1 of 2

সুয়ো দুয়োর কথা

সুয়ো দুয়োর কথা

পৌষ মাসের সোদো

এক বেনে সওদাগরের সাতটি ছেলে আর একটি মেয়ে। মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে, কিন্তু বিয়ের পর তার শ্বশুর বা স্বামী তাকে আর বাপের বাড়ি পাঠায় না। কেন যে পাঠায় না, তারা কেউ জানে না। সওদাগরও আর সে মেয়ের নাম করেন না। এমনি করে সাত-আট বৎসর কেটে গেল, সওদাগর গঙ্গা লাভ করলেন। তখন সাত ভাইয়ে সাত ডিঙি ধন নিয়ে বাণিজ্য করতে বেরুলেন। ডিঙি করে যেতে যেতে পাঁচ মাস কেটে গেল। তাঁরা অনেক দেশ বেড়িয়ে দৈবক্রমে এক ডাকাতের বাড়িতে গিয়ে অতিথি হলেন। ডাকাতেরা পাঁচ ভাই, সকলেই সাত ভাইকে খুব আদর করে একটা ঘরে বসালে। তাঁদের রেঁধে খাবার জন্যে একটা ভাঙা হাঁড়ি, ভিজে কাঠ, ভাঙা উনুন, চাল ডাল দিয়ে তারা চলে গেল। এমন সময় একটি সুন্দর ফুটফুটে বউ এসে তাঁদের বলতে লাগল, ‘তোমাদের বাড়ি কোথায় গা? তোমরা এখানে কী করতে এসেছ?’ সাত ভাইয়ে বললেন, ‘আমরা অমুক সওদাগরের ছেলে। তা-তুমি কাঁদছ কেন গা?’ বউটি বললে, ‘তবে তোমরা হয়তো আমার ভাই গো! মাকে বোলো, আমি এখনও মরিনি। আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই ভাই, আস্তে আস্তে পালিয়ে যাও।’ বউটি এই বলে প্রণাম করে তাড়াতাড়ি চলে গেল। এমন সময় ডাকাতদের মা এসে বললে, ‘বাবা, তোমাদের দেখে আমার বড়ো মায়া হচ্ছে; তোমরা এদেশে কেন এলে বাছা; এ যে ডাকাতদের দেশ, এখানে কেউ আসে না। তোমাদের ধন কড়ি যা আছে, সব লুটে নিয়ে এখনি তোমাদের মেরে ফেলবে। আর ভিজে উনানে, ভিজে কাঠ জ্বেলে, ভাঙা হাঁড়িতে কি রান্না হয় বাছা! এই নাও আমি তেল মাখিয়ে কাঠ এনেছি, এর জ্বাল দিয়ে তাড়াতাড়ি রেঁধে চারটি খেয়ে নাও।’ সাত ভাইয়ে তাই করলেন, আধসিদ্ধ খেয়ে বুড়িকে প্রণাম করে ডিঙ্গিতে চড়ে উত্তর দিকে চলে গেলেন।

ডাকাতদের মা তখন সেই ঘরঘানিতে আগুন দিয়ে চিৎকার করতে লাগল, ‘ওরে তোরা কোথায় গেলি রে বাপ! শীগগির আয়, অতিথিরা ঘরে আগুন দিয়ে পালিয়ে গেল।’ তখন ডাকাতেরা পাঁচ ভাইয়ে এসে বলতে লাগল, ‘সর্বনাশী, আগে আমাদের খবর দিতে পারলিনি!’ ডাকাতদের মা বললে, ‘এইমাত্র তারা পালিয়েছে, আমি স্বচক্ষে দেখেছি তারা দক্ষিণ দিকে গেছে। যা যা শীগগির যা, যদি ধরতে পারিস। আজ কেন বেরুলি বাবা! কী দুটো একটা সামান্য মানুষের জন্যে দাঁড়িয়ে থেকে কী পেলি? আজ তো একটাও মানুষ মারতে পারলিনি, আজ ঘরে বসে সাত ডিঙি ধন পেতিস। যা যা, দক্ষিণ দিকে দৌড়ে যা!’ তখন পাঁচ ভাইয়ে দক্ষিণ দিকে ছুটে যেতে লাগল। যেতে যেতে তারা ধানের খেতে, সরষের খেতে, কড়াইশুঁটির খেতে গিয়ে পড়তে লাগল। একে অন্ধকার রাত, সবাই সিমের খেতে যেতেই পায়ে লতাপাতা জড়িয়ে পড়ে গেল। ওদিকে সওদাগরের সাত ছেলে নির্বিঘ্নে আর এক দেশে গেলেন। সেখানে সাত ভাইয়ে বিয়ে করলেন। তারপর চৌদ্দ ডিঙ্গি ধন নিয়ে, সাত বউ নিয়ে সাত ভাইয়ে দেশে এসে দামামায় ঘা দিলেন। তার আগের দিন সুয়ো দুয়োর পুজো গেছে, সাত ভাইয়ের মা পাড়ার মেয়েরা সেই সুয়ো দুয়োর ডিঙি ভাসাতে এসেছেন। সকলেই নৌকার কাছে এসে দেখেন, সাত বউ সাত ছেলে এসেছে। গিন্নি তখন সাত বউয়ের মুখে চুমু খেয়ে, সাত বেটার হাত ধরে একে একে নামিয়ে নিলেন। ছেলেরা বললেন, ‘ও কি ভাসাচ্ছ মা? তুমি এখনও বুঝি খেলা করো?’ গিন্নি বললেন, বাবা! ও কথা বলতে নেই। কাল সুয়ো দুয়োর পূজা গিয়েছে কি-না, তাই আমরা ডিঙি ভাসাতে এসেছি। চল, প্রণাম করে ঘরে চল।’ তখন সাত ভাই, বউ, গিন্নি আর সবাই সুয়ো দুয়োকে প্রণাম করে বাড়ি এলেন, তারপর সাত বউকে বরণ করে ঘরে তুললেন।

একদিন ছেলেরা মাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মা! আমাদের কি একটিও বোন নাই? গিন্নি তখন কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আছে বাবা, একটি আছে। সে মেয়েটি আমার কাছে আদৌ থাকত না, তার পিসির বাড়িতে থাকত। তোমরা তখন ছোটো ছোটো ছিলে বলে মনে নেই।’ সাত ভাইয়ে বললেন, ‘সে বোনটি এখন কোথায় মা?’ মা বললেন, ‘সে লজ্জার কথা আর কী বলব! তোমাদের পিসিমা না দেখে শুনে তাকে ডাকাতের বাড়িতে বিয়ে দিয়েছে, তাই আমরা আর তার তত্ত্ব লই না। আর সে মেয়ে-জামাইয়ের মুখও দেখি না।’ সাত ভাই বললেন, ‘হাঁ মা! আমাদের বোনটি কি বড়ো সুন্দরী? মা বললেন, ‘হাঁ বাবা, খুব সুন্দরী! সে ঠিক কর্তার মতো হয়েছে।’ তখন সাত ভাইয়ে ডাকাতদের বাড়ির আর সেই বউটির গল্প করলেন। মা বললেন, ‘হাঁ, সেই আমার খুকি রে। তাহলে এখনও বাছা আমার এতো কষ্টেও বেঁচে আছে।’

তখন সাত ভাইয়ে, জামাই বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে পাঠালেন। ডাকাতরা পাঁচ ভাই, ও তাদের বউরা, আর সেই বুড়িমা, নিমন্ত্রণ রাখতে এল। গিন্নি মেয়েটিকে দেখেই চিনতে পারলেন। বুকের কাছে এনে, গলা জড়িয়ে অনেক কাঁদলেন। বুড়িকে খুব বেয়ান বেয়ান করে ডাকতে লাগলেন। তখন পরস্পর পরিচয় হয়ে গেল। তিনি জামাইকে সাত ডিঙি ধন দিয়ে বললেন, ‘বাবা! আর কখনও ডাকাতি করো না, যা হবার হয়েছে।’ জামাই বললেন, ‘না মা, আর কখনও এমন কাজ করব না। কিন্তু আমরা যে-এত পাপ করেছি, কী করে লোক-সমাজে মুখ দেখাব? আর কী করেই বা আমাদের পাপ ক্ষয় হবে?’ গিন্নি বললেন, ‘তুমি ঘরে গিয়ে সর্বদা শুদ্ধাচারে ভগবানকে ডাকবে, তাতে অনেক পাপ ক্ষয় হবে। তারপর বৎসরান্তে মকর সংক্রান্তির দিন কলাপেটোর ডিঙি করে, গাঁদা ফুলে সাজিয়ে, জোড়া পান, জোড়া কলা, সুপারি, পৈতা, কড়ির ভারা দিয়ে সাজিয়ে, সুয়ো দুয়োর পুজো করবে। সেদিন উপবাস করবে, পরদিন গঙ্গায় বা পুকুরে সেই পেটো ভাসিয়ে দেবে। সেই ডিঙিতে একটি ঘৃতের প্রদীপ জ্বেলে দেবে। এই রকম বৎসর বৎসর করতে ভুলো না। তাহলে পাপক্ষয় হবে। কখনও কোনও বিপদে পড়বে না। আমাদের বাপ-পিতামহের কাল পর্যন্ত এই সুয়ো দুয়োর পুজো করেছি বলেই আমার সাত বেটাকে ডাকাতে মারতে পারেনি। যে এই ব্রত করে, তার কখনও কোনো বিপদ হয় না।’ তখন পাঁচ ভাইয়ে পাঁচ বউয়ে সাত ডিঙি ধন নিয়ে মাকে সঙ্গে করে দেশে চলে গেল। সেই অবধি দেশে দেশে সুয়ো দুয়োর ব্রত প্রচার হল।

পৌষ মাসের সোদোর কথা সমাপ্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *