সুন্দরী ঝর্ণা

সুন্দরী ঝর্ণা

ঝর্ণা নামে একটি মেয়েকে আমি চিনি এবং সে সুন্দরীও বটে। কিন্তু আজ তার কথা নয়। যদি দিন পাই আর একদিন বলব। —

সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই একটা কবিতার কলি মাথার মধ্যে ঢুকে পড়ল—ঝর্ণা ঝর্ণা সুন্দরী ঝর্ণা—

এমন আমার মাঝে মাঝে হয়। সকালবেলা কবিতার কলি মাথায় আসে, তারপর বন্দী ভোমরার মতো সারাদিন মাথার মধ্যে গুঞ্জন করতে থাকে।

পুণায় আজ এগারো দিন ধরে বৃষ্টি চলেছে, বিরাম বিশ্রাম নেই। মন নিরানন্দ। চায়ে চুমুক দিতে দিতে খবরের কাগজ পড়লাম। আনন্দদায়ক কোনও সংবাদ নেই। চীনের ড্রাগন জিভ বার করে হিমালয় পর্বতটিকে চেটে নেবার চেষ্টা করছে। কালিদাসের হিমালয়, দেবতাত্মা হিমালয়। যাক—

ঝর্ণা ঝর্ণা সুন্দরী ঝর্ণা

ভারতের দুই প্রান্তে দ্বিখণ্ডিত রাহু কেতু উচ্চকণ্ঠে ভারতের নিন্দাবাদ ও নিজেদের জিন্দাবাদ করছে। দু’দিকেই মোরগ ডাকছে—কু-ক্রুর-কু। কিন্তু সকাল হচ্ছে না।

কাগজে পূণার খবরও আছে। খড়গবৎসলার ড্যাম টৈটুম্বুর, বাঁধ ছাপিয়ে জল বইতে আরম্ভ করেছে। কিন্তু ভয়ের কিছু নেই, মিলিটারি ইঞ্জিনীয়ারের দল এসে পাহারা দিচ্ছেন।

বিশেষ চিন্তিত হলাম না। প্রতি বছরই খড়্‌গবৎসলার বাঁধ কানায় কানায় ভরে ওঠে, স্লুইস্‌ খুলে জল বার করে দেওয়া হয়। জল নিকাশের প্রধান রাস্তা মুথা নদী। মুথা নদীর খাত পুণা শহরের মাঝখান দিয়ে গিয়েছে। সারা বছর মুথার খাতে শীর্ণ জলধারা প্রবাহিত হয়, কিন্তু বর্ষাকালে খাত ভরে ওঠে; তার ওপর যখন খড়্‌গবৎসলা বাঁধের জল খুলে দেওয়া হয়, তখন মুথা নদীর চেহারা বদলে যায়, রণরঙ্গিণী মূর্তিতে উত্তাল তরঙ্গ তুলে সে ছুটতে থাকে। বাড়তি জল বার করে দেয়। পুণা শহরে মুথা নদীর ওপর তিনটি বড় বড় পুল আছে। যতই জল বাড়ক, শহরের কোনও ক্ষতি হয় না।

এগারো দিন সূর্যের মুখ দেখিনি কিন্তু আজ আকাশ যেন একটু হালকা হয়েছে। আমার বাড়ির সামনে সিকি মাইল দূরে পাহাড়ের টিলার ওপর পার্বতী মন্দির, ঝির ঝির বৃষ্টির ফাঁকে পার্বতী মন্দিরের চূড়া দেখা যাচ্ছে। হয়তো বিকেলবেলা সূর্যের মুখ দেখতে পাব।

ঝর্ণা! ঝর্ণা! তরলিত চন্দ্রিকা চন্দনবর্ণা—

ছাতা মাথায় দিয়ে মারাঠী বন্ধু এলেন। পণ্ডিত ব্যক্তি, মাঝে মাঝে আসেন, গল্পসল্প করেন, তারপর এক পেয়ালা কফি খেয়ে চলে যান। তিনি আজ পদার্পণ করতেই আমার কুকুর কালীচরণ ঘেউ ঘেউ করে তাঁকে তেড়ে গেল। কালীচরণ শান্ত প্রকৃতির কুকুর, মারাঠী পণ্ডিত তার অপরিচিত নয়। কিন্তু ক’দিন থেকে তার মেজাজ খারাপ। আমি তাকে ধমক দিলাম, ‘কেলো!’ কেলো ঘাড় গুঁজে বারান্দার কোণে গিয়ে বসল।

বন্ধুকে বললাম, ‘কেলোর দোষ নেবেন না। বৃষ্টির জন্যে বেরুতে পাচ্ছে না, তাই ওর মন খারাপ।’

বন্ধু একটু হাসলেন, ‘আমাদের সকলেরই মন খারাপ। শহরে জনরব শুনছি খড়্‌গবাস্‌লার বাঁধের অবস্থা ভাল নয়।’

বললাম, ‘সে তো ফি বারেই শোনা যায়।’

তিনি বললেন, ‘এবার একটু বিশেষত্ব আছে। খড়্‌গবাস্‌লার বাঁধ থেকে কয়েক মাইল দূরে আর একটা কাঁচা বাঁধ কিছুদিন আগে তৈরি হয়েছে, উদ্দেশ্য গ্রীষ্মকালে খড়্‌গবাস্‌লার জলে টান পড়লে ওখান থেকে জল আনা চলবে। নতুন বাঁধের নাম—পানশেট্। এই পানশেট্ ড্যাম যদি ভাঙে তার সমস্ত জল এসে খড়্‌গবাস্‌লার ড্যামে ঠেলা মারবে।’

যদি ঠেলা মারেই আমরা কি করতে পারি। মানুষ নিজের সুখ-সুবিধার জন্যে নগর গড়ে তোলে, প্রকৃতি তিন মিনিটের ভূমিকম্পে ধূলিসাৎ করে দেয়। কেউ কিছু করতে পারে কি?

মারাঠী বন্ধু কফি খেয়ে ছাতা মাথায় দিয়ে চলে গেলেন।

ঝর্ণা ঝর্ণা সুন্দরী ঝর্ণা—

বেলা এগারোটার সময় তিনটে জেট্ প্লেন মাথার ওপর তিন-চারবার চক্কর দিয়ে চলে গেল। পুণা পশ্চিম ভারতের সামরিক কেন্দ্র; প্রায় রোজই জেট্ প্লেন উড়তে দেখি; কিন্তু আজ যেন ওদের ওড়ার একটা উদ্দেশ্য আছে।

জেট্ প্লেনের কর্ণবিদারী মেঘনাদ মিলিয়ে যাবার পর একটি অটো-রিক্‌শ এসে বাড়ির সামনে থামল। আমার বারো বছরের নাতি লাফিয়ে রিক্‌শ থেকে নামল—‘দাদা!’ তার মুখে উগ্র উত্তেজনা।

আমিও উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালাম, ‘কিরে! এত শিগ্‌গির ফিরে এলি যে!’ সে স্কুলে গিয়েছিল। তার স্কুল মুথা নদীর ওপারে।

নাতি এক নিশ্বাসে বলল, ‘বাঁধ ভেঙে জল আসছে—স্কুলে ছুটি দিয়ে দিলে বাস চলছে না—ভাগ্যিস একটা অটো-রিক্‌শ পেয়ে গেলুম, নইলে আসতে পারতুম না—ডেক্যান্ জিমখানায় জল এসে গেছে—লক্‌ড়ী পুলের ওপর দিয়ে জল বেয়ে যাচ্ছে—’

হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল, আবার বসে পড়লাম।

ঝর্ণা ঝর্ণা সুন্দরী ঝর্ণা—

কিছুক্ষণ পরে চারিদিক থেকে সমবেত মনুষ্য কণ্ঠের কলরব আসতে লাগল। তারপর দেখলাম পালে পালে মানুষ ছুটে আসছে। নদীর ধারে যাদের বাড়ি তারা পালাচ্ছে, তাদের ঘর বাড়ি ভেসে গেছে। শহরের মধ্যে পার্বতী মন্দির সবচেয়ে উঁচু জায়গা, তাই গৃহহারারা এই দিকেই ছুটে আসছে। দেখতে দেখতে পার্বতী পাহাড়ের ঢালু অঙ্গ মানুষে ভরে গেল।

দুঃসহ উদ্বেগে দুপুর কাটল। বৃষ্টি বন্ধ হয়েছে, দু’-একজন চেনা পরিচিত লোক মাঝে মাঝে খবর দিয়ে যাচ্ছে—লক্‌ড়ী পুল ডুবে গেছে…সাহিত্য পরিষৎ পর্যন্ত জল এসেছে…নদীর দু’ধারে কত বাড়ি ছিল, সব ভেসে গেছে…মানুষ গরু মোষ বানের জলে ভেসে যাচ্ছে…

একটা আধপাগলা লোক চিৎকার করছে—আসছে! মহাপ্রলয় আসছে; কেউ বাঁচবে না।—

ঝর্ণা ঝর্ণা—

বেলা চারটে থেকে জল নামতে শুরু করল। নিজের নিরাপত্তার জন্যে ভগবানকে ধন্যবাদ দিতে দিতে ভাবতে লাগলাম—আমার বাড়ি যদি নদীর ধারে হত, নাতিও যদি ঠিক সময়ে ফিরে না আসত…

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আলো নেই, অন্ধকার শহর। কালীচরণ রাস্তায় বেরোয়নি, বারান্দার কোণে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। তার মনেও বোধ হয় মহা দুযোর্গের ছোঁয়াচ লেগেছে।

এই সময় একটি ব্যাপার দেখে চমৎকৃত হয়ে গেলাম। দেখি ছোট্ট একটি কাঠবেরালি সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায় উঠছে। মনে হল, বাচ্চা কাঠবেরালি, সবাঙ্গ ভিজে, থুর থুর করে কাঁপছে। হয়তো নদীর ধারে কোনও গাছে তার বাসা ছিল, বানের জলে গাছ ভেসে গেছে, কাঠবেরালি কোনও রকমে ডাঙ্গায় উঠেছে, তারপর আশ্রয় খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসে হাজির হয়েছে।

কেলো ঘাড় তুলে একবার দেখল তারপর আবার থাবার ওপর মুখ রেখে মিটি মিটি চোখে কাঠবেরালিকে নিরীক্ষণ করতে লাগল। কাঠবেরালি এদিক-ওদিক ঘুরে শেষ পর্যন্ত কেলোর পাশে গিয়ে বসল। অন্য সময় হলে কেলো তাকে দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলত। কিন্তু আজ কেলো নির্বিকার। ওরা বোধহয় জানে, মহা দুর্যোগের সময় হিংসা করতে নেই।

গৃহিণী কাঠবেরালিকে একটু দুধ দিলেন, সে চেটেপুটে খেয়ে ফেলল।

আজকের একটা দিনে কত কি দেখলাম, কত কি অনুভব করলাম। কিন্তু মাথার মধ্যে ভোমরার নেপথ্য সঙ্গীত থামেনি। রাত্রে ক্লান্ত দেহ এবং অবসন্ন মন নিয়ে যখন শুতে গেলাম তখনও মাথার মধ্যে বন্দী ভোমরাটা গুঞ্জন করে চলছে—ঝর্ণা ঝর্ণা সুন্দরী ঝর্ণা।

৫ মাঘ ১৩৬৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *