বেরিয়ে দেখি সূর্যর গাড়ি তখনও আসেনি৷ তার বদলে কালো রঙা একটা ঝকঝকে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির সামনে৷

বোকার মতো চাইছি এদিক-ওদিক এমন সময় উর্দিপরা ড্রাইভার সেই কালো গাড়ি থেকে নেমে সেলাম করে বলল, সেন সাব ভেজিন হ্যায় হুজৌর৷

অবাক হয়ে এগিয়ে গেলাম৷ পেছনের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইল ড্রাইভার৷ আমি উঠলে, সযত্নে বন্ধ করল৷ তারপর অল্পক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম সূর্যর বাড়িতে৷ বাড়ি না বলে তাকে প্রাসাদ বলাই ভালো৷ লন, বাগান, দারুণ বারান্দাওয়ালা বাড়ি৷

সূর্য বরাবরই ক্যাবলা ছিল৷ পড়াশোনাতেও ভালো ছিল না৷ পেছনের বেঞ্চে বসত৷ মাঝে মাঝেই ক্লাস কাটত৷ এবং মাস্টারমশায়দের নির্দেশে বেঞ্চে দাঁড়াত৷ খেলত অবশ্য ভালো৷ খুব ভালো ইনসুয়িং বল করত৷ পড়াশোনায় যে খারাপ ছিল সেটা বড়ো কথা নয়৷ স্কুলের পরীক্ষাটাই সব নয়৷ জীবনও একটা পরীক্ষা৷ ব্যাটল অফ লাইফ৷ সেই পরীক্ষায় ও প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ স্কলার৷ আর আমি স্কুল ফাইন্যালে পঁয়ত্রিশ হওয়া সত্ত্বেও সরকারি অফিসের কেরানি৷ এইটাই ঘটনা৷ স্কুলের পরের বছরগুলোতে সূর্য অনেক মানুষের সঙ্গে মিশে, অনেক পরিশ্রমও করে, সৎভাবেই হোক কি অসৎভাবেই হোক সমাজে একজন কেউ-কেটা হয়েছে৷ আর আমি স্কুল-কলেজে যা শিখেছিলাম, তার সব কিছু এবং আমি যে ভালো-ছাত্র এই শ্লাঘাটুকুকেই বুকে করে ভিতরে-বাইরে ক্ষয়ে গেছি এই ক-বছরে৷

চাকরিতে যখন ঢুকেছিলাম তখন অনেক আশা ছিল, উৎসাহ ছিল৷ কিন্তু সরকারি চাকরির এই গরাদের মধ্যে থাকলে সিংহও ভীতু কুকুর হয়ে ওঠে৷ কাজ না করে করে এখন কাজ করার ক্ষমতাটুকু পর্যন্ত নষ্ট হয়ে গেছে৷ ইন্সপেক্টরশিপ-এর পরীক্ষায় পাশ করে বসে আছি গত আট বছর৷ এখনও অফিসার করল না আমায়৷ ভ্যাকান্সি নেই৷

লাভ কি? আমি একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছি৷ ফুরিয়ে গেছি৷ এখন আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না আর৷ তাইই সূর্যকে দেখে খুব ভালো লাগল৷ আমারই স্কুলের বন্ধু তো৷ স্কুলে যাকে বন্ধু বলে গণ্য করিনি এখন তাকেই পরমবন্ধু বলে প্রচার করতে চাইছে মন৷

সূর্য তার স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল৷ কালোর মধ্যে মিষ্টি চেহারা এবং দারুণ সপ্রতিভ৷ কথায় কথায় দারুণ-উচ্চারণের ইংরিজি বলছিলেন সুতপা৷ বললেন, তোমরা একটু লনে গিয়ে বোসো, আমি তোপসে মাছ ভাজা আর বিয়র পাঠিয়ে দিচ্ছি৷

সূর্য বলছিল, সুতপাদের বাড়ি দিল্লি! দিল্লিতেই আলাপ হয়েছিল ওদের৷

সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় সুতপা বললেন, ক’টায় খাবেন? আপনার বন্ধু কিন্তু অনেক পদ রান্নার ফরমাশ করেছেন৷ দুটো নাগাদ আমি ডাকব আপনাদের৷ তার আগে সব শেষ হবে না৷ ততক্ষণ খিদে বাড়ান৷

সূর্য বলল, তার আগে আমাদেরও খিদে পাবে না৷

লনের কুশন-লাগানো সাদা বেতের চেয়ারে বসে সূর্য বলল, এসব চলে তো রে তোর? একটু-আধটু ঢুকু-ঢুকু?

মুখে বললাম, কখনও-সখনও৷

মনে মনে বললাম, পরের পয়সায় হলে চলে৷ নিজে যা মায়না পাই তাতে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়৷ নিজের পয়সায় এসব করি এমন সামর্থ্য কোথায়?

খুবই আনন্দ হল৷ রাজপ্রাসাদে রাজকীয় অভ্যর্থনা পেলাম৷ সেদিন বিকেল চারটের সময় আমাদের পাড়ার গলির মোড়ে (কারণ আমাদের গলিতে গাড়ি ঢোকে না) যখন সূর্যর কালো উর্দিপরা ড্রাইভার সাদা মার্সিডিস গাড়ি করে আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেল তখন পান্ডে পানওয়ালা থেকে রতনমুদি পর্যন্ত সকলেই অত্যন্ত সম্ভ্রমের চোখে আমার দিকে তাকাল৷ আমি যে সত্যিই একজন ফেলনা মানুষ নই, সে সম্বন্ধে ওদের কোনো সন্দেহই আর রইল না৷

গলির মধ্যে ঢুকে, একটা সিগারেট ধরিয়ে হেঁটে যেতে যেতে ভাবছিলাম আমাদের উজ্জ্বল সব বন্ধু-বান্ধবরা, যারা উনিভার্সিটি থেকে উজ্জ্বলতর ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়েছিল তারা সকলেই আমারই মতো স্তিমিত তারা হয়ে টিমটিম করছে জীবনের আকাশে৷ সূর্যর দীপ্তি আর তার চোখ-ধাঁধানো ঔজ্জ্বল্য অন্য সকলকেই ম্লান করে দিয়েছে৷ নাথিং সাকসিডস লাইক সাকসেস৷

পরের রবিবার আমি মায়ের বিনা-অনুরোধেই রানি মাসির খোঁজ নেওয়ার জন্যে সল্ট লেকের দিকে যাব বলে বেরিয়ে পড়লাম৷ কিন্তু গলির মোড়ে আসতেই চমকে গেলাম সূর্যর সাদা মার্সিডিস গাড়ি দেখে৷ ড্রাইভার দরজা খুলে রানি মাসি আর মেসোকে নামাচ্ছে৷ মেসোর হাতে ‘মিঠাই’-এর সন্দেশের প্যাকেট৷ মুখে দারুণ হাসি৷

এই যে তপু! ঠিক সময়েই এসেছি বলো! পাছে তুমি বেরিয়ে পড়ো তাইই সকাল সকাল এলাম৷ আমরা আজ তোমাদের বাড়িতেই ডে-স্পেন্ড করব৷ গাড়ির বুটে গলদা চিংড়ি আর নারকোল আছে৷ বুনুকে বলতে হবে যেন জমিয়ে মালাইকারি রাঁধে৷

গলদা চিংড়ি!

মাথা ঘুরে গেল আমার৷ আজই সকালে বাজারে গেছিলাম৷ সত্তর টাকা কেজি৷

রানি মাসি আর মেসোকে মার কাছে পৌঁছে দিয়েই আমি বেরিয়ে গেলাম৷ তারপর রঞ্জিতদার দর্জির দোকান থেকে একটা ফোন করলাম সূর্যকে৷

সূর্যই ধরল ফোন!

বলল, কী রে তপু? গুড মর্নিং৷ আসবি নাকি?

নাঃ৷ কী ব্যাপার বল তো? সাতদিন আগে মেসোর এক রূপ দেখলাম৷ আর আজ অন্য রূপ৷ তুই দেখছি মন্ত্রজ্ঞ৷ কী করে করলি? এমন পরিবর্তন?

আমি কিছুই নই৷ করিওনি কিছুই৷

সে কীরে! আমি তো কিছুই বুঝছি না৷

তুই বুঝবি না৷ আসল কথাটা হচ্ছে মাইনে বা পেনশানের টাকায় কারোই যে কুলোচ্ছে না আজকাল৷ যে যতই অনেসট হোক না কেন৷ অনেস্টি ধুয়ে পেট চলছে না৷ আমি কেউই না৷ আসল ব্যাপারটা হচ্ছে ইনফ্লেশান৷ টাকা তো কাগজ হয়ে গেছে৷

বুঝলাম না৷ আমার মেসোর মতো লোককে বশ করলি কী করে? সেটা খোলসা করে বল৷

তোর মেসোকে আমি আমার কোম্পানির রিটেনার অ্যাপয়েন্ট করেছি৷ আমার লিয়াঁজো অফিসার৷ মাসে দু’হাজার টাকা মাইনে৷ ইন নাম্বার টু৷ এবং যখনই দরকার তখনই গাড়ি৷ আমার সঙ্গে ওঁর ডিপার্টমেন্টের লোকজনের একটু আলাপ-পরিচয় করিয়ে দেবেন শুধু৷ যখনই প্রয়োজন হবে৷ একটু ইনট্রোডাকশান৷ ওঁর এইটুকুই করবার৷

তোর মতো মানুষরাই মিলে সমস্ত দেশটাকে অসৎ করে দিলি সূর্য, এমনকী, আমার মেসোকেও৷ আনথিংকেবল৷ আফটার রিটায়ারমেন্ট!

ডোন্ট বি সিলি৷ আমি করিনি৷ ইনফ্লেশান করেছে৷ আমি তো নিমিত্ত মাত্র৷ আমি কট্টর সোস্যালিস্ট৷ ‘‘হ্যাভস’’রা যদি ‘‘হ্যাভ নটস’’দের না দেখে তো কে দেখবে বল? দেশের-দশের ভালোই করেছি আমি চিরদিন৷ এখনও করছি৷ এসব কথা থাক৷ চলে আয় তুই৷ আজও তোপসে মাছ আছে৷ রোদে বসে বিয়ার খাবি তো চলে আয়৷

আজ হবে না৷ আর কখনও হবে কি না তাও জানি না৷ যে কারণে আমার সল্ট লেকে যাওয়ার দরকার ছিল, সেই কারণটাকেই তো তুই উৎপাটন করে দিয়েছিস৷ উলটে মেসোই এখন আমাদের দেখাশোনা করবেন মনে হচ্ছে৷

তাহলেই দ্যাখ৷ ভালোই হয়েছে বল৷ শুধুই নিজের ভালো নয়, সকলের ভালো করাই আমার জীবনের মট্ট৷ ব্রত৷ আজ না আসিস তো আগামী রবিবারে আসিস৷ তোকে কিছু ভালো পরামর্শ দেব৷

বললাম, ছাড়ছি এখন৷

বাড়ির দিকে ফিরে আসবার সময় সূর্যর ড্রাইভারের সঙ্গে মুখোমুখি হল৷ সেলাম করল সে আমায় দেখে৷ বেশ ভালো লাগল৷ আবারও সকলে দেখল৷ পান্ডে পানওয়ালা, রতনমুদি৷ পাড়ায় আমার ইজ্জত বেড়ে গেল৷ ইকনমিক্স-এর প্রফেসর শ্যামবাবু এদিকে আসছিলেন৷ একবার সাদা ম্যার্সিডিস, কালো উর্দিপরা ড্রাইভারের দিকে তাকালেন উনি, তারপর আমার দিকে৷ বললেন, ভালো তো? তপুবাবু?

হেসে বললাম, ভালো৷

আসলে, বলতে চেয়েছিলাম, খুবই ভালো৷ না বললেও, শ্যামবাবু বুঝলেন৷ বিনয়ের সঙ্গে বললেন, একদিন আসুন বাড়িতে৷ আমাদের যে ভুলেই গেলেন একেবারে৷

না, না৷ যাব৷ ভুলব কেন?

হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম এক মিথ্যা সূর্যর একটা গাড়ি আর ড্রাইভারের প্রতিফলিত আলোতেই এই চাপা অন্ধকার গলি আলোকিত হয়ে গেল৷

কী আশ্চর্য!



Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *