সুবিধাবাদিজম
আকাশ এই সময় কেমন নীল হয়ে ওঠে। ভেসে আসে খণ্ডখণ্ড মেঘ। উদাস আর মন্থর। মন যেন কেমন করতে থাকে। মনে হয় ওই আকাশেই যদি ঘরবাড়ি করা যেত। ওইখানেই পাতা হত পূজার আসন। দেবীর বেদি। মাটির পৃথিবীর কথা আর ভাবতে ইচ্ছে করে না। ইচ্ছে করে না তাকাতে। পৃথিবী বড় হতাশ করছে। মানুষের বেহিসেবী-দাপটে বেঁচে থাকার আনন্দটাই নষ্ট হয়ে এসেছে।
ধন, জন, অর্থ, প্রতিপত্তি, যশ, খ্যাতির কোনও দাম নেই। মানুষ ভালোবাসতে চায়, ভালোবাসা পেতে চায়। বিশাল মানব-গোষ্ঠীকে নিয়ে একটা পরিবার গড়তে চায়। নিরাপত্তা চায়। এই মারামারি, কাটাকাটি, দেশসেবার নামে ভণ্ডামি, মুখে বলছে এক, করছে আর এক। এই সবই দেখতে-দেখতে মনে হয়, মানুষের সমস্ত ব্যাপারটাই একটা বড় রকমের তামাশা। প্রাণী হিসেবে মানুষ খুব উৎকৃষ্ট কিছু নয়। অকারণে নিষ্ঠুর। বোধবুদ্ধি শূন্য। আত্মম্ভর। কল্যাণ, অকল্যাণের ধার ধারে না। সবসময় অভিনয়। চরিত্র বলে কিছু নেই। যার সুযোগ আছে, সে কেবল নিজের কোলে ঝোল টেনে চলেছে।
অসুরের চরিত্র আছে, সে বীর। মনে-প্রাণে অধার্মিক। সে যা করে, তা বিশ্বাস করে। মানুষ অসুরও নয়, দেবতাও নয়। দেবতা হতে চায়, কিন্তু বিশ্বাস নেই, নিষ্ঠা নেই, সাধনা নেই। মানুষ হল অসুরের ক্রীতদাস। প্রবৃত্তির কাছে বিকিয়ে বসে আছে। নীচ সত্তা যে আদেশ করবে তাই পালন করতে বাধ্য।
পূজা শব্দের অর্থ তাহলে কি? তার পূজা, কীসের পূজা? মূর্তি হল গুণের আকর। মাটি লেপা, খড়ের পুতুল নয়। যাঁর পূজা করছি তাঁর কিছু গুণ যদি আমরা ধারণ করতে না পারি, তাহলে আমরা আবার কীসের ধার্মিক, কেমন ধার্মিক? দেবী দুর্গা হলেন শক্তি। শুভ শক্তি, যিনি অশুভকে নাশ করেন। আমরা কি শক্তির কণামাত্র আহরণ করতে পেরেছি? এত হিংসা, এত দানবীয় দাপাদাপি চারপাশে; এত দারিদ্র্য, লাঞ্ছনা, নির্যাতন, নিপীড়ন! কেন? ভারত নাকি পূণ্যভূমি, ধর্মের দেশ! অনেক পূণ্য ফলে মানুষ এদেশে জন্মায়।
জন্মে কি হয়! জানোয়ার হয়! সারাটা জীবন বড়-বড় কথা শোনে। প্রতিশ্রুতির ভারে নুয়ে পড়ে। সমস্যার পর সমস্যা। কোনও সমস্যারই সমাধান নেই। রাষ্ট্রযন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় মানুষকে কিছু দেওয়ার জন্যে। নিরাপত্তা, সুস্থ জীবিকা, জীবনের সুস্থ বিকাশের পরিমণ্ডল, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাস্তাঘাট, যানবাহন, আলো, পরিবেশ, স্বাস্থ্য, আইনকানুন। নির্বাচিত হওয়ার আগে জন-প্রতিনিধিরা প্রতিশ্রুতির যে ফিরিস্তি তুলে ধরেন, তাতে বহু ভালো ভালো আশা জাগানোর কথা থাকে। গদিতে আরোহণ করে তাঁরা সব ভুলে যান। তখন দলবাজি ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। মানুষ তখন অবাক হয়ে দেখতে থাকে, যে-ই যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। স্বজন-পোষণই চলতে থাকে নানা নামে। এইসব দেখে-দেখে আমাদের ধারণা হয়েছে, সব পার্টিই মরণে-অলা পার্টি। দাসখত লিখে দিয়ে যারা ঝান্ডা ধরতে পারবে তারাই দিনান্তে পাঁউরুটি আলুর দম পাবে যারা পারবে না, তারা নির্যাতন সহ্য করবে।
একটা সর্বনাশা ভাবধারা আমাদের রাজনীতিতে প্রথম থেকেই এমনভাবে ঢুকে গেছে যা আর সংশোধন সম্ভব নয়। মানুষ যখন জলে-জঙ্গলে বসবাস করত, ট্রাইব্যাল ছিল, তখন যেমন দল ছিল, দলপতি ছিল, এ-দলে ও-দলে মারামারি হত, এখনও ঠিক সেই অবস্থাই চলছে। তখন লড়াই হত জায়গা-জমি নিয়ে, খাদ্য নিয়ে, নারীর দখল নিয়ে, এখন হয় গদির লড়াই, মতবাদের লড়াই। এক সময় পাদরিরা ধরে-ধরে খ্রিস্টান করত, ইসলাম শাসকরা দেব-দেউল ভেঙে মসজিদ বানাত, গোমাংস খাইয়ে, মুখে থুথু দিয়ে ধর্মান্তরিত করত। সেই একই ব্যাপার চলছে অন্য নামে। অন্যভাবে। দলের সমর্থক হতে হবে, না হলে জমির ফসল যাবে। বসতবাটি যাবে। প্রয়োজনে হাসপাতালে অ্যাডমিশন হবে না, ছেলেমেয়ের, নিজের চাকরি জুটবে না। শিক্ষায়তনে ভরতির সুযোগ মিলবে না। যার চাকরি আছে তাকে বদলি করা হবে। প্রাণ গেলেও আপত্তি নেই।
দেশ একটা, দল অনেক। মতবাদ হল আইওয়াশ। অর্থনীতি, সমাজনীতির সঙ্গে যোগ নেই। মতবাদ হল আইডল। ধর্ম আর ধর্মের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে যাদের এত জেহাদ, তারা কিন্তু সযত্নে মতবাদের একটা অদৃশ্য দেব-প্রতিমা সামনে খাড়া করে মানুষের সহজাত ফ্যানটিসিজমে জিগিরের খোঁচা মেরে চলেছে। আমাদের যেসব প্রবৃত্তি প্রবল তার মধ্যে হিংসা প্রবল। প্রবল বিদ্বেষভাব। শান্তির চেয়ে লড়াই আমাদের বেশি উত্তেজিত করে। প্রেমের চেয়ে প্রবল হল ঘৃণা। মানুষকে সাইকোলজিক্যাল নাচানো হচ্ছে। প্রতিবেশিকে আমরা বাঙালিরা সহ্য করতে পারি না, বরাবরই আমরা অসামাজিক, স্বার্থপর, অনুদার। আমাদের ইতিহাস বিশ্বাসঘাতকতার, পদলেহনের, ক্রীতদাসের। স্বদেশের ঠাকুর ফেলে বিদেশের কুকুর ধরার প্রবণতা আমাদের আজকের নয়। দলাদলিতে আমরা শ্রেষ্ঠ। মাটি দিয়ে পুতুল গড়া সহজ। হাতের চাপে যে কোনও আকৃতি নিতে পারে। নমনীয়। ইস্পাত হলে সহজ হত না। এই জাতীয় চরিত্রকে বিদেশিরা যেভাবে স্লেভ তৈরির কাজে লাগিয়েছিল, স্বদেশিরাও নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনে সেইভাবেই কাজে লাগাচ্ছে। ধর্মের নামে হত্যা, নিপীড়নের বদলে মতবাদের নামে তছনছ চলছে। গেঁয়োযোগী ভিখ পায় না এ-দেশে। অমুকে বিলেত ঘুরে এসেছে শুনলে আমরা স্বসম্ভ্রমে এগিয়ে যাই এখনও। বিলেত ফেরত ডাক্তার, কি সাহেব ডাক্তার কেন, হালুইকর যদি সাহেব হয় আমরা একেবারে গলে যাই। দেশ থেকে দেশের ফসলটুকু ছাড়া আমাদের তখনও কিছু নেওয়ার ছিল না। এখনও কিছু নেওয়ার নেই। এ দেশের ধর্ম, দর্শন, মহাপুরুষ, মত, পথ সব ফেলে দাও। নিয়ে এসো বিদেশি মতবাদ। সেই মতবাদ ভালো করবে কি খারাপ করবে, দেখার দরকার নেই। উপযুক্ত ক্ষেত্রে উপযুক্তভাবে প্রযুক্ত হল কি না, প্রয়োগ করা যায় কি না, এসব প্রশ্ন পরে, প্রয়োজনও নেই। এদেশের মানুষকে এমন একটা অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে যে অবস্থায় প্রশ্ন আসে না, আসে আত্মসংলাপ, ‘সলিলোকি’। কেউ চ্যালেঞ্জ করছে না। করবার সাহস হবে না; কারণ পাশেই থাকবে প্রহরী কুকুর। ধর্মগুরুর মতো, রাজনীতির গুরুরা কীর্তন শোনাতে থাকবে, ‘ভজো, ভজো, প্রভুর ভজনা করো, আমরা সুদিনের সন্ধানে আছি। গোটাকতক শত্রু খতম করতে পারলেই তোমাদের ধরে এনে দোব’। এ-দেশের মানুষ কি আর চাইবে! দুশো আড়াইশো বছর ইংরেজ বুটের তলায় রেখেছিল। তারপর সাঁইত্রিশ-আটত্রিশ বছরের স্বাধীনতায় যা হয়েছে তা ইতিহাস লিখবে। কিছু মানুষ, বোধ-বুদ্ধিসম্পন্ন কিছু মানুষ, স্তাবক, হাত তোলা নয়, ধামাধরা নয় এমন কিছু মানুষ লিখবেন সেই ইতিহাস। ‘লুট লে, লুট লে’ চলেছে সেই সাতচল্লিশ থেকে। আর একে-একে পরিবারের পর পরিবার এসে পড়ছে পথে। ঝুপড়িতে বাড়ছে নব ভারতের জনতা। এই স্তরে থেকে মানুষ কি চাইতে পারে? কি চাইতে হয় জানা আছে কি? সাঁইত্রিশ-আটত্রিশ বছর ধরে একটি পরিকল্পনাই হয়েছে—মানুষকে কীভাবে আরও গরিব করা যায়। শাসক আর শাসিতের মধ্যে বিশাল একটা ফারাক তৈরি করে রাখতে হবে পরিখার মতো, সহজে লাফিয়ে যেন চলে আসতে না পারে ওরা। নিজের ছেলেকে বলব ‘ভালো করে লেখাপড়া কর।’ সুযোগ পেলেই তাকে বিদেশে পাঠাব, আর ওদের ছেলেকে বলব, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বোমা মার। এমন হাস্যকর কথাও বলে ফেলব—ছাত্ররাই শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনা করবে। ছাত্ররাই পরীক্ষা নেবে। আসলে হচ্ছেও তাই। নির্বাচিত প্রশ্ন তালিকার বাইরে প্রশ্ন এলে পরীকের জীবন সংশয়। পরীক্ষাকেন্দ্রে গণ-টোকাটুকি। বাধা দিতে চাইলেই মৃত্যু।
‘ক্লাস’ আর ‘মাস’, দুটো ক্লাসই তো এখন স্পষ্ট। সোনার পাথরবাটি গোছের অবস্থা! মাস হল ক্লাসের হাতিয়ার। অমানুষ হওয়ার পুরো স্বাধীনতা দেওয়া আছে। মানুষ হওয়ার স্বাধীনতা নেই। সুযোগও নেই। কিছুই যখন নেই, আর আমাদের জাতীয় চরিত্রের ধরনটাই যখন—গয়ংগচ্ছ, যা হোক, যেভাবেই হোক দিন কাটিয়ে যাও, আর সংসার বাড়িয়ে যাও, কিছু পাওয়ার আশাও নেই। অ্যামবিশান নেই যে জাতের, সে জাতের ‘আমরা বাঙালি’ বলে চেঁচানোই সার হবে। তখন পূজা উপচারের কি মানে হয়! সত্যিই কোনও মানে নেই। দুর্গাপুজোও বিচ্ছিন্নতার জন্ম দিচ্ছে। উস্কানি দিচ্ছে। দুর্গাপুজো কেন? সব পুজোই হল দলীয় রেষারেষি। ভক্তিটক্তি বাজে। নেতারা সময় সময় বলেন, ‘আহা, ওদেরও তো একটা কিছু করা চাই। একটা কিছু নিয়ে থাকতে হবে তো। চাকরি নেই বাকরি নেই!’
‘এনগেজ’ করে রাখতে হবে। ভারী সুন্দর কথা। এই এনগেজমেন্টের অর্থ হল, বোমাবাজি করা। পুজো করা। জোর করে চাঁদা আদায়। মারধোর। দাঙ্গাহাঙ্গামা। খুনখারাপি। সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক, চোলাইয়ের কারবার, নেশা ভাঙ গাঁজা ছিনতাই। মাস্তানি। কি সুন্দর একটা শ্রেণি বা বর্ণ বেরিয়ে এসেছে—মাস্তান। এরপর ইন্টেলেকচুয়্যাল বাঙালি বই লিখবেন—’মাস্তানস অফ দি ওরিয়েন্ট। বিদেশি প্রকাশক ছাপবেন। বাংলায় অনুবাদ হবে। লেখককে নিয়ে সেমিনার হবে। গবেষকরা গবেষণা করবেন। যেমন নকশালরা মরলেন, প্রাণ দিলেন আর পরবর্তীকালে লেখক-প্রকাশক গাড়িবাড়ি করে ফেললেন। কেউ-কেউ আবার বলে আমি নকশাল ছিলুম। এতকাল পানাপুকুরে হাড়ি মাথায় দিয়ে আত্মগোপন করেছিলুম, এখন আমার আত্মপ্রকাশ! তাকে নিয়ে হইচই। বাঙালি সুতোর ব্যবসা করত সুতানুটিতে, সেই ব্যবসা এখন সর্বতে। নেপোরা সবসময় রেডি। দই পেলেই হয়।
ধর্মও এখন নেপোদের হাতে। এনগেজ করে রাখা আমাদের ছেলেদের।
বিলিতি বুলির বাংলা, আওয়ার বয়েজ! সবই বুঝি আমরা। দিন-দিন দেখছি। সবকিছু থেকেই স্পিরিট উড়ে যাচ্ছে। আত্মশূন্য অবস্থা। একে স্পিরিচ্যুয়ালিজমের উলটো মেটিরিয়ালিজম বলে না। এর নাম সুবিধাবাদিজম। সবার ওপরে নৈবেদ্যের চূড়ায় কলার মতো নেপো।