সুপার মিনিং
এই চূড়ান্ত সত্য মানুষের সীমিত জ্ঞান-বুদ্ধিকে অপরিহার্যভাবেই ছাড়িয়ে যায়। লোগোথেরাপিতে আমরা এভাবেই সুপার মিনিং-এর অর্থ দাঁড় করাই। মানুষ যা চায়, তা সবসময় পায় না। কিছু অস্তিত্ববাদী দার্শনিক তাই জীবনের অর্থহীনতাকে সহ্য করতে শেখায়। যদিও অন্যকিছু হওয়াটাই বাঞ্চনীয় ছিল। কেননা, যুক্তির চেয়ে আবেগ বেশি গভীর।
একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ যখন সুপার-মিনিং বা ‘বৃহৎ অর্থ’ ধারণার বাইরে চলে যান, তখন আগে হোক বা পরে হোক রোগীর কাছে তাকে বিব্রত হতে হয়। আমার কথাই বলি। আমার ছয় বছরের মেয়ে আমাকে একবার জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, আমরা কেন মহান প্রভুর গুণগান করি?
আমি সাথে সাথেই বললাম, ‘মাগো, কয়েক সপ্তাহ আগে তুমি হাম রোগে আক্রান্ত হয়েছিলে। তখন মহান ঈশ্বর তোমাকে সুস্থতা দান করেছেন।
আমার কথা মেয়ের মনে ধরলো না। সে সাথে সাথেই বলল, ‘ভালো, তবে বাবা, ভুলে যেও না, আমাকে হাম রোগ কিন্তু সেই দিয়েছিল।’
তবে রোগী যখন ধর্মভীরু হোন, ধর্মের প্রতি যখন তার অটল বিশ্বাস থাকে, তখন ধর্মীয় বিষয় নিয়ে সে কোনো প্রশ্ন তোলে না। তার চিকিৎসার জন্য যখন আধ্যাত্মিক জ্ঞানকে ব্যবহার করা হয়, তখন তিনি সেটি খুব সহজেই মেনে নেন। যা তার চিকিৎসার জন্য দরকারি। তাই রোগীকে চিকিৎসা করার জন্য অনেক সময় চিকিৎসককে রোগীর জায়গা কল্পনা করে নিতে হয়।
একবার আমাকেও তাই করতে হয়েছিল। গল্পটা বলছি। একবার একজন রাব্বি অর্থাৎ ইহুদি পণ্ডিত পূর্ব ইউরোপ থেকে আমার সাথে দেখা করতে আসনে। তখন তিনি আমাকে তার গল্প বলেন। তার প্রথম স্ত্রী মারা গেছে। তার ছয় সন্তানকে অশউইজের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের গ্যাস চেম্বারে হত্যা করা হয়েছিল। তারপর তিনি দ্বিতীয়বারের মতো বিয়ে করেন। কিন্তু দ্বিতীয় স্ত্রী ছিল বন্ধ্যা। তার কোলে কোনো সন্তান জন্মগ্রহণ করেনি। আমার পর্যবেক্ষণ বলে, সন্তান জন্মদেয়াই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়। তাহলে জীবন অর্থহীন হয়ে পড়তো। আর যে নিজেই অর্থহীন, সে কখনোই চিরস্থায়ী কোনো অর্থ দাঁড় করাতে পারে না। তবে রাব্বির মূল্যায়নটা ছিল একজন গোঁড়া ইহুদির মূল্যায়ন। একজন গোঁড়া ইহুদি হিসেবে তার মনে দুঃখ ছিল তার কোনো ছেলে নেই। যে তার মৃত্যুর পর তার জন্য দোয়া করবে।
তার বিশ্বাসের সাথে, দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আমার অমিল থাকলেও আমি কিন্তু হাল ছাড়িনি। আমি যথাসাধ্য ভাবে তাকে সাহায্য করতে চেষ্টা করলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, বেহেশতে তিনি তার সন্তানদের সাথে দেখা করতে চান কি না? আমি তাকে খুবই সহানুভূতিশীলতার সাথে প্রশ্ন করলাম। খেয়াল করলাম, আমার প্রশ্ন শোনার সাথে সাথেই তার চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি ঝরতে লাগলো। এবার তার দুঃখের আসল কারণ বেরিয়ে এলো। তিনি বলতে লাগলেন, তার নিরাপরাদ সন্তানদের মেরে ফেলা হয়েছে। তারা শহিদ হয়ে গেছে। এজন্য তারা বেহেশতে সর্বোচ্চ সম্মান পাবে। কিন্তু তিনি একজন বৃদ্ধ, পাপী বান্দা। তিনি নিজের জন্য বেহেশতের এত সম্মান আশা করেন না।
আমি তার উত্তরে দমে গেলাম না। বললাম, ‘আপনার ধারণা কিন্তু ঠিক নয়, রাব্বি। আপনি আপনার সন্তানদের জন্য বেঁচে আছেন। তাদের জন্য আপনার মনে যে ভালোবাসা, যে কষ্ট আছে। তা নিশ্চয় আপনার মনে যদি কিছু পাপ থেকেও থাকে, তাকে দূর করে দেবে। এভাবে আপনি আপনার সন্তানদের মতো নিস্পাপ হয়ে উঠবেন। তখন কি বেহেশতে আপনার সন্তানদের সাথে আপনার দেখ হবে না? আপনার এই কষ্টের, চোখের পানির কোনো মূল্যই কি প্রভু দিবে না? দিবে। অর্থাৎ আপনি যে এই কষ্ট করছেন, তা নিরর্থক নয়।’
আমার কথায় তিনি নতুন একটি দৃষ্টিভঙ্গি ফিরে পেলেন। ফলে এত বছর ধরে তার বুকে জমে থাকা কষ্টের পাথর নিঃশব্দে নেমে গেল।