সূর্যগ্রহণ
একে রবিবার, তার ওপর মহালয়া। এমন দিনে সমস্তিপুর ফার্স্ট প্যাসেঞ্জার থেকে মধুপুরে নামা বড়ো সহজ ব্যাপার নয়। অনেক ঠেলাঠেলি গুঁতোগুঁতির পর দুটো সুটকেস আর দময়ন্তীকে সামলেসুমলে প্ল্যাটফর্মে নামল সমরেশ। সুটকেস দুটো দময়ন্তীর পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে দম ফেলে বলল, ‘বাপ রে, ট্রেন থেকে নামতেই তো একটা পুরোদস্তুর এনার্জি খরচা হয়ে গেল। এখন রঞ্জিতের দর্শন পাই, তাহলেই বাঁচোয়া, তা নয়তো চিত্তির।’ বলে সমস্ত লোকের মাথার ওপর গলা বাড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল।
দময়ন্তী অবশ্য কাউকেই দেখতে পাচ্ছিল না। ওর চারদিকের লোকেদের বুকে পিঠেই ওর দৃষ্টি আটকে যাচ্ছিল। এদিকে ট্রেন আবার চলতে শুরু করেছে সশব্দে, লোকজনের চিৎকার বেড়ে গেছে। এত সব হট্টগোল ভেদ করে সমরেশের বাজখাঁই গলা গর্জন করে উঠল, ‘অ্যাই রঞ্জিত, অ্যাই হতভাগা!’
এই রঞ্জিত হতভাগা বা রঞ্জিত রায়চৌধুরী সমরেশের বহুদিনের বন্ধু। ইন্টারমিডিয়েট থেকে একসঙ্গে পড়ছে দু-জনে, ইঞ্জিনিয়ারিংয়েও এক ডিপার্টমেন্টে ছিল। এই দুই হরিহরাত্মার গুন্ডামির ঠেলায় ওদের সহপাঠী এবং শিক্ষক— সকলেরই আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড় হয়েছিল। কলেজ ছাড়ার পর দু-জনে দু-জায়গায় চলে যায়। দেখাসাক্ষাৎও বড়ো হয় না, কারণ সমরেশ বরাবরই কলকাতায় আর রঞ্জিত পশ্চিমবাংলার বাইরে বাইরেই এতকাল কাটিয়েছে। তবে চিঠিপত্রে যোগাযোগ সবসময়েই ছিল। আপাতত রঞ্জিত আছে মধুপুর থেকে মাইল ত্রিশেক দূরে কুন্তীপুর থার্মাল পাওয়ার স্টেশনে, একটা জার্মান ফার্মের হয়ে সুইচ গিয়ার বসাচ্ছে। অনেক চিঠি লেখালেখির পর অবশেষে এতদিনে ঘরকুনো গেঁতো সমরেশ নড়ে বসতে রাজি হয়েছে।
রঞ্জিতের সঙ্গে এখনও মুখোমুখি আলাপ হয়নি দময়ন্তীর। কিন্তু সমরেশের সিংহনাদের একটু পরেই ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে সে সমরেশের কাঁধে প্রকাণ্ড একটা থাপ্পড় কষিয়ে বলল, ‘তাহলে এলি, শেষ পর্যন্ত?’
তাকে চিনতে অসুবিধে হল না। ছাত্রজীবনে তোলা ছবি, যা ওর দেখা ছিল, তার সঙ্গে বর্তমান চেহারার বিশেষ কোনো অমিল নেই। সমরেশের চেয়ে মাথায় খাটো হলেও সাধারণ বাঙালির তুলনায় বেশ লম্বা। শ্যামলা রং, তীক্ষ্ন দীর্ঘ নাক, প্রশস্ত কপাল, চঞ্চল মেদহীন শরীর। পুরু লেন্সের চশমার আড়ালে চোখ দুটো উজ্জ্বল। পরনে একদম গোল হয়ে যাওয়া একটা ব্লু জিনস, কালচে ধূসর রঙের নাইলনের উঁচু-গলা গেঞ্জি আর পায়ে একজোড়া ধূলিধূসরিত ক্যানভাসের হান্টিং বুট।
সমরেশ তার বন্ধুকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বলল, ‘ফ্যাক্টরি থেকে সোজা আসছিস বুঝি?’
রঞ্জিত মাথা নেড়ে বলল, ‘না তো। আজ তো রোববার, আজ আবার ফ্যাক্টরি কী? কেন?’
‘না, এই এমনিই জিজ্ঞেস করছিলুম আর কি।’
ভুরু কুঁচকে রঞ্জিত কিছুক্ষণ প্রশ্নটার কারণ অনুধাবন করবার চেষ্টা করল। তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে দময়ন্তীর দিকে ফিরে নমস্কার করে বলল, ‘আমার নাম রঞ্জিত রায়চৌধুরী। সেই আপনাদের বিয়ের দিন আপনাকে দেখেছিলুম, আর আজ এই দেখা হল।’
মৃদু হেসে প্রতিনমস্কার করে দময়ন্তী বলল, ‘আপনার গল্প অনেক শুনেছি ওর মুখে।’
সন্দিগ্ধ মুখ করে রঞ্জিত বলল, ‘সেগুলো একটাও বিশ্বাস করেননি তো? গুল মারা কিন্তু ওর ভয়ানক বদভ্যেস। আসলে আমি খুব ভালো লোক।’ বলে একগাল হাসল।
দময়ন্তী বলল, ‘আমি জানি আপনি ভালো লোক। আমার কর্তা হোস্টেলে আপনাদের দুর্দান্তপনার যেসব গল্প করেছেন, সেগুলো একথাটাই প্রমাণ করবার জন্যে আপনারা দু-জনেই খুব ভালো লোক।’
সমরেশের পিঠে সস্নেহে আর একটা থাপ্পড় কষাতে গিয়ে হঠাৎ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল রঞ্জিত। সমরেশের দু-হাতে ধরা দুটো সুটকেস দেখিয়ে বলল, ‘ভেবেছিস কী তুই? ঘর বুলায়ে মেহমানকে দিয়ে আমি কুলির কাজ করাই? নামা মাল দুটো। বাহাদুর! সামান উঠাকে জিপমে রাখখো।’ তারপর দময়ন্তীর দিকে ফিরে বলল, ‘এবার চলুন। দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি। আর দেরি করা ঠিক নয়।’
সমরেশ বলল, ‘যথার্থ। এই বেলা দ্বিপ্রহরে শরতের রৌদ্র আর পেটের খিদে— দুটোই খুব প্রখর হয়ে উঠেছে।’
রঞ্জিতের পেছনে প্রচ্ছন্ন বাহাদুর আত্মপ্রকাশ করে সুটকেস দুটো তুলে নিয়ে গেটের দিকে এগোল। তাকে অনুসরণ করতে করতে রঞ্জিত বলল, ‘চিরটাকাল দেখছি, তোর কেবল খাই খাই।’
‘যা বলেছেন।’ দময়ন্তী বলল, ‘এই একটু আগে একবাক্স লুচি আর হালুয়া খেয়েছে।’
সমরেশ প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল। ওকে বাধা দিয়ে রঞ্জিত বলল, ‘ভালো কথা, মনে পড়ে গেল বউদি। আচ্ছা, আমাকে তো দেখলেন। এখন বলুন তো, বাড়িতে কী কী রান্না হয়েছে আর আমার বসবার ঘরের রং নীল না হলদে?’
লজ্জিত আর অপ্রস্তুত হল দময়ন্তী। বলল, ‘কী যে বলেন, তার ঠিক নেই। আমি কি হাত গুনতে জানি?’
হাত নেড়ে রঞ্জিত বলল, ‘রহস্যভেদীদের কাণ্ডই আলাদা। তারা তো লোকের বাঁ-কানের শেপ দেখে বলে দিতে পারে, তার ডান পকেটের মানিব্যাগে এক টাকার রেজগি আছে কি নেই।’
‘সে যারা পারে, তারা পারে,’ দময়ন্তী বলল, ‘আমি পারিনে।’
.
২
বাহাদুর এগিয়ে গিয়ে স্টেশনের বাইরের চত্বরে একটা জিপে মালগুলো রাখল। বনেটের ওপর কাচের নীচে সবুজের ওপর সাদা দিয়ে লেখা ‘শ্লোয়েনডফ’— রঞ্জিতের কোম্পানির নাম।
রঞ্জিত বাহাদুরকে বলল, ‘টিফিন ক্যারিয়ার নিকালো পহলে।’ তারপর দময়ন্তীকে বলল, ‘এখন বাজে আড়াইটে, বাড়ি পৌঁছুতে চারটে বাজবে। এখনই বেশ দেরি হয়ে গেছে। চারটে বাজলে সমরেশ কি আর রক্ষে রাখবে? খিদে পেলে তো আবার ওর মাথায় খুন চেপে যায়। লাঞ্চটা এখানেই সেরে নেওয়া ভালো। কি বলেন?’
জবাবটা সমরেশই দিল। বলল, ‘বিলক্ষণ, বিলক্ষণ।’ বলে প্রথম বাটিটা থেকে উৎফুল্ল মুখে একটা কাটলেট তুলতে গিয়ে থমকে গেল।
ওর ঠিক পেছনেই একটা মোটা গলা প্রশ্ন করল, ‘আরে, দময়ন্তী না?’
প্রশ্নকর্তা একজন খাকি পোশাকমণ্ডিত পুলিশ অফিসার। বয়েস কম, সুদর্শন, তবে মুখে একটা পুলিশোচিত গ্রামভারী হাসি।
দময়ন্তী হইহই করে উঠল, ‘আরে জয়ন্ত। তুমি এখানে?— ওগো, এ হচ্ছে জয়ন্ত চতুর্বেদী, আমাদের সঙ্গে একসঙ্গে কলেজে পড়ত। এম এ পাশ করবার পর আইপিএস হয়েছিল। আর ইনি সমরেশ দত্তগুপ্ত, আমার স্বামী। আর ইনি মিস্টার রঞ্জিত রায়চৌধুরী, ওঁর বহুদিনের বন্ধু। ওঁর বাড়িতেই এসেছি আমরা, কুন্তীপুর থার্মাল পাওয়ার স্টেশনে।’
দু-জনের সঙ্গে খুব কেতাদুরস্তভাবে করমর্দন করে জয়ন্ত বলল, ‘কুন্তীপুর থার্মাল পাওয়ার? বাপ রে, সে তো অনেক দূর। বলি, খাবারদাবার সঙ্গে আছে তো?’ ছেলেটির বাংলা কেবল নির্ভুল নয়, শ্রুতিমধুরও।
রঞ্জিত বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে যথেষ্ট আছে। নিন না, আপনিও নিন।’ বলে অমায়িক হেসে একটা প্লেট এগিয়ে ধরল।
দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়ল জয়ন্ত। বলল, ‘না, আমার খাওয়া হয়ে গেছে। আর তা ছাড়া আমি এখন অন ডিউটি।’
‘কী এমন ভয়ানক রাজকার্য করছ শুনি?’ দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘বলা নিষেধ আছে নাকি?’
‘না, নিষেধ তেমন কিছু নয়। খবর পেয়েছি, একজন জবরদস্ত ক্রিমিনাল এ অঞ্চলে পদার্পণ করেছেন, স্টেশনে আমাদের পাহারাটা তাই চেক করতে এসেছিলুম।’
‘জবরদস্ত ক্রিমিনাল? খুনি-টুনি নয় তো?’ সমরেশ শঙ্কিত প্রশ্ন করল।
আবার একটা গ্রামভারী হাসি হাসল জয়ন্ত, ‘না, না, সেরকম নয়। ইনি একজন আন্তর্জাতিক চোরাই মালের কারবারি। তবে দরকার হলে খুনখারাপি দু-চারটে যে করেন না, এমন নয়। শুনেছি, লোকটা নাকি উচ্চশিক্ষিত, তবে কিনা সমাজবিরোধী, কাজেই শিক্ষাটা জলে গেছে বলা চলে।’
‘দুনিয়ায় এত জায়গা থাকতে, এই মধুপুরে কোন মধুর সন্ধান পেয়েছেন ভদ্রলোক?’ রঞ্জিত জিজ্ঞেস করল, ‘হাওয়া বদলাতে আসেননি নিশ্চয়ই।’
‘কী যে মধু পেয়েছেন, সেটাই তো বুঝতে পারছি না। তবে এসেছেন যখন, তখন কিছু একটা না করে ছাড়বেন বলে মনে হয় না। অসুবিধে কী জানেন? শ্রীমানের বর্ণনা যা পেয়েছি, তাতে এই চেঞ্জারের ভিড়ে খোঁজা কি সোজা কথা? মধুপুর কি একটা একটুখানি জায়গা? চারদিকে গিসগিস করছে মানুষ। দেওঘর থেকে এসে এখানে চারদিন যাবৎ বসে আছি, একটা ক্লু পাচ্ছি না।’
রঞ্জিত বলল, ‘ক্ষিতীশ মুস্তাফি বলে আমার এক বন্ধু ছিল। তার বাবা প্রথম কলকাতায় আসেন তাঁর ছোটোভাইকে খুঁজতে। শুধু দুটি ক্লু ছিল তাঁর কাছে। প্রথমত, তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে তাঁর ভাই কলকাতাতেই চাকরি করে আর দ্বিতীয়ত, তাঁর ভাইয়ের ডাকনাম গাবলু, ভালোনামটা ভুলে গিয়েছিলেন। হাওড়ায় নামার ছ-দিন বাদে টালিগঞ্জে সেই গাবলুকে খুঁজে বের করেন ভদ্রলোক। অসাধারণ প্রতিভা! আমি বলি কি তাঁকে একবার খবর দিলে হয় না?’
এইবার জয়ন্ত চতুর্বেদীর মুখে তার বয়সোচিত একটা হাসি ফুটে বেরোল। বলল, ‘মিস্টার মুস্তাফির তো তাও দুটো ক্লু ছিল, আমার যে মোটে একটা। এই চিড়িয়ার যে নামটাও সঠিক জানি না। পুলিশের খাতায় নাম অবশ্য একটা আছে— সাধন গুহ। তবে বোধ হয় বাঙালি নয় খুব সম্ভব উত্তর প্রদেশের লোক।’
রঞ্জিত বলল, ‘বউদি, আপনি একবার চেষ্টা করে দেখবেন নাকি? জানেন তো জয়ন্তবাবু, আপনার বন্ধুটিও একজন অপরাধবিজ্ঞানী।’
জয়ন্ত বলল, ‘দময়ন্তী? সে কী, তুমি আজকাল প্রফেসারি ছেড়ে ডিটেকটিভগিরি শুরু করলে নাকি? মেয়েছেলের লাইন এসব নয় হে, চোর-ছ্যাঁচোড় গুন্ডা-দাঙ্গাবাজদের সঙ্গে টক্কর দেওয়া তোমাদের কম্ম নয়।’
দময়ন্তী বলল, ‘ঠিক কথা। রঞ্জিতবাবুর কথায় কান দিয়ো না তো। নাও, তার চেয়ে বরং একটা সন্দেশ খাও, তোমার ডিউটির তাতে কিছু ক্ষতি হবে না।’
জয়ন্ত সত্যিই কথাটায় কান দিল না। সন্দেশটা নিয়ে তাতে একটা কামড় বসিয়ে বলল, ‘বাঃ, বাঃ, বড়িয়া জিনিস, খাসা মিষ্টি। কোত্থেকে পেলেন? কুন্তীপুরে কি মিষ্টির দোকান হয়েছে নাকি আজকাল?’
রঞ্জিত বলল, ‘না, না, এগুলো বাড়িতে তৈরি। আমাদের চিফ এগজিকিউটিভ মিস্টার নিশীথ সান্যালের স্ত্রী বানিয়ে দিয়েছেন।’
সমরেশ একমুখ কাটলেটের ভেতর থেকে কোনোরকমে বলল, ‘বেড়ে ”বস”টি তো তোর। বলি বিবাহযোগ্যা সুন্দরী কন্যা আছে নাকি মিস্টার সান্যালের? তুই তো শুনি বারেন্দ্র। পালটি ঘর হলে চেষ্টা করব নাকি বল?’
মৃদু হাসল রঞ্জিত। বলল, ‘মিস্টার সান্যাল আমার বস নন, কাস্টমার বলতে পারিস। আর হ্যাঁ, সুন্দরী কন্যা আছে ঠিকই, তবে চেষ্টা করে লাভ নেই। সেসব অনেক উঁচু মহলের ব্যাপার; তুই ধারে-কাছেও ঘেঁষতে পারবি নে।’
সন্দেশ শেষ করে পুনরায় গ্রামভারী হাসল জয়ন্ত। বলল, ‘আপনারা খাওয়া-দাওয়া করুন। আমি চলি। একদিন যাব’খন কুন্তীপুর— আপনাদের দেখে আসব। দময়ন্তী তো কলকাতার মেয়ে, তিনদিনেই হাঁপিয়ে উঠবে। দেখবার বলতে তো ওই একটা দেড় হাত বাই দু-হাত মিউজিয়াম আর পাওয়ার স্টেশনের বাঁশের ভারা। না একটা সিনেমা, না কিছু।’
.
৩
মধুপুর গিরিডি রোড থেকে বাঁ-দিকে একটা পিচঢালা রাস্তায় ঢুকল জিপটা। মোড়ের মাথায় প্রকাণ্ড হলুদ বোর্ডের ওপর কালো অক্ষরে হিন্দি আর ইংরেজিতে জানানো আছে যে কুন্তীপুর থার্মাল পাওয়ার স্টেশন এই রাস্তার ওপরেই পাওয়া যাবে।
জনমানবহীন রুক্ষ মাঠের ওপর দিয়ে হু-হু করে জিপটা চালাচ্ছিল রঞ্জিত। পাশে সমরেশ, একদম ধারে দময়ন্তী আর পেছনে সটিফিন ক্যারিয়ার বাহাদুর। দু-পাশে দিগন্তবিস্তৃত অনাবৃত জমি। কোথাও লালচে, কোথাও ধূসর, কোথাও-বা কালো। দূরে দূরে দু-একটা সবুজ ঘাসের দ্বীপ দেখা যায়। এক-আধটা নিঃসঙ্গ গাছ, কোথাও বড়ো বড়ো পাথরের চাঁই স্তূপাকার হয়ে পড়ে আছে। ঝিমঝিম করছে রোদ, বাতাসে সামান্য ঠান্ডার আমেজ। দময়ন্তীর ঝিমুনি আসছিল। আর পথটাও যেন একটা প্রকাণ্ড অজগর সাপের মতো এঁকেবেঁকে উঁচু-নীচু জমির ওপর রোদ্দুরে নিজেকে ছড়িয়ে ফেলে ঘুমোচ্ছিল।
সমরেশ সব দেখেশুনে বলল, ‘তুই ঠিক জানিস রঞ্জিত, যে, এই রাস্তাটা ইয়াকুটস্কে গিয়ে শেষ হয়নি, কিংবা হন্ডুরাসে? বাপ রে, পাণ্ডববর্জিত জায়গা বোধ হয় একেই বলে!’
রঞ্জিত বলল, ‘এ জায়গাটা মোটেই পাণ্ডববর্জিত নয়, পাণ্ডববর্জিত হল গিয়ে তোদের যাকে বলে ওয়েস্ট বেঙ্গল। কুন্তীপুর নামটা এমনি হয়নি। ওখানে একটা নদী আছে, নাম ধারোয়া। জনশ্রুতি বলে, কুন্তী নাকি তার ধারে যজ্ঞ করেছিলেন আর পঞ্চপাণ্ডব পিকনিক করেছিলেন।
‘তবে জনশ্রুতিটা যদি উড়িয়েও দিস, তাহলেও ওখানে অতীতে কিছু একটা যে ছিল, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। বছর পাঁচেক আগে, এখন যেখানে পাওয়ার স্টেশন, সেটা ছিল চারদিকে পাহাড় ঘেরা একটা দুরধিগম্য জায়গা। ওই পাহাড়গুলোরই একটার বাইরের গায়ে ছিল কুন্তীপুর গ্রাম আর কুন্তীপুর কোল মাইনস-এর একটা ছোট্ট খনি। থার্ডক্লাস কয়লা বেরোত। পরে স্থির হল যে ওই কয়লা গুঁড়ো করে পাওয়ার স্টেশন চালানো হবে— এ অঞ্চলের শক্তির অভাব দূর করবার জন্য। তখন ওই চারদিকে পাহাড়-ঘেরা উপত্যকাটাকেই পছন্দ করা হল স্টেশনের জন্য আর খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হল। তখন মাটির তলা থেকে কিছু কিছু অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস বেরোতে লাগল— যেমন চিত্রবিচিত্র করা মাটির পাত্র, দেবদেবীর মূর্তির ভাঙাচোরা টুকরো, কারুকার্য করা ইট, ঢালাই লোহার শেকল, এইসব। পাটনা থেকে বিশেষজ্ঞ এলেন। দেখেশুনে বললেন, এ এমন কিছু নয়, কোনো প্রাচীন জনপদের চিহ্ন সব— মারাত্মক কিছু বলা যায় না। বিহারের যেকোনো জায়গা খোঁড়াখুঁড়ি করলে অমন দু-চারটে জিনিস পাওয়া যাবে। তবে মহাভারতে যাকে গিরিদুর্গ বলেছে, এ জায়গাটা ছিল সেইরকম কিছু।
‘এরপর থেকে ও নিয়ে আর কেউ বিশেষ মাথা ঘামাত না। মিস্টার সান্যাল মূর্তি-টুর্তিগুলো সযত্নে একটা ঘরে সাজিয়ে রেখেছেন, ওঁর স্ত্রী ঝাড়ামোছা করেন আর আমরা বলি মিউজিয়াম— এই পর্যন্ত।
‘তারপর মাস তিনেক আগে, এমন একটা মূর্তি বেরোল, যেটা নিয়ে বেশ হইচই পড়ে গেল। পাথরের তৈরি সূর্যমূর্তি; অপূর্ব কারুকার্য আর প্রায় আস্ত।
‘মিস্টার সান্যালের এসব ব্যাপারে খুব উৎসাহ। তাঁর চিঠি পেয়ে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলেন ডক্টর সীতারাম ঝা। তিনি তো মূর্তিটা দেখেই লাফিয়ে উঠলেন। তারপর থেকে উনি কুন্তীপুরেই আছেন। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ান, মাপজোক করেন। কী খোঁজেন, কে জানে। মূর্তিটা এখন আছে কুন্তীপুরেই। ডক্টর ঝা যে গবেষণা করছেন, সেটা শেষ হলে ওটা ইউনিভার্সিটিতে নিয়ে যাওয়া হবে।’
দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘ডক্টর ঝা কি এখনও ওখানেই আছেন? অগাধ পণ্ডিত— পুরাতত্ত্ব আর নৃতত্ত্ব দুটোতেই দিকপাল। এত নাম শুনেছি ওঁর, এবার আলাপ করতে হবে।’
রঞ্জিত বলল, ‘হ্যাঁ, উনি আছেন বটে, তবে আলাপ করার সুবিধে হবে কি না জানি না। বড়ো অদ্ভুত লোক, কারুর সঙ্গে বড়ো একটা কথা বলেন না। এমনকী যাঁর অতিথি হয়ে আছেন, সেই মিস্টার সান্যালের সঙ্গে পর্যন্ত কালেভদ্রে দু-একটা কথা বলেন।’
‘কথা আবার বলবেন কী?’ সমরেশ মন্তব্য করল, ‘পুরাকীর্তি সম্বন্ধে তোদের যা জ্ঞানগম্যি! আর এই মরুভূমিতে থেকে থেকে তোদের মগজপোরা গোবর তো শুকিয়ে ঘুঁটে হয়ে গেছে।’
রঞ্জিত বলল, ‘যা যাঃ! তুই আর পুরাকীর্তি সম্পর্কে লেকচার দিস না। তবে, মরুভূমি মরুভূমি বলে তোর যে মনে হচ্ছে, সেটা আজ ছুটির দিন তাই। অন্যান্য দিন যথেষ্ট গাড়ি চলে, কনস্ট্রাকশনের মালপত্তর যায়, লোকজন যাতায়াত করে।’
এমন সময় রাস্তার বাঁ-পাশে বিরাট সাইনবোর্ড দেখা গেল। ইংরেজি আর হিন্দিতে লেখা ‘ধীরে চালান, সামনে অস্থায়ী সেতু।’
সমরেশ জিজ্ঞেস করল, ‘অস্থায়ী কেন?’
‘কেন তা আমি কি জানি? গত চার বছর যাবৎ দেখছি স্থায়ীভাবে অস্থায়ী। লেখাজোখা কম করিনি, কিন্তু এদেশের সরকারকে নড়ায় কার সাধ্যি! দয়া করে ব্রিজটা যে করে দিয়েছিলেন সেই ঢের। এখন দেখাশোনা করি আমরাই, আসল কাজের বাবুরা সব বেপাত্তা।
‘বুঝলি, আগে কুন্তীপুর কোল মাইনসের রাস্তাটাই ছিল আমাদের যাতায়াতের একমাত্র রাস্তা। কিন্তু তার অনেকগুলো অসুবিধে ছিল। প্রথমত, যে রাস্তাটা আমাদের পাওয়ার স্টেশন থেকে কুন্তীপুরে নেমেছে, সেটা যেমন খাড়া তেমনি সরু আর বিপজ্জনক। ওই রাস্তায় বোঝাই লরি তো একেবারেই চলে না। কয়লা আসে রোপওয়ে দিয়ে। দ্বিতীয়ত, কুন্তীপুরের সবচেয়ে কাছের রেলস্টেশন হচ্ছে বনটুলিয়া, প্রায় কুড়ি মাইল দূরে, মিটার গেজের ওপর। বনটুলিয়া থেকে কলকাতা বা পাটনা যেতে দু-বার বদল করতে হয়। তাই অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মধুপুরের সঙ্গে এই যোগাযোগের রাস্তাটা করানো হয়েছে। এদিকের রাস্তাটা অনেক কম ঢালু। তবে মাঝখানে ধারোয়া নদীটা পড়ে, তার ওপর শালবাল্লা পুঁতে আর লোহার জয়েস্ট দিয়ে একটা ব্রিজ খাড়া করা হয়েছে। তার ওপর দিয়ে দশটনী ট্রাক যায় বটে, কিন্তু বর্ষাকালে যখন ধারোয়ায় ঢল নামে, তখন তার অবস্থা অত্যন্ত সঙ্গিন হয়ে পড়ে। আমাদের সিভিল কনট্রাক্টর ইন্দার সিং তখন সব কাজ ছেড়ে ব্রিজটা সামলাতেই সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকে। প্রায় এসে গেছি। ওই যে বোল্ডারগুলো দেখছিস, ওগুলোর ওপাশে বাঁক ঘুরলেই ব্রিজটা দেখতে পাবি।’
মোড়টা ঘুরতেই ব্রিজটা দেখা গেল।
যার দুই উঁচু পাড়ের ভেতর সেতুবন্ধন করা হয়েছে, সেই নদীটা খুব ভয়ংকর কিছু বলে মোটেই মনে হয় না। মাঝারি রকমের চওড়া, বড়ো বড়ো পাথরের চাঙড়ের ভেতর দিয়ে পথ করে কুলকুল শব্দে বয়ে চলেছে। খুব একটা শান্ত শান্ত ভাব।
ব্রিজটা বেশ সরু। একটা লরি কোনোরকমে যেতে পারে। শালকাঠের তক্তা ফেলে ওপরের পাটাতনটা করা। তার ওপর দিয়ে যখন জিপ যাচ্ছিল, তখন ঘট ঘট ঘটাং ঘটাং করে শব্দ হচ্ছিল।
ব্রিজের মুখে জিপটা উঠতেই সমরেশ দেখল সামনে এক অপূর্ব দৃশ্য— অন্তত এমন দৃশ্য যা এরকম জায়গায় মোটেই কল্পনা করা যায় না। ব্রিজের মাঝামাঝি দুটি মেয়ে জিপটা এসে পড়ার আগেই পার হয়ে যাওয়ার জন্য শশব্যস্ত হয়ে হাঁটছে আর তার ফলে পেছন থেকে বড়োই মনোরম দেখাচ্ছে। একটি মেয়ে লম্বা-চওড়া, দারুণ ফর্সা, পরনে চুড়িদার আর সবুজের ওপর কালো ছোপ মারা কুর্তা ও অপরজনের মাঝারি গড়ন, মাজা রং, পরনে হলুদ রঙের স্ট্রেচ প্যান্টস আর লাল রঙের কলারওলা হাত-গুটোনো শার্টের মতো জামা। দু-জনেরই চুল কাঁধ পর্যন্ত ছাঁটা, হাতে ড্রয়িং বোর্ড আর কাঁধের ঝোলায় পাকানো কাগজের বান্ডিল। মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছিল সমরেশ।
ব্রিজটা পার হওয়ার আগেই দু-জনের খুব কাছে চলে এল গাড়িটা। তাড়াতাড়ি ওরা বাঁ-পাশে সরে গিয়ে যাওয়ার রাস্তা করে দিল। রঞ্জিত ঠিক ওদের পাশে এনে গাড়ি দাঁড় করাল। এবার দু-জনকে সামনে থেকে দেখল সমরেশ।
লম্বা মেয়েটিকে অন্য মেয়েটির পাশে অতিকায় বলে মনে হচ্ছিল। তার সব কিছুই খুব বড়ো বড়ো। প্রকাণ্ড নাক, বিশাল চোখ, চওড়া মুখ, পীনোন্নত পয়োধর। গায়ের রং প্রচণ্ড রকমের ফর্সা হলেও মুখটা বারংবার দেখতে ইচ্ছে করে না। অপর মেয়েটিকে তার আড়ালে প্রায় দেখাই যাচ্ছিল না। তবে নাকে একজোড়া অতিরিক্ত রকমের বড়ো চশমা আর তার পেছনে দুটি ঘনকৃষ্ণ আয়তপল্লব হাস্যোজ্জ্বল চোখ লক্ষ করা গেল।
লম্বা মেয়েটি হাত নেড়ে রঞ্জিতকে বলল, ‘হাই!’
রঞ্জিত মোলায়েম হেসে হাত নেড়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই উলটো দিক থেকে আরেকটা জিপ পেছনে ধুলোর মেঘ উড়িয়ে উল্কার মতো এসে ব্রিজের অন্য মুখটায় দাঁড়াল। একটা সাহেবের হাঁড়ির মতো প্রকাণ্ড মুন্ডু জিপ থেকে বেরিয়ে রুক্ষ কর্কশ গলায় চিৎকার করে বলল, ‘রানজিট। ব্রিজটা আটকে রেখো না। যদি গল্প করতে হয় তো রাস্তাটা ছেড়ে করো।’ সাহেবের ইংরেজিটা খুব শুদ্ধ না হলেও অত্যন্ত মর্মস্পর্শী।
রঞ্জিত দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘যাচ্ছ তো মদ গিলতে, এত তাড়া কীসের?’ তারপর চেঁচিয়ে বলল, ‘ব্রিজটা এখন পুরোপুরি তোমার, আমরা যাচ্ছি। তোমার দেরি করিয়ে দেবার জন্য অত্যন্ত দুঃখিত।’ বলে হ্যাঁচকা টানে ফার্স্ট গিয়ার দিয়ে হুস করে বেরিয়ে গেল।
দময়ন্তী চট করে পেছন ফিরে দেখে নিয়ে বলল, ‘সাহেবের কিন্তু খুব তাড়া আছে মনে হচ্ছে না। নিজেই এখন রাস্তা আটকে মেয়ে দুটির সঙ্গে গল্প করছে।’
দাঁতের ফাঁকে রঞ্জিত বলল, ‘হুঁ!’
‘লোকটা কে?’
‘ক্লাউস ফগলার। আমার বস। বেটা নাতসি— বেটার ঊর্ধ্বতন চতুর্দশপুরুষ নাতসি। বেটা মনে করে যে ও শ্লোয়েনডর্ফের ফ্যুয়েরার আর আমরা সব পোলিশ জু।’
অট্টহাস্য করে সমরেশ বলল, ‘ভারি অন্যায়, ভারি অন্যায়। দেখ, ভারত সরকারকে খবর দিয়ে কোনো লাভ হবে না, তুই বরং ইজরাইলে একটা চিঠি লিখে দে।’
জ্বলন্ত দৃষ্টিতে সমরেশের দিকে তাকাল রঞ্জিত। বিড়বিড় করে বলল, ‘ঘুঁটে পোড়ে, গোবর হাসে।’
রঞ্জিতের দুঃখটা কিন্তু দময়ন্তীর বেজেছিল। বলল, ‘ওসব সাহেবের কথা থাক। মেয়ে দুটির কথা বলুন। ওরা কারা?’
মুখের মেঘ কেটে গেল রঞ্জিতের। হেসে বলল, ‘বাড়ি এসে গেছি। চলুন, বলছি।’
ইতিমধ্যে নদী পার হয়ে জিপটা ক্রমশ ওপরে উঠছিল। সামনে একটা রুক্ষ পাহাড় পথরোধ করে দাঁড়িয়ে ছিল, মনে হচ্ছিল কাউকে নিজের ওপাশে যেতে দেওয়ার তার একদম ইচ্ছে নেই। কিন্তু সে নিতান্তই একটা অনড় বোবা পাহাড়, মানুষ তার ইচ্ছের কোনো পরোয়াই করে না। তার সমস্ত উগ্র, কর্কশ ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে পথটা একটা মোলায়েম বাঁক নিয়ে একটা খাঁজের মধ্য দিয়ে ওপাশে গিয়ে পড়েছে। রঞ্জিতের জিপ ওপারে গিয়েই গতি শ্লথ করল।
সামনে একটা উপত্যকা, তবে ছোটো সংস্করণ। চারদিকেই পাহাড় ঘেরা, যদিও পাহাড়গুলো কোনোটাই খুব উঁচু নয়। উপত্যকাটা মোটামুটি ডিম্বাকৃতি, পরিমাণে দু-শো একরের বেশি হবে না। ডিমটাকে মাঝখান দিয়ে চিরে রাস্তাটা চলে গেছে অন্যপ্রান্তে— যেখানে কয়লার বাঙ্কার আর বয়লার হাউস। তারপর চিমনি, পাওয়ার হাউস, কমপ্রেশর হাউস, সুইচ ইয়ার্ড ইত্যাদি। একদম কাছে একটা দোতলা লম্বা ধাঁচের কাচে-মোড়া অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিল্ডিং। এগুলো সব ডান দিকে; আর বাঁ-দিকে কতকগুলো ছোটো ছোটো সুন্দর টুইন কটেজ— স্টাফ কোয়ার্টার্স। আর তাদের পেছনে কতকগুলো দোতলা বাড়ি বড়ো অফিসারদের জন্য।
এদের মধ্যে দর্শনীয় হচ্ছে একটি পার্ক। চারদিকের ধূসর রুক্ষতার মধ্যে ঝকঝকে সবুজ। পার্কটার মাঝখানে রেলিং ঘেরা প্রকাণ্ড পুকুর, তার মধ্যে অসংখ্য ফোয়ারা দিয়ে সহস্র ধারায় জল শূন্যে ছিটিয়ে পড়ছে। অপূর্ব দৃশ্য।
জিপটা আস্তে আস্তে যাচ্ছিল। দময়ন্তী পার্কটা দেখে মুগ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘বাঃ, কী সুন্দর!’
রঞ্জিত বলল, ‘সত্যি চমৎকার। আসলে কিন্তু ওই পুকুরটার ফোয়ারাগুলো গরম-জল ঠান্ডা করবার জন্য। কিন্তু ভারি সুন্দরভাবে কাজে লাগানো হয়েছে ব্যাপারটাকে।’
সমরেশ জিজ্ঞেস করল, ‘কুলিরা থাকে কোথায়?’
আবার জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকাল রঞ্জিত। বলল, ‘তোর কি কোনোদিন সূক্ষ্ম রসবোধ বলে কোনো কিছু হবে না? একটা সুন্দর জিনিস দেখাচ্ছিলুম, তার মধ্যে কুলিরা থাকে কোথায় তাই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লি। যত্তো সব! ওই দূরে বাঙ্কারটার পেছনে ধাওড়া লাইন আর সাঁওতাল কুলি আর কামিনরা আসে নদীর ওপারে ডিংরিয়া গ্রাম থেকে। শ্রীমান ক্লাউস আপাতত ওই ডিংরিয়াতেই গেছে হাঁড়িয়ার সন্ধানে। হয়েছে? এবার চাস তো চল, সুয়েজ ডিসপোজাল প্লান্টটা দেখিয়ে নিয়ে আসি।’
বলতে বলতে গাড়িটা একটা টুইন কটেজের সামনে দাঁড়াল। ততক্ষণে রাস্তায় রাস্তায় বাড়িতে বাড়িতে আলো জ্বলে উঠতে শুরু করেছে, যদিও ওপরের আকাশে তখনও দিনের আলোর চিহ্ন সম্পূর্ণ মুছে যায়নি। চারদিকে পাহাড় ঘেরা হওয়ার ফলে এখানে রাত্রি আসে তাড়াতাড়ি, দিন শুরু হয় দেরিতে।
গাড়িটা দাঁড়াতে সমরেশ বলল, ‘এখানে কী?’
‘কী আবার?’ রঞ্জিত বলল, ‘নামবি এখানে, এটা আমার বাড়ি।’
‘তবে যে তুই বললি, সুয়েজ ডিসপোজাল প্লান্ট…’
.
৪
বাঁ-দিকের গেটটা খুলে রঞ্জিত ভেতরে ঢুকল।
সামনে খানিকটা লন, ফুলগাছ-টাছ একটাও নেই। যদিও ডান দিকের বাড়িটায় জিনিয়া, গাঁদা আর গার্ডেনিয়ায় বাগান আলো করে আছে। বাড়ি দুটোর বিভাজক পাথরের দেওয়ালটা নীচু। পাশের বাড়ির লনে লোকজন কেউ দেখা গেল না।
বাড়িটা ছোটো নয়, আবার অস্বস্তিজনক রকমের বড়োও নয়। সামনে চওড়া বারান্দা, দুটো শোয়ার ঘর, খাওয়া আর বসবার ঘর একসঙ্গে, বড়োসড়ো একটা রান্নাঘর, আধুনিক বাথরুম আর একটা অতিথিকক্ষ। পেছনে পাঁচিল ঘেরা একটু উঠোন আর চাকরদের ঘর। সব মিলিয়ে একটা আরামপ্রদ ব্যাপার।
জিনিসপত্র ঘরে গুছিয়ে রেখে, হাত মুখ ধুয়ে সবাই এসে লনে চেয়ার পেতে বসল। বাহাদুর রান্নাঘরে খাবার গরম করছিল, কিন্তু সবার হাতে এককাপ করে চা ঠিক ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।
বারান্দায় একটা ফ্লুয়োরোসেন্ট আলো জ্বলছিল, তার নীলাভ আলোয় আলোকিত হয়েছিল লনটা। মাথার ওপর ঝকঝকে তারাভরা আকাশ। দূরে ডান দিকে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিল্ডিং-এ গোটাকয়েক আলো জ্বলছিল আর বাঁ-দিকে পাওয়ার হাউসের বাইরে গোটাকতক আলো। এ ছাড়া সামনে স্বল্পালোকিত রাস্তাটা ছাড়া সমস্তই অন্ধকারে ঢাকা। ঠিক সমুখে খোলা সুইচ। ইয়ার্ডের ওপাশে গাঢ়তর অন্ধকার পাহাড়টাকে রাজসিক বলে মনে হচ্ছিল। মাথার ওপরে রোপওয়ের মৃদু ঘড়ঘড় শব্দ আর দূরে পাওয়ার হাউস থেকে ভেসে আসা একটা একটানা যান্ত্রিক আওয়াজ ছাড়া আর সমস্ত নিস্তব্ধ।
তিনজনে অর্ধবৃত্তাকারে বারান্দার আলোটা পেছনে করে সামনে তাকিয়ে বসে ছিল। রঞ্জিত বলল, ‘বউদি, জায়গাটা কেমন লাগছে আপনার?’
দময়ন্তী মৃদুস্বরে বলল, ‘খুব সুন্দর। এত ভালো আমি কল্পনাই করিনি।’ সমরেশও মাথা নেড়ে সায় দিল।
রঞ্জিত বলল, ‘জানেন, আমি বহু জায়গায় কাজ করেছি, তাদের বেশির ভাগই শহর থেকে দূরে ঈশ্বর বিবর্জিত জায়গা। কিন্তু কোনোখানেই আমার এত ভালো লাগেনি, যেমন এখানে এসে লাগল। এখানে বসে আমার মনে হয়, আমি যেন পৃথিবীর অনেক কাছাকাছি বসে আছি, আমি তার হৃদয়ের স্পন্দন শুনতে পাচ্ছি আর পৃথিবী তার দু-হাত দিয়ে আমাকে তার বুকের কাছে আঁকড়ে রেখেছে। ওপরে মুখ তুললে তার হাতের ওপর দিয়ে আমি শুধু ওই আকাশ দেখি। রবীন্দ্রনাথের সেই গানটার মতো—
আমায় ঘেরি, আমায় চুমি,
কেবল তুমি, কেবল তুমি।
রঞ্জিত দম নেওয়ার জন্য থামল। শঙ্কিত চোখে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে সমরেশ বলল, ‘হ্যাঁরে রঞ্জিত, বলি, তুই কারো প্রেমে-ট্রেমে পড়িসনি তো? নাকি তোর পুরোনো আমাশাটা আবার চাড়া দিয়ে উঠেছে?’
রঞ্জিতের স্বপ্নজড়িমা পলকে ভেগে গেল। খাড়া হয়ে বসে শূন্যে দু-হাত ছুড়ে দিয়ে বলল, ‘তোর মতন নীরস নিরেট গবেট জগতে আর ক-টা আছে বলতে পারিস? বলি, এটা তো স্বীকার করবি যে এ জায়গাটার একটা বিশেষ চার্ম আছে? একটা মোহিনী শক্তি আছে? এমন একটা নির্জন নীরবতা…’
বলামাত্র দড়াম করে অদূরেই একটা শব্দ হল। সমরেশ আর দময়ন্তী চমকে উঠে দেখল, সাইকেল থেকে না নেমেই তার সামনের চাকা দিয়ে সশব্দে ধাক্কা দিয়ে গেটটা খুলে একজন ভেতরে প্রবেশ করল, তারপর চলন্ত বাহন থেকেই তড়াক করে লাফ দিয়ে নেমে লনের ওপর এসে উঠল। একটি মেয়ে। আলো-আঁধারে তার লাল রঙের জামা আর গাঢ় হলুদ রঙের স্ট্রেচ প্যান্টস দেখে বোঝা গেল, ইনি ব্রিজের ওপর দেখা দুটি মেয়ের একজন।
কোনোদিকে দৃকপাত না করে মেয়েটি বলে উঠল, ‘রঞ্জিতদা, মা বলে পাঠালেন যে, আজ রাত্রে আপনার আর আপনার বন্ধুদের আমাদের বাড়িতে খাওয়ার নেমন্তন্ন। যদি ভুলে যান, কপালে আপনার অশেষ দুঃখ আছে।’ অদ্ভুত মিষ্টি সুরেলা গলা মেয়েটির।
সমরেশ আর দময়ন্তী যতই চমকে উঠুক, মেয়েটির সশব্দ প্রবেশে কিন্তু রঞ্জিতকে বিন্দুমাত্র বিচলিত দেখা গেল না। এহেন ব্যাপারে সে বেশ অভ্যস্ত মনে হল। খুব গম্ভীর গলায় বলল, ‘ভোলবার কি জো আছে? আজ সকাল থেকে তুমি পঞ্চম বার্তাবাহক। ভোরবেলা প্রথমে আমার কাঁচা ঘুমটি ভাঙিয়ে তোমার বাবা স্বয়ং সংবাদটি দেন, তারপর আসে তোমাদের চাকর, তারপর ড্রাইভার, স্টেশনে বেরোনোর একটু আগে পুনরায় তোমাদের চাকর আর সবশেষে তুমি। তোমার মাকে বলো গিয়ে আমরা আর একটু রাত হলেই যাব। তাঁর চিন্তার কোনো কারণ নেই।’
মেয়েটি কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রঞ্জিতের কথা শুনছিল। দময়ন্তী দেখছিল, তরতরে মিষ্টি মুখখানি মেয়েটির। চোখে একজোড়া অতিরিক্ত রকমের বড়ো চশমার মাঝখান দিয়ে একটি টিকোলো নাক বেরিয়ে আছে, তার নীচে পাতলা অধরোষ্ঠ। পোশাক-আশাক আধুনিক বটে, কিন্তু মুখে প্রসাধনের চিহ্নমাত্র নেই। রোগাপটকা স্বাস্থ্য, আর পাঁচটা কলেজে পড়া বাঙালি মেয়ের মতোই। তবে চোখ দুটি উজ্জ্বল। চশমার কাচে বারান্দার আলোর প্রতিফলন সত্ত্বেও সেটা দেখতে অসুবিধে হয় না।
রঞ্জিতের কথা শেষ হতেই মেয়েটি বলল, ‘অলরাইট! তবে বেশি রাত করবেন না যেন, তাহলে কিন্তু মা নিজেই আসবেন।’ বলে পেছন ফিরে সাইকেলটা নিয়ে একটু দৌড়ে প্যাডেলে পা না দিয়েই একলাফে সিটে উঠে বসে আধখোলা গেটের মধ্যে দিয়ে অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় সাঁ করে বেরিয়ে চলে গেল। রাস্তার প্রায় অন্ধকার থেকে সুরেলা কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘গেটটা বন্ধ করে দেবেন রঞ্জিতদা, ভুলে যাবেন না যেন।’
দময়ন্তী বলল, ‘দেখেছ? এই অন্ধকারের মধ্যে হুস করে বেরিয়ে গেল, অথচ সাইকেলে একটা আলো পর্যন্ত নেই!’
রঞ্জিত ব্যাজার গলায় বলল, ‘শুধু আলো কেন, ব্রেকও নেই, ঘন্টিও নেই। কতবার বলেছি, দাও, সাইকেলটা ওয়ার্কশপ থেকে মেরামত করিয়ে দিই, কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা।’
‘মেয়েটি কে?’ সমরেশ খুব সাবধানে প্রশ্ন করল।
‘লোপামুদ্রা। মিস্টার নিশীথ সান্যালের মেয়ে। যাদবপুরে ইংরিজিতে এমএ পড়ে, ছুটিতে এসেছে। এক নম্বরের গেছো।’
দময়ন্তী বলল, ‘হ্যাঁ, সে তো দেখতেই পেলুম। আচ্ছা, ওর সঙ্গে যে অন্য মেয়েটিকে দেখেছিলুম, সে কে? সে কি বাঙালি?’
‘না, পাঞ্জাবি। এখানকার সিভিল কনট্রাক্টর ইন্দার সিংয়ের মেয়ে প্রমীলা। কলকাতায় বিএ পাশ করে আর্ট কলেজে পড়ছে এখন। তবে ছবি যা আঁকে, সে-বিষয়ে যত কম বলা যায়, ততই ভালো। এককালে নাকি ভালো অ্যাথলিট ছিল, তাই নিয়ে থাকলেই পারত, জীবনে উন্নতি করত। ওই যে দেখলেন না, ওরা কাগজপত্র নিয়ে ফিরছিল— ওরা গিয়েছিল ডিংরিয়া গ্রামে ছবি আঁকতে। কালকে জোগাড় করে দু-জনের ছবিই দেখাব আপনাকে। লোপামুদ্রা কোনো ট্রেনিং না থাকা সত্ত্বেও প্রমীলার চেয়ে বোধ হয় হাজার গুণ ভালো ছবি আঁকে। শুধু বড়ো তড়বড় করে বলে শেষ করে উঠতে পারে না। এ ছাড়া, অনেক প্রতিভা আছে মেয়েটির। ভালো রবীন্দ্রসংগীত গায়, পিয়ানো বাজায়, ইউনিভার্সিটির চ্যাম্পিয়ন সুইমার আর পুডিং যা রাঁধে— অসাধারণ। কিন্তু এত গেছো, কোনো কিছু যে বেশিক্ষণ সিরিয়াসলি করবে, তা আর হয়ে ওঠে না। ওকে যখন প্রথম দেখি, তখন ও হায়ার সেকেন্ডারি দেওয়া স্কার্ট-পরা মেয়ে, আর আজ ও এমএ পড়ে। এতদিনেও স্বভাবের কিন্তু কোনো পরিবর্তন দেখলুম না। সেই হড়বড় করে চলা, আর তড়বড় করে কথা বলা।’
সমরেশ বলল, ‘হুঁ! যাক, তুই যেন এখানকার চার্ম সম্বন্ধে কী বলছিলি?’
রঞ্জিত কোনো জবাব দেওয়ার আগেই দূরে একটা জিপের ক্রুদ্ধ গর্জন শোনা গেল। তিনজনে মাথা উঁচু করে দেখল, ডান দিকে দূরে একজোড়া চোখ ধাঁধানো অত্যুজ্জ্বল সিল্ড বিম হেডলাইট এক লাফে পাহাড়ের ওপর থেকে উপত্যকায় নামল, তারপর প্রচণ্ড গতিতে এগিয়ে এসে ওদের সামনে দিয়ে উড়ে চলে গেল।
রঞ্জিত বিড়বিড় করে বলল, ‘বস ফিরলেন।’
সমরেশ প্রশ্ন করল, ‘তোর বস জার্মানিতে দমকল চালাত নাকি রে?’
এবারও জবাব দেবার সুযোগ পেল না রঞ্জিত। কারণ, তার পরমুহূর্তেই ওদের বাঁ-দিকে কিছু দূরে ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে ব্রেক কষার একটা কর্ণবিদারী আওয়াজ হল, তারপরেই একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। তিনজনে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। একদৌড়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াল ওরা।
দূরে সারি সারি কোল-বাঙ্কারের সামনে একটা গাড়ি উলটে পড়ে আছে বোঝা গেল, আর তার চারদিক ঘিরে লকলকে আগুনের শিখা লাফিয়ে উঠছে।
রঞ্জিত দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘ফগলার! কী সর্বনাশ!’ বলে ঊর্ধ্বশ্বাসে নিজের জিপের দিকে ছুটল। এবং কয়েক লহমার মধ্যে তিনজনকে নিয়ে ওর জিপ যে গতিতে ধাবিত হল, তা আগেরটির চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়।
.
৫
অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় রঞ্জিতের লোকেরা কতকগুলো বড়ো বড়ো ফ্লাডলাইট কোল-বাঙ্কারের থামগুলোর সঙ্গে লটকে দিয়ে জায়গাটা আলোকিত করে ফেলেছে। চারজিকে অজস্র লোক— এমনকী বাঙ্কারের ওপরও কৌতূহলী দর্শকদের ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছে। কুন্তীপুর আউটপোস্টের দারোগা আর জনাপাঁচেক সেপাই থার্মাল পাওয়ার স্টেশনের সিকিউরিটির জনাদশেক নেপালি দারোয়ানের সাহায্যে ভিড় কন্ট্রোল করছে। একটু আগেই যে জায়গাটাকে প্রায় জনহীন বলে মনে হচ্ছিল, তার ভেতরে যে এত লোক লুকিয়ে ছিল ভাবতে আশ্চর্য লাগে।
ফগলারের জিপের আগুন নিভে গেছে। সাহেবের জ্ঞানহীন মৃতপ্রায় শরীরটা তুলে নিয়ে মধুপুরের দিকে ছুটে চলে গেছেন কুন্তীপুরের মেডিক্যাল অফিসার ডা রমেশ পাণ্ডে আর মি সান্যাল স্বয়ং। কিন্তু একটি রক্তাক্ত বীভৎস মৃতদেহ অদ্ভুত বিকৃত ভঙ্গিতে পড়ে আছে রাস্তার মাঝখানে। সিভিল কনট্রাক্টর ইন্দার সিং বড়ো শোচনীয়ভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন।
পুলিশের ইনভেস্টিগেশন শেষ না হলে মৃতদেহ সরানো যাচ্ছে না। আর সরানো যাচ্ছে না কৌতূহলী জনতাকে— যারা মাছির মতো ঘিরে রয়েছে মৃতদেহটাকে।
দর্শকদের ভিড়ের বৃত্তের বাইরে রঞ্জিতের জিপের ভেতর দু-হাতে মুখ ঢেকে বসে ছিল দময়ন্তী। রক্তে, ঘিলুতে মাখামাখি সেই প্রাণহীন ভয়াবহ মুখটার বিভীষিকা মন থেকে সরিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। আর জিপের বনেটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে ছিল লোপামুদ্রা। সমস্ত ঘটনার ভীষণতায় সেও কেমন হতবাক, হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল।
একটু বাদে ভিড় থেকে বেরিয়ে এল সমরেশ, রঞ্জিত আর দারোগা সাহেব। রঞ্জিত বলল, ‘লোপামুদ্রা যা বলেছে, কথাটা ঠিক বউদি। দুটি কামিনও দেখেছে ইন্দার সিংকে বুকে হেঁটে জিপের সামনে এসে পড়তে। অবশ্য ওরা উলটোদিক থেকে আসছিল, হেডলাইটের তীব্র আলোয় স্পষ্ট কিছু দেখতে পায়নি। তাহলেও লোপামুদ্রা যা বলেছে, তার সঙ্গে প্রায় সবটাই মিলে গেছে। জিপটা বাঙ্কারগুলোর মাঝামাঝি এসে পড়লে উলটোদিকের ঝোপের ভেতর থেকে ইন্দার সিং হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এসে সামনে পড়েন। ব্যাপারটা আত্মহত্যাই। অন্তত এ ব্যাপারে ফগলারের কোনো দোষ নেই, সেটা স্বীকার করতেই হবে। কারণ রাস্তায় দাগ দেখে বোঝা যাচ্ছে যে ও প্রায় পনেরো গজ দূর থেকে ব্রেক কষে আর ডান দিকে গাড়ি ঘোরায়। তবু গাড়ির গতি এত বেশি ছিল যে ঠিক সামলাতে পারেনি।’
‘ইন্দার সিং হামাগুড়ি দিয়ে এলেন কেন?’ দময়ন্তী আত্মগতভাবে জিজ্ঞাসা করল।
দারোগা সাহেবটি নবীন যুবক, বোধ হয় সদ্য চাকরিতে ঢুকেছেন। এতক্ষণ অসীম কৌতূহল আর কিছুটা কৌতুকমিশ্রিত অবিশ্বাস নিয়ে সমরেশের বিশাল শরীরের আড়াল থেকে একদৃষ্টে দময়ন্তীকে দেখছিলেন। এবার শব্দ করে হেসে বললেন, ‘নশেমে থে, আউর ক্যা! আপনারা জানেন না, কিন্তু রঞ্জিতবাবুর অজানা নেই যে সূর্য ডুবলে সিং সাহেবকে বোতল ছাড়া কেউ কখনো দেখেনি।’
রঞ্জিত কথাটা সমর্থন করল। বলল, ‘কথাটা সত্যি। আচ্ছা বউদি, আপনি কি আর কিছু জানতে বা দেখতে চান?’
‘না,’ দময়ন্তী বলল, ‘শুনলুম, ডিএসপি আসছেন মধুপুর থেকে। তিনি নাকি ইন্দার সিংয়ের বন্ধুলোক। তিনি যখন তদন্ত করবেন, তখন যেন আমাকে সঙ্গে থাকতে দেওয়া হয়।’
দারোগা সাহেব কথাটা বুঝলেন। বললেন, ‘বেশক! এ আর এমন বেশি কথা কী? আমি সব ব্যবস্থা করে দেব। ডিএসপি সাহাব খুব ভালো লোক। আমার কথা তিনি কখনোই ফেলতে পারবেন না।’
‘প্রমীলা এখনও কাঁদেনি, না রঞ্জিতদা?’ লোপামুদ্রা জিজ্ঞেস করল।
‘নাঃ, ওই বাজারের নীচে ট্রলি লাইনের ওপর সে পাথরের মতো বসে আছে তো বসেই আছে। কাউকে চিনতে পারছে বলেও মনে হচ্ছে না, কারোর কথা কানেও ঢুকছে না। শকটা বড়ো জোর লেগেছে। তবে এখন দেখলুম, বিজয় অরোরার স্ত্রী আর হরবন্স চোপরার গিন্নি, দু-জনে দু-পাশে বসে আছে।’
‘আমি আর একবার যাব, রঞ্জিতদা? ও পাগল হয়ে যাবে না তো?’
‘গিয়ে কোনো লাভ নেই লোপা, ও তোমাকে চিনতেও পারবে না। তার চেয়ে বাড়ি চলো। তোমার সাইকেলটা দাও, পাঠিয়ে দিচ্ছি। আর সবাই মিলে চলো, তোমাদের বাড়ি যাই। প্রমীলা কাঁদবে। শকটা একটু কেটে গেলেই কাঁদবে। আপাতত এই ভদ্রমহিলার শকটাও একটু শান্ত করা দরকার। কি বলেন, বউদি? এই নার্ভ দিয়ে আপনি গোয়েন্দাগিরি করেন?’ বলে মৃদু হাসল।
হঠাৎ জিপের পেছন থেকে একটা মোটা গলায় ইংরেজিতে প্রশ্ন হল, ‘লোপু! তুমি এখানে মিস্টার রায়চৌধুরীর জিপের ওপর বসে কী করছ? আর এত ভিড়ই-বা কীসের? কোনো জংলি কার্নিভ্যাল হচ্ছে নাকি?’
প্রশ্নকর্তা একজন পক্বগুম্ফ, পক্বকেশ বৃদ্ধ। পরনে কালো সার্জের ট্রাউজার আর কালো-সাদায় চৌখুপি গলাবন্ধ কোট, চোখে পুরু লেন্সের চশমা আর গভীর ভ্রূকুটি। তাঁর সঙ্গে একজন সঙ্গীও আছেন, তবে তিনি সম্পূর্ণ বিপরীত। অসাধারণ সুদর্শন, প্রায় বোম্বে ফিলমের কোনো নামজাদা নায়কের মতো চেহারা, অঙ্গে আধুনিক মূল্যবান পোশাক, কাঁধে ঝোলা আর মুখে রমণীমোহন হাসি।
লোপামুদ্রা বলল, ‘না, ডক্টর ঝা। কার্নিভ্যাল নয়, একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। মিস্টার ইন্দার সিং মারা গেছেন।’
ড ঝা-র মুখে কোনো বিকার দেখা গেল না। বললেন, ‘অ! কিন্তু পুলিশ দেখছি যেন। আমাদের বাড়ি যাওয়ার কোনো অসুবিধে হবে না তো?’
দারোগাবাবু তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বললেন, ‘না, না, প্রফেসার সাহাব। আপনাদের কেউ বাধা দেবে না। এটা একটা আত্মহত্যার কেস।’
‘ভালো।’ বলে ড ঝা তাঁর সঙ্গীর দিকে ফিরলেন, ‘চলো রাজীব। আমি অত্যন্ত ক্লান্ত।’
রাজীবের মুখের হাসি ততক্ষণে মিলিয়ে গেছে। দু-চোখে নেমেছে বেদনার ছায়া। রঞ্জিতকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইন্দার সিং আত্মহত্যা করল শেষ পর্যন্ত? বাঙ্কারের ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে নিশ্চয়ই?’
ফ্যাকাশে মুখ তুলে রঞ্জিত বলল, ‘না, ক্লাউসের জিপের নীচে পড়ে।’
‘ক্লাউসের জিপ?’ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন রাজীব। কিন্তু অধৈর্যভাবে হাতের মোটা লাঠিটা মাটিতে ঠুকে ড ঝা ধমকে উঠলেন, ‘সময় নষ্ট কোরো না রাজীব। বাড়ি গিয়ে অনেকগুলো স্পেসিমেন আমাদের ট্যাগ করতে হবে।’
প্রশ্রয়ের হাসি হাসলেন রাজীব। বললেন, ‘হ্যাঁ, সাহেব চলুন।’ তারপর রঞ্জিতকে আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার জিপে এঁকে তো চিনতে পারলুম না।’
রঞ্জিত বলল, ‘ইনি আমার বন্ধুর স্ত্রী। আর ইনি আমার বন্ধু সমরেশ। আপনাদের বাড়িতেই নিয়ে যাচ্ছিলুম এঁদের, মিসেস সান্যাল নেমন্তন্ন করেছেন। সেখানেই আবার দেখা হবে।’
ড ঝা একটু এগিয়ে গিয়েছিলেন। সেখান থেকেই ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘দেখা হবে না। আর রাজীব, মিস্টার সান্যালকে বলবে, কালকেই আমরা ক্যাম্পে থাকার ব্যবস্থা করব। মিসেস সান্যালের এই অন্তহীন নেমন্তন্নগুলোর ঝঞ্ঝাট পোয়াবার জন্য আমার এখানে আসা নয়।’
‘ঠিক আছে সাহেব, তাই হবে।’ বলে রাজীব হঠাৎ মুন্ডুটা জিপের ভেতর গলিয়ে দিয়ে দময়ন্তীকে বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না যেন। ওঁর স্বভাবই এইরকম। নিজের কাজটুকুর বাইরে ওঁর আর কোনো জগৎ নেই। দেখছেন না, এই বয়েসেও এত রাত অবধি মাঠেঘাটে জ্ঞানের সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মিস্টার সান্যালের বাড়িতে আপনার সঙ্গে ঠিক দেখা করব, দেখে নেবেন।’ বলে হতবাক দময়ন্তীকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মুন্ডু বের করে নিয়ে এক দৌড়ে ড ঝা-র কাছে চলে গেলেন।
সমরেশ হাঁ করে এতক্ষণ সমস্ত ঘটনাটা দেখছিল। দু-জনে ভিড়ের মধ্যে অদৃশ্য হলে রঞ্জিতকে জিজ্ঞেস করল, ‘এই কি তোর ড সীতারাম ঝা?’
‘হ্যাঁ।’
‘আর সঙ্গের চ্যালাটি?’
‘ওর নাম রাজীব সিনহা। ইতিহাসের নামজাদা ছাত্র ছিল, ডক্টর ঝা-র চোখের মণি। ওর বাবা নাকি বোম্বের অনেকগুলো কোম্পানির মালিক, লক্ষপতি লোক। ছেলের অবশ্য সেসব কোম্পানির চেয়ে ইতিহাসেই আগ্রহ বেশি, তাই না লোপামুদ্রা?’
লোপামুদ্রার মুখে একটা রহস্যময়, বিচিত্র হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘হ্যাঁ, তাই তো শুনি।’ বলে একলাফে জিপ থেকে নেমে মাটিতে শোয়ানো হাড়-জিরজিরে সাইকেলটা তুলতে তুলতে বলল, ‘আমি চললুম। আপনারা আসুন।’ বলে একলাফে বাহনে উঠে ভিড়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
রঞ্জিত কাতর চোখে তাকিয়ে ছিল। সমরেশ বলল, ‘রাজীবচন্দ্রের ইতিহাস ছাড়াও অন্য কোনো কোনো জিনিসের প্রতিও বেশ আগ্রহ আছে বলে মনে হচ্ছে যেন?’
রঞ্জিত বলল, ‘হুঁ। লোকটা একটা স্কাউন্ড্রেল, ডন জুয়ান মার্কা হাসিতে মেয়ে পটাবার যম। লোপামুদ্রার মতো মেয়েও যে কী করে ওর কবজায় গেল! এখন নাকি দু-জনে গভীর প্রেম।’
‘কে বললে আপনাকে?’ দময়ন্তী প্রশ্ন করল।
‘সেইরকমই তো শুনতে পাই। রাজীবও আমাকে সেইরকম হিন্টই দিয়ে থাকে। আর হবে নাই-বা কেন? দু-জনেই বিরাট ধনী পরিবারের, ইংরেজি-ঘেঁষা সমাজে ঘোরাঘুরি করে, পপ কালচার অনুধাবন করতে পারে, আবার মোটামুটি লেখাপড়াও জানে। কাজেই দু-জনের মনের, মতের, মানসিকতার মিল হওয়াই স্বাভাবিক। আর ছেলেটার চেহারা দেখেছিস তো? মুন্ডু ঘুরিয়ে দেবার মতোই। সবই ভালো ছিল, কিন্তু ছেলেটা যে দুশ্চরিত্র।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রঞ্জিত ড্রাইভারের সিটে উঠে বসল।
সমরেশ ওর পাশে উঠে বসে খুব আস্তে আস্তে বলল, ‘লোপামুদ্রাকে উদ্ধার করবার জন্য তুই একবার লড়ে গেলে পারিস না?’
হেসে ফেলল রঞ্জিত। বলল, ‘দুর গাধা! লোপামুদ্রার প্রতি কি আমার সেরকম কোনো দুর্বলতা আছে বলে ভেবেছিস নাকি তুই? ওকে তো সেই ফ্রক-পরা অবস্থা থেকে দেখে আসছি, এই সেদিনও ও আমার পিঠের ওপর কথাবার্তা নেই, গুম গুম করে কিল মারত। এখন যদি হঠাৎ ওকে বোকা বোকা মুখ করে গিয়ে বলি, লোপু, তুমি আমায় বে করবে? তাহলে ব্যাপারটা কী হবে বুঝতে পারছিস? একেবারে লজ্জাদার কেচ্ছা!
‘তা ছাড়া তোকে আগেই বলেছি না, এসব অতি উচ্চমহলের ব্যাপার! আমার পক্ষে তার ধারে-কাছেও যাওয়া অসম্ভব। তোর বাবা তো তাও একটা মোটামুটি ভালো চাকরি করতেন, আর আমার বাবা ছিলেন মুঙ্গের জেলা স্কুলের অঙ্কের টিচার। যখন মারা যান, টাকার অভাবে আমার পড়াশুনো বন্ধ হবার জো হয়েছিল, সে তো তুই জানিস। তারপর আমার দুই দিদির বিয়ে দিতে হল। সেই পর্বতপ্রমাণ ঋণের বোঝা আজও সবটা নামেনি ঘাড় থেকে। আমার অ্যাসেটই বল আর লায়াবিলিটিই বল, সব ওই ঋণটুকু। এ ছাড়া আমার ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স বলতেও কিছু নেই, বাড়িজমি বলতেও কিছু নেই। আমাকে প্রায় মুক্ত বিহঙ্গ বলতে পারিস।’
দময়ন্তী বলল, ‘তাতে কী প্রমাণ হয়? আপনার কি ধারণা যে মেয়েদের কাছে টাকাটাই সবচেয়ে বড়ো জিনিস?’
‘নয় কেন? বউদি, আপনি তো অপরাধতত্ত্ব নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, আপনার তো এ বিষয়ে কোনোরকম সন্দেহ বা রঙিন বিশ্বাস থাকবার কথা নয়। তা ছাড়া আরও একটা পয়েন্ট আছে। সেটা সামাজিক স্তরভেদের। মুঙ্গের জিলা স্কুলের ছেলে আর আগাগোড়া লোরেটোতে পড়া মেয়ের মধ্যে ফারাক অনেকখানি। আমরা বুগী আর সাম্বার মধ্যে তফাত বুঝিনে, ইংরেজিটা আপসে আসে না, আগে মনে মনে বাংলা থেকে ট্রানস্লেট করি, তারপর বলি। আচ্ছা, দারোগা সাহেব, আমরা চলি তাহলে। ডিএসপি এলে এত্তেলা পাঠাবেন।’
দময়ন্তী বলল, ‘আপনি মস্ত ভুল করছেন। মনের মিলের জন্য যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা টাকাও নয়, চোস্ত ইংরিজিও নয়, সেটা রুচির, মূল্যবোধের। এই রুচি বা মূল্যবোধ আমরা তৈরি করি আমাদের পরিবার থেকে, পরিপার্শ্ব থেকে এবং স্কুল-কলেজের শিক্ষা থেকেও। কাজেই আপনি একচক্ষু হরিণের মতো মাত্র একটা দিকই দেখেছেন, হয়তো অন্যদিকটা বাদ দিয়ে যাচ্ছেন।’
মাথা নেড়ে সমরেশ বলল, ‘ঠিক, ঠিক। তুই খামোখা হীনম্মন্যতায় ভুগছিস। গো উ অ্যান্ড উইন হার।’ বলে তর্জনীটা রঞ্জিতের নাকের সামনে সজোরে নেড়ে দিল।
ক্যাঁচ করে ব্রেক কষে জিপটা দাঁড় করিয়ে ফেলল রঞ্জিত। হতাশভাবে স্টিয়ারিংয়ের ওপর একটা চাপড় মেরে বলল, ‘কী আরম্ভ করেছিস কী তোরা? তোরা কি পাগল হলি, না আমি পাগল হলুম, কে আমায় বুঝিয়ে দেবে? কোথাও কিছু নেই, তোরা একটা কেস খাড়া করে ফেলতে চাস? ভাই সমরেশ! আমি দিব্যি আছি। খাচ্ছি, দাচ্ছি, বেড়িয়ে বেড়াচ্ছি। আমি একচক্ষু হরিণও নই, হীনম্মন্যতাতেও ভুগছি না। এই গরিবকে ঘোড়ারোগ ধরাসনি, বাপ। প্রেম জিনিসটা অমনি গজায় না। তার জমি দরকার হয়, গোড়ায় জল দিতে হয়। আমি অনেকটা আমার বাড়ির বাগানটার মতো। সেখানে ফুল গজায় না, শুধু ঘাস হয়— গোরুর খাদ্য, কবির কাজে লাগে না।’
সমরেশ উদাস হয়ে বাইরে তাকিয়ে নির্লিপ্ত গলায় আবৃত্তি করল,
মাটির আঁধার নীচে কে জানে ঠিকানা,
মেলিতেছে অঙ্কুরের পাখা,
লক্ষ লক্ষ বীজের বলাকা।
দময়ন্তী তাড়াতাড়ি মুখে আঁচল চাপা দিল। রঞ্জিত, ‘হোপলেস,’ বলে একটা গর্জন করে জিপ চালু করে দিল।
.
৬
মিসেস সরমা সান্যাল মোটাসোটা হাসিখুশি গৃহিণীবাহিনী জাতীয়া মহিলা হলেও অত্যন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্না এবং তাঁর কথাবার্তাও অত্যন্ত সরল আর প্রাঞ্জল। রেখে-ঢেকে কথা বলা তাঁর আসে না।
সমরেশরা আসামাত্র হইহই করে ওদের সম্বর্ধনা করেই অদৃশ্য হয়েছেন রান্নাঘরে। তবে যাওয়ার আগে জানিয়ে গেছেন যে এহেন একটা ব্যাপার যে ঘটবে, সেটা তিনি অনেক আগেই জানতেন। কেন যে পুরুষমানুষেরা মদের মতো এরকম একটা দুর্গন্ধযুক্ত বিস্বাদ জঘন্য বস্তু কোঁত কোঁত করে গেলে এবং তারপরে অদ্ভুত মাথামুন্ডুহীন ব্যবহার করে, তা তাঁর বুদ্ধির অগম্য। লোপামুদ্রার বাবাকে অনেক কষ্টে ঠেকিয়ে রেখেছেন। একথাও অনেকদিন আগেই বলে দিয়েছেন যে ইন্দার সিং রোজ যে পরিমাণে মদ খায়, তাতে সে একদিন বেঘোরে মারা পড়বেই। সকলেই দেখতে পাচ্ছে যে তাঁর অনুমান অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে। তা ছাড়া ক্লাউসটাও পাঁড় মাতাল। সমরেশ আর রঞ্জিতের ঘটে যদি বুদ্ধি বলে কোনো পদার্থ থাকে, তাহলে তারা যেন এইসব মাতালের উদভুট্টি কাণ্ডের থেকে শতহস্ত দূরে থাকে।
স্বভাবতই অতিথিরা এই বাক্যসম্প্রপাতের সামনে কোনোরকম মুখ খোলবার সুযোগই পায়নি। এখন ভদ্রমহিলা দরজার আড়ালে অদৃশ্য হতে আরেকজন ঘরে প্রবেশ করল। রাজীব। এর মধ্যেই তার পোশাক পালটানো হয়ে গেছে। ফিনফিনে আদ্দির লখনৌ চিকনের পাঞ্জাবি আর পায়জামার ভেতর দিয়ে গায়ের গোলাপি রং যেন ফেটে বেরোচ্ছে।
ঘরে ঢুকেই জাপানি কায়দায় দময়ন্তীকে বাও করে তার উলটোদিকের একটা সোফায় বসে পড়ল রাজীব। মিষ্টি হেসে বলল, ‘দেখেছেন তো, ঠিক চলে এসেছি! বলেছিলুম কিনা?’
দময়ন্তী কাষ্ঠ হেসে মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ, সে তো দেখতেই পাচ্ছি।’ বলে করুণ চোখে বাকি দু-জনের দিকে সাহায্যের আশায় তাকাল।
রাজীব কিন্তু তাদের সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আবার দময়ন্তীকে বলল, ‘আমার পরিচয় রঞ্জিতবাবু নিশ্চয়ই দিয়েছেন। আপনার নাম কিন্তু এখনও জানতে পারিনি। অবশ্য আপনার স্বামীর নাম আমার এখনও মনে আছে— সমরেশ, তাই না?’
পুনরায় কাষ্ঠহাসি হাসল দময়ন্তী, ‘ঠিকই মনে আছে আপনার। আমার নাম দময়ন্তী।’
‘বাঃ, বাঃ, কী চমৎকার নাম! চাকরি-বাকরি করেন, না শুধুই ঘরগেরস্থালি?’
‘ঘরগেরস্থালিও করি, চাকরিও করি।’
‘চাকরি করেন?’ জিভের ডগায় চুকচুক শব্দ করল রাজীব ‘আপনার মতো মহিলাদের চাকরি করতে দেখলে ভীষণ কষ্ট হয় আমার।’
‘এটা কিন্তু খুব প্রাচীনপন্থীর মতো কথা হল রাজীববাবু,’ রঞ্জিত বলে উঠল, ‘আজকালকার দিনে মেয়েদের চাকরি পুরুষের চাকরি করার মতো স্বাভাবিক নয় কি? আপনার পরিবারের মেয়েদের চাকরি করতে যাওয়াটা হয়তো দুঃখের হতে পারে, কিন্তু আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে তা নয়; আপনি নিজের পয়সা খরচ করে আপনার শিক্ষকের সঙ্গে মাঠঘাটে ঘুরতে পারেন আপনার ইতিহাসের নেশা চরিতার্থ করবার জন্য, আমরা তা পারিনে। আমাদের মেয়েদের চাকরি করতেই হয়।’
আলোচনাটা ঠিক এদিকে মোড় ঘুরবে আশা করেনি রাজীব। একটা লাগসই জবাব তার মুখে আসতে দেরি হতে লাগল। ইতিমধ্যে লোপামুদ্রা কখন যে ঘরে ঢুকে একটা জানলার সিলের ওপর উঠে বসে আছে সেটা কেউই লক্ষ করেনি, সবাই রাজীবকে দেখতেই ব্যস্ত ছিল। এখন ঘরের তিক্ত স্তব্ধতা ভেঙে লোপামুদ্রা বলে উঠল, ‘প্রাচীনপন্থীই বলুন আর যাই বলুন রঞ্জিতদা, আমি কিন্তু চাকরি করতে পারব না। সাত-আট ঘণ্টা এক জায়গায় বসে থাকা— ও আমার ধাতে সইবে না।’
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে নাটকীয় ভঙ্গিতে রাজীব বলল, ‘ঠিক কথা লোপা, তুমি চাকরি করবে কেন? আমি বলছি চাকরি তোমাকে করতে হবে না।’ বলে খুব একটা গর্বিত ভঙ্গিতে সবার দিকে তাকাল। বিষণ্ণ মুখে চুপ করে রইল রঞ্জিত।
দময়ন্তী হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি তবে কী করবে, লোপামুদ্রা?’
‘অন্য কোনোভাবে রোজগার করব। প্রবন্ধ লিখব, ফ্রিলান্স সাংবাদিক হব।’
এই সময় বাইরে কিছু লোকের উচ্চকণ্ঠে কথাবার্তা শোনা গেল। ঘরে প্রথমে প্রবেশ করলেন একজন দীর্ঘদেহী সুপুরুষ প্রৌঢ় ভদ্রলোক; মুখে পাইপ, পরনে সাদা ট্রাউজার আর হাওয়াই শার্ট, চোখে একজোড়া মোটা ফ্রেমের পুরু লেন্সের চশমা। ভদ্রলোক ঘরে ঢুকেই বললেন, ‘এই যে রঞ্জিত, তোমরা এসে গেছ! এসো, বাইরে বারান্দায় এসে বোসো। ডিআইজি এসে গেছেন, লোকজনও জোগাড় করে এনেছি। ওখানেই কথাবার্তা হবে।’
আর সকলের সঙ্গে উঠে দাঁড়াল রঞ্জিত। বলল, ‘চলুন মিস্টার সান্যাল।’
মি সান্যাল এবার দময়ন্তীর দিকে ফিরে বললেন, ‘আপনিই মিসেস দময়ন্তী দত্তগুপ্ত? আপনি ডিটেকটিভ? কী আশ্চর্য!’
সমরেশ মৃদুকণ্ঠে বলল, ‘ডিটেকটিভ কথাটা উনি অপছন্দ করেন, রহস্যসন্ধানী বলতে পারেন।’
সহাস্যে নিশীথ সান্যাল বললেন, ‘আরে, ওই হল।’ তারপর সস্নেহে দময়ন্তীর কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘এইটুকু মেয়ে ডাকাত-খুনিদের নিয়ে ঘাঁটাখাঁটি করে? কী দরকার বাপু তোমার এসব গণ্ডগোলের মধ্যে থাকার?’
দময়ন্তী হেসে বলল, ‘ঠিক ঘাঁটাঘাঁটি করিনে, কেউ বিপদে পড়লে সাহায্য করি মাত্র। আর আপনি আমায় যত ছোটো ভাবছেন, আমি কিন্তু অতটা নই।’
সমরেশ পূর্ববৎ মৃদুকণ্ঠে যোগ করল, ‘হ্যাঁ, তা, মেঘে মেঘে বেলা নেহাত …’
কপট ক্রোধে সান্যাল বললেন, ‘তুমি থামো তো হে ছোকরা, তুমি এসবের কী বোঝ? মেয়েদের বয়েস আমি বুঝিনে, বোঝ তুমি?’
রাজীব এতক্ষণ নির্বাক হয়ে সব কথা শুনছিল। হঠাৎ সশব্দে হেসে উঠল। বলল, ‘আপনি ডিটেকটিভ? ইয়া আল্লা। এরপর কবে শুনব মেয়েরা ট্রেনড্রাইভার হয়েছে কিংবা ফাইটার পাইলট হয়ে লড়াই করছে। জগতে জানবার জিনিসের বোধ হয় কোনো অন্ত নেই।’
.
৭
বারান্দায় বেতের চেয়ারগুলোর মধ্যে একটায় মধ্যমণিরূপে বিরাজ করছিলেন ডিআইজি সাহেব— আমাদের পূর্বপরিচিত জয়ন্ত চতুর্বেদী। দময়ন্তীকে ঘর থেকে বেরোতে দেখে অত্যন্ত গম্ভীর মুখে বলল, ‘এত শিগগিরই যে আবার দেখা হয়ে যাবে, ভাবিনি। অন্তত এরকম একটা পরিস্থিতিতে। যাক, বোসো দময়ন্তী। তুমি নাকি আমার সঙ্গে থাকতে চাও, তদন্তের সময়?’
‘যদি তোমার আপত্তি না থাকে।’ হেসে বলল দময়ন্তী।
‘তদন্ত করবার বিশেষ কিছু আছে বলে তো মনে হচ্ছে না আমার। এটা একটা পরিষ্কার আত্মহত্যার কেস। অথবা অ্যাক্সিডেন্ট। ইন্দার সিংকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতুম। অত্যন্ত দিলদরিয়া লোক ছিল, কিন্তু প্রচণ্ড মদ খেত। কাজেই, মদের ঝোঁকে স্বেচ্ছায় হোক বা বেখেয়ালে হোক, ক্লাউসের জিপের সামনে এসে পড়েছিল। ক্লাউসও মদ খায় আর খেলে প্রচণ্ড জোরে গাড়ি চালায়। ইন্দার হঠাৎ সামনে এসে পড়াতে সামলাতে পারেনি, কিন্তু খুব চেষ্টা করেছিল।’
‘ইন্দার সিং মদ খেতেন ঠিক, কিন্তু তুমি কি তাঁকে কোনোদিন বেচাল দেখেছ?’
‘না, তা অবশ্য দেখিনি। তবে তোমাদের শরৎচন্দ্রই না বলেছিলেন যে, মদ যে খায় সে কোনো না কোনো দিন মাতাল হয়ই?’
‘কথাটা মিথ্যে নয়। কিন্তু মাতাল হলে লোকে যেসব দুঃসাহসিক বা অসম্ভব কাজ করে বসে, সেগুলো নিজের কোনো সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতেই, তাই নয় কি? ইন্দার সিং কি কোনোদিন আত্মহত্যা করবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন বা তাঁর মনের কোনো চাপা দুঃখের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন?’
‘না, অন্তত আমার কাছে নয়। ফুর্তিবাজ দিলখোলা লোক ছিল, না হেসে কারোর সঙ্গে কথা কইত না। দুঃখ-ফুঃখর ধারই ধারত না। তবে অল্প বয়েসে স্ত্রী মারা যাওয়ায় হয়তো কোনো চাপা বেদনা বোধ ছিল, আমরা জানতুম না। তার থেকেই আত্মহত্যা করার একটা সুপ্ত ইচ্ছে জেগেছিল হয়তো।’
নিশীথ সান্যাল বললেন, ‘আমার সঙ্গে ইন্দারের যেটুকু কথাবার্তা হয়েছে, তাতে কিন্তু আমার ধারণা ছিল যে, ওর বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই প্রবলতর। আমাকে বলত, আমি মরতে চাইনে সান্যাল সাহেব। আমি মরে গেলে মিলুকে কে দেখবে? আমাদের তো আর কেউ নেই।’
দময়ন্তী জয়ন্তকে বলল, ‘তাহলেই দেখো, খুব সম্ভবত আত্মহত্যা করার কোনো ইচ্ছেই ইন্দার সিংয়ের ছিল না। মনস্তত্ত্ব আমি ভালো বুঝিনে, কিন্তু তুমি বলতে পারবে, মদ খেলে লোকে যে অদ্ভুত অদ্ভুত সব কাণ্ড করে তার মধ্যে কি কোনো কার্যকারণ সম্পর্ক থাকে না?’
রঞ্জিত বলল, ‘বউদি! সবসময় হয়তো থাকে না। আমাদের কোম্পানির এক সাহেব একবার প্রচুর মদ খেয়ে তিনতলার ছাদে উঠে, ”ইফ বার্ডস ক্যান ফ্লাই হোয়াই ক্যান্ট আই,” বলে উড্ডীয়মান হতে গিয়ে একেবারে পপাত চ, মমার চ।’
দময়ন্তী বলল, ‘এর মধ্যে কিন্তু কার্যকারণ সম্পর্ক আছে। সাহেব নিশ্চয়ই উড়ন্ত হবার একটা তীব্র ইচ্ছা মনের মধ্যে পোষণ করতেন, সে-ইচ্ছের উৎস যাই হোক না কেন?’
অধৈর্যভাবে হাত নেড়ে জয়ন্ত বলল, ‘তবে কি তুমি বলতে চাও, এটা ইচ্ছাকৃত নরহত্যা? অর্থাৎ ইন্দার সিংকে তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কেউ জোর করে ক্লাউসের গাড়ির সামনে ফেলে দিয়েছিল? কিন্তু লোপামুদ্রার জবানবন্দি যা পড়লুম, এবং দু-জন কামিনও যা সাক্ষ্য দিয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে ইন্দার সিং বুকে হেঁটে রাস্তার মাঝখানে চলে এসে চাপা পড়েছেন, তাঁর সামনে বা পেছনে কেউই ছিল না। হত্যাকারী কি ম্যাজিশিয়ান যে নিজে অদৃশ্য থেকে ইন্দারকে টানতে টানতে পথের ওপর নিয়ে আসবে? হ্যাঁ, তুমি বলতে পার যে সেই সময় ইন্দার মৃতই ছিল, কেউ তার গলায় দড়ি বেঁধে টেনে এনে ফেলেছে। সেক্ষেত্রে হত্যাকারী দড়িটা খুলল কী করে? ওখানটা এমনিতে অন্ধকার ঠিকই, কিন্তু ঘটনার মুহূর্তে প্রথমে জিপের হেডলাইটের আলোয় এবং অব্যবহিত পরে জিপের আগুনে জায়গাটা আলোকিত ছিল। কেউ মৃতদেহর কাছে দড়ি খুলতে এগিয়ে এলে কামিনরা বা লোপামুদ্রা নিশ্চয়ই দেখতে পেত, কারণ ওরা কেউই ঘটনাস্থল থেকে খুব একটা দূরে ছিল না।’
দময়ন্তী লোপামুদ্রার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি কাউকে ইন্দার সিংয়ের কাছে এগোতে দেখনি?’
‘দেখেছি,’ বলল লোপামুদ্রা, ‘ওই দু-জন কামিনকে। ওদের একজন দৌড়ে গেল পাওয়ার হাউসের দিকে, অন্যজন সিং সাহেবের দিকে। তারপর পাওয়ার হাউস থেকে চারজন লোক বেরিয়ে এসে জ্বলন্ত জিপের ভেতর থেকে ফগলারকে টেনে বের করে। ইতিমধ্যে আমিও ওখানে গিয়ে পড়েছিলুম।’
‘যে কামিনটি সিংয়ের কাছে দৌড়ে গিয়েছিল, সে কী করেছিল? ওর গায়ে হাত দিয়েছিল কি?’
‘মোটেই না। সিং সাহেবের মুখের দিকে একবার তাকিয়েই চিৎকার করে দৌড় মেরেছিল উলটোদিকে।’
‘তুমি যখন মৃতদেহর কাছে পৌঁছুলে, তখন কি চারজন পাওয়ার হাউস অ্যাটেন্ড্যান্ট এসে গেছে?’
‘না, আমি পৌঁছোবার সময় ওরা ফগলারকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল। ওদের আসতে দেখে আমি তাড়াতাড়ি সাইকেল চেপে প্রমীলাকে খবর দিতে যাই।’
‘তাহলে তুমি মৃতদেহর কাছে কিছুক্ষণ একা ছিলে? কতক্ষণ?’
‘কয়েক সেকেন্ড।’
‘দেহের কোথাও কোনো দড়ি বাঁধা দেখনি?’
‘না, কোথাও না।’
‘আচ্ছা সিং সাহেব ঠিক কীভাবে হামাগুড়ি দিয়ে গিয়েছিলেন, বর্ণনা করতে পার?’
‘নাঃ। ঘটনাটার জন্যে তো প্রস্তুত ছিলুম না, কাজেই ভালো করে দেখতে পাইনি, তা ছাড়া একটু দূরেও ছিলুম। তবে ভঙ্গিটা যে অত্যন্ত অস্বাভাবিক ছিল তা মনে আছে— ঠিক কীরকম তা মনে নেই।’
দময়ন্তী আর কোনো প্রশ্ন না করে চুপ করে রইল। জয়ন্ত বলল, ‘আর কাউকে প্রশ্ন করতে চাও?’
‘হ্যাঁ।’ দময়ন্তী বলল, ‘কেবল প্রমীলাকে।’
জয়ন্ত বলল, ‘প্রমীলা মৃতদেহর সঙ্গে দেওঘর চলে গেছে, ওকে তো পাবে না। যাক, এবার আমার ক-টা জেরা করবার আছে, সেগুলো সেরে নিই, কি বলো?’ তারপর গলা নামিয়ে বলল, ‘তুমি কী প্রমাণ করতে চাইছ জানি না, তবে তোমার জেরা শুনে মনে হচ্ছে, এর মধ্যে কোনো ফাউল প্লে থাকলেও থাকতে পারে।’
হাসল দময়ন্তী। বলল, ‘আপাতত আমি শুধু এইটেই প্রমাণ করতে চাইছি যে, ব্যাপারটা দুই মাতালের কাণ্ড বলে জড়িয়ে দিয়ো না। একটু গভীরে তদন্ত করো।’
জয়ন্ত তর্জনী তুলে বলল, ‘ঠিক হ্যায়।’
.
৮
খাওয়া-দাওয়াটা মন্দ হল না, কিন্তু ঘরের আবহাওয়াটা কিছুতেই তৃপ্তিকর হল না। জয়ন্ত আর মি সান্যালের মজার মজার গল্প আর মিসেস সান্যালের রঞ্জিতের পোশাক-আশাকের প্রতি অমনোযোগিতা সম্পর্কে সরস অনুযোগ সবাই উপভোগ করলেও, সমস্ত কথাবার্তাই কিন্তু বার বার ঘুরে ঘুরে ইন্দার সিংয়ের মৃত্যুর প্রসঙ্গেই এসে পড়তে লাগল। সন্ধ্যার দুর্ঘটনার স্মৃতি নাছোড়বান্দা অতিথির মতো ঘরের মধ্যে রয়ে গেল, তাকে বিদায় দেওয়া গেল না কিছুতেই।
আর রঞ্জিত সারাক্ষণ গম্ভীর উদবিগ্ন মুখে চুপ করে বসে রইল। কোনো কথা যে ওর কানে বিশেষ ঢুকছে, তা মনে হল না।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে জয়ন্তকে বিদায় দিয়ে রঞ্জিত তার অতিথিদের নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হল। জিপে স্টার্ট দিয়ে একপা না এগোতেই একটি লোক হাত দেখিয়ে ওদের দাঁড় করাল। লোকটি রাজীব। ধীরে ধীরে জিপের কাছে এগিয়ে এসে বলল, ‘মিসেস দত্তগুপ্ত, একটা কথা ছিল আপনার সঙ্গে।’
দময়ন্তী রঞ্জিতের মুখে সুস্পষ্ট বিতৃষ্ণা দেখেও বলল, ‘বলুন।’
‘মাপ করবেন মিসেস দত্তগুপ্ত। অনুচিত হলেও আপনাকে একটা কথা বলা প্রয়োজন মনে করি। আমার মনে হচ্ছে, আপনি একটা সামান্য ব্যাপারকে অকারণে বড়ো করে তুলছেন। আমি অবশ্য ঘটনাস্থলে ছিলুম না, তাহলেও বুঝতে পারছি যে ইন্দার সিংয়ের হামাগুড়ি দিয়ে ছুটন্ত জিপের সমনে পড়াটাই আপনার অস্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে। আচ্ছা, আত্মহত্যা করাটাই কি একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়? কিন্তু লোকে কি আত্মহত্যা করে না?’
দময়ন্তী হেসে বলল, ‘ঘটনাটা যে আত্মহত্যা নয়, একথা আমিও জোর করে বলি না, রাজীববাবু। কিন্তু যেহেতু ব্যাপারটা একটু অস্বাভাবিক, তখন তদন্ত করে দেখতে তো কোনো দোষ নেই। যদি কোনো অপরাধী এর পেছনে লুকিয়ে থাকে, তাকে কি ছেড়ে দেওয়া উচিত?’
‘না, তা নয়।’ রাজীবের গলার স্বর এখন গম্ভীর, চিন্তিত। আগেকার উজ্জ্বলতার চিহ্নমাত্র নেই। ‘তবে কি জানেন? অকারণে বেশি গভীরে তদন্ত করতে গেলে হয়তো অনেক সময় ভুল হয় আর তখন নিরপরাধ লোকেরা শাস্তি পায়। সামান্য দু-একটা কথার বেশি অর্থ খুঁজতে গেলে তাতে কেবল অনর্থই বাড়ে।’
‘আপনার কথাটা আরেকটু স্পষ্ট করে বলবেন?’
‘আর কী বলব মিসেস দত্তগুপ্ত? যা ঘটবার তা তো ঘটেই গেছে। দেখবেন যেন শুধু শুধু কোনো নিরপরাধ লোককে তার বোঝা বইতে না হয়। জয়ন্ত চতুর্বেদীকে আর খুঁচিয়ে তুলবেন না।’ বলে পেছন ফিরে ধীরে ধীরে মি সান্যালের বাড়ির দিকে চলে গেল।
জিপে স্টার্ট দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রঞ্জিত। বলল, ‘এতদিন ভাবতুম রাজীব সিনহা দেখতে যত সুন্দর, ঘটে তত বুদ্ধি ধরে না। এখন দেখছি আমার ধারণাটা ভুল।’ ওর গলায় সুস্পষ্ট সহানুভূতি।
.
৯
পরদিন সকাল বেলা সাতটার মধ্যে রঞ্জিত বেরিয়ে গেল। সমরেশ তখনও নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। উঠল আরও একঘণ্টা পরে। তারপর সারাদিন লনে বসে। দময়ন্তী খানিকক্ষণ রান্নাঘরে কাটাল বাহাদুরের সঙ্গে, খানিকক্ষণ ঘরদোর গুছোল। অবশেষে উল নিয়ে সমরেশের পাশে বসে বোনা শুরু করল। বিকেল তিনটে নাগাদ বিরক্ত হয়ে উঠল সমরেশ। দময়ন্তীর হাত থেকে কাঁটা দুটো জোর করে কেড়ে নিয়ে বলল, ‘দুর, দুর! আমায় ঘেরি, আমায় চুমির নিকুচি করেছে। এখানে লোকে থাকে কী করে বলো তো? কলকাতায় ছুটির দিনগুলো কাটে ঝড়ের বেগে আর এখানে বেলা সাড়ে তিনটে বাজাতেই মাথার অর্ধেক চুল পেকে ঝরে গেল। একটা লোক মরল, ভাবলুম এবার সব একটার পর একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা ঘটতে শুরু করবে। কোথায় কী? আমার কী মনে হয় জানো? তোমার সন্দেহ একেবারে অমূলক— রজ্জুতে সর্পভ্রম! ইন্দার সিং আত্মহত্যাই করেছেন বোরড স্টিফ হয়ে। সেইজন্যেই হাঁটতে পারেননি, হামাগুড়ি দিয়ে গিয়েছিলেন। খুব সিম্পল ব্যাপার। এখানে আর বেশিদিন থাকলে আমাকেও হামাগুড়ি দিতে দেখতে পারো, তখন যেন আশ্চর্য হোয়ো না।’
দময়ন্তী অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় আবার কাঁটা দুটো কেড়ে নিল সমরেশের হাত থেকে। সে দুটো বোনবার ঝোলার মধ্যে রেখে দিয়ে বলল, ‘পনেরো দিন থাকব বলে এসে একদিনের মধ্যেই এরকম হা-হুতাশ করলে চলবে কেন? এইজন্যেই কলকাতার লোকেদের আমি পছন্দ করিনে। সবসময় একটা হইহই আর দাঙ্গাহাঙ্গামার মধ্যে থাকা চাই। কেন, এই শান্ত নির্জনতাটা তোমার ভালো লাগছে না? আমার তো ভীষণ ভালো লাগছে।’
দড়াম করে পিলে চমকানো শব্দ করে লনের গেটটা খুলে গেল। যমের অরুচি সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে লোপামুদ্রা ভেতরে ঢুকে লনের ওপর শুইয়ে দিল সেটাকে। তারপর দময়ন্তীর পাশে এসে বসল। নিঃসংকোচে মুখের দিকে তাকিযে বলল, ‘আপনি সত্যিই ডিটেকটিভ? রাজীবদা কালকে আমায় বলল আপনার সঙ্গে সাবধানে কথা কইতে। আমার কেমন বিশ্বাস হয় না।’
‘কেন, বিশ্বাস হয় না কেন?’ শব্দের ধাক্কায় উঠে বসেছিল সমরেশ, এখন আবার শুয়ে পড়তে পড়তে বলল।
‘জানি না কেন। আমার আপনাকে দেখলে কেমন মনে হয় আপনি দার্শনিক।’
‘দার্শনিক! বল কী?’ দময়ন্তী হাসতে হাসতে বলল।
সমরেশ যোগ করল ‘যেনাহং নামৃতস্যাম, তেনাহং কিম কুর্যাম টাইপের ব্যাপার?’
কথাটা লোপামুদ্রার খুব বোধগম্য হল বলে মনে হল না। বলল, ‘আচ্ছা, আপনি কী চাকরি করেন? নিশ্চয়ই দর্শন পড়ান, তাই না।’
‘প্রায় ঠিক ধরেছ। পড়াই বটে তবে দর্শন নয়, ইতিহাস। হতাশ হলে নাকি?’
‘নাঃ, হতাশ হব কেন? ইতিহাসও তো একরকম দর্শনই। আমার কিন্তু অসম্ভব উত্তেজিত লাগছে, জানেন? এত কাছ থেকে দেখছি আপনাকে! আমি এর আগে কোনোদিন কোনো ক্রিমিনোজলিস্ট দেখিনি।’
‘অর্নিথোলজিস্ট দেখেছ এর আগে অথবা প্যালিঅনটোলজিস্ট?’ সমরেশ জিজ্ঞেস করল।
লাফ দিয়ে সমরেশের দিকে ঘুরে বসল লোপামুদ্রা। একমাথা চুল ঝাঁকিয়ে বলল, ‘নিশ্চয়ই দেখেছি। আমার বড়োমাসির এক ছেলে জিয়োলজিতে ডক্টরেট আর আপনার বন্ধু রঞ্জিতদাই তো একজন পক্ষীবিশারদ। দেখেননি, কত বই আছে ওঁর পাখির ওপরে?’
সমরেশ অবাক। বলল, ‘কই, বেটার এই গুণের কথা তো আগে শুনিনি? নিশ্চয়ই ইদানীং শুরু করেছে। সবসময়েই কিছু-না-কিছু নিয়ে আছে। জানো লোপামুদ্রা, ও দেখতে ওরকম ন্যালাখ্যাপা মতন হলে কী হবে, ওর ভেতরে অনেক ক্ষমতা আছে। ও ভালো ছবি আঁকত ছাত্রজীবনে, ভালো কবিতা লিখত, বেহালা বাজাত চমৎকার, আবার গুন্ডামিতে সবার ওপরে ছিল।’
বাইরে একটা জিপ এসে দাঁড়াল। একটু পরেই ধূলিধূসরিত রঞ্জিত লনে ঢুকে ধপ করে সমরেশের পাশে বসে পড়ে বলল, ‘এই যে লোপামুদ্রা, তোমাকে না কতদিন বলেছি যে তোমার ওই অখেদ্যে সাইকেলটা আমার লনে তুলবে না? বারণ করলে শোন না কেন?’
রঞ্জিতের শাসন গ্রাহ্যই করল না লোপামুদ্রা। হাত নেড়ে বলল, ‘নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখবেন, স্যার! মাথা থেকে পা পর্যন্ত তো ধুলোয় ঢাকা। ওইভাবে আপনি নিজে যদি লনের ওপর উঠতে পারেন, তবে আমার সাইকেলটা দোষ করল কী? ওটা আপনার থেকে পরিষ্কার।’
‘বাদ দে,’ সমরেশ বলল, ‘গিয়েছিলি কোথায়? সাইটে না অন্য কোথাও?’
‘মধুপুর গিয়েছিলুম। বসকে দেখতে আর প্রমীলার খবর নিতে। মেয়েটা সামলেছে খুব। কাল ফিরবে। জয়ন্ত চতুর্বেদীর সঙ্গেও দেখা করেছি। বলল, কাল-পরশু এসে বউদিকে নিয়ে প্রমীলার কাছে যাবে।’
‘তোর বস কী বলল?’
‘কী আর বলবে, এখনও অজ্ঞান। তবে ডাক্তার বলল, বেটার জান খুব কড়া। এ যাত্রা বেঁচে গেল। নাতসি তো। মরতে সময় নেবে।’
‘আপনারা ভয়ানক নিষ্ঠুর!’ মুখ ভার করে বলল লোপামুদ্রা।
‘ওরা নিষ্ঠুর হতে পারে লোপামুদ্রা, কিন্তু অন্তত বাইরে ভালোমানুষির অভিনয় করে না— এই যা বাঁচোয়া।’ বলল দময়ন্তী, ‘যাদের চেনা যায় না, তারাই ভয়ংকর!’
দময়ন্তীর কথায় প্রচ্ছন্ন ঠাট্টাটা গায়ে মাখল না রঞ্জিত; বলল, ‘ঠিক, ঠিক, আমরা যা করি, খোলাখুলি করি। রেখে-ঢেকে কিছু করা আমাদের আসে না। তবে হ্যাঁ, অসুবিধে হচ্ছে যে সবাই যদি আমাদের মতো হত, তাহলে জগতে রহস্যসন্ধানীদের আর করে খেতে হত না।’ বলে সমরেশকে চোখ টিপল।
‘থাক, থাক।’ দময়ন্তী ঝংকার দিল ‘রহস্যসন্ধানীদের কথা চিন্তা করে তো ঘুম হচ্ছে না রাত্রে! ভালো কথা, লোপামুদ্রা, রহস্যসন্ধানীর কথায় মনে পড়ল। আচ্ছা, তুমি কি শুধু আমায় দেখতেই এসেছিলে, না কোনো কথাও বলবার ছিল তোমার?’
একটু ইতস্তত করে লোপামুদ্রা বলল, ‘হ্যাঁ, দময়ন্তীদি, একটা কথা আপনাকে জানাতে চাইছিলুম। কথাটা আগে বলিনি, কারণ মনে হয়েছিল হয়তো ব্যাপারটার কোনো গুরুত্ব নেই।’
‘কী ব্যাপার?’
‘মানে মিস্টার সিং গতকাল বোধ হয় সত্যিই সম্পূর্ণ প্রকৃতিস্থ ছিলেন না। ওঁকে তো অনেকদিন ধরে দেখছি। ছুটির দিনে উনি সাধারণত খুব ভালো মেজাজে থাকেন, সবাইকে ডেকে ডেকে আড্ডা মারেন। অথচ কাল আমি সকালে যখন মিলুর সঙ্গে দেখা করতে যাই, তখন উনি ওঁর পেছনের ছোটো ঘরটায় বসে মদ খাচ্ছিলেন। মুখ ভয়ানক গম্ভীর। আমার দিকে একবার রক্তচক্ষু করে তাকালেন, হাসা তো দূরের কথা, চিনতে পারলেন বলেই মনে হল না। ওঁর মুখের অবস্থা দেখে তো আমি রীতিমতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম। তারপর দুপুর বেলা যখন মিলুকে ডাকতে যাই ছবি আঁকতে যাবার জন্য, দেখলুম তখনও সেই একইভাবে বসে মদ খাচ্ছেন। তখন তো মুখ তুলে তাকালেনই না। কিছু একটা হয়েছিল, জানেন! ঠিক স্বাভাবিক ছিলেন না।’
দময়ন্তী কিছুক্ষণ চিন্তিত মুখে চুপ করে বসে রইল; তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘কী ছবি আঁকলে তোমরা?’
লোপামুদ্রা এই অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে খানিকক্ষণ হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আমতা আমতা করে বলল, ‘ছবি!’
‘হ্যাঁ, তোমরা যে ছবি আঁকতে গিয়েছিলে বললে?’
‘ও। আমি আঁকলুম একটা সাঁওতাল মেয়ের মুখ। মিলু একটা বাচ্চা ছেলেকে স্কেচ করবার চেষ্টা করছিল, কিন্তু সে এমন ছটফট করছিল যে কিছুতেই এঁকে উঠতে পারল না। শেষ পর্যন্ত কাগজটা ছিঁড়ে ফেলে দিল।’
‘তোমার ড্রয়িংটা আমাকে একবার দেখাবে?’
‘আমার ড্রয়িংটা?’ লোপামুদ্রা তখনও আশ্চর্য হওয়ার ঘোর সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই দেখাবে। যাও তো লোপা, তোমার ড্রয়িংটা চট করে নিয়ে এসো।’ বলে উঠল রঞ্জিত। ওর গলা গম্ভীর, কিন্তু কাঁপা কাঁপা।
‘সেটা যে কোথায় আছে, কে জানে! আমি তো যত্ন করে রাখি না। আচ্ছা দময়ন্তীদি, আমার ড্রয়িংটা কি একান্তই দরকার?’
‘হ্যাঁ, লোপামুদ্রা।’ নীচু গলায় বলল দময়ন্তী, ‘একান্ত দরকার। ভালো করে খুঁজে বের করো।’
‘আচ্ছা, দেখি খুঁজে।’ বলে অনিচ্ছুক ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল লোপামুদ্রা। বিরস মুখে সাইকেলটা ঠেলতে ঠেলতে বেরিয়ে গেল লন থেকে।
লোপামুদ্রা অদৃশ্য হতেই রঞ্জিত প্রশ্ন করল, ‘বউদি! আপনি কি সত্যি মনে করেন, ইন্দার সিংয়ের মৃত্যুর সঙ্গে লোপার আঁকা ছবির কোনো সম্পর্ক আছে?’
অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল দময়ন্তী। কথাটা পুরো কানে ঢুকল বলে মনে হল না। মৃদু কণ্ঠে বলল, ‘থাকতে পারে।’
রঞ্জিত কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল।
সমরেশ বলল, ‘যা, হাতমুখ ধুয়ে নিগে যা। আর বাহাদুরকে বলিস, আমায় যেন এক পেয়ালা চা দিয়ে যায়।’
ক্লান্ত অনিশ্চিত পদক্ষেপে বাড়ির ভেতরে চলে গেল রঞ্জিত। সমরেশ বলল, ‘দেখো, সবাই কিন্তু বলছে, ব্যাপারটা অস্বাভাবিক নয়। এমনকী রাজীব, রঞ্জিত বা লোপামুদ্রা যাদের সন্দেহের ঊর্ধ্বে বলা যেতে পারে, তারাও চাইছে না যে এ ব্যাপারটা ঘাঁটাঘাঁটি হয়। কিন্তু তুমি কেন স্থির নিশ্চিত যে, এর মধ্যে কোনো গণ্ডগোল বা কারসাজি আছেই? ইন্দার সিংয়ের হামাগুড়ি দেওয়াটাই কি একমাত্র বস্তু, যা তোমার সন্দেহ জাগিয়ে তুলেছে?’
‘ঠিক হামাগুড়ি দেওয়াটা নয়,’ দময়ন্তী চিন্তিত কণ্ঠে বলল, ‘আমার সন্দেহ জাগিয়েছে একটা সরল অঙ্কের ব্যাপার।’
‘কীরকম?’
‘রাস্তায় যে টায়ারের দাগ দেখা গেছে তাতে মনে হয়, ক্লাউস ইন্দারের দেহ থেকে প্রায় পনেরো গজ দূর থেকে ব্রেক কষে। ঠিক তো? বেশ, এখন সেসময় ক্লাউসের জিপের গতি ছিল কত? কম করে ধরলেও ঘণ্টায় ষাট মাইল বা সেকেন্ডে তিরিশ গজ? ব্রেক না কষলে পনেরো গজ যেতে জিপটার লাগত আধ সেকেন্ড, ব্রেক কষার ফলে হয়তো একটু বেশি লেগেছে। কিন্তু সেটুকু আমরা ধর্তব্যের মধ্যে না আনতেও পারি, যেহেতু যেভাবে জিপ লাফিয়ে উঠে বিশ গজ দূরে ছিটকে গিয়ে পড়েছে, তাতে ব্রেক যে খুব একটা কার্যকরী হয়েছে তা মনে হয় না।
‘দ্বিতীয়ত চাকার দাগ থেকে এটাও বোঝা যাচ্ছে যে ধাক্কা লাগার আগের মুহূর্তে জিপের ডান দিকের চাকা রাস্তার ডান দিকের ধার ধরে গজখানেক ভেতরে ছিল। ইন্দার এসেছিলেন বাঁ-দিক থেকে এবং দুটো চাকাই তাঁর দেহের ওপর দিয়ে চলে যায়।
‘তৃতীয়ত, প্রত্যক্ষদর্শীরা প্রত্যেকেই বলেছে যে ইন্দার আগেভাগে রাস্তার ওপরে এসে শুয়ে ছিলেন না। জিপও এগিয়েছে, তিনিও এগিয়েছেন।
‘এখন যদি ধরে নেওয়া যায় যে ক্লাউস যখন তাঁকে দেখতে পায়, তখন তিনি সাড়ে সাত কি আট গজ চওড়া রাস্তার এক তৃতীয়াংশও এগিয়ে এসেছেন, তাহলেও মেনে নিতে হয় যে, আধ সেকেন্ডে তিনি চার গজ রাস্তা হামাগুড়ি গিয়ে এগিয়েছেন অর্থাৎ তখন তাঁর গতি ছিল ঘণ্টায় সতেরো মাইল। এইটেই আমি মেনে নিতে রাজি নই। মাতাল অবস্থায় তো দূরের কথা, তুমি আদা-জল খেয়ে চেষ্টা করে দেখো দিকি যে, এক মিনিট হামাগুড়ি দিয়ে তুমি চারশো আশি গজ যেতে পারো কি না? এককালে তো শুনি তুমি মস্ত স্পোর্টসম্যান ছিলে।’
সমরেশ পুনরায় লম্বা হয়ে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ল। বলল, ‘হামাগুড়ি দিয়ে? ইয়া আল্লা।’
‘বেশ, তাহলে প্রমাণ হচ্ছে কী? হয় ইন্দারকে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, নয়তো কতকগুলো রোলারের ওপর চড়িয়ে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, কিন্বা দুটোই, অর্থাৎ দড়ি বেঁধে রোলারের ওপর দিয়ে টেনে নেওয়া হয়েছিল। মোটকথা, সেসময় হয় ইন্দার ছিলেন মৃত অথবা অজ্ঞান।’
‘কিন্তু দড়ি আর রোলারগুলো গেল কোথায়?’
‘রোলার কোনো সমস্যা নয়। কনস্ট্রাকশন সাইটে অসংখ্য কাটা পাইপ পড়ে আছে। জিপের ধাক্কায় ছিটকে গিয়ে রোলার হিসেবে যাদের ব্যবহার করা হয়েছিল, তারা মিশে গেছে বাকি সকলের সঙ্গে। কিন্তু দড়িটাই প্রশ্ন। কী দড়ি? মোটা কাছি নিশ্চয়ই নয়। আর সেটা খুলল কী করে? কেউ কি সেটা খুলে দিয়েছিল? সে কে?’
‘ঠিক কথা। সে কে?’
বাইরে আবার একটা জিপের দাঁড়ানোর শব্দ পাওয়া গেল। গেট খুলে ভেতরে এলেন নিশীথ সান্যাল। হাতে একটা গোল করে পাকানো কাগজ। বললেন, ‘লোপামুদ্রা পাঠিয়ে দিল। এই ছবিটা নাকি ইন্দারের মৃত্যুরহস্যের উৎঘাটনে সাহায্য করবে?’
দময়ন্তী আর সমরেশ উঠে দাঁড়িয়েছিল। দময়ন্তী বলল, ‘চলুন, বারান্দায় গিয়ে বসা যাক। লোপামুদ্রা এল না কেন?’
‘কলকাতা থেকে একগাদা রেকর্ডের একটা পার্সেল এসেছে একটু আগে। তাই নিয়ে পড়েছে। গান-পাগল মেয়ে, সবকটা শুনে তবে উঠবে।’ বলতে বলতে বারান্দার ওপর একটা বেতের চেয়ার দখল করে বসলেন নিশীথ সান্যাল।
এক পেয়ালা চা হাতে করে রঞ্জিত ভেতর ঘর থেকে বারান্দায় আসছিল, মি সান্যালকে দেখে তৎক্ষণাৎ পেয়ালাটা তাঁর দিকে এগিয়ে ধরল। সান্যাল হাতের পাকানো কাগজটা তাড়াতাড়ি দময়ন্তীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে দু-হাতে পিরিচটা ধরলেন।
কাগজটা খুলে মেলে ধরল দময়ন্তী। কালি-কলমে আঁকা একটি সাঁওতাল মেয়ের মুখের স্কেচ। বিমূর্ত মোটেই নয়, মুখের ডৌল এবং ভাব চমৎকার স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু ভাবটি খুব সুখপ্রদ নয়। সমস্ত মুখে একটা আদিমতা, অল্প ফাঁক হয়ে থাকা ঠোঁটের ভেতর হিংস্র দাঁতের পঙক্তি, চোখে বন্য ক্ষুধার্ত দৃষ্টি। মনকে খুশি করে না বটে, তবে নাড়া দেয়।
চারজনেই নির্বাক হয়ে ছবিটি দেখছিলেন। প্রথম প্রশ্ন করল রঞ্জিত। বিমূঢ় কণ্ঠে বলল, ‘এইটেই কি কালকের আঁকা ছবি?’
‘হ্যাঁ।’ নিশীথ সান্যাল বললেন।
‘তার প্রমাণ কী? এটা তো কালকে আঁকা নাও হতে পারে? কোথাও তো তারিখ দেওয়া নেই।’
দময়ন্তী বলল, ‘ডিংরিয়া গ্রামে এই মেয়েটিকে খুঁজে বের করা কঠিন হবে না রঞ্জিতবাবু। তাকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে।’
‘কিন্তু কী বুঝলেন আপনি এই ছবি দেখে?’
‘বুঝলুম, লোপামুদ্রার হাত খুব ভালো ড্রয়িং-এ। ওর পক্ষে একদিন নামি শিল্পী হওয়া মোটেই কঠিন হবে না।’
খুশি খুশি মুখে মাথা নাড়লেন সান্যাল। বললেন, ‘ঠিক ঠিক। আমিও তো সেই কথাই বলি। যাক, ওই ইন্দারের অ্যাক্সিডেন্টের সঙ্গে এটার কোনো সম্পর্ক নেই তাহলে? আমি শুনেই লোপাকে বলেছি যে, দময়ন্তী আসলে তোর ছবিটা দেখতে চায়, বাকিটা ঠাট্টা। তা, তোমারও কি আর্ট-টার্টে উৎসাহ আছে নাকি?’
‘তেমন কিছু নয়, এই অল্পস্বল্প আর কি।’ মৃদু হাসল দময়ন্তী।
‘আমি আবার, বুঝলে, এসব ব্যাপারে একদম অজ্ঞ। একেবারে কিছুই মাথায় ঢোকে না। অবন ঠাকুর বা নন্দলাল বোসের ছবি হলে দেখতে ভালো লাগে, ওই পর্যন্ত। ওহে রঞ্জিত, আমাদের মিউজিয়ামটা ওঁদের দেখিয়েছ? ছেলেমানুষি ব্যাপার। তবে ওঁদের হয়তো ভালো লাগতেও পারে।’
রঞ্জিত বলল, ‘আমাদের মিউজিয়াম বলবেন না, বলুন আমার। আর্ট বোঝেন না বলছিলেন অথচ বেছে বেছে এমন সব জিনিস সাজিয়ে রেখেছেন যাদের প্রত্যেকটি দর্শনীয়। সূর্যমূর্তিটা তো বিশেষ করে। ডক্টর ঝা-ও সেকথা স্বীকার করেছেন।’
লজ্জিতভাবে পকেট থেকে পাইপ বের করে তার মধ্যে তামাক ভরতে ভরতে সান্যাল বললেন, ‘আরে না, না। কী যে বল তার ঠিক নেই। আমরা হলুম ইঞ্জিনিয়ার, বুঝেছেন? ওসব রসকষ আমাদের কবেই শুকিয়ে গেছে গাদা গাদা ফর্মূলার চাপে। কি বল হে সমরেশ?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনার কথা খুব খাঁটি। তাহলে কালই আমরা আপনার সংগ্রহশালাটি দেখে নিই। টুরিস্ট হিসেবে এসেছি যখন, তখন যাবতীয় দ্রষ্টব্য দেখে নিতে হবে তো। সময়ও কাটবে, জ্ঞান-বুদ্ধি যদি হয় তো সেটা উপরি পাওনা।’
‘হ্যাঁ। আর সেইসঙ্গে তোমার, কী বলে রহস্যসন্ধানী গৃহিণীটিও এদিক-ওদিক একটু দেখে নিতে পারবে, যদি অপরাধীকে পাকড়াও করতে তাতে সুবিধে হয়। আহা বেচারি! এসেছিল দু-দিন আনন্দে কাটাবে বলে, তার মধ্যে যত বাজে ঝামেলা!’
‘ওকথা বলবেন না।’ সমরেশ বলল, ‘জানেন তো ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে, তা নইলে আবার তার রাত্রে ঘুম হয় না।’
.
১০
রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর পরিতৃপ্ত মুখে পেটে হাত বুলোতে বুলোতে ঘরে ঢুকল সমরেশ। বলল, ‘বুঝলি রঞ্জিত, তোর বাহাদুর সত্যি রান্নাতেও বাহাদুর। খাওয়াটা কিছু গুরুতর হয়ে যাচ্ছে রে। একমাত্র সুখের কথা যে তোর কিছু খসানো যাচ্ছে। তবে কিনা, ভাণ্ডার আমরা ফেরার আগেই না শেষ হয়ে যায়। সেটাই একমাত্র চিন্তা।’
রঞ্জিত বলল, ‘চিন্তা করিসনি। তুই আসবি বলে যবে থেকে জেনেছি, সেদিন থেকেই এ তল্লাটের চালডাল ইস্তক যাবতীয় খাদ্যদ্রব্য যতরকমভাবে সম্ভব জোগাড় করে রেখেছি। শিগগিরই এ অঞ্চলে একটা দুর্ভিক্ষ লাগবে সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই।’
‘লাগুক গে।’ বলে খাটের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল সমরেশ। একটা সিগারেট ধরিয়ে আর একটা রঞ্জিতকে দিয়ে বলল, ‘তোর এই অতিথি-কক্ষটি এককথায় অপূর্ব। এদিকের দরজা খুললে অন্দরমহল আর ওদিকের দরজা খুললে বাইরের বারান্দা। একদিকে প্রাইভেসি অন্যদিকে ইন্টিমেসি। অতি চমৎকার।’
‘কী অতি চমৎকার?’ মশলা চিবোতে চিবোতে ঘরে ঢুকল দময়ন্তী।
‘এই ঘরটার কথা বলছিলুম আর কি। কিন্তু সেকথা থাক। আজ বিকেলে যে কথাটা সম্পূর্ণ হল না, সেটা শেষ করো দিকি। কথা হচ্ছিল, ইন্দার সিং যদি খুন হয়েই থাকেন, কেন হলেন?’
দময়ন্তী একটা আরামকেদারার ওপর বসে উল বোনার সরঞ্জাম বের করল। ক্ষিপ্র হাতে কাঁটা দুটো চালাতে চালাতে প্রশ্ন করল, ‘একটা লোক আরেকটা লোককে ঠান্ডা মাথায় খুন করে কেন?’
রঞ্জিত বলল, ‘তার অনেক কারণ থাকতে পারে। ব্যর্থ প্রেম, টাকাপয়সা, সেডিস্ট আনন্দ অথবা নিছক পাগলামো।’
দময়ন্তী বলল, ‘ঠিক কথা। আপনার কথাগুলোকেই আরও সংক্ষেপে বলা যায়— প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে, কোনো অব্যবহিত লাভের আশায় বা পাগলামির জন্য! ইন্দার সিং যেভাবে নিহত হয়েছেন, তাতে বোঝা যায় যে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে পাগলামি নয়, বরং কোনো অত্যন্ত বুদ্ধিমান মস্তিষ্ক কাজ করছে। দ্বিতীয়ত, হত্যাকারী বা হত্যাকারীরা এটাই প্রমাণ করবার চেষ্টা করছে যে এটা আদৌ খুন নয়, নিতান্তই একটা দুর্ঘটনা মাত্র। এ থেকে আমার মনে হয়, এটা প্রতিহিংসাজনিত খুন নয়। কারণ এ ধরনের হত্যাকারীরা নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে চায় ঠিকই, কিন্তু খুনটা চাপা দিতে চায় না। বরং চায় যে সকলে জানুক পাপীর মৃত্যু এরকম ভয়ংকরভাবেই হয়ে থাকে। তবে ইন্দার সিং ছিলেন কনট্রাক্টর। নানা রকমের লোকের সঙ্গে মিশেছেন। হয়তো কখনো কোনো কেউটে সাপের লেজে পা দিয়ে দিয়েছিলেন; সে এতদিনে ছোবল মারল। তবুও প্রশ্ন থেকেই যায়, সে এটাকে দুর্ঘটনা বলে প্রমাণ করতে চাইছে কেন?’
সমরেশ বলল, ‘তাহলে তুমি বলতে চাইছ, কেউ কোনো লাভের আশায় এই কম্মো করেছে? কী লাভ?’
‘সেইটেই আমি ভালো বুঝতে পারছি না। এক হতে পারে, কেউ প্রমীলাকে বিয়ে করতে চাইছে; ইন্দারের তাতে আপত্তি। সে হবু শ্বশুরকে কায়দা করে সরিয়েছে— যাতে প্রমীলা বুঝতে না পারে যে তার হবু বর নরঘাতক!’
‘হুঁ, যে-সে নর নয়, একেবারে শ্বশুর!’ বলল সমরেশ।
‘যাই হোক, এ সম্বন্ধে আমি এতই কম জানি যে কাল প্রমীলার সঙ্গে কথা না বলে কিছুই স্থির করতে পারব না। তবে আরও একটা সম্ভাবনা আছে। হয়তো কোনো একটা অপরাধ ঘটতে চলেছে বা ঘটে গেছে— যার সঙ্গে ইন্দার যুক্ত ছিলেন এবং শেষ মুহূর্তে পিছপা হয়েছিলেন; সেইজন্যে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হল। এ অঞ্চলে কোনো বড়ো অপরাধের ঘটনা আমরা এখনও জানি না। আর যেহেতু হত্যাকারী চাইছে যে পুলিশ এ ব্যাপারটা দুর্ঘটনা ভেবে বিশেষ নাড়াচাড়া না করে, তাতে সন্দেহ হয় যে ষড়যন্ত্র এখনও চলেছে। কিছু একটা শিগগিরই ঘটবে।’
সিগারেটে একটা দীর্ঘ টান দিয়ে রঞ্জিত বলল, ‘আপনি ব্যাপারটা বড্ড বেশি টানছেন। দেখবেন যেন পর্বতের মূষিক-প্রসব না হয় শেষ পর্যন্ত।’
‘হতে যে পারে না, তা নয়। তবু ইন্দার সিং যদি কোনো দুষ্টচক্রের হাতে নিহত হয়ে থাকেন, তাদের একবার খোঁজ করে দেখতে তো দোষ নেই।’
‘কিছুমাত্র না। তবে ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে আপনাকে গায়ের ব্যথাতেই ভুগতে হবে। যাক, এখন শুয়ে পড়ুন; কাল আবার আমাদের মিউজিয়াম দেখতে যেতে হবে।’
‘হ্যাঁ, আর সেইসঙ্গে একবার প্রমীলার সঙ্গেও দেখা করে আসব। খোঁজখবর কিছু করা যাবে। আচ্ছা, প্রমীলা আমার সঙ্গে দেখা করতে আপত্তি করবে না তো?’
.
১১
সুইচ ইয়ার্ডের পেছনে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে একটা গোলাকার বাড়ি দেখিয়ে রঞ্জিত বলল, ‘ওই হল আমাদের কীর্তিসংগ্রহশালা। ওই বাড়িখানার সমস্তটাই একটা ঘর।’
ঘরটা দেখতে অনেকটা বয়ামের মতো। তার নীচের মোটা অংশটা প্রায় পঁচিশ ফুট ব্যাসের ফুট তিরিশেক উঁচু; আর ওপরের অংশটা দশ ফুট ব্যাস, ফুট আষ্টেক উঁচু। ওপরের অংশটা আগাগোড়া কাচ দিয়ে মোড়া, কিন্তু নীচে কোনো জানলার বালাই নেই। ইয়ার্ডের দিকে একটা বড়ো দরজা, তার সামনে একফালি ঢাকা বারান্দা। সেই বারান্দার সামনে এসে শেষ হয়েছে মূল রাস্তা থেকে বেরোনো একটা পিচঢালা পথ। চারদিকে রুক্ষ অসমতল জমি, ঠিক পেছনেই পাহাড়ের খাড়া পাথুরে দেওয়াল। পাওয়ার হাউস বা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিং, দুটোই প্রায় আট-ন-শো গজ দূরে যদি সরলরেখায় যাওয়া যায়। কিন্তু সেভাবে যাওয়ার কোনো পথ নেই।
জিপ থেকে নামতে নামতে সমরেশ জিজ্ঞেস করল, ‘এরকম নির্জন একটা জায়গায় এহেন একটা ঘর বানাবার কারণ কী?’
রঞ্জিত বলল, ‘কারণ এই ঘরটাই আমাদের কন্ট্রোল রুম হওয়ার কথা ছিল। প্রথমে ঠিক হয়েছিল যে কুন্তীপুর থার্মাল পাওয়ার পঞ্চাশ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। সেই হিসেবে প্ল্যান করা হয়েছিল, গোটা কয়েক বাড়িও উঠেছিল। কিন্তু পরে ঠিক হল যে, না, ওতে কুলোবে না; দেড়শো মেগাওয়াটের প্ল্যান্ট বসাও। আমাদের প্ল্যানিং যা যেরকম হয় আর কি। ব্যস, আবার নতুন করে সব নকশা-টকশা হল, পুরোনো বাড়িগুলো কিছু ভাঙা পড়ল, কিন্তু কাজে লাগিয়ে দেওয়া গেল। এ ঘরটা একটেরে পড়ে গেল বলে ভাঙাও হল না, কাজেও লাগল না।
‘কথা ছিল, বাড়িটার ভেতরে মাঝখান বরাবর একটা ক্যাটওয়াক বসিয়ে দোতলা বানিয়ে ফেলে তার দেওয়ালে কন্ট্রোল প্যানেলগুলো বসানো হবে। ঘরটা গোলাকার হওয়ার ফলে প্যানেলগুলো সব অ্যাঙ্গল থেকেই দিব্যি দেখা যাবে। ওপরের স্কাইলাইটগুলো দিয়ে আসবে আলো হাওয়া। কিন্তু ক্যাটওয়াক বসানোর আগেই ঘরটা বর্জিত হয়েছিল। যাক, ভেতরে ঢোকবার আগে, চল চারদিকটা একবার দেখে আসবি।’
সমরেশ জিজ্ঞেস করল, ‘ক্যাটওয়াক কেন? একটা অন্ত ফ্লোর করলে দোষ কী ছিল?’
‘দোষ নয়, ক্যাটওয়াকের একটা সুবিধে ছিল। ওপরে যে ওই স্কাইলাইটের ঘরটা দেখছিস, ওর ঠিক নীচেই একটা জয়েস্ট বসানো আছে। আর ওই একটা জয়েস্টের সাহায্যেই ক্যাটওয়াকের মাঝখানের ফাঁকটা দিয়ে ভারী ভারী সুইচ আর প্যানেলগুলো দোতলায় তোলা যেত। আস্ত ফ্লোর হলে, তোলা একটু কঠিন হত, এই আর কি।
‘বাড়িটার পেছনদিকে ওই লোহার ঘোরানো সিঁড়িটা দিয়ে ছাদে উঠে জয়েস্টের সঙ্গে একটা চেনপুলি ব্লক বাঁধার ওয়াস্তা। তারপর সামনের দরজা দিয়ে এক একটা প্যানেল ঢোকাও আর তাদের স্ব স্ব জায়গায় ঝপঝপ করে বসিয়ে দাও। ওই স্কাইলাইটগুলোর একটা আসলে দরজা। ওটা দিয়ে ঢুকে জয়েস্টের ওপরে যাওয়া যায়। আপাতত, দরজাটা তালা বন্ধ আছে।’
‘বুঝলুম,’ সমরেশ বলল, ‘মাথা অনেক খাটানো হয়েছিল। কাজে লাগল না, এই যা।’
‘নাঃ। চলো, এখন ভেতরে ঢোকা যাক।’
ঘরটার চারদিকে একটা পাক মেরে ওরা এসে দরজার সামনে দাঁড়াল। আট ফুট উঁচু ছ-ফুট চওড়া লোহার পাতে মোড়া দরজা, আগাগোড়া মসৃণ, শুধু মাঝখানে একধারে ল্যাচ কী ঢোকানোর গোল চাকতি। পকেট থেকে চাবি বের করে কী-হোলের ভেতর ঢোকাতে ঢোকাতে রঞ্জিত বলল, ‘দরজাটা দেখেছিস? একদম চোরপ্রূফ। বাইরের তালা দেওয়ার কোনো সিস্টেমই নেই। আর এই যে ল্যাচটা দেখছিস— এটা খাস বিলিতি।’
‘দেখলুম,’ সমরেশ বলল, ‘কুন্তীপুরের জলহাওয়া থেকে আরম্ভ করে ইটপাথর মায় বাড়ির দরজা-জানলাগুলোরও যদি তুই গুণগান করতে থাকিস, তাহলে তো আর বাঁচিনে।’
দরজাটা খুলে রঞ্জিত কী যেন একটা কথা বলতে যাচ্ছিল, প্রত্যুত্তরে কিন্তু ভেতরের দিকে তাকিয়ে সমরেশ আর দময়ন্তী এমন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল যে সেকথাটা আর বলা হল না।
উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠাটা অস্বাভাবিক নয়।
ওপরের স্কাইলাইটগুলো থেকে এসে পড়া আলোয় ঘরটা আলোকিত। চারদিকের দেওয়ালের কোল ঘেঁষে সার সার টেবিলের ওপর ছোটোবড়ো অসংখ্য পাথরের মূর্তি। তাদের প্রত্যেকটিই খুব সুন্দর। কিন্তু তাদের সকলকে ম্লান করে দিয়ে ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা কালো পাথরের টেবিলের ওপর দাঁড় করানো আছে একটি অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যময় কালো পাথরের দেবতার মূর্তি। ফুট তিনেক উঁচু সমভঙ্গ মূর্তিটি প্রথম দৃষ্টিতে অভগ্ন বলেই মনে হয়। মানুষের কালাপাহাড়ি আর প্রকৃতির ক্ষয়রোগের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে অহংকৃত আনন্দে নিজের অলৌকিক পৌরুষ, অপরিসীম তিতিক্ষা আর মহিমান্বিত দৈবী জ্যোতি বিকীর্ণ করছে।
দময়ন্তী আবেগ-কম্পিত গলায় বলল, ‘কী অপূর্ব! আর কী অদ্ভুত প্রতিভা সেই ভাস্করের যিনি এই মূর্তি গড়েছিলেন। দেবতা নিশ্চয়ই তাঁর সামনে স্বমহিমায় রূপ নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তা নয়তো এই আশ্চর্য দেবত্বের রূপ কল্পনা তো সাধারণ মানুষের চিন্তায় বা ধ্যানে আসতে পারে না।’
‘আটার ননসেন্স!’ একটা বিরক্ত-ক্রুদ্ধ গলা ওদের তিনজনের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিল। ওরা পেছন ফিরে দেখল, দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন ড ঝা, তাঁর দু-চোখে জ্বলন্ত ক্রোধ আর পেছনে লজ্জিত, সংকুচিত রাজীব। ‘দেবতা রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন?’ ড ঝা-র গলা হিস হিস করে উঠল, ‘আজকালকার দিনে কোনো শিক্ষিত লোকের মনে এরকম চিন্তা আসাটা শুধু অদ্ভুত নয়, অন্যায়। আপনাদের মনে রাখা উচিত, এ মূর্তি বৈজ্ঞানিকের গবেষণার বস্তু, কোনো ছ্যাবলামোর জিনিস নয়। নোট নাও তো রাজীব, যত শীঘ্র সম্ভব, আমরা মূর্তিটাকে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যাব। এসব জিনিস এখানে বেশিদিন ফেলে রাখাই অন্যায় হয়েছে।’
সমরেশ প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই বিনীত কণ্ঠে দময়ন্তী বলল, ‘আমাদের ক্ষমা করবেন ডক্টর ঝা। আপনি পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন, ঠিক বুঝতে পারিনি। আসলে মূর্তিটা এত সুন্দর যে উচ্ছ্বাস প্রকাশ না করে পারিনি। এই মূর্তিটা সম্পর্কে আপনি কিছু বলুন না।’
ড ঝা তখনও রাগে গরগর করছেন। বললেন, ‘আপনার নাম কী আমি জানি না। তবে আপনাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিতে চাই, বাজে বকে নষ্ট করবার মতো সময় আমার নেই। আমরা এখানে এসেছি কাজ করতে। রাজীব, আজ আমরা ভৈরব মূর্তিটা স্টাডি করব, খাতা পেনসিল বের করো।’
রাজীব করুণ চোখে সকলের দিকে তাকিয়ে ঝোলা থেকে খাতা পেনসিল বের করল। ড ঝা গটগট করে ঘরের একদিকে একটা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে তার ওপরে রাখা মূর্তিটার ওপর ঝুঁকে পড়ে বললেন, ‘আমি আশা করব, এখানে গোলমাল করে কেউ আমায় বিরক্ত করবেন না।’
তক্ষুনি বাইরে ঝনঝন ঝনাৎ করে একটা শব্দ হল, তারপরেই সহাস্যবদনে ঘরে ঢুকল লোপামুদ্রা। বলল, ‘বাইরে রঞ্জিতদার জিপ দেখেই বুঝেছি দময়ন্তীদি এখানে আছেন। তাই চলে এলুম। বাব্বা, আজকে কীরকম গরম পড়েছে হঠাৎ? মনে হচ্ছে, বৃষ্টি হবে।’
সবাই সভয়ে ড ঝা-র আর একটা বিস্ফোরণের আশঙ্কায় চুপ করে রইল, কিন্তু লোপামুদ্রা সেই নীরবতা লক্ষই করল না। উচ্চকণ্ঠে বলল, ‘দময়ন্তীদি, আমাদের সূর্যমূর্তিটা দেখেছেন? অপূর্ব, তাই না? পাথরের বটে, কিন্তু কী পালিশ। একদম কাচের মতো গা।’
সমরেশ এইরকম একটা সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিল। সমান উচ্চকণ্ঠে বলল, ‘সূর্যমূর্তি বুঝলে কী করে? এটা তো বিষ্ণুমূর্তিও হতে পারে, ইন্দ্রের মূর্তিও হতে পারে, প্রজ্ঞাপারমিতা হতেই-বা বাধা কী?’
রঞ্জিত বলল, ‘তোর যেমন বুদ্ধি। প্রজ্ঞাপারমিতা তো মেয়েছেলে রে, গাধা!’
সমরেশ বলল, ‘মঞ্জুশ্রী যদি পুরুষ হতে পারে, প্রজ্ঞাপারমিতাই-বা হবে না কেন?’
দময়ন্তী চাপা গলায় বলল, ‘না, না, এটা সূর্যমূর্তিই। দেখছ না দু-হাতে দুটো ফুল আর পায়ে হাঁটু পর্যন্ত বুটজুতো? ওই কিরীট, পায়ের কাছে দুই স্ত্রী, ওসবই সূর্যমূর্তির বৈশিষ্ট্য। বোধ হয় অষ্টম শতাব্দীর মূর্তি, গুপ্তোত্তর যুগের।’
সমরেশ চট করে তাকিয়ে দেখে নিল ড ঝা এবং রাজীব দু-জনেই উৎকর্ণ হয়ে দময়ন্তীর কথা শুনছেন। ও থামতেই রাজীব বলল, ‘শাবাশ, মিসেস দত্তগুপ্ত! আপনি কি ডিটেকটিভগিরির সঙ্গে সঙ্গে পুরাতত্ত্বেরও আলোচনা করে থাকেন নাকি?’
দময়ন্তী বলল, ‘ডিটেকটিভগিরিটা আমার আসল কাজ নয়, মিস্টার সিনহা। আমি ইতিহাসের শিক্ষক, মধ্যযুগের ইতিহাস আমার অন্যতম বিষয়।’ বলতে বলতে দময়ন্তী মূর্তিটার সামনে ঝুঁকে পড়ল।
বিস্ফারিত চোখে রাজীব বলল, ‘কী আশ্চর্য। আপনি ইতিহাসের শিক্ষক? কী আশ্চর্য!’
এতে এত আশ্চর্য হওয়ার কী আছে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল রঞ্জিত। কিন্তু হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়াল দময়ন্তী, ঘুরে দাঁড়াল সমরেশ আর রঞ্জিতের দিকে। মুখ উত্তেজনায় উজ্জ্বল। সমরেশ সেটা লক্ষ করে চাপা গলায় বলল, ‘কী হল? কিছু একটা দেখেছ মনে হচ্ছে?’
দময়ন্তী সেকথার জবাব দিল না। ডক্টর ঝা-র দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, ‘মূর্তিটার পায়ের নীচে লিপিটা পড়েছেন, ডক্টর ঝা? কী লেখা আছে?’
ব্যঙ্গবঙ্কিম গলায় ডক্টর ঝা বললেন, ‘নিজেই পড়ে নিন না, মিসেস ডিটেকটিভ। আমার গবেষণার জিনিস আমি অন্য কাউকে প্রকাশ করে বলি না।’
দময়ন্তী মাথা নেড়ে স্মিতমুখে বলল, ‘সেকথা অস্বাভাবিক নয়। আচ্ছা, দেখি আমি নিজেই চেষ্টা করে। একটা খাতা-পেনসিল হলে ভালো হত—’
ওর কথা শেষ হতে-না-হতেই রঞ্জিত পকেট থেকে একটা ছোটো ডায়েরি আর একটা কলম এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এতে চলবে?’
‘চলবে।’ বলে দময়ন্তী আবার মূর্তিটার সামনে ঝুঁকে পড়ল।
ডক্টর ঝা রাজীবকে বললেন, ‘চলো, এখানে এই সার্কাসের মধ্যে সময় নষ্ট না করে আমরা একবার ঘরে গিয়ে কয়েকটা চিঠি লিখে ফেলি।’
.
১২
ডায়েরি থেকে মুখ তুলে দময়ন্তী ফিকে হাসল। লোপামুদ্রা সমরেশকে নিয়ে ঘরের অন্যান্য পুরাবস্তুগুলো দেখাচ্ছিল আর অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিল। কিন্তু রঞ্জিত কিঞ্চিৎ উৎকণ্ঠিতভাবে দময়ন্তীর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। জিজ্ঞেস করল, ‘কী হল বউদি? কী লেখা আছে?’
‘লেখা আছে, কোনো এক মহাসামন্ত বাসুদেব তাঁর অভীষ্ট পূরণের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এই মূর্তি সহস্র সহস্র রত্নখচিত রথের ওপর স্থাপন করে মার্তণ্ড মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করলেন। তারপর কতকগুলো সাংকেতিক চিহ্ন আছে, তার অর্থোদ্ধার করা আমার সাধ্য নয়। ডক্টর ঝা-কে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন, তিনি হয়তো কিছু বলতে পারবেন।’
‘এই লেখা থেকে কিছু অনুমান করতে পারলেন?’
‘কিছু নয়। কে জানে কে ছিলেন এই মহাসামন্ত বাসুদেব? এই কুন্তীপুরেই তাঁর রাজধানী ছিল কি না তাই-বা কে জানে?’
ঘরে ঢুকলেন নিশীথ সান্যাল। বললেন, ‘এই যে, তোমরা এসে গেছ! বেশ, বেশ।’ তারপর গলা উঁচু করে বললেন, ‘লোপা, প্রমীলা এসেছে দেওঘর থেকে। তোকে ডাকছে। যদিও খুব সামলেছে মেয়েটা, কিন্তু তবু যদি বেশি কান্নাকাটি করে তো মিসেস আরিয়াকে ডেকে নিস। নিজে পাকামো কিছু করিস না।’
‘আচ্ছা বাবা, আচ্ছা।’ বলে লোপামুদ্রা গটগট করে বেরিয়ে চলে গেল।
দময়ন্তীকে জিজ্ঞেস করলেন মি সান্যাল, ‘কী, কেমন লাগছে আমাদের মিউজিয়াম? খুব আহামরি কিছু একটা নয়, তবে নেহাত মন্দও নয়, কি বলো?’
দময়ন্তী বলল, ‘অত্যন্ত সুন্দর! প্রত্যেকটি মূর্তি চমৎকার। বিশেষ করে এই সূর্যমূর্তিটা। মহামূল্যবান জিনিস, ঐতিহাসিক গুরুত্বও এর কম নয়। এটা এখানে না রেখে অবিলম্বে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বা জাতীয় সংগ্রহশালায় পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। প্রথমত, এমন জিনিসের এখানে অজ্ঞাতবাস করা ঠিক নয়; আর দ্বিতীয়ত, প্রফেশনাল কেয়ারে না থাকলে নষ্টও তো হয়ে যেতে পারে।’
মি সান্যাল বললেন, ‘এই মূর্তিটা থাকবে না এখানে। ডক্টর ঝা এখন যে গবেষণাটা করছেন, সেটা শেষ হলেই একে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যাবেন। আর নষ্ট হওয়ার কথা ভাবছ? সে-ভয় নেই। এখানে এঁর যত্ন-আত্তির কোনো অভাব নেই। বাইরের লোকও কেউ আসতে পারে না! ওই তিরিশ ফুট উঁচু ছাদের ওপর থেকে তো কেউ নামতে পারে না; আসার একমাত্র পথ লোহার দরজা। তার ল্যাবের চাবি আমি আমার ড্রয়ারে রাখি, অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন না হলে কাউকে দিই না। তা ছাড়া সারারাত একজন দারোয়ানের ডিউটি থাকে এখানে। সে বারান্দায় বসে পাহারা দেয়।’
‘মতান্তরে ঘুমোয়।’ রঞ্জিত সহাস্যে বলল।
‘তোমাদের যত সন্দেহবাতিক।’ মি সান্যাল বললেন, ‘সেকথা থাক। দময়ন্তী, তুমি কি একবার প্রমীলার সঙ্গে দেখা করবে? ওর সঙ্গে আমার একটু কথা হয়েছে। ও কিন্তু নিশ্চিত যে ইন্দারের মৃত্যুটা দুর্ঘটনাই; আর কিছু নয়।’
চিন্তিত মুখে মাথা নাড়ল দময়ন্তী। ‘হ্যাঁ, একবার দেখা করব ভাবছি। কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন আছে। ইন্দারের মৃত্যুর ব্যাপারে পুলিশ তদন্ত করছে। সাধারণভাবে তাদের বিচার গ্রাহ্য। আমি এর মধ্যে হস্তক্ষেপ করতে গেলে কারোর তো একটা অনুমতির দরকার। প্রমীলা যদি আমার সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করে, আমি কী করতে পারি?’
হাত নেড়ে সান্যাল বললেন, ‘আমি অনুমতি দিচ্ছি। আমি এখানকার চিফ এগজিকিউটিভ, আমার স্টেটের ভেতরে একটা অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে। তার তদন্তের ভার আমি তোমাকে দিলুম। পুলিশ তার কাজ করুক, কিন্তু তোমাকেও যাতে সবরকমে সাহায্য করে, তার জন্যে আমি তাদের বলে দেব। আর গভর্নমেন্টকে বলে তোমার কনসালটেশন ফি…’
বাধা দিয়ে দময়ন্তী বলল, ‘ফি-র কথা থাক। আর পুলিশকেও কিছু বলবার দরকার হবে না বোধ হয়। জয়ন্ত চতুর্বেদী সাহায্য সবরকমেই করবে, কিন্তু পুলিশ হিসেবে তো তদন্তে আমাকে নামতে বলতে পারে না। আপনার অনুমতি সেই দিক দিয়ে আমাদের খুব সাহায্য করবে।’
.
১৩
সেইদিন রাত্রিবেলা।
ঘর থেকে শুভরাত্রি জানিয়ে রঞ্জিত বেরিয়ে গেলে সমরেশ দরজাটা বন্ধ করে দিল। দময়ন্তী বলল, ‘জানলাগুলোও বন্ধ করে দাও। আকাশে যেরকম মেঘ করেছে, মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে।’
সমরেশ বলল, ‘হবে মানে? ঝিপঝিপ করে শুরু হয়ে গেছে। বাপস, বাইরে কী অন্ধকার! রাত সবে সওয়া দশটা, এখনই মনে হচ্ছে যেন বারোটা বেজে গেছে।’
দময়ন্তী বলল, ‘আজকের রাতটা কিন্তু নিশাচরদের আদর্শ রাত। ঘন অন্ধকার, টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে, দুয়ার দেওয়া সকল ঘরে, এখনই তো পথিকহীন পথের পরে সন্দেহজনক লোকেদের গতিবিধি।’ তারপর গুনগুন করে এক কলি গেয়েই ফেলল ‘বাহিরে কিছু দেখিতে নাহি পাই, তোমার পথ কোথায় ভাবি তাই।’
সমরেশ শেষ জানলাটা বন্ধ করতে করতে বলল, ‘পথ কি সত্যিই কিছু ভেবে পাওনি? প্রমীলার সঙ্গে কথাবার্তায় কী বুঝলে?’
দময়ন্তী খাটের ওপর গড়িয়ে পড়ল। বলল, ‘প্রমীলাকে দেখে তোমার কী মনে হল?’
সমরেশ চিন্তিত মুখে গাল চুলকোতে চুলকোতে বলল, ‘অনেক কিছুই মনে হল, তবে পাঞ্জাবি মেয়েরা যে বাঙালি মেয়েদের তুলনায় অনেক বেশি শক্তপোক্ত— অনেক বেশি প্র্যাকটিক্যাল, সেটা স্পষ্টই বোঝা গেল।’
‘প্রথমত, আমরা যখন ঢুকলুম, তখন ও কেমন গম্ভীরভাবে ওর বাবার অ্যাকাউন্ট্যান্টের কাছে হিসেবপত্তর বুঝে নিচ্ছিল, দেখলে? বাঙালি মেয়ে হলে তো শোক কাটতেই দু-মাস লাগত। অথচ বাবার কথা বলতে গিয়ে চোখে জল ঠিক এল, গলাও ধরে এল, যদিও হাত-পা ছুড়ে কান্নাকাটি করল না।
দ্বিতীয়ত, তোমার প্রত্যেকটি প্রশ্ন ভেবে-চিন্তে ধীরে-সুস্থে উত্তর দিচ্ছিল। কোনো জড়তা নেই। স্পষ্ট নিঃসংকোচ কথাবার্তা। ওর বাবার মৃত্যুটা যে নিতান্তই দুর্ঘটনা, সে-বিষয়ে একদম দ্বিধাহীন। তুমি যখন ওকে বোঝাচ্ছিলে যে ওর বাবার মৃত্যুর পেছনে কোনো জটিল ষড়যন্ত্র থাকতে পারে এবং সেক্ষেত্রে ওরও বিপদের সম্ভাবনা; তখন তো তোমার কথা উড়িয়ে দিল। সাবধান হওয়ার কথাকে কোনো পাত্তাই দিল না। আমার বেশ ভালোই লাগল।’
দময়ন্তী বলল, ‘ওর তিনটে কথা কিন্তু খুব ইন্টারেস্টিং। এক নম্বর, ওর বাবার কোনোরকম কোনো শত্রুর কথা ওর জানা নেই। দু-নম্বর, ঘটনার দিন উনি বেশ স্বাভাবিকই ছিলেন। আর তিন নম্বর, ধরো বিয়ের কোনোরকম চেষ্টাই ওর বাবা করছিলেন না।’
‘এতে কি তোমার মনে হয় প্রমীলা কোনো কথা চেপে যাচ্ছে?’
‘ঠিক বুঝলুম না। কেউ একটা কোথাও উলটোপালটা কথা বলছে। কেন বলছে?’
‘তাই তো, কেন বলছে?’ সমরেশ দময়ন্তীর পাশে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে কড়িকাঠের টিকটিকিটাকে প্রশ্ন করল।
টিকটিকিটা কোনো জবাব দেওয়ার আগেই খুট করে সদর দরজাটা খোলবার শব্দ হল। যথাসম্ভব নিঃশব্দে কেউ এসে বারান্দায় দাঁড়াল, একটা ছাতা খোলার শব্দ, তারপর বৃষ্টির মধ্যে নেমে যাওয়ার আওয়াজ। তড়াক করে লাফ দিয়ে সমরেশ খাট থেকে উঠে পড়ল। একটা জানলা একটু ফাঁক করে খুলে বাইরে তাকিয়েই ঝপ করে বন্ধ করে ফেলল। দময়ন্তীর দিকে উত্তেজিতভাবে তাকিয়ে বলল, ‘রনু এই বৃষ্টির মধ্যে বাইরে গেল কেন?’
‘তা আমি কেমন করে বলব?’ তন্দ্রাজড়িত গলায় দময়ন্তী বলল, ‘আলোটা নিভিয়ে তুমি শুয়ে পড়ো তো।’
সমরেশ আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। রঞ্জিতের এই অসময়ে বাইরে যাওয়া নিয়ে দময়ন্তীর সঙ্গে আলোচনা করবে কি না ভাবছিল, কিন্তু দময়ন্তীর স্বগতোক্তি শোনা গেল ‘প্রমীলা বলল, যদিও ওর শত্রু কেউ নেই, কিন্তু কেউ যদি ওর অনিষ্ট করে, তাহলে সে নিস্তার পাবে না; যদি ও বেঁচে না থাকে তাহলেও না। একথা বলল কেন?’
সমরেশ বলল, ‘প্রমীলা তোমাদের মতো ভেতো বাঙালি মেয়ে নয়, রীতিমতো পঞ্চনদবাসী বীরাঙ্গনা। ওদের কথাবার্তাই ওরকম। খুন কা বদলা খুন। আচ্ছা, একটা কথা, প্রমীলাকে প্রশ্ন করার সময় সবাইকে ঘর থেকে বের করে দিলে কেন? এমনকী লোপামুদ্রাকে পর্যন্ত?’
দময়ন্তীর দিক থেকে কোনো জবাব এল না। মৃদু নিশ্বাসের শব্দে বোঝা গেল ও ঘুমিয়ে পড়েছে। কড়িকাঠের টিকটিকিটাকেও অন্ধকারে দেখা যাচ্ছিল না। কাজেই সমরেশও ঘুমিয়ে পড়ল।
.
১৪
সমরেশের ঘুম ভাঙল নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে। ঘুম ভাঙার কারণটা অনুধাবন করতেও বেশি দেরি হল না। একটি উষ্ণ, নরম হাত ওর গলা জড়িয়ে ধরেছে। অত্যন্ত পুলকিত হয়ে উঠতে যাচ্ছিল সে, কিন্তু তার আগেই দময়ন্তীর ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর ফিসফিস করে বলল, ‘আমার বাঁ-পাশের জানলাটার দিকে তাকিয়ে দেখো।’
সমরেশ দেখল, জানলাটা খুব আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে। অন্ধকার দেওয়ালের গায়ে একটা চার ফুট লম্বা ব্লু ব্ল্যাক রেখা যেন ধীরে ধীরে মোটা হয়ে উঠছে। ইঞ্চি তিনেক ফাঁক হয়ে খুলে যাওয়া বন্ধ হল, আর সেই ফাঁকের ভেতর দিয়ে একটা সাদা চকচকে নল শিকারি সাপের মতো নিঃশব্দে ঘরের মধ্যে ঢুকে এল।
বন্দুক! বিদ্যুতের মতো কথাটা মনের মধ্যে লাফিয়ে উঠল। তৎক্ষণাৎ সমরেশ দময়ন্তীকে দু-হাতে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে ডান দিকে গড়িয়ে গিয়ে সশব্দে খাট থেকে নীচে পড়ে গেল। তারপর ওকে এক ধাক্কায় খাটের নীচে ঠেলে দিয়ে, লাফিয়ে উঠে বারান্দার দিকের দরজার ছিটকিনিটা খুলে বাইরে গিয়ে পড়ল।
কিন্তু ওইটুকু সময়েই দেরি হয়ে গেল। বন্দুকধারী যিনি এসেছিলেন, তিনি সমরেশের খাট থেকে পড়ার শব্দ শুনেই সাবধান হয়ে গিয়েছিলেন, ছিটকিনি খোলার শব্দ পাওয়ামাত্র জানলা ছেড়ে এক লাফে পাশের বাড়ির নীচু পাঁচিল ডিঙিয়ে, প্রচণ্ড জোরে দৌড়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেছেন। সমরেশ তাঁর টিকিটিও দেখতে পেল না।
একটু বাদেই দময়ন্তী এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে একটা হাত জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল, ‘কাউকে দেখতে পেলে?’
‘নাঃ, বেটা দৌড়োয় খুব জোর। কোনো চিহ্নই দেখতে পেলুম না। ভিজে মাটিতে কোনো শব্দও নিশ্চয়ই পাশের বাড়ির ওরা শুনতে পায়নি। পেলেও কি আর কিছু বলবে?’
বৃষ্টি তখন থেমে গেছে, কিন্তু আকাশে স্তূপের পর স্তূপ ঘন কালো মেঘ। পাশের বাড়িটা শব্দহীন। ওরা সত্যিই বোধ হয় কোনো আওয়াজ শোনেনি।
সমরেশ বলল, ‘রাস্তা দিয়ে কে যেন আসছে না। জুতোর পচপচ আওয়াজ শুনছি। চৌকিদার নাকি?’
দময়ন্তী বলল, ‘না, চৌকিদার নয়। চৌকিদারের জুতোর তলায় কাঁটা মারা থাকে।’
জুতোর আওয়াজটা ওদের বাড়ির গেটের সামনেই এসে থামল। খড়খড় করে গেটটা খোলার আওয়াজ। সমরেশ হাত বাড়িয়ে বারান্দার আলোটা জ্বেলে দিল। এক ঝলক উজ্জ্বল নীলাভ আলো ঝাঁপিয়ে পড়ল অন্ধকার লনের ওপর। আর সেই আলোয় বিভ্রান্তদৃষ্টি রঞ্জিত ছাতা হাতে লনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ল। স্পষ্টতই এই সময় সে বারান্দায় তার দুই অতিথিকে একেবারেই আশা করেনি।
‘এত রাতে কোথায় গিয়েছিলি?’ সমরেশের গলা অতিরিক্ত রকমের স্বাভাবিক শোনাল।
‘এই— ইয়ে, সাইটে গিয়েছিলুম। পাওয়ার হাউসে।’ রঞ্জিত আমতা আমতা করে বলল।
‘সাইটে? তোদের সাইটে কি রাত্রেও কাজ হয়?’
বিস্ময়ের ধাক্কাটা যেন ততক্ষণে খানিকটা সামলেছে রঞ্জিত। বলল, ‘হয়। মাঝে মাঝে আমি ফ্লাইং ভিজিট দিই। তা তোরা দু-জনে এত রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কেন? আমার অপেক্ষায় ছিলি নাকি?’
‘না, ঠিক তা নয়। একজন ভিজিটার এসেছিলেন বন্দুক হাতে নিয়ে। ওই জানলা দিয়ে আমাদের দিকে তাকও করেছিলেন। কিন্তু আমি বাইরে বেরিয়ে এসে মুখোমুখি সাক্ষাৎ করার চেষ্টা করায় তিনি বিরক্ত হয়ে স্থানত্যাগ করেছেন।’
‘বন্দুক হাতে ভিজিটার? কী সর্বনাশ! কে সে?’
‘দেখতে পাইনি। অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে চলবে না, গাইতে গাইতেই বেরোচ্ছিলুম, কিন্তু তিনি কর্ণপাত করেননি।’
‘ইয়ার্কি থামা। চল, এক্ষুনি মিস্টার সান্যালের বাড়ি যাই। মধুপুরে মিস্টার চতুর্বেদীকে ফোনে কনট্যাক্ট করা যায় কি না দেখি।’
‘এত রাতে?’
‘রাত খুব বেশি হয়নি। বারোটাও বাজেনি। উনি এখনও জেগেই আছেন। ওঁকে জানানো দরকার ব্যাপারটা। অন্য কোনো জায়গায় গিয়ে ফোন করার চেষ্টা বৃথা। এক্সচেঞ্জ নির্ঘাত ঘুমোচ্ছে। ওঁর ফোনটা ডাইরেক্ট।’
‘ঠিক আছে। চল তাহলে। এই পোশাকেই যাই, কি বলিস?’
দময়ন্তী বলল, ‘তার আগে একটা টর্চ আনো তো, আমার সুটকেসের ভেতর আছে। আমি একবার জানলার তলাটা দেখতে চাই।’
রঞ্জিত তাড়াতাড়ি পকেট থেকে একটা ছোট্ট টর্চ বের করে দময়ন্তীর হাতে দিয়ে বলল, ‘দেখুন তো, এতে চলবে?’
‘চলবে,’ বলে দময়ন্তী সন্তর্পণে বারান্দা থেকে নেমে জানলার নীচে আলো ফেলল। কতকগুলো জুতোর ছাপ, খুব সম্ভবত ক্যানভাসের জুতো। রঞ্জিত উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘একী, এ তো মনে হচ্ছে বারো-চোদ্দো বছরের কোনো ছেলের পায়ের ছাপ! এ বয়েসের ছেলে তো এখানে তেমন কেউ নেই।’
দময়তী চিন্তিত চোখ তুলে তাকাল। আপন মনে বলল, ‘নেই কি?’
.
১৫
নিশীথ সান্যাল নীচে বসবার ঘরে বসে গল্পের বই পড়ছিলেন। বাড়ির কেউই ঘুমোয়নি। খাওয়া-দাওয়ার পাট একটু আগেই চুকেছে বলে মনে হল। রঞ্জিতের মুখে সব শুনে ভদ্রলোক স্তম্ভিত। বললেন, ‘এ কী বিপদে পড়লুম বলো দেখি। কোন দিক সামলাই বুঝতে পারছি না? যাও রঞ্জিত, ফোনটা চেষ্টা করে দেখো। কুন্তীপুর আউটপোস্টেও একটা ফোন করে দাও।’
রঞ্জিত ফোন করতে ওপরে গেলে দময়ন্তী প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা মিস্টার সান্যাল, এখানে কার কাছে বন্দুক আছে?’
সান্যাল বললেন, ‘নেই কার? অফিসার প্রায় সবারই কাছে। কনট্রাক্টর যাঁরা আছেন, তাঁদেরও সকলেরই কাছে। কনট্রাক্টরদের সুপারভাইজার, লোকজন কুলি-কামিনদের অবশ্য নেই। অন্তত আমি জানিনে। তবে বন্দুক চালাতে জানে এরকম বারো-চোদ্দো বছরের কোনো ছেলে এখানে নেই, সে-বিষয়ে আমি নিশ্চিত। এখানে যাঁদের ওই বয়েসের ছেলে আছে, তাঁরা তাদের হোস্টেলে রেখেই পড়ান। বেশির ভাগ অবাঙালি, এই সময় পুজোর ছুটি তারা বড়ো একটা পায় না।’
রঞ্জিত দোতলা থেকে নেমে এল। বলল, ‘কুন্তীপুর থানায় ফোন করে এলুম। সাবইনস্পেকটর প্রসাদ আসতে চেয়েছিল। আমি বারণ করে দিলুম। যা দেখবার, বউদিই দেখে নেবেন। প্রসাদ বলল যে ও মধুপুরকে কনট্যাক্ট করবে। কাল সকালেই জয়ন্ত চতুর্বেদী এসে যাবে। প্রসাদকে সব ডিটেল বলে দিয়েছি।’
সান্যাল বললেন, ‘বেশ করেছ। এখন একটু বোসো। তোমার জিপে আর বাড়ি গিয়ে কাজ নেই। আমি ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলে দিচ্ছি। সে তোমাদের পৌঁছে দিয়ে আসবে।’
দময়ন্তী বলল, ‘না, না, মিস্টার সান্যাল, তার কোনো দরকার হবে না। বিপদ যা ছিল তা কেটে গেছে। আমরা ঠিক বাড়ি চলে যেতে পারব।’
সান্যাল ধমকে উঠতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তক্ষুনি বাইরে থেকে ঘরে এসে ঢুকল লোপামুদ্রা। ঢুকেই হইহই করে উঠল, ‘এ কী দময়ন্তীদি? আপনারা সবাই এত রাত্রে?’
সান্যাল বললেন, ‘শুনিসনি? ভয়ানক ব্যাপার!’ বলে সমস্ত ঘটনাটা সবিস্তার এবং বেশ রং চড়িয়ে বললেন।
শুনে লোপামুদ্রা মহা খুশি। বলল, ‘কী মজা! আপনি লোকটাকে ধরতে পারলেন না, সমরেশদা? আপনি, একেবারে অপদার্থ!’
সমরেশ সহাস্যে বলল, ‘যা, যা, বাজে বকিসনি। অপদার্থ, না? তুই হলে তো এতক্ষণে দাঁত-কপাটি লেগে পড়ে থাকতিস। তা বলি গিয়েছিলি কোথায়? এই রাতবিরেতে বাইরে ঘুরছিলি কেন?’
লোপামুদ্রা বলল, ‘আফটার ডিনার ওয়াক আ মাইল করছিলুম।’
‘তার মানে?’ রঞ্জিত গম্ভীর মগ্নকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল।
‘তার মানে, পেছনের বাগানে হটহাউসের ভেতর বেড়াচ্ছিলুম। রাজীবদা ওর জীবনের অদ্ভুত অদ্ভুত সব গল্প বলছিল। ভীষণ মজার সব গল্প।’
লোপামুদ্রার মজার গল্প শোনার কথা শুনে কেউ যে খুব একটা মজা পেল তা মনে হল না। সমরেশও একটু থতোমতো খেয়ে গেল। রঞ্জিত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আচ্ছা, মিস্টার সান্যাল, আমরা তাহলে এখন উঠি।’
সান্যাল সম্মতি জানাতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ পাশের অফিস ঘরে ইন্টারকম যন্ত্রের কঁ কঁ আওয়াজে তাড়াতাড়ি উঠে চলে গেলেন। অদৃশ্য বক্তার সঙ্গে তাঁর উচ্চকণ্ঠের আলাপ শোনা গেল, ‘কী বললে? ঢল নামছে? পাহাড়ে জোর বৃষ্টি হয়েছে? কে বললে? ডিংরিয়ার মোড়ল এসে খবর দিয়েছে? হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওরা এ ব্যাপারে এক্সপার্ট। দু-ঘণ্টার মধ্যে এসে পড়বে? কী সর্বনাশ! হ্যাঁ, হ্যাঁ, এখুনি ব্যবস্থা নিতে হবে।’
ফ্যাকাশে মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সান্যাল। বললেন, ‘সিকিউরিটি কী বলল, শুনলে তো রঞ্জিত? এখন কী করবে? ইন্দারও নেই।’
উঠে দাঁড়িয়ে দৃঢ় কণ্ঠে রঞ্জিত বলল, ‘আপনি চিন্তা করবেন না, মিস্টার সান্যাল। আমি সব ব্যবস্থা করছি। ইন্দারের মেট বলদেও গোয়ালা আমার কথা ইন্দারের চেয়ে কম শুনবে না। আপনি ভ্যানটার ব্যবস্থা করুন। আমি এক্ষুনি ধাওড়া লাইনে চলে যাচ্ছি। আর সিকিউরিটিকে বলুন, সাইকেল করে এক্ষুনি যেন একজন ডিংরিয়ায় চলে যায়, যত লোক পারে জোগাড় করে আনুক। আর ব্রিজটা যেন বন্ধ করে দেয়। অনুমতি ছাড়া পায়ে হেঁটেও যেন লোক চলাচল না করে।’
‘মালপত্র কী লাগবে?’
‘দড়িদড়া, উইনচ, গোটাকয়েক ক্ল্যাম্প, হামবর এইসব। সমস্তই ইন্দারের বাড়ির একতলায় গুদামে আছে। বলদেও জানে, আমিও জানি। আপনি আর দেরি না করে গ্যারেজে ফোন করে ভ্যানটা আনান। আমি ওতেই চলে যাব। ইন্দার কী করত আমরা বহুবার দেখেছি, বলদেও নিজের হাতে করেছে, কাজেই এবারেও ঠিক সামলে দেব।’
‘দেখো, কী করতে পার।’ বলে হন্তদন্ত হয়ে নিশীথ সান্যাল আবার অফিস ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।
বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়েছে, সঙ্গে প্রচণ্ড ঝোড়ো হাওয়া। কাচের শার্সি ভেদ করে ঘরে ঢোকবার জন্য বৃষ্টির ছাট নিষ্ঠুর জিঘাংসায় বার বার ঝাঁপিয়ে পড়ছে। বাগানের গাছগুলো উন্মাদের মতো টলছে, মাথা ঝাঁকাচ্ছে, নুয়ে পড়তে চাইছে মাটিতে।
নিশীথ সান্যাল অফিস ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, ‘দশ মিনিটের মধ্যে ভ্যান এসে যাবে, রঞ্জিত।’ তারপর উদবিগ্ন চোখে বাইরে তাকিয়ে বললেন, ‘ইস! কী শুরু হল বলো দেখি?’ বছরের এই সময়টা… যত সব।’
ওঁর কথা শেষ হতে-না-হতেই আবার অফিস ঘরের ইন্টারকম কঁ কঁ করে উঠল। সমরেশ সান্যালকে বলল, ‘এখন এমার্জেন্সির সময়, আমরা আর আপনাকে বিরক্ত করব না। রঞ্জিতের জিপ নিয়ে আমরা চলে যাচ্ছি। আর রঞ্জিত, তুই ব্রিজে যাবার সময় আমাকে তুলে নিয়ে যাস।’
রঞ্জিত বলল, ‘মোটেই না। আজ রাত্রে বউদিকে কিছুতেই একলা থাকতে দেওয়া যেতে পারে না। তোর ওপরেও যে খুব একটা ভরসা করি, তা নয়। যাক, নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। এই চাবি নে, এক্ষুনি চলে যা। কাল সকালে দেখা হবে।’
.
১৬
ভোরবেলা পর্যন্ত একটানা বৃষ্টি চলল। সাতটা নাগাদ বৃষ্টি থামল বটে, কিন্তু মেঘে চতুর্দিক অন্ধকার হয়েই রইল। সমরেশ বা দময়ন্তী সারাটা রাতই প্রায় না ঘুমিয়ে চিন্তায় চিন্তায় কাটাল। তারপর দু-জনে রঞ্জিতের আশায় বসে ছিল বারান্দায় ডেকচেয়ারে।
সাড়ে আটটা নাগাদ দূরে পাহাড়ের ওপর ভ্যানটাকে আসতে দেখা গেল। সমরেশ বলল, ‘রনু আসছে। ব্রিজটা আছে না ভেসে গেল, কে জানে।’
গাড়িটা এসে গেটের সামনে দাঁড়াল। ভেতর থেকে নামল কিন্তু একজন নয়, দু-জন। জয়ন্ত আর রঞ্জিত। সাবধানে জল-কাদা বাঁচিয়ে বারান্দায় এসে উঠল দু-জনে। রঞ্জিত বাড়ির ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল, জয়ন্ত একটা শূন্য চেয়ার দখল করে বসল।
‘তোমাকে নাকি কাল বন্দুকধারী আততায়ী আক্রমণ করেছিল?’ জয়ন্ত প্রশ্ন করল, ‘কী আরম্ভ হল বলো দেখি এখানে?’
‘আরম্ভ এখনও হয়নি, এটা ভূমিকামাত্র।’ দময়ন্তী বলল, ‘কিন্তু তোমার জিপ কোথায়, সৈন্যসামন্ত কই?’
‘সৈন্যসামন্ত আনিনি। ড্রাইভার জিপ চালিয়ে এনেছে। সেটা আছে নদীর ওপারে। রঞ্জিতবাবুর লোকজন আর ইন্দারের লোকজন মিলে ব্রিজটাকে দড়িদড়া দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে, একটা বেড়ালও হাঁটতে দিচ্ছে না ওপর দিয়ে। অথচ নিজেরা পরমানন্দে ব্রিজটার ওপরে, নীচে, সর্বাঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’
‘ব্রিজটা তাহলে আস্তই আছে? খুলবে কখন?’
‘আজ বেলা দুটোর আগে তো নয়ই।’
‘দুটো? আচ্ছা, জয়ন্ত, তোমার হোলস্টারে পিস্তল আছে? সেটা চলে?’
‘আলবত আছে। চলে না মানে? কিন্তু কেন বলো দেখি?’
‘বলব তোমায় পরে। এখন আমার একটা অনুরোধ রাখবে? আজ লাঞ্চটা এখানেই সারবে?’
হাসল জয়ন্ত। বলল, ‘ভয় করছে নাকি তোমার? কিচ্ছু চিন্তা কোরো না। আমি লাঞ্চটা এখানেই সারব, সেটা কিছু নয়। কিন্তু, বলি বেফাঁস কিছু করে ফেলেছ নাকি?’
মাথা নেড়ে সমরেশ বলল, ‘আহা, তা নয়। আপনি বুঝতে পারছেন না জয়ন্তবাবু, ও সন্দেহ করছে যে আজকেই কিছু একটা ঘটবে।’
‘কী ঘটবে?’ দময়ন্তীকে জিজ্ঞাসা করল জয়ন্ত।
‘জানি না।’
‘জান না। অথচ ঘটবে সেটা জান?’ জয়ন্ত হাসল।
‘হ্যাঁ। ইন্দারের মৃত্যুতে যে সন্দেহটা হয়েছিল, কাল রাত্রের ঘটনায় সেটা বদ্ধমূল হয়েছে। শুধু বুঝতে পারছি না যে কী সেই ব্যাপার যার সঙ্গে আমাদের এবং ইন্দার সিংয়ের কিছুমাত্র যোগাযোগ থাকতে পারে।’
‘যোগাযোগ তো থাকতেই পারে। উনিই তো একজন।’ বলে জয়ন্ত বাড়ির ভেতরটা আঙুল দিয়ে দেখাল। অর্থাৎ রঞ্জিত।
দময়ন্তী চিন্তিত মুখে বলল, ‘হুঁ।’ তারপর চোখ বুজে চেয়ারে এলিয়ে পড়ল।
জয়ন্ত বলল, ‘দেখো, ইন্দারের মৃত্যুটা আমি খুব সিরিয়াসলি নিইনি এবং সত্যি কথা বলতে কী, তোমার ব্যাপারটাও আমি খুব গুরুত্ব দিচ্ছি না। এ অঞ্চলে তোমার নাকি মহিলা রহস্যসন্ধানী বলে নাম ছড়িয়ে পড়েছে? কোনো চ্যাংড়া হয়তো তোমাকে পরীক্ষা করতে এসেছিল, তাড়া করতে পালায়। এরকম ঘটনা দেখেছি তো।’
রঞ্জিত তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বেরোল। একটা চেয়ার টেনে বসে হাঁক মারল, ‘বাহাদুর! নাস্তা লাগাও। যাক, জয়ন্তবাবু, ইনস্পেকটর প্রসাদের টেলিফোন পেয়েছেন আশা করি। নাকি ঘুরতে ঘুরতে এলেন?’
জয়ন্ত বলল, ‘না, ঘুরতে ঘুরতে নয়। টেলিফোন পেয়েই এসেছি। তা ছাড়া আজ তো এমনিতেই আসতুম। প্রমীলার সঙ্গে দেখা করবার জন্য। টেলিফোনটা পেয়ে ভোরবেলাতেই চলে এলুম, এই আর কি।’
দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘অটোপসির রিপোর্ট পেলে নাকি?’
‘হ্যাঁ, পেয়েছি। সন্দেহ যা করেছিলুম, তাই। পেটে প্রচুর পরিমাণে অ্যালকোহল পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বিষ কিছু পাওয়া যায়নি। তবু যদি বল যে মাথায় ডান্ডা মেরে অজ্ঞান করা হয়েছিল, সেটা প্রমাণ করার কোনো উপায় আর নেই। দুর্ঘটনায় মাথার খুলি ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছিল।’
‘তবে প্রমাণ করার আর কোনো দরকার আছে বলেও মনে হয় না। পাকস্থলীর অতিরিক্ত পরিমাণ অ্যালকোহলই তোমার থিয়োরি ভুল প্রমাণ করতে যথেষ্ট।’ হাসতে হাসতে শেষ করল জয়ন্ত।
দময়ন্তী কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল। রঞ্জিত রুটি চিবোতে চিবোতে বলল, ‘আপনারা তাহলে আর ব্যাপারটা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন না?’
‘অগ্রসর? আমরা ব্যাপারটা কোনো সময়েই বিবেচনার জন্য গ্রহণ করিনি। দময়ন্তী একটা সন্দেহ প্রকাশ করেছিল, সকলেরই তা করবার অধিকার আছে। আমরা সেই সন্দেহটুকু নিরসন করলুম, এই মাত্র।’
‘কিন্তু কালকের রাত্রের ঘটনাটা? সেটা কিন্তু আমার ভালো ঠেকছে না।’
‘ওটাও সামান্য ব্যাপার। প্রসাদকে বলে দিয়েছি একটু বেলায় আসতে। ও-ই সব ফয়সালা করে দেবে, দেখবেন।’
রঞ্জিত চায়ের বাটি নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘জয়ন্তবাবু, আপনি তো আছেন এখন? আমি তাহলে চললুম। পাহাড়ে আবার বৃষ্টি নামল কি না কে জানে! আকাশের অবস্থা তো ভালো নয়। সর্বক্ষণই ব্রিজটার ওপর নজর রাখা দরকার। এঁরা রইলেন, আপনি এঁদের একটু দেখবেন।’
জয়ন্ত বলল, ‘ঠিক আছে। কেবল জল নেমে গেলে আমাকে একটু খবর দেবেন, আমি গিয়ে জিপটা নিয়ে আসব। ড্রাইভারকে ছেড়ে দিয়েছি, সে খেয়েদেয়ে বেলা একটা নাগাদ আসবে। পাহাড়ি নদীর ব্যাপার, হয়তো দেখবেন একটু পরেই জল একদম নেমে যাবে।’
‘বেশ, আমি সিকিউরিটিকে জানিয়ে দেব। ওরা এসে আপনাকে খবর দিয়ে যাবে।’ বলে রঞ্জিত বারান্দা থেকে নেমে ভ্যানটার দিকে রওনা হল। ভ্যানে উঠে চিৎকার করে বলল, ‘বউদি, যতক্ষণ না ফিরি, সাবধানে থাকবেন।’
স্মিতমুখে ঘাড় নাড়ল দময়ন্তী।
.
১৭
জয়ন্ত বলল, ‘সত্যি সাবধানে থাকা দরকার। তোমার ওই বন্দুকধারীর জন্য বলছি না। পাড়ার ছোকরা কয়েকটাকে ধরে চাবকালেই সে বেরিয়ে পড়বে। আমার আসল চিন্তা হচ্ছে, সেই বেটা চোরের রাজা সাধন গুহ। সেই জরুকা ভাই যে কোথায় ছুপিয়ে আছে আর কী কু-মতলব ভাঁজছে, ভগবান জানেন। আমার এখন মধুপুর থানা আগলে থাকার কথা; অথচ দেখো, আমি এখানে দিব্যি আড্ডা মারছি।’
দময়ন্তী হঠাৎ চেয়ারের ওপর খাড়া হয়ে উঠে বলল। বিস্ফারিত চোখে জয়ন্তর দিকে চেয়ে বলল, ‘কী বললে? সাধন গুহ, না?’ বলে আবার চোখ বুজে চেয়ারে এলিয়ে পড়ল।
জয়ন্ত একটু চমকে গিয়েছিল সন্দেহ নেই। অবাক হয়ে দময়ন্তীকে কী কথা যেন বলতে গিয়েও চুপ করে গেল।
দময়ন্তী একভাবে অনেকক্ষণ পড়ে রইল। জয়ন্ত আর সমরেশ একটার পর একটা পরস্পরের সিগারেট ধ্বংস করতে লাগল। দময়ন্তীর চিন্তাস্রোতে বাধা না দেওয়ার মতো বুদ্ধি যে জয়ন্তর ঘটে আছে, তাতেই সমরেশ যথেষ্ট কৃতজ্ঞ বোধ করছিল। সমরেশ বুঝতে পারছিল যে দময়ন্তী একটা হারানো সূত্র খুঁজে পেয়েছে; কারণ ওর মুখের রং ধীরে ধীরে পালটাচ্ছিল, রক্তিমাভ হয়ে উঠছিল।
হঠাৎ চোখ খুলে দময়ন্তী জয়ন্তকে জিজ্ঞেস করল, ‘জগতের সবচেয়ে বড়ো গাধা, গবেটস্য গবেটকে দেখতে চাও?’
উদবিগ্ন মুখে সমরেশ বলল, ‘কে সে শুনি?’
‘এই যে, আমি।’
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সমরেশ বলল, ‘কেন? হল কী?’
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দময়ন্তী বলল, ‘আশ্চর্য, সাধন গুহ নামটা আমার মনেই আসেনি! সেই আন্তর্জাতিক চোরাই চালানদার।’
জয়ন্তও উঠে দাঁড়িয়েছিল। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘তুমি বলতে চাও, সাধন গুহ এখানেই আছে? কোথায়? আর ওই নাম শুনেই তোমার সব ধাঁধা পরিষ্কার হয়ে গেল?’
দময়ন্তী বলল, ‘সব নয়, প্রায় সব। সমরেশ, আমাদের এক্ষুনি একবার মিউজিয়ামে নিয়ে চলো।’
সমরেশ অবাক। বলল, ‘মিউজিয়াম! সেখানে কী?’
‘আমার অনুমান যদি মিথ্যে না হয়,’ দময়ন্তী বলল, ‘সূর্যমূর্তিটা কাল রাত্রে চুরি গেছে।’
.
১৮
দু-পাশের মাঠে থই থই করছে জল। রাস্তাটা তার মধ্যে কোনোক্রমে মাথা উঁচু করে আছে। তার ওপর দিয়ে সাবধানে জিপ চালাচ্ছিল সমরেশ। দময়ন্তী নির্বাক হয়ে চিন্তা করছিল। তার মুখের দিকে তাকিয়ে জয়ন্তও কথা বাড়ায়নি।
দূর থেকেই দেখা গেল মিউজিয়ামের দরজা খোলা। বারান্দার ওপর চার-পাঁচজন লোক ঘোরাঘুরি করছে। সকলেই বেশ উত্তেজিত।
গাড়ি থামতেই দু-জন কাছে এগিয়ে এল। একজন নেপালি। জয়ন্তকে দেখে স্যালুট করে বিনা ভূমিকায় বলল, ‘রামবাহাদুর খুন হো গ্যয়া সাব।’ বলে বারান্দার একপাশে কম্বল মোড়া একটি দেহ দেখাল।
‘ক্যা?’ বলে একলাফে জিপ থেকে নামল জয়ন্ত ‘খুন হো গ্যয়া? ক্যায়সে?’
হাত নেড়ে নেপালি বলল, ‘মালুম নেহি, সাব। উও দরওয়াজা খুলা থা আউর লাশ উধর মিলা। বদন জরা দেখ লিজিয়ে হুজুর।’
গলার মধ্যে বিরক্তির শব্দ করে জয়ন্ত মৃতদেহর কাছে এগিয়ে গেল। মুখের ওপর থেকে কম্বলটা সরাতেই একজোড়া বিস্ফারিত চোখ বেরিয়ে এল, তারপর সমস্ত মুখটা। ভয়াবহ আতঙ্কে তার প্রত্যেকটি রেখা বিকৃত। কম্বল যথাস্থানে রেখে জয়ন্ত বলল, ‘অন্যান্য আঘাত আছে কি না জানি না, তবে মরার আগে দুর্দান্ত ভয় পেয়েছিল লোকটা। কিন্তু রামবাহাদুরকে আমি যতদূর জানতুম, বেশ সাহসী লোক ছিল।’
উপস্থিত সকলে মাথা নেড়ে সেকথার সায় দিল।
ঘটনার বিবরণে জানা গেল, রামবাহাদুরের ডিউটি সকাল আটটায় শেষ হয়। কিন্তু দশটা পর্যন্তও সে না ফেরাতে ওর ছোটোভাই ওকে খুঁজতে বেরোয় ও এখানে এসে মৃত অবস্থায় দেখতে পেয়ে চেঁচামেচি করে লোকজন জোগাড় করে। তাদের একজন গেছে ডাক্তার রমেশ পাণ্ডেকে ডাকতে। তিনি এলেন বলে।
তিনজনেই ইতিমধ্যে ঘরের ভেতর তাকিয়ে দেখে নিয়েছে— বেদি শূন্য।
মৃতদেহ মামুলি পরীক্ষার পর জয়ন্ত আর দময়ন্তী সমরেশকে নিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকল। বলল, ‘আমার মনে হয়, কাল একটা মস্ত বড়ো গ্যাং এসেছিল এবং সবাই মিলে রামবাহাদুরকে আচমকা কাবু করে ওর বুকের ওপর বসে ওকে মেরে ফেলে। কিন্তু তারা নিঃশব্দে এল কী করে? রামবাহাদুর বাঁশিটাও বাজাবার সময় পেল না!’
সমরেশ বলল, ‘হয়তো ঘুমোচ্ছিল।’
‘উঁহু, এরা ডিউটির সময় ঘুমোনোর পাত্র তো নয়। তা ছাড়া গলায় একটা ঘষটানোর দাগ আছে, কিন্তু আশ্চর্য, শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।’
দময়ন্তী বলল, ‘আচ্ছা, মনে করো কাল রাত্রে বৃষ্টি পড়ছে, ঠান্ডা হাওয়া বইছে, এর মধ্যে কম্বল মুড়ি দিয়ে দরজার দিকে পেছন করে রামবাহাদুর বসে ছিল সামনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে। এমন সময় একজন নিঃশব্দে পেছনের দরজা খুলে বেরিয়ে এল। রামবাহাদুর স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি যে সে পেছন থেকে আক্রান্ত হতে পারে। তাই পেছন থেকে যখন আচমকা গলায় ফাঁস পরিয়ে টান পড়ল, সে আতঙ্কে বাধা দিতে পারল না। তুমি দেখ, ও মারা গেছে শকে, দমবন্ধ হয়ে নয়। শুনতে হাস্যকর হলেও, শকটা বোধ হয় ভূতের ভয়জনিত। নেপালিরা দুর্দান্ত সাহসী, শত্রুর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে পেছোয় না কক্ষনো। কিন্তু ওদের জগতে আছে অসংখ্য ভূতপ্রেত— যাদের ওরা কক্ষনো ঘাঁটায় না। অত্যন্ত কুসংস্কারাচ্ছন্ন মন ওদের, মন্ত্রতন্ত্র, তুকতাকে বিশ্বাস করে— যেমন বিশ্বাস করে পুবদিকে সূর্য ওঠা। এবং আমার ধারণা, ওকে মারা চোরের উদ্দেশ্য ছিল না, অজ্ঞান করে ফেলাই উদ্দেশ্য ছিল।’
জয়ন্ত বলল, ‘তোমার চিত্রটা প্রায় বাস্তব বলা চলে, কিন্তু একটা মস্ত বড়ো প্রশ্ন আছে যে! হত্যাকারী ঘরের মধ্যে ঢুকল কী করে?’
‘ওই ছাদের ভেতর দিয়ে।’
‘কথাটা অমন অম্লানবদনে বোলো না। ওই তিরিশ ফুট কি তিনি লাফ দিয়ে নেমেছেন?’
‘না, দড়ি বেয়ে। ওই জয়েস্টের সঙ্গে দড়ি বেঁধে নেমেছেন, পরে দড়িটা খুলে নিয়ে গেছেন।’
‘কষ্ট করে দড়িটা খোলবার দরকার কী ছিল?’
‘কারণ দড়িটা খুব ইম্পর্ট্যন্ট। ওটা চোরকে পরিচিত করতে পারত।’
সমরেশ বলল, ‘ইন্দারের গলা থেকে দড়িটা খোলবার কারণও কি তাই? কিন্তু খুলল কী করে?’
দময়ন্তী বলল, ‘একটা কারণ তো বটেই। প্রথম কারণ অবশ্য একথা প্রমাণ করা যে ইন্দারের মৃত্যুটা দুর্ঘটনা। আর খুলল কী করে? ড্র হিচ ফাঁসের নাম জানো? স্কাউটে তো ছিলে না কোনোদিন, জানবে কী করে?’
জয়ন্ত তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে দময়ন্তীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ঠিক— ঠিক কথা বলেছ।’
‘ড্র হিচ-টা কী বস্তু?’ সমরেশ প্রশ্ন করল।
জয়ন্ত বলল, ‘ওটা এমন একটা ফাঁস, যাতে দড়ির একদিক ধরে টানলে ফাঁসটা খুব শক্ত হয়ে বসে, অন্যদিকটা টানলে পুরোটা খুলে যায়। একটা ফসকা গেরোর মধ্যে আরেকটা ফসকা গেরো আর কি। দমকলে বা সৈন্যবাহিনীতে এর খুব ব্যবহার আছে। এমন কিছু কঠিন নয়, একটু প্র্যাকটিসের দরকার হয়। কিন্তু এখন চুরি করেছে যখন, তখন তো সূর্যমূর্তিটা এখানেই আছে; এখান থেকে বেরোনোর রাস্তা তো বন্ধ।’
দময়ন্তী বলল, ‘চোর অমন বোকা নয়। সে আটঘাট বেঁধে কাজ করেছে নিশ্চয়ই। আমার ধারণা, মূর্তি এখানে নেই— থাকতে পারে না।’
‘কিন্তু বাইরে বেরোল কী করে? সূর্যদেব নিশ্চয়ই শূন্যপথে প্রস্থান করেননি?’
‘ঠিক তাই করেছেন, জয়ন্ত। কিন্তু মূর্তির আগে চোরকে ধরা দরকার। তা নইলে সব ভেস্তে যাবে।’
‘তোমার হেঁয়ালি আমি বিশেষ বুঝতে পারছি না, দময়ন্তী। এখন আমাদের কী করা দরকার?’
‘আমাদের সকলের আগে একবার প্রমীলার খোঁজ করা দরকার। এক্ষুনি।’
উত্তেজনায় জয়ন্তর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘ঠিক, আমি এবার কিছুটা বুঝতে পারছি। বার বার সযত্নে দড়িটা কেন খোলা হল, বোধ হয় তাও। ওই তো ডক্টর পাণ্ডে এসে গেছেন। ওঁর সঙ্গে একটু কথা বলেই, চলো আমরা যাই।’
.
১৯
ইন্দার সিংয়ের বাড়ির বারান্দায় একটি অল্পবয়সি সাঁওতাল মেয়ে উবু হয়ে বসে ছিল। সমরেশ জিপটা দাঁড় করাতে তাড়াতাড়ি আশান্বিত মুখে উঠে এল সে, কিন্তু ভেতরে দময়ন্তীকে দেখে যে হতাশ হল, বোঝা গেল।
জয়ন্ত জিজ্ঞেস করল, ‘প্রমীলা কোথায়?’
‘জানি না তো। সকাল বেলাতেই কোথায় বেরিয়েছেন। আমি এসে দেখি দরজা খোলা। ঘর পরিষ্কার করেছি, বাসন ধুয়েছি, এখন ওঁর জন্য বসে আছি। বলেছিলেন আজ আমায় মাইনে দেবেন।’
দময়ন্তী বলল, ‘তার মানে প্রমীলা কাল রাত্রে বাড়ি ফেরেনি। আমার ভয় হচ্ছে, ওর কোনো বিপদ হয়েছে।’
জয়ন্ত বলল, ‘আচ্ছা, তোমার কি সন্দেহ প্রমীলাই এই নাটকের প্রধান চরিত্র, না অন্য কেউ আছে? তোমার বিশ্বাস সাধন গুহ কাছাকাছি লুকিয়ে থেকে প্রমীলাকে চালনা করছে?’
‘হ্যাঁ, তবে লুকিয়ে নয়, দিব্যি প্রকাশ্যে। চলো, বলছি।’
সমরেশ জিপে স্টার্ট দিয়ে এগোতে যাবে, একটা ব্যাকুল চিৎকার ওকে বাধা দিল। দেখা গেল, রাস্তার মোড় থেকে একজন নেপালি সিকিউরিটি গার্ড চিৎকার করতে করতে আর হাত নাড়তে নাড়তে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসছে। সমরেশ তাড়াতাড়ি ব্যাক গিয়ার দিয়ে গাড়িটা পিছিয়ে লোকটির কাছে নিয়ে এল। লোকটি গাড়ির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘ডিএসপি সাহাব, প্রমীলা কাউর খুন হো গয়ি!’
‘কাঁহা?’ তিনজনে প্রায় সমস্বরে চিৎকার করে উঠল।
‘উও কুলিং ট্যাঙ্ককে ভিতর, সাহাব।’
‘লাশ ভিতরসে উঠায়া?’
‘জি হাঁ। সিকিউরিটি অফসর কাপুর সাহাবনে হামকো আপকো বুলানেকে লিয়ে ভেজা, সাব।’
জয়ন্ত একবার দু-জনের দিকে তাকাল। দময়ন্তীর মুখ ক্রোধে, ঘৃণায় থমথম করছে। ও চাপা গলায় বলল, ‘আর দেরি নয়, জয়ন্ত। কাপুর এখন থাক। সে ততক্ষণ লাশ আগলাক। আমাদের শয়তানটাকে ধরা দরকার। চলো, সমরেশ।’
সমরেশ বলল, ‘কোথায় যাব?’
‘মিস্টার সান্যালের বাড়ি।’
জয়ন্ত নেপালিটিকে দ্রুতকণ্ঠে কতকগুলো উপদেশ দিয়ে সমরেশকে বলল, ‘চলুন।’
আবার বাধা পড়ল। এবার উলটো দিক থেকে হাত নাড়তে নাড়তে হনহন করে সাইকেল চালিয়ে আসতে দেখা গেল লোপামুদ্রাকে। সাঁ করে সাইকেলটাকে জিপের পাশে এনে বলল, ‘মিস্টার চতুর্বেদী, মিস্টার রায়চৌধুরী খবর পাঠিয়েছেন যে ব্রিজটা হয়ে গেছে। বাবা আপনাকে সে-খবরটা দিতে বললেন।’
জয়ন্ত কিছু বলবার আগেই দময়ন্তী বলল, ‘লোপা, এ খবরটা কি আর কেউ জানে?’
‘জানি না তো। কেন?’
‘সেটা পরে বলব। এখন কেউ জানুক বা না জানুক, তুমি কাউকে পাঠিয়ে এই মুহূর্তে রঞ্জিতবাবুর কাছে খবর দিতে পারো যে, ব্রিজটা যেন অবিলম্বে বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং কাউকে, আই রিপিট, কাউকে যেন পার হতে দেওয়া না হয়?’
লোপামুদ্রা কী বুঝল, কে জানে। দৃঢ়ভাবে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘অন্য কাউকে পাঠাব কেন? আমিই যাচ্ছি। আমার চেয়ে জোরে এ তল্লাটে কেউ সাইকেল চালাতে পারে না।’ বলে সাইকেলের মুখ ঘুরিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে বেরিয়ে চলে গেল।
জয়ন্ত মুগ্ধ হয়ে দময়ন্তীর কথাবার্তা শুনছিল। বলল, ‘শাবাশ! আমি দুঃখিত যে তোমাকে আন্ডার এস্টিমেট করেছিলুম।’
নির্বাক স্তম্ভিত সাঁওতাল মেয়েটিকে পেছনে ফেলে সমরেশের জিপ প্রচণ্ড জোরে এগিয়ে গেল।
.
২০
মিসেস সান্যাল বললেন, ‘ওই যে মিস্টার সান্যাল এসে গেছেন, ডক্টর ঝা। সকাল থেকে তো নিজের অফিসে গিয়ে বসে আছেন। একে ব্রিজের খবর ভালো নয়, তার ওপর রামবাহাদুরের মৃত্যু আর মূর্তি-চুরির কথা শুনে ভয়ানক অস্থির হয়ে পড়েছেন।’
মি সান্যাল ঘরে ঢুকে স্ত্রীকে বললেন, ‘ওগো, শুনেছ? প্রমীলা মারা গেছে। কেউ ওর গলা টিপে কুলিং ট্যাঙ্কের ভেতর ফেলে রেখে গেছে।’
শিউরে উঠলেন সরমা, ‘সে কী কথা গো! এসব কী শুরু হল এখানে? পুলিশে খবর দিয়েছ?’
‘মাপ করবেন মিস্টার সান্যাল, আপনাদের বাধা দিতে বাধ্য হচ্ছি।’ সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন ড ঝা, ‘আমি জানতে চাই, ব্রিজটা কখন খোলা হবে।’
ড ঝা আর রাজীবকে লক্ষই করেননি মি সান্যাল। চমকে উঠে বললেন, ‘ওঃ, আপনি। হ্যাঁ, কী বলছিলেন?’
‘ব্রিজটা কখন খোলা হবে?’
‘কেন বলুন তো?’
‘শুনলুম, আমার সূর্যমূর্তিটা নাকি চুরি গেছে। আপনাকে বহুদিন আমি বলেছি, এটা সাবধানে রাখবেন, আমার ঘরে রাখুন, আপনি শোনেননি। আমারই ভুল হয়েছিল, আপনার অযৌক্তিক আবদার শোনা যে যতদিন ওটা এখানে থাকবে, ততদিন যেন ওই জাঙ্কহাউসে থেকে সকলের মনোরঞ্জন করতে পারে। তাতে করে লাভ হল এই যে আমার এতদিনের গবেষণা শেষমুহূর্তে এসে নষ্ট হয়ে গেল আর অমূল্য মূর্তিটা গেল কোনো চোরের মনোরঞ্জন করতে। এ অবস্থায় আমার এখানে থাকার আর কোনো দরকার নেই। আমি অবিলম্বে চলে যেতে চাই।’
মাথা নীচু করে লজ্জিত কণ্ঠে মি সান্যাল বললেন, ‘সত্যিই আমার ভুল হয়েছিল ড ঝা। ব্রিজটা খুলে দিয়েছে, আপনারা ইচ্ছে করলেই যেতে পারেন। তবে আমি অনুরোধ করব…’
মি সান্যাল কী অনুরোধ করবেন সে-বিষয়ে কর্ণপাত না করে রাজীব বলল, ‘খুলে দিয়েছে? এত তাড়াতাড়ি? ঠিক আছে, চলুন সাহেব। আমি গাড়ি বের করছি।’
রাজীব দ্রুতপদে দরজার কাছে এগিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে গেল। দরজা আগলে উদ্যত পিস্তল হাতে জয়ন্ত, তার দু-পাশে সমরেশ আর দময়ন্তী। ‘একটু অপেক্ষা করতে হবে যে মিস্টার সিনহা,’ জয়ন্তর গলায় সুস্পষ্ট বিদ্রূপ, ‘ব্রিজটা খোলা হয়েছিল বটে, কিন্তু আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আপনারা তো যেতে পারবেন না।’
রাজীব বিড়বিড় করে বলল, ‘বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে? তার মানে?’
‘মানে অতি প্রাঞ্জল। এখন আপনাদের ব্রিজটা পেরোতে হলে আমাদের গাড়ি করেই যেতে হবে। সে-গাড়িটার আবার বিশেষ একটা নাম আছে। আমরা তাকে আদর করে বলি ব্ল্যাক মারিয়া।’
ফেটে পড়লেন ড ঝা। চিৎকার করে উঠলেন, ‘এসবের অর্থ কী মিস্টার সান্যাল? আমরা আপনার অতিথি আর আপনারই ঘরে বসে আমাদের এইভাবে অপমানিত হতে হবে?’
ঘরের মধ্যে ঢুকে এল দময়ন্তী। রাজীবকে লক্ষ করে বলল, ‘আপনার শাগরেদটিকে চুপ করতে বলুন। এই থিয়েটারের আর কোনো প্রয়োজন নেই, মিস্টার সিনহা। নাকি আপনাকে মিস্টার গুহ বলে সম্বোধন করব?’
কিছুক্ষণ বিস্ফারিত চোখে দময়ন্তীর দিকে চেয়ে রইল রাজীব, তারপর একটা হিংস্র হাসিতে দাঁত বের করল। বলল, ‘কী বলছেন, মিসেস ডিটেকটিভ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি দেখছি ভয়ানক রেগে গেছেন আমার ওপর। তবে হ্যাঁ, রেগে গেলে আপনাকে মন্দ দেখায় না একথা স্বীকার করতেই হবে।’
কষ্টে আত্মসম্বরণ করে দময়ন্তী বলল, ‘আমি কী বলছি, আপনি ভালোই বুঝতে পারছেন, মিস্টার সিনহা। ন্যাকামো করে আর লাভ নেই। এখন চুপ করে ওই সোফায় বসুন, আর মিস্টার সান্যাল আপনি আর একবার কুন্তীপুর মাইনস-এ ইনস্পেকটর প্রসাদকে আর মধুপুরে হেডকোয়ার্টার্সে টেলিফোন করুন।’
ব্যস্তভাবে মাথা নেড়ে মি সান্যাল বললেন, ‘হ্যাঁ, মা, এই যে যাই। কিন্তু এসব কী ব্যাপার? ডক্টর ঝা কি কোনো অপরাধ করেছেন? কী অপরাধ? আর এই গুহই-বা কে?’ বলে এক কোণে মিইয়ে যাওয়া ড ঝা-র দিকে তাকালেন।
দময়ন্তী বলল, ‘এ ডক্টর ঝা নয় মিস্টার সান্যাল! এ একটা বাজে লোক। এই রাজীব সিনহা ওরফে সাধন গুহর চ্যালা। আর ইনি একজন আন্তর্জাতিক অপরাধী। অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে আমাদের দেশের প্রাচীন শিল্পকীর্তিগুলি চুরি করে মোটা মুনাফার বিনিময়ে বিদেশে চালান করেন। কোনোরকম নীতিজ্ঞান নেই এঁর, হেন পাপকাজ নেই যা ইনি করতে অপারগ।’
হো হো করে হেসে উঠল রাজীব। বলল, ‘চমৎকার, চমৎকার! অতি উপভোগ্য গালগল্প সন্দেহ নেই। আমি যদি মূর্তি চুরি করেই থাকি, তবে আপনারা সার্চ করে সেটা খুঁজে বের করুন, তারপরে আমায় দোষারোপ করবেন। মূর্তিটা কি আমার কাছেই আছে বলে আপনার ধারণা, মিসেস ডিটেকটিভ?’
‘না মিস্টার গুহ, মূর্তিটা এখানে নেই। সেটাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।’
‘তবে সেটা আছে কোথায়? এখান থেকে অত বড়ো মূর্তিটা কি কেউ পকেটে করে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল, না সেটা উড়ে চলে গেল বাইরে?’
‘উড়েই গেছে, মিস্টার গুহ। এবং এখন সেটা কোথায় আছে তার সঠিক বিবরণ দিতে না পারলেও, মোটামুটি বর্ণনা দিতে পারি।’
‘পারেন নাকি? কীরকম শুনি?’
‘সেটা আছে কুন্তীপুর মাইনসে, যেখানে রোপওয়ের বাকেটে কয়লা লোডিং হয় সেখানে। আপনার কোনো এজেন্ট লোডার সেজে সেটি বাকেট থেকে উদ্ধার করে আপনি না গিয়ে পৌঁছোনো পর্যন্ত আগলাচ্ছে।’
রাজীব ক্রুদ্ধ কিন্তু নির্বাক দৃষ্টিতে দময়ন্তীর দিকে তাকিয়ে রইল, কী বলবে ভেবে পেল না। নিশীথ সান্যাল বললেন, ‘আর একটু স্পষ্ট করে বলো, আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না।’
দময়ন্তী বলল, ‘কাল রাত সাড়ে দশটা নাগাদ এই ডক্টর ঝা-রূপী লোকটি আর প্রমীলা মূর্তিটা চুরি করে। নাটের গুরু তখন আপনার বাগানে হটহাউসের ভেতর পায়চারি করতে করতে লোপামুদ্রাকে নানারকম মজার গল্প শোনাচ্ছিলেন। নিজের অ্যালিবাই তৈরি করছিলেন আর কি। আর ডক্টর ঝা তো বুড়োমানুষ, রোজই রাত ন-টা নাগাদ খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়েন। তাঁর ঘর তো অন্ধকার বটেই।
‘বাইরেও তখন ঘন অন্ধকার, বৃষ্টি শুরু হয়েছে, ঠান্ডা হাওয়া বইছে। রাস্তাঘাট নির্জন, সমস্ত বাড়িঘরে দরজা-জানলা বন্ধ— এমন রাত নিশাচরদের পক্ষে আশীর্বাদ স্বরূপ। কাজেই, ওই বুড়োমানুষটি তাঁর অন্ধকার ঘর ছেড়ে, প্রমীলাকে নিয়ে মিউজিয়ামে যায় কাজ হাসিল করতে। দূরে দাঁড়িয়ে থাকে বুড়োমানুষটি আর প্রমীলা নিঃশব্দে ভিজে মাঠের ওপর দিয়ে এগিয়ে যায় মিউজিয়ামের পেছনদিকে। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে গিয়ে স্কাইলাটের পাল্লা খুলে ফেলে একটা পরচাবি দিয়ে। তারপর, স্কাইলাইটের ভেতর দিয়ে গলে জয়েস্টের ওপর বসে, দড়িতে ড্র হিচ ফাঁস লাগিয়ে নেমে যায় নীচে। দড়িটা খুলে নিয়ে, দরজা খুলে পেছন থেকে গলায় ফাঁস লাগিয়ে রামবাহাদুরকে অজ্ঞান করতে যায়, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাতে রামবাহাদুর আতঙ্কে মারা যায়।
‘এবার এগিয়ে আসেন ওই বুড়োমানুষটি। তাঁর হাতে তখন খুব সম্ভবত একটা হুইল ব্যারো বা হাতে ঠেলা গাড়ি যা কনস্ট্রাকশন সাইটে যত্রতত্র পড়ে আছে। সেই হুইল ব্যারোর ওপর মূর্তিটা চাপিয়ে দু-জনে যান কোল বাঙ্কারের কাছে। সেখানে রোপওয়ের বাকেটগুলো ধীরে ধীরে নেমে আসছে নীচে, বাঙ্কারের ওপর কয়লা ফেলে দিচ্ছে, উলটে গিয়ে আবার সোজা হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সেইসময় মূর্তিটা একটা বাকেটের ওপর চড়িয়ে দিয়ে বাকেটটার গায়ে একটা চিহ্ন এঁকে দেওয়া খুব কঠিন ব্যাপার নয়। রোপওয়ে স্বনিয়ন্ত্রিত ব্যাপার, বাঙ্কার জনমানবহীন, কাজেই কারোর দেখে ফেলার সম্ভাবনা একেবারেই নেই।
‘বাকেটটা যখন কুন্তীপুর কোল মাইনসের লোডিং পয়েন্টে গিয়ে পৌঁছোল, তখন সেখানে অপেক্ষা করছে মিস্টার সিনহা ওরফে মিস্টার গুহর কয়েকজন চ্যালা। লোডিং পয়েন্টে আসার বেশ কিছু আগেই বাকেটগুলো লোডিং প্ল্যাটফর্মের লেভেলে নেমে আসে। কাজেই বেলচা আর কয়লা ভরার একটু আগেই দু-তিনজন মিলে ধরাধরি করে মাল নামিয়ে ফেলা হল। আপাতত সেটা ওখানেই আছে সেই চ্যালাদের কোনো একজনের হেপাজতে।’
সমরেশ বলল, ‘সেটা তো এতক্ষণে কলকাতা বা বোম্বাইতেও পাচার হয়ে গিয়ে থাকতে পারে?’
‘অসম্ভব। অত দামি মূর্তি রাজীববাবু নিজে সঙ্গে করে না নিয়ে গিয়ে অন্য কাউকে দিয়ে পাঠাবেন, তা মনে হয় না। বুঝছ না, যেখানে মূর্তিটা চুরি করতে সাধন গুহ স্বয়ং এসেছেন, সেখানে তার মূল্য আর গুরুত্ব কতখানি? সেটা কি তিনি বেশিক্ষণ হাতছাড়া করে রাখতে পারেন? ওঁর হিসেবে শুধু পাহাড়ে প্রচণ্ড বৃষ্টি আর তার ফলস্বরূপ ধারোয়ায় ঢলটা ছিল না, তা নইলে এতক্ষণে…’
জয়ন্ত বলল, ‘তাহলে কুন্তীপুরে এক্ষুনি একটা সার্চ হওয়া দরকার।’
রক্তাভ মুখে দাঁড়িয়ে ছিল রাজীব। কঠিন কণ্ঠে বলল, ‘ব্যাপারটা কিন্তু বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাচ্ছে, মিস্টার চতুর্বেদী। আমি রাজীব সিনহা, আমার বাবার নাম শ্রীশিবকুমার সিনহা, আমরা লছমনপুরার জমিদার। গভর্নমেন্টের তরফ থেকে আমাকে ফাঁসানোর জন্য এই মহিলার সাহায্যে একটা মূর্তি-চুরির বাজে বাহানা তুলে আপনারা আমার গতিবিধি বন্ধ করতে চাইছেন— এর ফল কিন্তু ভালো হবে না। এই মহিলা যে আষাঢ়ে গল্পটি বললেন, সেটা সম্পূর্ণই তাঁর অনুমানভিত্তিক। পুলিশ হিসেবে আপনার জানা উচিত ছিল যে, সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়া কোনো অভিযোগ খাড়া করা যায় না এবং একজন নিরপরাধ নাগরিককে গ্রেপ্তার করা যায় না।’
উদবিগ্ন দৃষ্টিতে জয়ন্ত দময়ন্তীর দিকে তাকাল। দময়ন্তী সহজ গলায় বলল, ‘যে মূর্তির জন্য এতদিন এখানে বসে রইলেন, সেটার চুরি যাওয়াটা কি আপনার কাছে এখন বাজে বাহানা, মিস্টার সিনহা? তবে হ্যাঁ, আপনার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ তো মূর্তি-চুরি নয়, প্রধান অভিযোগ নরহত্যার। ইন্দার সিং ও তাঁর মেয়ে প্রমীলাকে ঠান্ডা মাথায় খুন করেছেন আপনি।’
‘এটাও কি আপনার অনুমান, না কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে?’ ব্যঙ্গকণ্ঠে প্রশ্ন করল রাজীব।
‘সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে, মিস্টার সিনহা। কোনো অপরাধই আপনি স্বহস্তে করেননি, কেবল ইন্দার সিংকে ক্লাউসের গাড়ির নীচে ফেলা ছাড়া। ড্র হিচ ফাঁস লাগিয়েছিলেন, কিন্তু সেটাই আপনাকে ধরিয়ে দিল। প্রমীলা আপনাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করত ঠিকই, কিন্তু চুরি করার উদ্দেশ্যে যে ফাঁস আপনি ওকে শেখাচ্ছিলেন, আমিও সেই ফাঁসের নাম করাতে ওর মনে সন্দেহের ভূতটা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। আমিও তাই চাইছিলুম। সেই ভূতটাই ওকে নিজের বিপদের সংকেত দেয় এবং তার জন্যেই প্রমীলা একটা ডায়েরিতে মূর্তি-চুরির ষড়যন্ত্রের সমস্ত কথা লিখে রেখে গেছে। সেটা আদালতে সব সত্যই প্রকাশ করবে মিস্টার সিনহা। প্রমীলাকে যে আপনি খুন করেছেন, সেটা অবশ্য প্রমাণ করব আমরা।’
বিস্ফারিত রক্তাভ চোখে রাজীব দময়ন্তীর কথা শুনছিল। বিড়বিড় করে বলল, ‘প্রমীলার ডায়েরি? সব লেখা আছে?’ তারপর বাঁ-হাতটা তুলে ডান হাতের চেটোয় সজোরে এক ঘুসি মারল।
ওটা সংকেত। তৎক্ষণাৎ সীতারাম ঝা-রূপী লোকটি হঠাৎ বিদ্যুদবেগে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাতের লাঠি তুলে প্রচণ্ড আঘাত করল অপ্রস্তুত জয়ন্তর ডান হাতে— পিস্তলটা ছিটকে চলে গেল ঘরের এককোণে। জয়ন্ত ‘উঃ’ বলে আর্তনাদ করে উঠে আহত মণিবন্ধটি চেপে ধরে বসে পড়ল মাটিতে। একলাফে ঘরের মধ্যে চলে এল সমরেশ। ঝা-রূপী লোকটি পিস্তলটার দিকে সবে এক পা বাড়িয়েছে, এমন সময়ে সমরেশের ডান হাতের প্রচণ্ড ঘুসি তার চোয়ালে লেগে তাকে ধরাশায়ী করে ফেলল। কড়াৎ করে শব্দ হল একটা, বোধ হয় চোয়ালটা ভেঙে গেল। সমরেশ অবাক হয়ে দেখল, লোকটা মাটিতে পড়ে আর নড়ল না, একদম অজ্ঞান।
ইতিমধ্যে রাজীব প্রকাণ্ড লাফ দিয়ে যন্ত্রণাকাতর জয়ন্তকে টপকে বাইরে চলে গেছে এবং বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকা সান্যাল সাহেবের জিপটায় স্টার্ট দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে বাড়ির কম্পাউন্ডের বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
হতভম্ব মিসেস সান্যালের পেছন থেকে বেরিয়ে এল দময়ন্তী। কম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘সমরেশ, শিগগির চলো; ওকে আমাদের ধরতেই হবে। পালিয়ে যেতে দিলে চলবে না। ওই তেপান্তরের মাঠের মধ্যে গিয়ে পড়লে ওকে আর কোনোদিনও খুঁজে পাওয়া যাবে না।’
সমরেশ জয়ন্তর দিকে তাকাল। বাঁ-হাতে ডান হাতটা চেপে ধরে উঠে দাঁড়িয়ে জয়ন্ত বলল, ‘জরুর। এক্ষুনি চলো।’
.
২১
রঞ্জিতের জিপটা সমরেশের হাতে চলছিল ভালোই। গাঁ গাঁ করতে করতে চড়াই পার হয়ে পাহাড়ের খাঁজটার ওপর পৌঁছোতেই নীচে সান্যাল সাহেবের জিপটাকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ব্রিজের দিকে এগোতে দেখা গেল। ওখান থেকেই দময়ন্তী নীচে রঞ্জিতকে চিনতে পারল। কারণ, প্রথমত ওর পোশাক আর দ্বিতীয়ত গাঢ় লাল রঙের জামা পরা লোপামুদ্রা ব্রিজের একটা পায়ারের পাশে দাঁড়িয়ে ওর সঙ্গে কথা বলছিল।
দাঁতে দাঁত চেপে জিপ চালাচ্ছিল সমরেশ, অ্যাক্সিলারেটর পুরো দাবানো। সামনের গাড়িটার সঙ্গে তখনও ওর দূরত্ব অনেক।
দময়ন্তী দেখল, রঞ্জিত আর লোপামুদ্রা দু-জনেই মুখ তুলে রাজীবের গাড়িটা দেখল, তারপর রঞ্জিত হাত নাড়তে নাড়তে উঠে এল ব্রিজের মাঝখানে। গাড়িটা কিন্তু থামল না। গাড়িটা যে থামবে না, সেটা বোধ হয় রঞ্জিত অনুভব করল একেবারে শেষ মুহূর্তে। ডান দিকে লাফটা দিল ঠিকই, কিন্তু জিপের বাঁ-দিকে গায়ের সঙ্গে আটকানো স্টেপনিটা ওকে আঘাত করল। শূন্যে দু-পাক ঘুরে ও আছড়ে গিয়ে পড়ল ব্রিজের একধারে, তারপর গড়িয়ে বাঁধের নীচে অদৃশ্য হয়ে গেল। খানিকটা জল ছিটকে উঠল ওপরে।
দময়ন্তী চিৎকার করে উঠতে গিয়েও সামলে নিল। লাল জামা পরা হিলহিলে একটা শরীর তিরের মতো ওদের সামনে দিয়ে ছুটে গিয়ে রঞ্জিত যেখানে অদৃশ্য হয়েছিল, সেখান থেকে লাফ দিল নীচে। আবার খানিকটা জল ছিটকে উঠল।
সমরেশ অ্যাক্সিলারেটর থেকে পা তুলে নিল। বলল, ‘রাজীব জাহান্নমে যাক। আমি গাড়ি থামাচ্ছি। রনুকে বাঁচানো অনেক বেশি দরকার। লোপা চ্যাম্পিয়ন সাঁতারু হতে পারে, কিন্তু ও একা সামলাতে পারবে না।’
রাজীবকে আর জাহান্নম পর্যন্ত যেতে হল না। ওর গাড়ি ব্রিজটা পার হওয়ার আগেই রাস্তার অপর প্রান্তে বোল্ডারের আড়ালে একটা যান্ত্রিক গর্জন শোনা গেল। প্রাণপণে ব্রেক কষে রাজীব যখন গাড়িটা দাঁড় করাল, তখন সে নিজেকে মুখোমুখি দেখতে পেল একটা ব্ল্যাক মারিয়ার।
ঠিক সেই মুহূর্তেই সমরেশের জিপ ব্রিজের মুখে এসে দাঁড়াল। সমরেশ একবার ফিরেও তাকাল না অন্যপ্রান্তে যে নাটকের অভিনয় হচ্ছিল, তার দিকে। দুটো বড়ো বড়ো লাফে বাঁধের ওপর উঠে গেল, তারপর দর্শকদের ভিড় ঠেলে ওর বিশাল শরীরটা ঝাঁপিয়ে পড়ল নীচের তরঙ্গায়িত জলের ওপর। ওর কানে জলকল্লোল ভেদ করে একটা সুরেলা কণ্ঠস্বর ভেসে এল ‘সমরেশদা, এইদিকে আসুন শিগগির। আমি আর ধরে রাখতে পারছি না।’
.
২২
একগাদা বন্দুকধারী সেপাইয়ের সঙ্গে ব্ল্যাক মারিয়া থেকে যে হোয়াইট ম্যানটি লাফ দিয়ে নামলেন, তাঁকে চিনতে অসুবিধে হল না দময়ন্তীর। সে ক্লাউস। মাথায় ব্যান্ডেজ, একটা হাত ঝুলছে স্লিং-এ। সায়েব নেমেই রাজীবকে দেখিয়ে সঙ্গের ইনস্পেকটরটিকে বলল, ‘এই সেই লোক। এক্ষুনি একে পাকড়াও করুন।’ বলে এমন একটা অলস দৃষ্টিতে চারদিকে তাকাল যেন কিছুই হয়নি, যেন নিত্যি নিত্যি সে এইভাবেই বদমায়েশদের ধরে দিয়ে থাকে।
জয়ন্ত এগিয়ে গিয়ে ক্লাউসকে বলল, ‘তুমি কোত্থেকে?’
সাহেব যদি ভালো ইংরিজি জানত, তাহলে হয়তো ওর কাহিনিটা সংক্ষিপ্ত হত। তার বদলে প্রচুর অদ্ভুত শব্দ এবং প্রচুরতর অঙ্গভঙ্গি সহকারে সে যা বলল, তার মর্মার্থ হচ্ছে গত রবিবার ও যখন ডিংরিয়া গ্রাম থেকে কিঞ্চিৎ মহুয়া পান করে বাড়ি ফিরছিল, তখন বাঙ্কারগুলোর কাছাকাছি আসতেই দেখতে পায় যে একটা লোক রাস্তার বাঁ-দিক থেকে উঠে বুকে হেঁটে রাস্তার মাঝ বরাবর চলে আসছে। ক্লাউসের মনে হল যে লোকটা মাতাল এবং সে রাস্তার মাঝখানে আসবার আগেই ওর সামনে দিয়ে পার হয়ে যাওয়া যাবে, যেহেতু দূরত্বটা তখন খুবই কম। সেই উদ্দেশ্যে ও ডান দিকে কাটায়। কিন্তু অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে লোকটা এগিয়ে আসে এবং প্রাণপণে ব্রেক কষেও কোনো লাভ হয় না। তবে লোকটার সঙ্গে ধাক্কা লাগা এবং তার ফলে গাড়িটা লাফিয়ে উঠে বাঙ্কারের নীচে গিয়ে উলটে পড়ার আগে দুটো জিনিস চোখে পড়ে তার হেডলাইটের আলোয়। প্রথমত, লোকটাকে দুই কাঁধের নীচে দড়ি বেঁধে টানা হচ্ছে আর দ্বিতীয়ত, সেটা টানছে বাঙ্কারের একটি থামের আড়ালে দাঁড়ানো রাজীব। ছিটকে ওঠা জিপের আলো যদিও এক লহমার জন্যই তার মুখে পড়েছিল, কিন্তু রাজীব ওর এতই পরিচিত যে ভুল হওয়ার কোনো কারণ ছিল না।
গতকাল রাত্রে ও পুরো জ্ঞান ফিরে পায় এবং তক্ষুনি ডাক্তারকে জানায় যে পুলিশ যেন পত্রপাঠ কুন্তীপুর থার্মাল পাওয়ারে যায়। ডাক্তার প্রলাপ ভেবে (বা ভাষা বুঝতে অপারগ হয়ে) পাত্তা দেননি। আজ সকালে উঠে অনেক চেঁচামেচি করে, শেষে কতকগুলো স্টুপিড কাগজে সই করে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সোজা থানায় যায় এবং সেখান থেকে সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে এই আবির্ভাব। ধন্যবাদ জানানোর কোনো দরকার নেই, কারণ এটাই সমস্ত সভ্য মানুষের করণীয় কাজ।
জয়ন্ত দময়ন্তীকে বলল, ‘এখন কিংকর্তব্য?’
দময়ন্তী ব্রিজের রেলিং-এর ওপর ঝুঁকে নীচে স্রোতের সঙ্গে যুধ্যমান দুটি মানুষ আর একটি জ্ঞানহীন শরীরের দিকে ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। ক্লাউসের কথা ওর কানে ঢোকেনি কিছুই। এখন জয়ন্তর কথা শুনে বলল, ‘তুমি এক্ষুনি কুন্তীপুর মাইনসে চলে যাও জয়ন্ত, মূর্তিটা উদ্ধার করো। দেখো, দেখো, সমরেশ দড়িটা ধরে ফেলেছে, ওই তো লোপাও ধরেছে। কিন্তু রঞ্জিতবাবু? এখনও অজ্ঞান, বেঁচে আছেন তো?’
জনতার চিৎকারে দময়ন্তীর বাকি কথাগুলো ডুবে গেল। যারা দড়ি ছুড়ে দিয়েছিল, তারা অকারণে চেঁচাতে চেঁচাতে জল থেকে টেনে তুলল তিনজনকে। তারই মধ্যে একটা হর্ষোৎফুল্ল গলা শোনা গেল ‘চাউধ্রিবাবু জিন্দা হ্যায়।’
.
২৩
কথা হচ্ছিল থার্মাল পাওয়ারের ছোট্ট হাসপাতালের দোতলার বারান্দায় বসে। মি সান্যাল, সমরেশ, দময়ন্তী আর জয়ন্ত একটা আরামকেদারায় শায়িত গলা পর্যন্ত মোটা চাদরে ঢাকা রঞ্জিতকে ঘিরে বসে ছিল। রঞ্জিতের আঘাত খুব গুরুতর নয়, কিন্তু ওকে কাবু করে ফেলেছিল আঘাতজনিত শক। আপাতত ওই শকের ধাক্কা ও কাটিয়ে উঠেছে। মহাসপ্তমীর ঢাক বাজছে দূরে। সবাই উৎফুল্ল মুখে গল্প করছিল।
জয়ন্ত বলছিল, ‘যাক, সব কাজ মোটামুটি মিটল। সূর্যমূর্তি আর রাজীব সিনহাকে সদরে চালান করে দেওয়া গেছে। ও কিন্তু লছমনপুরার কথা যা বলেছিল, সেটা সত্যিই। ও যে সত্যি সত্যি সাধন গুহ, সেটা কোনোদিন প্রমাণ করা যাবে কি না সন্দেহ। অর্থাৎ কুন্তীপুরের অপরাধগুলো ছাড়া অন্য অপরাধগুলোয় ওকে ফাঁসানো যাবে বলে তো মনে হয় না।’
দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘ওর কি ফাঁসি হবে?’
অট্টহাসি করে জয়ন্ত বলল, ‘ফাঁসি? জেল হবে কি না তাই দেখো। হলেও সেটা দিনের না মাসের, সেটাই প্রশ্ন। আরে, ফাঁসি হওয়া কি চাট্টিখানি কথা? কোনো অপরাধেরই তো কোনো প্রত্যক্ষদ্রষ্টা কেউ নেই। ক্লাউসের সাক্ষ্য তো প্রথমেই হাওয়া হয়ে যাবে, কারণ ও তখন ছিল মাতাল, কী দেখেছে না দেখেছে তার কোনো মূল্যই নেই। প্রমীলার ডায়েরিরও বিশেষ কোনো গুরুত্ব নেই। একমাত্র ভরসা, কুন্তীপুর মাইনসে যে বেটাকে মূর্তির সঙ্গে গ্রেপ্তার করেছিলুম, সে নাকি রাজসাক্ষী হতে রাজি হয়েছে। যদি বেটা শেষ পর্যন্ত মত পরিবর্তন না করে, তাহলে হয়তো কিছু হতে পারে। তা নয় তো রঞ্জিতবাবুকে ধাক্কা মারা ছাড়া আর কোনো অপরাধই নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করা ভয়ানক কঠিন হবে। তবে হ্যাঁ, পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা। ওই রাজীবকে আর বেশিদিন করে খেতে হচ্ছে না।’
‘নিন রঞ্জিতদা, দুধটুকু খেয়ে ফেলুন,’ বলে লোপামুদ্রা বারান্দায় এসে ঠক করে গেলাসটা আরামকেদারার হাতলের ওপর রাখল। আজ ও একটা কমলা রঙের সুতির শাড়ি পরেছে, বেশ বড়োসড়ো গিন্নিবান্নি দেখাচ্ছে।
বেজার মুখ করে রঞ্জিত বলল, ‘আমি দুধ খাব না। দুধ খেতে আমার ভালো লাগে না।’
সমরেশ চোখ পাকিয়ে বলল, ‘দেখ রঞ্জিত, লোপা যা বলবে, বিনা বাক্যব্যয়ে শুনে যাবি। ভুলে যাস না, আজ যে তুই বেটা এখানে বসে বসে হাওয়া খাচ্ছিস, সেটা ওরই কৃপায়।’
রঞ্জিত স্নিগ্ধ দৃষ্টি তুলে লোপামুদ্রার দিকে তাকাল। বলল, ‘ওর কথা শুনি বা নাই শুনি, ও জানে, আমার প্রাণের জন্য আমি ওর কাছে ঋণী। তাই না লোপামুদ্রা?’
লোপামুদ্রার মুখটা যেন কেমন একরকম হয়ে গেল। বলল, ‘আমি কিছুই জানিনে, রঞ্জিতদা। কার প্রাণের ঋণ কতখানি, কে বলতে পারে?’
দময়ন্তী মৃদুকণ্ঠে বলল, ‘তোমার হিসেব ঠিক আছে তো, লোপা?’
মাথা নীচু করে লোপা বলল, ‘হ্যাঁ, দময়ন্তীদি, আছে।’
নিশীথ সান্যাল হাঁ করে এই কথোপকথন শুনছিলেন। মুখ থেকে পাইপ নামিয়ে বললেন, ‘কী সাংকেতিক ভাষায় কথা বলছ তোমরা? হেঁয়ালি ছেড়ে একটু স্পষ্ট ভাষায় কথা বলবে?’
রঞ্জিত তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, বউদি, আপনি একেবারে গোড়া থেকে বলুন। কিছু রেখে-ঢেকে বলবেন না। আমরা কেউই সমস্তটা শুনিনি।’
হেসে ফেলল দময়ন্তী। বলল, ‘ভয় নেই আপনার, গোড়া থেকেই বলছি।’
লোপামুদ্রা একটা চেয়ার টেনে বসে বলল, ‘বলুন। গল্পও চলবে, দুধের গেলাসও খালি হবে, ব্যস।’
‘প্রথম দিন আমরা যেদিন এলুম, সেদিনই যে দুর্ঘটনা ঘটল, সেটা যে হত্যাকাণ্ড বলে আমার সন্দেহ হয়েছিল কেন, তা তো আপনাদের আগেই বলেছি। এখন সমস্ত হত্যাকাণ্ডের পেছনে একটা মোটিভ থাকে। এক্ষেত্রে সেটা কী? আমার কেবল সন্দেহ হচ্ছিল যে, কোনো একটা কিছু ঘটতে চলেছে। ইন্দার হয় কোনো অপরাধীদলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা অথবা স্বার্থের বৈপরীত্যের ফলে প্রাণ হারিয়েছেন। ওই দুর্ঘটনার সমস্ত ডিটেলই এই সন্দেহের উদ্রেক করে।
‘এখন এই অপরাধটা কী হতে পারে, সে-বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র কোনো জ্ঞান ছিল না। জায়গাটা আমার অপরিচিত আর এখানকার অধিবাসীদের ভেতর কোনো ঈর্ষা বা দলাদলি আছে কি না তাও আমার জানা ছিল না। শুধু বুঝতে পারছিলুম যে এত বিস্তারিতভাবে মাথা ঘামিয়ে যখন খুন করা হয়েছে, তখন অপরাধটা নিশ্চয়ই খুব বড়ো ধরনের কিছু। এখানে বড়ো ধরনের অপরাধ কী হতে পারে, আমি কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলুম না।
‘এদিকে আর একটা জিনিস আমার মনে খচখচ করছিল— তা হল ড ঝা-র কথাবার্তা। প্রথম দিন উনি যখন আমাদের সামনে এলেন, বলেছিলেন, এখানে কি জংলিদের কোনো কার্নিভ্যাল হচ্ছে নাকি? জংলি কথাটা আমার কানে খট করে বেজেছিল। সেটা সুগভীর ঘৃণার সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছিল। আমি জানতুম, ড সীতারাম ঝা শুধু একজন প্রত্নতাত্ত্বিকই নন, একজন মস্ত বড়ো নৃতাত্ত্বিকও। পিছিয়ে থাকা উপজাতি গোষ্ঠীগুলির প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা না থাকলে কেউ নৃতাত্ত্বিক হিসেবে সফল হতে পারে না। তবে কি আমি ডক্টর ঝা সম্পর্কে খুব ভুল খবর পেয়েছিলুম?
‘দ্বিতীয়ত, ডক্টর ঝা-র ব্যবহারও আমার কাছে অস্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছিল। পণ্ডিত লোকেরা বাজে লোককে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য অভদ্র ব্যবহার করেন, এটা ঠিক। দুনিয়ার সবাইকে নির্বোধ মনে করেন, এটাও ঠিক। কিন্তু কখনো ইতরামো করেন না। ডক্টর ঝা মিউজিয়ামে আমার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছিলেন, সেটা ইতরামোর পর্যায়ে পড়ে।
‘তৃতীয়ত, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্টাল হেড, তাঁর একজন প্রাক্তন ছাত্রকে সঙ্গে নিয়ে বৃদ্ধ-বয়েসে মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, মাটি খুঁড়ছেন, অথচ কারো সাহায্য নিচ্ছেন না, এটাও কেমন যেন অস্বাভাবিক। এ অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয় এখন খোলাই থাকে। তার মধ্যে তিন-চার মাস তিনি এখানে পড়ে থাকেন! গবেষণা করছেন? কী গবেষণা? কী ধরনের গবেষণা?
‘ডক্টর ঝা-র ব্যবহার আমার কাছে অদ্ভুত এবং অপ্রত্যাশিত বলে মনে হলেও, আমি কিন্তু তখনও ইন্দার সিংয়ের মৃত্যুর সঙ্গে ওদের কোনোরকম যোগাযোগের কথা বুঝতে পারিনি।
‘এরপর রাজীব। সে নির্লজ্জ লেডি কিলার। সবাইকে বলে বেড়ায় সে লোপার সঙ্গে একরকম এনগেজড অথচ আমার সামনে এসে ছলাকলা বিস্তার করতে একটুও সংকোচ করে না। এমনকী, এমন একটা অস্বস্তিকর আবহাওয়ায় যেখানে ইন্দারের মৃত্যুর স্মৃতি তখনও দগদগ করছে। কিন্তু যেই সে শুনল যে আমি একজন রহস্যসন্ধানী— তৎক্ষণাৎ তার ব্যবহার একদম পালটে গেল। আপনাদের গেটের সামনে ওর কথাবার্তা রঞ্জিতবাবুর মনে আছে নিশ্চয়ই। এরকম হল কেন? সেটা কি অপরাধবিশেষজ্ঞদের প্রতি স্বাভাবিক অস্বস্তি না অন্য কিছু?
‘এ ছাড়া লোপার কথাবার্তায়, চোখের চাউনিতে, আমি প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলুম যে লোপা আর যার প্রতিই আকৃষ্ট হোক না কেন, সে রাজীব নয়। এটা বুঝতে অবশ্য আমাকে ডিডাকটিভ লজিক খাটাতে হয়নি, আমার নারীসুলভ ইনস্টিঙ্কটই আমায় সেকথা বুঝিয়ে দিয়েছে। কিন্তু রাজীব বলে বেড়াচ্ছে যে লোপার সঙ্গে তার খুব খাতির। কেন? সে বিরাট বড়োলোকের ছেলে, প্রজাপতির মতো সে ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ায়। তার অভিজ্ঞতায় লোপার মনোভাব বোঝা তো কঠিন কিছু নয়, তা সত্ত্বেও সে একথা বলে বেড়াচ্ছে কেন? তা হলে কি সে এই গুজব রটিয়ে তার আড়ালে কিছু লুকোতে চাইছে?
‘এতগুলো প্রশ্নকে আমি কিছুতেই একটা পরিপ্রেক্ষিতে আনতে পারছিলুম না, কারণ তাদের নায়ক-নায়িকাদের উদ্দেশ্য আমি কিছুই জানতুম না। জগতে নানারকম লোক অকারণে নানারকম অদ্ভুত অদ্ভুত আচরণ করে, এই বলে আমি নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলুম। কিন্তু এই আচরণগুলোর পেছনে কী যেন একটা ইঙ্গিত আছে, এই বোধটা আমি কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারছিলুম না।’
‘আচ্ছা, আপনি তো লোপাকেও সন্দেহ করেছিলেন, তাই না?’ রঞ্জিত প্রশ্ন করল।
‘প্রথম দিকে জেরার পর অনিচ্ছাসত্ত্বেও ওকে সাসপেক্টের দলে ধরেছিলুম বটে, কিন্তু ওর ড্রয়িংটা দেখে আমার সমস্ত সন্দেহ ঘুচে যায়। যে মেয়ে ঘণ্টাকয়েক বাদেই একটা হত্যাকাণ্ডের অংশীদার হতে যাচ্ছে, তার হাত থেকে অমন নিশ্চিত রেখায় ছবি বেরোয় না, যদি না সে অত্যন্ত কঠিন অপরাধী হয়। লোপাকে চিনতে আমার একটুও ভুল হয়নি রঞ্জিতবাবু, বরং আপনিই… ইয়ে, কী বলে, ওকে একটু…’ বলতে বলতে দময়ন্তী সন্দেহে লোপামুদ্রার দিকে চেয়ে চোখ টিপল।
আরক্ত মুখে রঞ্জিত বলল, ‘আমি কক্ষনো ওকে সন্দেহ করিনি। আমি ওকে সম্ভাব্য সকল রকমের বিপদ থেকে উদ্ধার করবার জন্য সব ডিটেল জানতে চাইছিলুম— নিজেকে প্রস্তুত রাখা উদ্দেশ্য ছিল আমার।’
সমরেশ বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তোর বুদ্ধির দৌড় আমাদের জানা আছে। তারপর বলো।’
দময়ন্তী আবার শুরু করল ‘ডক্টর ঝা আর রাজীবের গবেষণার বিষয়বস্তুটি কী হতে পারে, সে-বিষয়ে আমি আলো দেখতে পেলুম সূর্যমূর্তিটির পাদলিপিটা পড়ে। সূর্যমূর্তিটি প্রায় অক্ষত, অর্থাৎ কোনো বিধর্মীর হাতে সে পড়েনি। যদি ধরে নেওয়া যায় যে কুন্তীপুরই ছিল মহাসামন্ত বাসুদেবের রাজধানী এবং ভূমিকম্প বা মহামারি যেকোনো কারণেই হোক না কেন, হঠাৎ একদিন এই জায়গাটা পরিত্যক্ত হয়, তাহলে নিশ্চয়ই মার্তণ্ড মন্দিরটি স্বাভাবিকভাবে কালক্রমে ভেঙে পড়ে গেছে এবং তার গর্ভগৃহটি মাটির তলায় চাপা পড়ে গেছে। তাহলে যেখানে সূর্যমূর্তিটি পাওয়া গেছে তার কাছাকাছিই সহস্র সহস্র মণিমুক্তোখচিত রথটি পাওয়া যাবে। তার জন্যেই এই অন্বেষণ— এহেন একটা সন্দেহ আমার মনে দৃঢ়ভাবে চেপে বসে।
‘এরপর আমরা গেলুম প্রমীলার সঙ্গে দেখা করতে। গিয়ে দেখি, প্রমীলার তখন অনেক কাজ। আমাদের সঙ্গে কথা বলার চেয়ে বাপের হিসেবপত্তর দেখার দিকেই তার নজর বেশি। যদি মিস্টার সান্যালের অনুমতিপত্র না দেখাতুম, তাহলে হয়তো ও আমার সঙ্গে কথাই বলত না। কথাও তো প্রথমে বলতেই চায়নি। তখন ঘর থেকে সব্বাইকে বের করে দিয়ে নিভৃতে ওর সঙ্গে কথা বললুম, যাতে ও আমার বক্তব্য মন দিয়ে শোনে। ওর সঙ্গে অনেক কথাই হল। তার মধ্যে প্রথম খটকা লাগল যখন ও বলল যে মৃত্যুর দিন ইন্দার স্বাভাবিকই ছিল। অথচ লোপা বলেছিল যে সে ইন্দারকে অত্যন্ত অস্থির, প্রায় অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় দেখতে পায়। লোপা মিথ্যে বলে থাকতে পারত; কিন্তু যদি ধরে নেওয়া যায় যে ও সত্যি কথাই বলেছিল, তাহলেই ব্যাপারটা স্বাভাবিক হয়। অথচ প্রমীলা জানে যে লোপা তার বাবাকে দেখেছে, তা সত্ত্বেও সে মিথ্যে কথাটা বলল কেন? শুধু লোপা কেন, আরও অনেকেই নিশ্চয়ই ইন্দারকে সেদিন সকালে দেখেছে। প্রমীলা জানে না তারা সাক্ষ্য দিয়েছে কি না। সে-অবস্থায় ওর পক্ষে মিথ্যে কথা বলাটা চূড়ান্ত নির্বুদ্ধিতা নয় কি? ওর বাবা অপ্রকৃতিস্থ ছিলেন, এ তথ্যটুকু জানিয়েও অন্যভাবে সে-ঘটনাটায় রং চড়ানো যেত।
‘এর দ্বিতীয় সম্ভাবনাটা হচ্ছে যে প্রমীলা আদৌ হয়তো মিথ্যে কথা বলেনি। … না, না, রঞ্জিতবাবু, তার মানে এই নয় যে লোপা মিথ্যে কথা বলেছিল। আসলে নিশ্চয়ই ওর মানসিক অবস্থা সকাল থেকে এমন ছিল যে প্রমীলা মোটেই লক্ষই করেনি তার বাবার অপ্রকৃতিস্থতা। দ্বিতীয়ত, লোপার সঙ্গে ছবি আঁকতে গিয়ে প্রমীলার ব্যর্থতাও এইদিকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করে। প্রমীলার তখন মনঃসংযোগ করার ক্ষমতা ছিল না, সে নিজেকে কোনো কিছু একটা ঘটনার জন্যে প্রস্তুত করছিল।
‘কী ঘটনা? তাহলে কি প্রমীলা কোনো দুষ্টচক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে কোনো অপরাধকর্মে লিপ্ত হতে যাচ্ছে এবং তার বাবা ওর কথাবার্তায় বা অন্য কোনোভাবে সেটা জেনে ফেলেই এত আপসেট হয়ে গেছেন? আর এইজন্যেই— এই জেনে ফেলার অপরাধেই কি তাঁর জীবনান্ত হল? ঘটনা পরম্পরায় আমার এই অনুমানই একমাত্র যুক্তিসিদ্ধ বলে মনে হল।
‘এইভাবেই আমি প্রথম প্রমীলাকে সন্দেহ করি। কিন্তু ও কি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত? বাপের মৃত্যুর পর ওর অবস্থা দেখে আমি এটুকু বুঝেছিলুম যে ও এই ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। তা ছাড়া ও পাঞ্জাবি, পিতৃঘাতকের সঙ্গে খেলা করবার মতো কাপুরুষও নয়। অতএব নিশ্চয়ই হত্যাকারীরা তাকে তার পিতৃহত্যার প্ল্যান সম্পর্কে কিছুই জানায়নি এবং সেও ওই হত্যাকারীর এমনই অন্ধভক্ত যে ঘটনাটার স্বাভাবিকত্ব সম্পর্কে যা বোঝানো হয়েছে, তা-ই বেদবাক্য বলে মেনে নিয়েছে। যেরকম দৃঢ়তার সঙ্গে ও বলল যে তার বাবার মৃত্যুটা দুর্ঘটনা, তাতে সেরকম সন্দেহই হয়। কোনো মেয়ের এহেন অন্ধভক্তি তার বাবা ছাড়া আর হয় স্বামী বা প্রেমাস্পদর প্রতি। তবে কি কেউ প্রমীলাকে প্রেমের ফাঁদে আটকে তার কার্যোদ্ধার করতে চায়? প্রমীলা বলেছে, ইন্দার হাজার কাজের চাপে তার বিয়ের কোনো চেষ্টাই করেনি। অতএব এর মধ্যে একটা প্রেমঘটিত ব্যাপার আছে, যদিও প্রেমটা খুব নির্মল নয়।
‘আমি যখন ওকে অত্যন্ত বিস্তারিতভাবে বোঝালুম যে ইন্দারের মৃত্যুটা কেন আমার হত্যাকাণ্ড বলে মনে হয়, কীভাবে তাঁকে রোলারের ওপর ফেলে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং যেকোনোভাবেই হোক দড়িটা পরে খুলে ফেলা হয়েছে, তখন দেখলুম ওর মুখ থেকে পরতে পরতে রক্ত নেমে যাচ্ছে। শুধু যে ওর বাবার মৃত্যুর বীভৎসতাই ওকে বিচলিত করেছিল তা নয়, ওকে তখন নিশ্চয়ই ড্র হিচ ফাঁসটা শেখানো হচ্ছিল এবং সেই কথাটা মনে পড়ে যাওয়াতে ওর মনেও সন্দেহ জেগে ওঠে। ও বুদ্ধিমতী মেয়ে। ওকে যখন বললুম, ওরও বিপদের সম্ভাবনা আছে, তখন আমাকে বলল যে মৃত্যুর পরও ও তাহলে হত্যাকারীদের শাস্তি দেবে। এর একমাত্র অর্থ হয়, ডায়েরিতে ও সব কথা— যা ওর জানা— সব বিস্তারিত লিখে রাখবে যাতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে পুলিশ সেটা খুঁজে পায়। আমার অনুমান ভুল হয়নি, আমরা সেটা খুঁজে পেয়েছি। তবে প্রমীলার সন্দেহ হলেও তখন আর পেছোনোর উপায় নেই। জানলার বাইরে পা বাড়িয়ে ঝাঁপ দেওয়া হয়ে গেছে।
‘আমার সঙ্গে কথাবার্তার ফলে এই সন্দেহ ছাড়াও প্রমীলার মনে কিন্তু আরেকটা ভাবেরও উদয় হয়েছিল। সেটা হচ্ছে, আমার প্রতি একটা প্রচণ্ড রাগ; কারণ ওর প্রথম ভালোবাসার পাত্রের প্রতি আমি ওর মনটা বিষিয়ে দেবার চেষ্টা করছি। আমি কারো নাম করিনি, আমার তো তখন সবে সন্দেহগুলো দানা বাঁধতে শুরু করেছে, করলে আর রক্ষে থাকত না। অবিশ্যি এই রাগের কথাটা আমি বুঝতে পেরেছিলুম পরে। কীভাবে, সেটা পরে বলছি।
‘এখন রাজীব আর ডক্টর ঝা-র সন্দেহজনক ব্যবহারে কোনো একটা অজ্ঞাত অপরাধের অংশীদার হিসেবে প্রমীলা এবং নিহত ইন্দার এদের মধ্যে কোনো যোগসূত্র আমি খুঁজে পাচ্ছিলুম না। সেদিন সকালে জয়ন্ত সাধন গুহর নাম করামাত্র আন্তর্জাতিক চোরাই মাল সরবরাহকারী কথাটা আমায় সেই সূত্রটি জুগিয়ে দিল।
‘ছবিটা আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। আমি বুঝতে পারলুম আমার হারানো যোগসূত্র হচ্ছে সূর্যমূর্তিটা। কেন, বলছি।
‘আজকাল ভারতবর্ষ থেকে যা কিছু চোরাপথে বিদেশের বাজারে চালান যায়, আমাদের প্রাচীন শিল্পকীর্তিগুলি তাদের অন্যতম। অতএব সাধন গুহর লিস্টে যে এই সম্পদগুলি অন্যতম প্রধান স্থান দখল করে আছে, তাতে সংশয় নেই। এইসব মূর্তিচোরদের এজেন্ট ছড়ানো আছে নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগে, মিউজিয়ামে, মন্দির কমিটিতে ইত্যাদি। মিস্টার সান্যাল যে চিঠিখানা লিখেছিলেন, সেটা বিভাগীয় প্রধান ডক্টর ঝা পর্যন্ত পৌঁছোয়ইনি; তার আগেই তাঁর কোনো সহকর্মী বা পিয়োন বা অন্য কেউ সেটা হস্তগত করে। সাধন গুহ সেটা পেয়ে প্রথমে একজন চ্যালাকে ডক্টর ঝা সাজিয়ে পাঠায় এবং তার রিপোর্টের ভিত্তিতে নিজে চ্যালা সেজে এসে বসে।
‘ডক্টর ঝা সম্পর্কে শুনেছি, তিনি তাঁর গবেষণাতেই মগ্ন থাকেন, তাঁর ছাত্ররাই তাঁকে বড়ো একটা দেখতে পায় না। নিজেও অমিশুক এবং খুব গম্ভীর প্রকৃতির লোক। কাজেই এই নির্মীয়মাণ পাওয়ার স্টেশনে, যেখানে তাঁর বর্তমান বা প্রাক্তন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট পুরাতাত্ত্বিক ছাত্রদের থাকার প্রায় কোনো সম্ভাবনাই নেই; এবং অল্পবয়সি আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ছাত্ররা, যারা তাঁকে নিতান্তই কম সময়ের জন্য দেখে, তারা পর্যন্ত বাইরে হোস্টেলে পড়াশোনা করছে, সেখানে তাঁকে চিনতে পারার লোক একেবারেই নেই বলা চলে। তা সত্ত্বেও বলব, তাঁর ছদ্মবেশ নিখুঁত হয়েছিল। আমি ডক্টর ঝা-র ছবি দেখেছিলুম, মুখটা মনে ছিল। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি যে এই ডক্টর ঝা জাল। তা ছাড়া ব্যবহারটিও এমন করে রাখা হয়েছিল, যাতে কেউ বেশি ধারে-কাছে ঘেঁষতেই না পারে।’
‘আচ্ছা, রাজীব প্রথমেই মূর্তিটা চুরি করল না কেন? আর তুমি আসামাত্রই চুরি করাটা দরকার হয়ে পড়ল?’ সান্যাল সাহেব প্রশ্ন করলেন।
‘প্রথমেই চুরি না করার কারণ হচ্ছে যে মূর্তিটার পাদলিপিতে যে সহস্র সহস্র রত্নখচিত রথের কথা লেখা আছে, সেটাকেও তো ছাড়া যায় না। প্রথম দু-মাস বোধ হয় লেগেছে মহাসামন্ত বাসুদেবের সঠিক পরিচয়, তাঁর রাজত্বের লোকেশন আর কুন্তীপুরে তাঁর কোনো এস্টাবলিশমেন্ট ছিল কি না সেটা খুঁজে বের করতে। সাংকেতিক চিহ্নগুলোর অর্থোদ্ধারের চেষ্টাও বোধ হয় একইসঙ্গে এগোচ্ছিল। আমার ধারণা, রাজীবের ইতিহাসবেত্তা বন্ধুরা খুঁজে পেতে এখানেই বাসুদেবের একটা ঠিকানা ছিল বলে জানিয়েছিল। কিন্তু সাংকেতিক চিহ্নগুলোর অর্থোদ্ধার করা যায়নি, তাই নানাভাবে মার্তণ্ড মন্দিরের স্থানটা খুঁজে বের করবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল দু-জনে। অনেক লোক নেওয়া যাচ্ছিল না, কারণ সত্যিই যদি গুপ্তধন আবিষ্কৃত হয়, তাহলে সেটা জানাজানি হয়ে যাবে; আর বাইরে থেকে বেশি লোক আনলে সবার সন্দেহ হবে। এসব ব্যাপারে মন্ত্রগুপ্তি অত্যন্ত জরুরি। তাই গোপনে এবং ধীরে ধীরে কাজ এগোচ্ছিল।
‘একইসঙ্গে মূর্তিটা চুরি করার প্ল্যানও চলছিল। প্রশ্ন হতে পারে, ওরা তো ”বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে চললুম” বলে মূর্তিটা গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে চলে যেতে পারত। কিন্তু তাতে একটা অসুবিধে ছিল। মিস্টার সান্যাল ওটা এমনি ছাড়তেন না, ভালো করে প্যাক করে একটা বিরাট বাক্স বানিয়ে পাঠাতেন। সেটা রাজীবের ফিয়াটে আঁটত না, বড়ো ভ্যানের দরকার হত। এবং অত্যুৎসাহী মিস্টার সান্যাল তাঁর প্রাণের চেয়ে প্রিয় মূর্তিটাকে হয় নিজে সঙ্গে করে নয়তো নিজের পাইকবরকন্দাজ সঙ্গে দিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসতেন। তাই না, মিস্টার সান্যাল?’
স্মিতমুখে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লেন সান্যাল। বললেন, ‘ঠিক, আমি প্রথমেই ওদের বলে দিয়েছিলুম যে আমি স্বহস্তে ওটা পাটনায় পৌঁছে দিয়ে আসব। ওরা গাঁইগুঁই করে বিনয় প্রকাশ করেছিল, কিন্তু বেশি চাপ দেয়নি।’
‘চাপ বেশি না দেওয়ার কারণ হল ওদের অপরাধী মনের দুর্বলতা। যাক সেকথা, এখন দেখা যাচ্ছে যে মূর্তিটা চুরি করতে হলে তিরিশ ফুট দড়ি বেয়ে নেমে একটা দরজা খোলা দরকার। একটা সাঁওতালকে ধরে কাজটা হয়তো করানো যেত, কিন্তু তাতে গোপনীয়তা বজায় নাও থাকতে পারত। বাইরে থেকে অ্যাথলিট ধরে আনার ব্যাপারটায় রাজীব সাহস পেল না, কারণ একটা আকাটকে ইতিহাসে পণ্ডিত সাজিয়ে সামনে রাখতেই যথেষ্ট মেহনত, তার ওপর আরেকটা না বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই রাজীব অ্যাথলিট প্রমীলার সঙ্গে প্রেম শুরু করে দিল। প্রমীলার বয়স হয়েছিল, কিন্তু ওর বিয়ের কোনো চেষ্টাই করছিলেন না ওর বাবা, আর ওর মুখশ্রীও এমন ছিল না যে কেউ এগিয়ে এসে প্রেম নিবেদন করবে। কাজেই ওর শুষ্ক হৃদয় রাজীব অতি সহজেই জয় করে নিল। আর সেইসঙ্গে সর্বপ্রকারে এই চেষ্টাই করতে লাগল যাতে সকলের ধারণা হয় যে রাজীব আসলে লোপার প্রতিই আকৃষ্ট, প্রমীলার সঙ্গে ওর কোনো সংশ্রবই নেই। গুজবটা রটনা করার মূল উদ্দেশ্য এটাই। তবে ওর অভিনয় একদম স্বাভাবিকই হয়েছিল বলা চলে, কারণ আমার ধারণা ও বোধ হয় সত্যিই লোপার…’
রঞ্জিত বাধা দিয়ে বলল, ‘থাক বউদি, ওই স্কাউন্ড্রেলটার এ ব্যাপার নিয়ে আর বেশি নাড়াচাড়া করবেন না।’
সহাস্যে দময়ন্তী বলল, ‘বেশ কথা, তা না হয় না-ই করলুম। যা হোক, প্রমীলার সঙ্গে ভালোবাসার খেলায় রাজীবের আরও একটা উদ্দেশ্য সিদ্ধ হল। তিরিশ ফুট উঁচু থেকে ড্র হিচ ফাঁস লাগিয়ে নীচে নামতে অন্তত পঁয়ষট্টি কি সত্তর ফুট দড়ি লাগার কথা। সে-দড়ি খুব শক্ত হতে হবে, কিন্তু মোটা বা ভারী হলে চলবে না। ইন্দার সিং সিভিল কনট্রাক্টর, তার স্টকে নানারকম দড়ি আছে। বিরাট লম্বা অথচ সরু ম্যানিলা রোপের তার অভাব নেই। আমার ধারণা, রাজীব এবং প্রমীলা যখন ওই দড়ির স্টক ঘাঁটতে ঘাঁটতে নিজেদের প্ল্যান আলোচনা করছিল, তখন অপ্রত্যাশিতভাবে সেখানে উপস্থিত হন মিস্টার সিং। অন্তরাল থেকে সব শুনে তো তাঁর চক্ষুস্থির। তৎক্ষণাৎ রাজীবকে বিদায় করে দিয়ে তিনি নিশ্চয়ই প্রমীলাকে ভয়ানক বকাবকি করেছিলেন এবং তাঁর মেয়ে চুরি করতে যাচ্ছে, এই সম্ভাবনায় অত্যন্ত আপসেট হয়ে পড়েছিলেন। সেই ঝগড়াঝাঁটির ফলে প্রমীলাও খুবই বিচলিত হয়ে পড়ে। তার ওপর অ্যাডভেঞ্চারের উত্তেজনা। সব মিলিয়ে ওর মানসিক অবস্থা এমন হয়ে পড়েছিল যে, পরদিন তার বাবার ব্যবহারের অস্বাভাবিকতাটুকু ওর চোখেই পড়েনি। রাজীব কিন্তু চুপ করে বসে ছিল না। ইন্দার আর কিছু করবার আগেই সে আঘাত হানল। আমরা সেইদিনই এসে পৌঁছোলুম।
‘রাজীব দেখল, এখন সমূহ বিপদ। আমি শুধু রহস্যসন্ধানীই নই, ইতিহাস সম্পর্কেও খোঁজখবর রাখি। মূর্তিটার পাদলিপির যখন পাঠোদ্ধার শুরু করলুম, ওরা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে গেল। ইন্দারের মৃত্যুটা যে হত্যাকাণ্ড সেটা আমি বুঝে ফেলেছিলুম বলে ওরা এমনিতেই ভয় পেয়েছিল, তার ওপর পাঠোদ্ধারটা যদি করে ফেলতে পারি তাহলে ওদের যে কীসের গবেষণা হয়তো সেটাও ধরে ফেলব এরকম সন্দেহ ওদের হল। এদিকে প্রমীলা এসে গেছে। অতএব স্থির হল সেই রাত্রেই চুরি করতে হবে। রাত্রিবেলা টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হল। আদর্শ সময়ে মঞ্চে নাটকের শেষদৃশ্যের অভিনয় শুরু হল।
‘সেই রাত্রে আমার ওপর যে আক্রমণ হয় তাতে আমি নিশ্চিত হলুম যে, যে অপরাধকাণ্ডটি ঘটতে যাচ্ছে বলে সন্দেহ করছিলুম, সেটা ঘটে গেছে। বন্দুক হাতে প্রমীলা এসেছিল আমাকে মারতে। কর্তব্য সম্পন্ন হয়েছে, এখন ও যাবে ওর প্রেমিকের সঙ্গে রঙিন ভবিষ্যতের পথে, যে প্রেমিক ওই মূর্তি বিক্রি করে লক্ষপতি হয়ে ওর জন্যে বানাবে ভালোবাসার প্রাসাদ। তার আগে যে তার ভালোবাসার দেবতাটির প্রতি ওর মনে কুৎসিত বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে, তাকে খতম না করে গেলে তার পাঞ্জাবি ধমনীর রক্ত ঠান্ডা হবে কেন? আমার ধারণা, নাটকের এই অংশটুকু ইমপ্রম্পটু, রাজীব এর রচয়িতা নয়।
‘এরপর প্রমীলা সোজা গেল রাজীবের কাছে। পরদিন ভোরেই রাজীবের চলে যাওয়ার ব্যবস্থা সব পাকা। প্রমীলাও হিসেবপত্র সব বুঝে নিয়েছে। এখন গিয়ে বলল, এখন আমারে লহ করুণা করে। রাজীব রাজি হল না। বলল, মূর্তিটা বিক্রি করে লক্ষ টাকা পেয়ে ঘর সাজিয়ে তারপর ওকে নিয়ে যাবে। এইবার প্রমীলার মনে যে সন্দেহ আমি ঢুকিয়ে দিয়েছিলুম তার দংশন শুরু হল। ও চাপ দিতে লাগল, বোধ হয় ভয়ও দেখাল। তখন নির্বিকার চিত্তে রাজীব অথবা তার শাগরেদ ওকে খুন করে ফেলে দিয়ে এল পুকুরে।
‘কিন্তু ওদের যাওয়া হল না। ততক্ষণে ওরা জেনে গেছে যে ব্রিজ বন্ধ। এরপর কী হল তা আমরা সকলেই জানি।’
সমরেশ বলল, ‘ক্লাউসের কৃতিত্বও কিন্তু কম নয়। ষাঁড়ের ডালনা খাওয়া অমন চেহারা না হলে কেউ অজ্ঞান অবস্থা থেকে জ্ঞান ফিরে পেয়েই হইহই করে আসতে পারে? তুই ঠিকই বলেছিলি, বেটা নির্ঘাত নাতসি।’
জয়ন্ত বলল, ‘আর রাজীব আমায় কী বলেছে, জানেন না? বলেছে, বুদ্ধির খেলায় এর আগেও আমি হেরেছি, কিন্তু এবারের মতো এত আনন্দ আর কখনো হেরে গিয়ে পাইনি। লোকটা কিন্তু সত্যিই গ্যালান্ট।
‘তবে আমি বলব, যদি কেউ সবচেয়ে বেশি অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য হয় তো সে লোপামুদ্রা। ওইটুকু মেয়ের মধ্যে যে এরকম দুর্দান্ত সাহস লুকিয়ে থাকেত পারে, আমি তা কল্পনাও করিনি।’
এমন সময় নীচে রাস্তা দিয়ে মিসেস সরমা সান্যালকে এইদিকেই আসতে দেখা গেল। দময়ন্তী বোধ হয় ওঁর সম্বন্ধে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ রঞ্জিতের দিকে চোখ পড়াতে থেমে গেল। স্পষ্টতই রঞ্জিত অত্যন্ত চঞ্চল হয়ে পড়েছিল, কান দুটো টকটক করছে লাল, ফ্যাকাশে মুখে ঠোঁট দুটো কাঁপছে থরথর করে। দময়ন্তী খুব ভালোমানুষের মতো মুখ করে বলল, ‘রঞ্জিতবাবু, আপনি কি কিছু বলবেন? বলুন না।’
রঞ্জিত আরক্ত চোখ তুলে মি সান্যালের দিকে তাকাল। এক বুক নিশ্বাস টেনে ভরাট গলায় বলল, ‘মিস্টার সান্যাল, আমি লোপামুদ্রাকে বিয়ে করতে চাই।’
মি সান্যাল অবনত মস্তকে কী যেন চিন্তা করছিলেন, হঠাৎ এহেন একটি প্রস্তাবের আঘাতে চমকে মুখ তুলে তাকালেন। অবাক হয়ে রঞ্জিতের মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে চোখ থেকে চশমাটা খুলে ফেললেন। তারপর হিমশীতল কণ্ঠে বললেন, ‘তুমি লোপাকে বিয়ে করতে চাও? সে কী! এ হতে পারে না তোমাকে আমি বুদ্ধিমান ভালো ছেলে বলে জানতুম, আর তুমি কিনা আমার সেই ধারণাটা ভেঙে দিলে?’
সান্যালের কথায় সমস্ত শ্রোতাদের ওপর একটা কঠিন নীরবতা নেমে এল। লোপা নিঃশব্দে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেল। স্তম্ভিত সমরেশ একটা লড়াই করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে কী যেন বলতে গেল, কিন্তু তার আগেই মি সান্যাল আবার বললেন, ‘ছিঃ রঞ্জিত। তুমি কী দেখলে লোপার মধ্যে? ওর চেহারাটাই ভালো, আসলে ও একদম গবেট, বুদ্ধিশুদ্ধি কিছু নেই। এটা তুমি এতদিনেও বুঝতে পারোনি? ও তো তোমাকে সারাজীবন জ্বালিয়ে খাবে।’
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সবাই হেসে উঠল, জয়ন্ত আর সমরেশ তো সশব্দে। গম্ভীর কণ্ঠে সান্যাল বলে চললেন, ‘রঞ্জিত, আজ আমার কী আনন্দের দিন, তোমাকে কী করে বোঝাব! তোমার বাবাকে আমি চিনতুম, প্রেসিডেন্সি কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় তাঁর সঙ্গে আলাপ। আমার চেয়ে দু-বছরের সিনিয়র ছিলেন তিনি। কী ঋজু, আদর্শবাদী অথচ মধুর ব্যক্তিত্ব ছিল তাঁর। তাঁকে আমরা যেমন শ্রদ্ধা করতুম, তেমনি ভালোবাসতুম। তোমার মধ্যে আমি সেই দৃঢ়তার চিহ্ন দেখতে পেয়েছি। আমি জানি তুমি কত কষ্ট করেছ, কত দুঃখ পেয়েছ, কিন্তু ভেঙে পড়নি কোনোদিন। তোমাকে আমার আত্মীয় বা সন্তানরূপে পাওয়া আমার অনেক দিনের বাসনা ছিল, রঞ্জিত। আজ আমার আনন্দ আরও শতগুণ বাড়ত, যদি আজ তোমার বাবার পাশে তোমাদের দাঁড় করাতে পারতুম, আমার মেয়েকে তাঁর আশীর্বাদ পাওয়াতে পারতুম।’
চুপ করলেন মি সান্যাল। সবাই নতমুখে তাঁর শেষ কথাগুলো শুনছিল, তারা নীরব হয়েই রইল।
সেই নীরবতা ভঙ্গ করে ঝড়ের মতো এসে ঢুকলেন সরমা, পেছনে হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে এসেছেন রোরুদ্যমানা লোপামুদ্রাকে। নতমস্তকে সকলের দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, ‘রঞ্জিত, উনি নাকি বলেছেন যে, তোমার সঙ্গে লোপার বিয়ে দেবেন না? ওঁর কথা গ্রাহ্যি কোরো না, বাবা। বুড়ো হয়েছেন তো, ভীমরতি ধরেছে। ওঁর কি একার মেয়ে নাকি? উনি যদি না দেন তো আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দেব।’
সবাই হো হো করে হেসে উঠল। জয়ন্ত বলল, ‘আপনার কোনো চিন্তা নেই, মিসেস সান্যাল। আমরাও সবাই আপনার পাশে দাঁড়িয়ে থাকব।’
সমরেশ বলল, ‘যাক, আপাতত এই নাটকের এইখানেই সমাপ্তি। ঘটনা অনেকই ঘটল, শুধু দুটো জিনিস দেখলুম যা কোনোদিন দেখব ভাবিনি।’
হাসতে হাসতে রঞ্জিত জিজ্ঞেস করল, ‘কোন দুটো জিনিস?’
সমরেশ বলল, ‘একটা লোপামুদ্রার চোখে জল, আর একটা তোর মুখে বোকা বোকা হাসি।’