1 of 2

সূর্যদেবতার পুরোহিত

সূর্যদেবতার পুরোহিত

প্রিয় বিমলেন্দু,

তিনদিনের ঘোর বর্ষার পর আজ সন্ধ্যার পর থেকে চারদিকের আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা হয়ে এসেছে। মনে হচ্ছে, প্রায় শীতকাল। স্থির করেছি, আজ রাত দশটার পর ‘মমি’টাকে পরীক্ষা করব। যদি কৌতূহল চরিতার্থ করতে চাও, সেই সময়ে তুমি উপস্থিত থেকো। অবনীকেও খবর পাঠিয়েছি। ইতি—

 সুরেশ্বর

তখন সন্ধ্যা উতরে গেছে। তাড়াতাড়ি আহরাদি সেরে বিপুল উৎসাহে সুরেশ্বরের বাড়ির দিকে যাত্রা করলুম।

প্রাচীন মিশর ও তার বিলুপ্ত সভ্যতা নিয়ে সুরেশ্বর বহুকাল থেকেই আলোচনা করে আসছে এবং এ সম্বন্ধে তার জ্ঞান ছিল অগাধ। মিশরে বসেই সে কাটিয়ে দিয়েছে কয়েকটা বৎসর। প্রাচীন মিশরের ‘হাইয়ারঅগ্লিপ’ বা চিত্রাক্ষরে লেখা পুঁথি পর্যন্ত সে অনায়াসেই পাঠ করতে পারত।

গত মাসে মিশর থেকে ফেরবার সময়ে সুরেশ্বর বহু চেষ্টার পর একটি মমি সংগ্রহ করতে পেরেছিল। এতদিন কলকাতায় অতিরিক্ত গ্রীষ্মাধিক্যের জন্যে সে মমির আবরণ খুলতে পারেনি।

মমি কী, তোমরা অনেকেই তা জানো। কলকাতার জাদুঘরেও একটি মমি রক্ষিত আছে। পঁয়ত্রিশ কী চল্লিশ বৎসর আগে তার অবস্থা ছিল বেশ ভালো। কিন্তু বাংলাদেশের স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় এখন তার বিশেষ দুর্দশা হয়েছে।

মমি হচ্ছে শুকনো মড়া। প্রাচীন মিশরীয়দের বিশ্বাস ছিল, মৃত্যুর পরেও মানুষের দেহকে রক্ষা করলে আত্মা আবার দেহের ভেতরে বাস করতে পারে। এইরকম সব সুরক্ষিত দেহ মিশরের নানাস্থানে সমাধিগৃহের মধ্যে পাওয়া যায়। যেসব দেহ কবরস্থ হয়েছিল হাজার হাজার বৎসর আগে। কেবল প্রাচীন মিশরে নয়, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ারও কোনো কোনো জায়গা থেকে রক্ষিত শব পাওয়া গিয়েছে।

প্রাচীন মিশরে আগে মড়ার নাকের ভেতর দিয়ে মস্তিষ্ক টেনে বার করে নেওয়া হত। তারপর পেটের পাশে ছ্যাঁদা করে বার করে নেওয়া হত নাড়িভুঁড়িগুলো। তারপর ক্ষুর চালিয়ে দেহটাকে কামিয়ে ও ধুয়ে ফেলা হত। অবশেষে ভেতরে নানা সুগন্ধ ঔষধ পুরে এবং অন্যান্য প্রক্রিয়ার পর দেহটিকে ক্ষৌমবস্ত্রে জড়িয়ে কফিনের মধ্যে স্থাপন করা হত। একেই বলে মমি।

যথাসময়ে যথাস্থানে উপস্থিত হয়ে দেখি, প্রখর আলোকে সমুজ্জ্বল একটি ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে সুরেশ্বর ও অবনী এবং ঘরের ঠিক মাঝখানে লম্বা টেবিলের ওপরে রয়েছে একটি প্রকাণ্ড কাষ্ঠাধার। আন্দাজ করলুম, সেটি লম্বায় নয় ফুট, চওড়ায় তিন ফুট ও গভীরতায় আড়াই ফুটের কম হবে না।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সুরেশ্বর বললে, ‘দশটা বেজে তিন মিনিট। বিমল, আমরা তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলুম। এসো, এইবারে কাজ আরম্ভ করা যাক।’

সে টেবিলের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। কাষ্ঠাধারটি সুদৃশ্য। তার গায়ে আঁকা রয়েছে রঙিন চিত্রাক্ষর ও শবযাত্রার ছবি প্রভৃতি। সুরেশ্বর ধীরে ধীরে কাষ্ঠাধারের ডালা তুললে এবং তারপর আমরা সকলে মিলে গুঁড়ো রজনের আবরণ সরিয়ে ভেতর থেকে একটি কফিন বার করে টেবিলের ওপরে স্থাপন করলুম। কফিনটি দেবদারু-কাঠ দিয়ে তৈরি।

কিছুক্ষণ চেষ্টার পর যন্ত্রপাতির সাহায্যে কফিনেরও ডালা খুলে ফেলা হল। তারপর দেখা গেল বস্ত্রাবৃত দেহটাকে।

সুরেশ্বর বললে, ‘তোমরা দুজনে দেহটাকে তুলে ধরো, আমি ওর গায়ে জড়ানো কাপড়টা খুলে নিই।’

বাবা, মান্ধাতার আমলের শুকনো মড়া! খানিক ইতস্তত করে আমরা সুরেশ্বরের কথামতো কাজ করলুম।

তারপর সে যেন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের মতো ব্যাপার! মমির গায়ে কাপড়ের পাকের-পর-পাক! অবশেষে তাও খুলে ফেলা হল।

একটা পুরুষের মমি। গায়ের রং লালচে, মুখ ও দেহের সর্বাঙ্গ অবিকৃত, চামড়া কঠিন ও মসৃণ। চোখ দুটি মোদা।

সুরেশ্বর সানন্দে বললে, ‘এতটা আমি আশা করিনি! আমার ভাগ্য ভালো, এমন নিখুঁত মমি সহজে পাওয়া যায় না।’

আমি বললুম, ‘কিন্তু এই শুকনো মড়াটাকে নিয়ে তোমার কী লাভ হবে? এ আর নড়বেও না, অতীতের গল্পও বলবে না।’

অবনী বললে, ‘সুরেশ্বর, তোমার ইলেকট্রিক ব্যাটারিটা একবার নিয়ে এসো তো!’

‘কেন?’

এই দেহটার ওপরে প্রয়োগ করে দেখব।’

‘আরে, এটা তো এখন মাটির পুতুলের শামিল! ইলেকট্রিক ব্যাটারি চালিয়ে কী লাভ হবে?’

‘তবু একবার দেখাই যাক না।’

সুরেশ্বর ব্যাটারি নিয়ে এল। অবনী ব্যাটারির তারের একটা প্রান্ত মমির দেহের সঙ্গে সংলগ্ন করে চালিয়ে দিলে।

দেহটা তেমনি আড়ষ্ট, কিন্তু—

ও কী ব্যাপার! এতক্ষণ মমির যে চোখ ছিল বোঁজা, এখন খুলে গিয়েছে তার পাতা!

এ যে অপ্রত্যাশিত, অপার্থিব দৃশ্য! অবনী তো মাটির ওপরে টপ করে বসে পড়ে হামাগুড়ি দিয়ে চটপট টেবিলের তলায় ঢুকে গেল। আমিও আঁতকে উঠে তাড়াতাড়ি পিছিয়ে পড়লুম।

সুরেশ্বর হেসে উঠে বললে, ‘মাভৈঃ! তোমরা মিছে ভয় পাও কেন? যা দেখলে তা বৈদ্যুতিক শক্তির ক্রিয়া! অবশ্য, আমিও প্রথমটায় একটু চমকে গিয়েছিলুম, কারণ এতকালের পুরোনো একটা শুকনো মড়ার ওপরে বিদ্যুৎপ্রবাহ যে কোনো কাজ করবে, এ কথা আমি ভাবতে পারিনি।’

আশ্বস্ত হয়ে আমি এগিয়ে এলুম। অবনীও টেবিলের তলা থেকে আত্মপ্রকাশ করল।

সুরেশ্বর বললে, ‘আর একবার ব্যাটারি চালিয়ে দেখা যাক আবার কী কাণ্ড হয়।’ বলতে বলতে ব্যাটারি চালিয়ে দিলে।

অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে মমি তার ডান পা-খানা নিজের পেটের কাছ পর্যন্ত গুটিয়ে নিলে এবং পরমুহূর্তেই সুরেশ্বরের বুকের ওপরে এমন প্রচণ্ড পদাঘাত করলে যে, সে ছিটকে পাঁচ হাত তফাতে গিয়ে ভূতলশায়ী হল।

আমরা আবার নিরাপদ ব্যবধানে সরে যেতে দেরি করলুম না।

সুরেশ্বর উঠে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে বললে, ‘কাঠের আধারে চিত্রাক্ষরে লেখা তারিখ আমি পড়ে দেখেছি। এই মমিটাকে কবর দেওয়া হয়েছে পাঁচ হাজার বছর আগে। কিন্তু আজ সে মরে গিয়েও আমাকে পদাঘাত করতে ছাড়লে না!’

কিন্তু এবারে যা হল তা একেবারেই স্বপ্নাতীত!

মমি বিকট হেঁড়ে গলায় বিজাতীয় ভাষায় কথা কয়ে উঠল! পরে প্রাচীন মিশরীয় ভাষায় অভিজ্ঞ সুরেশ্বরের মুখে শুনেছিলুম মমি বলেছিল, ‘নির্বোধ! আমার মৃত্যু হয়নি!’

শিউরে উঠে আমার সর্বাঙ্গ হিম হয়ে গেল। আর তো ইলেকট্রিক ব্যাটারির দোহাই দেওয়া চলে না! বিদ্যুতের যতই মহিমা থাক, মড়ার মুখে কোনোদিনই সে ভাষা দিতে পারবে না।

এবারে সুরেশ্বরও স্তব্ধ ও স্তম্ভিতের মতো দাঁড়িয়ে রইল। তার মুখ দেখলে মনে হয়, নিজের কানকেও সে বিশ্বাস করতে পারছে না।

সভয়ে দেখলুম, প্রবল শ্বাসপ্রশ্বাসে উঠছে আর নামছে মমির বক্ষদেশ!

সুরেশ্বর অভিভূত কণ্ঠে মিশরীয় ভাষায় বললে, ‘তুমি মৃত নও!’

ক্রুদ্ধ, কর্কশকণ্ঠে মমি বলল, ‘না, না! আমি জীবিত! আত্মা হচ্ছে অমর। এই দেহের ভেতরেই আমি বিরাজ করি।’

‘কে তুমি?’

‘আমি রাজপুরোহিত উর-নিনা, সূর্যদেবতারা আমার প্রভু।’

বাধো-বাধো গলায় সুরেশ্বর বললে, ‘পাঁচ হাজার বৎসর পরে তোমার দেহকে আবার আমরা জাগিয়ে তুলেছি। এজন্যে কি কৃতজ্ঞ নও?’

হুংকার দিয়ে মমি বলে উঠল, ‘কৃতজ্ঞ! তোদের অপবিত্র হাতের ছোঁয়ায় আমার দেহ কলঙ্কিত হয়েছে। এইবারে আমি তোদের শাস্তি দেব!’

আমরা পায়ে পায়ে দরজার দিকে অগ্রসর হতে হতে দেখলুম, আচম্বিতে মমির দেহটা টেবিলের ওপরে সিধে হয়ে উঠে বসল এবং তারপর শুনলুম অমানুষিক কণ্ঠে ঘর-ফাটানো চিৎকার— ‘ক্ষুধা! ক্ষুধা! পাঁচ হাজার বছরের ক্ষুধার জ্বালায় আমি ছটফট করে মরছি! দে রে-দে রে— খেতে দেরে, খেতে দে!— হা হা হা হা হা হা!’

দারুণ আতঙ্কে আচ্ছন্ন হয়ে আমরা প্রাণপণ বেগে ঘরের ভেতর থেকে পলায়ন করলুম।

সে রাত্রে সুরেশ্বর আমার সঙ্গেই বাস করলে।

পরদিন প্রভাতে বহু লোকজন নিয়ে আমরা আবার সুরেশ্বরের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলুম ভয়ে ভয়ে।

কিন্তু কেউ কোথাও নেই। ঘরের ভেতরে পড়ে রয়েছে কেবল চিত্র-বিচিত্র কাষ্ঠাধার, রাশিকৃত ক্ষৌমবস্ত্র ও শূন্য কফিনটা।

* এডগার অ্যালান পো অবলম্বনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *