সুরা, নারী এবং সেলসের চাকরি

সুরা, নারী এবং সেলসের চাকরি

ক্যাম্পাস প্লেসমেন্টে সেলসে চাকরি পেয় খুবই আনন্দের সঙ্গে খবরটা যখন আমার শ্বশুরমশাইকে সোল্লাসে জানাই, ভদ্রলোক খানিকক্ষণ চুপ থেকে ধরা গলায় জিজ্ঞেস করেন, ‘সেলস ছাড়া আর কোনও প্রফেশন পছন্দ হলো না বাবা?’

প্রৌঢ় মানুষটির মনোকষ্টের কারণ বুঝতে অবশ্য বেশী দেরি হয়নি। সেলসের লোকেদের নিয়ে প্রচলিত ধারণাই হচ্ছে যে এরা আদ্যন্ত মিথ্যাবাদী, ওভারস্মার্ট, দেখানেপনায় অভ্যস্ত, সুরাসক্ত এবং দুশ্চরিত্র! এমন ছেলে জামাই করে কোন শ্বশুরই বা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন বলুন?

প্রথম তিনটি অভিযোগের কারণ অনুমান করা খুব কঠিন নয়। সেলসের চাকরিতে এত বিচিত্র চরিত্রের লোকের সঙ্গে সদাসর্বদাই ডিল করতে হয় যে একটা বাহ্যিক চালাকচতুরতা এসেই পড়ে। বস্তুত অত্যন্ত সহজসরল মাটির মানুষ হলে সেলসে টিঁকে থাকা একটু মুশকিল। এখানে একটু বাগ্বিস্তারের দরকার আছে। প্রচলিত ধারণা হচ্ছে যে সেলসে সফল হতে গেলে এক্সট্রোভার্ট হওয়াটা অন্যতম আবশ্যিক শর্ত। কথাটা আদ্যন্ত ভুল। চালাকচতুর হওয়ার সঙ্গে এক্সট্রোভার্ট বা ইনট্রোভার্ট হওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই, আমার দেখা সবচেয়ে প্রতিভাবান সেলস ম্যানেজাররা প্রায় প্রত্যেকেই খুবই ইন্ট্রোভার্ট। কিন্তু তাঁরা অসামান্য ধীশক্তির অধিকারী, যুক্তিতর্কে তথ্যে তত্ত্বে প্রতিপক্ষকে অনায়াসে ফালাফালা করে দিতে সিদ্ধহস্ত। মোদ্দা কথা তুমি তোমার আইডিয়া সামনের লোকটিকে যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে বিক্রি করতে পারছো কি না তার ওপরে নির্ভর করছে তোমার সফলতা, তার সঙ্গে মিথ্যাকথা বলার বা দেখানেপনার কোনও সম্পর্ক নেই। কারণ অন্যকে টুপি পরাতে পারো কি না সেটা ততটা ইম্পর্ট্যান্ট নয়, তোমাকে টুপি পরাবার যাবতীয় প্রয়াস হেলায় এড়িয়ে যেতে পারছো কি না, সেটাই বিশেষ বিচার্য। কামড়াবার দরকার নেই, তুমি যে ফেঁস করতে পারো সেটা জানান দিলেই হবে। আর মিথ্যাকথা বলে সেলস প্রফেশনে আজ অবধি কেউ টিঁকে থাকতে পারেনি, ইন্টিগ্রিটি বা সততা হচ্ছে সেলসে সফল হওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত। আমার অভিজ্ঞতা বলে ডিস্ট্রিবিউটর ও ম্যানেজাররা সেই সেলস অফিসারকেই একমাত্র পছন্দ করেন যে সৎ, পরিশ্রমী, ডেডিকেটেড এবং কমিটেড। মিথ্যাকথা ধরে ফেলতে ঘাঘু সেলস ম্যানেজাররা একমুহূর্তের বেশী সময় নেন না, প্রতিটি সিনিয়র সেলসম্যানেজার লোকচরিত্র চেনার ক্ষেত্রে বড়বড় সাইকোলজিস্ট ও রাজনৈতিক নেতাকে বলে বলে দশ গোল দিতে পারেন।

পরের দুটো অভিযোগ আকারে প্রকারে ও ওজনে কিঞ্চিৎ গভীর ও সিরিয়াস। প্রতিটি সেলসজীবিকেই পেটের ধান্দায় মাসের অনেকটা সময় ঘরের বাইরে বাইরে কাটাতে হয়। দিনের বেলাটা না হয় মার্কেটে মার্কেটে কেটে যায়, সন্ধ্যেবেলায় হোটেলে ফিরে মানুষটার আর করে কী? এখানে থেকেই অনেকে ধান্যেশ্বরীর কৃপাপাত্র হয়ে পড়েন। তদুপরি মানুষের শরীর বলে কথা, অনেকেরই ইদিকউদিকের প্রলোভনে মতিচ্ছন্ন হতে আর কতদূর? প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, কখন কে ধরা পড়ে কে জানে? তবে তার জন্যে অনেকেরই সংসার কেরিয়ার সব ছারেখারে যেতে দেখেছি। কথিত আছে একটি বিখ্যাত কম্পানীর রিজিওনাল ম্যানেজার একবার শিলং এর হোটেলে এক স্থানীয় বিবাহিতা মহিলার সঙ্গে কিঞ্চিৎ আপত্তিকর অবস্থায় ধরা পড়েছিলেন। যদিও ভদ্রলোক উপস্থিত বিক্ষুব্ধ জনতাকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন যে ওঁরা বৌদ্ধতন্ত্রে ফার্মা”স লাস্ট থিওরেমের প্রয়োগ অথবা ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর ওপরে জাপানের আপেলের সাইজের প্রভাব এইরকম বিষয়ের ওপর খুবই মনোজ্ঞ আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন, অশিক্ষিত ইতর জনতা সে কথায় বিন্দুমাত্র পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। ওই শীতের রাতে, শিলং এর রাস্তায় ভদ্রলোককে টাই পরিয়ে রাস্তায় হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।

আপনারা বোধহয় কথাটা ঠিক বোঝেননি, ভদ্রলোককে শুধুমাত্র টাই পরিয়েই থানায় নিয়ে যাওয়া হয়!

এই লাইনে আরও অনেক অম্লমধুরতিক্তকষায় গল্প এই কলমচি”র জানা আছে, কিন্তু প্রকাশ করতে সবিশেষ ভয় পাচ্ছি বলাই বাহুল্য। একে দিনকাল খারাপ, তার ওপরে কুশীলবরা অনেকেই ফেসবুকে বহাল তবিয়তে বিরাজমান। কোত্থেকে কোথায় কে একটা চিরকুট ছেড়ে দেবে, তারপর সেটা পত্রবোমা হয়ে আমার ইয়েতে আছড়ে পড়ুক, অমন চাইবার মত আহাম্মক আমি নই বাওয়া।

বরং মদ্যপান নিয়ে চারটে ছোট্টখাট্টো গপ্প বলে আপনাদের মনোরঞ্জন করি, ক্যামন? এমনিতেই জাত বেচুবাবু, কাস্টমারের মনোরথগতিতে মলয় সুপবন সাপ্লাই করা ছাড়া আর কিই বা বিশেষ কাজ থাকে বলুন?

ঘটনা এক। পাত্র সদ্য বিয়ে করেছে, চোখে তার রঙিন মধুচন্দ্রিমার রঙ তখনও ফিকে হয়নি, তাহার চোখে তো সকলই নবীন, সকলই বিমল সকলই শ্যামল… এমন সময় সুহাসিনী, সুমধুরভাষিণী, রম্যকপর্দিনী নববধূর কথায় তার মনোজগতে ধেয়ে এলো সে কোন সর্বনাশী ভূমিকম্পের আভাষ? এ কোন সকাল? এ যে ড্রাই ডে”র চেয়েও অন্ধকার..

বিয়ের সবে একমাস হয়েছে, ছুটির দুপুরে দ্বিপ্রাহরিক আহারান্তে দুইজনে কিঞ্চিৎ বুলাদি”র হাডুডু খেলে ক্লান্ত, পরের রাউন্ডের প্রস্তুতি নিচ্ছেন , এমন সময় সেই সুতনুকার পদ্মডাঁটার মতো হাতখানি আমাদের নাটকের হিরোর বুকে উঠে এলো, ‘তুমি মদ খাও? বাবা বললো যে! ছিঃ। ‘

পাত্রের তো হাতে এলইডি! আর কোথায় কি সেটা বললাম না, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পড়ছে, রামোঃ।

পাত্র কিছু বলার আগেই সেই পদ্মপলাশলোচনা মহিলাটি তাঁর বিপুল আঁখিদুটি পাত্রের মুখের ওপর এনে বললেন, ‘কথা দাও, এক পেগের বেশি খাবে না। আমার ফ্রেণ্ড শকুন্তলা বলেছে যে দিনে এক পেগের বেশি খেলে মানুষ মরে যায়। তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না? বলো, বলো, বলো যে তুমি এক পেগই খাবে এবার থেকে।’

পাত্রটি চ্যাম্পিয়ন সেলসমহারথী, গাঢ় গলায় উত্তর দিলো, ‘হ্যাঁ প্রিয়ে, এবার থেকে আমি এক পেগই কিনবো, এক পেগই খাবো। ত্বমসি মম জীবং ত্বমসি মম… ‘ ইত্যাদি প্রভৃতি…

এইভাবেই চলছিলো, মহিলাও খুশি ছিলেন, আমাদের গল্পের হিরোও তদ্রূপ। কিন্তু একদিন সব পাখি ঘরে আসে, সব সুখের শেষ হয়। আমাদের হিরো একদিন লওওম্বা ট্যুর শেষে ট্রা লা লা লা টিং টং গাইতে গাইতে ঘরে ঢুকে দেখেন যে গিন্নিমা কালবৈশাখীর মত মুখ করে সোফায় বসে।

ততদিনে বিয়ের চার কি পাঁচ বছর হয়ে গেছে। ষোড়শী ত্রিপুরসুন্দরী এখন ভৈরবীরূপেন অধিষ্ঠিতা। গিন্নির মুখ দেখেই কর্তা মনে মনে প্রমাদ গণলেন, মুখে যদিও মধুহাসিটি অমলিন, ‘কি খবর প্রিয়ে?’

শান্ত গলায় ইস্পাতের ছুরির মত ঠাণ্ডা ধারালো প্রশ্ন ভেসে এলো, ‘কত মিলিলিটারে এক পেগ হয়?’

পাত্র বুঝিলেন যে অদ্যই শেষ রজনী। দাবার বোর্ডে আজ তিনি অভিমন্যুসম একাকী , চারিদিকে প্রতিপক্ষের গজ নৌকো ঘোড়া মিলে সপ্তরথীর অক্ষ্মৌহিনী কমপ্লিট। কিন্তু তিনিও উচ্চঘর, সেলসোরাজার বংশধর। তিনি কি ডরান সখা বিবাহিত বৌয়ে? মসৃণভাবে উচ্চাঙ্গের হাসি বিলিয়ে তিনি বললেন ‘আজ হঠাৎ এ প্রশ্ন?’

চিবিয়ে চিবিয়ে উত্তর এলো, ‘শকুন্তলা ইউ এস থেকে ফিরেছে, আজ দুপুরে বাড়িতে এসেছিল। আমাকে বলে গেছে যে সিক্সটি মিলিলিটারে এক পেগ হয়। আর তুমি…..’ বলে অপরিসীম ঘৃণা সহ একটি নিঃশেষিত পাঁইটের বোতল বিজিতের ছিন্নকন্থাটির ন্যায় তুলে ধরে বললেন, ‘আর তুমি আজ অবধি যে আমাকে বুঝিয়ে এলে এটাই এক পেগ?’

সেই সেলসকুলমার্তণ্ডের খবর জেনে আপনাদের আর লাভ নেই। সে ছোকরা এখন বিলকুল শুধরে গেছে। লেকটাউনের কাছাকাছি কোথাও বউ আর একমাত্র মেয়েকে নিয়ে তার সুখের সোমসার। এসব কথা যেন খবদ্দার তাদের কান অব্ধি না পৌঁছয়, এই বলে দিলাম, হুঁ!

দ্বিতীয় গল্প, এটা আমার স্বচক্ষে দেখা। তখন আমি একটি প্রসাধনী-সামগ্রী বিক্রেতা কম্পানীর রিজিওনাল ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত। প্রথম বছর অকথ্য পরিশ্রমের পর দ্বিতীয় বছরে কিছু ভালো ব্যবসার মুখ দেখেছি। কানাঘুষোয় শুনছি যে সে বছর বেস্ট রিজিওনের অ্যাওয়ার্ড আমাদের কপালে ড্যান্সরত। ফলে ঢাকঢোল পিটিয়ে সেই বছর ইস্টের সেলস কনফারেন্স ফেলেছি রায়চক র‌্যানডিসন ফোর্টে। আহা, অ্যাওয়ার্ড সেরিমনিটাও ত্যামন জমকালো হওয়া চাই কি না?

তা সেই ফাংশন শেষ, আমরা বেস্ট রিজিওনের অ্যাওয়ার্ড পেয়ে নেচেকুঁদে একশা। আমি নিজেও অত্যন্ত প্রীতিভরে কোমর দুলিয়ে আমার দুর্দান্ত নৃত্যশৈলী প্রদর্শন করে আবেগের একশো আট নম্বর মেঘে ভাসছি, এমন সময় দেখি আমাদের ওয়েস্ট বেঙ্গলের এরিয়া ম্যানেজার নেই! মানে অমন মন মাতানো হুল্লোড়ের মধ্যে তিনি জাস্ট গায়েব।

চার পেগ গলাধঃকরণ করেও চিন্তায় পড়ে গেলুম। সে ছোকরাকে আপনারা অনেকেই চেনেন, ”পাটায়াতে পটলকুমার”এর সৌজন্যে। অমন চৌখস ছেলে চট করে আজকাল পাওয়াই যায় না। এই মাগ্যিগণ্ডার বাজারে বউ হারালে বউ পাওয়া যায় রে পাগলা, এরিয়া ম্যানেজার হারালে এরিয়া ম্যানেজার পাওয়া যায় না। আমার চার পেগের নেশা টুক করে নেমে গেলো, আমি টর্চ জ্বালিয়ে ছোঁড়াকে খুঁজতে বেরোলুম।

অবশ্য বেশীদূর যেতে হলো না, রাস্তাতেই তার সঙ্গে আমার মোলাকাত। ছেলের চোখ উস্কোখুস্কো, মাথার চুল খাড়া হয়ে গেছে। ছোকরাকে দেখেই বুক থেকে পাষাণভার নেমে গেসলো, আমি স্নেহভরে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘কি রে ভাই, খুব টেনশনে আছিস নাকি? এই যে বেস্ট এরিয়া ম্যানেজারের অ্যাওয়ার্ড পেলি, তাতেও এই অবস্থা কেন? মাল খাবি ভাই? আয় দেখি, আমার রুমে এখনও হাপ্পবোতল… ‘

সে ছেলে আর্তনাদ করে উঠলো, ‘না বস, তুমি জানো না কি হয়েছে। ঈশান আর হরিকে পাওয়া যাচ্ছে না!’

খানিকটা আশ্চর্যই হলুম, দুজনেই বেঙ্গল টিমের চ্যাম্পিয়ন সেলস অফিসার, ‘তারা মালফাল খেয়ে ইয়ে উলটে পড়ে আছে কোথাও, তাতে তুই এত চিন্তিত হচ্ছিস কেন?’

‘বস, তুমি ওদের চেনো না। দুটোই সকালে বিয়ার দিয়ে দাঁত মাজে, হুইস্কি দিয়ে রাত্রে মুখ ধোয়। মদ খেলে দুটোরই কোনও হুঁশ থাকে না। সারা তল্লাট খুঁজে খুঁজে পেলাম না, মালদুটো যদি গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে থাকে?’

‘মানে?’ এবার আমারই মাথার চুল খাড়াখাড়া হয়ে যায়, ‘খামোখা ওরা মাল খেয়ে গঙ্গায় ঝাঁপাতে যাবেই বা কেন? হোয়াই? আন্সার মি’।

‘আরে বস, তুমি জানো না, দুটো পগেয়ামার্কা পাজির পাঝাড়া, প্পুরো বিষ মাল। গতবার দোলের সময় তো তুমি ট্যুরে গেসলে। আমরা নিজেদের মতো করে অফিসে দোল খেলছি, এমন সময় হঠাৎ দেখি দুটোতেই হা রে রে রে করে তেড়ে গিয়ে রাস্তায় হেঁটে যাওয়া এক মাড়োয়াড়ি মহিলাকে রংফং মাখিয়ে… উফ সে কী হুজ্জোতি.. তোমাকে তো বলিনি। তারপর মহিলার কাছে হাতেপায়ে ধরে ক্ষমাটমা চেয়ে কোনওমতে সেট তো করলাম। ও মা, তারপর দেখি দুজনেই একটা রোগাভোগা বেওয়ারিশ বলদ পাকড়েছে, আর তারপর তার পিঠে চড়ার সে কী মরণপণ চেষ্টা! পিছলে পিছলে পড়ে যাচ্ছে, আর রাস্তায় গড়িয়ে পড়েই বলছে জ্জ্যায় সিয়ারাম। তারপর…’

আর তারপর শোনার অবস্থায় আর ছিলাম না। ধরা গলায় বললাম, ‘হ্যাঁ রে, এসব তো আগে বলিসনি। তা তারা কোথায় যেতে পারে বলে তোর মনে হয়?’

চোখমুখ লাল করে সে ছোকরা বললো, ‘বলা যায় না। মালমূল খেয়ে ফোর্টের সাইড থেকে গঙ্গায় ঝাঁপালেই বা আটকাচ্ছে কে? আশিস ঝা বললো ও না কি স্বকর্ণে শুনেছে যে আজ দুজনের মধ্যে বাজি ধরাধরি হয়েছে, রাতে মাল খেয়ে গঙ্গায় নেমে সাঁতরে যে ওপারে উঠে, কোলাঘাটের থার্মাল পাওয়ার স্টেশনের চিমনির মাথায় নিজের জাঙিয়া টাঙিয়ে আসতে পারবে, তাকেই অন্যজন মর্দ বলে মেনে নেবে।’

শুনে, আমারই শুকিয়ে গেলো। মানে বুক। সেলস কনফারেন্সে এসে টীমের ছেলে গঙ্গায় ডুবে গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটলে কী পরিমাণ স্ক্যান্ডাল ছড়াবে ভেবেই আমার নেশার অবস্থা চমকে চোদ্দ। চমকে চমচম বললেও চলে। আমি কাতর কণ্ঠে বললুম, ‘চল ভাই, আমিও খুঁজি।’

যাঁরা কখনও রায়চক র‌্যাআডিসন ফোর্টে গেছেন তাঁরা জানেন যে মেন বিল্ডিঙের পেছনে একটা নরম ঘাসে ছাওয়া একটি বিস্তীর্ণ মাঠ আছে। তার মাঝখান দিয়ে ছোট্ট একটি নালা বয়ে গেছে, তার ওপরে একটি রূপকথা সাইজের সাঁকো। রাতের বেলা জায়গাটি ভারী মনোরম দেখায়। আমরা দুইজনে ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশপাথর স্কীমে আহিড়ি পিহিড়ি করে এসে দূউউর থেইক্যা দেহি ঘাসের উপর শুয়্যা আছে কেডা রে?

আর কে? দুই মক্কেল দেখি হাসি হাসি মুখে চিৎপাত হয়ে শুয়ে নির্মল আকাশ অবলোকন করছেন। সুজন, বেঙ্গলের এএসএম গিয়ে আগেই ডান পা তুললো কোনও একটার গলায় তুলে দেবে বলে। তারপর কি মনে হতে পা”টা নামিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বললো, ‘কি বে *তু* রা, এখানে শুয়ে শুয়ে কি আকাশের তারা গুণছিস নাকি বে?’

দুই স্যাঙাতের কোনও একজন ঠেঁটে একটা শেয়ানা মার্কা হাসি ঝুলিয়ে বললো, ‘ গুউউ, আকাস্টাম্মাইরি হেবিব্লু দেকাচ্চে, তুমিওসুয়ে পড়ো..মেয়াজটা একদমসরিফ হয়ে যাবে।’

শুনে আমিই ওদের কারো একটার কোথাও পা তুলে দিতে যাচ্ছিলাম। তার অবশ্য দরকার হলো না, সুজন নীচু হয়ে দুটোকেই নড়া ধরে দাঁড় করালো, তারপর দুটো ক্যাঁৎ করে লাথি মেরে বললো ‘চুপচাপ ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়বি। যদি বেগড়বাঁই দেখেছি, কাল সকালে দুটোকেই কান ধরে তুলে গড়িয়াহাটে মার্কেট ভিজিটে পাঠাবো, মনে থাকে যেন।’

তারপর সেই চাঁদনি রাতে দুটোয় যখন টলমল করতে করতে একে অন্যকে জড়িয়ে হাডা মাল্লে, দেখে মনে হলো দুটো রোগাসোগা গরিলাই যেন মহুয়া খেয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে।

তারপর সেইখানে দাঁড়িয়ে মিনিট দশেক ধরে আমি আর সুজন আধুনিক যুবসমাজের ওপর মদ্যপানের কুফল এবং তজ্জনিত কারণে সমাজের সার্বিক অবক্ষয় সংক্রান্ত একটা ছোটখাটো সেমিনার সেরে নিলাম। সুজন পকেটে করে একটা বিপি”র পাঁইট এনেছিল, সেইটে খেতে খেতে! তারপর বোতলটা ছুঁড়ে দিয়ে দুজনেই হোটেল বিল্ডিং এর দিকে রওনা দিলুম।

তারপর রাস্তায় এক বিদেশিনী সুতনুকাকে দেখে সুজনের আবার স্বভাবজাত আলাপপ্রিয়তা উসকে উঠলো, ছোকরা বেশ রমনীমোহন হাসি ঠেঁটে ঝুলিয়ে, ‘হ্যাল্লো ম্যাডাম,নিউ ইন ইণ্ডিয়া’ বলে খেজুর করতে গেলো। সুতনুকা জাস্ট পাত্তা দিলেন না। ছোকরা বেজার মুখে ফেরত এসে আমাকে আধুনিক বিদেশী সভ্যতার হিংস্র অবক্ষয় নিয়ে নাতিদীর্ঘ নিয়ে ছোটখাটো ভাষণ দিতে দিতে সিঁড়ির কাছে এসে দুজনেই বাক্যিহারা!

এসে দেখি সেখানে সেই দুই মক্কেল যে সতর্কতার সঙ্গে সিঁড়ির রেলিং ধরে ওপরে ওঠার চেষ্টা করছেন তার সঙ্গে একমাত্র তুলনীয় মাইনশোভিত যুদ্ধক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত কম্যান্ডোবাহিনীর শঙ্কিত পদচারণা! আর তো আর, দেওয়ালের টিকটিকি গুলো অবধি সেই বিচিত্র কুচকাওয়াজ দেখে হাঁ করে অবলোকয়মান! আর পা যে রেটে টলছে সে আর কহতব্য নয়। সিঁড়ি বেচারার যদি কোনও হুঁশপর্ব থাকতো, সে ব্যাটা পাক্কা উঠে এসে এই দুই মক্কেলের কানের গোড়ায় ঠাটিয়ে দুটো থাপ্পড় মেরে বলতো, ‘বাঁ., গুছিয়ে হাঁটতে পারো না, সিঁড়ি চড়তে এয়েচো?’

কিন্তু আমরা যেটা দেখে সম্পূর্ণ বাকরহিত হয়ে গেলাম সেটা হচ্ছে তাদের প্রত্যেকের বগলে ছলছলায়মান দুটি পাঁইটের বোতল! যাতে সে দুটি পড়ে ভেঙে না যায় তার জন্যেই এত উতরোল, এত সশঙ্ক পদবিক্ষেপ !

আমরা স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি, এমন সময়ে দুই মক্কেল টুলটুল করে হাঁটতে ফার্স ফ্লোরে পৌঁছলো। ওদের রুমও ওই ফ্লোরেই, ল্যাণ্ডিং এর পাশেই। আমরা দ্রুত সেখানে পৌঁছে দেখি একজন কী কার্ডের বদলে ওয়ালেট থেকে ক্রেডিট কার্ড বার করে অত্যন্ত মন দিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করছে, অপর জন দুবগলে দুটি পাঁইট হস্তে দণ্ডায়মান। তার অষ্টাবক্র দেহবল্লরীতে এক অদ্ভুত প্রসন্নতার আমেজ, মুখে শ্রীচৈতন্য মার্কা এক ভাববিহ্বল হাসি। আমাকে দেখে বিলোল মদির কটাক্ষে খ্যাঁক করে হেসে সে বললে, ‘ গুউউ, কেমন আছেন, খওরটওর সব ভাও?’

চণ্ডীদাস কহে নবপরিচয় কালিয়া বঁধুর সনে!

দুটোকে ওখানেই বলি দেবো নাকি উল্টো করে সারারাত ঝুলিয়ে রাখাটাই ঠিক হবে এসব ভেবে ওঠার মাঝেই দেখি আমার গলা থেকে আর্তচিৎকার বেরিয়ে এলো, ‘ তোরা আবারও খাবি? এর পরেও?’

রুমের সামনে দাঁড়িয়ে ভুবনমোহিনী হাসি হেসে দুই মক্কেল আমাকে বললো, ‘গুউউ, তুমিইই তো বয়েচিলে, ওয়ান ফদ্দ্যা রোড!’

ঘরের চৌকাঠ থেকে বিছানা অবধি রাস্তার দৈর্ঘ্য কত কিলোমিটার সুপর্ণা? সে রাস্তা কতদূর?

বলতে বলতে হঠাৎ মনে পড়ে গেলো মিশ্রাজীর কথা। আমার চাকরির প্রথম দিকে ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ। ইচ্ছে করেই পিতৃদত্ত আসল পদবীটি চেপে গেলাম, কার মনে কী আছে সে তো বলা যায় না। সে যা হোক, মিশ্রাজী যে অতি ভালো মানুষ ছিলেন, তাতে সন্দেহ নাস্তি। দোষের মধ্যে ভদ্রলোক বড় প্রেম বিলোতে ভালোবাসতেন। সেই প্রথম শতাব্দীতে মানুষকে ভালোবেসে ক্রুশকাঠে আত্মবলিদান দেওয়া মহামানবটি, আর নবদ্বীপের পথে পথে হরিনামে মাতোয়ারা হয়ে আচণ্ডালে কোল দেওয়া যুবকটি ছাড়া এমন সার্বিক প্রেমোন্মাদ মানুষ পৃথিবীর ইতিহাসে কমই এসেছেন। তবে কিনা মিশ্রাজী ভবভূতির লেখা আদ্ধেকটা বিশ্বাস করতেন, লিমিটেড টাইম আর বসুধা বিপুল, অতএব উনি ব্যাপারটা বেশী ছড়াননি, মহিলামহলের মধ্যেই ব্যাপারটা সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। মুশকিল হচ্ছে এই প্রেমাকুল ভদ্রলোকটি বিশ্বাস করতেন জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা, প্রেম করতেন প্রায় ফিবোনাচ্চি সিরিজে। কুলোকে বলতো পাটনা শহরে ড্যুরেক্সের ব্যবসার নেট প্রফিটের অনেকটাই মিশ্রাজীর পকেট থেকে আসে। তবে কুলোকে মুক্তকণ্ঠে এও স্বীকার যেতো যে, ড্যুরেক্স নামের আবেগরোধী ব্র্যা।ণ্ডটি না থাকলে মিশ্রাজীর ”কর্মক্ষম সময়ের” মধ্যে বিহারের জনসংখ্যার ওপর যে আশঙ্কাজনক চাপ পড়তো, তা সামলাবার জন্যে সঞ্জয়-গান্ধী ছাড়া পথ ছিলো না! আমি শুধু সত্যের খাতিরে স্বীকার করতে বাধ্য যে এই প্রাচীন অরণ্যের প্রবাদ আমি সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করি। কারণ স্বচক্ষে দেখেছি যে মিশ্রাজীর প্রথমা কন্যাটি যখন কলেজে পাঠরতা, তখন মিশ্রাজীর নবতমা বান্ধবীটি প্রথমা কন্যার থেকে মাত্র দুই বছরের বড়!

গোলমাল হলো যেদিন মিশ্রাজীর বড় মেয়েটির গ্র্যা জুয়েশন পাশের উপলক্ষে তাঁদের ভদ্রাসনে ছোট একটি পার্টির আয়োজন করা হয়। মিশ্রাজী তাঁর নৈমিত্তিক অভিসার সেরে, বাবার কেনা ল্যামব্রেটা স্কুটারে চড়ে চিৎকোহরা থেকে কঙ্করবাগস্থ নিজ আলয়ে ফিরছিলেন।ঐতিহাসিকদের মতে সেদিন ছিলো ঘোর অমাবস্যা আর দিনের বেলা পাটনা শহরে ”গোবর বিকাস রেইলি” বা এইজাতীয় কিছু র‌্যা লী ছিলো। অথবা মিশ্রাজীর মনে স্ফূর্তি কিছু বেশী হয়ে থাকবে, মোটমাট রাস্তায় পড়ে থাকা গোবরে স্কুটারের চাকা স্কিড করে মিশ্রাজী খুবই অনিচ্ছাপূর্বক পাটনা মেডিক্যাল কলেজে নিজের শ্রীচরণদ্বয়ের ধূলো দিতে বাধ্য হলেন!

আর সেইদিনই একটু রাতে খবর পেয়ে মিশ্রাজীর যাবতীয় বান্ধবীরা এবং মিশ্রাজীর অর্ধাঙ্গিনী একইসঙ্গে হাসপাতালে এসে উপস্থিত হন!

খুব সম্ভবত হাউণ্ড অফ বাস্কারভিলসেই শার্লক হোমসের জবানীতে আর্থার কোন্যান ডয়েল বলেছিলেন, যার জন্যে পৃথিবীর একটি নারীও চোখের জল ফেলে না, তার মত দুর্ভাগা আর কেউ নেই। মহামতি ডয়েল এইটে বলে জাননি যে যার জন্যে কম করে জনা তিরিশেক নারী একই সঙ্গে চোখের জল ফেলতে হাজির হন, তার কী অবস্থা হয়! ভূষণ্ডির মাঠের হালহকিকতের খবর রাখা কেমিস্ট্রি বিশেষজ্ঞ ক্ষণজন্মা ভদ্রলোকটি হয়তো জানলেও জানতে পারতেন!

এখনও পাটনা মেডিক্যাল কলেজে গেলে দেখবেন যে সদর দরজায় সশস্ত্র সান্ত্রীরা অত্যাধুনিক অটোমেটিক রাইফেল হাতে সতর্ক চোখে পাহারা দিচ্ছে, একসঙ্গে অনেক মহিলা ঢুকলে কড়াকড়িটা কিছু বেশিই হয়। এখন আপনি যদি সেই রাতের ঘটনার সঙ্গে এই সতর্ক সাবধানী এন্ট্রি চেকিং এর কোনও কার্যকারণ খুঁজতে চান তো আমি নাচার!

পুরুষ মাত্রেরই বুড়ো হওয়ার দোরগোড়ায় এসে ছ্যেঁকছোঁকানি বেড়ে যায়, এ কথা সর্বনারীবিদিত। কথাটা প্রথম শুনি আমার মেজদির এক বান্ধবীর কাছে। এখানে বলে রাখা ভালো যে আমার বড় হয়ে ওঠাটা সম্পূর্ণ নারীবেষ্টিত, পাঁচজন দিদি আর তিনটি বোনের মধ্যে একমাত্র ভাই হিসেবে বেড়ে উঠলে যা হয়। সেই থেকে মেয়েলি আড্ডা, মেয়েলি কূটকচালি (কথাটা সম্পূর্ণ ভুল। পরনিন্দা পরচর্চায় ছেলেদের উৎসাহ কিছুমাত্র কম না, এ আমি হলফ করে বলতে পারি) এসবে আমার তুমুল উৎসাহ। মেজদির সেই বান্ধবী স্পষ্টই বলেছিলেন যে বাসে ট্রামে যারা মেয়েদের সঙ্গে অসভ্যতা করে তাদের বেশীরভাগই আধবুড়ো পুরুষ। বরং ইয়ং ছেলেপিলেরা তুলনায় অনেক ভদ্র ব্যবহার করে। কথাটা খুব সম্ভবত সত্যি। আমার দেখা যে কটি নারীঘটিত কর্পো-কেলেঙ্কারি আছে, তার সব কটিতেই টপ লেভেলের পঞ্চাশোর্ধ বসেদের নবযৌবনসুলভ ছল্লিবল্লি দেখে কম আমোদ পাইনি। তবে যেটা স্বীকার না করলে নেহাত অন্যায় হবে, সেটা হচ্ছে যে এর প্রতিটি কেসে উল্টোদিকে যে মহিলাটি ছিলেন, এসবের মধ্যে তাঁরও অবদান কিছু কম ছিলো না। কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের অনেকবারই এক্সপ্লয়েটেড হতে দেখেছি, নারীলোভী দাপুটে বসের নির্লজ্জ হিংস্র যৌন আগ্রাসনও দেখেছি। কিন্তু যেখানে পারস্পরিক সম্মতিতে অবাধ লীলাখেলা চলছে সেখানে কেবল একপক্ষকে দায়ী করাটা বোধহয় ঠিক নয়।

কর্পো লাইফে ইন্টুমিন্টু নিয়ে তিনটে প্রায় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে। বারো বছর হয়ে গেলো , এই হাটে করেকম্মে খাচ্ছি। এই তিনটেই দেখলুম। অন্য ইন্ডাস্ট্রির ব্যাপারে জানি না বললেই চলে।

কর্পো লাইফে তিন ধরনের ইয়ে চলে, (১) বসের সংগে, এক্সট্রা সুবিধার বিনিময়ে (২) যৌন হেনস্থা (৩) বহুদিন একসংগে কাজ করতে করতে এক্সট্রা সখ্য গড়ে ওঠে। কখনোসখনো সেটা একটু বেএক্তিয়ার হয়ে পড়ে। প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, কখন কে.. ইত্যাদি ইত্যাদি। ইহাদিগকে আমরা অফিস স্পাউস বলিয়া থাকি।

১. যে কম্পানির কথা বলছি, তখন সে কম্পানি আমি ছেড়ে দিয়েছি। আমারই এক বন্ধু ইস্টে রিজিওনাল ম্যানেজার হয়ে এসেছে। কম্পানি ছাড়লে কি হবে, সেলস অনেকটা আর্মির মতন, ওয়ান্স আ কমান্ডার, অলওয়েজ আ কমান্ডার। তা আমার টিমের লোকজন মাঝেমাঝেই ফোন করে আমার খোঁজখবর নিতো। আমি একদিন জিজ্ঞেস করলুম, নতুন আর এস এম চালাচ্ছে কি রকম? ওপারে যিনি ছিলেন, তিনি খ্যাঁক করে হেসে বললেন, ‘অফিসটা পুরো মধু বৃন্দাবন হয়ে গেলো স্যার’। কেচ্ছাকাহিনী শুনতে আমার চিরকালই হেবি ইন্টারেস্ট। সোৎসাহে বল্লুম ”বল বল, বেশ গুছিয়ে বল তো বাপু”।

খবরে শুনলুম সেই লতুন লতুন রিজিওনাল ম্যানেজারের সঙ্গে নাকি রিজিওনাল এইচ আর এক্সিকিউটিভ বংগললনাটির ভাবভালোবাসা একটু অতিরিক্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। বক্তার দাবি, সে ও তার সংগীরা নাকি একাধিকবার মহিলাটিকে ম্যানেজারের কেবিনে বসে রিজিওনাল ম্যানেজারকে হামি খেতে দেখেছে। যথারীতি আমি গুল বলে উড়িয়ে দিই। তারপর শোনা গেলো সমস্ত আউটস্টেশন মার্কেট ভিজিটে নাকি এইচ আর না গেলে চলছেই না, যদিও সেলস ভিজিটে এইচ আরের কোন কাজই নেই। খবরে আরও প্রকাশ, প্রায়ই নাকি বিভিন্ন হোটেলে রুম বুক করে দুই জনের মধ্যে অত্যন্ত দুরূহ স্ট্র্যাটেজিক আলোচনা চলছে সারাদিন ধরে। মাঝেমাঝে সারা রাত ধরেও!

পাপ আর পেরেম গোপন থাকেনা, ওপন হতে বাইধ্য। ভদ্রমহিলা শেষে স্যাবাটিকাল নিতে বাধ্য হন। এখন ইউ এস এতে বরের কোলে হামি খাচ্ছেন বোধহয়। রিজিওনাল ম্যানেজারটিকে ট্রান্সফার করা হয়।

২. আমার প্রাক্তন কম্পানি, কেভিনকেয়ার। চার বছর আগে যখন জয়েন করি, এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ এইচ আর হেড ছিলেন। সেলস বা মার্কেটিং হেডরা অব্ধি তাকে সমঝে চলতেন। ভদ্রলোক খুবই কাজের লোক ছিলেন সন্দেহ নেই। হঠাত একদিন শুনি তিনি নেই!! না না, দেহ রাখেননি, রেজিগনেশন লেটার রেখেছেন! কি ব্যাপার, চারিদিকে তীব্র কৌতূহল। কিন্তু টপ ম্যানেজাররা সব্বাই মুখ বুজে মৌনীবাবাসুলভ তুষ্ণীভাব অবলম্বন করেছেন। আমার বস,তৎকালীন সেলস হেড, তো আমার ফোন দেখলেই কেটে দিচ্ছেন। অতএব এইচ আরের এক জুনিয়ার ছোকরা কে পাকড়ালুম। সে মাল কিছুতেই কিছু বলে না। শেষে তাকে মিষ্টি দই দিয়ে বোঁদে মেখে খাওয়াবো, এই প্রতিশ্রুতি দিতে ছোকরা মুখ খুলল।

খবরে প্রকাশ, এইচ আর হেড ভদ্রলোকটি নাকি তেনারই ডিপার্টমেন্টের একটি কচি বয়েসী রূপবতী কন্যেকে বহুদিন ধরেই ছুটির দিনে তেনার ফাঁকা ফ্ল্যাটে গিয়ে সম্বর রসম ইত্যাদি খেয়ে আসার ঢালাও আমন্ত্রণ জানাচ্ছিলেন। মেয়েটি সংগত কারণেই এড়িয়ে চলছিল। প্রবলপ্রতাপ এইচ আর হেড, কাকে কি বলবে বেচারি? শেষে এক মন উচাটন বসন্তের বিকেলে ভদ্রলোক এই মেয়েটিকে নিজের কেবিনে ডেকে, খুব সম্ভবত নিষ্পাপ মনেই, শরীরের বিশেষ অংশে স্নেহপূর্বক সুড়সুড়ি দিয়ে ফেলেন। মেয়েটি কথা না বাড়িয়ে সোওওজা এমডি র কাছে (যিনি মালিকও বটে) কেঁদে হত্যে দেয়। মালিক ভদ্রলোকটির সংগে কাজ করেছি অনেকদিন।আদ্যন্ত প্রফেশনাল ভালোমানুষ। তিনি ওইদিনই এইচ আর হেডকে ডেকে রেজিগনেশন নেন। ফিনান্সকে বলেন সমস্ত দেনাপাওনা চব্বিশঘণ্টার মধ্যে মিটিয়ে দিতে।

৩. এইটে বলতে সামান্য সংকোচ বোধ করছি। কারণ এটি আমারই, যাকে বলে ”শাসনামলে” ঘটে।

বিশেষ কিছু না। আমারই অফিসের এক ভদ্রলোক ও এক ভদ্রমহিলা একে অন্যের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত হয়ে পড়েন। দুজনেই অনেকদিন এক সঙ্গে কাজ করেছেন, খুবই এফিশিয়েন্ট। বন্ধুত্ব আগেও ছিল। হঠাত করে দুই জনেই ”বাঁধন খুলে দাও, দাও দাও দাও” করে প্রেমের জোয়ারে ভেসে গেলেন। দুইজনেরই ভরভরন্ত সংসার।

তাতে ব্র্যা ঞ্চ হেড হিসেবে আমার কিছু বলার ছিল না। আমি তো আর কারও মর্যাল সায়েন্সের টিচার নই রে ভাই!! কিন্তু ঘটনা ক্রমেই ঘনঘটা হয়ে উঠতে লাগলো। লোকজন এসে কম্পলেইন করতে লাগলো যে ভালোবাসার যা বহিঃপ্রকাশ এদিকওদিক ছিটকে পড়ছে, তাতে অফিসে কাজ করা দায় হয়ে উঠেছে। আমি নিজেই একদিন দেখি মেন’স টয়লেটে দুজনে খুব মন দিয়ে চুমু খাচ্ছেন। আমি তাও কিছু বলিনি। শোনা গেলো অফিস শেষ হবার অনেক পরেও দুজনে থেকে যাচ্ছেন অনেক্ষণ, আমারই কেবিনের দরজা বন্ধ করে নাকি অনেক শিশিরভেজা গল্পগুজব হচ্ছে, তখনও কিছু বলিনি। কিন্তু একদিন যখন অফিসে এসে, আমার কেবিনে রাখা কালো ভেলভেট মোড়া সোফাটির ওপর কিছু সন্দেহজনক সাদা দাগ দেখতে পেলুম, সেদিন তাকে ঠিক শিশিরের ফেঁটা বলতে মন চাইলো না। ফলে নেহাত বাধ্য হয়েই দুজনকে ডেকে বল্লুম, ভাই,ভালোবাসা তোদের হৃদয়ে রহিল গাঁথা, কালেক্কে রোমিও জুলিয়েট, মীনাকুমারি কামাল আমরোহী, দেব শুভশ্রীর পরেই তোদের নাম নেওয়া হবে।কিন্তু এখনকার মতন তোরা আয়।

ভদ্রলোকটি কেটে পড়েন। মহিলাটি থেকে যান। পরের ঘটনা আর বিস্তারিত বলে লাভ নেই।

এইসব খুচখাচ সব জায়গাতেই থাকে। স্কুলের টিচার, প্রফেসর, এদেরও প্রেম ও পরকীয়া করতে দেখেছি। গ্ল্যামার ইন্ডাস্ট্রিতে পারসেন্টেজ একটু হাই হতে পারে, তবে লোকে শুধুমাত্র শুয়েই ওপরে উঠছে এমন দাবি করা মূর্খামির পরিচয়। তা হলে এদ্দিনে ইচ্ছে করলে সানি লিওনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন, মিয়া খলিফা প্রেসিডেন্ট!!!

সেলসের লোকেদের ব্যাপারে আরও একটা দোষারোপ হলো যে এরা বড় মুখ আলগা, সামান্য বেশিই খিস্তিপ্রবণ। কথাটা যে আদ্যন্ত সত্যি, সে আমি নিজেকে দিয়েই বুঝি। এই খিস্তিপ্রিয়তার সামাজিক তথা মনস্তাত্ত্বিক কারণ আমি জানি না, এসব উঁচু দাগের আলোচনার ঈথারতরঙ্গ আমার মত আদ্যন্ত অশিক্ষিত বেচুবাবুর নলেজ-অ্যান্টেনার অনেক ওপর দিয়ে বয়। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিমতে, সম্ভবত আর্মিসুলভ দলীয় সংবদ্ধতা আর টার্গেট মিট করার মানসিক চাপ এর কারণ, গালাগালি দেওয়াটা প্রেশার কুকারের সিটির কাজ করে। চোদ্দ পনেরো বছর হলো, সেলসের লাইনে আছি, বহু বিচিত্র গালাগালি শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। তবে সেইসব সুভাষিতাবলীর মধ্যে মনে গেঁথে আছে জনৈক চক্রবর্তীবাবুর বাঁধা লব্জ। সেলসের টিম মিটিং হোক বা ডিস্ট্রিবিউটদের সঙ্গে নেক্সট ইয়ারের স্ট্র্যা টেজি নির্ধারণ, সামান্য প্ররোচনাতেই তিনি ভারী উত্তেজিত হয়ে উঠতেন। আর তারপরেই পাঁচফুট উচ্চতার, পঞ্চাশ কিলো ওজনের, বাহান্ন বছর বয়সী গৌরবর্ণ ব্রাহ্মণসন্তানটি ক্রোধভরে কাঁপতে কাঁপতে দক্ষিণহস্তের তর্জনী তুলে রাগী দুর্বাসার স্টাইলে বলতেন ‘আমাকে চেনো না বাঁ*, মার্কেটে আমার নাম শুনে নিও, আমি জাস্ট চোখে দেখে প্রেগন্যান্ট করে দিতে পারি, বুয়েচো? জাস্ট চোখ দিয়ে অ্যামন করে দেখবো আর পেট হয়ে যাবে…আমাকে চেনো না বাঁ…’

নেহাত মহারাজ যুবনাশ্বের পর ভারতবর্ষে আর কোনও পুরুষের গর্ভবান হওয়ার ইতিহাস নেই, তাই অমন ব্রহ্মতেজোময় অভিশাপটি বিফলে গেলো। নইলে অমন অন্তঃস্তল, তথা অন্তঃস্তলপেটভেদী দৃষ্টি কজন অনিচ্ছুক ডিলারই যে ”রোধ” করতে পারতেন তা খোদায় মালুম!

এবার আরেক দাদার গল্প। একবার এক ডিলারের সঙ্গে মীট করতে গেছি, তখন আমি কচি এরিয়া ম্যানেজার, দুনিয়ার হালহকিকত সম্পর্কে নিতান্তই নাদান বললে চলে। সঙ্গে আমার আটান্ন বছর বয়সী এক সেলস সুপারভাইজার। পদানুযায়ী তাঁর অবস্থান আমার একধাপ নীচে হলে কি হবে, সেলসাভিজ্ঞতায় ইনি অফিসে ভীষ্মপিতামহসম মর্যাদা পেয়ে থাকেন। অফিসের টিকটিকিগুলো অবধি আরশোলা ধরার আগে নতমস্তকে দাদার পার্মিশন নিয়ে থাকে বলে অফিসে কানাঘুষো আছে।

তা সেই ডিলার কথঞ্চিৎ কারণে খচে পুরো কেষ্টদা হয়ে ছিলেন। দোষটা আমাদেরই, তাই আমিও যারপরনাই ডিফেন্সিভ মোডে ম্রিয়মাণ ছিলাম। তা আলোচনা চলতে চলতে সেই ডিলারের গোলাবাজী চরমে, আমি ডানকার্কে আটক ব্রিটিশবাহিনীর মতই অসহায় বোধ করছি আর আড়ে আড়ে সেই সেলসশাস্ত্রে অধিরথ পণ্ডিতটির দিকে কাতরস্বরে তাকাচ্ছি, এমন সময়ে দেখি ঝিমুনি ছেড়ে তিনি সজাগ হয়ে উঠলেন। ডিলারের দিকে সরু চোখ মেলে তাকিয়ে বললেন, ‘চ্যাচাঁচ্ছিস কেন?’

কিন্তু ডিলারের মেজাজও সেদিন পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ভোটের আবহাওয়ার মতই গরমাগরম। তিনিও বাছাবাছা ক”টা কুকথা শুনিয়ে দিলেন। আমাদের সুপারভাইজার দাদা ততক্ষণ ধরে একটা দেশকাঠি নিয়ে নিমীলতনয়নে নিজের কান খোঁচাচ্ছিলেন। ডিলারভদ্রলোক সামান্য চুপ করতেই বললেন ‘দ্যাখো সামন্ত, ইয়ে দুটো (এই বলে দুই হাতে গোলাকার কিছু ধরার মতো ভঙ্গি করলেন) যতই বড় হোক, এইটার (বলে ডানহাতের মধ্যমাঙ্গুলিটি অত্যন্ত কনস্পিক্যুয়াসলি বাগিয়ে ধরলেন) থেকে নীচেই থাকে বুঝেছো? তাই কম্পানীর ওপর বেশী রঙ নিও না, ক্যামন?’

আমি আর সেই বাৎসরিক পাঁচ কোটি টাকার ব্যবসা দেওয়া ডিলার মহোদয় দুজনেই স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম এই মহাপুরুষপপ্রবরটির দিকে!

এই ঘটনার প্রায় ছয়বছর পরে গ্যাঙস অফ ওয়াসেপুর নামক অসামান্য চলচ্চিত্রটিতে এমনই একটা ডায়ালগ শুনে সেদিনের সেই মহাপুরুষবাণীর প্রকৃত নিহিতার্থ হৃদয়ঙ্গম করতে সমর্থ হই!

যাক কথায় কথায় অনেকটাই বলে ফেললাম। এবার তৃতীয় গল্প।

আগেই বলে রাখি যে গল্পটা আমার শোনা, আমার প্রত্যক্ষ করা নয়। ফলে কাহিনীটা যিনি বলেছেন তাঁর জবানীতেই শোনা যাক।

‘সেবার আমাদের অ্যানুয়াল কনফারেন্স রাখা হয়েছে আইটিসি সোনার বাংলাতে। সে বছর ইস্ট রিজিওন ভালো ব্যবসা দিয়েছে। ফলে কম্পানীও খুব খুশি, ঢালাও দারুমুর্গী চলছে। শেষে যখন টয়লেটে হিসি করতে গিয়ে দেখলাম আমাদের রিজিওনাল ম্যানেজার আট পেগ মাল চড়িয়ে খুবই নিবিষ্টচিত্তে দেওয়ালের আয়নার গায়ে তোড়ে হিসি করছেন, তখন মনে হলো এবার বাড়ি যাওয়াটা সত্যিই প্রয়োজন।

আমার বাড়ি, তুমি তো জানই, সল্টলেকে। সেদিন আমার পাঁচশো সিসির এনফিল্ডটা নিয়ে এসেছিলাম। আমার এই একশো কুড়ি কিলো ওজনের জন্যে ওই বাইকই ঠিক, দিব্যি মানিয়ে যায়। তা বাইরে এসে একটা সিগারেট খেয়ে বাইক বার করেছি, এমন সময় দেখি আমার টীমের মদনগোপাল, ওরফে মগাই গৌরাঙ্গের মত দুহাত তুলে দৌড়তে দৌড়তে আসছে। আমি তো বাইকে স্টার্ট দিয়ে দাঁড়ালাম। মদনা টলতে টলতে এসে বললো, ‘গুরু, উল্টোডাঙ্গা অবধি নামিয়ে দেবে প্লিজ?’

আমার কেমন যেন বড় মায়া হলো। ছোকরার তিন কূলে কেউ নেই, একাই থাকে। তার ওপর বড় প্রেমপ্রেম বাই আছে, মেয়ে দেখামাত্র প্রপোজ করে, কিন্তু কেউ পাত্তা দেয় না। ওজনে বড়জোর চল্লিশ কিলো, খ্যাংরাকাঠির মতো চুল, বড় বড় গোরুচোরের মত চোখ। বাড়ি বাঙ্গুরে। আমি বললাম ‘আচ্ছা বোস, তোকে বাঙুর অবধি পৌঁছে দিচ্ছি।’

তারপর তাকে নিয়ে তো চলছি। ফাঁকা শুনশান রাস্তাঘাট। এপ্রিল মাস, একটু আগে বৃষ্টি হয়েছে, ঠাণ্ডা মিঠে ফুরফুরে হাওয়া। ছোকরা বাইকে বসেই আমার পিঠে মাথা গুঁজে ঘুমিয়ে পড়েছে, আমি অবশ্য কিছু মাইণ্ড করিনি। বাইপাসের পাশের ওই পুকুরটার ওপারে মস্ত চাঁদ উঠেছে, তার ওপরে বাতাসে শিরশিরানি ভাব। নেশাটা দিব্যি জমে উঠেছে, চিংড়িহাটার মোড়ে পৌঁছেছি, এমন সময় অচানক রেড সিগন্যাল। যেই জোরে ব্রেক কষেছি, অমনি মদনবাবু ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে টুক পেছন থেকে উলটে রাস্তায় পড়লেন এবং তৎক্ষণাৎ রাস্তায় শুয়ে থাকা একটা নেড়িকে জড়িয়ে ধরে ‘ওহ স্যুইটি, ইউ আর সো সফট’ বলে ঘুমিয়ে পড়লেন।’

আজ থেকে প্রায় বছর দশেক আগে আমি একটি মশামারা কম্পানির মাছিমারা এরিয়া ম্যানেজার ছিলুম। মানে আমাদের ব্যবসা ছিলো মশা মারার কয়েল, মেশিন, লিক্যুইড রিফিল, আরশোলা মারার স্প্রে ইত্যাদি বিক্রি করা। ব্র্যাণ্ডের নাম? গুডনাইট আর হিট।

আমি যখন জয়েন করি তখন কম্পানির বৃহস্পতি তুঙ্গে। তিন বছরের মধ্যে টার্নওভার ডাবল, বিদেশভ্রমন ( মল্লিখিত ”প্যারিসে নিশিবাসরে” পড়ার দুর্ভাগ্য হয়েছে কি? ওই, তখনই যাওয়া আর কি), ইত্যাদি তো ছিলই, আর পেয়েছিলাম রেকর্ড পরিমাণ ইন্সেনটিভ, যা এখনও চঞ্চঙ্খও ইন্ডাস্ট্রিতে অবিশ্বাস্য বলে ধরা হয়।

তা এমনই এক সময়ে মার্কেটিং এর এক কর্তাব্যক্তির মাথায় এলো ওডোমসের সঙ্গে সমানে টক্কর দেনেওয়ালা প্রডাক্ট বার করার কথা। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম, হা রে রে রে করে , ঢাকঢোল পিটিয়ে আমরা বাজারে আনলুম হার্বাল বডিক্রিম, মশাও মারবে সলমান খানের মতন দাবাংবিক্রমে, আর ত্বকও হবে ক্যাটরিনা কইফের মতন মখমলি, এই ছিলো প্রডাক্টের গুণাবলীর নির্যাস। কুলোকে অবশ্য বলতো মশা মারে কেষ্ট মুখার্জির মতন আর ত্বকের টেক্সচার প্রায় ওম পুরীর কাছাকাছি পৌঁছয়, তবে সেসব হিংসুটেদের কথা পাত্তা দেওয়ার কথাও নয়, আমরা দিইও নি।

আমাদের ব্র্যা ণ্ডের ট্যাগলাইন ছিলো, ”মচ্ছরোঁ সে করে ওয়ার, ত্বচা সে করে পেয়ার”। বলা বাহুল্য, হিন্দিতে ওর থেকে ভালো ট্যাগলাইন আর হয়না। এদিকে আবার যেহেতু সেবছর কলকাতা ডিপো সবচেয়ে ভালো পারফর্ম করে (করবে নাই বা কেন শুনি? এরিয়া ম্যানেজার কে সেটা একবার দেখবেন না মহাই? বিদ্যায়, বুদ্ধিতে, পৌরুষে, সাহসে,চরিত্রে, রূপেরঙেগন্ধেবর্ণেস্পর্শে অমন ”সেকেন্ড টু নান এরিয়া ম্যানেজার আর কটা দেখেছেন মশাই খুলে বলুন দিকিনি, হুঁ হুঁ), ফলে কলকেতা শহরের যন্যি বিশেষ মার্কেটিং প্ল্যান বানানো হচ্ছে, এবং বাংলা ভাষায় লিখিত পোস্টারে পোস্টারে চারিদিক ছয়লাপ করে দেওয়া হবে।

সাধু উদ্যোগ। আমরা তো মশাই সেলসম্যান এবং মার্চেন্ডাইজার বাহিনী নিয়ে রেডি, এমন সময় মার্কেটিং হেডের ফোন, ‘তুঝে বাংলা পঢ়া আতা হ্যায় কেয়া?’

মানে? খাজা কাঁঠাল নাকি ব্যাটা? আতা হ্যায় কি রে, আম হ্যায়, জাম হ্যায়, জামরুল হ্যায়, কাঁঠালি কলা ভি হ্যায়। তোর দরকারটা কি সেইটে খুলে বল দিকিন।

‘পোস্টার কা বাংলা ভার্শান আয়া হ্যায়, পঢ়কে বাতা, সব ঠিকঠাক হ্যায় ইয়া নেহি।’

আচ্ছা, পাঠাও।

এলো, মানে তিনি এলেন। আর সে কি আসা! আমরা তো মশাই সেই হিন্দি ক্যাচলাইনের বাংলা অনুবাদ পড়ে হেসে কুটিপাটি! মাইরি! সে অনুবাদ শুনলে কলকাতা ইউনিভার্সিটি যে আমাদের ডালকুত্তো দিয়ে খাওয়াতো তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই! চাইকি ‘গুডনাইটের ফাঁসি চাই, দিতে হবে, দিয়ে দাও’ বলে কলেজ স্কোয়ারে চাট্টি মিছিল বেরোলেও আশ্চয্যি হতাম না!

যথারীতি হ্যা হ্যা করে হাসতে হাসতে মার্কেটিং ম্যানেজারকে শুধোলাম, ‘কৌনসা চু** ইয়ে বানায়া হ্যায় ভাউ’ (মারাঠিতে ভাউ মানে সম্মানীয় বড়দা)।

তিনি রোষকষায়িত লোচনে (মানে টেলিফোনে যতটা লোচন বোঝা যায় আর কি!) ‘ঠিক হ্যায় বে, ফির তু হি বানা!’

বাঙালকে চ্যালেঞ্জ করে কেউ পার পায়নি একথা সর্ববাঙালবিদিত। ফলে সেই ”মচ্ছরোঁ সে করে ওয়ার, ত্বচা সে করে পেয়ার” নিয়ে বসতে হলো। শেষে দমদম পার্কের নাইট ক্যুইন ডান্সবারে চার পেগ মাল চড়িয়ে, লাভলির ডান্স দেখতে টক করে বাংলাটা মাথায় চলে এলো, ‘মশার জন্যে সর্বনাশা, ত্বকের প্রতি ভালোবাসা’।

সেইদিন লাভলি ওরফে পাকিজাকে পাঁচশো টাকার বকশিশ দিয়েছিলুম,স্পষ্ট মনে আছে! সেদিন আমার অনারে স্পেশাল ‘কাজরা রে’ নেচেছিলো, আহা, সে অসামান্য নাচ এখনও চোখে লেগে আছে।

এত কথা বলার কারনটা হলো যে আজ সকালের আনন্দবাজারে এয়ারটেলের একটি অকথ্য এবং অশ্রাব্য বাংলায় লেখা অ্যাড বেরোয় বলে শুনেছি। আমার বাড়িতে গত দশ বছর ধরে আনন্দবাজার ঢোকে না। ফলে এহেন কীর্তিটির খোঁজ পাই ফেসবুকে। আর তারপর সেই স্টেটাস সুনামি।

এখানে একটি কথা খুবই সাহস টাহস করে অতি সন্তর্পণে অভিজ্ঞজনের চরণে পেশ করি। তেরো বছর হয়ে গেলো কর্পোরেট লাইনে আছি। মার্কেটিংএর অপ্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও কিছু আছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলছি যে এতে আনন্দবাজারের কিছু মাত্র দোষ লেই কো! কম্পানির মিডিয়া এজেন্সি আর মিডিয়া হাউসের মধ্যে এই চুক্তিই হয় যে এজেন্সি হাতি ঘোড়া গু গোবর যা ছাপাবে, মিডিয়া তাই ছাপতে বাধ্য। একটি অক্ষর ইদিকউদিক করার কথা, বা কালার টোন সামান্য বদলে দেওয়ার কথা ভাবাই যায় না! পরে যদি এজেন্সি এসে তেড়েমেড়ে বলে যে ‘ওইটেই আমাদের ক্লায়েন্ট চেয়েছিলেন, আপনি ফোঁপরদালালি করার কে মশাই? এই যে মূমুর্শুর বানান বদলে মুমূর্ষু করে দিলেন, জানেন এতে করে আমার ক্লায়েন্টের আড়াই জন কাস্টমার কমে গেছে, ফলে উহাদিগের সতেরো নয়া পয়সা প্রফিট ক্ষতি হইয়াছে, এ ক্ষতিপূরণ কে করবে? আপনি?’ তাহলে মিডিয়ার কুচ্ছু করার থাকে না। ফলে তিনি যা পান, অম্লানবদনে তাই ছেপে দেন। শুধুমাত্র দেশের ক্ষতি হয়, বা দাঙ্গায় উস্কানি দেওয়া হয় এমন কপি চোখে পড়লে মিডিয়া ম্যানেজার ওপরওয়ালার মতামত চান। নইলে এসব এয়ারিটেলের ফেয়ারিটেলে পেয়ার কা দুশমন জান কা দুশমন হতে তাঁদের বয়েএএ গ্যাছে!

দোষটা কার? এয়ারটেলের মার্কেটিং এন্ড কমিউনিকেশন ম্যানেজার এবং তাদের মিডিয়া এজেন্সির। সবসময় এসব স্থানীয় ভাষায় লেখা পাবলিক কমিউনিকেশন মার্কেটিং ম্যানেজাররা ব্যক্তিগত ভাবে একবার ক্রস চেক করিয়ে নেন। এক্ষেত্রে এজেন্সিটি যে অপদার্থের একশেষ সে নিয়ে সন্দেহ নেই, মূল অপরাধ তাদেরই। গাদাগুচ্ছের টাকা খিঁচে এই অ্যাড কপি উপহার দেওয়া প্রায় ক্রিমিনাল অফেন্স, তাদের কন্ট্রাক্ট আজ কালের মধ্যে বাতিল না হলে আশ্চর্য হবো। তবে এয়ারটেলের মার্কেটিং ম্যানেজারও দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। ওটুকু সতর্কতা বজায় রাখার জন্যেই তেনাকে অত টাকা মাইনে দেওয়া হয়।

আবারও বলছি, আনন্দবাজারের দায়িত্ব এক্ষেত্রে নেই বললেই চলে। তাদের কিছুই করার ছিলো না।

এই নিয়ে একটা মজার গল্প বলি। এসব কাণ্ডকে ইংরেজিতে বলে ফ ‘পা’ ( faux pas)। এরকম মার্কেটিং ফ ‘পা’ র গল্প আপনি মার্কেটিং বা অ্যাড এজেন্সির লোকেদের কাছে গাদাগাদা শুনতে পাবেন। তারই মধ্যে থেকে এক উমদা পিস পেশ করি।

উত্তরভারতখ্যাত একটি ব্যথা বেদনা উপশমকারী মলম প্রস্তুতকারক কম্পানি ঠিক করলেন তাঁরা দক্ষিণ ভারতে ব্যবসা বাড়াবেন। দক্ষিণ ভারত অম্রুতাঞ্জনের দুর্গ বললেই চলে। এঁরা সেখানে তেমন কিছু সুবিধা করে উঠতে পারেননি। সেখানে কিছু করতে গেলে সোজা সদর দফতরে কামান দাগাই শ্রেয়। ফলে অনেক ব্রেইনস্টর্মিং এর পর, দু-দুটি অ্যাড এজেন্সি পেশ করলো তাদের ক্রিয়েটিভ জ্যুইস নিংড়োনো সেই অসামান্য কপি, দেখা যাচ্ছে যে মলমের টিউব থেকে একটু মলম বেরিয়ে আছে, নিচে লেখা your own soothepaste। মানে আপনার ব্যথা বেদনায় আরাম দেয় বা সুদিং করে এমন পেস্ট। সঙ্গে টুথপেস্টের সঙ্গে অ্যালিটারেশন।

চমৎকার না?

অফ কোর্স চমৎকার! মার্কেটিং ম্যানেজার আর দুবার ভাবলেন না। কম্বুর্ন্টে বললেন গো অ্যাহেড গাইজ। ক্র্যা ক দ্য মার্কেট!

তা হইহই করে একদিন রাতের বেলা সেই হোর্ডিং এ মুড়ে ফেলা হলো সমস্ত চেন্নাই! অ্যাড এজেন্সি, মিডিয়া এজেন্সি আর মার্কেটিং ম্যানেজার সোল্লাসে গলা অবধি মাল টেনে ঘুমোতে গেলেন।

পরদিন সক্কালে সেই কম্পানির ডিরেক্টরের কাছে তামিলনাড়ুর গভর্নমেন্ট থেকে ফোন। ওপারের লোকটি যাবতীয় শ কারান্ত ব কারান্ত (শেষ হলে ম ও চ কারান্ত) গালি দিয়ে জানালো যে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ এক্ষুণি যেন সমস্ত হোর্ডিং নামিয়ে ফেলা হয়। নইলে মেরিনা বিচে মে মাসে দুপুরে দাঁড় করিয়ে শুকনো ইডলি খাইয়ে এবং তদন্তে জল না দিয়ে সব কটাকে কোতল করা হবে!

যথারীতি কম্পানির সক্কলে না রাম না গঙ্গা! মার্কেটিং ম্যানেজার তখন মহাবলীপুরমের রিসর্টে তাঁর তামিল গার্লফ্রেণ্ডের সঙ্গে বোধহয় ইকিড়মিকিড় চামচিকির খেলতে গেছিলেন। বড়কর্তার ধমক খেয়ে প্যান্টটা পরেই দৌড়!

চেন্নাই ঢুকে দেখেন সারা শহর হাসছে! যেখানেই সেই হোর্ডিং, সেখানেই ক্যাওড়া পাবলিক জড়ো হতে হুল্লাট মজা নিচ্ছে। তামিল ভদ্রজনেরা দেখামাত্র মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছেন। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে কম্পানির নামে খিস্তি করছেন, কেউ হোর্ডিংরে নামে ঢিল ছুঁড়ছেন…মানে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের পর বিজেপি বা কংগ্রেসের রাজ্য দফতরের অবস্থা আর কি!

তা তিনি নেমে একজনকে পাকড়াও করলেন, ‘এত হাসির কি হলো ভায়া?’

‘ও হোহোহো, সুদপেস্ট.. হ্যা হ্যা হ্যা’ করে সে ফের হেসে গড়িয়ে পড়ে!

ম্যানেজার সাহেব এবার ন্যয্য কারনেই অসহিষ্ণুহয়ে পড়েন, ‘তাতে হয়েছেটা কি?’

সে খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকায়, তারপর ফের হাসিতে ফেটে পড়ে, ‘তুমি তামিল নও, না?’

‘না। তো?’

‘তাই সুদ শব্দের মানে জানো না, ও হো হো হো’

এবার চেঁচিয়ে ফেলেন ম্যানেজার, ‘বলি হেসেই যাবে না মানেটাও বলবে?’

‘তামিলে সুদ মানে পোঁদ। এই হোর্ডিংটার মানে হচ্ছে, ও হো হো হো, টিউবে ভরা আপনার নিজের পোঁদের পেস্ট’!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *