পাঁচ
‘জলমানবী’র ডেকে দাঁড়িয়ে আছে জোহান মিলফোর্ড। গার্ড রেইলে ঠেস দিয়ে। কান পেতে শুনছে নিশির শব্দ। সাগরের মিষ্টি কল্লোল।
উচ্ছ্বসিত আবেগে জাহাজের গায়ে আদরের চাপড় মারছে ঢেউ। ছলাত-ছল সে তান পূর্ণতা পেয়েছে কিন্নরী হাওয়ার সঙ্গতে। সাঁই-সাঁই শব্দটা কখনও শোনাচ্ছে শিসের মত, কখনও মনে হচ্ছে অপেরা-গায়িকার চড়া পর্দার গলার আওয়াজ।
বাদ্যযন্ত্রের ভূমিকা পালন করছে নোঙর। জোয়ারের সাথে তাল মিলিয়ে বাজনা বাজাচ্ছে। কাঠের গায়ে ধাতব শেকলের গা ঘষটানির আওয়াজ উঠছে মৃদু।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে এই প্রাকৃতিক কনসার্ট। একনাগাড়ে। শুনতে একটুও একঘেয়ে লাগে না জোহানের। সঙ্গীতসন্ধ্যায় প্রায় প্রতিদিনই হাজির থাকে জলমানবীর ‘ক্যাপ্টেন’। আজকের আসরে সে-ই একমাত্র শ্রোতা।
রাত বাড়ছে। হাজার বছরের পুরানো রাত।
আকাশে চাঁদ নেই। কিন্তু তারার জন্যে জমাট বাঁধতে পারছে না অন্ধকার।
অনতিদূরে মিটমিট করছে কয়েকটা আলো। একটু পর-পর নিভে যাচ্ছে একটা-একটা করে। বাতি নিভিয়ে ঘুমাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে বন্দরনগরী।
মিশ্র অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে আছে জোহানের ভেতরটা। পরাজিত। হোম-সিকনেস। বিভারের ফার বিক্রি করে ভাগ্য ফেরাবার আশায় দক্ষিণে এসেছিল। অনেক শহর-বন্দর ঘুরেছে। কাঙ্ক্ষিত দাম পায়নি পশমের। শেষে সস্তায় বেচে দিতে হয়েছে সব। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে ঘরের ছেলে ফিরে চলেছে এখন ঘরে।
সাদা বালুকাবেলার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল জোহান।
যতদূর দেখা যায়, একটা জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই।
চাপা কষ্ট জোহানের বুকের মাঝে। জমাট বেঁধে গুমরে মরছে। দৃশ্যমান ক্ষতি আর অদৃশ্য ক্ষততে জর্জরিত।
সাত-সাতটা মাস দেশের সাথে কোনও সম্পর্ক নেই। মাঝে মাঝে মনে হয়, এটা কোনও জীবন? সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘুরে বেড়ানো! তবু যদি প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মাঝে সমন্বয় হত! তা হলে বলা যেত— শেষ ভাল যার, সব ভাল।
কত মানুষ পথে নামছে। জীবিকার জন্যে দেশান্তরী হচ্ছে। সম্ভাবনার কষ্টিপাথরে নিজের বরাত যাচাই করে দেখতে চায় সবাই।
কোথাও হয়তো পাওয়া যায় প্রচুর সুগন্ধি। বনে-জঙ্গলে আছে মশলার ভাণ্ডার। দেশে এনে বেচলে লাল লাল।
কেউ বা করে আদম-ব্যবসা। এক দেশের নিগ্রো আর আদিবাসীদের ধরে নিয়ে গিয়ে আরেক দেশে বেচে দিয়ে আসে। হাজারে হাজারে।
কোনও দেশের খনিতে আছে তাল-তাল সোনা। কপালে থাকলে ঠেকায় কে!
কোনও বণিক রূপা আর খনিজ রত্নভর্তি জাহাজ ভাসায় ভিন মুলুকের পানে।
কারও সম্বল কাপড় রাঙাবার নীল।
এই সবই আদার ব্যাপারিদের কারবার। জোহানের পুঁজি স্বল্প।
তার জাহাজটাও ঠিক জাহাজ নয়। বোট। চল্লিশ ফুট লম্বা একটা স্কুনার। সামনে-পেছনে এক জোড়া মাস্তুল। যাত্রাবিরতি চলছে আপাতত। ভোরের আলো না ফোটাতক জলমানবীর বিশ্রাম।
একা নয় বোটটা। আরও দুটো জলযান সঙ্গ দিচ্ছে তাকে। ফিসফিসিয়ে কথা বলছে তারা। সারারাত চলবে এই আলাপন।
শহরতলির সব আলোই নিভে গেছে। গায়ে গায়ে লেগে থাকা বাড়িগুলো এখন একতাল আলকাতরা। কোনওটা আলাদা করে ঠাহর করবার উপায় নেই। তবে তারার আলোতে আবছা ভাবে চোখে পড়ছে আরও দূরের স্প্যানিশ ফোর্টের কালচে-ধূসর ভুতুড়ে অবয়ব।
বিশাল মোটা, পাথরের একটা থাম গর্বিত ভঙ্গিতে উঠে গেছে আকাশের দিকে। মাথাটা চোখা। দিনের আলো থাকতে দেখেছে, থামের গায়ে আঙুরলতা পেঁচিয়ে আছে ভাইন স্নেকের মত। স্তম্ভের উচ্চতার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে।
কালো-কালো ফোকর দুর্গটার গায়ে। ওগুলোর কোনওটা জানালা, কোনওটা ঘুলঘুলি।
একটা আগুন ধিইয়ে উঠল কি চারকোনা অন্ধকারে?
হ্যাঁ। বাতি জ্বালিয়েছে কেউ।
নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে ক্ষুদ্র শিখাটা। পরমুহূর্তে গায়েব হয়ে গেল।
জানালা জুড়ে এখন মিটমিটে আভা। ফিকে হতে হতে মিলিয়ে গেল সেটাও।
দুর্গের পেছনের চির-হরিৎ জঙ্গল থেকে ধেয়ে এল ভিজে এক ঝলক বাতাস। খুব সম্ভব বৃষ্টি হচ্ছে কাছে কোথাও।
ঠাণ্ডা লাগায় জোহানের শরীরটা শিউরে উঠল। দুই হাতের তালু চালান করে দিল সে বগলের তলায়।
অ্যাশ কালারের কর্ডের জ্যাকেট ওর পরনে। কালো ফেল্ট হ্যাটটা সামনের দিকে একটু নামানো।
আলকাতরা গোলা অন্ধকারে একটা আলো জ্বলে উঠল
সব রকমের লোক আছে ওখানে- ওই লোকালয়ে। সাদা, নিগ্রো, বাদামি, হলুদ- নানান জাতের জগাখিচুড়ি। সমস্ত দুনিয়ায় ঘুরে ফিরে আর কোথাও ঠাঁই না পেয়ে উঠেছে গিয়ে যেন ওই দ্বীপটাতে। পোড় খাওয়া মানুষ সব। বেশির ভাগই ভাল। তবে যেগুলো হারামী, মহা হারামী। ঝাড়ে-বংশে ইবলিশ।
খটখট করে একটা আওয়াজ উঠল। আঁধারে কী জানি চলে- ফিরে বেড়াচ্ছে ডেকের ওপরে। জোহানের বুটের পাশ দিয়ে হেঁটে গেল।
না দেখেও বুঝতে পারল জোহান, জিনিসটা কী। কাঁকড়া। কোনও ভাবে উঠে পড়েছে বোটে।
প্লপ!
পানিতে লাফিয়ে পড়েছে জীবটা। যেখানে তার নিবাস।
একটা অস্বাভাবিকতা টের পেতে শিরদাঁড়া সোজা হয়ে গেল জোহানের।
কোথা থেকে যেন উদয় হয়েছে সাদাটে একটা ছায়ামূর্তি। সৈকতের বালির ওপর দিয়ে ছুটে আসছে তীরের দিকে।
মূর্তিটা যে মানুষ, সেটা বোঝা গেল ছায়াটা উল্লম্ব বলে। উচ্চতা দেখে মনে হচ্ছে- বাচ্চা কোনও ছেলে।
নাকি মেয়ে?
এই অসময়ে করছেটা কী সে বিরান উপকূলে?
কী করতে চাইছে?
চোখ তীক্ষ করে তাকিয়ে থাকল জোহান। মাথাটা ওর টানটান হয়ে আছে ঘাড়ের ওপরে। ভেতরে ক্ষিপ্র গতিতে বইছে চিন্তা।
পানির কিনারায় এসে থমকে দাঁড়াল মানবশিশু।
…তার পরেই ঘটল ভোজবাজি।
সেরকমই মনে হলো জোহানের।
সাদা ছায়াটা এক লাফে দ্বিগুণ হয়ে গেছে!
ধাঁধায় পড়ে গেল জোহান। এ কী ভুতুড়ে কারবার! পরক্ষণে ধরতে পারল ভুলটা।
‘বাচ্চা’টা আদপে বাচ্চা নয়! বড় মানুষ।
সাদা রঙের পোশাক মানুষটার পরনে। আলখেল্লা-জাতীয় কিছু। পা পর্যন্ত লম্বা ঝুল। গাঢ় রঙের খাটো আরেকটা পরিচ্ছদ জড়িয়েছে তার ওপরে। শরীরের ঊর্ধ্বাংশে। ফলে আবছায়াতে ঘটেছে দৃষ্টিবিভ্রম। এখন ওপরের কাপড়টা খুলতেই—
ঝপাত!
আবছামত আওয়াজটা কর্ণগোচর হতে ফের সচকিত হলো জোহান। রেলিং-এর ওপরে শক্ত হয়ে চেপে বসল ওর আঙুলগুলো।
সাগরে ঝাঁপ দিয়েছে লোকটা!
সুইসাইড করতে চায় নাকি?
না বোধ হয়। তা হলে সাঁতরাত না।
দোয়াতের কালির মত কালো পানির ওপরে স্থির ভাবে নিবদ্ধ জোহানের চোখ দুটো। …স্পষ্ট করে কিছু বুঝবার উপায় নেই। একবারের জন্যে ধূসর একটা ঝিলিক দেখতে পেয়েছে বলে মনে হলো।
বকের মত গলা বাড়িয়ে লোকটাকে খুঁজল জোহান। দেখতে পেল না কোথাও।
একটা আওয়াজ ভেসে এল ট্যাফরেইলের নীচে থেকে। চমকে উঠল সে। কান খাড়া হয়ে গেল।
বোটের গায়ে খালি হাতে চাপড় দিচ্ছে কেউ। এবারে একটা গলার স্বর শোনা গেল।
‘হেল্প!’
চাপা কণ্ঠ। তীক্ষ্ণ।
আবার শব্দ হলো বোটের গায়ে।
‘ইজ এনিবডি দেয়ার?’
মেয়েলি গলা।
আরও কয়েকটা চাপড়ের শব্দ শোনা গেল।
‘হোলা!’*
[*হোলা (Hola) : স্প্যানিশ ভাষায় ‘হ্যালো’।]
দৌড় দিল জোহান। বোটের পেছন দিকে গিয়ে নীচে ঝুঁকল।
এখনও সুস্পষ্ট নয়। তবে আগের চাইতে পরিষ্কার।
এক তরুণী।
সাঁতার কাটছে, আর হাবুডুবু খাচ্ছে।
ছয়
একটু সরে গেল মেয়েটা বোটের কাছ থেকে। জোহানকে দেখতে পেয়েছে।
‘বাঁচাও!’
বিপদগ্রস্ত তরুণীর আবেদন উপেক্ষা করা কোনও পুরুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। কিন্তু কথা সেটা নয়।
পালিয়ে এসেছে, বোঝা যাচ্ছে।
কীসের থেকে?
‘পোর ফেভারত*… জলদি তোলো আমাকে… ডুবে গেলাম!’
[*পোর ফেভার (Por favor) : ‘দয়া করে’।]
কথাটার গুরুত্ব আপাত স্থবির জোহানকে তৎপর করে তুলল। স্টারবোর্ড ঘেঁষে ছুট লাগাল সে জলমানবীর পেটের দিকে। গুটিয়ে রাখা দড়ির মইটা নামিয়ে দিল। সেই সাথে গেল নির্দেশঃ ‘এদিকে!’
একটু পরে রোপ-ল্যাডারের কাছে ভাসতে দেখা গেল মেয়েটাকে।
‘একটা মই ঝুলছে, দেখো!’ গলা তুলল জোহান, ‘ধরে ফেলো ওটা!’
‘পেয়েছি!’ কয়েক সেকেণ্ড পরে শব্দ এল নীচে থেকে। ‘এবার উঠে এসো রশি বেয়ে।’
ছলাত-ছলাত শব্দ হলো পানিতে।
দুই মিনিটের মধ্যে মইয়ের মাথায় উঠে এল তরুণী। ভিজে কোঁকড়ানো চুলগুলো তার কপালে, গালে, গলায় লেপটে রয়েছে।
হাত এগিয়ে দিল জোহান। ধরে ফেলল মেয়েটার এক বাহু। রেইল ডিঙিয়ে ডেকে উঠে আসতে সাহায্য করল তাকে।
‘গ্রেশাস,’ অস্ফুট স্বরে ধন্যবাদ জানাল স্প্যানিশ তরুণী। ‘ওয়েলকাম।’ এখন কী?
প্রাথমিক উত্তেজনা কেটে যেতে ইতিকর্তব্য নিয়ে মুশকিলে পড়ে গেল জোহান। স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে রইল একপাশে।
তরুণী মাথা থেকে পানি ঝরাতে ব্যস্ত। একদিকে হেলিয়ে রেখেছে ঘাড়। কাপড় নিংড়াবার মত দুই হাতে এক করে চিপছে কালো চুলগুলো।
ছপছপে নাইটগাউনটা সেঁটে আছে তার গায়ের সাথে। নীচে শেমিজ থাকলেও ভিজে যাবার কারণে ট্রান্সপারেন্ট একটা ভাব ফুটেছে কাপড়ে। মূর্ত হয়ে উঠেছে উদ্ভিন্নযৌবনা দেহের রহস্যময় খাঁজ-ভাঁজগুলো।
চোখ সরাতে পারছে না জোহান। এভাবে তাকিয়ে থাকাটা অসভ্যতার পর্যায়ে পড়ে জেনেও।
ঝাঁকি দিয়ে চুলগুলো পেছনে সরিয়ে দিল শ্বেতবসনা। এতক্ষণে যেন পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধে সচেতন হলো সে। হাত দুটো গুণচিহ্নের মত উঠে এসে আড়াল করল উন্নত দুই স্তন।
‘দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছ কী, সেনিয়োর? জাহাজ ছাড়তে বলো! আর দয়া করে কোট-টোট— একটা কিছু আনো… ঠাণ্ডায় তো একেবারে জমে গেলাম!’ ত্রস্ত কণ্ঠটায় একই সাথে আদেশ ও অনুরোধের সুর।
থতমত খেয়ে গেলেও ক্যাপ্টেন-সুলভ গাম্ভীর্যের খোলস ছেড়ে বের হলো না জোহান। ব্যক্তিত্ব অক্ষুণ্ণ রেখে বলল, ‘সকালের আগে যাত্রা করছি না আমরা।’
‘আমার উপদেশ যদি শোনো, তা হলে এক্ষুণি রওনা হও,’ মেয়েটির গলায় ধৈর্যচ্যুতির লক্ষণ। ‘ওরা আসছে। সৈকতে আমার কার্ডিগানটা খুঁজে পেলে বুঝে যাবে অনেক কিছু। হারবারের প্রত্যেকটা জাহাজ তল্লাশি করবে ওরা। …বিপদে পড়তে যাচ্ছ তুমি, সেনিয়োর!’
‘বিপদ’ শব্দটা সাবধানী করে তুলল জোহানকে।
এমনিতে নানান আশঙ্কা ঘাড়ে করে চলতে হয় তাকে। জলদস্যুর ভয় আছে। জলদেবতার অভিসম্পাত নামতে পারে যখন-তখন। কত রকম আনপ্রেডিক্টেবল ঘটনা ঘটতে পারে সাগরে…
না। জেনে-শুনে সে বিপদ ডেকে আনতে চায় না।
মেয়েটা কে, কোত্থেকে এসেছে- এসব প্রশ্ন আপাতত মুলতবি থাক। তরুণীর অসহিষ্ণু ভাব দেখে মনে হচ্ছে, বিশদ ভাবে বলবার সময় নেই এখন।
আরও একটা জিনিস বুঝল জোহান। মেয়েটাকে ফিরিয়ে দেবার সাধ্য নেই তার।
কিঞ্চিৎ ত্যক্ত বোধ করল। রুটিনের, বাইরে কিছু করা সাধারণত ওর ধাতে নেই। নির্ঝঞ্ঝাটে যে থাকতে চায়, তার কাছে তো এটা উপদ্রবের সমতুল্য।
কিন্তু হিপো কোথায়? হার্ডি?
গোলমাল টের পায়নি ওরা?
দুই কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙাবার জন্যে ডিউটি-বেলের রশি ঝাঁকাতে লাগল জোহান।
টিং-টিং-টিং-টিং করে ঘণ্টা বাজতে আরম্ভ করল নীচে।
সবার আগে যে ডেকে পা রাখল, তাকে দেখে তরুণীর মনে হলো, সৃষ্টিকর্তা লোকটাকে ভালুক বানাতে গিয়ে মানুষ বানিয়ে ফেলেছে। বাদামি লোমে ভরা বিশাল এক দৈত্য।
‘কী ব্যাপার, বস? এত রাতে আবার ডাকাডাকি কীসের?’ চোখ রগড়াতে রগড়াতে মুখ দিয়ে অবিমিশ্র বিরক্তি ওগরাল হার্ডি রোভার।
‘নোঙর তোলো, হার্ডি।’
‘কী জন্য?’
‘রওনা হচ্ছি আমরা।’ হার্ডিকে আর কোনও প্রশ্ন করবার চান্স না দিয়ে বলল জোহান, ‘আলো জ্বালাবে না। বেশি আওয়াজ করবে না।’
আওয়াজ তো তুমিই বেশি করছ, বস!’
একমাত্র হার্ডিই মনিবকে এভাবে কথা বলবার সাহস রাখে। তার ধারণা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা তার গণতান্ত্রিক অধিকার।
‘কিন্তু এসবের মানে কী?’ কৈফিয়ত চাইল সে।
ইতিমধ্যে ডেকে হাজির হয়েছে হিপো পটেমাস।
নামের সাথে স্বাস্থ্যের কোনও মিল নেই তার। সাইজে হার্ডির অর্ধেক। দৈর্ঘ্যেও, প্রস্থেও। তুলনা করলে ‘লিলিপুট’ বলা চলে। এ যেন ‘কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন’।
বোটে একটা ‘পরী’কে দেখে খাবি খাবার দশা হলো হিপোর।
‘কাপ্তান, বস, মেয়েটা কে?’
হিপোর কথায় হাওয়াইয়ান টান।
‘কোন্ মেয়ে?’
প্রশ্নটা করেছে হার্ডি। জোহানের পেছনে দাঁড়ানো যুবতীর উপস্থিতি খেয়াল করেনি সে। হিপোর দৃষ্টি অনুসরণ করে বিমূঢ় হয়ে গেল। তবে সেটা মুহূর্তের জন্যে।
‘হুইল ধর, হিপো,’ বলল হার্ডি গম্ভীর গলায়। বসের জবাবের অপেক্ষায় না থেকে নিজেও কাজ করতে চলল। যেতে যেতে গজগজ করছে, ‘হুঁহ, মেয়েমানুষ! তাই তো বলি, এত তাড়া কীসের! আরে, গবেট, মেয়েমানুষের মধ্যে আছেটা কী, মাংসের ডেলা ছাড়া?’
হার্ডির মন্তব্য জোহানের কান এড়ায়নি। বিব্রত চোখে তাকাল সে তরুণীর দিকে।
তিরতির করে কাঁপছে মেয়েটার সর্বাঙ্গ। আঙুলগুলো আঁকড়ে ধরে আছে নিজের দুই কাঁধ। …কেবল শীত নয়; আয়ত চোখ জোড়া বলছে, আরও কারণ রয়েছে এর পেছনে।
ক্লান্তি?
ভয়?
সাত
অনুকূল বাতাসের ধাক্কায় চুপিচুপি ধাক্কায় চুপিচুপি হারবার ত্যাগ করল জলমানবী। জল-সমতলের ওপরে সফেদ ফেনা সৃষ্টি হলো কি হলো না।
ওপরে এসে হার্ডির পাশে দাঁড়াল জোহান।
লাতিন তরুণী কাপড় বদলাচ্ছে নীচে।
দূরত্বের কারণে ঝাপসা একটা সাদা রেখায় পরিণত হওয়া বালুকাবেলার দিকে চোখ হার্ডির। গণ্ডগোলের আশঙ্কা করছে। নির্দয় ভাবে গাল চুলকাতে চুলকাতে তাকাল সে জোহানের দিকে। ‘কী মনে হলো, বস, মেয়েটাকে দেখে? জেলঘুঘু?’
‘নো,’ স্পষ্ট করে এবং জোরের সাথে বলল জোহান।
‘এতটা নিশ্চিত হচ্ছ কীভাবে?’
একটু ভাবল জোহান। ‘আমার মন বলছে,’ বলল ও।
অন্ধকারেও চকচক করে উঠল হার্ডির সাদা দাঁত। হাসছে। অদ্ভুত এক স্বরে আওড়াল, ‘মন!’
‘তা ছাড়া চেহারা দেখেও তো বোঝা যায়….
‘না, তা যায় না,’ দ্বিমত প্রকাশ করল হার্ডি।
জোহান আর কিছু বলল না। সে নিজেও নিজের সাথে একমত নয়।
একটা কথা মনে আসতে হার্ডি বলল, ‘দেখো গে, বিয়ের আসর থেকে পালিয়েছে কি না!’
‘সম্ভাবনা কম।’
‘এটাও কি তোমার মন বলছে?’ হার্ডির কণ্ঠস্বরে কৌতুক।
‘নো, স্যর। আন্দাজে বললাম।’
‘কীভাবে করলে আন্দাজটা?’
‘খুব সহজ। মেয়েটার হাতে কোনও আংটি দেখিনি।’
খুলে ফেলতে পারে- এ কথাটা হার্ডির মাথাতেই এল না। বসের যুক্তি মেনে নিয়েছে। ‘তোমার অনুমান ঠিক হলে তো ভালই।’
‘কী মনে হয় তোমার, হার্ডি?’ প্রশ্নটা জোহানকে অনেকক্ষণ ধরে খোঁচাচ্ছে। ‘আমি কি কোনও ভুল করেছি?’
‘তোমার কথা মাথার উপর দিয়ে গেছে, বস।’
‘মেয়েটাকে তো উঠতে দিলাম বোটে,’ খোলাখুলি বলবার প্রয়াস পেল জোহান। ‘কাজটা কি ঠিক করলাম?’
‘আমি তো কোনও দোষ দেখি না, বস।’
‘না… মানে… চিনি না, জানি না…..
‘বস, মেয়েটা বিপদে পড়েছে, ঠিক তো?’
‘নিঃসন্দেহে।’
‘সে ক্ষেত্রে একজন ভদ্রলোক এবং পুরুষমানুষের কাজই করেছ তুমি,’ রায় দিয়ে দিল হার্ডি। ‘যখন যেটা করা দরকার, সেটা করে ফেলতে হয়। এ কথা তুমিও জানো, বস। এজন্য যদি কোনও ঝামেলা আসে, সেটার দায় তোমার নয়।’
‘ঝামেলা আশা করছ তুমি?’
‘মেয়েছেলে মানেই ঝামেলা, বস!’ উদাসীন গলায় বলল
হার্ডি।
‘কী বলো, না বলো!’ অন্য সময় হলে বলত জোহান। ‘তোমার মায়ের ব্যাপারেও কি একই ধারণা?’
হার্ডি বলত, ওর মা কী রকম খাণ্ডারনী টাইপের মহিলা। তার মুখের ওপর দিয়ে কোনও দিন একটা কথা বলবার মওকা পায় না বাপ।
বালক বয়স থেকে এটা দেখতে দেখতে বিয়ে সম্বন্ধে হীনম্মন্যতা জন্মে গেছে হার্ডির। মুক্ত বাতাস খাওয়াতে ছেদ পড়বে ভেবে সে ওপথ মাড়ায়নি। …তাতে কী? সাগরের সাথে প্রেম করে হার্ডি। সাগরে থাকলে ওর নাকি নিজেকে কামোন্মাদ এক তুর্কি মনে হয়, যে তার ক্রীতদাসীদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরীটাকে ভোগ করছে।
আগে হলে হার্ডির মনস্তত্ত্ব নিয়ে হাসাহাসি করত জোহান। তর্কাতর্কি হত কিছুক্ষণ। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। রসিকতার মানসিকতা নেই দু’জনের কারোরই।
তুফান আসছে। কালো মেঘ ঘনিয়ে উঠেছে জোহানের মনের মধ্যে। অনাগত বিপদের সঙ্কেত দিচ্ছে ষষ্ঠ ইন্দ্ৰিয়।
কাদের কাছ থেকে পালাচ্ছে মেয়েটা?
‘ওরা’ কারা?
ভাবনাটা শেয়ার করল হার্ডির সাথে।
‘এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বকবক করে তো লাভ নেই, বস!’ তিরস্কার করল হার্ডি। ‘যাও, কথা বলো মেয়েটার সাথে। জিজ্ঞেস করো, কে? কেন? কীভাবে?’
কমপ্যানিয়ন ওয়ের দিকে হাঁটা দিল জোহান।
নীচে নেমে দেখে, এরই মাঝে ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা। ওর বাঙ্ক দখল করেছে। গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে কম্বল গায়ে দিয়ে
নাইটি ও অন্যান্য ভিজে কাপড় স্তূপ হয়ে পড়ে আছে কেবিনের এক কোনায়।
কামরাটা উষ্ণতায় ভরা। তেল আর ধোঁয়ার ঝাঁজাল গন্ধে ভরপুর। পিতলের লণ্ঠন ঝুলছে হুক থেকে। জাহাজের দুলুনির সাথে মৃদু দুলছে। চিমনি দিয়ে উগরে দিচ্ছে পাতলা ধোঁয়া।
ঘুমন্ত মুখটা পরখ করল জোহান।
মেয়েটা দেখতে আগুন। স্বর্গের অপ্সরী বললে নির্ভুল হবে। ফুটন্ত গোলাপের সাথেও তুলনা করা যায়।
…আগুন আর ফুলের চারপাশেই ভিড় করে পোকা।
নিয়মিত ছন্দে নিঃশ্বাস পড়ছে মেয়েটার। বন্ধ চোখের পাতার নীচে মণি জোড়া থির হয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগের উত্তেজনার কোনও চিহ্ন নেই। মনে হচ্ছে, এক ঘুমে রাত কাবার করে দেবে।
আলোটা কমিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এল জোহান।
তারা দেখছিল হার্ডি। এত তাড়াতাড়ি বসকে ফিরে আসতে দেখে অবাক হলো।
‘কী বলে, বস?’
‘কিছুই না। ঘুমের দেশে আছে।’
‘অ।’ হতাশ হলো খালাসি। ‘অনেক ক্লান্ত ছিল বোধ হয়।’
‘হুম। তোমার কী অবস্থা, বস?’
‘টায়ার্ড।’
‘তা হলে শোও গে, যাও।’
‘যাচ্ছি।’
সাগরকূলের শেষ রেখাটুকুও মিলিয়ে গেছে।
হার্ডি বলল, ‘আমার বাঙ্কে ঘুমাতে পারো তুমি।’
সাগর থেকে চোখ ফেরাল জোহান। দ্বিরুক্তি করল না।
আট
ভোর চারটেয় হার্ডিকে রিলিফ দিতে এল জোহান।
আকাশের পূর্ব-সীমানা দখল করে আছে মেঘ। উত্তর-আকাশে লটকে থাকা নিঃসঙ্গ শুকতারা জুলজুল করে চেয়ে আছে।
লোনা পানি ছুঁয়ে আসছে দামাল হাওয়া। সাগরের দীর্ঘশ্বাস যেন।
দুরন্ত সাগরের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলেছে বোট। প্রেমিক পুরুষের মত দুষ্টুমি করে জলমানবীর গায়ে পানি ছিটাচ্ছে যেন সাগর।
স্টার্নে প্রস্তরমূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে হার্ডি। চেয়ে আছে সুদূরের পানে। দুনিয়ার আর কোনও দিকে খেয়াল নেই।
হার্ডির চেহারাতে স্থির হয়ে আছে ফ্রিজিয়ান স্টোনের গা ছমছমে কাঠিন্য। চাঁদির ফুরফুরে চুলগুলো উড়ছে।
‘খবর আছে কোনও?’
পাথরের স্ট্যাচু প্রাণ পেল যেন জোহানের কথায়। কাঁধ ঝাঁকি দিল হার্ডি। ‘একটা ক্রুশকাঠ দেখলাম, মনে হলো, বস। অবশ্য আমার ভুলও হতে পারে। একবার মাত্র দেখেছি।’
‘খালি চোখে?’
‘প্রথমে খালি চোখেই দেখেছি। তারপর চোখ লাগালাম দুরবিনে। দেখি, নেই। কুয়াশার মধ্যে গায়েব হয়ে গেছে।’
চিন্তিত হলো জোহান।
“ভুল হতে পারে”–এটা কথার কথা। কোনও কিছু সম্বন্ধে নিশ্চিত হলেই এ কথা বলে হার্ডি।
ক্রুশকাঠ মানে মাস্তুল। যদিও ওই জাহাজের সাথে মেয়েটার কোনও সম্পর্ক আছে, এটা ভাববার কারণ নেই।
‘ঠিক আছে। তুমি যাও!’
‘আই, আই, স্যর। গেলাম, বেবি।’
শেষ কথাটা জলমানবীর উদ্দেশে। হার্ডি বিশ্বাস করে, সব জাহাজের প্রাণ আছে। ঘোড়ার মত তাদের আদর দিয়ে, শাসন করে বশে রাখতে হয়।
কম্পাসের রিডিং দেখল জোহান। হিপোর হাত থেকে হুইলের ভার নিয়ে তাকেও শুতে পাঠিয়ে দিল।
ফো’ক্যাসলে ফিরবার আগে কমপ্যানিয়ন ওয়ে হয়ে যেতে চাইল হাওয়াই নিবাসী। দুই ঢোক ব্র্যাণ্ডি গিলবে।
সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে পরীর সামনে পড়ল লোকটা।
ওপরে যাচ্ছিল তরুণী। পলিনেশিয়ান যুবকের চোখে নির্জলা মুগ্ধতা ফুটে উঠতে দেখল।
মারফতি হাসি হিপোর ঠোঁটে। দুই আঙুলে তোবড়ানো সি- ক্যাপের কার্নিস স্পর্শ করল আলতো করে। একপাশে সরে মেয়েটার যাবার পথ করে দিল।
‘তোমাদের মালিক কোথায়?’ জানতে চাইল তরুণী।
কোনাকুনি চোখ তুলে ছাতের দিকে ইঙ্গিত করল হিপো। ‘উপরেই আছে, ম্যা’ম।’
‘গ্রেশাস।’
‘বুঝি নাই।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ।’
দিলখোলা হাসি হাসল হাওয়াইয়ান।
পেছনে পায়ের আওয়াজ পেয়ে ঘাড় ঘোরাল জোহান।
মেয়েটা।
অপরিচিতা তার পাশে এসে দাঁড়াল। জোহানের একটা শার্ট আর প্যান্ট পরেছে। জিনসের প্যান্টটা বেল্ট দিয়ে আটকানো গেলেও ঢলঢল করছে লাল ফ্লানেলের শার্ট। তবে পুরুষের কাপড়ে তাকে মোটেই আড়ষ্ট মনে হচ্ছে না। যেন এটাই স্বাভাবিক।
জোহানের বরং মনে হলো, পুরুষের পোশাকও চমৎকার মানিয়ে গেছে মেয়েটার নিজের রূপের কারণে।
পুবের আকাশে এখন এক মুঠো মলিন আলোর বিভা। কুয়াশা-কুয়াশা ধোঁয়াটে ভাব চতুর্দিকে।
কিন্তু সকাল যেন হার মেনে যাবে মেয়েটার সজীবতার কাছে। ‘গুড মরনিং।’
‘বুয়েনোস ডায়াস।’
এই প্রথম হাসল তরুণী।
জোহানের মনে হলো, কেঁপে উঠল ধরণী। অদ্ভুত সুন্দর মুখটা যেন পৃথিবীতে অদ্বিতীয়।
সারপেন্টাইল মারবেলের মত সবুজ চোখ। টিকালো নাক। কমলার কোয়ার মত অধর।
ঠিক এই রকম দেখতে কোনও গ্রিক দেবীর একটা ছবি কোথায় জানি দেখেছিল, মনে করতে পারল না সে।
সাগরের গান শুনতে লাগল ওরা। একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছে মাঝে মাঝে। অপরজনের চোখ এড়িয়ে।
এক পর্যায়ে মেয়েটার চোখে ধরা পড়ে গেল জোহান। অপ্রতিভ হয়ে গিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল।
গালের পাতলা চামড়ায় আপেলের রং ধরল তরুণীর। পুরুষের মুগ্ধ দৃষ্টি পড়ে নিতে কোনও নারীরই ভুল হয় না।
‘কোথায় চলেছি আমরা?’ ক’মুহূর্ত বাদে জানতে চাইল মেয়েটা।
অপ্রস্তুত ভাবটা ঝটিতি কাটিয়ে উঠবার সুযোগ পেয়ে স্বস্তি অনুভব করল জোহান।
‘আলটা ক্যালিফোরনিয়াতে, ম্যা’ম,’ বলল সে। সাথে যোগ করল, ‘পথে যদি আর কোথাও নামতে না চাও।’
‘তোমার দেশ, সেনিয়োর?’ সাগ্রহে জানতে চাইল তরুণী।
স্মিত হাসল জোহান। ‘ক্যালিফোরনিয়া দেশ নয়, ম্যা’ম। টেরিটোরি।’
‘কোথায় সেটা?’
‘মেকসিকোতে।’
‘যেতে কদ্দিন লাগবে, সেনিয়োর?’
অঙ্ক কষল জোহান। ‘তা, দুই-তিন হপ্তা তো লাগবেই, ম্যা’ম।’
‘বাব্বাহ, এত!’ ধনুকের মত বাঁকা ভ্রূ ছড়িয়ে বিস্ময় প্রকাশ করল তরুণী।
‘বেশিও লাগতে পারে, ম্যা’ম।’
‘আরও বেশি!’
‘আবার কমও লাগতে পারে।’
তরুণীর চোখে প্রশ্নচিহ্ন। ‘তোমার হিব্রু বুঝতে পারছি না, সেনিয়োর!’
জোহান হেসে ফেলল। ‘চমৎকার হাওয়া দিচ্ছে, তা-ই না?’ কোন্ কথা থেকে কোন্ কথা! তরুণী অবাক। কথা জোগাল না মুখে।
আগের কথার খেই ধরল জোহান, ‘তুমি কি জানো, বাতাসের গন্তব্য কোথায়?’
অনিশ্চিত ভঙ্গিতে ডাইনে-বাঁয়ে মাথা নাড়ল তরুণী।
‘আমিও জানি না।’
‘তো?’ উদ্ভ্রান্ত দেখাচ্ছে তরুণীকে।
ওপরের দিকে চোখের ইশারা করল জোহান। ‘পাল, ম্যা’ম।’ স্কুলমাস্টারের ভঙ্গিতে বলল, ‘বোটটাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে বাতাস। স্রোতও সাহায্য করছে। কিন্তু সব সময় তো আর এমনটা থাকবে না। বাতাস পড়ে যেতে পারে। চলতে হতে পারে উজান ঠেলে। আর যদি ঝড় ওঠে… সাগর খেপে যায়…’ হাসল সে। ‘বুঝতেই পারছ, ম্যা’ম…’
সমঝদারের মত মাথা ওপর-নীচ করল মেয়েটা।
‘কত তাড়াতাড়ি পৌছাতে পারব, সেটা নির্ভর করছে আবহাওয়ার মেজাজের উপরে। বাতাস আর সাগর নিজেদের মর্জি মাফিক চলে। তাই আগেভাগে কিছু বলা যায় না।’
মেঘ কেটে যাচ্ছে। কয়েকটা সুরঙ্গ তৈরি হয়েছে আকাশের গায়ে। সকালের নির্মল আলো নামছে ধরায়।
‘সুন্দর করে কথা বলো তুমি, সেনিয়োর,’ মেয়েটার মন্তব্যে মুগ্ধতার ছাপ ফুটল। ‘কবিতা-টবিতা লেখো নাকি?’
বো রেইলে জড়োসড়ো হয়ে বসে ছিল একটা সি-গাল। জোহানের অট্টহাসির শব্দে ভয় পেয়ে উড়ে গেল শাপ দিতে দিতে।
‘হাসলে কেন, সেনিয়োর?’
‘সরি, ম্যা’ম।’
‘না, বলো।’
‘কবিতা লিখবার কথা বললে না?’ এমন ভাবে বলল জোহান, যেন একটা বাচ্চার সাথে কথা বলছে। ‘রুক্ষ অঞ্চলের মানুষ আমরা। শ্রম আর ঘামের জীবন। সাহিত্য চর্চার সময় কোথায়, ম্যা’ম?’
সলজ্জ হাসল তরুণী।
ওকে সহজ করবার জন্যে জিজ্ঞেস করল জোহান, ‘তুমি এত ভাল ইংরেজি শিখলে কোথায়?’
খুশি হলো মেয়েটা। ‘ভাল বলছ? সত্যিই?’
‘অ্যাবসলিউটলি,’ মন থেকে বলল জোহান।
‘এক পাদ্রির কাছে শিখেছি।’
ক্ষণকালের জন্যে কথা ফুরিয়ে গেল দু’জনের।
‘তা, কী ইচ্ছা, আমাদের সাথেই যাবে?’ সহৃদয় হাসি জোহানের ঠোঁটে।
বলবার আগে খানিক দ্বিধা করল তরুণী। ‘সেনিয়োরের যদি আপত্তি না থাকে!’
‘না… আপত্তি আর কী!’ জোহান বলল, ‘কিন্তু তারপর?’
ক্ষণিকের জন্যে দূরে কোথাও হারিয়ে গেল মেয়েটার দৃষ্টি। ক্লিষ্ট হাসল। ‘জানি না, সেনিয়োর।’
জোহান ভেবে পেল না, কী বলবে।
‘পালাচ্ছি আমি,’ স্বীকারোক্তি দিল তরুণী।
‘কেন, কী করেছ তুমি?’ তরল গলায় জানতে চাইল জোহান। ‘কী করেছি?’ অভিমান প্রকাশ পেল মেয়েটার গলায়। ‘নিজের মতন করে বাঁচতে চাওয়াটা কি অপরাধ?’
‘নিশ্চয় নয়।’
‘সেটাই চেয়েছিলাম আমি। অথচ…’ গলাটা ধরে এল।
টুকরো কথাগুলো থেকে আসল সূত্রটা ধরবার চেষ্টা করছে জোহান। গোটা ব্যাপারটা গোলকধাঁধার মত লাগছে তার কাছে। অস্পষ্ট। জটিল। দুর্বোধ্য।
তার অসহায়ত্ব আঁচ করতে পারল তরুণী মুখ দেখে। ‘একজনের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে চাই আমি… যতখানি সম্ভব…’
‘কে লোকটা?’
‘এল মারিয়াচির নাম শুনেছ?’
নয়
কেউ যেন হেঁটে গেল জোহানের কবরের ওপর দিয়ে। পেটের ভেতরে কিলবিল করে উঠল অযুত মাকড়সা।
কথাটা বলে তাকিয়ে আছে তরুণী। একদৃষ্টে।
কে না চেনে দুর্ধর্ষ মারিয়াচিকে! বড়লোক বংশের বখে যাওয়া সন্তান। তবে লক্ষ্যহীন তরুণ সে নয়। কিন্তু অ্যাম্বিশন থাকলেও ধৈর্য জিনিসটার ঘাটতি রয়েছে তার মধ্যে। সৎপথ তাই মারিয়াচির ধাতে নেই। পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া সম্পদ নানা রকম ধোঁয়াটে কারবারে বিনিয়োগ করেছে সে। কালো টাকায় ভরেছে নিজের পকেট আর সিন্দুক। লোকটার রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তিও কম নয়।
মারিয়াচির সাথে কখনও মোলাকাত হয়নি জোহানের। সবই শোনা কথা। তবে যা রটে, তা কিছুটা হলেও তো বটে! ছেড়ে আসা লাতিন নগরীর পানশালায় রাই উইস্কির স্বাদ চাখতে গিয়ে দুর্বিনীত যুবকের অনেক ‘সুনাম’ কানে এসেছে ওর।
লোকটা নাকি একবারই গুলি করে, এবং সেটা কখনওই ফসকায় না।
সেই লোক কি এই মেয়ের পিছে লেগেছে? চিন্তার কথা তা হলে!
ব্যাপারটা নিশ্চিত হওয়া দরকার।
‘তুমি… মানে, তোমার সাথে…
‘আজ দুপুরে মারিয়াচির সাথে বিয়ে হতে যাচ্ছিল আমার।’ নিরানন্দ চেহারায় হাসল মেয়েটা।
তার মানে, হার্ডিই ঠিক।
প্রমাদ গুনল জোহান। ব্যাপার গুরুতর! একজনের বাগদত্তাকে ভেগে যেতে সাহায্য করছে সে!
কোনও হবু স্বামীর জন্যে বিষয়টা চূড়ান্ত অপমানের শামিল, যদি সে কাপুরুষ না হয়। আর পাত্র যেখানে মারিয়াচির মত টাফ গাই, সে তো ছেড়ে কথা কইবে না। তার মত লোকেরা পরাজয়কে ঘৃণা করে। যা চায়, তা না পাওয়া পর্যন্ত থামে না।
বিপন্ন বোধ করল জোহান। এ কোন্ বিচ্ছিরি হুজ্জতে জড়িয়ে পড়ল সে!
‘তুমি এই বিয়েতে রাজি নও, ম্যা’ম?’
চিবুক উঁচাল তরুণী বিদ্রোহী শিশুর মত। ‘প্রশ্নই আসে না!’ ঠোঁটের কোণ বেঁকে গেল বিতৃষ্ণায়। ‘গা ঘিনঘিন করে আমার মারিয়াচিকে দেখলে!
‘তোমার বাবা-মা…
‘নেই। ছোটবেলায় মারা গেছে,’ নিরাবেগ স্বরে বলল মেয়েটা। ‘চাচার কাছে মানুষ হয়েছি আমি।’
‘তার কী মত?’
‘পেটে মদ পড়লে হুঁশ থাকে না বুড়োর!’ খেদ ঝরল মেয়েটার কণ্ঠ থেকে। ‘দিনের মধ্যে আঠারো ঘণ্টাই পড়ে থাকে বোতল
নিয়ে। বলতে পারো, মারিয়াচির কাছে আমাকে এক রকম বেচে দিয়েছে চাচা।’
‘প্রতিবাদ করোনি?’
‘করিনি আবার!’ ফুঁসে উঠল যেন সাপিনী। ‘মেয়েলোকের কথার দাম দেয় নাকি কেউ!’
মেয়েটার জন্যে সহমর্মিতা অনুভব করল জোহান।
‘ভেবেছিলাম, আত্মহত্যা করব…’
ভাগ্যিস, করেনি। মস্ত ক্ষতি হয়ে যেত তা হলে পৃথিবীর, জোহান ভাবল।
‘আত্মহত্যা মহা পাপ,’ বলল ও। ‘বাইবেলে কী বলা হয়েছে, শোনোনি?’
‘ওই নচ্ছারটার ঘর করবার চাইতে পাপ করে জাহান্নামে যেতে রাজি আমি!’ রাগত স্বরে বলল সেনিয়োরিটা, ‘তোমরা- পুরুষেরা এসব বুঝবে না!’
কথার জেরে অস্বস্তিকর নীরবতা নামল ওদের মাঝে।
পেছনে কুকুরের কান্নার মত বিকট আওয়াজ শুনে হার্টবিট মিস করল মেয়েটা।
জোহান চমকাল না। হার্ডির হাইয়ের সাথে পরিচিত সে।
মাথার ওপরে তোলা হাত দুটো নামাল ভালুকমানব। ঝাড়া দিল। মট-মট আওয়াজ হলো হাড় ফুটবার।
লোকটার হাসি দুই কানের লতি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে আছে। অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে একবার বস, একবার মেয়েটার দিকে তাকাল। ঘোষণা করবার সুরে বলল, ‘সকাল হয়ে গেছে!’ যেন এখনও ওরা সেটা জানে না।
‘ঘুম হয়ে গেল?’ হার্ডিকে জিজ্ঞেস করল জোহান।
‘ঘুমাইনি তো, বস!’ পট-পট করে হাতের আঙুল ফোটাচ্ছে ভালুক। ‘চেষ্টা করেছি। লাভ হয়নি। মেহমানের কথা মনে হচ্ছিল কেবল।’ মেয়েটার দিকে চেয়ে চোখ নাচাল। ‘বিছানায় এপাশ- ওপাশ করতে করতে পিঠ ব্যথা হয়ে গেছে।
‘হার্ডি রোভার। আমার ডান হাত,’ পরিচয় করিয়ে দিল জোহান।
বুকের ওপরে একটা হাত রেখে নড করল বিশালদেহী মানব। বাইরের লোকের কাছে সম্মান দিয়েছে বলে জোহানের প্রতি কৃতার্থ বোধ করছে সে।
‘সুপ্রভাত, সেনিয়োর রোভার।’
‘শুধু হার্ডি,’ শুধরে দিল বিশালদেহী। ‘ওসব সেনিয়োর- টেনিয়োর বসের জন্য আলাদা করে রাখো, ম্যাডাম। আমি কামলা শ্রেণীর মানুষ।’
ঘুরে কয়েক পা এগিয়ে কাজে ব্যস্ত হলো সে।
‘হার্ডি সব সময়ই এরকম চাঁছা-ছোলা।’ ক্ষীণ বিব্রত বোধ করছে জোহান। ‘তুমি কিছু মনে কোরো না, ম্যা’ম। মানুষটা সে ভালই।’
বখাটে বাতাস এলোমেলো করে দিচ্ছে চুলগুলো। সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে মেয়েটা।
‘আমি একটা বোকা।’
‘উঁ?’ বুঝতে পারল না জোহান, হঠাৎ করে নিজেকে চারিত্রিক সার্টিফিকেট দেবার প্রয়োজন পড়ল কী জন্যে মেয়েটার।
বোঝা গেল পরের কথায়।
‘নিজের পরিচয়টা পর্যন্ত দিইনি এখনও…
‘এখন দাও।’
‘আমি এলেনা মনটেরো।
‘জোহান মিলফোর্ড।’ হাত বাড়িয়ে দিল জোহান।
হাতটা ধরল এলেনা।
জোহান পুলকিত হলো।
ছোট্ট হাত। পেলব। শীতল।
‘আমি দুঃখিত, সেনিয়োর মিলফোর্ড।’
আবার কী হলো? কী এমন ঘটল, যার জন্যে সরি বলা লাগল ওর?
‘দুঃখটা কী জন্য, ম্যা’ম?’
‘এই যে… সিন্দাবাদের ভূতের মতন তোমার ঘাড়ে চেপে বসলাম!’
আচ্ছা, এই কথা!
‘তুমি যে আত্মহত্যা করোনি, তাতেই আমি খুশি।’ জোহান এখন নিজের কাছে পরিষ্কার। সমস্ত দ্বিধা দূর হয়ে গেছে তার মন থেকে। ‘তোমার অ্যাটিচুড পছন্দ হয়েছে আমার। স্বাধীনচেতা নারীদের আমি পছন্দ করি।’
শেষ মন্তব্যটা ছুরির মত বিঁধল এলেনাকে। এত ভাল লাগল কেন কথাটা?
জোহানের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল সে। মনে হলো, হারিয়ে যাবে। যুবকের চোখের মণি দুটো যেন দুই টুকরো স্যাফায়ার। ঝলমল করছে।
বুঝতে শিখবার পর থেকেই পরপুরুষের চোখে লালসা দেখে এসেছে এলেনা। অভিভাবক একজন থাকলেও নিজেকে ওর অরক্ষিত মনে হয়েছে সব সময়। কিন্তু জোহান মিলফোর্ডের চোখে কামনা নেই। শুধু কৌতূহল।
‘ধন্যবাদ তোমাকে, সেনিয়োর মিলফোর্ড।’ এলেনার চোখ- জোড়া কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল। ‘কথাগুলো বলতে পেরে হালকা লাগছে নিজেকে।’
হেসে ওপরে তাকাল জোহান- মাস্তুলের মাথায়।
দুই মাস্তুলের বড়টাতে লাগানো রয়েছে একটা মাচামত। ক্রো’জ নেস্ট। ওখানে উঠে বসে বহুদূরে চোখ রাখা যায়।
হার্ডি উঠেছে গিয়ে ‘কাকের বাসা’য়। কপালে তার চিন্তার রেখা।
বেশ ফরসা হয়ে গেছে চারপাশ।
কুয়াশা পুরোপুরি না কাটলেও হার্ডির শ্যেনদৃষ্টিতে জাহাজটা ঠিকই ধরা পড়েছে।
চটপট হিসেব বের করে ফেলল তার অভিজ্ঞ মগজ। দশ কি বারো মাইল দূরে রয়েছে ওটা।
জলমানবীর পিছু নেয়নি তো?
গড নোজ!