সূর্যমুখী
ইহার পরে কেমন করিয়া যে দুটা বছর চোখের পলকে কাটিয়া গেল তাহা কেহ টেরই পাইল না। অনেক পরিবর্তনই ইতিমধ্যে ঘটিয়া গেছে। তন্মধ্যে সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা, ইহারা অচিরেই একটি নূতন অতিথির আগমন সম্ভাবনায় পুলকিত হইয়া উঠিয়াছে। আজকাল এই ভাবী শিশুটিই সকল প্রসঙ্গের মূল উৎস।
সমীরণের দিকে সুমুখ ফিরিয়া নূতন সেক্রেটারিয়েট টেবিলে ঠেসান দিয়া মেঝেয় বসিয়া মক্ষি একমনে সেলাই করিতেছিল। অকস্মাৎ কি কথা মনে পড়ায় সে বলিল,—ওগো শুনছ?
সমীরণ খাটের উপর শুইয়া একখানা নভেল খুলিয়া পড়িতেছিল,—অর্থাৎ তাহার ফাঁক দিয়া একদৃষ্টে মক্ষির পানে চাহিয়াছিল। সে হাসিয়া বলিল—না।
মক্ষি হাতের সেলাই মাটিতে রাখিয়া সমীরণের খাটে আসিয়া বসিল এবং তার হাতের বইখানি ছুঁড়িয়া টেবিলের উপর ফেলিয়া দিয়া বলিল,—সত্যবতী কি বলছিলো জানো?
সমীরণ অবিচলিতভাবে বলিল,—জানি।
সমীরণ যে কিছুই জানে না, তা মক্ষি বেশ জানে। রাগিয়া বলিল,—তুমি তো সবই জানো। বলো তো কি বলছিলো?
—বলছিলো তোমার খোকা হবে।
সমীরণের সম্বল যে শুধু অনুমান তাহা মক্ষি বুঝিল। একটু হাসিয়া তার গাল টিপিয়া দিয়া বলিল,—সব জানে।
সমীরণ হাসিয়া বলিল,—সব জানি, বোমা তৈরী করা থেকে কাপড়ের দোকান করা পর্যন্ত।
বোমা তৈরীর কথায় মক্ষির অনেক কথা মনে পড়িয়া গেল। বলিল,—আচ্ছা, আমার অনেক পরিবর্তন হয়েছে, না? তুমি ছিলে, যেদিন আমি আমহার্স্ট স্ট্রীট পোস্টাফিল লুট করে নিয়ে আসি? উঃ! এখন আর পারিনে বোধ হয়।
সে একবার আপনার হাতের পেশীগুলি দেখিল, কিছু নাই, সব ঢিলা হইয়া গেছে।
পাশ বালিশটা টানিয়া লইয়া সমীরণের পা-তলার দিকে কাৎ হইয়া শুইয়া পড়িয়া মক্ষি বলিল,—চুলোয় যাক। আর পেরেও কাজ নেই।
সমীরণ ব্যস্ত হইয়া সরিয়া গিয়া বলিল, ওকি, পা-তলার দিকে কেন?
মক্ষি পা-তলার দিকে আর একটু আরাম করিয়া শুইয়া বলিল,—একটু পুণ্য সঞ্চয় করে নিচ্ছি। তুমি হলে পতিদেবতা।
সমীরণ বিব্রতভাবে বলিল,—তা কি কোনো দিন বলেছি?
—তুমি কেন বলবে? আমার স্বার্থের খাতিরে আমি বলছি। আমি দেখলাম, অন্দরে বসে-বসে তোমার উপার্জনের অর্থে খাওয়া বেশ আরামজনক। বললাম, তুমিই আমার একমাত্র দেবতা, আমার ইহকাল-পরকাল, আমার সর্বস্ব। তুমি দেখলে, এ অতি সত্যি কথা। আমি কুঞ্জবনে পদ্মপত্রের ওপর শুয়ে বিরহ যাপন করতে লাগলাম। তুমি বন থেকে ফল এনে আমায় খাওয়ালে, ঝর্ণা থেকে অঞ্জলি-অঞ্জলি জল এনে নিজের হাতে আমায় পান করালে, গাছ থেকে পাতা এনে আমার জন্যে কুটির তৈরী করলে, এবং তারপরে তোমার গৃহলক্ষ্মীর পাহারায় কুটিরদ্বারে দিবারাত্রি ধনুর্বাণ হাতে জেগে বসে রইলে। এর পরেও তোমাকে পতিদেবতা বলবো না?
সমীরণ উত্তেজিতভাবে উঠিয়া বসিয়া বলিল,—তুমি আমায় ঠাট্টা করছ? কিন্তু আমি তো তোমাকে কোনো দিন অসম্মান করি নি।
সমীরণের উত্তেজনা দেখিয়া মক্ষি একটু গম্ভীর হইল। বুঝিল, কথাটা সমীরণকে ব্যথা দিয়াছে। অসীম সোহাগে ডানহাতখানি তার কোলের উপর ফেলিয়া দিয়া মক্ষি ঢিমা তালে বলিতে লাগিল,—একটু হয়তো পরিহাস করেছি, কিন্তু সবটা মিথ্যা নয়। মেয়েদের প্রেম হচ্ছে লতার প্রেম, একটা বড় গাছকে না জড়িয়ে ধরে সে দাঁড়াতে পারে না। বুকে হাত দিয়ে বলতো, তুমি চাও না সেবা, চাও না ভক্তি, চাও না আমার অধীনতা?—না, না, সত্য কথাকে বেঁকিয়ে লাভ নেই। দু’বছর ধরে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে তোমাকে পরীক্ষা করে বুঝেছি, তুমি এই সবই চাও। এ তোমাদের প্রবৃত্তি। এ তোমাদের পেশীবহুল বলিষ্ঠ দেহের ধর্ম। তোমাদের কোনো হাত নেই। এমন কি, এর জন্যে তোমাদের কিছুমাত্র লজ্জিত হবারও কারণ নেই।
দম লইবার জন্য মক্ষি একটু থামিল।
তারপরে বলিল,—আর আমাদের ঠিক তার উলটো-কোমল দেহ এবং কোমলতর মন নিয়ে আমরা তোমাদের কাছ থেকে আদর চাই, সোহাগ চাই এবং এরই জন্যে কত কৌশলই জন্ম থেকে আয়ত্ত করে ফেলি। আমার সোহাগ-নিবেদন দেখে মাঝে মাঝে তুমি অবাক হয়ে চাও, সে আমি জানি। তুমি ভাবো, এত কৌশল এ শিখলো কোথায়?
—কিন্তু হাঁসের ছানাকে সাঁতার শেখাবার জন্যে সাঁতার ক্লাবের মেম্বার হতে হয়? আমরা সোহাগ চাই, আদর চাই আর তারই লোভে তোমাদের সেবা করি, শুশ্রুষা করি তোমাদের পায়ের তলায় মাথা লুটিয়ে দিই—তোমাদের বলি পতিদেবতা।
—শুধু লোভে? অন্তরের কোনো প্রেরণা নেই?
মক্ষি হাসিয়া বলিল,—অন্তরের প্রেরণাই তো লোভ জাগায়। তোমাদের সেবা করে আমাদের আনন্দ হয়, সে আনন্দ আমাদের সমস্ত কাজে ছিটকে ওঠে দেখতে পাও না?
সমীরণ কহিল,কিন্তু আমরা কি তোমাদের সেবা করিনে, শুশ্রুষা করিতেন, তোমাদের পায়ের তলায় মাথা রেখে বলিনে, ‘স্মর গরল খণ্ডনং মম শিরসি মণ্ডনং দেহি পদপল্লবমুদারম’?
মক্ষি হাসিয়া বলিল,—বলো। কিন্তু তার মধ্যে ভক্তি থাকে না, থাকে স্নেহ, থাকে অনুকম্পা। ও হচ্ছে সোহাগ জানাবার একটা নতুনতরো ভান। কেমন জানো? মা ছেলেকে মাথার ওপর তুলে নাচিয়ে সোহাগ জানান, তাতে ছেলেরও মর্যাদা বাড়ে না, মায়েরও আসন ছোট হয় না। ও শুধু সোহাগ জানাবার একটা ভঙ্গি। কিন্তু আমরা যে তোমাদের পায়ের তলায় মাথা রাখি, সে সোহাগ জানাতে নয়, পূজো করতে।
সমীরণ তাহাকে একটা ঠেলা দিয়া বলিল,—যাও, তুমি অতি সেকেলে হয়ে পড়েছ।
—সেকেলেই তো। কিন্তু আজকে যে মত পুরোনো, পাঁচশো বছর পরে সেইটেকেই নতুন মত বলে আজকের মতোই তারা লাফালাফি করবে। পৃথিবীর মতবাদ, রাষ্ট্রীয়ই বলো, আর সামাজিকই বলো, ঘড়ির কাঁটার মতো একের ঘর থেকে লাফাতে লাফাতে বারোর ঘরে আসে, আবার সেখান থেকে লাফিয়ে একের ঘরে পড়ে।
সমীরণ বাধা দিয়া বলিল,—তা পড়ুক। কিন্তু তোমার মতো শিক্ষিতা মেয়েও যদি আজকের এই নারী-জাগরণের দিনে-
—রাখো, রাখো, তোমার নারী জাগরণের দিন। ওটা ছেলেদের একটা চাল, আর মেয়েরা না বুঝে তাতে লাফিয়ে পড়েছে। ওর মানে যে কি, সে আমি বুঝে নিয়েছি।
—কি বুঝে নিয়েছ তুমি?
—বুঝেছি, নারী-জাগরণ না হলে তিরিশ টাকায় আর কুলোয় না। দেখছি তো, বি.এ., এম. এ. পাশ করে তিরিশ টাকার জন্য ঝুলোঝুলি। সেই তিরিশ টাকাও পায় যাদের কপালের জোর খুব বেশী। সে ক্ষেত্রে নারী-জাগরণ না হলে শতকরা নব্বুই জনকে সন্ন্যাসী হয়ে থাকতে হয়। মক্ষি হাসিতে লাগিল।
সমীরণ উত্তেজিতভাবে বলিল,—বেশ তো, তাই না হয় সত্যি হল। কিন্তু তাতেই বা ক্ষতি কি?
—ক্ষতি তোমাদের নয়, ক্ষতি আমাদের। আমাদেরই এই সুখের ব্যবসা নষ্ট হয়ে যাবে। দিব্যি পায়ের ওপর-
বাধা দিয়া সমীরণ বলিল, আর এই যে সব অত্যাচার হচ্ছে, অমানুষিক নির্যাতন, নৃশংস প্রহার-
মক্ষি জোরে হাসিয়া উঠিল—থামো, থামো, সে অত্যাচার তুমি ঠেকাবে কি দিয়ে?
—কেন নারী-জাগরণ যদি হয়-
—কিচ্ছু হবে না। ইউরোপের যে কোনো দেশের খবরের কাগজগুলো একবার পড়, দেখবে সেই নারী-জাগরণের দেশেও প্রত্যহ কি অত্যাচার হচ্ছে। ওগো দয়ার সাগর, পুরুষের গায়ের জোর যতদিন বেশী থাকবে ততদিন ও অত্যাচার চলবেই। ওর প্রতিকার নেই। ওর জন্যে মাথা খারাপ না করে তুমি বরং দোকানে গিয়ে বসো গে, আমিও ও বাড়ী থেকে একটু ঘুরে আসি।
বলিয়া দরজার কাছ পর্যন্ত গিয়া আবার কি ভাবিয়া ফিরিয়া আসিয়া হাসিতে হাসিতে বলিল,—কিন্তু মারটা শুধু তো মার নয়, শাসনও। ওর যে অংশ পিঠের ওপর পড়ে সে অংশে দাগ বসায়। কিন্তু এখানে এসে অনেক মেয়েই তো দেখলাম, মনে তো হল না যে, মনের ওপর কোনো স্থায়ী দাগ বসে।
সমীরণের আরও একটু কাছে গিয়া মক্ষি টিপিয়া-টিপিয়া হাসিতে হাসিতে বলিল,—খুন এবং ডাকাতির অন্তত পাঁচটা ওয়ারেন্ট আমার নামে তো ঝুলছে, আমারই মনে হয়, একটু-আধটু তোমার হাতের মার বোধ হয় আমিই সইতে পারি।
বলিয়া মক্ষি আর এক সেকেন্ড না দাঁড়াইয়া সমীরণের মাথায় একটা ঝাঁকি দিয়া বাহির হইয়া গেল।
.
মক্ষি যেন অনেকটা বাচাল হইয়াছে,—কথা যেন বড় বেশী বলিতেছে। বিপ্লবীদলের যখন সে নেত্রী ছিল, তখন অবশ্য কথা কম বলিত না। বরং একটু কথা বেশী বলাই স্বভাব। কিন্তু মধ্যে যেন একেবারে চুপ হইয়া গিয়াছিল। সর্বদাই যেন একটা কিছু ভাবিত সমীরণ কাছে আসিলেই কেমন একটু সঙ্কুচিত হইয়া থাকিত।
এখন সে সঙ্কোচের চিহ্নমাত্র নাই! বরং সে-ই দিনের মধ্যে দশবার সমীরণকে ঠেলা দিয়া, নাড়া দিয়া, হাসাইয়া, অনাবশ্যক বকাইয়া অস্থির করিয়া তুলিত।
রাত্রে ঘুম তো নাই। সমীরণ বেচারা সমস্ত দিন দোকান করিয়া এবং এখান ওখান ঘোরা-ঘুরি করিয়া ক্লান্ত হইয়া ফিরিত কিন্তু চোখের পাতা বুজিবার উপায় কি? মক্ষি খাওয়া- দাওয়া সারিয়া, খাটের উপর আসর জমাইয়া বসিত বলিত,—এই যে, ঘুমুতে দিচ্ছি দাঁড়াও।
ঘুমের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পন্ন হইত। সমীরণ চোখ মেলিয়া উপরের দিকে চাহিয়া নূতন একটা গাঁজার দোকান খুলিবার উপায় চিন্তা করিত, আর মক্ষি কোথাকার কথা কোথায় টানিয়া আনিয়া অনর্গল বকিয়া যাইত এবং একবার করিয়া টান খোঁপা ঢিল করিত আর একবার ঢিল খোঁপা টান করিত। তারপর হঠাৎ এক সময় বলিত,—আচ্ছা, ঘুমোও। এবং সমীরণ পাশ ফিরিয়া শুইতে-না-শুইতে মক্ষি পাঁচ মিনিটের মধ্যে অঘোরে ঘুমাইয়া পড়িত।
মাঝে মাঝে সমীরণের অমনোযোগিতা ধরাও পড়িয়া যাইত। তখন তার আর লাঞ্ছনার সীমা থাকিত না। মুখখানি গম্ভীর করিয়া আপাদমস্তক কাপড় ঢাকা দিয়া মক্ষি ও-পাশ ফিরিয়া শুইয়া পড়িত। আর হাত ধরিয়া, বিনয় করিয়া ক্ষমা চাহিয়া, হাসাইবার চেষ্টা করিয়া সমীরণ যখন কোনো প্রকারেই ক্ষমা পাইত না, তখন অগত্যা বাধ্য হইয়া ক্ষুন্নমনে সে শুইয়া পড়িত।
কিন্তু এক মিনিট যাইতে না যাইতেই ও-পাশের ক্রুদ্ধ ব্যক্তিটি একটু অতিরিক্ত রকম সশব্দে নড়িয়া চড়িয়া এ-পাশ ফিরিত এবং সমীরণকে একটা ঠেলা দিয়া বলিত,—- ঘুমুচ্ছ যে বড়!
—তবে কি করবো? সমস্ত রাত খাটের ওপর ‘নাড়ুগোপাল’ হয়ে বসে থাকবো?
মক্ষি খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিত, বলিত,—হ্যাঁ, তাই থাকতে হবে। থাকোনা গো, থাকোনা। ওঠো-
তাহার ঠেলাঠেলিতে অস্থির হইয়া সমীরণ সজোরে তাহাকে বুকে চাপিয়া ধরিত। অমনি ঝড়ের সময় তেল ঢালিয়া দিলে বিক্ষুব্ধ সমুদ্র যেমন শান্ত হইয়া পড়ে, মক্ষি তেমনি এক মিনিটের মধ্যে শান্ত হইয়া তার বুকের মধ্যে এলাইয়া পড়িত। গভীর সুখে চোখ বুজিয়া আসিত।
সমীরণ এখন আর তাহাকে মক্ষি বলিয়া ডাকে না। কখনো বলে বিদ্যুৎ, কখনো বলে লতা।
বিদ্যুৎ হাসে, বলে,—কেন, মক্ষি নই কেন?
সমীরণ বলে,—না, মক্ষি নও। মক্ষিরাণীর সহস্র দাস মৌমাছি থাকে। আজ কিন্তু তুমি একান্ত করে শুধু আমারই।
সমীরণ তাহাকে কাছে টানিতে যায়। হাত ছাড়াইয়া লইয়া বিদ্যুৎ বলে,–এইতো, এইতো, এখন থেকেই একচেটিয়া অধিকার স্থাপন আরম্ভ হল?
সে পরিহাস সমীরণ গায়ে মাখে না। বলে, হ্যাঁ হল। তাতে কি?
বিদ্যুৎ বলে,—তাইতো। ছিলাম রাণী হলাম দাসী। কিন্তু তাতেও তৃপ্তি হল না, এখন করতে চাও ক্রীতদাসী।
সমীরণ হাসিয়া বলে,—তারও চেয়ে বেশী। ক্রীতদাসীকে লোকে বিক্রী করতে পারে, তোমায় আমি তাও পারবো না।
—পারবে না?
—না।
কিছুদিন হইতেই বিদ্যুতের মনে একটা খটকা লাগিয়াছে। তার মনে প্রশ্ন জাগিয়াছে, সমাজে তার ভাবী সন্তানের স্থান কোথায়।
বিবাহকে সে চিরদিনই একটা অপ্রয়োজনীয় অনুষ্ঠান বলিয়া মনে করিয়া আসিয়াছে। আজও সে মত শিথিল হয় নাই। কিন্তু এতদিন বিবাহকে দু’জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিল। দুটি নর-নারীর মধ্যে প্রেমের নির্ঝর যেখানে স্বতই উৎসারিত হইয়া ওঠে, সেখানে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা অশোভন। কিন্তু দুটি নর-নারীর মধ্যেই তো বিবাহের সমাপ্তি নয়। তাহাদের কল্যাণে, তাহাদের প্রেমে, তাহাদের পুণ্যে আরও বহু অতিথি এ সংসারে আসিবে। জনক-জননীর প্রেমের প্রতি তাহাদের যত বড়ই শ্রদ্ধা থাক, এবং যত বড় সত্যের মধ্যেই তাহাদের জন্ম হইয়াছে বলিয়া বিশ্বাস করুক, লোক সমাজে মুখ নামাইয়া চলিতে হইলে তাহারা জনক-জননীকে ক্ষমা করিতে পারিবে না।
সমাজ একটা আছে। সে সমাজ ভালো হোক মন্দ হোক, অত্যন্ত জরাজীর্ণ হোক, বাণপ্রস্থ না হইলে, তাহার অনুশাসন না মানিয়া উপায় নাই। এই অতি বৃদ্ধ অন্ধ- সংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের মধ্যে তাহার ভাবী-শিশুটিকে কল্পনা করিয়া বিদ্যুতের দুশ্চিন্তার আর অন্ত নাই।
অথচ, বিবাহ করিয়া বাঁধনটাকে আর এক দফা পাকা করিয়া লইবারও উপায় ছিল না। তাহাদের আগমনকাল হইতে এখানকার সকলেই জানে তাহারা বিবাহিত দম্পতি। তাহাদের চোখের সুমুখে নিজেদের মিথ্যাভাষণ স্পষ্ট করিয়া ধরিয়া দিবার সাহস হয় নাই। তাও বটে, আবার এখন যে সমস্ত প্রশ্ন উঠিয়াছে তখন সে সমস্ত প্রশ্ন উঠিবার অবসরই পায় নাই।
অথচ এই সমস্ত প্রশ্ন সমীরণের সম্মুখে উত্থাপন করিতেও সঙ্কোচ হয়। আপনার মনের মধ্যেই পুষিয়া রাখে। তার বসন্তকে ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ে। মনে পড়ে, মুখখানি কাঁচুমাচু করিয়া কেমন ভাবে সে তাহার কাছে কাছে ঘুরিত। তাহারই পাশে আপনার অজ্ঞাত সন্তানের মুখখানি কল্পনা করিতেও সে শিহরিয়া ওঠে।
সমীরণের কথার উত্তরে সে তাহার পানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হানিয়া বলিল,—কিন্তু যদি আমায় ত্যাগই করো, আমি কি করতে পারি?
বিদ্যুতের মনের এই চাঞ্চল্যের খবর সমীরণ রাখিত না। সে হাসিয়া বলিল,—তাহলে তুমিও আমায় ত্যাগ করবে।
এ উত্তরে বিদ্যুৎ সন্তুষ্ট হইতে পারিল না। একটু শীর্ণ হাসি হাসিল মাত্র। কিন্তু কোনো তর্ক করিল না, কিম্বা তাহার মনের ব্যথা কোথায় তাহাও জানাইবার চেষ্টা করিল না।
সমীরণ তাহাকে কাছে আকর্ষণ করিয়া বলিল,—এ আর ভালো লাগে না, বিদ্যুৎ -চল অন্য কোথাও যাই।
বিদ্যুৎ হাসিয়া বলিল,—কোথায় যাবে?
—যেখানে হয়। এ কাপড়ের দোকান আর ভালো লাগে না। বরং চল, আবার তেমনি করে বনে-জঙ্গলে ঘুরি। তেমনি করে আমলকী গাছের ছায়ায় তুমি আমার কোলের ওপর মাথা রেখে নিদ্রা যাবে, আর আমি সমস্ত রাত নির্নিমেষে তোমার মুখের পানে চেয়ে থাকবো। আর দিনের বেলায় ছায়ায় ঢাকা বন পথে-পথে দু’জনে শুধু ঘুরে বেড়াবো,—শুধু দু’জনে,—তুমি আর আমি। যাবে?
বিদ্যুতের যে লোভ হইতেছিল না, তা নয়। কিন্তু সে লোভ সম্বরণ করিয়া বলিল,—বেশ। আর যে তৃতীয় ব্যক্তি আসছে, সে?
তাহার কথা সমীরণের মনেই আসে নাই। বলিল, সে-ও সঙ্গে থাকবে,—কখনো তোমার কোলে, কখনো আমার কোলে।
এবারে বিদ্যুৎ গম্ভীর হইয়া বলিল,—তা হয় না। আমরা পারি, কিন্তু সে তা পারবে না। তার জন্যে তোমাকেও দোকান করতে হবে, আমাকেও সংসারের কাজে উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হবে। তার জন্যে বাড়ী চাই, আরও যা যা কিছু মানুষের দরকার তাও চাই।
সমীরণ পরিহাস করিবার চেষ্টা করিয়া বলিল,—সম্ভব হলে একখানা মোটরও চাই।
কিন্তু সে পরিহাসে বিন্দুমাত্র যোগ না দিয়া মক্ষি বলিল, হাঁ, সম্ভব হলে একখানা মোটরও চাই।
তার মুখের পানে চাহিয়া সমীরণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিল—তা ঠিক।
.
দিন কয়েক পরে।
এক সুপ্রভাতে সমীরণ আসিয়া জানাইল, গাঁজার দোকানটি পাওয়া গেছে।
সুখবর সন্দেহ নাই। সহরটি ছোট হইলেও গাঁজার দোকানে বিক্রী বড় কম হয় না। সে জন্য প্রতিবারই এই দোকানটির লোভে যত প্রার্থী আসিয়া উপস্থিত হয় তাহাদের সংখ্যা বড় কম নয়,—এবারেও গুজরাটি, মারাঠি, মাদ্রাজী, এমনকি যূথভ্রষ্ট পার্শী পর্যন্ত ছিল। তাহার মধ্যে এই দুর্বল এবং অতি অসহায় বাঙালীটির পক্ষে পথ করিয়া লওয়া বড় চারটিখানি কথা নয়। কিন্তু বড়বাবু সহায় থাকিলে কি না হয়?
তথাপি বিদ্যুৎ যেন এ সংবাদে ততটা সুখী হইতে পারিল না। বিদ্যুৎ শেলী পড়িয়াছে, কীটস পড়িয়াছে, সুইনবার্ন পড়িয়াছে, তার উপর মেয়েমানুষ,—অর্থাৎ এক কথায় ভদ্রমহিলা বলিতে যা বোঝায় তাই। পেটের দায়ে গাঁজার দোকান করায় তার মন তেমন সায় দিতে পারিল না।
শুধু বলিল,—বেশ।
সমীরণ উচ্ছ্বসিত হইয়া বলিল,—শুধু বেশ? মাসে তিনশোটি টাকা ফেলে ছেড়ে। এর আর মার নেই। বুঝলে বিদ্যুৎবরণী?
সম্বোধনের বাহার এবং বহর দেখিয়া না হাসিয়া পারিল না। একটু দ্বিধার ভঙ্গিতে সে বলিল, কিন্তু শেষটায় গাঁজার দোকান?
—তাতে কি? গাঁজা খাবো না তো, বিক্রী করব। তাতে দোষটা কি শুনি?
কিন্তু শুনিবার কোনো আগ্রহ না দেখাইয়াই সমীরণ বলিল,—লতা, তোমার ছেলের জন্যে একটি মোটর আসছে বারে নিও। ব্যস্।
ছেলের মোটরের সম্ভাবনায় বিদ্যুৎ হাসিয়া উঠিল। এমন কি, গাঁজার দোকানের দ্বিধাও যেন তিরোহিত হইল।
সমীরণ বলিতে লাগিল,—আর ছেলের মায়ের জন্যে ছেলের মায়ের জন্যে-
কিন্তু ছেলের মায়ের জন্য দিবার মতো জিনিস হাতের কাছে না পাইয়া সমীরণ বলিল,—ছেলের মায়ের জন্য কি বলো তো?
মক্ষি হাসিয়া বলিল,—একটা হাতী।
সমীরণ বিরক্তির ভান করিয়া বলিল,—না, না, হাতী না, হাতী আবার কি হবে? বলো না গো, ছেলের মায়ের জন্যে কি দেওয়া যায়?
দীর্ঘ দেহলতা তরঙ্গের মতো দুলাইতে-দুলাইতে কাছে আসিয়া বিদ্যুৎ বলিল,—বলবো?
—বলো।
সমীরণের কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া বিদ্যুৎ দুটি অক্ষরের একটি কথা বলিয়াই চকিতে দূরে সরিয়া আসিয়া হাসিতে লাগিল।
তাহাকে ধরিতে না পারিয়া অপ্রস্তুত ভাবে সমীরণ বলিল,—কিন্তু তার জন্যে গাঁজার দোকান করার দরকার কি? সে তো—
সমীরণ গম্ভীর হইয়া বলিল,—তুমি সত্যি বলেছ লতা, এ জীবনে আমার কাছে তোমার এবং তোমার কাছে আমার এর চেয়ে চাইবার জিনিস আর কি বা আছে। কিন্তু সে কথা কি বুঝি? কেবলি নিজেকে ক্ষিপ্ন করি, ক্লিষ্ট করি, হাঁফিয়ে তুলি,—যেন বলতে চাই, দেখ, তোমার জন্যে কতই আমি সইছি। এই পুরুষের প্রেম। এর সমস্ত ফাঁক অহঙ্কারের রসে ভরা। পৃথিবীর বুক ফাটিয়ে, সমুদ্রের তলা ঘেঁটে সে রত্ন তোলে শুধু প্রিয়ার গলার মাল্য রচনার জন্যে। এই পুরুষের প্রেম!
সমীরণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া শূন্যপ্রেক্ষণে বাহিরের পানে চাহিয়া রহিল।
প্রিয়ার ঠোঁটে যে এত মধু তাহা মক্ষিও সবে জানিয়াছে। সুদীর্ঘ বিপ্লবী জীবনে এ ক্ষুধা তাহার মনে বাসা বাঁধিবার অবসরই পায় নাই। আজ তাহার নিজেরই বিস্ময় লাগে, এ দুরন্ত তৃষ্ণা এতদিন তাহার মনের অতলে শান্ত হইয়া ছিল কি করিয়া? কিন্তু ছিল তো!
সুনিশ্চিত মৃত্যুর পূর্বাহ্ণে বিমলও ইহার বেশী আর কিছু চাহে নাই। কিন্তু সেদিন সে স্পর্শে তার দেহ মার্বেলের মত ঠাণ্ডা ও কঠিন হইয়া উঠিয়াছিল,কোথাও কোনো অনুভূতি ছিল না। এবং- এবং বিমলের প্রতি একটু ঘৃণার উদ্রেকও হইয়াছিল বুঝি। তারপরে—কিন্তু তারপরে একটা যুগ বহিয়া গেছে।
বিদ্যুৎ সমীরণের চিবুক ধরিয়া মুখখানি তুলিয়া ব্যঙ্গ করিয়া বলিল,—তুমি কাঁদছো?
বিদ্যুতের চোখের তারা চাপা হাসিতে কাঁপিতেছিল। সেদিকে চাহিয়া সমীরণ হাসিয়া ফেলিল। বলিল,—গাঁজার ভেন্ডার বলে তুমি আমায় উপেক্ষা করো না। মানুষের বুকের কথা মাঝে মাঝে ভাবতে আমিও চেষ্টা করি।
চোখে-মুখে বিস্ময়ের ভাব দেখাইয়া বিদ্যুৎ বলিল,—আশ্চর্য তো! তারপরে?
—তারপরে আবার সব গুলিয়ে যায়। কাপড়ের গাঁটে আর গাঁজার জটায় সব তাল পাকিয়ে যায়।
—বিপদ তো কম নয়। তুমি চিকিৎসা করাও।
গভীর আবেগে বিদ্যুৎকে আকর্ষণ করিয়া জোর করিয়া পাশে বসাইয়া তার একখানি হাত ধরিয়া সমীরণ বলিল,—তাই করাবো। কাপড়ের দোকান আর গাঁজা বিক্রি সব একদিন পিছনে থাকবে পড়ে, আর আমার সকল রোগের ওষুধ আছে যার কাছে তারই হাতে নিশ্চিন্ত করে সমস্ত ভার সঁপে দোব। তারও দেরী নেই।
বিদ্যুৎ তার হাতখানি রাইয়া লইয়া বলিল,—সে কি গো! “পুলিন যাবে ফরাক্কাবাদ চলে”?
—হ্যাঁ ফরাক্কাবাদ চলে, কিন্তু বাসা বাঁধবার জন্যে নয়—বলিয়া একখানি গান গাহিয়া মনের সঙ্কল্প জানাইবার জন্য কেবল সে মুখখানি ছুঁচল করিয়াছে এমন সময় বিদ্যুৎ তীব্রকণ্ঠে বলিয়া উঠিল,—
—তা তুমি পারো। তুমি অত্যন্ত নিষ্ঠুর, অত্যন্ত নির্মম, তুমি সব পারো।
বাসা ভাঙিবার প্রস্তাব বিদ্যুৎ মোটে সহিতে পারে না। আপনার নিভৃত নীড়টির উপর তার গভীর মমতা বসিয়া গেছে। কিন্তু তাহার উষ্মার কারণ কি তাহা সমীরণ বুঝিয়া উঠিবার পূর্বেই বিদ্যুৎ বলিল,—মেয়েদের ‘পরে তোমার যে শ্রদ্ধা নেই, এ তো সবাই জানে। আমার রূপের আকর্ষণেই তুমি পিছু নিয়েছিলে, সে মোহ এখন ভেঙেছে, এবার শিকল কেটে পালাবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছ।
এত বড় কঠোর মন্তব্যে সমীরণ ব্যথিত হইয়া বলিল,—তোমার রূপ অনন্ত, কিন্তু শুধু তারই আকর্ষণে আমি তোমার পিছু নিয়েছি এ মিথ্যা তুমি কেমন করে বললে?
কিন্তু তার কাতরতায় বিদ্যুৎ এতটুকু টলিল না। বলিল,—আমি বলিনি, বলেছ তুমি নিজে। তুমি নিজে স্বীকার করেছ নারীর যে-রূপ তা পুরুষকে লুব্ধ করে, মুগ্ধ করে, নারীর পিছু-পিছু টেনে নিয়ে বেড়ায়। তুমিই বলেছ, নারীর প্রতি পুরুষের যে শ্রদ্ধা তা এই।
কটুকণ্ঠে সমীরণ বলিল,—তা এই বটে, কিন্তু তোমার প্রতি আমার যে প্রীতি তা এই নয়। বলেছি, নারীর শক্তির ‘পরে আমার শ্রদ্ধা নেই। তার মানে এ নয় যে, তোমার স্নেহের ‘পরেও আমার শ্রদ্ধা নেই।
সমীরণকে এমন কটুকণ্ঠে কথা কহিতে বিদ্যুৎ কখনো শোনে নাই। সে অবাক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
সমীরণ বলিল, ‘পিছু নেওয়া’, ‘শিকল কাটা’ এ সব কথা তুমি কোথায় শিখেছ জানি না। কিন্তু মিথ্যে আঘাত দিয়ে আমার চোখে জল এনো না। পিছু আমি নিই নি, শিকল কাটার কোনো ইচ্ছাও জানাই নি। দোষ আমার এই যে আমি এ বাসা ভাঙতে চেয়েছি। কিন্তু, বিশ্বাস করো, মক্ষিরাণীর যে বাসার ‘পরে এত মমতা জন্মেছে, এ আমি আজ প্রথম জানলাম। কবিতা করার ইচ্ছে নেই, কিন্তু সত্যি বলছি, আজকে আমার বলে কিছু রাখিনি,–তোমার প্রেমে সমস্ত সমর্পণ করেছি।
সমীরণের চোখ দিয়া ঝরঝর করিয়া কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়াইয়া পড়িল। অপরাধীর মতো কাছে আসিয়া বিদ্যুৎ তার একখানি হাত নিজের করতলে গ্রহণ করিল। কিন্তু তাহাকে একটি সান্ত্বনার কথা বলিবার কিম্বা ত্রুটি স্বীকার করিবার কোনো অবসর না দিয়াই হাত ছাড়াইয়া লইয়া সমীরণ নিঃশব্দে জলভরা মেঘের মতো মন্থর গতিতে বাহির হইয়া গেল।
.
ভাবপ্রবণ দুটি তরুণ-তরুণী কখনো কখনো ভাব করিয়া কখনো ঝগড়া করিয়া এমনি ভাবে সংসার করে। ভাদ্রের মেঘের মতো কখনও আচম্বিতে হাসিতে হাসিতে এক পশলা বৃষ্টি হইয়া যায়, কখনও কাঁদিতে কাঁদিতে এক ঝলক রৌদ্রালোক খেলিয়া যায়। সর্বক্ষণ মেঘ জমিয়া থাকে ক্বচিৎ।
দিনান্তে সত্যবতীর সঙ্গে অন্তত একবার দেখা করা চাই-ই। বয়সে কিছু ছোট হইলেও সত্যবতীর অভিজ্ঞতা বেশী। দিনান্তে অন্তত একবার কাছে ডাকিয়া তাহার সঙ্গে চুপি-চুপি গত রাত্রের গল্প না করিলে বিদ্যুৎ হাঁফাইয়া ওঠে। এমন কি, বিশেষ-বিশেষ ক্ষেত্রে সত্যবতীর পরামর্শ লওয়ারও প্রয়োজন হয়।
সত্যবতী লেখা-পড়া জানে না, বয়সও কাঁচা। কিন্তু তাহার তূণে একেবারে মোক্ষম- মোক্ষম অস্ত্র সংগৃহীত আছে। সুতরাং উপদেশও দেয় বাছা-বাছা। সমীরণ কাঁদিতে- কাঁদিতে উঠিয়া গেছে শুনিয়া সে একেবারে পুলকিত হইয়া উঠিল।
বলিল,—দিদি, পুরুষ-মানুষকে দিনরাত্রি চোখের জলে ভিজিয়ে রাখতে হয়, তবে সে নরম থাকে। রাশ ঢিলে দিয়েছ কি মাথায় উঠেছে। এই দস্তুর।
দস্তুর তো বটে, কিন্তু বিদ্যুৎ অতখানি পারে না। সমীরণের চোখে জল দেখিলে সে অস্থির হইয়া ওঠে।
তাহার মনের ভাব বুঝিয়া সত্যবতী হাসিয়া বলিল,—দিদি, ওর পায়ে কাঁটা ফুটলে দাঁত দিয়ে তুলে দিতে পারি, ওর এতটুকু মঙ্গলের জন্যে বুকের রক্ত দিতে পারি। সে স্বতন্ত্র কথা। কিন্তু সংসার করতে গেলে, ওদের নাকে দড়ি পরাতেই হবে। নইলে ওরা সমস্ত উলটে দেবে। স্বামীর চোখে জল দেখলে কষ্ট হয় বই কি! কিন্তু কি আর করা যাবে? ওই যে ওদের ওষুধ।
বিদ্যুৎ দেখিল, কথাটা মিথ্যা নয়। সমীরণ যেন আইন-কানুন শান্তি-শৃঙ্খলা সমস্ত দু’পায়ে মাড়াইয়া শুধু তাহাকে বুকে করিয়া গ্রহে-গ্রহে ছুটিতে চাহে। এত উদ্দামতা সে সহিতে পারে না। সে চায় অশ্বত্থ গাছের একটুখানি ছায়া, দুটি চোখের একটুখানি মায়া, একটি ছোট নীড়।
বিদ্যুতের ভাবী শিশুর জন্য কাঁথা সেলাই করিতে করিতে সত্যবতী বলিল,—পুরুষ- মানুষ কেমন জানো? সেই যে কথায় বলে “খায়, আর বন পানে-পানে চায়”-তেমনি। ছুটে পালাবার জন্যে ব্যাকুল হয়েই আছে।
কাঁথা সেলাই দেখিতে দেখিতে একটুখানি মুচকি হাসিয়া বিদ্যুৎ বলিল,—কি নাম রেখেছে, জানো?
সেলাই হইতে মুখ না তুলিয়াই সত্যবতী বলিল,—না।
বিদ্যুৎ বলিল- অশোক। মানে কি জানো? যার কোনো শোক নেই। মানুষের ছেলের নাম অশোক! বিদ্যুৎ হাসিতে লাগিল।
সত্যবতী দুষ্টুমির হাসি হাসিয়া বলিল,—আর যদি মেয়ে হয়?
বিদ্যুৎ জোর করিয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না, না, মেয়ে কেন হবে? ছেলেই হবে।
আমোদ হইয়াছে বেশী দিবাকর প্রভাকরের। সত্যবতী বলিয়া দিয়াছে, শীঘ্রই তাহাদের ভাই আসিবে। কাঁথা সেলাই হইতে আরম্ভ করিয়া যত কিছু উদ্যোগ-আয়োজন চলিতেছে, সব সেই অনাগত ভাইটির জন্য। তাহার আগমনের প্রতীক্ষায় উহারা দুইজন অধীর হইয়া উঠিয়াছে। রোজ সকালে উঠিয়া একবার করিয়া জিজ্ঞাসা করে, মা ভাইটি এসেছে?
সত্যবতী হাসিয়া বলে,—আজকে কি রে! সে এখনো দু’মাস পরে।
দু’মাস কতদিন বেচারীরা জানে না। দু’দিন-পাঁচদিন পরে আবার জিজ্ঞাসা করে। সত্যবতী বলে,—সে কি রে! দু’মাস কি এখনো হয়েছে নাকি?
বার-বার মনঃক্ষুণ্ণ হওয়ায় ছেলে দুটি চটিয়া গেছে। এখন তাহারা রাগিয়া মুখ ভার করিয়া বলে,—ভাইটি আসবে, না হাতী আসবে?
ছেলে দুটি যেন কি! বিদ্যুৎ এবং সত্যবতী ইহাদের কথায় আকুল হয়।
বিদ্যুতের একটু ভয়ও হইয়াছে। এদেশের প্রসূতির মৃত্যুহার যে কত বেশী তাহা তাহার অজানা নয়। জীবনের ‘পরে কেমন যেন একটা মায়া বসিয়াছে। তাছাড়া সমীরণ আছে,—যে নিজে কোন কাজ করিতে পারে না; বিদ্যুৎকে সমস্ত জিনিস তার হাতের কাছে আগাইয়া দিতে হয়।
কিন্তু এ ভয় সে প্রকাশ করে না। শুধু যে কয়টা দিন বাঁচিয়া আছে সে কয়টা দিন নিবিড় করিয়া সমীরণকে জড়াইয়া থাকিবার চেষ্টা করে। তথাপি, সে ভয় সম্পূর্ণভাবে গোপন করিতেও পারে না। মাঝে-মাঝে এক-একটা প্রশ্নে তাহার মনের ভয় উৎকণ্ঠা প্রকাশ হইয়া পড়ে।
—আচ্ছা আমি মরে গেলে তুমি খুব কাঁদবে, না?
সমীরণ হাসিয়া বলে,—না, আমি পরমানন্দে রসগোল্লা খাব।
তাহার মৃত্যুতে যে সমীরণ কত ব্যথা পাইবে তাহা বিদ্যুৎ জানে। এ উত্তরে তাই সে মনে মনে খুশিই হয়। তবু প্রেম বারে বারে যাচাই করিবার মেয়েদের যে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি আছে, বোধ হয় তাহারই বশে মুখ ভার করিয়া বলে,—তা তুমি পারো। দু’দিন যেতে না যেতেই আবার একটা বিয়ে করে সংসার পাতবে।
বিদ্যুতের এলোচুলের প্রান্ত মুঠায় করিয়া চিপিতে-চিপিতে সমীরণ বলিল, নিশ্চয়। ওটা আমার একটা ব্যবসা কি না! আমার তিনটে ব্যবসা,—কাপড়ের, গাঁজার আর বিয়ে করার।
এবারে বিদ্যুৎ জোরেই হাসিয়া ফেলিল। বলিল,—নয় তো, বনে-বনে আমলকী গাছের ছায়ায় ছায়ায় দিব্যি ঘুরে বেড়াবে। সে একটা স্বপ্ন তো তোমার আছেই।
—তা আছে। কিন্তু সে স্বপ্নের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে মায়ার স্পর্শ দেবে সে তো তুমি। দেখ, স্বয়ং কবিগুরু রামচন্দ্রকে প্রাণ ধরে একলা, এমন কি শুধু লক্ষ্মণের সঙ্গেও বনে পাঠাতে পারেন নি। আর তুমি একলা আমায় বনে পাঠাতে চাও? হায় রে কলিকাল!
বিদ্যুৎ খুশি হইয়া যায় এবং নিদ্রা না আসা পর্যন্ত একলাই পুরাতন বিস্মৃত এবং অর্ধবিস্মৃত কাহিনী রোমন্থন করিয়া চলে। ঘুম বাড়িয়াছে, কিন্তু জাগিয়া থাকিবার ইচ্ছা আছে ষোল আনা।
.
ছেলেই হইল,—সুকুমার, কান্তিমান বলিষ্ঠ শিশু।
মক্ষির আর কাজের অন্ত নাই। দোলনায় শুইয়া শুইয়া অশোক আপন মনে খেলা করে, কাজ করিতে করিতে বিদ্যুৎ দশবার ছুটিয়া আসিয়া তাহাকে দেখিয়া যায়। চুমু খাইয়া, কোলে করিয়া, বুকে চাপিয়া ধরিয়া তাহার আর আশ মিটে না, সহস্রবার দেখিয়াও দেখা শেষ হয় না।
রাত্রে ঘুমাইয়া আছে, অকস্মাৎ চমকিয়া দেখিল, কোলের কাছে ছেলে নাই। বিদ্যুৎ ভয়ার্তকণ্ঠে সমীরণকে ঠেলা দিয়া জাগাইয়া বলিল, ওগো অশোক কই?
তাহার ভীতকণ্ঠে চমকিয়া সমীরণ তড়াক করিয়া বিছানার উপর উঠিয়া বসিল,—কি হয়েছে।
এমন সময় উভয়েরই দৃষ্টি পড়িল, অশোক পা-তলার দিকে দিব্য আরামে শুইয়া হাত-পা ছুঁড়িয়া ব্যায়াম-কৌশল আয়ত্ত করিতেছে। পা ছুঁড়িতে-ছুঁড়িতেই সে যে কখন পা-তলার দিকে সরিয়া গেছে বিদ্যুৎ কিছুই টের পায় নাই।
সে তাহাকে কোলে করিয়া বারম্বার চুমু খাইয়া বিশুদ্ধ বাংলায় উপদেশ দিতে লাগিল,—অমন দুরন্তপনা করিতে নাই। সবাই তাহা হইলে মন্দ বলিবে। রাত্রিতে শান্ত হইয়া চুপ করিয়া এক জায়গায় শুইয়া থাকিতে হয়।
এ উপদেশ কতখানি এই ছয় মাসের শিশু হৃদয়ঙ্গম করিল তাহা সে-ই জানে। সে শুধু কোলের উপর শুইয়া আরও স্ফূর্তিতে হাত-পা ছুঁড়িতে লাগিল এবং পিটপিট করিয়া চাহিয়া হাসিতে হাসিতে অস্ফুট শব্দ করিতে লাগিল।
বিদ্যুৎ বলিল,–ছেলেটা কি দুষ্টু হয়েছে দেখছ?
সমীরণ তখন শুইয়া পড়িয়া দ্বিতীয় পর্ব নিদ্রার আয়োজন করিতেছিল। বলিল,—তোমারই ছেলে তো!
তাহাকে একটা চিমটি কাটিয়া বিদ্যুৎ বলিল,—আর তোমার নয় বুঝি?
ও-পাশ ফিরিয়া শুইয়া সমীরণ বলিল,—কি জানি।
ছেলে কোলে করিতে সমীরণ মোটে পারে না। ইহার জন্য বিদ্যুতের কাছে তাহাকে নিত্য কম গঞ্জনা সহিতে হয় না। বিদ্যুতের মান ভাঙাইবার জন্য তাহাকে বাধ্য হইয়া মাঝে-মাঝে অশোককে কোলে করিতে হয়। বিদ্যুৎকে সে কিছুতেই বুঝাইতে পারে না যে, কোলে করিতে না পারাটা অক্ষমতার জন্য, ছেলের ‘পরে স্নেহ তাহার কম নয়। বিদ্যুৎ রাগিয়া বলে,—আমিও তো এর আগে ছেলে কোলে করিনি। আমি কি করে পারছি?
সমীরণ বলে,ও ক্ষমতা তোমাদের স্বভাবসিদ্ধ।
বিদ্যুৎ সে কথা কিছুতেই মানে না। বলে, আর অন্য পুরুষ-মানুষে ছেলে কোলে করছে না। দেখ গে, সত্যবতীর বরের-
কিন্তু ছেলেটা ভালো, বাপের দুঃখ বোঝে। কোলে চড়িয়া বেড়াইতেই সে ভালোবাসে না। সমীরণ মিনিট দুই কোলে করিয়া চুপি-চুপি এক কোণে তাহাকে নামাইয়া দিয়া সরিয়া পড়ে। ছেলেটা বেশ খেলা করে, কাঁদেও না, কিছু না।
বিপদ হইল, অশোক আরও একটু বড় হইয়া যখন রীতিমত হামা দিয়া টহল দিতে শিখিল এবং ভোজ্যাভোজ্য পৃথিবীর যাবতীয় বস্তুর আস্বাদ গ্রহণে ব্যগ্র হইল। তখন তাহাকে সামলাইয়া রাখা একা বিদ্যুতের পক্ষে অসাধ্য হইয়া উঠিল। ছেলে ধরিবার জন্য একটা লোক অবশ্য রাখা হইল। কিন্তু সে চব্বিশ ঘণ্টা থাকিতে পারে না, এবং চব্বিশ ঘণ্টা তাহার কাছে রাখিয়াও বিদ্যুতের বিশ্বাস হয় না।
একদিন তো প্রলয় কাণ্ড আরম্ভ হইল।
দুপুর বেলা। বিদ্যুৎ একমনে বসিয়া অশোকের একটা জামা সেলাই করিতেছিল। এমন সময় চাকরটা আসিয়া তাহার কাছে অশোককে নামাইয়া দিয়া খাইবার জন্য বাড়ী চলিয়া গেল। কতক্ষণ আর? আধ ঘণ্টার বেশী হইবে না, বিদ্যুৎ চাহিয়া দেখে, অশোক নাই। ভাবিল, বোধ হয় বাহিরে খেলা করিতেছে। ডাক দিল, কোন সাড়া আসিল না।
তাড়াতাড়ি বাহিরে আসিয়া দেখিল, কোথাও অশোক নাই। সমস্ত ঘর, এখন কি রান্নাঘর পর্যন্ত খুঁজিয়া আসিল, কোথাও নাই। সর্বনাশ! উঠানের এক কোণেই একটা ইঁদারা আছে। তাহার চারিদিকে উঁচু করিয়া যদিও ঘের দেওয়া আছে, কিন্তু বিপদ ঘটিতে কতক্ষণ। একবার ইঁদারার উপর ঝুঁকিয়া দেখিল, জল নড়িতেছে না! কিন্তু আধ ঘণ্টার উপর হইয়া গেছে। হয় তো এতক্ষণ ধরিয়া জল আলোড়িত হইয়া সবে শান্ত হইয়াছে। কিছু বিচিত্র নয়।
সমীরণ খাইয়া-দাইয়া গাঁজার দোকানে বাহির হইয়া গেছে, শীঘ্র ফিরিবার সম্ভাবনা নাই। বিদ্যুৎ কাঁদিয়া কাটিয়া, চুল ছিঁড়িয়া তুমুল কাণ্ড আরম্ভ করিয়া দিল। খিড়কীর এবং সদরের দুইটা দরজাই ভিতর হইতে বন্ধ। বাহিরে অশোক কিছুতেই যাইতে পারে নাই। তবে?
এমন সময় বারান্দার এককোণে শিশুর কান্না শোনা গেল। বিদ্যুৎ চিলের মতো একেবারে সেখানে ছুটিয়া গেল।
অশোকচন্দ্রই বটে। ওই কোণটায় কতকগুলা বেতের ঝুড়ি সারি সারি উঁচু করিয়া সাজানো ছিল। অশোক কি করিয়া সেখানে প্রবেশ করিয়াছিল এবং অর্ধঘণ্টার মধ্যে স্তূপের বাহির আসিতে না পারিয়া শেষ ব্রহ্মাস্ত্র ক্রন্দনের পন্থা অবলম্বন করিয়াছিল। বেচারা না পারে এদিকে আসিতে, না পারে ওদিকে যাইতে। বিদ্যুৎকে দেখিয়াই সে দু’হাত বাড়াইয়া দিল।
এমন সময় সদর দরজায় করাঘাত হইল এবং সমীরণের কণ্ঠ শোনা গেল, দরজা খুলে দাও।
অশোককে ভর্ৎসনা করা আর হইল না, সে তাড়াতাড়ি তাহাকে কোলে করিয়াই ছুটিয়া আসিয়া দ্বার খুলিয়া দিল। ইচ্ছা, পুত্রের বদলে পিতাকে বেশ দু’কথা শোনাইয়া দেওয়া। কিন্তু দ্বার খুলিয়াই এক জটাজুটধারী সন্ন্যাসীকে সমীরণের সঙ্গে দেখিয়া সে অবাক হইয়া চাহিয়া রহিল। কিন্তু পরক্ষণেই তাঁহার হাত ধরিয়া বলিল,—মেজ-দা! তুমি! সে প্রণাম করিতেও ভুলিয়া গেল।
মেজ-দা কিন্তু বিদ্যুতের কোলে ছেলে এবং তাহার চেহারার অপরূপ পরিবর্তন দেখিয়া বিস্মিতভাবে দাঁড়াইয়া রহিলেন। তাঁর ঋজু দীর্ঘ দেহ ঈষৎ নুইয়া পড়িয়াছে, চোখের সে তীব্র জ্যোতি নাই, মুখে-চোখে একটা শান্ত সুস্থির ভাব। সে-দৃষ্টির পানে চাহিয়াই বিদ্যুৎ বুঝিল, মেজদার বিস্ময় কোথায়। অসীম লজ্জায় সে নতনেত্রে সঙ্কুচিত অপরাধীর মতো দাঁড়াইয়া রহিল। আর সমীরণ পাশ কাটাইয়া একেবারে ঘরের ভিতরে সরিয়া পড়িল।
গাঁজার দোকান হইতে ফিরিবার পথে সমীরণের সঙ্গে মেজদার দেখা। প্রথমটা সমীরণ তত খেয়াল করে নাই, পাশ কাটাইয়া চলিয়া আসিতেছিল। মেজ-দা কিন্তু তাহাকে চিনিতে পারিয়া সুমুখে আসিয়া পথ আগলাইয়া দাঁড়াইয়া হাসিতে লাগিলেন। তখন সমীরণ তাঁহাকে চিনিতে পারিল, এবং পায়ের ধূলা লইয়া বাসায় নিয়া আসিল। বিদ্যুৎ যে এখানে আছে, সে কথা সে বলিয়াছে। কিন্তু তার বেশী আর কিছু লজ্জায় বলিতে পারে নাই।
কতক্ষণ পরে মেজ-দা গভীর বেদনায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন,—চলো, ঘরে যাই।
দীর্ঘশ্বাস ফেলিবারই কথা। অপরিসীম স্নেহে যে মেয়েটিকে একটু-একটু করিয়া নিজের হাতে তিনি মানুষ করিয়া গিয়াছিলেন, তীর্থপর্যটন হইতে প্রত্যাগমন করিয়া তাহাকে আর ফিরিয়া পাইবেন না, ইহা কি তিনি স্বপ্নেও ভাবিয়াছিলেন? যে মেয়েটি পার্বত্য ঝরণার মতো কুটিল তরঙ্গভঙ্গে নাচিতে নাচিতে বুকে ঝাঁপাইয়া পড়িত, মেজ-দা বুঝিলেন, সে গেছে নিঃশেষ হইয়া। এইখানে তিনি ভুল করিলেন। সে নিঃশেষ হয় নাই বরং ভাদ্রের নদীর মতো কূলে কূলে ছাপাইয়া উঠিয়া নিঃশব্দে বহিয়া চলিয়াছে। লঘু গতি গুরু হইয়াছে।
বিদ্যুৎ মেজ-দাকে তাহাদের শয়ন কক্ষে লইয়া আসিতে পারিল না। আগে যে ঘর- খানিতে সে-শুইত, সেইখানে তাঁহার জন্য আসন পাতিয়া দিল। আস্তে আস্তে বলিল,—তোমার হাত মুখ ধোবার জল আনি?
মেজ-দা মেঘের মতো গম্ভীর মুখে বলিলেন,—আনো।
অতবড় জটা এবং অতবড় দাড়ি অশোক ইতিপূর্বে কখনো দেখে নাই। ভয়ে ভালো করিয়া সে ও-দিকে চাহিতেও পারিতেছিল না, আবার কৌতূহলও দমন করা অসাধ্য। বিদ্যুৎ তাহাকে লইয়া বাহির হইয়া আসিতে সে যেন বাঁচিয়া গেল।
শোবার ঘরে আসিয়া বিদ্যুৎ তাহাকে সমীরণের কাছে নামাইয়া দিয়া নবোঢ়া বালিকার মতো চুপে চুপে বলিল,—তুমি মেজ-দার কাছে বোসো গে। আমি হাত-মুখ ধোবার জল দিয়ে একটু খাবারও তৈরি করবো কি না।
সমীরণ পা ঝুলাইয়া খাটের উপর বসিয়াছিল, এই প্রস্তাবে একেবারে, চিৎ হইয়া শুইয়া পড়িয়া শুধু বলিল,—ওরে বাবা!
নিজের দুর্বলতায় বিদ্যুৎ নিজের উপরই বিরক্ত হইতেছিল। তারই ঝাঁজ সে সমীরণের উপর ফেলিল, বলিল,—ওরে বাবা কেন? মেজ-দা কি বাঘ না ভালুক?
সমীরণ কিন্তু তথাপি আশ্বাস পাইল না। ও-পাশ ফিরিয়া শুইল।
এমন সময় ও-ঘর হইতে মেজ-দার কণ্ঠ শোনা গেল,—মণি কোথায় গেল?
সঙ্গে-সঙ্গে বিদ্যুৎ দ্রুতপদে বাহির হইয়া গেল এবং সমীরণ তড়াক করিয়া লাফাইয়া উঠিয়া বলিল,—আজ্ঞে এই যে, যাই।
বহুদিন পরে সেই পুরাতন ডাকে মেজ-দা আবার তাহাকে ডাকিলেন। সমীরণ খোকা কোলে করিয়াই ও ঘরে চলিয়া গেল। বিদ্যুৎ জল আনিয়া বারান্দায় রাখিল। মেজ-দা হস্তপদ প্রক্ষালন করিয়া সমীরণের সঙ্গে গল্প করিতে বসিলেন।
অনেকক্ষণ পরে বিদ্যুৎ যখন চা ও খাবার লইয়া আসিল, তখন অশোকচন্দ্র তাহার জটাধারী মামার কোল জাঁকাইয়া বসিয়াছে এবং সভয়ে মাঝে মাঝে দাড়িতে ও জটায় একবার করিয়া আঙুল ঠেকাইয়াই সরাইয়া লইতেছে। ওই ঘন জঙ্গলে ভীতিপ্রদ কত কি যে থাকিতে পারে বলা তো যায় না।
মেজ-দা বলিতেছিলেন,—এ আমি জানতাম। রক্তবিপ্লব কোনো দিন এদেশে সফল হতে পারে না, কোনো দিন না। তবু যখন তোমাদের ছেড়ে চলে আসি, তখন নিঃসংশয় হতে পারি নি। তাই তোমাদের বাধা দিই নি। যদি বুঝতাম, স্বাধীনতা একটা পদার্থ, যা ওরা আমাদের ঘর থেকে চুরি করে নিয়ে ওদের রাইটার্স বিলডিংসের টেবিলের দেরাজে লুকিয়ে রেখেছে, তাহলে বলতাম, চল সমীরণ একদিন রাত্রে সেটা চুরি করে নিয়ে এসে স্বস্থানে রেখে দিই গে।—তুমি বলতে পারো, ওদের কোন বাড়ীতে আমাদের স্বাধীনতা লুকোনো আছে, কোন লোকটির কাছে? সমীরণ, স্বাধীনতা অন্তরের ধন, আমরা নিজের দোষে তা খুইয়েছি। পরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে সান্ত্বনা হয়তো মিলবে, কিন্তু তাতে কোনো লাভ নেই।
মেজ-দা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন,—সমস্ত ভারতবর্ষ তো ঘুরে এলাম। সবাই গান্ধীরাজের জন্যেই ব্যস্ত, স্বরাজের ‘পরে কারো কোনো বিশেষ লোভ আছে বলে তো মনে হল না। স্বরাজের কামনা হয়তো মনের অতলে লুকিয়ে কোথাও আছে, আজও দলগুলি মেলতে পারে নি। যাবে সমীরণ, এই কোটি-কোটি স্বদেশবাসীকে মানুষ করতে আবার একবার বেরুবে?
কিন্তু সমীরণ জবাব দিবার পূর্বেই বিদ্যুৎ বলিল,—আমরা আর বেরুবো না মেজ- দা। যে-কথার মানে জানিনে, সে-কাজে আমরা আর নামতে পারবো না।
—কি কথার মানে জানো না?
—ওই মানুষ করার কথার, মেজ-দা। কাকে মানুষ বলে, আর কাকে বলে না, সে আমরা আজও বুঝিনি।
মেজ-দা ব্যথিত নেত্রে বিদ্যুতের পানে চাহিলেন।
বিদ্যুৎ বলিল,—এর জন্যে তোমাকে নতুন একটা সস্তানদল গড়তে হবে। আমরা এইখানেই রইলাম। তোমার সন্তানদল আমাদের মানুষ করতে যদি কোনদিন আমাদের কুটিরে পদার্পণ করেন আমরা বরং পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে তাঁদের সম্বর্ধনা করবো। তোমার মুক্তি খুব বড় জিনিস মেজ-দা, স্বদেশের মুক্তি আরও বড় জিনিস। এর জন্যে ভারতের কোটি-কোটি সন্তানকে মানুষকে করতে হবে সেও বুঝি। কিন্তু আমার এই একটি মাত্র সস্তান, মেজ-দা। যদি একে কোনোমতে মানুষ করতে পারি, তাহলেই বুঝবো, আমার যা করবার তা করা হল।
বলিবার কথা মেজ-দার যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এতক্ষণে বিদ্যুতের অন্তর বুঝিবার তাঁহার আর বাকী ছিল না। বুঝিলেন এখানে বৃথা চেষ্টা। তিনি কোনো কথা না বলিয়া আহারে মনোনিবেশ করিলেন।
বস্তুত বিদ্যুতের আশ্রয়ে মেজ-দা আরও চারিদিন রহিয়া গেলেন, কিন্তু দেশের অবস্থা ও সে অবস্থায় কি করা কর্তব্য, সে সম্বন্ধে বিদ্যুতের সঙ্গে আর একবারও আলাপ করিলেন না। কেবল মাঝে-মাঝে একটু-আধটু আঘাত দিতেন। যথা :-
—একটা গল্প শুনবি মক্ষি?
—কি গল্প?
—একটি মেয়ে ছিল, তলোয়ারের মতো ঝকঝকে-বিদ্যুতের মতো জ্বালাময়ী। সে ছিল আমার বোন। একদিন-
—জানি, জানি। সে অভাগী মরে গেল তো?
—না, মরেনি। একদিন-
—হ্যাঁ, সে মরেছে মেজ-দা। আমি নিজে দেখেছি।
—কিন্তু আমি দেখেছি, সে বেঁচেই আছে। একেবারে মরচে ধরে গেছে।
—তুমি যাকে দেখেছ সে অন্য লোক মেজ-দা। সে অশোকের মা। আমি জানি, তোমার সে বোন মরে গেছে।
—তা হবে! মেজ-দা দীর্ঘশ্বাস ফেলিলেন।
পরের দিন মেজ-দা চলিয়া গেলেন। এবং বিদ্যুৎ যদি ভুল দেখিয়া না থাকে, যাওয়ার সময় অশোককে বিদ্যুতের কোলে দিয়া তিনি যখন শিশুটির সুকোমল গালে চুমু দিলেন, তখন তাঁহারও দুই চোখ জলে ভরিয়া উঠিল।
বিদ্যুৎ তো ক্রমাগত ঘষিয়া চোখ দু’টা জবা ফুলের মতো লাল করিয়া ফেলিল। বলিল,—আমারই কপাল খেতে তুমি এসেছিলে মেজ-দা, তবু তোমায় ছেড়ে দিতে বুক ফেটে যাচ্ছে। যাদের কোনদিন চোখেও দেখনি, সেই অগণিত ভাই-বোনের জন্যে তোমার ব্যথার অন্ত নেই কিন্তু আমার দুঃখ কি দেখতে পাও না?
মেজ-দা হাসিয়া বলিলেন,—তাদের দেখিনি কে বললে রে?
বিদ্যুৎ মাথায় একটা ঝাঁকি দিয়া বলিল,—কিছুতে দেখনি মেজ-দা। আমার মতো করে তুমি পৃথিবীর আর কোনো মেয়েকে দেখনি।
মেজ-দা চলিয়া গেলে বিদ্যুৎ খাটের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া একেবারে ছেলেমানুষের মতো কাঁদিতে লাগিল। সমীরণ আসিয়া তাহাকে কত করিয়া সান্ত্বনা দিয়া বুঝাইতে সে আস্তে-আস্তে ও-ঘরে গেল।
সমীরণ বলে,—অদ্ভুত এই মেজ-দা! না বিদ্যুৎ? এই পৃথিবীর ভিতরে, এই পৃথিবীর বাইরে কোথাও তাঁর কোনো বন্ধন নেই। এ কি সহজ?
বিদ্যুৎ বলে,—সহজ নয় কেন? ওঁর পক্ষে ওইটেই সহজ, আর উলটোটাই কঠিন।
—ও কথা বোলো না, বিদ্যুৎ। মেজ-দা নির্মম তো নন। অশোককে নামিয়ে দেবার সময় তাঁর চোখে জল দেখ নি?
—সেইটেই বুঝতে পারি নি। সকলকে নিঃশব্দে সরিয়ে দিয়ে উনি যখন চলে যান তার মানে বুঝি। কিন্তু ওঁর চোখে জল আমাকে বিস্মিত করেছে।
—ওতে বিস্ময়ের কিছু নেই। ব্যথা ওঁরও বাজে। কিন্তু ওদিকের টান এদিকের ব্যথাকেও ছাপিয়ে ওঠে বলেই ছেড়ে যাওয়া সম্ভব হয়।
বিদ্যুৎ একটু থামিয়া বলে,—প্রিয়জনকে ছেড়ে যাওয়া কি খুব বাহাদুরীর কাজ নাকি?
—কোন্টা বাহাদুরীর কাজ সে আমিও জানিনে, বিদ্যুৎ। শুধু বুঝি, সত্যিকার মানুষদের এমনি করে প্রিয়জনদের ছেড়ে যাওয়ার প্রয়োজন হয়। সে প্রয়োজন হয়েছিল বুদ্ধের, হয়েছিল চৈতন্যের।
—আশ্চর্য নৃশংসতা। প্রিয়ার দুঃখ যে বুঝলে না, মানুষের দুঃখে তার বেদনার সিন্ধু উদ্বেল হয়ে উঠলো! আচ্ছা, তুমি বলতে পারো, স্ত্রীর সঙ্গে কি ধর্মাচরণ হয় না?
সমীরণ হাসিয়া বলিল,—না, সে আমি বলতে পারবো না। তবে আমার মনে হয়, তা হয় না বলেই তাঁরা নিয়ে যান নি।
—তোমার মনে হয়? কেন মনে হয়?
—এইজন্যে যে, তোমরা নিজেরাও অত দূর দৌড়তে পারো না, সঙ্গীটিকেও দৌড়তে দেবে না। কেন মনে হয় জানো, বিদ্যুৎ? তোমায় তো দেখলাম, এত বড় প্রতিভাশালিনী মেয়ে লক্ষেও একটার বেশী হয় না। সেই তোমারও দৌড়ের একটা সীমা আছে। ওর বেশী টান তোমার স্নায়ুতে সয় না। অথচ, তোমার অর্ধেক প্রতিভা নিয়ে একটা ছেলে ওর দ্বিগুণ যেতে পারে।
বিদ্যুৎ গুম্ হইয়া বসিয়া রহিল। তারপর আস্তে-আস্তে বাহিরে চলিয়া গেল। একটু পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিল,—দেখ, তোমায় আমি মুক্তি দিলাম। তুমি যা খুশি করতে পারো, যেখানে খুশি যেতে পারো। আমি এতটুকু বাধা দোব না। মিছে তোমায় আটকে রাখা।
কথাটা সে পরিহাস করিয়া বলে নাই। এবং এইটুকু বলিতেই অশ্রুর বাষ্প তাহার কণ্ঠরোধ করিল। সে উদ্যত অশ্রু চাপিতে চাপিতে চলিয়া গেল।
আটকাইয়া রাখিয়া কোনো লাভও নাই। মেজদা তাহাকে আবার একটা নূতন মন্ত্রে দীক্ষা দিয়ে গেছেন। এবার আর বোমা রিভলবার লইয়া নয়। এবারে দিয়া গেছেন ভারতের এই তেত্রিশ কোটি মানুষকে সেবা করিবার মন্ত্র। তাহারই নেশায় সে কিছুদিন হইতে বিভোর হইয়া আছে।
বিদ্যুৎ চলিয়া যাওয়ার পর সে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। তারপর আলমারী খুলিয়া একখানি কবিতার বই বাহির করিয়া মেফিলডের “সী-ফিভার” কবিতাটি পড়িতে বসিল। এই কবিতাটি তাহার বড় ভালো লাগে, কিছু না হইলেও অন্তত একশত বার পড়িয়াছে। যখনই পড়ে, মনে হয়, সমুদ্র তাহাকে আহ্বান করিতেছে, তাহাকেও যাইতে হইবে। নির্জন সমুদ্র এবং আকাশ তাহাকেও ডাক দিতেছে। নৌকা মিলিয়াছে, মাথার উপর ধ্রুবতারা তাহার দিক নির্ণয়ের জন্য জাগিয়া আছে। এই ধূসর কুয়াসাচ্ছন্ন সমুদ্রে সাদা পাল তুলিয়া তাহাকেও ঊষাযাত্রা করিতে হইবে। এই অমোঘ, সুতীব্র আহ্বানে ‘না’ বলিবার সাধ্য কি। যাযাবর জীবনের মোহ তাহাকে অভিভূত করিয়াছে। ঝড়ের বাঁশী, ধারালো ছুরির মতো তীক্ষ্ণ বাতাসের ঝাপ্টা তাহাকে উতলা করিয়া তুলিয়াছে।
And all I ask is a merry yarn from a
laughing fellow-rover,
And a quiet sleep and a sweet dream when
the long trick’s over.
সমীরণ দীর্ঘশ্বাস ফেলিল। হায়, হাস্যময়ী সহযাত্রী তাহার কই? নিশ্চিত নিদ্রা এবং সুমধুর স্বপ্ন আজ কতদূরে?
কিন্তু খানিক পরে বিদ্যুৎ যখন খাবার আনিয়া তার সম্মুখে রাখিল তখন তার মুখে আষাঢ়ের মেঘের ছবি দেখিয়া তার স্বপ্ন-জাল একেবারে ছিঁড়িয়া গেল। বিদ্যুৎ কিন্তু একটা কথাও কহিল না। যেমন গুম্ হইয়া আসিয়াছিল, তেমনি করিয়াই চলিয়া গেল।
সমস্ত দিন এইভাবেই চলিল। একজন অপ্রসন্ন মুখে এড়াইয়া চলিবার চেষ্টা করে, আর একজন তাহাকেই খুশি করিবার জন্য পিছু পিছু ঘোরে।
রাত্রে অশোককে লইয়া বিদ্যুৎ তাহার নিজের বিছানায় গম্ভীরভাবে শুইয়া পড়িল। সমীরণও ও খাটে শুইয়া শুইয়া স্বপ্ন রচনা করিতে লাগিল,—
I must go down to the seas again,
to the vagrant gipsy life,
To the gull’s way and the whale’s way where
the wind’s like a whetted knife.
অনেকক্ষণ পরে বিদ্যুৎ সমীরণের খাটের কাছে দাঁড়াইয়া গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করিল,—বিকেলে তোমার শরীরটা খারাপ করছিলো বলছিলে যে, এখন কেমন আছ?
—ভালো।
তার পা-তলার দিকে বসিয়া বিদ্যুৎ বলিল,—দেখি, তোমার পায়ে একটু হাত বুলিয়ে দিই।
সমীরণ তাড়াতাড়ি পা সরাইয়া লইয়া বলিল, না, না, থাক। আমি এখন বেশ আছি। কিচ্ছু কষ্ট হচ্ছে না।
অত্যন্ত ক্লান্ত স্বরে বিদ্যুৎ বলিল,—আমাকে আর জ্বালিও না। দেখি-
সমীরণ আর একটি কথাও বলিতে সাহস করিল না। বিদ্যুৎ তাহার একখানি পা কোলের উপর লইয়া হাত বুলাইতে লাগিল।
সমীরণ হাসিয়া বলিল,—সমস্ত দিন এই সংসার নিয়ে তো হাড়ভাঙা পরিশ্রম। তার উপর রাত্রিতে আবার এই। এতো পারো!
বিদ্যুৎ একটু হাসিয়া বলিল,—কিন্তু আমরা তো দেশোদ্ধার করতে পারি নে।
সে কথার কোনো উত্তর না দিয়া সমীরণ বলিল,–এই একটু আগে আমাকে যদি সমস্ত দায় থেকে মুক্তি দিয়েই গেলে, তবে আবার কেন এমন করে বাঁধতে এলে?
সমীরণ তার হাতদুটি ধরিয়া ঈষৎ আকর্ষণ করিতেই বিদ্যুৎ তার বুকের কাছটিতে আসিয়া বসিয়া বলিল,—তুমি বুঝি সেই আনন্দে আছ? সে হচ্ছে না। তোমার মুক্তি কোনো কালেই নেই।
একটু থামিয়া বলিল,—না, সত্যি, আজকে আমার মনটা এমন খারাপ হয়ে আছে যে, কিছু ভালো লাগছে না। মেজ-দা যে আমার মাথা কতখানি খেয়ে গেলেন বুঝতে তো পারছি নে, কিন্তু এমন ভয় করছে আমার, তা আর কি বলবো।
সমীরণ তার দুটি করতল মুঠার মধ্যে লইয়া বলিল,—ভয় কিসের?
বিদ্যুৎ অকস্মাৎ তার বুকের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া বলিল,—তুমি বলো, তুমি কোনোদিন আমাকে ছেড়ে যাবে না। আমাকে এমনি অসহায় অবস্থায় ফেলে যেতে তোমার কষ্ট হবে না? তুমি কি ভেবেছ তুমি চলে গেলে আর একটা দিনও আমি বাঁচবো? তখন তোমার অশোকের কি দশা হবে তা ভেবেছ? আমার গায়ে হাত দিয়ে বলো, তুমি কোথাও যাবে না।
বিদ্যুতের চোখের জল সমীরণ সইতে পারে না। তার চোখের কোণ বহিয়া বড়- বড় দু’বিন্দু অশ্রু গড়াইয়া পড়িল। সে বিদ্যুতের মাথায় হাত বুলাইতে-বুলাইতে বলিল,—তোমার গায়ে হাত দিয়ে বলছি, আমি কোথাও যাবো না। তোমাকে মিথ্যে বলবো না, আজই আমার কলকাতা যাবার কথা ছিল। স্টেশনে আমার জন্যে লোক অপেক্ষা করে থাকবে। কিন্তু তোমার চোখের জল ফেলে কোথাও যাবো না, এ আমি তোমার গায়ে হাত দিয়ে বলছি।
বিদ্যুৎ বিস্মিতভাবে উঠিয়া বসিয়া বলিল,—ভিতরে-ভিতরে এতদূর স্থির হয়ে গেছে! অথচ সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিল।
অনেকক্ষণ দু’জনে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। তারপরে বিদ্যুৎ বলিল,—তুমি একদিন বলেছিলে মনে আছে যে, আমার জন্যে তুমি স্বর্গও তুচ্ছ করতে পারো?
—সকল সময় সকল কথা আমার মনে থাকে না বিদ্যুৎ। যখনই কোনো কথা ভুলবো, আমার মনে পড়িয়ে দিও, বেশ?
সমীরণ আস্তে আস্তে বিদ্যুতের মাথা তাহার বুকের কাছে আকর্ষণ করিল। তাহার বুকের উপর মাথা রাখিয়া বিদ্যুৎ চুপে চুপে বলিল,—গায়ে হাত দিয়ে দিব্যি করলে কি হয় জানো তো?
সমীরণ হাসিয়া বলিল,—জানি কিছু হয় না। এখন রাত হয়েছে, শোওগে যাও।
বিদ্যুৎ ভালো করিয়া তাহার পাশে শুইবার স্থান সংগ্রহ করিয়া বলিল,—আজকে এইখানেই শোব যে।
—তবু ভয় গেল না?
বিদ্যুৎ তার কাছে আরো ঘেঁসিয়া গিয়া বলিল,—তোমাদের কি বিশ্বাস আছে? সে সমীরণের কাপড়ের প্রান্ত বেশ করিয়া হাতের মুঠায় জড়াইয়া লইয়া বলিল,—এইবার যাও তো কেমন যাবে?
উত্তরে সমীরণ শুধু একটু হাসিল, বলিল,—ঘুমোও।
একটু পরেই বিদ্যুৎ নিশ্চিন্ত মনে নিদ্রা গেল। কিন্তু সমীরণের কিছুতে ঘুম আসে না। কাল হাওড়া স্টেশনে তাহার অপেক্ষায় উদগ্রীব হইয়া তাহার দলের ছেলেরা দাঁড়াইয়া থাকিবে এবং দেখা না পাইয়া হতাশ ভাবে ফিরিয়া যাইবে। মেজ-দা হয়তো তাহার সম্বন্ধে নানা কথা ভাবিবেন, সহকর্মীরা পরিহাস করিবে, ছোটরা নিরুৎসাহ হইয়া পড়িবে। মনে পড়িল, ভারতের কোটি-কোটি ভাই-বোন যাহাদের পেটে অন্ন নাই, দেহে সামর্থ্য নাই, চোখে দীপ্তি নাই, যাহাদের শিক্ষা, দীক্ষা কিছুই নাই, তাহারা তাহারই মুখ চাহিয়া বসিয়া আছে। আর সে এখানে প্রিয়ার আঁচল ধরিয়া নিশ্চিন্তে রাত্রি যাপন করিতেছে। চমৎকার!
এমনি ভাবে প্রাণধারণ করিবার গ্লানি তাহার মন ধিক্কারে ভরিয়া দিল। তাহার কানে সমুদ্রের সুস্পষ্ট, অমোঘ আহ্বান বাজিতে লাগিল, ঝড়ের রাত্রের হাঙ্গর-তিমিসঙ্কুল সমুদ্র। সমীরণ অস্থির হইয়া উঠিল। দূরে একটা ঘড়িতে ঢং, ঢং, ঢং করিয়া তিনটা বাজিল।
এখনও একঘণ্টা সময় আছে। তাড়াতাড়ি করিলে এখনও কলিকাতার মেল ধরা যায়। সমীরণ অতি সন্তর্পণে উঠিয়া বসিল। সারাদিনের গুরু পরিশ্রমে ক্লান্ত হইয়া বিদ্যুৎ অঘোরে নিদ্রা যাইতেছে। তাহার হাতের মুঠায় তখনও সমীরণের কাপড়ের প্রান্তটুকু আবদ্ধ ছিল। প্রদীপের ক্ষীণ আলোয় তার নিদ্রিত মুখের সুষমার পানে সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে ক্ষণেক চাহিয়া রহিল, একবার একটু দ্বিধাও করিল। কিন্তু পরক্ষণে দৃঢ় হস্তে বালিশের নীচে হইতে একখানা ছোরা বাহির করিয়া অতি সন্তর্পণে কাপড়ের প্রান্তটুকু কাটিয়া লইল। তারপরে আস্তে-আস্তে খাটের নীচে নামিয়া আসিয়া বিদ্যুতের পাশে দাঁড়াইল, আস্তে-আস্তে তাহার রক্তিম অধরে একটা চুমা দিল। অশোকের বিছানার কাছে গিয়া তার গাল দুটি টিপিয়া দিয়া একটা চুমা দিল। অতৃপ্তনয়নে একবার অশোকের, একবার বিদ্যুতের মুখের পানে আবার চাহিয়া রহিল। বেশীক্ষণ চাহিয়া দেখিতে সাহস হইল না। পাছে কারো ঘুম ভাঙিয়া যায়, পাছে-। সমীরণ নিজের ‘পরেও তেমন বিশ্বাস করিতে পারিল না। আপন মনেই একবার আবৃত্তি করিল,—
চাবো না পশ্চাতে মোরা, মানিব না বন্ধন ক্রন্দন,
হেরিব না দিক
গণিব না দিনক্ষণ, করিব না বিতর্ক বিচার,
উদ্দাম পথিক।
মুহূর্তে করিব পান মৃত্যুর ফেনিল উন্মত্ততা
উপকণ্ঠ ভরি’,
খিন্ন শীর্ণ জীবনের শত লক্ষ ধিকার লাঞ্ছনা
উৎসর্জন করি’।।
অবশেষে চোরের মতো নিঃশব্দে দরজা খুলিয়া বাহির হইয়া গেল।
সুগভীর নিদ্রার ঘোরে বিদ্যুৎ বোধ হয় সমীরণ মনে করিয়াই পাশ-বালিশটিকে জড়াইয়া ধরিল। কিন্তু সমীরণ তখন কলিকাতা মেলে উঠিয়া বসিয়াছে। তখন কি লক্ষ কোটি অজানা মানবের দুঃখে,—যাহাদের বেদনা হয়তো তাহার মনে সত্য হইয়াই ওঠে নাই, তাহাদেরই বেদনার চাপে একটি প্রিয়ার নিগূঢ় মর্মব্যথা দলিত, পিষ্ট হইয়া গেছে?