সুরের জাদু – কৌশিক চট্টোপাধ্যায়

সুরের জাদু – কৌশিক চট্টোপাধ্যায়

রাজা

মন্ত্রী

সেনাপতি

বিদূষক

তথ্যমন্ত্রী

যন্ত্র কোকিল

জীবন্ত কোকিল

মিনা

প্রহরী১

প্রহরী২

চালক

ঘোষক

সৈন্যগণ

দর্শকগণ

প্রথম দৃশ্য

[ রাজসভা। রাজামশাই একটা বাঁশিতে সুর তোলার চেষ্টা করছেন কিন্তু ঠিকমতো পারছেন না। রেগে যাচ্ছেন। এই সময় ভয়ে ভয়ে পা টিপেটিপে প্রবেশ করে মন্ত্রী, সেনাপতি আর বিদূষক ]

সকলে। মহারাজের জয় হোক।

[ ওদের দেখে রাজা একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন ]

রাজা। অপদার্থ, অপোগণ্ড, হনুমান, ভোঁদড়, ছুঁচো, ইঁদুর, উঃ। দাঁড়িয়ে আছে দেখো, যেন কেত্তনে যাবে। ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না। কী হল? চুপ করে আছ কেন? জবাব দাও।

মন্ত্রী। মহারাজ, দয়া করে যদি আমাদের অপরাধটা কী-

রাজা। চোপ! ফের কথা!

বিদূষক। ফের কথা কয়োনাকো চুপ করে থাকো।

বলিতে চাহ যাহা মনে মনে রাখো।

রাজা। থামো। আবার জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে অপরাধটা কী। গুরুতর অপরাধ। আমার রাজ্যের কথা আমাকেই চেপে যাওয়া। ইয়ারকি পায়া।

সেনাপতি। মহারাজ, কথাটি কী যদি একটিবার বলতেন।

রাজা। চুপ করো।

[ তথ্যমন্ত্রী আসে বগলে ফাইল নিয়ে ]

তথ্যমন্ত্রী। মহারাজের জয় হোক।

রাজা। এই যে তথ্যমন্ত্রী। বলি তোমার দপ্তরখানা আছে না সগগে গেছে?

তথ্যমন্ত্রী। বলেন কী মহারাজ, আমার দপ্তরে ফাইলের সংখ্যা আট কোটি চুয়াত্তর লক্ষ আটশো বারো।

রাজা। ওই নিয়েই মরো। তা ফাইলে তথ্য আছে না উই ধরেছে?

তথ্যমন্ত্রী। তথ্য তথ্য। ঠাসাঠাসি তথ্য। আলপিন থেকে আলপনা যে বিষয়ে চান সে বিষয়ে তথ্য। যেমন ধরুন আপনি হয়তো জানতে চাইলেন-

রাজা। থাক। জেনে কাজ নেই। যতসব ঘোড়ার ডিমের তথ্য।

তথ্যমন্ত্রী। আজ্ঞে তাও পাবেন।

রাজা। চোপ। (সেনাপতি হাই তোলে বেড়ালের মতন) হাই তুলো না। মুখ বন্ধ। এই হাই তুলে তুলে দেশরক্ষা হয়! আচ্ছা তোমরা বলতে পারো, তোমরা কী করতে আছ? কী করতে অন্ন ধংসাচ্ছ? এত বড়ো একটা ঘটনা, অথচ কেউ কিচ্ছু জানে না! ছিঃ ছিঃ ছিঃ! লজ্জায় আমার ঘুমোতে ইচ্ছে করছে।

তথ্যমন্ত্রী। আমি বলছিলাম যে-

রাজা। এই এক হতচ্ছাড়া তথ্যমন্ত্রী হয়েছে। শুধু কথা আর কথা। শুধু ক ক। তথ্য মানে আলপিন? তথ্য মানে আলপনা? আর কিছু নয়? গান নয়? গান?

সকলে। গান?

রাজা। বাঃ। গান জানো না?

বিদূষক। বাগানেতে কত ফুল হেসে দোল খায়।

লাল নীল সবুজের ছোপা ছোপা গায়।

রাজা। চোপ। গর্দভ। বললাম গান। বুঝল বাগান। সকাল থেকে সন্ধে শুধু ছড়া কেটেই চলেছে-কেটেই চলেছে। যেন তাঁতি বাড়ির চরকা। মন্ত্রী তুমি বলো। আমার রাজ্যে সব থেকে ভালো গান কে গায়?

মন্ত্রী। আজ্ঞে আপনি।

রাজা। মারব এক চড়। তোষামুদি হচ্ছে? নিলডাউন হও। সেনাপতি।

সেনাপতি। আজ্ঞে শোনা হয়নি।

রাজা। কেন?

সেনাপতি। সব সময় যুদ্ধ করছি। গান শুনব কখন?

রাজা। নিলডাউন। বিদূষক!

বিদূষক। কথা সুরে মিশিয়ে গায় লোকে গান।

শুনিলে পরে মন করে আনচান।

[ রাজা তো রাগে একেবারে লাফিয়ে ওঠে ]

রাজা। হাঁদা এক জুটিয়াছে রাজসভা মাঝে।

নামেতে বিদূষক, গর্দভ কাজে।

সকলে। শান্ত হোন মহারাজ।

[ বিদূষক রাজা বলার আগেই নিলডাউন হয়ে যায় ]

রাজা। এক গাঁট্টা মারব। বললাম কে ভালো গান গায়। তা না, মুখ্যুটা ধান ভানতে শিবের গীত গাইতে আরম্ভ করল!

তথ্যমন্ত্রী। মহারাজ, প্রাপ্ত তথ্যানুসারে এরাজ্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী কুমারী উচিশ্রী।

রাজা। কী বিশ্রী?

তথ্যমন্ত্রী। উন্মুককণ্ঠী উচিশ্রী।

রাজা। কী বিশ্রী!

তথ্যমন্ত্রী। উনি আগে ছিলেন রুচিশ্রী। এখন আধুনিক গেয়ে নাম নিয়েছেন উচিশ্রী।

রাজা। সেটা কী বস্তু।

তথ্যমন্ত্রী। আজ্ঞে নাম।

রাজা। নাম রাখলেই হল? এর অর্থ কী?

তথ্যমন্ত্রী। অর্থ নেই।

রাজা। মজা নাকি?

তথ্যমন্ত্রী। আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ। আজকাল অনেক গানের মতো অনেক নামেরও অর্থ হয় না মহারাজ। প্রাপ্ত তথ্যানুসারে শতকরা পাঁচ দশমিক তিন পাঁচ ভাগ নামের অর্থের ক্ষেত্রে দেখা যায় পূর্বনামের তুলনায়….

রাজা। থামবে! লজ্জা। লজ্জা। এরা কিনা রাজকর্মচারী! এদের ভরসায় আমি দেশ চালাই। ছিঃ ছিঃ। দূত-(দূত আসে) সংবাদ বলো। শুনিয়ে দাও।

দূত। বিদেশি পর্যটকদের মতে এ রাজ্যের একটি বিস্ময় একটি কোকিল। তার গান শুনতে মানুষ ছুটে আসে দূরদূরান্ত থেকে। কাঠফাটা রোদ্দুরে ঝড় জলকে উপেক্ষা করে মানুষ মোহিত হতে আসে এর কণ্ঠের জাদুতে।

[ রাজার ইশারায় দূত চলে যায়। পারিষদরা গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসে ]

রাজা। শুনলে? গোমুখ্যুর দল? কী? জবাব দাও।

সকলে। আজ্ঞে মহারাজ। কোকিল তো ঠিক মানুষ নয়। তাই-

রাজা। চোপ। আবার মুখে মুখে কথা। আমার রাজ্যের পাখি। আমার দেশের পাখি বনে বনে মাঠে মাঠে গান গেয়ে বেড়াচ্ছে আর সেসব খবর না রেখে যত অকাজ করে বেড়াচ্ছে? তোমরা শুধু বেতন লহ বাঁটি। রাজার কাজে কিছুই নাহি দৃষ্টি। শোনো তিনদিন সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে পাখি আমার চাই। যেখান থেকে পারো। যেভাবে পারো ওই পাখিকে রাজসভায় হাজির করবে। না হলে সব ব্যাটাকে শুলে চড়াব। এই বলে দিলাম। ভেবেছ শুধু গিলবে (গাঁট্টা) কাজের বেলা ঢুলবে। (চুলের মুঠি) আর আসল কাজ ভুলবে। (পেটে চিমটি) আজ থেকে না চলবে। (গাল রগড়ানি) পান থেকে চুন খসলে পরে, পরশু শূলে চড়বে।

[ রাজা চলে যায়

বিদূষক। কোকিলারে কোকিলা

এ কী গান গাহিলা

পিলে মোর চমকায়

প্রাণপাখি খাবি খায়।

[ বিদূষক মাথা ঘুরে পড়ে অন্যদের কোলে। আলো নিভে যায় ]

দ্বিতীয় দৃশ্য

[ হালকা আলোয় রাজসভার দৃশ্য পরিবর্তন হয়ে যায় বনের দৃশ্যে। ভোরের আলো গায়ে মেখে কোকিল তখন গান গাইছিল মনের সুখে ]

কোকিল। কণ্ঠে আমার গান

জুড়াই সবার প্রাণ।

সেইটুকুনই পাওয়া।

নেই তো কোনো চাওয়া।

[ এমন সময় জাল, ফাঁদ, লাঠি, সড়কি নিয়ে রাজার লোকজন প্রবেশ করে ]

সকলে। জোরসে চল চলরে।

আরও জোরে চলরে।

পা মিলিয়ে চলরে।

কোকিলটাকে ধররে।

ওই যে-ধর ধর ধর ধর ধর …

হায় হায় এ কী হল

কোকিলটা যে উড়ে গেল!

থামলে পরে চলবে না।

চলবে না ভাই চলবে না।

রাজার আদেশ মানতে হবে।

নইলে শূলে চড়তে হবে।

বেঘোরে যে মরতে হবে।

ওই যে-ধর ধর ধর ধর ধর …

[ সবাই মিলে চেপে ধরে কোকিলকে ]

এই মরেছে! কোকিল কোথায় এ যে বিদূষক।

হায় হায় এ কী হল

এবারও যে উড়ে গেল!

বিদূষক। কোকিলারে কোকিলা

কোন গাছে বসিলা।

নেমে আয় বাবারে।

প্রাণটুকু বাঁচারে।

[ সবার তখন বেদম অবস্থা ]

সেনাপতি। নাঃ। আর আশা নেই। কোকিলা কি সেনাপতি, এক ডাকেই হাজির!

তথ্যমন্ত্রী। মন্ত্রীবর। প্রাপ্ত তথ্যানুসারে ব্যর্থতাই কিন্তু সাফল্যের স্তম্ভ। ফল নয়। প্রচেষ্টাই তো আসল।

মন্ত্রী। সে তো আমি বুঝলাম ভাই। রাজা কি তা শুনবে!

বিদূষক। ঠিক তিনদিন গুণবে।

তারপর কান মুলে

চড়িয়ে দেবে শূলে।

[ এমন সময় গান গাইতে গাইতে ছোট্ট মেয়ে মিনা আসে ]

মিনা। কণ্ঠে আমার গান।

জুড়াই সবার প্রাণ।

সেই টুকুনই পাওয়া।

নেই তো কিছু চাওয়া।

মন্ত্রী। এই মেয়ে, শোন শোন। কী নাম তোর?

মিনা। মিনা।

তথ্যমন্ত্রী। এই গান তুই কোথা থেকে শিখলি? এ তো কোকিলের গান।

মিনা। শিখিনি তো। শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গেছে।

বিদূষক। কার কাছ থেকে শিখলি মা তাড়াতাড়ি বল না।

মিনা। আমার একটা বন্ধু আছে। কোকিল সোনা। রোজ সকালে আমি যখন কাজে যাই-

সেনাপতি। কাজে? এতটুকু মেয়ে তুই আবার কী কাজ করিস?

মিনা। বারে! লোকের বাড়ি বাসন মাজি না তিন বাড়ি। আগে অবশ্য মা-ই সব করত। কিন্তু সেই যে মা বিছানায় পড়ল আর উঠতে পারে না। তাই আমাকেই সব করতে হয়।

[ বাইরে কোকিলের সুর শোনা যায় ]

ওই তো বন্ধুর গলা। কী সুন্দর লাগে। রোজ সকালে বন্ধু আমায় গান শোনায়। শুধু আজ সকালেই দেখলাম না। কোথায় গিয়ে মরেছে কে জানে। আচ্ছা তোমরা এত লাঠিসোটা নিয়ে এসেছ কেন গো?

সেনাপতি। তোমার বন্ধু ওই শয়তান কোকিলটাকে ধরতে।

মিনা। ওমা, সে কী কথা!

মন্ত্রী। না মা, না। ধরতে নয়। নেমন্তন্ন করতে এসেছি। রাজবাড়িতে জলসা হবে। তাই রাজামশাই আমাদের পাঠিয়েছেন তোমার বন্ধুকে নিয়ে যেতে।

মিনা। কিন্তু বন্ধু তো বনে ছাড়া আর কোথাও গান গায় না। ও কী বলে জানো? বন্ধু বলে-ডালে বসে দুলতে না পারলে নাকি ওর গানই মনে আসে না।

মন্ত্রী। তাহলে আর কী করা। শুধু একটিবার যদি তোমার বন্ধুর গান শুনতে পেতাম।

মিনা। এ আর এমনকী? তোমরা শুনবে বন্ধুর গান?

মন্ত্রী। লক্ষ্মী মেয়ে, একটিবার নিয়ে চলো না তোমার বন্ধুর কাছে।

মিনা। শোনো, তোমাদের কোথাও যেতে হবে না। ওসব লাঠিসোটাগুলো সরাও তো আগে। ওগুলো আমার বন্ধুর দু-চোখের বিষ। বন্ধু বলে যাদের মাথা মোটা তারাই কথায় কথায় লাঠি ঘোরায়। তোমরা এক কাজ করো। ওই ঝোপের পেছনে লুকিয়ে পড়ো। আমি বন্ধুকে এখানে নিয়ে আসছি।

[ সবাই লুকিয়ে পড়ে ঝোপঝাড়ের আড়ালে ]

মিনা। ওরে বাবারে কত বড়ো সাপ! বন্ধু-বাঁচাও। বন্ধু তুমি কোথায়?

[ কোকিল আসে ]

কোকিল। কী হয়েছে? কী হয়েছে?

মিনা। হিঃ হিঃ হিঃ -ঠক ঠক ঠক ঠকালাম।

কোকিল। শুধু বদমাইসি বুদ্ধি, না!

মিনা। সকালে কোথায় গিয়েছিলে?

