পঁচিশ
জমিতে অজস্র ভাংচুর। প্রভাতী সূর্য লম্বা ছায়া সৃষ্টি করেছে তার ওপরে।
পুরানো দুশ্চিন্তার সাথে নতুন দুর্ভাবনা বয়ে নিয়ে চলেছে জোহান। ক্ষণে ক্ষণে পেছনে তাকাচ্ছে। মেকসিকানের বক্তব্যের স্বপক্ষে যায়, এমন কিছু খুঁজে ফিরছে তার চোখ।
সেরকম কিছুই অবশ্য চোখে পড়ল না। পড়বার কথাও নয়। বন্ধুর পথে এক শ’ গজের বেশি দৃষ্টি চলে না।
জোহানের মন বিক্ষিপ্ত। আলভারো কি সত্যি কিছু দেখেছে? নাকি এটা তার ইনস্টিঙ্কট? সহজাত প্রবৃত্তি। যে ক্ষমতার বলে অনেক কিছু আঁচ করে ফেলা যায়। কারও-কারও থাকে বটে এই অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা। জীবনে যাদের অভিজ্ঞতা প্রচুর।
সকাল গড়াল।
মাঝদুপুরেও অব্যাহত রইল যাত্রা। সবিরাম।
এই একঘেয়েমির মধ্যে একটা ঘটনা বিনোদনের খোরাক জোগাল।
দেখা গেল, এক ট্যারানটুলা আর নীল বোলতার মাঝে হাঙ্গামা বেধে গেছে পথের ওপরে। শেষ পর্যন্ত হুল ফুটিয়ে মাকড়সাকে অজ্ঞান করে ফেলল বোলতা। একটা খোঁদলের কাছে টেনে নিয়ে গেল শত্রুকে। ডিম পাড়ল তার গায়ে। ডিম ফুটে বাচ্চাগুলো যখন বেরোবে, ওই আটপেয়ে বেচারাকে খেয়েই বড় হবে তারা। জন্মের আগেই ছানাপোনাদের খাবারের ব্যবস্থা করে দিল মা।
বিকেলের সমাপ্তিতে দৃষ্টিপথ থেকে সব রশ্মি উঠিয়ে নিল সূর্য। পাহাড়ের আঁচলে মুখ লুকাল।
আলভারো বলল, ‘শুধু খাবার বিরতি। আজ রাতে ঘুমানো চলবে না।’
মুখের ওপর থেকে একগাছি চুল সরাল এলেনা। ক্যালিকো ড্রেসের হাতায় কপালের স্বেদ মুছল। চোখে অনীহা। তবে কোনও প্রশ্ন করল না। চেহারায় দৃঢ়তা ধরে রাখতে সচেষ্ট 1
অভিনয়টা বুঝতে পারল জোহান। অস্বস্তি লাগল। কিন্তু কী করবে? আলভারোর সিদ্ধান্তের পিঠে কিছু বলতে বাধছে।
বিশ্রান্তি ওদের দরকার। বিশেষ করে, মেয়েদের। সে নিজেই যেখানে অসম্ভব পরিশ্রান্ত, সেখানে ওদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়।
ওর মায়ের ধাত জানা আছে জোহানের। মুখ বুজে সইবে, তবু টু-শব্দটি করবে না। কিন্তু কষ্ট যে হচ্ছে, এটা বুঝতে মন পড়বার বিদ্যা জানা লাগে না।
বুড়ো মেক্সের জীবনীশক্তি অবাক করবার মত। কোথায় জানি ন শুনেছে, রুশ দেশের দক্ষিণ অঞ্চলে, ককেসাস পর্বতের উপজাতীয় লোকেরা এক শ’ বছর বয়সেও বেশ শক্তপোক্ত থাকে। ঘোড়ায় চড়ে লড়াই করে।
আলভারো বলল, কেন সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে।
জোহান ছাড়া বাকি সবাই জানল, এই স্বর্ণযাত্রায় তারা একা নয়। জেনে দুশ্চিন্তান্বিত হলো।
এটাও বলল মেকসিকান, পশ্চাদ্ধাবনকারীরা হয়তো জানে না, তাদের উপস্থিতি ফাঁস হয়ে গেছে।
খোশমেজাজি ফুলার ভাবনাক্লিষ্ট মুখে দাড়ি ঘষতে লাগল।
পেছনে, রিজের মাথায় নড়াচড়ার আভাস পেয়েছিল সে একবার। সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠেছিল তার মন। কী নড়ছিল, তা বলতে পারবে না। বহুদূরে ছিল সেটা।
ঘোড়া হতে পারে।
অথবা মানুষ।
আবার প্রাকৃতিক কোনও কারণেও হতে পারে।
হলফ করে বলা সম্ভব নয়।
চলবার ফাঁকে নিরীক্ষা করেছে চূড়াটা স্যাম ফুলার। তেমন কিছু দেখা যায়নি। তবে যদ্দূর গেছে, তা-ই যথেষ্ট।
ও দেখল, কোনও রকম জানান না দিয়ে আচমকা উড়ে চলে গেল একটা পাখি।
কিছু একটা দেখে ভয় পেয়েছে ওটা।
আর ‘কিছু একটা’ মানে, অনেক কিছুই হতে পারে।
হয়তো সাপ।
সাগুয়্যারো ক্যাকটাসের দুটো ডালের ভাঁজে বাসা বানায় পাখি। ব্ল্যাক রেসার সাপ কদাচিৎ হানা দেয় তাদের সুখের নীড়ে।
হয়তো পেঁচা।
প্রেমিক পাখি গিল্ডেড ফ্লিকারদের ভালবাসার বাসস্থান থেকে উৎখাত করে ভাবুক চেহারার এই নিশাচর। একবারও ভাবতে চায় না, বাড়িঅলার কী পরিণতি হবে।
হয়তো বেজি।
নয়তো…
খারাপটার জন্যে রেডি থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।
সন্দেহের কথাটা এই বেলা জানিয়ে রাখা দরকার মনে করল স্যাম ফুলার।
শুনে সবার ভারাক্রান্ত মুখ আরও একটু থমথমে হয়ে উঠল।
আলভারো খোলসা করল, সে কী করে টের পেল। কাচ বা ধাতব কিছুতে প্রতিফলিত রোদ দেখে। নির্ঘাত বিনকিউলার।
নিজেকে লাথি মারতে মন চাইছে জোহানের। তারটা কেন সে আনল না!
চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। এখন আফসোস করে কী হবে?
ফালি করে কাটা বেকন ভাজার সুবাস ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে। পেটের ভেতরে ছুঁচোর কেত্তন। বেকন সহযোগে টরটিয়া দিয়ে ওরা উদরপূর্তি করল।
পটপট শব্দ করে পুড়ছে পাইনের ডাল। ফুলকি উড়ছে। বাতাসে ঝাঁজাল গন্ধ।
আগুন নেভাতে যাচ্ছে, জোহানকে মেকসিকান বারণ করল। লাকড়ি যোগ করতে বলল আরও।
তার অভিপ্রায় জলবৎ তরলং। ‘ওদেরকে ফাঁকি দেব। আগুন
দেখে অনুসরণ করবার কথা ভাববে না লোকগুলো। চামে বহুদূর চলে যাব আমরা।’
ছাব্বিশ
আগের রাতে যেখানে আগুন জ্বলতে দেখেছিল, লোকগুলো সেখানে পৌঁছে গেছে।
এখন অবশ্য আগুন জ্বলছে না। রাতেরই কোনও একসময় নিভে গেছে।
আশপাশে কয়েকবার চক্কর দিল ঘোড়াগুলো। ফিরে এল আবার ছাইয়ের স্তূপের কাছে।
‘ঘটনা কিছু বুঝতে পারছ, মারিয়াচি?’ যেন ষড়যন্ত্র করছে, এমন ভঙ্গিতে বলল ম্যানুয়েল আরবো। তার অবশ্য দরকার ছিল না।
হাতির শুঁড়ের মত বাঁকানো মোছ আর ত্রিভুজাকৃতির শ্মশ্রু নড়ে উঠল। ‘পরিষ্কার।
‘ধোঁকা দিয়েছে!’ ম্যানুয়েল আরবোর চাপা স্বরে ক্ষোভ ফুটল।
হোঁতকা এক লোক বলে উঠল, ‘চলো, মারিয়াচি। এখান থেকে চলে যাই।’
লোকটার মেদবহুল গলার ঝুলন্ত মাংসে ভাঁজ পড়েছে কয়েকটা। পেটটা কোমরবন্ধের ওপর দিয়ে সামনের দিকে বের হয়ে এসেছে হাত খানেক। নীল শার্টটা গ্যালিসের বন্ধনে বাঁধা।
দরদর করে অবিরল ধারায় ঘামছে সে। মুখটা লাল হয়ে আছে। বগলের কাছে বিশ্রী হলদেটে দাগ পড়েছে ঘামের।
মারিয়াচি তার দিকে এমন ঠাণ্ডা চোখে তাকাল যে, কথাটা বলবার জন্যে পস্তাতে শুরু করল আলবার্তো স্যান জুয়ান। প্রসঙ্গ ঘোরাবার জন্যে তড়িঘড়ি করে তাকাল জিল ট্যাটামের দিকে।
‘সেনিয়োর ট্যাটাম,’ হ্যাট খুলে নিজেকে বাতাস করল মোটু। সামনের দিকে চাঁদি খালি হতে শুরু করেছে তার। ‘এই অঞ্চলের বিপদ-আপদ সম্বন্ধে একটু বলবে?’
মারিয়াচির দিকে তাকাল জিল ট্যাটাম। কর্ডরয় জ্যাকেট আর সুতী ট্রাউজার পরা স্প্যানিয়ার্ডের ঘোড়াটা প্যালোমিনো জাতের। সোনালী গায়ের রং। ধূলিমলিন হলেও ওটার কাছে ওর মেয়ারটাকে একদম ফকিরা লাগছে।
সুটের ভেতরে হাত ঢোকাল ট্যাটাম। ভেস্টের পকেট থেকে সিগার বের করল। নখের ওপরে ঠুকে ঠোঁটে তুলল সেটা।
‘শত্রুর শত্রু বন্ধু’ – বহুল প্রচলিত এই সূত্রের কারণে মারিয়াচির সাথে গাঁটছড়া বাঁধেনি সে। সাক্ষাতেই বুঝেছে, তারা দু’জন এক ছাঁচের মানুষ নয়। অনভিপ্রেত ঢেঁকিটা গিলতে হয়েছে মাইকেল ডগলাসের উপরোধে।
গভর্নরের পুরানো বন্ধু এই স্প্যানিশ তরুণ। তাকে সব রকমের সহায়তা করবার নির্দেশ দিয়েছে ডগলাস। এই নির্দেশ অগ্রাহ্য করবার ক্ষমতা নেই তার। করতে সে চায়ও না। লোকটাকে হাতে রাখতে পারলে নিকট-ভবিষ্যতে পলিটিশিয়ান হওয়া তার জন্যে সহজ হয়ে যাবে। মন্দের ভাল এ-ই, অন্য আরও হিসেব রয়েছে তার।
লাতিন যুবক কি সোনার ব্যাপারটা জানে? মনে হয় না। সে- ও মিলফোর্ডের পিছু নিয়েছে, এটা জেনেই সন্তুষ্ট।
ওই পাওনা টাকা কিছুই নয় সোনার কাছে।
জেরার্ড মিলফোর্ড সম্পর্কে যেসব কানাঘুষো শোনা যায়, সোনার সন্ধান পাওয়া তার মধ্যে একটা। কেউ বিশ্বাস করুক বা না করুক, সে এই ‘গল্প’ বিশ্বাস করে। আর সেই বিশ্বাসে লক্ষ্যস্থির করেই না মিলফোর্ড ফ্যামিলির পশ্চাদ্ধাবন করছে সে। যদ্দূর বুঝেছে, সোনাই এখন মিলফোর্ড পরিবারের তুরুপের শেষ তাস।
মিসেস মিলফোর্ডকে ডেডলাইন দেবার পর সবার একসাথে শহরে না ফেরাটা একটা ভাল কাজ হয়েছে। সে আর চিন শহরের ট্রেইল ধরেছে। ক্রিস আর শর্টি উঠে গেছে অধিত্যকায়। রানশের ওপরে নজর রাখবার জন্যে। মিলফোর্ডের গুষ্টি পগার পার হতে পারে, এই অনুমান মিথ্যে হয়নি তার।
মনে মনে চালিয়াতি হাসি হাসল চতুর ট্যাটাম। সেরের ওপরে সোয়া সের থাকে। ওরা বোধ হয় ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেনি।
জোহান মিলফোর্ডকে রানশে দেখেই শহরের উদ্দেশে ঘোড়া ছুটিয়েছে শর্টি। তাকে নিয়ে রওনা হতে যাবে, এমন সময় ঘাড়ে এসে চাপল মারিয়াচি। গভর্নরের মেসেজ নিয়ে এসেছে সে।
ওয়েস্টকোটের পকেট থেকে একটা গিলটি করা ঘড়ি বের করে সময় দেখল জিল ট্যাটাম। ইচ্ছে করেই সময়ক্ষেপণ করছে। ঘড়িটা আবার পকেটে ঢুকিয়ে কষে টান দিল চুরুটে। ধোঁয়া ছাড়ল একমুখ। ‘বিপদ তেমন কিছু নয়… বুনো জানোয়ার-টানোয়ার আছে… র্যাটলার …..
