সুন্দরবনের নিচে

সুন্দরবনের নিচে

রোজির আব্বা ছেলেমেয়েদের নিয়ে গরমের ছুটি কাটাতে যাচ্ছেন দেশের বাড়িতে। তাঁদের বাড়ি যেতে হলে নদীপথে নৌকায় যেতে হয় পুরো দু’দিন। বেশ বড় একটা নৌকা ভাড়া করে তারা রওনা হয়েছেন সেই সাত-সকালে, পাখি ডাকারও আগে। এখন ঠিক দুপুরবেলা।

নৌকা এখন সুন্দরবনের পাশ দিয়ে চলছে। মাথার উপর চড়া রোদ—রোদের কিরণে নদীর পানি হিরের কুচির মতো জ্বলছে, তাকানো যায় না সে-দিকে। অথচ বনের দিকে তাকাও—যেন সন্ধ্যা নেমেছে সেখানে। বড় বড় গাছের ডাল-পালা আর হাজারো নাম-না-জানা লতার পাতা এমনই মজবুত ছাউনি বানিয়ে তুলছে যে তার ফাঁক দিয়ে এক ছিটে রোদের কিরণও সেঁধোবার উপায় নেই। মনের অনেক কৌতূহল আর ভয় নিয়ে রোজি সেই ঠাণ্ডা ছায়াঘেরা বনের দিকে তাকিয়ে রইল।

সুন্দরবনের কথা সে তার আব্বার মুখে অনেক শুনেছে। ওর ভেতরটা নাকি নানারকম হিংস্র জীবজন্তুতে ভরা—সে- সবের মধ্যে আবার সেরা হল রয়েল বেঙ্গল টাইগার— মানে সুন্দরবনের বাঘ। রোজির আব্বা অনেক দিন আগে একটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার শিকার করেছিলেন। তার মাথাটা আর চামড়াটা এখনও রোজিদের বসবার ঘরে দেওয়ালে সাজানো রয়েছে।

রোজির আব্বার খুব শিকারের সখ। রোজি আব্বার মুখে শিকারের গল্প শোনে আর ভাবে, বড় হলে সেও আব্বার সঙ্গে শিকারে যাবে। তার আম্মা বলেন, ‘দূর! তুই যে মেয়ে! তুই শিকারে যাবি!’ কিন্তু আব্বা বলেন, ‘তাতে কী। মেয়েদের শিকারে যেতে বাধা নেই। তা ছাড়া, ও হলো স্বাধীন বাংলাদেশের মেয়ে, ও তো শিকারে যাবেই!’ সে-কথা শুনে রোজির বুক ফুলে ওঠে 1

বনের দিকে তাকিয়ে রোজি এ-সব কথা ভাবছে আর নৌকা তরতর করে এগিয়ে চলছে। খানিক পরে সামনে একটা খাঁড়ি দেখতে পাওয়া গেল। মাঝিরা দুপুরের রান্না করবার জন্য খাঁড়ির মুখে ঢুকে নৌকা বাঁধতে চাইল। রোজির আব্বা ‘হ্যাঁ’ বলতেই তারা খাঁড়ির মধ্যে ঢুকে একটা সুবিধেমতো জায়গা দেখে নৌকা বাঁধল।

রান্নাবান্নার জিনিসপত্র নিয়ে মাঝিরা নৌকা থেকে নামতেই রোজি-ও গুটিগুটি তাদের পিছুপিছু নামতে যাচ্ছিল। ইচ্ছে, বনের মধ্যে একটু ঘুরেফিরে আসে; কিন্তু নামবার আগেই তার আম্মা একথাবা মেরে কাঁধ ধরে বসিয়ে দিলেন, সেইসঙ্গে এক ধমক— ‘খবরদার দস্যি মেয়ে, নামবি তো ‘ঠ্যাং ভেঙে দেব। ছোট মেয়ে, কোথায় কোন্ গাছের ফাঁকে পথ হারিয়ে ফেলবি, আর হালুম করে ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ ধরে খেয়ে ফেলবে। চুপ করে বসে থাক্। বরং এইখান থেকে বসে বসে দ্যাখ।’

মার কথার ভঙ্গিতে মনে হল ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ বুঝি গাছের আড়ালে ওঁৎ পেতেই আছে হালুম করে ওকে ধরবার জন্যে। অথচ কই, মাঝিরা তো দিব্যি ছায়ায় নেমে রাঁধাবাড়া করছে, তাদের তো ধরতে আসছে না! কিন্তু সে-কথা মাকে বোঝায় কে? কী আর করবে? রোজি নৌকার ভেতরেই লাফ-ঝাঁপ শুরু করে দিল।

রোজিদের দুপুরের খাবার সঙ্গেই ছিল। সেগুলো সবাইকে খাইয়ে তারপর আম্মা বললেন, ‘একটু চুপ করে তোরা ঘুমো তো দেখি। এখন আর লাফা-ঝাঁপা করিনে।’ অগত্যা রোজি চুপ করে ছইয়ের গায়ে ঠেস দিয়ে বসল।

পাড় থেকে যে সরুপথটা ঘন বনের মধ্যে মিলিয়ে গিয়েছে, সেইদিকে চেয়ে-চেয়ে তার মনে দুষ্টু বুদ্ধি জেগে উঠল। ভাবল, মা একটু ঘুমোলেই সে টুক করে উঠে চুপিসারে নেমে একবার ঘুরে আসবে ঐ সামনের বন থেকে। একবার না-যাওয়া পর্যন্ত তার ভালো লাগছে না। সরুপথটা যেন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। কিছুক্ষণ পরে তার আম্মা ঘুমিয়ে পড়লেন। মায়ের কড়া হুকুম— উঠে যাবার উপায় নেই, তবুও ভাবনার শেষ নেই।

ভাবতে ভাবতে রোজিরও চোখে ঘুম নেমে আসছিল। হঠাৎ মাথা ঝাঁকি দিয়ে সোজা হয়ে দেখে মা-র চোখ বুজে এসেছে। অমনি রোজি উঠে পড়ল। কোনোদিকে না-তাকিয়ে, পায়ের তলায় একটুও শব্দ না করে সে এগিয়ে চলল সামনের দিকে। আর কী আশ্চর্য! পথটাও যেন আস্তে আস্তে বেশ চওড়া হয়ে তাকে আরো এগিয়ে চলার উ ৎসাহ দিতে লাগল। অনেক দূরে চলে একসময় তার নৌকায় ফেরার কথা মনে পড়ল, তখন সে ফিরে চলল। এবার কিন্তু অনেক হেঁটেও নৌকায় পৌঁছতে পারল না।

রোজি বুঝল সে পথ হারিয়ে ফেলেছে। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে তার বুক হিম হয়ে গেল। তবু সাহস না হারিয়ে এ-দিক ও-দিক চলাফেরা করে নৌকায় পৌছবার চেষ্টাই করতে লাগল। এক জায়গায় একটা সুড়ঙ্গের মতো দেখে আগাপিছু না-ভেবে সে সুড়ঙ্গটার মধ্যে ঢুকে পড়ল। ঢুকেই রোজি অবাক—এ কোথায় সে এল! এ কাদের গাঁ? কেমন সুন্দর ছোট্ট-ছোট্ট রাস্তা এ-দিক ও-দিক চলে গেছে, কেমন অদ্ভুত ধরনের সব বাড়িঘর—কোনোটা ধানের মরাইয়ের মতো, কোনোটা উল্টানো কাগজের ঠোঙার মতো। রোজি হতবুদ্ধির মতো এ-দিক ও-দিক ঘোরাফেরা করতে লাগল। হঠাৎ একসময় সে পেছন থেকে একটা চাপা গলার আওয়াজ শুনল, ‘ওগো দু-পেয়ে বাছা, কোথায় যাবে তুমি?

রোজি চমকে পিছন ফিরে দেখে একটা অদ্ভুত ধরনের জীব— অনেকটা বুনো ছাগলের মতো দেখতে, বিরাট দেহ, চক্‌চকে শাদা রঙ আর গোলাপি চোখ সে দাঁড়িয়ে আছে। তার পেছনে লম্বা লেজের আগায় একটা গিঁট দেওয়া, যেমন ধারা রোজির আম্মা তার চুলে রিবন দিয়ে ‘বো’ করে দেন। তার কান দুটো অদ্ভুত, সরু, লম্বা আর উপরদিকে খাড়া। তার পা চারটে, কিন্তু সে দাঁড়িয়ে আছে পেছনের দুটো পায়ে ভর দিয়ে।

রোজিকে দেখে জন্তুটা-যে খুব উত্তেজিত হয়েছিল, তা বোঝা যাচ্ছিল তার ‘বো’-বাঁধা লেজটা ঘন ঘন নাড়ানো দেখে। সে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কোথায় যাবে?’

একটা জানোয়ারকে বাংলায় কথা বলতে দেখে রোজি খুব অবাক হয়েছিল। সে আশ্চর্য হয়ে বিস্ময়ের মুখে একটা শব্দ করে উঠল। জন্তুটা ভাবল রোজি বোধহয় ভয় পেয়েছে। এবার সে খুব মোলায়েম সুরে বলল, ‘ভয় পেয়ো না বাছা, আমি জানোয়ার খুব ভালোবাসি।’

সঙ্গে সঙ্গে রোজি প্রতিবাদ করে উঠল, ‘আমি তো জানোয়ার নই!‘

সে তার লম্বা কান দুটো নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ, সবাই প্রথম-প্রথম তাই বলে বটে। সবাই তাই বলে, বেচারিরা! তা যাক্ গে, তুমি এস বাছা আমার সঙ্গে। তোমার খাঁচাটা অবিশ্যি এখনও সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে ওঠেনি। আমি ভাবতেই পারিনি এত সুন্দর নমুনা এত তাড়াতাড়ি পেয়ে যাব। তা নমুনা হিসেবে তুমি চমৎকার হবে। কিন্তু আর দুটো দিন আগে যদি আসতে, সব সেরা নমুনা তুমিই হতে পারতে। মাত্র গতকাল সেই বোতলমুখো নীলচে গুবরেপোকাটাকে ধরেছি। সেই এখন আমার এই নমুনাগুলোর মধ্যে সব সেরা। কী আফসোস্, দুটো দিন আগে আসোনি তুমি!’

কথাবার্তা শুনে রোজির মাথার মধ্যে সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল, সে এবার বলে উঠল, ‘কী সব বলছ তুমি, কিছুই বুঝছি না। কে তোমার নমুনা, কিসের নমুনা?’

জন্তুটা মিষ্টিমিষ্টি হেসে আরো মোলায়েম করে বলল, ‘তুমি জানবেই বা কোত্থেকে। বুঝিয়ে বলছি। আমাদের এখনকার যিনি বাদশাহ ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার,’ দুনিয়ার যতসব অদ্ভুত-অদ্ভুত জন্তু-জানোয়ারের নমুনা যোগাড় করা হচ্ছে তার বাতিক। এর জন্যে তিনি বিরাট চিড়িয়াখানা বানিয়েছেন। আর কত রকম সুখ-সুবিধের ব্যবস্থা সেখানে—ফ্যান, ইলেকট্রিক লাইট, স্প্রিঙের গদি, রেডিও আরও কত কী! যে যত আজব রকমের নমুনা যোগাড় করতে পারে, সে তত বেশি পুরস্কার আর সম্মান পায়। তাই আমরা সবসময় নমুনা খুঁজে বেড়াই, আর পেলেই ধরে নিয়ে খাঁচায় পুরে রাখি।’

শুনে তো রোজির আত্মা খাঁচাছাড়া হবার যোগাড়। সে ভাবতে লাগল কী করে এর হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। এ-দিকে জন্তুটা কিন্তু কথা বলতে বলতে রোজির হাতটি ধরে তার বাড়ির দিকে হাঁটা দিয়েছে। খানিক পরেই তারা বাড়িটার সামনে এসে পড়ল। রোজি তাকিয়ে দেখল বুনো ছাগলের মতো জন্তুটার বাড়ি একটা ওলটানো ঠোঙার মতো— তাতে দরজা, জানালা সবই আছে। বাড়ির সামনে একটা নেমপ্লেটও ঝুলছে, তাতে লেখা, ‘ঢোকো-বা-থামো।’

রোজি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতেই সে মাথা নুইয়ে বিনীতভবে বলল, ‘অধীনের নাম ওটা। আর এই হল গরিবের বাড়ি। আশা করি, বাড়িটা তোমার ভালোই লাগবে। হ্যাঁ, আমার নামটা কেমন লাগছে তোমার? খুব মিষ্টি না শুনতে? এস, বাড়ির ভেতরে এস।’

রোজি ভেতরে ঢুকে দেখল, বাহ্ বেশ চমৎকার সাজানো তো ঘরটা! একটা সুন্দর দোলা, সূক্ষ্ম কারুকার্য-করা কয়েকটা পানি খাবার পাত্র, সিল্কের ঝালরওয়ালা চাদর-ঢাকা একটা বিছানা।

রোজির এই অবাক ভাব দেখে ‘ঢোকো-বা-থামো’ খুব খুশি হয়ে তার ‘বো’-করে বাঁধা লেজটা কয়েকবার মাটিতে আছড়ে বলল, ‘তোমার অবাক হবার কিছু নেই এতে। আমার পূর্বপুরুষরা যখন মাটির ওপরে থাকতেন, তখন তাদের খোঁয়াড়ে থাকতে হত। সে কষ্ট সইতে না পেরে আমার দাদাজান এখানে মাটির নিচে চলে এসে এই বিরাট বাড়ি তৈরি করান। এখানে আমরা খুব আরামে থাকি।’

রোজি চকিত হয়ে বলল, ‘আমরা কি এখন মাটির নিচে আছি নাকি?’

—হ্যাঁগো, আমাদের এই জায়গাটা সুন্দরবনের ঠিক তলায়। উপরে বড় ভিড়, যতসব হাঘরে হাভাতে ছোটলোকদের ভিড়ে পথ চলাই দায়। মাটির তলার এই রাজ্যে আমরা খুব সুখে আছি।

রোজি অবাক হয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে রইল। ‘ঢোকো-বা-থামো’ ততক্ষণে একটা মস্ত মোটা রকমের নোটখাতা বের করেছে। একটা পেন্সিল হাতে দিয়ে রোজির দিকে কেমন যেন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি পোষা না বুনো?’ প্রশ্নটা এতই আচমকা যে, রোজি থতমত খেয়ে গেল। তোতলাতে তোতলাতে বললো, ‘আ-আমি জা-জানি না।’

‘ও,তা হলে তুমি পোষা।’ এই বলে ‘ঢোকো-বা-থামো’ তার খাতায় লিখলো : ‘পোষা।’

তারপর আবার শুধাল, ‘তোমার মোচগুলো কী কী কাজে লাগে?

রোজি খেপে উঠল, ‘মোচ? আমি কি বেড়াল যে আমার মোচ হবে?’

‘আহা, চোটো না, চোটো না। তুমি অবশ্য দু-পেয়ে, চারপেয়েদের সঙ্গে তোমার মিল না থাকাই স্বাভাবিক। তাহলে তোমার মোচ নেই বলছ?’-এই বলে সে রোজির কাছে এসে তার মুখটা ভালো করে দেখে খাতায় লিখল : ‘মাকুন্দা।

তারপরের প্রশ্নটা হল : কী কী মজার খেলা তুমি জানো?

রোজি কট্‌ট্ করে তার দিকে তাকাল। ‘ঢোকো-বা-থামো’ তাকে তোয়াজ করার মতো সুরে বলল, ‘ছোটবেলায় নিশ্চয়ই উলের গোলা ছাড়ানো, বল লোফালুফি— এ-সব ধরনের খেলা শিখেছ?’

রোজির রাগ এবার বাধা মানল না, সে ধমকে বলল, ‘দ্যাখো, আমি বেড়াল-কুকুর নই যে, উল আর বল নিয়ে খেলব। আমি মানুষ। এ-রকম বেয়াড়া ধরনের প্রশ্ন করো না। আমি কোনো খেলা জানি নে।’

‘ঢোকো-বা-থামো’ তার খাতায় লিখল : ‘কোনো কম্মের নয়।’

রোজি তা দেখে রাগে ফুলতে লাগল। ‘ঢোকো-বা-থামো’ এবার ভয়ে-ভয়ে খুব আস্তে নরম করে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা গর্ত করো কোন জায়গায়?

রোজি ফেটে পড়ল রাগে, ‘আমরা গর্তে থাকি না। আমরা মানুষ, দালান-কোঠায় থাকি; কিন্তু তুমি থামবে কি-না বলো?’

তাকে থামানোর ভঙ্গিতে হাত তুলে ‘ঢোকো-বা-থামো’ বলল, ‘আচ্ছা আচ্ছা, আর কিছু জিজ্ঞেস করব না। তবে গর্তে থাকো না, এ একটা কথা হল?’- বলে সে খাতায় লিখল : ‘মিথ্যে কথা বলে।’

সেটা দেখে রোজি মাটিতে পা ঠুকে চেঁচিয়ে বললো, ‘কখনই নয়। তুমি বদমাশ।’

‘ঢোকো-বা-থামো’ চমকে দু-পা পিছিয়ে বলল, ‘তোমার বোধহয় খিদে পেয়েছে, তাই এত খেপে উঠেছ। আচ্ছা, কী খাবে বল? তুমি কি মাছ-মাংস খাও? না শাকসব্জি?’

রোজি বলল, ‘তোমার কথা বুঝলাম না।’

—মানে, তুমি গোশ্‌ত খাবে না আলু খাবে?

খাওয়ার কথায় রোজি রাগ ভুলে চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘আমি দুটোই খাব।

শুনে ‘ঢোকো-বা-থামো’ ভীষণ উত্তেজিত হয়ে দুইলাফ দিয়ে উঠল, তার লেজ আর কান দুই-ই ঘন-ঘন নড়তে লাগল। চোখ ঠিকরে সে বলে উঠল, ‘দুই-ই খাবে? বল কী?’ সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ গর্বে ভরে উঠল, খাতাটা টেনে নিয়ে মস্ত বড় বড় অক্ষরে লিখল : ‘নিরামিষামিষ ভোজী।’

‘নিরামিষামিষ’ কী অপূর্ব নমুনা সে যোগাড় করেছে, এই কথা ভেবে গর্বে ‘ঢোকো-বা-থামো’র শরীর ঘেমে উঠল। তার ফলে রোজিকে খাওয়ানোর কথা বেমালুম ভুলে সে বলল, ‘তোমার খাঁচাটা দেখবে এখন? অবিশ্যি শেষ হয়নি, তবে হয়ে যাবে দু-একদিনে।’

রোজির মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। কোনোমতে যদি সে ছাগলের মতো এই জন্তুটাকে ঐ খাঁচাটার মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পারে, তাহলেই সে খালাস। এই ভেবে সে বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই দেখব, চল।’

ভেতরের দিকে একটা বারান্দায় রোজিকে নিয়ে ‘ঢোকো-বা-থামো’ খাঁচাটা তাকে দেখিয়ে গদ্‌গদ্ হয়ে বলল, ‘কেমন সুন্দর আর মজবুত খাঁচা দেখেছ? তোমার পছন্দ হয়? দ্যাখো ভেতরে আবার দোল খাবার জন্যে শিক আছে। ওটার মধ্যে তুমি খুব আরামেই থাকবে। দরজাটা তৈরি করা হয়ে গেলেই তোমাকে ওর মধ্যে রাখব।’

রোজি তার ভয় লুকোবার জন্যে হাসল। বলল, ‘তুমি আমাকে ওর মধ্যে রাখবে কী করে? দেখছ না শিকগুলো কত ফাঁক-ফাঁক? আমি তো ওর ফাঁক দিয়ে ইচ্ছেমতো গলে বেরিয়ে আসতে পারব। এই দ্যাখো, মাথাটা কেমন ঢুকে যাচ্ছে।’—বলে সে তার ছোট্ট মাথাটা শিকের ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে আবার বের করে আনল।

‘তাই তো, তাই তো’। জন্তুটা একদম বোকা বনে গেছে, ‘আমি তো এ-কথা একেবারেই ভাবিনি।’

রোজি বলল, ‘দ্যাখো না, তোমার মাথাটাও ঢুকবে। আমার কথা যদি তোমার বিশ্বাস না হয়, তবে নিজে নিজেই পরখ করে দ্যাখো— শিকগুলো কত ফাঁক-ফাঁক?

‘ঢোকো-বা-থামো’ শিকগুলোর কাছে তার প্রকাণ্ড মাথা নিয়ে গেল আর অমনি রোজি খুব জোরে এক ঠেলা দিয়ে তার মাথাটা দুটো শিকের ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দিল। মুহূর্তের জন্য তার লম্বা কান দুটো আটকে গেছিল, রোজি ভাবল, ‘হায় হায় আমার চেষ্টা বুঝি ব্যর্থ হল!’ কিন্তু পরমুহূর্তে কান দুটো ঢুকে গিয়ে ভেতর দিকে খাড়া হয়ে উঠল। ফলে মাথাটা বেশ ভালোভাবে শিকের মধ্যে আটকে গেল, জন্তুটা নিজেকে কিছুতেই আর টেনে বের করে আনতে পারল না।

রোজি তখন আর-এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করল না। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে বাইরের দরজাটার শিকল তুলে দিয়ে দৌড়োতে লাগল। কোন্‌ দিকে যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে—কিছুই খেয়াল রইল না, কেবল ‘আম্মা, আম্মা’ বলে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়োতে লাগল। হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি খেলো সে : কিরে রোজি, ঘুমের মধ্যে কাঁদছিস্ কেন রে? এই—ওঠ ওঠ, বিকেল হয়ে গেল, দেখ দেখ কতদূর এসে পড়েছি। মা-র হাতের ঝাঁকুনিতে রোজি ধড়মড় করে উঠে বসল। ওহ্। সে তাহলে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *