সুবর্ণরেখা
শেষ পর্যন্ত সেই অসম্ভবই সম্ভব হল। সঞ্জয় আর চৈতালী স্বপ্নেও ভাবেনি কলকাকলিতে ময়নাকে ভর্তি করা সম্ভব হবে। কেজি ওয়ান বা টুতে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করার জন্য কত হাজার হাজার বাবামায়েরা যে ধর্না দেন, তার ঠিকঠিকানা নেই। ওখানে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করার চাইতে লটারিতে দুপাঁচ লাখ টাকা প্রাইজ পাওয়া অনেক সহজ।
কলকাকলি স্কুলটি সত্যি ভালো। লেখাপড়া ছাড়াও নাচগাননাটকডিবেটকুইজ সারা বছর ধরে চলছে। এর উপর আছে খেলাধূলার অফুরন্ত সুযোগ। ক্রিকেটহকি ফুটবলবাস্কেটবলটেনিসব্যাডমিন্টন ছাড়াও যোগব্যায়াম। ছোট বড় দুটি অডিটোরিয়াম। কি বিশাল লাইব্রেরি! রিডিং রুমে প্রত্যেকের আলাদা চেয়ারটেবিল। সব চাইতে বড় কথা, একবার ভর্তি করতে পারলে বারো ক্লাস পর্যন্ত নিশ্চিত।
তবে হ্যাঁ, অসুবিধে একটাই। স্কুলে বাস নেই। তাছাড়া স্কুলটি শহরের এক প্রান্তে। শহরের মধ্যে হলে কি এই বিশাল এলাকা নিয়ে স্কুল হতে পারতো? কলকাতার স্কুল বাড়িগুলো যেন সরকারি ও সওদাগরী অফিসের ঢংএ তৈরি। প্রাণহীন, বৈশিষ্ট্যহীন, ইটকাঠ, লোহালক্কড় দিয়ে তৈরি একটা জেলখানা। যে কোনো একটা বাড়িতে কিছু ছেলেমেয়েকে কয়েক ঘণ্টা বন্দী রাখলেই কী স্কুল হয়।
সঞ্জয় আর চৈতালী শুধু খুশি না, অত্যন্ত নিশ্চিন্ত।
সঞ্জয় ফ্যাক্টরি থেকে ফিরে কফি খেতে খেতে বলল, তবে চৈতি, তোমার ঝামেলা বাড়ল। আমি তো সাত সকালে বেরিয়ে যাই। ময়নাকে পৌঁছে দেওয়া, নিয়ে আসা তোমাকেই করতে হবে।
মেয়েকে ভালো স্কুলে পড়াতে হলে এটুকু কষ্ট তো করতেই হবে।
একটু ভেজা তুলায় স্কিন লোশন মাখিয়ে আলতো করে মুখে দিতে দিতে চৈতালী আবার বলে, গিরিবালা সংসারের কাজকর্ম ঠিকঠাক করতে পারলেও ওকে দিয়ে তো মেয়েকে অত দূরে পাঠাতে পারব না।
সঞ্জয় কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলে, সে তো একশ বার। তাছাড়া একে ওর বয়স হয়েছে, তার উপর চোখ খারাপ।
সঞ্জয়ের ফ্যাক্টরি বজবজে। আটটার আগেই ওকে ফ্যাক্টরিতে পৌঁছতে হয়। ঠিক পৌনে সাতটায় অফিসের গাড়ি আসে। তারপর গলফ ক্লাব আর যোধপুর পার্ক থেকে আরো দুজনকে তুলে নিয়ে সোজা বজবজ! ফ্যাক্টরির ছুটি চারটেয় কিন্তু সাড়ে পাঁচটা ছটার আগে সঞ্জয় ফ্যাক্টরি থেকে বেরুতে পারে না। মোটামুটি সাতটা নাগাদ বাড়ি ফিরে আসে।
ময়নার স্কুল সাড়ে আটটা থেকে সাড়ে এগারোটা। চৈতালী ওকে পৌঁছে দিয়ে আর বাড়ি ফিরে আসে না। ট্রামবাস পথঘাটের যা অবস্থা! ঐ সময়টুকু ও স্কুলেই কাটিয়ে দেয়!
প্রথম দিকে চৈতালী লাইব্রেরি বিল্ডিং এর পেছন দিকে কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় একটা গল্পের বই পড়েই ঐ সময়টুকু কাটিয়ে দিত। তবে এখন আর গল্পের বই নিয়ে যাবার দরকার হয় না। ওর মতো অনেক ছেলেমেয়েদেরই মায়েরা ঐ সময়টুকু স্কুলেই কাটিয়ে দেন। তাদের অনেকের সঙ্গেই এখন ওর বন্ধুত্ব। হাজার হোক সবাই প্রায় সমবয়সী। তাই রোজই বেশ আড্ডা হয়। এদের মধ্যে একমাত্র মলিনাদিরই বয়স বেশি। প্রায় চল্লিশবিয়াল্লিশ হবে কিন্তু মেয়েদের আড্ডার আসরে বয়সটা কোনো ব্যাপার না। তাছাড়া ওর মতো আড্ডাবাজ ফাজিল মহিলা সত্যি সুর্লভ। রেখা হাসতে হাসতে বলে, কলেজইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় সবাই আমাকে ফাজিল বলতো কিন্তু তোমার সঙ্গে আড্ডা দিয়ে দেখছি, আমি ফাজলামির অআ কখও শিখিনি।
মলিনাদি হাসতে হাসতে বলেন, তোরা তো নেহাতই শিশু। এখন ফ্রয়েড সাহেব এলেও অনেক কিছু শিখিয়ে দিতে পারি।
সত্যিই তাই। ছেলেমেয়েদের চোখ মুখ দেখেই উনি কত কি বুঝতে পারেন। এইতো সেদিন মানসীকে দেখেই বললেন, হ্যাঁরে, কাল স্বামীর সোহাগ পেয়েছিস, তাই না?
মানসী প্রথমে স্বীকার করতে চায়নি কিন্তু মলিনাদির সঙ্গে কী ও পেরে উঠতে পারে? শেষ পর্যন্ত ঠিকই স্বীকার করেছে। আবার একদিন শীলাকে দেখেই উনি বললেন, হ্যাঁরে, কাল বরের সঙ্গে ঝগড়া করেছিস?
আমি ঝগড়া করিনি; ও ঝগড়া করেছে।
ঐ একই ব্যাপার। মলিনাদি একটু চাপা হাসি হেসে বললেন, আমার ঠাকুমা কি বলতেন জানিস?
শীলা বিন্দুমাত্র ভাবাবেগ প্রকাশ না করে ওর দিকে তাকায়।
ঠাকুমা বলতেন, পুরুষের রাগ বাসী হতে দিতে নেই। রাত্তিরের মধ্যেই সব ঝগড়া ঝাটি মিটিয়ে ফেলতে হয়। এবার মলিনাদি একটু হেসে শীলাকে বলেন, হারে হতভাগী, রাত্তিরের ঝগড়া মিটিয়ে ফেলার মন্ত্র কি ভুলে গেছিস?
ওর কথায় শীলার মুখেও হাসি ফুটে ওঠে।
নিঃসন্দেহে কলকাকলির এই নিত্যকার আড্ডার আসরের মধ্যমণি মলিনাদি। এই আড্ডার ব্যাপারে উনি বলেন, দ্যাখ, সব সংসারেরই কিছু না কিছু ঝামেলা বা অশান্তি থাকবেই। এখানে আমরা সেসব নিয়ে একটা কথাও বলব না। এখানে আমরা শুধু প্রাণভরে আড্ডা দেব।
ইন্দ্রানী সঙ্গে সঙ্গে বলে, তোমার আজ্ঞা মানেই তো শুধু প্রেম আর ভালোবাসার
কে প্রেম করে না বা ভালোবাসে না?
ইন্দ্রানী মুখ টিপে হাসতে হাসতে বলে, অন্যদের কথা বলতে পারব না, তবে আমি কোনদিন প্রেম করিনি।
সব পুরুষের জীবনে প্রেম না এলেও সব মেয়েই প্রেমে পড়ে। মলিনাদি মুখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে বলেন, তোর এই সর্বনাশা রূপ দেখে যে কত ছেলে প্রেমে পড়েছে, তার তত ঠিকঠিকানা নেই।
কেউ আমার প্রেমে পড়েনি।
তোর রূপ দেখে আমারই তোকে জড়িয়ে শুতে ইচ্ছে করে আর…
মলিনাদির কথায় সবাই হেসে ওঠে।
এবার মলিনাদি গম্ভীর হয়ে বলেন, নে, নে, চটপট বল, কে কে তোকে জড়িয়ে ধরেছে, কে কে তোকে গাছের আড়ালে বা বাড়ির চিলেকোঠায় নিয়ে আদরটা করেছে, কে কে…
দু একজন শুধু চিঠি লিখেছিল।
ব্যস?
হ্যাঁ।
ওরে বাপু, প্রেম হাঁটে না, দৌড়োয়। শুধু চিঠি লিখে তোর মতো সুন্দরীকে ছেলেরা ছেড়ে দেবে না
সবাই ওকে সমর্থন জানায়।
সম্মিলিত আক্রমণের মুখে শেষ পর্যন্ত ইন্দ্রানী পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয় কিন্তু একটি শর্তেনামধাম বলব না, কেউ জিজ্ঞাসাও করতে পারবে না।
মলিনাদি কলিং দেন, দ্যাখ ইন্দ্রানী, মোগলাই খানাও বিনা নুনে মুখে রোচে না।
সবার চাপে ইন্দ্রানী আস্তে আস্তে সব কথা বলেপাশের বাড়ির শেখরদাকে বরাবরই ভালো লাগতো কিন্তু যাদবপুরে পড়ার সময় বিদেশ রায়ের সঙ্গেই আমার খুব ঘনিষ্ঠতা হয।…
ঘনিষ্ঠতা মানে?
যতটা ঘনিষ্ঠ হওয়া সম্ভব।
তুই তো শুধু বড়লোকের মেয়ে না, একমাত্র সন্তান। তোর পক্ষে তো সব কিছুই সম্ভব ছিল।
ইন্দ্রানী চাপা হাসি হাসতে হাসতে বলে, তা ঠিক; কিন্তু নিছক ভয়েব জন্য অনেক চুযোগেরই ষোলআনা ব্যবহার করতে পারিনি।
কে যেন প্রশ্ন করল, এখন আফসোস হয় না?
হাসতে হাসতেই এলা বলল, আমার তো ভীষণ আফসোস হয়।
এক একদিন এক একজনের প্রেমের কাহিনি শুনতে শুনতেই কেজি সেকশনের টির ঘণ্টা পড়ে। ওরা যে যার ছেলেমেয়ে নিয়ে বাড়ি চলে যান।
একদিন মলিনাদি আসরের শুরুতেই ফতোয়া জারি করলেন, আজ মানসীর পালা
মানসী এক গাল হাসি হেসে বলল, আমি আর নতুন করে কী বলব? ঐ একই ব্যাপার। একটু হাসি, একটু ইসারা। দুচারটে চিঠিপত্রের লেনদেন..
আর?
আর দুর্গাপুজোর সময় একটু এদিকওদিক ঘোরাঘুরি।
আর?
ঐ সুবর্ণরেখার ধারে পাশাপাশি বসে দুচারটে মনের কথা বলা।
মলিনাদি ঠোঁট উল্টে বললেন, ব্যস। সুবর্ণরেখার ধারে গিয়েও শুধু পাশাপাশি বয়ে থাকা! অসম্ভব।
চাপা হাসি হেসে মানসী বলল, সত্যি বলছি।
ন্যাকামি করিস নে মানসী। যে খোকাখুকু সবার চোখে ধুলো দিয়ে নির্জন সুবর্ণরেখার পাড়ে চলে যায়, তারা শুধু মনের কথা বলার পাত্রপাত্রী হতে পারে না
তিনচারজন একসঙ্গে বলল, ঠিক বলেছেন।
মেয়েরা পুরুষদের কাছ থেকে অনেক কিছু লুকিয়ে রাখে, রাখতে পারে কিন্তু মেয়ের মেয়েদের কাছে হেরে যাবেই। কেউ স্বেচ্ছায় সানন্দে নিজের জীবনের গোপনতম কাহিনি প্রকাশ করে, কেউ কেউ ঘটনাচক্রে প্রকাশ করতে বাধ্য হয়। হ্যাঁ, মানসীও স্বীকার না করে পারে নি।সঞ্জয় ছুটিতে জামশেদপুর এলেই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে এমন পাগলামি করত যে আমি কিছুতেই ঠেকাতে পারতাম না।
চৈতালী বলল, কনগ্রাচুলেশন!
রেখা জিজ্ঞেস করল, ওকে বিয়ে করলি না কেন?
ওর মা আগেই মারা গিয়েছিলেন। তারপর হঠাৎ ওর বাবাও মারা গেলেন ওদিকে সঞ্জয় যাদবপুর থেকে পাশ করেই গ্লাসগো চলে গেল। তাই আর যোগাযোগই রইল না।
.
সেদিন রাত্রে কথায় কথায় চৈতালী সঞ্জয়কে জিজ্ঞেস করল, তোমার আর জামশেদপুর যেতে ইচ্ছে করে না?
জামশেদপুর যেতে তেমন ইচ্ছে হয় না কিন্তু সুবর্ণরেখার কথা খুব মনে হয়
খুব সুন্দর নদী, তাই না?
পৃথিবীতে অনেক সুন্দর নদী আছে কিন্তু যাদবপুরে পড়ার সময় ছুটিতে বাড়ি গেলে শুধু সুবর্ণরেখার ধারে চলে যেতাম। সঞ্জয় চৈতালীর দিকে তাকিয়ে বলে, ওখানে গিয়ে যে কি আনন্দ পেতাম, তা তুমি ভাবতে পারবে না।
চৈতালী চুপ করে থাকে।
একটু পরে সঞ্জয় জিজ্ঞেস করে, তুমি সুবর্ণরেখা দেখেছ?
না, না, আমি কী করে দেখব?
চৈতালী কী করে বলবে, বৌদির মেজদার বিয়েতে ঘাটশিলা গিয়ে ছোড়দার মোটর সাইকেল চড়ে সুবর্ণরেখার আশেপাশে চলে যেত। ঐ সুবর্ণরেখার পাড়েই তো অবিস্মরণীয় আনন্দের স্বাদ পেয়েছে। সূর্যের তির্যক রশ্মির আলোয় ঐ শাল ফাঁকে ফাঁকে যে ইতিহাস ছড়িয়ে আছে, তা কী মুখে প্রকাশ করা যায়?
সে স্মৃতি শুধু অনুভবের, শুধু রোমন্থনের।