সুহা, আই লভ ইউ
আট-ন’ বছরের বাচ্চাটার পিঠে বেত পড়ছে সপাসপ। ছেলেটা থরথর করে কাঁপছে। প্রার্থনার ভঙ্গীতে তার দুই হাত নিবদ্ধ। মুখে টু শব্দটি নেই। ফরসা মুখটা হয়ে উঠেছে টকটকে লাল। অত মার খেয়ে হাঁফ ধরছে। হাঁফিয়ে উঠেছেন ছেলেটির বাবাও। তাঁর হাতেই বেত যে!
মারতে মারতে বাবা বলছেন, ‘বল, আর যাবি ওখানে?’
প্রথম বারে ছেলেটা কোনো উত্তরই দিল না। আবার ধেয়ে এল প্রশ্ন, সঙ্গে বেতের ঘা-ও। এবার মাথা নীচু করে ছেলেটি বলল, ‘আমি ওখানে গেলে কার, কী ক্ষতি হবে?’
‘ক্ষতি নয়, হারাম হবে… হারাম! আমরা মুসলিম। ওরা জিউস। শত শত বছর ধরে ওদের সঙ্গে আমাদের লড়াই চলছে। ইজ্জতের লড়াই, ইমানের লড়াই। আর তুই কিনা ওদের উপাসনার সময়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকছিস? এই শিক্ষা হচ্ছে তোর? দোজখেও জায়গা হবে না! ইয়াল্লাহ!’
‘আমি তো ওদের সঙ্গে ইবাদত করতে যাই না, ওদের মন পড়তে যাই।’
‘মন পড়তে যাস? কী হবে শুনি মন পড়ে?’
‘কারো সঙ্গে তর্ক করতে গেলে আগে তার যুক্তি বুঝতে হয়। সেটাই করছি।’
পরের আঘাত করার আগে বাবা ভাবলেন, ছেলেটা কি সত্যিই এই কথাগুলো বুঝে বলছে? নাকি ও পাগল? ওকে মারা কি ঠিক হবে? তাই আরেকবার সুযোগ দিলেন ছেলেকে— ‘কথা দে, আর জিউসদের আড্ডায় যাবি না।’
‘আমি তো যাবই!’
এরপরে বেতের ঘায়ে চামড়া ফেটে গিয়েছিল ছেলেটার। রক্তাক্ত দেহের ভেতরে তার থেকেও বেশি ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল ছেলেটার মন। বাবার প্রতি জন্ম নিয়েছিল অকল্পনীয় ঘৃণা। সেই ঘৃণা শেষ হয়নি পরবর্তীকালে পিতার মৃত্যুতেও।
আর সেদিনের সেই ছোট্ট ছেলেটা? তার কী হল?
সে বড় হতে হতে ‘শের’ হয়ে গেল। মরুসিংহ!
মোহাম্মেদ আবদেল রহমান আবদেল রাউফ আরাফাত অল-কুদওয়া অল- হুস্পেইনি, ওই মরু সিংহের নাম। কারো চোখে তিনি নায়ক; কেউ বলে, তিনি খলনায়ক। ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মের প্রথম দিন থেকেই তার ঘোর বিরোধী এই ব্যক্তিত্ব দশকের পর দশক জুড়ে পিএলও-এর মাথা হয়ে ইসরায়েলের জননায়কদের বুকে কাঁপন ধরিয়েছেন। ইয়াসের আরাফাত-হ্যাঁ, এই নামেই সারা বিশ্ব তাঁকে চেনে।
কিন্তু এত বড় একটা নাম থাকতে পিএলও চেয়ারম্যান কীভাবে ‘ইয়াসের আরাফাত’ হয়ে গেলেন?
মধ্যপ্রাচ্যের অবাক করা অপার ভাণ্ডারের মতোই অবাক করে দেওয়ার মতো সেখানকার রীতিনীতিও। তেমনই একটি উদাহরণ হল ইয়াসের আরাফাতের পিতৃপ্রদত্ত এই নাম। নামের ছত্রে ছত্রে যুক্ত রয়েছে তাঁর বংশ, গোত্র, স্থান— সবকিছুর ইতিহাস। ‘মোহাম্মেদ আবদেল রহমান’ই হল ইয়াসের আরাফাতের আসল নাম। ইংরাজিতে যাকে বলে, ফার্স্ট নেম। স্বীয় জাতির রীতি মেনে পিতার নাম ‘আবদেল রাউফ’ যুক্ত হয়েছিল। আর তার ঠিক পরেই বসা ‘আরাফাত’ ছিল ইয়াসের আরাফাতের পিতামহের নাম। জনজাতির পরিচয় মিলত ‘অল-কুদওয়া’ থেকে, ঠিক যেমন গোত্রের পরিচয়ের জন্য ছিল ‘অল- হুস্পেইনি’। আরাফাতের জন্ম হয়েছিল মিশরের কায়রো শহরে। আর সেখানকার রীতি ছিল নামের প্রথমে ‘মোহাম্মেদ’ থাকলে সেটাকে বাদ দিয়ে দেওয়া। ‘মোহাম্মেদ’ বাদ দিয়েই ক্ষান্ত হননি আরাফাত। বাবার দেওয়া পুরো নামটাকে ঘাড় থেকে নামিয়ে দিলেন। ছিন্ন করে ফেললেন নিজের পিতার নামটাকেও।
আরাফাত ছাত্রজীবন থেকেই কট্টর ইসলামিক পন্থার দিকে ঝুঁকেছিলেন। প্রথমে মুসলিম ব্রাদারহুড জয়েন করেন। ইসলামকে কট্টর তথা তাঁদের শুদ্ধতম রূপে বিশ্বজনীন করে তোলাই হয়ে উঠেছিল আরাফাতের একমাত্র লক্ষ্য। নিজেকে হজরত মহম্মদের অনুসারী রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছিলেন তিনি এবং সেইমতো পদক্ষেপও নিলেন। হজরত মহম্মদের এক অন্যতম সঙ্গী অম্মার ইবন ইয়াসিরের নামের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে নিজের নাম রাখলেন ‘ইয়াসের’। গোত্র এবং জনজাতির পরিচয় বাহক অংশ বাদ পড়লেও বাদ গেল না ‘আরাফাত’। ইসলামে মক্কার আরাফাত উপত্যকার গুরুত্ব অপরিসীম। পয়গম্বর মহম্মদ অন্তিম বিদায়ের আগে এখানেই নিজের বাণী ঘোষণা করেছিলেন।
‘আরাফাতের পিএলও গঠন’ কিংবা ‘ফাতাহ্ নামক সংগঠনের জনক হিসাবে আরাফাত’ এই জাতীয় বিষয় নিয়ে লিখতে বসলে পাতার পর পাতা ব্যয় করতে হবে। ইসরায়েলকে একটার পর একটা ধাক্কা দিয়ে গেছেন আরাফাত। আজকের শিব খেরা বা সন্দীপ মাহেশ্বরীকে দেখলে অসামান্য মোটিভেশনাল স্পিকার মনে করা হয়। ইয়াসের আরাফাতকে শুনলে মনে হবে এঁরা ওঁর কাছে শিশু। হাজার হাজার যুবককে কট্টরপন্থী ইসলামের জন্য উদ্বুদ্ধ করে প্রাণ দিতে ও নিতে রাজি করিয়ে ফেলা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়! জুডাইজমে আস্থাবান ইসরায়েল, জায়নিস্ট রাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রচণ্ডতম শত্রুর নাম ছিল ইয়াসের আরাফাত।
টানা চার দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে একক ব্যক্তিত্ব হিসাবে আরাফাত যেভাবে খবরে থেকেছেন তা সম্ভবত এর আগে কখনো হয়নি এবং এরপরেও কখনো হবে না। ইসরায়েলের বিরোধ হোক বা শান্তিচুক্তির কথা কিংবা সেই শান্তিচুক্তির প্রক্রিয়াকে ভঙ্গ করে ‘সেকেন্ড ইন্তিফাদা’, নাম একটাই- আরাফাত… আরাফাত!
ইসরায়েলের মাথাব্যথার এই অন্যতম কারণের উদ্দেশ্যে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী আরিয়েল শ্যারন একবার বলেছিলেন, ‘মাই রেসপন্স, মাই রিয়েকশন উইল বি টোটালি ডিফারেন্ট।’
এই কথা শুনে ইয়াসের আরাফাতের উপদেষ্টা বলেছিলেন, ‘আপনি কি হুমকি দিচ্ছেন?’
‘আমি কাউকে হুমকি দিই না। আপনারা আমার নীতি তো জানেনই, যেই ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে, আমি তাকে শায়েস্তা করে দেব। পথের সেই কাঁটাটাকে সরিয়ে দেব!’
কিন্তু সহজ হয়নি আরাফাত নামের এই কাঁটাকে উপড়ে ফেলা। যখনই কোনো পিস প্রসেস এগিয়েছে, তখনই বাধার কারণ হয়েছেন ইয়াসের। দিনের পর দিন ইসরায়েল কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অপেক্ষা করে থেকেছে যে, কবে ইয়াসের আরাফাত তাদের পথ থেকে সরে দাঁড়াবে। কবে বন্ধ হবে তাঁর খেলা। ২০০৩ সালে আরাফাতকে মসনদচ্যুত করার চেষ্টাও হয়। কিন্তু কেউ তা করে দেখাতে পারেনি। ‘তোমার চেষ্টা, আমার জয়’ সুলভ ভঙ্গীতে ক্ষমতা হাতে রেখেছেন আরাফাত।
বিশ্ব রাজনীতির চালও বড় অদ্ভুত। আমেরিকার মতো বিগ ব্রাদার সেখানে বড় ভূমিকা নেয়। কখনো টমকাকার দেশের মানুষেরা বলেন, আমরা সন্ত্রাসবাদ সহ্য করব না। আবার কখনো তাঁদেরই উবাচ, ইসরায়েল যেন আরাফাতের কোনো ক্ষতি না করে।
হ্যাঁ, এমনই কথা বলিয়ে নেওয়া হয়েছিল আরিয়েল শ্যারনকে দিয়ে। কিন্তু তাঁর মুখের কথাই কি মনের কথা ছিল?
আরাফাতের উত্থান প্রায় সকলের জানা। ইতিহাস বলছে, আরাফাতের বিরুদ্ধে লড়াই চলেছে বটে, কিন্তু তাঁর পতন ঘটানো যায়নি। ইসরায়েলের মতো সর্বোচ্চ শক্তিসম্পন্ন প্রতিপক্ষও আরাফাতের টিকিটি ছুঁতে পারেনি বলেই দাবি করে প্যালেস্টাইন। কিন্তু সত্যিই কি তাই? কীভাবে মৃত্যু হয়েছিল প্যালেস্টাইনের মরুসিংহের?
১২ অক্টোবর, ২০০৪। নিজের বাসগৃহে ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়েন আরাফাত। খাওয়ার চার ঘণ্টার মধ্যেই গা গুলোনো, বমি, তলপেটে যন্ত্রণা আরম্ভ হয়ে যায়। ভয়ানক দুর্বল বোধ করছিলেন আরাফাত। মূর্ছাও যান। কিন্তু জ্বর আসেনি। প্যালেস্টাইনের এই নেতার চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা ওমর ডাকা সঙ্গে সঙ্গেই ওষুধ দেন। কিছু দিন আগেই ‘ফ্লু’তে আক্রান্ত হয়েছিলেন আরাফাত, তাই ওমর ভেবে নিয়েছিলেন হয়তো জ্বর রিল্যান্স করেছে।
আরাফাত যে শ্রেণীর নেতা, তাঁদের ক্ষেত্রে রোগ কিংবা অন্য যে কোনো ধরনের আক্রমণে শরীর ক্ষতিগ্রস্থ হলেও ইমেজ নষ্ট হওয়ার ভয়ে সেই খবর স্বীকার করা হয় না। তাই কেউ মানতে রাজি হচ্ছিল না যে, আরাফাত ভয়ানক রকমে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। দিন ছয়েক এভাবেই কাটল। ১৭ অক্টোবর মিশর থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের একটি দল এল চিকিৎসার জন্য। কিন্তু তাঁরাও রোগের উৎস নিরূপণ করতে পারলেন না। ডাক্তাররা বললেন, গ্যাসএন্ট্রাইটিস। অথচ ওষুধে কাজ হচ্ছিল না। দিন তিনেকের মধ্যে হু হু করে নামতে লাগল অনুচক্রিকার সংখ্যা। দেহের আভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা বেড়ে চলল। অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে নানা রকমের পরীক্ষামূলক চিকিৎসা চলছিল। চলল স্টেরয়েড। কিন্তু কোনো লাভ হল না।
আরাফাত অসুস্থ জেনে ফোনের পর ফোন করে চলেছিলেন তাঁর স্ত্রী সুহা আরাফাত। সাড়া মিলছিল না। অসুস্থ ইয়াসেরের সঙ্গে কিছুতেই যোগাযোগ করতে পারছিলেন না সুহা। বলা হচ্ছিল সামান্য জ্বরই হয়েছে। শেষে অবশ্য কথা হল। কিন্তু সেই বার্তালাপের পর বিস্মিতই হয়েছিলেন সুহা। আরাফাত দম্পতি খুব ভালো করেই জানতেন যে, শত্রুপক্ষ সবসময়ে তাঁদের ওপরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বজায় রেখেছে। প্রতিটা ফোনকল ট্যাপ করছে বিপক্ষ। তাই ফোনে কথা বলার সময়ে অত্যন্ত কেজো তথা নীরস কথাই চলত দুজনের মধ্যে। ফর্মাল সুর ছেড়ে ওইদিনে অসুস্থ আরাফাত হঠাৎ করেই বলেছিলেন, ‘সুহা, আই লভ ইউ!’ চমকে উঠেছিলেন পত্নী সুহা। জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আজকে হঠাৎ এভাবে কথা বলছ কেন?’ ইয়াসের সেদিন আবার বলেছিলেন, ‘আই লভ ইউ! আই লভ জাহওয়া!’ জাহওয়া হল আরাফাত দম্পতির একমাত্র কন্যার নাম।
আরাফাতকে দেওয়া কোনো ওষুধেই কাজ হচ্ছিল না। টিউনিশিয়া থেকে এক দল ডাক্তারকে আনা হল। ভয়ানক বমি এবং ডায়েরিয়ার প্রকোপে ইয়াসের তখন নাস্তানাবুদ। ভাবার মতো কথা যে, একজন ৭৫ বছর বয়স্ক মানুষের পক্ষে আর কতখানি কষ্ট সহ্য করা সম্ভব। মিশরের চিকিৎসকেরা স্টমাক লাইনিং-এ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বোঝার জন্য এন্ডোস্কপি করার কথা জানালে প্যালেস্টাইনের পক্ষ থেকে ‘না’ করে দেওয়া হল। বলা হল আগেই এন্ডোস্কপি করা হয়েছে।
২৮ অক্টোবর জর্ডন থেকে এল এক দল চিকিৎসক। কিন্তু হাল শোধরালো না দেখে পশ্চিমের কোনো দেশে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো হবে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হল। ফ্রান্সে নিয়ে যাওয়ার কথা ঠিক হল সর্বসম্মতিক্রমে।
আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে দুটো চপার আরাফাতকে নিয়ে যেতে। সম্ভবত এই প্রথম আরাফাতকে মারার জন্য নয়, তাঁর জীবন রক্ষার জন্য কপ্টার আসছিল। দুর্বল আরাফাতকে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হল। মাথায় চিরপরিচিত সেই ফিশনেট কাফিয়াটা ডান কাঁধ দিয়ে ত্রিভুজের মতো ঝুলছিল না। তার বদলে মাথায় শোভা পাচ্ছিল একটা রাশিয়ান ফারের টুপি। ক্ষীণ দেহ। মুখের বলিরেখা বৃদ্ধি পেয়েছিল। গালের পাকা, খোঁচা খোঁচা দাড়ির ফাঁকে চামড়ায় লাল, হলুদ ছোপ জানান দিচ্ছিল মানুষটা ভয়ানক অসুস্থ। জনতার ভিড়ে ভর করে এলেন মরুসিংহ। চপারে ওঠার সময় সমানে হাত নেড়ে নিজের সমর্থকদের উদ্দেশে ছুড়ে দিলেন চুম্বন। মুখে স্মিত হাসি— আমি ফিরে আসব, তোমরা আমার জন্য অপেক্ষা ক’রো।
ফ্রান্সের পার্সি মিলিটারি হসপিটালের হেমাটোলজি ওয়ার্ডে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করা হল আরাফাতকে। প্লাজমা, ব্লাড ক্লটিং এজেন্ট দেওয়া আরম্ভ হল। চিকিৎসায় সাড়া দিতে শুরু করল রোগী। বমি বন্ধ হল। ডায়েরিয়ার প্রকোপ কমল। এসবের পাশাপাশি একের পর এক পরীক্ষার মাধ্যমে চলতে লাগল রোগের সঠিক অন্বেষণ। কিন্তু কিচ্ছু ধরা পড়ল না।
তাহলে কি বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল আরাফাতকে?
ফরাসি চিকিৎসকেরা কিন্তু সে কথা কখনো স্বীকার করেনি।
সবই ভালোর দিকে এগোচ্ছিল। হঠাৎ করেই ৩ নভেম্বর অবস্থার অবনতি ঘটল। নাটকীয় ভাবে মুহূর্তে মুহূর্তে পালটাতে লাগল চিত্র। বিছানা থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছিলেন অসুস্থ ইয়াসের। চিৎকার করছিলেন।
শারীরিক বেদনার উপশম ঘটানোর সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মানসিক ভাবে সুহা তাঁকে সাহস জোগাচ্ছিলেন, ‘শান্ত হও! শান্ত হও!’
আরাফাতের বিছানার ঠিক পাশেই মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে ইয়াসেরের দুই হাতের ওপর হাত রেখেছিলেন সুহা। নিজের প্রাক্তন সেক্রেটারি, নিজের প্রেমিকা, নিজের পত্নী সুহাকে চিনতে পারছিলেন না মরুভূমির সিংহ। একটাও কথা বেরোচ্ছিল না আরাফাতের মুখ থেকে। নিথর হয়ে থাকা একটা অসহায় মানুষকে দেখে তখন কে বলবে যে ইসরায়েলের মতো একটা প্রবল শক্তিশালী রাষ্ট্রের চার দশকের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল এ-ই? চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল কেবল। আর সেই দৃশ্য দেখে কেঁদে খানখান হয়ে যাচ্ছিল সুহার হৃদয়, আরাফাতের প্রেমিকার বুক।
এটাই আরাফাতের ইহজীবনের অন্তিম দৃশ্য। এরপর কোমায় চলে যান তিনি। স্বাভাবিক ছন্দে আর ফিরতে পারেননি ইয়াসের।
সুহা নিজে ভালোবাসার মানুষকে ফিরিয়ে আনার জন্য সবরকম সম্ভাব্য প্ৰয়াস করেছিলেন। মন মানেনি বলে আরাফাতের রুমে বসে কোরানের আয়াত পড়েও শুনিয়েছিলেন। সেই সময়ে ইয়াসেরের হাত নড়ে ওঠে। ডাক্তারকে ডেকে আনা হয়। ডাক্তার বলেন, কোমায় এমনটা হয়। আশার শেষ আলো ওখানেই নিভে গিয়েছিল।
আরাফাতকে মৃত বলে ঘোষণা করার খবর ছড়িয়ে পড়ছিল। সুহা সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ‘ওঁকে জীবিত অবস্থাতেই কবর দিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে।’ প্যালেস্টানিয়ান অথোরিটির প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস অন্যান্য রাজনেতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব গঠন করার ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা আরম্ভ করে দিয়েছিলেন।
একজন মৃত্যুপথযাত্রীর যাত্রা আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। ফরাসি ওই হসপিটালে ওই সময়ে আরাফাতের দেহ থেকে নানা স্যাম্পেল কালেক্ট করা হয়। আরসেনিক থেকে আরম্ভ করে প্রচলিত সমস্ত রকমের বিষ এবং ড্রাগসের উপস্থিতি আছে কিনা খতিয়ে দেখাও হয়। কিন্তু কোনো সূত্র মেলে না। ‘ল্যুভে’ এবং ‘ফ্রেডরিখ’— এই দুটি ছদ্মনামকে ব্যবহার করেই এই সমস্ত রিপোর্ট করা হয়েছিল,যাতে প্রতিটা পরীক্ষণের গোপনীয়তা বজায় থাকে।
আরম্ভ হয় তেজস্ক্রিয় পদার্থের উপস্থিতির পরীক্ষা। গামা অ্যাকটিভিটির রিপোর্ট নেগেটিভ আসে।
অবশেষে ১১ নভেম্বর মরুসিংহের পথচলা থেমে যায়। আধিকারিক ভাবে তাঁর মৃত্যু ঘোষণা করা হয়। মৃত্যুর কারণ হিসাবে লেখা হয়, ‘মিস্টেরিয়াস ব্লাড ডিসঅর্ডার’।
গুজব ছড়িয়ে পড়ে আগুনের মতো। কেউ বলে, অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে লিভার সিরোসিস হয়েছিল। কেউ লিখল, এইডস। কারো মতে আবার লিউকেমিয়া হয়েছিল আরাফাতের। এরই মাঝে প্যালেস্টাইনের বিদেশমন্ত্রী নাবিল শাথ দাবি করে বসলেন, ‘আরাফাতকে রাজনৈতিক কারণে গুপ্তহত্যা করা হয়েছে।’
সাংঘাতিক এক তত্ত্ব! তাহলে কি আরাফাতের পতনই ঘটানো হয়েছিল? কে বা কারা ছিল এর নেপথ্যে?
ফরাসি চিকিৎসকেরা যে জানিয়েছিলেন কোনো বিষ দেওয়া হয়নি? নাকি কথাটাকে সামান্য অন্যভাবে পড়া উচিত— এমন এক বিষের ব্যবহার করা হয়েছিল যা ফরাসি ল্যাবরেটরিতে মেলেই না?
আর আশ্চর্যের বিষয় হল না সুহা, না প্যালেস্টাইন গভর্নমেন্ট কেউই আরাফাতের মৃতদেহের অটোপসি করানোর কথা ভাবেনি বা বলেনি।
কারণ কী?
সুহা পরে জানিয়েছিলেন, ‘আমার মাথাতেই আসেনি ব্যাপারটা।’ আর প্যালেস্টাইনের পক্ষ থেকে বিষয়টা ইসলামে হারাম বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
এখন প্রশ্ন হল, পয়জনিং-এর প্রশ্নটা তাহলে উঠছে কোথা থেকে?
২০০৯ সালে আরাফাতের এক প্রাক্তন উপদেষ্টা বাসসাম আবু শরীফ নিজের বই ‘আরাফাত অ্যান্ড দ্য ড্রিম অব প্যালেস্টাইন: অ্যান ইনসাইডারস অ্যাকাউন্ট’- এ লিখে বসলেন যে, ইসরায়েল তেজস্ক্রিয় পদার্থের মাধ্যমে ইয়াসের আরাফাতকে হত্যা করেছে। তিনি লিখলেন, আইডিএফ আরাফাতের ওষুধ সরবরাহকারী অ্যাম্বুলেন্সটিকে আটক করে আধ ঘণ্টা ধরে তল্লাশি চালায়। তল্লাশি তো কিছুই হয়নি, সেই সময়ে কোনো ওষুধের ভায়াল বদলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় বিষাক্ত তেজস্ক্রিয় পদার্থ এবং সেই পদার্থ নিয়মিত একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় আরাফাতের দেহে যেতে থাকার ফলেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।
কেউ কেউ বলে থাকেন যে, প্যালেস্টাইনের মধ্যেই আরাফাতের শত্রুর অভাব ছিল না। তারাই হয়তো বিষপ্রয়োগে মেরেছিল তাঁকে। এক্ষেত্রে নাম উঠে আসে ‘পপুলার রেজিস্টান্স কমিটিজ’-এর। এই সন্ত্রাসবাদী সংগঠনটি ইয়াসের আরাফাতের মৃত্যুর অব্যবহিত সময় পরেই গাজা ভূখণ্ডের মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স হেড জেনারেল মুসা আরাফাতকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে যায়। এরা নাকি আরাফাত পরিবারের কাউকে মসনদে চাইছিল না। কিন্তু উঠে আসে আরেকটা প্রশ্নও, যে তেজস্ক্রিয় পদার্থের নাম পরে শোনা যায়, সেই ‘পোলোনিয়াম ২১০’ কি পপুলার রেজিস্টান্স কমিটিজের মতো ক্ষুদ্র সংগঠনের হাতে আসা সম্ভব?
তাহলে কে বা কারা?
প্যালেস্টাইনের এক অন্যতম আধিকারিক তথা স্বর্গত ইয়াসের আরাফাতের আত্মীয় নাসির আল-কুদওয়া বলেন, ‘ইসরায়েলের হাতে পোলোনিয়াম আছে এবং তারা ইয়াসের আরাফাতকে হত্যা করার ক্ষমতা ও উদ্দেশ্য দুই-ই রাখে।’ তরজা চলতে থাকে। খবর পাকা করে সুইজারল্যান্ডের ইন্সটিটিউট অব রেডিয়েশন ফিজিক্স জানায় যে, অসুস্থ হওয়ার পর থেকে চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে আরাফাত যে পোশাক ব্যবহার করেছিলেন কিংবা তাঁর কাফিয়া থেকে পাওয়া চুলে নাকি পোলোনিয়ামের অস্তিত্ব মিলেছে। চুলে পোলোনিয়াম যে স্তরে মিলেছে তাতে বোঝা যায় বেশ কিছু দিন ধরেই নাকি আরাফাতকে তেজস্ক্রিয় এই পদার্থের ডোজ দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু এসবই ২০১২ সালের ঘটনা।
আর মৃত্যু ঘটেছিল কবে?
২০০৪ সালের ১১ নভেম্বর।
মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। তাই যখন ইসরায়েলের দিকে সন্দেহের আঙুল তোলা হতে লাগল, তখন ইসরায়েল জবাব দিল, সুহা এতদিন ধরে না কাচা জামাকাপড় রেখে দিয়েছিলেন? আচমকা মনে হল পরীক্ষা করা প্রয়োজন আর আকাশ থেকে হাত ঘুরিয়ে পোলোনিয়াম পাওয়া গেল? সেটাও ইসরায়েল দিয়েছে বলা হয়ে গেল?
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সুহা এবার আরাফাতের দেহ কবর থেকে তোলার অনুমতি জোগাড় করে ফেললেন। জেসাস ক্রাইস্টের পরে কার্যত আবার একবার ‘রেজারেকশন’ দেখল মধ্যপ্রাচ্য। রাশিয়া, ফ্রান্স এবং সুইস ফরেনসিক টিম এসে আরাফাতের দেহাবশেষের নমুনা সংগ্রহ করল। উদ্দেশ্য একটাই পোলোনিয়ামের অস্তিত্ব খোঁজা। কিন্তু ওই যে, মাঝে এতগুলো বছর চলে গিয়েছিল। আর পোলোনিয়ামের এই আইসোটোপের হাফ লাইফ ১৩৮ দিন ৯ ঘণ্টার সামান্য বেশি। এমতাবস্থায় প্রতি ১৩৮ দিন ৯ ঘণ্টায় এই পদার্থ ঠিক নিজের অর্ধেক পরিমাপে কমে আসে, আর তাই সেক্ষেত্রে ৮ বছরের এই সুদীর্ঘ ব্যবধানে এর নমুনা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তবুও কাজ চলল। সুইস অথোরিটি জানাল, পোলনিয়ামের উপস্থিতি দেখা গেছে এবং আরাফাতের মৃত্যুর কারণও এই পোলোনিয়ামই হতে পারে। রাশিয়া এবং ফ্রান্সের রিপোর্ট কিন্তু সার্বজনীন করা হল না। পরে জানা গেল যে ফ্রান্সের রিপোর্টে পোলোনিয়ামের উপস্থিতি প্রমাণিত হলেও তা ‘প্রাকৃতিক’। রাশিয়ার ফলাফলে বলা হয়েছিল, কোনো পোলোনিয়ামই মেলেনি।
ধোঁয়াশা! ধোঁয়াশা! শুধুই ধোঁয়াশা!
একজন মৃত ব্যক্তি। হত্যা নাকি স্বাভাবিক মৃত্যু? চতুর্দিকে অজস্র শত্রু। অসংখ্য জিউসের রক্তে রাঙা হাত দুটোকে কাটার জন্য কি একবারও ভাবেনি ইসরায়েল? তা তো নয়— বহু বার ব্যর্থ প্রয়াস হয়েছে আরাফাতকে মারার। পরে খানিকটা মার্কিন চাপের ফলেই প্রকাশ্যে সেই হত্যার প্রয়াস থেকে পিছিয়ে এলেও কিন্তু ইসরায়েল হাল ছাড়েনি। শোনা যায়, ২০০৪ সালের ১১ নভেম্বরের ইসরায়েলের এক মিটিংয়েই নাকি নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল ইয়াসের আরাফাতের ভাগ্য। বাকিটা ঈশ্বর জানেন। তবে হ্যাঁ, এই কথা মানতেই হয় যে, রোগে ভুগে মরুন বা বিষের প্রয়োগে, জীবনের অন্তিম ক্ষণে মরুভূমির এই দুর্ধর্ষ ব্যক্তি শত শত জিউসের রক্তে রাঙা দুই হাতেও প্রেমিকাকেই জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘সুহা, আই লভ ইউ!’