সুন্দরবনের রক্তপাগল

সুন্দরবনের রক্তপাগল

প্রথম – সুন্দরবনে সুন্দরবাবু

বিশাল অরণ্য—সাম্রাজ্য! তরঙ্গিত শ্যামলতার মহাসাগর!

দুর্ভেদ্য জঙ্গলের প্রাচীর—তার ভিতর দিয়ে যাতায়াতও করতে পারে না মানুষ। আবার ইচ্ছা থাকলেও মানুষ এই জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আনাগোনা করতে ভরসা করে না, কারণ এ হচ্ছে মহা বিপজ্জনক স্থান। এখানকার প্রধান বাসিন্দা হচ্ছে ‘রয়েল বেঙ্গল’ ব্যাঘ্র এবং তার উপর আছে ‘বয়ার’ বা বন্য মহিষ—তারাও এমন হিংস্র যে শিকারিরা তাদের বাঘের চেয়ে কম ভয় করে না। আর আছে পাঁচ ফুট লম্বা ও তিন ফুট উঁচু তীক্ষ্নদন্তধারী ভীষণ বন্য বরাহ। মাঝে মাঝে আজও গণ্ডারের দেখা পাওয়া যায়। প্রতি পদেই এখানে সর্পভয়। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড অজগর তো আছেই এবং সেই সঙ্গে আছে এত জাতের বিষধর সর্প, পৃথিবীর কোথাও পাওয়া যায় না যাদের তুলনা। তাদের নামও কত—রকম! ধনীরাজ, দুধরাজ, পাতরাজ, মণিরাজ, ভীমরাজ, মণিচূড়, শঙ্খচূড়, শাঁখামুঠি, নাগরচাঁদ, গোখুরা ও কেউটে প্রভৃতি। এদের প্রত্যেকেরই দংশন হচ্ছে মারাত্মক। কাজেই মানুষ নিতান্ত দায়ে না পড়লে এই ভয়াবহ অরণ্যের ত্রিসীমানায় আসতে রাজি হয় না।

এই বিপুল অরণ্য ভেদ করে যেখান—সেখান দিয়ে বয়ে যাচ্ছে বড়ো, মাঝারি ও ছোটো নদ আর নদী এবং খাল আর নালা। সাধারণত এই জলপথের সাহায্যেই মানুষ কতটা নিশ্চিন্ত হয়ে এখানে আনাগোনা করতে পারে। কিন্তু এই জলপথও কিছুমাত্র নিরাপদ নয়। কারণ, নৌকো থেকে নত হয়ে হস্ত—প্রক্ষালণের জন্যে তুমি যদি একবার জলস্পর্শ করবার চেষ্টা করো, তাহলে পরমুহূর্তেই হয়তো নৌকার উপর থেকে একেবারে অদৃশ্য হয়ে যাবে! এখানকার প্রত্যেক নদীতে বাস করে অসংখ্য বড়ো বড়ো কুমির! সর্বদাই তারা সচেতন হয়ে আছে, কখন তোমাকে নিজের কবলগত করবার সুযোগ পাবে বলে।

অরণ্যের মাঝে মাঝে ছোটো—বড়ো মাঠ আর জলাভূমি। সেসব জায়গায় গিয়ে কবিত্ব প্রকাশ করবার কোনও উপায় নেই। দেখতে সুন্দর হলেও সেখানকার বাতাস পর্যন্ত বিষাক্ত।

অরণ্যের মাঝে যেখানে—সেখানে দেখা যায় ‘সুন্দরী’ গাছের ভিড়। তাদের আকার সুদীর্ঘ, সুকঠিন কাঠের রং লাল! পাতা ছোটো ছোটো, পাতাগুলির উপরদিকে খুব তেলা ও নীচের দিকের রং ধূসর। এ বনে গাছ আছে আরও অনেক জাতের, তাদের অনেকের নামও বেশ বিচিত্র! যথা—ধোন্দল, গেঁয়ো, বাইন, কেওড়া, বলা, গরান, হেন্তাল, গর্জন, গাব ও বনঝাউ। এখানে গোলপাতা ও হোগলাও দেখা যায় যেখানে—সেখানে।

বলা বাহুল্য, এই পৃথিবীবিখ্যাত অরণ্যের নাম—সুন্দরবন। দক্ষিণবাংলা বলতে বোঝায় এই অতি—ভীষণ সুন্দরবনকেই।

এই অরণ্যের যেখানে সমাপ্তি সেইখান থেকে আরম্ভ হয়েছে অনন্ত সাগরের চিরন্তন উচ্ছ্বাস!

এই সুন্দরবনের একটি অবৃহৎ নদীর ভিতর দিয়ে চারিদিকের নীরবতাকে শব্দিত করে ছুটে চলেছে একখানি মোটরবোট। তখন সন্ধ্যাবেলা—যদিও পূর্ণিমার চাঁদকে দেখে অন্ধকার সেদিন বেরিয়ে আসতে পারেনি বনের ভিতর থেকে। বোটের এখানে—সেখানে বসে রয়েছে কয়েকজন দীর্ঘাকার বলবান ব্যক্তি, উর্দি না থাকলেও তাদের দেখে বুঝতে বিলম্ব হয় না যে, তারা পুলিশ—ফৌজের অন্তর্গত!

মোটরবোটের ভিতর বসে আছেন এক ব্যক্তি, তাঁর পরনে ছিল উচ্চতম পুলিশ—কর্মচারীদের মার্কা—মারা পোশাক। তিনি টুপিটি খুলে রেখেছিলেন বলে দেখা যাচ্ছে, তাঁর সারা মাথাটি জুড়ে বিরাজ করছে প্রকাণ্ড একটি টাক। এবং তেমনি প্রকাণ্ড তাঁর ভুঁড়িটি, এমন হৃষ্টপুষ্ট দোদুল্যমান ভুঁড়ি কোনও পুলিশ—কর্মচারীর দেহেই শোভা পায় না। বোটের ভিতরে বসে তিনি এদিকের ও ওদিকের গবাক্ষ দিয়ে নদীর দুই তীরের দিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টিপাত করছিলেন বারংবার।

কিন্তু নদীর কোনওদিকেই সন্দেহজনক কিছুই দেখা যায় না। নদীর দুই তীরের বনের গাছপালা করছে সুমধুর মর্মরধ্বনি এবং মাথার উপরকার সমুজ্জ্বল আকাশের গায়ে জেগে আছে পূর্ণচন্দ্রের জ্যোতির্ময় মুখ। কোথাও মানুষ বা অন্য কোনও জন্তুর সাড়া নেই, এমনকি, সুন্দরবনের ব্যাঘ্রদের কণ্ঠেও এখনও জাগ্রত হয়নি বিভীষণ মৃত্যু—ধ্রুপদ!

নদীর জলকে ফেনায়িত করে সমানে ছুটে চলেছে কলের নৌকো। প্রকৃতির আদিম ও স্বাভাবিক সৌন্দর্যের মধ্যে কৃত্রিম ও আধুনিক এই মোটরবোটকে দেখাচ্ছে অত্যন্ত বেমানান। কিন্তু উপায় নেই, যেখানে হবে আধুনিক সভ্যতার পদার্পণ, প্রকৃতির স্বাভাবিক সৌন্দর্যের মধ্যে সেখানেই হবে ছন্দপাত।

আচম্বিতে হল এক ধারণাতীত ব্যাপার! মোটরবোট বাধা পেয়ে অধিকতর উচ্চস্বরে করে উঠল এক ক্রুদ্ধ গর্জন। কলের নৌকো আর অগ্রসর হতে পারলে না।

বোটের ভিতরকার সেই হৃষ্টপুষ্ট লোকটি বলে উঠলেন, ‘হুম! হল কী? বোটের কল—কবজা খারাপ হয়ে গেল নাকি?’

বোট যে চালাচ্ছিল সে বললে, ‘না হুজুর, বোটের সামনে জলের ভিতর থেকে জেগে উঠেছে দু—গাছা মোটা কাছি।’

—’কাছি কী বাপু? জলের ভিতরে কাছিম থাকতে পারে, কিন্তু জলের ভিতর থেকে কাছি ভেসে ওঠে এমন কথাও তো কখনও শুনিনি!’

—’হ্যাঁ হুজুর, জলের ভিতর থেকে ভেসে উঠেছে দু—গাছা কাছি! চেয়ে দেখুন, কাছি দু—গাছা নদীর এপার থেকে ওপার পর্যন্ত চলে গিয়েছে। ও কাছি কারা ধরে আছে জানি না, কিন্তু তারা বোধহয় আমাদের বাধা দিতে চায়!’

—’বাধা দিতে চায়? হুম! তাহলে ব্যাপারটা বেশ বোঝাই যাচ্ছে! যাদের ধরবার জন্যে আমরা এসেছি এ অঞ্চলে, তারাই বোধহয় আমাদের ধরবার ফিকিরে আছে! বোটের মুখ ফেরাও, বোটের মুখ ফেরাও! যেদিক থেকে আসছি আবার সেইদিকে ফিরে চলো!’

বোট কিন্তু মুখ ফিরিয়েও মুক্তিলাভ করতে পারলে না। কারণ ইতিমধ্যে ওদিকেও জেগে উঠেছে আরও দু—গাছা মোটা মোটা কাছি! বোটের এখন এদিক বা ওদিক কোনও দিকেই যাবার উপায় নেই!

হৃষ্টপুষ্ট ব্যক্তিটির ললাটদেশ তখন ঘর্মাক্ত হয়ে উঠেছে। রুমাল দিয়ে কপাল মুছতে মুছতে এবং হাঁসফাঁস করতে করতে ভিতর থেকে বাইরে এসে তিনি বললেন, ‘পঁচিশ বছর পুলিশে চাকরি করছি! এমনভাবে ফাঁদে—পড়া ইঁদুরের মতন মরতে আমি রাজি নই! আমি এখনই জলে ঝাঁপ খাব!’

এক ব্যক্তি বললে, ‘সে কী স্যার! জলে ঝাঁপ খাবেন কী? শুনেছি আপনি তো সাঁতার জানেন না!’

—’হুম! সাঁতার জানি না বটে, কিন্তু তোমরা ভেবেছ কি আমি হচ্ছি নিতান্ত নাবালক? আমার জামার তলায় আছে জলে ভেসে থাকবার পোশাক! স্রোতের টানে ভাসতে ভাসতে অনায়াসেই আমি বিপদের বাইরে গিয়ে পড়তে পারব—কিছুতেই আমি ডুবব না। বাপু হে, জলপথে যখন শত্রুপুরীতে এসেছি, তখন কি আমি প্রস্তুত হয়ে আসিনি মনে করো?’

—’কিন্তু স্যার, এখানকার নদীতে কিলবিল করে কুমিরের দল! তাদের কেউ না কেউ আপনাকে কাঁৎ করে গিলে ফেলবে।’

—’ধ্যাৎ, বোকারাম কোথাকার! তুমি কি জানো না মানুষ যতক্ষণ জলে সাঁতার কাটে, কুমির তাকে ধরতে পারে না? মানুষ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেই কুমির তার লক্ষ্য স্থির করতে পারে!’

হঠাৎ আর—একজন বলে উঠল, ‘হুজুর, নদীর দু—তীরের দিকে তাকিয়ে দেখুন! ওদিক থেকে দু—খানা আর এদিক থেকে দু—খানা নৌকো তরতর করে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে!’

—’ওরা আমাদেরই বন্দি করতে আসছে! এইবারে আমি জলে ঝাঁপ খাব!’

—’কিন্তু স্যার, আপনি তো জলে ঝাঁপ খেয়ে হয় পাতালে, নয় কুমিরের পেটে গিয়ে হাজির হবেন! আমরা এখন কী করি।’

—’সাঁতার জানা থাকে তো জলে ঝাঁপ খাও, হয়তো বোম্বেটেদের হাতে ধরা দাও! এসময়ের মূলমন্ত্র কী জানো? চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা!’

—’না স্যার, আমরা ওদের হাতে ধরা দেব না, আমরা ওদের সঙ্গে লড়াই করব!’

—’দলে ওরা ভারী, ওদের সঙ্গে লড়াই করে সুবিধে করে উঠতে পারবে কি? বেশ, তোমাদের যা—খুশি তাই করো, আমি কিন্তু জলে ঝাঁপ খেলুম! জয় মা কালী, জয় মা দুর্গা! শ্রীচরণে ঠাঁই দিয়ো মা! হুম!’

দ্বিতীয় – সবচেয়ে বিস্ময়কর

সেদিন এখানে চায়ের আসরে অতিরিক্ত ঘটা। কারণটা হচ্ছে, জয়ন্ত ও মানিক করেছে আজ বিমল ও কুমারকে প্রভাতি—চায়ের নিমন্ত্রণ!

জয়ন্ত জানত বিমল, কুমার, রামহরি ও বাঘা—এরা সবাই হচ্ছে একই পরিবারের অন্তর্গত। কাজেই বিমল ও কুমারের সঙ্গে এসেছিল রামহরি এবং বাঘাও।

এবং রামহরির রন্ধনের হাত অত্যন্ত সুপটু বলে নিমন্ত্রিত হয়েও তাকে ঢুকতে হয়েছিল রন্ধনশালায়, জয়ন্ত ও মানিকের বিশেষ অনুরোধে।

প্রভাতি—চায়ের আসর হলে কী হয়, রামহরি সেদিন প্রস্তুত করেছিল অনেক—রকম খাবার।

ইতিমধ্যে খাবারের ছোটো এক—দফা হয়ে গেল—গরম গরম টোস্ট, এগ—পোচ এবং চা!

চায়ের পেয়ালায় চামচে দিয়ে চিনি মেশাতে মেশাতে জয়ন্ত বললে, ‘বিমলবাবু, কুমারবাবু, আপনারা তো পৃথিবীর জানা—অজানা বহু দুর্গম দেশে বেড়িয়ে এসেছেন। এমনকি পৃথিবীর বাইরে মঙ্গল—গ্রহে গিয়েও পদার্পণ করতে ছাড়েননি! কিন্তু বলতে পারেন কি, আপনারা সবচেয়ে বিস্ময়কর কী দেখেছেন?’

বিমল একটা চুমুক দিয়ে চায়ের পেয়ালাটা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে বললে, ‘সবচেয়ে বিস্ময়কর কী দেখেছি? কুমার, তুমি এ প্রশ্নের কী উত্তর দিতে চাও?’

কুমার হাসতে হাসতে বললে, ‘জীবনে আমার কাছে সবচেয়ে আশ্চর্য হচ্ছে, আমাদের এই বাঘা!’

মানিক বললে, ‘বাঘা? শুনেছি আপনারা ময়নামতীর মায়াকাননে গিয়ে আদিম পৃথিবীর অতিকায় জীব ডাইনোসর প্রভৃতির সঙ্গেও আলাপ করে এসেছেন। বাঘা কি তাদের চেয়েও আশ্চর্য?’

বিমল উচ্ছ্বসিত স্বরে বললে, ‘নিশ্চয়, নিশ্চয়! বাঘার চেয়ে আশ্চর্য কোনও কিছু আমিও জীবনে দেখিনি!’

জয়ন্ত বললে, ‘বাঘাকে আপনি ভালোবাসেন, তাই ওকথা বলছেন! লোকে যাকে ভালোবাসে, তাকেই সবচেয়ে বড়ো বলে মনে করে। ওই তো একটা দেশি কুকুর—’

বিমল বাধা দিয়ে বলে উঠল, ‘জয়ন্তবাবু, আপনার মতন বুদ্ধিমান লোকও যদি গোলাম মনোবৃত্তির পরিচয় দেন, তাহলে আমরা অত্যন্ত দুঃখিত হব। সাদা চামড়ারা এই কালো বাংলাদেশ আর এই কালো বাঙালিকে ঘৃণা করে বলে এ—দেশের কুকুর বাঘাও কি হবে ঘৃণ্য জীব? বাঘাকে আপনারা এখনও চেনবার সুযোগ পাননি। কুকুর হলেও সে হচ্ছে অদ্ভুত, বাংলার গৌরব! ইউরোপ—আমেরিকার যে—কোনও ‘পেডিগ্রি—ডগের’ চেয়েও সে হচ্ছে উচ্চতর শ্রেণির জীব! বাঘাকে আমরা যদি হুকুম দি, তাহলে সে একলাই সিংহেরও উপরে গিয়ে লাফিয়ে পড়তে পারে। কত বড়ো বড়ো সাংঘাতিক বিপদ থেকে বাঘা আমাদের উদ্ধার করেছে, সে—কথা তো আপনারা জানেন না! বাঘাকে আমরা অধিকাংশ মানুষের চেয়ে শ্রদ্ধা করি!’

কুমার বললে, ‘শুধু আমরা নই, বাংলার কবি ঈশ্বর গুপ্ত পর্যন্ত অনেক—কাল আগেই বলে গিয়েছেন :

 ‘কত রূপ স্নেহ করি দেশের কুকুর ধরি’

 বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া।’—

জয়ন্তবাবু, বাঘা হচ্ছে বাংলার কুকুর, কিন্তু তার ভিতরে গোলাম মনোবৃত্তি নেই। ঠিকমতো যত্ন করলে আর পালন করতে পারলে বাংলার নিজস্ব কুকুরও যে কতখানি অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে, বাঘা হচ্ছে তারই জ্বলন্ত প্রমাণ!’

ঘরের এক প্রান্ত দিয়ে একটা নেংটি ইঁদুর ল্যাজ তুলে তিরের মতো কোণের ওই আলমারিটার তলায় গিয়ে ঢুকেছিল, বাঘা এতক্ষণ ছিল তাকেই পুনরাবিষ্কার করবার চেষ্টায় ব্যতিব্যস্ত! কিন্তু পলাতক ইঁদুরের কোনও সন্ধানই পাওয়া গেল না। বাঘা ইঁদুরকে ধরবার চেষ্টা করছিল বটে, কিন্তু সজাগ কানে বারবার শুনছিল তার নিজেরই নাম! অতএব ইঁদুরকে ত্যাগ করে সে এখন তার মনিবদের কাছে যাওয়াই উচিত বলে মনে করলে।

কুমার হাসতে হাসতে বললে, ‘কী রে বাঘা, তুই আবার কী বলতে চাস?’

বাঘা প্রবল বেগে লাঙ্গুল আস্ফালন করে একটি লাফ মেরে বললে, ‘ঘেউ, ঘেউ!’

বিমল হেসে ফেলে বললে, ‘বাঘা রে, তুই দিশি—কুকুর বলে জয়ন্তবাবু আর মানিকবাবু তোকে মানতে রাজি হচ্ছেন না। তুই একবার এঁদের ধমকে দে তো!’

বাঘা তখনই জয়ন্ত আর মানিকের দিকে ফিরে দাঁত—খিঁচিয়ে গম্ভীর স্বরে গরর গরর করে গর্জন করে উঠল!

জয়ন্ত হো হো করে হেসে উঠে বললে, ‘ব্যাস, বিমলবাবু! আপনাকে আর কিছু প্রমাণিত করতে হবে না! বাঘা যে গেল—জন্মে মানুষ ছিল, আর এ—জন্মেও তার কুকুর—দেহের ভিতরে যে মানুষের আত্মা বর্তমান আছে, এ—কথা স্বীকার করতে আমি বাধ্য হচ্ছি! দ্বারপথ দিয়ে দেখতে পাচ্ছি, বারান্দা দিয়ে রামহরি আর মধু আসছে খাবারের ‘ট্রে’ হাতে করে! অতএব মুখ দিয়ে এখন বাক্য ত্যাগ না করে খাদ্য গ্রহণ করাই হচ্ছে বুদ্ধিমানের কাজ!’

ঠিক এই সময়েই শোনা গেল সিঁড়ির উপর দিয়ে ভারী ভারী দ্রুত চলা পায়ের শব্দ!

জয়ন্ত বললে, ‘ওপায়ের শব্দ আমি চিনি! সুন্দরবাবু আসছেন! পায়ের শব্দ শুনেই মনে হচ্ছে ব্যাপার বড়ো গুরুতর!’

বলতে বলতে সুন্দরবাবু এসে হাজির হলেন সেই ঘরের দ্বারদেশে।

মানিক বললে, ‘চতুষ্পদ জীবদের নাসিকার শক্তি নাকি মানুষদেরও চেয়ে প্রখর! কিন্তু সুন্দরবাবু, আপনার ঘ্রাণশক্তি তাদেরও হার মানাতে পারে!’

সুন্দরবাবু মাথার টুপি খুলে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ভ্রূ কুঞ্চিত করে বললেন, ‘একথার মানে কী মানিক?’

—’মানেটা হচ্ছে এই যে, আজ আমাদের এখানে পানাহারের বিশেষ আয়োজন হয়েছে, এ—কথাটা আপনি জানতে পারলেন কেমন করে?’

সুন্দরবাবু ধুপ করে একখানা চেয়ারের উপরে বসে পড়ে বললেন, ‘হুম! পানাহার! পানাহার করতেই আমি এখানে এসেছি বটে! পরপারে যেতে যেতে কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে আজ আমি তোমাদের কাছে ছুটে এসেছি! প্রাণ থাকলে লোকে পেটের কথা ভাবে, আমি এখন পেটের কথা মোটেই ভাবছি না!’

মানিক বললে, ‘তাহলে আপনি কি আজ এখানে দয়া করে কিছুই গ্রহণ করবেন না’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘আমি কি তাই বলছি? হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতে নেই। খাবার তৈরি থাকলে যে খেতে রাজি হয় না আমার মতে সে হচ্ছে—নরাধাম!’

জয়ন্ত বললে, ‘সুন্দরবাবু, হাসি—ঠাট্টার কথা থাক, আপনার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি, আপনি আজ এখানে বেড়াতে বেড়াতে খাবার খেতে আসেননি! ব্যাপার কী বলুন তো?’

সুন্দরবাবু সাগ্রহে একখানা ‘ফ্রেঞ্চ কাটলেট’কে আক্রমণ করে বললেন, ‘বলছি ভায়া, বলছি! এমন ব্যাপার আমি আর কখনও দেখিওনি শুনিওনি! তোমাদের সঙ্গে পরামর্শ না করে আমি কোনও কাজ করি না, জানো তো!…আরে, হুম! বিমলবাবু? কুমারবাবু? আপনারাও আজ এখানে হাজির? আমার ভাগ্য দেখছি খুব ভালো।…আরে, সেই বিচ্ছিরি নেড়িকুত্তাটাকেও সঙ্গে এনেছেন দেখছি যে! আর ব্যাটা আর—সবাইকে ছেড়ে ঠিক আমার দিকেই কটমট করে তাকিয়ে আছে! মশায়, ও কুকুরটা আমার দিকে অমন করে তাকিয়ে থাকলে আমি ভারী নার্ভাস হয়ে যাই! ওকে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতে বলুন।’

কিন্তু বাঘাকে মানা করতে হল না, হঠাৎ নীচে থেকে রামহরির ডাক শুনে এক দৌড় মেরে ঘরের বাইরে চলে গেল।

খানিকক্ষণ পরে ভোজন—পর্ব শেষ হল। সুন্দরবাবু উঠে গিয়ে একখানা আরামপ্রদ সোফার উপর বসে এক পায়ের উপরে আর এক পা তুলে দিয়ে আগে একটি সুদীর্ঘ ‘আঃ’ শব্দ উচ্চারণ করলেন। তারপর একটি চুরোট ধরিয়ে হুস করে খানিকটা ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে শুরু করলেন তাঁর কাহিনি!

সুন্দরবনের ভিতরে দেখা দিয়েছে এক আধুনিক দেবী চৌধুরানি! তাকে এখনও কেউ চোখে দেখেনি, সবাই শুনেছে কেবল তার কণ্ঠস্বর!

জয়ন্ত, তুমি জানো সুন্দরবনের ভিতরে নানা—শ্রেণির ব্যবসায়ীরা সর্বদাই যাতায়াত করে। আর সুন্দরবনের ভিতরে মানুষের যাতায়াতের প্রধান পথ হচ্ছে জলপথ। এত নদী—নালা বোধহয় পৃথিবীর আর কোনও দেশের কোনও অরণ্যেই নেই। সুন্দরবনের জঙ্গল নানা স্থানেই এত ঘনসন্নিবিষ্ট যে, তার ভিতরে মানুষ প্রবেশ করবে কী, দিন—দুপুরে প্রখর সূর্যালোকও প্রবেশ করতে পারে না। জঙ্গল যেখানে পাতলা সেখানেও মানুষের পক্ষে নিরাপদ নয়। হয়তো গাছের উপরে দুলতে থাকে মোটা মোটা অজগর এবং গাছের তলায় মানুষের জন্যে অপেক্ষা করে ব্যাঘ্রাচার্য বৃহল্লাঙ্গুল। এবং সেইসঙ্গে আরও অনেক রকম চতুষ্পদ জীব আর বুকে—হাঁটা বিষাক্ত সরীসৃপও আছে। তবু মোম, মধুর সংগ্রাহক আর কাঠুরিয়াদের জঙ্গলের ভিতরে পায়ে হেঁটে প্রবেশ করা ছাড়া উপায় কিন্তু নেই। যাদের বাধ্য হয়ে পদব্রজে সুন্দরবনের ভিতরে প্রবেশ করতে হয়, তারা মোবরা—গাজির বংশধর নামে খ্যাত ফকিরদের কাছে গিয়ে আগে আশ্রয় নিয়ে থাকে। এই ফকিররা নাকি মন্ত্রগুণে ব্যাঘ্র বা কুমিরের হিংস্র দৃষ্টি মানুষদের উপরে পড়তে দেয় না।

যাক সে কথা। এখন জলপথের কথাই হোক। বলেছি সুন্দরবনের জলপথে নৌকোয় চড়ে নানা—শ্রেণির ব্যবসায়ীরা সর্বদাই আসা—যাওয়া করে থাকে। কিন্তু হঠাৎ এইসব জলপথ হয়ে উঠেছে বিপজ্জনক—এমনকি সাংঘাতিক।

ধরো, কোনও ধনী—ব্যবসায়ীর নৌকো সুন্দরবনের কোনও একটা নদীর ভিতর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। যেতে যেতে নৌকোর আরোহীরা দেখলে দূর থেকে বেগে আর একখানা বড়ো নৌকো (বা সময়ে সময়ে দ্রুতগামী ছিপ) বেগে তাদের কাছে এসে হাজির হল।

সেই বড়ো নৌকো বা ছিপের উপর থেকে একজন লোক চেঁচিয়ে ব্যবসায়ীদেরনৌকোর চালককে ডেকে বললে, ‘মাঝি, একটু আগুন কি দেশলাই আছে ভাই? আমাদের আগুন কি দেশলাই নেই, আমরা তামাক খেতে পাচ্ছি না।’

ব্যবসায়ীদের নৌকোর মাঝি আগুন বা দেশলাই দিয়ে নবাগতকে সাহায্য করতে উদ্যত হল।

কিন্তু সেই সে হাত বাড়িয়ে নতুন নৌকোকে আগুন বা দেশলাই দিতে গেল, অমনি অপর নৌকোর উপর থেকে কেউ তার হাত ধরে টান মেরে তাকে একেবারে জলের ভিতরে ফেলে দিলে। মাঝিহীন নৌকো আর অগ্রসর হতে পারলে না। সেই সুযোগে নতুন নৌকোর উপর থেকে যমদূতের মতন দশ—বারোজন লোক বাঘের মতন লাফ মেরে ব্যবসায়ীদের নৌকোর উপর এসে পড়ল—তারা সকলেই সশস্ত্র। কেবল তরোয়াল বা ছোরা নয়, তাদের সঙ্গে থাকে বন্দুক আর রিভলভার পর্যন্ত।

তারপর তারা ব্যবসায়ীদের নৌকোর সমস্ত আরোহীকে আক্রমণ করে। তারা এমন নির্দয় যে, কারুকেই প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে দেয় না। সকলকেই খুন করে তাদের সঙ্গে টাকাকড়ি বা মূল্যবান যা কিছু থাকে সমস্তই লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়। এমনকি নৌকোখানাকে পর্যন্ত ছাড়ে না। সেখানাকেও তাদের নৌকোর সঙ্গে বেঁধে নিয়ে যায় কোথায়, তা কেউ জানে না।

মাঝে মাঝে আক্রান্ত—ব্যবসায়ীদের নৌকোর ভিতর থেকে দু—একজন লোক কোনও গতিকে জলে ঝাঁপ খেয়ে সাঁতার দিয়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছে। তাদের মুখ থেকেই জানতে পেরেছি বোম্বেটেদের এই আক্রমণ—প্রণালী।

জয়ন্ত, এই আক্রমণের কৌশলটা নতুন নয়। হয়তো তুমি জানো, এদেশে যখন ইংরেজ—শাসনের আরম্ভ, ডাকাত আর বোম্বেটেদের অত্যাচারে বাংলাদেশ তখন ছিল প্রায় অরাজকের মতন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডাকাত আর বোম্বেটেদের তখন আলাদা করে ভাবা হত না। বাংলাদেশ নদী—প্রধান বলে স্থলপথের দস্যুরা তখন প্রায়ই সাহায্য গ্রহণ করত জলপথের। সে—সময়কার ডাকাত বা বোম্বেটেরা যখন কোনও নৌকোর উপর এসে হানা দিত, তখন সুন্দরবনের এই আধুনিক বোম্বেটেদের মতোই প্রথমে গোড়া ফেঁদে বলত, ‘মাঝি, একটু আগুন দেবে ভাই?’ দেখা যাচ্ছে, এই আধুনিক বোম্বেটেরা আবার সেই পুরাতন কৌশলই অবলম্বন করতে চায়।

কিন্তু আর একটি আশ্চর্য ব্যাপার কী জানো? সুন্দরবনে ব্যবসায়ীদের প্রত্যেক নৌকোই যখন আক্রান্ত হয়েছে, তখন শুনতে পাওয়া গেছে এক তীব্র আর তীক্ষ্ন নারীকণ্ঠ! বোম্বেটেরা সকলেই সেই নারীকণ্ঠেরই আদেশ পালন করে।

অথচ সেই নারী যে কে, আজ—পর্যন্ত কেউ তা দেখেনি! আজকাল ছিপের ব্যবহার নেই, কিন্তু এই বোম্বেটেরা মাঝে মাঝে ব্যবহার করে সেই সেকেলে ছিপ। এ শ্রেণির নৌকো—অর্থাৎ ছিপের উপরে কোনওরকম ছাউনি থাকে না; সকলেই তা জানে। কিন্তু ছিপের উপরে এখনও পর্যন্ত কেউ কোনও স্ত্রীলোককে দেখতে পায়নি। সুতরাং আমরা অনুমান করতে পারি, বিংশ শতাব্দীর এই আধুনিক দেবী চৌধুরানি হত্যা ও লুণ্ঠন করে পুরুষের ছদ্মবেশের আড়ালেই।

কর্তাদের হুকুম হয়েছিল, যেমন করে হোক আমাকে এই অতিনৃশংস দস্যুদলকে গ্রেপ্তার করতেই হবে। কারণ সুন্দরবনের জলপথে আজকাল নাকি ব্যবসায়ীদের নৌকোর আনাগোনা বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে। আজ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে নাকি পাঁচ শতেরও বেশি লোক। কর্তাদের হুকুম অবশ্য আমার ভালো লাগেনি মোটেই। যতসব মারাত্মক মামলার ভার আমার ঘাড়েই—বা পড়বে কেন? কিন্তু উপায় নেই, আমি হচ্ছি মাইনের চাকর। হুম! আর বেশিদিন দেরি নেই। পেনশন নিতে পারলেই বাঁচি!

দলবলসুদ্ধ দেবী চৌধুরানিকে পাকড়াও করবার জন্যে যেতে হল আমাকে। সেপাইদের নিয়ে মোটরবোটে চড়ে দিন—পনেরো ধরে সুন্দরবনের নানা নদী—নালাতে ঘুরে ঘুরে বেড়ালুম। কিন্তু একটা বোম্বেটেরও চুলের টিকি পর্যন্ত দেখতে পেলুম না। এমনকি এ—কয়দিনের ভিতরে কোনও ব্যবসায়ীর নৌকোই বোম্বেটের দ্বারা আক্রান্ত হয়নি। আশ্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ভাবলুম, দেবী চৌধুরানি—বেটি তার দলবল নিয়ে বোধহয় পুলিশের ভয়ে সুন্দরবন ছেড়ে চম্পট দিয়েছে।

হায় রে কপাল! পরশু রাত্রেই ভালো করেই টের পেয়েছি, আমার সে বিশ্বাস হচ্ছে একেবারেই বাজে বিশ্বাস! হুম! পরশু রাত্রের কথা ভাবতেও আমার পিলে চমকে যাচ্ছে এখনও। উঃ, সে কী ব্যাপার! একেলে দেবী চৌধুরানি—বেটি কী ধড়িবাজ মেয়ে রে বাবা!

মোটরবোটে চেপে ফিরে আসছিলুম কলকাতার দিকে। আকাশে ছিল চাঁদের আলো, বাতাসে ছিল ফুলন্ত সবুজ পাতার গন্ধ। নদীর জল চাঁদের আলোর লক্ষ লক্ষ হিরের টুকরো নিয়ে লোফালুফি করতে করতে তর তর করে বয়ে যাচ্ছিল গান গাইতে গাইতে। জয়ন্ত, তুমি বিশ্বাস করবে না, হঠাৎ আমার প্রাণে জাগল কবিত্ব! হঠাৎ আমি আত্মহারা হয়ে গেয়ে উঠলুম, রবিঠাকুরের ‘ও আমার চাঁদের আলো’ বলে সেই গানটা! কিন্তু পুলিশের পক্ষে কবিত্ব যে কী সাংঘাতিক জিনিস, সেটা টের পেতে বিলম্ব হল না।

কবিত্বের জোয়ারে ভেসে যেই অন্যমনস্ক হয়েছি, আচম্বিতে আমাদের মোটরবোটের আগে আর পিছনে জেগে উঠল দু—গাছা দু—গাছা করে চার গাছা দড়ির বাধা! আমাদের বোটের এগুবার আর পিছোবার দুই পথই বন্ধ। জলের ভেতরে চার গাছা মোটা কাছি ডুবিয়ে দুই তীরে অপেক্ষা করছিল একেলে দেবী চৌধুরানির দল। বোটকে কবলে পেয়েই তারা করে ফেললে সেখানাকে একেবারেই বন্দি!

কিন্তু হুঁ হুঁ বাবা, আমি হচ্ছি শত শত যুদ্ধজয়ী প্রাচীন পুলিশ কর্মচারী! এত সহজে আমাকে কি হস্তগত করা যায়? জলপথে যাচ্ছি, অথচ আমি সাঁতার জানি না। যদি কোনও অঘটন ঘটে, অগাধ জলের মধ্যে তলিয়ে যাব আড়াই—মণ ওজনের নিরেট লোহার জিনিসের মতো। কাজেই সুন্দরবনের নদীতে বেড়াবার সময় আমার ইউনিফরমের তলায় এমন মজার পোশাক পরেছিলুম যে, আড়াই মণ তিন মণ ওজনের বৃহৎ মানুষকেও তা পাতালের দিকে তলিয়ে যেতে দেয় না কিছুতেই।

অম্লান বদনে খেলুম জলে ঝাঁপ! সেই মোটরবোটের আর আমার দলের লোকদের কী যে হাল হল, তার আমি কিছুই জানি না। কিন্তু আমি খরস্রোতা নদীর টানে ভেসে চললুম রীতিমতো দ্রুতবেগে! তারপর বোধহয় মাইল—কয়েক পথ পার হয়ে ভাসতে ভাসতে উঠলুম গিয়ে নদীর এক তীরে।

তীরে উঠেই শুনলুম, খানিক তফাত থেকে এক ব্যাঘ্র গাইছে হালুম—হুলুম রাগিণী! বোম্বেটেরা ভালো কি বাঘরা ভালো তা নিয়ে আমি মনে মনে আলোচনা করবার কোনও সুযোগ পেলুম না! আমি প্রাণপণ চেষ্টায় চড়ে বসলুম একটা বড়ো গাছের উঁচু ডালের উপরেই।

সেখানে আবার—এক নতুন বিপদ! বিষম কিচির—মিচির আওয়াজ শুনেই বুঝলুম সেই গাছের ডালে বাস করে বোধহয় শত শত বাঁদর! মনে হল, গভীর রাত্রে এই অনাহূত মানুষ—অতিথিকে দেখে সেই শত শত বানরের দল যেন আশ্রয় দিতে মোটেই প্রস্তুত নয়! গাছের ডালের উপর শব্দ শুনেই আন্দাজ করলুম, তাদের কেউ কেউ যেন আসছে আমাকে আক্রমণ করতে! জলে স্থলে শূন্যে গাছের ডালেও আমার জন্যে আজ দেখছি অপেক্ষা করে আছে কেবল বিপদের পর বিপদ! মেজাজ ভীষণ গরম হয়ে উঠল! আর কোনও দয়া—মমতা না করে চতুর্দিকে করতে লাগলুম রিভলভারের গুলিবৃষ্টি! রিভলভারের কী মহিমা! অতবড়ো গাছটা হয়ে গেল একদম নিঃশব্দ! কেবল গাছের তলায় মাটির উপরে শুনতে লাগলুম ধুপ—ধাপ শব্দের পর শব্দ! বুঝলুম, বানরের দল এ গাছের বাসা ছেড়ে মাটির উপরে লাফ মেরে সরে পড়ছে অন্য কোথাও!

বাঁদরের দল তো গেল ভাই, এল আবার নতুন শত্রুর দল! তারা আবার এমন শত্রু যে, কামান দাগলেও ব্যর্থ হবে গোলা ছোড়া! এই হতভাগ্য সুন্দরবাবুকে আক্রমণ করলে ঝাঁকে ঝাঁকে লাখে লাখে ভয়াবহ মশারা মনের সুখে পাঁ পাঁ রাগিণী ভোঁজতে ভোঁজতে। সে যে কী ভয়ঙ্কর কাণ্ড, কলকাতায় বসে তোমরা তা আন্দাজ করতে পারবে না। আমি বলছি তা যে অত্যুক্তি নয়, এখনও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলে তোমরা সেটা কতক আন্দাজ করতে পারবে। বারবার মনে হয়েছিল ডাকুকগে সুন্দরবনের কেঁদো বাঘ, মারি লাফটা আবার মাটির উপরে! যাক, বুদ্ধিমানের মতো সে ইচ্ছা দমন করে ফেলেছিলুম।

কিন্তু জয়ন্ত, একটা কথা এখানে উল্লেখ করা দরকার। যদিও আমি কোনও নারীকে দেখতে পাইনি, কিন্তু নৌকোর উপর থেকে ঝাঁপ খেয়ে আমি যখন অগাধ জলের উপরে ভাসছি, নদীর এক তীর থেকে তখন শুনতে পেয়েছিলুম, খনখনে মেয়ে—গলায় খল খল অট্টহাসির পর অট্টহাসি! সে যে নারীর কণ্ঠ তাতে আর কোনওই সন্দেহ নেই, কিন্তু পৃথিবীর কোনও নারীর কণ্ঠই যে সে—রকম বীভৎস, নিষ্ঠুর আর হিংস্র অট্টহাসি হাসতে পারে, আমি কখনও স্বপ্নেও তা ধারণায় আনতে পারিনি। ভয়ানক বন্ধু, ভয়ংকর! সেই কুৎসিত হাসির ভিতরে জেগে উঠেছিল যেন দুনিয়ার সমস্ত পাপ আর শয়তানি! হুম!’

তৃতীয় – নতুন অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ

জিজ্ঞাসু—চোখে জয়ন্তের মুখের পানে তাকিয়ে চুপ করে বসে রইলেন সুন্দরবাবু।

জয়ন্তও খানিকক্ষণ মুখ নামিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। তারপর মুখ তুলে ধীরে ধীরে বললে, ‘বিমলবাবু, কুমারবাবু, সব তো শুনলেন সুন্দরবাবুর মুখে। আপনাদের কী মনে হয়?’

বিমল বললে, ‘বাংলাদেশে মেয়ে—বোম্বেটের কথা এই প্রথম শুনলুম।’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘কেন, বঙ্কিমবাবুর উপন্যাসে আপনি কি দেবী চৌধুরানির কথা পড়েননি?’

বিমল বললে, ‘পড়েছি। যদিও দেবী চৌধুরানির সঙ্গে ইতিহাসের সম্পর্ক আছে, তবু ওই নারী—চরিত্রটিকে নিয়ে বঙ্কিমবাবু লিখেছিলেন—কাল্পনিক উপন্যাস। আর ইতিহাসের কি উপন্যাসের দেবী চৌধুরানি মেয়ে—বোম্বেটে ছিলেন না। রংপুর অঞ্চলে যখন একবার চাষারা বিদ্রোহী হয়, দেবী চৌধুরানি আর ভবানী পাঠক প্রভৃতির নাম শোনা গিয়েছিল সেই—সময়ে। ভবানী পাঠক যে—কালীর প্রতিমাকে পুজো করতেন, ও অঞ্চলে এখনও তা বিদ্যমান আছে। আমি আর কুমার সেই প্রতিমাকে স্বচক্ষে দেখে এসেছি। কিন্তু সুন্দরবাবু, আজ যে মেয়ে—বোম্বেটের কথা বললেন, আমার কাছে তা অত্যন্ত অদ্ভুত বলেই মনে হল।’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘কেন, অদ্ভুত বলে মনে হল কেন? আপনি কি জানেন না এই কলকাতা শহরেই নামজাদা মেয়ে—গুন্ডা আছে? মেয়ে—গুন্ডা যখন থাকতে পারে, মেয়ে—বোম্বেটেই—বা থাকবে না কেন? হুম! এই পৃথিবীটা হচ্ছে এক আজব জায়গা, এখানে অসম্ভব কিছুই নেই।’

বিমল বললে, ‘আমি আপনার কথায় প্রতিবাদ করছি না সুন্দরবাবু। ব্যাপারটা অদ্ভুত বলে মনে হচ্ছে, তাই বললুম।’

কুমার বললে, ‘মেয়েই হোক আর পুরুষই হোক, প্রত্যেক বোম্বেটের পিছনে কিছু না কিছু পূর্ব—ইতিহাস থাকেই। পুলিশের কর্তব্য হচ্ছে, আগে সেই ইতিহাসের খবর নেওয়া। কোনও মেয়ে—বোম্বেটে হঠাৎ আকাশ থেকে খসে পড়তে পারে না। বোম্বেটে রূপে দেখা দেবার আগেই নিশ্চয়ই সে অন্য কোনও না কোনও রূপে আত্মপ্রকাশ করে। পুলিশের খাতায় আপনি ওই মেয়ে—বোম্বেটের কোনও পূর্ব—ইতিহাস পেয়েছেন কি?’

সুন্দরবাবু মাথা নেড়ে বললেন, ‘কিছুই পাইনি। ওই যা বললেন, এই বোম্বেটে—বেটি ঠিক যেন আকাশ থেকেই খসে পড়েছে।’

জয়ন্ত বললে, ‘সুন্দরবন অঞ্চলে কোনও মেয়ে—বোম্বেটের যে আবির্ভাব হয়েছে, সুন্দরবাবুর কাহিনির ভিতরে আমি তার কোনও প্রমাণই পেলুম না।’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘প্রমাণ পেলে না মানে? তবে এতক্ষণ ধরে আমি কার কথা বললুম?’

সুন্দরবাবুর কথার প্রতিধ্বনি করে জয়ন্ত বললে, ‘কার কথা বললেন, আমিও তাই জিজ্ঞাসা করছি।’

—’কার কথা আবার, আমি ওই মেয়ে—বোম্বেটের কথাই বলেছি।’

—’তাকে কেউ দেখেছে?’

—’না। কিন্তু সবাই তার গলা শুনেছে। হুকুম দেয় সে, আর দলের পুরুষরা সেই হুকুম—মতো কাজ করে।’

—’বুঝলুম। কিন্তু সকলেই—এমনকি আপনিও শুনেছেন কেবল একটি নারীর কণ্ঠস্বর। সেই নারীকে কেউ কোনওদিন দেখেনি, এমনকি তার কোনও পূর্ব—ইতিহাস পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। চোখে না দেখে কেবল কোনও কণ্ঠস্বরের ওপর নির্ভর করে আমি কোনও কথাই বলতে চাই না।’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘শোনা—কথা মাত্রই কি বাজে হয় বাপু?’

—’কোন কথা বাজে আর কোন কথা কাজের তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না। মেয়ে—বোম্বেটের কথা নিয়েও এখন আমি আলোচনা করতে চাই না। আমি নাড়াচাড়া করছি কেবল ওই ঘটনাগুলো নিয়ে। বোঝা যাচ্ছে, সুন্দরবন অঞ্চলে একদল নৃশংস জলদস্যুর আবির্ভাব হয়েছে। তারা খালি ডাকাতি করে না, যাদের উপরে হানা দেয় তাদের প্রত্যেককেই হত্যা করে। আর সব—চেয়ে ভাববার কথা হচ্ছে, ডাকাতরা নৌকোগুলো পর্যন্ত নিয়ে অদৃশ্য হয়।’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘এর মধ্যে আর ভাববার কথা কী আছে?’

জয়ন্ত বললে, ‘ভাববার কথা নেই? ডাকাতরা নৌকোগুলো নিয়ে যায় কেন?’

—’কেন আবার, সমস্ত প্রমাণ নষ্ট করে দেবে বলে। লুটপাটের পর তারা প্রত্যেক মানুষকে খুন করে ওই কারণেই।’

বিমল বললে, ‘সুন্দরবাবু, আমার মনে হয় এই নৌকোচুরির ভিতরে অন্য কোনও রহস্যও থাকতে পারে।’

—’কী রহস্য, শুনি?’

—’আমার বিশ্বাস, ওই ডাকাতদের দলপতি এমন একটা বৃহৎ দল গঠন করছে কিংবা করেছে, যার জন্য দরকার অনেক নৌকোর।’

জয়ন্ত বললে, ‘আমিও বিমলবাবুর কথায় সায় দি।’

সুন্দরবাবু চমকে উঠে বললেন, ‘ও বাবা, হুম!’

মানিক বললে, ‘এ অনুমান যদি সত্য হয়, তাহলে ব্যাপারটা রীতিমতো সাংঘাতিক বলে মানতে হবে। যে ডাকাতরা প্রত্যেক মানুষকেই হত্যা করে, তারা দলে ভারী হলে কি আর রক্ষে আছে?’

জয়ন্ত বললে, ‘আমিও সেই কথাই ভাবছি।’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘ভেবেছি তো আমিও অনেক। খালি ভেবে কী লাভ, একটা উপায় তো করতে হবে?’

জয়ন্ত বললে, ‘আমাদের প্রথম কর্তব্য হচ্ছে, ঘটনাস্থলের দিকে যাত্রা করা।’

সুন্দরবাবু মাথার টাকের উপরে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ‘আরে বাবা, যাত্রা—থিয়েটারের কথা ছেড়ে দাও! যাত্রা তো আমিও করেছিলুম, কিন্তু ফল হল কী? ঘটে বুদ্ধি আছে বলে কোনওগতিকে পৈতৃক প্রাণটি নিয়ে এযাত্রা পালিয়ে আসতে পেরেছি!’

জয়ন্ত বললে, ‘বোকার মতন কাজ করলেই শাস্তিভোগ করতে হয়।’

—’হুম, বোকার মতন আবার কী কাজ করলুম?’

—’আপনি যে চারিদিকে বিজ্ঞাপন প্রচার করতে গিয়েছিলেন!’

—’মানে?’

—’প্রকাশ্যে নৌকো—বোঝাই পুলিশ—ফৌজ নিয়ে আপনি গিয়েছিলেন ডাকাতদের ধরতে। কাজেই আপনাকে ধরতে চেষ্টা করেছিল, তারাই।’

সুন্দরবাবু অনুতপ্তকণ্ঠে বললেন, ‘ঠিক ভাই জয়ন্ত, ঠিক! বড্ড ভুল হয়ে গিয়েছে! হ্যাঁ, আমি স্বীকার করছি ও অঞ্চলে আমাদের যাওয়া উচিত ছিল, ছদ্মবেশে।’

জয়ন্ত বললে, ‘তা যাননি বলেই পুলিশের সাড়া পেয়েই ডাকাতরা প্রথমে জাল গুটিয়ে আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিল। তারপর চমৎকার ফাঁদ পেতে তারা চেষ্টা করেছিল পুলিশ—বাহিনীকে একেবারে উচ্ছেদ করতে!’

সুন্দরবাবু কাঁচুমাচু মুখে বললেন, ‘উচ্ছেদ তো তারা করেছেই, হয়তো দলের ভিতরে বেঁচে আছি খালি আমিই একলা। শুনছি আমাদের বড়ো—সাহেব নাকি আমার উপরে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়েছেন। এখনও তাঁর সঙ্গে মুখোমুখি হইনি, কিন্তু কেমন করে যে মুখরক্ষা করব কিছুই আমি বুঝতে পারছি না। ভাই জয়ন্ত, তুমি একটা সৎপরামর্শ দাও।’

জয়ন্ত বললে, ‘আমার মত যদি মানেন, তাহলে সদলবলে আবার ঘটনাস্থলের দিকে যাত্রা করুন।’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘এবারে তুমিও আমাদের সঙ্গে থাকবে তো?’

—’যদি বলেন, থাকব। আমিও থাকব, মানিকও থাকবে। বিমলবাবু, কুমারবাবু, আপনাদের খবর কী? হাতে কোনও নতুন অ্যাডভেঞ্চার আছে নাকি?’

বিমল মাথা নাড়তে নাড়তে বললে, ‘একটাও না, একটাও না। দুনিয়ায় অত্যন্ত অ্যাডভেঞ্চারের অভাব হয়েছে, আমি আর কুমার এখন বেকার বসে আছি।’

জয়ন্ত হাসতে হাসতে বললে, ‘তাহলে চলুন না, সকলে মিলে একবার সুন্দরবন ভ্রমণ করে আসি।’

বিমল ও কুমার একসঙ্গেই বললে, ‘রাজি!’

মানিক হাসতে হাসতে বললে, ‘জয়ন্ত, ক্যাংলাদের তুমি জিজ্ঞাসা করছ ভাত খাবে কি না! নতুন অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পেলে বিমলবাবু আর কুমারবাবু যে তখনই মেতে উঠবেন, এটা তো জানা কথাই!’

চতুর্থ – বিজনবাবুর প্রমোদ—তরণী

চব্বিশ পরগনার প্রান্তদেশে সমুদ্রের অনেকগুলো বাহু যেখানে সুন্দরবনের মধ্যে প্রবেশ করেছে, তারই কাছাকাছি মাঝারি একটি নদীপথ।

সেই নদীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে নোঙরে বাঁধা ‘লঞ্চ’। সেখানি হচ্ছে বিখ্যাত জমিদার বিজনবিহারী রায়চৌধুরির বাষ্পীয় প্রমোদ—তরণী।

জমিদারি থেকে বিজনবাবুর বার্ষিক আয় চার লক্ষ টাকার উপর। তার উপরে আছে তাঁর ব্যাংকের খাতা। বয়সে তিনি যুবক এবং জমিদারির একমাত্র মালিক! তাঁর নাম জানে না বাংলাদেশে এমন লোক খুব কমই আছে, কেননা দীনদুঃখীদের জন্যে তিনি অর্থব্যয় করেন অকাতরে। তাঁর একটি শখও আছে এবং সেটি হচ্ছে সংগীতপ্রিয়তা। নিয়মিত মাহিনা দিয়ে তিনি অনেক বিখ্যাত সংগীতশিল্পীকে রীতিমতো লালনপালন করেন।

মাঝে মাঝে তিনি তাঁর বাষ্পীয় প্রমোদ—তরণী নিয়ে বেরিয়ে পড়েন বাংলাদেশের নানা জলপথে। বিশেষ করে সুন্দরবন হচ্ছে তাঁর অত্যন্ত প্রিয় জায়গা। এখানে তিনি যখন অবসরযাপন করতে যান, তখন তাঁর সঙ্গে থাকে কয়েকজন সংগীতপ্রিয় বন্ধু এবং কয়েকজন বিখ্যাত গায়ক।

সেদিন ছিল, পূর্ণিমার রাত। পরিপূর্ণ চন্দ্রালোকে সুন্দরবনের অসীম শ্যামলতা হয়ে উঠেছে বিচিত্র এবং জ্যোতির্ময়! বাতাসের ছন্দে ছন্দে নদীর দুই তীরের নির্জন অরণ্যের মধ্য থেকে ভেসে আর ভেসে আসছে অশ্রান্ত মর্মর—রাগিণী! এবং সেই রাগিণীর সঙ্গে সুর জুড়ে দিয়েছে উচ্ছ্বসিত তটিনীর অপূর্ব কলতান!

বিজনবাবুর প্রমোদ—তরণীও নিস্তব্ধ হয়ে ছিল না। ‘লঞ্চে’র উপরকার ছাদের উপরে বসেছে বেশ একটি ছোটোখাটো সভা। সেখানে গায়করা আছেন আর আছেন বিজনবাবু ও তাঁর বন্ধুগণ। একজন বিখ্যাত গায়ক তখন সন্তবাহারে করছিলেন চমৎকার আলাপ।

এমন সময়ে নদীপথে উঠল একটা বেসুরো শব্দ। একখানা মোটরবোট গর্জন করতে করতে এসে থেমে গেল ঠিক প্রমোদ—তরণীর পাশে।

বিজনবাবু ‘লঞ্চে’র ধারেই বসেছিলেন। তিনি একটু অন্যমনস্ক হয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখে বুঝলেন, মোটরবোটখানার কোনও কল বোধহয় বিগড়ে গিয়েছে।

মিনিট চার—পাঁচ পরে মোটরবোটের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন একটি প্রাচীন ভদ্রলোক। উজ্জ্বল চাঁদের আলোকে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছিল, তাঁর মাথার শ্বেত কেশ এবং মুখের ধবধবে লম্বা দাড়ি। ভদ্রলোকের আকারও যে বিশাল দীর্ঘ সেটাও বেশ বোঝা গেল, কিন্তু বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে তাঁর দেহ।

হঠাৎ জেগে উঠল এক নারী—কণ্ঠস্বর। যেন কোনও নারী বললে, ‘এই ‘লঞ্চে’র মালিক কে?’

বিজনবাবু বিস্মিতভাবে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ছাদের রেলিঙে ঝুঁকে পড়ে এদিকে—ওদিকে তাকিয়েও দেখতে পেলেন না কোনও নারীকেই!

তারপরই তাঁর বিস্ময় আরও বেড়ে উঠল। কারণ সেই বৃদ্ধ তাঁকে সম্বোধন করেই আবার সেই নারী—কণ্ঠেই বললে, ‘এই ‘লঞ্চে’র মালিকের সঙ্গে একবার আমার দেখা হবে কি?’

নারী—কণ্ঠে কথা কইছেন ওই বৃদ্ধ ভদ্রলোক!

বিজনবাবু জীবনে কোনও পুরুষের গলাতেই এমন মেয়েলি—আওয়াজ শোনেননি। নিজের হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে তিনি বললেন, ‘আমিই এই ‘লঞ্চে’র মালিক। আপনি কী বলতে চান, বলুন।’

মোটরবোটের বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন, ‘নমস্কার মশাই, নমস্কার। আমার বোট অচল হয়ে গিয়েছে। বোটের চালক বলছে তার ‘পেট্রলে’র ভাণ্ডার ফুরিয়ে গিয়েছে। আপনার কাছ থেকে কিছু ‘পেট্রল’ আশা করতে পারি কি? বড়োই বিপদে পড়েছি মশাই, যদি এই উপকারটি করতে পারেন তাহলে আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ হয়ে থাকব।’

বিজনবাবু বললেন, ‘আমার ‘লঞ্চে’ তো অতিরিক্ত ‘পেট্রল’ নেই! আপনাকে যে এই বিপদে সাহায্য করতে পারলুম না, এজন্যে বড়োই দুঃখিত হচ্ছি।’

বৃদ্ধ স্তব্ধ হয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। তারপর হতাশভাবে বললেন, ‘কার মুখ দেখে বেরিয়েছি জানি না, বড়োই বিপদে পড়লুম। বোট হল অচল, সঙ্গে নেই খাবার, আজ সারারাত অনাহারেই কাটাতে হবে দেখছি! আর কাল সকালেই বা এ—বোট চলবে কেমন করে, তাও তো বুঝতে পারছি না!’

বৃদ্ধ আবার যখন বোটের ভিতরে ঢুকতে উদ্যত হলেন বিজনবাবু সেইসময়ে বললেন, ‘মশাই, আপনার অতটা চিন্তিত হবার কারণ নেই। বোটখানা আমার ‘লঞ্চে’র পিছনে বেঁধে আজ আপনি অনায়াসেই আমাদের সঙ্গে রাত্রিবাস করতে পারেন।’

বৃদ্ধ বললেন, ‘ধন্যবাদ, আপনাকে ধন্যবাদ! কিন্তু আমি তো একলা নই, আমার সঙ্গে রয়েছে যে আরও জন—আষ্টেক লোক। তাদের কি ব্যবস্থা করি বলুন দেখি?’

বিজনবাবু সহাস্যে বললেন, ‘তাঁদের ব্যবস্থা করতেও আমার কষ্ট হবে না। সবাইকে সঙ্গে করে আপনি এখন ‘লঞ্চে’র উপরে এলেই আমি আনন্দিত হব।’

বৃদ্ধের দেহ বোধহয় অত্যন্ত দুর্বল। তাঁর সঙ্গের লোকেরা তাঁকে সাহায্য না করলে নিশ্চয়ই তিনি বোট ছেড়ে ‘লঞ্চে’র উপরে এসে উঠতে পারতেন না। বৃদ্ধ লাঠিতে ভর দিয়ে সদলবলে ‘লঞ্চে’র ছাদের উপরে এসে দাঁড়ালেন। বিজনবাবু দেখলেন, বৃদ্ধের প্রত্যেক সঙ্গীরই দেহ হচ্ছে রীতিমতো অসাধারণ। সকলেরই মূর্তি যেমন বলিষ্ঠ তেমনি সুদীর্ঘ এবং সকলেরই হাতে রয়েছে এক—একগাছা করে বড়ো লাঠি! ওই—সব বলবান মূর্তির পাশে বৃদ্ধের দেহকে দেখাচ্ছিল এত অসহায় যে, বর্ণনা করে তা বোঝানো যায় না।

বিজনবাবু হাসতে হাসতে বললেন, ‘আপনার সঙ্গে এত মোটা মোটা লাঠির সমারোহ কেন?’

বৃদ্ধ সহাস্যে বললেন, ‘সুন্দরবন জায়গা তো নিরাপদ নয়! কখন কী হয় বলা যায় না! সেইজন্যে একটু প্রস্তুত থাকতে হয়!’

বিজনবাবু বললেন, ‘কিন্তু আমার এই ‘লঞ্চে’র উপরে আপনাদেরই ওই লাঠিগুলি কোনও কাজেই লাগবে না! এখানে হচ্ছে সংগীতচর্চা, যষ্টির সঙ্গে যার কোনওই সম্পর্ক নেই!’

হঠাৎ আসরের ভিতর থেকে বিজনবাবুর এক বন্ধু দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, ‘কী আশ্চর্য! চেয়ে দ্যাখো বিজন, চেয়ে দ্যাখো! চারিদিক থেকে ভেসে আসছে কতগুলো নৌকো! খান—চারেক ছিপও আছে দেখছি! ব্যাপার কী?’

নোঙর বেঁধে ‘লঞ্চ’ যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানকার নদীর দুই তীরেই ছিল এখানে—ওখানে কতগুলো ছোটো ছোটো নালার মতো জলপথ। নৌকোগুলো বেরিয়ে আসছে সেইসব নালার ভিতর থেকেই। বিজনবাবু ভালো করে দেখবার জন্যে আবার ‘লঞ্চে’র ধারের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন, এমন সময় সেই বৃদ্ধ বললেন, ‘আপনিই তো বিজনবাবু?’

বিজনবাবু ফিরে বললেন, ‘আপনি আমার নামও জানেন দেখছি!’

আচম্বিতে বৃদ্ধের চেহারা গেল একেবারে বদলে! যুবকের মতন সোজা হয়ে বুক ফুলিয়ে সেই অদ্ভুত বৃদ্ধ তীক্ষ্ন নারী—কণ্ঠে বললেন, ‘মশায়ের নাম জানি বলেই তো ‘লঞ্চে’র উপরে এসে উঠেছি! সকলের পরিচয় না জানলে কি আমাদের চলে? হা হা হা হা!’

কণ্ঠ—নারীর, কিন্তু কী তীব্র সেই অট্টহাস্য!

বিজনবাবু শান্তকণ্ঠেই বললেন, ‘আপনার কথার মানে বুঝতে পারলুম না।’

বৃদ্ধ বললেন, ‘মানে বুঝতে আর বেশি দেরি লাগবে না! আপনি সুন্দরবনের মধুডাকাতের নাম শুনেছেন কি?’

বিজনবাবু বললেন, ‘অমন বিখ্যাত ব্যক্তির নাম আবার শুনিনি? মধুডাকাতের অত্যাচারে সুন্দরবনের নদীতে নদীতে আজ ব্যবসায়ীদের নৌকো চলে না বললেই হয়। মধু খালি অর্থ লুণ্ঠনই করে না, তার কবলে যারা পড়ে তাদের সকলেরই হত্যা করে! সুতরাং বুঝতেই পারছেন, মধুর ব্যবহারও বিশেষ মধুর নয়!’ বলতে বলতে তিনি লক্ষ করে দেখলেন, বৃদ্ধের একটা চোখ হচ্ছে পাথরের চোখ। সেই একচক্ষু বৃদ্ধ খনখনে মেয়ে—গলায় আবার অট্টহাস্য করে উঠে বললেন, ‘আমিই হচ্ছি সেই মধুডাকাত! এখন আমার বক্তব্যটা আপনি দয়া করে শুনবেন কি?’

বিজনবাবু একথা শুনেও কিছুমাত্র বিচলিত হলেন না। স্থিরকণ্ঠে বললেন, ‘তুমি মধু কি বিষ আমি তা জানতে চাই না, কিন্তু আমার ‘লঞ্চে’র উপরে তোমার আবির্ভাব কেন?’

মধু তার লাঠিটা সশব্দে ঠুকতে ঠুকতে বললে, ‘আপনার কথার উত্তর দিচ্ছি। আপনি একজন দানশীল ব্যক্তি আর বাংলাদেশের একজন প্রসিদ্ধ লোক। আমার নিয়ম হচ্ছে, যাদের ওপরে আমি হানা দি, তাদের সকলকেই করি খুন! কিন্তু আপনাকে আমি খুন করতে চাই না!’

বিজনবাবু বললেন, ‘আমার উপরে তোমার এতটা অনুগ্রহের কারণ কী?’

—’কারণ আছে বই কি! আপনাকে আমি এখনই কীটের মতন হত্যা করতে পারি, কিন্তু তা করব না কেন জানেন? ভিমরুলের চাকে খোঁচা না মারাই ভালো!’

—’অর্থাৎ?’

—’আপনার মতো নামজাদা লোককে আজ যদি আমি পরলোকে পাঠিয়ে দি, তাহলে ইহলোকে উঠবে অত্যন্ত অভদ্র কোলাহল! কিন্তু আপনাকে প্রাণে মারব না কেবল একটি শর্তে!’

—’শর্তটা কী শুনি?’

—’আপনার আর আপনার বন্ধুদের কাছে যা কিছু টাকাকড়ি আর মূল্যবান জিনিস আছে, সমস্তই এখনই আমার হাতে ভালো মানুষের মতন সমর্পণ করুন!’

—’তাই নাকি?’

—’হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ! আমার যে কথা সেই কাজ!’

আচম্বিতে সেই নির্জন অরণ্যবিহারী রাত্রির বুক যেন বিদীর্ণ হয়ে গেল তীব্র বাঁশির পর বাঁশির শব্দে!

মধুডাকাত সচমকে বলে উঠল, ‘ও কীসের শব্দ?’

বিজনবাবু প্রশান্তভাবে হাসতে হাসতে বললেন, ‘মধুডাকাত, বেজে উঠেছে পুলিশের বাঁশি! চেয়ে দ্যাখো, চারিদিক থেকে ছুটে আসছে তোমাকে অভ্যর্থনা করবার জন্যে পুলিশের মোটরবোটগুলো! আজ তুমি ফাঁদে পা দিয়েছ!’

মধু টপ করে তার মোটা লাঠিগাছা মাথার উপরে তুলে বিকৃত নারী—কণ্ঠে কুৎসিত ভয়াবহ গর্জন করে বললে, ‘তাই নাকি? তাহলে আগে তুই—ই মর!’

বিজনবাবু দুই পা পিছিয়ে গিয়ে চকিতে পকেটের ভিতর থেকে একটি চকচকে অটোমেটিক রিভলভার বার করে বললেন, ‘মধু, আমিও অপ্রস্তুত হয়ে নেই! পুলিশের অনুরোধে তোমার লীলাখেলা সাঙ্গ করবার জন্যেই আজ আমার এখানে আগমন হয়েছে!’

মধুর একটিমাত্র চক্ষু একবার প্রদীপ্ত হয়ে উঠেই আবার নিবে গেল! সঙ্গে সঙ্গে সে তিরবেগে ছুটে গিয়ে ‘লঞ্চে’র ছাদের উপর থেকে মারলে এক লাফ!

নদীর জলে ঝপাং করে গুরুদেহ পতনের একটা শব্দ হল। বিজনবাবু ছাদের ধারে গিয়ে দেখলেন, মধু গিয়ে উঠল তার নিজের মোটরবোটের ভিতরে এবং তারপরেই চালকের আসনে বসে বোটখানা চালিয়ে দিলে পূর্ণবেগে!

চারিদিক থেকে যে নৌকো ও ছিপগুলো ‘লঞ্চে’র দিকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসছিল, পুলিশের মোটরবোটগুলো তাদের উপরে গিয়েই পড়ল। তারপরেই সে চন্দ্রপুলকিত আকাশ যেন বিষাক্ত হয়ে উঠল উপরি উপরি মনুষ্য—কণ্ঠের চিৎকারে, গর্জনে, আর্তনাদে এবং ঘনঘন বন্দুকের শব্দে!

কিন্তু পুলিশের একখানা মোটরবোট সেই হাঙ্গামায় যোগ দিলে না, সেখানা দ্রুতবেগে এগিয়ে চলে গেল সোজা নদীর পথ ধরে।

সেই বোটের ভিতরে বসে আছে সুন্দরবাবুর সঙ্গে জয়ন্ত, মানিক, বিমল ও কুমার।

সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম! মধুবেটা দেখছি আমার সেই মোটরবোটখানা নিয়েই লম্বা দেবার চেষ্টায় আছে!’

এ বোটখানা চালাচ্ছিল বিমল স্বয়ং। বোটের গতি যথাসম্ভব বাড়িয়ে দিয়ে সে বললে, ‘জয়ন্তবাবু, মধুর বোট ‘স্টার্ট’ পেয়েছে আমাদের আগেই! ওর নাগাল ধরতে পারব কি না বুঝতে পারছি না।’

জয়ন্ত বললে, ‘চাঁদের আলোয় কালো রেখার মতো মধুর বোটখানা সামনেই দেখা যাচ্ছে! স্পিড আরও বাড়িয়ে দিলে কি ওকে ধরতে পারা যাবে না?’

বিমল বললে, ‘স্পিড যা বাড়িয়ে দিয়েছি তাই—ই হচ্ছে বিপজ্জনক! কিন্তু তবু মধু আর আমাদের মধ্যে ব্যবধান কমছে বলে তো মনে হচ্ছে না!’

নদী এতক্ষণ চলছিল সমান রেখায়। তারপরই খানিক দূরে দেখা গেল একটা বাঁক! মধুর বোটখানা অদৃশ্য হয়ে গেল সেই বাঁকের কাছে মোড় ফিরে। মিনিট—দেড়েক পরেই পুলিশের বোটখানাও যখন সেই বাঁকের কাছে গিয়ে মোড় ফিরলে তখন সবাই দেখতে পেলে, নদী আবার চলে গিয়েছে সরল রেখায় এবং মধুর বোট চাঁদের আলোয় কালো রেখার মতো ছুটে চলেছে তেমনি পূর্ণবেগে!

সুন্দরবাবু উত্তেজিতস্বরে বললেন, ‘বিমলবাবু, আরও ‘স্পিড’ বাড়ান! মধুব্যাটাকে আজ ধরতে হবেই!’

বিমল মাথা নেড়ে বললে, ‘এ বোটের ‘স্পিড’ আর বাড়াবার উপায় নেই! তবে মনে হচ্ছে, আমরা বোধকরি শেষপর্যন্ত মধুর বোটের নাগাল ধরতে পারব!’

নির্জন ও নিস্তব্ধ সেই বন্যজগতে নদীর দুই পাড়ের বড়ো বড়ো বনস্পতিরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেন সবিস্ময়ে দেখতে লাগল, যন্ত্রযুগের মনুষ্যদের হস্তে চালিত দু—খানা কলের নৌকোর উল্কাগতির লীলা!

কুমার উৎসাহিতকণ্ঠে চেঁচিয়ে বললে, ‘নদী আবার বেঁকে গিয়েছে! কিন্তু বোধ হচ্ছে ওই বাঁকের কাছে গিয়েই আমরা মধুর বোটখানাকে ধরে ফেলতে পারব!’

বিমল প্রাণপণে বোটের যন্ত্র সামলাতে সামলাতে দাঁতে দাঁত চেপে বললে, ‘মনে তো হচ্ছে পারব! কিন্তু সামনের বোটখানার অবস্থা দেখছ কি?’

সত্যই তাই!

মধুর বোটখানা বাঁকের কাছে গিয়ে মোড় ফিরলে না, বিদ্যুৎ—বেগে সামনের দিকেই সমানে এগিয়ে চলল!

জয়ন্ত ত্রস্তকণ্ঠে বললে, ‘কী সর্বনাশ! মধু যে—ভাবে বোট চালাচ্ছে, এখনই যে বিষম দুর্ঘটনা হবার সম্ভাবনা! মধু কি আত্মহত্যা করতে চায়?’

বলতে বলতে বাঁকের কাছে মোড় না ফিরে মধুর বোটখানা তীব্রবেগে গিয়ে পড়ল নদীর পাড়ের উপরে! ভীষণ একটা শব্দ হল এবং তারপরেই বোটের ভিতর থেকে লকলক করে বেরিয়ে পড়ল আরক্ত—অগ্নির সমুজ্জ্বল শিখা!

সুন্দরবাবু বললেন, ‘মধুব্যাটা বোট সামলাতে পারলে না, বোধহয় জ্যান্ত অবস্থায় ওকে আর ধরতে পারব না, শেষপর্যন্ত ব্যাটা আমাদের ফাঁকি দিয়েই পালাল!’

বিমল নিজের বোটের গতি ধীরে ধীরে কমিয়ে বাঁকের কাছে গিয়ে হাজির হল। মধুর বোটের উপরে তখনও চলছে অগ্নিদেবের রক্তাক্ত নৃত্য!… … …

… … … কিন্তু সেই অগ্নিময় বোটের আগুন যখন নেবানো হল, তখন তার ভিতরে কোনও দগ্ধবিদগ্ধ মানুষের দেহাবশেষ পাওয়া গেল না।

সুন্দরবাবু মাথার টাক চুলকোতে চুলকোতে বললেন, ‘কী আশ্চর্য! এরই মধ্যে মধুর দেহ কি পুড়ে ছাই হয়ে গেল?’

বিমল তিক্তহাসি হেসে বললে, ‘সুন্দরবাবু, আমার মনে হচ্ছে, মধু আবার বোধহয় আমাদের ফাঁকি দিলে!’

জয়ন্ত বললে, ‘আমারও তাই বিশ্বাস। মধু বাঁকের আড়ালে গিয়েই বোট থেকে জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে! তারপর সাঁতরে নদীর পাড়ে গিয়ে উঠেছে! আমরা বোকার মতো যখন এই শূন্য বোটের পিছনে ছুটে আসছি তখন সে জঙ্গলের কোনও নিরাপদ আশ্রয়ের ভিতরে গিয়ে লুকিয়ে পড়েছে! আজ আর তাকে আবিষ্কার করা অসম্ভব!

পঞ্চম – অবলাকান্ত

বিজনবাবুর প্রমোদ—তরণী সেই নদীপথেই অচল হয়ে রইল।

কেবল শশব্যস্ত হয়ে উঠল পুলিশের মোটরবোটগুলো, তারা সুন্দরবনের এ অঞ্চলের সমস্ত নদীনালা দিয়ে ছুটোছুটি করতে লাগল। এইভাবে কেটে গেল কয়েক দিন।

সেদিন প্রমোদ—তরণীর একটি কামরার ভিতরে বসে ছিল জয়ন্ত, মানিক, বিমল ও কুমার। সুন্দরবাবু সেখানে ছিলেন না, তিনি চরের মুখে কী খবর পেয়ে মধুডাকাতের খোঁজে মোটরবোটে চড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন।

মাঝের কয়দিনের ভিতরে কোনও ঘটনা যে ঘটেনি তা নয়। যে রাত্রে মধুডাকাত পালিয়ে গিয়েছিল পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে, তারপর থেকে কেউ তার সন্ধান না পেলেও সুন্দরবনের এই অঞ্চলে ব্যবসায়ীদের নৌকো আক্রান্ত হচ্ছে প্রায়ই। কিন্তু কারা আক্রমণ করছে এবং আক্রমণকারীরা কোথায় যে অদৃশ্য হচ্ছে তার কোনও খোঁজই পাওয়া যাচ্ছে না। তবে আক্রমণের পদ্ধতি সেই একই রকমের। বোম্বেটেরা অর্থলুণ্ঠন এবং ব্যবসায়ীদের হত্যা করে নৌকো পর্যন্ত নিয়ে পলায়ন করছে। সুতরাং এইসব উপদ্রবের মূলে আছে যে মধুডাকাতই সেটা বুঝতে কারুরই দেরি লাগল না।

সেদিন প্রমোদ—তরণীর কামরায় বসে মানিক বলছিল, ‘জয়ন্ত, একটা বিষয় লক্ষ করেছ কি?’

—’কী?’

—’যত ডাকাতি হচ্ছে সব চৌদ্দো—পনেরো মাইলের ভিতরে। অথচ দলে দলে পুলিশকর্মচারী সুন্দরবনের এ—অঞ্চলের বিশ—পঁচিশ মাইল জায়গা জুড়ে কোথাও তন্নতন্ন করে খুঁজতে বাকি রাখেনি। এর মধ্যে হয়তো একটা টেনিস বল পড়লেও তারা খুঁজে বার করতে পারত। এখনও দশ—পনেরো মাইলের মধ্যে যেসব ডাকাতি হচ্ছে, সবাই বলছে সেসব মধুডাকাতের কীর্তি! কিন্তু একথা সত্য বলে মানি কী করে?’

জয়ন্ত দুই চক্ষু মুদে চুপ করে বসে রইল, কোনও জবাবই দিলে না। মনে হল, যেন সে কোনও—একটা বিশেষ কথা দিয়ে নীরবে নাড়াচাড়া করছে। এমন সময়ে সশব্দে সুন্দরবাবুর প্রবেশ।

কামরায় ঢুকেই মাথার টুপিটা খুলে একদিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে মহা বিরক্তিভরে তিনি বলে উঠলেন, ‘হুম! মোধোব্যাটার কোনও পাত্তাই পাওয়া গেল না! যত সব বাজে খবর!’

জয়ন্ত হঠাৎ চোখ খুলে চেয়ারের উপরে সোজা হয়ে উঠে বসে নিজের রুপোর নস্যদানি বার করে দু—টিপ নস্য গ্রহণ করলে। তারপর হাসতে হাসতে বললে, ‘বিমলবাবু, সেই ‘জেরিনার কণ্ঠহারে’*র মামলাটা মনে আছে কি? সে মামলায় আমরা সকলেই তো একসঙ্গে ছিলুম!’

বিমল বসে বসে একখানা ইংরেজি সচিত্র সাময়িকের পাতা ওলটাচ্ছিল। জয়ন্তের প্রশ্ন শুনে কাগজ থেকে মুখ তুলে বললে, ‘সে তো এই গেল—বছরের ব্যাপার! এত শীঘ্র ভুলে যাবার তো কোনও কারণ নেই।’

—’সেই মামলায় আমাদের বিরুদ্ধে প্রধান ভূমিকায় যে অভিনয় করেছিল, তার কথাও মনে আছে তো?’

বিমল কোনও জবাব দেবার আগেই সুন্দরবাবু বলে উঠলেন, ‘ও বাবা, সে কথা কি ভোলবার? মাত্র একখানা বাড়ির ভেতরেই সে ব্যাটা আমাদের সকলকে রীতিমতো ঘোল খাইয়ে ছেড়েছিল! আর শেষপর্যন্ত আমরা তাকে হাতেনাতে গ্রেপ্তারও করতে পারিনি!’

কুমার বললে, ‘আপনারা কি অবলাকান্তের কথা বলছেন?’

বিমল হঠাৎ অত্যন্ত সচেতন হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললে, ‘অবলাকান্ত, অবলাকান্ত! জয়ন্তবাবু, আপনি খুব একটা মস্ত প্রশ্ন করেছেন!’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘এ আর মস্ত প্রশ্ন কী? অবলাকান্তের মামলা তো অনেকদিন আগেই চুকে গিয়েছে! তাকে নিয়ে এখন আর মাথা ঘামিয়ে লাভ কী?’

বিমল বললে, ‘জয়ন্তবাবু, সেই অবলাকান্ত! যে প্রথমেই করেছিল আমাকে বন্দি, আমাকে ঝুলিয়ে দিয়েছিল গলায় দড়ি দিয়ে! আশ্চর্য সেই অবলাকান্ত! অসাধারণ সুদীর্ঘ তার অতি কৃষ্ণবর্ণ দেহ, মুখের উপরে জেগে থাকে তার একটিমাত্র চক্ষু, কারণ তার অপর চক্ষুটি পাথরে তৈরি, কিন্তু সেই প্রকাণ্ড পুরুষালি চেহারার ভিতর দিয়ে নির্গত হয় একেবারেই মেয়েলি—কণ্ঠস্বর!’

জয়ন্ত বললে, ‘সেই অবলাকান্ত গঙ্গায় বানের টানে ঝাঁপ দিয়েছিল বটে, কিন্তু অনেক সন্ধান করেও আমরা তার দেহ খুঁজে পাইনি।’

সুন্দরবাবু হঠাৎ তাঁর সেই গুরুভার দেহ নিয়ে একটি বৃহৎ লম্ফ ত্যাগ করে বললেন, ‘হুম! এ সব কথার মানে কী?’

জয়ন্ত হাসতে হাসতে বললে, ‘মানেটা আপনি নিজে নিজেই বোঝবার চেষ্টা করুন!’

কুমার বললে, ‘বিজনবাবুর মুখে শুনলুম, মধুডাকাতেরও রং হচ্ছে কালো, আর তার দেহ হচ্ছে সুদীর্ঘ! তারও একটা চোখ পাথরের আর সে—ও কথা কয় একেবারে মেয়েলি গলায়! মধুডাকাতের সঙ্গে অবলাকান্তের চেহারার বিশেষত্ব বড্ড বেশি মিলে যাচ্ছে!’

সুন্দরবাবু চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘এ একটা আবিষ্কার। মস্তবড়ো আবিষ্কার। সেদিনকার সেই অবলাকান্তই যে আজ মধুডাকাত রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে, এ বিষয়ে আমার আর কোনওই সন্দেহ নেই। হুম!’

জয়ন্ত বললে, ‘সুন্দরবাবু, মধুই বলুন আর অবলাকান্তই বলুন, তার টিকির খোঁজ পর্যন্ত এখনও তো পাওয়া গেল না! আপনারা সুন্দরবনের এ অঞ্চলের বিশ—পঁচিশ মাইল তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখলেন, কিন্তু এখনও পর্যন্ত কিছুই আবিষ্কার করতে পারলেন না! অতএব আমাদের এখন উচিত হচ্ছে, কলকাতায় আবার ফিরে যাওয়া। বুনোহাঁসের পিছনে কতদিন ধরে ছুটব?’

সুন্দরবাবু ধপাস করে একখানা চেয়ারের উপরে বসে পড়ে হতাশভাবে বললেন, ‘কী করব ভাই, এই মধুব্যাটা হয়তো ভোজবাজি জানে! সে কাছাকাছিই আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যদিও সে এই ‘লঞ্চে’র ত্রিসীমানায় আসে না, তবু নৌকোর উপর হানা দিচ্ছে দশ—পনেরো মাইলের ভিতরেই! সে কাছেই আছে অথচ তাকে দেখা যাচ্ছে না, বোধহয় সে মায়াবী—ফুসমন্ত্র জানে!’

ঠিক এইসময়েই বিজনবাবুর অনুচররা কামরার ভিতরে এসে ঢুকল কয়েকখানা ‘ট্রে’ ভরে খাদ্য ও চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে। চমৎকৃত হয়ে গেল যেন সুন্দরবাবুর দেহ ও মুখ! তিনি তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ‘এসেছ বাবা! বড়োই ভালো কাজ করেছ। খিদেয় পেটের নাড়ি চাঁ চাঁ করছে!’

বিজনবাবুর অতিথি—সৎকার হচ্ছে চমৎকার! এটা হচ্ছে সুন্দরবাবুর নিজস্ব মত। কিন্তু বিমল ও কুমার এবং জয়ন্ত ও মানিকের মত হচ্ছে সম্পূর্ণ উলটো! তারা বলে, ‘চমৎকার ব্যাপার যে কতখানি ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে, আজ এখানে এসেই তার প্রমাণ পাওয়া গেল।’

প্রভাতি—চায়ের আসরে বিশ—তিরিশ রকম টুকিটাকি খাবার; মধ্যাহ্নের খাদ্যতালিকায় পাওয়া যাবে অন্তত পঞ্চাশ রকম খাবারের নাম; বৈকালি—চায়ের আসরে আবার সেই বিশ—তিরিশ রকম খাবার এবং রাত্রের ভোজের ব্যাপারটা হচ্ছে রীতিমতো গুরুতর! একদিন খাদ্যতালিকায় সেখানে নাম পাওয়া গিয়েছিল, পঁচাত্তর রকম খাবারের!

কুমার বললে, ‘বড়োমানুষ দেখাচ্ছেন বড়োমানুষি। কিন্তু খাবারের ঠ্যালায় আমাদের মতন ছোটোমানুষের প্রাণ যে ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়ছে! সত্যি জয়ন্তবাবু, বিজনবাবু আমাদের খাদ্য—পর্বতের তলদেশে একেবারে পিষে মেরে ফেলতে চাইছেন! আমার মনে হচ্ছে, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি!’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম! কুমারবাবু, অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন না! খাবারের ভয়ে কেউ যে পালিয়ে যেতে চায় এমন কথা এই প্রথম শুনলুম! কে জানে বাবা, দুনিয়ায় কতরকম লোকই আছে!’

মানিক বললে, ‘ঠিক বলেছেন সুন্দরবাবু! আমিও সেই কথাই ভাবছিলুম!’

সুন্দরবাবু কোনওদিনই মানিকের রসনাকে বিশ্বাস করেন না। তিনি সন্দিগ্ধ—স্বরেই বললেন, ‘কী রকম, তুমিও ওই কথাই ভাবছিলে?’

মানিক বললে, ‘হ্যাঁ সুন্দরবাবু। দুনিয়ায় কত রকম লোকই আছে! কোনও মানুষের পক্ষীর আহার, আবার কেউ পেট ভরায় ঠিক গ্লুটনের মতন।’

সুন্দরবাবু দুই ভুরু কুঞ্চিত করে বললেন, ‘গ্লুটন মানে?’

—’তা জানেন না বুঝি? গ্লুটন নামে এক চতুষ্পদ জানোয়ার আছে, সে যত পাবে ততই খাবে! এমনকি, যখন খেতে আর পারবে না তখনও সে গ্রোগ্রাসে উদর পূর্ণ করতে চাইবে!’

—’খিদে মিটে গেলে কেউ আবার খেতে চায় নাকি?’

—’গ্লুটনরা চায়। তাদের পেট যখন খেয়ে খেয়ে ফোলা—হাপরের মতন হয়ে উঠেছে, অথচ সামনের খাবার যখন শেষ হয়নি, তখন তারা কী করে জানেন?’

সুন্দরবাবু অধিকতর সন্দিগ্ধকণ্ঠে বললেন, ‘আমি জানি না, আর জানতেও চাই না!’

—’আহা, তবু শুনে রাখুন না! গ্লুটন তখন করে কী, বনের ভিতরে খুঁজে এমন দুটো বড়ো বড়ো গাছ বেছে নেয় যাদের মধ্যের ফাঁক দিয়ে তার শরীর একেবারেই গলে না। কিন্তু গ্লুটন সেই অল্প ফাঁকটুকুর ভিতরেই নিজের শরীর এমন প্রাণপণে গলিয়ে দেবার চেষ্টা করে যে, দু—দিক থেকে বিষম চাপ খেয়ে তার পেটের খাবার আবার হড় হড় করে বাইরে বেরিয়ে পড়ে। তারপর পেট যেই খালি হয়ে যায়, তখন সে আবার বাকি খাবারগুলোকে পাঠিয়ে দেয় জোর করে খালি করা পেটের ভিতরে!’

সুন্দরবাবু অত্যন্ত মুখভার করে বললেন, ‘এখানে হঠাৎ তোমার ওই গ্লুটনের কথাটা মনে পড়ল কেন বলো দেখি?’

মানিক দুষ্টুমির হাসি হেসে বললে, ‘মানে পড়ল, তাই বললুম! কেন মনে পড়ল, সে কথা নাই বা বললুম!’

সুন্দরবাবু ক্রুদ্ধস্বরে বললেন, ‘তোমার মতন হাড়—বজ্জাত ছোকরা জীবনে আমি আর কখনও দেখিনি! আমি এত বোকা নই হে, কাকে লক্ষ্য করে তুমি এ কথা বলছ তা বুঝতে পেরেছি! হুম!’ তিনি রাগে গস গস করতে করতে উঠে গিয়ে একখানা বড়ো সোফার উপরে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লেন—নিজের প্রচণ্ড হজমশক্তির দ্বারা বৃহৎ উদরের বৃহত্তর ভার খানিকটা কমিয়ে ফেলবার জন্যে।

মানিক আর কুমার দাবাবোড়ে খেলতে বসে গেল। একখানা চেয়ার জানলার দিকে টেনে নিয়ে গিয়ে বসে পড়ে জয়ন্ত বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল, নদীর ওই তীরে সুন্দরবনের কাঁচা শ্যামলতার উপর দিয়ে বয়ে যেতে যেতে চঞ্চল বাতাস দুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে আলো আর ছায়ার হিন্দোলা!

খানিকক্ষণ কারুর মুখে কোনও কথা নেই।

বিমল হঠাৎ নীরবতা ভঙ্গ করে ডাকলে, ‘জয়ন্তবাবু!’

—’কী বলছেন বিমলবাবু?’

—’আপনি সুন্দরবনের এখানকার প্রাচীন ইতিহাস জানেন?’

—’বিশেষ কিছুই জানি না।’

—’প্রাচীনকালে এখানে একটি মস্ত বড়ো রাজ্য ছিল। তখন কেউ তাকে ডাকত—ব্যাঘ্রতটী বলে, আর কেউ ডাকত—সমতট বলে। এই সমতট রাজ্য এমন বিখ্যাত ছিল যে, সেকালকার চিন দেশের প্রসিদ্ধ ভ্রমণকারী য়ুয়ান চুয়াং পর্যন্ত এখানে বেড়াতে এসেছিলেন। সেইসময়ে তিনি এসে দেখেছিলেন, এখানে নানাজাতীয় ধর্মোপাসকরা বাস করেন। তাঁদের কেউ জৈন, কেউ বৌদ্ধ, কেউ হিন্দু। এখানে তিনি তিরিশটি বড়ো বড়ো বৌদ্ধ মঠ আর বিহার দেখেছিলেন, আর দেখেছিলেন হিন্দুদের একশোটি মন্দির। বলা বাহুল্য, প্রত্যেক শহরে যা যা থাকে এখানেও সে সমস্তের কোনওই অভাব ছিল না—অর্থাৎ নাগরিকদের অসংখ্য ঘরবাড়ি, ধনীদের অট্টালিকা, রাজা—রাজড়াদের প্রাসাদ। কিন্তু সে—সব অতীত ঐশ্বর্যের চিহ্ন এখন পৃথিবীর বুক থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।’

জয়ন্ত জিজ্ঞাসা করলে, ‘তার কারণ?’

—’সুন্দরবনের এখানটা হচ্ছে একটা অদ্ভুত জায়গা। এখানকার মাটি নাকি ক্রমাগত নীচের দিকে বসে যায় আর তার উপরে এসে জায়গা জুড়ে থাকে নতুন মাটি। আজও সুন্দরবনের এই অঞ্চলের অনেক জায়গা খনন করে উপরকার মাটির তলায় পাওয়া গিয়েছে বড়ো বড়ো প্রাসাদ, অট্টালিকা আর ঘরবাড়ির ভগ্নাবশেষ। আবার অনেক জায়গায় মাটি খুঁড়ে দেখা গিয়েছে, বড়ো বড়ো গাছগুলো মাটি চাপা পড়েও সোজা হয়ে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে। এখানে এসে সন্ধানী লোক যদি খোঁজে আর চেষ্টা করে, তাহলে পৃথিবীর গর্ভ থেকে আবিষ্কার করতে পারে সেকালকার একাধিক ভূপ্রোথিত অট্টালিকা বা মন্দির প্রভৃতি। অবশ্য আবিষ্কার করবার জন্যে কারুকে বিশেষ সন্ধান করতে হয় না, কারণ পৃথিবীর উপরকার মাটির দিকে দৃষ্টিপাত করলেই অনেক সময় বোঝা যায় যে, লোকের চোখের আড়লে এখানে লুকিয়ে আছে, অতীতের কোনও না কোনও কীর্তি!’

জয়ন্ত হঠাৎ চেয়ার ঘুরিয়ে বসে আগ্রহভরে বললে, ‘তারপর?’

—’তারপর? ভারতে যখন মোগলদের সাম্রাজ্য, বাংলার মহাবীর প্রতাপাদিত্য যখন স্বাধীনতার তূর্যধ্বনি করছেন, তখনও এখানে আবার নতুন করে মানুষের বসতি—অর্থাৎ শহর বা গ্রাম বসাবার চেষ্টা হয়েছিল। তখনও এখানে সুন্দরবনের কেঁদোবাঘের হুঙ্কারের চেয়ে ঢের বেশি শোনা যেত নাগরিক মানুষদের মিষ্ট কণ্ঠস্বর। কিন্তু তারপরই এখানে শুরু হয়, পর্তুগিজ—বোম্বেটেদের অমানুষিক অত্যাচার। তারা ডাঙায় নেমে লুটপাটই করত না, সেইসঙ্গে ধরে নিয়ে যেত অগুন্তি মেয়ে, পুরুষ আর বালকদেরও। পাছে সেই বন্দিরা জলদস্যুদের জাহাজ থেকে জলে লাফিয়ে পালিয়ে যায়, সেইজন্যে তাদের অনেককে কীরকম করে ধরে রাখা হত জানেন?’

এতক্ষণে সুন্দরবাবুর প্রায় ঘুমন্ত আগ্রহ সম্পূর্ণ জাগ্রত হয়ে উঠেছিল। তিনি ধড়মড় করে সোফার উপরে উঠে পড়ে বললেন, ‘বিমলবাবু, আপনার গল্পটি ভারী ইন্টারেস্টিং লাগছে!’

—’এ গল্প নয় সুন্দরবাবু, এসব হচ্ছে ইতিহাসের কথা।’

—’মানলুম। কিন্তু ওই পাজি পর্তুগিজরা বাঙালি বেচারিদের জাহাজের উপরে নিয়ে গিয়ে কীরকম করে ধরে রাখত?’

—’জাহাজের পাটাতনের তলায় যেখানে দশজন লোক ধরে না সেইখানে ঢুকিয়ে দিত হয়তো একশোজন বাঙালিকে। তারপর তাদের প্রত্যেকের হাত পেরেক বা হুক মেরে জাহাজের কাঠের সঙ্গে সংলগ্ন করে দিত। তাদের বাস করতে হত ঘুটঘুটে অন্ধকারে, তাদের কেউ শুতে পেত না—কারণ পা ছড়াবার মতন ঠাঁই সেখানে থাকত না। কিন্তু তাদের বাঁচিয়ে না রাখলে চলবে না, কেননা দেশবিদেশে গোলামরূপে তাদের বিক্রি করবার জন্যেই গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হত। অতএব তাদের মাঝে মাঝে কিছু জল আর কিছু কিছু করে অসিদ্ধ শুকনো চাউল খেতে দেওয়া হত। বুঝতেই পারছেন, এ অবস্থায় মানুষ বাঁচতেই পারে না! যাদের নিতান্ত কইমাছের প্রাণ, তারাই বেঁচে থাকত কোনওগতিকে—অর্থাৎ দুইশতজনের মধ্যে হয়তো পঁচিশ কি তিরিশটি প্রাণী।’

কুমার ও মানিক দাবাবোড়ে খেলা ভুলে গিয়ে শিউরে উঠে সঙ্গে সঙ্গে বললে, ‘কী ভয়ানক!’

বিমল বললে, ‘ওই মহাপাপিষ্ঠ পর্তুগিজ—বোম্বেটেদের অত্যাচারেই শেষটা সুন্দরবন একেবারেই জনশূন্য হয়ে গেল। মানুষের বদলে এই দেশে শেষটা বেড়ে উঠতে লাগল, ব্যাঘ্র আর বন্য জন্তুদের বংশ।’

জয়ন্ত হঠাৎ নিজের আসন ত্যাগ করে উঠে বিমলের সামনে এসে বসে বললে, ‘বিমলবাবু, আজ হঠাৎ আপনি পুরাতন ইতিহাসের কথা তুললেন কেন?’

জয়ন্তের মুখের পানে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিমল হাসতে হাসতে বললে, ‘আমি নিজের দেশের প্রাচীন ইতিহাস ভালোবাসি। আর অবসর পেলে মাঝে মাঝে একটু—আধটু প্রত্নতত্ত্বের চর্চাও করি। আজ আমার কী ইচ্ছা হচ্ছে জানেন?’

—’বলুন!’

—’আপাতত দেখছি, সুন্দরবাবুর হাতে কোনওই কাজ নেই। মধুডাকাত অদৃশ্য, তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে দলে দলে পুলিশের চর। মধু দশ—পনেরো মাইলের ভিতরে ডাকাতি করছে, অথচ এখনও তার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। যদি ইতিমধ্যে মধুর সন্ধান পাওয়া যায়, তাহলে সুন্দরবাবুই তার জন্যে বিজনবাবুর এই ‘লঞ্চে’ বসে অপেক্ষা করুন। এই ফাঁকে আমি আর কুমার আর আমাদের বাঘা, আর আমাদের রামহরি যদি সুন্দরবনের খানিকটা ঘোরাঘুরি করে দেখি, তাতে আপনাদের কিছু আপত্তি আছে কি?’

সুন্দরবাবু, বললেন, ‘হঠাৎ এই বিপদভরা বনেজঙ্গলে ছুটোছুটি করে আপনাদের কী লাভ হবে?

—’লাভ হয়তো কিছুই হবে না। মানুষ বসবার বা দাঁড়াবার বা শুয়ে ঘুমোবার জন্যে ছোটাছুটি করে না। ছোটবার জন্যেই সে ছোটে!’

—’হুম! ছুটে কোথায় যাবেন?’

—’কোথাও না। থাকব এই সুন্দরবনেই। তবে আমার কৌতূহল যখন জেগেছে তখন ছুটোছুটি করে একবার দেখবার চেষ্টা করব, এ অঞ্চলের কোথাও প্রাচীন কীর্ত্তির কোনও চিহ্ন আছে কি না।’

—’চিহ্ন মানে?’

—’চিহ্ন মানে? আমার মনে একটা সন্দেহ জেগেছে যে, এখানকার কাছাকাছি কোনও—এক জায়গায় এমন কোনও প্রাচীন বৌদ্ধবিহার বা প্রাচীন অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ, আছে, যা খুঁজে বার করতে পারলে বাংলার অতীতের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা দ্বিগুণ বেড়ে উঠবে।’

—’পাগলের কথা! অতীতের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়াবার জন্যে আমি বাঘ বা অজগরের পেটের ভিতরে ঢুকতে রাজি নই!’

জয়ন্তের দুই চক্ষু জ্বলে উঠল। সে বললে, ‘বিমলবাবু, আমিও আপনাদের সঙ্গে যাব।’

মানিক দাঁড়িয়ে উঠে বললে, ‘আমিও!’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘বাব্বাঃ! যত পাগলের পাল্লায় এসে পড়েছি! আমি এক পাও নড়ছি না, আমি এইখানেই অচল শিবলিঙ্গের মতন বসে থাকব। ‘ডিউটি ইজ ডিউটি’! হুম!’

ষষ্ঠ – অজগরের কুণ্ডলী

সেদিন রাত্রে হঠাৎ এল ঝমঝম করে বৃষ্টি।

তখন বর্ষাকাল নয় বটে, কিন্তু সুন্দরবনের এ অঞ্চলটা হচ্ছে বঙ্গোপসাগরের একেবারে পাশেই। এখানে সমুদ্রের উদ্দাম ঝোড়োহাওয়া কোথা থেকে কখন যে বিদ্যুতাগ্নিভরা জলবর্ষি কালো মেঘকে টেনে আনবে, কেউ তা আন্দাজ করতে পারে না।

প্রায় ঘণ্টা—তিনেক ধরে হু হু ঝোড়ো বাতাসে এই অরণ্যজগতের চতুর্দিকে প্রলয় হাহাকার জাগিয়ে সেই জলভরা কালো মেঘ চাঁদকে আবার মুক্তি দিয়ে চলে গেল কোথায়!

বিমল ও জয়ন্তের দল পরদিন প্রভাতে যখন ধারালো দৃষ্টি দিয়ে সুন্দরবনের শ্যামল দেহকে ব্যবচ্ছেদ করবার জন্যে বেরিয়ে পড়ল, তখনও চারিদিকে থইথই করছে জল আর জল। যেখানে জল নেই সেখানে কর্দমের রাজত্ব।

মানিক বললে, ‘বিমলবাবু, অন্তত আজ আমাদের ফিরে যাওয়া উচিত। দেবতা আমাদের ওপরে বিরূপ। বরুণদেবের অভিশাপে পথ আর বিপথ এত বেশি দুর্গম হয়ে উঠেছে যে, আজ আমাদের অভিযান হয়তো একেবারেই ব্যর্থ হয়ে যাবে!’

বিমল হেসে বললে, ‘আমার ঘর পালানো মন যখন অজানা পথের ডাক শুনতে পায়, তখন দেবতা বা দানব কারুর বাধাই আমি মানি না!’

জয়ন্ত বললে, ‘আমারও মন আজ প্রতিজ্ঞা করেছে যে, আপনার মনেরই সঙ্গী হবে। ইচ্ছে প্রবল হলে জল—কাদা—জঙ্গল মানুষকে কোনও বাধাই দিতে পারে না!’

পিছন থেকে রামহরি গজগজ করতে করতে বললে, ‘মানিকবাবু ঠিক কথাই বলেছেন! কিন্তু এই জয়ন্তবাবুটি দেখছি আমাদের খোকাবাবুরই মতন মাথাপাগলা। এক পাগলাকেই সামলাতে পারি না, আজ ডবল পাগলাকে নিয়ে হাড় জ্বালাতন হবে দেখছি! কী গো কুমারবাবু, তোমার ইচ্ছেটা কী শুনি?’

কুমার হাসতে হাসতে বললে, ‘রামহরি, তুমি কি জানো না যে, বিমলের ইচ্ছা আর আমার ইচ্ছা এক?’

রামহরি একটা নিশ্বাস ফেলে বললে, ‘তা জানি না আবার! তবু কথার কথা জিজ্ঞাসা করছিলুম। কিন্তু বাঘা বেচারিকে এখানে মিছিমিছি টেনে এনে কী লাভ হল? হ্যাঁ রে বাঘা, এই বিচ্ছিরি জল—কাদা—জঙ্গল তোর কি ভালো লাগবে?’

বাঘা যেন রামহরির কথার প্রতিবাদ করবার জন্যেই বিপুল পুলকে ঘনঘন লাঙ্গুল আন্দোলন করতে করতে ঠিক পাশের একটি ছোট্ট নালার জলে ঝম্প প্রদান করে সচিৎকারে বলে উঠল, ‘ঘেউ, ঘেউ, ঘেউ!’

রামহরি রেগে টং হয়ে বললে, ‘যেমন মনিব, তেমনি কুকুর! নাঃ, এখানে আর আমার কোনও কথা কওয়াই উচিত নয়!’

তারপর আরম্ভ হল যাত্রা! আর সে কী যাত্রা! পদে পদে সে কী বাধা! কোথাও কোমরভোর ঘোলা জল, কোথাও হাঁটুভোর পুরু কাদা, কোথাও সূর্যালোকে সমুজ্জ্বল দিবসেও অমাবস্যার রাত্রির মতন অন্ধকার জঙ্গলের অন্তঃপুর, কোথাও কাঁটাঝোপের পর কাঁটাঝোপের সুতীক্ষ্ন দংশন!

তবু তারা অগ্রসর হয়েছে! তারা জলাভূমি মানলে না, জঙ্গলের যত অদৃশ্য বিভীষিকাকে মানলে না, মনুষ্যপদচিহ্নহীন অপথ, বিপথ বা কুপথ কিছুই মানলে না! তারা সঙ্গে করে এনেছিল তিনখানা ছোটো ছোটো অতিশয় হাল্কা রবারের নৌকো, স্থলপথ শেষ হয়ে গিয়ে যেখানে আসে জলপথের পর জলপথ, সেই নৌকোর উপরে আরোহণ করে তারা এই নদীবহুল সুন্দরবনের বাধাকে সরিয়ে দেয়!

একাধিক বিষাক্ত সাপেরও দেখা পাওয়া গেল। কিন্তু তারা গতরাত্রের ঝড়বৃষ্টিতে এমন অসহায় হয়ে পড়েছে যে, ঘৃণ্য মানুষদের দেখেও কোনও রকম আক্রমণ এমনকি পালাবার চেষ্টা পর্যন্ত করলে না। কোনও কোনও জলপথে দু—চারটে কুমিরের প্রলুব্ধ মুখও দেখা গেল, কিন্তু দলের কারুর না কারুর বন্দুকের আওয়াজ শুনেই আবার তারা তলিয়ে গেল অতল তলে!

কিন্তু তাদের সবচেয়ে জ্বালাতন করছিল সুন্দরবনবিহারী অসুন্দর মশকের দল! তারা স্থলে বা জলে যেখান দিয়েই যাচ্ছে সেইখানেই ওই মশকেরা হতে চাচ্ছে যেন তাদের সহযাত্রী! আর কী যাতনাদায়ক সহযাত্রী তারা! মশকরাজ্যের জাতীয়সংগীত গাইতে গাইতে নিষ্ঠুর আনন্দে তারা বিমল ও জয়ন্ত প্রভৃতির দেহের অনাবৃত অংশের উপরে এসে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল এবং সঙ্গে সঙ্গে সকলের দেহকে করে তুললে স্ফীত, রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত!

এমনকি, বাঘা পর্যন্ত অতিষ্ঠ হয়ে উঠল! তার রোমশ দেহও সুন্দরবনের মশাদের হুলগুলোকে ঠেকাতে পারলে না! সে বারংবার ঊর্ধ্বমুখে লম্ফত্যাগ করে এক এক গ্রাসে দলে দলে মশককে গলাধঃকরণ করলে বটে, কিন্তু তবু এই ভয়াবহ পতঙ্গদের অত্যাচার কিছুমাত্র কমল বলে মনে হল না!

সকাল থেকে বৈকাল পর্যন্ত এইভাবে পথ আর বিপথের ভিতর দিয়ে ঘুরে ঘুরে কেটে গেল। কিন্তু প্রায় মাইল পনেরো ঘোরাঘুরি করেও তারা এই অরণ্য জগতের ভিতর থেকে সেকালকার মানুষের হাতে—গড়া একখানা পুরাতন ইষ্টক পর্যন্ত আবিষ্কার করতে পারলে না। এখানে পৃথিবীর প্রাণীদের মধ্যে সাড়া দিচ্ছে খালি গাছে গাছে বানর ও নানাজাতের পাখিরা। সুন্দরবন যেসব হিংস্র ও চতুষ্পদ জীবের জন্যে বিখ্যাত, তাদেরও কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। বোধহয় গত—রাত্রের ঝড়বৃষ্টির তাল সামলাতে সামলাতে তারাও আজ বিব্রত হয়ে আছে।

বৈকাল যখন কেটে গেল, তারা উদরের অতিজাগ্রত অগ্নিদেবকে তুষ্ট করবার জন্যে এক—জায়গায় বসে পড়তে বাধ্য হল। সঙ্গে ছিল স্যান্ডউইচ, সিদ্ধ ডিম, মর্তমান কদলী আর ফ্লাস্ক—ভরা গরম চা!

আহারপর্ব যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, জয়ন্ত হঠাৎ সচমকে বলে উঠল, ‘একী ব্যাপার বিমলবাবু?’

—’কী?’

—’নীচের দিকে তাকিয়ে দেখুন।’

বিমল কর্দমাক্ত পৃথিবীর দিকে দৃষ্টিপাত করে নির্বাক হয়ে গেল ক্ষণকালের জন্যে। তারপরে বিস্মিতভাবে বললে, ‘এ যে দেখছি নতুন মানুষের পায়ের দাগ! এতক্ষণ পর্যন্ত এই গভীর অরণ্যে একজন মানুষকেও দেখতে পেলুম না, কিন্তু এখানে এই পায়ের দাগ এল কেমন করে? এ পায়ের দাগ তো পুরানো নয়! কাল রাতে উচ্ছল ধারায় যে বৃষ্টি হয়ে গেছে, মাটির উপরকার যে কোনও পুরানো পায়ের দাগ তাতে বিলুপ্ত না হয়ে পারে না! এ হচ্ছে এমন কোনও মানুষের পায়ের দাগ, যে একটু আগেই এখানে ছিল বিরাজমান!’

জয়ন্ত বললে, ‘এ পায়ের দাগ যে আমাদের নয়, সেকথা বলাই বাহুল্য। কারণ আমাদের সকলেরই পায়ে আছে জুতো, আর এই পদচিহ্নের অধিকারী এখানে এসেছে পাদুকাহীন শ্রীচরণ নিয়ে! সে যে আমাদের পরে এসেছে, এ বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই। কারণ, প্রায় সব জায়গাতেই তার পায়ের ছাপ পড়েছে আমাদের পদচিহ্নের উপরেই! কে সে?’

কুমার দু—চারবার এদিকে—ওদিকে ঘুরে বললে, ‘এ নগ্নপদের মালিক ঢুকেছে পাশের ওই বনের ভিতরে, কারণ পদচিহ্নগুলো হঠাৎ বেঁকে ওই জঙ্গলের ভিতর গিয়ে অদৃশ্য হয়েছে।’

ইতিমধ্যে বাঘা হয়ে উঠেছে অত্যন্ত সচেতন! সে যেন সকলকার কথা বুঝতে পারলে! এতক্ষণ সে থেবড়ি খেয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে বসেছিল এই বৈকালি ভোজের স্যান্ডউইচ বা সিদ্ধ ডিমের দু—এক টুকরো লাভ করবার জন্যে। কিন্তু এখন হঠাৎ এই নতুন পদচিহ্নের আঘ্রাণ নিয়ে দুই কান খাড়া করে গরর গরর চাপা গর্জন করে উঠল! তারপর অতিলোভনীয় স্যান্ডউইচ প্রভৃতির কথা একেবারে ভুলে গিয়ে সেই নগ্নপদের চিহ্ন শুঁকতে শুঁকতে ঢুকে গেল পাশের একটা অন্ধকার জঙ্গলের ভিতরে!

কুমারও ছুটল তার পিছনে পিছনে। এবং দলের বাকি সকলেই বিনা বাক্যব্যয়ে বাধ্য হল তারই পশ্চাৎ অনুসরণ করতে।

কিন্তু জঙ্গলের ভিতরে কারুকেই পাওয়া গেল না। সেখানে পদচিহ্ন দেখেও অগ্রসর হবার উপায় নেই, কারণ, মাটির উপরটা আচ্ছন্ন করে আছে সুদীর্ঘ আগাছার দল।

সকলে আবার জঙ্গলের বাইরে এসে দাঁড়াল।

জয়ন্ত বললে, ‘ব্যাপারটা বেশ বোঝা যাচ্ছে। এই বনের ভিতরে চোখের সামনে আমরা কোনও মানুষকে দেখতে পাচ্ছি না বটে, কিন্তু আমাদের পিছনে পিছনে নিশ্চয়ই এসেছে কোনও লোক। নিশ্চয়ই সে আমাদের গতিবিধির ওপরে লক্ষ রাখছিল, কিন্তু হঠাৎ আমরা বৈকালি ভোজের জন্যে এইখানে বসে পড়েছি দেখে, ধরা পড়বার ভয়ে পাশের জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে!’

বিমল বললে, ‘কিন্তু মাটির উপরে তাকে পা ফেলে আসতে হয়েছে। সে যে কোথা থেকে এসেছে এই মাটির উপরেই তার চিহ্ন লেখা আছে! তাকে যখন পেলুম না তখন দেখা যাক, সে আমাদের পিছনে পিছনে এসেছে কোন অন্তরাল থেকে!’

জয়ন্ত আগেই দাঁড়িয়ে উঠেছিল। সে বললে, ‘বিমলবাবু, ঠিক বলেছেন। আসুন, এইবার সেই চেষ্টাই করা যাক!’

মানিক বললে, ‘আমরা এসেছিলুম সুন্দরবনের ভিতর থেকে কোনও পুরাকীর্তির সন্ধান করতে। কিন্তু ব্যাপারটা হয়ে উঠেছে এখন গোয়েন্দাকাহিনির মতন!’

জয়ন্ত বিরক্তকণ্ঠে বললে, ‘মানিক, তুমি মূর্খের মতন কথা কোয়ো না!’

—’আমি কি মূর্খের মতন কথা কয়েছি? তাহলে ব্যাপারটা আমাকে বুঝিয়ে দাও।’

—’ছিঃ! মানিক, এতকাল আমার সঙ্গে থেকেও তুমি যে এমন বোকার মতো কথা কইবে, তা আমি জানতুম না! বোঝাবুঝির কথা হবে পরে, এখন আগে দেখতে হবে এই নগ্নপদের চিহ্নগুলো এসেছে কোথা থেকে!’

সকলে আবার ফিরতিপথে অগ্রসর হল। পুরু কাদার উপরে পায়ের চিহ্নগুলো অত্যন্ত স্পষ্ট। সকলে তাই দেখে এগুতে এগুতে প্রায় দেড় মাইল পথ পার হয়ে গেল। তারপরেই দেখা গেল পদচিহ্নগুলো প্রবেশ করেছে এমন এক প্রচণ্ড অরণ্যের মধ্যে, যেখানে কোনও জীবের পক্ষে যাতায়াত করবার কল্পনা করাও অসম্ভব!

কী অন্ধকার অরণ্য! সূর্যের আলোক এখনও নির্বাপিত হয়ে যায়নি, কিন্তু সে—অরণ্যের মধ্যে দৃষ্টি চালনা করতে গেলেও চক্ষু যেন নীরন্ধ্র—অন্ধকারের নিরেট প্রাচীরে ধাক্কা খেয়ে পালিয়ে আসতে চায়! তবু সকলেই টর্চের আলো জ্বেলে সেই নিস্তব্ধ ও নির্জন অরণ্যের মধ্যে প্রবেশ করলে।

আশ্চর্য ব্যাপার। অমন যে দুর্গম বন—জঙ্গল, তার ভিতরেও গাছপালা ও কাঁটা—ঝোপ কেটে কারা যেন পথ তৈরি করে নিয়েছে! সুদীর্ঘ তৃণ ও আগাছা—ঢাকা মাটির উপরে আর কারুর পদচিহ্ন দেখা যায় না বটে, কিন্তু ভুল হবার কোনওই উপায় নেই। কারণ এই গভীর অরণ্যের বাধাকে সরিয়ে দিয়ে একটা সংকীর্ণ পথের রেখা বরাবরই চলে গিয়েছে সামনের দিকে! সে—পথের এ—পাশে অন্ধকার, ও—পাশে অন্ধকার, তার উপরদিকেও নিশ্ছিদ্র অন্ধকার! সকলের মনে হল, এই তিমিরাবগুণ্ঠিত অদ্ভুত পথ দিয়ে অগ্রসর হলে একটু পরেই যেন প্রবেশ করা যাবে, রহস্যময় অন্ধকারের নিজস্ব অন্তঃপুরের মধ্যে!

কিন্তু হঠাৎ শেষ হয়ে গেল পথ। পাওয়া গেল একটি ছোটো ময়দানের মতন জায়গা। সেখানে মাথার উপরকার আকাশে তখনও জেগে আছে অস্তোন্মুখ সূর্যের আলোক—আশীর্বাদ!

আচম্বিতে সেই মহা নির্জন ও মহা নিস্তব্ধ অরণ্যভূমির গভীর নিদ্রা খণ্ডবিখণ্ড হয়ে গেল যেন উপর্যুপরি ভীষণ দুই শব্দে!

—গুড়ুম! গুড়ুম!

গর্জন করে উঠেছে রামহরির বন্দুক! সঙ্গে সঙ্গে রামহরির এক প্রচণ্ড পদাঘাত খেয়ে বিমল পাঁচ—ছয় হাত দূরে ঠিকরে গিয়ে পড়ল!

ততক্ষণে আর সকলেই সচেতন হয়ে সভয়ে দূরে সরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে! রামহরি তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে বিমলের হাত ধরে টেনে তুলে কাতরকণ্ঠে বললে, ‘খোকাবাবু, তোমাকে আমি লাথি মেরে যে পাপ করেছি, ভগবান আমাকে তার জন্যে ক্ষমা করুন! ওই গাছটার ওপর থেকে মস্ত—বড়ো একটা অজগর তোমার ওপরে ঝাঁপ খেতে আসছিল! বন্দুকের দু—গুলিতে আমি তার মাথা গুঁড়ো করে দিয়েছি! অজগরটা ছটফট করতে করতে ওই বড়ো ঝোপটার ভেতরে গিয়ে পড়েছে।’

তখন সেই ঝোপটাও হয়ে উঠেছে আশ্চর্যরূপে জীবন্ত! তার অনেক গাছ—আগাছা তীব্রবেগে ছিটকে এদিকে—ওদিকে ছড়িয়ে পড়ছে—যেন তার মধ্যে অভিনীত হচ্ছে এক ভয়াবহ বিরাটের নাটকীয় লীলা!

বাঘা মহা ক্রোধে গর্জন করে ছুটে যাচ্ছিল সেইদিকে! কুমার একলাফে তার উপরে গিয়ে পড়ে তাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বললে, ‘ওরে বাঘা, তুই কি জানিস না, অজগরের মৃত্যু—যন্ত্রণা? তার দেহ থেকে প্রাণ বেরিয়ে গেলেও তার সর্বাঙ্গ কুণ্ডলিত হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে? সেই মৃত অজগরের জীবন্ত দেহের কুণ্ডলের ভিতরে গিয়ে পড়লে যে—কোনও গণ্ডার বা হাতি পর্যন্ত পরলোকে যাত্রা করতে পারে?’

ইতিমধ্যে বিমল সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। রামহরির একটা কথাও আমলে না এনে চিৎকার করে সে বললে, ‘কোনও কথা না বলে সবাই এখান থেকে পালিয়ে এসো! চলো, আমরা ওপাশের ওই ঝোপটার ভিতরে গিয়ে ঢুকি।’

একটা অতি অন্ধকার জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে সবাই যখন আত্মগোপন করলে—মানিক তখন শুধোলে, ‘বিমলবাবু, অজগরের মাথা তো গুঁড়ো হয়ে গিয়েছে, সে তো আমাদের আর তেড়ে এসে আক্রমণ করতে পারত না? তবে তাড়াতাড়ি আমাদের এখানে পালিয়ে আসতে বললেন কার ভয়ে?’

জয়ন্ত ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললে, ‘মানিক, তোমার নির্বুদ্ধিতা দেখে আমি হতবুদ্ধি হয়ে যাব বলে মনে হচ্ছে! তুমি কি এটুকু বুঝতে পারছ না যে, আমরা এক পদচিহ্ন অনুসরণ করে এই দুর্ভেদ্য জঙ্গলের ভিতরে এসে ঢুকেছি, মানুষের হাতে কাটা এক অভাবিত পথ দিয়ে? নিশ্চয়ই আমরা এসে পড়েছি শত্রুপুরীতে। এখান থেকেই কোনও চর গিয়েছিল আমাদের পিছনে পিছনে! চর যারা পাঠিয়েছিল তারা নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে নেই! যদিও বা ঘুমিয়ে থাকল, দু—দুবার বন্দুকের গর্জনে ভেঙে গিয়েছে তাদের ঘুম! এই দুর্ভেদ্য জঙ্গলে কোনওদিন কোনও মানুষ আসে না, অথচ এখানে বন্দুক গর্জন করে উঠল দু—দুবার! বন্দুকের গর্জন জানায় মানুষের অস্তিত্ব! তুমি কি মনে করছ যারা আমাদের পিছনে চর পাঠিয়েছিল তারা এখনও অন্ধকার থেকে আলোকে এসে হাজির হয়নি? তারা অজগরেরও চেয়ে ভয়ানক! বিমলবাবু ওইজন্যেই বলছিলেন তোমাদের লুকিয়ে পড়তে!’

কুমার বললে, ‘জয়ন্তবাবু, আমি আপনাদের সব শেষে এই জঙ্গলে এসে ঢুকেছি। কিন্তু ঢোকবার আগেই কী দেখলুম জানেন? ডান দিকে খানিক দূরে জেগে আছে একটা পাহাড়—পাহাড়ই বা বলি কেন, খুব উঁচু ঢিপির মতন একটা জায়গা, আর তারই তলা থেকে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এল একটা মানুষ! বোধহয় একটা নয়, তারও পিছনে পিছনে যেন দেখলুম আরও দু—চারটে মাথা!’

হঠাৎ মানিক বললে, ‘চুপ! জঙ্গলের বাইরে যেন কাদের গলা পাওয়া যাচ্ছে।’

দু—তিনজন লোকের অস্ফুট কণ্ঠস্বর শোনা গেল বটে।

কিন্তু তারপরেই জাগ্রত হয়ে উঠল এক ভয়ংকর, বীভৎস আর্তনাদ! রাত্রির নিস্তব্ধ আকাশ যেন বিদীর্ণ হয়ে গেল।

বিমল বললে, ‘জয়ন্তবাবু, কিছু বুঝতে পারছেন কি? অভাবিতরূপে এখানে বন্দুক গর্জন করে উঠল কেন তাই জানবার জন্যে কৌতূহলী হয়ে কেউ কেউ ঘটনাস্থলে এসে হাজির হয়েছে! তারপর একটা জঙ্গল ঘন ঘন আন্দোলিত হচ্ছে দেখে তারা ঢুকেছিল ওই জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে। তার ভিতরে পাকসাট খাচ্ছিল মৃত অজগরের দেখতে—জীবন্ত সুদীর্ঘ দেহ! তারই দেহের পাকের ভিতরে গিয়ে পড়ে কোনও নির্বোধ হতভাগ্যকে এখন ইহলোক ত্যাগ করতে হয়েছে!’

সেই জঙ্গলের বাইরে দূর থেকে শোনা গেল অনেকগুলো মানুষের কণ্ঠস্বর। তারা যে কী বলছে তা বোঝা গেল না বটে, কিন্তু তারা যে উপকারী বন্ধু নয় এইটুকু বুঝে বিমল ও জয়ন্ত প্রভৃতি একেবারে স্তব্ধ হয়ে রইল। পাছে বাঘা পশুবুদ্ধির উত্তেজনায় আচমকা চিৎকার করে ওঠে, সেই ভয়ে কুমার দুই হাত দিয়ে তার মুখ ভালো করে চেপে রইল।

সকলে অপেক্ষা করতে লাগল রুদ্ধশ্বাসে! যেন কোনও বিপদ এখনই এসে পড়বে তাদের স্কন্ধের উপরে।

কিন্তু তাদের সৌভাগ্যক্রমে কোনও বিপদেরই সূচনা হল না। বাইরের কণ্ঠস্বরগুলো নীরব হয়ে গেল ধীরে ধীরে। তারপরে জাগ্রত হয়ে রইল শুধু সুন্দরবনের বনস্পতিদের অনন্ত মর্মর ভাষা এবং চন্দ্রপুলকিত রজনীর ঝর ঝর জ্যোৎস্নাধারা!

সপ্তম – কেউটের জঙ্গলে

জয়ন্ত হামাগুড়ি দিয়ে জঙ্গলের ভিতর থেকে খুব ধীরে ধীরে বাইরের দিকে এগিয়ে এল। তারপর একটা ঝোপ একটু ফাঁক করে মুখ বাড়িয়ে এদিক—ওদিক দেখে নিয়ে বললে, ‘কোনওদিকে কেউ নেই। একটু আগে এখানে যে একটা মস্তবড়ো ট্র্যাজেডি হয়ে গেছে, সেটাও আর বোঝবার উপায় নেই। কেবল অজগর সাপের জঙ্গলটা এখনও তেমনি ছটফটিয়ে দুলে দুলে উঠছে।’

রামহরি বললে, ‘ও বাবা, তাহলে মরাকেও ভয় করতে হয়!’

মানিক বললে, ‘জয়ন্ত আর আমি যখন কাম্বোডিয়ায় ওঙ্কারধামের জঙ্গলে গিয়েছিলুম,তখনও এর চেয়ে দু—গুণ বড়ো একটা ভয়ংকর অজগর আমাদের আক্রমণ করেছিল। সেই অজগরটা মরবার চব্বিশ ঘণ্টা পরেও পাকসাট খেতে ছাড়েনি।’*

হঠাৎ পিছন থেকে ফাঁস করে একটা তীব্র গর্জন শোনা গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে চমকে বিদ্যুৎ—বেগে পিছন ফিরে সকলেই ত্রস্তনেত্রে দেখলে, কুমার ছিটকে একদিকে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে মাটির উপরে আছড়ে পড়ল এবং বাঘা প্রচণ্ড এক লাফ মেরে আক্রমণ করলে প্রকাণ্ড একটা কেউটে সাপকে! এ সাপুড়েদের রুগ্ন, কৃশ, প্রায়—অনাহারী পোষমানা সাপ নয়, এ হচ্ছে একেবারে স্বাধীন সর্প! লম্বায় প্রায় সাত—আট হাত আর তার দেহের বেড়ও প্রায় আট—দশ ইঞ্চি! বাঘা অত্যন্ত জোয়ান ও বৃহৎ কুকুর। সে একেবারে গিয়ে কেউটের গলা কামড়ে ধরেছিল বটে, কিন্তু সাপটা ঠিক অজগরের মতোই বাঘার সর্বাঙ্গকে নিজের দেহের পাক দিয়ে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলে যে, সে বেচারি দেখতে দেখতে সাপের গলা কামড়ে ধরেই মাটির উপর শুয়ে পড়ে ছটফট করতে লাগল! দেখেই বোঝা গেল, কেউটে মরলেও বাঘার বাঁচবার কোনও উপায় নেই!

কুমার পাগলের মতো মাটির উপর থেকে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই সর্পের মারাত্মক আলিঙ্গনে বদ্ধ তার প্রিয়তম বাঘার দেহের উপরে! তারপর অত্যন্ত তাড়াতাড়ি পকেট থেকে একখানা বৃহৎ ছুরি বার করে সাপটার দেহকে নানা জায়গায় আঘাত করে খণ্ডবিখণ্ড করে দিলে!

রামহরি বলে উঠল, ‘খবরদার বাঘা, সাপটার মুন্ডু এখনও ছাড়িসনে! শুনেছি কেউটেদের কাটা মুন্ডুও লাফ মেরে মানুষদের কামড়ে দেয়!’

বাঘা মানুষ—রামহরির ভাষা হয়তো বুঝলে না, কিন্তু নিম্নশ্রেণির জীবদেহের যে সহজাত বুদ্ধি থাকে, বাঘার ঘটে সেটুকুর অভাব ছিল না। কুমার যখন কেউটের দেহের পাক কেটে তাকে মুক্তিদান করলে, তখনও সে সাপের মুন্ডুটাকে ত্যাগ করতে রাজি হল না। এবং সত্যসত্যই সেই দেহহীন মুণ্ডটা তখনও তাকে দংশন করবার চেষ্টা করছিল!

কুমার আবার তার সেই সুদীর্ঘ ও তীক্ষ্নধার ছুরি দিয়ে সাপটার মুণ্ডটাকে কুচিকুচি করে প্রায় আট—দশ খণ্ডে বিভক্ত করে দিলে। বাঘা তখন সর্পমুণ্ডের অবশিষ্ট অংশ ত্যাগ করে থেবড়ি খেয়ে বসে রক্তাক্ত জিহ্বা বার করে হা হা করে হাঁপাতে লাগল।

মানিক ত্রস্তকণ্ঠে বললে, ‘বাবা, কেউটে আবার এক বড়ো হয়! এ যে প্রায় একটা ময়াল সাপ!’

জয়ন্ত বললে, ‘বাঘা দেখছি অদ্ভুত এক সাহসী কুকুর। ও না থাকলে আজ বোধহয় কেউটের বিষে আমাদের দু—তিনজনকে মরতেই হত!’

রামহরি বাঘাকে কোলে করে তুলে নিয়ে বললে, ‘খোকাবাবু, এ সর্বনেশে জঙ্গলের ভিতরে আর থাকা নয়! তাড়াতাড়ি খোলা জায়গায় বেরিয়ে পড়ি চলো।’

বিমল বললে, ‘আমারও সেই মত। অজগর এলেন, কেউটে এলেন, অতঃপর আবার কে আসবেন কিছুই বলা যায় না! মানুষ—শত্রুকে আমি ভয় করি না, কিন্তু এই বুকেহাঁটা হিলবিলে জীবদের কাছ থেকে যত তফাতে থাকা যায়, ততই ভালো!’

সকলে একে একে জঙ্গলের ভিতর থেকে বেরিয়ে খোলা জায়গায় এসে দাঁড়াল।

কুমার একদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললে, ‘জয়ন্তবাবু, ওই দেখুন, সেই মস্তবড়ো মাটির স্তূপটা! ওটা বোধহয় পঞ্চাশ—ষাট ফুট উঁচু। প্রায় ছোটোখাটো একটা পাহাড় বললেই চলে!’

জয়ন্ত বিস্মিতকণ্ঠে বললে, ‘এমন সমতল জমির উপরে হঠাৎ অত বড়ো একটা মাটির স্তূপের সৃষ্টি হল কেমন করে?’

বিমল বলল, ‘এরকম মাটির স্তূপ সুন্দরবনের আরও কোনও কোনও জায়গায় পাওয়া গিয়েছে। আপনি কি ‘ভরত—ভায়নার’ স্তূপের নাম শোনেননি?’

—’না।’

—’ওই ‘ভরত—ভায়নার’ স্তূপ এ অঞ্চলে খুবই বিখ্যাত। এখনও তা খনন করা হয়নি বটে, কিন্তু প্রত্নতত্ত্ববিদ পণ্ডিতদের বিশ্বাস, ওখানে খনন করলে প্রাচীন বৌদ্ধযুগের কোনও সৌধ বা বিহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে!’

কুমার বললে, ‘জঙ্গলে ভিতরে ঢোকবার আগে দূর থেকে আমি ওখানেই দেখেছিলুম, যেন মাটি ফুঁড়েই উঠে আসছে মনুষ্যমূর্তি!’

বিমল উৎসাহিত কণ্ঠে বললে, ‘জয়ন্তবাবু, এতক্ষণ ধরে যা খুঁজছিলুম, এইবারে বোধহয় তারই সন্ধান পাওয়া গেল!’

মানিক বললে, ‘আমরা তো দেখতে এসেছি এখানে কোনও পুরাকীর্তিচিহ্ন পাওয়া যায় কি না।’

বিমল বললে, ‘সেকথা সত্য। কিন্তু আমরা এখানে প্রত্নতত্ত্ববিদের কর্তব্য পালন করতে আসিনি। আমাদের এই অনুসন্ধানের আসল উদ্দেশ্য কী জানেন মানিকবাবু?’

জয়ন্ত বললে, ‘আমি জানি। আমি প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ পাইনি, তাই এ অঞ্চলের অরণ্যরাজ্যের মধ্যে যে প্রাচীন প্রাসাদ, মঠ আর বৌদ্ধবিহার প্রভৃতির অস্তিত্ব আছে, এটা আমার একেবারেই অজানা ছিল। বিজনবাবুর লঞ্চে বসে প্রায়ই শুনছিলুম, মধুডাকাতের দল মাত্র দশ—পনেরো মাইলের ভিতরেই বাস করে, এত চেষ্টাতেও তাদের আস্তানা খুঁজে পাওয়া যায় না কেন? রোজ আমি বসে বসে কেবল এই কথাটাই ভাবতুম। তারপর বিমলবাবুর কথা শুনে আমি যেন পেলুম একটা মস্ত সম্ভাবনার ইঙ্গিত। তিনি বললেন, ‘সুন্দরবনের মাটি নাকি যুগে যুগে ক্রমাগতই নীচের দিকে অবনত হয়ে যাচ্ছে, আর সেই মাটি ফুঁড়ে মাঝে মাঝে পাওয়া যাচ্ছে সেকালকার ঘরবাড়ির ধ্বংসাবশেষ।’ তৎক্ষণাৎ আমার মন সচকিতে জেগে উঠল। ভাবলুম, মধু কি তাহলে দলবল নিয়ে এই রকম চোখের আড়ালে অদৃশ্য কোনও ধ্বংসাবশেষের ভিতরে গিয়ে আত্মগোপন করে? আরও আন্দাজ করলুম, খুব সম্ভব বিমলবাবুর মনেও জেগেছে সেইরকম কোনও সন্দেহ! তাই তিনি যখন নতুন—কোনও পুরাকীর্তি আবিষ্কারের অছিলায় সুন্দরবনের এ—অঞ্চলটায় বেড়াবার জন্যে বেরিয়ে পড়তে চাইলেন, আমি তখনই সাগ্রহে তাঁর প্রস্তাবে সায় দিলুম। কেমন বিমলবাবু, কথাটা কি ঠিক নয়?’

বিমল কোনও জবাব দিলে না, মুখ টিপেটিপে কেবল হাসতে লাগল।

কুমার অধীরকণ্ঠে বললে, ‘এসব আলোচনা পরে করলেও ক্ষতি হবে না! আমার এ সর্বনেশে বন মোটেই ভালো লাগছে না, যদি কিছু করবার থাকে তাড়াতাড়ি সেরে ফেলুন!’

রামহরি বললে, ‘যা বলেছ কুমারবাবু। ওই দ্যাখো না, ওখান দিয়ে আবার একটা মস্ত গোখরো সাপ আমাদের দেখেই ফণা তুলে ভয় দেখিয়ে বাঁ বাঁ করে ছুটে পালিয়ে গেল! আমি ডাকাতের সঙ্গে, বাঘ—ভাল্লুকের সঙ্গে, হাতি আর গণ্ডারের সঙ্গেও লড়তে রাজি আছি, কিন্তু ওই সাপটাপের সঙ্গে কিছুতেই আমার পোষাবে না! কোথাও কিচ্ছু নেই, হঠাৎ দিলে ফাঁস করে এক কামড়। তারপরে সঙ্গে—সঙ্গেই হল অক্কালাভ! এমন হতচ্ছাড়া জায়গাকে যত শিগগির ছাড়তে পারি, ততই ভালো!’

জয়ন্ত বললে, ‘সত্যি, এ হচ্ছে একটা অভিশপ্ত ঠাঁই! বিমলবাবু, এখানে দেখছি গোয়েন্দাগিরির চেয়ে অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধই বেশি। এদিকে আপনি হচ্ছেন বহুদর্শী, আপনিই বলুন, এখন আমাদের কী করা উচিত।’

বিমল বললে, ‘আপনার মতন বুদ্ধিমান লোককে আমি আর কী বলব বলুন? তবে এতদূর যখন এসেছি, তখন ওই স্তূপটার কাছে গিয়ে একবার উঁকিঝুঁকি মারলে মন্দ হয় কি?’

জয়ন্ত সহাস্যে বললে, ‘আপনি যে এই কথাই বলবেন, তা আমি আগে থাকতেই জানি। ওই স্তূপটার কাছে যাবার জন্যে আমার মনও আগ্রহে অধীর হয়ে উঠেছে।’

বিমল বললে, ‘বেশ, তবে তাই চলুন। কিন্তু সকলকেই বলছি—হুঁশিয়ার! প্রত্যেকেই নিজের নিজের বন্দুক আর রিভলভার প্রস্তুত করে রাখো! ওই মৃত্তিকাস্তূপের কাছে গেলে যে—কোনও মুহূর্তেই ছুটতে পারে রক্তনদীর বন্যা! ভগবান জানেন, সে রক্ত হবে কাদের? আমাদের? না শত্রুদের?’

অষ্টম – ফাঁপা কোটরে সুড়ঙ্গপথ

কোন দিকে যেতে হবে এটা আর দেখিয়ে দিতে হল না। কারণ কর্দমাক্ত পৃথিবীর উপরে যে পদচিহ্নগুলোর স্পষ্ট চিত্র লেখা আছে, তারাই মৌনভাষায় যেন চিৎকার করেই বলে দিতে লাগল, কোন দিক থেকে এসেছে এবং কোন দিকে ফিরে গিয়েছে শত্রুর দল!

কুমার বললে, ‘বাঘা রে, ওই পায়ের দাগগুলো একবার শুঁকে দেখ! তারপর যে কী করতে হবে তোকে আর নিশ্চয়ই বুঝিয়ে দিতে হবে না! তারপর আজ তোকেই মহাজন করে আমরা করব তোরই পদাঙ্ক অনুসরণ!’

যাঁরা নিয়মিতভাবে কুকুর পোষেন তাঁরা সকলেই জানেন, কুকুর তার মানুষ—মনিবের অনেক ভাষাই বুঝতে পারে। বিশেষত, আমাদের বাঘা জাতে দিশি হলেও শিক্ষা ও লালনপালনের গুণে সে হয়ে উঠেছিল কুকুর—সমাজের মধ্যে রীতিমতো অসাধারণ!

বাঘা থেবড়ি খেয়ে মাটির উপরে বসে পৃথিবীর উপরে পটাপট শব্দে ল্যাজ আছড়াতে আছড়াতে ঊর্ধ্বমুখে জিভ বার করে কুমারের কথাগুলো সানন্দে শ্রবণ করলে। তারপরেই হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে মুখ নামিয়ে পদচিহ্ন আঁকা মাটির উপরটা ভালো করে বারকয়েক শুঁকে নিলে।

তারপর সে আর কোনওই ইতস্তত করলে না, মাটির উপরটা শুঁকতে শুঁকতে এগিয়ে চলল অত্যন্ত তাড়াতাড়ি!

বিমল ও জয়ন্ত প্রভৃতি অগ্রসর হল বাঘার পিছনে পিছনে।

চতুর্দিকে যে স্তব্ধতা, তাকে ভয়াবহ বললেও অত্যুক্তি হবে না। শহরের বাসিন্দারা—গভীর রাত্রে নগর যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন যে নীরবতাকে অনুভব করেন, তার সঙ্গে এখানকার নীরবতা কিছুই মেলে না। এ যেন মৃত্যুলোকের একান্ত নিস্তব্ধতা, এর মধ্যে জীবনের এতটুকু শ্বাসপ্রশ্বাস পর্যন্ত নেই। এমনকী বন্যবাতাসেরও যেন দম বন্ধ হয়ে গিয়েছে। গাছের একটা পাতা পর্যন্ত নড়ছে না। সেই সমাধিজগতের মধ্যে মৃতের মতন পাণ্ডুর চাঁদের চোখের আলো পর্যন্ত যেন মূর্ছিত হয়ে পড়ে আছে!

সকলে সেই স্তূপটার কাছে গিয়ে হাজির হল! সেখানেও জীবনের কোনও চঞ্চলতা নেই। খানিক আলো আর খানিক কালো মেখে সেই উঁচু মাটির ঢিপিটা দাঁড়িয়ে রয়েছে যেন সেই সমতল জগতে একটা অসম্ভব বিস্ময়ের মতো!

স্তূপের অনেকখানি পর্যন্ত ঢেকে খাড়া হয়ে ছিল একটা বিরাট বটবৃক্ষ। সেই একটিমাত্র বনস্পতিই সেখানে সৃষ্টি করেছে যেন একটি ছোটোখাটো অরণ্য। তার নানা শাখাপ্রশাখার তলা থেকে নেমে এসেছে এমন মোটা মোটা ঝুরি যে দেখলেই মনে হয় সেগুলো কোনও বড়ো বড়ো গাছের গুঁড়ি।

বাঘা সেই বিরাট বটগাছের তলায় যেখানে গিয়ে হাজির হল তার চারিদিকেই রয়েছে এমন ঘন ঝোপঝাপ যে, দলে দলে মানুষও তার ভিতরে গিয়ে দাঁড়ালে একেবারে অদৃশ্য হয়ে হারিয়ে যেতে পারে। বিমল পিছন ফিরে ডাকল, ‘রামহরি!’

রামহরি সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এসে বললে, ‘কী খোকাবাবু?’

—’তোমার মোটঘাটের ভিতরে গোটাতিনেক পেট্রলের লণ্ঠন আছে। চটপট সেগুলো বার করে জ্বালিয়ে ফ্যালো! এই অতিকায় গাছের তলায় যে নিবিড় অন্ধকার, অন্ধের মতো এগিয়ে শেষকালে কি কোনও অজগরের পেটের ভেতরে গিয়ে হাজির হব?’

তিনটে পেট্রলের সমুজ্জ্বল আলোকের আঘাতে সেই মস্তবড়ো বটগাছের তলা থেকে সমস্ত অন্ধকার ছুটে পালিয়ে গেল যেন মুহূর্তের মধ্যে।

বাঘা তখন হাজির হয়েছে বটগাছের প্রধান গুঁড়িটার কাছে। তারপরেই সে যেন হতভম্বের মতন ‘কুঁই কুঁই’ শব্দে কেমন একটা করুণ আর্তনাদ করতে লাগল!

জয়ন্ত এদিক—ওদিক পরীক্ষা করে বিস্মিতস্বরে বললে, ‘এ কী আশ্চর্য ব্যাপার! পায়ের চিহ্নগুলো শেষ হয়ে গিয়েছে একেবারে এই গাছের গুঁড়ির তলায় এসে!’

পেট্রলের লণ্ঠনগুলোর উজ্জ্বল আলোকের উপরেও উজ্জ্বলতর আলোক সৃষ্টি করে সেখানে জ্বলে উঠল সকলকার হাতে বৈদ্যুতিক টর্চ! সেই ঝুপসি গাছের তলাটা দিনেদুপুরেও নিশ্চয়ই কখনও পায়নি তেমন দীপ্তির আভাস।

বৃহৎ বটগাছটার প্রধান গুঁড়ির বেড় হয়তো ত্রিশ—পঁয়ত্রিশ হাতের কম হবে না!

তারই উপরে হাত বুলিয়ে এবং তীক্ষ্ন দৃষ্টিপাত করে কুমার বললে, ‘বিমল, বিমল! এখানে একটা খুব সূক্ষ্মভাবে কাটা দরজার চিহ্ন রয়েছে! গাছের গুঁড়িতে দরজার চিহ্ন! এমন ব্যাপার কল্পনাতেও আনা যায় না!’

সত্য কথা!

জয়ন্ত একটা ধাক্কা মারলে, সেই প্রকাণ্ড বৃক্ষের দেহের খানিকটা ঢুকে গেল ভিতর দিকে—ঠিক যেন একটা দরজার পাল্লার মতো!

তারপর সে ভিতরে গিয়ে ঢুকল। এদিকে, ওদিকে, উপরে ও নীচে টর্চের আলোকপাত করে বিস্মিতকণ্ঠে বললে, ‘বিমলবাবু, একী অদ্ভুত ব্যাপার! এই গাছের গুঁড়িটা একেবারে ফাঁপা। তবে এতবড়ো গাছটা জ্যান্ত হয়ে আছে কেমন করে?’

রামহরি বললে, ‘আপনার বাবু শহুরে মানুষ! আপনারা তো দেখেননি, এমন অনেক বড়ো বড়ো বটগাছ আছে যাদের আসল গুঁড়ি মরে গিয়ে একেবারে ফাঁপা হয়ে যায়! তবু সেসব গাছ জ্যান্ত হয়েই থাকে। চারিদিকে এই যেসব ঝুরি দেখছেন, মাটি থেকে রস শুষে নিয়ে এরাই বাঁচিয়ে রাখে বটগাছদের।’

উজ্জ্বল পেট্রলের আলোকে চারিদিকে তাকিয়ে বোঝা গেল, সেই বৃক্ষকোটরের ভিতরটাকে একখানি বড়োসড়ো ঘর বললেও অত্যুক্তি হবে না। কেবল সেই ঘরের উপরদিকে ছাদের আবরণ নেই, ঊর্ধ্বমুখে তাকালে দেখা যায় চাঁদের আলোমাখা এক টুকরো আকাশ।

ইতিমধ্যে আর একটা নতুন আবিষ্কার করে ফেলেছে জয়ন্ত! কোটরের একপ্রান্তে মাটির সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে রয়েছে একখানা মাঝারি আকারের দরজার পাল্লা। খুব বড়ো একটা কড়া ধরে উপরদিকে টানবামাত্র দরজাটা বাইরের দিকে খুলে এল বেশ সহজেই।

জয়ন্ত নীচের দিকে উঁকি মেরে দেখে বললে, ‘একসার সিঁড়ি নীচের দিকে নেমে গিয়েছে দেখছি। এখন আমাদের কী করা উচিত?’

বিমল বললে, ‘এখন আমাদের পাতালপ্রবেশ করা ছাড়া উপায় নেই।’

রামহরি বললে, ‘তোমার কি গাঁয়ার্তুমি করবার বয়স এখনও গেল না খোকাবাবু? পাতালে প্রবেশ করব বলছ যে, কিন্তু দলে ভারী ডাকাতরা যদি আমাদের আক্রমণ করে?’

—’আমরাও আত্মরক্ষা আর প্রতি—আক্রমণ করবার জন্যে প্রস্তুত হয়েই এসেছি। আমাদের প্রত্যেকেরই সঙ্গে আছে অটোমেটিক বন্দুক আর অটোমেটিক রিভলভার—খুব সম্ভব ডাকাতদের কারুর কাছেই যা নেই। আমরা পাঁচজনে দুশোজন ডাকাতকে বাধা দিলেও দিতে পারি।’

জয়ন্ত বললে, ‘আপনারা এইখানে দাঁড়িয়ে একটু অপেক্ষা করুন। আগে আমি একলা চুপি চুপি নীচে নেমে গিয়ে এখানকার হালচালটা কিছু কিছু বোঝবার চেষ্টা করে আসিগে।’ বলেই পা টিপে টিপে সিঁড়ি দিয়ে নীচের দিকে নেমে অন্ধকারের ভিতরে মিলিয়ে গেল।

খানিকক্ষণ উপরকার কারুর মুখেই কোনও কথা নেই। কেবল গাছের কোটরের কোনখান থেকে একটা তক্ষক বিশ্রীকণ্ঠে বারকয়েক ডেকে উঠল।

মিনিট ছয়—সাত পরে জয়ন্ত আবার সিঁড়ির উপরকার ধাপে এসে দাঁড়াল। বললে, ‘বিশেষ কিছুই পাওয়া গেল না। সিঁড়ি দিয়ে নেমেই পেলুম একটা বেশ লম্বা আর চওড়া সুড়ঙ্গপথ। তার চারিদিকটাই বাঁধানো। পরীক্ষা করে বুঝলুম, এ সুড়ঙ্গটা নতুন তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু তার ভিতরে জনপ্রাণীর সাড়া নেই, বিরাজ করছে ঠিক সমাধির স্তব্ধতা। সুড়ঙ্গের শেষপ্রান্তে গিয়ে পেলুম আর একটা দরজা, কিন্তু তার পাল্লাদুটো ওধার থেকে বন্ধ। দরজার উপরে কান পেতেও জীবনের কোনও লক্ষণই আবিষ্কার করতে পারলুম না। ওই দরজার ওধারে কী আছে জানি না, কিন্তু আপাতত আমরা এই সুড়ঙ্গের ভিতরে বোধহয় নিরাপদেই প্রবেশ করতে পারি।’

বিমল বললে, ‘বেশ, তাহলে আপনি পথ দেখান।’

জয়ন্ত আগে আগে আবার সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল এবং তার পশ্চাৎ অনুসরণ করলে বিমল, কুমার, মানিক, রামহরি ও বাঘা। সুড়ঙ্গের ভিতরে গিয়ে হাজির হয়ে চারিদিকে তাকাতে তাকাতে কুমার বললে, ‘বাঃ, এরা যে এখানে বেশ পাকা বন্দোবস্ত করে ফেলেছে দেখছি। কিন্তু সুড়ঙ্গটার ভিতর দিয়ে এগুলে আমরা কোথায় গিয়ে পড়ব?’

বিমল বললে, ‘আমার বিশ্বাস, উপরে যে স্তূপটা দেখে এসেছি, মাটির তলা দিয়ে সুড়ঙ্গের সাহায্যে আমরা হয়তো তারই ভিতরে প্রবেশ করতে পারি। হয়তো ওই স্তূপের তলায় পুরানো ঘরবাড়ির ধ্বংসাবশেষ আছে। হয়তো ধ্বংসাবশেষের কোনও কোনও জায়গা অল্পবিস্তর মেরামত করে নিলে এখনও সেখানে মানুষ বাস করতে পারে। দৈবগতিকে এটা জানতে পেরেই মধুডাকাত এখানে এসে গেড়েছে তার গোপন আস্তানা!’

মানিক বললে, ‘কিন্তু পাতালের ভিতরে ডাকাতরা আলোবাতাস পাবে কেমন করে?’

বিমল বললে, ‘যারা পৃথিবীর চোখে ধুলো দেবার জন্যে এত আয়োজন করতে পেরেছে, তারা কি আর ওদিকে দৃষ্টি দেয়নি? হয়তো তারা উপর থেকে স্তূপের স্থানে স্থানে খুঁড়ে ভিতরে আলো আর বাতাস যাবার পথ করে নিয়েছে!’

এমনি কথাবার্তা হচ্ছে, হঠাৎ পিছন দিকে একটা শব্দ হল। সবাই একসঙ্গে চমকে ফিরে দাঁড়িয়ে সবিস্ময়ে দেখলে, সুড়ঙ্গের যে মুখ দিয়ে তারা ভিতরে প্রবেশ করেছে সেই মুখটার উপর থেকে নীচে পর্যন্ত জুড়ে আছে অনেকগুলো বিষম মোটা মোটা লোহার গরাদে! আবার তাদের পিছনদিকে সেইরকম আর একটা শব্দ এবং আবার তারা চমকে ফিরে অবাক হয়ে দেখলে, সুড়ঙ্গের অন্যদিকেও মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত জুড়ে এসে পড়েছে তেমনি মোটা মোটা কতকগুলো লোহার গরাদে!

তাদের পিছু হঠবার বা সামনে এগুবার দুই পথই বন্ধ! তারা যেন পশুশালার লোহার খোঁচার মধ্যে বন্দি!

অকস্মাৎ সেই সুড়ঙ্গপথ এক অতি তীব্র, তীক্ষ্ন ও রোমাঞ্চকর হা—হা—হা—হা অট্টহাসির রোলে পরিপূর্ণ হয়ে গেল! সত্যি কথা বলতে কী, সে—বীভৎস হাসির বর্ণনা তার ওই হা—হা—হা—হা রবের দ্বারা বোঝানো যায় না—কারণ, সে—যেন চামুণ্ডারূপিণী প্রচণ্ড কোনও নারীর খল খল খল খল অট্টহাসি!

তিন—তিনটে প্রদীপ্ত পেট্রলের লণ্ঠন সেই সুড়ঙ্গপথের শেষ প্রান্তকেও দিয়েছিল অন্ধকারের কবল থেকে মুক্তি।

দেখা গেল, সুড়ঙ্গপথের অন্য প্রান্তের বন্ধ দরজাটা খুলে গিয়েছে এবং সেই দরজার সামনে এসে আবির্ভূত হয়েছে পনেরো—কুড়িটা সুদীর্ঘ মূর্তি! এতদূর থেকেও লণ্ঠনের উজ্জ্বল আলোতেও তাদের কারুর চেহারা স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছিল না বটে, কিন্তু এটা বেশ আন্দাজ করতে পারা যাচ্ছিল যে, সেই মূর্তিগুলোর প্রত্যেকটাই রীতিমতো যমদূতের মতোই দেখতে!

কে যে হাসছে বোঝা যাচ্ছিল না তাও। হঠাৎ সেই নারীকণ্ঠের তীব্র হাসি থেমে গিয়ে জেগে উঠল, খনখনে মেয়েগলায় একটা কৌতুকপূর্ণ স্বর—’ওরে পুঁচকে বিমল! আমার গলা শুনে তুই কি আমাকে চিনতে পারছিস?’

বিমল শান্ত অথচ অবিচলিতকণ্ঠে বললে, ‘চিনতে পারছি বই কি অবলাকান্ত! অমন বিরাট দেহে অমন কুৎসিত নারীকণ্ঠ ভগবান বোধহয় পৃথিবীর দ্বিতীয় কোনও পুরুষকে দান করেননি! তুমি মধুডাকাত বলেই আত্মপরিচয় দাও কিংবা বৃদ্ধের ছদ্মবেশই ধারণ করো, কিন্তু তোমার অস্তিত্ব আমি এখানে আসবার আগেই অনুমান করে নিয়েছি। সেই ‘জেরিনার কণ্ঠহারে’র মামলায় শেষপর্যন্ত হেরে গিয়েও তুমি আমাদের ফাঁকি দিয়ে লম্বা দিয়েছিলে, একথা কি আমি কোনওদিন ভুলব? আজ যে আবার তোমাকে মুঠোর ভেতরে পেয়েছি, এটা জেনে আমার মন আনন্দে নেচে উঠছে!’

আবার সেই খনখনে গলায় খল খল অট্টাহাসি! তারপরই হঠাৎ হাসি থামিয়ে অবলাকান্ত চিৎকার করে বললে, ‘বলিস কীরে? তুই আমাকে মুঠোর ভেতরে পেয়েছিস? না আমি তোকে আর তোর স্যাঙাতদের বুনো কুকুর—শেয়ালের মতন লোহার খোঁচায় বন্দি করে ফেলেছি? খালি তুই কেন, মস্তবড়ো গোয়েন্দা বলে যে নাম কিনতে চায়, সেই জয়ন্তগাধাকে তোর মতন আগেও আমি একবার নিজের হাতের মুঠোর ভেতরে পেয়েছিলুম, আজও আবার পেয়েছি! এক ঢিলে আজ আমি দুই পাখি মারতে চাই! তোদের দু—জনের সঙ্গে আর যারা আছে তাদের আমি উল্লেখযোগ্য বলে মনেই করি না! তবে এইসঙ্গে সেই হাঁতকা পুলিশকর্মচারী সুন্দরটাকে জালে ফেলতে পারলে আমার প্রতিহিংসা আজ একেবারে সার্থক হত!’

জয়ন্ত বললে, ‘অবলাকান্ত, তোমার বাজে তড়পানি শোনবার জন্যে আমরা প্রস্তুত নই। তুমি কি করতে চাও, তাই বলো।’

—’আমি কী করতে চাই? আমি কী করতে চাই? তা শুনলে তোদের দেহের রক্ত হিম হয়ে যাবে! বিজম জমিদারের ‘লঞ্চ’ আক্রমণ করবার আগে যদি আমি তোদের খবর জানতে পারতুম, তাহলে আগে থাকতে সেইখানেই ব্যবস্থা করতুম তোদের টিপে মেরে ফেলবার জন্যে! তারপরেই যখন হঠাৎ তোদের দেখা পেলুম, তখনই বুঝলুম যে, তোদের মতন ছিনে—জাঁক শেষপর্যন্ত না দেখে ছাড়বে না। তারপর আজ এই বিপথে আমার আড্ডার এত কাছে বন্দুকের শব্দ শুনেই আমার জানতে বাকি রইল না যে, এখানেও হয়েছে তোদেরই অশুভ আবির্ভাব! আমি বুদ্ধিমানের মতন তখন আর কোনও গোলমাল না করে তোদের যথাযোগ্য অভ্যর্থনা করবার জন্যে সমস্ত ব্যবস্থা ঠিক করে রাখলুম। আমি জানতুম, তোরা এখানে আসবি, আসবি, আসবি! হা—হা—হা—হা—হা!’

জয়ন্ত অধীরকণ্ঠে বললে, ‘তোমার প্রলাপের উচ্ছ্বাস আর আমাদের ভালো লাগছে না! তুমি এখন কী করতে চাও তাই বলো।’

—’আমি কী করতে চাই? আমি কী করতে চাই? আমি যা করতে চাই, সেটা তোদের কাছে একটুও ভালো লাগবে না! আমার প্রতিহিংসা সর্বদাই দৌড়োয় উলটো পথে! আমি তোদের হাতে মারব না, ভাতে মারব! বুঝেছিস?’

জয়ন্ত বললে, ‘ভাতে মারবার কথা কী বলছ? তোমার কাছে আমরা ভাত খেতে আসিনি!’

আবার অট্টহাসি হেসে অবলাকান্ত বললে, ‘তাই নাকি? তাহলে সংক্ষেপেই শোন, আমি কী করতে চাই। তোরা ওই লোহার খোঁচাতেই বন্দি হয়ে থাকবি—দিনের পর দিন—যতদিন না পটল তুলিস! তোদের একফাঁটা জল খেতে দেব না, এককণা খাবারও দেব না! ওই খোঁচার ভেতরেই ছটফট করতে করতে অনাহারে তোরা মরে থাকবি! ওখান থেকেই সবাই মিলে তোরা যতখুশি চ্যাঁচাতে পারিস, তোদের গলার আওয়াজ এই পাতাল ফুঁড়ে পৃথিবীর উপরে জেগে ওঠবার কোনও পথই নেই। হা—হা—হা—হা—হা!’

দাঁতে দাঁত চেপে কুমার নিম্নস্বরে বললে, ‘বিমল! জয়ন্তবাবু! মানিকবাবু! রামহরি! শয়তানের আস্ফালন আর সহ্য হচ্ছে না! মরতে হয় মরব, কিন্তু এখন শত্রুনিপাত করবার সুযোগ ছেড়ে দেব কেন?’

বিমল বললে, ‘ঠিক বলেছ! ছোড়ো সবাই একসঙ্গে অটোমেটিক বন্দুকগুলো!’

পরমুহূর্তেই একসঙ্গে পাঁচ—পাঁচটা অটোমেটিক বন্দুক গর্জন করতে লাগল বারংবার! কেবল বন্দুকগুলোর শব্দে নয়, অনেকগুলো মনুষ্যকণ্ঠের ভয়াবহ আর্তনাদে সুড়ঙ্গপথের সেই বদ্ধ আবহাওয়া যেন বিষাক্ত হয়ে উঠল।

জয়ন্ত উন্মত্তের মতো চিৎকার করে বলল, ‘তোরা যদি যুদ্ধ করতে চাস, আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ কর! লড়াই করে মরতে আমরা রাজি আছি! আয়, দেখি কাদের বন্দুকের প্রতাপ বেশি?’

মনুষ্যকণ্ঠ থেকে আর কোনও উত্তর শোনা গেল না, অল্পক্ষণ খানিক ঝটাপটি ও হুড়োহুড়ি শব্দের পর শোনা গেল কেবল একটা দরজা সজোরে বন্ধ করে দেওয়ার আওয়াজ।

জয়ন্ত আবার প্রাণপণে চিৎকার করে বললে, ‘ফের যদি তোরা ওই দরজা খুলিস, আমাদের কাছ থেকে এইরকম অভ্যর্থনাই লাভ করবি! আমরা মরতে—মরতেও তোদের মেরে তবে মরব!’

কিন্তু আর কারুর কণ্ঠস্বর পাওয়া গেল না। সেই বন্ধ দরজা বন্ধ হয়েই রইল, কেবল দেখা গেল, দরজার সামনে মাটির উপরে নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে চারটে মনুষ্যমূর্তি! নিশ্চয়ই তারা কেউ আর বেঁচে নেই! হয়তো আহত হয়েছে আরও অনেকগুলো মানুষ, কিন্তু তারা কোনওগতিকে আশ্রয় নিয়েছে ওই বন্ধ দরজার নিরাপদ অন্তরালে!

খানিকক্ষণ কেটে গেল নীরবতার মধ্য দিয়ে। হয়তো সকলেই তখন নিজের নিজের ভীষণ পরিণামের কথা চিন্তা করছিল।

কেবল রামহরি বিমলকে সম্বোধন করে বললে, ‘খোকাবাবু, তুমি যখন সঙ্গে আছ, তখন আমি জানি যে, আমাদের কারুর কোনওই ভয় নেই। এখন কেমন করে এই খোঁচার বাইরে যাই বলো দেখি? এর লোহার ডান্ডাগুলো এত মোটা যে, হাতি এলেও এদের কিছুই করতে পারবে না! হে বাবা বিশ্বনাথ! বুড়ো বয়সে অন্নজল না খেয়ে মরবার ইচ্ছে আমার মোটেই নেই! তুমি আমাদের একটা উপায় করে দাও বাবা!’ বলেই সে দুই হাত জোড় করে বাবা বিশ্বনাথের উদ্দেশে বারংবার প্রণামের পর প্রণাম করতে লাগল।

বিমল হাসতে হাসতে সহজ স্বরেই বললে, ‘ভাই রামহরি, বাবা বিশ্বনাথের ইচ্ছায় এখান থেকে পালাবার উপায় আমাদের সঙ্গেই আছে।’

জয়ন্ত বিস্মিতকণ্ঠে বললে, ‘কীরকম?’

বিমল বললে, ‘খুব সোজা উপায়। কিন্তু সবাইকে আমার কথামতো কাজ করতে হবে।’

—’বলুন।’

—’সকলে মিলে এখানে চিৎকার করে কথা বলতে থাকুন আর মাঝে মাঝে প্রাণপণে গলা ছেড়ে গান শুরু করে দিন। আর নিবিয়ে দেওয়া হোক পেট্রলের আলোগুলো। আমি এখন চাই খালি অন্ধকার আর কোলাহল!’

—’আপনার কথার অর্থ বুঝতে পারছি না!’

—’আমি সব জায়গাতেই প্রস্তুত হয়েই যাই। অনেক দেখে দেখে আমার যথেষ্ট শিক্ষালাভ হয়েছে। হঠাৎ কেউ আমাকে বিপদে ফেলতে পারবে না। আমার সঙ্গে কী আছে জানেন? একটি অতিসূক্ষ্ম প্রথম শ্রেণির উকো! এই উকো দিয়েই লোহার ডান্ডা কেটে আমি এখান থেকে সকলকার পালাবার পথ আবার খুলে দেব। কিন্তু বলা তো যায় না, এই অদ্ভুত সুড়ঙ্গপথের কোন অজানা রন্ধ্রের পিছনে আছে কোন দুরাত্মার সাবধানি চক্ষু! আর লোহার উপরে উকো ঘষলেই একটা শব্দের সৃষ্টি হবে। সেই শব্দটা ঢাকবার জন্যেই সকলকে গোলমাল করতে অনুরোধ করছি। তারপর যদি সেই শব্দ শুনে অন্ধকারে ওদিককার দরজা খোলার আওয়াজ হয়, তখন কেউ যেন একসঙ্গে বন্দুক ছুড়তে একটুকু ইতস্তত না করেন।’

সেই পাতালপুরীর ভিতরে বসে রাত্রি কি দিন কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। আসলে তখন হচ্ছে, শেষ রাত্রি।

বিমল তার উকোর সাহায্যে একটা মোটা লোহার ডান্ডা একেবারে কেটে ফেললে। তারপরে মুখ তুলে বললে, ‘জয়ন্তবাবু, এইবারে কিন্তু দয়া করে আমার কয়েকটি উপদেশ শুনতে হবে। অবশ্য এই উপদেশ মানা আর না—মানা, সে হচ্ছে আপনাদের অভিরুচি।’

জয়ন্ত বললে, ‘বিমলবাবু, দেখছি আজকের নাটকের নায়ক হচ্ছেন আপনিই! এখানে হয়তো আমাদের অনাহারেই মরে পড়ে থাকতে হত—যদি আপনাকে আজ সঙ্গে না পেতুম। আপনি আজ যা বলবেন, সেটা হবে আমাদের কাছে আদেশের মতন!’

বিমল বললে, ‘জয়ন্তবাবু, আপনার এতটা বেশি বিনয় প্রকাশ করবার কোনওই দরকার নেই। আমি যা বলব তা হবে সোজা কথাই!…দেখুন, পালাবার জন্যে আমরা এখানে আসিনি, আমরা এখানে এসেছি একদল দুর্ধর্ষ বোম্বেটে গ্রেপ্তার করতে। পালাতে আমরা এখনই পারি, কারণ পথ আমি সাফ করে দিয়েছি। কিন্তু আপনারা এখান থেকে পালাতে চান, না এই দুর্ধর্ষ দস্যুদলকে গ্রেপ্তার করতে চান!’

জয়ন্ত বললে, ‘বিমলবাবু, ওই অবলাকান্তর ওপরে আমার অনেকদিনের ক্রোধ পুঞ্জীভূত হয়ে আছে। ও আমাদের বারংবার ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গিয়েছে! ওকে আর ওর দলকে যদি গ্রেপ্তার করতে পারি, তাহলে সে সুযোগ আমি নিশ্চয়ই ছাড়ব না! তবে ব্যবস্থা যা দেখছি, এখান থেকে আমাদের পালাবার পথ খোলা রয়েছে, কিন্তু অবলাকান্তদের গ্রেপ্তার করবার কোনওই সুযোগ নেই!’

জয়ন্তের কথার কোনও জবাব না দিয়ে বিমল বললে, ‘কুমার, আজ একটুখানি জাগ্রত হতে পারবে?’

কুমার, হাসতে হাসতে সেলাম করে বললে, ‘জো—হুকুম, মহারাজ!’

বিমল বললে, ‘শোনো কুমার! এখান থেকে বিজনবাবুদের ‘লঞ্চ’ বোধহয় বেশি দূরে নেই! তোমাকে সেইখানে যেতে হবে। আমাদের পালাবার পথ খোলা থাকলেও আমরা এইখানেই আপাতত অচল শিবের মতোই বসে রইলুম। এখন হয়তো বাইরে গিয়ে দেখবে, ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিন্তু তোমার কুকুর—বন্ধু বাঘাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাও—সে তোমাকে নিশ্চয়ই পথ চিনিয়ে দেবে।’

কুমার বললে, ‘আমাকে কী যে করতে হবে এখনও সেটা বুঝতে পারছি না।’

বিমল বললে, ‘তোমাকে বিশেষ কিছুই করতে হবে না। বাঘাকে ইঙ্গিত করলেই সে তোমাকে নিশ্চয়ই পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে, ‘লঞ্চ’ যেখানে আছে সেইখানেই। ‘লঞ্চ’—এর উপরে তিন ডজন বন্দুকধারী পুলিশের সেপাই আছে! তার উপরেও আছে আরও পনেরো—বিশজন লোক। তুমি সমস্ত কথা বলে তাদের সবাইকে সশস্ত্র হয়ে এইখানে আসবার জন্যে অনুরোধ করবে।’

মানিক বললে, ‘কিন্তু বিমলবাবু, পথ যখন খোলা রয়েছে, তখন আপাতত সবাই তো আমরা এখান থেকে সরে পড়তে পারি! তারপর ‘লঞ্চ’ থেকে লোকজন নিয়ে এসে আবার আমরা চেষ্টা করে দেখব এই শয়তানদের গ্রেপ্তার করতে পারি কি না?’

জয়ন্ত রুক্ষস্বরে বললে, ‘মানিক, তোমার আজ হল কী বলো দেখি? তুমি আজ বারবার নির্বোধের মতন কথা কইছ! এখান থেকে আমরা সবাই যদি সরে পড়ি, তাহলে এই পাতালপুরীর বাসিন্দারা তৎক্ষণাৎ সচেতন হয়ে উঠবে, সেটা কি আন্দাজ করতে পারছ না? তারপর ফিরে এসে আর কি তাদের কোনও পাত্তা পাবে?’

বিমল বললে, ‘ঠিক বলেছেন জয়ন্তবাবু! আমি কি চাই জানেন? আমরা এইখানেই বসে থাকব, বেশি বিপদ দেখলেই এখান থেকে সেই মুহূর্তেই সরে পড়ব—কারণ আমাদের পালাবার পথ খোলাই আছে! কিন্তু আমরা তো পালাবার জন্যে এখানে আসিনি, আমরা এসেছি মধুডাকাত বা অবলাকান্ত আর তার দলবল গ্রেপ্তার করতে! কুমার চলে যাক বাঘাকে নিয়ে! সে লঞ্চের উপরে গিয়ে খবর দিক, আমাদের কী অবস্থা! তারপর কেউ যথাসময়ে আসতে পারে ভালোই, না পারে, আমরা নিজেদের পথ নিজেরাই করে নেব—অখন।’

জয়ন্ত বিমলকে আলিঙ্গন করে বললে, ‘দাদা’ তুমি তো গোয়েন্দা নও, আমিই হচ্ছি ডিটেকটিভ! কিন্তু তুমি ভাই আজকে আমাকেও হারিয়ে দিলে!’

বিমল বললে, ‘কে যে হেরে যাবে আর কে যে হারবে না, সেকথা নিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না। তুমি হচ্ছ আমার বন্ধু, তুমি যদি হুকুম করো, আমি সবকিছু করতে পারি!’

জয়ন্ত বললে, ‘আপনি যদি হুকুমের কথা বলেন, সেটা অত্যন্ত অন্যায় হবে। আপনি আমাদের চেয়ে কত বেশি দেখেছেন! যে লোক মঙ্গলগ্রহ গিয়ে ফিরে এসেছে তাকে আমরা কী—ই বা হুকুম করব?’

নবম – তারপর কী হল?

চারিদিকে প্রখর দিবালোক ছড়িয়ে সূর্য তখন উঠেছে আকাশের অনেকখানি উপরে।

কিন্তু সূর্যের আলোকের এককণাও সুড়ঙ্গপথের মধ্যে প্রবেশ করেনি। নিবিড় অন্ধকারের মধ্যে তারা উৎকর্ণ হয়ে বসেছিল একেবারে নীরবে। তাদের প্রত্যেকেরই হাতের বন্দুক যে কোনও মুহূর্তে অগ্নি উদ্গার করবার জন্যে প্রস্তুত হয়েই আছে। সুড়ঙ্গপথের ওদিককার দরজাটা যদি কেউ খোলবার চেষ্টা করে কিংবা ওদিকে যদি কোনও সন্দেহজনক শব্দ শোনা যায়, তাহলে প্রত্যেকেই একসঙ্গে বন্দুক ছুড়তে একটুও বিলম্ব করবে না।

কিন্তু অবলাকান্ত বা তার কোনও অনুচর একবারও দরজা খোলবার বা উঁকিঝুঁকি মারবার চেষ্টা করলে না। দরজা খুললেই যে কীরকম বিপদের সম্ভাবনা, একটু আগেই তারা তার যে নমুনা পেয়েছে তাদের পক্ষে তাই—ই হয়েছে যথেষ্ট। আর একথাও তারা বোধহয় ভাবছে, বন্দিরা যখন লোহার খোঁচার ভিতরে, তাদের পালাবার কোনও উপায়ই যখন নেই এবং অন্ন ও জল থেকে বঞ্চিত করে তাদের যখন হত্যাই করা হবে, তখন আর দরজা খুলে পাহারা দিতে গিয়ে যেচে বিপদকে ডেকে আনবার দরকার কী?

…হঠাৎ সুড়ঙ্গ—পথের মুখে একটা শব্দ শোনা গেল। সাবধানি পায়ের শব্দ! তারপরই একটা চাপা কণ্ঠস্বরে শোনা গেল—’হুম! এ যে বেজায় অন্ধকার বাবা!’

মানিক উৎফুল্লকণ্ঠে বলে উঠল, ‘আমাদের সুন্দরবাবু এসেছেন! পায়ের শব্দ শুনে বোঝা যাচ্ছে সুন্দরবাবু একলা আসছেন না!’

ইতিমধ্যে বিমল সুড়ঙ্গের ভিতর দিকে প্রবেশ করবার জন্যে ওদিককার একটা লোহার ডান্ডা উকো ঘষে কেটে ফেলেছে। সেই পথ দিয়ে বেরুতে বেরুতে বিমল বললে, ‘জয়ন্তবাবু, এইবারে পেট্রলের লণ্ঠনগুলো জ্বালিয়ে ফেলুন।’

আলোকের ধাক্কায় অন্ধকার যখন অদৃশ্য হল তখন দেখা গেল, সিঁড়ি দিয়ে নেমে সুড়ঙ্গের মুখে এসে দাঁড়িয়েছেন সুন্দরবাবু। তারপর আবির্ভূত হল কুমার ও বাঘা! তারপর পদশব্দের পর পদশব্দ তুলে ভিতরে নেমে আসতে লাগল দলে দলে সশস্ত্র পুলিশের লোক।

খোঁচার ভিতরকার বন্দিরাও তখন বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। জয়ন্ত মৃদুকণ্ঠে বললে, ‘সুন্দরবাবু, আপাতত কোনও কথা বলবার বা গোলমাল করবার চেষ্টা করবেন না। খোঁচার কাটা—ডান্ডার ফাঁক দিয়ে গলে চুপিচুপি আমাদের সঙ্গে এগিয়ে আসুন!’

জয়ন্ত ও বিমল সর্বাগ্রে অগ্রসর হল। তারপর তারা সুড়ঙ্গপ্রান্তের সেই বন্ধ দরজাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সেখানে তখনও পড়েছিল কতকগুলো মৃতদেহ! সেদিকে দৃষ্টিপাত না করে দরজার উপরে কান পেতে তারা শুনতে লাগল, কিন্তু দরজার ওদিকে নেই কোনও রকম ধ্বনির অস্তিত্ব।

জয়ন্ত ধীরে ধীরে ঠেলা দিতে দরজা গেল খুলে।

দেখা গেল একখানা বেশ বড়ো ঘর। ঘরখানা যে বহুকালের পুরাতন প্রথম দৃষ্টিতেই সেটাও অনুমান করা যায়।

কিন্তু ঘরের মধ্যেও জনপ্রাণী নেই।

বিমল ঘরের ভিতরে ঢুকে বলল, ‘জয়ন্তবাবু, ওদিককার দেওয়ালে কী একখানা কাগজ মারা রয়েছে দেখছেন?’

জয়ন্ত তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে কাগজখানার উপরে টর্চের আলোক নিক্ষেপ করে উত্তেজিত ও উচ্চস্বরে পড়তে লাগল : ‘ওহে জয়ন্ত—গাধা, ওরে বিমল—শেয়াল। তোরা কি ভেবেছিস আমি অভিমন্যুর মতন নির্বোধ? এই পাতালপুরীতে ঢোকবার পথ রেখেছি আর পালাবার পথ রাখিনি? এখান থেকে বাইরে বেরুবার খালি একটা নয়, অনেকগুলো পথই আছে! পাহারাওয়ালা খালি তোদেরই নেই, আমারও আছে। আমার পাহারাওয়ালারা দিনেরাতে বনে বনে পাহারা দিয়ে বেড়ায়! তাদেরই মুখে খবর পেলুম, সুন্দর—ছুঁচো একদল ছাতুখোর লালপাগড়ি নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে আমার এই আড্ডার দিকে ছুটে আসছে। এযাত্রা আবার তোরা আমাকে ফাঁকি দিলি বটে, কিন্তু এত সহজে ধরা পড়বার ছেলে নই আমিও। তোরা যখন এই শূন্য পাতালপুরীতে বসে হাহুতাশ করবি, আমি তখন থাকব বহুদূরে—বহুদূরে। আমার ঠিকানা যদি চাস তাহলে আবার তোরা আমার সঙ্গে দেখা করিস। তখন তোদের আমি খুব ভালো করেই অভ্যর্থনা করবার চেষ্টা করব। আর আমার সঙ্গে আবার আলাপ করবার শখ যদি তোদের মিটে গিয়ে থাকে, তাহলেও জেনে রাখিস, কমলি তোদের ছাড়বে না। আজ থেকে আমি রইলুম তোদের পিছনে পিছনে মূর্তিমান শনির মতো। ইতি অবলাকান্ত।’ শেষ—দিকটা পড়তে পড়তে জয়ন্তের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠল অত্যন্ত করুণ!

বিমল সকৌতুকে উচ্চকণ্ঠে হাসতে লাগল!

রামহরি বললে, ‘কী যে হাসো খোকাবাবু, গা যেন জ্বলে যায়!’

মানিক বললে, ‘সুন্দরবাবু, এখন আপনি কী করবেন?’

সুন্দরবাবু ফাঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেবল বললেন, ‘হুম!’

কুমার বললে, ‘বাঘা, তুই কিছু বলবি না?’

বাঘা মুখ তুলে বললে, ‘ঘেউ, ঘেউ, ঘেউ!’

প্রকাশিত—১৯৪০

* লেখকের ‘জেরিনার কণ্ঠহার’ দ্রষ্টব্য।

* লেখকের ‘পদ্মরাগ বুদ্ধ’ দ্রষ্টব্য।

___

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *