সুরটে ইংরাজ কুঠির এক পুরাতন কাহিনী
(মূল ফারসী উপাদান হইতে)
খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে ভারতের রাজনৈতিক গগনে মুঘল-সাম্রাজ্যের মধ্যাহ্ন সূর্য্য পূর্ণ বিকাশ বিতরণ করিয়া, অস্তাচলমুখে দ্রুত ধাবিত হইল। ঐ শতাব্দী শেষ হইবার সাত বৎসর মাত্র পরে আওরংজীবের সুদীর্ঘ পঞ্চাশবর্ষব্যাপী রাজত্ব শেষ হইবার সঙ্গে সঙ্গেই সকলে দেখিতে পাইল মুঘল সাম্রাজ্যের জীবন নাই, তাহা মৃত, ছায়ামাত্র। অথচ বিধাতার এমন বিধি যে, এই সপ্তদশ শতাব্দীতেই ভারতের ভবিষ্যৎ ভাগ্যনিয়ন্তা জাতিগুলি প্রায় অদৃশ্যভাবেই এখানে, একটি করিয়া স্থায়ী আস্তানা গড়িল। আমাদের রাজনৈতিক গগনে একাধারে সূর্য্যাস্ত সূর্যোদয় ঘটিল।
মুঘল সরকারের যেমন অগণিত চিঠি, কাগজপত্র, রিপোর্ট ও সংবাদলিপি (ওয়াকেয়া) রক্ষা পাইয়াছে, তেমনি যে ইউরোপীয় বণিকগণ অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভারতে রাজার পর রাজা হইলেন, তাঁহাদেরও ভারতী কুঠিগুলির অতি বিস্তীর্ণ দৈনিক বিবরণ, হিসাবপত্র, চিঠি ও বর্ণনা আমাদের সম্মুখে বিদ্যমান আছে, এবং ইহার অধিকাংশই ছাপা হইয়াছে। পারসিক ও ইংরাজী অভিজ্ঞ ঐতিহাসিকদের পক্ষে ইহা একটি স্বর্ণ সুযোগ।
এই সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে ইংরাজদের সুরটের কুঠির উপরে যে মহা বিপৎপাত হইয়াছিল, তাহার অতি দীর্ঘ সমসাময়িক বিবরণ ফার্সী চিঠি ও সরকারী কাগজ এবং ইংরাজী ডায়েরী হইতে সংগ্রহ করা অতি সহজ এবং এই বিবরণ বড়ই মনোরম।
স্থানাভাবে এখানে সংক্ষিপ্ত ইতিহাস মাত্র দেওয়া গেল। যে ইংরাজ সাম্রাজ্য আজ জগৎজয়ী-অর্দ্ধপৃথিবী গ্রাস করিয়া রহিয়াছে, ভারতে তাহার ক্ষুদ্র প্রারম্ভে সেই যুগের সাম্রাজ্য স্থাপয়িতা বণিকগণকে বাদশাহের কাছে কি প্রকার লাঞ্ছনা পাইতে হইয়াছিল, তাহার সত্য ও সমসাময়িক বিবরণ না পড়িলে বিশ্বাস করা যায় না।
খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর শেষে চতুর্থ ভাগে বাঙ্গলা, মাদ্রাজ এবং পশ্চিম ভারতীয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কুঠিসমূহ দিল্লীর বাদশাহের সহিত সংঘর্ষে আসে। বাঙ্গলায় এই বিরোধ সংগ্রামে পরিণত হওয়ায় ইংরাজ বণিকরা এই প্রদেশ পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। কিন্তু ইংরাজদিগের এই বাণিজ্য হইতে রাজকোষে প্রচুর ধনাগম হইত বলিয়া বঙ্গের নবাব ইংরাজদিগকে পুনরায় ডাকিয়া বাণিজ্য করিবার অধিকার দিলেন। অবশেষে সপ্তদশ শতাব্দী শেষ হইবার পূর্ব্বেই ইংরাজ বণিকেরা এমন কতকগুলি দুর্গ স্থাপন করিতে পারিলেন যাহা Hedges বহুপূৰ্ব্ব হইতেই বাণিজ্যের পক্ষে অত্যাবশ্যক বলিয়া নির্দ্ধারিত করিয়াছিলেন। এইসব দুর্গে ইংরাজ– বণিকদিগের কর্মচারীগণ ও মালপত্র বহিশত্রুর আক্রমণ অথবা বিদ্রোহ এবং প্রাদেশিক শাসনকৰ্ত্তাদিগের অন্যায় উৎপীড়নের হাত হইতে রক্ষা পাইতে পারিত।
মাদ্রাজস্থ ইংরাজ কুঠী প্রকৃতপক্ষে কখনও আক্রান্ত হয় নাই বটে, কিন্তু ১৬৯৬ খ্রিস্টাব্দে বাদশাহের কর্ণাটকস্থ সেনাপতি জুলফিকার খাঁ যুদ্ধের ব্যয়নির্ব্বাহার্থ চারি লক্ষ টাকা কর্জ্জ চাহিয়া বিফল মনোরথ হওয়ায় মাদ্রাজের কুঠী আক্রমণ ও লুণ্ঠন করিবেন বলিয়া ভয় দেখাইয়াছিলেন। সত্য বটে যে ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারী মাসে সলীম খাঁ নামে তাঁহার এক কর্মচারী সেন্ট ডেভিড দুর্গ আক্রমণ করেন, কিন্তু তাহা তাঁহার বিনা অনুমতিতেই সংঘটিত হইয়াছিল। এই দশ বৎসরে মাদ্রাজ শহর হইতে প্রভূত লাভ হয়। কথিত আছে যে, এই সময় বাণিজ্য দ্রব্যসমূহের শুল্ক হইতে রাজস্ব বিভাগের আয় ছিল প্রায় চারি লক্ষ টাকা। এই আয়ের পরিমাণ গোপন রাখিবার জন্য মাদ্রাজের ইংরাজ শাসনকর্তার স্বাক্ষরিত এক আদেশ এই মর্ম্মে জারি করা হয় যে, ভবিষ্যতে কোম্পানীর বাণিজ্য এবং রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত সমস্ত হিসাব ভারতবাসীর নিকট হইতে গোপন রাখিবার নিমিত্ত ইংরাজী লিখিতে হইবে; তৎসঙ্গে এই আদেশও জারি করা হয় যে, কোম্পানীর কোন ভারতীয় কর্মচারী এমন কোন হিসাব রাখিতে পারিবে না, যাহার সহিত সে নিজে সংশ্লিষ্ট নহে।
১৬৯০-১৬৯৮ পর্য্যন্ত কর্ণাটকের অধিকার লইয়া মুঘলদিগের সহিত মারাঠাদিগের যে বিরোধ হয়, তাহা ভারতের ইতিহাসে জিঞ্জীর অবরোধ বলিয়া বিখ্যাত। এই দীর্ঘকালব্যাপী ধ্বংসপ্রবণ বিরোধের সময় সমৃদ্ধশালী ভারতবাসিগণ মাদ্রাজ উপকূলস্থ ইউরোপবাসীদিগের উপনিবেশ সমূহ সুরক্ষিত দেখিয়া তথায় আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং ফলে এই সমস্ত উপনিবেশ ধনে জনে প্রভূত সমৃদ্ধি লাভ করে। পণ্ডিচেরী শহর ইহার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এই শহরের লোকসংখ্যা এক বৎসরের মধ্যে দ্বিগুণিত হইয়াছিল। কিন্তু পূর্ব্বোক্ত যুদ্ধের ফলে যখন পথঘাট বিপদাকীর্ণ হইয়া গ্রামসমূহের শান্তি এবং শৃঙ্খলা নষ্ট হয়, তখন পূৰ্ব্ব উপকূল স্থানসমূহের বয়নশিল্প প্রায় সম্পূর্ণভাবে তিরোহিত হইয়া যায়। ইহার ফলে স্বদেশে রপ্তানী করিবার জন্য এদেশজাত দ্রব্য যথেষ্ট পরিমাণে সংগ্রহ করা ইউরোপীয়দিগের পক্ষে দুঃসাধ্য হইয়া ওঠে। যদিও মাদ্রাজ-কৌউন্সিলের সভ্যদিগকে এই দশ বৎসর অত্যন্ত উদ্বেগের সহিত কালযাপন করিতে হইয়াছিল, তথাপি অপূৰ্ব্ব নৈপুণ্য ও সৌভাগ্যের ফলে তাহারা আপনাদিগকে মুঘল এবং মারাঠাদিগের অত্যাচার ও উৎপীড়ন হইতে রক্ষা করিয়া স্বীয় কার্য্যসিদ্ধির পথে স্থিরগতিতে অগ্রসর হইয়াছিল।
কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে ইংরাজ কুঠীগুলির মধ্যে সুরটের কুঠী সৰ্ব্বাপেক্ষা অধিক দুৰ্দ্দশায় পতিত হয়। ইহা এমন এক স্থান অবস্থিত ছিল যে মুঘলেরা অতিশয় অল্প আয়াসে এইস্থানে আক্রমণ করিতে পারিত। কিন্তু এই সময় ইহা যে সমস্ত অসুবিধায় পতিত হয়, তাহার সহিত মুঘল সাম্রাজ্যের বিশেষ কোন সংস্রব ছিল না। এই সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা অত্যন্ত মন্দীভূত হইয়াছিল, এবং ভারতীয় ব্যবসায়ীদের নিকট কোম্পানীর ঋণের মাত্রা অত্যন্ত বৰ্দ্ধিত হওয়ায় ও তাহা পরিশোধ করিবার উপযুক্ত অর্থ না থাকায়, কোম্পানীর নাম বিশেষ ছোট হইয়া গিয়াছিল। ইহার সঙ্গে সঙ্গে দুঃখের মাত্রা ষোলকলায় পূর্ণ করিয়া অনধিকারী ইংরাজ ব্যবসায়ীর দল এবং নূতন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী, পুরাতন কোম্পানীর সমূহ আর্থিক ক্ষতি করিয়া তাঁহাদের প্রতিপত্তি খর্ব্ব করিয়াছিলেন। এই সময়ে সুরাটে ফরাসীদিগের যে কুঠী ছিল, তাহা মন্দীভূত ব্যবসায়ের ফলে এবং অর্থাভাবে প্রায় বন্ধ হইয়া যায়।
কিন্তু এই সময়ে ভারত-মহাসাগরস্থ ইউরোপীয় জলদস্যুগণের অত্যাচারের ফলে ভারতীয় সমাজে যে ক্রোধের উৎপন্ন হয় তাহাই ইংরাজ এবং অপরাপর ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদিগের সর্ব্বাপেক্ষা অধিক ক্ষতি করিয়াছিল। এই সময়ে প্রধানত ইংরাজ এবং মার্কিন-জাতীয় কয়েক দল দুঃসাহসিক দস্যু-স্বদেশে অভিযুক্ত হইয়া তথা হইতে পলায়ন পূর্ব্বক ভারত মহাসাগরে আসিয়া পারস্য, আরব ও জাঞ্জীবারের সহিত স্থাপিত ভারতীয় বাণিজ্যের সমূহ ক্ষতি করে; এমন কি ইহারা, ইংরাজ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর জাহাজগুলিকেও সকল সময়ে রেহাই দিত না।
১৬৯৫ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে সুরটে এই মর্ম্মে এক সংবাদ পাওয়া যায় যে, ৪৬টি কামানযুক্ত একটি বৃহৎ দস্যু-জাহাজ ইংরাজ পতাকা প্রদর্শন করিয়া আবদুল গফুর বোরা নামক সুরটস্থ সৰ্ব্বাপেক্ষা ধনী বণিকের একখানি জাহাজ লুণ্ঠন করিয়াছে। ইহাতে জনসাধারণে কোম্পানীর এবং অনধিকারী ব্যবসায়ীদিগের অধীনস্থ সকল ইংরাজের উপরই ক্রুদ্ধ হইয়া উঠে। অন্ত্রস্থ শাসনকর্তা ইতিমাদ খাঁ- যিনি সৰ্ব্বদা বিদেশীদিগের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ছিলেন– কোম্পানীর দ্রব্যাদি এবং অধীনস্থ কর্মচারীগণকে উত্তেজিত মুসলমান জনতার হাত হইতে রক্ষা করিবার জন্য কোম্পানীর মালখানার চারিপাশে রক্ষী স্থাপন করিয়াছিলেন। ইহার অল্পদিন পরেই এই মৰ্ম্মে এক সংবাদ পাওয়া যায় যে, উক্ত দস্যুদল মুঘল সম্রাটের গজ্ঞ-ই-সওয়াই নামক একখানি বৃহৎ জাহাজ আক্রমণ করিয়া হাজিদিগকে সতিশয় নির্যাতিত ও লুণ্ঠন করিয়াছে এবং জাহাজস্থ স্ত্রীলোকদিগের উপরও অত্যাচার করিয়াছে। এই ঘটনাটি মুসলমান ধর্মের প্রতি অপমানকর বলিয়া পরিগণিত হওয়ায় জনসাধারণের প্রতিহিংসা অদম্য হইয়া উঠিল। সুরটের শাসনকর্তা সুরট ও ব্রোচস্থ ইংরাজদিগকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া আপনার বুদ্ধিসত্তার পরিচয় দিয়াছিলেন, কারণ তাহা না হইলে উত্তেজিত জনতা তাহাদিগকে কাটিয়া খন্ড খন্ড করিয়া ফেলিত। এইরূপে সভাপতি এস্লী এবং তাঁহার সভায় সভ্যগণ প্রমুখাৎ ৬৩ জন ইংরাজ সুরটে এবং স্বালী মেরিনেতে বন্দীদশায় পতিত হয়। দশ মাস কারাবাসের পর ১৬৯৬ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে জুন তাঁরিখে তাহারা মুক্তিলাভ করেন। ১৬৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২রা জানুয়ারী তারিখে অপর একটি জলদস্যুতার ফলে ইঁহারা পুনরায় বন্দীদশায় পতিত হন। ইহার কারণ এই যে, আব্দুল গফুর টুপিধারীত দিগকে দস্যুদিগের অন্যতম বলিয়া নির্দেশ করেন। পুনরায় ১৭০১ খ্রিস্টাব্দের ৯ই ফেব্রুয়ারী তারিখে সার জন্ গেয়ার আওরংজীবের আদেশে ধৃত হইয়া স্বল্পাধিক কঠোর নিয়ম পালন পূর্ব্বক ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ পর্য্যন্ত বন্দীভাবে জীবন যাপন করেন।
যে সকল ইউরোপীয় জাতি ভারতবর্ষে বাণিজ্য করিতেন, তাঁহারা যদি মিলিত হইয়া– ভারত মহাসাগরস্থ জলদস্যুদিগের নিবারণার্থ কোন পন্থা অবলম্বন এবং এই প্রকার শান্তি রক্ষার প্রতিদান স্বরূপ মুঘল সম্রাটের সহিত কোনরূপ চুক্তি করিতে পারিতেন, তাহা হইলে উপরোক্ত সকল দুঃখ কষ্ট হইতে অব্যাহতি লাভ করিয়া দিল্লীর সম্রাটের সহিত বন্ধুভাবে সকল বিষয়ে নিষ্পত্তি করা তাঁহাদের পক্ষে সম্ভবপর হইত। কিন্তু সম্রাট সৈন্যদলের নিমিত্ত যে পারিশ্রমিক নির্দ্ধারিত করেন, তাহা খুবই অল্প ছিল। এই সময়ে সুরটের শাসনকর্তার দরবারে ওলন্দাজেরা ইংরাজদিগের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করিতেছিলেন এবং ইংরাজরাও আপনাদিগের মধ্যে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন। একদিকে যেমন নূতন কোম্পানীর পরিচালকগণ পুরাতন কোম্পানীর নামে মিথ্যা দোষারোপ করিয়া অত্যন্ত লজ্জাকরভাবে তাঁহাদিগকে ধ্বংস করিতে উদ্যত হইয়াছিলেন, অপরপক্ষে তেমনি পুরাতন কোম্পানীও নূতন কোম্পানীর কর্মচারীগণকে বন্দী করিয়া বৃটিশ সম্রাটের বিরুদ্ধাচরণকারীরূপে তাঁহাদের হস্তে সমর্পণ করিবার জন্য মুঘল সরকারকে প্ররোচনা দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
সমস্ত সংবাদ আমরা ফারসী পুস্তক হইতেই সঠিক সংগ্রহ করিতে পারি। তাহার তিনখানির পরিচয় নিম্নে প্রদত্ত হইল।
(১) ফারসী ভাষায় লিখিত সুরটের কুঠীর ১৬৯৫-১৬৯৬ খ্রিস্টাব্দের চিঠির নকল বহি, বর্তমানে লণ্ডনস্থ ইন্ডিয়া অফিসে রক্ষিত আছে। ইহাতে ১১৩ খানি চিঠি আছে, ইহা হস্তলিখিত এবং ১২৯ পৃষ্ঠার। ইহার প্রতি পৃষ্ঠায় ১৫টি করিয়া পংক্তি আছে। ইহাতে পংক্তির সংখ্যা বিষয়ে স্থানে স্থানে বিভেদ আছে এবং মধ্যে মধ্যে অলিখিত দুই একখানি পৃষ্ঠাও দৃষ্ট হয়। ইহা ‘এথি’র তালিকাভুক্ত ৩৭০ নম্বরের বহি।
(২) কালিমাৎ-ই-তৈব্য একখানি হস্তলিখিত গ্রন্থ। আওরংজীব তাঁহার মুনশী ইনায়েতউল্লা খাঁকে যে সকল সংক্ষিপ্ত বিবরণ ও আভাস দিয়াছিলেন এবং যাহা পরে লিপির আয়তনে পরিবর্তিত হইয়া বহুবিধ রাজকর্মচারীর নিকট প্রেরিত হইয়াছিল, ইহাতে সেই সমস্ত বিবরণ ও আভাস লিখিত আছে। ইহা হইতে যে সমস্ত বিবরণ পাওয়া যায়, তাহার সকলগুলিই ১৭০০ হইতে ১৭০৫ খ্রিস্টাব্দে ঘটিয়াছিল। ইহা হইতে আমরা মুঘল সম্রাটের প্রকৃত মনোভাব জানিতে পারি। আমার নিকট ইহার যে হস্তলিপি আছে, তাহা ২৯৭ পৃষ্ঠাব্যাপী, প্রতি পৃষ্ঠায় ১৩টি করিয়া পংক্তি আছে।
(৩)আখবারাৎ-ই-দরবার-ই-মুয়াল–আওরংজীবের প্রাত্যহিক দরবারের সংবাদ প্রচারার্থ মুদ্রিত পত্র অথবা সাময়িক পত্রিকা। গ্রেটব্রিটেনস্থ Royal Asiatic Society-র গ্রন্থাগারে রক্ষিত টড্ হস্তলিপি।
রাজদরবারে গৃহীত দ্রুত প্রেরিত সরকারী বার্তা ও সংবাদ প্রচারার্থ মুদ্রিত পত্র সমূহের জনসাধারণে প্রচারিত সম্রাটের আদেশাবলী এবং উপঢৌকন প্রদানাদি রাজদরবারের অন্যান্য কার্য্য সমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ। এই সকল গ্রন্থে লিখিত আছে। এই সকল গ্রন্থের স্থানে স্থানে ইংরাজদিগের বিষয় উল্লেখ আছে, যথা, Sir William Norris এর পরিদর্শন। কিন্তু তাহাদের সহিত কিরূপ ব্যবহার করা হইত, অথবা কি আলোচনা হইয়াছিল, এ বিষয়ে ইহার কোথাও কিছুই লিখিত নাই। মোটের উপর এই সমস্ত প্রাসঙ্গিক উল্লেখ এত সংক্ষিপ্ত যে, এগুলি আমাদের কোনোই প্রয়োজনে আসে না।
মুঘল সাম্রাজ্যের সরকারী কাগজপত্র এবং মাদ্রাজ ও সুরটস্থ ইংরাজ কুঠী সমূহের সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দশমাংশের দলিলাদি একত্র পাঠে দেখা যায় যে শেষোক্ত দলিলাদি প্রায় নির্ভুল; ইহা ছাড়া আরও অনেক বিশেষ বিবরণ ও উদাহরণ জানা যায়, যাহা আমরা বর্তমানেই অবগত। কেবলমাত্র এই সমস্ত সরকারী কাগজপত্র হইতেই মুঘল সম্রাটের আন্তরিক চিন্তা, তাঁহার সচিববৃন্দের যুক্তি পরামর্শ এবং ভারতের সুবিধার বিষয় যাহা সম্রাটের দরবারস্থ ইংরাজ বণিকগণের প্রতিনিধিগণ সাধারণতঃ মাত্র অনুমানই করিতেন জানিতে পারি।
মক্কা এবং মদিনা গমনের জন্য জলপথ কিরূপ নিরাপদ ও অবাধ করা যায়, ইহাই বাদশাহের একমাত্র চিন্তার বিষয় হইয়াছিল। তিনি তাহার মন্ত্রীকে লেখেন-
“সামরিক দ্রব্যসম্ভার তত্ত্ব বিধায়ক (মীর-আতশ) গোলন্দাজ বিভাগের ফিরিঙ্গীগণকে জিজ্ঞাসা করিয়া যেন অবধারণ করে যে, বন্ধুভাবে নিষ্পত্তি অথবা যুদ্ধবিগ্রহ এই দুই উপায়ের কোনটির দ্বারা জলদস্যুদিগকে শাস্তি প্রদান করিয়া তীর্থযাত্রী ও বণিকদিগের পথ নিরাপদ করা যাইতে পারে।” অপর একস্থানে তিনি লেখেন, “সুরটের তহশীলদার আমান খাঁকে পত্র দ্বারা জ্ঞাপন কর যে, যেন তিনি মক্কাযাত্রী হাজী পর্যটক এবং সংবাদ বাহকগণের গমনাগমনের পথ নিরাপদ করিবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। ফিরিঙ্গীদের মধ্যে একতা নাই, তাহাদের মধ্যে অনেক দলই নেতা অথবা চালকহীন, তাহাদের মধ্যে ফরাসী অথবা যে জাতি সুরট হইতে প্রাপ্ত শুল্কের এক দশমাংশ লইয়া ‘টুপিধারী জলদস্যুদিগকে শাস্তি দিতে স্বীকৃত হইবে, তাহাদিগের সাহায্য গ্রহণ কর।’ (কালীমা-চিঠি ১৩৮ ও ৩৩২)
ফারসী ভাষায় লিখিত সুরট–কুঠীর চিঠির নকল বইখানি হইতে আমরা জানিতে পারি যে, ওলান্দাজেরা ইংরাজদিগকে দূরীভূত করিয়া আপনাদিগকে সম্রাটের সুনজরে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য অথবা ইংরাজদিগের অবস্থা সম্পূর্ণভাবে শোচনীয় করিবার জন্য, ভারতীয় তীর্থযাত্রীদিগের পোতসমূহ নিরাপদে মক্কায় পৌঁছিয়া দিবে– এই মর্মে এই অঙ্গীকার-পত্র তৎক্ষণাৎ স্বাক্ষর করে। (১নং ওলন্দাজ কোম্পানীর সুরটস্থ পরিচালক কর্তৃক স্বাক্ষরিত অঙ্গীকার পত্র। তারিখ ২৫শে ডিসেম্বর ১৬৯৬; ১৮নং ওলন্দাজদিগের প্রতিনিধি এবং পরিচালক কর্তৃক ১৯শে অক্টোবর তারিখে স্বাক্ষরিত চুক্তিপত্র। ৩৬নং– শেষোক্ত দুইজন হইতে চিঠি সমূহ।)
বন্দীভাবে অবস্থানকালে এস্লী অক্লান্ত পরিশ্রম সহকারে নিম্নলিখিত ব্যক্তিগণকে পত্র লেখেন; সুরটের শাসনকর্তাকে ৩৩খানি, তাঁহার মুঘল দরবারস্থ প্রতিনিধি দায়ানৎ রায়কে ৩ খানি, আর্মেনিয়াবাসী ইসা কুলীকে ১১ খানি, আওরংজীবের শিবিরস্থ আর্মেনিয়াবাসী কোন খ্রিস্টান পাদরীকে ৪ খানি, সম্রাটকে ২ খানি, প্রধান উজীর আসাদ খাঁকে ১ খানি। এতদ্ভিন্ন আরও কয়েকজনকে তিনি পত্র লেখেন। এই সমস্ত পত্রে তিনি ইংরাজ কোম্পানীর অধীনস্থ কর্মচারীদিগের নির্দোষিতা প্রমাণ করেন ও সুরট কুঠীতে আবদ্ধ ব্যক্তিগণকে মুক্তি দিবার জন্য অনুরোধ করেন। বোম্বাই-এর শাসনকর্তা সার জন গেয়ার এ বিষয়ে যথেষ্ট চেষ্টা করিয়াছিলেন। তিনি ইতিমাদ্ খাঁকে ২ খানা, মীর্জা মুহম্মদ জাহিদকে ২ খানা ও সম্রাটকে ১ খানা পত্র লেখেন। এই সকল পত্রে ইংরাজেরা সর্ব্বদা সুবিচার প্রার্থনা করিতেন। তাঁহারা বলিতেন তাঁহারা বণিক, তাঁহারা জলদস্যু নন, তৎসঙ্গে তাঁহারা একথাও স্মরণ করাইয়া দিতেন যে, সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় হইতে মুঘল-রাজপুরুষরা ইংরাজ ব্যবসায়িগণকে কেমন করিয়া বন্ধুভাবে ভারতবর্ষে রক্ষা করিয়া আসিতেছেন।
সুরটের বন্দীগণ যখন এইরূপ দুৰ্দ্দশায় পতিত হইয়া আপনাদিগের মুক্তির জন্য চেষ্টা করিতেছিলেন, তখন একটি হাস্যকর ঘটনা ঘটে। দায়ানৎ রায় মুঘল দরবারে ইংরাজ কোম্পানীর প্রতিনিধি ছিলেন। যে রাজপুরুষ তাঁহাকে রাজ-দরবারে পরিচিত করিয়া দিয়াছিলেন, তাঁহার প্রথানুযায়ী প্রাপ্য ও সম্রাটের কৃপাভাজন প্রতিষ্ঠাসম্পন্ন রাজপুরুষদিগের উপহার প্রভৃতি দৌত্যকাৰ্য নিৰ্ব্বাহার্থ বহুবিধ ব্যয় এবং তাঁহার বেতন বহুদিন যাবৎ অনাদায়ী ছিল। এই সময় সুরট কুঠীর আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত মন্দা। সুরট কৌউন্সিলের পুনঃ পুনঃ প্রতিজ্ঞা সত্ত্বেও দায়ানৎ রায় তাঁহার প্রাপ্য প্রাপ্ত হন নাই। তৎপরে সুরট কুঠী অবরুদ্ধ হইলে ম্রাটের নিকট হইতে মুক্তির আদেশ প্রার্থনা করিবার জন্য যখন তাঁহাকে পত্র লেখা হয়, তখন তিনি তাঁহার প্রাপ্য আদায়ের পক্ষে ইহা এক সুবিধা মনে করিলেন। তাই যখন এল্লী রাজদরবারে তাঁহার আবেদন পেশ করিতে এবং প্রধান অমাত্যকে তাঁহাদের স্বপক্ষে আনিবার জন্য আদেশ করিয়া দায়ানৎ রায়কে পত্র দিলেন, তখন তিনি তাঁহার উত্তরে বাকী প্রাপ্য ও প্রতিষ্ঠাসম্পন্ন রাজপুরুষদিগকে স্বপক্ষে আনিবার নিমিত্ত অর্থ চাহিয়া পাঠাইলেন। তিনি তাঁহার প্রভুদিগকে স্পষ্ট করিয়া বলিয়া পাঠাইলেন যে, রাজদরবারে প্রভূত অর্থ ব্যতিরেকে কিছু করিবার উপায় নাই; এবং এ কথাও লিখিলেন যে, ইংরাজদিগের উপর সম্রাটের ক্রোধ এত অধিক যে সম্রাটের কৃপাভাজনদিগের মধ্যে কেহই প্রচুর উৎকোচ ভিন্ন ইংরাজদিগের স্বপক্ষে সম্রাটের নিকট কিছুই বলিতে রাজী নন।
ইহার উত্তরে এলী তাঁহাকে কঠোর ভর্ৎসনা করিয়া অনতিবিলম্বে এই মৰ্ম্মে একখানি পত্র দিলেন “তুমি অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করিয়াছ।” এবং সেই সঙ্গে তাহাকে বরখাস্ত করিয়া সেই স্থানে ইসা কুলী নামক একজন আৰ্ম্মেনিয়ানকে আওরংজীবের দরবারে ইংরাজ প্রতিনিধি নিযুক্ত করিলেন।
[বাঁশরী, বর্ষ ২, মাঘ ৬, আশ্বিন, ১৩৩১।]