পটলা সমগ্র ১
পটলা সমগ্র ২

সুন্দরবনের শয়তান

সুন্দরবনের শয়তান

আমাদের গোবর্ধনের মামা নকুলবাবু এখন কুমড়ো হোলসেল বিজনেসে অনেক টাকা কামিয়ে এবার কুলেপাড়ার খালধারে ওর কুমড়োর গুদামের পাশের মাঠটায় বিরাট করাত কল গড়েছে। দিনরাত কাঠ, বড় বড় গুঁড়ি চেরাই হয়। ট্রাকে করে আসে নানা মুলুক থেকে কাঠের গুড়ি, তাই চিরে নানা কড়ি-বড়গা, তক্তা বানায় ।

ইদানীং নকুলমামা কোনো কোম্পানির চায়ের পেটি বানাবার অর্ডারও পেয়েছে। লাখ লাখ টাকার কাজ।

অবশ্য শুনি এত টাকার ব্যবস্থা করেছে আমাদের পটলার কাকাই। তিনিই এই ব্যবসার পার্টনার, অর্থাৎ আমাদের পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের পটলা এবং গোবরা দুজনের আত্মীয়রাই এই কারবারের পত্তন করেছে।

আমাদের ক্লাবের মাঠের পাশে তাদের কারখানার বাতিল তক্তা ছাটল, খুঁটি ইত্যাদি দিয়ে আমরা ক্লাবঘরও বানিয়েছি একেবারে ছবিতে দেখা লগ কেবিনের স্টাইলে। রং-চং করে একেবারে ফরেস্ট বাংলোর মত ক্লাবঘর হয়েছে।

শীতের মুখ। স্কুলের সেকেন্ড টার্মিনালও হয়ে গেছে। ফুটবলের যুদ্ধ তেমন নেই আর, ইদানীং সৌরভ গাঙ্গুলীর দেখাদেখি পাড়ায় পাড়ায় বহু সৌরভ শচীন গড়ে তোলার সাধনা শুরু হয়েছে।

তাই আমাদের ক্লাবের মাঠেও ন্যাপাদা এখন টুপি মাথায় দিয়ে সাদা প্যান্ট পরে বাচ্চাদের নিয়ে ক্রিকেট কোচিং-এ ব্যস্ত।

সেদিন গোবরাই বলে—চল সুন্দরবন ঘুরে আসা যাক। দারুণ জায়গা।

ছোটকার মন মেজাজ ভালো নেই। এবার পরীক্ষায় সে নির্ঘাৎ ফেলই করবে, বিশেষ করে অঙ্কে আর ইংরাজিতে। ছোটকা বলে।

–দ্যাশের লোক ইংরেজি পড়ানোর জন্য ক্যান পাগল হইছে কইতি পারস? বিদেশির ভাষা, ক্যান মাতৃভাষা কি দোষ করছে? কটমট ভাষা–পোলাপানগোর ফ্যাল কইরাইবার মতলব, আর অঙ্ক? তুই ক’ বান্দর, বাঁশে উঠতি নামতি ক্যান যাইব? গাছ নাই, চৌবাচ্চার অঙ্ক ? চৌবাচ্চার জল কত থাকব তার জন্য এত হিসাব? আর ওই এলজেবরা? বাচ্চাদের উপর টর্চার’-

ছোটকার এসব প্রশ্নের জবাব দিতে গেলেই বিপদই বাড়বে। তাই বলি—মন দিয়ে পড় ওসব দেখবি ঠিক পাস করবি।

ছোটকা বলে—পইড়া পাস করবি তরা, আমি বিজিনেস করুম। কাঠের বিজনেস! গোবরাও ইদানীং মামার কুমড়োর বিজিনেসের সঙ্গে কাঠের বিজনেসও দেখছে। গোবরা বলে— সুন্দরবনের গেঁও কাঠ-এর দারুণ ডিমান্ড। মামা তো বন ইজারা নিয়ে কাঠ আনাচ্ছে সুন্দরবন থেকে। চল বেড়িয়ে আসবি আর কেমন করে কাঠের বিজনেস করে সবাই দেখবি ।

পটলা অবশ্য এর মধ্যে বিজনেস অনেক কিছুই করেছে অবশ্য কোনটাই তার টেকেনি। সেবার গ্যাস বেলুনের ব্যবসা করে তো নিজেই গ্যাস বিমানে চেপে আকাশেই উঠে গেছল। পরে বহুৎ ঝামেলার পর ধরাধামে ফিরে আসে। আইসক্রিমের ব্যবসা করতে গিয়ে নিজেই আইসক্রিম হতে হতে রয়ে গেছল।

তবু পটলা বলে—বি-বিজনেসেই সব। ব্ বাণিজ্যে বসতি লল—পটলার জিবটা মাঝে মাঝে আলটাকরায় সেট হয়ে যায়। তোতলা বললে রেগে যায় তাই ওই ভাবেই জানাই ওকে। আমিই পাদস্ফরণ করি-লক্ষ্মী। পটলা ততক্ষণে জিবটাকে স্বস্থানে ফিরিয়ে এনে বলে—হ্যাঁ । তাই বলছি চল সুন্দরবন ঘুরে আসবি।

ফটিক গানের রেওয়াজ করছিল। সে আবার আজকালকার সঙ্গীত গায় না। বলে—ওসব শব্দদূষণ। গান হবে একেবারে প্রকৃতির মত, সহজ-সুন্দর বর্ণময়। তাই কালোয়াতিই গায় সে। আর এক একখান গান যখন ধরে সেটাকে নিয়ে বছর খানেক ধরে বমিই করবে বিকট স্বরে। বলে,

—এ সমুদ্র রে, মেরে সইয়া, স্নেহ এই দুটো কথা নে আমার। ওস্তাদজিরা ঘরানার মারফাটিয়াজি দু’ঘণ্টা সুরের জাল বুনতে পারেন। কি সুর? শুনলে পাগল হয়ে যাবি। ছোটকা বলে—তা বুঝছি। তর গান শুইনাই পাগল হই, মনে হয় তর গলা টিইপা ধরি তবেই মার্ডার করুম, তর ওস্তাদ মারফাটিয়াজির গান শুনলে মাইরা মাথা ফাটাই দিমু ! ফটিক গর্জে ওঠে—সাট্ আপ্। গুরু নিন্দা করবি না।

কোনমতে ওদের থামাতে হয়। এহেন ফটিকও বলে—চল, সুন্দরবনই ঘুরে আসি। তয় টাইগার—ওই রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখাতে পারবি?

ছোটকা গর্জে ওঠে—বাঘ দেইখা পান্টুল বাসন্তী কালার হইব ফকে! যা বীর তুই !

—কি বললি? আমি ভীতু? জানিস আমার কাকা কত বড় শিকারি? আমিও কাকার সঙ্গে বাঘ মারতে গেছি তরাই-এর জঙ্গলে। নর্থ বেঙ্গলের ছেলে আমি। আমাকে বাঘ-এর ভয় দেখাবি না। তুই তো বাঙ্গাল, শিয়ালও দেখিসনি।

ছোটকাকে থামাতে অবশ্য পটলার নগদ কিছু খসল। নেপাল দোকানের টোস্ট, ওমলেট পেতে ছোটকা বলে—ঠিক আছে। চল সুন্দরবনই যামু।

গোবর্ধন বলে—পটলা, তাহলে ক্যাশকড়ি ম্যানেজ কর। খরচা তো আছে।

পটলা এখন আমাদের কামধেনু। তাদের পরিবারের একমাত্র বংশধর। কাকার ওই সব ব্যবসার ভাবী মালিক সে। সুতরাং সে যাবে, আর কুমড়ো মামা অর্থা’ নকুলমামার ওনলি ভাগ্নে গোবরাও যাবে তাই কোম্পানি থেকেই ক্যাশকড়ির ব্যবস্থা হয়ে গেল।

সব ব্যবস্থাই হয়ে যাবে, শুধু আমাদের কষ্ট করে বডি ফেলতে হবে ওদের লঞ্চে। পটলা বলে—কাকাকে বলে সব ম্যানেজ করে নেব। তো-তোরা শুধু যাবি। ব্যস! পটলাকে নিয়েই গোল বাধে। ওই রায়বাড়ির একমাত্র বংশধর। বিরাট ব্যবসা ওর বাবা কাকাদের। কুলেপাড়া কেন কলকাতার এখানে ওখানে ছড়ানো অনেক বাড়ি, এদিকের বড় দুটো বাজার, চিংড়ি-মাছের ভেড়ি কি নেই? পটলার ঠাকুমাই গোল বাধায়—তুই সোঁদরবনে যাবি কি রে? সেখানে জলে কুমীর ডাঙায় বাঘ, না না। তোর যাওয়া হবে না। আবার কোথা কি বাধাবি? তোকে বিশ্বাস নাই ।

পটলারও ওই দোষ। যেখানেই যাবে একটা না একটা ঝামেলা বাধাবেই। পটলার ব্যাপার নিয়ে অনেক কাহিনিই লেখা হয়েছে। বিপদ, ঝামেলাও যেন পটলার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। নিজের দোষেই বিপদের জালে জড়াবে, তারপর অবশ্য এই পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের হোঁৎকা, গোবরা ফটিক আর এই অধমের ডাক পড়বে সেসব সমাধান করার জন্য।

তাই ঠাকুমা পটলাকে ছাড়তে চায় না।

এদিকে পটলাও জেদ ধরে—ক-কেন যাব না? রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ঠাকুমা রেখেছ বাঙালি করে, ম্ মানুষ করোনি।

পটলার কাকাই বলে—তা সত্যি মা, এত বড় ব্যবসা করছি সুন্দরবনের কাঠ নিয়ে ও দেখেই আসুক ব্যাপারটা। হোঁৎকারাও যাবে না হয়।

হোঁৎকাসহ আমাদের ক’জনের ডাক পড়ে ঠাকুমার কাছে। ঠাকুমা আমাদের ক্লাবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। ফুটবল ফাইনাল, কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের গাইয়েদের খরচা ইত্যাদি নানা ব্যাপারে ঠাকুমাই টাকা যোগায়। তাই ঠাকুমাকে মেনে চলতে হয় আমাদের।

ঠাকুমা বলে-পটলা সোঁদরবনে যাচ্ছে, তোরাও নাকি যাবি।

হোঁৎকা বলে—ঠাকুমা, এহন অনেকেই লঞ্চ লই বাচ্চা-টাচ্চাদের লই সুন্দরবন ভ্রমণে যায়, মেলা খরচা কইরাও টুরিস্ট স্পট হইছে।

ঠাকুমা বলে—ওই ভুইফোড় ফুটানিওয়ালা বাবু, বাবুনীদের কথা ছাড়। বিপদের জায়গা, তোরা পটলাকে ওখানে যেতে না কর। তার চেয়ে কাশী বৃন্দাবন যা, দেবদেবীর ঠাঁই, তীর্থ। পটলা বলে—ক্ কাশীবৃন্দাবন তুমি যাচ্ছ যাও। বৃন্দাবন নয় সু-সুন্দরবনই যাব।

হোঁৎকাই বলে—ভয় নাই ঠাকুমা। আমার বাড়িতে পড়ার খুব চাপ দিত্যাছে, পড়ছিও। তবু আপনি কইছেন যামু ওর সাথে। ওই গোবরাদের লই যামু। দিন পনেরো ভয় নাই, নিরাপদেই ঘুইরা আসুম।

ঠাকুমা কিছুটা আশ্বস্ত হয়—তাহলে যা। তবে খুব সাবধানে যাবি। শুনলাম নকুলও যাচ্ছে? পটলার ছোটকা বলেন—হ্যাঁ মা, নকুলবাবু ওদিকের সব জানেন। হুঁশিয়ার লোক। ও সঙ্গে থাকবে। কোনো ভয় নাই। যাক পটল কদিন ঘুরেই আসুক।

সুন্দরবন এককালে কলকাতা অবধিই বিস্তৃত ছিল। লর্ডহেস্টিংস নাকি বর্তমানে যেখানে পার্কস্ট্রিট সেখানেই হরিণ শিকার করতেন। কালীঘাট তো ছিল গভীর বনের মধ্যেই। দিনের আলোয় মানুষ-জন গিয়ে পুজো দিয়ে বেলাবেলিই ফিরে আসত। পথে বাঘ, ডাকাত সবকিছুর ভয়ই ছিল।

মূলত সুন্দরবন গড়ে উঠেছে গঙ্গার অসংখ্য ব-দ্বীপকে ঘিরে। এদিকে গঙ্গা—ওদিকে ইচ্ছামতী গিয়ে মিশেছে সমুদ্রে। যশোর জেলাতেও পশর, শিবসা প্রভৃতি নদী মিশেছে। এই মোহানায় বাংলার দক্ষিণ প্রান্তে অসংখ্য দ্বীপে গজিয়ে ওঠে বনভূমি। সুন্দরবন তাই বিশালই। বর্তমানে বাংলাকে কেটে দুভাগ করা হয়েছে। তাই সুন্দরবনও পড়েছে দুই বাংলার দক্ষিণ সীমান্তে দুই দেশের ভাগে।

কিন্তু এই বাংলায় এর বিস্তার দক্ষিণ চব্বিশ পরগনাতেই। ওদিকে বাংলাদেশের ভাগে পড়েছে বেশিরভাগ সুন্দরবনটাই।

এখানে নদী-খালের জল নোনা। সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা খেলে, তাই সব জলই নোনা আর বনও গভীর।

আগে কলকাতার উপকণ্ঠ অবধি যে ভয়াল বন ছিল, ক্রমশ মানুষের বসতি বাড়ার জন্যই মানুষরা ওই বনভূমিকে কেটে নির্মূল করে দিল। গড়ে উঠল গ্রাম, গ্রামের পর গ্রাম। বিদ্যানদী-মাতলা—আর অনেক নদী খালকে ক্রমশ বাঁধ দিয়ে দিয়ে পিছু হঠতে বাধ্য করল। আর গড়ে তুলল বসত, চাষের জমি।

অরণ্যভূমিও পিছু হঠতে লাগল। এখন দূরেই সরে গেছে আদিম রহস্যময়ী সুন্দরবন। গড়ে উঠেছে আবাদ, বসতি, গঞ্জও ৷

আমাদের সেই বনভূমিতে যেতে হবে লোকালয়ের সীমা ছাড়িয়ে। এখনও যেটুকু বনভূমি আছে তাও বেশ ভয়ালই আর দুর্গম। মানুষ সেই অরণ্যে বাস করে না, করতে পারে না। দু দশ দিনের জন্য যায় কাঠ ব্যবসায়ীদের লোকজন, বড় বড় নৌকা, ছোট নৌকা—সঙ্গে লোকজন। তাদের খাবার দাবার মায় খাবার জল অবধি নিয়ে যেতে হয়। ওই বড় বড় নৌকাতে দল-বেঁধে ছোট গাং-এ নোঙর করে থাকে। আর দিনের বেলায় কাঠ কাটে, ফেরে নৌকায়। ওখানেই থাকা খাওয়া।

কাঠ বোঝাই হয়ে গেলে চলে আসে, আবার সেই আদিম অরণ্য নিজের নির্জনতাকে ফিরে পায়। কাঠ কাটতে গিয়ে বাঘের পেটে কুমিরের পেটে, না হয় সাপের ছোবলে দু’একজনকে রেখে আসে মাঝে মাঝে। না হয় গাং-এর তুফানে নৌকাডুবিতেও মরে। এসব সাধারণ ব্যাপার ওই অরণ্য জগতে।

তাই সুন্দরবনকে ভয় করে সবাই। তবু মানুষ যায় সেখানে।

নকুলমামা অর্থাৎ গোবর্ধনের কুমড়ো মামা এতকাল কুমড়োর ব্যবসা করে চেহারাটাকেও বেশ নধর সাইজের একটি কুমড়োই বানিয়েছে। ভুঁড়িটিও বেশ কুমড়োর মত গোলগাল, চোখদুটো পিটপিট করছে, দর্শনীয় বস্তু তার চোখের জোড়া ভুরু। যেন সতেজ পালং শাকের একটি আঁটি ধনুকাকারের মত। তার সঙ্গে ইয়া পাতটাঙ্গির সাইজে এক জোড়া পুরুষ্টু কাবলী বেড়ালের লেজের মত গোঁফ! গোল মুখে ওই ভুরু যুগল আর গোঁফ জোড়ার অবদান কম নয়।

চোখে নিকেলের চশমা। দেখলে মনে হবে চলন্ত পিপের উপর যেন একটা ফুল সাইজ পাকা তাল কেউ রেখেছে। আর গলার আওয়াজ। হ্যাঁ আওয়াজ বটে। যেন হাঁড়ির ভিতর থেকে কেউ কথা বলছে। ওই গোলগাল ভুঁড়িটি নানা অভিজ্ঞতায় ঠাসা। মাথাটা ছোট কিন্তু ওই মাথায় রকমারি বুদ্ধিও খেলে যায় অনায়াসেই।

নকুলমামা এসেছে পটলাদের বাড়িতে। সুন্দরবন তিনিও যাচ্ছেন। একটা নিশান জিপে করে যাব আমরা সন্দেশখালির এপারে ধামাখালি পর্যন্ত। সেখানে নকুলমামারা একটা কাঠগোলা বানিয়েছে। ঘর টরও আছে। নৌকার ডিপো। ওখানে বন থেকে মাল এনে খালাস করা হয় তারপর ট্রাকে করে কলকাতার করাতকলে কাঠ আসে।

আগে কলকাতা অবধিই নৌকা আসত সুন্দরবন থেকে, এমনকী অধুনা বাংলাদেশ যশোর খুলনা থেকে। এখনও সল্টলেকের এদিকে কেষ্টপুর খাল তার চিহ্ন হিসাবে বয়ে চলেছে। আজকের মেট্রোপলিটান বাইপাস গড়ে উঠেছে সেই খাল বুজিয়ে।

নকুলমামা জিপে আমাদের পাঁচমূর্তিকে দেখে একটু অবাক হয়। আমাদের মালপত্রও উঠছে জিপে। আমরাও হাজির। নকুলমামা বলে—তোমরাও যাবে নাকি সুন্দরবনে? এ্যাঁ-ওখানে কি করবে?

ঠাকুমা বলে—তাই বলো নকুল? বললাম কাশী বৃন্দাবন যা-তা নয় বাদাবনে যাব।

পটলার কাকা বলেন—যাক, একটু দেখেই আসুক। নকুল কাকাবাবুকে চটাতে পারে না । সেও তৎক্ষণাৎ সুর পাল্টে বলে—তাই চলুক। ব্যবসার ক্ষেত্রে নিজেদের কেউ যাওয়াই উচিত। চল দেখে আসবি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কত কষ্টে দুটো পয়সা রোজগার করছি।

নকুলমামা যে খুশি হয় নি তা বেশ বুঝেছি।

ইদানীং গোবরাও নকুলমামার উপর খুশি নয়। অবশ্য গোবর্ধনের নিজের মামা নয়, গ্রাম সম্পর্কে মামা। গোবর্ধনের নিজের মামার বন্ধু। অবশ্য গোবরা বলে—নকুলমামা এখন ফরেনেও কুমড়ো চালান দিয়ে ভালো রোজগার করছে।

নকুলমামা জিপের সামনের সিটে আলো করে বসেছে। অবশ্য নকুলমামা ঠিক ফর্সা নয় । অর্থাৎ পাকা কুমড়োর মত নয় তবে চালকুমড়োর মত কালো অঙ্গে ধুলোর প্রলেপ পড়েছে। গোঁফগুলোর রং বদলেছে, ধুলোয় রঞ্জিত। আমরা পিছনের সিটে বসে চলেছি।

হোঁৎকা বলে—ফরেনে কুমড়ো কেউ খায়? গুল মারবি না গোবরা? ফরেনে কুমড়ো এক্সপোর্ট করছে?

গোবরা বলে—হ্যাঁ। বাংলাদেশ ফরেন নয়? মামা এখন ট্রাক ট্রাক কুমড়ো এখানে এনে নৌকায় করে নদীপথে বাংলাদেশ পাঠাচ্ছে। সেখানে কত দাম জানিস ?

হোঁৎকা বলে–হঃ, এবার বুঝছি ওই নকুলমামা সুন্দরবনে কাঠই নয়—কুমড়োর চালানও দিত্যাছে, তাই আসছে ।

এককালে যে সেসব অঞ্চলে বন ছিল তা বোঝা যায়। এখনও নোনা গাং-এর আভাস মেলে, ক্রমশঃ লোকালয়ও আসে দূরে দূরে। ধু ধু মাঠ, মাঝখান দিয়ে উঁচু রাস্তাটা গেছে। বর্ষায় সারা মাঠ ডুবে যায় ।

ক্রমশ এসে পড়লাম বড়নদীর ধারে। বিস্তীর্ণ গাং, গাং নয় যেন সমুদ্রের খাড়িই, তার থেকে একটা বড় খাল বের হয়ে গেছে। এই দুই নদীর সঙ্গমে নকুলমামাদের কাঠের আড়ত, ওদিকে টিনের চালের ছাউনি দেওয়া গুদাম মত, তার পাশে কাঠের খুঁটির উপর উঁচু ঘর কয়েকটা। সিঁড়ি দিয়ে ঘরে উঠতে হয়।

সাপ আর বন্যার প্রতিরোধে এমনি উঁচু টং-এর উপর ঘর। ওদিকে ওই খালের ধারে বেশ কিছু ছোট বড় নৌকা বাঁধা, কিছু নৌকো ডাঙায় তুলে মেরামত, রং-টং করা হচ্ছে। খালের মধ্যে একটা লঞ্চও রয়েছে।

পটলা বলে—ওটা এই কোম্পানির লঞ্চ। ছোট কাকাই ওটা কিনে দিয়েছে।

নকুলমামাকে দেখেছি আসার সময় দু’একটা গ্রামের মধ্যে জিপ থামিয়ে নেমে গেছে। স্থানীয় কিছু লোকজনদের সঙ্গে কথাবার্তা কইছে। একটা লোককে তো জিপেই তুলে নিল।

কালো লোকটা–ওর গালে একটা কাটার দাগ। লোকটা আমাদের দিকে চেয়ে কি যেন বলে মামাকে। ওর চাহনিটা কেমন যেন ধূর্ত শিয়ালের মত। চোখ দুটো ট্যারা।

হোঁৎকা বলে–ট্যারা লোক সুবিধার হয় না। হালা কুনদিকে চাইছে, কারে দেখছে তা বোঝানের উপায় নাই। সঙ্গী, ওর উপর নজর রাখতি হইব। কেস্ সুবিধার বুঝছি না।

পটলা বলে—বে-বেড়াতে চলেছিস ‘এনজয়’ কর, তা না তর সব তাতেই বারুদের গন্ধ পাওয়া চাই।

গোবরা বলে—কে জানে, নকুল মামা কি যে করে। কুমড়ো কাঠ বেচতে গেলে পাইকের, মহাজন সামলাতে হয় রে। তাই ওকে নিয়েছে। বাদাবনে যেতে গেলে সাবধান হতে হয়, ওরা এখানকার লোক-তাই নিয়েছে সঙ্গে।

স্থল পথ এবার শেষ হল, এই ধামাখালি ডিপোয় এসে আমরা জিপ খালি করলাম। ওদিকে নকুলমামা তখন খুবই ব্যস্ত। লোকজন নিয়ে কাঠ-এর চালান দেখছে। সুন্দরবনে গাছ মাত্র কয়েক রকমেরই হয়। ওই দ্বীপগুলো জোয়ারের সময়, প্রায় সবই ডুবে যায় জোয়ারের জলে। নোনা জলে শাল ইত্যাদি সাধারণ গাছ হয় না।

এখানে জন্মে নাসিক্যমূল আছে এমনি সব গাছ। শিকড়গুলোর মাটি ভেদ করা তীক্ষ্ণশূল এক, দেড়ফিট দুফিট উঠে থাকে মাটির উপর। মানুষ জন পড়ে গেলে তাদের অবস্থা হবে ভীষ্মের শরশয্যার মতই। গেঁথে যেতেও পারে। ওই নাসিক্যমূল থেকে বাতাস টেনে নেয় এখানের গাছ, খাদ্য আহরণ করে ।

এই বনে তাই সুন্দরী, গরান, কেওড়া, বাইন, ধুন্দুল, গর্জন প্রভৃতি গাছই হয়। আর হয় হলুদ কালো হিতালের বন, কিছু গোলপাতার গাছও হয়। নারকেল গাছের মত ছোট ছোট ফলও হয়, ভিতরে জল থাকে। এই গোলপাতা দিয়ে ঘরও ছাওয়া হয় আবাদ অঞ্চলে।

বাইন কাঠের ছোট ফালি তক্তা দিয়ে চায়ের পেটি তৈরি হয়। ওই কাঠের চাহিদাও বেশি। গরান কাঠও মজবুত, এর ছাল এর ‘কাথ’ চামড়া ট্যান করতে লাগে। আর গরান কাঠে ব্রাশ এর হাতল আরও নানা কাজে লাগে। ধুন্দুল কাঠ লাগে উডপেন্সিল তৈরির কাজে। কাঠের চাহিদাও প্রচুর।

নকুলমামা এদিক ওদিক ঘোরে নিজের কাজেই ব্যস্ত সে। আমরা নতুন এসেছি, কোথায় থাকব বনে যাবার কি হবে, খাওয়াদাওয়ার কি হবে এসবের কথা ভাবার সময় তার নাই। পটলাকে বলি—এসব কি রে?

পটলাও চটে উঠেছে। ওদিকে কাঠের ঘরে তক্তাপোশে বসে একজন লোক খাতাপত্র লিখছিল, আমাদের মা মরা বাছুরের মত অসহায় ভাবে এদিক ওদিক ঘুরতে দেখে সেই বের হয়ে আসে।

পটলাদের বাড়িতে সে কয়েকবারই এসেছে। তাই দেখেই চিনতে পারে। সেই-ই এগিয়ে আসে—আসুন, আসুন ছোটবাবু, শুনছিলাম বটে আপনি বেড়াতে আসবেন। তা নকুলবাবু তো কিছু বলেননি। আমিও ঘরে কাজ করছিলাম। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন, আসুন ঘরে আসুন। চা-টা খান, তারপর থাকার ব্যবস্থা করছি।

তখন বৈকাল নামছে। দুপুরে খেয়েদেয়েই বের হয়েছি। অবশ্য দীর্ঘ পথের ঝাঁকানিতে সে সব উধাও হয়ে গেছে। লোকটি নিজেই নিজের পরিচয় দেয়- আমার নাম মদন নস্কর।

এখানের কাজকম্মো দেখি। হামিদ, পাকানিকে বলে আয় পাঁচখান ডবল ডিমের মামলেট আর গবার দোকানে টাটকা পাউরুটি থাকলে পাঁচখান আন, না হলে মুড়িই আনবি, সঙ্গে মণ্ডা-ফণ্ডা যা পাস। দৌড়ে যা ।

ছেলেটার বয়স বেশি নয়। আমাদের বয়সিই। কালো বেশ হৃষ্টপুষ্ট চেহারা। হামিদ দৌড়ল। মদনবাবুর ইঙ্গিতে এর মধ্যে জল এনেছে একজন। তেষ্টাও পেয়েছিল। মদনবাবু বলে—জল খান। খাবার আনছে। বাদাবন তবু তো এখন যাত্রীটাত্রী আসে বাসে কিছু মেলে, তাও সব সময়ে নয়।

এর মধ্যে হামিদই দৌড় ঝাঁপ করে ওমলেট পাউরুটি চা এসব এনেছে। চা-টা খাচ্ছি এর মধ্যে মদনবাবু উঠে গিয়ে লোকজন নিয়ে আমাদের মালপত্র ওদিকের একটা ঘরে তুলে এবার আমাদের ডেকে নিয়ে যায় ৷

উঁচু পাটাতনের উপর ঘরটা। কাঠের দেওয়াল, মেজেও কাঠের, জানলা খুললেই দেখা যায় গাং-এর বিস্তার। বিকালের সূর্য্যের রং এখন বেগুনি রং-এর ধারায় পরিণত হয়েছে।

হামিদই আমাদের দেখাশোনার কাজে লেগেছে। ছেলেটা বেশ চটপটে। এর মধ্যে বিছানা করে খাবার জলও এনেছে কুঁজোয়। এখানের অনেক খবরই দেয় সে। বাদাবনে নৌকাতেও গেছে, নিজেও নৌকা বাইতে পারে।

ঘরে থিতু হয়ে এবার বের হই আশপাশে ঘুরতে। ওদিকে বেশ লম্বা একটা গুদাম, ওখানে এদের মালপত্র থাকে, ওদিকে গিয়ে দেখি সেই কুমড়োর টাল।

গোবরা কুমড়ো বিশারদ, সেই-ই বলে—নকুলমামা দেখি এখানেও এত কুমড়ো স্টক করেছে। কাঠ আর কুমড়ো—ডবল লাভ।

হামিদ বলে—ইখানে নৌকা বোঝাই হয়ে কুমড়ো আসে বাংলাদেশ থেকে।

আমরা অবাক হই। এদেশে এত কুমড়ো তবু এত কুমড়ো আসে বিদেশ থেকেও। দেখি নকুলমামা ওদিকে নদীর ঘাটে ব্যস্ত একটা বড় নৌকা থেকে কুমড়ো নামছে।

হঠাৎ আমাদের ওখানে দেখে একটু অবাক হয় ৷

—তোমরা? এখানে ?

আমিই বলি—বেড়াতে বের হয়েছি।

—তা ভালো। ঘুরে টুরে দ্যাখো। তবে কি দেখবে? দেখার কি কিছু আছে। এই গাং আর কাদা। হ্যাঁ—গাং-এ নেমো না। জল পর্যন্ত ছোঁবে না নদীতে, যা কামটের রাজ্যি। কামট এর নামই শুনেছি।

হামিদ বলে—না-না। পানিতে নামতে দিব না বাবুদের।

নকুলমামা বলে–আর সন্ধ্যার মুখেই ফিরবে বুঝলে পটল বাবাজি। এখানে মা মনসার রাজ্যি। সব একেবারে জাত কুলীন। গোখরো-চন্দ্রবোরা-খুব সাবধান

সরে আসি। ও চায় না আমরা বেশি ঘোরাঘুরি করি। আর প্রথম থেকেই দেখছি নকুলমামা আমাদের আসার বিপক্ষেই কথা বলছে।

আমরা চলে আসতে দেখি নকুলের সেই সহচরও একটা নৌকা থেকে নেমে ওর কাছে আসে, আর আমাদের দেখিয়ে কি যেন বলছে।

শুধোই, ওই ট্যারা লোকটা কে রে হামিদ?

হামিদ বলে—ওই তো নোটন শিকারি, বাদাবনে, গাং-এর মুলুকের গুনীন। ও অনেক মন্তর তন্তর জানে। দেহবন্ধন, বনবন্ধন, বাঘের মুখবন্ধন সব। নকুলবাবুর ওই কুমড়োর নৌকা যা আসে ওইই আনে ওপার বাংলা থেকে। যা বন্দুক চালায় ও—আশমানের পাখিকে পেড়ে ফেলে। অর্থাৎ লোকটার গুণ অশেষ, আর নকুলবাবুর ও যে খুবই বিশ্বস্ত তা মনে হয়।

হোঁৎকা বলে—সে জনডিস্ মনে লয়।

হামিদ বলে–কিছু কইলেন বাবু? ও কথাটার অর্থ ঠিক বুঝতে পারেনি। হোঁৎকা বলেনা, কিছু কই নি, চল !

ওদিকে নৌকা মেরামত, রং করা হচ্ছে। খালের মাঝখানে লঞ্চটা নোঙর করা। ওতে নৌকায় করে মালপত্র নিয়ে গিয়ে তোলা হচ্ছে।

সন্ধেবেলাতে মদনবাবু ঘরে এসে বলে – আজকের রাত কালকের দিনটা এখানে থেকে কাল রাতের ভাঁটিতে বের হবেন জঙ্গলে। আমাদেরও রসদপত্র যাবে, খাবার জল যাবে। মালপত্র রেডি করে নেবে কালই।

এবার নকুলবাবুর দেখা মেলে। অর্থাৎ তার ব্যবসাপত্র সামলে এতক্ষণে লোকটার ফুরসত মিলেছে। ওর ঘরটা ওদিকে। এবার নকুলবাবু পোশাক বদলে আসে টর্চ হাতে আমাদের ঘরে। বলে—ও এখানেই থাকার ব্যবস্থা করেছে ম্যানেজার? কিন্তু এটা তো বসন্তবাবুর ঘর! এখানে তুললে? অর্থাৎ এই ঘরে তোলাটাও ওর পছন্দ হয়নি। কিন্তু ম্যানেজার মদনবাবু বলে—বসন্ত বাবুর ভাইপো ওদের তাই এখানেই রেখেছি। কাল রাতের ভাটিতেই লঞ্চ ছাড়ব ভাবছি বনে যাবার জন্য।

নকুল বলে—কাল রাতে? আমার যে এক চালান মাল আসার কথা। দুশো মণ কুমড়ো আসবে।

মদনবাবু বলে-মাল এলে লোকদের বলে যাব, তারা গুদামে রাখবে।—না-না । আমাকেই থাকতে হবে। অবশ্য আজ রাতে যদি এসে যায় মাল তাহলে গোলমাল হবে না। ট্রাকও আসবে, আজ রাতেই তাহলে মাল কলকাতায় পাঠাতে হবে ।

মদনবাবু বলে—কাল রাতে লঞ্চ না ছাড়লে বনে কাঠের কাজে যারা রয়েছে তাদের খাবার, জল-এর টান পড়বে। কাল যেতেই হবে।

ম্যানেজার চলে যায়।

নকুলবাবু এবার বলে—কেন যে বনে যাচ্ছ। এখানেই দু-চার দিন থেকে নদীর মাছ-টাছ খেয়ে কলকাতা ফিরে যাও। বনে বিপদ, কষ্ট

হোঁৎকা বলে—তার জন্য ভাবতি হইব না। এতদূর আইছি বন দেইখাই যামু।

নকুল বলে—অ! যাবেই? ঠিক আছে। শোন—এখানে বাঘ কুমির ছাড়াও ডাকাতের ভয়ও খুব। রাত বিরেতে হুট হাট বাইরে যাবে না। ঘরের মধ্যেই থাকবে।

উপদেশ দিয়ে চলে যায় মামা।

গোবরা বলে—তখন থেকে আমাদের পিছু লেগেছে কেন রে?

ফটিক বলে—আমাদের জন্য বেশি ভাবেন ভাই। হোঁৎকা কিছু বলে না।

রাতে ম্যানেজারবাবু আমাদের জন্য টাটকা পারশে মাছের ঝোল, ভেটকির কালিয়া করিয়েছে। নকুলমামা বলে–চিংড়ি পাওনি হে মদন?

মদনবাবু বলে—সকালে রামপুরে হাটে পাঠাব। আমাদের পুকুরেও দেখব।

নকুল বলে—কলকাতার বাবুদের খাওয়াও আদর করে। হবু মালিক!

পটলার উদ্দেশেই কথাটা যেন রসিকতা করেই বলেছে। আমরা চুপ করেই থাকি।

রাত নেমেছে। বাতাসে ওঠে ঢেউ-এর গর্জন।

ঝড়ো হাওয়া বয়। চারিদিক অন্ধকার। ওর মধ্যে দেখি ওদিকে নদীর ঘাটে ছায়ামূর্তির দল কি কাজে ব্যস্ত। বড় নৌকা থেকে মালপত্র নামছে। অন্ধকারেই ওরা মাল তুলছে গুদামে। হোঁৎকার ডাকে এগিয়ে আসি, জানলার বাইরে গাং-এ ওদের কাজকর্ম চলছে দ্রুতগতিতে। নকুলবাবুর চাপা কণ্ঠস্বর শোনা যায়।

–তাড়াতাড়ি মাল খালাস করে নৌকা ছেড়ে দে! হোঁৎকা বলে—অন্ধকারে কি হয় রে এখানে?

আমিও সঠিক জানি না, তাই বলি-কে জানে।

কিছুক্ষণের মধ্যে ঘাটের ব্যস্ততা কমে যায়। লোকদেরও আর দেখা যায় না। সব যেন ঘুমিয়ে পড়ে। আমাদের ঘুম নাই ।

হোঁৎকা বলে—চুপ মাইরা চল। কেসখান দেইখা আসি।

গোবরা বলে—নকুলমামা বলেছিল ডাকাতের ভয়!

হোঁৎকা বলে ওঠে—থো ফালাইয়া তর নকুলমামার কথা। চল তো।

অন্ধকারে আমরা বের হয়েছি পাঁচমূর্তির দল। ক্যাম্প-এর সবাই শুয়ে পড়েছে। নৌকাগুলো ছায়ার মত দাঁড়িয়ে আছে। হোঁৎকা এগিয়ে যায় গুদামের দিকে। দরজাটা ভেজানো।

ভিতরে কুমড়োর স্তুপ। তার ওদিকে মোমবাতি জ্বেলে নকুলবাবু উবু হয়ে বসে কুমড়ো নিয়েই নাড়াচাড়া করছে। হোঁৎকা বলে,

—ওখানে কি করতিছে?

হঠাৎ পিছনে দু তিনজন আমাদের উপর লাফিয়ে পড়ে। ওদের অতর্কিত আক্রমণে আমি ফটিক ছিটকে পড়েছি। লোক দুটো আমাদেরই ধরতে চায়। কিন্তু হোঁৎকা গোবরা আর পটলারা বের হয়েই কয়েকটা গরান-এর কাঠ হাতে তুলে নিয়েছিল। আমাদের লাঠিও ছিটকে পড়েছে। কিন্তু ওদের লাঠির আঘাতেই আক্রমণকারীরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে ।

ওরা বেদম পিটছে লোকদুটোকে। তারাও বিপদ বুঝে সরে পড়ে। এবার ছাড়া পেয়ে আমরা সরে আসি নৌকার পিছনে। দেখি নকুলবাবুও ওই শব্দে বের হয়ে আসে। কাকে যেন বলে –কি ব্যাপার? গোলমাল শুনছিলাম ?

সেই নোটনই বলে-কারা যেন এদিকেই এসেছিল? গুদামের দরজায় দেখলাম। —সেকি! কারা? ধরতে পারলি না তাদের? নকুলবাবু গর্জে ওঠে। —সব পালালো ! নকুলবাবু বলে—চারিদিক নজর রাখ! তখনই বলেছিলাম, হুঁশিয়ার থাকবি। কি যে করিস ? আমরাও ততক্ষণে ব্যাপারটা কিছুটা অনুমান করে নৌকার আড়াল দিয়ে হামাগুড়ি মেরে এদিক ওদিক ঘুরে এলে নিজেদের ঘরে ঢুকেছি।

গোবরা বলে—কিছু একটা ব্যাপার আছে।

হোঁৎকা বলে—গন্ধ আমিও পাইছি। তয় ঠিক বুঝতে পারছি না। নজর রাখতি হইব ওই মামার উপর। গোবরা ও তর শকুনি মামা রে। শোন, লাঠিগুলান সাথেই রাখ, কাজে দিব।

শুয়ে পড়ি। রাত তখন বারোটা বেজে গেছে। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। ঘরের মেঝেতে ঢালা ফরাস পাতা। তাতেই পাঁচজন শুয়েছি। দিন ভোর ধকল গেছে, রাতেও, শুতেই ঘুমিয়ে পড়ি।

হঠাৎ মনে হয় ঘরের মধ্যে ছায়ামূর্তির পদধ্বনি। চোখ মেলে দেখি অন্ধকার ঘরের দরজাটা খোলা। হাওয়া ঢুকছে আর এদিকে কাঠের মেঝের উপর কাদের পায়ের শব্দও শোনা যায় মনে হয়, আমাদেরই কেউ উঠেছে বোধ হয়। তারপরই দেখি ধস্তাধস্তি চলেছে। পটলাকেই ধরেছে ওরা।

একজন বলে-এটাকেই তুলে নে চল কর্তার হুকুম।

পটলার মুখ চেপে ধরেছে ওরা। হোঁৎকা—গোবরা ওদিকে ঘুমুচ্ছে। আমিও ব্যাপার দেখে চুপচাপ বের হয়ে গিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে শিকল তুলে দিয়ে চিৎকার করতে থাকি। -চোর-চোর-ডাকাত-ডাকাত!

ক্যাম্পের লোকজন জেগে উঠেছে। ওদিকে ঘরের মধ্যে বন্দী লোকদুটোও এবার ব্যাপার বেগতিক বুঝে শিকার ফেলে পালাতে চেষ্টাই করে, কিন্তু ততক্ষণে ভিতরে হোঁৎকা, গোবরাও জেগে উঠেছে। হাতে তাদের লাঠি-ছায়ামূর্তি দুটোকে তারাও দুচার ঘা কসেছে।

বাইরেও লোকজনের গলা পাওয়া যায়। বন্দী লোকদুটো এভাবে জালে পড়বে ভাবতে পারেনি। তারা মরিয়া হয়ে জানলার দিকে ছুটে যায়। পলকা জানলার শিক-ওদিকে পিঠে তখন লাঠিও পড়ছে, বাইরেও মাঝি বাওয়ালিরা ছুটে আসছে। তারা জানলার শিক কোনরকমে বেঁকিয়ে ওরই ফাঁকে গলে নীচে লাফ দিয়ে পড়ে গাং-এর দিকে দৌড়াল।

পিছনে কে তাড়া করে –ধর, ধর !

দরজা খুলে এবার আমি ওদের বাইরে আনি। চোরদের ধরা যায় না। অন্ধকারে প্রাণের দায়ে দৌড়ে তারা তখন পগারপার।

ম্যানেজারও এসে পড়ে। এর কিছুক্ষণ পর নকুল মামা গোলগাল শরীর নিয়ে এসে হাজির হয়—কি ব্যাপার?

ম্যানেজার গর্জাচ্ছে—ধরতে পারলি না ওদের?

হামিদ বলে—দৌড়ালাম পিছু পিছু কোথায় সটকে গেল।

নকুলমামা এবার মুখ খোলে। ধরতে পারলি না? অকম্মার দল। আমাদের বলে—বলিনি,

এসব ডাকাতের রাজ্য। ঘরে এসে হানা দেয়। সাবধানে থাকবে।

নকুলবাবু আবার উপদেশ দিয়ে চলে যা-

বাকি রাতটা ঘুমোতে পারি না। হোঁৎকা বলে–পটলকে তুলে নিতে আইছিল ওরা? আমি জানাই—তাই মনে হল।

হোঁৎকা বলে—নাটক জমছে। তয় শেষ দেইখা ছাড়ুম। দেখি কোথাকার জল কোথায় গড়ায়।

ফটিক বলে—ভেবেছিলাম শান্তিতে একটু আলাপ করব রাগ রাগিণীর, যা শুরু হল প্রথম থেকে গান মাথায় উঠবে মনে হচ্ছে।

হোঁৎকা বলে—তুই গান গা। তর ওই ‘মেরি সঁইয়া’ ওই গান পইচা গেছে। অন্যগান গাইবি কয়ে দিলাম।

দিনটা ভালোই কাটল।

মদনবাবু আমাদের দিকে এবার বিশেষ নজর রেখেছে। দুপুরে খাওয়া দাওয়া ভালোই হল। সামনেই নোনা জলের পুকুর হামিদই জাল ফেলে তাজা পারশে, ভেটকি, বাগদা চিংড়ি ধরে। নকুলমামা বলে—হ্যাঁ। চিংড়িটা ভালোই রেঁধেছ পাকানি। দাও, বাবুদের দাও। কলকাতায়

এ জিনিস মেলে না। খাও—ওর কথার স্বরেও বিদ্রূপের ছোঁয়া।

বৈকালে বের হয়েছি। ওদিকে ডিঙিগুলো রাখা, দেখি ওই নোটনও সেখানে রয়েছে। আমাদের দেখে বলে—আজ রাতেই বের হবেন তো!

—হ্যাঁ।

নোটন বলে—তারই ব্যবস্থা করছি। অ্যাই ডিঙি মজুত রাখবি। বাবুদের লঞ্চ তুলে দিতে হবে।

ওদিকে নৌকা ঘাটায় বড় বড় জালায় টিউবওয়েলের জল তোলা হচ্ছে। বনের মধ্যে যারা কাজ করছে তাদের জন্য চালের বস্তা, ডাল, সরষের তেলের টিন, মায় পেঁয়াজ লঙ্কা, কুমড়ো-মুলো এসব উঠছে। তামাক-বিড়ির পেটি, নানাকিছু নিয়ে যেতে হয়। সেখানে কিছুই মেলে না। সেইসব মাল তোলা হচ্ছে নৌকায় ।

হঠাৎ ওদিকে একটা লোককে দেখে চাইলাম। কপালে তাজা ক্ষত, তাতে চুন লাগানো, লোকটা লেংড়ে হাঁটছে। হঠাৎ আমাদের দেখে সে নৌকার আড়ালে বসে পড়ল আমাদের দৃষ্টি এড়াবার জন্যই।

আমিই এগিয়ে যাই, লোকটাকে যেন কাল রাতে দেখেছি, কিন্তু নৌকার ওখানে গিয়ে আর দেখা পাই না। হোঁৎকা বলে—ওখানে কি করস অ্যাই সমী?

এসে বলি—ওই লোকটা কাল ঘরে ঢুকেছিল। মাথায় লাঠির ঘা পায়েও চোট আছে। —তাই নাকি !

-কিন্তু কোথায় পালালো নৌকার আড়ালে।

গোবর্ধন বলে—বুঝলি ভূত এই সরষের মধ্যেই রয়েছে।

হোঁৎকা বলে–ধরতে পারলে ভূতের বাবার পাত্তাও বাইর করুম। কিন্তু ধরাই গেল না তাকে।

সন্ধ্যার পরই বের হবার তোড়জোড় শুরু হয়। লঞ্চটা খাল-এর ভিতরে গভীর জলে রয়েছে। ওখানে আমাদের জন্য তোষক, কম্বল, বালিশ সব পাঠানো হয়েছে। খাবার-দাবারও তোলা হয়েছে। সাত দশদিন থাকতে হবে লঞ্চে। তার জন্য সবই নিতে হয়েছে।

এবার আমরা গিয়ে ওই লঞ্চে উঠে শুয়ে পড়ব। ভাঁটা আসবে মাঝরাতে। তখন যাত্রা শুরু হবে।

নকুলমামা তখন ব্যস্ত। বলে—তোমরা লঞ্চে উঠে আরাম করে শুয়ে পড়ো। আমি এদিকের সব ঝঞ্ঝাট সামলে লঞ্চে উঠব। ছাড়ার মুখে কত কাজ আমার।

এর মধ্যে ট্রাকও এসে গেছে মামার। নিজে ওই নোটন আরও কিছু লোকজন নিয়ে ট্রাকে কুমড়ো তুলছে। মাঝে মাঝে হাক পাড়ে – সাবধানে লোড করবি কুমড়ো। বড়গুলো নীচে দে। নিজে ট্রাকে উঠে কুমড়ো বোঝাই করা দেখছে। মধ্যে ম্যানেজার মদনবাবুও নিজে থেকে কিছু কুমড়ো তুলে দেয়। নকুলমামা বলে— সাবধানে নে যাবি। আর কলকাতার আড়তের সরকার বাবুকে বলবি এই লটের কোনো মাল আমি না ফেরা অবধি বেচা যেন না হয় ।

মদন অর্থাৎ ম্যানেজার বলে–আপনি নিশ্চিন্তে বলে যান। এই চালানের সঙ্গে আমিই যাব কলকাতায়। সরকারকে সব বলে কয়ে আসব। ভাববেন না।

লোকটা খুবই কাজের। এত বড় কাঠের কারবার, এত নৌকা, তার মাঝি, কাঠুরিয়াদের সে একাই সামলায়। আমাদের জন্যও সব ব্যবস্থা নিখুঁত করে রেখেছে।

ভাটার টান। গাং-এর জল অনেক নীচে নেমে গেছে। এখন এক হাঁটু কাদা ভেঙে ডিঙিতে উঠতে হবে। সেই ডিঙি নিয়ে যাবে আমাদের লঞ্চে। শীতের রাত। কাদাও ঠান্ডা বরফ, জলও। পটল বলে—কাদা ভেঙে যেতে হবে ?

নকুলমামা বলে—কি হে ম্যানেজার, কলকাতার বাবুদের নে ফ্যাসাদ হল যে। কাদা ভাঙবে না সুন্দরবন দেখতে যাবে?

ওদিকে কয়েকটা ডিঙি তোলা আছে, মদনবাবু বলে কি ভেবে—ওই ডিঙিতে উঠে বসুন আপনারা।

নকুলের সঙ্গী নোটনই বলে—তাই ভালো। আসেন বাবুরা। অ্যাই হামিদ তুই বৈঠা নে বোস। ওই ডিঙি ঢালু কাদায় ঠেলে দিই, গাং-এ পড়লে তুই বাবুদের নিয়ে যাবি লঞ্চে। নীচে ঘাটে হ্যাজাক জ্বেলে অন্য নৌকায় রসদপত্র উঠছে। আমরা শুকনো ডাঙায়, ডিঙিতে চেপে বসলাম। সামনে খুবই ঢালু গভীর নদীর বুক, কাদায় থিকথিক করছে।

ওরা ঠেলে নৌকাটাকে উপরে কাদার মুখে এনে জোরে ঠেলতেই নৌকাটা মহা কাদায় পড়ে গভীর ঢালু পথে তীব্র গতিবেগ নিয়ে এসে জলে পড়ে। জায়গাটা বড়নদী আর ওই খালের মোহানা। ভাটার সময়েও জল বেশ গভীর আর দুই নদীর মোহানায় তাই চোরা স্রোতও আছে। নৌকাটা তীর বেগে এসে নদীতে পড়েছে। হামিদ তখনও হাল ঠিকমত লাগাতে পারে নি, নদীর সঙ্গমে চোরা স্রোতের আবর্তে নৌকাটা ঘুরছে, দূরে লঞ্চটা দেখা যায়, এদিকে ঘাট থেকেও বেশ দূরে এসে গেছে নৌকাটা ৷

হঠাৎ আবিষ্কার করি জুতো ভিজে গেছে। নীচের দিকে চেয়ে দেখি নৌকার তলাটার কয়েকটা তক্তার জোড় খুলে আছে আর সেই পথ দিয়ে ফোয়ারার মত গাং-এর জল চারিদিক থেকে ঠেলে উঠছে নৌকায় ।

চিৎকার করি—নৌকার ফুটোয় চারিদিকে জল উঠছে। হামিদও বিভ্রান্ত। পটলা হোঁৎকা চিৎকাস করে—নৌকা ডুবছে ।

গোবরা হাঁক পাড়ে—নকুলমামা। আমরা ডুবে যাচ্ছি। নৌকা ডুবছে। গহনগাং, কুমির কামটের আস্তানা। মাঝে মাঝে কুমির এখানে ডাঙার কাছে এসে গরু বাছুরকে ল্যাজের ঝাপটায় গাং-এ ফেলে নিয়ে চলে যায় নদীর অতলে।

কামটের ঝাঁক হাড় থেকে ধারালো দাঁত দিয়ে মাংস কুরে কুরে নেয়। এখানে জলে পড়া মানেই নিশ্চিত মৃত্যু। সামনে সেই মৃত্যুর বিভীষিকা, নৌকার খোল প্রায় সিকিভাগ জলে ভরে গেছে। আর মিনিট কয়েকের মধ্যে হিমরাতে আমরাও জলের অতলে তলিয়ে যাব নৌকা সমেত।

আমাদের ডাকাডাকি চিৎকারে ডাঙার মাঝিদের খেয়াল হয়। ওরা দুদিক থেকে দুখানা নৌকা নিয়ে আসছে আমাদের ডুবন্ত নৌকার দিকে। জল তখন হাঁটুর কাছাকাছি এসে গেছে। হিমশীতল স্পর্শ, এদিকে নদীর অতল গহ্বর, ওপাশে অন্ধকার নদীর বিস্তার।

যা হোক কোনমতে ওরা দুখানা ডিঙি দুদিক থেকে এনে আমাদের হাত ধরে টেনে তোলে দুদিকের নৌকায়। আমাদের ফুটো নৌকাটা তখুনিই জলভর্তি অবস্থায় অতলে তলিয়ে গেল চোখের সামনে ।

ওই ডিঙি দুটোই আমাদের এনে লঞ্চে তুলে দেয়। তারপর থিতু হয়ে বসে এবার ওই চরম বিপদের কথাটা ভাবছি।

পটলা বলে—জো-জোর বেঁচে গেছি।

হোঁৎকা বলে—তা তো বাঁচছি, কিন্তু জাইনা শুইনা আমাগোর ওই ফুটা নৌকায় উঠতি দিল ক্যান?

প্রশ্নটা আমারও। কিন্তু এর কোনো উত্তর পাই না।

গোবরা বলে-ওরা হয়তো জানে না, ফুটো ডিঙি ওগুলো, মেরামতের জন্য তোলা ছিল। তাতেই উঠে ছিলাম।

কিন্তু আমারও কেমন সন্দেহ হয়। এসে অবধি দেখছি কেউ বা কারা বারবার আমাদের বিপদে ফেলতে চাইছে। বারবার তারা আক্রমণ করেছে আমাদের। যদিও কিছু করতে পারে নি। তাই বোধহয় জেনে শুনেই প্ল্যান করেই আমাদের শেষ করতে চেয়েছিল এই ভাবে। আমি বলি—আমারও কেমন সন্দেহ হচ্ছে হোঁৎকা। পটলা, তোদের এখানে অনেক কিছুই হয় যেটা আর কেউ দেখুক এরা চায় না। আমরা যদি কিছু দেখে ফেলি তাই পদে পদে ওরা বাধা দিচ্ছে। পটলা বলে—ক-করেকট। কিন্তু এর শেষ দেখতেই হবে সমী, হোঁৎকা ।

হোঁৎকা বলে—ক্ষুধা পাইছে। এত একসাইটেড হলি আমার ক্ষুধা পায়। কিছু খাই লই। তারপর ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করনে লাগবো। হোঁৎকা সামনে একটা পাঁউরুটি আর জেলির কৌটা দেখে সেটার সৎকারে লেগে যায়।

আমি বলি—হোঁৎকা এখন জলপথে চলেছি। সুন্দরবন বলে কথা, খাবার জল অবধি রেশন করা—বেশি খাস না ।

হোঁৎকা আমার কথায় কান দেয় না। পাঁউরুটি চিবিয়ে চলে। গোবরা ওদিকের ডেকে আমাদের বিছানার ব্যবস্থা করছে। বলি—ওরা তো গাং-এর অতলে চিরবিশ্রামের সুযোগই করে দিয়েছিল। এখানে তুই-ই কর।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। ঘুম ভাঙে লঞ্চের ইঞ্জিনের শব্দে আর লঞ্চের দোলানিতে। চেয়ে দেখি লোকালয়ের চিহ্ন আর নেই। বিশাল গাং-এর বুক চিরে লঞ্চটা চলেছে। ফিকে কুয়াশার জাল বিছানো নদী।

লঞ্চের শব্দে জলচর পাখির ঝাঁক উড়ে যায়। পুব আকাশ লালে লাল। দূরে ঘনবনের মাথায় সূর্য উঠছে। শান্ত গাং—সভ্যজগৎ থেকে আমরা দূরে সুন্দরবনের সীমানায় এসে গেছি।

লঞ্চের পিছনে বাঁধা দু তিনটে বড় নৌকা। জল, রসদপত্র বয়ে নিয়ে চলেছে বনের গভীরে

পড়ে থাকা কাঠুরিয়াদের উদ্দেশে।

পটলার ঘুম ভেঙে গেছে ছাদের উপর থেকে লঞ্চের ইঞ্জিনের ধকধক শব্দ ছাপিয়ে ভেসে ওঠে ফটিকের সেই গান—মেরে সইয়া। তিন বছর ধরে ওই এক লাইনই গাইছে। গান তো নয় যেন সুরকে ধারাল চপার দিয়ে কিমা বানিয়ে চলেছে।

পটলা লঞ্চের বাইরে চেয়ে বলে—বি-বিউটিফুল! সুন্দর।

হোঁৎকা গর্জে ওঠে—মার্ডার করুম। এক্কেবারে শ্যাষ কইরা দিমু । -কাকে? শুধোই আমি।

হোঁৎকা বলে—তগোর ওই তানসেনের বাচ্চা ফটিক সেনেরে।

এমন সময় শোনা যায় জোরালো স্বরে খোল কর্তালের বাদ্যি—তারপরই শুরু হয় একদল লোকের সুরে বেসুরে উদ্দাম চিৎকার—হরি বোল হরিবোল হরিবোল বল ভাই।

এই দূর সমুদ্রঘেষা সুন্দরবনের নির্জন ফাঁড়িতে হঠাৎ উন্মত্ত কেত্তন শুনে চাইলাম। এবার দেখি লঞ্চের সামনের সিঁড়ি দিয়ে নামছে গোল পিপের মত দেহখান নিয়ে নকুল মামা। ইয়া গোঁফ জোড়া আর পালংশাক হেন দুই ভুরু নাচিয়ে বলে—বুঝলে গুরুদেব বলেন শত কাজের মধ্যেও সকাল সন্ধ্যা নামকীর্তন শুনলে দিন ভালো যায়। অহা-সুধামাখা হরিনাম হে, শোন ।

একজন বিকট হেঁড়ে গলায় নাম করছে—হরিবোল—আর তারপরই একপাল লোক কলকণ্ঠে নাম গর্জন করে চলেছে। টেপ রেকর্ডারে বাজছে ওই নামব্রহ্ম নদীর বুক কাঁপিয়ে নকুল মামারও ভক্তির জোয়ার এসেছে। নেহাৎ শব্দদূষণের কানুন এখানে নেই। তাই রক্ষে। কিন্তু ওই নামসুধা আমাদের কাছে বিষবৎ হয়ে উঠেছে। নকুলমামা বলে—শোন, হরিনাম কানে গেলে পুণ্য হয় ।

হামিদ এর মধ্যে চা করে এনেছে, স্টকে বিস্কুট ছিল। ওই দিয়েই চা পর্ব সারি।

এবার লোকালয়ের সীমা পার হয়ে লঞ্চ ঢুকছে আদিম অরণ্য জগতে। ধু-ধু গাং, সীমা নাই । সারেং কাশেম মিঞা বলে—ওই দেখেছেন নদীর ওদিকেই বাংলাদেশ। অর্থাৎ সীমান্ত দিয়েই চলেছি আমরা।

নকুলমামা তখন চোখ বুজে পদ্মাসনে বসে নামসুধা পান করে চলেছেন ।

বড় গাং-এর বুক চিরে চলেছি। দুদিকে ঘনবন। হলুদ কালো হিজল, কেওড়া গাছ, সবুজ বাইন, গোলপাতার জঙ্গল, মাঝে মাঝে একটু ফাঁকা চরের মত দেখা যায় নদীর বাঁকে। সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ হরিণের পাল চরছে, কাছেই বনের শুরু। গাছে গাছে বাঁদরের জটলা। কেওড়াগাছের পাতা হরিণের প্রিয় খাদ্য, আর বানরগুলো ওই গাছে বসে ফল, পাতা খায়, ডালপাতা ভেঙে নীচে ফেলে হরিণগুলো তারই লোভে বানরের পালের সঙ্গেই থাকে। ওই শ্রেণীর প্রাণীদের মধ্যে একটা মিতালীর বন্ধন গড়ে ওঠে।

মাঝে মাঝে গাছের ডাল থেকে দু’একটা বাঁদর হরিণের ঘাড়ে পড়ে আর ঘোড়ার পিঠে চাপার মত ভঙ্গিতে বসে পড়ে, হরিণটাও ওকে পিঠে নিয়ে দৌড়তে থাকে। একচক্কর দৌড়ে যেন সার্কাসের খেলা দেখিয়ে হরিণের পিঠ থেকে আবার গাছের ডালে এসে বিরাজমান হয় বাঁদরটা।

লঞ্চ চলেছে। দুদিকে বনভূমি, বড় নদী থেকে একটা বড় খাল বের হয়ে গেছে। জোয়ারের জলে ফুলে ওঠে আবার ভাটার টানে তাদের বুকে জেগে ওঠে পলিকাদা, গাছগুলো নুইয়ে পড়েছে খালের উপর। সবুজ হলুদ বন, কে যেন বাগানের মত করে সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। তাই মনে হয় সুন্দরবন যেন সত্যই সুন্দর বনই।

একটা পত্রহীন গাছ দেখা যায়। মরা ডাল থেকে লম্বা লম্বা কি ঝুলছে বড় ডাঁটার মত। পাতা নেই—শুধু ওই ঝুলন্ত ডাঁটার সমাবেশ। শুধোই সারঙ্গকে—ওটা কি গাছ। এত ডাঁটা ঝুলছে মোটা মোটা ?

সারেং কাশেম মিঞার সঙ্গে এর মধ্যে আলাপ হয়ে গেছে। বয়স্ক বেশ ভদ্র মানুষ কাশেম মিঞা। ও বলে—ওটা? দাঁড়াও দেখাচ্ছি, কাশেমকে বনে বাদাড়ে ঘুরতে হয়, ওরা সঙ্গে দু দশটা চকোলেট বোমার মত পটকা রাখে।

বাদাবনের বাঘকে ভয় দেখাবার জন্যও ওটার দরকার। সেই পটকায় আগুন দিয়ে লঞ্চ থেকেই কাছাকাছি বনের দিকে ওটা ছুড়ে দেয়, আকাশে পটকাটা সশব্দে ফেটে যায়, অবাক দৃশ্য? ডাঁটাগুলো ওই আওয়াজ শুনে সজীব হয়ে ওঠে আর নিমেষের মধ্যে তারা ডাল ছেড়ে এদিক ওদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ডাল আবার শূন্যপ্রায় হয়ে যায় ৷

কাশেম মিঞা বলে—ওসব বুনো সাপ, জলে বন ডুবে যায় তখন ওই ভাবেই গাছে আশ্রয় নেয়। আওয়াজ পেতেই সব সরে গেছে ।

নকুলমামা ততক্ষণে হরিবোল-এর ক্যাসেট থামিয়ে কি সব হিসাবনিকাশ লিখতে ব্যস্ত। আমার কথায় বলে-বলিনি, এখানে পদে পদে বিপদ। জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ, বনে সাপ আর-

-আর কি?

আমার কথায় নকুলমামা বলে—থাক! ত্যানাদের মুখোমুখি যেন না হতে হয়।

হোঁৎকা পটলারা নীচের থেকে তখন ক্লাবের ফুটবল টিম নিয়ে জোর তর্ক শুরু করেছে। লঞ্চের পিছনে রান্নার জায়গা। হামিদ আর একটা ছেলে দুজনে রান্নার যোগাড় করছে। বন আর বন, বড় নদী ছেড়ে একটা বড়খালে ঢুকেছি। বনকে দেখতে পাই আরও কাছ থেকে। খুব ঘন আর দুর্ভেদ্য, মাটিতে তীরের ফলার মত মূলগুলো উঠে রয়েছে। পা পড়লে গেঁথে যাবে। ঘন হেঁতাল বন। হলুদ কালো ছায়া ঘন ঝোপ ।

হামিদ বলে—এখানেই বড় শিয়ালরা থাকে। বাঘকে এরা বড়শিয়ালই বলে।

লঞ্চের পিছনে দুখানা বড় নৌকা তাতে রসদপত্র খাবার জল চলেছে। হঠাৎ বাঁকের মাথা থেকে একটা ছোট লম্বামত নৌকা খান কয়েক দাঁড় ফেলে ঝপঝাপ করে এগিয়ে আসে আমাদের দিকে।

এতক্ষণ কাছাকাছি কোনো নৌকা দেখিনি। মানুষের দেখাও পাইনি। এবার মানুষ দেখছি বনের গভীরে। রোদে জলে ওদের দেহের বর্ণ তামাটে, কিন্তু বলিষ্ঠ পেশীবহুল দেহ। মাথায় গামছা বাঁধা, খালি গা, দু’ একজনের গায়ে ফতুয়া, গেঞ্জি, তবে সেগুলো কোনকালে সাদা ছিল তা বলা মুশকিল ।

নকুলমামাই বলে— সারেঙ্গভাই।

কাশেম লঞ্চের স্টিয়ারিং হাতে চাইল ওর দিকে। ওই নৌকা থেকেই লোকগুলো দেখছে আমাদের সারেঙ্গ লঞ্চের গতিবেগ বাড়িয়ে হর্ণটা বাজাতে থাকে।—সেই শব্দ বনে ধ্বনি প্রতিধ্বনি তোলে। বেগে লঞ্চটা বের হয়ে গেল—ওরা নৌকাটা নিয়ে ওদিকে বনের মধ্যে একটা ছোট খালে ঢুকে গেল।

নকুলমামা নেমে এসে কখন পিছনের বাথরুমে অর্থাৎ কাঠের বেড়া দেওয়া ঝুলন্ত একটা খুপরি, শৌচকার্য সেখানেই সারতে হয় কোনমতে। মামাকে ওখান থেকে বের হতে দেখি। নকুলমামা কখন ওখানে সেদিয়েছিল জানি না। ওখান থেকে বের হয়ে নকুলবাবু এদিক ওদিক চাইছে সতর্কিত চাহনিতে।

-গেছে ব্যাটারা ?

কে বলে—হ্যাঁ!

কাশেম মিঞা অবশ্য চারিদিকে নজর রেখে জোরেই লঞ্চ চালাচ্ছে। নৌকার মাঝিরাও সাবধানী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। নকুলমামাকে শুধোই—ওরা কারা?

নকুল বলে-কে জানে! মধু বাওলিয়ার নৌকা হতে পারে, তবে বিশ্বাস নাই। হতে পারে কপিল সর্দারের লোক, বললাম না, বাঘ ছাড়াও এই সুন্দরবনে বাঘের বাবাও আছে। গুরুদেব!

জয় গুরু!

নকুলবাবুর মত সাহসী লোককেও বাথরুমে লুকোতে হয় কাদের ভয়ে তা ঠিক বুঝতে পারি না।

পটলা বলে—কি ব্যাপার রে হামিদ?

হামিদই বলে—কপিল সর্দার এই অঞ্চলের নামি ডাকাত। জল ডাকাত। ওর মস্ত দল। ওরা গাং-এ ডাকাতি করে বেড়ায়। কাঠমহাজন, মাছ মহাজনদের নৌকা লুট করে। লোকাকে আটকে রেখে মোটা টাকা আদায় করে। পুলিশ ওদের খুঁজছে—কিন্তু কোথায় কোনো গাং-এ কুন বনে কখন থাকে তার হিসাব কেউ জানে না ।

নকুলমামা বলে—অ কাশেম মিঞা খেরিয়ে কখন পৌছবা? কাশেন বলে—আর এসে গেছি। এই তো এখানে যুধিষ্ঠির পড়েছিল আর দু বাঁকের পথ!

—যুধিষ্ঠির পড়েছিল মানে? পটলাই বলে মহাভারতের যুধিষ্ঠির এই বাদাবনে আসবে কেন ?

হাসে নকুলবাবু, বলে- আরে সে যুধিষ্ঠির নয়, মাঝি বাওমিয়া যুধিষ্ঠির। সেবার এখানে নৌকা গেরাপি করে রেখেছিল রাতে। ঘুমুচ্ছিল, বাঘ এসে নোঙরের রসি থাবায় ধরি টেনে টেনে নৌকা কাছে এনেছিল। ওরা টেরও পায়নি। নৌকা কাছে আসতে এক লাফে নৌকায় উঠে যুধিষ্ঠিরকে মুখে করে নিয়ে চলে যায়।

-সেকি! চমকে উঠি ওর কথায়।

নকুলবাবু বলে—এখানে সবই হয়। যুধিষ্ঠিরকে বাঘে মেরেছিল এখানে। তাই ওই যে ডালে ঝুলছে এখন ওর ছেড়া লুঙি, মাদুর। ওইটাই নিশানা। ওতেই লোকে সাবধান হয়, যে বাঘ রে মুলুক এটা।

পটলাকে বলি—এ কোথায় এলাম রে! বাঘ—কামট, কুমির—জলদস্যু কি নাই ?

পটলা বলে—তুই ক-কাওয়ার্ড। ভীতু, এই সব না হলে অ্যাডভেঞ্চার হয়। হোঁৎকা তখন

একরাশ মুড়ি আর স্রেফ কাঁচা লঙ্কা, পিঁয়াজ সঙ্গে খেজুরগুড়ের পাটালি দিয়েই সেকেন্ড রাউন্ড জলযোগ সারছে আর গোবর্ধন ওদিকে পাকানির কাছে বসে কুমড়ো কেটে চলেছে। কুমড়োর তরকারিই এখানে অন্যতম প্রধান আইটেম।

পটলা বলে–হোঁৎকা, সমী সুন্দরবনে এসে ভয় পেয়েছে রে। হোঁৎকা তখন মুখে মুড়ি উইথ খেজুর পাটালি চিবুতে ব্যস্ত। সেটাকে ম্যানেজ করে বলে—ভয়, আমিও পাইছিরে। খাইতে না পাওয়ার ভয়। কিছুই তো মেলে না এহানে, খামু কি?

নকুলমামা বলে—তাই তো বলছিলাম এসো না। এখন বোঝো মজা। পটল বলে—এসেই যখন পড়েছি তখন শেষ দেখেই যাব।

শেষ অবধি বনের মধ্যে যেখানে গাছ কাটাই হচ্ছে সেখানে এসে পৌঁছালো আমাদের লঞ্চ। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল নামছে। রোদের রং হলুদ হয়ে আসছে। বড় নদীর থেকে একটা মাঝারি সাইজের খাল বের হয়ে ঢুকেছে বনের মধ্যে

লঞ্চটা এগিয়ে আসে। খালের বুকে ভক ছোট বড় নানা সাইজের নৌকা রয়েছে। রয়েছে বনবিভাগের পানসী অফিসবোট, ওদিকে খালের ধারে একটু ফাঁকা মত চরভূমি, সেখানে বন থেকে কেটে আনা নানা কাঠের স্তূপ, পাশেই খাল। সেখানে দুহাজার আড়াই হাজার মণ কাঠ ধরে এমনি সব বড় বড় নৌকায় কাঠ সাজানো হচ্ছে। বেশ কিছু লোকজন মাঝি বাওয়ালি, মায় কাঠ মহাজনদের নৌকাও রয়েছে।

এই এলাকাতে কাঠ কাটাই হচ্ছে এখন। বনবিভাগের থেকে গাছে গাছে চিহ্ন দিয়ে আসবে, সেইসব গাছই কাটাই হবে। এক একটা এরিয়া করে গাছ কাটাই হবার পর কুড়ি বছর আর সেই এলাকায় কাঠ কাটাই হবে না ।

তবে নকুলমামা বলে—ওসব আগের নিয়ম ছিল। এখন টাইগার প্রজেক্ট হয়েছে। বাঘেদের শান্তি নষ্ট করা চলবে না। বন কাটাইও এবার খুব কম হবে ।

বনের ব্যবসা এবার ডকে উঠবে। আর ক’দিন বাঘ বাঁচুক, বন বাঁচুক, তবে মানুষ বাঁচবে। বোঝো নিয়ম !

বনবিভাগের বিট অফিসার ভূষণবাবুও এসেছেন আমাদের লঞ্চে। আমাদের দেখে বলেন—ইয়ং ম্যান, সব অ্যাডভেঞ্চারে এসেছ। বাঃ! একটু সাবধানে থাকবে।

অবশ্য হেঁটে বেড়াবার জায়গা এখানে খুবই কম। আমরা এসেছি শেষ দ্বীপে। এই খালটা গিয়ে পড়েছে সমুদ্রে।

সেদিন বৈকালে ডিঙিতে কয়েকজনকে নিয়ে আমরা খাল বেয়ে সমুদ্রের ধারেই গেছি। এখানে দেখি বিস্তীর্ণ বালুচর। তবে জনমানবহীন। একটু দূরেই বনের শুরু।

পলিমাটিতে কিছু সরগাছও রয়েছে। ঝোপঝাড়। সেখানে একটা ছোট্ট ডোবার মত। হাঁটু ভোরও নয় তার চেয়ে কম জল। ওই জলটা ছেঁচে দিতে ক্রমশ আবার জল ওঠে। সেই জল নোনা নয়। মিঠে জলই। চারিদিকে নোনা জলের মধ্যে এই একটু মিঠে জলের উৎস, তাই ডোবার ধারে হরিণ, বন শুয়োর মায় বাঘের পায়ের ছাপও দেখা যায়।

আমাদের মাঝিরা সেই জলই সংগ্রহ করে মাঝে মাঝে। কালচরে দেখা যায় বড় বড় সারস জাতীয় পাখিদের। মানুষ নামক জীব তারা দেখেনি। তাই অবাক হয়ে চেয়ে থাকে—কাছে যেতেও ভয় পায় না, কৌতূহলী দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।

এমন সময় হামিদের ডাক শুনে চাইলাম।

হামিদ বলে–দ্যাখেন পায়ের ছাপ। বড় কাছিমের ছাপ। কোথায় ডিম পাড়ছে, দেখতে এসেছিল।

ছাপটা লক্ষ করে এগিয়ে যাই। পটলা বলে-বালির নীচে ক-কাছিম থাকবে?

হামিদ একটু এগিয়ে গিয়ে একটা বালির ছোট ঢিপির মত দেখে নিজেই বালি সরাতে থাকে। পটলা বলে—ওখানে কাছিম ?

কাছিম নয়, দেখা যায় বালির নীচে ঢাকা দেওয়া হয়েছে এক তাল গোল গোল পিংপং বলের সাইজের কাছিমের ডিম। সাদা সঙ্গে লালচে আভা। তুলতুল করছে। অথচ খোলটা ভাঙে না।

একটা ঝুড়িতে তোলা হল। নকুলবাবু বলে—খাসা ওমলেট হবে।

হোঁৎকা খাবারের গন্ধ পেয়ে আবার আগ্রহী হয়ে সেই ঝুড়িতে তোলে প্রায় আশি নব্বইটা ডিম। কাছিম সমুদ্র থেকে উঠে এসে বালি খুঁড়ে সেই গর্তে ডিম পাড়ে তারপর বালি চাপা দিয়ে চলে যায়। বালির তলে ডিমগুলো ওরই বেশ কিছুদিন পর পূর্ণতা লাভ করে ফেটে যায়—তার থেকে কাছিমের বাচ্চাগুলো সমুদ্রের ডাক শুনে কোনোমতে গিয়ে জলে নামে, জলেই বসবাস শুরু করে। সমুদ্রই যেন তাদের ডাকে জলে যেতে।

ডিমের সমস্যা সমাধান তো হল। সকালে চায়ের জল চাপিয়ে হামিদ বড় নৌকার সংলগ্ন জালি কেটে নেমে যায়। জাল দিয়ে খালা মারতে তারতাজা পারশে-ভেটকি-ভাওন, সিলেট, পমফ্রেট প্রভৃতি নোনা জলের মাছ ওঠে।

সেই মাছ ভাজা না হয় কাছিমের ডিমের ওমলেট আর মুড়ি এই জলযোগ। দু’দিনেই বিরক্তি ধরে যায়। শোওয়া বসা ওই লঞ্চে, মাঝে মাঝে ওই চরটুকুতে সাবধানে পায়চারি করা—এই কাজ।

একদিন জোর করেই বনে গেছি। সকালে কাঠ কাটার লোকজন স্নান করে সকালে ফ্যানাভাত খেয়ে নৌকায় খাবার জল তামাক, বিড়ি নিয়ে বনের সরু খালে ঢুকে পড়ে। বনের গভীরে এসেছি আমরা। খাল ও সরু দুদিকের বনসীমা খালের বুক অন্ধকার করে রেখেছে।

কাঠুরিয়ারা বনের মধ্যে জমাট ঘন গাছগাছালি কেটে পথ করে তার মধ্য দিয়ে বনে বনে ঢোকে, মাটিতে পা ফেলে সাবধানে অসতর্ক হলে গরানের শূলোয় পা ফুঁড়ে যাবে, সাপে ছোবল দেবে, বাঘ-এর ভয় তো আছেই।

বনের মধ্যে কাঠগুলো কাটে আর ওই গুঁড়ি পথে সে সব বের করে এনে ডিঙিতে করে নৌকা বলতে বড় নৌকার কাছে আনে ।

ওরা গাছ কাটছে বনের মধ্যে, হঠাৎ বনভূমি কাঁপিয়ে ওঠে চাপা গর্জন। চমকে উঠি আমরা। কে চিৎকার করে ওঠে—হুঁশিয়ার। কেউ বনবিবি, বাবা দক্ষিণরায়ের নাম জপছে। চিৎকারটার পরই শোনা যায় একটা আর্তনাদ।

পটলা, হোঁৎকা আমরা কি করব জানি না। কলরব ওঠে—গুপীকে বাঘ নেছে—হুঁশিয়ার। হামিদ আমাদের কোনোমতে টেনে এনে বনের ভিতর থেকে ডিঙিতে তোলে।

হোঁৎকা বলে—কি হইছে দ্যাখ?

হামিদ বলে—ওরা দেখবে। আপনারা চলেন। সে নৌকা বাইতে থাকে। আর্তনাদটা আর শোনা যায় না। শোনা যায় গহন অরণ্যের বুকে বাঘের গর্জন। গাং-এর জলে ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয় শব্দটা।

আমাদের নিয়ে নৌকাটা ফিরে আসতে নকুলবাবু বলে – বলেছিলাম বনে যেও না! কি যে হত? বাঘের চিৎকার এখান থেকেই শোনা যায়। নৌকা বসতের শান্ত জীবনে চাঞ্চল্য আসে। ফরেস্টের বাবুরাও বন্দুক রাইফেল নিয়ে বের হয়। দু চারটে কাঠুরিয়াদের নৌকা আসছে।

ক্রমশ ফেরে সকলেই। আর সুখের খবর গুপীকে বাঘটা ধরতে পারেনি। গুপীই আৰ্তনাদ করে কাছের একটা বড় কেওড়া গাছে উঠে পড়তে বাঘটার চেষ্টা নিষ্ফল হয়। তাই ব্যর্থ আক্রোশে সেটা তখনও বনে বনে গর্জন করে ফিরছে।

গুপী ফিরে এসে ঘটিখানেক জল খেয়ে তখন বাঘটার বর্ণনা দিচ্ছে সবিস্তারে।

পটলা বলে—রয়েল বেঙ্গল টাইগারই দেখেছ তাহলে?

গুপী বলে—বাবা দক্ষিণরায়ই বাঁচিয়েছেন।

কয়েকজন কাঠমহাজনের নৌকাই রয়েছে এখানে। তার মধ্যে গগনবাবুর নৌকায় এসেছে গগনবাবুর এক বন্ধু। হাফপ্যান্ট পরে থাকে—মুখে সব সময় বাঁকানো পাইপ, ফুক ফুক ধোঁয়া বের হয়। রোজ ওই জঙ্গলেই দাড়ি কামিয়ে ফিট ফাট থাকে ওই গোপালবাবু।

গোপালবাবু বলে—ফুঃ রয়েল বেঙ্গল টাইগার! তরাই-এর জঙ্গলে কত হাতি —বাঘ মেরেছি। এ তো তুচ্ছ। বলুন এটাকে আমিই ফিনিস করে দিই।

বনবাবু বলে-না-না। বাঘ মারা বেআইনি। এই এলাকা থেকে বাঘটাকে হটাতে হবে। আমরা চেষ্টা করছি, পারেন তো আপনারাও করুন। না হলে কাজ করার অসুবিধা হবে। ওই বাঘটার সাহস বেড়ে যাবে, সে এদিকেও আসতে পারে।

পটলা বলে-বাঘটা দেখতে পেলাম না ।

হোঁৎকা এর মধ্যে ওই গগনবাবুর শিকারি বন্ধু গোপালবাবুকেই আমাদের লঞ্চে এনে হামিদকে দিয়ে চা আলুসেদ্ধ সার্ভ করিয়ে খোস গল্প জুড়েছে।

গোপাল কারফর্মা নাকি মস্ত শিকারি। মধ্যপ্রদেশ, উড়িষ্যা মায় তরাই-এর অরণ্যের তামাম বাঘ হাতি তাকে চেনে। ওদের কতজনকে যে সে মেরেছে তার ঠিক ঠিকানা নাই।

আমি বলি—বাঘ হাতি মারা তো এখন নিষেধ।

পটলাও ওই গল্পবাজ শিকারিকে দেখে তার বোলচাল শুনে খুশি নয়। সেও বলে–কারেক্ট। এখন তো হান্টিং বেআইনি কাজ।

গোপাল কারফর্মার দেহটা টিক্‌টিকে লগার মত। মুখখানাও আমসি মার্কা, তোবড়ানো। তবে নকুলবাবুর মত একজোড়া পুরুষ্ট গোঁফ তার মুখখানাকে শ্রীমণ্ডিত করে তুলেছে। নকুলবাবু বলে ওঠে—আরে চোরাগোপ্তা সব শিকারই হয়।

গোপাল কারফর্মা খ্যাক খ্যাক করে হেসে বলে—তা অবশ্যই হয়। করিও। তবে আমার লিস্টে এই বিয়ের আগেই আমি শ’ খানেক বাঘ মেরেছি মশাই। ওয়ান হানড্রেড। তখন তো এসব আইন কোথায় ?

নকুলবাবু বলে—তাহলে বাদাবনের এই বাঘটাকেই কিল করে দ্যান গোপালবাবু। না হলে নিরাপদে কাঠ কাটতে দেবে না ব্যাটা!

গোপাল বলে—দেখি। তবে সামনে বনবাবুরা রয়েছে যে। তবে বলছেন ভেবে দেখি । নকুলবাবু বলে—গগনবাবুকেও বলছি। বাঘটাকে নিকেশ করে দ্যান মশায়। ফরেস্টের লোকেদের আমরা সামলে নেব।

নকুলবাবু চলে যেতে পটলা বলে–বে-আইনি কাজ করবেন না। পুলিশ কেস হয়ে যাবে। গোপাল কারফর্মা বলে-ভাবছি একবার চেষ্টা তো করা দরকার। ওরা বলছেন।

এবার হোঁৎকাই প্ল্যানটা দেয়। সে বলে-একটা কথা কমু স্যার ?

কারফর্মা স্যার বলাতে খুব খুশি। বলে সে—বলো, বলো।

হোঁৎকা বলে—ওই বাঘ মাইরা শ্যাষে বিপদে পড়বেন। বাঘও আপনারে মারতি পারে। কারফর্মা গোঁফে তা দিয়ে বলে-এ্যাঁ। কত বাঘকে আমি কিল করেছি। ওসব আমার কাছে জলভাত।

হোঁৎকা বলে—হউক জলভাত, তয় কি জানেন। বাঘে ছুইলি আঠারো ঘা আর পুলিশে ছুইলি সর্বাঙ্গে ঘা হইব। বাঘের চেয়েও ডেঞ্জার।

কথাটা কারফর্মাও মানে। আমরাও হোঁৎকাকেই সাপোর্ট করি সকলে।

হোঁৎকা বলে—ওরা কইছে ওদের কথামত বনের মধ্যে মাচানে বসেন, তয় ভোরের দিকি অনেক হরিণ জল খাইতে আসে, সেইসময় একখান হরিণই ফিনিস কইরা দেন। বলে – সঙ্গে সঙ্গে কাইটা মাংস বানাই দিমু, কেউ জানতি পারব না। জমাইয়া মাংস খামু ক’দিন।

পটলা বলে—হরিণের চামড়াটা ঠাকুমাকে দিতে হবে পুজোর আসন হবে ।

হোঁৎকা বলে—তাই হইব। তর ঠাকুমারে ওটা দিতি পারলে ভালো আমদানি হইব। হোঁৎকা বলে—তাহলে কালই গাছাল দিন স্যার।

মিঃ কারফর্মা কি ভাবছে। গোবরা বলে – কি হল স্যার। ভয় পেয়ে গেলেন? কারফর্মা গোঁফ মুচরিয়ে বলে—বুঝলে ছোকরা গোপাল কারফর্মা ভয় ডর কাকে বলে জানে না।

সেদিন সন্ধ্যার মুখে একটা ছোট ডিঙিতে করে নকুলবাবু একটু কাঠ কাটার হিসাব দেখতে বেরুবেন। এই বনবাসেও নকুলবাবু কেমন ব্যস্ত। মাঝে মাঝে একাই দু’একজনকে নিয়ে বের হয়ে যায় বনে। কি করে কে জানে। তবু সকাল সন্ধ্যা ওই টেপরেকর্ডারে গুরুদেবের অমৃতময় সেই হেড়ে বেসুরো গলায় নামগর্জন শুনবেই। নীরব বন ঝাঁপিয়ে সেই হুঙ্কার জাগে—বলো নিতাই গৌর রাধেশ্যাম, হরেকৃষ্ণ হরে রাম। সেই সঙ্গে শোনা যায় উদ্দাম খোলের শব্দ। বনতল কেঁপে ওঠে।

সন্ধ্যার মুখে আমরা আমাদের নৌকা থেকে দেখছি একটু দূরে বনের মধ্যে খালে নৌকা রেখে নকুলবাবু কাছে স্তূপগুলো দেখছে। সূর্য অস্ত গেছে, অন্ধকার নামছে খালের বুকে।

নৌকায় টেপরেকর্ডারটা পাটাতনে রাখা ওদিকে বনে আঁধার ফিকে থেকে ঘনতর হচ্ছে। নকুলবাবু চশমাটা খুলে রেখে মুখে চোখে জল দিচ্ছে। এরপর নামগান শুরু হবে টেপে―তার সঙ্গে নকুলবাবুও গলা মিলিয়ে গুরুদেবের দোহারকি শুরু করবে বিকট স্বরে।

হঠাৎ নকুলবাবু চিৎকার করে ওঠে। সামনের কেওড়াগাছ থেকে একটা বাঁদর অনেকক্ষণ থেকেই লক্ষ করছিল, এবার ফাঁক পেতেই একলাফে নেমে এসে নৌকার পাটাতনে রাখা

নকুলবাবুর চশমাটাই নিজের চোখে পরে নেয় বানরনন্দন। নকুলবাবু তেড়ে যেতেই ওই পাওয়ার দেওয়া চশমায় বাঁদরটা নকুলবাবুর গালটা নিরীক্ষণ করে সপাটে সেখানে একটা চড় কসিয়ে গাছের ডালে উঠে এদিক ওদিকে লাফিয়ে বনে সেদিয়ে যায় চশমা পরেই ।

নকুলবাবুও চশমার শোকে বিহ্বল হয়ে বনেই ঢুকতে যাবে, হঠাৎ এমনি সময় আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বাঘের গর্জন ওঠে। নৌকা বসতের মানুষজন চমকে ওঠে।

বাঘটা যে এখানেই হানা দেবে তা ভাবেনি কেউ। আমরা হতচকিত। দূরে বিশাল বাঘটা এবার সামনের নৌকার পাটাতনেই লাফ দেয়। একজন বাওয়ালি বসেছিল হালের ওদিকে। নকুলবাবু নীচে। ওই বাঘ দেখে নকুলবাবু কাঠগাদার আড়ালে কাদাতেই গড়াগড়ি খাচ্ছে গুরুদেবকে স্মরণ করে।

এদিকে ওজনদার বাঘটা নৌকার পলকা পাটাতনে লাফ দিতেই ওর ওজনে বাখারির এক পিস পাটাতন উল্টে যায়, বাঘবাবাজির ল্যাজ সেই ভাঙ্গা বাখারির চার ফিট বাই তিন ফিট পিসে ঢুকে গেছে। নকুলবাবুর গুরুদেবের অমৃতকণ্ঠবাহী টেপ রেকর্ডারের বেল্টটা বাঘের গলাতে জম্পেশ করে আটকে গেছে। আর নড়াচড়ার ফলেই বোধহয় ‘প্লে অন’ সুইচটাতে চাপ পড়তেই গুরুদেবের বজ্র নির্ঘোষ শোনা যায় ।

—বলো নিতাই গৌর রাধে এ শ্যাম্‌।

হরে কৃষ্ণ-হরে রাম—ম।। ব্যালো—ও

সুন্দরবনের বাঘও ওই বজ্রনির্ঘোষে আতঙ্কিত হয়ে এবার শিকারের মায়া ছেড়ে বনে ফেরার জন্য লম্ফ দিয়ে ডাঙ্গায় নামে। ল্যাজে সেই বাখারির পাটাতনের পিস আটকে রয়েছে। আর গলদেশে বেল্টের মালা পরা টেপরেকর্ডারেও সুধাকণ্ঠের নামগান, চলেছে। জীবনে এমন বিপদে কখনও পড়েনি বাঘবাবাজি ।

তখনও বজ্রকণ্ঠে নামগান চলেছে, আর সেই নামগানের গুঁতোয় বাঘবাবাজি ওই পাটাতন শুদ্ধ ল্যাজ আর কণ্ঠদেশে দোদুল্যমান নামগান এর কলরব নিয়ে সোজা বনের গভীরে ঢুকে কোনো দিকে দৌড়াল বাঁচার পরান নিয়ে কে জানে। এতক্ষণ ভীত চকিত দৃষ্টিতে ওই নাটক দেখছিলাম। এবার পটলা বলে বুঝলি ফটিক, বাঘটা গ-গানের খুব ভক্ত। তো-তোর সাকরেদ করে নে।

হোঁৎকা বলে—ও ওই নকুলমামার গুরুদেবেরই চ্যালা হইব। যা নামগান শোনাচ্ছে এখন ব্যাটা ।

নকুলবাবুকে আর চেনা যায় না। চশমা গেছে মায় শেষ পারানির কড়ি গুরুদেবের নামসুধাও ওই জানোয়ারটা চুরি করে নিয়েছে। আর তাকে সর্বাঙ্গে পলিকাদা মাখিয়ে ভূত বানিয়ে গেছে। নকুলমামা শীতে কাঁপছে। তবু কোনমতে ছোট নৌকায় দাঁড়িয়ে চান করে কাপড় চোপড় বদলে এসে লঞ্চে বসে।

হোঁৎকাই বলে—হামিদ চা দে। খাবার দে মামাবাবুকে।

পটলা বলে—বাঘটা এক নম্বর শয়তান। আপনার গুরুদেবের নামও নিয়ে গেল।

নকুলবাবু গর্জে ওঠে—ওর বিহিত করবোই। হামিদ, নৌকা নে যা। গগনবাবুর বোট থেকে সেই শিকারি সাহেবকে ডেকে আন।

নকুলবাবু বাঘের উপর খুবই কুপিত। প্রতিশোধ নিতেই হবে। কে জানে বাঘটা এখনও গান শুনছে কিনা। গগনবাবুও এসেছে গোপালবাবুর সঙ্গে। নকুলবাবু বলে—ওই ব্যাটা বাঘকে এক গুলিতে খতম করতে হবে গোপালবাবু।

গোপাল কারফর্মা বলে—সিওর। বিটুইন টু আইজ। ব্যস—একটি বুলেট, খতম । —তাই করুন। ব্যাটা গুরুদেবকে নিয়ে ছেলেখেলা করবে?

গগনবাবু বলে—কিন্তু ফরেস্টের বাবুরা—

নকুল বলে—ও আমি দেখে নেবো।

পরিকল্পনা হয় কাল ভোরেই মিঃ কারফর্মা ওই বনের মধ্যে বড় একটা গাছে উঠে পড়বে, আর নকুলমামার প্রিয় সেই নোটনও নাকি খুব সাহসী। বাদাবনের ঘোঁতঘাত সবই জানে সে। নোটনই তাকে নিয়ে যাবে বাঘের ঠিকানায়। কথাটা গোপনই থাকে। বাঘ মারা হলে তাকে ছাল চামড়া ছাড়িয়ে পুঁতে দেবে মাটিতে। বাঘের চামড়ার দামই হবে কয়েক লাখ টাকা। নখ-দাঁতও বেশ চড়াদরে বিক্রি হয়।

পটলা আমরা ওদের পরিকল্পনা শুনে অবাক ।

পটলা বলে—ওই নকুলবাবুর এটাও ব্যবসা। কায়দা করে বাঘ মেরে চামড়া বেচে বিদেশে । গোবরা বলে—নকুলমামার তাই এত আমদানি।

হোঁৎকা বলে—লোকটা দশ নম্বরী। ওর অনেক রকম কালা ধান্দাই আছে। ওর মতলব ভালো না। কিন্তু আমাদের করার কিছুই নাই। এসব অন্যায়কে সহ্য করতে হবে?

পটলাই বলে—এটা ঠিক করছেন না আপনি। আমাদের কোম্পানির কাজে এসে লুকিয়ে সুন্দরবনের বাঘ মেরে লাখ টাকায় সেই চামড়া বিদেশে পাচার করবেন। এটা ঠিক নয়।

নকুলবাবু গুম হয়ে যায়। পটলা বলে—এর আগেও আপনি লুকিয়ে বাঘ হরিণের চামড়া বিক্রি করেছেন।

নকুলবাবু বলে—যা জানো না তা নিয়ে কথা বলবে না। আর এই বাদাবনে আমার ওপর কথা বললে ভালো হবে না। এখানে মুখ বুজে থাকতে হবে তোমাদের। বাইরে গিয়েও কোনো কথা বলবে না, সাবধান করে দিচ্ছি পটল, আর তোমাদেরও।

পটলা বলে—হুমকি দিচ্ছেন?

নকুল গর্জে ওঠে—সাবধান! কোনো কথা যেন না বেরোয়। ফল ভালো হবে না । নকুলবাবু শাসানি দিয়ে উপরের কেবিনে ঢুকল। সেই দাড়ি গোঁফ ভর্তি মুখ নিয়ে নোটনও কুতকুতে চোখের নীরব চাহনিতে আমাদের নীরব শাসানিই দিয়ে যায়।

এবার বুঝেছি নকুলবাবুর বাদাবনে বেশ কিছু দু-নম্বরী ধান্দা আছে। এসবের থেকেই তার এত রোজগার। তাই কুমড়োর ব্যবসা ছেড়ে এখন বাদাবনে যাতায়াত শুরু করেছে।

পটলার কাকা এত সব খবর রাখেন না। তার অনেক ব্যবসা। এই ব্যবসার ভার তিনি নকুলবাবুর উপর দিয়ে নিশ্চিন্ত রয়েছেন। আর নকুলবাবুই আড়ালে নানা বেআইনি পথে নিজের রোজগার বাড়িয়ে চলেছে।

পটলা বলে—এর বি-বিহিত করতেই হবে। কাকামণিকে গে সব কথাই বলব। একটা শয়তানের চক্র গড়ে উঠেছে এখানে।

হোঁৎকা বলে—এহন চুপ মাইরা থাক। বাদাবনে ওরাই দেহি যা খুশি তাই করছে। হালায় কুমড়ো মামা এহানেও দেহি কুমড়া ইমপোর্ট এক্সপোর্ট করতিছে, ওদিক থেকেও নানা মাল আনছে।

পটলা বলে—ব্যাটা শয়তান ?

হোঁৎকা বলে—চুপ মাইরা থাক। দেহি কাল সকালে তো কারফর্মারে কইছি, যদি হরিণের মাংস জোটে, খাই দাই লঞ্চ লই ফিরুম। নৌকায় লঞ্চে বইসা পায়ে বাত ধইরা যাইব। ঘোরনের জায়গাই নাই ওই বীচ ছাড়া।

সকালের আলো সবে ফুটছে। পুব আকাশের বুকে রূপালী আভাস জাগে। নৌকাবসত তখনও জাগেনি। আজ শুক্রবার, বন কাটাই-এর লোকদের ছুটি ।

দেখি গগনবাবুদের নৌকা থেকে একটা ছোট নৌকায় কারফর্মা সাহেব উঠে এল। পরনে খাঁকি হাফপ্যান্ট, শার্ট, মাথায় টুপি, গলায় কার্টুজের মালা, হাতে রাইফেল। নৌকায় রয়েছে নোটন সর্দার। দাড়ি গোঁফে ঢাকা মুখ, গায়ে একটা ধুমসো চাদর জড়ানো, মাথায় গামছা বাধতে নোটন সর্দার ডিঙিখানা আমাদের লঞ্চের পাশ দিয়ে বেয়ে চলে গেল বনের দিকে। আমরা বীর শিকারিকে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানাই। হাত নাড়ে গোপালবাবুও। নকুলবাবুও দেখছে। তার চোখে বাঘ মারা স্বপ্ন। আর বেশ কয়েক লাখ টাকা এসে যাবে যদি ওই দশ এগারো ফিট রয়েল বেঙ্গলের চামড়াটা পায়। নকুলবাবুর এখন সেই গুরুদেবের নাম গানের ক্যাসেট নেই। তাই নিজেই বাঁশ ফাটা গলায় নাম করে গুরুদেবের স্টাইলে।—ব্যালো—নিতাই গৌর—কোত্থেকে একটা ছোট কত্তালও বের করে এবার কয়েক লাখ টাকা আমদানির স্বপ্নে নাম গান শুরু করেছে।

আমরাও লঞ্চে উৎকর্ণ হয়ে বসে আছি। দূর বনের কোনো গাছের উপর ভোরের আলোতেই কারফর্মার মত নিপুণ শিকারি বসে আছে তাক করে। বনের মধ্যে ভোরের বেলাতে হরিণের পাল বের হয় খাবারের সন্ধানে। পাল পাল হরিণ আছে এখানে। তার একটা নিশ্চয়ই পড়বে ওর গুলিতে।

হোঁৎকা বলে—হামিদ বেশি কইরা আদা পিঁয়াজ লঙ্কা রেডি রাখবি, মাংস আমিই বানাইমু। নকুলবাবু নামকীর্তন করছে বনের দিকে কান পেতে। কখন গুলির শব্দ শোনা যাবে তারই জন্য কান পেতে আছে। ঘণ্টা দু-তিন পার হয়ে গেল। বেলা বেড়ে ওঠে। সোনা রোদ ছড়িয়ে পড়ে কেওড়া বাইন গাছের বুকে। আজ নৌকাবসতের লোকদের কর্মব্যস্ততা নেই। খালের বুকে নৌকার যাতায়াতও কম!

দেখা যায় বনের দিক থেকে সেই ডিঙিটা আসছে। ওদিকে কারফর্মার বসে আছে, মাথায় টুপিটা নাই, এদিকে নোটন সর্দার গুম হয়ে হাল মেরে ডিঙিটা আনছে

আমরা ব্যগ্র হয়ে নজর রি। হোঁৎকা বলে – দ্যাখ নৌকার খোলে হরিণ ফরিণ কিছু আছে কি না? ওদিকে নকুলবাবু নৌকা দেখে নামকেত্তন সিকেয় তুলে রেখে লাফ দিয়ে লঞ্চের ছাদ থেকে দেখছে নৌকাটার দিকে।

কে জানে বাঘ মেরে বনেই রেখে এসেছে বোধহয়। তাহলে নকুল লোকজন নিয়ে ছাল ছাড়াবার জন্য রওনা দেবে। হুঙ্কার ছাড়ে সে—জয় গুরু! অ্যাই নোটন।

নৌকাটা কিন্তু আমাদের লঞ্চের দিকে আর্টিস মার্ণ নোটন সর্দারও সাড়া দেয় না। কারফর্মা সাহেবকে নিয়ে ওদিকে রাখা গগন মহাজনের বড় নৌকায় তুলে দিয়ে এবার নোটন ডিঙি নিয়ে ফিরছে আমাদের লঞ্চের কাছে।

নকুলবাবু গর্জে ওঠে—কি রে নোটন কথার জবাব দিচ্ছিস না যে? নোটনের জবাব দেবার সময় নেই। ডিঙিটা নৌকার কাছির সঙ্গে বেঁধে এবার সে নৌকায় রাখা ছোট বালতিটা দিয়ে গাং-এর জল তুলছে আর হড় হড় করে মাথায় গায়ে ঢেলেই চলেছে। আর মাঝে মাঝে আওয়াজ করে—রাম, রাম! আবার জল ঢালে সর্বাঙ্গে। আমরাও অবাক নোটনের কাণ্ড দেখে ৷ তারপর নেয়ে ধুয়ে জামা কাপড় চাদর কেচে লুঙি ফতুয়া পরে এবার লঞ্চে উঠে আসে নোটন। হোঁৎকার একরাশ পিঁয়াজ আদা ছাড়ানো পড়ে আছে, নকুলবাবু গর্জে ওঠে—কি হল? কিছু বলছিস না কেন বাঘটাকে মারতে পারলে ওই ব্যাটা শিকারি ! ব্যাটা গোলন্দাজ !

এবার নোটন ফেটে পড়ে। বলে সে—শিকারি! গোলন্দাজ ! বাপ মারেনি টিকটিকি তার ব্যাটা গোলন্দাজ! তাহলে বলি সব খোলসা করে! রাম-রাম !

ভোরের আবছা আলোয় তারা ডিঙি থেকে নেমে সাবধানে গিয়ে একটা কেওড়া গাছের উঁচু ডালে উঠে বসেছে। বাঘটার পায়ের ছাপও দেখেছে তারা নরম মাটিতে।

আশেপাশেই ঘুরছে বাঘটা। গাছের, উপরের ডালে বসেছে কারফর্মা সাহেব বন্দুক বাগিয়ে, আর তার ঠিক নীচের ডালেই বসেছে নোটন সর্দার।

ভোরের কুয়াশা মাখা গাছগাছালি, ‘স্তব্ধ বন’ বাতাসে ওঠে সমুদ্রের গর্জন আর বনে বনে হাওয়ার শব্দ । চোখ মেলে বসে আছে। হঠাৎ একটা শব্দ। ওদিকের বনে একটা সাবধানী শব্দ । কারফর্মাকে নোটন ইশারা করে—বাঘ !

কারফর্মার চোখ দুটো যেন লাল হয়ে ওঠে। অস্ফুট কণ্ঠে সে আওয়াজ করে–বা-আ-ঘ ! তারপরই মুখ তোলে নোটন, দাড়ি গোঁফ ঢাকা মুখে কয়েক ফোঁটা উষ্ণ তরল পদার্থ পড়ে তারপরই দুর্গন্ধময় পদার্থ উপর থেকে পড়ছে, নোটনের মুখ দাড়ি ছাপিয়ে সেই পূতি গন্ধময় আধাতরল বস্তু সর্বাঙ্গে পড়তে থাকে।

কারফর্মার হাতের বন্দুক সশব্দে নীচে পড়েছে আর কারফর্মা দুহাতে গাছের ডাল ধরে ঝুলছে আর মুখে অস্ফুট আর্তনাদ বা-ঘ—বাঘ – বাঁচাও !

সেই সঙ্গে প্রাকৃতিক কর্মও ঘটে চলেছে নীচে নোটনের দেহের উপর নিঃসাড়ে, বাঘের নাম শুনে।

হাসতে থাকি ওই অপূর্ব দৃশ্যের কল্পনা করে।

হোঁৎকা শুধোয়—বাঘ দেখছিলা?

নোটন বলে—বাঘ! কোথায় বাঘ! দেখি পাশের গাছে একটা বড় বাঁদর ওই দৃশ্য দেখে দাঁত বের করে দেওয়লা করছে।

নকুলবাবু গর্জে ওঠে—এই শিকারি! ফুটানিবাজ! বাঘের নাম শুনেই বাহ্যি পেস্বাব করে, সে গেছে বাঘ মারতে!

নোটন বলে—ভাবলাম ওরে গাছের ডালেই রেখে ফিরে যাই, তা গগনবাবুর সন্ধী, তাই নামিয়ে বন্দুক কুড়িয়ে নে এলাম। টুপিখান কোথায় গেল কে জানে? কুন বান্দর পরে ডালে ডালে ঘুরবে।

নকুলবাবুর হাতে এত টাকা ফসকে গেল। হোঁৎকা বলে—সুন্দরবনের বান্দর, বাঘ বেশ রসিক! বান্দরে চশমা চোখে দেয়, টুপিও পইরা ঘোরে আর রয়েল বেঙ্গল টাইগারও গুরুদেবের নামগান শুইনা বেষ্ণব হই গেছে গিয়া ।

নকুলমামা বলে—থামতো! সুন্দরবন তোমাদের কুলেপাড়া রাসমণির বাজার নয় এখানে সবকিছুই হতে পারে। খুব ডেঞ্জার জায়গা।

তখন ঠিক বুঝিনি ব্যাপারটা। বুঝলাম সেই রাতেই। লঞ্চের ভিতর শুয়ে আছি। এখানে দিনের চেহারা আর রাতের চেহারা দুটো সম্পূর্ণ আলাদা। সন্ধ্যার পর নামে আদিম আরণ্যক অন্ধকার। বনের মাঝে হরিণের টলটলে চোখ দেখা যায়। বাতাসে ওঠে সমুদ্রের গর্জন। সবাই তখন নৌকায় উঠে আসে।

এক এক নৌকায় এক একদল কাঠের পিদিম জ্বলে, একজন ‘সোনাভানের কাহিনি’ না হয় মা বনবিবির পাঁচালি পড়ে অন্যরা শোনে। কেউ বা কাহিনি শোনায়, রাজা-রাজপুত্ৰ, জিন পরীর কাহিনি সকলেই শোনে মুগ্ধ হয়ে ।

রাতে খাওয়া দাওয়ার পাট আটটার মধ্যে চুকিয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ে। অন্ধকার রাতে এখানে কেউ কারো নাম ধরেও ডাকে না। কাউকে ডাকার দরকার হলে ‘কু’ করে শব্দ করে অন্যজন ওই ডাকেই সাড়া দেয়।

সেদিন সকালে পটলা হামিদ হোঁৎকাদের নিয়ে ডিঙিতে বীচে গেছি কাছিমের ডিমের সন্ধানে। বালুচর বেশ প্রশস্ত। এখানে ফাঁকায় বেড়ানো যায় বনের দিকে নজর রেখে। বালিতে ডিমের সন্ধান করছি।

হঠাৎ দেখা যায় বনের দিক থেকে ক’জন লোক সরু একটা খাল থেকে নৌকা নিয়ে বের হয়ে আসছে। কাঠ মহাজনদের লোকই হবে—মিঠে জলের সন্ধানে এসেছে তাই ভেবে আমরা ডিমের সন্ধান করছি ওদিকে। হঠাৎ পটলার চিৎকার শুনে চাইলাম। লোকগুলো পটলাকে ধরে ওর মুখ বন্ধ করে জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে তাদের ডিঙিতে তোলে।

আমরা দৌড়ে যাবার আগেই ডিঙিতে পটলাকে তুলে তীব্র বেগে ডিঙি বেয়ে বনের মধ্যে ঢুকে গেল ।

আমাদের ডিঙিটাও দূরে ওদিকের খালে রয়েছে। আসতে গেলে সমুদ্রে নেমে ডিঙি বেয়ে এই খালের মুখে এসে ঢুকতে হবে। আর এই খালটা বনের মধ্যে ঢুকে এদিক ওদিকে ছড়িয়ে গেছে। কোথায় গেছে আমাদের পক্ষে খোঁজাও সম্ভব নয় ।

তাই আমরা ওদের পিছনে যাবার চেষ্টা না করে ডিঙি নিয়ে ফিরে এলাম নৌকা-বসতে। তখন বেলা প্রায় এগারোটা। নৌকা বসতের বেশিরভাগ কাঠুরিয়া, মাঝি সবাই বনে গাছ কাটতে গেছে। নকুলবাবুও নাই। বনবিভাগের নৌকাতে গিয়েও বিট অফিসার, গার্ডদের দেখা পাই না। ওরা বনের মধ্যে কাজে গেছে। একজন মাত্র রান্নার লোক রয়েছে ওদের বোটে। সে আর কি বলবে। কেউ না, অথচ পটলাকে কারা তুলে নিয়ে গেল। হোঁৎকা বলে—বেশ গড়বড় হয়ে গেল। এহন কি করা যায় ?

গোবর্ধন বলে—নকুলমামাও নাই। ওদিকে রয়েছে মিঃ কারফর্মা। সেদিনের বাঘ মারার ওই নাটকের পর তিনি আর এমুখো হননি।

ছটফট করছি আমরা। কাশেম মিঞা সারেং লঞ্চেই ছিল। সে বলে—চলেন দেখি, ব্যাটাদের নৌকা যদি দেখতে পাই। খবর পেয়ে কারফর্মা সাহেবও এসেছে বন্দুক নিয়ে। সেও বলে—সে কি বাদাবনে কিডন্যাপিং?

আমি জানাই—ঠিক বুঝছি না, ওরা পটলাকে কেন তুলে নিয়ে যাবে ?

হোঁৎকা বলে—চল, দেখি !

কাশেম মিঞা লঞ্চ নিয়ে বের হল। সঙ্গে কারফর্মাও রয়েছে। এখাল ওখাল ঘুরে সমুদ্রের একদিকে ঘুরে এলাম, কিন্তু তেমন কোনো নৌকার সন্ধান মেলে না। গাং-এ কয়েকজন মাছ ধরছিল নৌকায় করে ।

কাশেম মিঞা তাদেরও জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু তারা বলে–দু’ একখান নৌকা যাতায়াত করতে দেখছি, কিন্তু তেমন কিছু তো দেখি নাই বাবুরা।

ঘণ্টা দুয়েক এদিক ওদিক নিষ্ফল ঘোরাঘুরি করে নৌকাবসতে ফিরি হতাশ মনে, ততক্ষণে নকুলবাবুও ফিরেছে। পটলার কোনো খবরই নাই।

সব শুনে নকুলবাবু বলে—তখনই বলেছিলাম সুন্দরবনে এসো না। এখানে মানুষ বাঘ আছে। এ তাদেরই কাজ। লাখ দুলাখ টাকা চাইবে কম করে, দিলে ফেরৎ পাবে। না হলে ব্যস ! হোঁৎকা বলে—এহন কি করা যায় কন?

বনবিভাগের বিট অফিসারও এসেছে। তার বনের ফেরির নৌকা থেকে একজনকে তুলে নিয়ে গেছে কারা, তাদেরও দায়িত্ব এসে গেছে। তরুণ বিট অফিসার নরেনবাবু বলে—তারা আশপাশেই ছিল।

নকুলবাবু বলে আমাদের-কেনে গেছলে বীচে? এ্যা–না বলে, না কয়ে যেখানে সেখানে ঘুরবে? খাও এবার ডিম, ঘোড়ার ডিমই খাও। আর এখন পটলের কাকাবাবুদের কি জবাব দেব আমি ?

আমিই বলি—পুলিশে খবর দিতে হবে। আর দেখছিলাম নদীতে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের লঞ্চ। বনের এদিক ওদিকের জল পথে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে, ওই ফোর্সের লোকেদেরও খবর দেওয়া দরকার।

নকুলমামা বলে–সব খবর রাখো দেখছি। এ্যা—ওই বি-এস এফ এর লোকদের তো চেন না, দেবে তোমাদেরই ফাটকে পুরে।

ফটিক বলে—দেয় দিক। তবু পটলাকে বের করার চেষ্টা ওরা করবেই।

হোঁৎকা বলে–বনে বইসা থাকুম না, পুলিশেই যামু।

নকুলবাবু বলে—ভেবে দেখতে দাও। হয় তো এর মধ্যেও কোনো খবর এসে পড়তে পারে।

তারপর আমাদের সান্ত্বনা দেবার জন্য বলে–আমিও বসে নাই। দায়িত্ব আমারও আছে পটলের জন্যে। দেখা যাক কি হয়। যাও এখন চান খাওয়া করে নাও ।

আমাদের মন মেজাজ ভালো নাই। এই দুর্গম বনে হঠাৎ এইভাবে পটলাকে কারা তুলে নিয়ে গেল জানি না। কোথায় গেল তাও জানি না। কলকাতায় গিয়ে পটলার বাবা মা তার ঠাকুমাকে কি জবাব দেব তাও ভাবতেই পারছি না।

পটলাও ভাবেনি যে এইভাবে অতর্কিতে ওরা এসে তার উপরই লাফিয়ে পড়ে এইভাবে মুখ টিপে ধরে এনে নৌকায় তুলে বনের গভীরে পালাবে। সেও দল থেকে একটু ওদিকে বালুচরে দাঁড়িয়ে নীল আকাশ, সমুদ্র দেখছিল! মাঝে মাঝে তার মনে কবিত্ব জেগে ওঠে, কবিতাও লিখে ফেলে তখন ডজন খানেক। কিন্তু ওই কবিত্বের জন্য এইভাবে তাকে তুলে নিয়ে যাবে কেউ তা ভাবেনি, নৌকাটার গড়নও আলাদা ধরনের। কিছুটা সরু, আট-দশজন লোক একতালে দাঁড় ফেলছে আর ছিপখানা তীর বেগে জলকেটে ছুটে চলেছে। লোকগুলোর ‘চেহারাও বেশ বলিষ্ঠ, পেশীবহুল। নৌকার খোলে দেখে তরোয়াল, লাঠি-বল্লম, রামদা এসব তো আছেই আর ওদিকে একজন বসে আছে, লম্বা চুল, ধরা গালপাট্টা, কোমরে লাল শালুর বেষ্টনী, মাথায় একটা গামছা। ওর গায়ে একটা ফতুয়া আর হাতে বন্দুক। ওই এদের নেতা । লোকটা বলে–এ্যাই বাঁটুল, তুই ওই জেলে ডিঙিটার লোকটাকে বল—এই চিঠিখানা যেন সে ওই কাঠকাটাই এর বনবাবুর নৌকাতে দেয়। বলবি ভূপতি সর্দারের হুকুম।

নদীতে দুতিন খানা বাছাড়ি নৌকায় কয়েকজন লোক গাং-এর ধারে জাল ফেলে মাছ ধরছিল। মাছ ধরে ওরা জালের পিছনে বাখারির তৈরি ডুবন্ত খাঁচার মত আছে, তাতেই মাছগুলো রাখে, মাছগুলো পালাতে পারে না, ওই হাপরের খাঁচায় বন্দী হয়ে থাকে। সেই তাজামাছ ওরা আড়তে নিয়ে যায় কোনো গঞ্জে।

জেলে ডিঙির লোকগুলো হঠাৎ ওই ছিপটাকে তাদের দিকে আসতে দেখে জাল ফাল ফেলে হাত জোড় করে কান্নাকাটি করতে থাকে—মেরো না গো। গরিব মানুষ, পরান হাতে নে প্যাটের দায়ে গাং-এ এসেছি। দোহাই তোমাদের, সঙ্গে ত্যামন কিছু নাই দুদিনের খোরাকি আছে তা নে যাও, পরানে মেরো না ।

পটলাও বুঝেছে এই নৌকার লোকেরা কুখ্যাত জল ডাকাত। এই এলাকার আতঙ্ক। সে এদের কবলেই পড়েছে। ছিপের নেতা মত লোকটা গর্জে ওঠে–এ্যাই চোপ! মারব না তোদের। শোন, এই চিঠিখানা ওই যে ওই ছোট মনসার বাদায়, কাঠ কাটাই এর ঘেরি হয়েছে জানিস।

একজন জেলে বলে—হ্যাঁ বাবু, ফরেস্টের পিটেল বোটও আছে, মেলা নৌকা বাওয়ালিও আছে, দেখলাম ।

ডাকাতটা বলে—ওই বনবাবুদের বোটে এই চিঠি পৌঁছে দিবি আজই। ঠিক তো ! লোকটা এত সহজে রেহাই পাবে ভাবেনি। বলে—তাই দেব বাবু ।

-হ্যাঁ। আর না দিলে এ গাং আর আসতে হবে না। কপিল সর্দারের লোক তোদের শেষ করে দেবে।

জেলেরা সবাই বলে—না, না। আজই বৈকালে পৌঁছে দেব।

পটলাকে নিয়ে ছিপটা এবার বড় নদী ছেড়ে আবার বড় একটা খালে ঢোকে। চলেছে তারা। একসঙ্গে জলে দশটা দাঁড়ের শব্দ ওঠে। পটলা দেখছে বন এখানে গভীর। দুপুরবেলা পার হয়ে গেছে।

ওদের একজন মাটির হাঁড়ি থেকে পান্তাভাত আর মাছের চচ্চড়ি সঙ্গে পিঁয়াজ আর কাঁচালঙ্কা এগিয়ে দেয় ওর দিকে একটা ময়লা সানকিতে। লাল কাদাকাদা ফাটা চালের ভাত। মাছটার বিশ্রী গন্ধ উঠছে।

–খাও।

পটলা বলে—খিদে নাই ৷

ওরা খেতে থাকে। একজন বলে—খিদে পেলেই খাবে। অন্যজনও খ্যা খ্যা করে হাসতে হাসতে বলে—সর্দার ওর জন্য হালুয়া, পোলাও রেঁধে রাখবে। অনেক টাকার মাল শুনছি। দাম দিলে নাকি ওর বাবা কাকারা দু পাঁচ লাখটাকাই দেবে।

পটলা শুনছে কথাটা। ঠিক ভাবতে পারে না এরা নকুলবাবুর খবর পেল কোথা থেকে। তাহলে নকুলবাবু কি এদের চেনে? কথাটা এদের শুধোতে পারে না। চুপ করেই থাকে। পড়ন্ত বেলায় বনের গভীরে এসে থামল এদের নৌকা। গাছের ডাল থেকে একটা পাখি তীক্ষ্ণস্বরে ডেকে ওঠে।

এদের ছিপ থেকেও একজন দুহাতে মুখ ঢেকে অমনি একটা আওয়াজ করতে এবার বনের ভিতর থেকে একজন লোক বাঁশের মাথায় একটা নীল কাপড় পতাকার মত নাড়তে ছিপটা এবার বাঁকের মাথা দিয়ে খালের ভিতর এগিয়ে যায়। দেখে পটলা খালের মধ্যে বেশ কয়েকখানা ছোট বড় ছিপ নৌকা, আর একটা বড় নৌকা—বেশ ছই এর ঘর করা, দু চারটে ছইওয়ালা নৌকাও আছে। এখানে বনের মধ্যে বেশ খানিকটা উঁচু ডাঙামত, সেখানে বন কেটে কাঠের ঘরও রয়েছে দু একটা।

বনের গভীরে এটা সেই কোনো ভূপতি সর্দারের অস্থায়ী রাজধানী বলেই মনে হল। ছিপ থেকে সেই নেতা মত লোকটা উঠে গেল ওই বড় নৌকার পাটাতনে। দেখা যায় একজন লোক একটা কাঠের বেঞ্চে বসে তামাক খাচ্ছে।

পটলা ছিপ থেকে দেখছে লোকটাকে। সেই ছিপের সর্দার যেতেই লোকটা তামাক খাওয়া ছেড়ে চাইল। গোলমত মুখ, চোখ দুটো বুনোমোষের মত লাল টকটকে। আর গলার আওয়াজও বিশ্রী ফাটা—তবে সতেজ। শুধোয় সে এনেছিস ছেলেটাকে?

—ওই তো!

পটলাকে নিয়ে যায় ওরা ওই সর্দারের কাছে। কপিল সর্দার পটলাকে আপাদমস্তক দেখে বলে—ওদের খপর দিইছিস?

-হ্যাঁ।

সর্দার বলে—এটাকে নে গিয়ে ওই নৌকায় রাখ। নজর রাখবি। আর শোন–এর খাবার দাবারের যেন ভালো ব্যবস্থা করা হয় ।

পটলাকে বলে—যাও। ওখানেই থাকবে। পালাবার পথ এখানে নাই, চারিদিকে বন আর নদী। বাঘ না হয়, কুমিরেই শেষ করে দেবে।

পটলাকে এনে ওরা একটা ছইওয়ালা নৌকায় তোলে। দুজনকে বলে সেই লোকটা—নজর রাখবি। আর খাবার দাবারের সব ব্যবস্থাই কর এর। কত্তার হুকুম, কোনো অসুবিধা যেন না হয়। অনেক টাকার মাল।

পটলা বুঝেছে সে এই জলদস্যুদের গল্পই শুনেছিল। আজ সত্যিই এদের পাল্লাতেই পড়েছে।

বনের গভীরে থাকলেও সভ্যজগতের সঙ্গে যে এদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে তা বুঝতে পারে পটলা। নৌকায় তোষক বালিশ কম্বল সবই আছে। সকাল থেকে কিছুই খায় নি, দু’এক গ্লাস জল ছাড়া।

এখানে ওর জন্য বৈকালে চা আর গরম রুটি আলু চচ্চড়ি গুড় আসে। কাচের প্লেট গ্লাস নাবে, ভাঁড়ারে খাবারের অভাব নাই। বনের গহনে রেডিও বাজে সর্দারের নৌকায়।

বনের হরিণের মাংস এই নৌকাবসতে পায়নি, রাতে হরিণের মাংস রুটি সবই জোটে। আরামেই আছে, কিন্তু বন্ধুরা নেই। একা একপাল ডাকাতের মধ্যে বাস করতে হবে কতদিন তাও জানে না, আর কখনও কুলেপাড়ার বাড়িতে মা বাবা ঠাকুমার কাছে ফিরতে পারবে কি না তা জানে না পটলা ।

ভাবতেও কষ্ট হয় ।

রাতে ঘুম আসে না। ছই এর ফাঁক দিয়ে দেখে রাতের বেলাতে তো এখানে লঞ্চ আসে। আবছা আলোয় কি সব কথাবার্তা হয় আবার ওরা অনেকে চলে যায়। রাতের অন্ধকারে এদের নানা কাজকারবার চলে এই সুরক্ষিত অঞ্চল থেকেই।

পটলার খবর আসে আমাদের কাছে বৈকাল গড়িয়ে সন্ধ্যার মুখে। সেই জেলেদের একটা ডিঙি এসে চিঠিখানা বিট অফিসারের নৌকায় দিয়ে গেছে।

লোকগুলোও বলে—একটা সোন্দর ছেলেকেও দেখলাম ওদের ছিপে, ওরে নিয়ে চলে গেল বিহারীখাসের ওদিকে।

বিট অফিসারই খবরটা আনে আমাদের লঞ্চে। বিট অফিসার নরেনবাবু বলে এ কপিল সর্দারের দলের কাজ। ব্যাটারা এদিকে রাজত্বি চালাচ্ছে। রাতে বর্ডার পার হয়ে দুনম্বরী মাল আনে আর এদিকে ডাকাতি গুম সবই করছে।

নকুলবাবু বলে—এদের তখন থেকে মানা করেছি কলকাতার ছেলে বনে বাদায় এসো না । এখন বুঝুক, বলে দুলাখ টাকা না পেলে ছাড়বে না পটলাকে। সাতদিনের মধ্যে টাকা না পেলে খতম করে দেবে।

আমরা ত চমকে উঠি।

– সেকি!

নকুলবাবু বলে—তাই লিখেছে। এই বুধবার টাকা এনে দিতে হবে পুইজালির মোড়ে গাং এর ধারে ওদের লোকের হাতে, তবেই পটলাকে ছাড়বে।

এমন বিপদে পড়তে হবে তা ভাবিনি আমরা।

নরেনবাবু বলেন—সন্দেশখালি থানায় গে খবর দিতে হবে।

নকুলবাবু বলে—পুলিশ! পুলিশ কি করবে এখানে? ছেলেটাকে পেতে গেলে সুড়সুড় করে টাকা দেওয়া ভালো। ওদের চটালে বিপদ হবে।

কি করা যাবে ভাবতে পারি না। হোঁৎকা বলে—

তাই ভালো। কালই আমরা গিয়া ওর বাবা কাকারে কই টাকা লই আসতি।

নকুলবাবু বলে—তাই করো, কিন্তু এদিকে এত হাজার টাকার কাঠ পড়ে আছে। সময়ে মাল চালান না গেলে বহুৎ লোকসান। তোমরা সকালে লঞ্চ নিয়ে চলে যাও। ধামাখালি থেকে বাস পাবে কলকাতার, কাল সন্ধ্যা তক কলকাতায় পৌঁছে পরশুই টাকা নিয়ে সন্ধ্যায় ফিরবে ক্যামন। তারপর দিন বুধবারও আমি কুমিরমারির হাটতলায় প্রমথ নস্করের কাপড়ের দোকানে থাকবো, তোমরা কাকাবাবুকে নে টাকা সমেত এসে পড়লে ছেলেটাকে বাঁচানো যেতে পারে।

—উঃ কি হল বলো তো? বাবুদের সাথে মুখ দেখাবার পথও রইল না। এখন টাকা দিয়ে বাঁচাবার চেষ্টাই করতে হবে পটলাকে। তোমরা গিয়ে ব্যবস্থা করো।

নরেনবাবু বলেন—এভাবে লোকের সর্বনাশ করবে, গাং নৌকা চলাচল করতে দেবে না, আমরাতো চেষ্টা করছি ওই ডাকাতদের ধরার।

নকুল বলে—আগে ছেলেটাকে ঘরে ফিরতে দেন, তারপর যা করার করবেন। পটলা বৈকালে এসেই তার নৌকায় উঠে বসেছে।

কি ভাবে মুক্ত হবে জানে না। নৌকায় একটা ছেলেও আছে। তার খাবারদাবার আনে । সেই বলে—কাল ভোরের জোয়ারে হাটে যাবে তারা, কুমিরমারির হাট থেকেই তারা আনাজপত্র, খাবারদাবার আনে মহাজনের গদি থেকে।

পটলার পকেটে একটা খাম, কাগজও ছিল। হঠাৎ তার মাথায় বুদ্ধিটা গজিয়ে ওঠে। বলে সে—হাটতলায় ডাকঘর আছে?

—ডাকঘর? ছেলেটা বলে—একটা লালবাক্স সেখানে চিঠি ফেলে টেলে? ——হ্যাঁ! এই জায়গাটার নাম কি?

ছেলেটা বলে—চামটার খাল, কেনে গো?

পটলা মনে মনে একটা নকশা করে রেখেছিল। বড় নদীর নাম হরিণগাড়া, তার থেকে ডাইনে একটা খাল বেরিয়েছে, ওটার নাম বলেছিল ওরা বিহারী খাল, ওই খালের বুক দিয়ে বাংলাদেশে যাবার স্টিমার যেত। তাই পথ সংকেতের একটা লোহার উপর সাতরং করা বোর্ডও আছে।

সেই বোর্ডের পাশ দিয়েই এই খাল ঢুকে এসেছে বনের গহনে ।

পটলা ডটপেন দিয়ে কাগজে, সেই ম্যাপটা আন্দাজমত এঁকে ফেলে, তাদের বনের মধ্যে বসতের খালটাও আঁকে। আর চিঠিখানায় কাকাকে ওসব জানায়। খালটার মুখবন্ধ করে ঠিকানা লিখে পটলা বলে ছেলেটাকে—

-তোর নাম কি?

–কেষ্টা। ছেলেটারও ওকে পছন্দ হয় ।

পটলা বলে—এখানে থাকতে ভালো লাগে?

কেষ্টা এদিক ওদিক চেয়ে বলে—না বাবু, এরা সাংঘাতিক লোক। আমার বাবাকেও এরাই মেরেছিল সেবার গাং-এ। পেটের দায়ে ইখানে পড়ে আছি। কোথাও অন্য কাজ পেলে চলে যাব এ মুলুক ছেড়ে, নালে এরা বাঁচতে দেবে না। বাইরে কোথাও কাউকে চিনি না, কে কাজ দেবে বাবু। ঘরে মা-একটা ভাই আছে।

কেষ্টার চোখ জলে ভরে ওঠে। পটলা বলে—

–আমি যদি ছাড়া পাই তোকে কলকাতা নিয়ে যাব। সেখানেই থাকবি কাজ করবি আমাদের ওখানেই

কেষ্টা বলে—সত্যি !

—হ্যাঁ, পটলার পকেটে কিছু টাকাও ছিল। লোকগুলো তার পকেট সার্চও করেনি। এমনিই তুলে এনেছিল। পটলা পকেট থেকে শ পাঁচেক টাকা বের করে ওকে দিয়ে বলে-

—এটা বাড়িতে দিবি। আর শোন—এই চিঠিখানা ডাকঘরের সেই চিঠিফেলার লালবাক্সে ফেলে দিবি আজই। খুব হুঁশিয়ার এরা কেউ যেন জানতে না পারে ।

কেষ্টা ধুতির পেট কোঁচড়ে টাকা সমেত চিঠিখানা ঠিকমত সেঁদিয়ে নিয়ে বলে—কেউ জানতি পারবে না। আজই ফেলে দেব।

ভোর রাতেই ওরা নৌকা নিয়ে মালপত্র আনতে বের হয়ে যায়। আটদাঁড়ের নৌকা – এক জোয়ারেই ওরা বেলা দশটার মধ্যে কুমীরমারিতে পৌঁছে যাবে।

ওই কপিল সর্দারের দলের লোকদের হাটে অনেকেই চেনে। তাদের কোনো অসুবিধাই হয় না। হাটে পৌঁছে লোকগুলো খাবারের দোকানে বসে এবার বিনাপয়সায় কচুরি জিলাপি খেতে থাকে।

কেষ্টার বাড়ি একটু ওদিকে, নদীর ধারে একটা ছোট বাড়িতে ওর মা-ভাই থাকে, বাবা নাই। কেষ্টা বাড়ির দিকেই রওনা হয়। টাকাগুলো মাকে দিয়ে ফেরার পথে গোপনে লালবাক্সে চিঠিখানা ফেলে দেবে।

আমাদের লঞ্চটা এসে থামে কুমিরমারির ঘাটে। ওদিকেই ফরেস্টের বিট অফিস নরেনবাবুর সঙ্গে নেমে গেছি বসতির শেষ প্রান্তে। ঝিলা, রায়মঙ্গল নদীর মোহানার মুখে ছায়াঘেরা বনবাংলো-ফরেস্ট অফিস। সামনে রায়মঙ্গল চলে গেছে বাংলাদেশের দিকে।

দূরে একটা বি-এস-এফ-এর লঞ্চকে দেখা যায় ।

নরেনবাবু এর মধ্যে অফিসে গিয়ে রেডিওতে যোগাযোগ শুরু করেছেন। চারদিকে ডাকাতদের এই নতুন শিকারের খবর ছড়িয়ে পড়ে।

আমি বলি-কলকাতা পুলিশকেও যদি মেসেজ দেন পটলার বাড়ির ঠিকানা-ফোন নাম্বার দিচ্ছি। ওর বাবাকেও যদি খবর দেন ভালো হয় ৷

নরেনবাবু কলকাতা পুলিশকেও ওখান থেকেই রেডিও মেসেজ দিয়ে দেন।

খিদে পেয়েছে।

দোকান বলতে ওই হাটতলায়, আজ হাটবার এখানে আজ বহু মানুষজন, নৌকার ভিড়। এইটাই মানুষের শেষ বসতি। দ্বীপটাও বেশ বড়ই। সব লোকজনই হাটে আসে। আর নৌকায় করে আসে অন্যদ্বীপের লোকজনও। দোকানীরাও আসে নৌকায়, মালপত্র নামিয়ে বেসাতি করে দিনশেষে দোকান গুটিয়ে নৌকায় তুলে আবার চলে যায় অন্য হাটে। দিনভোর ভিড় থাকে।

পথ দিয়ে যাচ্ছি হঠাৎ একটা ছেলে আমাদের দেখে শুধোয়

-বাবু, একখান চিঠি ফেলব, ডাকঘরের লালবাক্সে ফেললে চলে যাবে তো?

ওর কথায় চাইলাম। আমি শুধোই—কোথায় যাবে চিঠি?

হোঁৎকাই বলে—দেখি চিঠিখানা ।

ছেলেটি চিঠিখানা হোঁৎকার হাতে দিতে ঠিকানাটা পড়ে চমকে উঠি—এ যে পটলাদের বাড়ির ঠিকানা রে! মনে হচ্ছে পটলার হাতের লেখা।

শুধাই—এ চিঠি তুই কোথায় পেলি! কে দিয়েছে ফেলতে? ছেলেটা এবার ঘাবড়ে যায়, বলে না—হায়। আমি কিছু জানি না গো।

পালাবার চেষ্টা করতে গোবরা খপ করে ওর হাতটা ধরে বলে-একদম চেল্লাবি না, পালাবার চেষ্টা করলে তোকে গাং-এ ডুবিয়ে দেব। কি নাম তোর ?

— কেষ্টা।

আমিই বলি–কোন ভয় নাই তোর। ওই বাবু আমাদের বন্ধু। আমরা তাকেই খুঁজছি। চল আমাদের সঙ্গে।

খাওয়া মাথায় উঠল, কেষ্টাকে নিয়ে এসে হাজির করি নরেনবাবুর কাছে সেই চিঠিসমেত। নরেনবাবু এর মধ্যে কলকাতায়, বারাসাত হেডকোয়ার্টারে মেসেজ দিয়েছেন, বসিরহাট পুলিশ দপ্তরে বনদপ্তরে খবর গেছে। যেখান থেকে ওরা বি-এস-এফ-এর দপ্তরে খবর দিয়েছে। যেভাবে হোক ওই জলদস্যুদের ধরতেই হবে।

পুলিশ বিভাগ, বনদপ্তর ওই ভূপতি সর্দারের দলের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। লোকটা অনেকদিন ধরেই এই এলাকায় নানা জায়গায় ডাকাতি, খুন জখম করে চলেছে।

গাং-এর জেলে, কাঠুরিয়া-কাঠমহাজনদের নৌকা লুট করে, অনেককে ধরে নিয়ে গিয়ে মোটা টাকা মুক্তিপণ আদায় করছে। এছাড়া ইদানীং এই সীমান্ত দিয়ে চোরাচালানও অনেক বেড়ে গেছে।

এসবের মূলে ওই কপিল সর্দারের দলই। স্থানীয় কোনো কোন ব্যবসায়ী ওই দলের সাহায্যেই ওদের দিয়েই লাখ লাখ টাকার বিদেশি মাল, সোনার বিস্কুট এসব আমদানি করে চলেছে।

কলকাতার পথে এমন অনেক মাল ধরাও পড়েছে। কিন্তু আসল অপরাধীদের কেউ ছুঁতেও পারেনি। পুলিশ বি-এস-এফ ওই ডাকাতদের কোনো সন্ধানই পাচ্ছে না।

এবার পটলাকে তুলে নিয়ে গিয়েছে।

আর কেষ্টার হাতের চিঠিখানাতে একটা ম্যাপও আঁকা আছে। নরেনবাবু ওইসব অঞ্চলে প্রায় ঘোরাঘুরি করেন, তিনি ম্যাপটা দেখে কিছুটা অনুমান করেন চামটার জঙ্গলে রয়েছে তারা মনে হচ্ছে। কোথায় আছে ওরা? কেষ্টা কাঁদছে, নরেনবাবু বলেন কি রে!

—কিছু জানি না বাবু! ওরা জানতে পারলে আমাকে তো শেষ করবেই, মা ভাইটাকেও খতম করে দেবে।

সেটা খুবই সম্ভব ওই দানবের পক্ষে। কেষ্টাই চেনে সেই গাং, বনের গহন অঞ্চল পুলিশকে সেইই নিয়ে যেতে পারে ওখানে। আর যা করার তাড়াতাড়িই করতে হবে।

হোঁৎকা বলে একটা কিছু করতি হইব!

আমি বলি—স্যার। ওই কেষ্টা আর ও ওর দলের পাঁচ ছজনের সঙ্গে নৌকায় এসেছে। ওরা না ফিরলে লোকগুলো মায় সর্দারও জেনে ফেলবে কিছু অঘটন ঘটেছে।

নরেনবাবু কি ভেবে বলেন কেষ্টাকে–ঠিক আছে, যা তুই ফিরে যা। তবে বলিস না এখানে এসেছিলি, তোরা ফিরবি কোনো দিকে?

কেষ্টা বলে—ওরা বলছিল বাঘনার গাং দিয়েই ফিরবে মরিচঝাঁপির ফোড়ন দিয়ে। নরেনবাবু বলেন—ঠিক আছে, তুই যা।

কেষ্টা ছাড়া পেয়ে দৌড়লো।

আমরা বলি—ছেড়ে দিলেন ওটাকে!

হোঁৎকা বলে—এখন কি হইব?

নরেনবাবু বলেন দ্যাখনা এবার কি হয়। এর মধ্যে কয়েকটা মেসেজ দিতে হবে।

আমরা বলি আমরা চলে যাব?

নরেনবাবু বলেন কলকাতায় তোমাদের বন্ধুর বাড়িতে এতক্ষণ পুলিশ থেকে ফোনে সব খবরই চলে গেছে। ওরাও বোধহয় রওনা দেবেন এখনই ।

এখানেই থেকে যাও তোমরা। পুলিশ ওদিক থেকে কোনো মেসেজ থাকলে আমাদের এখুনিই জানাবে।

নরেনবাবু আবার পুলিশ হেড কোয়ার্টারে বি-এস এফের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে থাকেন।

আমরা ক্যাম্পে ফিরে গিয়ে কি করব ভাবতে পারছি না।

অবশ্য কলকাতার মেসেজ এসেছে পটলার কাকা এখানেই আসছেন, তাই আমাদের এখন এখানেই থাকতে হবে।

নরেনবাবুই আমাদের লঞ্চের সারেংকে বলে কাশেম মিঞা, লঞ্চ নিয়ে আপনি ধামাখালির ক্যাম্পে চলে যান। সেখানে কলকাতা থেকে পটলের কাকাবাবু আসছেন তাকে নিয়ে সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরে আসবেন এখানে।

লঞ্চ চলে গেল, আমরা রয়ে গেলাম ফরেস্টের রেস্ট হাউসে।

ওখানেই দুপুরের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থাও হয়েছে। হোঁৎকা বলে—কি গড়বড় হইল সবকিছু।

গোাবরা বলে পটলার কাকাবাবু আসছেন ।

হোঁৎকা বলে কিছু বুঝছি না। ওই কিষ্টারে ছাড়লো ক্যান?

এদিকে দেখি ঘাটে এসে ভিড়েছে একটা লঞ্চ ।

বৈকাল হবো হবো, নরেনবাবু বলেন—চলো, দেখা যাক প্রাথমিক কাজটা কতদূর করা যায়।

লঞ্চ নিয়ে আমরা বাঘনা নদী ধরে চলেছি। এর একদিকে বন, আর এপাশে বাঁধের নীচে দু’ একটা ঘর দেখা যাচ্ছে। শেষ জনবসতি, এরপর বসতি আর নাই, নদী আর গহন বন। আমাদের লঞ্চটা একটা ঝোপের ধারে এসে থামল, ওদিকে বনের ভিতর একটা খাল চলে গেছে। একটা হাট ফেরত দু’একটা নৌকায় লোকজন চলেছে।

দেখা যায় একটা নৌকায় কেষ্টা রয়েছে আর ছ’সাতজন লোক নৌকায় মালপত্র নিয়ে চলেছে। ওরা এবার বনের মধ্যে খালে ঢুকে উধাও হয়ে যাবে।

হঠাৎ বনের ভিতর থেকে একটা লঞ্চ থেকে বিকট জোরে সাইরেন বেজে ওঠে। ওই নৌকার লোকজন সচকিত হয়ে নৌকা খালের ধারে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতে বনের ভিতর থেকে পুলিশের একটা লঞ্চ এগিয়ে এসে ওদের পথ আটকে দাঁড়ায়।

এপাশ থেকে ফরেস্টের লঞ্চও গিয়ে তাদের রুখেছে। গার্ডদের হাতে বন্দুক, ওদিকে পুলিশও তৈরি।

কেষ্টাদের নৌকা থেকে একজন জলে ঝাঁপ দিতেই পুলিশের লঞ্চ এসে তাকে ফাঁস দিয়ে

ধরে টেনে তোলে। আর নৌকার সবকটাকেই পুলিশ ঘিরে ফেলে অ্যারেস্ট করে তাদের লঞ্চে তোলে। মাল বোঝাই নৌকাটাকেও টেনে এনে ফরেস্টের জেটিতে লাগায়।

এতদিন পর ভূপতি সর্দারের দলের কয়েকজনকে হাতে-নাতে ধরেছে পুলিশ।

এবার বুঝতে পারি নরেনবাবু কেষ্টাকে কেন ছেড়ে দিয়েছিল। ওকে না ছাড়লে দলের বাকি ক’জনকে ধরতে পারত না। লোকগুলোকে দড়ি দিয়ে পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা হয়েছে। আর পুলিশ গর্জায় কোথায় তোদের আস্তানা-তাই বল।

লোকগুলো মুখ খুলতে চায় না। পুলিশও ছাড়বে না।

বৈকাল নামছে, এর মধ্যে পুলিশের নানা প্রকারের জেরার চোটে কয়েকজন মুখ খুলেছে। ততক্ষণে বি-এস-এফের একটা লঞ্চও এসে পড়েছে সদরের নির্দেশে।

নকুলবাবু আমাদের লঞ্চটাকে বিদায় করে এবার নিশ্চিত হয়। বিট অফিসারও নাই, নকুলবাবু ওই দিনই লোকজন নিয়ে বেশ দ্রুতগতিতে অনেক দামি কাঠ কেটে ফেলে সাইজ করে নৌকাতে বোঝাই করে ফেলে।

নৌকাগুলো মাল নিয়ে যাত্রা করবে এই জোয়ারে। তার আগেই সে অন্য নৌকায় নোটন আরও কজনকে নিয়ে বের হয়। এই নৌকাটায় একটা ইঞ্জিনও লাগানো।

নকুলবাবু বিশেষ কাজে এইটা নিয়ে যাতায়াত করে। তার জন্য বিশেষ কিছু মাল আসবে বনের মধ্যে একটা জায়গায় বর্ডার পার হয়ে। সেগুলো নিয়ে ফিরবে সে ধামাখালির ক্যাম্পে। তাই বের হয় সে বৈকালেই সেই গন্তব্যস্থানের উদ্দেশে।

কপিল সর্দারের ব্যবসাপত্র ভালোই চলছে। গহনবনের এক এক ঠাঁই। এসে কিছুদিনের জন্য নৌকা বসত গড়ে তোলে। ওইটাই তার অস্থায়ী হেডকোয়ার্টার।

তবে এক জায়গায় সে বেশিদিন থাকে না, থাকা নিরাপদ নয়। তাই মাঝে মাঝে দলবল নিয়ে সর্দার ঠাঁই বদল করে।

সেই ভাবেই এখানে এসে রয়েছে কদিন ভূপতি সর্দার। তার জাল বহুদূর অবধি ছড়ানো। আবাদের অনেক ধনী লোক তাকে খুশি রাখে। তার জন্য মোটা টাকা মাসোহারা দেয়, বড় বড় মাছের আড়তদার কাঠ মহাজনদেরও মাসকাবারি দিতে হয় যথাস্থানে, না হলে এই বাদাবনে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য করে খেতে হবে না।

নকুলবাবুও সেটা জানে। সে আরও বুদ্ধিমান। তাই ওই প্রণামী দেওয়া ছাড়াও ভূপতি সর্দারের সাহায্যে অন্য ব্যবসাপত্র শুরু করেছে।

অবশ্য মূলধন নকুলবাবুর। বর্ডারের ওপার থেকে দুস্তর গাং এই গহন সুন্দরবন পার হয়ে প্রচুর, বিদেশি মালপত্র আনা হয় ৷

এসব আনে নকুলবাবুর লোকজনই কিন্তু তাদের মদত দেয় এই ভূপতি সর্দারের লোক। সীমান্তের গাং-এ বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স এর টহলদারী লঞ্চ ঘুরে বেড়ায়। এরা তাদের ফাঁকি দিয়ে বনের কোনো সুড়ি পথে মাল আনে। মাঝে মাঝে গুলি বিনিময়ও হয়।

এরাও সেই বিদ্যায় কম নয়, এদের কাছে আধুনিক অস্ত্রও আছে। তাই দরকার হলে মোকাবিলা করেও পালিয়ে আসে কোনো গোপন পথে। মাল চলাচল-এর কাজ ঠিকই চলে।

কপিল সর্দার এসবের জন্য মোটা টাকাই বখরা হিসাবে পায়। আর পার্টিরাও তাদের মাল পেয়ে যায়। ভূপতি সর্দার এছাড়াও মাঝে মাঝে তা বুঝে কোনো বিদ্রোহী মহাজনকে সযুত করার জন্যই তার নৌকার জেলে বা কাঠুরিয়াদের ধরে মোটা টাকা মুক্তিপণ আদায় করে। কপিল সর্দার ডিঙিতে তার অস্থায়ী ক্যাম্প পরিদর্শন করে নিজের বোটে উঠে আসে। বেশ ছিমছাম আধুনিক কায়দায় সাজানো বোট। তাতে শক্তিশালী ইঞ্জিন লাগানো। এছাড়াও বেশ কিছু ভুটভুটিও আছে।

সর্দার এককালে লঞ্চ নিয়ে মাছের ব্যবসা করত। এই সুন্দরবনের নদী খাড়ি তার চেনা। ক্রমশ ভূপতি বুঝেছিল জোর যার মুল্লুক তার।

বাদাবনে ক্রমশ সেই নীতির জোরেই সে বড়লোক হয়ে ওঠে। মাছের নৌকা লুট শুরু করে ক্রমশ সে মানুষের সর্বস্ব লুট করতে শুরু করে আজ এইখানে পৌঁছেছে, ঠান্ডা মাথায় মানুষ খুন করতেও তার বাধে না।

কত গরিব জেলে-বাওয়ালি তার কাজের প্রতিবাদ করতে গাং-এ তলিয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নাই ।”

কপিল ক্রমশ দলপতি হয়ে ওঠে।

বৈকালে সব দেখে শুনে আসে। গাছের ডালে তার পাহারাদার থাকে। শিকার গাং-এ ঢোকার মুখেই সে খবর পায় ।

কপিল পটলাকেও দেখে।

–কি রে!

পটলা চুপ করে থাকে। কপিল বলে—দু লাখ টাকা এলেই তোকে মোল্লাখালির লঞ্চে তুলে দেব। সে কদিন থাক। আর সাতদিনের মধ্যে টাকা না এলে—তখন খতম।

পটলা চুপ করেই থাকে। ভয়ও হয়। কিন্তু বেশ বুঝেছে সে এই মানুষটার কাছে দয়া চাওয়া বৃথা।

সর্দার শুধোয়-এ্যাই ভুতো, ন্যাপারা এখনও হাট থেকে ফেরেনি?

ন্যাপা নৌকা মেরামতের কাজ করছিল, ডাঙায় নৌকা তুলে পরীক্ষা করতে হয় তলার কাঠ—বোড় ঠিকঠাক আছে কিনা। সেগুলো মেরামত রং করতে হয় মিস্ত্রির কাজ করার লোকদের দিয়ে।

ভুতো বলে—এখনও ফেরার টাইম হয়নি। এতটা পথ যাতায়াত করতে হবে। হাটে মাল তুলে তবে তো আসবে। এসে যাবে ।

সন্ধ্যা নামে, রাত ঘনায়। তখনও ফেরে না সেই ন্যাপার দল হাট থেকে। এবার ভাবনায় পড়ে কপিল সর্দার।

এমন সময় অন্ধকারে ‘কু’ শব্দ ওঠে, যেন কোনো পাখিই ডাকছে। ডাকটা এদিক ওদিকে ধ্বনি প্রতিধ্বনি তোলে। গাং-এর বুকে নৌকার ইঞ্জিনের শব্দ।

কপিল সচকিত হয়ে ওঠে। ওই ডাকে বুঝতে পারে, সে তাদেরই কোনো নৌকা আসছে, অর্থাৎ সেই নৌকাকে তার খালে ঢোকার অনুমতি দিয়েছে।

কপিল নিশ্চিত হয় হাট থেকে বোধহয় ন্যাপারাই ফিরছে, সে এসে পাটাতনে দাঁড়ায়। নৌকাটা এসে তার নৌকার গায়ে লাগে। উঠে আসে একজন।

কপিল হতাশ হয়—ন্যাপার নৌকা এ নয়। এসেছে তার এক পার্টনার নকুলবাবু। ছই এর ভিতরে ঢুকে যায় ওকে নিয়ে।

নকুল বলে—ফরেস্টের চালান এসেছে আমার ?

কপিল তখনও চিন্তায় রয়েছে, তবু কারবার করতে হবে। তাই বলে,

—হ্যাঁ, মাল নিয়ে যাও তোমার। ওই যে! পেটি দুটো দেখায়! নকুল জানে এই চালানে তার বেশ মোটা লাভই হবে। তাই সর্দারকে সে একটা থলে এগিয়ে দিয়ে বলে—পঞ্চাশ হাজার টাকা আছে। কপিল টাকাটা নেয়। নকুলবাবু বলে,

-আর দুলাখ আসছে সর্দার, আমার কমিশন যেন ঠিক থাকে। ওই ছেলেটাকে ছাড়াতে ওরা টাকাই দেবে !

ভূপতি বলে—এলে পাবে।

নকুল তার নৌকায় মাল তুলে নিয়ে বের হবে রাতের বেলা এত টাকার মাল নকুল কাউকে বিশ্বাস করে না। কে জানে এ-মাল নিয়ে বের হলে মাঝগাং-এ এই তার দলকে দিয়ে লুট করিয়ে সব কেড়ে নেবে।

তাই ওর নৌকা বসতেই রাতটা পার করে ভোরেই বের হবে। এই ভেবে সে নৌকাটা এনে ওদের নৌকাগুলোর কাছাকাছি নোঙর করে রয়েছে, ওদের কাছাকাছি থাকাই নিরাপদ।

কপিল এবার চিন্তায় পড়ে। হাট থেকে ওরা ফিরল না। ওদের কোনো বিপদ হলে তাদেরও বিপদ, অথচ কোনো খবরও নাই। ভূপতি রাতের বেলাতেই তার দলের বিশ্বস্ত নেতা ক’জনকে ডেকে আনে নৌকায় ৷

—ওরা ফিরল না। পুলিশের হাতে ধরা পড়েনি তো?

এরাও ভাবছে কথাটা কপিল বলে রাতেই তোরা ক’জন চলে যা, হাটের রহিম ওস্তাগর আমাদের চেনা জানা। তার কাছে গেলে খবর পাবি। হোঁশিয়ার! বিপদ দেখলে কোনরকমে এসে খবর দিবি।

সন্ধ্যার পরই বাঘনা ফরেস্ট অফিসের জেটিতে দুতিনটে লঞ্চ, ট্রলার পুলিশের লঞ্চ, বি-এস-এফের দুটো লঞ্চ এসে পড়ে। নরেনবাবু অন্যদের সঙ্গে কি আলোচনা করছে। তারপরই কেষ্টা আর ওদের দলের একজনকে নিয়ে লঞ্চে তোলে।

আমি হোঁৎকা, ফটিক, গোবর্ধনও রয়েছি ফরেস্টের লঞ্চে। পুলিশ-বি-এস-এফের লোক কেষ্টা আর সেই লোকটাকে তাদের লঞ্চে তুলে এবার যাত্রা করে।

আগে বি এস এফ-এর লঞ্চ দুটো—তারপর পুলিশের লঞ্চ, পিছনে ফরেস্টের লঞ্চ আমরা আবার গাং-এর দিকে চলেছি। কাকাবাবু এখনও আসতে পারেননি। কাশেমের লঞ্চও ফেরেনি। বলা আছে ওর লঞ্চ এলে ওরা যেন এখানেই অপেক্ষা করে।

এর মধ্যে পুলিশ, বি-এস-এফ যুগ্মভাবে তাদের প্ল্যান করে নিয়েছে। ফরেস্টের লঞ্চেও নরেনবাবু, কয়েকজন গার্ড রাইফেল নিয়ে তৈরি। তবে খুব প্রয়োজন না হলে এরা কিছু করবে না। যা করার পুলিশ, বি-এস-এফই করবে।

বি-এস-এফ পথ চেনে, তবু কেষ্টাই তাদের বড় গাং থেকে ভিতরের খালের হদিশ দেয়, খালটা ভিতরে শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে গেছে। এরা লঞ্চদুটোকে একদিকে ঢোকায় আর একটা লঞ্চকে অন্যপথে এগিয়ে যেতে বলে। আমরা রইছি পিছনে।

পুলিশকে আগেই কৌশল বাতলেছিল লোকটা মারের চোটে। খালে ঢুকবার মুখেই পাখির সেই ডাক—সঙ্গে সঙ্গে আলো বসানো রাইফেল থেকে এক ঝলক আলো আর গুলি নিয়ে নিপুণ লক্ষ্যে লাগে গাছের ডালের লোকটার পায়ে আর্তনাদ করে সে নীচের ঝোপে পড়ে ‘কু’ ডাকও থেমে যায় কপিলের সেই পাহারাদারের।

লঞ্চগুলো এগিয়ে চলেছে।

কপিল সর্দার তার দলবল চমকে ওঠে ওই শব্দে। রাতের নির্জন বনে শব্দটা উঠছে।

দলবল জেগে ওঠে—একি! মনোকে পাহারায় রেখেছিলি?

–হ্যাঁ। গুলির শব্দ শুনলাম সর্দার।

—সেকি! তৈরি হ সবাই ! কোনো ব্যাটাকে ধারে কাছে ভিড়তে দিবি না ।

ওরাও সব সজাগ হয়ে ওঠে।

পটলার ঘুম ভেঙে গেছে, দেখছে নৌকা বহর নিমেষের মধ্যে জেগে গেছে। আর বনের অন্ধকার বিদীর্ণ করে জোরাল সার্চলাইটের আলো গাং-এর দুদিক থেকে এসে পড়ে নৌকাগুলোর উপর।

মাইকে ঘোষণা শোনা যায় কপিল সর্দার, পুলিশ, বি-এস-এফ তোমাদের দুদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। পালাবার চেষ্টা করলেই গুলি করা হবে। যে যার হাতিয়ার ফেলে দুহাত মাথার উপরে তুলে দাঁড়াও। না হলে গুলি করে সব নৌকা ফুটো করে তোমাদের শেষ করা হবে। সর্দারের চ্যালাদেরকে লাফ দিয়ে বনে পালাবার চেষ্টা করতেই গুলিতে সে আর্তনাদ করে ছিটকে পড়ে। চারিদিকের গাং বন আলোয় ভরে গেছে।

কপিল স্বপ্নেও ভাবেনি যে এইভাবে তাদের ডেরা দুদিক থেকে ঘিরে ফেলবে পুলিশ–বি-এস-এফ তাদের জালে ফেলবে। আর লড়াই করা বৃথা। ওদের হাতে অনেক মারণাস্ত্র, শেষই করে দেবে তাদের।

পুলিশ এবার ওদের সবকটাকেই কাউকে দড়িতে বেঁধে, কাউকে হাতকড়া পরিয়ে লঞ্চে তোলে।

পটলাকেও ফিরে পেয়েছি আমরা। হঠাৎ দেখা যায় পুলিশ আর একটা নৌকা থেকে নকুলবাবু, নোটনকে তুলছে বোটে। নকুল আমাদের দেখে বলে—আমি ডাকাত দলের কেউ নই। আমার পার্টনারের ভাইপোকে এরা ধরে এনেছিল, তাই এসেছিলাম এদের কাছে ওকেই ছাড়াবার জন্য। শুধান ওদের।

আমরাও বুঝতে পারি না নকুলবাবু এখানে কেন আসবে। হয়তো পটলার জন্যই এসেছিল। হোঁৎকা বলে—থাম তো। ওটা শয়তানের হাড়। অন্য কোনো মতলব আঁটছে।

পুলিশ অফিসার ওই পেটিটা লঞ্চে তুলে আনে–দেখা যায় ওর মধ্যে মজবুত করে প্যাক করা—সোনার বিস্কুট। পুলিশ অফিসার বলে নকুলবাবুকে-এসব আপনার নৌকায় পাওয়া গেছে। ওদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সোনা স্মাগলিং করেন।

—না স্যার। নকুলবাবু বলে—ওসব কিছুই জানি না স্যার। নরেনবাবু বলে—সব জানা যাবে। চলুন এখন

কাকাবাবুকে অফিসেই পাওয়া যায়। তিনিও আমাদের লঞ্চে উঠে আসেন । পটলাকে উদ্ধার করেই ফিরছি আর একটা মস্ত কাজ করেছিলাম আমরা। ভূপতি সর্দার ওই বাদাবনের আতঙ্ককে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পেরেছি। নকুলবাবু কাকাবাবুকে বলে দেখুন, কি না কি পেয়েছে পুলিশ আমাকে ধরেছে। সোনা স্মাগল করি বলছে। ছাড়ান আমাকে।

পুলিশও এসেছে ধামাখালির গুদামে। কুমড়োর গুদাম। নকুলবাবু বলে—দেখুন স্যার। সোনাদানার ব্যাপারে নাই ।

কিন্তু দেখা যায় বেশ কিছু কুমড়োর গা চৌকো করে দাগানো। সেটাতে দাগ দিতে সেই পিসটা উঠে আসে—সেই পথে কুমড়োর মধ্যে সোনার বিস্কুট ঢুকিয়ে সেই কুমড়ো শহরে চালান আনে নকুলবাবু পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে।

কয়েকটা কুমড়োর মধ্যেই সোনার বিস্কুট মিলতে নকুলবাবু স্তব্ধ ৷

কাকাবাবু বলেন—এর জন্যই বাদাবনে ব্যবসা করতেন নকুলবাবু। আপনিই টাকার লোভে পটলাকে ডাকাতদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, এটা সর্দারই পুলিশকে বলেছে।

পুলিশ নকুলবাবুকেও কপিল সর্দারের দলের সঙ্গে চালান দিল সদরে।

হোঁৎকা বলে—এবার কুলেপাড়ায় ফিরে চল পটলা। যা বাদাবনে আনছিলি, কুন খাদ্যি নাই। আর আসুম না এহানে ৷

তবে বিজয়ীর মতই সেবার সুন্দরবন ভ্রমণ সেরে ফিরেছি আমরা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *