সুন্দরী লেন
‘এত রাত হল?’
‘রোজই তোমাকে এক কৈফিয়ত দিতে আমার ভালো লাগে না। আমি পারব না দিতে।’
শেষ কথাটা যতটা সম্ভব কর্কশ গলায় বললে শিখা। পাশের বাড়ির ঘড়িতে রাত বারোটা বাজছে। সারা পাড়া নিস্তব্ধ। একটু আগে রাতের শান্তি ইঞ্জিনের শব্দে, হেডলাইটের রেখায় চিরে দিয়ে গেছে একটা ট্যাক্সি। আবার ধীরে ধীরে অন্ধকার জোড়া লেগে এসেছে। অন্ধকারে এর ওর রকে শুয়ে থাকা গোটা কয়েক ধামসা কুকুর মাঝে মাঝে গুমরে উঠছে। অন্ধকারের শূন্যতায় সময় সময় ওরা প্রেতের উপস্থিতি টের পায়।
উত্তর কলকাতার বুকের ওপর পড়ে আছে এক চিলতে লাজুক গলি। মোটেই সুন্দর নয়। তবু কোথাও এক জায়গায় রসিকতা করে নাম লিখে রাখা হয়েছে ‘সুন্দরী লেন’। বাবু কলকাতার রমরমার দিনে এই গলি যেখানে বাঁক নিয়ে বিডন স্ট্রিটে পড়ছে, সেই বাঁকের মুখে বিশাল এক বাড়ি ছিল। সেই বাড়িতে বসবাস করতেন সুন্দরী দাসী নামে এক বদান্য মহিলা। দান, ধ্যান, পূজাপাঠ, হরিনাম সংকীর্তন, মন্দির প্রতিষ্ঠা, দরিদ্র-সেবা ইত্যাদি পুণ্যকর্মের অক্ষয় স্মৃতি রেখে শতাব্দীর প্রথম দিকেই বিদায় নিয়ে চলে গেছেন। প্রথম জীবনে সেকালের কোনো এক উদারবাবুর রক্ষিতা ছিলেন। তিনিই তাঁর প্রাণের মানুষটিকে এই ইমারত উপহার দিয়েছিলেন। তখন এই অঞ্চলে এত বাড়িঘর ছিল না। গোটা তিন বাগানবাড়ি ছিল। সেসব এখন আর নেই। মাঠময়দান করে খুপরি খুপরি বাড়ি হয়েছে গায়ে গায়ে। আলো ঢোকে না। বাতাস ঢোকে না। সুন্দরী সুন্দরী দাসী একটি গলি। সেই বিশাল ইমারতের লাগোয়া। রাধামাধবের মন্দিরটি আজও আছে। টিং টিং করে আরতি হয়। সেবিকা মধ্যবয়সী একজন মহিলা। মহিলার অতীত নেই। বর্তমানে তিনি রাধামাধবের পদাশ্রিতা। এই মন্দিরের এক পাশেই সেবিকার বসবাসের ব্যবস্থা।
শিখা প্রথমে ডান পা তুলে ডান পায়ের উঁচু হিল জুতো উঁচু র্যাকে রাখল। একটা চেয়ারে বসে রুদ্র শিখাকে লক্ষ করছে। বাঁ-পায়ের ওপর ভর রেখে বাঁ-হাতে ঘরের দরজার ফ্রেম ধরে শরীরের টাল সামলাচ্ছে। ডান পা-টা উঁচু করার সময় বাঁ-পায়ের ওপর শায়া সমেত শাড়ির অনেকখানি ওপরে উঠে গেছে। ধবধবে সাদা পা বেরিয়ে পড়েছে। সুন্দর সুগঠিত পা। যে পা বাজনার তালে তালে রাতের পর রাত মঞ্চে নাচে। পায়ের ওপর যে দেহকান্ডটি সেটি নানা ছন্দে দোলে, দোমড়ায় মোচড়ায়। ডান পা নামিয়ে শিখা বাঁ-পা তুললে জুতো রাখার জন্যে। মেঝেতে শক্ত কাঠের গোড়ালির খট-খট শব্দ হল! আজ চার-পাঁচ বছর হল এই দেহ আর এই মনের সঙ্গে রুদ্র ভীষণ পরিচিত। তবু শিখার এইভাবে জুতো রাখার ভঙ্গিতে রুদ্র কাবু হয়ে গেল। বুকের আঁচল সরে গেছে একপাশে। একটা হাত তোলা থাকায় পাতলা ব্লাউজের আবরণ ভেদ করে একপাশের বুক বিদ্রোহী হতে চাইছে। ভরাট কাঁধে টান টান হয়ে আছে ভেতরের জামার ফিতে। রুদ্র জানে শরীরটাকে শিখা খুব যত্নে রাখে। শরীরটাই তার নেশা। রোজ সকালে ঘণ্টা দুই ব্যায়াম করে। আসন, ফ্রি হ্যাণ্ড, দোমড়ানো মোচড়ানো। মাঝে মাঝে কোমর আর নিতম্বের মাপ নেয়, ওজন নেয়। মুখের জন্যে আবার বিশেষ পরিচর্যার ব্যবস্থা। গরম জল, ঠাণ্ডা জল, গোলাপ জল, নানারকমের প্রলেপ। হরেক রকম দেশি-বিদেশি বইয়ের দামি দামি উপদেশ।
শিখা ঘরে এসে টেবিলের সামনে আয়নার বিপরীতে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে দেখতে কান থেকে পাথরের দুল খুলছে একে একে। মুখটা একবার ডানদিকে ফিরল, একবার বাঁ-দিকে। রুদ্র একই মুখ দুটো দেখছে। একবার আসল মুখ আর আয়নায় তার প্রতিফলন। একটা সোজা দিক আর একটা উলটো দিক। ধারালো সুন্দর মুখ। টানা টানা চোখ। সব সময় একটু রাগি রাগি। যখন হাসে তখনও যেন রাগ যায় না। প্রেমের চরম মুহূর্তেও রুদ্র লক্ষ্য করেছে কেমন যেন উদাস ভাব। ভেতরে এমন একটা কঠিন প্রাণী আছে যে ভাঙে না, গলে না, টলে না। সমর্পণ জানে না। নিবেদন জানে না। শিখার দেহের ওপর সব কিছু খেলা করে এক সময় ক্লান্ত হয়ে তারা নিজেরাই সরে পড়ে। উদাসীনতা যেন শিখার হাত ধরা। রুদ্র লক্ষ করেছে, একমাত্র শিখা যখন নিজেকে নিয়ে নিজের শরীরকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তখন তার মুখে কোমল ছায়া ঘন হয়ে আসে। দৃষ্টিতে প্রেম আসে। হাতের আঙুল দেখছে। পায়ের গোড়ালিতে পাথর ঘষছে। বুকের খাঁজে তোয়ালে চেপে ধরছে। চুল উঁচু করে ঘাড় মুছছে। চোখে সরু করে কাজল টানছে। আড়াল থেকে দেখছে রুদ্র, তখন তাকে প্রেমিক বলেই মনে হয়। চোখের মণিতে হাসির ঝিলিক।
শিখা ঘরে এসেছে। গুনগুন করে গান গাইছে। ঘরের বাতাসে ভাসছে দামি বিলিতি সুবাস। শিখাকে দেখে রুদ্রর মনে হচ্ছে মাইকেল এঞ্জেলোর তৈরি প্লাস্টার অফ প্যারিসের একটি ভাস্কর্য নীল সিল্কের শাড়ি পরে এই মধ্যরাতে মধ্য-উত্তর কলকাতার একটি ফ্ল্যাটে হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠেছে। রুদ্রর হিংসে হচ্ছে, ঘৃণা হচ্ছে। আবার ভীষণ ভাবে কাছে পেতেও ইচ্ছে করছে। বিয়ের আগে আর বিয়ের পরে যেভাবে পেয়েছিল কয়েক বছর। এখন আর উপায় নেই। দিন বদলে গেছে। প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে। অনেক বড়ো উমেদার জুটে গেছে এখন। আম কাটলে বা কাঁঠাল ছাড়ালে যে ভাবে নীল নীল ডুমো ডুমো মাছি ছেঁকে ধরে শিখার এখন সেই অবস্থা।
রুদ্র জিজ্ঞেস করলে, ‘আজ কে ছিল সঙ্গে?’
শিখার সংক্ষিপ্ত উত্তর, ‘কেউ একজন ছিল নিশ্চয়।’
‘ভালোভাবে কথার উত্তর দিতে পার না?’
‘না পারি না।’
‘দিন দিন খুব বেড়ে যাচ্ছ তুমি।’
‘দিন দিন সব কিছুই বাড়ে। বয়স বাড়ে। লোক বাড়ে।’
‘আজ খেয়েছ?’
‘খেয়েছি।’
‘কতটা?’
‘ঠিক ততটা যতটায় গা গরম হয়।’
রুদ্র চিৎকার করে উঠল, ‘শিখা!’
শিখা ঠাণ্ডা গলায় বললে, ‘ওঘরে যাও। আমি কাপড় ছাড়ব।’
‘কেন, আমার সামনে লজ্জা করছে?’
‘লজ্জা নয়। তোমাকে আনন্দ দেবার সামান্যতম ইচ্ছা আমার নেই। তুমি পাশের ঘরে যাও।’
‘যে হাজারখানেক দর্শকের সামনে উলঙ্গ হতে পারে সে আমার সামনেও পারবে।’
‘মুখ সামলে কথা বলবে।’
‘এতদিন হাত আর পা সামলে রেখেছিলুম, এবার সেটাও চলবে।’
‘চালিয়ে দেখতে পার।’
রুদ্র ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বললে, ‘চরিত্রহীন।’
শিখা সঙ্গেসঙ্গে বললে, ‘নপুংসক।’
একটা বড়ো ঘর, একটা বসার ঘর ছোটো মতো, রান্নাঘর আর তার সঙ্গেই চৌকো মতো একটা জায়গা যেটাকে ইংরেজিতে ডাইনিং স্পেস বলে বাড়িওয়ালা গৌরব বাড়াবার চেষ্টা করেছেন। বসার ঘরে তিনটে কোচ একটা সেন্টার টেবিল। টেবিলের তলায় দু-হাত বাই তিন হাত মাপের এক চিলতে কার্পেট। সংসারে শান্তি না থাক ঘর সাজাবার কেতায় যেন ত্রুটি না থাকে। আধুনিক জীবনের এই হল ধর্ম।
রুদ্র একটা কোচে বসে পা দুটো জোড়া করে সামনের সেন্টার টেবিলের ওপর টানটান করে ছড়িয়ে দিল। কী একটা ম্যাগাজিন ছিল নীচে মুখ থুবড়ে পড়ল। রুদ্র গ্রাহ্যই করল না। দু-কান দিয়ে উত্তাপ বেরোচ্ছে তার। শিখা আজকাল সুযোগ পেলেই পুরুষত্বের খোঁটা দেয়। ব্যঙ্গ করে পৌরুষ নিয়ে। এ এক নতুন কায়দা। অপদস্থ করার নতুন পদ্ধতি। মনস্তাত্ত্বিক নিপীড়ন। এই একটা জায়গায় রুদ্র হেরে যায়। শিখার সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। প্রেমিক রুদ্র ডাকাত হতে পারে না। তার ভেতরে একটা মেয়েলি ভাব আছে। নরম, কোমল। কথা বলে ধীরে। মানুষের সঙ্গে অভদ্র আচরণ করতে পারে না। শিখা এক সময় তাকে ভালোবেসেছিল এই সব গুণের জন্যেই। বলতো তোমার মুখটা কী মিষ্টি। চোখ দুটো কী সুন্দর। কোনো পাপ নেই। সেই সব দিন কোথায় চলে গেল। কত তাড়াতাড়ি সব বদলে যায়। দিনের সঙ্গেসঙ্গে মানুষের মনটাও কোথায় চলে যায়।
রুদ্র শুনতে পাচ্ছে শিখা বাথরুমে ঢুকেছে। জল পড়ার শব্দ হচ্ছে। তখন থেকেই কী একটা গান গাইছে গুনগুন করে। আজ ভীষণ ফুর্তিতে আছে। পয়সাওয়ালা প্রোডিউসার ধরেছে। মঞ্চ থেকে বাংলা ফিলম। বাঙলা থেকে হিন্দি। স্বপ্ন দেখছে শিখা। টাকা থাকলে অনেককে স্বপ্ন দেখানো যায়। রুদ্রর পয়সা থাকলে রুদ্রও দেখাতে পারত। তবে শিখাকে নয়, অন্য কাউকে। স্বামী-স্ত্রী, মা-মেয়ে, বাপ-ছেলে, পৃথিবীতে এই ধরনের কিছু সম্পর্ক আছে যার চেয়ে তিক্ত সম্পর্ক আর নেই। খুব কাছের অথচ গরলে ভরা!
শিখা বাথরুম থেকে বেরিয়েছে। ওপাশ থেকে বহুরকমের খুটখাট শব্দ ভেসে আসছে। শিখা ভুলেও একবার এ-ঘরে আসছে না। শোবার ঘরের দরজা বন্ধের শব্দ হল। রুদ্র উঠে দাঁড়াল। অসহ্য। অসহনীয় ব্যাপার। ভেবেছে কি?
ঠেলতেই দরজা খুলে গেল। পায়ের পাতায় আর গোড়ালিতে ক্রিম ঘষছে শিখা। সংক্ষিপ্ত বেশবাস। অন্য সময় হলে, দু-বছর আগে হলেও রুদ্র কী করত বলা শক্ত। তবে ঘরের আলো হয়তো নিবে যেত। একটা হুটোপাটির শব্দ। মাঝে মাঝে খিল খিল হাসি। আদরের তিরস্কার— আঃ কি হচ্ছে।
শিখার এই সব ভাবভঙ্গি আর ছলাকলা তার আর ভালো লাগে না। যখন প্রেম ছিল, ভালোবাসা ছিল তখন শিখার সব কিছু ভালো লাগত! তার তাকানো, কথায় কথায় মাইরি বলা। আচমকা পিঠে চড় মারার অভ্যাস। রুদ্র হয়তো চিঠি লিখছে আচমকা এসে হাত নাড়িয়ে দিয়ে খিল খিল হাসি। পিঠের ওপর ঝুলে পড়ে কুট করে কান কামড়ে দেওয়া।
রুদ্র বললে, ‘কী হল? খাওয়া-দাওয়া হবে না?’
গুনগুন গানের ফাঁকে শিখা খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললে, ‘আমার খাওয়া হয়ে গেছে।’
‘অ, তোমার হলেই হয়ে গেল, আমার কী হবে?’
‘খেয়ে নাও। মনুর মা তো সব চাপা দিয়েই রেখে গেছে।’
‘সব তো ঠাণ্ডা জল।’
‘গ্যাস আছে। জ্বেলে গরম করে নাও। তোমার তো পক্ষাঘাত হয়নি।’
‘কীভাবে কথা বলছ শিখা?’
‘তোমার সঙ্গে এর চেয়ে ভালোভাবে কথা বলা যায় না।’
‘আমি এতই ঘৃণ্য!’
‘অনেকটা কেঁচোর মতো।’
‘তুমি কী চাইছ শিখা?’
‘তোমার ভাষায় একটু বেশিরকম উড়তে চাইছি। হয়েছে? উত্তর পেয়েছ! যাও এখন নিজের জায়গায় যাও। আমাকে আর বিরক্ত কোরো না। আমার ঘুম পেয়েছে।’
শিখা মাথার ওপর দু-হাত তুলে শরীর মুচড়ে হাই তুলল। ইচ্ছে করে এমন একটা ভঙ্গি করল যাতে রুদ্রর শরীরে আগুন জ্বলে ওঠে।
শিখা আজকাল এইরকম করে। রুদ্র যাতে দগ্ধে দগ্ধে মরে। ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে যায়। অপমানে কুঁকড়ে থাকে। সেই দিনগুলোর কথা শিখার মন থেকে মুছে যাওয়া শক্ত। নিজের উন্নতির জন্যে, তরতর প্রমোশনের জন্যে রুদ্র শিখাকে বহুবার টোপ হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। অফিসের বড়োকর্তাকে ডেকে এক কাজের অছিলায় নিজে সরে পড়ত। খুব সোজা হিসেব। কত নোংরামিই না শিখাকে সহ্য করতে হয়েছে। তখন বড়ো অসহায় ছিল। আজ আর সেদিন নেই। আজ সে ওই নীচ, নোংরা লোকটাকে লাথি মারতে পারে। নোংরা ব্যাধিতে ভুগছে। দেহের ক্ষিদে দিন দিন বাড়ছে। মেটাবার ক্ষমতা নেই। শয়তান। শয়তান এখন সতীপনার উপদেশ দিতে আসে। চাকরি বাকরি সব খুইয়ে বসে আছে। চার-শো বিশ করে দু-এক-শো রোজগার করে। মাঝে মাঝে অপমানিত হয়, ঝাড় খায়। রুদ্রই তাকে খেলতে শিখিয়েছে। খেলাতে শিখিয়েছে। বহু পুরুষকেই সে খেলায়, রুদ্র তাদের মধ্যে একজন। আয়নার দিকে ঘুরে বসে শিখা বুকে পাউডার ছড়াতে লাগল! রুদ্র কুকুরের মতো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখুক। চেনে-বাঁধা কুকুর। লোকটা এত বড়ো পাজি শিখাকে বিয়ের পর মা-বাবাকে ভুলে গেল। ছেড়ে চলে এল। মা যখন মৃত্যুশয্যায় রুদ্র তখন শিখাকে নিয়ে গোপালপুরে ফুর্তি করছে। বৃদ্ধা যখন মারা যাচ্ছেন রুদ্র তখন প্রচন্ড মদ্যপান করে শিখার নগ্ন বুকে মুখ ঘষছে। বৃদ্ধ পিতা এখনও জীবিত। রুদ্র ভুলেও সে পথ মাড়ায় না।
রুদ্র শিখাকে আয়নায় দেখতে দেখতে বললে, ‘আজও তুমি খেয়েছ?’
‘কেন আজ ড্রাই ডে না কি?’
রুদ্র প্রচন্ড ধমক দিল, ‘শিখা!’
শিখা সুর করে বললে, ‘বাবা, বিষ নেই তার কুলোপনা চক্কর!’
‘তুমি তোমার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছ।’
‘এক সময় তুমিই তো আমার মাত্রা ঠিক করে দিয়েছিলে গুরু। দুটো বড়ো, অ্যাণ্ড ইউ লুক ভেরি সেক্সি। সেইটাই সামান্য একটু বেড়েছে। কখনো তিন, কখনো চার অ্যাণ্ড আই লুক মোর সেক্সি। এ বিট মোর সেক্সি। আমার গাল গোলাপি হয়। আমার দেহ জ্বলতে থাকে ফসফরাসের মতো। ওরা তাই বলে গো। একটু আগে শক্তি আমার ঘাড়ে মুখ ঘষতে ঘষতে তাই বলেছিল। বলেছিল আমেরিকায় জন্মালে আমি মেরিলিন মনরো হতে পারতুম।’
রুদ্র গর্জন করে উঠল, ‘কে শক্তি?’
‘ও মা! শক্তিকে চেন না। সাতটা হিট ছবির প্রডিউসার। শক্তি আমাকে নায়িকা করবে।’
‘আমি তাকে খুন করব।’
‘খুন করবে? আহা বাছারে! জেলে যাবার শখ হয়েছে গোপালের।’
শিখাকে মারার জন্যে রুদ্র তেড়ে গিয়েছিল। মাঝপথেই থেমে যেতে হল। হার্টের অবস্থা খুব খারাপ। চোখে অন্ধকার দেখছে। বিন বিন করে ঘাম বেরোচ্ছে। জিভ আর গলা শুকিয়ে কাঠ। চেয়ারের পেছন ধরে সামলে নিল। সেই অবস্থাতেই শুনতে পেল শিখা বলছে, ‘আমার মতো রোজ রাতে তোমার পার্টির পয়সায় একটু করে স্কচ খাও না গো, সঙ্গে চিকেন তন্দুর। তুমি তো লাইসেন্স পাইয়ে দিতে পার। কতরকমের লাইসেন্স। সিমেন্টের, লোহার, মদের দোকানের, গাড়ির, মেয়েছেলে নাচাবার, তোমার অভাব কীসের?’
রুদ্র ঘর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য একপা একপা করে দরজার দিকে এগোচ্ছে। চোখের সামনে সবই ঝাপসা। তারই মধ্যে দেখছে শিখা শরীরের সব কিছু খুলে ফেলেছে। কানে আসছে চটুল কন্ঠ—‘কাম, কাম মাই ডারলিং, কাম, আই অ্যাম রেডি।’
রুদ্রর মাঝে মাঝে মনে হয়, একদিন গলা টিপে শেষ করে দেয়। যখন জেগে থাকে তখন সম্ভব হবে না। বাইরে থেকে শরীর স্বাস্থ্য দেখলে মনে হবে না রুদ্র অসুস্থ। ভেতরটা একেবারে ফোঁপরা হয়ে গেছে। গেছে নিজের দোষে। মদ, সিগারেট, অনিয়ম, উচ্ছৃঙ্খলতা। স্নায়ু বলে আর কিছু নেই। একটু উত্তেজিত হলেই কাঁপতে থাকে থরথর করে। ইসিজি করিয়েছিল হার্টের অবস্থা শোচনীয়। রক্তে চিনি এসেছে। শিখা যখন ঘুম আর অ্যালকোহলে বেহুঁশ থাকে সেই সময় খুব সহজেই করা যায়; কিন্তু নিদ্রিত শিখা এমনই লোভনীয় এমনই আকর্ষণীয়, তাকালেই থমকে দাঁড়াতে হয়। মনে হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাগানে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাস্করের হাতে খোদাই করা, স্নানরতা ভেনাস, ক্লান্ত হয়ে পাথরের বেদি থেকে নেমে এসে বিছানায় শুয়ে পড়েছে।
ও ঘরের আলো নিবে গেল। জোর শব্দে দরজা বন্ধ হল। ঘরের নয়, যেন মনের দরজা বন্ধ হল। সেই শিখা আর এই শিখা! রুদ্র ভাবে, কীভাবে দিন বদলায়! চরিত্র বদলায়। শিখাকে তো সে পাপের জগৎ থেকেই তুলে এনেছিল ভালোবাসা দিয়ে। গাঁটছড়া বেঁধে নিয়ে এসেছিল প্রথমে গগন হালদার লেনের বাড়িতে। কে না জানে উন্নতির জন্যে ক্ষমতাশালী মানুষকে কিছু- না-কিছু দিতে হয়। খোদ ঈশ্বর ওই আকাশে, তেত্রিশ কোটি দেব-দেবীর বহর নিয়ে ব্রহ্মান্ড শাসন করছেন। মন্দিরে মন্দিরে তাঁর চৌকি। পেলা দাও, মানত করো, মাথা ঠোকো, উপোস করো, তবে যদি তিনি সন্তুষ্ট হন। ক্ষমতাশালী মানুষ হল নিজের এলাকার ঈশ্বর। সেই ঈশ্বরকে তুষ্ট করার জন্যে পুজো তো দিতেই হবে। যে পুজোর যে নৈবেদ্য। কোথাও মদ। কোথাও অর্থ। কোথাও একটু নারীসঙ্গ। কাজ বাগাবার জন্যে যাকে যা দেবার তা দিতে হয়।
কেন? তুমি জান না। ওই যে অত বড়ো চিত্রাভিনেত্রী, প্রতি ছবিতে যিনি এখন পনেরো লাখ টাকা ফি নেন, সেই অভিনেত্রী প্রথম কয়েক বছর কার রক্ষিতা ছিলেন? তুমি জান না! তুমি পড়োনি ফিলম ম্যাগাজিনে। এখন তিনি বিরাট মহিলা। দেশে-বিদেশে নাম। প্লেনে চেপে লণ্ডন। রয়াল অ্যালবার্ট হলে এ দেশের প্রতিনিধি হয়ে ভারতীয় কনসার্টের উদ্বোধন করেছেন। এখন তাঁর কী ভীষণ দাপট। কে আর বলতে সাহস পায়, আপনি তো এক সময় ইয়ে ছিলেন।
রুদ্র উত্তেজনায় উঠে পড়ল চেয়ার ছেড়ে। ঘরে পায়চারি করছে।
প্রথম যখন সরকারি চাকরিতে বহাল হতে গেলুম, বললে ডাক্তারি পরীক্ষা দিতে হবে। কীরকম পরীক্ষা। সরকারি সার্জেন একপ্রকার প্রায় উলঙ্গই করে ছাড়লে। নিয়ম। প্রথা। প্যান্ট নামাও বলায়, আমি প্রতিবাদ করেছিলুম শিখা। পেন্ট নামাবো মানে? বুড়ো ডাক্তার গম্ভীর মুখে বললেন, হয় যা বলছি তাই করুন নয় তো সরে পড়ুন। এই চাকরিতে ঢোকার আগে প্যান্ট খুলতেই হবে মশাই। আপনার পিতাও খুলেছিলেন। আপনার পুত্রকেও খুলতে হবে।
ওই যে সরল সরকার। সামান্য ম্যাট্রিক পাশ করে আজ কত বড়ো চাকরি করছে! গাড়ি এসে তুলে নিয়ে যায়। কী সুন্দর বাড়ি করেছে। চামরি গাইয়ের মতো বউ। কী করে হয়েছে তুমি জান না শিখা! পাড়ার সবাই জানে। সরল সরকারের বউই সরল সরকারের লক্ষ্মী। সবাই জানে সে কাহিনি। তুমিও জান। সরলের বউ একদিন সরলের অফিসে গিয়েছিল স্বামীর খোঁজে। খবর পাঠিয়ে বসে আছে ভিজিটার্স রুমে। এমন সময় কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর নির্মল সেনগুপ্ত রিসেপশনস্টিকে বোর্ডে না পেয়ে ফায়ার করার জন্যে তেড়ে বেরিয়ে এলেন নিজের বাতানুকুল অনুপম প্রকোষ্ঠ ছেড়ে। রিসেপশানে ঢুকেই সরলের বউকে একা বসে থাকতে দেখে প্রশ্ন করলেন, ‘হোয়্যার ইজ শি?’ সরলের বউ সঠিক কোনো উত্তর দিতে না পারলেও সাহস করে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বললে, ‘অ্যাজ শি ইজ ক্যারিং, শি হ্যাজ গন টু ভমিট।’
সেনগুপ্তর চোখ কান দুটোই জুড়িয়ে গেল। সরলের বউয়ের তখন ভীষণ চটক।
সেনগুপ্ত নরম গলায় বললে, ‘হু আর ইউ?’
‘সরল’স ওয়াইফ।’
ব্যস, জিনিসটা সেই দিনই জমে গেল। রিসেপশান থেকে সোজা বড়ো কত্তার চেম্বারে। সেখান থেকে বার, রেস্তোরাঁ, রেস্তোরাঁ, বার ঘুরতে ঘুরতে সোজা হোটেলে। হোটেলে নানারকম দুরূহ ইন্টারভিউ-এর পর ‘সরল’স ওয়াইফ’ সায়েবের পি.এ.। একটু বেশি খাওয়া-দাওয়ার ফলে শরীরটা ইদানীং আবার রমণীদের মতো হয়েছে। তা হোক। প্রথমে সেনগুপ্ত কবজা করেছিল, এখন মহিলা সেনগুপ্তকে কবজা করেছে। আহা, এই তো দুনিয়ার নিয়ম। গিভ অ্যাণ্ড টেক। প্রথমে মানুষ মদ ধরে তারপর মদে মানুষ ধরে। সরলের বউ চালাক, সরলও উদার। যেভাবেই হোক আমাদের বাঁচতে হবে। এ বাজারে পয়সা ছাড়া বাঁচা যায় না। তুমিও জান, আমিও জানি। সেই তো নিজের স্বার্থে তোমাকে শরীর ভাঙাতে হল। আমাদের দু-জনের স্বার্থে যখন একটা আধবুড়োকে খেলাতে বললুম, তখন এমন সতীপনা করলে পুরো পরিকল্পনাটা তো কেঁচে গেলই, আমারও বারোটা বেজে গেল।
রুদ্র এত কথা একসঙ্গে কখনো ভাবতে পারে না। ইদানীং পারছে। শিখা তার সম্পত্তি। সেই সম্পত্তি ওই এক ইম্প্রেসারিও দিনের পর দিন চোখের সামনে একটু একটু করে ভোগ করবে আর রুদ্র সব শেষে ছিবড়েটি কোলে নিয়ে, হরি দিন তো গেল করবে, তা হয় না। তা হতে পারে না। শিখাকে একদিন বলেছিল, বেরিয়ে যাও। শিখা সঙ্গেসঙ্গে বলেছিল, বেরোতে হয়, তুমি বেরোও। এ ফ্ল্যাট আমার। আমি ভাড়া দি।
এক বিছানায় বহুকাল শোয় না দু-জনে। সেই দিন শেষ উঠে চলে এসেছিল রুদ্র, যেদিন শিখা পা দিয়ে ঠেলে তার পা সরিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, তুমি কাছে এলে আমার গা ঘিনঘিন করে। মনে হয় গায়ের ওপর গিরগিটি চলে বেড়াচ্ছে।
রুদ্র বলেছিল, তুমি আমার বউ, আমি তোমার স্বামী, তুমি আমাকে লাথি মারছ, লাথি মেরে সরিয়ে দিতে চাইছ!
শিখা সেদিন একটু বেশি ঘোরে ছিল। বলেছিল, আমার লাথির দাম জান? কলকাতায় এমন লোক আছে যে আমার এক একটা লাথির জন্য হাজার টাকা দেবে। বেশি স্বামীগিরি ফলাতে এসো না। নীচে নেমে শোও। তোমার ওই আদর-টাদর অসহ্য লাগে। তোমাদের মতো খেয়ো পুরুষদের জন্য তো পাড়া আছে। পাঁচ টাকা, পাঁচ-শো টাকা সবরকমই পাবে।
রুদ্র সেই থেকে বিছানা আলাদা করে নিয়েছে।
রুদ্র হঠাৎ হেসে ফেলল। সামান্য একটা মেয়েছেলের জন্যে সে কি-না করেছে। মাকে মেরেছে। বাপকে ছেড়েছে। ভাইকে তাড়িয়েছে। অসৎ উপার্জনে উপহার কিনেছে। আর দিনের পর দিন দিওয়ানা হয়ে ঘুরেছে। ঘুরছে। না আর নয়। রুদ্র উঠে পড়ল। ক্ষিদে পেয়েছে, খেতে হবে এখন।
শিখা সংসার-টংসার দেখা অনেক কাল ছেড়ে দিয়েছে। রান্নাঘরের চেহারা দেখলে যেন কান্না পায়। এলোমেলো। অগোছালো। সব ওলট-পালট। ইঁদুর ছুটছে। টিকটিকি ঘুরছে থালার ওপর। বিশ্রী একটা আঁশটে গন্ধ ভেপসে আছে বন্ধ ঘরে। কে বলেছিলেন—সুন্দর শরীরে সুন্দর মন বাস করে! ভুল! সম্পূর্ণ ভুল কথা।
রুদ্র একটা জানলা খুলে দিল। নীচেই সুন্দরী লেন, অন্ধকারে পাক খেতে খেতে চলে গেছে আরও অন্ধকারে মাতাল পথিকের মতো। দূরে শ্যামসুন্দর মন্দির। মিটি মিটি আলো জ্বলছে এখনও। রুদ্র পথের দিকে, প্রায় ভেঙে পড়া মন্দিরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। মায়ের কথা মনে পড়ছে। শৈশব থেকে যৌবন, কত উৎপাত সহ্য করে গেছেন মহিলা। বাবাকে দেখতে পাচ্ছে চোখের সামনে, পুরোনো রংচটা একটা ছাতা বগলে, বাড়ি বাড়ি টিউশানি করে ফিরছেন বৃদ্ধ। সেই বয়েস, যে বয়েসে মানুষ ছেলের রোজগারে সামান্য শাকান্ন খেয়ে, শান্তিতে ভগবত চিন্তায় জীবন কাটাবার স্বপ্ন দেখে। ভাইটা ট্রেনে কাটা পড়ে মরেছে।
সমস্ত কিছুর জন্যে দায়ী ওই উচ্ছৃঙ্খল মেয়েটা। আর দায়ী তার কাম, তার লোভ আর ভোগবাসনা। রুদ্র ফিরে তাকাল ঘরের দিকে। সে একটা নেংটি ইঁদুর। ধরা পড়েছে শিখার ইঁদুর কলে। এই কল থেকে বেরোতে হবে মনের জোরে। শিখাকে সে মারতে পারবে না। শিখাকে সে ছাড়তেও পারবে না। এরই নাম কি ভালোবাসা!
রুদ্র স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। সামনে একটা ফালি টেবিল। এলোমেলো বাসনপত্তর। টেবিলের তলায় একটা কেরোসিনের টিন। আজ কী বার! কত সাল! রুদ্র খেয়াল করার চেষ্টা করল। বছর কীরকম ঘন, পোড়া মোবিলের মতো একটু একটু করে গড়াচ্ছে! আর কী কিছু হবে! ফিরে আসবে জীবনের সুখের দিন? অমলিন শৈশব। স্বপ্ন দেখার কৈশোর। প্রেমের যৌবন!
কে এক নিশাচর বিশ্রীরকম কাশতে কাশতে চলে গেল। দূর থেকে তার ভীষণ কাশির শব্দ ভেসে আসছে এখনও। একটু পরেই আবার সব চুপচাপ। মাঝে মাঝে সরু তারের মতো ফিনফিনে বাতাস ঢুকছে খোলা জানলা দিয়ে। একটা সসপ্যানের ওপর ইঁদুর উঠেছিল। প্যানটা নেচে উঠল। অদৃশ্য কোণ থেকে একটা টিকটিকি কিটকিট করে উঠল।
সুন্দরী লেন এখন একেবারেই অচৈতন্য। গভীর, গভীর নিদ্রায়! এমনকী আজ কুকুরগুলোও ডাকতে ভয় পাচ্ছে। রাধামাধব মন্দিরের টিমটিমে আলোটাও নিবে গেছে। সেবিকা সামনের রকে একটুকরো তেরপলের ওপর শুয়ে আছেন। আজকাল সহজে ঘুম আসতে চায় না। এপাশ, ওপাশ করতে করতে একটু যা-ও বা এল, দেখতে দেখতে ভোর। উঠে পড়ার তাগিদ।
সেবিকা শুয়ে আছেন সামনের আকাশের দিকে চোখ রেখে। সতেরো নম্বর বাড়ির জানলা খোলা। এত রাতেও আলো জ্বলছে। শিল্পীর বাড়ি। শিল্পীদের রাত নেই। মেয়েটা কোনো দিন শেষ রাতেও ফেরে। ঘুম আসে না সেবিকার। রাধামাধব! তুমি কত কি-ই না দেখালে প্রভু। এ পাড়ায় এখনও এমন মানুষ আছে যে মাঝে মাঝেই রাত নিশুতি হলে তার কাছে আসে কু-প্রস্তাব নিয়ে। সেবিকা মনে মনে হাসেন, আর তার রাধামাধবকে বলেন—বাঁশিটি আড়ে নিয়ে বাঁকা হয়ে আছ প্রভু। পৃথিবীর কিছুই তুমি দেখছ না। একেবারে এলে দিয়েছ। কোথায় মন্দিরে আসবে তোমার খোঁজে, না ছুটে এসেছে দেহের খোঁজে। মানুষের মুখে আগুন।
সতেরো নম্বর বাড়ির খোলা জানলায় আলোটা হঠাৎ খুব জোর হয়ে উঠল। বাবা এত রাতে উনুনে আগুন পড়ল! এরপর রান্নাবান্না তারপর খাওয়া! ভোর হয়ে যাবে যে রে। অভিনয় করিস বলে সবই কি অভিনয়! তেলচিটে কালো ধোঁয়া বেরুচ্ছে গলগল করে! বিশ্রী পোড়া গন্ধ। সেবিকা তেরপল ছেড়ে উঠে বসলেন, হায় ঈশ্বর! এ তো উনুনে আগুন নয়। আগুন লেগে গেছে সারা ঘরে। সাপের জিভের মতো লকলকিয়ে উঠছে। সারা ঘরে জড়াজড়ি করছে। সর্পমৈথুনের মতো। আগুনের আভায় অন্ধকার গলি কাঁপছে।
সকালেই পুলিশ এল। ওয়্যারলেস লাগানো একটা জিপ। একটা কালো ঢাকা ভ্যান। অনেক লোকলস্কর। গলিটা একেবারে ভরে গেল। অফিসার-ইন-চার্জ মন্দিরের সেবিকাকে প্রশ্ন করলেন, ‘কি হয়েছিল বলুন।’
‘আমি দেখলুম!’
‘কি দেখলেন?’
‘জীবনে যা দেখিনি। তখন অনেক রাত। কত রাত তা বলতে পারব না। ওই যে সতেরো নম্বর বাড়ি। ওই যে জানলা খোলা। এ পাড়ার সবাই ওই বাড়িটাকে বলে নাচমহল। অনেক রাত পর্যন্ত আলো জ্বলছিল। আমার তো ঘুম আসে না ভাই। এই এইখানটায় এক টুকরো তেরপল বিছিয়ে শুয়ে শুয়ে দেখছি—আলো জ্বলছে। কে একজন দাঁড়িয়ে রইল জানলায়, অনেকক্ষণ ধরে। দেখছি শুয়ে শুয়ে। তন্দ্রামতো এসেছে। হঠাৎ মনে হল চোখের সামনে একটা আলো কাঁপছে। এত আলো। তাকিয়ে দেখি আগুন। ওই ঘরটা যেন জ্বলে উঠেছে। লকলকে শিখা হিলহিল করে নাচছে সারা ঘরে।’
‘তারপর?’
‘তা আমি ভাবলুম আগুন লেগে গেছে। আগুন আগুন বলে চিৎকার করলুম। কে শুনবে। গভীর রাতে মেয়েছেলের গলা। হঠাৎ, আকাশ-বাতাস কাঁপানো আর একটা চিৎকারে আমি ভাই অবশ হয়ে গেলুম। মেয়েছেলের রাত-চেরা গলা—বাঁচাও। তারপর দেখি কী, সম্পূর্ণ উলঙ্গ একটি মেয়ে তীরবেগে ছুটে আসছে এই দিকে। আর পেছনে ছুটে আসছে দুটো জ্বলন্ত হাত, সামনে দাঁড়িয়ে জ্বলন্ত এক মানুষ। আমি এমন দৃশ্য জীবনে দেখিনি। মেয়েটা ছুটছে আর চিৎকার করছে—বাঁচাও বাঁচাও! জ্বলন্ত মানুষ প্রায় ধরে ফেলে আর কী। আমি বলছি, জয় রাধা-মাধব বাঁচাও, জয় রাধামাধব বাঁচাও। তেরপলটা তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিলুম সেই মানুষটার দিকে। পড়ে গেল। পড়ল আর উঠল না। তেরপলের তলায় ধুঁইয়ে ধুঁইয়ে পুড়ে একেবারে অঙ্গার হয়ে গেল।’
‘কোথায় সেই মেয়ে?’
‘আমার পুজোর কাপড়টা ওকে পরিয়ে দিয়েছি। সেই থেকে বসে আছে গুম মেরে। মেয়েটা পাথর হয়ে গেছে।’
এই সুন্দরী লেনের অনেক ইতিহাস।
সেই সুন্দরী দাসীর জুড়ি গাড়ির ঘোড়া একবার ক্ষেপে গিয়ে হরেন সাঁতরার মেয়েকে চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছিল। সেই মৃত্যু সুন্দরীর জীবনের মোড় ফিরিয়ে দিয়েছিল। ইতিহাসের সেই শুরু। রুদ্রের পুড়ে মরায় পাড়া আবার জেগে উঠল কিছুদিন। এ খুন, না আত্মহত্যা! থানা পুলিশ খুব হল। শেষে ঢেউ উঠল, ঢেউ পড়ল। ঘটনা হারিয়ে গেল, ঘটনার স্রোতে।
শুধু রাধামাধবের মন্দিরটি বেশ ঝকঝকে নতুন হয়েছে। পেছনের দিকে একটা থাকার ঘর হয়েছে। কেউ বলে শিখা পুলিশের ভয়ে সেবিকা কিঙ্করী হয়েছে। তা না হলে স্বামী-খুনের অপরাধে জেল হত। প্রবীণা সেবিকা বলে, ‘শিখা, যে যা বলে বলতে দে। প্রথম প্রথম অনেকেই আমাকে বলত। আমার সম্পর্কে রটিয়েছিল, ও তো একটা বেশ্যা।’
মানুষের মুখ আর নদীর স্রোত, আপনি বন্ধ না হলে বন্ধ করা যায় না।
শিখাই শুধু জানে শিখার কথা। চোখ বুজলেই সে দেখতে পায়, তার মাথার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে এক জ্বলন্ত পুরুষ। এক একবার, বাতাসের সুরে ডাকছে—শিখা, আর মুখ থেকে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসছে আগুন আর নীল ধোঁয়া। অনেকেই প্রশ্ন করেছিল—তোমার স্বামী আগুনে পুড়ছে। তুমি দেখছ। নেভাবার চেষ্টা না করে তুমি ছুটে পালালে কেন? এর নাম ভালোবাসা! শিখা কোনো উত্তর দিতে পারে না। অদ্ভুত একটা অস্বস্তি বোধ করে—রুদ্র জ্বলতে জ্বলতে তাকে আলিঙ্গনে বাঁধতে চাইছে। ভালোবাসার আলিঙ্গন নয়, মৃত্যুর আলিঙ্গন। শিখা ছুটছে। রাত্রিবাস ছিঁড়ে পড়ে গেছে শরীর থেকে।
শিখা বলতে পারে না, স্বামী কে? সবাই তো কামনার জ্বলন্ত আগুন। নারীর বিধিলিপি সেই আগুনে তিলে তিলে মরা।