সুন্দরবনের জঙ্গলে

সুন্দরবনের জঙ্গলে

(১)

ও ঘর থেকে ল্যান্ডফোনটা বেজে উঠল৷ আমি অলসতা কাটিয়ে ইজিচেয়ার থেকে উঠে গেলাম৷ অমিতদার ফোন৷ প্রায় দেড়মাস পর আজ আবার দাদার ফোন পেলাম৷

‘বুবাই কেমন আছিস? শোন, সেই দামুর ব্যাপারটা মনে আছে? পুলিশ জানিয়েছে দিন চারেক আগে প্রচন্ড ভয় পাওয়ার কারণে কার্ডিয়াক এরেস্টে মালতি…’

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই ফোনটা কেটে গেল৷ দাদার নম্বরটা ছিল আমার কাছে৷ তবে সেটা কাজ দিল না৷ অনেক চেষ্টা করেও ফোনটা আর লাগল না৷ শেষে কি যেন বলতে গেল দাদা? মালতির কার্ডিয়াক এরেস্ট? কথাগুলো মনে করলে আজও ভয় করে৷

(২)

খেলাটা বেশ জমে উঠেছিল৷ আমার দল ছিল জেতার মুখে৷ ঠিক সেই সময় চারিদিক কালো করে ঘনিয়ে এল মেঘ৷ মেঘের ভাবগতিক দেখে বোঝাই যাচ্ছিল বৃষ্টি নামতে আর বেশি দেরি নেই৷ দলের বেশিরভাগ ছেলেই তড়িঘড়ি করে মাঠ ছেড়ে পালাল৷ থেকে গেলাম শুধু আমি, বুবাইদা, তোফা, প্রীতম, নীল আর রাজ৷ বুবাইদা আর প্রীতমের বাড়ি পাশের পাড়াতে৷ মেঘের এই অবস্থা দেখে আমি ওদের বললাম আকাশ পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত আমার বাড়িতে থেকে যেতে৷ জমিয়ে আড্ডা দেওয়ার জন্য উপযুক্ত মরশুম, তাই বাকিদেরকেও থাকতে বললাম৷ সকলেই রাজি হল৷

বারান্দার চেয়ারগুলো টেনে নিয়ে সকলে এর-ওর মুখোমুখি গোল করে বসলাম৷

আলকাতরার আস্তরণে মোড়া বাইরের ঘন কালো মেঘ বিকেলের সূর্যকে ঢেকে ফেলছে৷ ঘড়ির কাঁটা তখন সোয়া পাঁচটা ছুঁয়েছে৷ কিন্তু বাইরের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল যেন রাত্রি নেমে এসেছে৷ এর মধ্যেই মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল৷ আর এর মাঝেই আবার কারেন্টটাও চলে গেল৷ বাইরে বৃষ্টি, মেঘের গর্জন আর সেই সঙ্গে গগনবিদারী বজ্রপাতের শব্দ৷ আশেপাশের জমাট কালো অন্ধকার, আর বারান্দার এক কোণে মিটমিট করে জ্বলতে থাকা হ্যারিকেনের আবছা আলোয় ঘরের পরিবেশটা ভূতের গল্পের জন্য বেশ জমে উঠেছে৷ এই সুযোগে বুবাইদাকে বললাম তার জীবনের একটা ভৌতিক অভিজ্ঞতার গল্প আমাদের শোনাতে৷ সবাই আমার মতে মত দিল৷

কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বুবাইদা বললো, ‘বেশ, তবে তাই হোক৷ আজ আমি আমার সুন্দরবন ভ্রমণের এক অভিজ্ঞতার গল্প তোদের শোনাব।’ বুবাইদা বলা শুরু করল-

‘তোরা সবাই জানিস নিশ্চয় আমার দাদা পুলিশের অফিসার৷ ডিউটি থেকে ছুটি পেলেই দাদা বেরিয়ে পড়ে ভ্রমণে৷ আর এইসব ভ্রমণে বেশিরভাগ সময়ই দাদার সঙ্গী হিসেবে থাকি আমি৷ সেবারের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে সুন্দরবন ভ্রমণে যাব বলে ঠিক করেছিলাম আমরা৷ দাদার এক কলিগের বাড়ি ওখানেই৷ বলা বাহুল্য এই পরিচিতির সুবাদে আলাদা করে আর গাইড ভাড়া করবার প্রয়োজন পড়ল না৷ এছাড়াও আরেকটা সুবিধে হয়েছিল৷ অনেক জোরাজুরি করায় তার বাড়িতে থেকে যাওয়াতে হোটেল ভাড়াটাও বেঁচে গেছিল৷

নির্দিষ্ট দিনে রওনা দিলাম৷ প্রথমে ক্যানিং থেকে অটো ধরে সোনাখালি ফেরি ঘাট৷ তারপর সেখান থেকে নৌকা করে হোগল, করতাল নদী পেরিয়ে যখন গোসাবা পৌঁছালাম তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এসেছে৷

গোসাবা উপদ্বীপের একটি গ্রাম সাতজেলিয়া৷ শহরের আধুনিকতার রেশ তখনও এখানে এসে পৌঁছায় নি বললেই চলে৷ উঁচু উঁচু নারকেল, তাল আরও অজানা বনানির মাঝে ইতস্তত ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গ্রাম্য বাড়ি৷ এদের অধিকাংশই মাটির৷ কিছুর তো চাল পড়ে, মাটির দেওয়াল ছেড়ে ভগ্নপ্রায় দশা৷ পথে যেতে যেতে দেখলাম গ্রামের কয়েকজন বধূ একটা জলাশয়ের পাশে নিত্য গৃহকর্ম করছে৷ অমিতদার থেকে জানলাম, গ্রামের এই জলাশয়ের জলেই স্নান থেকে শুরু করে সব রকম নিত্য গৃহকর্ম সম্পন্ন হয়৷ মনে মনে ভাবলাম এদের জীবনে হাইজিন নামক কোন শব্দই বোধহয় নাই৷ কথায় আছে না মানুষ অভ্যাসের দাস৷ এক্ষেত্রে বোধ হয় মানুষ পরিস্থিতির দাস৷ না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না এখানকার লোকেরা কি নিদারুন দারিদ্রতায়, অভাব-অনটনে বাঁচে৷ তবুও এদের কোন অভিযোগ নেই৷ এদের প্রাণবন্ত হাসি তারই প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত৷

(৩)

“বদরের পায়ে দিয়ে ফুল।
বেয়ে ওঠো নদীর কূল॥
মুখে বলল হরি হরি।
গুরু আছেন কান্ডারি॥
লাও ভাই বদরের নাম।
গাজী আছে লেখাপান॥
দরিয়ায় পাঁচ পীর।
গাজী বদর বদর॥”

পরদিন যাত্রার পূর্বে বয়ানটা বলে মাঝি দু’হাতের কোশে নদীর জল তুলল৷ ছিটিয়ে দিল পানসির গলুইতে, আমাদের আর ওর নিজের মাথায়৷ এই রীতিটাকে এরা খুব পয়া মনে করে৷ ওদের বিশ্বাস এতে যাত্রা বিপদমুক্ত হয়৷

পানসি ভাসল খাঁড়িতে৷ সেদিন সারাটা দিন কূল ধরেই নৌকায় সুন্দরবন পরিদর্শন করলাম৷ সুন্দরী, গেওয়া, ঝানা, খালসার, কেওড়ার গাঢ় ঘন সবুজ অরণ্যরাশির সমারোহ আমার মনে এক অদ্ভুত আনন্দস্রোত বয়ে আনল৷ যা বলে বোঝানো যায় না৷ সৌন্দর্যের লীলাভূমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন এই সুন্দরবন৷ কপাল মন্দ ছিল তাই রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার বাবাজীবনের গর্জন শুনতে পেলেও দর্শন পাই নি৷ আমুদি, নিহারির মত নিত্য রকমারি মাছের লোভনীয় ভোজের সাথে পশ্চিমবঙ্গের ব-দ্বীপ অঞ্চলের জীবনযাপন বেশ উপভোগ করছিলাম দু’জনেই৷

এরই মাঝে একদিন অপ্রত্যাশিত ভাবেই ঘটে গেল এক ঘটনা৷ সেদিন আমি ভোর থাকতেই ঘুম থেকে উঠে পড়েছিলাম৷ বাইরে এসে দেখি দিনমণির স্বর্ণাভ পরশ তখনও অরণ্যানীতে পড়ে নি৷ হাঁটতে হাঁটতে কূলের কাছে এসে পড়ি৷ দেখি পাঁচ সাতটা ডিঙি খাঁড়ি পেরোচ্ছে৷ সবকটাই ভিড়ে ঠাসাঠাসি৷ উল্টে যাবার দশা৷ তাদের ভাবগতিক দেখে মনে হল সব তড়িঘড়ি কোথাও চলেছে৷ এ কদিনে এরকম দৃশ্য একবারও চোখে পড়েনি৷ কেন জানি না ব্যাপারটা আমার মধ্যে খুব কৌতূহল জাগিয়ে তুলল৷ কৌতূহল নিবারণে দূর থেকেই হাঁক-ডাক পাড়লাম-

‘কি হয়েছে ভাই? সবাই এত ব্যস্ত ভাবে কোথায় চলল?’

নৌকার একজন বললো, ‘সুধাংশুপুর গাঁয়ে দামুর বউকে ভূতে পেয়েচে গো বাবু! ওঝা আসচে ভূত নামাতে৷’

ব্যাপারটা আমার খুব ইন্টারেস্টিং লাগল৷ দাদা আর অমিতদা কে জানালাম৷ অমিতদা জানালো এখানে এসব ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে৷ সুন্দরবনের একদিকে যেমন প্রকৃতির সৌন্দর্যের এক অপরূপ দৃষ্টান্ত লক্ষ করা যায়, ঠিক তেমনই এর অন্যদিকে রয়েছে অমানবিক হিংস্রতার ছাপ৷ এখানকার গহন অরণ্যের গভীরে লুকিয়ে আছে অনেক অজানা রহস্য, যা আমাদের সাধারণ জ্ঞানবুদ্ধির অতীত৷

ঠিক হল আমরাও যাব সুধাংশুপুরে, ব্যাপারটা দেখতে৷ সাতজেলিয়ার ওপাশে ঝিলা বন৷ মাঝে বন লাগোয়া খাঁড়ি৷ ডিঙি ভাসিয়ে রওনা দিলাম তিনজন৷ সাতজেলিয়া থেকে প্রায় দেড় ক্রোশ দূরে সুধাংশুপুর৷ গ্রামে পৌঁছে একে ওকে জিজ্ঞেস করে দামুর ঘর খুঁজেপেলাম শেষমেশ৷ ছোট্ট মাটির ঘর৷ চারপাশে জনগনের ঢল নেমেছে৷ কেন্দ্রবিন্দু, দামুর ঘর৷ ভিড় ঠেলে ভিতরে গিয়ে দেখলাম একটা মাঝ বয়সী বউ বিছানায় শুয়ে থর্ থর্ করে কাঁপছে। তার চারপাশে ঘিরে বসে আছে কয়েকজন মহিলা৷ তাদেরই মধ্যে একজন তার সেবা করছে৷ খেয়াল করলাম একটি লোক ঘরের ঠিক কোণটা করে দাঁড়িয়ে চুপচাপ সব দেখে চলেছে৷ লোকটার বুক পর্যন্ত ঝুলে পড়া কুচকুচে কালো দাড়ি৷ গলায় মোটা রুদ্রাক্ষের মালা৷ পরনে সাধুবস্ত্র আর কাঁধে লাল কাপড়ের ঝোলা। সহজেই অনুমেয় এই সেই ওঝা যার কথা লোকটা বলেছিল৷

কিছুক্ষণ পর লোকটা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল বিছানার দিকে৷ বিছানায় শায়িত বউটার পাশে এসে বসল৷ তারপর সে তার ঝোলা থেকে মড়ার খুলি আর একটা বড় হাড়ের টুকরো বের করে বউটার কপালে ঠেকাল৷ বিড়্ বিড়্ করে কিসব আওড়াতে লাগল৷ শুনে মনে হয় মন্ত্র বলছিল৷

ঘরটার আরেক কোণে কয়েকজন মহিলা অবাকবিস্ময়ে দাঁড়িয়ে এসব দেখছিল৷ অমিতদা তাদেরই একজনের কাছে গোটা ব্যাপারটার আগা-গোড়া কি হয়েছিল তা জানতে গেল৷ তাদের মধ্য থেকে একজন বললো, ‘সে এক ভয়ানক ঘটনা!’ অমিতদা আরও কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, দাদা বাধা দিল। পরিস্থিতি বুঝে অমিতদা ব্যাপারটাকে আর ঘাঁটালো না৷

(৪)

এই ঘটনার দু’দিন পর আমরা সেখান থেকে চলে এলাম৷ ফিরে আসার কয়েকদিন পর হঠাৎ একদিন অমিতদার ফোন৷ সে সেখানকার স্থানীয় কারও কাছে গোটা ঘটনাটা পরে শুনেছিল আর সেটাই আমাদের ফোনে জানিয়েছিল৷

পুরো ব্যাপারটা এবার বলি তাহলে শোন৷

-ওখানকার অধিকাংশ অধিবাসী সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল৷ এসব অরণ্য-নির্ভর লোকেদের দৈনন্দিন জীবিকা হল মাছ, মধু, গোলপাতা, কাঠ ইত্যাদি সংগ্রহ করে স্থানীয় হাটে, বাজারে বিক্রি করা৷ সেভাবে বলতে গেলে মূলত এটাই তাদের আয়ের একমাত্র পথ৷ এই সংগ্রহকারীরা বনে দল বেঁধে যায়৷ যারা গোলপাতা, গাছ-গাছারি ইত্যাদি সংগ্রহ করত তাদের বলা হয় ‘বাওয়ালি’৷ আর যারা চাক ভেঙে মধু সংগ্রহ করে তাদের বলা হত ‘মাওয়ালি’৷ প্রত্যেক দলে থাকে একজন দলপতি বা যাকে বলে সর্দার৷ মূলত বাঘের কারণেই এভাবে দল বেঁধে যাওয়া। তাছাড়া হাঁটু অব্দি জলকাদা পেরোনোর সময় সুন্দরবনের কালকেউটের মত বিষধর সাপের ভয়ও রয়েছে৷ একবার মানুষের উপস্থিতি টের পেলে তাড়া করে ছোবল বসাবে৷ কুচকুচে কালো, মাথায় স্বেত পদ্ম চিহ্নিত এই সাপ স্বভাবে বড্ড ভীতু হয়৷ নিজের আত্মরক্ষার্থে আগে থেকেই বিপদের উপর আক্রমন করে বিপদকে পরাস্ত করতে চায়৷ এসব ছাড়াও অন্যান্য অনেক হিংস্র জন্তুর ভয়ও থাকে। পর্যাপ্ত সামগ্রী সংগ্রহ করা হয়ে গেলে দল সূর্যাস্তের আগেই গ্রামে ফিরে আসে৷ সূর্যাস্তের পর বনে কেও থাকে না৷ তখন বন আর মানুষদের থাকে না৷ এখানে প্রতিটা মুহূর্ত বিপদের মধ্যে কাটাতে হয়৷ সরকারী নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পেটের দায়ে বারবার এরা ছুটে যায়। ফলস্বরূপ প্রতি বছর জুড়ে বিভিন্ন পত্রিকার শিরোনামের খবর; বন্য প্রানী কর্তৃক অমুকের মৃত্যু তমুকের প্রাণসংহার৷

এরকমই এক মাওয়ালি দলের সদস্য দামু৷ অন্যদিনের মতো সেদিনও বাড়তি রোজগারের আশায় তার দলের সাথে ঝিলা বনে যায়, মধু সংগ্রহের জন্য৷ এই মধু সংগ্রহ করার আগে অনেক ব্যবস্থা করতে হয়৷ যেমন- উপযুক্ত চাক খোঁজা৷ খালসি ফুলের মধু সর্বোৎকৃষ্ট৷ কিন্তু সেটা না পেলে কেওড়া গাছের উপর সচরাচর নির্ভর করতে হয়৷ এরপর গোছা বেঁধে, তার উপর শুকনো পাতা আর সবুজ হেতাল পাতা বিছিয়ে দেওয়া হয়৷ লাঠিতে বেঁধে সেটাতে অগ্নিসংযোগ করে ধূমায়মান গোছা মৌচাকের সামনে ধরা হয়৷ উদ্দেশ্য মৌমাছিদের গৃহত্যাগে বাধ্য করা৷ তারপর তো প্রতিবাদী হুলধারীদের আক্রমণ রয়েছেই৷ সিদ্ধহস্ত সংগ্রহকারীদেরও সেটা সয়ে যায় একসময়৷ কিন্তু আবার সইতে না পারলে সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই মৃত্যু নিশ্চিত৷

দামুর দল অন্যদিনের মত সেদিনও সংগ্রহ করছিল৷ কিন্তু সেদিন কেন যেন ওর শরীরটা ভাল লাগছিল না৷ তাই সে গাছের ছায়ায় বসেছিল৷ কিছুক্ষণ পর অস্বস্তি বোধ আরও বাড়ল৷ সে তার দলের সর্দারকে জানাল যে, তার খুব শরীর খারাপ করছে তাই সে বাড়ি চলে যেতে চায়৷ সর্দার রাজি হল না৷ সে দামুকে বললো গাছের ছায়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে, তাতে তার শরীর ভালো হয়ে যাবে৷ সর্দারের আদেশ৷ অখন্ডনীয়৷ কাজেই শত শরীর খারাপ করলেও, সর্দারের কথামতো সে দল থেকে কিছুটা দূরে একটা নিরিবিলি জায়গায় বিশ্রাম করতে লাগল৷ কিছুক্ষণ পরে সে বুঝতে পারল তার শরীরের অবনতি হচ্ছে। ক্রমশ তার শরীর কাঁপছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে৷ সে আর থাকতে না পেরে আবার সর্দার কে জানাল সে ফিরে যেতে চায়৷ সর্দার, দামুর শরীরের অবস্থা দেখে তাকে চলে যেতে বললো৷ কিন্তু এই অবস্থায় একা এই গভীর বনের পথ দিয়ে যাওয়া আত্মহত্যার সমান৷ দামু সর্দারের কাছে অনুরোধ করল তার সাথে যাওয়ার জন্য দলের কাউকে বলতে৷ সন্ধ্যা হতে আর বেশি দেরি ছিল না তার উপর সংগ্রহ করা তখনও শেষ হয় নি৷ কাজেই সর্দার, দামুর প্রস্তাব নাকচ করে দিল৷ সর্দার এও বললো, সে যদি একা যেতে না পারে তাহলে আর একটু কষ্ট সহ্য করে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে৷ কাজ শেষ হলে সকলের সাথে ফিরবে৷

কিন্তু সে জানাল, সে এখুনি গ্রামে ফিরতে চায়৷ এই শরীরে আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। অগত্যা শেষমেশ সে একাই ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল৷

দেখতে দেখতে কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ল৷ মাওয়ালিরাও দলবল সমেত গ্রামে ফেরার তোরজোড় শুরু করে দিল৷

গ্রামে ফিরে কর্তব্যপরায়ণ সর্দার ভাবে দামুর একবার খবরাখবর নেওয়া উচিৎ৷ সেই কোন ভর দুপুরে বেরিয়েছে৷ দল যায় দামুর ঘরে, খোঁজ নিতে৷ কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখে অন্য দৃশ্য৷ তার স্ত্রী জানায় দামু বাড়ি ফেরেনি৷ এই খবর শুনে সকলেই বেশ আশঙ্কিত হয়ে পড়ল৷ হবে নাই বা কেন৷ সেবারে সোনাখালির চরে মাছ ধরার সময় হারুন কে ওদের চোখের সামনে বাঘে নিয়ে গেল৷ পরদিন বন বিভাগের লোকেরা তল্লাশি চালিয়ে ওর আধ খাওয়া লাশ খুঁজে পেয়েছিল৷

সন্ধ্যা হয়ে গেছিল অনেকক্ষণ৷ তাহলে কি দামুকে বাঘে গিলেছে? দলের সবাই নিজেদের মধ্যে ফিস্ ফিস্ করে আলোচনা করতে লাগল৷ পাছে এসব কথা দামুর বউ এর কানে যায়, সর্দার তাদের ধমকে চুপ করতে বললো৷

সকালের সব ঘটনাই সর্দার দামুর বউকে জানায়৷ সব শুনে সে কান্নায় ভেঙে পড়ে৷ সর্দারের কাছে মিনতি করে, তার মরদকে খোঁজার জন্য বনে কিছু লোক পাঠাতে৷ কিন্তু রাতবিরেতে বনে লোক পাঠানো মানে তাদের নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া, সর্দার ভালোভাবে জানে সেটা৷ তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে জানিয়ে দেয় এটা করা অসম্ভব৷ সে আশ্বাস দেয়, ভোরের প্রথম আলো ফোটার সাথে সাথে সে তার দল নিয়ে দামুকে খুঁজতে বনে যাবে৷

সব শুনে অসহায়ের মত মালতি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল৷ কিছুক্ষণ এভাবে কান্নাকাটির পর একসময় স্থির হল৷ একরকম জেদের বশে সর্দারকে বললো, ‘তোমরা যাবে না তো কী হয়েছে? আমার মরদ, আমিই খুঁজে বের করব৷ আমি এখুনি যাব বাদায়, ওকে খুঁজতে।’

সে ছুটে ঘরের ভিতর থেকে একটা হ্যারিকেন নিয়ে এল৷ সকলের শত বারণ সত্ত্বেও নাছোড়বান্দা মালতি দৌড়তে লাগল চরের দিকে৷ চরের কাছে যেতেই দেখে একজন ডিঙি ভিড়ছে৷ মালতি, মাঝিকে অনুরোধ করল ঝিলা বাদায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য৷ আর কিছুক্ষণ পরেই জোয়ার আসবে নদীতে৷ তাছাড়া একলা মেয়েমানুষ এই রাত-বিরেতে বাদায় যাবে, মাঝি কোন কথায় শুনলো না মালতির৷ শেষে উপায় না দেখে মাঝির দিকে এগিয়ে দিল কড়কড়ে বেশ কিছু টাকা৷ গরীব মাঝির দু’দিনের রোজগার প্রায়৷ ডিঙি ভাসল৷ বেশ কিছু সময় পার করে নৌকা এসে থামল ঝিলার চরে৷ মাঝি আগেই বলে দিয়েছিল কেবল পৌঁছে দেওয়াটা ওর কাজ৷ অপেক্ষা করতে পারবে না৷ কথামত লগি টানল, দাঁড় বাইলো ফেরার পথে৷

সন্তর্পণে পা ফেলে পেরিয়ে চলল পাঁক, কাদা জল৷ তাড়াহুড়ো করতে গেলেই বিপদ৷ শ্বাসমূলে পা পড়লে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাবে একেবারে৷ মালতি সেবার সুধন্যখালে বনবিবির টাটে পুজো দিতে গিয়ে মা-এর তাগা নিয়ে এসেছিল৷ একটা নিজে পড়েছে আরেকটা সঙ্গে এনেছিল৷ তখন নানা কাজে সেটা পরাতে ভুলে গেছিল৷ মরদটাকে খুঁজে পেলে আগে তাগাটা পরাবে৷ তার মনে তখন কেবল মরদটাকে খুঁজে পাবার তাড়না৷ যত সে বনের ভিতরে যায়, বন তত গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে৷ রাত্রে বনের এই অন্ধকার পরিবেশ, মনের মধ্যে আতঙ্ক ডেকে আনে৷

চারপাশের নিবিড় কৃষ্ণতার বুক চিরে দু-একটা হিংস্র পশুর ডাক শোনা যাচ্ছিল মাঝেমধ্যেই৷ শীতের ঠান্ডা হাওয়া সাপের মত তার সারাগায়ে পাক খেয়ে শিরদাঁড়া বেয়ে নীচ নেমে তাকে বারবার শিহরিত করে তুলছিল৷

হ্যারিকেনটার কাঁচে কালি জমেছিল বেশ পুরু করে৷ এই মিশমিশে কালো অন্ধকারে, কালি পড়া হ্যারিকেনের ম্লান আলোয় দু’হাত দূরের জিনিস দেখা যাচ্ছিল না৷ ভয়ার্ত কন্ঠে সে দু’বার দামুকে ডাকল৷ সবকটা ইন্দ্রিয়কে সজাগ রেখে, কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করতে থাকল৷ কোন প্রত্যুত্তর যদি আসে, এই আশায়৷ মনে মনে বনবিবিকে স্মরণ করছে আর দামুকে ডেকে চলেছে৷ এভাবে অনেকটা সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর পোকামাকড় আর ঝিঁঝিঁ-র ডাক ছাড়া আর কিছুই তার কানে এল না৷ এই নির্জন বনে সে একলা মেয়ে-মানুষ৷ তার ভয় করে৷ যখন তখন বাঘ এসে তার ঘাড় মটকাতে পারে৷ কিছু আশ্চর্যের নয়৷

হঠাৎ একসময় তার মনে হল কেউ যেন তার নাম ধরে ডাকল৷ দামু? সে দু-একবার আওয়াজ দিল৷ আবার কান খাঁড়া করে শোনার চেষ্টা করল৷ কিন্তু না, কোন সাড়া শব্দই পাওয়া গেল না৷ হয়তো সেটা তার মনেরই ভুল৷

এভাবে আরও কিছুক্ষণ কেটে গেল৷ এবার তার মনে হল কেউ যেন তার পিছু নিয়েছে৷ বেশ ভয় পেল মালতি৷ পায়ের গতি বাড়াল, পিছনে তাকাবার সাহস পেল না৷ যদি বাঘ হয়? এই বুঝি এবার ঝাঁপিয়ে পড়ে তার টুঁটি কামড়ে ছিঁড়ে নেবে! মরদটাকে বোধহয় আর দেখতে পাবে না৷ এসব ভাবতে ভাবতে সে চলছিল৷ চলছিল নয় বরং যেন দৌড়াচ্ছিল৷ এভাবে কিছুদূর যাওয়ার পর একসময় সে হাঁফিয়ে এল। অবশেষে থামল৷ মনে সাহস এনে ঘুরে দাঁড়াল৷ আচমকা সে শুনতে পেল কেউ যেন পিছন থেকে আবারও তার নাম ধরে ডাকল৷ এবারেরটা আরো স্পষ্ট শোনালো৷ একবার ভুল শুনতে পারে, দু’বার নয়৷ মিশমিশে কালো অন্ধকারের মধ্যে সে দেখার চেষ্টা করল৷ একটু হলেও এতক্ষণে তার চোখ অন্ধকার সয়ে গিয়েছিল৷ তার মনে হল গাছগুলোর আড়ালে কেউ যেন দাঁড়িয়ে৷ জন্তু নয়, মানুষের মতন অবয়ব৷ তাহলে কি তার দামু দাঁড়িয়ে আছে? কালি পড়া হ্যারিকেনটা সামনে তুলে ধরে দেখার চেষ্টা করল৷ কিন্তু সেটার ম্লান আলো শীতের ঘন কুয়াশায় মিশে ঘোলাটে এক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল৷ স্পষ্ট করে কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না৷ কয়েক মুহূর্ত এভাবে উত্তেজনার মধ্যে কেটে গেল৷ সে সভয়ে কাঁপা গলায় বললো, ‘কে, কে ওখানে?’

‘মালতি!’ ওপাশ থেকে ছায়ামূর্তিটা বলে উঠল৷

চেনা গলায় তার নিজের নাম শুনে সে নিশ্চিত হল, যে এ তারই মরদ৷

‘তোমাকে খুঁজতে এসেছিলাম গো! অন্ধকারে কেনে দাঁড়িয়ে? কাছে এসো৷ দেখো মায়ের তাগা এনেছি তোমার জন্য৷ আর কোন বিপদ হবে না তোমার৷ ওই শয়তানগুলো বলে কিনা তোমাকে নাকি বাঘে নিয়ে গেছে৷ গাঁয়ে ফিরি একবার, মুখে নুড়ো ঘষে দেব ওদের!’ কথাগুলো বলতে বলতে তার দু’চোখ জলে ভরে গেল৷

‘যা বিপদ হবার তা তো হয়েই গেছে৷ ওরা ঠিকই বলেছে গো৷ আমার উপর যে দক্ষিণ রায়ের কোপ পড়েছে৷’

কথাটা শুনেই সে রাগে, বিস্ময়ে বললো, ‘কী যাতা বলছো? তাহলে আমার সামনে কে দাঁড়িয়ে আছে এতক্ষণ?’

গাছের অন্ধকার আড়াল থেকে ছায়ামূর্তিটা এবার ধীরে ধীরে এগিয়ে এল মালতির দিকে৷ অন্ধকারের মধ্যে হ্যারিকেনের ম্লান আলোর ক্ষীণ সীমারেখার মধ্যে এসে দাঁড়াল সে৷ মালতি হ্যারিকেনটা আরও একটু তুলে ধরল৷ এরপর সে যা দেখল তাতে তার সর্বাঙ্গে যেন এক বিদ্যুতের ঝিলিক বয়ে গেল! আতঙ্কে, বিস্ময়ে, বিস্ফারিত চোখে কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেল৷ তার সমস্ত বোধ বুদ্ধি যেন লোপ পেল৷ সে বুঝে উঠতে পারল না সামনে যে দাঁড়িয়ে ছিল সে কি সত্যিই দামু, নাকি অন্য কেউ? নাকি অন্য কিছু? শরীরে লেগে থাকা কাপড়ের অবশিষ্টাংশ অবিকল দামুর মত৷ কিন্তু তার মুখের বেশিরভাগ অংশেরই চামড়া গলে গিয়ে সাদা হাড় দেখা যাচ্ছে৷ চোখের মনির জায়গায় কেবল খালি দুটো কোটর৷ শরীরের অধিকাংশ জায়গার মাংস নেই, যেন খুবলে তুলে নেওয়া হয়েছিল৷ চারিদিকের ক্ষত থেকে চুঁইয়ে পড়ছে গাঢ় রক্ত। পাঁজরের হাড়ের ফাঁক থেকে দেখা যাচ্ছে হৃৎপিন্ডটা৷ চারিপাশে মাছি বনবন করছে৷ গা পাক দেওয়া আঁশটে দুর্গন্ধে চারিদিক ভরে উঠেছে৷

মালতির হাত-পা কাঁপতে লাগল৷ ওই শীতের রাত্রেও সে ঘেমে নেয়ে একাকার৷ আতঙ্কের চাপা আর্তনাদ তার বুকের ভিতর থেকে যেন বেরিয়ে আসতে চাইছিল, কিন্তু পারছিল না৷

‘এ কি! কে তুমি?’ অস্ফুট স্বরে কেবল কয়েকটা বিস্ময়সূচক কথা বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে৷

‘কেন চিনতে পারছো না? আমার যে আর ঘরে ফেরা হল না গো। তার আগেই যে বাঘে খেল আমাকে৷ তুমি এসেছো আমাকে নিয়ে যেতে৷ যাবে না আমাকে নিয়ে?’

মালতি আর থাকতে পারল না৷ তার বুঝতে বাকি ছিল না যে সামনে যে দাঁড়িয়ে ছিল সে তার দামু নয়৷ আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে সে ছুটে পালাতে গেল৷ কিন্তু পারল না৷ কোন এক অজানা শক্তি তার পা দু’টোকে শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছিল৷ শরীরের অবশিষ্ট সবটুকু শক্তি দিয়ে প্রচন্ড জোরে চিৎকার করতে চাইল৷ কিন্তু সে চেষ্টাও ব্যর্থ হল৷ একটা শব্দও তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল না৷ ধীরে ধীরে তার সমগ্র শরীর হালকা হয়ে এল৷ সে অনুভব করল, তার মাথা কেমন ঝিমঝিম করছে৷ সামনের সবকিছু কুয়াশার মত কেমন ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ৷ হ্যারিকেনটা হাত থেকে পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগল৷ এটাই কি তাহলে তার জীবনের শেষ পরিণতি? যদি তাই হয় তাহলে সেটা যে এত ভয়াবহ হবে সে ভাবতে পারছিল না৷ একসময় ধপ্ করে সশব্দে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল মালতি৷ অশরীরী তখনও সেখানেই দাঁড়িয়ে৷ ধীরে ধীরে ঘন কুয়শায় তার অবয়ব ঝাপসা হয়ে এল৷ কেবল চেরা পাঁজরের ভিতর থকে হৃৎপিন্ডের ধক্ ধক্! ধক্ ধক্! শব্দটা ভেসে আসছিল৷ ধীরে ধীরে একসময় সেটাও মিলিয়ে এল৷ অদূরে পড়ে থাকা হ্যারিকেনটার আলোটাও মালতির চোখে আবছা ঠেকল৷ একসময় তার চারিদিক অন্ধকারে ছেয়ে গেল৷

যখন জ্ঞান ফিরল তখন সে নিজেকে আবিষ্কার করল তার ঘরের বিছানায়৷ জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছিল৷ তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে মাওয়ালি দল৷

‘কি হয়েছিল আমার? আমি তো…’ কথাটা অসম্পূর্ণ রেখেই বোধশূন্য চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল সর্দারের দিকে৷

মালতির মনের কথা অনুমান করে দলের সর্দার যেটা জানিয়েছিল সেটা ঠিক এমন: ভোরের প্রথম আলো দেখেই দল ছুটে গিয়েছিল বনে৷ অনেক খোঁজাখুঁজির পর বাদার অনেকখানি ভিতরে মালতির সংজ্ঞাহীন দেহ আবিষ্কার করে৷ প্রথমে ভেবেছিল হয়ত মারা গিয়েছে৷ বনবিবিই ওকে রক্ষা করেছিলেন৷ তারপর ওকে গ্রামে নিয়ে আসা হয়৷ মাওয়ালি দল পরে বনকর্মীদের সাহায্য নিয়ে ঝিলা জঙ্গল তন্ন তন্ন করে খুঁজেছিল কিন্তু দামুর কোন হদিস পায় নি৷

‘সে তো আর নেই! সে আর ফিরবে না!’ সদ্য স্বামীহারা মালতি বুকভরা কষ্ট নিয়ে কথাটা বললো৷ বলতেই দু’চোখ তার জলে ফেটে পড়ল৷

কথা শুনে মাওয়ালি দল বিস্ময়ে তার দিকে চেয়ে থাকল৷ পরে সে সেদিন রাত্রের ঘটা সব ঘটনার কথাই জানিয়েছিল সর্দারকে৷

ডাক্তার, বদ্যি দেখিয়ে জ্বর ছেড়ে গেলেও দীর্ঘদিন ভোগার ফলে মালতির শরীর একেবারে ভেঙে পড়ল৷ মানসিক অবসাদে ভুগছিল৷ শোকস্তব্ধ মালতি নাওয়া-খাওয়া প্রায় ছেড়েই দিল৷ দামু ছাড়া যে তার তিনকুলে আর কেউ ছিল না৷ ভাগ্যের পরিহাস, সেটাকেও কেড়ে নিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *