সুবর্ণরেখার তীরে
সকাল বেলা ঘুম ভাঙার পরই মনে হল, আঃ কী সুন্দর এই জীবন! জানলা দিয়ে রোদ এসে পড়েছে, যেন ঠিক গলানো সোনা। বাতাসে একটু একটু শীত। আকাশ একেবারে ঝকঝকে নীল। জানলা দিয়েই দেখা যায়, বাগানে ফুটে আছে পাঁচরকম রঙের গোলাপ ফুল।
একটা চাদর জড়িয়ে বাইরে এসে দেখি, বিশ্বমামা আর বিলুদা চা খাচ্ছে। আমার আগেই ওরা উঠে পড়েছে? আমার আফশোস হল। আমার চেয়ে ওরা বেশিক্ষণ দেখতে পাবে সকালটা। এমন সুন্দর সকালে ঘুমোবার কোনো মানে হয়?
আমি বিশ্বমামাকে বললুম,—আমায় কেন ডেকে দাওনি?
বিশ্বমামা বললেন,—তোকে তিনবার ডেকেছি। তুই শুধু উঁ উঁ শব্দ করে এপাশ-ওপাশ করেছিস।
বিলুদা বলল,—বাছা কুম্ভকর্ণ!
বিশ্বমামা বললেন,—এক্ষুনি তৈরি হয়ে নে, নীলু। আমরা নদীর ধারে বেড়াতে যাব। তারপর সেখান থেকে ধারাগিরি পাহাড়ে। সারাদিন ফিরব না।
ঘাটশিলা জায়গাটায় সুবর্ণরেখা নদীর ধারটাই আমার বেশি ভালো লাগে। সাত বছর আগে, তখন আমার বয়েসও ছিল সাত বছর, বাবা-মায়ের সঙ্গে একবার বেড়াতে এসেছিলাম এখানে। সেবারে আমি নদীর ধারে বালি নিয়ে খেলা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম একসময়। বাবা-মা খেয়াল করেননি, বাড়ি চলে এসেছিলেন, তারপর সন্ধ্যে বেলা নদীতে ভাসতে ভাসতে আমি স্বর্গের মতন একটা জায়গায় চলে এসেছি, সেখানে কী সুন্দর গন্ধ!
সেই সাত বছর বয়েসের কত কথা ভুলে গেছি, কিন্তু সেই নদীর ধারে ঘুমিয়ে পড়া আর স্বপ্নটার কথা ঠিক মনে আছে।
একটু বাদে আমরা বেরিয়ে পড়লুম তিনজনে।
বিশ্বমামা অন্য দিন যেকোনো রাস্তায় যেতে যেতে গাছপালা, পশুপাখি, পাথর সম্বন্ধে কতরকম বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা শোনান। আজ তাঁর ওদিকে মন নেই। আজ গুনগুন করে গান গাইছেন আপন মনে।
এই নদীর ধারে অনেকে পিকনিক করতে আসে। কিন্তু আজ এখন মানুষজন বিশেষ নেই। পাতলা পাতলা বাতাস আর হালকা রোদের একটা খেলা চলছে। দূরের ছোটো ছোটো পাহাড়—মনে হয় যেন আকাশের গায়ে পেনসিলে আঁকা। একঝাঁক সাদা বক উড়ে গেল নদীর এপার থেকে ওপারে।
একজন বুড়ো মতন লোক কোমর পর্যন্ত জলে নেমে একটা গামছা দিয়ে জল আর বালি তুলে ছাঁকছে। আমরা যে পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, তা সে লক্ষও করছে না।
বিলুদা বলল,—লোকটা মাছ ধরছে নাকি?
বিশ্বমামা বললেন,—না। ওই লোকটা সোনা খুঁজছে।
বিলুদা বলল,—জলের মধ্যে নেমে সোনা খুঁজছে? লোকটা পাগল নাকি?
বিশ্বমামা বললেন,—পাগল কেন হবে? এই নদীর বালিতে সত্যিই তো সোনা পাওয়া যায়। সেই জন্যই তো নদীর নাম সুবর্ণরেখা।
বিলুদা তবু অবিশ্বাসী মুখ করে বলল,—যা:, তাহলে তো কত লোকই সোনা খুঁজতে আসত! সব বালি শেষ হয়ে যেত এতদিনে!
বিশ্বমামা বললেন,—এক সময় অনেক লোকই আসত এখানে সোনা খুঁজতে। আমি ছেলেবেলায় দেখেছি। সোনা সত্যি পাওয়া যায়, কিন্তু সারাদিন ধরে বালি ছেঁকে ছেঁকে হয়তো পাওয়া গেল একটা ছোট্ট দানা, মাসের পর মাস লেগে থাকলে হয়তো হবে পাঁচ রতি কিংবা দশ রতি, তাতে পরিশ্রম পোষায় না। সেই জন্য অনেকে হাল ছেড়ে দেয়। যারা খুব ভাগ্যবান হয়, তারা অনেক সময় বড়ো টুকরোও পেয়ে যায়। এই তো কাছেই সোনাপেট বলে একটা জায়গা আছে, সেখানে একটা লোক বড়ো এক টুকরো সোনা মেশানো পাথর, যাকে নাগেট বলে, সেরকম একটা পেয়ে বড়োলোক হয়ে গিয়েছিল।
বিলুদা এবার চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,—সত্যি? তাহলে চলো না আমরা সোনাপেট যাই!
বিশ্বমামা জিজ্ঞেসা করলেন,—তোর কাছে বড়ো একটা ছুরি দেখেছিলাম, সেটা সঙ্গে এনেছিস?
বিলুদা বলল,—না, আনিনি তো। দৌড়ে গিয়ে নিয়ে আসব?
বিশ্বমামা এবার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,—তুই জানিস ‘বোকার সোনা’ কাকে বলে?
আমি বোকার মতন বললুম,—বোকার সোনা? সে আবার কী?
একটা বড়ো পাথরের চাঁইয়ের ওপর বসে বিশ্বমামা বললেন, —তোরাও বস এখানে। তোদের একটা গল্প বলি। তোরা চার্লি চ্যাপলিনের ‘গোল্ড রাশ’ সিনেমাটা দেখেছিস?
আমি বললুম,—হ্যাঁ, দেখেছি, সেই যে চার্লি চ্যাপলিন খিদের চোটে জুতো খেয়ে ফেলেছিলেন!
বিশ্বমামা বললেন,—হ্যাঁ। তোদের সেই গোল্ড রাশেরই একটা গল্প শোনাব। আমেরিকা মহাদেশটা তো নতুন, ইউরোপ থেকে সাহেবরা আটলান্টিক মহাসাগর পেরিয়ে যখন সেখানে পৌঁছোয়, তখন তাদের ধারণাই ছিল না দেশটা এত বড়ো। পুব দিক থেকে তারা পশ্চিম দিকে আস্তে আস্তে এগোয়। তখন পশ্চিম দিকের নাম দিয়েছিল তারা ওয়াইলড ওয়েস্ট!
বিলুদা বলল,—হ্যাঁ, পাহাড়, মরুভূমি, হিংস্র রেড ইণ্ডিয়ান। ওখানকার গল্প নিয়ে যেসব ফিলম হয়েছে, সেগুলিই তো ওয়েস্টার্ন মুভি। দারুণ মারামারি।
বিশ্বমামা বললেন,—ওয়েস্টার্ন ছবিতে তো কাউ-বয় আর গ্যাংস্টাররা গোলাগুলি চালায়। আমার গল্পটা তার চেয়ে কিছুটা আগের। তখন অনেক লোকের ধারণা হয়েছিল, আমেরিকার ওই পশ্চিম দিকের মরুভূমিতে, নদীগুলোর ধারে সোনা ছড়িয়ে আছে। যে আগে গিয়ে কুড়িয়ে নিতে পারবে, সে-ই বড়োলোক হয়ে যাবে। কত লোক যে এই জন্য প্রাণ দিয়েছে তার ঠিক নেই। একে বলে মরীচিকার পেছনে ছোটা। খেতে পায়নি, মরুভূমির মধ্যে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে, রেড ইণ্ডিয়ানদের সঙ্গে খুনোখুনি করেছে।
বিলুদা জিজ্ঞেস করল, —কেউ কি সোনা পেয়ে বড়োলোক হয়েছিল?
বিশ্বমামা বললেন, —গুজব ছড়িয়ে ছিল যে কেউ কেউ পেয়েছে, কিন্তু তাদের দেখা যায়নি।… এবার শোন দুই বন্ধুর কথা। একজনের নাম বব, আর একজনের নাম নিক। একেবারে প্রাণের বন্ধু যাকে বলে। দু-জনেরই দারুণ স্বাস্থ্য আর দারুণ সাহস। ওরা যাত্রা শুরু করেছিল শিকাগো শহর থেকে। দু-জনের দুটো ঘোড়া আর রিভলবার, দুটো থলিতে সামান্য কিছু জিনিসপত্র। ওরা কোনো বড়ো দলের সঙ্গে ইচ্ছে করেই ভিড়ে যায়নি। বব আর নিক ঠিক করেছিল, ওরা অ্যারিজোনার মরুভূমিতে গিয়ে কিছুদিন থাকবে। বেশি জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে তো লাভ নেই, শুধু একটা জায়গা ভালো করে দেখার পর যা হয় হবে। অ্যারিজোনার ওই মরুভূমিটা বড়ো সুন্দর!
বিলুদা জিজ্ঞেস করল, —তুমি দেখেছ? তুমি গিয়েছিলে?
বিশ্বমামা বললেন, —হ্যাঁ, টুসন নামে একটা শহর আছে, তার খুব কাছেই ওই মরুভূমির শুরু। টুসন শহরে একবার একটা বক্তৃতা দিতে গিয়ে আমি পুরো মরুভূমিটা ঘুরে দেখেছি, রাত্তিরেও ছিলাম। তখনই তো বব আর নিকের গল্পটা শুনি।
বিলুদা জিজ্ঞেস করল, —সব মরুভূমিই তো একরকম হয়, ওটা বেশি সুন্দর কেন?
বিশ্বমামা বললেন, —মরুভূমি মানে সবাই ভাবে কোনো গাছপালা নেই, শুধু সমুদ্রের মতন ধু-ধু করছে বালি। অ্যারিজোনার মরুভূমি সেরকম না। অনেক গাছ আছে, ঠিক গাছ নয়। ক্যাকটাস। আমরা যেগুলোকে ফণীমনসা গাছ বলি। কিন্তু অতবড়ো ক্যাকটাস আমাদের দেশে হয় না, দোতলা-তিনতলা বাড়ির সমানও আছে। ওখানকার বালির রং একেবারে সোনালি। মাঝে মাঝে ছোটো ছোটো পাহাড়।
বব আর নিক সেরকম একটা পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিল। প্রত্যেক দিন তারা মেপে মেপে ঠিক দু-বিঘের মতন জমি তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখে! মাঝে মাঝে ওদের মধ্যে একজন ঘোড়া ছুটিয়ে গিয়ে দূরের একটা গ্রাম থেকে খাবার কিনে আনে, দু-একটা খরগোশ শিকার করে।
এইরকমভাবে কেটে গেল মাসের পর মাস! ওরা ধৈর্য না-হারিয়ে একটু একটু করে এগোয়। এর মধ্যে বিপদও ঘটল কয়েকবার। ওই মরুভূমিতে একরকম বিষাক্ত সাপ আছে, সেগুলোকে বলে র্যাটল স্নেক। সে সাপগুলো যখন উত্তেজিত হয়, তখন লেজের দিকে খট খট খট খট শব্দ হয়। একদিন বব-এর একেবারে সামনে পড়ে গেল ওইরকম একটা সাপ। বব তখন হাঁটু গেড়ে বসে বালি ঘেঁটে ঘেঁটে দেখছে। রিভলবারটা বার করতে গেলেই যদি সাপটা কামড়ায়, এই ভয়ে হাত নাড়তে পারছে না। নিক রয়েছে তার উলটো দিকে, সাপটার পেছনে। কিন্তু সে গুলি চালালে ববের গায়েও লাগবে। বেশি চিন্তা করারও সময় নেই। নিক ঝাঁপিয়ে পড়ল সাপটার ওপর, দু-হাতে তার মুখটা চেপে ধরল। একটু এদিক-ওদিক হলেই সাপটা তাকে কামড়াত।
আর একবার তিনটে ডাকাত এসে ওদের ওপর হানা দিয়েছিল। সেবারেও ববকে বাঁচাতে গিয়ে নিক আহত হয়। বব অবশ্য বাকি দুটো ডাকাতকে তাড়া করে গিয়ে মেরে আসে।
বিলুদা বলল, —বুঝেছি, এ গল্পের শেষে কী হবে। ওরা দু-জনে খুব বন্ধু ছিল তো? তারপর একদিন—
বিশ্বমামা বললেন, —ঠিক আছে, তুমি শেষ করো। তারপর দেখব মেলে কি না!
বিশ্বমামা বললেন,—সাত মাস পেরিয়ে গেল, রোদে পুড়ে জলে ভিজে ওদের চেহারা অদ্ভুত হয়ে গেছে। সারা মুখ দাড়িতে ভরতি, তবু ওদের জেদ যে সোনা না-নিয়ে ফিরবে না। তারপর একদিন সেই ব্যাপারটা ঘটল।
বিলুদা বলল,—ওরা সোনা খুঁজে পেল!
বিশ্বমামা বললেন,—ডাকাতদের উপদ্রবে ওরা প্রায়ই জায়গা পালটায়। যারা সোনা খুঁজতে আসে, তাদের সব কিছু কেড়ে নেবার জন্য একদল ডাকাতও ঘুরে বেড়াত এই মরুভূমিতে। একদিন সকালে, আগের রাতে খুব ঝড়-বৃষ্টি হয়ে গেছে, ওরা দু-জনে হাঁটছে। ওদের খাবার ফুরিয়ে গেছে। আগের রাতে কিছুই খাওয়া হয়নি, ওরা ঠিক করল দু-জনেই এক সঙ্গে শহরে যাবে। অনেকদিন বাদে কোনো সরাইখানায় গিয়ে ভালো করে খাবে।
হঠাৎ বব থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে অদ্ভুত গলায় ডাকল,—নিক!
নিকও তার বন্ধুর দৃষ্টি অনুসরণ করে দারুণ চমকে গেল। একটা ক্যাকটাস গাছের নীচে এক তাল সোনা। রোদ্দুর পড়ে চকচক করছে। ঠিক যেন ভোরবেলার সূর্য। ক্রিকেট খেলার বলের চেয়েও অনেকটা বড়ো সেই সোনার মন্ডটার সাইজ। অতখানি সোনা পেলে একজন দু-জন মানুষের সারাজীবন দারুণ আরামে কেটে যেতে পারে, আর কিছুই করতে হবে না।
দুই বন্ধু থমকে দাঁড়িয়ে আছে। ক-দিনের পরিশ্রমের পর এত কাছে এত বড়ো একটা সোনার মন্ড দেখেও ওরা যেন এগোতে পারছে না। বব বলে উঠল,—আমি আগে দেখেছি। নিক সঙ্গেসঙ্গে একটা ছুরি বার করে ববের পেটে ঢুকিয়ে এক টান দিল। বব আর কোনো শব্দও করতে পারল না, মরে গেল সেই মুহূর্তে।
বিলুদা বলল,—আমি ঠিক ধরেছিলুম। ঠিক বুঝেছিলুম। যেই সোনা খুঁজে পাবে, অমনি এক বন্ধু আর এক বন্ধুকে মারবে!
বিশ্বমামা গম্ভীরভাবে বললেন,—গল্প তো এখনও শেষ হয়নি। বোকারাম, শুরু করার একটু পরেই যারা শুনছে তারা যদি বুঝে যায় যে শেষে কী হবে, তাহলে সেটা গল্প হয় না। একটু অন্যরকম বলেই তো সেটা গল্প! গল্পের মাঝখানে কখনো বাধা দিতে নেই।
আমি বললুম,—তারপর কী হল বিশ্বমামা?
বিশ্বমামা বললেন,—যে নিক তার বন্ধুকে বারবার বাঁচিয়েছে, সোনা দেখামাত্রই সে সেই প্রাণের বন্ধুকে মেরে ফেলল। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই সোনার মন্ডটার ওপর। সেটা ঝুরঝুরিয়ে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল!
বিলুদা বলল,—সেটা সোনা নয়?
বিশ্বমামা বললেন,—অ্যারিজোনার মরুভূমিতে কখনো-কখনো ওরকম দেখা যায়। বিশেষত ঝড়-বৃষ্টির পর। ঝড়ে ওখানকার সোনার মতন বালি, ক্যাকটাসের আঠায় দলা পাকাতে থাকে, পাকিয়ে পাকিয়ে গোল বলের মতন হয়ে যায়, তার ওপর রোদ পড়লে অবিকল সোনার মতন দেখায়। ওখানে লোকে ওর নাম দিয়েছে ফুলস গোল্ড, বোকার সোনা। নিক তারপর পাগল হয়ে গেল! বদ্ধ উন্মাদ হয়ে সে সেই মরুভূমিতে চিৎকার করে বেড়াত,—বব ফিরে আয়! বব ফিরে আয়!
উঠে দাঁড়িয়ে আবার হাঁটতে হাঁটতে বিশ্বমামা বললেন,—সোনা জিনিসটা খুব খারাপ। মানুষের মধ্যে এমন লোভ জাগিয়ে দেয়!
বিলুদা বলল,—তুমি কী যে গল্প শোনালে বিশ্বমামা! আমরা যদি এখানে হঠাৎ একতাল সোনা সত্যি সত্যি দেখতে পাই, তাহলে কী আমরা মারামারি করব নাকি। তুমি আমার নিজের মামা, আর নীলু আমার নিজের ছোটো ভাই!
বিশ্বমামা বললেন,—মানুষের কাছে অনেক সময় নিজের আত্মীয়ের চেয়েও বন্ধু বড়ো হয়। বন্ধুর জন্য মানুষ প্রাণ দিতে পারে। আবার সেই বন্ধুকেই যখন কেউ আবার মারে, তখন সে কি তার কোনো আত্মীয়কে মারতে পারে না?
বিশ্ব্মামা গভীরভাবে বললেন,-গল্প তো এখনও শেষ হয় নি…
আমি এতক্ষণ বাদে বললুম, —থাক, ওসব কথা আর বলতে হবে না। এমন সুন্দর সকাল বেলাটায় মারামারির কথা শুনতে ভালো লাগে না।
বিশ্বমামা বললেন,—ঠিক বলেছিস। সোনা-টোনার কথা বাদ দে। সুবর্ণরেখা কী সুন্দর নাম। বিলু, এইরকম আরও কতকগুলো সুন্দর নদীর নাম বলতে পারবি?
বিলুদা বলল,—হ্যাঁ, কৃষ্ণা, কাবেরী, কপোতাক্ষ, ইছামতী, বিপাশা, চন্দ্রভাগা, নর্মদা।
বিশ্বমামা বললেন,—নর্মদা নদীতে বাঁধ দেওয়া নিয়ে এখন আন্দোলন চলছে। নর্মদা নামটার মানে জানিস?
বিলুদা বলল,—সব নামের কি মানে থাকে?
বিশ্বমামা বললেন, —বা:, মানে থাকবে না? নর্মদা মানে গভীর নীল জল। গল্প আছে যে একবার ব্রহ্মা অমরকণ্টক পাহাড়ে বিশ্রাম নেবার সময় ঘুমোচ্ছিলেন। কী একটা স্বপ্ন দেখে তাঁর চোখ থেকে খসে পড়ল দু-ফোঁটা জল। পাহাড়ের দু-পাশ দিয়ে সেই চোখের জলের ফোঁটা গড়িয়ে গিয়ে নদী হয়ে গেল, দুটো নদী। একটার নাম শোন, অন্যটার নাম নর্মদা।
বিলুদা বলল,—ব্রহ্মার এক ফোঁটা চোখের জলই যদি নদীর মতন, তাহলে ব্রহ্মার মুন্ডুটা কত বড়ো?
এইসব নানা গল্প করতে করতে আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেছি। হঠাৎ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে বিশ্বমামা আমার আর বিলুদার হাত চেপে ধরে বললেন,—দাঁড়া, এক পা নড়বি না।
আমি ভয় পেয়ে বললুম,—কী, সাপ নাকি?
বিলুদা বললেন,—সোনা! ওই তো!
খানিকটা দূরে বালিতে গাঁথা রয়েছে এক টুকরো পাথর। সোনার মতনই চকচক করছে। পাথরটার ওপরের অংশটাই দেখা যাচ্ছে, বালির মধ্যে রয়েছে আরও খানিকটা। এরকম রঙের পাথর তো আমরা আগে কখনো দেখিনি।
বিশ্বমামা বললেন,—ওটা যদি সোনা হয়, তাহলে ওটা কে পাবে, আগে ঠিক হয়ে যাক।
বিলুদা বলল,—আমরা ভাগ করে নেব!
বিশ্বমামা বললেন,—কীভাবে ভাগ হবে?
বিলুদা বলল,—তিন জনে সমান সমান!
বিশ্বমামা বললেন,—সমান সমান? বা:!
বিলুদা বলল,—না, মানে, তুমি বয়েসে বড়ো, তুমি বেশি পাবে। তুমি অর্ধেক আর বাকিটা আমরা দু-জনে।
বিশ্বমামা বললেন,—ঠিক তো?
বিলুদা বলল,—সোনাটার দাম ছ-ভাগে ভাগ করা হবে। তুমি নেবে তিন ভাগ, আমি দু-ভাগ, আর নীলু সবচেয়ে ছোটো, ও পাবে এক ভাগ!
হো-হো করে হেসে উঠে বিশ্বমামা বললেন,—এর মধ্যেই তিনরকম ভাগ হয়ে গেল। তোর কাছে ছুরি থাকলে নিশ্চয়ই আরেকরকম ভাগের কথা বলতিস?
তারপর হাসি মুছে ফেলে বিকট মুখভঙ্গি করে বিশ্বমামা বললেন,—যে আগে দেখে, সে-ই পায়। তোরা কিচ্ছু পাবি না। তোদের কাছে ছুরি-টুরি নেই আমি জানি। আমাকে বাধা দেবার চেষ্টা করলে দুই থাবড়া মারব। এখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক।
বিশ্বমামা ছুটে গিয়ে পাথরটা টেনে তুললেন। তারপর ভালো করে না-দেখেই সেটা ছুড়ে ফেলে দিলেন নদীর জলে!
বিলুদা আঁতকে উঠে বলল,—এ কী, তুমি ফেলে দিলে?
বিশ্বমামা বললেন,—বেশ করেছি। আমার জিনিস, আমি যা খুশি করব। এখন বাড়ি চল, খিদে পেয়েছে।
বিলুদা বলল,—ওঃ, ওটা সোনা ছিল না। যা চমকে দিয়েছিলে? ওটা কী ছিল বলো না?
বিশ্বমামা ওর কথার উত্তর দিলেন না।
হাঁটতে হাঁটতে আপন মনে বললেন,—ঘাসের ডগায় একটি শিশির বিন্দু। আলো পড়লে হিরের কুচির মতন ঝকঝক করে। ভোর বেলা গাছের পাতায় প্রথম সূর্যের আলো ঠিক সোনার মতন দেখায়। আসল হিরে বা সোনার চেয়ে কি তা কম সুন্দর?