কোকিল। আর বোলো না। সেই সকাল থেকে বনে ঘুরছে এক দঙ্গল বিশ্রী লোক। আমাকে ধরার জন্য জালি এনেছে কত। অনেক কষ্টে ফাঁকি দিয়েছি।

মিনা। তুমি বন্ধু জানো? ওরা তোমায় জলসায় গান গাইবার জন্য নেমন্তন্ন করতে এসেছে।

কোকিল। তুমি বললে না আমি বনে ছাড়া গান গাই না।

মিনা। সে তো বলেইছি। সকালের গানটা পাওনা আছে। শোনাও দেখি তাড়াতাড়ি। মায়ের আবার বাড়াবাড়ি।

কোকিল। ছোট্ট মেয়ে মিনা

বন্ধু আমার জেনো-

গান গাই মনের আনন্দে

বেচি না কোনোদিনও।

[ ওরা যখন মনের আনন্দে নাচছে, ঠিক তখনই আড়াল থেকে পা টিপেটিপে বেরিয়ে এল রাজার লোকজন। সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ল কোকিলের ওপর মিনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে। কোকিলকে বেঁধে কাঁধের উপর তুলে চলে গেল যুদ্ধ জয়ের ভঙ্গিতে। মিনা তখন একা একা কাঁদছে। আস্তে আস্তে আলো কমে গেল ]

তৃতীয় দৃশ্য

[ কারাগারে বন্দি কোকিল। সড়কি হাতে পাহারা দিচ্ছে একটা বেঁটে আর একটা লম্বা লোক। কোকিল কাঁদছে ]

১ম। এই, ওই ছিঁচকা৺দুনি বন্ধ কর।

২য়। সেই তখন থেকে নাকি কান্না কেঁদেই চলেছে। কেঁদেই চলেছে। চোপ। দেব যখন পেটের মধ্যে সড়কি চালিয়ে-

কোকিল। তোমরা আমাকে খাঁচায় বন্দি করেছ কেন?

১ম। করব না! যদি পেইলে যাও।

২য়। যদি কেটে পড়ো। আমরাও তো কাটা পড়ব ভাইটি।

১ম। তুমি বাবা লোক তো সুবিধার নও, সকাল থেকে কী দৌড়ঝাঁপটাই না করালে এতগুলো লোককে।

কোকিল। তোমরা আমায় একটা কথা বলো।

২য়। চোপ। বলছি না, কোনো কথা নয়, যাও চুপটি করে শুয়ে পড়ো।

কোকিল। শুধু একটা কথা বলো আমাকে ধরে আনলে কেন? আমিতো তোমাদের কোনো ক্ষতি করিনি।

১ম। এ ক্যাবলটা কী র্যা? এ কথাটা জানো না? রাজামশাই তোমার গান শুনবেন।

কোকিল। আমি বনে ছাড়া কোথাও গান গাই না।

২য়। অ্যা হ্যা-হ্যা! হাতিঘোড়া গেল তল আর মশা বলে কত জল!

১ম। কোথাকার এক কেলেকুচ্ছিত দু-পয়সার গায়ক, বলে কিনা রাজসভায় গান গাইবে না। আস্পর্ধা দেখেছ।

২য়। তাই না তাই। ওহে জানো? কত বড়ো বড়ো সব রেকড করা সিনিমার গান গাওয়া গায়ক-গায়িকা রাজামশাই একবার ডাকলেই না-

১ম। রাজামশাই কেন, মন্ত্রীমশাই-

২য়। হ্যাঁ। মন্ত্রীমশাই যদি একটি বার ডাকেন-

১ম। মন্ত্রীমশাই কেন সেনাপতি-

২য়। হ্যাঁ। সেনাপতি যদি-

১ম। সেনাপতি কী দরকার। আমরা আমরা-

২য়। হ্যাঁ। আমরা যদি একবার তুড়ি দিই না, তবে সব গড়াতে গড়াতে এসে গান গেয়ে যাবে। আর সেসব কী গান! তোমার মনে আছে ওই গানটা, ‘রাজা ভালো’, গাওতো-

১ম। রাজা ভালো রানি ভালো।

এদেশের সব ভালো।

জামা ভালো জুতো ভালো।

পায়ের তলার ধুলো ভালো।

রাজার নাকের সর্দি ভালো।

রানিমার বুদ্ধি ভালো।

প্রহরীর চাবুক ভালো।

ভালো ভালো সব ভালো

ভালো ভালো ভালো ভালো

ভালো ভালো ভালো ভালো …

কোকিল। চুপ করো। এ কি গান নাকি?

২য়। অ্যাই খবরদার। যা বোঝ না, তা নিয়ে কথা বলবে না।

১ম। তোমার সাহস তো কম নয়। তুমি রাজকর্মচারীদের গান শেখাচ্ছ। কাল সকালে তোমাকেও গাইতে হবে এই গান।

কোকিল। না কিছুতেই না। আমি গাইব না গান।

২য়। চোপ। পিটিয়ে খণ্ডত ত বানিয়ে দেব।

কোকিল। আমাকে মেরে ফেললেও গাইব না।

১ম। ওরে হাঁদা, নিজের ভালো বুঝলি না বাপ।

২য়। এখনও গুছোতে শিখলি না।

১ম। গান গাইলে মালা পাবি।

২য়। মন্ডামিঠাই লুচি পাবি।

১ম। থাকার জন্য মহল পাবি।

২য়। হিরে বসানো জামা পাবি।

কোকিল। চাই না। কিচ্ছু চাই না। আমার খাঁচা খুলে দাও। আমি চলে যাব।

১ম। আবদার আর কি!

কোকিল। আমি তো বলেই দিয়েছি। না গাইলে কী করবে তোমরা?

১ম। কিচ্ছু না। কিচ্ছু না। রাজার বাগানের ফল চুরি যাচ্ছে রোজ। কে সেই চোর?

২য়। ওই কোকিল।

১ম, ২য়। অতএব কারাদণ্ড। কারাদণ্ড। কারাদণ্ড।

২য়। রানির নাকের নাকছাবি পাওয়া গেছে কোথায়?

১ম। ওই কোকিলের বাসায়।

১ম, ২য়। অতএব কারাদণ্ড। কারাদণ্ড। কারাদণ্ড।

কোকিল। না। এ মিথ্যে। অন্যায়। এ অবিচার!

১ম, ২য়। বাজে কথা বোলো না। আমাদের মহারাজ কাউকে বিনা বিচারে আটকে রাখেন না। (ঢং ঢং করে ঘণ্টা পড়তে থাকে) চলো খেয়ে আসি।

[ ওরা চলে যায়

কোকিল। কে আছ? শোনো। আমার খাঁচার দরজা খুলে দাও। শুনতে পাচ্ছ? আমার খাঁচার দরজা খুলে দাও। আমি বনে ফিরে যাব। শোনো, শুনতে পাচ্ছ…

[ কোকিল চিৎকার করে কাঁদে। খাঁচা ভাঙার চেষ্টা করে। আলো কমে যেতে যেতে অন্ধকার ]

চতুর্থ দৃশ্য

[ মঞ্চের এক কোণে একজন ঘোষক ঘোষণা করে ]

ঘোষক। ঘোষণা ঘোষণা ঘোষণা। আগামীকাল সন্ধ্যায় রাজসভায় এ রাজ্যের গায়ক কোকিলের সঙ্গে বিদেশ থেকে আগত যন্ত্রকোকিলের গানের লড়াই হবে-এ। এই সভায় মহারাজ শ্রেষ্ঠ গায়ক নির্বাচন করবেন- ঘোষণা ঘোষণা ঘোষণা….এ…

[ আলো কমে আবার জ্বলে। রাজসভা জমজমাট। পাত্রমিত্র সাধারণ দর্শক কে না নেই? এককোণে যন্ত্রকোকিল। এখান-ওখান থেকে ঝুলছে তার। পোশাকও যেন সোনার পাত দিয়ে তৈরি। আর এক কোণে শিকল-বাঁধা জীবন্ত কোকিল। রাজা আসেন গোলাপ ফুল শুঁকতে শুঁকতে ]

সকলে। জয় মহারাজের জয়!

রাজা। এবার তাহলে লড়াই শুরু করে দেওয়া যাক। কী ব্যাপার, দেরি কেন?

তথ্যমন্ত্রী। সেনাপতি আসেনি এখনও।

রাজা। আজও লেট।

বিদূষক। গবেট।

[ সেনাপতি ছুটে আসে ]

সেনাপতি। মহারাজের জয় হোক!

রাজা। কী ব্যাপার, তুমি এত লেটে?

সেনাপতি। আজ্ঞে ঝামেলা হচ্ছিল গেটে। সহজে কি মেটে? তাই আমি লেটে।

রাজা। থাক থাক। মন্ত্রী, শুরু করো।

মন্ত্রী। যথা আজ্ঞা। হে সুধীজন, আপনারা জানেন আমাদের মহারাজের পরম সুহৃদ সাগর পারের মহারাজ। রাজামশাই-এর সংগীত ক্ষুধা নিবৃত্ত করিবার উদ্দেশ্যে এই স্বর্ণখচিত বহুমূল্যবান যন্ত্রকোকিলটি উপহার হিসাবে প্রদান করে বন্ধুত্বের যে নিদর্শন-

রাজা। শেষ। শেষ। বসো। শর্টে বলতে পারো না। শুরু করো।

বিদূষক। আসিয়াছ যারা হেথা শুন দিয়া মন। গানের লড়াই হেথা হইবে এখন।

রাজা। ধ্যাৎতেরিকা, শুরু করে না কেন? চালক, শুরু করো।

[ চালক অমনি খটাখট সুইচ টিপে যন্ত্রকোকিলকে চালায়। টকটক করে হাত-পা নড়তে থাকে যন্ত্রকোকিলের। সে হাঁটতে থাকে। সবাই তো বিস্ময়ে হতবাক। রাজার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয় যন্ত্রকোকিল। মহারাজ যেই হাত বাড়িয়েছেন, মহারাজের হাত থেকে বাঁশি কেড়ে হাত মুচড়ে সে ছুটতে থাকে ]

রাজা। একী! একী! বাঁশি নিয়ে যাচ্ছে-ধর ধর।

[ চালক তাড়াতাড়ি বাঁশি ফেরত দেয়। যন্ত্রকোকিল ঢিসট্যাক করে নেচে চলে ]

দর্শকরা। দেখেছ দেখেছ, ওমা! ওই দেখো নমস্কার করছে। পা-টা কেমন ঘোরাচ্ছে দেখো। হা-হা-হিহি কী কাণ্ড …

মন্ত্রী। মহারাজ, কেমন মাথা নাড়ছে দেখেছেন!

তথ্যমন্ত্রী। যেন পাওয়ার লুমের তাঁত।

বিদূষক। আর নাড়াসনে বাপ

এবার খুলে যাবে দাঁত।

রাজা। কিন্তু এ তো শুধু মাথা নাড়ছে আর হাত-পা ছুঁড়ছে। গান গাইছে কই?

মন্ত্রী। গাইবে মহারাজ, গাইবে। এটা তো সবে ইনট্রোডাকশন।

রাজা। মানে?

মন্ত্রী। মানে ভূমিকা।

রাজা। তাই বলো, চালক, গান চালাও।

[ চালক কীসব সুইচ টেপে আর জোর মিউজিকের সঙ্গে বিকৃত চিৎকারে গান ধরে যন্ত্র কোকিল ]

যন্ত্রকোকিল। ব্যা ব্যা ব্ল্যাক শিপ

হ্যাভ ইউ এনি উল?

ইয়েস স্যার ইয়েস স্যার

থ্রি ব্যাগস ফুল।

[ চালক থামায়। সবাই হাততালি দেয় ]

রাজা। খাসা। বেশ। এবার আসল কোকিল তুমি শোনাও, দেখি কেমন গাও।

কোকিল। না আমি গাইব না। কিছুতেই না।

রাজা। মন্ত্রী, এ বলে কী?

কোকিল। আমি কারো হুকুমে গান গাই না।

রাজা। চোপ। তোমার স্পর্ধা তো কম নয়! তুমি জানো তুমি কার সামনে দাঁড়িয়ে গান গাইছ। দু-পয়সার গায়ক, এত অহংকার তোমার! তোমার মতো হাজারটা গায়ক আমি আমার মুকুটের একটা মোতি দিয়ে কিনে নিতে পারি। মন্ত্রী, ওকে বন্দি করো। ওর দেমাক আমি ঘুচিয়ে দেব।

তথ্যমন্ত্রী। শান্ত হোন মহারাজ। আসলে ইংরেজি গান শুনে ব্যাটা ঘাবড়ে গিয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যানুসারে এমনই হয়।

দর্শকরা। হেরো-হেরো-দুয়ো-দুয়ো।

বিদূষক। হেরেছে হেরেছে, কেলে কোকিল হেরেছে।

যন্ত্র দেখে ঘেবড়ে গিয়ে কেলে কোকিল হেরেছে।

[সেই বিদ্রূপ আর চিৎকারে কেঁদে ফেলে কোকিল। তারপর উঠে দাঁড়ায়। গান ধরে অপূর্ব মিষ্টি কোনো লোকসংগীতের সুরে ]

কোকিল। রাজামশাই, রাজামশাই,

কী করে গান গাই?

রাজসভাতে গাওয়ার মতো

গান যে আমার নাই।

[ চালক রিমোট টেপে। যন্ত্র নাচতে থাকে। কোনো ঝমাঝম বিদেশি গান গেয়ে যন্ত্র থামে ]

কোকিল। রাজা গো মিনতি রেখে-

বনের পাখি বনের কোলে দাও ফিরে যেতে

রাজা গো মিনতি রেখে-

আরে হো-

এদেশের সবই নকল।

হাসি নকল অশ্রু নকল।

এল শেষে সুরও নকল।

আর চকমকানি নকল সুরে

দেখো সব ভুলিল আসল।

রাজা গো মিনতি রেখে-

[ যন্ত্রের নাচগান শুরু হয়। রাজা গলার মালা খুলে যন্ত্রকে দিয়ে বেরিয়ে যান। সবাই হাততালি দেয়। তারপর যন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে নাচতে নাচতে সবাই চলে যায়। কোকিল একা বসে কাঁদে। আলো নিভে যায় ]

পঞ্চম দৃশ্য

[ রাজার শয়ন কক্ষে রাজাকে গান শোনাচ্ছে যন্ত্রকোকিল। চালক রিমোটের সব সুইচ রাজাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে ]

চালক। এই দেখুন মহারাজ। এবার বারো নম্বরের লাল সুইচটা টিপলেই গান থেমে যাবে। অ্যা অ্যা এই-থেমে গেল। আবার চালু করতে গেলে দশ নম্বরের নীলটা। এই দেখুন। ঠিক আছে।

রাজা। এ তো সত্যি অবাক কাণ্ড। তুমি এখানে সুইচ টিপলে ওখানে গান গেয়ে উঠল?

চালক। গান কী বলছেন, নেচে উঠবে। হ্যাঁ। এই দেখুন এই তেরো নম্বরের হলুদটা টিপুন-টিপুন-

[ রাজা যেই টিপেছে সুইচ, অমনি লাফিয়ে উঠে যন্ত্র ছুটতে থাকে এলোমেলো। রাজা তো পড়ে-টড়ে গিয়ে একেবারে যা-তা অবস্থা। শেষে চালক অনেক কষ্টে থামায় ]

রাজা। এ কী কাণ্ড?

চালক। একটু জোরে টিপে ফেলেছিলেন মহারাজ।

রাজা। ও, জোরে টেপা চলবে না। আচ্ছা এমন কোনো সুইচ আছে, যাতে আমি যে গানটা বলব সেইটা গাইবে?

চালক। আছে। শুধু পনেরো নম্বরের সবুজটা টিপে গানটা একবার শুনিয়ে দিতে হবে। তারপর সেই দশ মানে নীলটা। দেখবেন-

রাজা। থাক। তুমি যাও। আমি দেখে নেব।

[ চালক চলে যায়। রাজা একটু গড়িয়ে নেয়। রিমোটটা ভালো করে দেখে। যন্ত্রকোকিলের মাথায় হাত বোলায় ]

রাজা। লক্ষ্মী ছেলে। সোনা ছেলে। একটু আস্তে আস্তে গাইবে কেমন। হাত-পা অত নাড়ালে মৌজ কেটে যায়। সুরটা আর একটু খেলিয়ে-গানটা কী জানো-গান হচ্ছে তুমি আমি সবাই। প্রত্যেকে একটা গান-একটু বাঁশি শোনো। সারে-গা-মা তুলেছি সবে। কেমন, হচ্ছে না? উত্তর দাও না কেন? যাকগে, একটা গান বলি গাও তো। দাঁড়াও, দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে আসি। গানটা কিন্তু বড়ো জবর গেয়েছিল, বলো? কিন্তু ওই যে চ্যাটাং চ্যাটাং কথা-থাকগে শোনো। ও তোমার তো আবার সুইচ না টিপলে শুনতে পাও না। কত যেন বলল? ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে, পনেরোর সবুজটা। ভালো করে শোনো-

রাজামশাই, রাজামশাই,

কী করে গান গাই?

রাজসভাতে গাওয়ার মতো

গান যে আমার নাই।

শুনলে। এবার কত বলল দশ নম্বরের নীলটা।

[ রাজা যেই না সুইচ টিপেছেন অমনি গোঁ গোঁ করে একটা শব্দ হয়। রাজা ব্যাপারটা বোঝার জন্য কাছে যেতেই এক ধাক্কায় তাকে ফেলে বিকৃত স্বরে, সুরে ও উচ্চারণে যন্ত্রকোকিল গাইতে থাকে-রাজামশাই রাজামশাই ]

রাজা। এই চোপ। চুপ করো। কী হচ্ছে। থামো। (রাজা রিমোটটা আছড়ে ফেলে মাটিতে। যন্ত্র থেমে যায়।) মন্ত্রী! মন্ত্রী!

[ মন্ত্রী আসে ছুটে ]

রাজা। বিদেয় করো। এক্ষুনি বিদেয় করো। পুরো অসুর। তালতলা দিয়ে হাঁটে না। বিদেয় করো। হাঁ করে দেখছ কী?

মন্ত্রী। মানে মহারাজ, আপনি তো এই গতকাল ওকে গলায় মালা পরিয়ে দিলেন।

রাজা। আমার ভীমরতি ধরেছিল বুঝলে। না হলে ওর গলায় মালা দিই। আহা গলাখানা কী? যেন হলস্টেন গোরু। ওই গলায় আবার মালা পরেছে। দে আমার মালা ফেরত দে। গান গাইতে পারে না, আবার মালা পরেছে। আমার মালা দে। আমি খেলব না।

[ মহারাজ মালা নিয়ে চলে যান। তথ্যমন্ত্রী, সেনাপতি, বিদূষক আসে পা টিপেটিপে ]

সেনাপতি। কী ব্যাপার মন্ত্রীমশাই? রাজামশাই রেগে চলে গেলেন কেন?

মন্ত্রী। কে জানে ভাই। যন্ত্রকোকিলের গান শুনে বেজায় চটে গেলেন। তাইতেই-

তথ্যমন্ত্রী। প্রাপ্ত তথ্যানুসারে এমনই হয়। নতুন গানের ক্ষেত্রে শতকরা ছিয়াত্তর দশমিক পাঁচ তিন ভাগ অভিজ্ঞতা এইরকম।

মন্ত্রী। থামো তো।

বিদূষক। কোকিলারে কোকিলা

একী গান গাহিলা।

রাজা রেগে উঠিলা

ঘর ছেড়ে চলিলা।

[ এই সময় ভেতরে থালা বাটি ফেলার আওয়াজ হয়। রাজার চিৎকার শোনা যায়-চাই না। কিচ্ছু চাই না। রাজভোগ চাই না। গান চাই। গান চাই ]

মন্ত্রী। রাজা আসছেন। চলো পালাই।

[ সবাই চলে যায়। রাজা আসেন ]

রাজা। কী ব্যাপার? এখানে ধ্বজা কার্তিকের মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও দূর হও। আমার সামনে থেকে বেরোও। এখানে থাকতে গেলে গান গাইতে হবে। গাইবে গান? তুমি কেন বোঝো না আমি গান ছাড়া থাকতে পারি না। খেতে পারি না। ঘুমোতে পারি না। গাও না। একটা গান গাও। তুমি যা চাও তাই দেব, গাও। ও, গাইবে না, গাইবে না গান। এত অহংকার! আমি রাজা, আমার হুকুম তুমি অগ্রাহ্য করো। তবে দেখো তোমাকে আমি ভেঙেচুরে তছনছ করে দেব। তোমার অহংকার আমি ধুলোয় মিশিয়ে দেব-

[ রাজা উন্মাদের মতো মারতে থাকে যন্ত্রকোকিলকে। তারপর ভেঙে ফেলে। ক্লান্ত হয়। আর্তনাদ করে ]

রাজা। আমি গান চাই-সুর চাই। আমাকে গান দাও।

[ বাইরে আসল কোকিলের গান শোনা যায়। রাজা উৎকর্ণ হয়। কোকিল আসে ]

রাজা। কে গান গাও অমন সুরে? কে?

কোকিল। আমি কোকিল, মহারাজ।

রাজা। কোকিল! তুমি এসেছ। আমাকে বাঁচাও। আমি তোমার ওপর অবিচার করেছি। আমি তোমায় অপমান করেছি কোকিল। কিন্তু বিশ্বাস করো। তোমার সুর আমি বুকে করে নিয়ে বেড়াচ্ছি। শোনাবে একটা গান? শোনাও না কোকিল। দু-দণ্ড শান্তি দাও আমাকে। গাও না কোকিল।

কোকিল। রাজা গো আর কেঁদো না।

সকাল- সাঁঝে জগত মাঝে

সুরের ময়ূর বুকে নাচে

কান পেতে সে সুর খোঁজো না।

রাজা গো আর কেঁদো না।

রাজা। এ সুর তুমি কোথায় পেলে কোকিল?

কোকিল। নদীর জলে যখন ঢেউ লাগে, আমি সুর শুনতে পাই মহারাজ। বাতাস দোলায় যখন, বাঁশ পাতায় আওয়াজ ওঠে সরসর, আমি সুর শুনতে পাই মহারাজ। শিউলি পাতা থেকে ভোরের শিশির যখন ঝরে পড়ে ঘাসের ওপর, আমি সুর শুনতে পাই মহারাজ। ভোর হয়ে আসছে, আমি এবার যাই মহারাজ।

রাজা। না। তুমি আমায় ছেড়ে যেয়ো না কোকিল। তুমি যে পুরস্কার চাও আমি তাই দেব। শুধু আমায় ছেড়ে যেও না।

কোকিল। তা কী করে হবে। আপনাদের প্রাসাদে হাঁপিয়ে ওঠে আমার মন। সুর যায় হারিয়ে। বনের বাতাসে যে সুর ওঠে তার দোলাই আলাদা।

রাজা। আমাকে শোনাবে সে সুর?

কোকিল। আপনি কেমন করে শুনবেন! আপনি তো রাজা?

রাজা। আমি চাই না রাজা সাজতে। তুমি আমাকে বনে নিয়ে চলো।

কোকিল। মহারাজ আপনি রাজা। আপনি কেমন করে সহ্য করবেন বনের দুঃখ-কষ্টের জীবন?

রাজা। যত কষ্টই হোক, তোমার গান শুনে আমি ভুলে যাব সব। এই দেখো। এই আমি খুলে ফেলছি আমার রাজবস্ত্র। রাজ অলংকার। এই আমি ছুঁড়ে ফেলছি আমার সোনার পাদুকা। এবারে আমায় নিয়ে চলো। কোকিল শোনো। আমায় ছেড়ে যেয়ো না। কোকিল, কথা শোনো বন্ধু, আমায় ছেড়ে যেয়ো না।

[ রাজা কাঁদতে থাকেন। কোকিল ততক্ষণে চলে গিয়েছিল প্রায় দরজার কাছে। একটু থামে। তারপর রাজার দিকে এগিয়ে আসে। তাঁর চোখ মুছিয়ে দেয়। তারপর তাঁর হাত ধরে হাঁটতে থাকে বনের উদ্দেশে। তখন ভোরের পাখিরা কিচিরমিচির করে স্বাগত জানায় ওদের। পরদা পড়ে যায় ]

(অনুপ্রেরণা: অ্যান্ডারসনের গল্প)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *