সুশীল মোটেই সুবোধ বালক নয়
সাহেব হুকুম দিলেন সুশীলকে চাবুক মারা হবে। সুশীলের বয়েস তখন পনেরো, তাই পনেরো ঘা কড়া চাবুক। জেলখানার চত্বরে যমদূতের মতন চেহারার প্রহরী লকলকে চাবুক নিয়ে মারতে লাগলো শপাং শপাং করে। পাশে দাঁড়িয়ে একজন গুনছে এক, দুই, তিন…
পনেরো বছরের ছেলে সুশীল সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কোনো দয়া চাইলো না, কাঁদলো না। সে যে ব্যথা পাচ্ছে তাই বোঝা গেল না। তার ঠোঁটে অল্প হাসি, সে গুনগুন করে গান গাইছে, ”আমায় বেত মেরে তুই মা ভোলাবি, আমি কী মার সেই ছেলে?”
মনে হয় রূপকথার গল্প। তা কিন্তু নয়। এখনো তেমন অনেক লোক বেঁচে আছে, যারা এই সব দৃশ্য নিজের চোখে দেখেছে। প্রায় সত্তর বছর আগেকার ঘটনা।
তোমরা অনেকেই বোধ হয় জানো যে একসময় ইংরেজরা ছিল আমাদের রাজা। এখন পৃথিবীতে পরাধীন দেশ প্রায় নেই—ই। কিন্তু এক সময় পৃথিবীর কয়েকটা মাত্র দেশের রাজা পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশ শাসন করতো। আমাদের দেশ দখল করেছিল ইংরেজরা। আমাদের ওপর তারা দারুণ অত্যাচার করতো। আর এদেশের সব জিনিসপত্র নিয়ে যেত নিজেদের দেশে।
তারপর আস্তে আস্তে আমাদের দেশের লোকেরাও প্রতিবাদ করতে শুরু করলে, ইংরেজদের তাড়াবার জন্য শুরু হলো লড়াই। কত ভালো ভালো সাহসী ছেলেমেয়েরা যে সেই লড়াইতে প্রাণ দিয়েছে তার ঠিক নেই। তাদের জন্যই আজ আমাদের দেশ স্বাধীন। অথচ তাদের অনেকের কথাই আমরা আজ মনে রাখিনি।
সেই রকম একজনের কথাই আজ আমি শোনাচ্ছি! সত্যি হলেও দারুণ রোমাঞ্চকর গল্প। শেষ পর্যন্ত পড়লে তবে বুঝতে পারবে। ছেলেটির নাম সুশীল সেন। ন্যাশনাল কলেজের ছাত্র। সে একদিন শিয়ালদার কাছ দিয়ে পায়ে হেঁটে আসছে, এমন সময় দেখলো কোর্টের কাছে খুব ভিড়। কী ব্যাপার? সে থমকে দাঁড়ালো।
সেই কোর্টে তখন একটা বিখ্যাত মামলা চলছে। তোমরা নিশ্চয়ই শ্রীঅরবিন্দর ছবি দেখেছো? এই শ্রীঅরবিন্দর নাম ছিল তখন শুধু অরবিন্দ ঘোষ এবং তিনি ছিলেন ‘বন্দে মাতরম’ বলে একটি পত্রিকার সম্পাদক। পুলিশ সেই পত্রিকার নামে মামলা এনেছে। সাক্ষী হিসেবে এনেছে আর একজন বিখ্যাত নেতা বিপিন পালকে। বিপিন পাল আদালতে এসে বেঁকে বসলেন। তিনি নিজের দেশের লোকের বিরুদ্ধে কিছুতেই সাক্ষী দেবেন না। তাই নিয়ে হুলস্থুল কাণ্ড! সেই মামলা দেখার জন্যই ভিড় করেছে অনেক লোক।
পুলিশ তখন ভিড় সরাবার জন্য লাঠি দিয়ে লোকজনকে মারতে শুরু করেছে। তখনকার ইংরেজ পুলিশ আমাদের দেশের লোকেদের তো মানুষ বলেই গণ্য করতো না। দুমদাম করে যখন খুশি পেটাতো। সার্জেন্ট যেই সুশীলকে এক ঘা মেরেছে, সেও উল্টে মেরেছে তার মুখে এক ঘুষি। সে মোটেই সহ্য করার ছেলে নয়, গায়েও খুব জোর! ঘুষি খেয়ে হকচকিয়ে গেল সার্জেন্ট। বাঙালিরা তো কখনো সাহেবের গায়ে হাত তোলবার সাহস দেখায় না। সে তখন লাঠি দিয়ে আবার খুব জোরে মারলো সুশীলকে। সুশীলও আবার তেড়ে এসে এক ঘুষি চালালো। তখন অনেকগুলো পুলিশ এসে সুশীলকে ঘিরে ধরে ফেললো। নিয়ে এলো সাহেব হাকিমের কাছে। হাকিম তো বাঙালির ছেলের এই আস্পর্ধার কথা শুনেই তেলে—বেগুনে জ্বলে উঠলেন। হুকুম দিলেন, মারো একে পনেরো ঘা চাবুক।
হাসিমুখে সহ্য করলো সুশীল সেই নির্যাতন। সাহেবরা দেখে নিক বাঙালির ছেলেরা আর সাহেবদের ভয় পায় না। সুশীলকে নিয়ে দেশের লোকের খুব গর্ব হলো। তাকে নিয়ে মিছিল বার করলো অনেকে মিলে। তখনকার দিনে আমাদের দেশের বড় নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় একটা সোনার মেডেল পাঠিয়ে দিলেন সুশীলের জন্য।
যে হাকিম সুশীলকে শাস্তি দিয়েছিল, তার ওপর কিন্তু সুশীল খুব রেগে রইলো। এরকম অত্যাচারী সাহেবদের শেষ করতেই হবে। সাহেবকে মারার জন্য সে একটা ফন্দি বার করলো। একখানা খুব মোটা বইয়ের মধ্যে একটা বোমা পুরে পাঠিয়ে দিলে সাহেবের নামে। সাহেব যেই বইটা খুলবে অমনি বোমাটা ফেটে যাবে। কিন্তু সাহেবটির ভাগ্য ভালো, বইটা নিজে খোলবার আগেই একজন আর্দালি খুলে ফেললে।
প্রতিশোধের আগুন তখন সুশীলের মনের মধ্যে জ্বলছে। সে বুঝলো শুধু একজন সাহেবকে মারলে তো হবে না। সব সাহেবকে তাড়াতে হবে। সেজন্য বড় দল চাই। অনেক অস্ত্রশস্ত্র চাই। তার জন্য সে পুরোপুরি যোগ দিল বিপ্লবীদের দলে। দেশের লোককে তৈরি করা আর বোমা বানানোর কাজ চলতে লাগলো।
কয়েকমাস পরে সে ধরা পড়ে গেল পুলিশের হাতে। একই সঙ্গে শ্রীঅরবিন্দ, বারীণ ঘোষ, কানাই, সত্যেন, উল্লাসকর, উপেন ব্যানার্জি ইত্যাদি বিখ্যাত বীরেরাও ধরা পড়েছিলেন। এদের মধ্যে সুশীলই সবচেয়ে ছোট।
বিচারে তার সাত বছর জেল হলো। কিন্তু তাকে জেল খাটতে হলো না অবশ্য। হাইকোর্টে তিন বিচারকের মধ্যে বারবার মতের অমিল হওয়ায়, শেষ পর্যন্ত ছেড়েই দেওয়া হলো তাকে।
এতবড় একটা শাস্তির হাত থেকে কোনোক্রমে ছাড়া পেলে অনেকেই ভাবে ওরেববাবা, খুব জোর বেঁচে গেছি, আর ওইসব কিছু করতে যাব না। সুশীল কিন্তু মোটেই সে রকম সুবোধ বালক ছিল না। যেমন তার সাহস তেমন তার গোঁ। আবার সে গোপনে দল তৈরি করলো। সাহেব কয়েকজনকে বন্দী করেছে বলেই কি আর সবাই চুপ করে থাকবে? সেই বন্দীদের ছাড়ানো দরকার। নতুন ছেলেদের বিপ্লবী করে তোলা দরকার।
সুশীল দুটো জিনিস ঠিক করলো। এদেশেরই নেতা হয়ে যারা দেশের ক্ষতি করবে কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা করবে, তাদের শাস্তি দিতে হবে। আর টাকা জোগাড় করতে হবে। গোপন দল চালাতে গেলে আরো টাকা লাগে। সে টাকা কোথা থেকে আসবে? যারা অত্যাচারী, যারা কৃপণ, তাদের কাছ থেকে জোর করে টাকা—পয়সা কেড়ে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। তাদের নাম ছিল তখন স্বদেশী ডাকাত।
সুশীল তার দল নিয়ে এ রকম অনেক বিশ্বাসঘাতককে শাস্তি দিল। অনেক জায়গা থেকে স্বদেশী ডাকাতি করে টাকা জোগাড় করতে লাগলো। পুলিশ কিন্তু কিছুতেই তাকে ছুঁতে পারেনি। আর সে পুলিশের হাতে ধরা দেবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছে। একবার কী কাণ্ড হলো শোনো! সুশীল এইসময় নদীতে নৌকোয় করে ঘুরে বেড়ায়। আর সুযোগ পেলে কৃপণ বড়লোকদের কাছ থেকে টাকা কেড়ে নিয়ে এসে গরিবদের দেয়। এইরকমভাবে একদিন তারা নদীয়া জেলার দুটো গ্রাম থেকে দু’বার লুঠ করে নৌকোয় চেপে পালাচ্ছে। অনেকক্ষণ নৌকো চালিয়ে এসে যখন নিশ্চিন্ত হলো যে পুলিশ তাদের খোঁজ পায়নি, তখন দলের লোকরা বললো, বড্ড খিদে পেয়েছে। খিদে তো পাবেই, দেড় দিন ধরে কিছু খাওয়া হয়নি!
নদীর ধারে নৌকো থামিয়ে তারা রান্না করতে বসলো। গ্রামের কয়েকজন লোক এরকম কয়েকটি অচেনা ছেলেকে দেখে সন্দেহ করলো। নিশ্চয়ই এরা ডাকাত। চুপিচুপি খবর দিল পুলিশকে। একদল পুলিশ এসে পড়লো হুড়মুড় করে। তখনো রান্না শেষ হয়নি। খাওয়া আর হলো না, সুশীলেরা নৌকোয় উঠে পড়লো। পুলিশ তখন গুলি ছুঁড়তে শুরু করেছে, ওরাও গুলি ছুঁড়ে তার উত্তর দেয়।
অন্ধকার রাত। গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে ডাকাতরা পালিয়ে গেল ঠিকই। কিন্তু এরই মধ্যে দারুণ একটা দুঃখের ঘটনা ঘটে গেল। দুরন্ত সাহসের সঙ্গে সুশীল আর তার দু—তিনজন বন্ধ গুলি ছুঁড়ছে পুলিশের দিকে। হঠাৎ এক সময় সুশীলের পাশেই যে বন্ধুটি দাঁড়িয়েছিল তার পা পিছলে গেল। সে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতেই তার হাতের পিস্তলটা ঘুরে গেল উল্টোদিকে। আর তার থেকে গুলি বেরিয়ে সোজা ঢুকে গেল সুশীলেরই পেটে।
সুশীল ধপাস করে পড়ে গেল জলে। দলের লোকেরা তো হতভম্ব। তাড়াতাড়ি তাকে জল থেকে আবার নৌকোয় টেনে তুললো। সুশীলের তখনো জ্ঞান আছে, কিন্তু সে বুঝে গেছে যে সে আর বেশিক্ষণ বাঁচবে না! যে বন্ধুর হাত ফসকে গুলি লেগেছিলো তার পেটে, তার ওপর সে একটুও রাগ করলো না। বরং কী করে বন্ধুরা পুলিশের হাতে ধরা না পড়ে পালাতে পারবে, সেটাই হলো তার একমাত্র চিন্তা। সে ফিসফিস করে বললো, শোন, আমি জানি, আমি আর বাঁচব না! আমি মরে গেলে তোরা আমার মৃতদেহটা সঙ্গে করে নিয়ে যাস না। তাতে কোনো লাভ নেই, শুধু শুধু নৌকোটা ভারি হয়ে থাকবে। নৌকোটা হাল্কা রাখা দরকার। সেই জন্য আমার মৃতদেহটা জলে ফেলে দিস। তার আগে শরীর থেকে কেটে ফেলিস মুন্ডুটা। দুটো আলাদা জায়গায় ফেলবি। আমার শরীরটা ভেসে উঠলেও পুলিশ চিনতে পারবে না…
এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সুশীল মরে গেল। বন্ধুরা কাঁদতে কাঁদতে সুশীলের কথা মতনই কাজ করলো। তখনো দূরে পুলিশ তেড়ে আসছে। বন্ধুরা নদীর এক জায়গায় একটা বাঁশ পুঁতে তার ডগায় বেঁধে দিল ওর রুমালটা। ওইটুকুই সুশীলের স্মৃতিচিহ্ন।
এই ঘটনা ঘটেছিল আজ থেকে ঠিক সাতষট্টি বছর আগে। ১৯১৫ সালের মে মাসে। তখন সুশীল সেনের বয়স মাত্র তেইশ।
যে ইংরেজ হাকিম সুশীলকে প্রথম বেত মারার শাস্তি দিয়েছিল তার নাম কিংসফোর্ড। এই কিংসফোর্ড সাহেবকে মারবার জন্যই মজঃফরপুর পর্যন্ত তাড়া করে গিয়েছিল ক্ষুদিরাম। তোমরা নিশ্চয়ই শহিদ ক্ষুদিরামের কথা সবাই জানো। না কি জানো না? তাহলে আমি মনে খুব দুঃখ পাবো। না জানলে এক্ষুনি বাবা—কাকার কাছে জিজ্ঞেস করে নাও!