সুর

সুর

টুং করে একটা শব্দ হতেই আঠেরোতলার লিফটের দরজা খুলে গেল৷ এবং সামনে তাকাতেই বিনোদের মনটা শরতের কাশের মতো দুলে উঠল৷ লিফটের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে তৃষা৷

এই স্টুডিয়োতে জয়েন করার পর থেকেই তৃষাকে ভারী ভালো লাগে বিনোদের৷ রিসেপশনিস্টের কাজ করে তৃষা৷ সেই সঙ্গে মাঝেমধ্যে ভয়েস ওভারেও কাজে লাগে৷ মুখটা পুতুলের মতো৷ টুকটুকে ফরসা৷ তবে যে জিনিসটা সব থেকে বেশি আকর্ষণ করে, সেটা হল ওর চোখ৷ ভরাট ডাগর অস্থির চোখে কুচকুচে কালো মণি৷ সারাক্ষণ যেন কাউকে খুঁজে চলেছে৷ বিনোদের মনে মনে ইচ্ছা ওই অস্থির মণি দুটো একদিন ওকেই খুঁজুক৷ মাঝেমধ্যে বিনোদের মনে হয়, তৃষারও ভালো লাগে ওকে৷ কে জানে….

—‘বিনোদদা যে, কাজ কমপ্লিট?’ ‘দা’ শুনতে ভালো লাগে না বিনোদের৷ ওকে কি বন্ধু ভাবতে পারে না তৃষা? কাষ্ঠহাসি হাসে, বলে, ‘এই আছি আর কী, আপনি বাড়ি ফিরছেন?’

—‘উঁহুঁ, তোমাকে লিফটে উঠতে দেখলাম তাই ধাওয়া করে এলাম৷’ কথাটা বলে একটু হাসে তৃষা৷ বিনোদ ভ্যাবাচ্যাকা খায়৷

—‘কেন? করতে পারি না?’

—‘হ্যাঁ…’ আমতা আমতা করে উত্তর দেয় বিনোদ, ‘কিন্তু আমি…’

—‘হ্যাঁ… তুমি৷ অফিসে ওরকম হাঁ করে তাকিয়ে থাকো কেন বলো তো?’ কথাটা বলে সটান বিনোদের দিকে ঘুরে তাকায় তৃষা৷ ওর ডান গালে রাখে নরম হাতটা, ‘আমাকে ভালো লাগে, তা-ই না বিনোদদা?’

চোখের দিকে তাকায় বিনোদ, চোখ মিথ্যে বলে না৷ মেয়েটা কি মজা করছে? বুঝতে পারে না৷ তবে এটুকু বোঝে, এই মুহূর্তে তৃষার অস্থির চোখ দুটো ওকেই খুঁজছে৷ লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে, ভিতরে এই দুটো প্রাণী ছাড়া আর কেউ নেই৷ সেটা হুড়মুড়িয়ে নেমে চলেছে নীচের দিকে৷ একটা ভীষণ অস্বস্তির ঢেউ বিনোদকে চেপে ধরে৷

‘জানো, এই অফিসটা ভালো নয়, এখানে এসে থেকে কয়েকজন আমাকে…’

তৃষার মাথাটা ঢলে পড়ে বিনোদের বুকে৷ মেয়েটার চোখ থেকে কিছু একটা তরল গড়িয়ে নামছে বিনোদের বুকে৷ তৃষা কাঁদছে? বিনোদের অস্বস্তিটা বেড়ে ওঠে৷ তৃষার চোখ দুটো সে পছন্দ করে৷ কিন্তু সে চোখ থেকে জল নামলে কেমন দেখাবে তা সে কল্পনা করেনি৷ সে লিফট থেকে কোনওমতে বের হতে চায়৷ কিন্তু লিফটটা থামছে না কেন?

‘প্লিজ, আপনি এভাবে কাঁদবেন না… আপনাকে হাসলে ভালো লাগে… আমি আপনাকে…’ হঠাৎ বিনোদের পকেটে ফোনটা বেজে ওঠে৷ সে ছিটকে সরে আসতে চায়৷ কিন্তু তৃষার নরম হাতগুলো আগলে ধরেছে তাকে৷ মেয়েটার কান্নাটা বেড়ে উঠেছে৷ স্টুডিয়োতে কি খারাপ কিছু হয়েছে তৃষার সঙ্গে?

দীপ ফোন করেছে৷ বিনোদ সেই অবস্থাতেই ফোনটা রিসিভ করে কানে লাগায়৷ ওপাশ থেকে গলা শোনা যায়, ‘শালা আহাম্মক, আজ আবার স্টুডিয়োতে ছাতা ফেলে যাচ্ছিস৷’

—‘এঃ! একদম ভুলে গিয়েছি৷ তুলে রাখ, কাল এসে নেব৷’

—‘এখন তো বৃষ্টি পড়ছে৷ ভিজে বাড়ি ফিরবি নাকি?’

—‘বৃষ্টি পড়ছে!’ বিড়বিড় করে বিনোদ, ‘আচ্ছা, দাঁড়া, লিফটে আছি৷ ব্যাক করছি…’

দীপ ফোন রেখে দিতে যাচ্ছিল, এমন সময় ওপাশ থেকে একটা গলা শুনতে পেল বিনোদ৷ সে একটু থমকে বলল, ‘দীপ, শুনছিস?’

—‘কী?’

—‘তোর পাশ দিয়ে এখুনি কেউ হেঁটে গেল, গান গাইতে গাইতে…’

—‘হ্যাঁ… গেল তো…’

—‘কে?’

কয়েক সেকেন্ড সময় নিল দীপ, তারপর উত্তর শোনা গেল, ‘তৃষা…. ওয়াশরুমের দিকে গেল…’

দীপ মিথ্যে বলেনি৷ গলার আওয়াজটা শুনেছে বিনোদ৷ তার বাঁ হাতটা এতক্ষণ তৃষার মাথায় ছিল৷ এবার সেটা নেমে আসে৷ দু-হাতের ধাক্কায় তাকে ছিটকে দূরে সরিয়ে দেয় বিনোদ৷

—‘কে তুমি?’

ফাঁকা লিফটের মধ্যে গমগম করে ওঠে চিৎকারটা৷

তৃষার মুখটা এখন ঢেকে আছে কপাল বেয়ে নেমে আসা-ঘন চুলের ঝালরে৷ মিষ্টি সুর কানে আসছে বিনোদের৷ সুরটা সে একটু আগেই কোথাও শুনেছে৷

—‘ও মা! আমি তৃষা, সেই যার চোখ দুটো ভালো লাগে তোমার? দেখবে এখন আমার চোখ দুটো?’ উচ্ছল গলায় বলে তৃষা, কিন্তু তাতেই বিনোদের শরীরের মাঝখান দিয়ে একটা সরীসৃপ উঠছে মনে হয়৷

মুখটা একটুও দেখা যাচ্ছে না৷ ধীরে ধীরে তৃষার দুটো হাত উঠে আসে৷ চুল দু-পাশে সরিয়ে নিজের মুখটা দেখাতে চায় সে৷

—‘উঁহুঁ… চোখ সরালে চলবে না৷ তাকিয়ে থাকো আমার দিকে… দ্যাখো, দ্যাখো আমার চোখ দুটো… বিনোদ…’

বিনোদের পা কেঁপে ওঠে৷ নিজের বুকের দিকে তাকায় সে৷ এতক্ষণ বুকে যে তরল স্পর্শটাকে সে জল ভাবছিল, সেটা জল নয়, রক্ত! মাঝখান থেকে চিরে চুল দু-দিকে ফাঁক করছে তৃষা৷

—‘তাকিয়ে আছ তো?…’ খেলার ছলে বলে সে, ‘এক… দুই…’

তিন গোনার আগেই কয়েক সেকেন্ড থেমে যায় তৃষা৷ তারপর এক ঝটকায় সরিয়ে ফেলে সমস্ত চুল৷ তীব্র আকাশ বিদীর্ণ করা পৈশাচিক হাসিতে ফেটে পড়ে সে৷ একটু আগে যে হাসি দেখতে চাইছিল বিনোদ…

তার ঘন হরিণ চোখের মণিটা এখন উধাও৷ সাদা, পোর্সিলিনের মতো দুটো চোখ৷ উদ্দাম নারকীয় হাসিতে বারবার কেঁপে উঠছে, কালো চেরা দাগে ভরে যাচ্ছে মুখ৷ তৃষার শরীরটা বদলে যাচ্ছে অন্য কিছুতে৷ একটু আগের সেই মিহি সুরটা বেড়ে চলেছে…

(দুই)

—‘আপনার নাম?’

—‘দীপ্তাংশু মিত্র৷’

—‘ভিকটিম শেষ আপনাকেই কল করেছিল?’

সেদিনের কথা মনে পড়লে এখনও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে দীপের৷ এই ক-দিন রাতে ভালো ঘুম হয়নি৷ চোখ বুজলেই বিনোদের মাঝখান থেকে দু-ভাগ হওয়া শরীরটা…

স্টুডিয়োরই ওয়েটিং রুমে ইন্টারোগেশন চলছে৷ দীপের সামনে বসে আছেন ইন্সপেক্টর নিরলস ব্যানার্জি৷ ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি৷ সুঠাম ঋজু চেহারা৷ শান্ত, ঘন চোখে চেয়ে আছেন সামনের টেবিলে বসা দু-জনের দিকে৷ একটু আগে লিফটের সিসিটিভি ফুটেজ দেখার পর থেকেই তাঁর ভুরু দুটো কুঁচকে আছে৷

—‘ও করেনি স্যার, আমি করেছিলাম৷ ছাতা নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিল, ভাবলাম এখনও বেশি দূর যায়নি, তাই কল করে ফিরে আসতে বললাম৷’

—‘গলায় অস্বাভাবিক কিছু খেয়াল করেছিলেন?’

—‘অস্বাভাবিক কিছু…’ একটু ভাবতে হয় দীপকে, ‘শিয়োরলি বলতে পারব না, তবে মনে হয়, একটু এক্সাইটেড লাগছিল৷’

কবজির উপর রাখা নোটবুকে কিছু লিখে নিলেন ইন্সপেক্টর, তারপর মুখ তুলে বললেন, ‘দেখুন দীপ্তাংশুবাবু৷ খুন একটা হয়েছে, মানে খুনি একজন আছে৷ এবং এখানে যেভাবে খুন হয়েছে, তাতে আত্মহত্যার কথা ভাবাই যায় না৷ খুনি একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাইছে এটা খুন! স্ট্রেঞ্জ!’

পরের কথাগুলো বলতে ইতস্তত করে দীপ, ‘আপনি তো স্যার ফুটেজটা দেখলেন৷ তারপরেও বলবেন এটা স্বাভাবিক একটা খুন?’

—‘অলৌকিক কিছু সাজেস্ট করতে চাইছেন?’ ব্যঙ্গের হাসি ফুটে ওঠে ইন্সপেক্টরের মুখে, ‘ফুটেজে যা দেখা যাচ্ছে, সেটা অ্যাবসার্ড বটে, কিন্তু অলৌকিক ছাড়াও তার ব্যাখ্যা দেওয়া যায়৷’ বড় করে একটা নিঃশ্বাস নেন ব্যানার্জি, ‘ফুটেজে আমরা দেখছি সেদিন সন্ধে সাতটা পনেরোতে আঠেরোতলা থেকে লিফটে ওঠেন বিনোদবাবু৷ সে সময়ে লিফটে তিনি একাই ছিলেন৷ তবে ওঠার পর থেকেই তিনি অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করেন৷ দেখে মনে হয় যেন তাঁর সঙ্গে অন্য কেউ আছে৷ কারও সঙ্গে কথা বলতেও শোনা যায়৷ অথচ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে লিফট ফাঁকা৷ আমরা ধরে নিতে পারি, কোনওরকম মানসিক সমস্যা ছিল তার৷ হ্যালুসিনেশন৷ এর কিছুক্ষণ পর লিফটের আলো নিবে যায় এবং মিনিট দশেক আলো বন্ধ থাকে৷ আলো জ্বলে উঠতে দেখা যায়, বিনোদবাবুর দেহ লিফটের মেঝেতে পড়ে আছে৷ এবং শরীর মাঝখান থেকে দু-ভাগ করে কাটা৷ কোয়াইট আ গোর৷ কিন্তু এমন তো হতেই পারে যতক্ষণ আলো বন্ধ ছিল, তার মধ্যে কেউ লিফটে ঢুকে খুনটা করে বেরিয়ে যায়?’

দীপের পাশের চেয়ারেই বসে ছিল জয়ন্ত৷ মুখ তুলে বলে, ‘দশ মিনিটের মধ্যে একটা মানুষকে আধখানা করে লম্বালম্বি কেটে ফেলা… এটা সম্ভব স্যার? তা ছাড়া লিফটের লগ বলছে, ওই সময়ের মধ্যে লিফট একবারও থামেনি, চলন্ত লিফটের মধ্যে মানুষ কী করে ঢুকবে বলুন তো?’

গালের খোঁচা-খোঁচা দাড়িতে হাত বোলালেন ব্যানার্জি, ‘মানে আপনাদের যুক্তি হল একটা ফাঁকা অন্ধকার লিফটের মধ্যে একটা নিরস্ত্র মানুষ নিজেকে দু-আধখানা করে কেটে ফেলেন! দ্যাট টু কোনও ওয়েপন ছাড়া!’

‘এটা কোনও মানুষের কাজ নয়, স্যার৷’ কথাটা বলতে গিয়ে জয়ন্তর গলা কেঁপে যায়৷

সেদিনের ঘটনার পরে প্রায় দিন সাতেক কেটে গেছে৷ স্টুডিয়োর পরিবেশ আগের থেকে কিছুটা শান্ত হয়েছে৷ কাজকর্ম আবার শুরু হয়েছে আগের মতো৷ বিনোদের দেহ ফরেনসিক করে আলাদা কিছু পাওয়া যায়নি৷ তারা জানিয়েছে, ‘ক্লিন কাট, কোনও ধারালো অস্ত্র দিয়ে উপর থেকে নিচ অবধি মাছের মতো কাটা হয়েছে মানুষটাকে৷ শরীরের দুটো ভাগেই অন্য কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই৷’

—‘আপনাদের স্টুডিয়োটা কত দিনের?’

—‘এই বছর পাঁচেকের হবে৷’ জয়ন্ত বলে৷

—‘মালিক তো আপনি?’ দীপের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করেন ব্যানার্জি৷

—‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷’

—‘কী ধরনের কাজ হয় এখানে?’

—‘সাউন্ড স্টুডিয়োতে যা হয়, অনেকে গান রেকর্ড করতে আসে, আমরা সুরও তৈরি করে দিই দরকার হলে৷ তারপর ধরুন ফলি থেকে শুরু করে…’

—‘মোট ক-জন কাজ করে এখানে?’

—‘স্টুডিয়োটা তো বিশেষ বড় নয়৷ সব মিলে পাঁচজন৷’

—‘নামগুলো বলবেন?’

দীপ বড় একটা শ্বাস নিয়ে বলতে থাকে, ‘আমরা দু-জন ছাড়া তৃষা বলে একটি মেয়ে আছে৷ তা ছাড়া বিকাশদা রেকর্ডিংটা দেখেন৷’

—‘বেশ, আপনারা কী কাজ করেন?’

—‘তৃষা রিসেপশনিস্ট, কোনও ক্লায়েন্টের ফিমেল ভয়েস ওভার দরকার হলে ও করে দেয়৷ বাকি আমরা তিনজন সাউন্ড মিক্সিংটা দেখি৷’

—‘আর যিনি মারা গিয়েছেন, আই মিন বিনোদ কাঞ্জিলাল?’

—‘ও মেইনলি ভয়েস ওভার করত৷ মানে টিভিতে যে বিজ্ঞাপন-টিজ্ঞাপন দেখেন, সেখানে যেমন থাকে-না…’

—‘হুম…’ নোটবইটা বন্ধ করে পকেটে রাখেন ব্যানার্জি, তারপর জয়ন্তর দিকে চোখ ফিরিয়ে বলেন ‘আপনি এখন যেতে পারেন৷ দীপ্তাংশুবাবুর সঙ্গে একটু দরকার আছে আমার৷’

জয়ন্ত বেরিয়ে যেতে ব্যানার্জি দীপের দিকে ফেরেন, ‘দেখুন৷ এটা যে হোমিসাইড তাতে সন্দেহ নেই৷ যেহেতু স্টুডিয়োর বিল্ডিং-এই হয়েছে এবং বিল্ডিঙের দারোয়ান বাইরে থেকে কাউকে লিফটে উঠতে দেখেনি তাই আপনাদের চারজনের কেউই সন্দেহের বাইরে নন৷ আপনাদের ফোন নম্বর আর ঠিকানাগুলো একটু লাগবে আমার৷’

—‘বাকিদেরগুলো দিচ্ছি, কিন্তু আমার ফোনটা ক-দিন হল সার্ভিস সেন্টারে দিয়েছি৷ কল রিসিভ করতে পারব না৷’

—‘সারাতে দিয়েছেন কেন?’

—‘একটু প্রবলেম হচ্ছে, স্যার৷ কল রিসিভ করলেই কখনও মিউট, আবার কখনও নিজে থেকেই কল রেকর্ড শুরু হয়ে যাচ্ছে৷’

কিছুটা এগিয়ে বসলেন ইন্সপেক্টর, ‘মানে ঘটনার দিনের আপনার সঙ্গে বিনোদবাবুর কলটাও রেকর্ড হয়ে থাকতে পারে!’

দীপের চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে ওঠে—‘হ্যাঁ… হ্যাঁ স্যার৷ হতে পারে৷ আমার খেয়াল ছিল না একদম৷’

‘যদি হয়ে থাকে তাহলে ওই রেকর্ডিংটা আমার চাই…’, টেবিলের উপরে হাত দিয়ে চাপড় মারেন ব্যানার্জি৷ নার্ভগুলো উত্তেজিত হয়ে ওঠে তার৷

—‘ফোনটা ঠিক হয়ে এলেই আমি আপনাকে…’

—‘না৷ এক্ষুনি লাগবে আমার… সার্ভিস সেন্টারের নম্বর আছে?’

—‘আমার কাছে নেই, কিন্তু ইন্টারনেটে পাওয়া যাবে৷’

—‘লুক ফর ইট৷ তারপর কল করে বলুন ওটা এক্ষুনি পাঠিয়ে দিতে৷’ দীপ দ্রুত ল্যাপটপ টেনে নিয়ে সার্চ করতে শুরু করে৷ ব্যানার্জি ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে গোটা স্টুডিয়োটা ভালো করে ঘুরে দেখতে থাকেন৷ মোট চারটে রুম৷ একটা রিসেপশন কাম ওয়েটিং রুম৷ একটা রেকর্ডিং রুম আর দুটো ঘরে বড় মেশিনে মিক্সিং হয়৷ রেকর্ডিং রুমের দু-দিকের দেওয়ালে দুটো বড় কাচের জানলা৷ দুটো জানলা দিয়ে দুটো মিক্সিং রুমের ভিতর দেখা যায়৷ রেকর্ডিং রুমে শিল্পীকে হাতের ইশারায় কিছু সংকেত দেওয়ার জন্য ব্যবহার হয় জানলাগুলো৷ তবে মূলত মিক্সিং রুম থেকে কণ্ঠশিল্পীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হয় হেডফোনের মাধ্যমে৷

ব্যানার্জি ফাঁকা রেকর্ডিং রুমের ভিতর ঢুকে এলেন৷ ঘরে দুটো চেয়ারের উপর দুটো হেডফোন রাখা৷ সেগুলোতে কান রাখলে মিক্সিং রুমগুলোর ভিতরের শব্দ শোনা যাবে৷

ব্যানার্জি প্রথম হেডফোনটায় কান রাখতে রুমের স্পিকারে বাজতে-থাকা বাউল গানের সুর শুনতে পেলেন৷ সেই সঙ্গে দু-জন মানুষের কথাবার্তা৷ গানে ঠিকঠাক সুর বসছে কি না সেই নিয়ে আলোচনা চলছে৷

সরে এসে দ্বিতীয় হেডফোনটায় কান রাখলেন তিনি৷ জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ঘরটা অন্ধকার৷ অর্থাৎ কাজ হচ্ছে না সেখানে৷ অথচ একটা মিষ্টি সুর বেজে চলেছে হেডফোনে৷ সুরটা চালিয়ে রেখেই কি কেউ ঘর অন্ধকার করে চলে গিয়েছে?

হঠাৎ ব্যানার্জির মনে হল ঘরের ভিতরের অন্ধকারটা নিষ্প্রাণ নয়৷ কিছু একটা নড়াচড়া করছে সেখানে৷ হাত তুলে একটা ইশারা করলেন তিনি৷ মনে হল, ওদিকের মানুষটাও হাত তুলল৷ জানলার কাছে ডাকল কি?

ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন তিনি৷ ঘরের অন্ধকার আর-একটু গাঢ় হয়ে উঠল৷ জানলার কাচ ঘেঁষে চোখ নিয়ে যেতে ব্যানার্জির মনে হল, জানলার ঠিক ওপারেই একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ তবে কোন দিকে তাকিয়ে আছে, বোঝা যাচ্ছে না৷ কারণ তার গোটা মুখটা চুল দিয়ে ঢাকা৷ সেই সুরটা এখন আর শোনা যাচ্ছে না৷ তার বদলে ফিসফিস করে কী যেন বলে চলেছে মেয়েটা৷ মন্ত্র পড়ছে কি? ভারী গা ছমছম করে গলাটা শুনলে৷

একটু আগেই দীপ্তাংশু বলে ছেলেটা বলছিল, এখানে সিনেমার কী সব কাজও হয়… তাহলে কোনও হরর মুভির এসএফএক্স-এর কাজ হচ্ছে এখন? কিন্তু কম্পিউটারগুলো চলছে না কেন?

কী মনে হতে জানলার কাচে কান রাখলেন ব্যানার্জি৷ মন্ত্রটা আরও জোরে শোনা যেতে লাগল৷ ভাষাটা পরিচিত নয়…

হঠাৎ থেমে গেল সব শব্দ৷ অখণ্ড নৈঃশব্দ্যে ভরে উঠল জানলার কাচ৷ কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করলেন ব্যানার্জি৷ এক… দুই… তিন…

এক ঝটকায় জানলায় মুখ ফেরাতেই তার বুকের ভিতরটা ঠান্ডা হয়ে গেল৷ মেয়েটা আরও কিছুটা এগিয়ে এসেছে৷ জানলার ওপারে একদম তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে৷ এখনও আগের মতোই চুল দিয়ে ঢাকা মুখটা৷ এবার তার নিঃশ্বাসের শব্দও শোনা যাচ্ছে৷

কিন্তু… একটা খটকা লাগল ব্যানার্জির৷ মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে জানলার ওপারে, অথচ ঠান্ডা নিঃশ্বাস এসে পড়ছে ব্যানার্জির ঘাড়ের পিছনে৷ এ কী করে হয়? কী করে…

আতঙ্কিত চোখে ব্যানার্জি খেয়াল করলেন— মেয়েটা জানলার ওপাশে দাঁড়িয়ে নেই৷ কাচের জানলার ওপাশে তার প্রতিচ্ছবিটা পড়েছে৷ অর্থাৎ সে দাঁড়িয়ে আছে এপারে…

আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলেন ব্যানার্জি৷ সঙ্গে সঙ্গে ঘরের দরজা খুলে গেল৷ দীপ এসে ঢুকল ঘরে৷ ব্যানার্জি হাঁপাতে হাঁপাতে পাশে তাকিয়ে দেখলেন জায়গাটা ফাঁকা৷ কেউ নেই সেখানে…

—‘স্যার…’ ব্যানার্জির চিৎকারে একটু অবাক হয়েছে সে৷ একবার ঢোঁক গিলে বলল, ‘রেকর্ডিংটা এসেছে স্যার৷ আমার মেইলে৷’

—‘গ্রেট, চলুন৷’ সামলে নিতে সময় লাগল ইন্সপেক্টরের৷ রিসেপশনের দিকে এগোতে এগোতে বললেন, ‘আচ্ছা, মিক্সিং রুম-বি-তে কোনও কাজ হচ্ছে আপনাদের?’

—‘না৷ পুজো দেরি আছে, কাজের চাপ কম৷ ঘরটা এখন ফাঁকাই থাকে৷’ দীপের ল্যাপটপে একটা হেডফোন গুঁজে রেকর্ডিংটা শুনতে লাগলেন ব্যানার্জি৷ রেকর্ডিং-এর কয়েক জায়গা মিউট হয়েছে৷ লিফটের ভিতরে নেটওয়ার্কের অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়৷ ফলে কথাগুলোও স্পষ্ট নয় খুব একটা৷ ব্যানার্জি ভলিউম ফুল করে মন দিয়ে শুনতে লাগলেন৷ বিনোদের গলায় উত্তেজনার ছাপ স্পষ্ট৷

রেকর্ডিং-এর একটা জায়গায় আটকালেন ব্যানার্জি৷ দীপ এপার থেকে তৃষার নাম বলতে আচমকাই কথা থামিয়ে দিল বিনোদ৷ ধরা, আতঙ্কিত গলায় একটা প্রশ্ন করল, ‘কে তুমি?’

অর্থাৎ লিফটে কেউ ছিল ওর সঙ্গে? নাকি এটাও হ্যালুসিনেশনের অঙ্গ৷ আবার প্লে করতে অন্য একটা জিনিস কানে এল ব্যানার্জির৷ একটা মিষ্টি সুর৷ বিনোদের ফোন তো এখনও ধরা আছে৷ তা ও সুর ভেসে আসছে কোথা থেকে? তার থেকেও বড় কথা-সুরটা ব্যানার্জির চেনা৷

একটু আগেই মিক্সিং রুম-বি থেকে এই সুরটাই ভেসে আসছিল…

(তিন)

রিককে ঘুম পাড়িয়ে ক্রিবটাকে একবার দুলিয়ে একটা ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় ফিরে এল বিকাশ৷ ক্রিবের পাশেই রাখা দু-ইঞ্চি স্পিকারে রিমির গলায় রেকর্ড করা একটা লালাবাই চালিয়ে দিয়েছে৷ মায়ের গলা পেয়েই মনে হয় একটু শান্ত হয়েছে রিক৷ রাত হতে মা-কে দেখতে না পেয়ে পাড়া মাথায় করেছিল ছেলেটা৷ আপাতত ঘুমিয়ে পড়েছে৷

নিশ্চিন্ত হয়ে বিছানায় ফিরে এসে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে বিকাশ৷ আজ সারাদিন একটা বড় অডিয়ো প্রোজেক্টের রেকর্ডিং ছিল৷ টানা আট ঘণ্টা স্পিকারের অত্যাচার চলেছে কানের কাছে৷ কোনও যান্ত্রিক শব্দই আর এখন সহ্য হচ্ছে না৷ ফোনটাও সাইলেন্ট করা৷ কেবল লালাবাইটা কানে আসছে৷ ভারী মিষ্টি করে গান গাইতে পারে রিমি৷ শুনতে এতটুকু বিরক্ত লাগছে না৷

জানলা দিয়ে একবার বাইরে তাকাল সে৷ ওদের ফ্ল্যাটটা এগারোতলায়, ফলে আশপাশের ঘরবাড়ি প্রায় কিছুই চোখে পড়ে না৷ একটা অতিরিক্ত বেড়ে-ওঠা নারকেল গাছ রাতের হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে কিছু দূরে৷ তা ছাড়া জানলার গোটাটা জুড়েই কালচে লাল আকাশ৷

নারকেল গাছটার মাথা দোলানো দেখতে দেখতে ঘুম পায় বিকাশের৷ এসি চলছে৷ চাদরটা গায়ের উপরে টেনে নেয়ে৷ বিকাশের শরীরটা লম্বা, ফলে পায়ের খানিকটা বেরিয়ে থাকে বিছানার বাইরে৷ সেখানে চাদর পৌঁছোয়নি৷ ঘুমিয়েই পড়েছিল বিকাশ৷ হঠাৎ মনে হল, নরম ছোঁয়া লাগল ওর পায়ের বেরিয়ে-থাকা অংশে৷ মনের ভুল নয়, বিকাশ নিশ্চিত৷ কিন্তু কে স্পর্শ করবে ওকে? বাড়িতে তো রিক ছাড়া কেউ নেই…

মনের ভুল? নাকি কেউ ঢুকল ঘরে?

—‘কে?’ কেউ নেই বলেই ঘুম-জড়ানো গলায় প্রশ্নটা করল বিকাশ৷ কোনও উত্তর এল না৷

সে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল৷ এগিয়ে গিয়ে দরজাটা দেখল একবার৷ নাঃ, টাইট করে বন্ধ করা আছে সেটা৷ আবার বিছানায় ফিরে যাচ্ছিল, ক্রিবের মধ্যে চোখ বাড়াল একবার৷ ছেলেটা ঘুমোনোর সময় মুখ দিয়ে শব্দ করে৷ এখন এত নিস্তব্ধ লাগছে কেন?

এতক্ষণে রিমির লালাবাই শেষ হয়ে গেছে৷ ক্রিবের পাশের ছোট ফ্ল্যাশ ড্রাইভে পরের ফাইল প্লে করছে স্পিকারটা৷ কিছু একটা কারণে একটু অবাক হয় বিকাশ৷ এটা গান নয়, একটা মিষ্টি সুর৷ একটু আগেই সুরটা শুনছিল, ভারী মিষ্টি আদুরে সুর, সে বন্ধ করল না৷

ক্রিবের পাশের নীল নাইটল্যাম্পটা জ্বেলে নিল বিকাশ৷ আর সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠল৷ ঘুমের ঘোরে নিজের গায়ের জামাটা উপরে তুলে মাথা ঢেকে ফেলেছে রিক৷ আর নিঃশ্বাস নিতে পারছে না৷

‘ওঃ গড!’ মনে মনে কথাটা বলে জামাটা নামিয়ে দেয় বিকাশ৷ বাচ্চাটার সমস্ত মুখ লাল হয়ে গেছে৷ দম নিতে নিতে মুখ দিয়ে কিছু শব্দ করে রিক৷ কী ভেবে বিকাশ খুলে নেয় জামাটা৷ বাচ্চার মাথায় একবার হাত বুলিয়ে ফিরে আসতে যাচ্ছিল বিছানায়৷ এমন সময় একটা জিনিস চোখে পড়তে সে থমকে যায়৷ ক্রিবের গদির উপর হাত দুটো দিয়ে বারবার আঁচড় কাটছে রিক৷ গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে, একটানা৷ ওইটুকু বাচ্চার আঁচড়েও গর্ত হয়ে গেছে তোশকে৷

দ্রুত পকেট থেকে ফোন বার করে করে রিমির নম্বরটা ডায়াল করে বিকাশ৷ কয়েকবার রিং হবার পর ওপাশ থেকে গলা শোনা যায়, ‘বাঃ একদম ঠিক সময়ে ফোন করেছ৷ যেই ঘুমিয়েছিলাম অমনি…’

—‘আসলে মনে পড়ছিল খুব তোমার কথা৷ কাল ভোরে ফিরছ তো?’

—‘হ্যাঁ, আর সেইজন্যেই এখন ঘুমোতে হবে…’

—‘আচ্ছা, শোনো-না৷’

—‘কী?’

বিকাশ কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বলে, ‘বলছি রিক বারবার দু-হাতে তোশক আঁচড়াচ্ছে৷ কখন এরকম করে বলোতো? খিদে পেয়েছে?’ এবার রাগত গলায় উত্তর দেয় রিমি, ‘তুমি আবার ওকে ভয় দেখিয়েছ৷’

—‘ভয়! মানে আমি…’

—‘অপদার্থ কোথাকার৷ মনে নেই? সেই একবার ভয়ঙ্কর একটা মুখোশ পরে ওর সামনে গিয়ে জোকারপনা করেছিলে, তারপরেই ওরকম করেছিল৷ আবার যদি আমার ছেলেকে ভয় দেখিয়েছ তাহলে কাল ভয় কাকে বলে, আমি বোঝাব তোমাকে৷’

—‘ধুর, আমি ভয় দেখাব কেন! নিজে মরছি নিজের জ্বালায়…’

—‘চুপ করো, তোমাকে চেনা আছে আমার…’

আর দু-চারটে বকাঝকা শুনিয়ে ফোন রেখে দেয় রিমি৷ বিকাশ ক্রিবের কাছে ফিরে এসে দ্যাখে আঁচড়ানো থামিয়ে দিয়েছে রিক৷ উলটে এখন অস্পষ্ট শব্দ করে হাসছে৷ কোনও কারণে ভারী খুশি হয়েছে৷

—‘কী রে? এত আনন্দের কী হয়েছে তোর?’ ছেলের পেটে একটা আঙুল রেখে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে বিকাশ৷ আনমনে হাসতে হাসতে একটা হাত ডান পাশে ছড়িয়ে দেয় রিক৷ হাতের তর্জনীটা সোজা হয়ে উঠে আছে৷ যেন কিছু দেখাতে চাইছে সে৷ বাচ্চারা অবশ্য এমন করেই থাকে৷ কী মনে হতে সেটা লক্ষ করে ঘরের দেওয়ালের দিকে তাকায় বিকাশ৷ রিক জানলার দিকে আঙুল দেখাচ্ছে৷ একটা আট মাসের বাচ্চা জানলা দেখাবে কেন? নাঃ, এমনিই তুলেছে আঙুলটা৷

বিকাশ ফিরে আসতে যাচ্ছিল বিছানার কাছে৷ এমন সময় একটা ব্যাপার খেয়াল করে৷ রিমির গলায় গান আবার শোনা যাচ্ছে৷ কিন্তু এবার আর স্পিকার থেকে নয়৷ গানটা ভেসে আসছে ফ্ল্যাটের জানলার বাইরে থেকে৷ রিকের হাসির শব্দ বেড়ে ওঠে সেই সঙ্গে৷

শ্বাস বন্ধ করে জানলার দিকে তাকায় বিকাশ৷ কাচের জানলার নীচ থেকে একটু একটু করে উপরে উঠে আসছে একটা মানুষের মাথা৷ চুল, চোখ, মুখ৷ এই মুখ বিকাশ চেনে— রিমি! কিন্তু এগারোতলার জানলায়…

বিকাশের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে গেয়ে চলেছে রিমি৷ মুখে মৃদু হাসি৷ ডান হাতটা উপরে তুলে হাতছানি দিল৷ জানলাটা খুলতে ইশারা করল৷

বিকাশ মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে গিয়ে খুলল জানলাটা৷

—‘তু… তুমি এখানে… আর এভাবে…’

—‘তুমি তো বললে, দেখতে ইচ্ছা করছে আমাকে… বলোনি?’

—‘হ্যাঁ… কিন্তু?’ বিকাশের মনে হল, এবার ও জ্ঞান হারাবে৷ মাথার ভিতরেও একটা চাপা যন্ত্রণা সবকিছু গুলিয়ে দিচ্ছে বারবার৷

—‘বাইরে দাঁড়িয়ে থাকব৷ ভিতরে আসতে বলবে না?’

জানলা থেকে সরে দাঁড়ায় বিকাশ৷ রিমি দু-হাতে জানলা ধরে ভিতরে ঢুকে আসে৷

—‘আমার খুব খিদে পেয়েছে, জানো…’ কথাটা বলতে বলতে এগিয়ে যায় রিকের দিকে৷ রিকের হাসিটা এখন অস্বাভাবিক শোনাচ্ছে৷ একটা বাচ্চা এভাবে হাসতে পারে না৷

—‘আমারও খুব মনে পড়ছিল তোমার কথা, ভীষণ ভীষণ ভীষণ…’ আচমকা এক ঝটকায় বিকাশের সামনে চলে আসে রিমি, ‘এই তোমার মনে আছে? বিয়ের ঠিক পরপর আমরা মিউজিক চালিয়ে সালসা নাচতাম, এই ঘরেই তো?’

‘হ্যাঁ… মানে…’

‘লেট’স ডান্স…’

স্পিকারে এখন স্যাক্সোফোন বাজতে শুরু করেছে৷ কিন্তু তার সুরটা সেই আগের মিষ্টি সুরের মতো৷ এবার শুধু তার সঙ্গে মিশেছে একটা বাচ্চা ছেলের হাসি… রিকের হাসি…

বিকাশের কোমরে দুটো হাত রাখে রিমি৷ কিশোরী মেয়ের মতো উচ্ছল দেখায় তাকে৷ খলখলিয়ে হেসে ওঠে সে৷

বিকাশের মনে হয়, তার কোমরে হাতের চাপ বাড়ছে৷ হাত নয়, যেন দুটো ধারালো ছুরির ফলা বসে যাচ্ছে কোমরে৷ তার শরীরটাকে ভাগ করে ফেলছে দু-ভাগে৷

‘রিমি… তুমি…’ মুখ তুলে রিমির চোখে তাকায় বিকাশ… রিমি আর নেই সেখানে৷ সে অন্য কিছুতে বদলে যাচ্ছে…

(চার)

দরজা খুলে অবাক হয়ে গেলেন নিরলস ব্যানার্জি৷ দরজার ওপাশে যে মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে তাকে তিনি আগেও দেখেছেন৷ কিন্তু তার মুখ-চোখের অবস্থা যে এরকম হতে পারে তা তিনি আগে কল্পনা করেননি৷ ছেলেটার চোখ দুটো কোটরে ঢুকে গেছে৷ সেই কোটরে রাতজাগা কালির ছাপ৷ মুখে না-কাটা গোঁফ-দাড়ির জঞ্জাল৷ জামার কলারটা কাঁধের দিকে ঢুকে আছে৷ বোঝা যায়, এই ক-দিনে কিছু একটা ভাবনা তাকে পাগল করে তুলেছে৷

—‘এ কী! আপনি এখানে?’

মুখ তুলে অস্পষ্ট গলায় দীপ বলে, ‘আ… আপনার ফোন নম্বরটা নেওয়া হয়নি, না হলে আগে ফোন করে আসতাম৷ আমার একটা স্বীকারোক্তি দেওয়ার আছে…’

—‘ভিতরে আসুন৷ তারপর কথা বলছি৷’ দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ালেন ব্যানার্জি৷ দীপ ভিতরে আসতে দরজাটা বন্ধ করে তাকে বসার ঘরে একটা চেয়ার দেখিয়ে দিলেন৷ ধোয়া মুখ তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতে দীপের সামনের চেয়ারে এসে বসে বললেন, ‘বলুন, কী বলার আছে…’

মুখ নামিয়ে নেয় দীপ৷ গলকণ্ঠটা একবার ওঠানামা করে৷ কপালে নুয়ে-পড়া উশকো খুশকো চুলগুলো চেপে ধরে বলে, ‘স্যার, বিনোদ আর বিকাশের মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী…’

—‘আপনার বক্তব্য রেকর্ড করতে পারি?’

দীপের ক্লান্ত মুখে একটা হাসি ফুটে ওঠে, ‘পারেন৷ কিন্তু সেই রেকর্ড কারও হাতে গেলে আমি জেলে যাব কি না জানি না, তবে অ্যাসাইলামের টিকিট নিশ্চিত৷’

নিজের স্মার্টফোনে রেকর্ডিং বাটন অন করে টেবিলে রাখেন ব্যানার্জি, তারপর মুখ তুলে বলেন, ‘হোয়াটএভার৷ বলুন এবার৷’

একবার গলাখাঁকারি দিয়ে বলতে থাকে দীপ, ‘ছোট থেকেই দেখেছি আমাদের পরিবারের সঙ্গে মিউজিকের একটা বড় যোগাযোগ রয়েছে৷ আমার দাদুর বাবা ছিলেন ভারতবিখ্যাত মিউজিশিয়ান৷ নাম বললে চিনতেও পারেন৷ শুধু তা-ই নয়, মিউজিকের খোঁজে দেশ-দেশান্তরে ঘুরেও বেড়াতেন৷ সংগ্রহ করে আনা শিট-মিউজিক একটা হলদে ডায়েরিতে লিখে রাখতেন৷ পৃথিবীর নানা প্রান্তের প্রায় দেড়শোরকম বাজনার কালেকশন ছিল তাঁর৷ কোন মিউজিকে কোন ইন্সট্রুমেন্টে বাজাতে হবে, সেটাও লেখা থাকত ডায়েরিতে৷

যাই হোক, তাঁর মৃত্যুর পর আমার দাদুর কাছে আসে সেই ডায়েরি আর ইন্সট্রুমেন্টস৷ সেখান থেকে ইভেঞ্চুয়ালি আমার বাবার কাছে৷ বাবারও মিউজিকে আগ্রহ ছিল না তা নয়, কিন্তু অল্প বয়সে কাগজের ব্যবসায় নেমে বিরাট টাকা লস খান তিনি৷ মার্কেটে ভয়ানক ধারবাকি পড়ে যায়৷ উপায়ান্তর না দেখে তিনি দাদুর ইন্সট্রুমেন্টের কালেকশন থেকে কিছু ইন্সট্রুমেন্ট বেচে দেন৷

আমার যখন পনেরো বছর বয়স তখন সেই ডায়েরিটা বাবার থেকে আমার হাতে আসে৷ বাবা ডায়েরিটা আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন, ‘দেখ দীপু, এ ডায়েরিটা আমাদের বংশের সম্পদ৷ পৃথিবীর প্রায় একশোটা দেশের এমন সব অজানা সুর এতে লেখা আছে, যা আজ পৃথিবী থেকেই হারিয়ে গেছে৷ এইসব সুর বাজাতে পারলে তোর ভিতরের সমস্ত সংকীর্ণতা, হিংসা, ঘৃণা মুছে যাবে৷ শুধু ডায়েরির একেবারে শেষ পাতায় একটা সুর লেখা আছে৷ ওইটা কোনওদিন বাজাতে যাস না৷ সর্বনাশ হবে…’

—‘আপনি তো জানেন স্যার, যেটা বারণ করা হয, সেটার প্রতিই আমাদের আগ্রহ জন্মায় বেশি৷ শেষ পাতার সুরটাই ডায়েরি খুলে প্রথম দেখি আমি৷ সে ভারী অদ্ভুত সুর, জানেন? আমরা পড়েছিলাম, ডায়াটোনিক স্কেলে একটা অক্টেভের মধ্যে একটাই ট্রাইটোন থাকতে পারে, অঙ্কের মতো মিউজিকের ক্ষেত্রে এ নিয়মটার নড়চড় হবার জো নেই৷ কিন্তু এই মিউজিকে এক অক্টেভে পাঁচটা থেকে ছ-টা ট্রাইটোন আছে৷ মানে সুরটা প্রকৃতির নিয়মের বাইরে৷ অশুভ৷

তবে বাবা আমাকে তেমন একটা গুরুত্ব দিয়ে সতর্ক করেননি, তার একটা কারণ হল এই যে, মিউজিকটা বাজাতে হবে ডুডুক দিয়ে৷ ডুডুক হল একটা প্রাচীন আর্মেনিয়ান ইন্সট্রুমেন্ট৷ খানিকটা বাঁশির মতো৷ আমাদের কালেকশনে ছিল, কিন্তু বাবা বিক্রি করে দিয়েছিলেন৷ ফলে আমার আগ্রহ থাকলেও বাজাতে পারিনি৷’

—‘ডায়েরিটা আছে আপনার কাছে?’ একমনে শুনছিলেন ইন্সপেক্টর৷ এবার প্রশ্ন করেন তিনি৷

—‘এখন নেই, বাড়িতে আছে৷’

—‘আচ্ছা বেশ, সেটা নিয়ে আসবেন একটু৷ এখন বলতে থাকুন৷’ জামার হাতায় কপালের ঘাম মোছে দীপ,

—‘হ্যাঁ… এবার এখনের ঘটনায় আসছি৷ আমি মেইনলি মিউজিক তৈরি করি ভিএস-টিতে… ভিএস-টি মানে…’

—‘জানি৷ বলতে থাকুন৷’

—‘কিছুদিন আগে ইন্টারনেট থেকে আমি একটা প্লাগ-ইন পারচেজ করি৷ তাতে ডুডুক ছিল৷ অর্থাৎ সেটা ব্যবহার করে ‘ডুডুক’ যন্ত্রটা ছাড়াও আমি ডুডুকের সুর তৈরি করতে পারব৷’

—‘আপনি সেটা দিয়ে ওই শিট-মিউজিক থেকে সুরটা তৈরি করেন৷ তা-ই তো?’

উপরে-নীচে মাথা দোলায় দীপ৷ চোয়াল ঝুলে পড়ে তার৷

—‘সেদিন আপনার ফোনের রেকর্ডিং-এ লিফটে যে সুরটা বাজছিল…’

‘হ্যাঁ স্যার… ওটাই… ওই মিউজিকটা ভালো নয়, স্যার৷ যেভাবে খুনগুলো হচ্ছে, তাতে আমার মনে হয় মিউজিকটা বাজিয়ে অশুভ কিছুকে জাগিয়ে তুলেছি আমি…’

‘হুম…’ অন্য সময় হলে দীপকে কোনও সাইকিয়াট্রিস্ট রেকমেন্ড করতেন নিরলস ব্যানার্জি৷ কিন্তু সেদিনের সেই চুলে-ঢাকা মুখটার কথা মনে পড়ে গেল তাঁর৷ একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, ‘জাগিয়ে তুলেছেন বলতে ডিমন জাতীয় কিছুর কথা বলছেন কি?’

—‘হতে পারে৷ আমি জানি না, স্যার৷’

কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়ে বসে থাকেন ব্যানার্জি, তারপর বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘এমন অলৌকিক খুন আমিও আগে দেখিনি দীপ্তাংশুবাবু৷ জীবনে ঢের ঢের কেস দেখেছি…’ মাঝখানে কথা থামিয়ে হঠাৎ একটা প্রশ্ন করেন তিনি, ‘আচ্ছা, ওই ডায়েরিটাতে মিউজিকটা কোথাকার বা কে তৈরি করেছে, সেই নিয়ে কিছু লেখা নেই?’

দীপ মাথা নাড়ায়, ‘না৷ মিউজিক আর ইন্সট্রুমেন্টের নাম ছাড়া অন্য কিছু নেই৷ তবে বিকাশ সুরটা দেখতে চেয়েছিল একবার৷ আমি ছবি তুলে পাঠিয়েছিলাম৷ সেটা ল্যাপটপে রয়ে গেছে৷’

—‘কই দেখি…’

পিঠের ব্যাগ থেকে নিজের ল্যাপটপটা বের করে আনে দীপ৷ তারপর সেটা অন করে একটা বিশেষ ছবি বের করে এগিয়ে দেয়৷ ডায়েরির একটা হলদে হয়ে যাওয়া পাতার ছবি৷ তার উপরে লাইন টেনে টেনে শিট মিউজিকের সিম্বল আঁকা আছে৷ এর মাথামুন্ডু কিছুই বোঝেন না ব্যানার্জি৷ কেবল একটা ব্যাপারে চোখ আটকায়৷ পাতার একেবারে উপরের প্রান্তে একটা মাঝারি সাইজের ‘#’ চিহ্ন আঁকা আছে৷

—‘এটা কী বলুন তো?’ ব্যানার্জি জিজ্ঞেস করেন৷

দীপ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়, ‘শার্প সিম্বল৷ মিউজিকে ওটা দিয়ে হায়ার পিচ বোঝানো হয়৷ ওই একই চিহ্নকে অঙ্কের ভাষায় হ্যাশ বলে৷ আমরা ফেসবুকেও খানিকটা মিউজিকের নিয়মেই হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করি৷ অন্য কথাগুলোর চেয়ে হ্যাশ চিহ্নের গায়ে লেগে-থাকা কথাগুলোর ভ্যালু হায়ার৷’ ‘হ্যাশট্যাগ!’ ভুরু কোঁচকায় ব্যানার্জির, ‘সে তো ফেসবুকে ব্যবহার হয়৷ এখানে হয়েছে কেন?’

—‘এখানে ওটা হায়ার পিচ বোঝাচ্ছে৷’

‘উঁহুঁ…’ মাথা নাড়েন ব্যানার্জি, ‘শিট-মিউজিক লেখা আছে পাতার মাঝামাঝি৷ তাহলে চিহ্নটা পাতার একেবারে উপরের দিকে এমন আলাদা করে লেখা কেন?’

দীপ একটু ধন্দে পড়ে, ‘তাহলে হয়তো মিউজিকটা লেখার আগে চিহ্নটা আঁকা প্যাকটিস করছিলেন আমার পিতামহ৷’

খুব ধীর পায়ে ঘরের ফাঁকা অংশে পায়চারি করতে থাকেন ব্যানার্জি, ‘একটা লোক যে একটা ডায়েরি ভরতি শিট-মিউজিক লিখেছে, তাকে একেবারে শেষ পাতায় পৌঁছে একটা সাধারণ চিহ্ন আঁকা প্যাকটিস করতে হল৷ না দীপবাবু৷ ওই চিহ্নটার একটা মানে আছে… কিন্তু…’

—‘কিন্তু কী স্যার?’

পায়চারি করতে করতে দাঁড়িয়ে পড়েন ব্যানার্জি, ‘আচ্ছা দীপবাবু৷ কবিতা যে পাতায় লেখা হয়, তার একেবারে উপরে কী লেখা থাকে?’

—‘কবিতার নাম আর কবির নাম৷’

—‘সে তো এখন, আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে যখন কবিরা রাজা-রাজড়ার সভায় ভাড়া খাটতেন তখন তাঁদের নাম লেখা হত কবিতার মধ্যে৷ কহেন কবি কালিদাস, পথে যেতে যেতে/ নাই তাই খাচ্ছ, থাকলে কোথায় পেতে?’

—‘তাহলে উপরে কী লেখা থাকত?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে দীপ৷

—‘যে রাজার উদ্দেশ্যে কবিতাটা উৎসর্গ করা হয়েছে, তাঁর নাম…’

—‘রাজা! মানে এখানে…’

—‘ডিমন৷’

প্রায় ছিটকে সোফা থেকে সরে আসে দীপ, ‘স্যার! আমার খেয়ালই ছিল না৷ এই হ্যাশ চিহ্নটা এসেছে একটা পৌরাণিক ডিমনের থেকে৷ গ্রিকরা ওই ডিমনকে বোঝাতে এই চিহ্ন ব্যবহার করত৷ বিলেথ! কথিত আছে, বিলেথ যেখানে যায়, সেখানেই বিশেষ কোনও সুর বাজতে থাকে৷ নোয়ার এক সন্তান হ্যাম প্রথম পৃথিবীতে নিয়ে আসে তাকে৷ পরে বিলেথের সাহায্য নিয়েই গণিতের উপর প্রথম বই লেখেন তিনি… অর্থাৎ….’

মুখে কিছু একটা বিড়বিড় করে চলেছেন ব্যানার্জি৷ স্থির চোখে স্ক্রিনের উপরের হ্যাশ চিহ্নটার দিকে তাকিয়ে আছেন, দীপ কান পেতে তাঁর কথাগুলো শোনার চেষ্টা করে, ‘দুটো মানুষ খুন হয়েছে৷ একজনকে লম্বালম্বি কাটা হয়েছে৷ অন্যজনকে আড়াআড়ি৷ হ্যাশ…’

—‘না স্যার…’ দীপ মাথা নেড়ে বলে, ‘সেটা তো যোগ চিহ্ন হচ্ছে৷ হ্যাশ মানে তো…’

একটা কাগজ টেনে তার উপরে একটা যোগ চিহ্ন আঁকেন ব্যানার্জি৷ তারপর সেই চিহ্নটার ডানদিকের উপরের কোণে আর-একটা যোগ চিহ্ন৷ কাগজ জুড়ে একটা অতিকায় হ্যাশ ফুটে ওঠে৷

—‘মানে একইভাবে আরও দুটো খুন হতে চলেছে…’

(পাঁচ)

—‘কী রে রেডি তো?’

হেডফোন থেকে ভেসে-আসা শব্দে মাইক্রোফোনের কাছে মুখ এনে তৃষা বলে, ‘আছি, তুমি কিউটা দাও৷’

—‘হ্যাঁ, দিচ্ছি৷ একবার শুনে নে আগে৷’ জয়ন্তর গলা মুছে গিয়ে হেডফোন থেকে প্রিরেকর্ডেড ভয়েজ ভেসে আসে, ‘আপনাদের সবার অনুরোধে এবার পুজোয় আসতে চলেছে…’

নিজের সামনে রাখা কাগজটায় তাকায় তৃষা, ‘সঞ্চারী মিত্রর নতুন গানের অ্যালবাম…’

আগের ভয়েসটুকুনি বিনোদের৷ গোটাটাই তার বলার কথা ছিল৷ বাড়ি যাওয়ার তাড়া থাকায় বাকিটা পরের দিন এসে করে দেবে বলে গিয়েছিল৷ সেদিনই লিফটে নৃশংসভাবে খুন হয় সে৷

হেডফোনে তার গলাটা শুনে একটা অস্বস্তি শুরু হয় তৃষার৷ সেটা কাটানোর চেষ্টা করে৷ গলায় মধ্যে খুশি-খুশি ভাবটা ফিরিয়ে এনে রিহার্স করে নেয়, ‘সঞ্চারী মিত্রর নতুন গানের অ্যালবাম…’

—‘ঠিক আছে… আবার দাও কিউটা৷ ফাইনাল৷’

—‘ওকে…’ জয়ন্তর গলা শোনা যায় হেডফোনে, ‘লেভেলটা ম্যাচ করাতে হবে, ঠিক যেন পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছিস… ওকে, গো…’ কান পেতে রেডি হয়ে থাকে তৃষা৷ বিনোদের ভয়েস শেষ হলেই বলতে হবে তা’কে, চলেছে…— ‘আপনাদের সবার অনুরোধে এবার পুজোয় আসতে চলেছে…’

—সঞ্চারী মিত্রর… তৃষা থেমে যায়৷ হেডফোন থেকে ভেসে-আসা একটা গলা কানে এসেছে ওর৷ ওর নাম ধরে ডেকে উঠেছে কেউ৷ গলাটা বিনোদের৷

—‘আরে, থেমে গেলি কেন?’ জয়ন্ত বিরক্ত হয়ে বলে৷

—‘না মানে…’ ইতস্তত করে তৃষা, ‘বিনোদদার রেকর্ডিংটা ওখানেই শেষ না আর কিছু বলা আছে?’

—‘কই না তো৷’

—‘ঠিক আছে… আর-একবার দাও৷’

—‘রেডি… গো…’

কয়েকটা নিস্তব্ধ মুহূর্ত কাটে৷ তৃষা অপেক্ষা করতে থাকে৷ একটা চাপা কান্নার শব্দ ভেসে আসে৷ তৃষার বুকের ভিতর দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নামতে লাগল৷ বিনোদ কাঁদছে, খুব চাপা-স্বরে কিছু কথাও বলছে যেন সে৷ চোখ বন্ধ করে তৃষা দু-হাতে হেডফোন চেপে ধরে, ‘আমাকে এভাবে মেরে ফেললে তৃষা!’

কান থেকে হেডফোনটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে চোখ খোলে সে৷ আর সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারে, গোটা ঘরের আলো নিবে গেছে৷ শুধু অদ্ভুত একটা শব্দ ভেসে আসছে কোনও একটা কোণ থেকে৷ যেন নিষ্প্রাণ মৃত একটা শরীরের থেকে টপটপ করে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে৷ যার শরীর, সে গুনগুনিয়ে একটা সুর ভাঁজছে৷ ভারী মিষ্টি একটা সুর৷

শব্দের উৎসের দিকে এগিয়ে যায় তৃষা৷ আবছা অন্ধকারের মধ্যে মনে হয়, একটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে ওর দিকে পিছন ফিরে৷ মানুষটাকে ও আগেও দেখেছে৷ গুনগুন সুরটা সে-ই ভাঁজছে৷

—‘বিনোদদা…’ এগিয়ে গিয়ে লোকটার কাঁধে হাত রাখে তৃষা৷ সঙ্গে সঙ্গে ঘরের আলো জ্বলে ওঠে৷ লোকটা ওর দিকে পিছন ফেরে৷ সত্যি বিনোদ দাঁড়িয়ে আছে৷ স্বাভাবিক গলায় বিনোদ বলে, ‘দেরি হয়ে যাচ্ছে তো৷ চলুন, বাকি রেকর্ডিংটা সেরে নিই…’

—‘কিন্তু তুমি তো…’ তৃষা অবাক হয়ে তাকায় তার দিকে৷

—‘আমি তো কী? আরে, কালকের মধ্যে প্রোজেক্টটা নামাতে না পারলে…’

তৃষা লক্ষ করে বিনোদের কপাল থেকে গলা অবধি একটা লম্বা চেরা দাগ৷ থুতনির নীচে সেই দাগ থেকে বেরিয়ে-আসা একফোঁটা রক্ত জমে আছে৷

—‘বিনোদদা, তোমার তো রক্ত বেরোচ্ছে…’

—‘রক্ত!’ হাত দিয়ে রক্তটা মুছে নিয়ে বিনোদ হো হো করে হেসে বলে, ‘কী করব বল, এমন করে কেটেছিস আমার শরীরটাকে…’

—‘আমি! এসব কী বলছ তুমি?’

—‘হ্যাঁ৷ তুই, মনে নেই? না?’ একটু কি রাগের ছোঁয়া বিনোদের গলায়? তৃষার অস্থির চোখ কিছু একটা খুঁজতে থাকে বিনোদের মুখে৷ আবার ঘরের আলো নিবে আসে৷ কেবল বিনোদের শরীরটাকে একটা সাদা স্পটলাইট ঘিরে থাকে যেন৷

বিনোদের পরের কথাগুলো পাথরের পাঁজর থেকে উঠে আসে, ঠান্ডা একটা বাতাস ঘিরে ধরে তৃষাকে৷

—‘তোর জন্যই সব শেষ হয়ে গেল আমার৷ আমার শরীরটাকে কেটে দু-ভাগ করে ফেললি তুই… তৃষা…’

বিনোদের সাদা শার্টের পেটের কাছটা রক্তে লাল হয়ে যায়৷ তারপর বুক, তারপর গলা৷ প্রচণ্ড যন্ত্রণায় চিৎকার করে ওঠে বিনোদ৷ তৃষা দু-হাতে মুখ ঢেকে ফ্যালে৷

—‘আপনাদের সবার অনুরোধে এবার পুজোয় আসতে চলেছে…’

—‘আপনাদের সবার অনুরোধে এবার পুজোয় আসতে চলেছে…’

 বারবার বেজে চলেছে ভয়েসটা৷ তৃষা হাঁপাতে হাঁপাতে চারপাশে তাকায়৷ স্টুডিয়োর রেকর্ডিং রুম! স্বস্তির নিশ্বাস ফ্যালে ও৷ হেডফোনে আবার জয়ন্তর গলা শোনা যায়,

—‘তুই ছেড়ে দে আজ৷ কিছু একটা প্রবলেম হচ্ছে তোর…’ পাশের ছোট টুল থেকে বোতল নিয়ে একটোক জল গলায় ঢালে তৃষা৷

নিঃশ্বাসের গতি কম হয়ে আসে তার৷ দু-হাতে মুখের উপর নেমে-আসা চুল সরিয়ে ফ্যালে— ‘মাইকটা অফলাইন করে দাও জয়ন্তদা, আমি ও ঘরে যাচ্ছি৷’ মুখ মুছতে মুছতে বলে তৃষা৷

—‘হ্যাঁ, দিচ্ছি৷’

তৃষা ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছিল৷ হঠাৎ খেয়াল করে, একটু আগে ‘হ্যাঁ, দিচ্ছি’ কথাটা জয়ন্তর নয়, বিনোদের গলা থেকে এসেছে৷

এগিয়ে এসে দুটো রুমের মাঝের জানলায় চোখ রাখে তৃষা৷ একটা আতঙ্কের ঢেউ তার শরীরটাকে ছিটকে দেয় জানলা থেকে৷

মিক্সার মেশিনের সামনের গদি-আঁটা চেয়ারে বসে আছে জয়ন্ত৷ তার শরীরটা কোমর থেকে দু-আধখানা করে কাটা৷ মেঝেতে যত দূর রক্ত গড়িয়েছে, তাতে বোঝা যায়, অন্তত মিনিট দশেক আগে তাকে খুন করে গিয়েছে কেউ৷

(ছয়)

—‘এই মুহূর্তে কে কে আছে আপনাদের স্টুডিয়োতে?’

একটু ভাবতে হয় দীপকে, ‘জানি না৷ এখন নতুন কোনও প্রোজেক্ট হাতে নিচ্ছি না আমরা৷ তবে আগের কয়েকটা পেন্ডিং পড়ে আছে, ওগুলো…’

—‘ওগুলো কী?’

—‘জয়ন্ত বলছিল, তৃষাকে দিয়ে ওগুলো কমপ্লিট করিয়ে নেবে৷’

—‘কখন?’

—‘জানি না৷ ওদের কাছে আলাদা চাবি থাকে৷ আমার কাছে এই ক-দিন ফোন নেই বলে…’

ব্যানার্জির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দেয়, ‘পরের টার্গেট কে, আমরা জানি না, কিন্তু আপনাদের স্টুডিয়োর কেউ নিরাপদ নয়৷’ পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে জয়ন্তর নম্বরটা ডায়াল করে ব্যানার্জি৷ ওপাশে বেশ কয়েকবার রিং হয়ে কেটে যায়৷ তৃষার নম্বর সুইচড অফ৷ দীপ মুখ তুলে বলে, ‘স্টুডিয়োতে থাকলে আমরা ফোন সাইলেন্ট করে রাখি৷ তাই হয়তো…’

ফিরে এসে আবার উলটোদিকের চেয়ারে বসে পড়েন ব্যানার্জি, কপালে হাত বুলোতে বুলোতে বলেন, ‘এই যে ডিমনের নাম বললেন৷ একে যেমন নিয়ে আসা যায়, তেমনি ফেরত পাঠানোরও তো রাস্তা আছে কিছু৷’

—‘তেমন কিছু তো…’ হঠাৎ থেমে যায় দীপ৷ উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘মনে হয় একটা উপায় আছে স্যার৷’

—‘কী উপায়?’

—‘এই শিট-মিউজিকটা যে পাতায় লেখা ছিল, তার ঠিক পিছনেই গ্রিক ভাষায় কিছু লেখা ছিল৷ চার-পাঁচ লাইনের বেশি নয়৷ এই দেখুন…’

ল্যাপটপে ছবিটা খুলে দেখায় দীপ৷ খুব ভালো করে তাকালে বোঝা যায় পিছনের পাতায় কালি দিয়ে লেখা কিছু অক্ষরের ছাপ এই পাতার স্পষ্ট অক্ষরের ফাঁকে ফাঁকে ফুটে উঠেছে৷

—‘এই পাতাটা আমাদের লাগবে৷ ক্যুইক… আপনার বাড়িতে কাউকে বললে ছবি পাঠিয়ে দিতে পারবে না?’

—‘বাড়িতে আমি একা থাকি স্যার৷ একটু পোষা কুকুর আছে শুধু৷’

কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন ব্যানার্জি, এমন সময় তাঁর ফোনটা বেজে উঠল, ‘তৃষা গাঙ্গুলি…’ বিড়বিড় করে বললেন ইন্সপেক্টর৷ তারপর রিসিভ করে কানে লাগালেন ফোনটা৷ ওপাশ থেকে একটা কান্না-মেশানো গলা শোনা গেল, ‘স্যার… আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন, এখানে চলে আসুন… স্যার…’

—‘আপনি শান্ত হোন৷ বলুন, কী হয়েছে৷’

—‘জয়ন্ত… জয়ন্ত ইজ ডেড৷ কেউ খুন করেছে ওকে৷’

—‘আপনি স্টুডিয়োতে?’

চাপা চিৎকারের শব্দ ভেসে আসে ওপাশ থেকে৷ আর কিছু শোনা যায় না, ব্যানার্জি চিৎকার করে বলেন, ‘আপনি স্টুডিয়ো থেকে বেরিয়ে লোকজনের মাঝে কোথাও দাঁড়ান৷ আমি এক্ষুনি যাচ্ছি…’

ফোনটা ওপাশ থেকে কেটে যায়৷ ব্যানার্জি দ্রুতপায়ে বেডরুমের দিকে এগোতে এগোতে বলেন, ‘মিস গাঙ্গুলিকে বাঁচানো দরকার৷ আগে আপনার স্টুডিয়ো, তারপর বাড়ি৷’

মিনিট দশেকের মধ্যে গাড়িতে স্টার্ট দেন ব্যানার্জি৷ দীপ উঠে বসে তার পাশের সিটে৷ এতক্ষণে সন্ধে নামতে শুরু করেছে ব্যস্ত কলকাতার বুকে৷ জনবহুল রাস্তার বুক চিরে দৌড়োতে থাকে গাড়িটা৷

স্টুডিয়ো বিল্ডিং-এর সামনে পৌঁছেই তৃষাকে দেখতে পায় ওরা৷ রাস্তার একধারে একটা আলোকোজ্জ্বল শপিং মলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে৷ গাড়িটাকে থামতে দেখে একবার ভিতরে তাকিয়ে দীপকে দেখে ছুটে গাড়িটার কাছে চলে আসে সে৷ তার চোখ-মুখ উদভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছে৷ গালের উপরে কান্নার দাগ৷ কাজল লেপটে আছে৷ বুকটা এখনও উত্তেজনায় ওঠানামা করছে বারবার৷

—‘গেট ইন…’ দীপ গাড়ি থেকে নেমে তাকে পিছনের সিটে বসিয়ে দেয়৷ তার মুখে কোনও কথা ফুটছে না৷ শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে বারবার৷

—‘জয়ন্ত…’ কিছু একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল দীপ৷ ব্যানার্জি হাত দেখিয়ে থামিয়ে দেন তাকে, ‘উনি উত্তর দেওয়ার অবস্থায় নেই, দীপবাবু৷ আমি থানায় ফোন করে দিয়েছি৷ ওরা জিপ নিয়ে আসছে৷’

—‘আপনি বুঝতে পারছেন না স্যার, ওরা ভাববে…’

—‘না, ভাববে না৷ একটা গোটা মানুষকে দু-আধখানা করে ফেলার শক্তি মিস গাঙ্গুলির গায়ে নেই৷ সারকামস্টানশিয়াল এভিডেন্স কিছুই মিলবে না৷ বাট শি নিডস টু কাম আপ উইথ আ স্টোরি…’

গুগল ম্যাপে দীপের বাড়ির লোকেশন দেখে ড্রাইভ করতে থাকেন ব্যানার্জি৷ দীপ রিয়ার ভিউ মিররে দ্যাখে, বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে তৃষা৷ সে মুখ ফিরিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে৷ বুকের ভিতর থেকে একটা চাপা কান্না ঠেলে বেরিয়ে আসে তার৷ এই সব কিছুর জন্যে সে একা দায়ী৷ ওই সুরটা না বাজালেই…

দীপের ফ্ল্যাটের সামনে এসে গাড়িটা যখন দাঁড়ায় তখন ঘড়িতে সন্ধে সাড়ে সাতটা৷ গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায় দু-জনে৷ দীপ পিছনের সিটটা দেখিয়ে বলে, ‘ওকে এখানে রেখে যাবেন?’

—‘না৷ আমাদের কারও একা থাকা উচিত হবে না৷ আমি ক্যারি করছি ওকে৷’

দু’হাতে তৃষার অচৈতন্য দেহটা তুলে কাঁধে ফেলেন ব্যানার্জি৷ দীপ ভিতরে ঢুকে লিফটের দিকে এগিয়ে যায়, ‘আমার ফ্ল্যাটটা ফোর্থ ফ্লোর৷’

পাঁচতলায় উঠে প্যাসেজ বেয়ে প্রায় দৌড়ে আসে দু-জনে৷ দীপ চাবি দিয়ে দরজা খুলে ফ্যালে৷ একটা মিশকালো দেহ ভিতরে থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর উপরে৷

একটা জার্মান শেফার্ড৷ সারাদিন ঘরে বন্ধ থাকে কুকুরটা৷ দরজার কাছেই বসে মনিবের জন্য অপেক্ষা করে হয়তো৷ দীপ মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শান্ত হয় সে৷ ল্যাজ নাড়াতে থাকে খুশি হয়ে৷ ব্যানার্জি সোফার উপরে শুইয়ে দেন তৃষাকে৷

—‘কোথায় আছে ডায়েরিটা?’

—‘ভিতরের ঘরে৷ আসুন আমার সঙ্গে৷’

ডাইনিং রুম পেরিয়ে ছুটে যায় ওরা৷ কুকুরটাও দীপের পিছন পিছন আসে৷ ছোট একটা ঘরের ভিতরে ঢুকে আসে দীপ৷ এ ঘর ভরতি শুধু বই৷ তিনদিকের দেওয়ালে থরে থরে সাজানো বই৷ তার কয়েকটা খসে এসে পড়েছে মেঝেতে৷ একদিকের মেঝেতে শোয়ানো আছে একটা গিটার, একটা ভায়োলিন, তার পাশেই কয়েকটা পুরোনো খাতা৷ বিছানার উপর একটা গীতবিতান খুলে রাখা আছে৷

—‘ডায়েরিটা…’ ঘরের বইয়ের পাহাড় আঁতিপাঁতি করে খুঁজতে থাকে দীপ৷

—‘আপনার মনে নেই কোথায় রেখেছেন?’

দীপকে অস্থির দেখায়, ‘এত বই আসলে আমার৷’ শেলফ থেকে একটা বই টেনে নেয় দীপ৷ সেটা ব্যানার্জির সামনে বাড়িয়ে ধরে বলে, ‘এই বইটা মিউজিক নিয়ে পড়া আমার প্রথম বই, জানেন? দশ বছর বয়সে পড়েছিলাম প্রথম৷ তখনই মিউজিকের প্রতি এমন একটা ভালোবাসা জন্মেছিল…’

—‘আপনি…’

—‘এ ঘরে যত বই দেখছেন, সব বই শুধু সুর নিয়ে, আমার সব মুখস্থ ওই গিটারটা… ওটা বাজাতে গিয়ে কতবার হাত কেটে গেছে…’

—‘আপনি প্লিজ ডায়েরিটা খুঁজুন…’

—‘ছোট থেকে নামকরা মিউজিশিয়ান হওয়ার ইচ্ছা৷ কিন্তু হতে পারিনি কিছুতেই৷ ওই যে একটা এক্স-ফ্যাক্টর লাগে… দীপ্তাংশু মিত্রর ছিল না, তা-ই না স্যার?’

—‘হতে পারে৷ কিন্তু এখন সময় নষ্ট না করে…’

—‘না, আছে৷ এক্স-ফ্যাক্টর আছে৷’ নিজের মনেই কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ায় দীপ, ‘ওঃ, মনে পড়েছে স্যার৷ ডায়েরিটা এখানে নেই৷’

—‘এখানে নেই! তাহলে কোথায় আছে?’ চিৎকার করে ওঠেন ব্যানার্জি৷

—‘গঙ্গায়৷ সাত দিন আগে কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ভাসিয়ে দিয়ে এসেছি৷’

—‘হোয়াট! এসব কী বলছেন আপনি!’

অদ্ভুত একটা হাসি হেসে ওঠে দীপ৷ বিছানার উপরে বসে পড়ে৷ পাশে বসে-থাকা কুকুরটার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলে, ‘বুঝলেন না? আরে, ওই দুটো পাতাই তো আমার এক্স-ফ্যাক্টর৷ আর নিজের এক্স-ফ্যাক্টর কি অন্য কাউকে দিতে আছে স্যার?’

ব্যানার্জি এগিয়ে যান দীপের দিকে৷ কিন্তু তার আগেই কুকুরটা রুখে দাঁড়ায়৷ মুখ দিয়ে হিংস্র গড়গড় শব্দ বেরিয়ে আসে তার৷

—‘এই… আপনি একটু ঘরের বাইরে যান তো… যান যান…’

কুকুরটা এগোতে থাকে ব্যানার্জির দিকে৷ ব্যানার্জি পিছিয়ে এসে দরজার বাইরে চলে আসেন৷ দীপ ঘরের ছিটকিনি তুলে দেয়৷ তারপর জানলার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলে, ‘বাকি কথা এই জানলা দিয়ে বলুন না হয়, এখনও খানিকটা সময় আছে৷’ ঘড়ির দিকে তাকায় দীপ৷ তারপর পিছিয়ে গিয়ে আবার বিছানায় বসে পড়ে, ‘সময়, মিউজিকের জন্য ভারী ইম্পর্ট্যান্ট জিনিস, টেম্পো বোঝেন তো? জানেন, এক সেকেন্ডের মধ্যে কতগুলো বার অফ নোটস যাবে, সেটা বুঝতে হয় ভালো করে…’

—‘আপনি প্লিজ এসব পাগলামি ছাড়ুন৷ ভুলে যাবেন না, ওই স্টুডিয়োতে আপনিও কাজ করেন…’

হো হো করে হেসে ওঠে দীপ, ‘জিন কি কখনও আলাদিনকে খুন করে ব্যানার্জিবাবু?’

ব্যানার্জি জানলার গ্রিল চেপে ধরেন, ‘মানে আপনি ইচ্ছা করে…’

—‘আরে না না, ইচ্ছা করে নয়৷ বলতে পারেন একরকম তালেগোলে…’ বইয়ের শেলফের সামনে পড়ে-থাকা একটা ছোট তিন-ইঞ্চি ছুরি হাতে তুলে নেয় দীপ৷ সেটার প্রান্ত বরাবর হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘আগেই বলেছি স্যার মিউজিক নিয়ে আমার বিস্তর পড়াশোনা থাকলেও ওই এক্স-ফ্যাক্টরটি ছিল না৷ নিষিদ্ধ শিট-মিউজিকটা বাজানোর ইচ্ছা ছোট থেকে৷ জানতাম, ওটা বাজালে আমার কোনও ক্ষতি হবে না৷ যুক্তিটা খুব সহজ, আপনিও একটু ভাবলেই ধরতে পারাতেন৷ বেলেথকে প্রথম জাগায় হ্যাম৷ এবং তার সাহায্যেই সে বই লেখে৷ মানে আলাদিনের উপর জিন সদয় হন৷ কিন্তু আমার ভয় ছিল অন্য কারও ক্ষতি হতে পারে৷ তো এই অবস্থায় আমার স্টুডিয়োর এক এমপ্লয়ির উপর আমার বিশ্রী রকমের ভালোবাসা জন্মায়৷ ওই যাকে আপনি কাঁধে করে নিয়ে এলেন, তার কথাই বলছি৷ কিন্তু সে আমাকে পাত্তাই দেয় না৷ উলটে তার দৃষ্টি পড়ে আমারই অফিসের আর-এক এমপ্লয়ি বিনোদের উপরে৷ আমার একদিন ভারী রাগ হল, জানেন৷ ভাবলাম, মিউজিকে ঠিক কী হয়, সেটা বিনোদকে দিয়েই পরীক্ষা করে দেখা যাক না হয়৷ তো মিউজিকটা বানিয়ে বিনোদকে শোনালাম৷ মানে হোয়াটস্যাপে পাঠালাম আর কী… আমরা মিউজিশিয়ানরা আনপাবলিশড মিউজিক জেনারেলি কাউকে শুনতে দিই না৷ ফলে বিনোদের কাছ থেকে ওটা অন্য কোথাও যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না৷’

বিনোদ মিউজিকটা শুনে-টুনে অফিস থেকে বের হয়ে গেল৷ তখনও বুঝতে পারিনি, ঠিক কী হবে৷ পরে যখন খবরটা পেলাম…’

—‘আপনি একটা পিশাচ, স্কাউন্ড্রেল… আই উইল কিল ইউ লাইক আ পিগ…’

ব্যানার্জির কথাটা কানেই গেল না দীপের, সে আগের মতোই বলে চলল, ‘এই বিনোদকে খুন করার পর থেকে আমার একটা অদ্ভুত নেশা ধরে গেল, জানেন? ভাবুন, ছোট থেকে আমার মিউজিককে কেউ পাত্তা দেয়নি, আমার ভিতরে এত শিক্ষা, অধ্যবসায়, আমার ডায়েরিতে ইতিহাস পালটে দেওয়ার মতো একটা সুর ধরা আছে অথচ আমি একটা মাঝারি মাপের স্টুডিয়োতে আলফাল গায়কদের জন্যে ট্র্যাক বানাই… আমার ভিতরের শিল্পীটা জেগে উঠল৷ একটা আস্ত মানুষকে মেরে ফেললাম, অথচ কেউ জানতে পারল না, কেউ সন্দেহ করতে পারল না, কে বলেছে আমার সুরে জাদু নেই? কে বলেছে আমার মধ্যে এক্স-ফ্যাক্টর নেই? ঠিক করলাম, আরও খুন করব৷ আরও ছড়িয়ে দেব আমার সুর৷ জানেনই তো, চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম, আমার তো হোমে কেউ নেই৷ অতএব স্টুডিয়ো৷ বিকাশের হোয়াটস্যাপে পাঠিয়ে দিলাম সুরটা৷ বললাম নতুন বানিয়েছি, শুনে দেখ…’ পরদিন সকালে শুনলাম বিকাশ খতম৷ আমার নেশা আরও বেড়ে উঠল৷ ভাবলাম প্রাথমিক টেস্টিং শেষ৷ এবার জিনিসটা ভাইরাল করা যাক৷ তার আগে শেষ একবার পরীক্ষা৷ ‘ইয়েস… জয়ন্ত… ভালো কথা!’ সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল দীপ৷ জার্মান শেফার্ডটা মুখ তুলে তাকিয়ে আছে তার দিকে৷ মনিবের এমন অদ্ভুত আচরণে কিছুটা অবাক হয়েছে সে৷ সে হাতের ছুরিটা পাশে রেখে দীপ বলল, ‘আমার ম্যাগনাম ওপাসটা তো শোনানোই হয়নি আপনাকে৷ সেদিন শুনেছিলেন বটে৷ কিন্তু পুরোটা শোনেননি৷ পুরোটা না শুনলে কাজ করে না আমার সুর…’ আরে না না, পালানোর চেষ্টা করবেন না৷ দরজা এখন পাস-কি ছাড়া খুলবে না৷ আর ওটা শুধু আমি জানি…’

পকেটে হাত চালান ব্যানার্জি৷ তাড়াহুড়োতে অস্ত্রটা আনতে ভুলে গেছেন, ‘আপনি আমাদের খুন করে বাঁচতে পারবেন না৷ এটা আপনার বাড়ি, আপনি আমাদের এখানে এনেছেন…’

—‘আজ্ঞে না, পুলিশ কিচ্ছু ভাববে না৷ একটা গোটা মানুষকে দু-আধখানা করে ফেলার শক্তি মিস্টার মিত্রর নেই৷ সারকামস্টানশিয়াল এভিডেন্স কিছুই মিলবে না৷ বাট আই নিড টু কাম আপ উইথ আ স্টোরি…’

একটা রিমোট কনট্রোল জাতীয় যন্ত্র হাতে তুলে নেয় দীপ৷ সঙ্গে সঙ্গে গোটা ফ্ল্যাট জুড়ে লুকোনো কোনও স্পিকার থেকে বিশেষ সুর গমগমিয়ে বেজে ওঠে৷ প্রাচীন আর্মেনিয়ান-বাঁশি ডুডুক বাজছে৷ ভারী মায়াবী একটা দূর৷ প্রকৃতির নিয়ম অমান্য করে বেজে চলেছে সেটা৷

—‘আপনাকে খুন করার ইচ্ছা ছিল না, জানেন৷ আপনি মানুষটা খারাপ নন৷ কিন্তু ওই যে সেদিন রেকর্ডিং-এ শুনে ফেলেছিলেন মিউজিকটা৷ একটু খোঁজাখুঁজি করলেই দেখতেন, মৃতদের সবার হোয়াটস্যাপেই ওই মিউজিক ফাইলটা আমি পাঠিয়েছি৷ কীভাবে খুনটা হয়েছে সেটা বুঝতে না পারলেও সন্দেহ তো নিশ্চয়ই করতেন… আমার হাতে যখন অস্ত্র আছে, লাইসেন্স আছে, তখন চালাব না কেন বলুন তো?’

—‘আর মিস গাঙ্গুলি? তাকে তো তুমি নাকি ভালোবাসতে…’

একটা শয়তানি হাসি খেলে যায় দীপের মুখে, ‘প্রকৃত শিল্পী কাউকে ভালোবাসে না৷ ভালোবাসে শুধু তার আর্টকে৷ আর তা ছাড়া…’ এগিয়ে আসে দীপ, ‘ওর মৃত্যু-পরোয়ানাতে তো আপনি সই করেছিলেন৷ আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনাকে, ওকে গাড়িতেই রেখে যাব কি না…’ ব্যানার্জি বুঝতে পারেন, পালানোর সব পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে৷ মিষ্টি সুরটা ভয়াবহ কোনও অতিপ্রাকৃত ছন্দে বেজে চলেছে এখন৷ শয়তানি হাসিটা এখনও লেগে রয়েছে দীপের মুখে, ‘এখনও বলবেন দীপ্তাংশু মিত্রর কোনও এক্স-ফ্যাক্টর নেই? এখনও বলবেন আমি জাত মিউজিশিয়ান নই? হ্যাঁ?’

দীপের হাসির তেজ বাড়তে থাকে৷ ব্যানার্জির মনে হয়, সেই স্টুডিয়োতে দেখা মেয়েটা এসে দাঁড়িয়েছে তাঁর ঠিক পিছনে৷ তিনি চোখ বন্ধ করে নেন৷

কোমরের কাছে একটা স্পর্শ অনুভব করেন৷

এমন সময় সুরটা ছাপিয়ে অন্য একটা শব্দ শোনা যায়৷ কুকুরের ডাক, খুব চাপা, কুঁইকুঁই স্বরে আওয়াজ করছে কুকুরটা৷ মনে হচ্ছে যেন কাঁদছে সে৷ শরীরটাকে মাটির কাছে এনে বারবার আছড়ে ফেলছে নিজের চোয়ালটা৷ কুকুরটা বুঝতে পেরেছে, যে সুরটা ফ্ল্যাটময় বেজে চলেছে, সেটা অশুভ৷ সেটা মানুষের ক্ষতি করে৷ কুকুর মানুষের ভাষা বুঝতে না পারলেও সুরের ভাষা বুঝতে পারে৷ নিজের মনিবকে এভাবে পালটে যেতে দেখে, অন্যের ক্ষতি করতে দেখেই হয়তো কাঁদছে সে৷

—‘তোর আবার কী হল রে?’ দীপ নীচু হয়ে তার মাথায় হাত রাখে৷ সঙ্গে সঙ্গে অভাবনীয় একটা কাণ্ড ঘটে যায়৷ কুকুরটা এক ঝটকায় লাফিয়ে উঠে দীপের টুঁটি কামড়ে ধরে৷ ব্যাপারটা ঘটবে, দীপ আশা করেনি৷ সে এক পলকের জন্য থতমত খেয়ে যায়৷ তারপর দু’হাতে ঠেলে সরানোর চেষ্টা করে প্রাণীটাকে৷ না পেরে আছড়ে পড়ে বিছানার উপর৷ এমনভাবে টুঁটিটা কামড়ে ধরেছে যে তার গলা থেকে একটা গোঙানি আর রক্ত ছাড়া কিছুই বেরোচ্ছে না৷

দীপ হাত চালিয়ে একটু আগের ছুরিটা খুঁজে পায় কোনওরকমে৷ মুহূর্তে সেটা চালিয়ে দেয় কুকুরের পেট লক্ষ্য করে৷ একবার, দু-বার, তিনবার… বারবার চালাতে থাকে ছুরিটা… কুকুরটার চোখ দিয়ে জল পড়তে থাকে, কিন্তু মনিবের টুঁটি সে ছাড়ে না… সে বুঝতে পেরেছে তার মৃত্যু আসন্ন, তবে মরার আগে তার মনিবের ভিতরে বাসা-বাঁধা এই অশুভ শয়তানকে ছিঁড়ে ফেলতে চায় সে৷

ব্যানার্জি খেয়াল করেন, তাঁর কোমর থেকে সেই চাপটা এবার ধীরে ধীরে কমে আসছে৷ মিনিটখানেক পরে সুরটা শেষ হবার আগেই মিলিয়ে আসে৷ সেই সঙ্গে দীপ আর কুকুরটার রক্তাক্ত নিথর দেহ বিছানা থেকে খসে মেঝের উপরে গড়িয়ে পড়ে৷ কুকুরটা কুঁইকুঁই করে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করে ওঠে কয়েকবার৷ চোখ দুটো রক্তে ভিজে গেছে তার৷ শরীরময় অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন৷ একটু পরে তার দেহ স্তব্ধ হয়ে যায়…

ব্যানার্জির মনে হয়, তিনি পায়ে বল পাচ্ছেন না৷ সুরটা বন্ধ হয়ে যেতে চারদিক অস্বাভাবিক নিস্তব্ধ লাগে তার৷ চোখ বন্ধ হয়ে আসে ধীরে ধীরে৷ কোনওরকমে পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে একটা নম্বর ডায়াল করেন—

ফোনটা রিসিভ হতে কোনও রেসপন্সের অপেক্ষা করেন না তিনি, শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে উচ্চারণ করেন, ‘সেন্ড হেল্প…!’ হাত থেকে খসে পড়ে ফোনটা৷

(সাত)

জ্ঞান ফিরতে তৃষা দ্যাখে, একটা গাড়ির ব্যাক-সিটে শুয়ে রয়েছে সে৷ গাড়িটা ধাবমান৷ উঠে বসে সামনের সিটে ব্যানার্জিকে দেখতে পায়৷ মনটাকে একটু শান্ত করে জিজ্ঞেস করে, ‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’

—‘আগে তোমাকে বাড়িতে ড্রপ করব, তারপর একটু থানায় যাব৷ দরকার আছে৷’ ব্যানার্জির গলা অবসন্ন শোনায়৷

—‘আর দীপ? ও কোথায় গেল?’

ব্যানার্জি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন৷ কলকাতার রাস্তায় এখন গাড়িঘোড়ার সংখ্যা কমে এসেছে৷ তৃষা বুঝতে পারে, তার বাড়ির পথেই চলেছে গাড়িটা৷

—‘দীপের বাড়িতে কী হল বলুন তো? আর জয়ন্ত! ওঃ গড…’

—‘সেসব পরে হবে না হয়৷ ইউ লুক ডিভাস্টেটেড৷ একটা গান শুনবেন? একটু চিয়ার আপ হবে?’

তৃষা কিছু উত্তর দেয় না৷ ব্যানার্জি হাত বাড়িয়ে কার রেডিয়োটা অন করে দেন৷ কয়েক সেকেন্ড কোনও শব্দ শোনা যায় না, তারপর মিষ্টি গানের সুর ভেসে আসে…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *