সুভাষচন্দ্র বসু (১৮৯৭–১৯৪৫) – ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’
যিনি ছিলেন মুক্তিকামী ভারতের বিক্ষুব্ধ তারুণ্যের প্রতীক, সাম্রাজ্যবাদের ব্রিটিশ নাগপাশ থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করতে যিনি তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, সেই মহাপুরুষের নাম সুভাষচন্দ্র বসু।
সুভাষ বসুর জন্ম ১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি, উড়িষ্যার কটক শহরে। তবে সুভাষ বসুর পৈতৃক বাসস্থান ছিল চব্বিশ পরগনা জেলার চাংড়িপোতা গ্রামে। পিতা ছিলেন আইনজীবী জানকীনাথ বসু এবং মা প্রভাবতী দেবী।
সুভাষ বসুর শিক্ষাজীবন শুরু হয় কটকের এক মিশনারি স্কুলে। পরে র্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক বেণীমাধব দাসের দ্বারা তার ভাবী বিপ্লবী জীবন বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। ১৯১১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাট্রিক পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। মুক্তিপথের সন্ধানে ব্যাকুলচিত্ত সুভাষ বসুকে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের বাণী গভীরভাবে উদ্দীপ্ত করে। ফলে তিনি গৃহত্যাগ করে কিছুকাল হিমালয় পর্বত অঞ্চল পরিভ্রমণ করেন এবং গভীর সাধনায় মগ্ন থাকেন। পরে তিনি সেখান থেকে ফিরে এসে আবার নতুন করে জীবন শুরু করেন।
বাল্যকালেই সুভাষ বসুর অন্তরে দেশপ্রেম জাগ্রত হয়। এই কলেজে পড়ার সময়ই ওটেন নামের জনৈক ইংরেজ অধ্যাপক বাঙালি জাতি সম্পর্কে অপমানজনক উক্তি করায় তিনি তার মুখের ওপর প্রতিবাদ করেন। শুধু তাই নয়, এই অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ওই অধ্যাপককে তিনি প্রহার করেন। ফলে তিনি কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন।
পরে স্যার আশুতোষের সহায়তায় তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই ১৯১৯ সালে বি. এ. পাস করে উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেত গমন করেন। ১৯২০ সালে বিলেতে কৃতিত্বের সঙ্গে আই. সি. এস. পাস করেন। দেশে ফিরে গান্ধিজির অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে সিভিল সার্ভিসের চাকরি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি ১৯২১ সালের ১৬ জুলাই মহাত্মা গান্ধির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। গান্ধিজি তাঁকে চিত্তরঞ্জন দাশের পরামর্শ অনুসারে কাজ করতে নির্দেশ দেন। এরপর তিনি গোলামির সমস্ত প্রলোভন ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সহকর্মী হিসেবে যোগদান করেন ভারতের মুক্তিসংগ্রামে।
সুভাষ বসুর কর্মজীবন ছিল ঘটনাবহুল, রূপকথার কাহিনীর মতোই রোমাঞ্চকর।
ইংল্যান্ডের যুবরাজ প্রিন্স অব ওয়েলস-এর ভারত আগমন উপলক্ষে সারা ভারতে যে হরতাল আহ্বান করা হয়েছিল, তার মূল হোতা বলে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।
১৯২২ সালে মুক্তিলাভের পর বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯২৩ সালে ফরোয়ার্ড পত্রিকার ম্যানেজার ও সম্পাদক হন।
এর পর কলকাতা করপোরেশন গঠিত হলে প্রথম মেয়র হন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এবং চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার হন সুভাষ বসু। তিনি করপোরেশনের কর্মকর্তা হয়েই স্বরাজ পার্টির মূলনীতি ঘোষণা করেন। এই দলের মূল লক্ষ্য ছিল ইংরেজকে বিতাড়িত করে দেশের পূর্ণস্বাধীনতা অর্জন
এই নীতি ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দলের অন্যান্য কর্মীসহ গ্রেফতার হন সুভাষ বসু। ১৯২৭ সালের ১৬ মে কারাগার থেকে মুক্তি পেলেও পুনরায় তাঁকে কারাবরণ করতে হয়। দীর্ঘকাল কারাবাসের ফলে তাঁর স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি ঘটে এবং ভগ্নস্বাস্থ্যের পুনরুদ্ধারে সুভাষ বসুকে চিকিৎসার জন্য ইউরোপে যেতে হয়। চিকিৎসার পর দেশে ফিরে এলেই আবার তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর গ্রেফতারের প্রতিবাদে ফেটে পড়ে বাংলাসহ সমগ্র ভারতে সর্বশ্রেণীর মানুষ। তাদের এককাট্টা স্লোগান : ভারতের গৌরব সুভাষ বোসের মুক্তি চাই।
অবশেষে ১৯৩৭ সালের ১৭ মার্চ মুক্তি পেলেন সুভাষ বসু। কারাবাসে আবার তাঁর শরীর ভেঙে পড়েছিল। চিকিৎসার জন্য আবার তাঁকে যেতে হয় অস্ট্রিয়ায়।
১৯৩৮ সালের ২৪ জানুয়ারি ত্রিপুরা কংগ্রেস সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন।
নেহেরু কমিটির সুপারিশ ছিল ঔপনিবেশিক স্বায়ত্ত শাসন এক বছরের মধ্যেই দিতে হবে। কিন্তু সুভাষ বসুর দাবি ছিল স্বায়ত্তশাসনের কোনো অর্থ হয় না, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা চাই। ইংরেজ এদেশ ছেড়ে চলে যাক। তিনি সগর্জনে বলে উঠলেন :”তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।”
১৯৩৯ সালে তিনি পুনরায় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। দক্ষিণপন্থি কংগ্রেস জোটের বিরোধিতার মুখে ১৯৩৯ সালের এপ্রিল মাসে কংগ্রেসের সভাপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ান। একই বছরের (১৯৩৯) ৩ মে তিনি গঠন করেন নতুন দল ফরোয়ার্ড ব্লক’।
এদিকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। সুভাষচন্দ্র ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষ্যে এই ঘটনার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করতে তৎপর হয়ে উঠলেন। ফলে নরমপন্থিরা তাঁকে ভুল বুঝলেন। বিদেশি সরকারও তাঁকে বেশিদিন মুক্ত থাকতে দিল না।
১৯৪০ সালে তাঁকে আবার গ্রেফতার করা হলো। কিন্তু ভগ্নস্বাস্থ্যের জন্য তাঁকে কারাগারে না পাঠিয়ে স্বগৃহে অন্তরীণ করে রাখা হলো। তিনি একদিন প্রহরীদের সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে অন্তরীণ অবস্থা থেকে মুক্ত পেশোয়ার এবং কাবুল হয়ে চলে আসেন প্রথমে বার্লিনে। পরে সেখান থেকে সোজা সিঙ্গাপুরে।
নেতাজি এবার দেশের বাইরে থেকে ব্রিটিশদের আঘাত হানাবার সংকল্প করলেন। দেশের ভেতরে থাকল তাঁর অগণিত অনুচর ও সহকর্মী। সিঙ্গাপুরে গঠিত হলো আজাদ হিন্দ ফৌজ (Indian National Army )। বাংলার দামাল ছেলে সুভাষচন্দ্র বসু হলেন তার সর্বাধিনায়ক। সেদিন থেকে তিনি হলেন নেতাজি সুভাষ বসু।
১৯৪২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি জাপানি আক্রমণে সিঙ্গাপুরের পতন হলো। সেখানে ধুরন্ধর ইংরেজরা ৩২,০০০ ভারতীয় সৈন্যকে জাপানিদের হাতে ছেড়ে দিল এবং ইংরেজ সেনাপতি পালিয়ে আত্মরকক্ষা করলেন। কিন্তু জাপানিরা ঐ নিরপরাধ ভারতীয় সৈন্যদেরকে বন্দি করেনি।
পরে এই ৩২,০০০ সৈন্যই প্রথমে তাদের দলনায়ক মোহন সিংহের নেতৃত্বে ভারত দখল করার লক্ষ্যে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেন।
সেই সময় জাপানে অবস্থান করছিলেন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু। আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠনের সংবাদ পেয়ে তিনি এই বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তারপর ১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর নেতাজি সুভাষ বসু আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বাধিনায়কের পদ গ্রহণ করে গঠন করেন স্বাধীন ভারতের অস্থায়ী সরকার।
নেতাজির নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ সিঙ্গাপুর থেকে এসে অবস্থান গ্রহণ করে বার্মার আরাকানে। কিন্তু জাপানিদের হাতে আন্দামানের পতন ঘটলে জাপান সরকার আন্দামানকে ছেড়ে দেন সুভাষ বসুর জিম্মায়। এই আন্দামানেই প্রথম উড্ডীন হয় স্বাধীন ভারতের বিজয় পতাকা।
তারপর ১৯৪৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি নেতাজী রেঙ্গুন থেকে ভারত আক্রমণের হুকুম দিলেন। আজাদ হিন্দ ফৌজ বার্মার (বর্তমান মায়ানমার) সীমান্ত পার হয়ে ১৮ মার্চ ভারতের মণিপুরে প্রবশ করে এবং ইম্ফল কোহিমার খানিকটা অংশ দখল করে নেয়।
কিন্তু পরে জাপান সরকার বিশ্বাসঘাতকতা করে সুভাষ বসুর সঙ্গে। জাপান চাইছিল ভারত তাদের অধিকারে আসুক। কিন্তু সুভাষ বসু চাইলেন, ইংরেজ চলে যাবার পর ভারত একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হোক। এ ব্যাপারে কোনো আপস নেই।
এই নিয়েই ভুল বোঝাবুঝি হলো জাপান সরকারের সঙ্গে সুভাষ বসুর। ফলে জাপান খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিল। এর ফলে সমরক্ষেত্রে আজাদ হিন্দ ফৌজের শত শত সেনা না খেয়ে, রোগেশোকে মারা যেতে লাগল। তাদের কেউ কেউ আত্মহত্যাও করল।
এরপর শুরু হলো ইংরেজদের বোমাবর্ষণ। ইংরেজরা গুপ্তঘাতক পাঠিয়ে কয়েকবার সুভাষ বসুকে হত্যা করার পরিকল্পনাও করেছিল, কিন্তু সফল হয়নি।
অবশেষে এই আজাদ হিন্দ ফৌজের একজন কুখ্যাত লেফটেন্যান্ট বিশ্বাসঘাতকতা করে বসে। সে পালিয়ে গিয়ে যোগ দিল ইংরেজদের দলে। সে সঙ্গে করে নিয়ে গেল সুভাষ বসুর অবসস্থান ও ঘাঁটির নাম, ছবিসহ গোপন খবরাখবর। ঘাঁটির সঠিক সন্ধান পেয়ে ইংরেজরা তাদে ওপর চালাল প্রচণ্ড আক্রমণ। তখন বাধ্য হয়েই পিছু হটতে হলো সুভাষ বসুকে।
এদিকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল। মিত্রবাহিনীর হাতে মার খেয়ে ১৯৪৫ সালের ২৩ এপ্রিল জাপানিরা পালাল সিঙ্গাপুর ছেড়ে। ফলে সুভাষ বসু ভারতীয় শেষ বাহিনীর ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে পালালেন সিঙ্গাপুর থেকে।
তিনি সিঙ্গাপুর থেকে জাপানি বিমানে করে এসে নামলেন ফরমোজার তাইহুকু বিমান বন্দরে। এই সময় তাঁর সাথে ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের স্টাফ অফিসার হাবিবুর রহমান।
এরপর তিনি তাইহুকু থেকে রওয়ানা হন টোকিওর উদ্দেশ্যে। যতদূর জানা যায়, এই বিমানযাত্রার সময়ই বিমানে বিস্ফোরণ ঘটে। নেতাজিকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর কয়েক ঘণ্টা পরেই তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন।
তবে তাঁর এই মৃত্যু নিয়ে মতবিভেদ আছে। কেউ বলেন, তিনি হাসপাতালেই মারা যান। আবার কেউ বলেন, আহত অবস্থাতেই তিনি হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যান। আজও তিনি নিরুদ্দেশ। ভারতবাসী তাঁর মৃত্যুর ঘটনাকে কখনো মেনে নেয়নি। ভারতের এই প্রাণপ্রিয় নেতার মরণজয়ী গৌরবের এখনো তাদের মনের আসনে আসীন
তাঁর ‘তরুণের স্বপ্ন’ এবং ইংরেজিতে লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী An Indian Pilgrim স্মরণীয় রচনা।