সুস্থিত পৃথিবী
অত্যন্ত বিষণ্ণ এক সময়ে বসে (জুলাই ১৯৬১) এ লেখা লিখছি আমি। যা লিখছি তা প্রকাশিত হওয়ার মতো অথবা প্রকাশিত হলেও তা পড়ার মতো সময় মানবজাতির হাতে আছে কি না, অর্থাৎ ততদিন মানবজাতি টিকে থাকবে কি না, বলা অসম্ভব। তবে এখনও আশা আছে, আর আশা থাকতে হতাশ হয়ে পড়া কাপুরুষের লক্ষণ।
এই মুহূর্তে পৃথিবীর সামনে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো: কারুর কাম্য কোনো কিছু যুদ্ধের সাহায্যে অর্জন করা কি সম্ভব? কেনেডি আর ক্রুশ্চেভ বলছেন–হ্যাঁ, সম্ভব। কেউ কেউ বলছেন-না, সম্ভব নয়। এই চূড়ান্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটির ব্যাপারে কেনেডি আর ক্রুশ্চেভ একমত। তারা যদি সম্ভাব্যতার যুক্তিসম্মত বিচার করতে সক্ষম হতেন, তাহলে দুজনেই একমত হতেন যে মানবজাতির নিশ্চিহ্ন হওয়ার সময় এসে গেছে। কিন্তু মানবজাতির নিশ্চিহ্ন হওয়ার ব্যাপারে তাদের কারুরই কোনো মাথাব্যথা নেই। অহমিকা, ঔদ্ধত্য, মর্যাদাহানির আশঙ্কা এবং মতাদর্শগত অসহিষ্ণুতা তাদের বিচারশক্তিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। তাঁদের এই অন্ধত্বকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে শক্তিশালী কিছু গোষ্ঠীর একই ধরনের অন্ধত্ব। তাদের নিজেদের আর তাদের সহকর্মী ও অনুগামীদের প্রচারের ফলে মানুষের মধ্যে যে উন্মাদনা দেখা দিয়েছে, তা-ও এই অন্ধত্বকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন মানুষদের মূর্খতাকে ঠেকানোর জন্য কি করা উচিত?
হতাশাবাদীরা বলতে পারেন-মানব প্রজাতিকে টিকিয়ে রেখে লাভটা কি? যে সব দুঃখ-ঘৃণা-ভয় আজ পর্যন্ত মানবজাতির জীবনকে ঘিরে থেকেছে, তার হাত থেকে মুক্তির সম্ভাবনায় খুশি হওয়াই কি উচিত নয়? যন্ত্রণা আর আতঙ্কের দীর্ঘ দুঃস্বপ্নের অবসানে আমাদের এই গ্রহ শান্তিকে ঘুমোচ্ছে, অবশেষে শান্তি পেয়েছে সে, একথা ভেবে আমাদের কি আনন্দ করা উচিত নয়?
আজ পর্যন্ত মানবজাতির জীবনে যতকিছু মূর্খতা, নিষ্ঠুরতা আর দুর্দশার ইতিবৃত্ত জড়িয়ে থেকেছে, তার কথা ভাবতে বসলে ইতিহাসের যে কোনো ছাত্রের মনেই এই ধরনের চিন্তা মাঝে মাঝে দেখা দিতে বাধ্য। পর্যালোচনা করতে বসলে শেষ পর্যন্ত আমরাও হয়তো আনন্দ উপভোগে অক্ষম আমাদের এই প্রজাতির নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পক্ষেই মৌন সম্মতি দিয়ে বসব।
তবে হতাশাবাদীরা সত্যের অর্ধেক অংশটাই শুধু দেখেন, আমার মতে যে অংশটা তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের মধ্যে শুধু নিষ্ঠুরতা আর যন্ত্রণাসৃষ্টির ক্ষমতাই নেই, মহত্ত্ব আর উৎকর্ষতার সম্ভাবনাও আছে। সে সম্ভাবনা আজও খুব বেশি বাস্তবায়িত হয়নি, কিন্তু যেটুকু হয়েছে তা থেকেই বোঝা যায় আরও অবাধ ও আরও আনন্দময় এক পৃথিবীতে জীবন কত সুন্দর হয়ে উঠতে পারে। মানুষ যদি তার গুণাবলিকে পূর্ণমাত্রায় বিকশিত করে তোলার সুযোগ পায়, তাহলে সে এমন এক উচ্চতায় পৌঁছতে পারে যা আজ আমরা কল্পনাও করতে পারব না। দারিদ্র্য, অসুস্থতা ও নিঃসঙ্গতা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। সুখের যুক্তিসম্মত প্রত্যাশা অবসান ঘটাতে পারে আতঙ্কের রাত্রির। আজ যা হাতে গোনা মাত্র কয়েকজনের উজ্জ্বল প্রতিভার লক্ষণ, বিবর্তনের পথ বেয়ে একদিন বহুজনই তার অধিকারী হয়ে উঠতে পারে। যে পরিণতিতে পৌঁছানো আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত সেখানে পৌঁছানোর আগেই আমরা যদি হঠকারীর মতো নিজেদের ধ্বংস করে না ফেলি, তাহলে আগামী লক্ষাধিক বছরে এই সবকিছুই বাস্তব হয়ে উঠতে পারে। না, হতাশাবাদীরদের কথায় কান দিয়ে আমাদের চলবে না, কারণ তাদের কথায় কান দিলে মানবজাতির ভবিষ্যতের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে হবে আমাদের।
এইসব সুদূরের আশার কথা সরিয়ে রেখে ভেবে দেখা যাক ঠিক এই মুহূর্তে আমাদের করণীয় কি?
প্রথমত, যুদ্ধের হাত থেকে অব্যাহতি পেতে হবে আমাদের। বর্তমানে ঠাণ্ডাযুদ্ধে প্রবৃত্ত দেশগুলো গণহত্যার প্রস্তুতির জন্য বছরে তিরিশ হাজার মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয় করে, অর্থাৎ প্রতি মিনিটে পাঁচশো পঁচাত্তর পাউন্ড। মানুষের কল্যাণের কাজে এই অর্থ ব্যয় করলে কত কাজ করা যেতে পারত। পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি মানুষ অপুষ্টির শিকার। ধনী দেশগুলো চায় দরিদ্রতর দেশগুলো কোনো রকমে টিকে থেকে তাদেরকে আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে সাহায্য করুক। এই মানসিকতা বজায় থাকলে ধনী দেশগুলো একমাত্র ঠাণ্ডাযুদ্ধে দরিদ্রতর দেশগুলোর সমর্থন আদায় করার উদ্দেশ্য ছাড়া আর কোনো কারণেই তাদের সাহায্য করবে না। কিন্তু তা না করে আমরা যদি আমাদের সম্পদের বিনিময়ে শান্তিকে সুরক্ষিত করার জন্য তাদের সমর্থন আদায় করতাম, তাহলে কি অনেক ভালো হতো না?
অস্ত্রনির্মাণ শিল্পের সঙ্গে মালিক বা শ্রমিক যাদের স্বার্থ জড়িত, তারা বলে নিরস্ত্রীকরণের ফলে এক ভয়াবহ আর্থিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। এ বিষয়ে মতামত দেওয়ার যোগ্যতা যাদের সব থেকে বেশি, তারা কিন্তু এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন। এ প্রসঙ্গে দুটি মূল্যবান প্রবন্ধের কথা উল্লেখ করতে চাই আমি। প্রথমটি প্রকাশিত হয়েছিল দ্য নেশনস বিজনেস (আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সের মুখপত্র) পত্রিকার অক্টোবর ১৯৫৯ সংখ্যায়, দ্বিতীয়টির লেখক ছিলেন সেনেটর হুবার্ট এইচ, হামফ্রে আমেরিকান সেনেটের নিরস্ত্রীকরণ সংক্রান্ত সাব কমিটির চেয়ারম্যান), প্রকাশিত হয়েছিল থিঙ্ক পত্রিকার জানুয়ারি ১৯৬০ সংখ্যায়। দুটি লেখাতেই বলা হয়েছে-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে বোঝা গিয়েছিল কয়েকটি সুস্পষ্ট ও বাস্তববাচিত সতর্কতা গ্রহণ করলে যুদ্ধভিত্তিক অর্থনীতিকে অনায়াসেই শান্তিভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করা যায়। সুতরাং পরস্পরকে হত্যার তোড়জোড় করা ছাড়া আমাদের বেঁচে থাকার আর অন্য কোনো উপায় নেই- এই স্ববিরোধী তত্ত্বটাকে আমরা ঝেড়ে ফেলতেই পারি।
বিশ্বসরকারকে স্বচ্ছন্দে কাজ করতে হলে অর্থনৈতিক শর্ত অবশ্যই পূরণ করতে হবে। তার মধ্যে যে শর্তটি ইতিমধ্যেই ব্যাপক স্বীকৃতি পেতে শুরু করেছে তা হলো-এই মুহূর্তের অনুন্নত দেশগুলোর জীবনযাত্রার মানকে পশ্চিমী দুনিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী দেশগুলোর মানে উন্নীত করে তোলা। পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক সমতা গড়ে তুলতে না পারলে দরিদ্রতর দেশগুলো চিরদিনই ধনী দেশগুলোকে ঈর্ষা করে যাবে এবং ধনী দেশগুলো সর্বদাই দরিদ্রতর দেশগুলোর হিংসাত্মক প্রতিক্রিয়ার আতঙ্কে ভুগবে।
এটুকুই সব নয়, আরও দুরূহ কিছু অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও গ্রহণ করা দরকার। শিল্পের জন্য বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল একান্তই প্রয়োজনীয়। তার মধ্যে বর্তমানে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামালগুলোর একটি হলো তেল। যুদ্ধের স্বার্থে ইউরেনিয়াম ব্যবহারের প্রয়োজন না থাকলেও পারমাণবিক শক্তিকে শিল্পগত কাজে ব্যবহার করার জন্য ইউরেনিয়াম প্রয়োজন। এইসব অত্যাবশ্যক কাঁচামাল ব্যক্তিগত মালিকানাধীন থাকার কোনো যুক্তি নেই। শুধু ব্যক্তিগত বা সংস্থাগত মালিকানাই নয়, এ সব কাঁচামালের মালিকানা কোনো রাষ্ট্রের হাতেও থাকা উচিত নয়। শিল্পের জন্য অত্যাবশ্যক যাবতীয় কাঁচামালের মালিকানা থাকবে একটি আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের হাতে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রয়োজনের ন্যায্যতা এবং তাদের দক্ষতা বিচার করে আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষ এইসব কাঁচামাল সরবরাহ করবে তাদের। যে সব রাষ্ট্র এই দক্ষতায় পিছিয়ে থাকবে তাদেরকে দক্ষতা অর্জনে সাহায্য করবে আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষ।
ভবিষ্যতের যে স্থিতিশীল পৃথিবীর স্বপ্ন দেখছি আমরা, সেই পৃথিবীতে বহুক্ষেত্রেই আজকের থেকে অনেক বেশি স্বাধীনতা থাকবে। সেইসঙ্গে মানুষের মনে বিশ্বসরকারের প্রতি আনুগত্য গড়ে তোলার জন্য এবং কোনো একটি দেশ বা কিছু সংখ্যক দেশ কর্তৃক যুদ্ধ বাধানোর সম্ভাবনাদূর করার জন্য স্বাধীনতার ওপর নতুন কিছু বাঁধাবাঁধন চালু করারও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে। এই বাঁধার্বাধনটুকু ছাড়া সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতা এবং অবাধ ভ্রমণের স্বাধীনতা পূর্ণ মাত্রাতেই বজায় থাকবে। তরুণদের আর সেখানো হবে না কিভাবে নিজের দেশের গুণাবলির ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে হয়, বিদেশিদের হত্যা করার ব্যাপারে তাদের যে সব দেশবাসীরা সব থেকে বেশি দক্ষতা দেখিয়েছে তাদের জন্য কিভাবে গর্বিত হতে হয়, অথবা কিভাবে আত্মস্থ করতে হয় মিঃ পডস্ন্যাপ-এর সেই বাণী, বিদেশি রাষ্ট্র? দুঃখিত, তাদের নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। ইতিহাসের শিক্ষাকে তুলে ধরতে হবে আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে। জ্ঞান বা শিল্পকলা, আবিষ্কার বা অভিযান-সব ব্যাপারেই যুদ্ধ সংক্রান্ত ঘটনাবলির ওপর কম গুরুত্ব দিয়ে শান্তিপূর্ণ সাফল্যগুলোর ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। কোনো দেশের শিক্ষা বিষয়ক কর্তৃপক্ষ যাতে উগ্র স্বাদেশিকতার প্রচার চালাতে কিংবা আন্তর্জাতিক সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের উসকানি দিতে না পারে, সেদিকে নজর রাখতে হবে বিশ্বসরকারকে। এই বাঁধাবাঁধনটুকু ছাড়া শিক্ষাক্ষেত্রে আজকের থেকে অনেক বেশি স্বাধীনতাই থাকবে ভবিষ্যতের সেই পৃথিবীতে। কোনো শিক্ষক যদি প্রচলিত ধারণার বিরুদ্ধে কোনো মত প্রচার করেন এবং সেই মতটি যদি যুদ্ধের পক্ষে উসকানিমূলক না হয়, তাহলে তাকে অবাধে তাঁর মত প্রচার করার সুযোগ দেওয়া হবে। ইতিহাস অথবা সামাজিক কোনো বিষয় সংক্রান্ত শিক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করা হবে মানুষের ওপর, মানবজাতির ওপর, কোনো বিশেষ দেশ বা কয়েকটি দেশের ওপরে নয়।
ব্যক্তি ও গোষ্ঠী, উভয়েই দুটি বিপরীত ধরনের কর্মোদ্দীপক লাভ করে থাকে-প্রথমটি হলো সহযোগিতা, অন্যটি প্রতিযোগিতা। বৈজ্ঞানিক কলাকৌশলের প্রতিটি অগ্রগতি সহযোগিতার আকাঙ্ক্ষিত ক্ষেত্রটিকে আরও প্রসারিত করে তোলে এবং প্রতিযোগিতার আকাঙ্ক্ষিত ক্ষেত্রটিকে সঙ্কুচিত করে দেয়। এর ফলে কর্মোদ্দীপক হিসেবেও প্রতিযোগিতার আর কোনো স্থান থাকবে না, তা আমি বলতে চাইছি না। আমি বলতে চাইছি, প্রতিযোগিতা যেন ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠার রূপ পরিগ্রহ না করে, বিশেষত, প্রতিযোগিতা যেন কিছুতেই যুদ্ধের রূপ না নেয়। শিক্ষার অন্যতম একটি উদ্দেশ্য হওয়া উচিত বিশ্বব্যাপী সহযোগিতার সম্ভাবনাময় দিকগুলো সম্বন্ধে তরুণ প্রজন্মকে সচেতন করে তোলা এবং সামগ্রিকভাবে মানবজাতির স্বার্থরক্ষা সংক্রান্ত চিন্তার অভ্যাস গড়ে তোলা। এই ধরনের শিক্ষার প্রসার ঘটলে সর্বত্রই বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব বিকশিত হয়ে উঠবে এবং আজ পর্যন্ত অধিকাংশ দেশের রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থায় অপরের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টির যে প্রচার একটা বড় জায়গা অধিকার করে থেকেছে তা হ্রাস প্রাপ্ত হবে।
অনেকের ধারণা যুদ্ধহীন পৃথিবী একটা বিস্বাদ, একঘেয়ে পৃথিবীতে পরিণত হবে। আমাদের এই পৃথিবীতে অনেক মানুষই যে নিতান্ত নীরস ও ছকবাঁধা পথে জীবনযাপন করেন, তা অনস্বীকার্য। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন যুদ্ধের সময় তাদেরকে ভিন্ন কোনো দেশে পাঠানো হলে তারা অন্তত গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ করার সুযোগ পেতে পারেন, একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতে পারেন এবং স্বদেশের পরিচিত জীবনযাত্রার থেকে ভিন্ন ধরনের কোনো জীবনযাত্রার চাক্ষুষ করার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেন। আমার মতে, যারা বিভিন্ন অভিযানের শরিক হতে চান, এমনকি কোনো বিপজ্জনক অভিযানেও অংশ নিতে চান, তাঁদের জন্য সেই ধরনের অভিযানের ব্যবস্থা করা উচিত। এই ধরনের অভিযান স্বাভাবিকভাবেই সহযোগিতামূলক হবে এবং এর জন্য দরকার হবে শৃঙ্খলা, সহযোগিতা, দায়িত্বশীলতা, এমনকি আজ্ঞানুবর্তিতাও। এগুলো ছাড়া মানসিক পরিপক্বতা গড়ে ওঠে না আর এই মানবিক পরিপক্কতার অভাবই এই মুহূর্তে অনেকের মধ্যে যুদ্ধপ্রীতির মূল কারণ হিসেবে কাজ করে চলেছে। উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে, হিমালয়ে আর আন্দিজ পবর্তমালায় বৈজ্ঞানিক অভিযানে অংশ নিতে যারা আগ্রহী, তাদের জন্য উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। যারা আরও উত্তেজনাপূর্ণ কোনো অভিযানের শরিক হতে চায় তারা মহাকাশ পর্যটনে যেতে পারে, যে সম্ভাবনা আর কিছুদিনের মধ্যেই বাস্তব হয়ে উঠবে। অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণের বিপুল ব্যয়ভার থেকে মুক্ত হওয়া গেলে সরকারি খরচেই এইসব দামাল যুবকের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা যাবে, শুধু দেখতে হবে তা যেন আজকের মতো কোনো দুর্দশা বা বিপর্যয় ডেকে না আনে অথবা মানবজাতির ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করার কারণ হয়ে না ওঠে।
যুদ্ধের আশঙ্কা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর একটা পরিবর্তনকালীন পর্যায় দেখা দেবে, যে পর্যায়ে মানুষের চিন্তাভাবনা আর অশান্ত অতীতের প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারবে না। যুদ্ধভীতির অবসানের ফলে পৃথিবীর যতটা লাভ হওয়া উচিত, ততটা লাভ এই পরিবর্তনকালীন পর্যায়ে বাস্তবায়িত হবে না। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক মনোভাবের আধিক্য তখনও থেকে যাবে এবং সৃজনোনুখ নতুন পৃথিবীর সঙ্গে নিজেদের মানসিকতাকে খাপ খাইয়ে নিতে পারবেন না অনেকেই, বিশেষত বয়স্ক মানুষরা। পুনর্গঠনের কাজের পাশাপাশি মানুষের মানসিকতা তার মানানসই করে তোলার জন্যও প্রয়াসী হতে হবে, প্রয়োজনে স্বাধীনতার ওপর কিছু বিধিনিষেধও হয়তো আরোপ করতে হবে। মানুষের মানসিকতাকে নতুন পৃথিবীর পক্ষে মানানসই করে তোলার কাজটা অসম্ভব কিছু নয়। মানবচরিত্রের দশ ভাগের নভাগই গড়ে ওঠে পরিবেশের প্রভাবে, মাত্র এক ভাগের জন্য দায়ী থাকে জিনগত কারণ। পরিবেশের প্রভাবে যে অংশটি গড়ে ওঠে, সেই অংশটিকে উপযুক্ত শিক্ষার সাহায্যে নতুন পৃথিবীর পক্ষে মানানসই করে তোলা যেতেই পারে। এমনকি জিনগত কারণ যে অংশটিকে প্রভাবিত করে সেই অংশটিও হয়তো একদিন বিজ্ঞানের সামনে নতি স্বীকার করবে। পরিবর্তীকালীন এই পর্যায়টি সফলভাবে অতিক্রম করা গেলে যে পৃথিবীতে পা রাখব আমরা, সে পৃথিবী কেমন হবে? সে পৃথিবীতে কিভাবে কাজ করবে শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞান? যাবতীয় ভয় থেকে, ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক ভয় আর রাষ্ট্রীয় স্তরে যুদ্ধের ভয় থেকে মুক্তি পাওয়ার ফলে মানুষের কর্মোদ্দীপনা এক অকল্পনীয় উচ্চতায় পৌঁছতে সক্ষম হবে বলে আশা করা যায়। অদ্যাবধি মানুষের যাবতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা-কল্পনার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অসংখ্য বিধিনিষেধ। দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এই জীবনের ওপারে এক স্বর্গলাভের আশার আশ্রয় নিয়েছে সে। নিগ্রোদের আধ্যাত্মিক গানের এই ভাবনাটা ব্যক্ত হয়েছে এইভাবে, ঘরে যখন ফিরব আমি, ঈশ্বরকে জানাব আমার সকল দুঃখের কথা। কিন্তু স্বর্গের আশায় বসে থাকার কোনো প্রয়োজনই নেই। এই পৃথিবীর বুকেই সুখময় হয়ে উঠতে পারে জীবন। কল্পনাকে প্রকাশ করার জন্য অতিকথার আশ্রয় নেওয়ারও কোনো প্রয়োজন নেই। যে পৃথিবী গড়ে উঠতে চলেছে, সেই পৃথিবীতে মানুষ ইচ্ছে করলে জাগতিক অস্তিত্বের চৌহদ্দির মধ্যেই অবাধে সৃষ্টিশীল করে তুলেতে পারবে তার কল্পনাকে। সাম্প্রতিককালের জ্ঞান এত দ্রুত বেড়ে উঠেছে যে তা শুধু হাতেগোনা কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে, আর তাদের মধ্যে অত্যল্প কয়েকজনই শুধু সেই জ্ঞানকে কাব্যিক অনুভূতি এবং মহাজাগতিক অন্তদৃষ্টির সাহায্যে পূর্ণতর করে তুলতে পেরেছেন। জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত টলেমীর পদ্ধতির শ্রেষ্ঠ কাব্যিক অভিব্যক্তি ঘটেছিল দান্তের লেখনিতে আর তার জন্য ওই পদ্ধতিকে প্রায় দেড় হাজার বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। বিজ্ঞানের বহু কিছুই আত্মস্থ করে উঠতে পারিনি আমরা। কিন্তু প্রাগ্রসর শিক্ষায় সমৃদ্ধ এক পৃথিবীতে বিজ্ঞানের সবটুকুই আত্মস্থ করা যাবে, আমাদের কাব্য ও শিল্প নতুন নতুন জগতে বিস্তৃত হয়ে জন্ম দেবে নতুন নতুন মহাকাব্যের। মানুষের বাধাবন্ধনহীন কর্মোদ্দীপনা থেকে জন্ম নেবে নতুন দীপ্তি, নতুন সৌন্দর্য, নতুন। মহত্ত্ব, অতীতের সঙ্কীর্ণ ও হিংসাদীর্ণ পৃথিবীতে যা একান্তই অসম্ভব ছিল। আমাদের বর্তমান সমস্যার যথাযথ সমাধান করা গেলে মানবজাতির সামনে। অপেক্ষা করছে তার অতীতের থেকে বহুগুণ দীর্ঘ এক ভবিষ্যৎ, যে ভবিষ্যৎ সুদূরপ্রসারী প্রত্যাশার ইঙ্গিতবাহী, অগণিত সাফল্যের অঙ্গীকারে উজ্জ্বল। মানুষ যে-সূত্রপাতটুকু করছে তা কোনো শিশুর পক্ষে যথেষ্টই কৃতিত্বের কারণ, জৈবিক অর্থে মানুষই এই পৃথিবীর সর্বশেষ প্রজাতি এবং সেই অর্থে আজও সে তার শৈশবাবস্থানেই আছে। ভবিষ্যতে সে আরও কত কি অর্জন করতে পারবে, তার কোনো সীমা নির্ধারণ করা অসম্ভব। আমি মনশ্চক্ষে দেখতে পাচ্ছি সেই সুখি সুন্দর পৃথিবীর ছবি, যে পৃথিবীতে প্রসার ঘটে মানুষের মনের, যেখানে আশার দল ঔজ্জ্বল্য হারায় না, সেখানে বৃহৎ কোনো ভাবনাকে তুচ্ছ কোনো উদ্দেশ্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা বলে আর অভিযুক্ত করা হয় না। এই সবকিছুই বাস্তব হয়ে উঠতে পারে, যদি আমরা একে বাস্তব হয়ে উঠতে দিই। এই উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অথবা মূর্খতাপ্রসূত পরিসমাপ্তি-কোনটাকে বেছে নেব, তা নির্ভর করছে আমাদের ওপরেই।