‘অ্যাপাচি?’ নিশ্চিন্ত হতে চাইল আলবার্তো। হাতের নোংরা রুমালটা মুখে ও ঘাড়ে বোলাল।
‘নাহ, এদিকে রেইড করে না ওরা।’
আলবার্তো হাঁপ ছাড়ল। রেডস্কিনদের তার বেজায় ভয়।
‘তবে অন্য সমস্যা আছে…’
স্থির চাউনি তুলে তাকাল মারিয়াচি। সমস্যা যেটাই হোক, পরোয়া করে না সে।
আলবার্তোর ঘন কালো ভুরু জোড়া কুঞ্চিত হয়ে আছে। ‘কী সমস্যা?’
‘ওরা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। ধরতে পারব কি না…’
‘এটা কোনও সমস্যাই নয়,’ থেমে থেমে, কিন্তু প্রতিটা শব্দ জোর দিয়ে বলল মারিয়াচি। কী বলো, ম্যানুয়েল?’
হ্যাট ছুঁয়ে আশ্বাস দিল ওস্তাদ ট্র্যাকার। নিজের সক্ষমতার ওপরে আস্থা রয়েছে তার।
কিন্তু আরও এক ডিগ্রি বাড়ল আলবার্তোর হতাশা। কোথায় সে ছিল, আর কোথায় এসে পড়েছে! সাগরতীরের মানুষ সে। এখানে সমুদ্রের নোনা বাতাস নেই। ডকইয়ার্ডের কলরব নেই। মাছের আঁষটে গন্ধ নেই। নেই সার্বক্ষণিক কর্মব্যস্ততা কিংবা হাসি-আনন্দে মুখর পরিবেশ। আছে কেবল পাহাড় আর পাহাড়। আর অন্তবিহীন অনিশ্চয়তা।
এই ক্লান্তিকর যাত্রার যেন আর শেষ নেই।
তিতিবিরক্ত হয়ে গেছে সে। এখানকার ধুলোবালি আর ভয়াবহ উত্তাপ তার সহ্য হচ্ছে না। মধ্যদুপুরের তাপতরঙ্গকে মনে হয় যেন শয়তানের নাচ। এর চাইতে সাগরতীরের ধোঁয়াশা মাখা মেঘলা দিনগুলো অনেক ভাল ছিল।
ভাল খাওয়া পেটে পড়েনি কয়েকদিন। আজেবাজে জিনিস দিয়ে পেট ভরাতে হয়েছে। শোওয়া-ঘুমাবারও কোনও ঠিক নেই। অজায়গা-কুজায়গায় রাত কাটাতে হচ্ছে খোলা আকাশের তলায়।
গ্রিঙ্গোগুলোকেও তার একটুও পছন্দ হয়নি। ইতর স্বভাবের। অহঙ্কারী। কথায়-কথায় হামবড়া ভাব প্রকাশ পাচ্ছে। খালি অন্যের চাইতে নিজেদের শ্রেয়তর প্রমাণের চেষ্টা। তিক্ত লাগছে তার এদের সংসর্গ।
নিদারুণ বিষণ্ণতা কুরে কুরে খাচ্ছে আলবার্তোকে। সর্বক্ষণ। নিঃসঙ্গত্ব যেন দুর্ভেদ্য পাঁচিল তৈরি করে ঘিরে রেখেছে তাকে।
ওপর দিকে চাইল সে।
গত দুইদিন লাগাতার রোদ বর্ষণ করে আজকের দিনটা নেতিয়ে পড়েছে যেন। ঈশান কোণ থেকে এসে জড়ো হয়েছে ধূসর মেঘের মিছিল। নিচু হতে হতে ছুঁয়ে ফেলেছে পর্বতশৃঙ্গ। রোদ আসবার সব ফাঁকফোকর বন্ধ। মেঘের ছায়া গোটা গিরিবাকে মুড়ে রেখেছে কাফনের কাপড়ের মত। আধিভৌতিক একটা আবহ গিরিসঙ্কট জুড়ে। কে জানে, এটা আশীর্বাদ, না অভিশাপের ইশারা?
‘ভ্যামোস!’ কোনও কারণ ছাড়াই বিস্ফোরিত হলো মারিয়াচি।
লাইন ধরে চলতে শুরু করল ওরা। ম্যানুয়েল আরবো দলনেতা। আগে রয়েছে।
তার পেছনে মারিয়াচি।
মারিয়াচির পেছনে জিল ট্যাটাম।
এরপর চিন মুয়েলার।
তারপর আলবার্তো।
টাকার। শটি।
ক্রমান্বয়ে।
সামনের দুই পায়ের ওপরে থুতনি রেখে বসে ছিল জীবটা। নিঃসঙ্গ এক নেকড়ে। পাহাড়ের উঁচু একটা তাক থেকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে নিরিখ করছিল লোকগুলোর কার্যকলাপ। সোজা হয়ে দাঁড়াল। চেয়ে থাকল দলটার গমনপথের দিকে।
সাতাশ
মধ্যাহ্নের প্রাক্কালে জোহানদের দলটা এসে হাজির হলো একটা অগভীর ক্রিকের কাছে।
জায়গাটা লালচে ধুলোয় আবৃত। লাল জমিন কদাচ জায়গা ছেড়ে দিয়েছে পিঙ্গল ঘাসকে। এই ক্যাটক্যাটে রঙের মাঝে মনোরম নীল এই খাঁড়ি বছরের অধিকাংশ সময় শুকনোই থাকে।
এই মুহূর্তে অবশ্য পানির রং নীল নয়, ধূসর। একটা নীল বক এক ঠ্যাঙে দাঁড়িয়ে আছে ক্রিকের মাঝখানটাতে। অসতর্ক কোনও ব্যাং কিংবা মাছের আশায়।
এক জায়গায় জঙ্গলমত। গাছের পাতারা কানাকানি করছে।
সাঁৎ করে কী জানি সরে গেল গাছের আড়ালে। বিগহর্নই হবে।
বাম দিকের মেসাটার ওপরে দৃষ্টি ফেলল জোহান।
টেবলল্যাণ্ডের ঢালু অংশে স্কুস আর জুনিপারের জটলা। ন্যাংটো শাখাগুলো রাইফেলের ব্যারেলের মত ছাইরঙা আকাশ আর অনাবৃত ক্লিফের দিকে তাক করা। ঢাল যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে শুরু হয়েছে বার্চের বিশৃঙ্খল সমাবেশ। একটা পায়ে চলা পথ- জন্তু-জানোয়ারেরই হবে- বার্চ বনের ভেতরে ঢুকে গেছে।
কত ওপরে রয়েছে তারা মাটি থেকে? তিন হাজার ফুট? চার হাজার?
নীরবতার নেকাব দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে যেন জায়গাটা। একটা পাখিও ডাকছে না। কেবল আপন মনে- বোধ হয় আকাশজোড়া মেঘের সাথে কথা বলছে ক্রিকের পানি। নীরবতার মাঝেও সেটাকে আলাদা কোনও শব্দ বলে মনে হচ্ছে না। বরঞ্চ এটাও যেন নীরবতারই অংশ।
জলাশয়ের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে হাত-মুখ ধুচ্ছে রোজমেরি মিলফোর্ড।
ভিজে একটা ন্যাকড়া দিয়ে মুখ মুছছে এলেনা।
হাঁটু-পানিতে নেমে গেছে চতুষ্পদগুলো। নাক ডুবিয়ে পানি খাচ্ছে।
ওদের সাথে ভিড়ে গেল জোহান। ধুলোর আস্তর জমেছে শরীর এবং কাপড়ে। ঝাড়া দিয়ে জামাকাপড় যতটা সম্ভব, পরিষ্কার করে নিল।
‘সেনিয়োর মিলফোর্ড,’ ন্যাকড়াটা পানিতে ভেজাতে ভেজাতে শুধাল এলেনা, ‘এটাই কি সেই জায়গা?’
‘না মনে হয়।’ দুই হাত পানিতে চুবিয়ে পরিষ্কার করছে জোহান। ‘তবে আর বেশি দূরে নেই বলেই ধারণা।’ চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দিল সে।
‘সেনিয়োর আলভারোকে জিজ্ঞেস করলেই হয়।’ কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে চোখ বোলাল মিসেস মিলফোর্ড। ‘কোথায় সে?’
পেছনে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না জোহান। না আলভারো। না স্যাম ফুলার।
ঘোড়া রেখে লাপাত্তা হয়ে গেছে দুই বুড়ো।
ডান হাতটা কপালের ওপরে রেখে চিবুক পর্যন্ত নামিয়ে আনল, জোহান। মুখের ওপর থেকে পানির কণাগুলো সরিয়ে ঝাড়া দিল হাত। সোজা হলো। হাতটা বাড়িয়ে দিল মায়ের দিকে
ছেলের হাত ধরল রোজমেরি।
তাকে সিধে হতে সাহায্য করল জোহান।
কিন্তু মায়ের সামনে মিস মনটেরোর হাত ধরতে বাধো বাধো ঠেকল তার।
বুঝতে পেরে মুচকি হাসল মেরি।
এলেনা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘যাবে আর কোথায়! আশপাশে কোথাও আছে।’
বিধ্বস্ত লাগছে তাকে। যাত্রাপথের ধকলের ছাপ পড়েছে চেহারাতে। চুলে জট। কুটো লেগে আছে।
‘এ জায়গাটার কোনও নাম আছে, জো?’ উৎসুক গলায় জানতে চাইল মিসেস মিলফোর্ড
এক কাঁধ উঁচিয়ে শ্রাগ করল জোহান। ‘সেনিয়োর আলভারো জানতে পারে। তবে যদ্দূর জানি, মা, এসব জায়গা ম্যাপে দেখানো হয়নি। নাম যদি থেকেই থাকে, সেটা সেনিয়োর আলভারোর নিজের দেয়া নাম খুব সম্ভব। যেমন, এই ক্রিকটা… এটার নাম সে হয়তো দিয়েছে- ‘নীল সরোবর’।
‘“সোনালী ঝরনা”র মতন?’ এলেনার বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন।
‘এগজ্যাক্টলি।’
মিসেস মিলফোর্ডের মন্তব্য, ‘ও একটা ম্যাপ বানিয়ে নিলেই পারত।’
‘সেটা মনে হয় চায় না সে।’
‘কেন? গোপন রাখবার স্বার্থে?’
‘সেরকমই মনে হচ্ছে, মা। এই জায়গা চিনত বাবা। সে এখন নেই। সেনিয়োর আলভারো চেনে। সে ছাড়া আর কেউ হয়তো জানে না এই এলাকার হদিস। সে মারা গেলে সব শেষ। অনেক বছর পরে আবার হয়তো কেউ আসবে এখানে। তার তো সেনিয়োর আলভারোর দেয়া নাম জানা নেই। সে একটা নতুন নাম দিল। ম্যাপও বানাতে পারে। তখন হয়তো সেই নামটাই স্থায়ী হবে। সেনিয়োর আলভারোর রাখা নাম হারিয়ে যাবে।’
কেন জানি অকারণেই মনটা খারাপ হয়ে গেল মেরির এ কথা শুনে। মানুষের জীবনটা আসলে কী!
একটা বাঁকের ওপাশ থেকে আত্মপ্রকাশ করল স্যাম ফুলার। মুহূর্ত পরে মেকসিকান। হারানো রতন খুঁজে পাবার হাসি তার মুখে। কাছে এসে বলল, ‘তোমাদের একটা জিনিস দেখাই।’
পাহাড়ের দেয়ালে সৃষ্ট একটা আচ্ছাদনের তলায় নিয়ে এল ওদের আলভারো।
করোটির মত দেখতে দশাসই একটা পাথর ছাউনির সমান্তরাল প্রাচীরে হেলান দিয়ে আছে। সেটার ওপরে কাঠকয়লা দিয়ে আঁকা একটা ছবি। উড়ন্ত অবস্থা থেকে মাটিতে এসে বসছে একটা ঈগল। দুই পাখা দুইদিকে ছড়ানো। নিপুণ শিল্পীর কাজ।
মেকসিকান হাসছে। ‘কার আঁকা, বলো তো!’
‘ইনডিয়ান?’ আলভারোকেই প্রশ্ন করল এলেনা।
মাথা ডান-বাঁ করল বুড়ো। ‘জেরির।’
ছ্যাত করে উঠল রোজমেরির বুক। অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ছবিটার দিকে। মহিলার বাম হাতটা খুঁজে নিল ছেলের হাত।
হাতে চাপ অনুভব করল জোহান।
‘মনে হচ্ছে, গতকাল এঁকেছে কেউ!’ প্রায় না ফোটা স্বরে বলল এলেনা।
আসলেও তা-ই। বৃষ্টি আর রোদের মুখ দেখেনি বলে তেমনই রয়ে গেছে ঈগলটা। অতন্দ্র প্রহরী যেন।
পাখিটার গায়ে হাত রাখল মেরি। বোলাতে লাগল। যেন আদর করছে। ফ্যাসফেঁসে গলায় বলল, ‘জেরি! জেরি!’
মহাকালের গহন হৃদয় মন্থন করে উঠে এল দীর্ঘশ্বাস- বয়ে গেল বিবাগী বাতাস।
আটাশ
লম্বা একটা গাছের ডাল দিয়ে ধুলোর গায়ে আঁকিবুকি কাটছে আলভারো। মুখ তুলে বলল, ‘রওনা হওয়া দরকার।’
উঠে দাঁড়িয়ে প্যান্টের পেছন দিকটা ঝাড়তে লাগল জোহান।
‘বসো একটু,’ বলল মেকসিকান, ‘কথা আছে।’
বলবার আগে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে নিল সে। ‘এরপর জঙ্গলে ঢুকব আমরা।’
বনটার দিকে না তাকিয়ে পারল না এলেনা। ওখানে কি কোনও আপদ-বিপদ অপেক্ষা করছে ওদের জন্যে? না হলে এটা বলবার জন্যে বসতে বলল কেন আলভারো? নাকি অন্য কোনও ব্যাপার?
আরও কিছু শুনবার আশায় মেকসিকানের মুখের দিকে চাইল সে।
‘তুমি যাচ্ছ না, ইয়াং ম্যান।’ হাতের ডালটা জোহানের দিকে উঁচিয়ে ধরল আলভারো।
সোজা হয়ে গেল জোহানের মেরুদণ্ড। ‘জী?’
‘আর তুমি।’ ডালটা দিয়ে এবার এলেনাকে দেখাল মেকসিকান। ‘তোমরা দু’জন এখানেই থাকছ।’
‘কেন, সেনিয়োর?’ আলভারোর কথার মাথামুণ্ড কিছু বুঝতে পারছে না জোহান।
‘দুটো কারণ আছে, বৎস।’
‘কারণগুলো বলবে?’
মাথা ঝাঁকাল মেকসিকান। ‘আমি চাই না যে, আসল জায়গা পর্যন্ত লোকগুলো আমাদের পিছু নিক। কিছুটা সময় যদিও নষ্ট করিয়ে দিয়েছি আমরা ওদের, কিন্তু মনে হচ্ছে না যে, এতে কোনও লাভ হবে। দক্ষ ট্র্যাকার ছাড়া এরকম একটা অভিযানে বেরোয় না কেউ। বুঝতে পারছ, কী বলছি?’
‘কিন্তু আমরা থেকেই বা কী করব, সেনিয়োর?’ প্রশ্ন করল এলেনা।
তার দিকে তাকিয়ে হাসল আলভারো। ‘ওদের মোকাবিলা করবে। তোমার কথা বলছি না। তবুও তোমাকে থাকতে হবে। কারণটা তোমার বুঝবার কথা।’
‘মারিয়াচি?’
‘মারিয়াচি। সে তোমার জন্য পৃথিবীর শেষ কিনারা পর্যন্ত যাবে। এই ঝুঁকি নিতে পারি না আমি।’
এলেনার মুখটা নত হয়ে এল।
‘মিসেস মিলফোর্ড যাবে আমার সাথে,’ জোহানের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল আলভারো। স্যাম ফুলারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমিও যাবে।’
‘আমি না হয় থাকি,’ স্যাম ফুলার প্রস্তাব করল। ‘একা ও কয়জনকে সামলাবে?’
‘তোমাকে সাথে নেবার কারণ আছে, দোস্ত।’ দাঁত বের করে হাসল মেকসিকান। ‘খোঁড়াখুঁড়ি করা লাগতে পারে। আমি পারব না। শরীরে কুলাবে না।’
‘কিন্তু ওর যদি কিছু হয়!’ ভীতি চাপা দিতে পারল না রোজমেরি। আলভারোর কথা শুনে ভয় ধরে গেছে তার।
‘কিছু যাতে না হয়; সেই প্রার্থনা করো,’ বলল আলভারো, ‘দেখো, সেনিয়োরা, ওদের সাথে তোমাদের বোঝাপড়া করতেই হবে। না হয় একটু আগেই করলে। ফয়সালা হয়ে যাওয়া সব দিক থেকে ভাল না? তা ছাড়া মনে হয় না, সোনার হদিস না পাওয়াতক ওরা আমাদের অনিষ্ট করবে।’
অকাট্য যুক্তি। জোহানের মন তবু খুঁতখুঁত করছে। একসাথে থাকলেই বুঝি ভাল হত। তর্ক করতে পারত, কিন্তু আলভারো তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই হাঁটবে বুঝে কথা বাড়াল না। মিসেস মিলফোর্ডকে অভয় দিল, ‘চিন্তা কোরো না, মা। আমার কিছু হবে না।’
‘শুধু নিজেকে নয়, ওকেও দেখতে হবে তোর,’ রোজমেরি যেন আদেশই করল ছেলেকে।
হতবিহ্বল দৃষ্টিতে মহিলার দিকে তাকাল এলেনা। এই একটা কথায় গ্লানিবোধ দূর হয়ে গেল তার মন থেকে। নিজের মরা মায়ের কথা মনে পড়ল।
‘দেখব, মা,’ প্রত্যয় প্রকাশ পেল জোহানের কণ্ঠস্বরে।
এলেনার কাছে এই আশ্বাসটুকুর অনেক দাম। ব্যাখ্যাতীত একটা নিরাপত্তাবোধ জাগল ওর মনে।
জোহান আলভারোর দিকে তাকায়। ‘কখন ফিরছ, সেনিয়োর?
‘আগামীকাল। সকাল অথবা দুপুর নাগাদ।’
আলভারোর নীল নকশা কারোরই মনঃপূত হয়নি। তবে তার বিচক্ষণতার ওপর দিয়ে সমালোচনা করবার মত অশ্রদ্ধা প্রকাশ করল না কেউ।
‘চলো, হে!’ বলে উঠে দাঁড়াল মেকসিকান। ‘যাওয়া যাক।’
ছেলেকে আলিঙ্গন করল রোজমেরি। তারপর এলেনাকে।
‘সাবধানে থেকো!’ সস্নেহ উদ্বেগ ঝরে পড়ল তার কণ্ঠ থেকে।
ওরা অন্তর্হিত হলো।
দুপুর ফুরাল। বিকেল হলো। ডুবন্ত রবির রক্তরাঙা আলোয় স্নাত হলো মালভূমি। গাঢ় হয়ে এল গোধূলির ছায়া। পাহাড়সারির ওপর থেকে জাফরানি আভা বিদায় নিল। ঘন হয়ে উঠল মধুর এক তমসা।
এমন পরিবেশে মনের মাঝে কেমন করে উঠবে না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন।
কঠিন। মাদার নেচার অতি বড় বাস্তববাদীকেও দার্শনিক বানিয়ে দেয়। জাগতিক সুখ-শান্তি, ইত্যাকার বিষয়গুলো তখন হাস্যকর, অনর্থক মনে হয়।
মাথায় দুশ্চিন্তার বোঝা না থাকলে নিসর্গের এই মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য তন্ময় হয়ে অবলোকন করত জোহান। ছেলেবেলা থেকেই সে আলো-আঁধারি আর নৈঃশব্দের পূজারি।
টুকটাক বাক্য বিনিময় ছাড়া মৌনতা বিরাজ করছে ওদের মাঝে। পরিবেশটা এমন, কথা বলতে অস্বস্তি লাগে।
একটু পর-পর বাঁকাচোরা বনের দিকে তাকাচ্ছে এলেনা। তার মনে হচ্ছে, কারা জানি ওত পেতে আছে অন্ধকারে। হামলে পড়ল বলে।
আচম্বিতে জোহানের বাহু খামচে ধরল সে।
মিশমিশে অন্ধকারে দুটো আলোর বিন্দু। পাশাপাশি। টকটকে লাল। তামস ভেদ করে জ্বলে উঠল আরও দুটো। বেশ নীচের দিকে।
কোনও জানোয়ারের চোখ। পিটপিট করছে না। অপলক।
‘ও কিছু নয়,’ মেয়েটার স্পর্শ জোহানকে উদ্বেলিত করে তুলেছে। ‘খরগোশ। ওই দেখো… লাফাচ্ছে…’
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে জঙ্গলের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল বিন্দুগুলো।
ফের অন্ধকার। না। টিপটিপ জ্বলছে জোনাকির দীপ।
ঊনত্রিশ
জায়গাটা ভৌতিক।
না, রোজমেরি মিলফোর্ড ভয় পাচ্ছে না। তবে মন একটু কেমন-কেমন যে করছে না, তা নয়। অনেক পুরানো একটা বাড়িতে গেলে যেমন হয়, সেইরকম অনুভূতি হচ্ছে।
অঞ্চলটা নিঝুম। এতটাই যে, নিজের নিঃশ্বাস আর বুকের ধুকপুকানির শব্দ কানে বাজছে পরিষ্কার।
এই শব্দহীনতা ঠিক স্বাভাবিক নয়। স্নায়ুতে চাপ দেয়।
একটা পাখি, কাঠবিড়ালি কিংবা গিরগিটি চোখে পড়ছে না। চরাচর নিস্তব্ধ। সমাহিত।
বিরাট বড় একটা ওক গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছে ঘোড়া তিনটে।
অনেক বয়স হয়েছে গাছটার। অনেক পুরানো। কালের সাক্ষী।
এরকম ওক জীবনে দেখেনি রোজমেরি। একেবারে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। ডালগুলোর এমন বিকৃত চেহারা, ভয় লাগে দেখলে। নেমে এসে মাটি ছুঁই-ছুঁই করছে।
মস্ত এক খোঁড়ল গাছটার পেটের মধ্যে। মাটি থেকে সামান্য ওপরে। মেরির মনে হলো, নিতল গহ্বর। পেটে খিদে নিয়ে মুখ ব্যাদান করে আছে অন্ধতামিস্র। কাছে গেলেই গিলে ফেলবে।
এক ঝলক দমকা বাতাস শিরশিরে শিহরণ তুলে দিয়ে গেল সোনালী-সবুজ পাতাগুলোতে।
শিরশিরানি অনুভব করল মেরি তলপেটে।
ছোট-বড় এন্তার পাথর কাছে-দূরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। এক নজর দেখলেই বোঝা যায়, পাথরগুলো নৈসর্গিক নয়। মানুষের হাত পড়েছে তাতে। যেন অনেককাল আগে মানুষ বাস করত এখানে।
ধসে পড়া একটা দেয়াল দেখে ধারণাটা পাকাপোক্ত হলো মেরির। ধ্বংসস্তূপের মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা! এক বিশাল জনমানবশূন্য পাথরের অরণ্যে!
আলভারোর দেখাদেখি ঘোড়া থেকে নামল দু’জনে। ম্যালা দিন পরে এখানে কারও পদচিহ্ন পড়ল।
কৌতূহল ভরে চারপাশটা দেখছে রোজমেরি। তা হলে এটাই সেই জায়গা? কারা থাকত এখানে? এখনও কি আছে?
‘বাকিটা পথ আমরা হেঁটে যাব,’ বলল মেকসিকান।
ঘাড় কাত করে সম্মতির ভঙ্গি করল মেরি।
‘স্যাম বয়, যন্ত্রপাতি নামাও।’
তার কাজ হলে পরে মেকসিকান বলল, ‘একটা প্রতিজ্ঞা করতে হবে তোমাদের সবাইকে।’
‘কী প্রতিজ্ঞা?’ মনের প্রশ্নকে কথায় তর্জমা করল স্যাম ফুলার।
‘দেয়ালে পিঠ ঠেকে না গেলে এখানে আর আসবে না। পারো তো, এই জায়গার হদিসই দেবে না কাউকে।’
‘আমি শপথ করছি, আলভারো,’ মাথা ঝাঁকিয়ে প্রতিশ্রুতি দিল ফুলার।
মিসেস মিলফোর্ডের চোখ দুটো জরিপ করল আলভারো। ‘আরেকটা কথা। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সোনা নেবে না তোমরা। জেরিকেও একই শর্ত দিয়েছিলাম।’
‘আমরা তোমার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব, সেনিয়োর,’ গভীর আত্মপ্রত্যয়ের সাথে কথাটা বলল মিসেস মিলফোর্ড
‘বেশ তা হলে, চলো। জুতা খুলতে হবে।
চোখে প্রশ্ন। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করল না রোজমেরি। গাছের শেকড়ে বসে পড়ল জুতো খুলবার জন্যে।
স্যাম ফুলারও নিচু হলো।
নিজের স্যাণ্ডেল জোড়া শেকড়ের ফাঁকে ঢুকিয়ে রাখল মেকসিকান। মিসেস মিলফোর্ড উঠে দাঁড়াতে বলল, ‘একটু কষ্ট হবে, সেনিয়োরা। দেখে-শুনে পা ফেলবে।’
গাঁইতি কাঁধে ফেলল ফুলার। আরেক হাতে তুলে নিল বেলচা।
আলভারোর পাশে-পাশে হাঁটতে লাগল রোজমেরি। অনেক প্রশ্ন জমা হয়ে আছে তার মগজের অভ্যন্তরে। হাঁটতে হাঁটতেই জিজ্ঞেস করল, ‘সেনিয়োর, জেরির সাথে কী করে চিন-পরিচয় হলো তোমার?’
হাঁটা না থামিয়েই ঘাড় ফেরাল আলভারো। ‘তোমাকে বলেনি ও?’
‘জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলেছে, বেশি মানুষ তোমাকে চিনুক, এটা নাকি তুমি চাও না।’
খুকখুক করে হাসল আলভারো। ‘ঠিকই বলেছে। লোকে জানলে বিরক্ত করবে, সেজন্য বলতে মানা করেছিলাম। আমার জীবনটা সাফসুতরো নয়, সেনিয়োরা। কালো দাগে ভরা।’
আলভারোর অতীত সম্পর্কে জানবার প্রচণ্ড আগ্রহ জাগল মেরির। আশা করল, বলবে। কিন্তু বুড়ো আর সেদিকে গেল না। মিসেস মিলফোর্ডের করা প্রশ্নটার জবাব দিল, ‘জেরি আমাকে খুঁজে বের করে। এক ইনডিয়ান ওল্ড ডাভ ওকে আমার কথা বলেছিল।’
‘শকুনের ছায়া?’
‘চেনো দেখছি। হ্যাঁ, ওই লোকই।’
‘জেরির পরে কি আর কেউ এসেছে সোনার খোঁজে?’
‘একজনও নয়, সেনিয়োরা… একজনও নয়।’
‘কতটুকু নিশ্চিত তুমি, সেনিয়োর?’
‘আমার হাত-পায়ে ক’টা আঙুল আছে, সে ব্যাপারে যতটুকু নিশ্চিত, ততটুকু।’
মেরি তারপরও সন্দিহান।
আলভারো আবার বলল, ‘সেনিয়োরা, কেউ যদি সোনার তালাশ করতে আসে, আমাকে এড়াবার সুযোগ নেই তার। দুই কুড়ি বছর ধরে ওই কুটিরে বাস করছি আমি। আমার বাড়ির সামনে দিয়ে গেছে সোনার ট্রেইলটা। ওই একটাই পথ। আর কোনও ভাবে এখানে আসবার রাস্তা নেই।’
‘তা হলে,’ অন্য একটা বিষয়ে চিন্তিত দেখাল মিসেস মিলফোর্ডকে। ‘বলছ, তোমাদের পরে আর কেউ এখানে আসেনি। এল না কেন, সেনিয়োর? সোনা আছে, জানে। তার পরেও আগ্রহী হলো না! পঙ্গপালের মতন এসে সাফ করে ফেলবার কথা!’
‘আমার মনে হয়, বেশির ভাগ লোকে এটাকে গল্প হিসেবে নিয়েছে। মরীচিকার পিছনে ঘুরে মরতে চায়নি কেউ। বিশ্বাস করাতে হলে প্রমাণ লাগে, সেনিয়োরা। তোমার স্বামী নিশ্চয় জনে জনে বলে বেড়ায়নি?’
‘না, সেনিয়োর। অনেকেই ওকে জিজ্ঞেস করেছে। স্রেফ অস্বীকার করে গেছে জেরি।’
কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটল ওরা।
কয়েকটা বিষয় ক্লিয়ার হয়েছে। কিন্তু এখনও মাথার ভেতরে পাখা ঝাপটাচ্ছে প্রশ্ন। মেরি আবার মুখ খুলল, ‘সেনিয়োর….’
‘বলো,’ হাঁটবার ওপরেই বলল মেকসিকান।
‘তুমি কি বলতে পারবে, এখানে সোনা এল কেমন করে?’
হোঁচট খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল যেন আলভারো। মহিলার দিকে তাকাল। হতভম্ব দেখাচ্ছে বুড়োকে। ‘তুমি জানো না?’,
বিভ্রান্তির দোলনায় দুলতে লাগল মেরি। ‘কী জানি না, সেনিয়োর?’
‘সোনা তো এখানে আসেনি, সেনিয়োরা। বরাবর ছিল।’
‘জানি তো।’ ঠোঁট মুড়ে হাসল রোজমেরি। ‘সোনার খনি। আমি আসলে জানতে চাইছি, কী করে তৈরি হয় সোনা। জানো তুমি?’
ঠাস করে কপাল চাপড়াল মেক্স। হতাশায় মাথা নাড়ছে। ‘খনি নয়, সেনিয়োরা… খনি নয়! আয়-হায়, কোথায় আছ তুমি!’
রোজমেরি মিলফোর্ড বোকা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
খনি নয়! তা হলে কী?
‘সেনিয়োরা, এই এলাকার ইতিহাস জানো তুমি?’
‘একটু-একটু।’
‘মস্ত একটা ভূমিকম্প হয়েছিল, জানো সেটা?’
‘হ্যাঁ, সেনিয়োর। শুনেছি।’
‘সেই দুর্যোগে গোটা একটা জনপদ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল, তা জানো?’
‘বলো কী!’
‘জানো না, তার মানে।’ গোঙাবার মত শব্দ করল আলভারো। ‘বুঝতে পারছি, জেরি তোমাকে বলেনি।’
‘ও কি জানত?’
‘আলবত জানত, সেনিয়োরা!’ তুড়ি বাজাল আলভারো। ‘ওই ইনডিয়ান সর্দারের কাছে শুনেই না সোনার জ্বর মাথাচাড়া দেয় জেরির মাঝে।’
‘কিন্তু, সেনিয়োর…’ ঠিক মেলাতে পারছে না মেরি। ‘আমি তো কিছু শুনিনি! আমি নিজেও তো তখন সর্দারের সামনে ছিলাম!’
‘সবটা বলেনি বোধ হয় তখন সর্দার। জেরি হয়তো পরে শুনেছে।’
ফের চলতে লাগল আলভারো। কেন বলল না, চিন্তা করছে। নাকি সর্দার ভেবেছে, মহিলা পেটে কথা রাখতে পারবে না! হবেও বা।
হাঁটবার ফাঁকে মেকসিকান বলল, ‘এখানে একটা জনবসতির পত্তন হয়েছিল। এই পাহাড়ের উপরে ছিল লোকগুলোর ঘাঁটি…’
‘কারা ছিল ওই লোকগুলো?’
‘এখানকার আদিম অধিবাসীদের একটা গোত্র। শোনা যায়, এই অঞ্চলের প্রথম বাসিন্দা…’
‘ভূমিকম্পেই শেষ হয়ে গেল এতগুলো মানুষ! ‘
মাথা দোলাল আলভারো।
শিউরে উঠল মেরি। শত-শত বছর আগের সেই প্রলয়ঙ্কর ধ্বংসের ছবিটা কল্পনা করবার চেষ্টা করছে।
‘দুই-একজন বেঁচে গিয়েছিল হয়তো,’ দাঁড়াল আলভারো। ‘আমার বিশ্বাস, ওদের মুখ থেকেই ছড়িয়ে পড়ে কিংবদন্তিটা।’
ঝুঁকে চকমকে একটা জিনিস তুলে নিল সে মাটি থেকে। রঙিন কাচ। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে ফেলে দেয়।
‘কিংবদন্তি?’ পেছন থেকে জিজ্ঞেস করল স্যাম ফুলার, ‘সত্যি নয়?’
শরীর ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল মেকসিকান। ‘স্যাম, কেউ যদি বলে, এই পাহাড়ে সোনা আছে, সেটা না হয় বিশ্বাস করা যায়,’ হাসল বুড়ো। ‘কিন্তু তারা সোনা বানাতে জানত, এটা বিশ্বাস করবে তুমি?’
চমকে উঠল মেরি।
সোনা বানাতে পারত!
হঠাৎ যেন একটা আগল খুলে গেছে হাট করে। একরাশ আলো এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে রোজমেরি মিলফোর্ডের মনের তিমিরে।
তবে কি এই সোনা গুপ্তধন?
ভাবনাটা থমকে গেল, যখন পাথরে তৈরি বেদির মত একটা জায়গার কাছে এসে ঘোষণা করল আলভারো, ‘এসে গেছি!’
.
‘এটা একটা বুটহিল।’
বেদির কিনারে বসে পড়েছে মেরি। অভ্যাস নেই, খালি পায়ে অনেকটা পথ মাড়িয়ে এসে ব্যথা করছে পা। আবার হেঁটে ফিরতে হবে, চিন্তা করে দমে গেল একটু।
‘আরেক বার বলবে, সেনিয়োর?’ আলভারোর কথাটা ধরতে পারেনি সে। ‘কী বললে, বুঝিনি।’
‘এটা একটা বুটহিল, সেনিয়োরা। কবরখানা। ‘
এই জন্যেই কি জুতা খুলতে বলেছে আলভারো? মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা প্ৰদৰ্শন?
‘তুমি বলছ, এখানে কবর দেয়া হত লোককে?
‘না, তা বলিনি।’
‘তা হলে কী বলতে চাইছ?’
‘বলতে চাইছি, বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছিল পাহাড়টা। খোদা মালুম, কত লোক মারা গিয়েছিল।’
‘ও, আচ্ছা… ভূমিকম্প।’
‘জেরি আর আমি মাটি খুঁড়ে হাড্ডিগুড্ডি পেয়েছিলাম।’ গাঁইতির মাথার দিকটা মাটিতে ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল স্যাম ফুলার। বেলচাটা মাটিতে। সদাহাস্যময় বুড়ো ক্রস আঁকল বুকে। চোখে নিরাসক্তি নিয়ে চারপাশে তাকাল।
প্রহর শেষের মরা আলো চারদিকের নিঝুমতাকে আরও ঘন করে তুলেছে।
ব্লাডহাউণ্ডের অনুসন্ধিৎসা নিয়ে জায়গাটা সার্চ করতে লাগল আলভারো। মাটির দিকে চোখ। মিনিট দুয়েক পরে এক জায়গায় গিয়ে থামল। মুখ তুলে তাকাল পশ্চিম দিকে। স্যাম ফুলারের দিকে চাইল।
‘ঘণ্টা দুই, আলো থাকবে এখনও,’ নিজেকেই শোনাল যেন মেকসিকান। ‘এদিকে এসো তো, স্যাম। খোঁড়ো এখানটায়।’ আলভারোর নির্দেশিত জায়গায় পড়ল গাঁইতির কোপ।